Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    আশাপূর্ণা দেবী – সাহিত্যের সেরা গল্প

    লেখক এক পাতা গল্প213 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    তাসের ঘর – আশাপূর্ণা দেবী

    তাসের ঘর

    কথাটা তুলিল তরঙ্গিণী সকালবেলা কুটনো কুটিতে বসিয়া। মমতা জ্বলন্ত উনানে হাঁড়ি চাপাইয়া ছুটিয়া আসিয়া কহিল, চাল ধোওয়ার গামলাটা নিয়ে কুটনো কুটতে বসেছো ঠাকুরঝি! দাও দিকি চট করে।

    ঠাকুরঝি কথাটায় কান না দিয়া আঙ্গুলের আগায় থোড়ের সুতা জড়াইতে জড়াইতে কহিল—দাদা কাল কত রাতে বাড়ি এল বৌ?

    মমতা থমকিয়া কহিল, কই কাল তো আসেননি ভাই। বিয়ে বাড়ির হাঙ্গামে খেয়ে দেয়ে ন’টার গাড়ি ধরা কি সহজ? ভোরের দিকে একটা ট্রেন আছে বলছিলেন, তাতেই বোধ হয়—

    তরঙ্গিণী চোখে মুখে বিস্ময় ফুটাইয়া বলিল—দাদা আসেন নি কাল? বল কি বৌ! আমি যে নিজের কানে শুনলাম—

    কী শুনলে?

    ভারী ভারী গলার আওয়াজ, ভাবলাম ঠাণ্ডা লেগে গলা বসে গেছে বোধ হয়। রাত তখন দুটো আড়াইটে হবে, ফিরে গিয়ে হিমিকে বললাম ‘তোর বাবা বোধ হয় বাড়ি এল—নারে হিমি?’

    মমতার বড় মেয়ে হিমানী কাছে বসিয়া হেঁট মুখে শাক বাছিতেছিল, পিসির কথার উত্তরে সাড়াও দিল না, মুখও তুলিল না।

    তাহার পানে এক নজর চাহিয়া অল্প বিরক্তভাবে মমতা বলিল, আজগুবি গল্পগুলো পরে হবে, এখন দাও তো গামলাটা, ভাতের জল ফুটে গেল।

    ভাত সম্বন্ধে উদ্বেগ প্রকাশ না করিয়া তরঙ্গিণী না-ছোড়ভাবে কহিল, তা ছাড়া পষ্ট দেখলাম যে বৌ, ভবানীর ঘরের দেওয়ালে তোমার জানালা থেকে ছায়া পড়েছে; দুজন মানুষের ছায়া—নারে হিমি? ও, ও উঠলো কিনা জল খেতে।

    বারে বারে কন্যাকে সাক্ষ্য মানায় মমতার হঠাৎ খেয়াল হইল তরঙ্গিণীর ইহা নিছক কৌতূহল মাত্র নয়, খুঁচাইয়া জেরা করিবার মত। রাগে আপাদমস্তক জ্বলিয়া যায়।

    তবে বোধ করি ভূত দেখে থাকবে ঠাকুরঝি—দেখো রাম নামের মাদুলীটা হারিও না যেন—বলিয়া কঠিন মুখে রুষ্ট হাসি হাসিয়া গামলাখানা উঠাইয়া লইয়া গেল।

    তখনকার মত কথাটা ওইখানেই চাপা পড়িল। সন্দেহ ভঞ্জন করিয়া গেলে হয় তো গোল মিটিয়া যাইত, কিন্তু কথাটা ‘পাঁচ কান’ করিবার ইচ্ছা মমতার ছিল না। তরঙ্গিণীকে বলা আর ‘দৈনিক আনন্দবাজার’-এ ছাপাইয়া দেওয়ার মধ্যে বড় বিশেষ প্রভেদ নাই। সময়ই বা কোথা? সেজ দেওর আটটায় ভাত খায়, হিমুর স্কুলের ‘বাস’ আসে সাড়ে আটটায়। তাহার পর, পরে পরে চলিতে থাকে, সাড়ে দশটা পর্যন্ত নিঃশ্বাস ফেলিবার অবকাশ থাকে না।

    স্কুলের ছেলে কয়টাকে চালান করিয়া দিয়া তবে ছুটি, তখন দুই দণ্ড পা মেলিয়া বসিয়া, চা খাওয়া, জল খাওয়া, গল্পগাছা করা চলিতে পারে।

    প্রায় নয়টার সময় তরঙ্গিণীর দাদা সুধাংশু আসিয়া পৌঁছিল।

    পকেট হইতে এক তাড়া ‘প্রীতিউপহার’ বাহির করিয়া ভগ্নির দিকে ছুঁড়িয়া দিয়া কহিল, তরু, দে তো একটু তেল, নেয়ে নিই। খাওয়া আর হচ্ছে না—যাক দরকারও নেই, যা সাংঘাতিক রাত হল কাল বাপস! ভদ্রলোকে যায় রেলের রাস্তায় নেমন্তন্নে? রাম বলো। কই গামছা?

    আধ মিনিটে স্নান সারিয়া উপরে উঠিয়াই হাঁক পাড়িল—আমার কাপড় কোথা গেল? খোকা—বল তো আমার কাপড় কই?

    মমতা রান্নাঘর হইতে মুখ বাড়াইয়া বলিল, খোকন, বল তো আনলাতেই তো আছে সরু মুগাপাড় ধুতিখানা—যা ব্যস্তবাগীশ মানুষ, দেখতে পেলে হয়।

    লোভ হইল এই ছুতায় উঠিয়া গেলে হয় একবার, প্রায় আঠার উনিশ ঘণ্টা দেখা নাই, বিরহ লাগে বৈকি। কিন্তু লজ্জা করে, অল্প বয়সের চাইতে এখন বেশি বয়সের লজ্জার বাধা আরো দুর্লঙ্ঘ্য।

    সুধাংশু অবশ্য ততক্ষণে আর একখানা কাপড় সংগ্রহ করিয়া নামিয়া আসিয়াছে।

    অতঃপর আর আধ মিনিট ভাতের থালার সামনে একবার বসিয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়!

    কিন্তু বিধাতাপুরুষ ব্যক্তিটি রসিক। এই শান্তিপূর্ণ নিরীহ সংসারটির স্বচ্ছন্দ জীবনযাত্রার উপর কটাক্ষপাত করিয়া তাঁহার সহসা বোধকরি রহস্য প্রবৃত্তি জাগিয়া উঠিল—

    মমতার ছোটবোনের ভাসুরপো নিমাই ম্লানমুখে আসিয়া কহিল, বড়ো মাসীমা, মা বললেন আপনাকে এখুনি একবার যেতে—খুড়িমার বড্ড কষ্ট হচ্ছে।

    মমতা হাতের কাজ ফেলিয়া ছুটিয়া আসিয়া কহিল, তাই নাকি! কখন থেকে রে নিমাই? খুব বুঝি বেশি কষ্ট হচ্ছে?

    হুঁ বোধহয়। মা পাঠিয়ে দিলেন আপনাকে নিয়ে যেতে।

    মমতার ছোট বোন সবিতার শ্বশুরবাড়ি এবাড়ি হইতে অধিক দূর নয়। তাহার বড় জা ভীরু স্বভাবের লোক, আগেই বলা ছিল সবিতার প্রসবকালে মমতাকে লইয়া যাইবেন।

    ভিজা হাত গামছায় মুছিতে মুছিতে মমতা বলিল, তাহলে একখানা রিকশ ডাক না বাবা।

    ছোটকাকা গাড়ি নিয়ে এসেছেন যে! আপনাকে নিয়ে গিয়ে ডাক্তার বাড়ি যাবেন। নিন তাড়াতাড়ি।

    মমতা তরঙ্গিণীকে ডাকিয়া কহিল, তাহলে তুমি একবার এদিকে এসো ঠাকুরঝি, সবই হয়ে গেছে, মোটা চালের ভাতটা হবে শুধু, আর চচ্চড়িটা চড়ান রইল, নামিও। মা বোধহয় আহ্নিকে বসেছেন, বোলো ব্যাপারটা……কখন ফিরতে পারি বলা যায় না। ভালয় ভালয় যাতে হয় তাই বল….কইরে নিমাই চল বাবা, দুর্গা! দুর্গা!

    তরঙ্গিণী ভ্রাতৃবধূর গমনপথের পানে তীব্র দৃষ্টি হানিয়া অস্ফুট সুরে মন্তব্য করিল, ‘ঢলানি!’

    অথচ কয়েক ঘণ্টা পূর্বে তরঙ্গিণী এমন উক্তি মুখে আনিবার কথা স্বপ্নেও ভাবিতে পারিত না।

    বিজলী ছেলের দুধের বাটি লইতে আসিয়া রান্নাঘরে তরঙ্গিণীকে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিল, বড়দি কোথা গেলেন ঠাকুরঝি।

    ঠাকুরঝি নিজের জন্য ও মায়ের জন্য দুইটি বড় পাথরের গ্লাসে চা ছাঁকিতেছিলেন, মুখ না তুলিয়া কহিলেন—

    এ সংসারে কে কখন আসে যায়, সব খবর তো রাখা দায় মেজবৌ! রাখলেও বিপদ।

    ‘ভূত দেখার’ উপহাসটা তখনো হজম হয় নাই।

    বিজলী কথাটার তাৎপর্য না বুঝিলেও দাঁড়াইবার সময় ছিল না, ছেলে কাঁদিতেছে।

    সুশীলাবালা আহ্নিকপূজা সারিয়া এতক্ষণে নীচে নামিলেন, তৃষ্ণার্তের মত পাথরের গ্লাসের কাছে বসিয়া পড়িয়া কহিলেন, বড়বৌমাকে দেখছিনে কেন তরি!

    বাবা, তোমার বড়বৌমার হিসেব দিতে দিতে গেলাম। বোনাই-বাড়ি গিয়েছেন গো, বুনের দেওর আদর করে গাড়ি করে নিয়ে গেলেন।

    সুশীলাবালার নাকি মেয়ের চাইতে বৌয়ের উপর টানটা অধিক, এমনি একটা বদনাম ছিল; বিশেষ করিয়া বড়বৌমাকে যে অত্যন্ত সুনজরে দেখিতেন একথা মিথ্যা নয়।

    শুধু তিনি বলিয়াই নয়—সদা হাস্যমুখী, নিরলস, কর্তব্যপরায়ণা বধূটিরও যেমন গুণের সীমা ছিল না, তেমনই ঘরে পরে এমন কেহ ছিল না যে, তাহাকে ভাল না বাসিয়া থাকিতে পারে।

    হাসিয়া গল্প করিতে, যত্ন করিয়া খাওয়াইতে, রোগের সেবা করিতে, তাহার জুড়ি ছিল না। লজ্জা সরমের হয়তো একটু কমতি ছিল, কিন্তু তাহার সরল নিঃসঙ্কোচ ব্যবহারের কাছে ‘বেহায়া’ নামটা ঘেঁষিতে সাহস পাইত না।

    কন্যার রাগে হাসিয়া ফেলিয়া সুশীলাবালা প্রশ্ন করিলেন—তোর তাই হিংসা হচ্ছে না? বোনের ব্যথা উঠেছে বুঝি? আহা তা যাবে বই কি, কথায় বলে—মা বোন। মা নেই, কাছের গোড়ায় বোন রয়েছে, যাবে না?

    তবে আর কি, ধেই ধেই করে ছুটতে হবে যার তার সঙ্গে, তোমার আস্কারাতেই তো গোল্লায় গেল। বুকের পাটা কত।

    খালি গ্লাসটা নামাইয়া একটা তৃপ্তির নিঃশ্বাসের সঙ্গে মা বলিলেন—অমন কথা বলিসনে তরু, বৌমা আমার লক্ষ্মী।

    কাজ নেই অমন লক্ষ্মীতে, লক্ষ্মীর গুণ জানলে আর—তরঙ্গিণী মুখখানা বাঁকাইল।

    অতঃপর ‘গুণ জানাজানি’ হইয়া গেল, সারাদিন ধরিয়া অপরাধিনীর অনুপস্থিতির সুযোগে বাড়িতে আলোচনার ঝড় বহিতে থাকিল। এবং বিজলী ভিন্ন প্রায় প্রত্যেকেই বিশ্বাস করিতে কষ্ট হইলেও করিতে দ্বিধাবোধ করিল না, বড়বৌয়ের স্বভাব চরিত্র সন্দেহজনক। দুর্ভাগ্যবশতঃ এমন অকাট্য প্রমাণ পাওয়া গেল যাহার উপর আর কথা চলে না।

    আঠার বৎসর যাবৎ মমতা যে শ্রদ্ধা-ভক্তি, ভালবাসা, সুনাম অর্জন করিয়া আসিতেছে, মুহূর্তের অবিবেচনায় তাহার ভরাডুবি করিয়া বসিল।

    হিমাংশু বৌকে সাবধান করিতেছিল—’দিদি, দিদি’, করে অত গলে পড়া চলবে না, বুঝলে? উনি যদি সাবধান না হন অগত্যা আমাকেই পথ দেখতে হবে।

    বিজলী উত্তেজিত হইয়া বলিল, মাগো তোমরা বাড়িশুদ্ধ সব পাগল হয়ে গেলে নাকি? এই কথা বিশ্বাস করতে প্রবৃত্তি হচ্ছে?

    প্রবৃত্তি হয় না-ই বটে, তবে মেয়েমানুষকে বিশ্বাসও নেই।

    বিজলীর মুখ রাঙা হইয়া উঠিল—তবে আমাকেও ঘাড় ধরে বিদেয় করে দাও না—বিশ্বাস কি, মেয়েমানুষ বৈতো নয়।

    দরকার হলে তাও পারি, আমি দাদা নই।

    অতিমাত্রায় পত্নীপ্রেমিক বলিয়া সুধাংশুর বরাবরই একটু অখ্যাতি ছিল।

    বিজলী বিরক্তি গোপন করিতে পারিল না, কহিল—দাদার মতন হলে তরে যেতে। সে যাক, তোমার বোনটিও তো মেয়ে বই পুরুষ নয়, বিশ্বাস কী? যদি মিথ্যে করে বলে থাকে?

    লাভ তার?

    দিদির ওপর ওর চিরকাল হিংসে।

    কাপড়জামাগুলো হিংসে করে কুড়িয়ে এনেছে বোধ করি?

    বিজলীর আর উত্তর জোগায় না।

    রহস্যই বটে।

    সবিতারও আক্কেল দেখ, আজিকার দিন ছাড়া আর দিন পাইল না। দিদি থাকিলে বিজলী কাঁদিয়া পায়ে ধরিয়া রহস্যের মূলসূত্র বাহির করিয়া ছাড়িত। কিন্তু তাহা হইবার নয়। যিনি জট পাকাইবার তিনি বসিয়া বসিয়া পাকাইতেছেন। কে ছাড়াইবে!

    সুশীলাবালা কপালে করাঘাত করিয়া কহিলেন—আমি তখনি জানি ও মেয়ে একদিন কি সর্বনাশ ঘটাবে। মেয়েমানুষ অত বাচাল! মাথার কাপড় ফেলে রাজ্যির লোকের সঙ্গে পাটি পেড়ে গল্প, ‘হ্যা হ্যা’ করে হাসি, কে বা জানে আপন, কে বা জানে পর। যে আসছে তাকেই চা খাওয়ান, জল খাওয়ান, আদর উথলে পড়ে। মেয়েমানুষ অত লোকমজানে হওয়া কি আর সুলক্ষণ?

    মমতার ছেলেটার অনেক ভাগ্য তাই ম্যাট্রিক একজামিন দিয়া বড় পিসীর বাড়ি বেড়াইতে গিয়াছে। হিমানীর সম্মুখে কেহ ‘রাখিয়া ঢাকিয়া’ বলিবার প্রয়োজন বিবেচনা করিল না।

    যাহাকে লইয়া এই তুমুল আন্দোলন, সে বেচারী সারাদিন দুশ্চিন্তায় অনাহারে যমে-মানুষে টানাটানি করিবার পর শিশু ও প্রসূতিকে নার্সের হেফাজতে রাখিয়া গঙ্গাস্নানান্তে যখন বাড়ি ফিরিল রাত্রি তখন অনেকটাই হইয়াছে।

    স্নানান্তে উহাদের বাড়ি হইতে আহার করিয়া তবে ফিরিবার কথা ছিল, ফিরিবার পথে মমতাই জোর করিয়া বাড়ির দুয়ারে নামিয়া পড়িয়াছে। স্বামীর উপর সূক্ষ্ম একটু অভিমানের সহিত উৎকণ্ঠাও জাগিতেছিল। নিশ্চিত জানিত সুধাংশু আসিয়া খবরটা শুনিলে, সবিতার বাড়ি ছুটিবে! কী জানি, গত রাত্রের অনিয়মে শরীর ভাল আছে কিনা!

    সবিতার সেই ছোট দেওর পৌঁছাইতে আসিয়াছিল, হাসিয়া কহিল—দেখছেন তো মমতাদি, বাড়িতে আপনাকে কারুরই দরকার নেই। সকলেই খেয়েদেয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমোচ্ছে। বেশ হয়েছে, খেতে পাবেন না। সারাদিন জলস্পর্শ করলেন না—বৌদি ভারী দুঃখিত হবেন কিন্তু।

    রাগ দুঃখু করতে মানা কোরো ভাই, আমি একদিন গিয়ে চেয়ে খেয়ে আসবো, সবু ভাল হোক।

    বাড়ির চাকর আসিয়া দুয়ার খুলিয়া দিতেই নজর পড়িল বাহিরের ঘরে কে ক্যাম্প খাট পাতিয়া শুইয়া আছে। বিস্মিত হইয়া কহিল—শুয়ে কে রে সুবোধ?

    আজ্ঞে বড়বাবু।

    বড়বাবু! সেকি নীচে কেন রে?

    কেন তাহা সুবোধও জানে না, বিছানা নামাইয়া আনার হুকুম তামিল করিয়াছে মাত্র। বুদ্ধি খাটাইয়া কহিল—আপনি আসবেন বলে বোধ হয়।

    মর মুখপোড়া—মৃদু হাসিয়া ভিজা কাপড়খানা চাকরের হাতে দিয়া মমতা ঘরে ঢুকিল। অন্ধকারে আন্দাজি শায়িত ব্যক্তির পিঠে হাত রাখিয়া বলিল, আশা ছেড়ে দিয়ে বসে আছো বুঝি? সেই জোগাড়ই হয়ে উঠেছিল আর কি—আসতে দেবে না কিছুতে। আমার তো আবার জানই, রাত্তিরে বুড়োটিকে ছেড়ে থাকতে পারিনে—লোকের ঠাট্টা তামাশায় কান না দিয়ে চলেই এলাম।

    সুধাংশু পিঠটা সরাইয়া লইল মাত্র, কথা কহিল না।

    মমতা ঈষৎ ঝুঁকিয়া পড়িয়া কহিল, বুড়ো বয়সে অভিমান তো কম নয়! হয়েছে, ওঠ। একবার গেলে না ও বাড়ি—কী কষ্টই পেলে ‘সবিটা’—হলেন তো এক মেয়ের ‘ঢিপি’—ভোগান্তির একশেষ।

    এত কথার একটিও উত্তর না পাইয়া বিস্মিত মমতা বিছানার একপ্রান্তে বসিয়া স্বামীর হাতখানা কোলের উপর টানিয়া লইয়া সস্নেহস্বরে বলিল, কি হয়েছে গো, শরীর ভাল নেই?

    বিরক্ত কোরো না, বাড়ির ভিতর যাও। হাত ছাড়াইয়া পিছন ফিরিয়া শুইল সুধাংশু।

    মমতা আহত হইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। এত রাগের কারণ কি! আপনার লোকের বিপদে আপদে মানুষ যাইতে পাইবে না নাকি?

    কিন্তু এ সব মান অভিমানের পালা লোকচক্ষে প্রকাশ করিয়া এ বয়সে খেলো হইবার মত স্বভাব তো স্বামীর নয়। ব্যাপার কি? আরো কোমল অনুনয়ের স্বরে কহিল, যাচ্ছি, কিন্তু তুমি সত্যই এখানে শোবে না কি? ওঠ ঘরে চল।

    ওঘরে ঢোকবার প্রবৃত্তি আমার নেই, তোমার সঙ্গে কথা কইবারও নয়, যাও সরে যাও।

    অনাহারক্লিষ্ট শ্রান্ত শরীরে স্বামীর এরূপ অভূতপূর্ব নিষ্ঠুর আচরণে মমতার চোখে জল আসিল, ধরা পড়িতে না দিয়া কহিল, অপরাধটা শুনতে পাই না?

    অপরাধের প্রমাণ ঘরে পুষে রেখে যে ন্যাকামির ভান করে, তার সঙ্গে তর্ক করবার রুচি আমার নেই। চালাকী শিখেছিলে বটে, তবে শেষরক্ষা হল না।

    মমতার এতক্ষণে মনে হইল—তরঙ্গিণীর সকালবেলার জেরার সহিত ইহার সংযোগ থাকিতেও পারে। কিন্তু—ছিঃ-ছিঃ! মাতালের মত টলিতে টলিতে উঠিয়া অপরাধের প্রমাণ খুঁজিতে হঠাৎ চোখে পড়িল খাটের পাশে একখানা কাদামাখা অর্ধমলিন খদ্দরের ধুতি ও তদনুরূপ একটি পাঞ্জাবি জড় হইয়া পড়িয়া আছে। ….ব্যাধতাড়িত পশুর মত পুলিশের তাড়া খাইয়া যে ছেলেটা গতরাত্রে কয়েক ঘণ্টার জন্য এঘরে আশ্রয় লইয়াছিল, সে যে নিজেকে নিরাপদ করিতে এক ফাঁকে পরিচ্ছদগুলো বদলাইয়া লইয়াছিল সেই খবরটাই মমতার জানা ছিল না। হয়তো যখন বাহির করিয়া দিবার আগে কেহ জাগিয়া আছে কিনা দেখিতে গিয়াছিল—

    স্তব্ধ অনড় মমতার কেমন করিয়া যে বসিয়া বসিয়া রাত্রি কাটিয়া গেল সে কেবল তিনিই জানিলেন, যিনি অলক্ষ্যে বসিয়া সকলের সুখ-দুঃখের হিসাব লইতেছেন।

    রুদ্ধশ্বাস বিজলী শুনিতে শুনিতে চমকিয়া বলিল, বল কি দিদি, তোমার মামাতো ভাই! বোমার মামলার সেই নিখিলেশ! জেল ভেঙে পালিয়ে এসেছে?

    হ্যাঁ।

    বিজলী বড়জাকে দুইহাতে জড়াইয়া ধরিয়া কাঁদিয়া উঠিল—কেন তুমি চুপ করে থাকবে দিদি, কেন সবাইকে বলবে না বুঝিয়ে? শুধু শুধু নিজেকে শাস্তি দেবে?

    মমতা শুষ্ক হাসি হাসিল, সে কাল হলে বলতাম মেজবৌ, আজ আর হয় না।

    কেন হয় না দিদি, ধর্ম কি নেই? এই অবিচারটা স্বচ্ছন্দে চলে যাবে?

    তবে চল তোকে উকিল খাড়া করে, করজোড়ে ন্যায় বিচারের প্রার্থনা করিগে।

    এত দুঃখেও ঠাট্টা-তামাশা আসে দিদি? ধন্যি বটে, ভূতেই পেয়েছে তোমায়, বিনা প্রতিবাদে এই মিথ্যেটা মেনে নেওয়াই কি বুদ্ধির কাজ হল?

    কোনটা সত্যি, কোনটা মিথ্যে, বুদ্ধি দিয়ে বিচার করা সব সময় সহজ নয় মেজবৌ। এতদিন যাকে পরম সত্য বলে জেনে এসেছি, দেখছি কি মিথ্যেই সেটা! আজ যদি মিথ্যেটাই সত্যি হয়ে দাঁড়ায় ক্ষতি কি?

    ক্ষতি তোমার মুণ্ডু—হিমুর মা তুমি বিনি দোষে এই অপমানটা সইবে?

    অপমান যা হয় তা আর ফেরে না বিজলী, কি বোঝাব ওদের? যদি বলে, ”বিপদে পড়ে এখন একটা গল্প রচনা করে এলে,” সে অপমান সইবে না।

    বিজলী বোকা, বিজলী অবুঝ, চোখের জল তাহার সস্তা। বলে, তাই কি হয়?

    কিন্তু হইবে না কেন, আঠার বছর ঘর করার পর মমতা সম্বন্ধে যাহাদের একথা বিশ্বাস করিতে বাধে নাই, ওটুকু তাদের কাছে খুব বেশি কি?

    যে হতভাগ্য ছেলেটা দুইদণ্ড আশ্রয় লইতে আসিয়া তাহার চিরদিনের আশ্রয় ভাঙিয়া দিয়া গেল, বিজলীর মত মমতা তাহার উপর রাগ করিতে পারে না।

    যে ভঙ্গুর ঘরখানা নিয়তির একটি ফুৎকারে ধূলি গুঁড়ি হইয়া গিয়াছে, তাহার উপর মমতার আর মমতা নাই।

    যাইবার বেলায় সুধাংশু বলিয়াছিল, এরকম ভাবে চলে গেলে আমাদের মান সম্ভ্রম কোথায় থাকবে বুঝতে পারছো?

    মমতা উত্তর করিয়াছিল—পারছি, কিন্তু ও জিনিসটা যে শুধু তোমাদের একলারই নেই, সেটাও ভুলতে পারছি না।

    মেয়ের বিয়ে দেওয়া দায় হবে তা জানো?

    হয়তো হবে—কিন্তু আমার নয়। এ সংসারের উপর আমার আর কোনো দায় নেই।

    মানুষের মন কঠিন হইলেও দুর্বল বই কি! সুধাংশুর চোখে জল আসিতে চায় কেন?

    কোথায় যাবে ঠিক করেছ মমতা?

    মমতা তাকায় নাই, মুখ ফিরাইয়া বলিয়াছিল, ঠিক কিছুই করিনি। এত বড় পৃথিবীটায় একটা মেয়েমানুষের ঠাঁই হয় কিনা সেটাই একবার দেখবো ঠিক করেছি।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleসেপিয়েন্স: এ ব্রিফ হিস্টোরি অফ হিউম্যানকাইন্ড – ইউভাল নোয়া হারারি
    Next Article ১০টি কিশোর উপন্যাস – আশাপূর্ণা দেবী

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }