Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    আলোর স্বাক্ষর – আশাপূর্ণা দেবী

    আশাপূর্ণা দেবী এক পাতা গল্প140 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ২. চন্দ্রনাথের ক্ষমতা

    চন্দ্রনাথের ক্ষমতা নেই খুব বেশী উত্তেজিত হবার।

    পঁচিশ বছর বয়সে বিপত্নীক, তারপর কেটে গেল আরো আঠাশটা বছর। নিজের সংসারে প্রভূত উপার্জন করেও কেমন একটা দাবিহীন মনোভাব নিয়েই কেটে গেল জীবন। কেবল যে দিদি নীহারকণার প্রতিই তিনি কৃতজ্ঞ তা নয়, দাসদাসীর প্রতিও যেন নিতান্ত কৃতজ্ঞ চন্দ্রনাথ। তার এতটুকু কাজ কেউ করে দিলে কৃতার্থম্মন্যের মত থাক থাক–এত কেন করে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন।

    আর ছেলে? শৈশবকাল থেকে নিজের ছেলেকে রাজপুত্রের সম্মান দিয়ে আসছেন চন্দ্রনাথ। ছেলে যদি একবার স্বেচ্ছায় তার কাছে এসে বসতো, চন্দ্রনাথ বর্তে যেতেন। সেই থেকে এই অবধি একই ভাব। ইন্দ্রনাথ যা কিছু করেছে কখনো বাধা দেননি। নীহারকণার ভাষায় যা ভূতের ব্যাগার–সেই সমাজকল্যাণ সঙ্রে ব্যাপারেও অবাধ স্বাধীনতা দিয়ে এসেছিলেন ছেলেকে।

    ছেলের বিয়ে? সে সম্বন্ধেও স্পষ্ট কোন চেতনা ছিল না চন্দ্রনাথের। নিশ্চিন্ত আছেন, দিদি যা ভাল বুঝবেন করবেন।

    কিন্তু নীহারকণা? নীহারকণার পক্ষে ইন্দুর বিয়ে-বিয়ে করে যতটা ব্যস্ত হওয়া উচিত তা কি নীহারকণা হয়েছেন কোনদিন? হয়তো হননি। পরমাসুন্দরীর খোঁজে বৃথা গড়িয়ে দিচ্ছেন দিন মাস বছর। কে বলতে পারে এ মনোবৃত্তির পিছনে কী আছে! হয়তো তার চিরবঞ্চিত জীবনে, কেবলমাত্র দৈবানুগ্রহে যে দুর্লভ রত্নটির মালিকানা পেয়েছিলেন, সেটি চট করে হাতছাড়া করে ফেলতে মন সায় দিচ্ছে না!

    কিন্তু একথা নীহারকণা নিজেই বোঝেন না, তা চন্দ্রনাথ।

    চন্দ্রনাথ এত কথা বোঝেন না। চন্দ্রনাথ নিশ্চিন্ত চিত্তে দিনের পর রাত্রি আর রাত্রির পর দিনের চক্রে পাক খেতে খেতে এগিয়ে যাচ্ছিলেন যৌবন থেকে প্রৌঢ়ত্বে-প্রৌঢ়ত্ব থেকে বার্ধক্যের পথে। মনের পরম আশ্রয় দিদি আছেন। পিঠোপিঠি ভাইবোন, এক বছরের বড় দিদি, তবু চন্দ্রনাথের কাছে দিদি অনেক উঁচুতে।

    হঠাৎ আজ নীহারকণা যখন অজস্র কান্নাকাটি, আস্ফালন শেষ করে চলে গেলেন, তখন স্তব্ধ হয়ে ভাবতে লাগলেন চন্দ্রনাথ,…তিনি কি কোনদিন ছেলের প্রতি উচিত কর্তব্য করেছিলেন?… তার সঙ্গে অন্তরঙ্গ হয়েছিলেন?

    তবে কেন ইন্দ্রনাথ কিছুতেই একাজ করতে পারে না বলে জোর করছিলেন! কেন ভাবতে পারছিলেন না সম্ভব হওয়াও অসম্ভব নয়!

    চন্দ্রনাথ কি ইন্দ্রনাথকে চেনেন? চেনবার চেষ্টা করেছেন কোনদিন?

    ইন্দ্রনাথের জীবনের পরিধি কতদূর বিস্তৃত সে খবর কি চন্দ্রনাথ রাখেন? একদা মাতৃহীন শিশুকে দিদির কাছে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে ছিলেন, আজও রয়ে গেছে সে নিশ্চিন্ত। সেই দুরন্ত শিশুটা ক্রমশ মাপে বড় হয়ে উঠেছে, উঠেছে বিদ্বান হয়ে, চোখজুড়ানো রূপ নিয়ে ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে, এই দেখে দেখেই চন্দ্রনাথের বুক ভরে গেছে। সেই ভরা বুক আর ভরা মনের নিশ্চিন্ত নিয়ে একভাবে কাটিয়ে যাচ্ছিলেন, কোনদিন কি খেয়াল করেছেন শুধু মাপে বড় হওয়াই শেষ কথা নয়, তার মাঝখানে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে পুরো পরিণত একটা মানুষ!

    যে যুবক হয়ে উঠেছে, সে যদি যৌবনের ধর্ম পালন করে থাকে, তবে এত ভয়ংকর রকম অবাক হবার কী আছে? প্রকৃতিই তো তার মধ্যে বিকশিত করে তুলেছে প্রেম, কামনা, সৃষ্টির বাসনা! আমার সন্তান একদা শিশু ছিল বলে চিরদিনই সে শিশু থাকবে এইটাই কি বুদ্ধিমানের যুক্তি? প্রকৃতি তার মধ্যে বসে আপন কাজ করে চলবে না?

    এখন এত কথা ভাবছেন চন্দ্রনাথ, কিন্তু তখন ভাবতে পারেননিযখন নীহারকণা এসে আছড়ে পড়েছিলেন। বলেছিলেন, চন্দর, মানুষ চিনি বলে বড় অহঙ্কার ছিল, সে অহঙ্কার চূর্ণ করে দিয়েছে ভগবান! ইন্দু আমাদের মুখে চুনকালি দিয়েছে!

    ইন্দু চুনকালি দিয়েছে? দিশেহারা চন্দ্রনাথ তখন হতভম্ব হয়ে বলে উঠেছিলেন, কী বলছে দিদি, আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না!

    বুঝতে পারবিনে চন্দর, বোঝবার কথা নয়। তবু ভগবান কাটার চাবুক মেরে বুঝিয়ে ছাড়লেন ইন্দু আমাদের লুকিয়ে বিয়ে করেছে, ছেলের বাপ হয়েছে।

    কী পাগলামি করছো দিদি? বলেছিলেন চন্দ্রনাথ, চিৎকার করে নয়, তীব্র প্রতিবাদে নয়। নীহারকণার মাথায় হঠাৎ কিছু ঘটেছে ভেবে হতাশ বিস্ময়ে বলেছিলেন, হঠাৎ কি দুঃস্বপ্ন দেখলে?

    তা নয়, তা নয় চন্দর, এতদিন তুই আমি দুদুটো আস্ত মানুষ চোখ মুদে পড়ে পড়ে অলীক সুখস্বপ্ন দেখছিলাম, জ্ঞান ছিল না চোখ খুললে পৃথিবীটাকে দেখতে হবে–নোংরা কুচ্ছিত নিষ্ঠুর পৃথিবী!

    কিন্তু হয়েছেটা কী?

    .

    কী হয়েছে সব খুলে বলেছিলেন নীহারকণা। মাঝখানে মাঝখানে খানিক কেঁদে, খানিক মাথা খুঁড়ে। তবু বলেছিলেন। বিকেল থেকে যা যা ঘটেছে, আর সেই কালশত্রু দুটোর সঙ্গে যা যা কথা হয়েছে সমস্তই খুলে বলেছিলেন নীহারকণা। আর সেই শুনে চন্দ্রনাথ বলে উঠেছিলেন, অসম্ভব! এ হতেই পারে না, ইন্দুর দ্বারা কখনো এ কাজ হতে পারে না।

    জোর গলায় বলেছিলেন। যতক্ষণ না জোঁকের মুখে নুন পড়েছিল, ততক্ষণই মাথা নেড়ে নেড়ে বলেছিলেন, এ হতে পারে না দিদি, এ হতে পারে না। এ কোন ষড়যন্ত্রের ব্যাপার।

    এখন ভাবছেন চন্দ্রনাথ, কেন বলেছিলাম এ কথা, কেন এত দৃঢ় বিশ্বাস রেখেছিলাম ছেলের উপর? ভাবলেন, আমি কি কোনদিন যাচাই করে দেখেছি তার দ্বারা কী হতে পারে, আর কী হতে পারে না?

    বারবার ভাবলেন চন্দ্রনাথ, তিনি কি কোনদিন কৌতূহলবশেও একবার উঁকি মেরে দেখতে গিয়েছেন, ইন্দ্রনাথের সমিতিটা কী, কী কাজ সেখানে হয়?

    কত সম্ভ্রান্ত ঘরের ছেলেরাও তো কত রকমের গুপ্ত সমিতি করে, দেশের কল্যাণের নাম করে অকল্যাণের আগুন জ্বালিয়ে বেড়ায়, শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত মার্জিতরুচি যুবকের দল দেশকে নিয়ে কতই না ছিনিমিনি খেলে বেড়ায়, ইন্দ্রনাথও যে তেমন কোন দলে গিয়ে পড়েনি কে বলতে পারে? আর হয়তো সেই সূত্রে কখন কোন ফ্যাসাদের মধ্যে মাথা গলাতে গিয়ে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছে। বাড়িতে জানাতে পারেনি ভয়ে আর লজ্জায়।

    বারবারই ভাবতে চেষ্টা করলেন, অসম্ভব নয়, অসম্ভব নয়–তবু বারবারই মন ক্লিষ্ট পীড়িত সঙ্কুচিত হয়ে ওঠে এই নিষ্ঠুর সত্যটা স্মরণ করে তার ছেলে এই হলো!

    না, এত যন্ত্রণা চন্দ্রনাথের ইন্দ্রনাথ কোন দুর্বলতার বশে বিয়ে করে বসেছে বলে নয়, লজ্জায় ভয়ে সে সংবাদ গোপন করেছে বলেও নয়, যন্ত্রণা–ইন্দ্রনাথ তার সেই স্ত্রীপুত্রকে ত্যাগ করেছে, করেছে তাদের অনুমুষ্টি বন্ধ করে দেওয়ার মত নীচতা!

    কী লজ্জা! কী লজ্জা!

    .

    আবার এই লজ্জার গ্লানির মধ্যেও চোখের সামনে ভেসে উঠছে ছেলের সেই সুকুমার কান্তি দেবোপম মূর্তিখানি। তখন আর হিসেব মেলাতে পারছেন না চন্দ্রনাথ। রাগ আসে না, রাগ করতে জানেন না চন্দ্রনাথ, রাগ করতে শেখেননি কখনো, তাই বারবার মেয়েদের মত চোখের জল মুছেছেন বসে বসে। জলবিন্দুটি পর্যন্ত মুখে দেননি।

    তারপর?

    .

    অনেক রাতে স্তব্ধতার বুক চিরে নীহারকণার চিৎকার উঠল।

    উদভ্রান্তের মত ছুটে নেমে এলেন।

    আর যখন নীহারকণা পাগলের মত কেঁদে উঠলেন, ওরে চন্দর, ছুটে বেরিয়ে দেখ লক্ষ্মীছাড়া ছেলে কোনদিকে গেল! ও চন্দর, কেন মরতে আমি তাকে বলতে গেলাম,–তোর বাপ মনের ঘেন্নায় তোকে তেজ্যপুত্তুর করেছে–সেই অভিমানে তক্ক করলো না, প্রতিবাদ করলো না, জন্মেরশোধ চললাম বলে চলে গেল। যা চন্দর ছুটে যা, ঝোঁকের মাথায় যদি কী না কী সর্বনাশ করে বসে কী করব, আমি কী করব? তখন সমস্ত কলরোল, সমস্ত বিপদাশঙ্কা ছাপিয়ে অভূতপূর্ব একটা শান্তিতে বুকটা ভরে ওঠে চন্দ্রনাথের। মনের গভীরে অন্তরালে কে যেন প্রার্থনা করতে থাকে–তাই হোক, তাও ভাল। ভয়ানক একটা কিছুই করে বসুক ইন্দ্রনাথ।

    মুখ থাকুক চন্দ্রনাথের নীহারকণার কাছে। মুখ থাকুক ইন্দ্রনাথের জগতের কাছে, থাকুক সভ্যতা আর সম্ভ্রমের কাছে। পরাজিত হোন্ নীহারকণা।

    এ এক আশ্চর্য হৃদয়-রহস্য! চিরদিন যে মানুষটাকে ভয় ভক্তি আর সম্মানের উচ্চাসনে বসিয়ে রেখে এসেছেন চন্দ্রনাথ, আজ একান্ত কামনা করছেন তার পরাজয় ঘটুক! যদি সে কামনা পূরণের জন্যে চরম মূল্য দিতে হয়, তাও হোক। চন্দ্রনাথ বিশ্বাস করেননি পুত্রের গ্লানি, নীহারকণা করেছিলেন।

    এখন? বেশ হয়েছে। বেশ হয়েছে! আঃ ইন্দ্র! নিরীহ গোবেচারা চন্দ্রনাথের হঠাৎ এ যেন এক অদ্ভুত নিষ্ঠুর মনোবৈকল্য।

    আর একবার আছড়ে পড়লেন নীহারকণা, তবু সঙের মতন দাঁড়িয়ে রইলি চন্দর? আমিই কি তবে এই রাতদুপুরে রাস্তায় বেরোবো?

    চন্দ্রনাথ চেতনা ফিরে পেলেন। রাস্তায় বেরোলেন।

    .

    ননীমাধব এসে দাঁড়ালো হাসতে হাসতে।

    কী মাসি কী খবর? হলে কিছু? কেষ্টমোহিনী মুখের হাসি গোপন করে, মুখে কিছুটা উদাস ভাব এনে বলে, এখন তো নগদ বিদেয়। তারপর দেখা যাক। কে জানতো ও রকম দজ্জাল একটা পিসি আছে ঘরে!

    হৃদয়-উচ্ছ্বাস ব্যক্ত করতে রাজী নয় কেষ্টমোহিনী। বেশি ব্যক্ত করলেই তো ননীকে বেশি বেশি ভাগ দিতে হবে। তবে ভেতরে ভেতরে আহ্লাদ উথলে উঠছিল। এখন তো নগদ বিদায় একশো টাকা! আর ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি? বৌ নাতিকে ঘরে তুলতে পারুন না পারুন, মাসে মাসে একশো টাকা করে মাসোহারা দেবেন নীহারকণা। এ প্রতিশ্রুতি পেয়েছে কেষ্টমোহিনী।

    ঘরে তুলতে দিচ্ছে কে!

    খুব হেসেছিল তখন কেষ্টমোহিনী, তুই মাগী বৌ নাতি ঘরে তুললে কেষ্টমোহিনী মা লক্ষ্মীকে ঘরে তুলবে কোন পথ দিয়ে? ওই ফরসা টুকটুকে ছেলেটাই হল কেষ্টমোহিনীর লক্ষ্মীর সরা। ভাগ্যিস যাই নয়না ছুঁড়ি ছেলেটাকে ভাড়া খাটায়! এই এতটুকুন থেকে কত জায়গায় গিয়ে কত রোজগার করল ছোঁড়া!

    পেয়ারাবাগানের সেই দাসেদের বাড়ি?

    ওঃ, তাদের কাগিন্নীতে তো লাঠালাঠিই বেধে গেল। তবু তো বুড়ো কত্তা অবিশ্যি ভীষ্মদেব তিনি নন,–মদো মাতাল, আরও অনেক গুণের গুণনিধি। কেষ্টমোহিনী নিজেই তার গুণের সাক্ষী। সেই ভরসাতেই বুকের পাটা শক্ত করে কমলিকে নিয়ে আর নয়নার ওই ছেলেটাকে নিয়ে গিয়ে দাসগিন্নীর কাছে কেঁদে পড়ে পাঁচশোখানি টাকা আদায় করে এসেছে কেষ্টমোহিনী।

    অবিশ্যি শুধু কান্নায় হয়নি, ভয় দেখাতে হয়েছে। লোক-জানাজানি করে দেবার ভয়। দাসগিন্নী সহজেই বিশ্বাস করেছিল, কর্তার রীতি-চরিত্তির তো বরাবরই জানতো। চুপি চুপি বলেছিল কেষ্টমোহিনীর কাছে, ওই বুড়ো বদমাশের হাতে দড়ি পড়লেই আমি বাঁচতাম বাছা, উচিত শাস্তি হতো। তোমার মামলার খরচা আমিই জোগাতাম।নাতনীর বয়সী একটা পুঁটকে ছুঁড়ির সঙ্গে কেলেঙ্কারি করার মজাটা টের পেত! কিন্তু কী করবো বাছা, এই সম্প্রতি ছেলের বিয়ে হয়েছে মস্তবড় বনেদী ঘরে। বৌ এখেনে রয়েছে, সে টের পেলে আমাকেই গলায় দড়ি দিতে হবে। সেই ভয়েই তোমাকে এই ঘুষ দিচ্ছি। কিন্তু মা কালীর দিব্যি, যেন আর কেউ জানতে না পারে!

    কেষ্টমোহিনীর অবিশ্যি তাতেও জের মরেনি। বলেছে, কিন্তু মা, আমি গরিব মানুষ, দু-দুটো মানুষ পুষি কোথা থেকে? নিতান্ত নিরুপায় বলেই না ওই পঞ্চাশ-ষাট বছরের বুড়োর সঙ্গে বোনঝির বে দিই! কে জানে মা, তোমার মতন এমন জগদ্ধাত্রী ঘরে? আমায় বলেছিলেন দশ বারো বছর হলো পরিবার গত হয়েছে, বেটার বৌরা সেবাযত্ন করে না

    কথা শেষ করতে হয়নি কেষ্টমোহিনীকে। ধেই ধেই করে নেচে উঠেছিল দাসগিন্নী।… কী বললে?…পরিবার গত হয়েছে? আসুক সে আজ! বুঝিয়ে দেব কেমন গত হয়েছে! তারপর আবার দেব কিছু বলে প্রতিশ্রুতি।

    আর সেই হোমিওপাথি ডাক্তারটা! কেলে জোঁক! তার জন্যে অবশ্য আর একটা ছেলে ভাড়া করতে হয়েছিল। এমন চাঁদের টুকরোর মত ছেলে সেই কেলে চামচিকের, তা বিশ্বাস করানো যেত না।

    তা সেবারে অসুবিধেতেও কম পড়তে হয়নি! লোকটার সঙ্গে একেবারে মুখোমুখি!

    তা কেষ্টমোহিনী কি আর হার মানবে? বলে কত বছর মিনার্ভা থিয়েটারে প্লে করে এল। দজ্জাল ঝি-চাকরানীর পার্ট করতে হলেই কেষ্টাকে ডাক পড়তো। মুখের চোটে পাড়ার লোক জড়ো করে ডাক্তারকে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছিল কেষ্টমোহিনী। মজা এই, ডাক্তারের কথাই অবিশ্বাস করলো সবাই। অবিশ্বাস করার হেতুও ছিল। চিকিৎসা করতে এই পাড়াতেই চব্বিশ ঘণ্টা গতিবিধি ডাক্তারের।

    তাছাড়া কমলিও তো কম অভিনয় শেখেনি! কেষ্টমোহিনীকেই তাক লাগিয়ে দেয় মাঝে মাঝে। তার মাঝে মাঝে মাথা হেঁট করে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা, মাঝে মাঝে মাসিকে থামানোর জন্যে ব্যাকুলতা, আর মাঝে মাঝে কোলের ছেলেটাকে জাপটে ধরে কান্না–দেখলে সাধ্য কি কেউ তাকে অবিশ্বাস করে!

    কখনো বলতে হয় বিয়ে করে পালিয়েছে, কখনো বলতে হয় নষ্ট করেছে। সহায় ওই ননীমাধব। কত কায়দাই করে।

    আর কত রকম সাজতে হল কেষ্টমোহিনীকেই! কখনো মা, কখনো মাসি, কখনো দিদিমা! কী করবে? বেয়াড়া মেয়েটা যে রোজগারের সোজা পথটায় কিছুতেই পা দেবে না। মিথ্যে অপবাদের ডালি মাথায় বইবে, মিথ্যে কলঙ্কের কালি মুখে মাখবে, তবু

    .

    ননী বললো, বলি মাসি, কিছু ছাড়ো-টাছড়া! একেবারে গুম হয়ে গেলে যে! পাওনি কিছু?

    পাইনি বলতে পারলেই কেষ্টমোহিনী বাঁচত। কিন্তু কমলি লক্ষ্মীছাড়ীর কাছে কি পার পাওয়া যাবে তাহলে? বাছার যে ননীদার ওপর সাতখানা প্রাণ! ওর কাছে একেবারে সত্যবাদী যুধিষ্ঠিরের ধর্মকন্যে হয়ে বসবেন!

    তাই বাধ্য হয়ে বলতে হয় কেষ্টমোহিনীকে, না পেয়ে কি আর ছেড়ে এসেছি?

    কত? কত? আশায় আনন্দে দুচোখ জুলজুল করে ওঠে ননীর।

    দিয়েছে শখানেক।

    শখানেক! ননী গম্ভীরভাবে বলে, মন্দ কি! তাছাড়া এক মাঘে তো শীত পালায় না! দাসত্তা যে গিন্নীর ভয়ে এখনো মাসোহারা দিচ্ছে! বুড়ো ঘুঘু দুর্নামের ভয়ে পুলিস ডাকতে পারে না। জানে তো, ডাকতে গেলে তাকেই পাবলিক মেরে লা করে দেবে একেবারে। হি হি করে হাসতে থাকে ননীমাধব।

    টাকা এখুনি নিয়ে কী করবি তুই?

    শোন কথা! টাকা নিয়ে কী করবি? নতুন একখানা ভাষা শোনালে বটে মাসি!…ফটোর খরচা নেই আমার? ফিলিমের আজকাল কত দাম জানো? পাওয়াই যায় না। কত কায়দা-কৌশল করে কাটামুণ্ডু ধড়ে জুড়তে হয়, তবে না? তোমার ব্যবসার মূলধন তো ওই ফটো! ওই থেকে কত টাকা তুলছ! অথচ ননীকে পাঁচটা টাকা দিতে হলেই তোমার হাত কাঁপে।

    কেষ্টমোহিনী মুখঝামটা দিয়ে বলে ওঠে, আমার জন্যেই শুধু করছিস কিনা! কিসের আশায় খেটে মরছিস, সে আর জানতে বাকি নেই আমার। বলি, আমার মজুরিটা বুঝি কিছুই না?… কত ঝুঁকি নিয়ে একাজ করতে হয় জানিস কিছু? সেবার সেই ভোটের বাবুটার বাড়িতে?-মার খেতে বাকি ছিল শুধু। আমাদের আটকে রেখে পুলিস ডাকতে যায় আর কি! নেহাৎ কমলির বুদ্ধির জোরেই প্রাণ নিয়ে ফিরে এসেছিলাম সেদিন। ও যখন কায়দা করে ঘাড় তুলে বললে,-পুলিস ডেকে জেলে দেবেন এ আর বিচিত্র কথা কি! আইন-আদালত সবই তো বড়লোকের জন্যে! গরিব চিরদিনই চোর, মিথ্যেবাদী, অপরাধী!–তখন কত্তার জোয়ান ছেলেটা কেমন ঘাবড়ে গিয়ে বাপের দিকে কটমটিয়ে তাকালো। তারপর দারোয়ানকে বললো গেট খুলে দে।…পথে এসে এক ঘণ্টা ধরে হাত-পা কেঁপে বুক ধড়ফড়িয়ে মরি।

    ননী হো হো করে হেসে ওঠে, হাসালে মাসি, তোমারও হাত-পা কাঁপে, বুক ধড়ফড় করে?

    না, আমার বুক পাথর দিয়ে তৈরি! বলে কেষ্টমোহিনী অপ্রসন্ন মুখে ঘরে ঢুকে যায় টাকা আনতে।

    ননী সব বিষয়ে সাহায্য করে সত্যি, কিন্তু এই এক মস্ত দোষ ননীর, ফি হাত ভাগ চায়। আরে বাবা, তোকেই যদি অর্ধেক দিয়ে দেবো তো দুদুটো মানুষের চলে কিসে? তাই কি থিয়েটারে ঢোকাতেই রাজী করানো গেল লক্ষ্মীছাড়া নির্বুদ্ধি মেয়েটাকে? কিছু করবেন না উনি! ভদ্দর থাকবেন।

    তবু ননী যাই এই এক বুদ্ধি আবিষ্কার করেছে, অপমানের ভয় দেখিয়ে মোচড় দিয়ে আদায়, তাই যাহোক করে চলছে। কিন্তু ওই দোষ ননীর, খালি টাকা টাকা!

    .

    মোটে পনেরো? ননী বেজার মুখে বলে।

    কেষ্টমোহিনী আরও বেজার মুখে বলে, তবে সব টাকাই নিয়ে যা! আমরা হরিমটর করি!

    অপ্রতিভ হয় ননী। টাকাটা পকেটে পুরে উদাসভাবে বলে, হতচ্ছাড়া ননীরও যে হরিমটরের অবস্থা মাসি! নইলে কি তোমাদের উপায়ে ভাগ বসাতে আসি! এক এক সময় মনে হয়, দূর ছাই, এসব ছেড়েছুঁড়ে ভেগে পড়ি!

    সে আমারও করে। বলে উঠে যায় কেষ্টমোহিনী।

    ননী কিন্তু টাকা নিয়েই চলে যায় না। এদিক-ওদিক তাকিয়ে টুক করে উঠোন পার হয়ে ওদিকের ছোট্ট ঘরটায় ঢুকে পড়ে। সে ঘরে একখানা সরু চৌকির ওপর উপুড় হয়ে পড়ে কী একখানা ছবি দেখছিল কমলি ওরফে অরুণা, ওরফে আরও অনেক কিছু। ননীর পায়ের শব্দে ঘাড় ফিরিয়েই চমকে উঠে তাড়াতাড়ি সেখানা উল্টে রেখে উঠে বসল।

    ননী চৌকির একপাশে বসে পড়ে সন্দেহের সুরে বলে, ছবিখানা তাড়াতাড়ি চাপলি যে?

    ছবি! কোন ছবি? ওঃ–এইটা, ফটোটা? কমলা যেন হঠাৎ ভারি অপ্রস্তুত হয়ে যায়। তারপরই কী ভেবে হেসে উঠে বলে, চাপলাম পাছে তোমার অহঙ্কার বেড়ে যায়।

    আমার অহঙ্কার!

    হ্যাঁ গো মশাই। বিভোর হয়ে পড়ে পড়ে দেখছিলাম তোমার ফটোর কায়দা। সত্যি, অবাক হয়ে যাই ননীদা, কী করে কর? কোথায় আমি আর কোথায় এই লোকটা! অথচ এমন বেমালুম মিলিয়ে দিয়েছ, যেন সত্যি ওর সঙ্গে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছি। এতে আবার আমাকে ফুলের মালা ফুলের মুকুট পরিয়ে সং সাজিয়েছ বলেই আরও হাসি পাচ্ছে।

    সং! ননী হেসে উঠে বলে, কই, দেখি আর একবার সংটা কী রকম!

    ছোট সাইজের বাঁধানো ফটোখানা এগিয়ে ধরে কমলা। দিয়ে যেন নিতান্ত নিস্পৃহভাবে তাকিয়ে থাকে ননীর দিকে।

    .

    ননী নিষ্পলক নেত্রে কিছুক্ষণ ছবিটার দিকে তাকিয়ে থেকে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে, কতবারই এরকম কায়দা কৌশল করলাম, কিন্তু এই ছবিখানা করে ইস্তক বুকটা যেন ফাঁকা ফাঁকা হয়ে গেছে।

    ওমা সে কি! কমলা একটু বেশি মাত্রাতেই হেসে ওঠে, ফাঁকা ফাঁকা কি গো? বরং বল যে বুকটা ভরাট হয়ে উঠেছে! এইটাই তো সব থেকে ভাল হয়েছে। দিন দিন তুমি বেশি বাহাদুর হয়ে উঠেছ ননীদা!

    দূর, ভাল লাগে না। ননী ছবিটা ঠেলে রেখে বলে, ওই লোকটার পাশে তোর ওই কনে সাজা ছবিটা দেখলেই প্রাণটা মোচড় দিয়ে ওঠে।

    কমলা আরও প্রগর্ভ হাসি হাসতে থাকে। অনেকক্ষণ হেসে বলে, এক নম্বর বুকটা ফাঁকা ফাঁকা, দুনম্বর প্রাণটায় মোচড়। লক্ষণ তো ভাল নয় ননীদা। কী হল তোমার?

    ননী নিঃশ্বাস ফেলে বলে, নাঃ, হবে আর কী! ছবিটা দেখছি আর মনে হচ্ছে ওর পাশেই ঠিক মানিয়েছে তোকে।

    কমলা ফের হি হি করে হাসে। হেসে হেসে মাথা দুলিয়ে বলে, ঠিক যেমন মানায় রাজপুত্রের পাশে ঘুঁটেওয়ালীকে।…সে যা দেখে এলাম ননীদা, মনে হল স্রেফ রাজপুত্ৰই। তুমি তো দোর থেকে ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে এলে। আমার এদিকে বাড়ি ঢুকতে পা কাঁপছে। এর আগে এতবড় বাড়িতে কখনো যাইনি বাপু। ভারি ভয় করছিল।

    ননী উদাসভাবে বলে, ভয় আমারই কি না করছিল! অথই জলের মুখে, জ্বলন্ত আগুনের মুখে ঠেলে দিই তোকে শুধু দুটো টাকার জন্যেই তো? এই যদি আজ আমার অবস্থা ভাল হত—

    চুপ করে যায় ননী। বোধ করি গলাটা ধরে যায় বলেই।

    কমলা এবার ম্লান হয়ে যায়। ম্লান মুখেই বলে, সত্যি ননীদা, তাই ভাবি কেন এমন হয়! এই ওদের বাড়ি গিয়েই মনে হচ্ছিল, ওদের যত টাকা তার একশ ভাগের একভাগও যদি তোমার থাকত ননীদা!

    একশ ভাগের? ননী ঝাজের সঙ্গে বলে ওঠে, তোর তাহলে কোন ধারণাই নেই। লক্ষ লক্ষ ভাগের এক ভাগ বল বরং। আমাদের কি কোন ভাগই আছে ছাই! এই পৃথিবীতে কোন কিছু ভাগ নেই আমাদের, এই হচ্ছে ভগবানের বিচার, বুঝলি কমলি?

    কমলাও একই রকম ঝাজালো সুরে বলে, যা বলেছ ননীদা। অথচ এই ভগবানের কাছেই নাকি মানুষের পাপপুণ্যির বিচার! চুরি করলে পাপ, লোক ঠকালে পাপ, মিছে কথা বললে পাপ, নিজেকে নিজে খারাপ করলেও পাপ–কিন্তু ভগবানের পাপের বিচার করবার জন্যে কোথাও . কেউ থাকলে যে কী দুর্দশা হত লোকটার, তাই ভাবি!

    ননী গম্ভীরভাবে বলে, ভগবানের পাপের? গরম তেলে ফেলে ভাজলেও ভগবানের উচিত শাস্তি হয় না, বুঝলি? ভেবে দেখ দিকি, মানুষগুলোকে গড়ল, তাদের মধ্যে লোভ হিংসে রাগ অভিমান ঠেসে ঠেসে ভরে দিল, অথচ উপদেশ দিল কী–তোরা দেবতা হ। …পাগল না মাতাল? তারপর দেখ, মানুষ গড়েছিস গড়, তাদের পেট গড়বার কী দরকার ছিল তোর? এমন পেট গড়েছে, সে পেটে দিনরাত রাবণের চিতা জ্বলছে! একবেলা তাকে ভুলে থাকবার জো নেই! ছি ছি!

    ননী প্রায়ই এ ধরনের কথা বলে। আর এসময় ভারি উত্তেজিত দেখায়।

    এরকম সময় কমলার ভারি মায়া লাগে ওকে দেখতে। তাই প্রায়ই অন্য প্রসঙ্গ তুলে ঠাণ্ডা করে। আজও হঠাৎ মুচকি হেসে বলে, তাই কি শুধু পেটেরই জ্বালা ননীদা? পেটের ওপরতলায় যার বাস,–সেই মনের? সেখানেই কি জ্বালা কম! সেখানেও তো খিদে তেষ্টা! সেখানেও তো দিনরাত রাবণের চিতা!

    ননী অপলক নেত্রে একবার কমলার হাসি-ছিটকানো মুখটা দেখে, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে সবেগে বলে, তোকে যে আবার ভগবান কী দিয়ে গড়েছে তাই ভাবি। এততেও হাসি আয়ে তোর?

    আসবে না মানে? বল কি ননীদা? হাসির সালসাতেই তো জীবয়ে আছি এখনো। যেদিন হাসি থাকবে না, সেদিন কমলিও থাকবে না।…ও কি, চলে যাচ্ছ যে?

    চলে যাব না তো কি থাকতে দিবি? তার বেলায় তো খিঁচিয়ে ওঠে ননীমাধব।

    কমলা চোখ তুলে তাকিয়ে থাকে চুপচাপ।

    অপ্রতিভ ননী মাথা হেঁট করে আবেগরুদ্ধ স্বরে বলে, আর পারছি না, বুঝলি কমলি! এক এক সময় মাথাটা খারাপ হয়ে যায়। নিত্যি নিত্যি মিথ্যে সিঁদুর পরেই মরছিস, সত্যি সিঁদুর আর দিতে পারলাম না তোকে।

    দিন একদিন আসবেই ননীদা। ভগবানের রাজ্যে—

    ফের ভগবান! ধমকে ওঠে ননী।

    কমলা হেসে ফেলে বলে, মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায় ননীদা। চিরকালের অব্যেস তো! তবুও বলি, ভগবান যে একেবারে নেই তাই বা বলা যায় কী করে? এই ধর না কেন, তুমি যদি এই ফন্দিটি আবিষ্কার না করতে, আজ আমাদের কী দুর্দশা হত বলো তো? মাসি কি তাহলে আমাকে ভাল থাকতে দিত? মেরে হাত-পা বেঁধেও হঠাৎ কেঁদে ফেলে কমলি।

    ননী বিমূঢ়ভাবে একটু তাকিয়ে বলে, কান্নাটান্না রাখ কমলি। কান্না আমি বরদাস্ত করতে পারিনে। শোন, উঠে পড়ে লেগে কাজের চেষ্টা আমি করছি। তোদের ভগবান যদি নেহাৎ শয়তান না হয়, একটাও কি লেগে যাবে না? তারপর-ননীর চোখদুটো আবেগে কোমল হয়ে আসে। খাটো ধুতি আর হাফশার্ট-পরা নিতান্ত গ্রাম্য-চেহারার ননীর শ্যামলা মুখেও যেন একটা দিব্য আলো ফুটে ওঠে।

    কমলা ব্যাকুলভাবে ওর একটা হাত চেপে ধরে বলে, তাই কর ননীদা, তাই কর। এভাবে লোক ঠকিয়ে বেড়াতে আর ভাল লাগে না।

    ননী এদিক-ওদিক তাকিয়ে ওর হাতটা তুলে একবার নিজের গালে বুলিয়ে নিয়ে ছেড়ে দিয়ে সস্নেহ কৌতুকে বলে, কেন, তুই তো বলিস তোর খুব মজা লাগে!

    সে প্রথম প্রথম লাগত। মনে হত লোকগুলো কী ভীতু! এখন ঘেন্না ধরে গেছে। মিছিমিছি মাথায় খানিক সিঁদুর লেপে যাকে তাকে গিয়ে ধরা তুমি আমায় নষ্ট করেছ, তুমি আমায় বিয়ে করে রেখে পালিয়ে গিয়েছ, একি কম ঘেন্নার কথা?

    ননী আর একবার অপলক চোখে কমলার পরম সুশ্রী মুখখানার দিকে তাকিয়ে বলে, দেখ কমলি, তুই ওই কেষ্টমোহিনীর সত্যিকার বোনঝি নয় বলেই এসব তোর কাছে ঘেন্নার বস্তু। তোর দেহে যে ভদ্রলোকের রক্ত। যেটুকু পারছিস সে শুধু অন্নঋণে। কিন্তু মাসির হুকুম শুনতে হলে আরও কত লজ্জার হত বল!

    শুনতাম আমি! ঝটকা মেরে উঠে দাঁড়ায় কমলি। দাঁড়িয়ে বলে, পৃথিবীতে মরবার কোন উপায় নেই?

    এই–এই জন্যেই তোকে আমার এত ভক্তি হয় কমলি। এখন শুনলে হাসবি হয়তো, কিন্তু আমিও একসময় বামুনের ঘরের ছেলে ছিলাম রে। নবছরে পৈতে হয়েছিল আমার, কানে এখনো বিধ আছে। পেটের জ্বালায় এখন আর জাত নেই।

    না থাকে নেই! আপদ গেছে! হেসে ওঠে কমলি।

    এবার ননীও প্রসন্ন হাসি হাসে। এমনি মেঘরৌদ্রের খেলাতেই বেঁচে আছে ওরা। ছবিখানা উপুড় করে রাখ কমলি, ওটাকে দেখছি আর গায়ে বিষ ছড়াচ্ছে আমার!

    আহা মরে যাই, নিজেরই তো কীর্তি! কিন্তু কই ননীদা, তুমি একদিন তোমার সেই ডার্করুম না কোথায় যেন নিয়ে গেলে না তো আমায়? বলেছিলে যে, সেখানে নিয়ে গিয়ে বুঝিয়ে দেবে, কী করে দুজায়গায় ভোলা আলাদা ছবি এক করে বেমালুম পাশাপাশি ফটো করে দিতে পারো!

    ডার্করুম তো আমারই ঘর রে কমলি। দরজা-জানলায় তেরপলের পর্দা লাগিয়ে অন্ধকার করে নিই। তোকে সেখানে? একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে ননী, ইচ্ছে তো খুব করে, কিন্তু ভরসা হয় না।

    ভরসা হয় না! কেন গো ননীদা? লোকনিন্দের ভয় বুঝি? কেউ কিছু বলকে?

    দূর, লোকের ভারি তোয়াক্কা রাখি আমি! ভয় যে আমার নিজেকেই।

    ধেৎ!

    ধেৎ মানে?…আমি একটা রক্তমাংসের মানুষ নই? পুরুষমানুষ?

    তবু তুমি যে খুব ভাল মানুষ ননদা, মহৎ মানুষ।

    ভারি যে লম্বা লম্বা কথা শিখেছিস! মহৎ বৃহৎ–বাসরে বাস!

    ননী হেসে ঘরের আবহাওয়া হালকা করে ফেলে,-দেখবি চল, মাসি এখন কী কী বিশেষণ দিচ্ছে আমাকে-মুখপোড়া, লক্ষ্মীছাড়া, হতভাগা, উনুনমুখো!

    সম্মিলিত হাসির রোলে ঘর মুখর হয়ে ওঠে।

    .

    আর ওদিকে কেষ্টমোহিনী রাগে ফুলতে থাকে।

    ননী তাদের অনেক উপকার করে সত্যি, তাদের লোক-ঠকানো ব্যবসার সহায়তাও করে ঢের। কিন্তু তাতে কি? তাতে কেষ্টমোহিনীর লাভটা কোথায়? ওই ননী মুখপোড়া আসরে এসে না দাঁড়ালে হয়তো বা এতদিনে কমলিকে টলানো যেত। তাহলে তো পায়ের ওপর পা রেখে…এমন উঞ্ছবৃত্তি করে বেড়াতে হত?…কিছু না হোক, থিয়েটারটা? কোম্পানির লোক এসে কত সাধ্যসাধনা করেছে, এখনো দেখা হলে অনুযোগ করে। মেয়ে একেবারে কাঠকবুল! কবে ননী লক্ষ্মীছাড়ার চাকরি হবে–তবে ওঁকে বিয়ে করে রানী করে দেবে, সেই পিত্যেসে বসে আছেন! আরে বাবা, এই যা করে বেড়াচ্ছিস, এও তো থিয়েটার! পাবলিক স্টেজে করলেই যত দোষ!..কত আশা করে তিন-তিনশ টাকা দিয়ে মেয়ে-ধরাদের কাছে কিনেছিলাম হারামজাদীকে! …অমন মুখ, অমন গড়ন, অমন গাওয়া ঘিয়ের মতন রং–সব বরবাদ! ছি ছি!

    .

    বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে খুব খানিকটা এলোমেলো ঘুরে একটা বাড়ির বোয়াকে বসে পড়ল ইন্দ্রনাথ। হলেও শহর কলকাতা, তবু রাত সাড়ে বারোটায় অকারণ অজানা রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো সমীচীন নয়। পুলিসের চোখে যদিও বা না পড়ে, চোরের চোখে পড়ে যেতে পারে। হাতে দামী ঘড়ি, দু আঙুলে দুটো মূল্যবান পাথরের আংটি, পাঞ্জাবিতে সোনার বোতাম, পকেটেও মুঠোখানেক টাকা।

    মনটা চঞ্চল হল। যতক্ষণ রাস্তায় হাঁটছিল ততক্ষণ চিন্তার ধারাবাহিকতা ছিল না, শুধু একটা দুরন্ত বিস্ময়, আর একটা অপরিসীম অপমানের জ্বালায় সমস্ত মনটা জুলছিল। এখন মনে হল চলে আসাটা যেন বড্ড বেশী নাটকীয় হয়ে গেছে।

    ঠিক যেন সিনেমার কোন নায়কের ভূমিকা নিয়েছে ইন্দ্রনাথ। সত্যি, পিসিমা মেয়েমানুষ আর বাবা হচ্ছেন ভালমানুষ। কে কোন্ শয়তানির জাল বিস্তার করতে কী না কী বলে গেছে, বিশ্বাস করে বসেছেন।

    তবু রাগ হয় বৈকি! ইন্দ্রনাথকে একবার জিজ্ঞেস করবারও প্রয়োজন বোধ করবেন না? অবাক হয়ে বলবেন না,এরা কে বল তো ইন্দু? তোকে ফাঁদে ফেলবার তালে বেড়াচ্ছে নাকি?

    সত্যি!…কে তারা?

    কে তারা? কী অদ্ভুত কথা বলতে এসেছিল! কত রকম প্রতারকের কত রকম প্রতারণার ভঙ্গি আছে এই কলকাতা শহরে, এও হয়তো তারই কোন এক নমুনা!

    কিন্তু আশ্চর্য, ফটো পেল কোথায়? জীবনে কবে কোনদিন কোনো মেয়ের সঙ্গে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ফটো তুলেছে ইন্দ্র?

    পিসিমার চোখে কি মন্ত্রপড়া ধুলোপড়া দিয়ে ধাঁধা লাগিয়ে গেল? চিনতে ভুল করলেন পিসিমা? ইন্দ্রর মুখ চিনতে পিসিমা ভুল করবেন?

    কিন্তু কী আপসোস! কী আপসোস, সেই হতচ্ছাড়া সময়টাতে ইন্দ্র বাড়িতেই উপস্থিত ছিল, স্বপ্নেও ধারণা করতে পারেনি সেই মুহূর্তে তার ঘরের কয়েক গজ দূরেই মৃত্যুবাণ রচিত হচ্ছে তার জন্যে।

    পিসিমা যদি পর্দার অন্তরালে বসে না থাকতেন! যদি একবারের জন্যে বেরিয়ে এসে খোঁজ করতেন ইন্দ্র ফিরেছে কিনা। যদি বলতেন ওরে ইন্দু, এসে দেখ তো এদের চিনিস কিনা?

    ইন্দ্র যে তার নিজের সংসারে লাঞ্ছিত হল, অপমানিত হল, বিচ্যুত হয়ে এল–এ সমস্ত অনুভূতি ছাপিয়েও অসহ্য একটা বিস্ময় ক্রমশ গ্রাস করছিল তাকে, কে সেই মেয়ে!

    কে সেই মেয়ে? যে মেয়ে চোখের জলে ভেসে বলে, এই ছবিই তার সম্বল! সোনার হার প্রত্যাখ্যান করে সেই ছবির বদলে! প্রতারকের প্রতারণাই যদি, তবে এমন কেন?

    নগদ একশ টাকা আর মাসোহারার প্রতিশ্রুতিটা নীহারকণা ইন্দ্রর কাছে বলবার অবকাশ পাননি, তাই হিসেব মিলোতে পারে না ইন্দ্র।…জুয়াচোর যদি তো সোনার হার নেয় না কেন?

    আরও কিছুক্ষণ চিন্তার অতল গভীরে ডুবে যায় ইন্দ্র।

    কী কুৎসিত আর কী অদ্ভুত অপবাদ! ইন্দ্রনাথের আকৃতিধারী শিশুসন্তান নাকি তার কাছে। কী লজ্জা, কী লজ্জা!

    বাবা শুনেছেন! লজ্জায় ঘৃণায় একা অন্ধকারে কানটা ঝা ঝাঁ করে ওঠে ইন্দ্রনাথের। তারপর খানিকক্ষণ পর সবলে মনের সমস্ত জঞ্জাল সরিয়ে উঠে দাঁড়ায়।

    .

    এখন রাতের আশ্রয় ঠিক করা দরকার। হঠাৎ মনে পড়েছে আগামীকাল অফিসে একটা জরুরী মিটিং আছে। যথানির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছতেই হবে। এলোমলো হয়ে পড়লে চলবে না।

    রাতের আশ্রয়! কিন্তু শুধুই কি আজকের এই অদ্ভুত রাতটার জন্য আশ্রয়? সারা জীবনের জন্য নয়? আচ্ছা চিরদিনের সেই আশ্ৰয়টা সত্যিই চিরদিনের মত ত্যাগ করে এল সে?

    সে রকম ভয়ংকর একটা অনুভূতি কিছুতেই মনে আনতে পারছে না ইন্দ্র। চেষ্টা করে ভাবতে গিয়েও কেমন ঝাপসা ঝাপসা লাগছে। শুধু সাময়িক একটা অসুবিধে বোধ ছাড়া বিশেষ কোনও বোধ নেই।

    কিন্তু এতে আর আশ্চর্য হবার কী আছে ইন্দ্র? এমনিই তো হয়। ভয়ংকর একটা ক্ষতি, প্রাণের প্রিয়জনকে হারানোর শোক, কিছুই কি ঠিক সেই মুহূর্তে অনুভব হয়? তখন কি চেষ্টা করে করে মনে আনতে হয় না–আমার সর্বস্ব গেল…আমার সর্ব গেল!

    ক্ষতির অনুভূতি আসে দিনে দিনে, তিলে তিলে, পলে পলে।

    তাই ইন্দ্রনাথ যতই মনে করতে চেষ্টা করে করুক, আমার আর নিজস্ব কোন আশ্রয় নেই, আমি গৃহচ্যুত সংসারচ্যুত, আমি নিঃসঙ্গ আমি একা–ঠিক এই মুহূর্তে সেই সত্যটা সম্পূর্ণ গুরুত্ব নিয়ে দেখা দেয় না।

    উঠে পড়ে ভাবে–দেখা যাক, সমাজকল্যাণ সঙ্ঘের কার্যালয়ের চাকরটাকে ঘুম ভাঙ্গিয়ে টেনে তোলা যায় কিনা। আজ রাতটা তো কার্যালয়ের অফিসঘরের সেই সরু চৌকিটায় স্থিতি। তারপর আছে ভাগ্য আর ভবিষ্যৎ।

    .

    নীহারকণার নির্দেশে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছিলেন চন্দ্রনাথ, কিন্তু বেরিয়ে পড়ে এমন মনে হল না যে কোনও পলাতক আসামীকে দৌড়ে গিয়ে ধরে ফেলবার জন্যে বেরিয়েছেন তিনি। বরং উল্টোই মনে হল। মনে হল চন্দ্রনাথ নিজেই বুঝি কোথাও চলে যাচ্ছেন। উধ্বশ্বাসে দৌড়ে পালিয়ে যাওয়া নয়, অন্যমনস্কভাবে কোনও লক্ষ্য স্থির না করে শুধু আস্তে আস্তে এগিয়ে যাওয়া। চাকরবাকরগুলো আসছিল পিছনে, হাত নেড়ে বাড়ি ফিরে যাবার ইশারা করলেন তাদের চন্দ্রনাথ, তারপর এগোতেই লাগলেন।

    চাকরগুলো অন্ধকারেই রয়ে গেল। পিসিমার আচার-আচরণ দেখে মনে হচ্ছে দাদাবাবুর কথাই ঠিক হঠাৎ মাথা গরম-ই হয়েছে আর দাদাবাবু ডাক্তার আর বরফ আনতে গেছে। কিন্তু বাবুর আচরণ দেখে তো ঠিক তা মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে এর ভিতরে কোনও রহস্য বর্তমান। কিন্তু কী সেই রহস্য?

    নিয্যস বিকেলবেলা যে মাগী একটা ছুঁড়ি আর একটা ছোট ছেলেকে নিয়ে এসেছিল, এ সেই তাদেরই কারসাজি। একটা কোন অঘটন ঘটেছে কোথাও কোনখানে।

    .

    চন্দ্রনাথ এগোতে এগোতে ভাবছেন, জীবনের কোন্ ঘটনাটা মানুষের অজ্ঞাত নয়? এই যে চন্দ্রনাথ এখন এই গভীর রাত্রির নির্জনতায় একা চলেছেন, এ কি কিছুক্ষণ আগেও ভাবতে পেরেছিলেন? কোনদিনই কি ভাবতে পারতেন, রাত বারোটায় একা একা পথ চলছেন চন্দ্রনাথ–হেঁটে হেঁটে, গায়ে গেঞ্জি, পায়ে চটি!

    .

    চলতে চলতে সহসা মনে হল এই যে এগিয়ে যাচ্ছেন, এটা যেন চন্দ্রনাথের সারা জীবনেরই একটা প্রতীক। সমস্তটা জীবন তো এমনি করেই পার হয়ে এলেন চন্দ্রনাথ, নিঃসঙ্গ নির্জন। জীবনের লক্ষ্য? তাই বা কই? কবে কি ভেবেছেন তেমন করে? ছেলেটাকে, একমাত্র সন্তানকে একটা মানুষের মত মানুষ করে তুলব, এমন কোন আদর্শ কি কখনো চন্দ্রনাথের মধ্যে কাজ করেছে?

    -না, মনে করতে পারলেন না। ছেলেকে প্রাণভরে ভালই বেসেছেন, তার সম্পর্কে চিন্তা করেননি কোনদিন।

    অর্থোপার্জন? সেটাই কি জীবনের লক্ষ্যবস্তু ছিল চন্দ্রনাথের? তাই বা বলা যায় কই? উপার্জন অবশ্য করেছেন প্রচুর, কিন্তু সেটা পরম একটা লক্ষ্য হিসেবে কি? নিঃসঙ্গ জীবনে কর্মের একটা নেশা ছিল, তাই কর্মক্ষেত্রে চলে এসেছেন নির্ভুল নিয়মে, এবং তার পুরস্কার যথেষ্ট পেয়েছেন এই পর্যন্ত।

    খুব বড়লোক হবো, সমাজের উঁচু চুড়োয় উঠে বসব, এ সব সখসাধ চন্দ্রনাথের কখনো ছিল না। কাজ দিয়ে ভরে রাখা মন ঘরে ফিরে এসে চেয়েছে একটু বিশ্রাম, একটু আরাম, একটু শান্তি। পেয়েছেন সেটুকু, ব্যস আর কি? আর কী চাইবার আছে জীবনে?

    এইটুকু যে পাচ্ছেন তার জন্যই যেন কৃতজ্ঞতা বোধের অন্ত নেই। ভগবানের প্রতি, সংসারের প্রতি, সর্বোপরি নীহারকণার প্রতি এক অপরিসীম কৃতজ্ঞতা নিয়ে জীবনটাকে কাটিয়ে দিলেন। সে জীবনে আর কিছু চাইবার আছে এটাও যেমন কোনদিন অনুভব করেননি, তেমনি খেয়াল করেননি, তাঁর আরও কিছু করবার আছে।

    আজ এই নির্জন রাস্তায় চলতে চলতে মনে হল চন্দ্রনাথের আরও কিছু করবার কিছু।…ছিল ছেলেকে জানবার।

    .

    অনেকক্ষণ রাস্তায় ঘুরে ঘুরে যখন চন্দ্রনাথ বাড়ি ফিরে এলেন, তখন আর একবার মনে হল তার অন্তত এতটুকুও জেনে রাখবার ছিল, ইন্দ্রনাথের সমিতির ঠিকানা কী? স্থির বিশ্বাস সেখানেই গেছে! নইলে?…আত্মহত্যা?

    না, নীহারকণার মতো অতটা দূর পর্যন্ত ভেবে উঠতে পারছেন না চন্দ্রনাথ।

    আজ রাত্রে আর কোন উপায় নেই। কাল, হা কাল বেলা দশটার পর খোঁজ করবার হদিস মিলতে পারে। যেখানেই চলে যাক রাগ করে, হয়তো অফিসে আসবে। মন বলছে খবর সেখানেই পাওয়া যাবে। সত্যিই তো আর জীবনটা মঞ্চের নাটক নয় যে, এইমাত্র যে ছিল সে চললাম বলে চলে গেল–আর জীবনে তার সন্ধান পাওয়া গেল না।

    .

    ননী চলে যাওয়ার পর কমলা অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইল চৌকিটায়। ননীর জন্যে মনটা মমতায় গলে যাচ্ছে। কী বেচারী লোকষ্টা! সামান্য একটা চাকরির জন্যে মাথা কুটে ফেলছে, তবু জুটছে না!

    জুটবেই বা কী করে, বিদ্যে-সাধ্যি না থাকলে কি আর এ যুগে কাজ জোটে? শুনতে পাওয়া যায় আগেকার আমলে নাকি কানাকড়ার বিদ্যে সম্বল করে মস্ত মস্ত অফিসের বড়বাবু হত। একালে পাস না করলে অফিসের পিয়নটি পর্যন্ত হবার জো নেই।

    বেচারী ননীদা শুধু জমা দেবার টাকার অভাবেই নাকি একটা পাস দিতে পারেনি! কমলার সঙ্গে ভাগ্য জড়িত করতে চেয়েছে বলেই বুঝি ননীর এই দুর্ভাগ্য!

    ননী অবশ্য সে কথা মানে না। সে বলে ভাগ্যকে সে এখনি ফিরিয়ে তুলতে পারে, যদি সামান্য কিছুও মূলধন জোটাতে পারে। ব্যবসার ঝোঁক তার, বলে ছোট্ট একটু ব্যবসা থেকেই কত বড় বড় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। বলে কমলাকে একবার ঘরে পুরে ফেলতে পারলেই চঞ্চলা কমলা উথলে উঠবেন তার সংসারে! শুধু সামান্য একটু মূলধন!–কিন্তু কোথায় সেই সামান্যটুকুও?

    .

    কমলা যে ঘেন্না-লজ্জার মাথা খেয়ে লোক ঠকিয়ে অপবাদ অপমান মাথায় বয়ে উপার্জন করে আনে, তার থেকে কি একটা টাকাও হাতে পায়?

    না, কমলাকে কেষ্টমোহিনী পাইপয়সাটিও দেয় না। অথচ সত্যিই কিছু আর সব টাকা কমলার ভাত-কাপড়ে যায় না।

    তা সেদিক থেকে তো দেখে না কেষ্টমোহিনী, দেখে অন্য দিক থেকে। তার মতে কেষ্টমোহিনীর নির্দেশক্রমে চললে যে টাকাটা ঘরে আনতে পারত কমলা, (কেষ্টমোহিনীর মতে সেটা হচ্ছে মোট মোট টাকা) সেই টাকাটা অবিরতই লোকসান যাচ্ছে। অতএব কমলার দ্বারা যে টাকা রোজগার হচ্ছে, সেটা কিছুই নয়। ত আর তার থেকে ভাগ চাইবে কমলা কোন ধৃষ্টতায়?

    .

    উঠতে বসতে কেষ্টমোহিনীর গঞ্জনা, ননীর ওই হতাশ ম্লানমুখ, আর প্রতিনিয়ত মিথ্যা প্রতারণার জাল ফেলে ফেলে টাকা উপায়ের চেষ্টা, এ যেন কমলার জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। কোথায় আলো…কোথায় পথ…?

    যদি তার জীবনে ননী না থাকত, যদি না থাকত ননীর ভালবাসা, তাহলে হয়তো কবেই এই জীবনটাকে শেষ করে দিত কমলা গলায় দড়ি দিয়ে কি বিষ খেয়ে। সে ধরনের মৃত্যু কমলা জ্ঞানাবধিই দেখছে। এই তো এই বছরখানেক আগে লতিকা মলো বিষ খেয়ে। সে কী কাণ্ড!

    পুলিস এল, বাড়িসুষ্ঠু সকলের সাক্ষী নেওয়া হল, লতিকার মাকে ধরে নিয়ে থানায় চলে গেল, কত ঝঞ্জাট। শেষ পর্যন্ত অবশ্য এই প্রমাণ করা হয়েছিল সেই দিনই অর্থাৎ সেই রাত্রেই একটা অজানা অচেনা লোক এসেছিল লতিকার কাছে, সেই নরপিশাচটাই লতিকার গায়ের গহনার লোভে বিষ খাইয়ে সব নিয়ে-থুয়ে সরে পড়েছে। সেই প্রমাণেই লতিকার মা ফিরে এল থানা থেকে, আর চীৎকার করে কাঁদতে বসে, ওরে কে আমার এমন সর্বনাশ করল রে, আমার সোনার পিতিমেকে বিষে নীল করে দিয়ে গেল রে–

    কিন্তু কমলা জানে এ সমস্তই বানানো কথা। কোন নতুন লোকই আসেনি সেদিন। আর কমলা নিজে দেখেছে মরে যাওয়ার পরও লতিকার গায়ে তার সব গহনাই ছিল। প্রথমটা আচমকা চেঁচামেচি শুনে বাসার সব বাসিন্দে হুড়মুড়িয়ে ছুটে গিয়েছিল, কমলাও গিয়েছিল। কিন্তু তারপরই লতিকার মা আর দিদিমা চেঁচাতে লাগল, তোমরা সব ভিড় ছাড়ো গো ভিড় ছাড়ো, দেখি বাছার আমার জ্ঞানচৈতন্য আছে কিনা।

    সকলেই একটু পিছু হটে এসেছিল, তার খানিক পরেই ফের পরিত্রাহি চীৎকার–ওগো কিছু নেই কিছু নেই, বিষে জরে গেছে বাছা আমার!

    অতএব এবার তোমরা ভিড় করতে পারো।

    কমলা দেখে তখন অবাক হয়ে গিয়েছিল, লতিকার গায়ে সোনারত্তি বলতে কিছু নেই। আর লতিকার মা ইনিয়ে-বিনিয়ে কাঁদছে, কোন্ নর-পিচেশ চামার এসেছিল গো, তুচ্ছ একটু সোনার লোভে আমার সোনার পিতিমেকে শেষ করে গেল!…ওরে তুই কেন চাইলিনে?

    অবাক হয়ে গিয়েছিল কমলা এই অদ্ভুত মিথ্যা প্রচারে, অনেক হাঙ্গামার হাত এড়াতেই যে এই ভয়ঙ্কর মুহূর্তেও এমন গল্প বানিয়ে ফেলল লতিকার মা, তা বুঝতে দেরি লেগেছিল কমলার।

    কমলা বুঝেছিল, বিষ লতিকা নিজেই খেয়েছে। কমলার চাইতে বয়সে কিছু বড় হলেও মনের প্রাণের কথা কমলার কাছে বলত লতিকা। বলত, তুই-ই ধন্যি মেয়ে কমলি, ওই জাঁহাবাজ কেষ্টমাসির কাছেও খোট বজায় রেখেছিস। ইচ্ছে হয় যে তোর চন্নামেওর খাই। কী ঘেন্নার জীবন আমার! নিজের মায়ের কাছেও ছাড়ান নেই! মাঝে মাঝে মনে হয় কমলি, বিষ খেয়ে এ ঘেন্নার প্রাণ শেষ করে ফেলি!

    কমলা সান্ত্বনা দিতে পারত না। শুধু মাঝে মাঝে বলত, কে জানে লতিকাদিও তোমার সত্যি মা কিনা! হয়তো তোমাকেও প্রফুল্লমাসি পয়সা দিয়ে কিনেছে! আমার যেমন মাসি, তোমার তেমন মা!

    হয়তো এইটুকুর মধ্যেই রাখতে চাইত অনেকখানি সান্ত্বনা। যে মানুষটা লতিকার মর্মান্তিক অপমানের মূল সে অন্তত লতিকার মা নয়, লতিকা নিজে নয় এই কুৎসিত কুলোব! এই শুধু, এর বেশি আর কী দিতে পারবে কমলা।

    লতিকা কিন্তু বিষণ্ণ হাসি হাসত। মাথা নেড়ে বলত, দূর, মা দিদিমা সব আমার চিরকালের। তাই তো ভাবি কমলি, তোর তবু মনে একটা সান্ত্বনা আছে–তোকে কিনে এনে চুরি করে এই নরকে এনে ফেলেছে, কিন্তু আমার যে ওপর ভেতর আগুনের জ্বালা! এই নরকেই আমার উৎপত্তি যখন ভাবি তখন মনে হয় গলায় ছুরি দিই, বিষ খাই, জলে ঝাপাই কি আগুনে পড়ি!..তাই কি স্বাধীনতা আছে? চব্বিশ ঘণ্টা পাহারা!…মা নামে আমার ঘেন্না কমলি!

    .

    লতিকার এ মৃত্যু যে আত্মহত্যা, এতে আর সন্দেহ ছিল না কমলার। হয়তো কমলাও কবে কোনদিন এমনি করে নিজেকে শেষ করে ফেলত, যদি না ননীদা…ননীদা-ই জব্দ করে রেখেছে কমলাকে।

    কিন্তু আর কতদিন এই কাঁটাবনের মাঝখান দিয়ে হাঁটবে কমলা? কবে পাবে সত্যিকার একটা পথ? যে রকম পথ দিয়ে সত্যিকার মানুষরা হাঁটে।

    .

    এ বাড়িতে আরও কত ঘটনাই ঘটে, যা কমলা বোঝে কোনও সত্যিকার মানুষদের সংসারে ঘটে না, কিছুতেই ঘটতে পারে না। মন গ্লানিতে ভরে আসে, ক্লেদাক্ত হয়ে ওঠে, তবু এই পরিবেশের মাঝখানেই পড়ে থাকতে হয় কমলাকে।

    তাই না নিজেকে কিছুতেই সত্যিকার মানুষ ভাবতে পারে না কমলা। একা বসে থাকলেই

    স্মৃতির অতল তলায় তলিয়ে গিয়ে, ডুবে যাওয়ার মতই রুদ্ধশ্বাস বক্ষে মনে আনতে চেষ্টা করে কমলা সেই তার অজ্ঞাত শৈশবকে!…কী ছিল সে? কে ছিল? কাদের মেয়ে? নির্মল পবিত্র সত্যিকার কোন মানুষদের!

    .

    হয়তো পথেঘাটে এখানে সেখানে কমলার সেই পূর্বজন্মের মা বাপ ভাইবোনেরা কমলারই সামনে দিয়ে হাঁটছে চলছে বেড়াচ্ছে। কমলা চিনতেও পারছে না। তারাও তাকিয়ে দেখছে না তাদের এই একদা হারিয়ে যাওয়া মেয়েটার দিকে। আর তাকিয়ে দেখলেই বা কী! চিনতে পারবে নাকি? গল্প উপন্যাসেই শুধু দেখা যায় সেই গল্পের মানুষরা অনেক…অনেক বছর পরে তাদের হারানো ছেলেমেয়েদের সন্ধান পায়, দেখা হয়। মিলন হয়। সব ফাঁকি, সব বাজে, মানুষের জীবনে ও রকম কিছু হয় না।

    তবু মাঝে মাঝে নিতান্ত সস্নেহে কমলা তার ডান হাঁটুর নিচের ছোট্ট জড়লের দাগটিকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে। এই রকম একটি তিল কি জড়ল চিহ্ন ধরেও নাকি অনেক সময় পরিচয় প্রমাণিত হয়।

    .

    আচ্ছা, কমলা যখন হারিয়ে গিয়েছিল তখন তার সেই জন্মদাত্রী মা কী করেছিল? শুধু দুচারদিন কেঁদেছিল? শুধু দুচারদিন হায় হায় হায় করেছিল?–ব্যস্, তারপর ছোট্ট মেয়েটাকে ভুলে গিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে খেয়েছে ঘুমিয়েছে বেড়িয়েছে, অন্য ছেলেমেয়েদের আদরযত্ন করেছে।

    এই কথাটা ভাবতে গেলেই বুকের মধ্যে হু-হুঁ করে ওঠে কমলার, ছলাৎ করে এক ঝলক জল এসে যায় চোখের কোণায়। একই ঘরে জন্মে তারা কত সুন্দর পবিত্র আর কমলা ছিটকে এসে পড়েছে কী পাঁকের মধ্যে!

    মাঝে মাঝে অন্য ছেলেমেয়ে-হীন একটি ঘরের ছবি কল্পনা করতে চেষ্টা করে কমলা। শূন্য ঘর খাঁ খাঁ করছে, আর আজও একমাত্র সন্তানহারা দুটি প্রাণী কেঁদে কেঁদে মাটি ভিজোচ্ছে!… হয়তো বুকে করে তুলে রেখেছে ছোট্ট একজোড়া লাল জুতো, ছোট্ট দুএকটি ফ্রক পেনি! কিন্তু এ কল্পনায় জোর পায় না কমলা। তেমন হলে কি আর তারা খুঁজে বের করত না তাদের সেই হারানো মানিককে? স্বর্গ মর্ত্য পাতাল তোলপাড় করে?

    না না, কেউ কমলাকে মনে করে নেই, কেউ কমলার কথা ভাবে না আর। সে-ঘর থেকে হারিয়ে গেছে কমলা। ইটকাঠের ঘর থেকে, মনের ঘর থেকে।

    আশ্চর্য! জগতে এত মেয়ে আছে, সবাইয়ের মা-বাপ আছে, ভাইবোন আছে, পরিচয়ের একটা জগৎ আছে–নেই শুধু কমলার!

    .

    হ্যাঁ, হারিয়েও যায় অনেকে। বাংলা খবরের কাগজে এ রকম অনেক যে দেখেছে কমলা নিরুদ্দেশের পাতায়। কিন্তু হারিয়ে গিয়ে কমলার মত এমন খারাপ জায়গায় এসে পড়ে কেউ?

    কেউ না। কেউ না। কমলার মত হতভাগী জগতে আর কেউ নেই।

    বড় ইচ্ছে করে কোনও ভাল গণকারকে হাতটা একবার দেখায়! ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান সব যিনি বলে দিতে পারেন হাতের ওই আঁকিবুকিগুলো থেকে! কমলার হাতের রেখা দেখেই বলে দেবেন কোথায় তার সেই জন্মদাত্রী মা, কোথায় তার আত্মীয়-পরিজন, কি তাদের ঠিকানা! বলে দেবেন কী নাম ছিল কমলার সেই আগের জন্মে, কেমন করে হারিয়ে গেল সে কেন্দ্রচ্যুত হয়ে, আর কেমন করেই বা এখানে এসে পড়ল!

    কিন্তু কোথায় তেমন ত্রিকালজ্ঞ জ্যোতিষী? কে তার সন্ধান এনে দেবে কমলাকে? কে তার কাছে নিয়ে যাবে কমলাকে?

    ননীদা বলে এরকম নাকি আছেন, কিন্তু ননীদা জানে না কোথায় আছেন। কাজেই সে শুধু স্বপ্নই থেকে গেছে। কমলার অতীতও অন্ধকার, ভবিষ্যৎও অন্ধকার।

    আর বর্তমান? সে বুঝি একেবারে আলোকোজ্জ্বল? প্রতিনিয়ত অঙ্কুশের তাড়না, প্রতিনিয়ত যমযন্ত্রণা! মাসি যদি সর্বদা অমন কটু কাটব্যও না করত! যদি শুধু পাখী পোষা বেড়াল পোর মত কমলাকে শুধু পুষেই ক্ষান্ত থাকত!

    .

    কিন্তু তা হবার নয়। অহরহ পোষার খরচা উসুল করে নিতে চায় কেষ্টমোহিনী। অহরহ সেই একমুঠো ভাতের খোঁটা দিয়ে দিয়ে সচেতন করিয়ে দিতে চায় কমলাকে। কমলা বিদ্রোহ করতে চাইলে তীব্র ভাষায় স্মরণ করিয়ে দেয়,খাচ্ছিস পরছিস, ঘরতলায় মাথা দিয়ে আছিস, তার দাম নেই?

    তাই দাম দিতে হয় কমলাকে। এক এক সময় ইচ্ছে হয় কমলার যেখানে দু চোখ যায়, চলে যায়। কিন্তু সাহস হয় না। কোথায় যাবে? কমলার বয়সী একটা মেয়ের পক্ষে পৃথিবী যে কী ভীষণ সে তো আর জানতে বাকি নেই তার। বড় দুঃখেই শিখেছে। দুঃখের বাড়া শিক্ষক নেই।

    তা ছাড়া ননী! আহা ননী যদি একটা ফটোর দোকানেও কাজ পেত।

    কী করে কোন্ ফাঁকে কার সঙ্গে না কার সঙ্গে মিশে ফটো তোলার কাজটা বেশ শিখে ফেলেছিল ননী, ছোট্ট একটা বক্স-ক্যামেরাও আছে তার। আছে ছবি প্রিন্ট করার মালমশলা। আর সকলের ওপর আছে ননীর ওই বিদ্যের সঙ্গে অদ্ভুত এক কৌশল। নইলে–

    কী ভেবে আবার সেই ফ্রেমে বাঁধানো যুগল ছবিটা হাতে তুলে নিল কমলা।

    আশ্চর্য…অদ্ভুত! কী করে করেছে? কে বলবে সত্যি কোন সদ্য বিয়ের বরকনের ছবি নয়? –সেই কনে হচ্ছে এই হতভাগী কমলা, আর বর এক দেবকান্তি রাজপুত্তুর।

    তাকিয়ে থাকতে থাকতে কেমন যেন নেশার মত লাগে কমলার, মাথার মধ্যে ঝিমঝিম করতে থাকে। কিন্তু শুধু কি আজই? রোজই এমন হয়।

    কী যে মোহিনী মায়া আছে ফটোটায়, দেখে দেখে যেন আর আশ মেটে না। দেখে দেখে শরীর অবশ হয়ে আসে, চোখ ফেটে জল আসতে চায়। লুকিয়ে তুলে রাখে, আবার এক সময় বার করে দেখে। ছবিটা নিয়ে এ এক মধুর রহস্যময় খেলা কমলার।

    কী অপরূপ লাবণ্যে ভরা ওই মুখখানা, যে মুখ কমলার ছবির মুখের পাশাপাশি থেকে মানুষ কমলার চোখের দিকে গভীর দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে। গভীর গম্ভীর কোমল দৃষ্টি। এ দৃষ্টি যেন সকরুণ স্নেহে সমবেদনা জানায়, আবার অন্তরের অন্তস্তল পর্যন্ত দেখে ফেলে ধিক্কার দেয়।

    না, এত স্পষ্ট করে এত কথা ভাবতে জানে না কমলা, শুধু তার মনের মধ্যে অস্পষ্ট বাষ্পের মত এমনি একটা আনন্দ আতঙ্ক শ্রদ্ধা সমীহের অপরিচিত অনুভূতি পাক খেতে থাকে।

    এ মানুষটাকে তো প্রত্যক্ষ দেখেছে কমলা, মাঝে মাঝেই দেখেছে, কই এমন বিভোর হয়ে যায়নি তো? কমলা কি এই ছবিটার প্রেমে পড়ে গেল নাকি? না, আগে যখন প্রত্যক্ষ দেখেছে, দেখেছে দূর থেকে। মানুষটা তখন সুদূর আকাশের তারা। জানতউজ্জ্বল ঝকঝকে সেই মানুষটা বস্তিতে বস্তিতে ঘুরে বক্তৃতা দেয়, স্বাস্থ্যশিক্ষা দেয়, ওষুধ দেয়, পথ্যি দেয়, কেউ খেতে না পেলে তার ভাতের ব্যবস্থাও করে দেয়।

    দেখেছে তাদের এই কলোনির মধ্যে ঘুরে ঘুরে নাইট-ইস্কুল বসাতে, রাস্তাঘাট ভাল করবার জন্যে কর্পোরেশনে দরখাস্ত দেবার জন্যে পাঁচজনের সইস্বাক্ষর জোগাড় করতে, দেখেছে অনেক লেখালেখি করে রাস্তায় দুদুটো টিউবওয়েল বসিয়ে দিতে।

    ননীদা যখন এই লোকটার ফটো নিয়ে এসে বলেছিল, এই দেখ কমলি, মার দিয়া কেল্লা! আর একটি নতুন শিকার! কেমন স্পষ্ট পরিষ্কার ছবিখানা নিয়ে নিলাম, টেরও পেল না! মহা উৎসাহে লেকচার দিচ্ছিলেন বাবু, ভিড়ের মধ্যে কখন যে শ্রীযুক্ত ননীবাবু তাঁর দফা গয়ার ব্যবস্থা করে ফেললেন, জানতেও পারল না!.মনটা তখন খারাপ হয়ে গিয়েছিল কমলার। মনে হয়েছিল, আহা, অমন ভাল লোকটার নামে কালি দেওয়া? আর সে কালি লাগাবার ভার পড়বে। এই কমলির ওপরেই?

    কিন্তু মুখ ফুটে প্রতিবাদ করতে কমলার লজ্জা করেছিল। শুধু বলেছিল, জানাজানি হলেই বা কী? যারা লেকচার দিয়ে বেড়ায় তাদের ফটো তত খবরের কাগজওলারাও নেয়!

    তা নেয় বটে। সেই সাহসেই তো নিশ্চিন্তি হয়ে বুকে ক্যামেরা ঝুলিয়ে বুক ফুলিয়ে বেড়াই।

    তারপর সসঙ্কোচে ব্যক্ত করেছিল কমলা হৃদয়ের মৃদু প্রতিবাদ-এত ভাল ভদ্রলোক, সকলের কত উপকার করছেন দেখতে পাই, ওঁকে কেন বাপু

    কথা শেষ করতে দেয়নি ননী, খিঁচিয়ে উঠেছিল, থাম কমলি, মেজাজ খারাপ করে দিসনি। ভদ্রলোক! ভাল লোক! বস্তিতে কলোনিতে লেকচার দিয়ে বেড়ানো লোক আমি নতুন দেখছিনে। যত সব মতলববাজের দল। নিশ্চয় সামনের বছর ইলেকশানে নামবে। এখন তাই দেশের গরিবদুঃখীদের জন্যে কুমীরকান্না কেঁদে বেড়াচ্ছে। এইসব লোককেই পাঁকে পুঁতে দিতে হয়, বুঝলি ঘলি!

    বলতে বলতে রাগে ফুলে উঠেছিল ননী, এরা আমাদের মতন গরিবদের হ্যাঁন করব, ত্যান করব বলে দুটো মিষ্টি কথা আর একটু মুষ্টিভিক্ষেয় ভুলিয়ে ভোটের ব্যবস্থাটি করে নিজের কার্যসিদ্ধি করে নেয়, আমাদের মই বানিয়ে উঁচু গাছের মগডালে চড়ে বসে, তারপর আর আমাদের চিনতে পারে না! এই পাঞ্জাবি উড়িয়ে বেড়ানো উপকার করা বাবুগুলোকে দেখলেই তাই গা-জ্বালা করে আমার! ওর মুখে চুনকালি পড়ক তাই চাই আমি। আর তাতে পাপও নেই। এসব লোকের চরিত্রই কি ভীষ্মদেব হয় নাকি? হয়তো খবর নিলে জানবি আরও কত কেষ্ট ঠাকুরালি করে বেড়িয়েছে।

    তবু কমলা সসঙ্কোচে বলেছিল, এঁকে কিন্তু তেমন মনে হয় না ননীদা।

    নাঃ, মনে হয় না! ওর কার্তিকের মতন চেহারা দেখে বুঝি মন গলে গেছে? এই তোকে বলে রাখছি কমলি, এ জগতে দেখতে পাবি যে যত দেবদূতের মতন দেখতে, সে তত ফেরেববাজ! তুই যদি ওর চেহারা দেখে

    আমি ওকে দেখিইনি ভাল করে। কমলা বলেছিল তাড়াতাড়ি ভয়ে ভয়ে।

    আর দেখতে হবেও না। ওকেই দেখিয়ে দিবি। খুব শাঁসালো ঘরের ছেলে, বেশ কিছু আদায় করা যাবে।

    কমলা ম্লানমুখে বলেছিল, আমার কিন্তু বড় ভয় করে ননীদা। প্রত্যেকবারই ভয় করে। ..সত্যি সত্যি যদি কেউ পুলিসে ধরিয়ে দেয়? তখন তো সব জোচ্চুরি ধরা পড়ে যাবে? জেলে যেতে হবে আমাদের।

    পুলিসে দেবে না। ননী একটু আত্মপ্রসাদের হাসি হাসে। জানি আমি বড়লোকদের বদনামের ভয়টা বড্ড বেশি। মহা মিথ্যে বলে বুঝলেও পুলিস-জানাজানি করে সমাজে মাথা হেট হতে চায় না। তাই চারটি টাকা দিলে যদি মেটে তো মিটুক বলে ঘুষ দেয়।

    সত্যি কথা প্রকাশ হলে সমাজে মাথা হেঁট হবে কেন ননীদা?

    কেন? হো হো করে হেসে উঠেছিল ননী, তুই এখনো নেহাৎ ছেলেমানুষ আছিস কমলি। সমাজ কি সত্যি কথাকে সত্যি বলে বিশ্বাস করবে? কেউ করবে না। বাপ ছেলেকে বিশ্বাস করবে না, ছেলে বাপকে বিশ্বাস করবে না। তা ভাই বন্ধু আত্মপর তো দূরের কথা! যতই ধর্মের জয়–অধর্মের পরাজয় হোক, লোকে ভাববে পুলিসকে হাত করে ডঙ্কা বাজিয়ে জিতে গেল। অথচ কেলেঙ্কারির চূড়ান্ত হবে, ঢাকে ঢোলে কাঠি পড়বে, খবরের কাগজওলাগুলো জেনে বুঝেও কায়দা করে রংচং চড়িয়ে খবর ছাপবে। জানে তো সবই। সবাই জানে। তাতেই তো মাসিকে আর তোকে এই পথ ধরিয়েছি। তবে সাবধান, মাসিকে সঙ্গে করে ভিন্ন এক পা নড়বি না। একলা পেলেই মেরে গুমখুন করে ফেলবে।

    নিঃশ্বাস ফেলে চুপ করেছিল কমলা।

    .

    তারপর ননী এক অদ্ভুত কাজ করল। কোথা থেকে কিনে নিয়ে এল একসেট ফুলের গহনা। বলল, তোর সব থেকে ভাল শাড়িটা আর এইগুলো পরে নে কমলি।

    সে কি গো ননীদা! না না, এমন সং সাজতে পারব না আমি!

    সং কী রে? রানী, রানী! কেমন একটা হতাশ হতাশ মুখে বলেছিল ননী, রটাতে হবে রাজপুত্তুর তোর গলায় মালা দিয়েছে, তা একটু রানী-রানী না দেখালে মানাবে কেন? এ ছবি বাছাধনের মাকে দেখালেই তার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। একেবারে বিয়ের বরকনের যুগল ছবি!

    যুগল ছবি কথাটা ননীর কাছেই শোনা কমলার।

    সত্যিই কনে সেজেছিল সেদিন কমলা।

    ফটো তোলার পর ননী আবেগ-আবেগ গলায় বলেছিল, এ ছবি আমার কাছে রেখে দেব একখানা। কী করব রে কমলি অনেক যে খরচা, নইলে কত ছবি তুলতাম তোর!

    .

    ছবিখানা তুলে রাখতে গিয়ে আবার একবার চোখের সামনে ধরে বসে রইল কমলা।

    ওই চোখ দুটো কি তাকে ভর্ৎসনা করছে? বলছে, ছি ছি, তুমি এমন নীচ? এত ইতর?

    সেদিন ওদের বাড়িতে গিয়েও যেন এমনি হয়েছিল কমলার। মনে হচ্ছিল সমস্ত বাড়িখানা তার আসবাবপত্র শোভা-সৌন্দর্য সমেত যেন অনবরত ভর্ৎসনা করছে ছি ছি, তুমি এমন নীচ!

    তিনতলায় উঠে তো ভয়ে প্রাণ উড়ে গিয়েছিল কমলার। এ কী! মাসি আর ননীদা কি পাগল?

    ওইখানে, ওই ঘরে ঢুকে বলতে হবে, তোমাদের ছেলে এই কমলাকে বিয়ে করেছে! যে কমলা দুখানার বেশি চারখানা শাড়ি কোনদিন পরেনি, দুবেলার বেশি চারবেলা কখনো খেতে পায়নি! আর যার পিঠের জামা খুললে এখনো কেষ্টমোহিনীর হাতের মারের দাগ খুঁজে পাওয়া যায়! এর আগে এত বড় জায়গায় কখনো আসেনি কমলা।

    কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই ভয়ঙ্কর অসম্ভব কথাটা বলা হয়েছিল। আর মিলে গিয়েছিল ননীদাদের হিসেবটাই। ওই ইন্দ্রবাবুর পিসিমা এই মারি এই মারি করেও শেষ অবধি বিশ্বাস করেছিলেন। কেষ্টমোহিনীর হাত ধরে বলেছিলেন, দেখ ভাই, একথা যেন সাত-কান না হয়। তোমার মেয়ে আর নাতির কষ্ট যাতে না হয় সে ব্যবস্থা আমি করব। আর এই একটু মিষ্টি খেও বলে সেই হাতে গুঁজে দিয়েছিলেন একশখানি টাকা।

    ননীদাদের হিসেবটাই ঠিক। স্ত্রী-পুরুষ সম্পর্কিত ব্যাপারে জগতে কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না!

    কিংবা কিংবা ননীদার সে কথাটাও হয়তো সত্যি। হয়তো স্বভাব-চরিত্র ভালই নয় ওর, তাই ওর পিসি এত সহজেই..

    কমলারা অবশ্য বিয়ে শব্দটা ব্যবহার করে। কিন্তু সমাজকে লুকিয়ে যে বিয়ে, তাকে কি আর লোকে সত্যি বিয়ে বলে সম্মান দেয়?

    .

    হঠাৎ ছবিখানা বিছানার তলায় খুঁজে রেখে দিল কমলা। ক্রমশ যত দেখছে তত যেন গা ছমছম করছে।

    আস্ত লোকটাকে আর একবার পাওয়া যায় না? দূর থেকে…অনেক দূর থেকে!

    .

    খোঁজ পেলি না চন্দর? ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়লেন নীহারকণা। সেরাত্রে নয়, তার পরদিন দুপুরে।

    চন্দ্রনাথ বিছানায় বসে পড়ে গভীর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলেন, পেয়েছি।

    পেয়েছিস?..আঁ, পেয়েছিস? তবে একলা এলি যে? ও চন্দর, অমন গুম হয়ে রয়েছিস কেন? কোথায় রেখে এলি তাকে? হাসপাতালে না–

    শেষ পরিণামের শব্দটা আর উচ্চারণ করেন না নীহারকণা। হাঁপাতে থাকেন।

    চন্দ্রনাথ হাত তুলে শান্ত হবার ইশারা করে বলেন, রেখে কোথাও আসিনি, দেখে এলাম তার অফিসে। কাজ করছে।

    অফিসে কাজ করছে। আঃ নারায়ণ! বাবা বিশ্বনাথ! মা মঙ্গলচণ্ডী!…আসবে তো সন্ধ্যেবেলা? আসবে না তো আর যাবে কোথায়? রাগ আর কতকাল থাকে মানুষের?–তা কাল রাত্তিরে ছিল কোথায় হতভাগা? রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছিল বোধহয়। হাসি আর কান্নার এক অপূর্ব রামধনু রঙে উথলে ওঠে নীহারকণার মুখ।

    রোস রোস, একে একে তোমার কথার উত্তর দিই।

    কী বললে? কাল রাত্তিরে ছিল কোথায়? ছিল ওদের সেই সঙ্ঘের অফিসঘরে। তারপর কী বললে? কতক্ষণ রাগ থাকে মানুষের? বলা যায় না, হয়তো চিরকাল। সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফিরবে কিনা?…না, ফিরবে না।

    ফিরবে না?

    না।

    ভুলের মাপ নেই?

    মাপ চাইনি।

    খানিকক্ষণ নিঃসীম স্তব্ধতা। তারপর নীহারকণা বলে ওঠেন, তুমি সেসব কথার কিছু জিজ্ঞেস করনি? সত্যি কি মিথ্যে, কে এমন শত্রু আছে তার যে এতবড় ষড়যন্ত্র করেছে?

    অফিসের মাঝখানে ওসব কথা! তাছাড়া কোনখানেই কি জিজ্ঞেস করতে পারতাম? না দিদি, সে সাধ্য আমার নেই। শুধু সহজভাবে বললাম, তোমার পিসিমা বড় ব্যস্ত হয়ে রয়েছেন, অফিস মিটলেই তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরো। সঙ্গে সঙ্গে বলল, আমি আমাদের সঙ্ঘের ওখানেই এখন কদিন থাকব বাবা। তারপর যা হয় একটা ব্যবস্থা করে নেব। বললাম, তোমার পিসিমা বড্ড বেশি কাতর হবেন– একটু হেসে বলল, আপনি তো আর হবেন না। শুধু পিসিমা। তাকে বলবেন আমি ভালই আছি।

    চন্দ্রনাথের গতকাল থেকে ভিজে হয়ে থাকা দুটি চোখের কোণ দিয়ে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। গোপন করবার আর চেষ্টা করেন না।

    নীহারকণা হঠাৎ ধিক্কার দিয়ে ওঠেন, ছি ছি! এত নিষ্ঠুর! এতটুকু মমতা নেই!

    আমরাও তো কম নিষ্ঠুর নই দিদি, আমরাও তো তাকে মমতা করিনি।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleউত্তরণ – আশাপূর্ণা দেবী
    Next Article আর এক ঝড় – আশাপূর্ণা দেবী

    Related Articles

    আশাপূর্ণা দেবী

    বিবাগী পাখি – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    কুমিরের হাঁ – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ঠিকানা – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ততোধিক – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ১. খবরটা এনেছিল মাধব

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    নতুন প্রহসন – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }