Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    আশাপূর্ণা দেবী – সাহিত্যের সেরা গল্প

    লেখক এক পাতা গল্প213 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    বহুরূপী – আশাপূর্ণা দেবী

    বহুরূপী

    আট ভাইবোনের মধ্যে নিখিল সকলের ছোট। মায়ের কোলের ছেলে।

    শুধু ছোট বলেই নয়, দাদা আর দিদিদের থেকে বেশ কিছু জুনিয়ার। কিন্তু ‘কোলের ছেলে’ বিশেষণটার সঙ্গে যে একটা ‘আদুরে’ ভাব জড়িত থাকে, নিখিলের ভাগ্যে তার একান্তই অভাব।

    কারণটা এই—সপ্তম সংখ্যাটিও প্রায় লায়েক হয়ে ওঠার পর হাঁফ ছেড়ে নিশ্বাস নিয়ে, আর গৃহিণীত্বের কোঠায় প্রমোশন পেয়ে—আবার অষ্টমের আবির্ভাব আদৌ প্রীতিকর হয়নি নিখিলের মা বিরজার কাছে। যেন বিবাহিতা মেয়েদের, আর বিবাহযোগ্য ছেলেদের সামনে মুখ তুলতে না পারার মতো অপরাধের একটা সাক্ষ্য নিখিল।

    তার ওপর রোগা আর কালো একটা ছেলে। যাকে দেখলে এ পরিবারভুক্ত বলেই মনে হয় না। পরিবারের মধ্যে প্রথম কালো চামড়ার আমদানি করেছে নিখিল।

    নিজে বিরজা এ বয়সেও—এতগুলি ছেলেমেয়ের মা হয়েও—টুকটুকে, থুপথুপে। বাজার চলতি বিশেষণে ‘লক্ষ্মী ঠাকরুনটি’। নিখিল বাদে বাকি ভাইবোনগুলি যেন কাচের পুতুলের ঝাড়।… ছোট ছোট চোখ, খাঁদা খাঁদা নাক, ঝিকঝিকে দাঁত, আর ফুটফুটে রঙওয়ালা গোলগাল ছেলেমেয়েগুলিকে দেখলেই লোকের পুতুলের নামটাই মনে হত চট করে। ওর বড়দির নামটাই তাই রাখা হয়েছে ‘পুতুল’।

    তাল মিলিয়ে মেজদি আর ছোড়দি হচ্ছেন ডলি আর লিলি। সত্যি বলতে কি, এত বড় হয়েও ওদের চেহারার ‘পৌত্তলিকতা’ ঘোচেনি। প্রতুল, অতুল, অজয় আর অখিল, সবই ওই এক ছাঁচের। এদের ভাইবোনদের সকলেরই গালে টোল খাওয়া আহ্লাদে হাসিটা সমাজে প্রায় বিখ্যাত। গালে টোল প্রত্যেকেরই পড়ে, কেবল নিখিল বাদ।

    ও আলাদা—একেবারে আলাদা। সকলের থেকে বিপরীত। ওর আড়া ছিপছিপে লম্বা, চোখ নাক আর ধারাল চোয়ালের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখা চওড়া কপাল, সামনের দাঁত দুটো হয়তো বা একটু উঁচুই। যার জন্যে ওকে দেখলেই কেমন যেন উদ্ধত মনে হয়। ওর বাহুল্যশাঁসবর্জিত গালে হাসলে টোল খাওয়ার কথা কেউ কল্পনাও করতে পারে না।

    তবু—শুধু আকৃতির বিরুদ্ধতা, এতদিনে এই বাইশ বছরের অভ্যাসে অবিশ্যি ভুলে যেতো সবাই, যদি নিখিলের প্রকৃতিটাও না হত সকলের থেকে বিপরীত।

    বিরুদ্ধ চেহারা বরং সহ্য হয়, সহ্য হয় না বিরুদ্ধ আচরণ।

    অথচ বাইশ বছর ধরে সহ্য করতেও হচ্ছে এঁদেরকে—বিরজাদম্পতি আর তাঁদের ভালো ভালো ছেলেমেয়েদের!

    ওঁরা যখন ভেতরে ঘুণধরা বনেদিয়ানার ওপর জৌলুসহীন জড়োয়া আর রিপু করা শালের পালিশ লাগিয়ে সমাজে চরে বেড়াতে চান, নিখিল তখন পুরনো স্যান্ডেল আর ঘাড়-ছেঁড়া টুইল সার্ট ওঁদের মুখ পোড়ায়।

    ওঁরা যখন হঠাৎ অতিথি অভ্যাগত এসে পড়লে ভালো ভালো নতুন গালচেগুলো ”তাড়াতাড়িতে” খুঁজে না পেয়ে হাতের কাছে পড়ে থাকা ক্ষয়ে শেষ হয়ে যাওয়া দড়ি-বার-করা গালচেখানাই পেতে দেন তাড়াতাড়ি, নিখিল তখন জাঁকিয়ে বসেই মহোৎসবে বাজার দরের গল্প ফেঁদে আক্ষেপ করে তাদের কাছে, সামান্য এক জোড়া মাদুরের জন্যে কতো অসুবিধে ভোগ হচ্ছে। ছ’মাস ধরে কিনে উঠতে পারা যাচ্ছে না জিনিসটা—মূল্যের দাহিকাশক্তির দাপটে।

    দাদারা যে ওর উঁচু দাঁতের ঔদ্ধত্যের ওপর ঘুষি বসিয়ে দেবার প্রবল স্পৃহাকে সামাল করতে পারে—সে তারা নিতান্তই ‘টোল খাওয়া গাল’ওয়ালা বলে।

    প্রতি পদে এই রকম করবে নিখিল।

    ওর চৈতন্যোদয় করতে—আজ পর্যন্ত যত ধিক্কার, লাঞ্ছনা, আর সদুপদেশ বর্ষিত হয়েছে—একত্রে জড়ো করলে কতো যে ওজন হত কে জানে। বোধ করি এগুলি উপযুক্ত পাত্রে বর্ষিত হলে দু’এক ডজন বাল্মিকী, বিল্বমঙ্গল, আর জগাই মাধাই তৈরি হতে পারতো।

    কিন্তু নিখিলের আর চৈতন্য হল না।

    নিশ্চিন্তচিত্তে ঘুরে বেড়ায়, যা খুশি তাই করে, যার তার সঙ্গে মেশে, এবং অম্লান বদনে দু’বেলা খাবার আসনে এসে বসে। অবশ্য ঠিক সময়মতো এবং সকলের সঙ্গে বসবার অবসর তার হয় না।

    বাড়ির কোনো কাজে তাকে পাবার উপায় নেই। একটা উপকারে শুধু লাগে সে, সেটা হচ্ছে বাড়ির প্রত্যেকটি সদস্যের রসনা পরিতৃপ্তির সহায়তা করা। মায় ঝি-চাকরটার পর্যন্ত।

    ভাববেন না—এর জন্যে দেশীবিলাতি কোনো মুখরোচক খাদ্যবস্তুর আমদানি করতে হয় নিখিলকে। কষ্ট করে কিছুই করতে হয় না তাকে, প্রত্যেকের রসনাকে যথেচ্ছ সমালোচনা করবার মধুর তৃপ্তির যোগান দিচ্ছে সে নিজেই, বা নিজের যথেচ্ছ ব্যবহারে।

    যাই হোক এতদিন পর্যন্ত চলছিল তবু, কিন্তু এবারে যেন নিখিল পরিবারের সকলের মাথায় বাজ ফেলেছে। সেবারে যখন সামান্য কয়েকটা টাকার জন্যে ‘হালতি বালতি ঘরের’ ছেলেদের মতো দুটো টিউশনি ধরেছিল নিখিল, তখনো সবাই প্রায় বজ্রাহত গোছই হয়েছিল বটে, কিন্তু এখন? এখনকার ব্যাপারের সঙ্গে তুলনাই হয় না তার। এর পক্ষে সে কিছুই নয়।

    ইদানীং যে তার ওপর একটা ‘দুরছাই, করুক যা খুশি’ গোছ ভাব এসে গিয়েছিল, সেটা নিঃশেষ হয়ে গেলো। ”কিছুতেই না” ”কখনোই না” গোছের মনোভাব নিয়ে সবাই একবার করে যুদ্ধে নামছে।

    নিখিলের মেজ-ভগ্নীপতি কোথা থেকে যেন সন্ধান-সুলুক জেনে নিয়ে দুঃসংবাদটা ‘চাউর’ করলেন শ্বশুরবাড়ি এসে।

    কি একটা সিনেমা কোম্পানিতে নাকি কাজ নিয়েছে নিখিল! অভিনয় করবে। অর্থাৎ এ বংশের মুখ শুধু পুড়িয়েই ক্ষান্ত হয়নি, পোড়ামুখের ওপর আবার চুন-কালি লেপেছে।

    এর পরেও কি আর রিপু করা শালের পালিশে আভিজাত্য অটুট রাখা যাবে? ছেলের সিনেমায় নামা!—এ আবার কল্পনা করা যায় নাকি?

    বড়দাদা প্রতুলই এসেছিলেন প্রথম হাল ধরতে।

    কোনো ভূমিকা না করেই সোজাসুজি বললেন তিনি, তোমার মতলবটা খুলে বলবে আমাদের?

    বড়বাবুর সামনে ক্ষুদে কেরানীর মতো চেয়ার ছেড়ে তটস্থ হয়ে উঠে দাঁড়ালো নিখিল, হাত দুটোই যা জোড় করতে বাকি। বড়দাদাদের দেখলে এই গরুড়পক্ষীর ভঙ্গিটি করবেই ও, তাঁরা এটাকে সম্মান না ভেবে অসম্মান ভাবলেও।

    —কী বলছেন বড়দা?

    —বলছি না কিছুই, শুধু তোমার মতলবটা জানতে চাইছি।

    —আমার মতলব? কই বিশেষ কিছু তো দেখতে পাচ্ছিনে বড়দা!

    —তুমি নাকি সিনেমায় নামা মনস্থ করেছো?

    —মনস্থ? না তো, এখন আর মনস্থ করছি কই?

    প্রতুল থতমত খেয়ে বলে—তবে যে রাসবেহারী বললে, তুমি নাকি কোন সিনেমা কোম্পানিতে—

    —ওঃ, সেই কথা বলছেন? সে তো কনট্রাক্ট হয়ে গেছে অনেকদিন। নতুন করে আর কিছু মনস্থ করছি না তাই বলছি। না, রাসবিহারীবাবু ভুল বলেননি কিছু।

    গম্ভীর ভারী গলায় দাদা বললেন—তুমি কী ভাবো, যতো ইচ্ছে ‘যা খুশি’ করবার অধিকার আছে তোমার?

    —কী যে বলেন বড়দা—সামান্য একটু হেসে ওঠে নিখিল, গালে টোল খাইয়ে নয়, উঁচু দাঁতের ঔজ্জ্বল্যে। বললো—অধিকারের গণ্ডিটা কী বিশ্রী ছোট আমাদের, ভাবলে তো মাথা ঘুরে যায়।…..সামান্য দিয়েই ধরুন—সামনের ওই লালবাড়ির দরজা দুটো সর্বদাই খোলা থাকে দেখছেন তো? ওর চৌকাঠে মাথা গলাবার অধিকার আমার কাছে কোনদিনই ভাবতে পারি না এমন কথা।

    —ভাবলেই পারো….বলে গটগট করে বেরিয়ে যান প্রতুল। আর কথা বলবার প্রবৃত্তি তাঁর নেই।

    তারপর এলেন বাবা।

    বললেন—নানা রকমে বংশের মুখ হাসিয়েও আশা মেটেনি তোমার?

    —বংশের মুখ হাসাতে পারব এ আশা কোনোদিন করিনি বাবা—নিজে না হেসেই বলতে থাকে নিখিল—তার জন্যে তো দাদারাই রয়েছেন। বংশের যদি সত্যিই মুখ চোখ কিছু থাকে, তাহলে আমার দুর্ব্যবহারে কাঁদাই স্বাভাবিক তাঁর।

    —হুঁ! কথার জাহাজ একটি! তোমার মতো ছেলেরা বায়স্কোপ থিয়েটার করবে না তো করবে কারা। কুলাঙ্গার হতভাগা!…..তবে আমার এই সাফ কথা, দুর্মতি যদি না ছাড়ো, এ বাড়িতে আর জায়গা হবে না তোমার!

    নিখিল হাসলো—এ বাড়িতে বেশিদিন কারই বা জায়গা হবে বাবা? দয়ালহরিবাবুর দয়ায় যে ক’টা দিন থাকতে পারা যায়।

    গিরীন্দ্রমোহন রাগে অন্ধকার দেখেন চারিদিক।

    চুপি চুপি দয়ালহরি মোক্তারের কাছে বাড়িটা বন্ধক দেওয়ার কথা কাকপক্ষীতে টের পায়নি, আর ও কিনা সেই খবর যোগাড় করে আনলো? ছেলে তো-নয় চিরশত্রু!

    গিরীন্দ্রমোহনের অন্ধকার দেখার ফাঁকে চোখ তুলে একবার বাড়িখানার আপাদমস্তক দেখে নেয় নিখিল। বাড়িখানা প্রকাণ্ড সন্দেহ নেই, জমি আছে বিস্তর, কিন্তু জীর্ণতার শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছে।

    ঠাকুর্দার আমলের পর থেকে মিস্ত্রীর হাত পড়েনি।….প্রাচীন দেহে অতীত মর্যাদার কিছুটা জীর্ণ সাক্ষ্য নিয়ে মৌন মুখে দাঁড়িয়ে আছে। এতো অবহেলার প্রতিশোধ নিতে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে না যে একদিন, তাই আশ্চর্য!

    কিন্তু ভেঙে পড়াই উচিত ছিল। নিখিল ভাবে—তাতে হয়তো ভালো হত ওদের। ওর নোনাধরা ইঁটের খাঁজে খাঁজে জড়িয়ে আছে যে নোনাধরা আভিজাত্য, তাকে জীইয়ে রাখবার চেষ্টা শুধু মূর্খতা নয়, অপরাধ!

    —মর্টগেজের টাকা তো কোনদিনই শোধ দিতে পারবেন না বাবা, তার চাইতে বেচেই দিন না বাড়িটা? জমির দরেও যদি কেউ নেয়, অনেক লাভ।

    গিরীন্দ্রমোহন রাগে কাঁপতে থাকেন….সত্যিকারের কাঁপা। কাঁপে হাত, পা, ঘাড়। এই ছেলেটাকে কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারেন না তিনি। অজয় যখন মদ খেয়ে অচৈতন্য অবস্থায় ইয়ার বন্ধুদের দ্বারা বাহিত হয়ে বাড়িতে এসে পড়ে, তখনো এমন হাত পা কাঁপে না গিরীন্দ্রমোহনের। কাঁপে না লিলির শ্বশুরবাড়ির ড্রাইভারের সঙ্গে লিলির নামোল্লেখ শুনেও।

    বাকশক্তি ফিরে পেলে বলেন, ”টাকা শোধ করতে পারবো না”, কেমন? বুড়ো বাপের মুখের ওপর এই ধিক্কার দেওয়াই তো উপযুক্ত ছেলের কর্তব্য! লজ্জা করে না? এক পয়সা ঘরে আনার মুরোদ নেই—

    —আনবার চেষ্টাই তো করছি, অথচ তাতেই আপনাদের রাগ!

    —চেষ্টা, চেষ্টা! থিয়েটার করে, ভাঁড়ামী করে, মুখে রঙ মেখে পয়সা আনা! ভদ্রলোকের ছেলের উপযুক্ত পেশা বটে! তুমি কী ভেবে রেখেছো—তোমার ওই পয়সা পা দিয়ে ছোঁব আমরা?

    —কিন্তু মেজদার টাকা তো মাথায় করে নেন আপনারা।

    —কেন, কেন, অতুলের কী দোষ হয়েছে শুনি? ওসব কে না করে?

    —করে, তবু রেস খেলাকে নিন্দেই করে লোকে।

    —করুক করুক, পরিবারের মুখ পোড়ানো নয় সেটা, বংশের গায়ে ধুলো দেওয়া নয়। হতভাগা কুলাঙ্গার! জেনে রেখো, তোমার মত পরিবর্তন না করলে এ বাড়ির সঙ্গে সম্বন্ধ শেষ তোমার।

    —জেনে রাখলাম—বলে হঠাৎ বাপের পায়ে হাত ঠেকিয়ে নমস্কারের মতো কী একটা করে নিখিল।

    গিরীন্দ্রমোহন একটু কেমন অপ্রতিভ হয়ে যান সত্যি, কিন্তু না, নিজেকে চেক করতে পারেন না তিনি। এই ছেলেটার ওপর একটা জাতক্রোধ আছে তাঁর। ওর ওই বিনীত ভঙ্গির নীচে লুকোনো যে ঔদ্ধত্য, সেটা অসহ্য।

    এলো আরো তিন দাদা।

    নিখিলের কাজটা যে তাদের গালে চড় মারার মতো হচ্ছে, এই কথাটা বোঝাতে নিখিলকে শুধু চড় মারতেই বাকি রাখলো তারা। নিখিল কেবল হাসে। লাঞ্ছনা গঞ্জনায় হাসে—এইটেই সবচেয়ে অসভ্যতা নিখিলের।

    নিজের নিজের শ্বশুরবাড়ির মোটরে চড়ে দিদিরা এলো।

    পুতুলই যা ওকে একটু স্নেহের চক্ষে দেখে, বরাবর দেখে। শৈশবকালে মায়ের অবহেলার পরিপূরক হিসেবে ওই যা একটু দেখাশোনা করতো নিখিলকে। ডলি তো ছুঁতোই না কালো বলে।

    পুতুল একলা ওকে কাছে বসিয়ে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে অনেক বোঝালো। বললো —তুই ছেলেমানুষ, এখুনি টাকার ভাবনা ভাববার দরকার কি তোর?

    নিখিল হেসে ফেলে উঠে দাঁড়ালো, গায়ের শার্টটা হঠাৎ খুলে ফেলে পিছন ফিরলো বড়দির দিকে।

    —ইস! … ছি ছি!….এই রকম ছেঁড়া গেঞ্জি পরে তুই…..পুতুল যেন শিউরে আপসে উঠলো—আচ্ছা তা আমাদেরও তো চুপিচুপি বলতে পারিস ভাই? আমরা তোর বড়োবোন, ভগবানের দয়ায় কিছুর অভাব নেই—তোকে দশ-বিশ টাকা দিতে পারি না?…..তিনজনে মিলে কিছু কিছু দিলেই তো—

    —অনায়াসে চলে যায় আমার, কেমন?….সত্যি, কেন যে এই সহজ উপায়টা মাথায় আসেনি তাই ভাবছি গো ‘পুতুলরাণী’—

    ছোটো মেয়ের মতো আদর করে বড়দির মাথায় চাপড় মারে নিখিল।…বোকাসোকা এই দিদিটির সঙ্গে যা সাদাসিধে কথা বলে নিখিল, ছোবল মারবার ফিকিরে থাকে না।

    —ঠাট্টা করছিস?…চিরদিনের কথা কী আর বলছি? যতোদিন না কিছু সুরাহা হয়। তুই এই রকম হাড়ির হালে কাটাবি, আর আমরা সোনাদানা পরবো! কেমন লাগে আমাদের! চোখ ছলছল করে আসে পুতুলের—বড়দা মেজদার গায়ে তো দিব্যি সিল্কের পাঞ্জাবি, জরিপাড় ধুতি দেখতে পাই—

    —পরতে জানাও একটা আর্ট, বড়দি—

    —বৌদিরা তো ঢাকাই শান্তিপুরী ছাড়া পরেন না দেখি—

    —বোধ হয় বাপের বাড়ির!

    —হ্যাঁ! বারোমাস বাপের বাড়ির কাপড়ে চলে!…এই যে আমরা বছরে মোটে একখানা কাপড় পুজোয় পাই, তাও শ্বশুরবাড়ির লোকের সামনে খুলে পরতে লজ্জা করে এমন শাড়ী—

    —এই তো ভুল করলে বড়দি! ওদের বাপের বাড়ির সঙ্গে তুলনা তোমাদের? কিসে আর কিসে!…

    —তুলনা করবো না? ওঃ, কেন শুনি?…এ বাড়ির যা নামডাক ছিল তার সিকিও আছে ওদের? এখনই না হয় অবস্থা পড়ে গেছে—

    অবিরত উল্টোপাল্টা কথা অম্লানবদনে বলে যেতে পারে পুতুল। নিজের কাছে অসঙ্গতিটা ধরা পড়ে না।

    পুতুল যেমনি বোকা, তেমনি চালাক ডলি।

    ও এসে যা বললো সে সব একেবারে কাটা কাটা ছাঁকা ছাঁকা। নিখিলের এ হেন কুৎসিত কাজে শ্বশুরবাড়িতে ওদের মুখ দেখানো যে ভার হবে সেই কথাটাই বললো শুধু অসংখ্যবার।

    —তোমাদের ‘মুখ দেখানোর’ দায়িত্বটা যে আমার ওপর ছিল সেটা তো আগে জানতাম না মেজদি—নিখিল হাসতে থাকে—তাহলে কনট্রাক্ট করবার আগে একবার নয় পরামর্শ করতে যেতাম—সেজদার এক সেট পোষাক ধার করে।

    —কেন, তোর কি ভদ্ররকম একটা জামাজুতোও নেই? ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে ডলি— সবই বাড়াবাড়ি! এদিকে তো দাদা মেজদার মেয়েদের স্নো পাউডারের খরচা দেখি মাসে তিরিশ টাকা।

    —আহা বেচারারা! নিখিল উদাস সুরে বলে—কতো উঞ্ছবৃত্তি করেই যে ওই টাকাটা সংগ্রহ করতে হয় মেয়েগুলোকে…..আরো ওদের জন্যেই—

    থেমে যায়।

    লিলি এসেছে।

    লিলির কথাবার্তা যেন সুরবাঁধা তারের যন্ত্র। কথা কইতে ভাবতে হয় না, ঠোকর খেতে হয় না ওকে।

    —তুই কি মনে করিস বিশ্রী একটা কিছু করাই খুব বাহাদুরি? কেন যে তুই এ বাড়িতে জন্মেছিলি তাই ভাবি অবাক হয়ে।…. একবার ভাবিস না তোর এই রকম নীচ কাজে বাবা কী রকম আঘাত পাবেন? বাবার যে রকম হাই ব্লাড প্রেসার, জানিস আকস্মিক একটা আঘাতে হঠাৎ হার্টফেল করাও বিচিত্র নয়!

    নিখিল এবার গম্ভীর হয়ে বলে—বনেদি হাড়ের মধ্যে সুরক্ষিত হার্ট অতো পলকা হয় না ছোড়দি। ছেলেমেয়েদের নীচতা দেখে ফেল করবার মতো পলকা হার্ট হলে অনেক আগেই ফেল করতো।

    মাকে ঘরে ঢুকতে দেখেই দুই হাত জোড় করে উঠে দাঁড়ালো নিখিল, বললো—দোহাই মা, তুমি আর মিথ্যে খাটতে এসো না, এমনিতেই তো বামুনঠাকুরকে ছাড়িয়ে দিয়ে যথেষ্ট খাটুনি বেড়েছে তোমার!

    —ছাড়িয়ে দিয়ে কি আবার—বিরজা রেগে ওঠেন—দেশে গিয়ে যে আর আসছে না সে শয়তানটা!

    —ও হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাই তো বটে! আমার আবার সব সময় মুখস্থ থাকে না কথাগুলো। ….যাকগে—বলছি তুমি আমাকে মানুষ করবার চেষ্টা আর কোরো না মা। দেখলে তো কিছুতেই কী পারলে! হেরেই মরলে।

    —না বাবা, তোমাকে মানুষ করার সাহস আর আমার নেই, শুধু বলছি—কী বলেছিস লিলিকে? সে একেবারে জলস্পর্শ না করে চলে গেল!

    —আমি আর কী বলবো—উদাসভাবে বলে নিখিল, বোধ হয় তোমাদের ওই আটার হালুয়া গলা দিয়ে গলবে না বলেই গলাবার চেষ্টা করেনি ছোড়দি!

    —আটার হালুয়া? মেয়ে জামাই এলে তাই দিই বুঝি আমি?

    —দাও না? তবুও ভালো, শুনে স্বস্তি পাচ্ছি যে এনামেলটা এখনো জায়গায় জায়গায় আটকে আছে, আগাগোড়া চটা উঠে যায়নি।—কিন্তু তোমার আদরের ছোটো মেয়েকে আমি কিছুই বলিনি মা! কেউ যদি কিছু বলে থাকে, সে বোধ করি ওর আত্মজ্ঞান।

    —তোমার কথার মারপ্যাঁচ আমি বুঝি না বাছা, মনে রেখো তোমার দিদি ও।

    —শুধু ওইটুকুই মনে রাখলে চলবে মা? ওর বরের ব্যাঙ্কের খাতাটা মনে রাখতে হবে না?—কলকাতায় ক’খানা বাড়ি আছে ওদের! কটা গাড়ি আছে! এসব অমনি ভুলে গেলেই হল?

    রাগ করে উঠে যান বিরজা।

    এক সময় এসে উদয় হন বড়ো বৌদি। এঘরে কদাচিৎ পা পড়ে তাঁর!

    —এই যে আসুন! বিনীত ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে ওঠে নিখিল।

    —ঢং কোরো না ছোটঠাকুরপো, আমি তোমার চাইতে দশ বছরের বড়ো, তা জানো?

    —জানতাম না, তবে জানলাম—দশ নয় বিশ।

    —তার মানে?

    —মানে—দশটা বছর কী আর হাতে না রেখেছেন?

    —থাক, ঢের হয়েছে! বাজে কথা থাক—বলতে এসেছি—

    —যা বলতে এসেছেন সব জানি আমি, কেন আর পরিশ্রম করবেন।….আমি যেন উচ্ছন্নে না যাই, এই উচ্চবংশের চাঁদমুখে যেন কালি না মাখাই, পিত্রালয়ে আপনাদের মুখ দেখাবার পথ বন্ধ না করি, ইত্যাদি, ইত্যাদি, কেমন তো?

    —হয়েছে হয়েছে! রাণু রেখার বিয়ের কথাটা একবার ভেবেছো? কাকা বায়স্কোপ করে শুনলে ভালো ঘরে বিয়ে হবে ওদের?

    —সেটা না করলেই কি বিয়ে হবে আপনার আশা হয়?

    —হবে না? কেন হবে না তাই শুনি? ওরা কী এতোই খারাপ দেখতে—

    —সর্বনাশ! তা বলছি না দোহাই আপনার, শুধু বলছি ভালো ঘরের দক্ষিণাও তো ভালো? বাবার না হয় ‘সর্ব টর্ব’ কিছুও ছিল, মেয়ে তিনটিকে ভালো ঘরে দিতে ‘স্বান্ত’ হয়েছেন—কিন্তু বড়দার—

    —ওই তো, ওই জন্যেই তো সর্বাঙ্গ জ্বলে যায় আমার! নিজের মেয়েগুলিকে লাট-বেলাটের ঘরে প্রতিষ্ঠা করতে আমাদের দফা শেষ করেছেন তোমার বাবা। ….আমি ওসব জানি না, ভিটে বিক্রি করিয়েও রাণু রেখার ভালো বিয়ে দেব আমি।

    —তাহলে এরপর অমল কমলের বৌদের রাতদিন সর্বাঙ্গ জ্বলবে।

    —বয়ে গেল।….কিন্তু তুমি ছোটঠাকুরপো, মেয়েদের বিয়ের আগে আর বেলেল্লাপনা কোরো না কিছু।

    —এমনও তো হতে পারে, তাতেই সুবিধে হয়ে যাবে বিয়ের। অর্থকৌলীন্য বলে একটা কথা আছে তো?

    —কী? তুমি ভেবেছ, তোমার ওই টাকা পা দিয়ে ছোঁবেন তোমার দাদা? চেনো না মানুষটিকে?

    —টাকার গায়েও দাগ পড়ে নাকি বৌদি?

    —ঘেন্না ধরিও না ছোটঠাকুরপো….

    মেজবৌ সরাসরি কিছু না বলে শুনিয়ে শুনিয়ে বললে—টাকার জন্যে যদি সবই করা যায় দিদি, তো বলুন না ছোটঠাকুরপোকে, আমরাও স্টেজে গিয়ে দাঁড়াই তবে? সংসারে কিছু টাকা আসুক!

    —এই তো মুস্কিল, সেটি হবার যো নেই! অথচ এতো চমৎকার স্টেজ-ফ্রি আপনারা, আর এমন সুন্দর অভিনয়-কুশলী!

    —দেখছেন তো দিদি, ওই জন্যেই তো কথা কইতে যাই না আমি। গুরুলঘুজ্ঞান এ বাড়িতে কারুর নেই। আমাদের ওখানে—

    —মাটি করেছে! ….. বৌদি, আমার চা-টা হয়ে থাকে তো দিয়ে দিন চট করে, ওখানের দৃষ্টান্ত শুরু হয়ে গেলে উঠতে পারা যাবে না।

    মেজবৌ রাগ করে চলে গেল।

    শুধু ভাইঝিরা।

    তারাই যা হঠাৎ চিরঅবজ্ঞাত ছোটকা’কে অলৌকিকত্বের কোঠায় উঠতে দেখে অভিভূত হয়ে পড়েছে। সত্যিকার নিজেদের একটা মানুষের ছবি পর্দায় উঠবে, এটা অলৌকিক ছাড়া আর কী?

    সিনেমা দেখার অভাবটা যে ঘুচলো, এবার থেকে সেটা সুনিশ্চিত। একটু তোয়াজ করতে পারলে বেশকিছু আদায় করাই কি যাবে না ছোটকার কাছে? শাড়ি, ব্লাউজ, প্রসাধন দ্রব্য। পুরানো শাড়ি কেটে নতুন ফ্যাসানের ব্লাউজ সেলাই করে, আর মুচিকে বাড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে ছেঁড়া জুতো লুকিয়ে সেলাই করিয়ে নিয়ে আর তো চলে না। দুর্বহ হয়ে উঠেছে জীবন! টাকা হাতে থাকলে দেবেই, এ আস্থা আছে নিখিলের ওপর। ওর টিউশানির সামান্য টাকা থেকেই তো তবু দিচ্ছে দু’পাঁচ টাকা।

    চুপি চুপি ছোটকার কাছে এসে পড়ল ওরা।

    —ছোটকা, ”পাশ” দেবে তো সিনেমার?

    —এবার কিন্তু পুজোর সময় টিসু সিল্কের শাড়ি—

    টিসু সিল্কের পরে যে আরো কত ফ্যাসান এলো গেলো ওরা জানেই না।

    —রেস্টুরেন্টে একদিন খাইয়ে দাও না ছোটকা—

    —আচ্ছা, আচ্ছা, সব হবে—

    তিনটে মেয়ের মাথা একসঙ্গে ঠেকিয়ে ঠুকে দিয়ে হেসে ওঠে নিখিল।

    এই দারিদ্র্য, এই নিরাবরণ দৈন্য অসহনীয়! তাই এর বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা নিখিলের। রসাতলে যাক আভিজাত্য, টাকা চাই।….অনেক টাকা—কেরানীগিরির টাকা নয়, স্কুল-মাস্টারির টাকা নয়—অনেক বেশি টাকা। ভদ্র অভদ্র যে কোনো উপায়েই হোক— আনতেই হবে চঞ্চলা লক্ষ্মীকে পকেটে পুরে।

    কোথা দিয়ে যে কী হয়—চঞ্চলা লক্ষ্মী কোন পথ দিয়ে যে ঢুকে পড়ে আটকা পড়ে যান কে জানে।….কিছুদিন পর থেকেই চেনাশোনা বন্ধু-বান্ধব দেখে অবাক হয়ে যায় —হরদম গাড়ি চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে নিখিল।….অতি বিখ্যাত একটি হোটেলে ওর বর্তমানের ঠিকানা।

    নিখিলও যে বিলাসিতা করতে জানে তাতে আর সন্দেহ থাকে না এখন।

    গিরীন্দ্রমোহনের হুকুম অবিশ্যি ও গোড়ায় মানেনি, বাড়িতেই ছিল। হুকুম মানলো সেই দিন, যেদিন প্রতুল ওর মুখের ওপর ছুঁড়ে মারলো মেয়েদের জন্যে কেনা টিসু সিল্কের শাড়িগুলো।

    নতুন ওই শাড়িগুলো পরে ছোটকার ছবির প্রথম রজনীতে যাবার কথা ছিল ওদের। শাড়িগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে যাবার সময় প্রতুল বেশি কথা না বলে শুধু ধিক্কার দিয়ে গিয়েছিল—এতো বেহায়া মানুষ হয়! আশ্চর্য!

    সেদিন থেকে বাড়ি ছেড়ে এই হোটেলে বসবাস নিখিলের।

    লক্ষ্মী তো ধরা দিচ্ছেন, কিন্তু কী করবে নিখিল লক্ষ্মীকে নিয়ে? কত খরচা করবে একা একা?

    কি হবে টাকায়—যদি রেখা, রাণু, শিপ্রারা এখনো পুরনো শাড়ি কাটা ব্লাউস পরে? কী হবে—যদি অমল কমল স্কুলে টিফিন নিয়ে যেতে পায় না বলে অসুখের দোহাই পেড়ে মান বজায় রাখে সহপাঠীদের কাছে? রাস্তায় ছড়িয়ে ফেলে দিলেই বা ক্ষতি কী সে টাকা—যে টাকায় বিরজার সংসারের নিরুদ্দিষ্ট বামুন-চাকরকে ফিরিয়ে আনা যাবে না? আনা যাবে না একটা ডাক্তার—শয্যাশায়ী গিরীন্দ্রমোহনের জন্যে?

    সে টাকা নিয়ে কী করবে নিখিল—যদি টাকার অভাবে বিয়ে বন্ধ থাকে রাণুর, অথচ তার টাকা থেকে খরচ করা যায় না এক পয়সা?

    বাড়ি যাবার ইচ্ছেটা কি খুব প্রবল নিখিলের?

    কই, তেমন বুঝতে পারে না সে। শুধু গাড়িটা নিয়ে বেরোলেই কেমন ইচ্ছে হয় ওই পথটা চক্কর দিয়ে আসতে।….

    কী সাংঘাতিক রকমের খুশি হত রাণু, রেখা, শিপ্রারা! কী হৈ-চৈ করতো খোকন, বুলু আর টুলু নিজেদের—সত্যিকার নিজেদের—একখানা গাড়ি পেলে!

    শুধু নিজের জন্যে গাড়ির কোন দরকার হয় নাকি? দু’আনা পয়সা ফেললেই তো চলে যাওয়া যায় কলকাতার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে।

    ঘাড়-ছেঁড়া টুইলসার্ট, আর কাঁটি ওঠা স্যান্ডেলেই তো চলছিল দিব্যি।

    টিফিনের সময় অমল-কমলের স্কুলের ধারে যেতে পারলে মাঝে মাঝে খবর পাওয়া যায় বাড়ির। গিরীন্দ্রমোহন যে আর উঠতে পারেন না বিছানা থেকে, বিরজার চোখে ছানি পড়েছে, অজয় বৌ ছেলে নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে বাস করছে কিছুকাল থেকে, আর অখিলের বৌ শোবার ঘরের বারান্দায় তোলা উনুন পেতে আলাদা রান্না করে নিজেরা কয়জন খায়—এ সবই কমলের মুখে শোনা। অমল চোখ পাকিয়ে শাসালেও বলে ফেলে কমল।

    মাঝে মাঝে সময় পেলেই ওই স্কুলের কাছটায় যাবার ইচ্ছেটা কেমন দুর্দমনীয় হয়ে ওঠে—দেশী বিদেশী খাদ্যবস্তুর বেশ একটু সংগ্রহ নিয়ে।

    অমল-কমল আগে নিতে চাইত না, এখন নেয়।

    আজ লোলুপ দৃষ্টিতে খাবারগুলোর দিকে তাকিয়ে একটা চিঠি দিলে কমল—মা দিয়েছেন।

    —মা? তোর মা?

    —হাঁ।

    খুলে পড়লে, ছোট্ট চিঠি—সময় লাগবার কিছু নেই। নিখিলকে একবার যেতে লিখেছেন বৌদি। বিশেষ নাকি প্রয়োজন। শেষের দিকে মাথার দিব্যও দিয়েছেন।

    অনেক ভেবে ভেবে গিয়ে হাজির হল পরদিনই। দোরের কাছ থেকেই বড়বৌ ছুটে এসে ওর হাত ধরলো—কি ভাই, বড়মানুষ হলে কী এমনি করেই মায়া কাটাতে হয়? কেউ মরে গেলেও একদিন খোঁজ নিতে ইচ্ছে হয় না?

    অবাক ছাড়া আর কী হবে নিখিল?

    —কিন্তু—কি যেন বললেন?

    —বলবো আর কি। কতো কথাই তো বলার আছে। লোকমুখে শুনি দিনরাত গাড়ি চড়ে বেড়াও, দামী সুট ছাড়া পরো না, পাঁচ-সাতশো টাকা হোটেলে খরচা করো— ওই কানেই শুনি।

    এবারে একটু হাসলো নিখিল, হয়তো কঠিনই একটু।

    —শুনতে হলে তো কান দিয়েই শুনতে হয় বৌদি!

    —তাই বলে একেবারে পর করে দেওয়া! যাকগে ভাই, আসল কথাই বলি—রাণুর একটা ভালো বিয়ের সম্বন্ধ হয়েছে—

    —হয়েছে? ভালোই। আমার নামটাম শুনে ফেলেনি তো তারা? তাহলেই হয়তো ভেস্তে যাবে।

    —বোকো না। বরং সে ছেলে নাকি তোমার ভীষণ ভক্ত। কিন্তু আসল কথা হচ্ছে, পাত্রপক্ষের বড্ডো ‘খাঁই’। ছ-সাত হাজারের কমে কিছুতেই হবে না।

    নিখিল একটা বোকার মতো প্রশ্ন করে বসলো—তাহলে আর কী করে হবে?

    —সেই তো কথা! ভরসা ছিল বাড়িটা, এখন শুনছি এ বাড়ি কোনকালে নাকি দেনার দায়ে ‘ও কর্ম্ম’ হয়ে আছে। ভাড়া দিয়ে থাকতে হয়। শুনে কী বিনামেঘে বজ্রাঘাত হল ভাবো?

    বজ্রাঘাত কি নিখিলেরও হল নাকি, নইলে অমন স্তব্ধ হয়ে গেলো কেন! কিছুই যে বলছে না!

    বড়বৌ ওর একটা হাত ছেড়ে দুটো হাত ধরলো, বললো এখন তুমিই ভাই ভরসা!

    —আমি?….আমি কী করতে পারি?

    আস্তে আস্তে হাত দুটো ছাড়িয়ে নিলো নিখিল।

    —ইচ্ছে করলে সবই পার ভাই, পাঁচ-সাত হাজার তো শুনেছি এখন কিছুই নয় তোমার কাছে।

    হঠাৎ হেসে উঠল নিখিল—কিন্তু আমি কেন দেবো?

    —তুমি কাকা…….মেয়েটার যদি একটা হিল্লে হয়, সেটুকু করবে না? তোমার দাদা অনেক আশা করে চিঠিটা লিখতে বললেন।

    কে জানে নিখিলই কি পাগল হল? তাই স্বচ্ছন্দে বললো, পাগল হয়েছেন? …. পাঁচ সাত হাজার টাকা কি খোলামকুচি? আছে বলেই দিতে হবে?

    সর্পাহত বড়বৌ অনেক কষ্টে একটা ক্ষীণ প্রশ্ন করলো—চলে যাচ্ছো?—দেখা করবে না কারুর সঙ্গে?

    —কী দরকার?

    ঝট করে নেমে গিয়ে গাড়িতে স্টার্ট দিলো নিখিল।

    ওপরের জানালার দিকে তাকালে না সাহস করে।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleসেপিয়েন্স: এ ব্রিফ হিস্টোরি অফ হিউম্যানকাইন্ড – ইউভাল নোয়া হারারি
    Next Article ১০টি কিশোর উপন্যাস – আশাপূর্ণা দেবী

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }