Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    আশাপূর্ণা দেবী – সাহিত্যের সেরা গল্প

    লেখক এক পাতা গল্প213 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ক্যাকটাস – আশাপূর্ণা দেবী

    ক্যাকটাস

    বড় বেশি প্রয়োজনের সময় অপ্রত্যাশিতভাবে সেই প্রয়োজনীয় বস্তুটি হাতে এসে পড়া মানুষের ভাগ্যে দৈবাৎই ঘটে।

    ভারতীর ভাগ্যে হঠাৎ সেই দৈবদুর্লভ ঘটনাটা ঘটে গেল। খবরটা পেয়ে ভারতী ভাগ্যের এই অযাচিত করুণায় আহ্লাদে যেন দিশেহারা হয়ে গেল।

    আর ওই খবরের পর বাকি যতক্ষণ কলেজের কাজে আটকে থাকতে হলো তাকে, ততক্ষণ সব কাজের মধ্যে পরিকল্পনা চলতে লাগলো তার কোন ভাষায় আর কোন ভঙ্গিতে খবরটা পরিবেশন করবে গিয়ে শিশিরের কাছে।

    কতক্ষণে করবে।

    সত্যি বাড়ির চিন্তায় যখন অস্থির হয়ে যাচ্ছে ভারতীরা, নিত্যনতুন অপমানের জ্বালায়, গ্লানি ও তিক্ততায় মন ভরে উঠেছে, স্বামী-স্ত্রী দুজনের প্রতিটি ছুটির বারের কাজ হয়েছে বাড়ি দেখতে বেরোনো, এবং খবরের কাগজ খুলে সর্বপ্রথম পঠিতব্য বিষয় হয়েছে ‘বাড়ি ও জমি’র ‘কলাম’, সেই হেন সময় খবরটা যেন বিধাতার হাতের আশীর্বাদী ফুলের মতো।

    অবশ্য ‘গৃহসমস্যা’ তাদের হবার কথা নয়, কারণ যে বাড়িটিতে ভাড়া আছে তারা, সে বাড়িটি অনেকাংশেই সুবিধাজনক। কিন্তু কিছুদিন থেকে বাড়িওয়ালারা আর ভারতীদের সুবিধাজনক মনে করছে না।

    নিত্যবর্ধিত বাড়িভাড়ার আকাশছোঁওয়া উচ্চহারের খবরে খবরে ওদের মেজাজও আকাশে চড়েছে এই অনেক দিনের ভাড়াটেদের উপর।

    অনেক দিনেরই।

    ভারতীয় তখনও বিয়ে হয়নি, সেই আমল থেকে এবাড়িতে আছে শিশিররা, বিয়ে হয়ে এই বাড়িতেই বৌ সাজে এসে ঢুকেছে ভারতী। দেখেছে একতলায় বাড়িওয়ালা, দোতলায় শিশিররা। কিন্তু ‘বাড়িওয়ালা’ মাত্র নয়, নিতান্ত আত্মীয়ের মতোই।

    শিশিরের মায়ের সঙ্গে বাড়িওয়ালা গৃহিণীর হৃদ্যতার শেষ ছিল না। শিশিরের মায়ের মৃত্যু হলে, তিনিই মা-মাসির মতো ওদের দেখেছেন, যত্ন করেছেন, ‘বৌমা বৌমা’ করে পাঁচবার খোঁজ নিয়েছেন। সুখে-দুঃখে একজন অভিভাবকের মতোই ছিলেন ওঁরা এদের।

    কিন্তু কালের গতিকে, সেই ‘নিকটাত্মীয়ই’ অনাত্মীয়ের ভূমিকা অভিনয় করছেন। একসঙ্গে দু’দুটো তোলা উনুন জ্বেলে দিচ্ছেন ভারতীর শোবার ঘরের জানলা লক্ষ্য করে, রাত ন’টা বাজতে না বাজতেই সদর দরজায় তালাচাবি মেরে দিচ্ছেন, ভারতীদের কাপড়-জামা দোতলার বারান্দায় শুকোতে দেওয়া দেখলে ‘মাথায় ঠেকছে’ বলে তারস্বরে আপত্তি জানাচ্ছেন, ভারতীর ছেলের হাতের রবারের বলটা ছিটকে নিচের উঠোনে পড়লে সরাসরি রাস্তায় ফেলে দিচ্ছেন। এবং যখন তখন ভারতীদের কর্ণকুহর ‘তাক’ করে একে ওকে তাকে উপদেশ দিচ্ছেন, ‘আর যা কর তা কর ভাই, মরে গেলেও কখনো বাড়িতে ভাড়াটে বসিও না। ও এমন সর্বনেশে জাত নয়, একবার গেড়ে বসলে জীবনে আর উঠবে না। পুরুষানুক্রমে রয়ে যাবে।’ এমনি আরো অনেক কিছু।

    ভাড়াটে বিতাড়ন কাণ্ডের কর্মসূচী অনুযায়ী যা যা করণীয়, তার সবটাই প্রায় করছেন ওঁরা, যা ভারতী বা শিশিরের কাছে মরণতুল্য।

    বিশেষ করে ‘শুনিয়ে বলা’ কথাগুলো বড় দুষ্পাচ্য। কর্মগত অপমানের চাইতে, বাক্যগত অপমানটাই যেন অধিক মর্মবিদারী। অথচ তার মাত্রাটা ক্রমশ বেড়েই চলেছে।

    কারণটা বোধ করি ওই জগৎ ব্রহ্মাণ্ডের সর্ববিধ মূল্যমান প্রতিনিয়ত বেড়ে চলা। গত সপ্তাহের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখা গেছে ‘দুইখানি ঘর ও রান্না ঘর, বাথরুম, দুইশত পঞ্চাশ—’ এ সপ্তাহে সেই বস্তুই ‘তিনশত পঁচিশ—’ পরবর্তী সপ্তাহে বোধ করি—তা সে যাক, মোটকথা, বরাবরের বন্ধু হঠাৎ শত্রুপক্ষ হয়ে দাঁড়ালে দুঃখের শেষ থাকে না। আর সে শত্রুর মতো নির্লজ্জ হতে বোধকরি চিরশত্রুও পারে না।

    এই আজই সকালে হয়ে গেছে একপালা।

    দোতলায় ঘণ্টু কী সূত্রে একটু বেশি দাপাদাপি করে ফেলেছিল, হঠাৎ নীচতলা থেকে গিন্নী কণ্ঠে মধু মেখে বলে উঠলেন, ‘বৌমা, অ বৌমা ছেলেকে একটু সামাল দাও মা, গরীবের জীর্ণ বাড়িখানা যে গুঁড়ো হয়ে গেল। ইহজীবনে খালিও তো পাব না কোনোদিন যে একবার মেরামত করিয়ে একটু শক্ত করে নেব।’

    ভারতীর তখন কলেজে আসবার সময়, কথা বাড়াল না। পারতপক্ষে বাড়ায়ও না। শুধু বছর আষ্টেকের ছেলেটাকেই করুণ মিনতি জানিয়ে এলো দাপাদাপি না করতে।

    কিন্তু আজ ঘণ্টুর স্কুলের কিসের যেন ছুটি, অথচ মা-বাবার ছুটি নেই, এহেন সুবর্ণ সুযোগ তার কিছু আর বেশি আসে না। অতএব ঘণ্টু যে মার মিনতি অগ্রাহ্য করে এবং ঝিকে থোড়াই কেয়ার করে যথেচ্ছাচার করে বেড়াবে সারাদিন, তাতে আর সন্দেহ কি!

    কে জানে গিয়ে কী পরিস্থিতি দেখবে ভারতী।

    আর আগে আগে? যখন ঘণ্টু আরো ছোট ছিল? ওই ওঁরাই ঘণ্টুকে সারাদিন নিজেদের কাছে রেখেছেন, নাইয়েছেন, খাইয়েছেন, ঘুম পাড়িয়েছেন!

    হয়তো তখন ওঁদের ওই আগ্রহ আর আন্তরিকতাটুকুর সাহায্যেই কলেজের চাকরিটা বজায় রাখা সম্ভব হয়েছিল ভারতীর। ওঁরাই কত আহ্লাদ করে বলেছেন, ‘তোমরাই ধন্য মেয়ে বৌমা! একালের মেয়েরা! এই সংসারের ছিষ্টি করছো, রাঁধছো বাড়ছো, আবার মোটা টাকা ঘরে আনছো! আমরা তো মিথ্যে মানুষ এটুকুও আর করব না?’

    চাকা ঘুরে গেছে।

    পালা বদল হয়েছে।

    এখন বাতাসে কথার তীর ছোঁড়ার খেলা।

    এখন ঘণ্টু বাড়ি থাকলে এই ধরনের তীর এসে কানের পর্দা ভেদ করে। ‘চললেন, না চললেন ব্যাগ দুলিয়ে, আঁচল উড়িয়ে, এখন ছেলের দৌরাত্মিতে মরুক পাড়ার লোক! অসহ্য এক জ্বালা হয়েছে বাবা!’

    শালীনতাহীন পালিশহীন এই মন্তব্যগুলো তারাই করে, যারা ঘণ্টুকে ‘চাঁদের টুকরো’ বলে আদর করেছে, আর ঘণ্টুর সম্ভাবনাকালে ভারতীকে আচার খাইয়েছে এবং সতর্কতার বহুবিধ উপদেশ দিয়েছে।

    হয়তো বা বিয়ের পর বৌ হয়ে আসা ভারতীর ক্রমবর্ধমান বিদ্যা ও তার ফলস্বরূপ একেবারে একটি কলেজের অধ্যাপিকা হয়ে বসার ইতিহাসটাও তাঁদের মনোভঙ্গের আরো একটা কারণ!

    কিন্তু সে যাক, সেটা ভারতীর ব্যাপার নয়।

    ভারতীর ব্যাপার হচ্ছে হঠাৎ গৃহসমস্যা সমাধানের এক সুবর্ণ সুযোগ এসে গেছে! সেটা হচ্ছে কর্তৃপক্ষ কলেজের হোস্টেল সুপারিন্টেন্ডেন্টের কাজটা ভারতীর উপর ন্যস্ত করাতে চাইছেন, যার ফলে সে বেশ উচ্চমানের একটি কোয়ার্টার্স পাবে।

    কলেজটা পুরনো কিন্তু হোস্টেলের বিল্ডিং আনকোরা নতুন, আধুনিক ছাঁদের এবং আধুনিক সুখ-সুবিধার উপকরণমণ্ডিত।

    মোটের মাথায় অতীব লোভনীয় সন্দেহ নেই।

    প্রস্তাবটা শুনে পর্যন্ত দিশেহার হবারই মতো!

    অবশ্য ‘ভেবে কাল উত্তর দেব’ বলেছে তখন, কিন্তু মনে জানছে ভাবাভাবির কিছু নেই, ও কাজ সে ভাল পারবে এ আস্থা আছে নিজের উপর। এ ধরনের কাজে প্রধান হচ্ছে তো ভাল ব্যবহার? অবশ্যই ফেল হবে না সে। তারপর ব্যবস্থাপনা!

    আটকাবে না, ঠিক চালিয়ে নেবে।

    বাড়ি ফেরার সময় ‘উত্তর দেবার’ আগেই ভারতী মনে মনে তার কর্মপদ্ধতির ছাঁচ গড়তে থাকে।

    ফিরে দেখলে ঘণ্টু খেলতে বেরিয়ে গেছে, ঝি উনুন ধরিয়ে দুধ জ্বাল দিচ্ছে।

    ঘুঁটে কয়লার উনুন।

    দেখামাত্রই মনে পড়ল ভারতীর ওখানে গ্যাসস্টোভ! কী পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, কী সহজ সুন্দর! পুরনো সংসারের ধারা আর অবশিষ্টাংশ নিয়েই সংসার করে এলো এতদিন ভারতী, নিজস্ব আধুনিক রুচি পদ্ধতির প্রয়োগ করতে পেল না কখনো, এবার ভাগ্য মুখ তুলে চেয়েছে!

    ঝিকে বললো, ‘সারদা, ঘণ্টুকে দুধ না খাইয়ে ছেড়েছ কেন?’

    সারদা অধ্যাপিকার মানমর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব মাত্র না নিয়ে ঝঙ্কার দিয়ে উঠলো, ‘বেশ বলেছ বৌদিদি, ছাড়লে কেন।’ তেমনি সুবোধ ছেলে যে তোমার ছাড়লে বেরোবে, না ছাড়লে ঘরে বসে থাকবে!’

    ‘তা হোক, দুধটা খাওয়া পর্যন্ত ধরে রাখার চেষ্টা করা উচিত ছিল তোমার। ওর ছুটি থাকলেই মুশকিল আমার। সারাদিন খুব দুষ্টুমী করেছে তো?’

    ‘দুষ্টুমী!’ সারদা আরো ঝঙ্কার দেয়, ‘ডাকাতি’ বলো। বাড়িওয়ালা গিন্নী তো ওপরে উঠে এসে যাচ্ছেতাই করে গেছে।’

    এ ধরনের অভিযোগ নতুন নয়।

    ভারতী শুনে লজ্জিত হয়, মনঃক্ষুণ্ণ হয়, ছেলেকে বকে। আজ মনে হলো, আশ্চর্য! ছোট বাচ্চা দৌরাত্ম্যি করবে না? তাই বলে তিনি ঠেলে উঠে এসে যাচ্ছেতাই করে যাবেন? এতো সাহস কেন? না, আমরা নিজের মানসম্ভ্রম রক্ষা করতে পারছি না, তেজ দেখিয়ে নাকের উপর দিয়ে চলে যেতে পারছি না, এই তো?

    ঠিক আছে, দ্বিধার প্রশ্ন নেই, কালই উত্তর দিয়ে দেব।

    ছটফট করতে থাকে শিশিরের ফেরার অপেক্ষায়।

    আর একবার রিহার্সাল দিয়ে নেয় মনে মনে, কী ভাবে পরিবেশন করবে খবরটা।

    একটু হেসে একটু বিব্রত ভাব দেখিয়ে—

    হ্যাঁ, একটু হেসে, একটু বিপন্ন ভাব দেখিয়ে বলে ওঠে, ‘কলেজে তো আজ একটা ব্যাপার—’

    শিশির হেসে বলে, ‘তোমাদের কলেজে তো রোজই ব্যাপার। হলো কি?’

    ‘না মানে অন্য কিছু না, আমার কাছেই একটা প্রস্তাব এসেছে।’

    ‘আরে বাবা, তুমি যে সেই গল্পের ‘আস্তে আস্তে ভাঙো’র মতো করছো! প্রস্তাবটা কি? বিলেত পাঠাতে চাইছে তোমায়?’

    ‘তোমার তো সব সময় আমাকে নিয়ে ঠাট্টা। শোনো মশাই, বলি, তাহলে। আমাকে উক্ত মহাবিদ্যালয়ের ছাত্রী আবাসের পরিচালিকা করতে চাইছে।’

    শিশির অবাক গলায় বলে, ‘তাই না কি? হঠাৎ তোমাকেই এমন যোগ্য ব্যক্তি মনে হলো যে?’

    ‘যোগ্যতা দেখেছে নিশ্চয় —’ ভারতী নিতান্ত তরুণীর ভঙ্গিতে ঘাড় দুলিয়ে হেসে হেসে বলে, ‘ভিতরে আছে গুণ! তুমিই শুধু দেখতে পাও না।’

    ‘তাই দেখছি। তা তুমি ফট করে হ্যাঁ করে আসোনি তো?’

    করে অবশ্য আসেনি ভারতী, কিন্তু শিশিরের কথার সুরে হঠাৎ একটু বিরক্তি এলো তার। যেমন উৎফুল্ল হবার কথা, হল না তো! অবশ্য আসল আকর্ষণটা শোনেনি এখনও। মানে, জানা কথা হলেও মনে আসেনি নিশ্চয়। তবু বিরক্তিটা দমন করতে পারলো না। বললো, কেন, হ্যাঁ করে আসায় দোষের কি আছে?’

    শিশির বুঝলো ভারতী চটেছে।

    কিন্তু কেন কে জানে শিশির আজ আর তাতে ভয় খেল না, নিজেকে সামলে নিল না, বরং যেন মজা পেল। তবে কথা বললো গম্ভীরভাবে, না দোষের আর কি, তবে— কাজটা খুব সহজ নয়।’

    ‘তা শক্ত কাজেই তো আনন্দ!’

    ‘সে আলাদা! সে তোমার হয়তো শক্ত অঙ্ক কষায়। এটা ঠিক তা নয়! রীতিমতো গোলমেলে কাজ।’

    ভারতী হেসে ওঠে, ‘নিজে গোলমেলে হলেই গোলমেলে। নিজে অনেস্ট থাকলে, ‘মাল’ নিয়ে ‘গোল’ না করলে, অসুবিধেটা কি?’

    ‘তা ভেবো না! মনে রেখো মেয়েগুলি এ যুগের ‘স্টুডেন্ট’! যাদের ইষ্টদেবতা হচ্ছেন অসন্তোষ, আর দীক্ষামন্ত্র হচ্ছে প্রতিবাদ!’

    ভারতী দৃঢ় গলায় বলে, ‘এটাও যুগের একটা ফ্যাসান! এই স্টুডেন্টদের নিন্দে করা! তারা যা দেখছে তাই শিখছে। আমরা নিজেরাই বা কী এমন ধৈর্য স্থৈর্য সন্তোষ সভ্যতার আদর্শ ধরছি এদের সামনে? নিজেরা ‘শিক্ষিত দীক্ষিত অবিকৃত চিত্ত’ হয়ে দেখাতে পারলে বোঝা যেত আসল গলদ কোথায়। তা যাক গে, আমাদের মেয়েরা অমন নয়। আমায় মেয়েরা কী ভালবাসে!’

    ‘ক্ষেত্রবিশেষে পরিবর্তনও ঘটে—’ শিশির হেসে ওঠে, ‘মাসীমা’ও তোমায় কী ভালবাসতেন। বৌমা বলতে অজ্ঞান হতেন!’

    ভারতীও হাসে। বলে, হ্যাঁ, ও একখানি দৃষ্টান্তের পরাকাষ্ঠা আছে বটে! তা হলেও অফারটা আমি ছাড়ব না বাবা! ওর বিরাট আকর্ষণটি ছাড়া চলবে না! অন্তত আমাদের মাসীমার হাতে ছাড়াতে পারা যাবে, শুধু এই আনন্দেই। কাজটা নেওয়া মানেই—একটি সুন্দর সুদৃশ্য সুরম্য বাসভবন—’

    হ্যাঁ, এইভাবেই রিহার্সাল দিয়ে রেখেছিল ভারতী! এতক্ষণে বলবার সুবিধে পেল। ভাবলো, এইবার আলো জ্বলে উঠবে শ্রোতার মুখে।

    কিন্তু কই?

    সে আশা কোনো এক অদৃশ্য দেয়ালে প্রতিহত হয়। শিশির বলে, যেন বিদ্রুপ মিশিয়ে বলে, ‘বাসভবনটা নিচ্ছ তাহলে?’

    ‘আরে! লোকটা বলে কি!’ ভারতী হাসির ঝাপটা মেরে যেন সম্ভাবনার ডানা মেলে এক অসীম সুখের আকাশে সাঁতরে আসে।

    ‘নেব না? বলে ওই জন্যেই শুনে পর্যন্ত আহ্লাদে ভাসছি—কতক্ষণে খবরটা দেব তোমায়! তা তুমি একেবারে ভেবেই আকুল। এতো ভাবনার কী আছে? আমি যদি ফাঁকি দিয়ে কেল্লা জয় করতে চেষ্টা না করে সত্যিকার খেটেখুটে কাজ করি, অসন্তোষ আসবে কেন মেয়েদের? ও ভেবে ভয় পেও না! আহা তুমি যদি আমাদের ওই কোয়ার্টার্সটা দেখতে! স্রেফ একখানি ছবি! দেখো কী একখানা সাজিয়ে ফেলবো। আর বাড়ি ছেড়ে দিলে তোমার মাসীমাও হয়তো—’ হেসে ওঠে ভারতী! বলে বসবেন, ‘বৌমা তোমরা চলে যাচ্ছো—টিকবো কি করে তাই ভাবছি।’ বলে কেঁদেই ফেলবেন। জগতে কিছুই অসম্ভব নয়।

    তা ভারতীর কথাটা হয়তো সত্যি।

    জগতে কিছুই অসম্ভব নয়!

    তাই ভারতীয় সুরে সুর মিলিয়ে হেসে না উঠে শিশির দুম করে বলে বসে, ‘বাড়িটা একেবারে ছেড়ে দেওয়ার প্রশ্ন আসছে কী করে? কোয়ার্টার্স তো পাচ্ছ তুমি!’

    ‘কী মুশকিল, আমি পাচ্ছি মানে? শুধু আমাকে থাকতে দেবে? আমার স্বামী পুত্রকে দেবে না?’

    ‘পুত্রের কথা বলতে পারি না—’ শিশির বলে, ‘প্রশ্নটা স্বামীকে নিয়ে। থাকতে দিলেই যে থাকা যাবে এমন নাও হতে পারে।’

    ভারতী বলে, ‘কায়দা রেখে একটু প্রাঞ্জল করে বলবে?’

    ‘প্রাঞ্জল তো সবটাই। তোমার ওই প্রমীলার রাজ্যে ঢুকে বাস করবার বাসনা আমার নেই।’

    ‘এই কথা!’

    ভারতী অস্বস্তির নিশ্বাস ফেলে, ‘প্রমীলার রাজ্যের সঙ্গে কোনো সংস্রব নেই মশাই, একেবারে ‘স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যাপার! এনট্রেন্সটা পর্যন্ত কম্পাউন্ডের গেটের মধ্যে নয়, বাইরে। তা ছাড়া ভুলে যাও নি বোধহয় হোস্টেলটাই মেয়েদের, কলেজটা ‘সহশিক্ষা’র। ছেলেদের হোস্টেল সুপারিনটেন্ডেন্টের কোয়ার্টার্সে তাঁর স্ত্রী নির্ভয়ে বাস করেন।’

    শিশির হেসে ওঠে, ‘সেটা বলবার মতো কথা নয়। মেয়েরা স্বামীর সঙ্গে বনে, অরণ্যে, পাতালে, পর্বতশিখরে সর্বত্র থাকতে পারে—’

    ভারতী হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যায়।

    ভারতী যে নিশ্চিন্ত উৎফুল্ল আর সরল মনটুকু নিয়ে ভাবী সংসারের সুখের ছবি আঁকছিল, সে ছবির উপর যেন একটা হিংস্র বাদুড়ের ডানার ছায়া পড়ে। ভারতী আস্তে বলে, ‘থাকতে পারে নয়, থাকতে বাধ্য হয়। এটাই হচ্ছে কথা!’

    আপত্তির কারণ বুঝতে আর বাকী নেই তার।

    স্ত্রীর ‘ভাগ্যলব্ধ’ সেই বাসায় যাবার ইচ্ছে হচ্ছে না বাবুর।

    সেই চিরন্তন পুরুষ জাতির অর্থহীন অহমিকা! কিছুতেই নিজেদেরকে স্ত্রীর থেকে উচ্চস্তরের না ভেবে ছাড়বে না। উচ্চস্তরের, উচ্চদরের, উচ্চমর্যাদার!

    আরে বাপু, যেকালে দশ বছরের মেয়েগুলোকে এনে নিজেদের সংসার গারদে প্রায় ক্রীতদাসীর মতোই জন্মের শোধ পুরে ফেলতিস, সেকালের চিন্তা-চেতনা-অভ্যাসটা ভুলতে পারছিস না কেন তোরা?

    স্বামী, প্রভু, বর ইত্যাদি করে ‘শ্রেষ্ঠাত্মক’ শব্দগুলো নিজেদের নামের সঙ্গে জুড়ে রেখে করলি তো এতদিন অনেক রাজ্যপাট, এবার সেই কৃত্রিম মোহভঙ্গ হোক না। জ্ঞানচক্ষু উন্মীলন করে দেখ না একবার ‘বর বড় না কনে বড়!’

    অর্থনৈতিক মুক্তির সঙ্গে সঙ্গেই কি স্ত্রী পুরুষ দুজনে একই সমতল ক্ষেত্রে নেমে আসে নি?

    তবে?

    মনে মনে ভাবল এসব ভারতী, চট করে মুখে কিছু বললো না। চলে এলো অন্য প্রসঙ্গে, বললো, ‘কী মুশকিল তুমি ফেরামাত্র গল্প জুড়ে দিয়েছি, এখনো যে হাত মুখ ধুতে যাওনি খেয়ালই হয়নি। যাও যাও চটপট! আলোচনা, বিবেচনা, ভাবনা সব কিছু পরে হবে।’

    তখন বাঁধ দিল।

    কিন্তু আবার তো আসবে ঢেউ।

    আবার উঠলো সেই প্রসঙ্গ। ঢেউয়ের ধাক্কাতেই উঠলো।

    ঘণ্টা তিনেক, পরে, ঘণ্টু সবে খেয়ে শুয়েছে, এরা খাবে বলে তোড়জোড় করছে, ঢেউ হয়ে এসে ধাক্কা দিলেন নীচতলার মাসীমা। যাঁকে আজকাল ভারতী ‘বাড়িওয়ালী মাসী’ বলতে শুরু করেছে আড়ালে আবডালে।

    মাসীমার নাম চারুলতা।

    তবে তাঁর নাম নিয়ে কেউ কোনোদিন চিন্তা করেনি। ইদানীং শিশির বলে, ‘এক হিসেবে সার্থকনাম্নী। ‘নষ্টনীড়ের’ নায়িকা। এমন সুখের নীড়টি আমাদের, কী নষ্টই করছেন।’

    তা এখন এই সম্ভাবনাময় মুহূর্তটি নষ্ট করলেন বটে।

    ভারতী ভাবছিল খেতে বসে, আবদেরে গলায় বুঝিয়ে আবদার করে, ওকে ওর ওই ‘নকল প্রেসটিজের মিনার’ থেকে নামিয়ে আনতে হবে। তা নইলে বলা যায় না, হয় তো হঠাৎ দুম করে বলে বসবে, ‘না! তোমার ও কাজ নেওয়া হবে না।’ ভাবছে সাত-পাঁচ বোঝাই যাচ্ছে।

    ভারতীও শতরকম করে বুঝিয়ে ওর মনের দ্বিধা ঘুচিয়ে দেবে।

    কিন্তু তার আগেই কুঁড়ি ভেঙে ফুল বার করলেন মাসীমা।

    একদা এ বাড়িতে ওঁর অবারিত যাতায়াত ছিল, কাজেই আড়ষ্ট হলেন না। সিঁড়িতে উঠেই বলে বসলেন, ‘বাবা শিশির, ডেকে-হেঁকেই বলতে হচ্ছে মনে কিছু কোরো না, বাড়িটা এবার ছেড়ে দিতে হবে! নানান রকমে জেরবার হয়ে যাচ্ছি তোমাদের রেখে! তার ওপর আমার নাতি সাহেবটি! কোনদিন গরীবের জীর্ণ বাড়িটুকুর ছাত নামিয়ে দেয়, এই আতঙ্কে প্রহর গুণি। আমার এই বলাটাই নোটিশ মনে করে বাড়ি খোঁজো—’

    বরাবর ‘মাসীমা’ বলেছে, মান্য দিয়েছে, একেবারে মুখের উপর অসম্মান করতে পারা যায় না, তাই শিশির নম্রভাবেই বলতে যাচ্ছিল, ‘খুঁজছি তো অনেকদিন থেকেই’—

    কিন্তু ওর বলার উপর ভারতী বলে উঠলো, ‘এযুগে তো নিয়মিত ভাড়া দিয়ে গেলে ‘নোটিশ’ বলে কিছু চলে না মাসীমা।’

    মাসীমা ঈষৎ চমকে ওঠেন।

    কারণ, এটা আশা করেননি।

    এযাবৎ যা কিছু তীর ছুঁড়ে আসছিলেন তিনিই। মনে হয় পাথরের দেয়ালে গিয়ে গড়িয়ে পড়ে। বিঁধতে পেরেছেন এমন প্রমাণ পান না।

    তিনি যা নিয়ে ‘অসুবিধে’ বলে চেঁচান, এরা সে বিষয়ে যতটা সম্ভব সতর্ক হয়, সাবধানী হয়। কোনোদিন জবাব শোনেন নি। আর আজ কি না ফট করে আইন দেখিয়ে বসলো?

    কালিপড়া মুখে বলেন, ‘আমরা সে যুগের মানুষ বৌমা, এ যুগে কি চলে তা জানি না, মোট কথা বাড়ির তোমরা ব্যবস্থা কর এই হচ্ছে কথা! অনিলের বে’ দেব ঘরের দরকার।’

    গট গট করে নেমে যান মুখ ফিরিয়ে।

    ভারতী শিশিরের দিকে একটি স্থির দৃষ্টি মেলে বলে, ‘শুনলে?’

    ‘শুনলাম’, শিশির বলে ওঠে, ‘শুনছিই তো সব সময়! তবে তোমার উচিত হলো না ওভাবে ওঁর মুখের ওপর আইন দেখিয়ে কথা বলা।’

    ভারতী তার স্বামীর এই উল্টোপাল্টা কথায় অবাক হয়ে যায়। বলতে কি মাসীমাদের পরিবর্তনের পর থেকে এযাবৎ যে মাসীমা এবং তস্য পরিবারের সঙ্গে ভদ্রতা বজায় রেখে চলে আসছে তারা, তার বারো আনা গৌরব ভারতীরই প্রাপ্য। শিশির অনেক সময়ই রেগে উঠে তেড়ে দু কথা বলতে যায়, ভারতীই নিবৃত্ত করে। বলে, ‘দোহাই তোমার, আর যা কর কর। কোঁদল করতে যেও না। মনে রেখো, পরে আবার মুখ দেখাতে হবে। একবার ‘মুখোমুখি ঝগড়া’ হয়ে গেলেই সমস্ত আবরণ খসে পড়ে, নির্লজ্জতার চরম সীমা পর্যন্ত পৌঁছতে আর বাধে না তখন। ভদ্রতা বজায় রেখে সরে পড়ার চেষ্টা করাই ভালো!’

    শিশির বলে, ‘কিন্তু ক্রমশই বাড়াচ্ছেন, ওতেই। প্রতিবাদও দরকার।’

    আশ্চর্য, আজ ভারতী যেই এই মুহূর্তের জন্যে নিজের নীতি থেকে স্খলিত হয়ে পড়েছে, সেই অমনি শিশির নিজের নীতি বদলে বসলো!

    ভারতী কয়েক সেকেন্ড নির্নিমেষে স্বামীর ওই উল্টোপাল্টা কথা বলা মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘উচিত হয় নি, কেমন?’

    ‘আমার তো তাই মনে হলো!’

    ‘অথচ তুমিই বলো প্রতিবাদ দরকার।’

    ‘বলি, তুমিই তাতে বাধা দাও।’

    ‘আমি সহজে দিই না। আজ উনি দুপুরে এসে ঘণ্টুকে যা ইচ্ছে বকে গেলেন, কান মলে দিয়েছেন, জানো সে কথা?’

    ‘বকে গেছেন, কান মলে গেছেন?’

    ‘তবে আর বলছি কি? ঘণ্টুর কাছে শুনতে পারো কাল। ছোট্ট ছেলেটাকে বলেছেন কী জানো? ‘তোরা আমাদের এই ভাঙা বাড়িতেই বা পড়ে আছিস কেন? মা-বাপ দুজনে রোজগার করছে, যা না অট্টালিকা বানিয়ে নিয়ে দাপাদাপি করগে না?’

    শিশির ছায়াচ্ছন্ন মুখে বলে ‘হুঁ।’

    ‘হু’ মানে?’

    ‘মানে ওই দুজনের রোজগারটাই চক্ষুশূল হয়েছে বোঝা যাচ্ছে!’

    ভারতী আর একবার ওই ছায়াচ্ছন্ন রহস্যময় মুখের দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টি হানে।

    কি বলতে চাইছে হঠাৎ ও?

    দুজনে রোজগার করাটা অনুচিত? পড়শীর সেটা চক্ষুশূল হবেই! তাতে পড়শীকে দোষারোপ করা চলে না!

    গম্ভীর মুখে বলে, ‘তা ভুলটা যখন হয়েই গেছে, তখন আর চারা নেই। তোমার মাসীমার চক্ষুকে শূলবেদনা থেকে রক্ষা করা অবশ্যই সম্ভব নয়? এখন আশা করি ‘প্রমীলার রাজ্য’ বলে একটা মিথ্যে ধুয়ো তুলে এই যন্ত্রণার হাত থেকে অব্যাহতি লাভটা পিছিয়ে দেবে না? বরং তোমার মাসীমাকে অবহিত করিয়ে এসো সামনের মাস থেকে বাড়ি ছেড়ে দিচ্ছি।’

    শিশিরও গম্ভীর হয়।

    বলে, ‘আমি তো পাগল হই নি!’

    ভারতী হঠাৎ ভারী উত্তেজিত হয়ে ওঠে।

    বলে, ‘তার মানে? তুমি তা হলে সত্যিই আমার পাওয়া কোয়ার্টার্সে যাবে না?’

    শিশির কথা চিবোয়, ‘একেবারে যাবো না এমন কথা কি প্রতিজ্ঞা করে বলা যায়? ধরো, ইনভ্যালিড হয়ে গিয়ে তোমার সংসারে পড়লাম!’

    ‘ওঃ তুমি আজ আমায় রাগাবেই প্রতিজ্ঞা করেছ। আমি কিন্তু আর রাগবো না। তোমাকে পাগলামীও করতে দেব না! কাজটা আমি নেবই, আর যেতেই হবে সকলকে। বুঝলে? কেন? তোমার বাড়িতে যদি আমি থাকতে পারি, কোনো অপমান বোধ করি না, আমার বাড়িতেই বা তুমি থাকতে পারবে না কেন?’

    ‘সব কথার উত্তর দিতে নেই।’

    ‘উত্তর নেই, তাই দিতে নেই। তুমি আমায় বোঝাও তোমার আপত্তিটা কোনখানে?’

    শিশির হঠাৎ একটু মুচকি হেসে, নিজের বুকের মাঝখানে হাত দিয়ে বলে, ‘এই খানে।’

    ‘সে বুঝেছি। কিন্তু তোমার ওই পচা কুসংস্কার ছাড়তে হবে। আমার দাবি মানতে হবে!’ ভারতীও অতএব হাল্কা হয়, ভালো ছেলের মতো মাসীমা’র নাকের সামনে দিয়ে বাড়ি ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে হবে! সত্যিই বলছি তোমায়, কাজটার জন্যে যত না হোক, ওই মহিলাটির কথা ভেবেই এত আহ্লাদ হয়েছে আমার।’

    শিশির গম্ভীরভাবে বলে, ‘ও কোনো কাজের কথা নয়। বাড়ি তো খোঁজা হচ্ছেই’—

    ‘সে তো বহুকালই হচ্ছে।’ ভারতী রেগে ওঠে, ‘হয় তো অনন্তকাল হবে, তাতে কোনো লাভ হবে কি?’

    কথায় কথায় কেবল তর্কই বাড়ে, আর বাড়ে জেদ। উভয় পক্ষেরই। শিশিরের এই অনমনীয় মনোভাব ভারতীকেও করে তোলে কঠিন।

    শেষ পর্যন্ত রেগে গিয়ে বলে ওঠে ভারতী, ‘ঠিক আছে তুমি থেকো তোমার পূজনীয়া মাসীমার বাড়িতে, পার তো তাঁর অনিলের বিয়েতে ভোজ খেও আর কোমর বেঁধে খেটো! আমি আমার ভবিষ্যৎ ঠিক করে ফেলেছি।’

    বলেই অবশ্য চমকে যায়।

    বোঝে একটু বেশি রূঢ় হয়ে গেছে, কিন্তু কি করবে মানুষের শরীর তো। একই রক্ত-মাংসে গড়া! শিশির যদি জীবনের আনন্দের দিকটা, শান্তির দিকটা, নিশ্চিন্ততার দিকটা কিছুতেই দেখব না পণ করে, কেবল প্যাঁচালো কথা কয়, কতক্ষণ সহ্য করা যায়?

    নিজের মনেও ক্রমশ প্যাঁচ উঠতে থাকে। মনে হয়, ওঃ তুমি পুরুষ বলে একেবারে রাজা হয়ে গেছ! তোমার অহঙ্কারই জয়ী হবে! কেন? আমি মানুষ নয়? আমার উন্নতি, আমার ভবিষ্যৎ, আমার আর্থিক সুবিধে দেখব না আমি? ক্ষমতা থাকতেও তোমার একটু তুচ্ছ অহমিকাকে তুষ্ট করতে ছেড়ে দেব সুযোগ? সেই আদি অন্তকালের ‘বৌগিরি’টা এখনো বজায় রেখেছি বলেই এত প্রশ্রয় তোমার কেমন?

    এই যে আমি সারাদিন খেটে এসে ক্লান্ত হয়ে পড়ি, কই একদিনও তো ভাবি না পাঁচ মিনিট বিশ্রাম করি! একবারও তো আশা করি না আমার মুখের সামনে কেউ জলের গ্লাসটা এনে ধরুক! আমি এসেই তোলা শাড়ি বদলে কোমর বেঁধে লেগে যাই কি করে তোমার ঘরে ফেরার সময় সব কিছু ফিটফাট করে তুলবো!

    আমি ফেরার পথে ছেলেকে স্কুল থেকে নিয়ে তবে ফিরি, তাকে খাওয়াই সাজাই, খেলতে পাঠাই, তোমার ফেরার আগেই যাতে খেলে বাড়ি ফেরে তার জন্যে একশোবার নির্দেশ দিয়ে রাখি। কারণ, জানি তুমি অল্পে উৎকণ্ঠিত হও। জানি তুমি এসেই ওকে দেখতে না পেলে দুঃখিত হও।

    ঘণ্টুর ব্যবস্থা করেই আমি হয় তো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু এক কাপ চা খেয়ে নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে যাই যাতে তুমি আসবার আগেই রান্নাটা সেরে ফেলতে পারি। আমার বাড়ি ফেরা আর তোমার বাড়ি ফেরার মধ্যে ঘণ্টা আড়াইয়ের ব্যবধান আছে বলেই, এই ব্যবস্থাটা সম্ভব করে তুলতে পারি আমি, ওই সামান্য সময়টুকুর মধ্যেই তোমার প্রিয় জলখাবারটুকু বানিয়ে নিই চায়ের টেবিলে পরিবেশন করতে। আবার নিজেকেও তো ‘তৈরি’ করে নিতে হয় সেই টেবিলে ‘পরিবেশিত’ হতে।

    শুধু যে আমিই ভালবাসি না সন্ধ্যাবেলা আলুথালু হয়ে বেড়ানো তা তো নয়, তুমিও তো পছন্দ করো না! সারাদিন খেটে এসে অত তাড়াহুড়ো করতে কি কষ্ট হয় না আমার?

    খুবই কষ্ট হয়।

    কিন্তু তুমি খুশি হবে ভেবে সব কষ্ট সয়ে যায় আমার। আজ পর্যন্ত আমার জীবনতরী নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে তোমার খুশির হাওয়ার গতি নির্ণয় করতে করতে।

    অথচ তুমি?

    তুমি জীবনে একবার মাত্র ভাবলে না, ‘আহা ও খুশি হবে!’

    তুমি আপন অহংকারে অটল।

    আমি সভ্য, আমি ভদ্র, আমি মমতাশীল, তাই মনে করিয়ে দিচ্ছি না—কাজটা নিলে বাড়তি যে টাকাটা আসবে, তার অঙ্ক তোমার মতো ‘শুধু কেরানীর’ পক্ষে উড়িয়ে দেবার নয়। মনে করিয়ে দিচ্ছি না, তোমার যা সারা মাসের উপার্জন আমার তা বারোদিনের।

    মনে করিয়ে দেব কি করে, নিজেই কি মনে করেছি কোনোদিন? আজ তুমি আমাকে বড় বেশি হতাশ করছো বলে, বড় বেশি দুঃখ দিচ্ছ বলে, মনে এসে যাচ্ছে!

    হ্যাঁ, মনের দুঃখেই ওই সব ছাইপাঁশ চিন্তা মনে এসে যাচ্ছে বেচারা ভারতীর।…. কিন্তু পরদিন যখন কলেজে আবার কথাটা ওঠে, ভারতী বলে ‘ভেবে দেখলাম আমার যোগ্যতা নেই!’

    অধ্যক্ষ বলেন, ‘যোগ্যতার বিচারটা আমাদের হাতেই ছেড়ে দিন না! সইটা করে ফেলুন চটপট।’

    অধ্যক্ষ বলেন, অন্যান্য অধ্যাপিকারা বলেন। বান্ধবী লীলা ঘোষ বলে, ‘তুই হচ্ছিস একের নম্বরের হাঁদা। নির্ঘাৎ তুই তোর সেই প্রাচীনপন্থী কর্তাটির নিষেধে এমন সুযোগটা ছাড়ছিস। আমি তো ভাবতেই পারছি না। আমায় অফার করলে আমি একটা ডিগবাজি খেয়ে নিতাম।’

    ভারতী হেসে বলে, ‘সে তো আমিও খাচ্ছি!’

    ‘ছাড় ওসব কাব্যকথা! কর্তার ইচ্ছায় কর্মের যুগ চলে গেছে বাবা, দেখ পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে?’

    হঠাৎ মনের মোড় ঘুরে যায়।

    হঠাৎ বলে বসে ভারতী—’ঠিক আছে।’

    ‘ঠিক আছে!’

    কিন্তু সে ঠিকটা কোথায়?

    জীবনটা যে বেঠিক হয়ে বসলো ভারতীর! শিশিরও তার সেই রাগ করে বলা কথায় ধুয়ো ধরেই বললো, ‘ঠিক আছে! তোমার ব্যবস্থাই বলবৎ হোক! আমি থেকে যাচ্ছি এখানে, তুমি ঘণ্টুকে নিয়ে—’

    ভারতী ভয় পেল।

    ভারতী ভারী একটা অসহায়তা বোধ করলো। ভারতী নম্র হলো, নিচু হলো।

    অনেক রাত্রে যখন ঘণ্টু ঘুমিয়ে পড়েছে, এঘরে চলে এলো। স্বামীর বুকের কাছে ঘেঁষে শুয়ে বললো, ‘দেখ বিশ্বাস কর আমি গিয়ে স্রেফ না করেই দিয়েছিলাম। কিন্তু এতো অনুরোধ উপরোধ হতে লাগলো, শেষ পর্যন্ত—আর আসলে তো কোনো যুক্তি দেখাতে পারছি না!

    ‘স্বামী এখানে আসতে ইচ্ছুক নয়’, এ রকম একটা যুক্তি দেখানো সম্ভব ছিল না বোধহয়?

    বুকের কাছে ঘেঁষে আসা মানুষটার বুকের ভাষা বোঝবার চেষ্টা করে না শিশির, বরং যেন নিজেকে সরিয়ে নেয় একটু।

    ভারতী তবু মান খোয়ায়।

    বলে, ‘মানুষ তো একটা বোকামীও করে, একটা ভুলও করে, মনে কর না তাই করে ফেলেছি, তুমি সেটা সামলাও।’

    শিশির রূঢ় গলায় হেসে ওঠে।

    বলে, ‘সামলোবো’? আমি? বলো কি?

    ‘দেড়শো খুকী’ সামলাবার ভার নিয়ে প্রতিজ্ঞাপত্রে স্বাক্ষর করে এলে, এখন এ কী বাণী?’

    হবে না, কিছুতেই নরম হবে না।

    কিছুতেই জীবনকে সহজ হতে দেবে না।

    সেই ছবির মতো সুন্দর বাসাটিতে সুন্দর করে ঘরকন্না সাজিয়ে সংসার করতে দেবে না ভারতীকে।

    নিষ্ঠুর লোকটা কি জানে, মেয়েরা বিদ্যায়, কর্মে, পদমর্যাদায় বা ‘পদে’র জটিলতায় যেখানেই পৌঁছক, তার একেবারে অন্তরের অন্তরলোকের একান্ত বাসনাটি থাকে মনের মতো একটি ‘ঘর’! সেখানে সুন্দর করে সংসার করা!

    বুঝতে পারছে না ও, জানতে পারছে না?

    নয় তো বা পারছে ঠিকই। সব পুরুষই পারে, আর মেয়েদের ওই দুর্বলতার সুযোগটুকু নিয়ে ভাব দেখায় তার নিজের কোনো কিছুতেই প্রয়োজন নেই! ‘ঘর’ বস্তুটা তার কাছে স্বপ্নের নয়, সাধের নয়, সাধনার নয়, নিতান্তই ‘আস্তানা’ মাত্র।

    ভাব দেখায়, দয়া করে যে ‘ঘর’ বাঁধে সে, সংসার করে, সে কেবলমাত্র নারীজাতির প্রয়োজন মেটাতে! নিজে সে নির্লিপ্ত উদাসীন, ‘ধরে আনা’ অসহায় জীব। ধরে বেঁধেই রেখে দেওয়া হয়েছে তাকে সংসারের সঙ্গে জুড়ে।

    তাই অনায়াসে নিতান্ত নির্মমতায় অগ্রাহ্য করতে পারে মেয়েমনের ছোট সুখ, ছোট আশা, ছোট ছোট বাসনার চাহিদা।

    শিশির ঘুমিয়ে পড়ে। ভারতীর মনে পড়তে থাকে, একবার ভারতীর বোনের বিয়েতে বারাসতে নেমন্তন্ন গিয়েছিল ওরা, রাত হয়ে গিয়েছিল, বাকী রাতটুকু থেকে যাবার জন্যে ভারতীর মা সহস্র অনুরোধ জানিয়েছিলেন, বলেছিলেন, ‘কাল সকালে এখান থেকে খাওয়াদাওয়া করেই অফিসে চলে যেও বাবা, আজ এতো রাত্তিরে—’

    শিশির ভারতীর মার সেই অনুরোধের মান রাখেনি। তার মানে ভারতীর মুখ রাখেনি, মান রাখেনি। তবু ভারতী সকালে শিশিরের খাওয়ার অসুবিধে হবে ভেবে, নিজেও সেই অত রাত্রে চলে এসেছিল শিশিরের সঙ্গে।…….

    ভারতীর মনে পড়ে একদিন—

    হ্যাঁ, এক এক করে এমন অনেক দিনের কথা মনে পড়তে থাকে ভারতীর, যার মধ্যে শিশিরের হৃদয়হীনতার স্বাক্ষর আছে।

    হয়তো এসব কথা জীবনেও মনে পড়তো না ভারতীর, এসব যে আজও মনের কোন গভীর স্তরে ছিলো তা ও টের পেত না, কিন্তু আজ উঠে আসতে লাগলো তারা, যেন আদালতের এক একটি ‘সাক্ষী’র মতো।

    ভারতী ভুলে গেল সে একটা ডক্টরেট পাওয়া মেয়ে, ভুলে গেল সে একটা বিশিষ্ট শিক্ষায়তনের অধ্যাপিকা, ভুলে গেল কর্মক্ষেত্রে তার মান-সম্ভ্রম কতখানি! নিতান্ত তরুণী মেয়ের মতো নবপরিণীতা অভিমানিনী বধূর মতো কেঁদে বালিশ ভেজাতে লাগলো।…

    সাক্ষী রইল না কেই, এই যা রক্ষা।

    তা’ ওই ‘রক্ষা’ নিয়েই এ সংসারের সমস্ত ‘সম্মানের আসন’গুলি সুরক্ষিত। নিভৃত অশ্রুর দর্শক থাকে না, নিভৃত চিন্তার সাক্ষী থাকে না।

    শিশিরেরই যে কোনো ‘নিভৃত-লোক’ নেই তাই বা কে বলতে পারে? হয়তো সেও পীড়িত হচ্ছে, আহত হচ্ছে, অভিমানে পাথর হচ্ছে, কারণ সে তার নিজের মতো করে ভাবছে, নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছে, নিজের চিন্তাধারায় বিচার করছে। তাই সেও হয়তো ভারতীকে অহঙ্কারী, উদ্ধত আর নিষ্ঠুর ভাবছে।

    দুজনেরই সাক্ষী-প্রমাণ নেই।

    এতদিন ওরা দুজনে দুজনের মধ্যে এমন ‘সম্পূর্ণ’ ছিল যে ওদের কোনো বন্ধুও নেই, যার কাছে হৃদয়ভার লঘু করতে বসতে পারে! নির্বান্ধব দুটো মানুষ অতঃপর আপন দুর্মতির দ্বারা পরিচালিত হতে থাকে, এবং প্রমাণ করতে থাকে, দুর্মতির অসাধ্য কাজ নেই।

    আরো একটা তত্ব নতুন করে প্রমাণ করে ছাড়ে ওরা, মানুষের কতো পরিবর্তনই হয়!’

    কারণ, পরবর্তী দৃশ্যটা সেই ছবির মতো বাসাটাকে গাছে-মাছে, কুশনে-কভারে, পর্দায় সোফায় সুন্দর করে সাজিয়ে ঘণ্টুকে নিয়ে একা আছে ভারতী, একটা বাচ্চা চাকর আছে সারাক্ষণের, সে তার ছোট ছোট হাতে বাড়িটিকে রেখেছে ধূলিমালিন্য শূন্য করে, একটা ঝি আছে, সে দুবেলা এসে মোটা কাজগুলো করে দিয়ে যায়, উঁচু টেবিলে রাখা গ্যাসের উনুনে রান্না করে, বেসিনে ফেনা করে সাবান কাচে।

    ভারতী মাঝে মাঝে ওই ঝিটার দিকে ঈর্ষার দৃষ্টিতে তাকায়, কারণ হঠাৎ হঠাৎ চারুলতা মাসীমার বাড়ির সেই ইটের উনুন-পাতা কালিঝুল রান্নাঘরটার কথা মনে পড়ে যায় ভারতীর, যেখানে বসে ভারতী অনেকগুলো বছর রান্না করেছে। মনে পড়ে যায়, সিমেন্টের চটা-ওঠা সেই কলঘরটাকে, যেখানে ভারতী অনেক সাবান কেচেছে, আর স্বপ্ন দেখেছে বেসিনওলা সুন্দর বাথরুমের।

    অথচ এখন কিছুতেই একটা রুমাল কেচে নিতেও ইচ্ছে হয় না, কিছুতেই রান্না ঘরে ঢুকে দুটো আলু ভাজতেও ইচ্ছে হয় না!

    কে জানে কেন!

    সে কি ভারতী বড়লোক হয়ে গেছে বলে? না, সন্ধ্যা হলেই ওর সেই মনোরম গোল বারান্দাটিতে অধ্যাপিকাদের আড্ডা বসে বলে সময় পায় না?

    এ আড্ডার প্রধান বক্তা বান্ধবী লীলা ঘোষ বলে, ‘দেখালো বটে একখানা তোর পরম গুরু! বলে দিচ্ছি ভারতী, ওসব তেজ অহমিকা—কিচ্ছু নয়, স্রেফ হিংসে! স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে ও জিনিসটা বেশ বেশি পরিমাণেই থাকে বুঝলি? নেহাত জয়েন্ট বিজনেসের স্বার্থে নিজেকে ঢেকে রাখে।’

    ভারতী ফিকে হেসে বলে, ‘এতো কথা জানলি কি করে?’

    ‘দেখে বৎসে, দেখে!’

    ‘তাই বুঝি বিয়ে করিস নি?’

    ‘দূর, তা বলে তা নয়—’ লীলা ঘোষ হেসে ওঠে, ‘এখনো পেলে করি। এই চেহারায় কে বিয়ে করবে বল? তাইতেই বুড়ি আইবুড়ি। তবে বুঝি সব।’

    হাসির ফোয়ারা ওঠে, তার সঙ্গে চা চলে।

    বাচ্চা ছেলেটা সাবধানে ট্রে করে বয়ে নিয়ে আসে ফাইন পেয়ালায় সোনালী চা!

    ভারতীকে উঠতেই হয় না।

    কাচের জানালার সামনে টবের উপরকার ক্যাকটাসগুলো কেউ মাথা খাড়া করে দাঁড়িয়ে থাকে, কেউ বাঁকা-চোরা বাহুগুলো এদিকে-ওদিকে ছড়িয়ে কাচের গায়ে একটা বিকৃত মানুষের মতো ছায়া সৃষ্টি করে।….

    বাতাসে পর্দা কাঁপে!

    ওদের হাসির সময় ভারতী সেইদিকে তাকিয়ে থাকে, হয়তো ভাবে, ‘কী এমন মন্দ আছি!’

    একসময় ঝিটা এসে জিজ্ঞেস করে, ‘দিদিমণি, খোকা কি এখন খাবে?’

    ভারতী বিরক্ত হয়ে বলে, ‘কেন? এখুনি খেয়ে নিলেই তোমার পালাবার সুবিধে হয়, কেমন? নটার আগে খাবে না, পড়বে নটা পর্যন্ত।’

    ঝি ভারীগলায় বলে, ‘আমার জন্যে বলিনি, পড়তে পড়তে ঘুমে ঢুলছে তাই—’ চলে যায় রাগ দেখিয়ে।

    ভারতীর বান্ধবীরা বলে, ‘ও বেচারা একটু লোনলি ফিল করে।’

    ভারতী কাচের গায়ের সেই বাঁকাচোরা ছায়াগুলোর দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্কের মতো বলে, ‘হ্যাঁ, তাই ভাবি মাঝে মাঝে কোনো একটা বোর্ডিঙে ভর্তি করে দিলে হয়। তবু অন্য ছেলেদের সঙ্গে—’

    আর শিশির?

    তা সত্যি বলতে দৃশ্যত শিশিরও কিছু খারাপ নেই। দোতলাটা ছেড়ে দিয়ে সে চারুলতা মাসীমার নীচতলার বৈঠকখানা ঘরটায় আশ্রয় নিয়েছে, একেবারে পেয়িং গেস্ট হিসেবে। যত্নের ত্রুটিমাত্র হচ্ছে না, মাসীমা বিগলিত স্নেহে সর্বদা ‘আহা’ করছেন, শিশিরের জামার বোতামটি লাগানো কিনা দেখতে বলছেন মেয়েদের!

    আর সেটা যে শুধু ‘দেখিয়েই’ করছেন, সে কথা বললেও মাসীমার প্রতি অবিচার করা হবে। মমতার বশেই করছেন।

    চিরদিনের স্নেহ-মমতার সম্পর্ক ছিল ভিতরে অন্তঃসলিলা হয়ে, তার উপরে একটা তীব্র স্বার্থের দুরন্ত ইচ্ছার ব্যাঘাত তাঁকে উগ্র তিক্ত নির্লজ্জ করে তুলেছিল। সে ব্যাঘাত দূর হয়েছে, দোতলাটায় একটু রঙের তুলি বুলিয়ে দিয়ে আশাতিরিক্ত ভাড়ায় একটা ভাড়াটে বসিয়েছেন, তার উপর বৈঠকখানা ঘরের অর্ধাংশ, আর দু-বেলা দু-থালা সাদামাটা খাওয়ার পরিবর্তে একমুঠো টাকা হাতে পাচ্ছেন, আর একবার তবে নির্লজ্জ হতে বাধা কি?

    অতএব আর একবার নির্লজ্জ হন চারুলতা মাসীমা। শিশিরের জন্যে মমতায় বিগলিত হন। বৌ পালিয়ে যাওয়া ছেলেটার নির্লিপ্ত মনের কাছে এ নির্লজ্জতার হাস্যকর কটুতা ধরা পড়বে না, এ বোধ মাসীমার আছে।

    কিন্তু শিশির কি এতোই বোধহীন হয়ে গেছে যে, আধখানা ঘরেই রাজী হয়েছে? তা হয়েছে। হয়তো চক্ষুলজ্জাতেই হয়েছে। কারণ, অবিবাহিত বড় হয়ে যাওয়া ছেলের ঠাঁই ছিল ঐ ঘরটাতেই, তাকে স্থানচ্যুত করতে চক্ষুলজ্জায় বেধেছে শিশিরের। বলেছে, থাক না, অনিল যেমন শুচ্ছিল, শুক না। বড় ঘর—’

    বরাবরই তো ছিল নিল ছোট ভাইয়ের মতো। অগে কত আব্দার করতো অনিল শিশিরের কাছে, কত উপদ্রব করতো শিশিরের মায়ের উপর।

    শিশিরের আর বেশি জায়গার দরকারই বা কি? এই তো কেটে যাচ্ছে দিন, কেটে যাচ্ছে রাত্রি। একথালা ভাত, একটা পাতা বিছানা, আর চান করে ছেড়ে রেখে যাওয়া ধুতি, গেঞ্জি, তোয়ালেগুলো কাচা শুকনো হয়ে হাতের কাছে মজুত থাকা।…. এ তো হচ্ছেই।

    এর বেশি চাইবার কি আছে?

    সংসারের দায়হীন, বাধ্যবাধকতাহীন এই জীবনেরও একটা বিশেষ সুর আছে বৈকি। মাসের প্রারম্ভে টাকাটা ধরে দেওয়ার পর, দ্বিতীয়বার আর চিন্তা করতে হয় না খেতে হলে খাটতে হয়। সংসার করতে হলে, শুধু টাকার ধান্ধাতেই নয়, তেল নুন লকড়ির ধান্ধাতেও বিশ্বভুবন চষে বেড়াতে হয়।

    সত্যি এখন তো আর শুনতে হয় না, পাঁউরুটি নাকি আর কুপন ছাড়া পাওয়া যাবে না শুনছি, কী মুশকিল বলো তো!’….. শুনতে হয় না ‘আমার কোনো কাজ তুমি কর না কেন বলো তো? যাও একবার দেখে এসো দিকি তেল সত্যিই একেবারে বাজার থেকে উধাও হয়ে গেছে কি না!’….. শুনতে হয় না, বেড়িয়ে ফেরার সময় একবার দোকান ঘুরে আসবে, চাটা একেবারে ফুরিয়ে গেছে!…. এই দেখ অজ তো সময় রয়েছে ঘণ্টুটাকে নিয়ে একবার ‘সাউথ টেলারিঙে’ যেতে পারবে, কটা সার্ট প্যান্টের দরকার ছিল ওর।’

    না, কোনো কিছু শুনতে হয় না।

    কোনো প্রয়োজনের কথা কেউ তোলে না শিশিরের কাছে।

    শিশির এখন এক অখণ্ড নিশ্চিন্ততার ‘শব্দহীন’ জগতে আশ্রয় পেয়েছে। এই ‘শব্দহীন’ জগতে বাইরের টুকটাক শব্দ মন্দ লাগে না। সে শব্দের মধ্যে কোনো দায় নেই। নেই কোনো অভিযোগের উদ্যত আক্রমণ।

    এ শব্দ শুধু কানের কাছে ভেসে যাওয়া কথামাত্র।

    অনিল সেই অনেকদিন আগের মতো মহোৎসাহে ওদের ফুটবল টীমের গল্প করে, ভালোই লাগে!

    মাসীমার মেয়েরা যখন-তখন বলে, ‘উঃ, শিশিরদা, কী অন্যমনস্ক আপনি, আপনার ঘরের জলের কুঁজোয় কাল থেকে জল নেই, বলেনও নি তো?’

    শুনতে খারাপ লাগে না।

    আর মাসীমা যখন ভাতের সামনে পাখা নাড়তে নাড়তে বলেন, ‘কি খাওয়ারই ছিরি হয়েছে বাবা তোমার, দেখলে প্রাণ ‘হায় হায়’ করে। ‘দিদি’র আমলে দেখেছি তো—একগোছা করে ঘী-জবজবে রুটি করে রাখতেন, ছেলে কলেজ থেকে এসে খাবে বলে। কী দিনই গেছে সে সব—’

    তখন তো আবেগে আনন্দে প্রায় চোখে জলই এসে যায় শিশিরের।

    ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শিশিরের মায়ের কথাই তোলেন চারুলতা মাসীমা বেশি সময়। দুজনে কী প্রগাঢ় ভাব ছিলো গাঢ়কণ্ঠে সেইটুকু স্মরণ করিয়ে দেন, আর মাঝে মাঝেই নিশ্বাস ফেলে বলেন, ‘কি জানি বাবা, কেমন মন বৌমার! এইভাবে সংসার ছন্নছাড়া করে চাকরির উন্নতি করতে গেল! আমরা এসব কথা ভাবতেও পারি না!’

    হয়তো এটাও শুধু ভারতীকে নিন্দে করেই বলেন না, এটা ওঁর সত্যিকার মনের কথাই।

    অসহায় একক পুরুষের উপর মমতা মেয়েমনের চিরন্তন প্রকৃতি, তা সে যে বয়সেরই হোক।

    ছন্নছাড়া সংসার ছাড়া ছেলেটাকে আরো মায়া করতে ইচ্ছে হয়, বৌটাকে আরো নিন্দে করতে ইচ্ছে হয়।

    ভারতীর দুর্মতিতে চারুলতা মাসীমার অনেক দিকে সুরাহা হলেও তার উপর রাগ না দেখিয়ে পারেন না।

    কিন্তু ওদের কি তাহলে একেবারেই দেখা হয় না? স্বামী-স্ত্রীর? বাপ-ছেলের?

    না, না, তাই কি সম্ভব?

    আইন আদালত করে ফারখৎ করে নি, কিছু না, যে যার সুবিধে হিসেবে আছে, এই তো।

    দেখা হয়।

    রবিবারে রবিবারে দেখা হয়।

    শিশির যায় না ভারতীই আসে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে। মাসীমার বাড়ির মধ্যেই এসে বসতে হয়। চাও খেতে হয় কখনো কখনো। ঘণ্টুও খাবার খায় রেকাবি করে। কোনো কোনোদিন যদি দেখে বাবা স্নান করতে গেছে, কি বেরিয়েছে, মাকে চুপি চুপি বলে, ‘মা একটু ছাতে যাব।’

    ছাতটাই আড্ডা ছিল। ভাঙা লাটাইটা এখনো গড়াগড়ি খাচ্ছে তার ছাতের ট্যাঙ্কটার নিচে।

    ভারতী ছেলের ঐ হ্যাংলামিতে বিরক্ত হয়, চোখ টেপে, কিন্তু শেষ রক্ষে হয় না। মাসীমা স্নেহে ভরা গলায় বলেন, ‘আহা, যাক, যাক, আজন্মের খেলার জায়গা! নতুন ভাড়াটেরা লোক খুব ভালো, কিছু বলবে না। যা, সিঁড়ি দিয়ে উঠে।’

    শিশির স্নান সেরে সাজসজ্জা করে নিলে তিনজনে একত্রে বেরোয়। রবিবার আর কেউই বাড়িতে খায় না, হোটেলে খাওয়া হয়।

    এটা যেন একটা অলিখিত আইনে স্থির হয়ে গেছে ও খরচাটা শিশিরই করবে, ভারতী কোনোদিন তার বটুয়ায় হাত দেয় না।

    বাইরে খাওয়া হয়, এখানে-ওখানে বেড়ানো হয়, হয়তো সিনেমা দেখা হয়, সার্কাস এলে সার্কাস।

    মোটের উপর ঘণ্টুর মনোরঞ্জনের প্রচেষ্টাটাই লক্ষ্যে পড়ে। যেন ঘণ্টুকে একটু আমোদ প্রমোদ দিতেই এই অভিযান ওদের। ফেরার সময় প্রায়ই জিনিসপত্র কেনা হয় ঘণ্টুর নাম করে। খেলনা, খাবার, লালমাছ, কাঁটাগাছ।

    তাই বলে কি দু’জনে কথা বলে না ওরা? পরস্পরে? হাসে না?

    সবই করে।

    সাময়িক ঘটনা-নির্ভর সেই সব হাসি কথা গল্প বাতাসের গায়ে তরঙ্গ তুলতে পারে না, বাতাসের গা বেয়ে গড়িয়ে পড়ে।

    সন্ধ্যার পর যে যার নিজ আশ্রয়ে ফেরে।

    ছাড়াছাড়ির সময় দু’জনে আস্তে বলে, ‘আচ্ছা!’

    শিশির ঘণ্টুর মাথায় একটু ছোট চাপড় মেরে বলে, ‘ঘণ্টুবাবু যা লায়েক হচ্ছে, এবার ওই আমাদের নিয়ে বেড়াতে বেরোবে, কি বলো ঘণ্টুবাবু?’

    ঘণ্টু মুখ ফিরিয়ে থাকে। মুখ নিচু করে থাকে।

    ঘণ্টু চোখটা কিছুতেই মা-বাপকে দেখতে দেয় না।

    ঘণ্টু যে বড় হয়ে উঠছে, তা বোঝা যায়।

    মাঝে মাঝে কখনো বড় হওয়া ঘণ্টু একটু-এদিক ওদিক সরে গেলে ভারতীও তা’র চোখটা দেখতে না দিয়ে বলে, ‘আমার বাড়িতে তা হলে যাবে না কোনোদিন?’

    ‘যাব না, একথা কবে বললাম?’

    ‘বলো নি। তা সত্যি!’

    ‘গেলেই হলো একদিন!’

    ভারতী চুপ করে যায়।

    ভারতী মনে মনে ভাবে, আশ্চর্য, আমার একটা শক্ত রোগও তো হয় না কখনো! কী অটুট স্বাস্থ্যই দিয়েছেন ভগবান।

    কল্পনা করে—সেই অটুটতা হঠাৎ টুটে গেছে, কলেজ কর্তৃপক্ষ শিশিরকে খবর পাঠিয়েছে—

    কিন্তু কল্পনা কল্পনাই থাকে।

    আবার পরবর্তী রবিবারে স্বাস্থ্য-শক্তিতে টলটলে চেহারাটি নিয়ে এসে দেখা দেয় ভারতী চারুলতা মাসীমার বাড়ি। হয়তো ইচ্ছে করে একটু বেলা করেই আসে, যাতে শিশির একেবারে প্রস্তুত থাকে, কিন্তু সে আশা বড় মেটে না। শিশির ওদের না দেখলে যেন গা তোলে না।

    অগত্যাই ভারতীকে মাসীমার রান্নাঘরের দরজায় এসে বসতে হয়।

    আর ঘণ্টু ছাতে যাবার জন্যে উসখুস করে, তবে আগের মতো জেদ করে না, লাফালাফি করে না। ভারী শান্ত হয়ে গেছে ছেলেটা। শান্ত আর গম্ভীর।

    ধরে নিতে হবে ঘণ্টুও ভালোই আছে। ভালো না থাকলে শান্ত হচ্ছে কি করে? সপ্তাহের পর সপ্তাহ একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে, একই উৎসাহ নিয়ে রবিবার শুরু, আর একই হতাশা নিয়ে রবিবার শেষ হয়।

    অথচ আশ্চর্য, এই জীবনটাকেও এখন আর অস্বাভাবিক লাগে না ওদের। পারিপার্শ্বিকের খাঁজে খাঁজে বসে গেছে সকলেই, বেশ খাপে খাপে খাপ খাইয়ে নিয়েছে নিজেদের।

    বিনিদ্র রাত্রির অপরিসীম ক্লান্তি নিয়েও ভারতী সহজেই সকালবেলা লালমাছগুলোকে খাবার দেয়, ক্যাকটাসের টবগুলোকে আলোর দিকে ঘুরিয়ে দেয়, আর ভাবে, আরও গোটাকতক কিনতে হবে।

    শিশিরও রবিবার সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে বিছানায় হাত-পা ছড়িয়েই ভাবতে শুরু করে, আসছে রবিবারে নতুন কি উপহার দেওয়া যায় ঘণ্টুকে।

    মানুষ যে শক্তিমান এইখানেই তার প্রমাণ। নিজেকে আশ্চর্য রকম ‘অ্যাডজাস্ট’ করে নিতে পারে মানুষ। ‘অ্যাডজাস্ট’ করতে করতেই তার জীবন পরিক্রমা।

    তবু যে কেন নিজেকে নিয়ে ভাবনার শেষ নেই তার, এইটাই প্রশ্নের, এইটাই বিস্ময়ের।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleসেপিয়েন্স: এ ব্রিফ হিস্টোরি অফ হিউম্যানকাইন্ড – ইউভাল নোয়া হারারি
    Next Article ১০টি কিশোর উপন্যাস – আশাপূর্ণা দেবী

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }