Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    আজ চিত্রার বিয়ে – হুমায়ূন আহমেদ

    December 26, 2025

    আমাদের সাদা বাড়ি – হুমায়ূন আহমেদ

    December 26, 2025

    আমি এবং কয়েকটি প্রজাপতি – হুমায়ূন আহমেদ

    December 26, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    আশাবরী – হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ এক পাতা গল্প120 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ২. বাবা এবার খুব হাসি খুশী

    বাবা এবার খুব হাসি খুশী হয়ে ফিরেছেন। সব বার এরকম হয় না। যতবার বাইরে থেকে আসেন তাঁকে ক্লান্ত লাগে, মনে হয় খানিকটা বয়স যেন বেড়েছে। মাথার কয়েকটা চুল বেশী পাকা। চোখের নীচটা যেন আগের চেয়েও সামান্য বেশী ঝুলেছে। এবার ব্যতিক্রম হল। বাবার মাথার সব চুল কুচকুচে কাল। পান খাওয়ার কারণে দাঁতে যে লাল ছোপ ছিল তাও নেই। ঝকঝকে সাদা দাঁত। টুথপেস্টের বিজ্ঞাপন হিসেবে চালিয়ে দেবার মত দাঁত।

    ভাইয়া বলল, চুলে কলপ দিয়েছ নাকি?

    বাবা খানিকটা লজ্জা পেলেন। লজ্জা ঢাকার তেমন চেষ্টা করলেন না। লাজুক গলাতে বললেন, চুল কাটতে গিয়েছি। কাটা শেষ হলে নাপিত বলল, ওয়াশ করে দেব না-কি স্যার? আমি বললাম, দাও। খানিকক্ষণ পরে দেখি এই অবস্থা। ওয়াশ মানে যে কলপ তাতো জানতাম না।

    ভাইয়া বলল, দাঁতের এই অবস্থা করলে কি করে? স্যাঁতও ওয়াশ করেছ?

    আরে না। ডেনটিস্টের কাছে গিয়েছিলাম দাত তুলতে। সে ক্লীন করে দিল।

    ভাইয়া বলল, তুমি তোমার বয়স দশ বছর কমিয়ে নিয়ে এসেছ? একটা রঙচঙা হাফসার্ট পরলে তোমার বয়স পনেরো বছর কম মনে হবে। দেব একটা সার্ট?

    কি কাণ্ড, গোসল করে বাবা সত্যি সত্যি রঙ্গিন সার্ট পরলেন। তার নিজের না, ভাইয়ার। লাল নীল ফুল আঁকা বাহারী সার্ট। মাপে খানিকটা বড় হল। কারণ ভাইয়া হচ্ছে প্রায় ছফুটের কাছাকাছি। তাতে অসুবিধা হল না। বাবাকে সার্টে খুব মানিয়ে গেল। তাঁকে যুবক ছেলের মতই দেখাতে লাগল। তিনি বারান্দায় মোড়ায় বসে পা নাচাতে নাচাতে সিগারেট টানতে লাগলেন। যেন তিনি পৃথিবীর সবচে সুখী মানুষ। গাঢ় গলায় বললেন, কই চা দাও তো, আরাম করে এককাপ চা খাই।

    মা চা নিয়ে বের হলেন। আমরা দ্বিতীয়বার চমকালাম। মার পরণে নতুন শাড়ি। এই শাড়ি বাবা নিয়ে এসেছেন। বাবা সম্ভবত কালার ব্লাইণ্ড। কালার ব্লাইণ্ড না হলে এমন ভয়াবহ রঙের শাড়ি কেনা সম্ভব না। মালটি কালার শাড়িতে মাকেও খুকী খুকী লাগছে। খুকী খুকী লাগার প্রধান কারণ মা কানে দুল পরেছেন। চুল টান টান করে বেণী করেছেন। এমন সাজগোজ করে মা লজ্জায় মরে যাচ্ছেন। কোনমতে বাবার সামনে চায়ের কাপ বেখে রান্নাঘরে পালিয়ে বাচলেন। মার সঙ্গে আমরা ঠাট্টা তামাশা বিশেষ করি না। কারণ তিনি রসিকতা বুঝতে পারেন না। কেঁদে ফেলেন। ভাইয়া যদি ঠাট্টা করে বলতো, ব্যাপার কি মা? আজ কি তোমার বিয়ে? তাহলে মা নিশ্চয়ই চায়ের কাপ ছুড়ে ফেলে চিৎকার করে কেদে একটা কাণ্ড ঘটাতেন।

    বাবা কিছুদিন বাইরে থেকে ফিরলে মা খানিকটা সাজসজ্জা করেন। কিছুটা নিজের ইচ্ছায় তবে বেশীরভাগই বাবার অনুরোধে। শাড়ি না পাল্টানো পর্যন্ত বাবা ঘ্যান ঘ্যান করতে থাকবেন–

    এতদিন পর আসলাম, তুমি ফকিরণী সেজে আছ ব্যাপারটা কি? শাড়িটা পাল্টাও তো। চুল টুল বাধে। একদিন রান্না না করলে কিছু যায় আসে না। না হয় হোটেল থেকে কিছু এনে খেয়ে নিলেই হবে। খাওয়াটা জরুরী না।

    মাকে বাধ্য হয়ে সাজ করতে হয়।

    তেমন কিছু না চুল বাধেন। চোখে কাজল দেন এবং তার একমাত্র গয়না কানের দুল জোড়া পরে ছেলে মেয়েদের সামনে লজ্জা সংকোচে এতটুকু হয়ে যান। আমরা এমন ভাব করি যে ব্যাপারটা কেউ লক্ষ্যই করছি না। কোন একটা ঠাট্টা করার জন্য ভাইয়ার জিব চুলকাতে থাকে। আমি চোখে চোখে ইশারা করি–যেন ঠাট্টা না করে।

    বাবা অনেকদিন পর আসায় আমাদের দিনটা সুন্দরভাবে শুরু হল। আপা বলল, সে ইউনিভার্সিটিতে যাবে না। আপা যেখানে ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছে না, আমার সেখানে কলেজে যাবার প্রশ্নই উঠে না। ভাইয়া যে ভাবে বাবার সামনে পা ছড়িয়ে বসেছে তাতে মনে হয় সেও কোথাও যাবে না।

    বাবা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন, তোর মাকে আজ তো দারুণ লাগছে। লক্ষ্য করেছিস? মনে হয় ষোল সতেরো বছরের খুকী! ঠিক না?

    ভাইয়া বলল, খুব ঠিক।

    বাবা বললেন, একটা ছবি তুলে রাখলে ভাল হত। আজ আবার আমাদের একটা বিশেষ দিন। বিশেষ দিন কেন সেটা আবার জানতে চাস না যেন। সব কিছু ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ডিসকাস করা যায় না। আমি মানুষটা ওড় ফ্যাশান্ড।

    ভাইয়া বলল, আমাকে হিন্টস দাও। বাকিটা আমরা আন্দাজে বুঝে নেব। আজ যে তোমাদের বিয়ের দিন না তা জানি–তোমাদের বিয়ে হয়েছে আগস্ট মাসে, এটা হল জুন। এই দিনে তোমরা কি করেছিলে?

    বাবা চোখ বন্ধ করে চায়ে চুমুক দিতে লাগলেন। ভাবটা এমন যেন প্রশ্নটা শুনতে পান নি।

    বাবা এবং মার অনেকগুলি বিশেষ দিন আছে। এই সব দিনগুলি তারা মনে রাখেন। একটাও ভুলেন না। এবং তাদের মত করে দিনগুলি পালনও করা হয়। কয়েকটা বিশেষ দিন আমরা জানি যেমন মে মাসের দু তারিখ–তাদের প্রথম দেখা। আগষ্ট মাসের আট তারিখ বাবার সঙ্গে পালিয়ে ঢাকায় চলে আসা। নানান ধরনের নাটকীয় কাণ্ড এই দুজন করেছেন। বাবার পক্ষে সবই সম্ভব কিন্তু মার মত শান্তি, সরল এবং খানিকটা বোকা বোকা ধরনের মহিলার পক্ষে কি করে সম্ভব তা কখনো ভেবে পাই না। মা যে কাণ্ড করেছেন, আমি বা আপা কখনো এসব করতে পারব বলে মনে হয় না।

    একটা ছেলে যার সঙ্গে কোন কথা হয় নি শুধু দূর থেকে চোখে চোখে দেখা–সে এক সন্ধ্যায় কাঁদতে কাঁদতে বলল, তুমি আমার সঙ্গে চল। যদি না যাও রেল লাইনে শুয়ে পড়ব। ওমি মা, যার বয়স মাত্র পনেরো, তিনি বাড়ির কাউকে একটা কথা না বলে বের হয়ে গেলেন। এটা কি করে সম্ভব হল, কে বলবে? আমি মাকে একবার খুব শক্ত করে ধরলাম–একটা ছেলেকে তুমি চেন না জান না। তোমাদের মধ্যে কোন কথাও হয় নি। সে এসে বলল, আর তুমি ঘর ছেড়ে বের হয়ে গেলে। কেন এটা করলে বল তো?

    মা বিরক্ত হয়ে বললেন, বাদ দে তো–। দুদিন পর পর এক কৃথা। বাদ দে।

    না বাদ দেব না। বলতে হবে।

    মা ভেজা ভেজা গলায় বলল, ঐ সন্ধ্যায় তোর বাবার সঙ্গে না বের হলে তো সে রেল লাইনে শুয়ে পড়ত। সেটা ভাল হত?

    সে রেল লাইনে শুয়ে পড়ত তা কি করে বুঝলে?

    বুঝা যায়। আমাকে কাঁদতে কাঁদতে বলল।

    ছেলেরা বানিয়ে বানিয়ে এ জাতীয় কথা অনেক বলে।

    তোদের সময় বলে। আমাদের সময় বলতো না।

    না বলতো না–তোমাদের সময় তো ছেলেরা মহাপুরুষ ছিল? সদা সত্য কথা কহিত।

    চুপ কর তো।

    তুমি খুব বোকা ছিলে মা। খুবই বোকা। বাবা না হয়ে অন্য কোন ছেলে হলে তোমার কি যে হত কে জানে।

    যথেষ্ট হয়েছে, চুপ কর।

    বাবাকেও জিজ্ঞেস করেছিলাম, খুব সিরিয়াস গলায় বলেছিলাম, আচ্ছা বাবা, মা যদি ঐ দিন তোমার সঙ্গে না যেত তুমি কি সত্যি সত্যি রেল লাইনে শুয়ে পড়তে?

    বাবা গলা নীচু করে বলেছিলেন, পাগল হয়েছিস? ঐদিন কথার কথা হিসেবে বলেছিলাম। তোর মা যে বের হয়ে চলে আসবে কে জানত। যখন সত্যি সত্যি বের হয়ে এল–মাথায় সপ্ত আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। এমন ভুৱা বয়সের মেয়েকে নিয়ে যাই কোথায়? পকেটে নাই পয়সা। স্টেশনে গিয়ে বসে আছি–তোর মা ক্রমাগত কাঁদছে। একবার ভয়ে ভয়ে বললাম–বাড়িতে ফিরে যাবে? তোর মা কাঁদতে কাঁদতে বলল–না। আমি মনে মনে বললাম, হে আল্লাহ পাক, তুমি আমাকে একি বিপদে ফেললে। ইউনুস নবী মাছের পেটে বসে যে দোয়া পড়েছিলেন–ক্রমাগত সেই দোয়া পড়ছি–লাইলা-হা ইল্লা আনতা সোবাহানাকা ইন্নি কুন্তু মিনাজ জুয়ালেমিন।

    দোয়ায় কাজ হল?

    খানিকটা হল। ট্রেনে উঠার পর তোর মার কান্না থেমে গেল।

    হাসি শুরু করলেন?

    না। গল্প শুরু করল। দুনিয়ার গল্প। এত গল্প যে তার পেটে ছিল কে জানত? আমার কান ঝালাপালা করে দিল। মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে পড়ি তখন সে আমাকে ধাক্কা দিয়ে জাগায়। বিরাট যন্ত্রণা। তার উপর আখাউড়া স্টেশনে টিকিট চেকার এসে টিকিট চাইল। সাড়ে সর্বনাশ। টিকিট কাটি নি।

    কাটনি কেন?

    পয়সা কোথায় টিকিট কাটব?

    তখন কি করলে?

    এই সব শুনে লাভ নেই। বাদ দে।

    বাদ দেব কেন বলনা শুনি।

    তোর মা টাকা দিল। ফাইন দিয়ে টিকিট কাটলাম। আজকাল যেমন বিনা ভাড়ায় চলে যাওয়া যায় কেউ কিছু বলে না। আমাদের সময় খুব কড়াকড়ি ছিল।

    মা কি ভাবে টাকা দিল? তার কাছে টাকা ছিল?

    হুঁ ছিল। মেয়েরা খুব হুঁসিয়ার। কোন মেয়ে কেঁকের মাথায় কিছু করে না, তোর মা তার বাবার ব্যাগ থেকে নগদ তিনশ টাকা নিয়ে এসেছিল। তখনকার তিনশ মানে মেলা টাকা। আমরা দুই মাস এই টাকার উপর বেঁচে ছিলাম।

    বাবা, তোমাদের জীবনের শুরুটা খুব সুন্দর ছিল। ছিল না?

    প্রশ্নটা করেই মনে হল ভুল করেছি। এই প্রশ্ন করা উচিত হয় নি। বাবার হাসি হাসি মুখ করুণ হয়ে গেছে। তিনি তাকিয়ে আছেন অন্যদিকে। কারণ তাঁদের জীবনের শুরুটা খুব সুন্দর ছিল না। তাঁরা কঠিন দুঃসময় পার করেছেন। আমার নানাজান বাবার বিরুদ্ধে কেইস করে দিয়েছিলেন। ফুসলিয়ে নাবালিকা অপহরণের মামলা। পুলিশ চারমাস পর বাবাকে ধরে হাজতে পাঠিয়ে দেয়। মাকে পাঠানো হয়। নানাজানের কাছে। মা তখন অন্তসত্ত্বা। সব জানার পর নানাজান কেইস তুলে নিলেন তবে বাবাকে গ্রহণ করলেন না। মা পুরোপুরি বন্দি হয়ে গেলেন। তাঁদের প্রথম সন্তানের জন্ম হল–আমাদের সবচে বড় বোন–নাম অরু। বাবা তাঁর প্রথম সন্তানের মুখ কোনদিন দেখতে পেলেন না। জন্মের পর পরই আমাদের বড় আপার মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুতে কোন রহস্য কি ছিল? হয়ত ছিল। আমরা জানি না জানতেও চাই না।

    বৎসরের একটা দিনে মা দরজা বন্ধ করে সারাদিন কাঁদেন। বাবা শুকনো মুখে দরজার বাইরে মোড়ায় বসে থাকেন। আমরা জানি এই দিনটি হচ্ছে–বড় আপার মৃত্যু দিন। যে বড় আপার বয়স মাত্র একদিন–কিন্তু একদিন বয়স হলেও সে আমাদের সবার বড়। সে বেঁচে থাকলে আজ আমরা চার ভাইবোন বাবাকে ঘিরে বসে থাকতাম। সে থাকতে বাবার সবচে কাছাকাছি। বড় মেয়েরা তো সব সময়ই বাবার কাছের জন্ম হয়। তা ছাড়া সে আমাদের বাবা-মার ভালবাসাবাসির প্রথম ফুল।

     

    বাবা চা শেষ করে খুশী খুশী স্বরে বললেন, এককাপ চায়ে তো তেমন জুত হল। সেকেণ্ড কাপ অব টি হবে না-কি? তোরা কেউ গিয়ে আরেক কাপ আন। তোর মা রান্নাঘরে বসে আছে কেন? আজ একটা বিশেষ দিন।

    আপা বলল, বিশেষ দিনটা কি বলে ফেল না।

    বাবা বললেন, অতিরিক্ত কৌতূহল ভাল না। বিশেষ করে বাবা-মার পার্সোন্যাল লাইফ সম্পর্কে ছেলেমেয়েদের কোন রকম কৌতূহল থাকা উচিত না। যা হোক এইবার শুধু বলছি–আর কিছু জানতে চাইবি না। চাইলেও লাভ হবে না। বলব না। আজকের দিনটা খুব ইম্পর্টেন্ট কারণ … বাবা কথা শেষ করতে পারলেন না। মা রাগী মুখে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে বললেন–চুপ করবে?

    অহা শখ করে শুনতে চাচ্ছে।

    তুমি যদি মুখ খোল আমি কিন্তু গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেব।

    থাকি তাহলে বাদ দিলাম।

    আপা বলল, তোমরা দুজন কোনখান থেকে ঘুরে আস না কেন? বাইরে কোন রেস্টুরেন্টে খাও। এখানের রান্নাবান্না আমি করব।

    বাবা বললেন, আইডিয়া খারাপ না। মিনু যাবে?

    মা বললেন, মরে গেলেও না।

    মার কথা এবং কাজ এক হল না। কিছুক্ষণের ভেতর মাকে দেখা গেল লজ্জা লজ্জা মুখে বের হচ্ছেন। বাবার গায়ে ভাইয়ার রঙিন সার্ট। সার্টটাকে এখন আরো বড় লাগছে। বাবাকে খুবই হাস্যকর দেখাচ্ছে। লম্বা সটি পরলে বেটে মানুষকে যে আরো বেঁটে লাগে তা আমার জানা ছিল না।

    বাবা বেশ কিছু টাকা পয়সা নিয়ে এসেছেন। এও এক রহস্য। তাঁর ব্যবসা এমনই যে কখনো হাতে কিছু থাকে না। বাড়িভাড়া দেয়া হয় তো দোকানে বাকি থাকে। যেবার দোকান ক্লিয়ার করা হয় সেবার বাইরের কারোর কাছে ধার হয়।

    এবার সব ধার মিটিয়ে দেয়া হল। তিন মাসের বাড়িভাড়া নিয়ে আমি দোতলায় উঠে গেলাম। সুলায়মান চাচা বসার ঘরে টিভির সামনে বসে ছিলেন। আমাকে দেখে শুকনো গলায় বললেন, কী খবর?

    আমি বললাম, বাড়িভাড়া দিতে এসেছি চাচা।

    ক মাসের?

    তিন মাসের।

    টেবিলের উপর রেখে দাও।

    কেমন শুকনো গলা। যেন আমাকে চেনেন না। কিংবা চেনেন কিন্তু পছন্দ করেন না। এরকম হবার কথা নয়। সুলায়মান চাচা ভাইয়ার মত আমাকেও পছন্দ করেন। প্রসঙ্গ ক্রমে বলে রাখি, বেশীরভাগ মানুষই কিন্তু আমাকেও পছন্দ করে। আমি যাদের ভয়াবহ রকমের অপছন্দ করি তারাও আমাকে পছন্দ করে। সুলায়মান চাচা আজ এমন করছেন কেন বুঝতে পারলাম না। এমন না যে টিভিতে খুব মজার কোন অনুষ্ঠান হচ্ছে। বেগুন চাষের সমস্যা নিয়ে টেকোমাথা এক লোক বকবক করছে। লোকটার হাতে বিরাট একটা বেগুন। সুলায়মান চাচা এক দৃষ্টিতে বেগুনটার। দিকে তাকিয়ে আছেন। যেন পৃথিবীর যাবতীয় রূপ-রস-গন্ধ ঐ বেগুনটা ধারণ করে আছে। বাড়িভাড়ার টাকাটাও গুনে দেখছেন না। যে কাজটা তিনি সব সময় করেন। গোনা শেষ করে এমনভাবে তাকান যেন শখানেক টাকা কম হয়েছে। এই সময় আমার বুক টিপ টিপ করতে থাকে।

    রেনু!

    জ্বি।

    রশিদ আমি পরে পাঠিয়ে দেব।

    জি আচ্ছা।

    জ্বি আচ্ছা বলার পরেও আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। তাকিয়ে আছি টিভির দিকে যেন আমিও ঐ বেগুনটাকে দেখে খুব মজা পাচ্ছি।

    রেনু।

    জ্বি।

    বসবি না-কি?

    আপনি বললে বসব।

    সুলায়মান চাচা কিছু বললেন না। আমি নিজের থেকেই বসলাম। সুলায়মান চাচার ঠিক পাশে। যেন ইচ্ছা করলেই তিনি আমার পিঠে হাত রাখতে পারেন। মাঝে মাঝে কথা বলার সময় তিনি পিঠে হাত রাখেন। যেন আমি তাঁর সবচে আদরের ছোট একটা মেয়ে। সুলায়মান চাচার আদর করে কথা বলার এই ভঙ্গিটা আমার খুব ভাল লাগে।

    রেনু!

    জ্বি।

    মনটা খুব খারাপ রে রেনু।

    কেন?

    জামাই তিনটা বড় বিরক্ত করছে।

    সে তো সব সময়ই করে।

    এবার বেশী করছে। এদের নিজেদের মধ্যে কোন মিল নেই। একজন আরেকজনকে দেখতে পারে না কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে মিলের অন্ত নেই। তিনজন, মিলে আমাকে ভাজা ভাজা করে ফেলছে।

    তাঁরা চান কি?

    তারা চায় বাড়িটা যেন আমি ওদের লিখে দি। ওরা বাড়ি ভেঙ্গে মাল্টিস্টোরিড এ্যাপার্টমেন্ট হাউস করবে।

    আপনি কি বললেন?

    এখনো কিছু বলিনি–রঞ্জুর কাছে পরামর্শ চেয়েছি। সেও কিছু বলছে না।

    ভাইয়ার কাছে পরামর্শ চেয়ে লাভ নেই চাচা–ও এমন পরামর্শ দেবে যে রাগে আপনার গা জ্বলে যাবে।

    আরে না–কি যে তুই বলিস। ওর পরামর্শ প্রথমে খুব হাস্যকর মনে হলেও শেষে দেখা যায় ঠিক আছে।

    আপনার মেয়েরা কি বলে চাচা?

    ওরা হচ্ছে হিজ মাস্টারস ভয়েস–জামাইরা যা বলে ওরা তাই বলে। আমাকে বুঝাতে চায়–শিখিয়ে দেয়া কথা নিজের মত করে বলার চেষ্টা করে–ভাঙ্গা বাড়ি করবে বাবা? বিশাল মাল্টিস্টোরিড কমপ্লেক্স হবে। সবচে উপরের ফ্ল্যাটে থাকবে তুমি। হাত পা ছড়িয়ে বাস করবে। আমরা তিন বোন থাকব তোমার কাছাকাছি। এই বয়সে তো সেবা দরকার বাবা।

    সুলায়মান চাচা চুপ করে গেলেন। তাকিয়ে আছেন টিভির দিকে। টিভিতে ক্লোজ আপে বেগুনের পাকা দেখা যাচ্ছে। ভয়ংকর লাগছে পোকাগুলিকে। আমি বললাম, চাচা যাই?

    তিনি কোন জবাব দিলেন না। পোকা দেখতে লাগলেন যেন পোকাঁদের ভেতর পৃথিবীর সব সৌন্দর্য প্রকাশ পেয়েছে। সেই সৌন্দর্য আমাকে তেমন আকর্ষণ করল না। আমি ঠিক করলাম দুলু আপার সঙ্গে খানিকক্ষণ গল্প করব। যদিও আজ দুলু আপাদের বাড়ি যাওয়া নিষিদ্ধ। শুক্রবার সন্ধ্যার পর তাদের বাড়িতে যাওয়া যায় না। দুলু আপার নিষেধ আছে। ঐ দিন দুলু আপার বাবা মদ্যপান করেন। অল্পতেই তাঁর নেশা হয়। তিনি হৈ চৈ করে নানা কাণ্ড করেন। দুলু আপা চান না সেই দৃশ্য আমি দেখি। ঐ দৃশ্য দেখার জন্যেই আমার শুধু শুক্রবারেই তাঁদের বাড়ি যেতে ইচ্ছা। করে। বেশ কবার গিয়েছি এখনো কিছু দেখিনি।

    আমি চলে গেলাম দুলু আপার ঘরে। দোতলার শেষ প্রান্তে দুলু আপার ঘর। ছোট্ট একটা খাট, সঙ্গে লাগোয়া চমৎকার ড্রেসিং টেবিল। আয়নাটা প্রকাণ্ড। আয়নার সামনে দাঁড়ালে এম্নিতেই মন ভাল হয়ে যায়। ঘরের এক কোণায় পুরনো ধরনের রেডিওগ্রাম। বেশীর ভাগ সময়ই দুলু আপার ঘরে ঢুকলে গান শোনা যায়। রেডিওগ্রামে সাতটা রেকর্ড চাপানো থাকে। শেষ হলেই নতুন রেকর্ড চাপানো হয়।

    আজ গান হচ্ছে না। দুলু আপার ঘরও অন্ধকার। আমি দরজার ফাঁক করে দেখি ঠাণ্ডা মেঝেতে আঁচল বিছিয়ে দুলু আপা শুয়ে আছেন। এটিও তাঁর এক অদ্ভুত অভ্যাস সিমেন্টের মেঝে সব সময় ধুয়ে মুছে রাখেন। বেশীর ভাগ সময় শুয়ে থাকেন মেঝেতে হাতে বই।

    দুলু আপা আসব?

    আয়।

    ঘর অন্ধকার কেন?

    মাথা ধরেছে। আয় আমার পাশে বস।

    আমি বসতে বসতে বললাম, চাচা কোথায়?

    দুলু আপা সহজ গলায় বললেন, নিজের ঘরেই আছেন। বাবাও আমার মত ঘর অন্ধকার করে বসে আছেন। ঐ দিকে খবর্দার যাবি না।

    চাচা কি করছেন?

    জানি না কি করছে। আমের সরবত খাবি?

    এখন তুমি আমের সরবত কোথায় পাবে?

    ডীপ ফ্রীজে আম আছে। খেতে চাইলে বানিয়ে দেই। বেশীক্ষণ লাগবে না। দেব?

    না।

    অন্য কিছু খাবি?

    উহুঁ। গান শুনব দুলু আপা।

    দুলু আপা ক্লান্ত গলায় বললেন, আজ থাক। অন্যদিন শুনবি। আজ মনটা ভাল নেই।

    আমি কি চলে যাব?

    না। তোকে আমি একটা চিঠি পড়াব। মন দিয়ে পড়ে বলবি চিঠিটা কেমন হয়েছে।

    তোমার লেখা চিঠি?

    হ্যাঁ।

    কাকে লিখেছ?

    সেটা তোর জানার দরকার নেই। তুই শুধু পড়বি। বানান ভুল থাকলে ঠিক করে দিবি।

    প্রেমপত্র নাকি?

    এত কথার দরকার কি?

    দাও পড়ি।

    দুলু আপা হাসতে হাসতে বললেন, দেবো। এত ব্যস্ত কেন? চিঠি পড়ে তুই। একটা শক খাবি। এখন চুপচাপ বসে থাক। অন্ধকারে চুপচাপ বসে থাকার মধ্যে এক ধরনের মজা আছে। মাঝে মাঝে আমি কি করি জানিস? দরজা জানালা সব বন্ধ করে ঘর নিকষ অন্ধকার করি। তারপর মেঝেতে চুপচাপ বসে থাকি। অল্প কিছুক্ষণ বসে থাকলেই মনে হয়–অনন্তকাল পার হয়েছে। টাইম স্লো হয়ে যায়।

    চিঠিটা দাও দুলু আপা, পড়ি।

    দুলু আপা চিঠি দিলেন। রেডিওবণ্ড কাগজে গোটা গোটা করে লেখা দীর্ঘ চিঠি। বিষয়বস্তু হচ্ছে–পূর্ণিমা রাতে রাস্তার সোডিয়াম বাতিগুলি যদি নেভানো থাকে তাহলে নগরবাসীরা পূর্ণিমা উপভোগের সুযোগ পায়। ঢাকা মিউনিসিপ্যালটি কি এই কাজটি করবে? ভরা পূর্ণিমার সময় রাত ১১টা থেকে রাত তিনটা পর্যন্ত রাস্তার সব বাতি নিভিয়ে দেবে? তখন তো চাঁদের আলোই থাকবে। কৃত্রিম বাতির প্রয়োজন কি?

    চিঠিটা কেমন?

    ইন্টারেস্টিং।

    দুলু আপা হাসতে হাসতে বললেন, তুই মনে হয় আরো ইন্টারেস্টিং কোন চিঠি আশা করেছিলি? কি করেছিলি না?

    হুঁ।

    দুলু আপা বাতি নিভিয়ে দিয়ে বললেন, নিজ থেকে আমি কখনো কোন ছেলেকে চিঠি লিখব না। কখনো না।

    লিখলে ক্ষতি কি?

    ক্ষতি আছে। কেউ যদি আমার সেই চিঠি নিয়ে হাসাহাসি করে আমার খুব কষ্ট হবে।

    এমন কাউকে লিখবে না যে তোমার চিঠি নিয়ে হাসাহাসি করবে।

    যাকে লিখতে চাই সে তাই করবে। হাসহাসি করবে। সবাইকে পড়ে শোনাবে। চিঠির ভাষা নিয়ে ক্যারিকেচার করবে।

    তোমার মনের কথা পৌঁছানো দিয়ে কথা। সে কি করবে না করবে তা দিয়ে তোমার প্রয়োজন কি?

    তুই এসব বুঝবি না। আচ্ছা তুই এখন যা।

    দুলু আপার ঘর থেকে বেরিয়েই দেখি সিঁড়ির মাথায় দুলু আপার বাবা। তিনি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আমি বললাম, স্নামালিকুম চাচা।

    তিনি গম্ভীর গলায় বললেন–কে? হুঁ আর ইউ।

    চাচা আমি রেনু।

    রেনুটা কে?

    আমি ঐ বাড়িতে থাকি?

    এখানে কি চাও?

    কিছু চাই না।

    আমাদের কথাবার্তা শুনে দুলু আপা বের হয়ে এলেন। তাঁর বাবার দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বললেন–তুমি ঘরে যাও বাবা।

    উনি সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ঘরের দিকে রওনা হলেন। রেলিং ধরে ধরে কেমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে টলতে টলতে যাচ্ছেন। আমি আগে মাতাল দেখিনি–এই প্রথম দেখলাম। বুকের মধ্যে ধ্বক করে উঠল।

    দুলু আপা বললেন, বাসায় যা রেনু। দাঁড়িয়ে আছিস কেন?

    আমি ক্ষীণ গলায় বললাম, যাচ্ছি।

    তুই কি ভয় পেয়েছিস?

    হুঁ।

    কেন? বাবা কিছু বলেছে তোকে?

    না।

    তাহলে ভয় পেলি কেন? আয় আমি তোকে এগিয়ে দিচ্ছি।

    এগিয়ে দিতে হবে না দুলু আপা।

    আমি সিঁড়ি বেয়ে নামছি। হঠাৎ মনে হল আমি নিজেও অবিকল দুলু আপার বাবার মতই টলতে টলতে নামছি। এক হাতে সিড়ির রেলিং ধরে আছি। সিঁড়ির গোড়ায় এসে পেছনে ফিরলাম। দুলু আপা এখনো দাঁড়িয়ে আছেন।

    আমি খানিকটা মন খারাপ করে বাসায় ফিরলাম। দুলু আপাকে আমি বেশ পছন্দ করি। তাঁকে যতটা পছন্দ করি নিজের আপাকে ততটা করি না। মাঝে মাঝেই আমার মনে হয় মীরা আপা আমার বোন না হয়ে দুলু আপা বোন হলে বেশ হত।

    তার মানে এই না যে আপাকে আমি পছন্দ করি না। করি। তবে কেন জানি খানিকটা ভয় ভয়ও লাগে। একজন মানুষ খুব পরিচিত একজনকে তখনি ভয় করে যখন সে তাকে বুঝতে পারে না। আপাকে আমি ঠিক বুঝতে পারি না। আগে আমরা দুবোন একটা ঘরে ঘুমুতাম। বড় একটা খাট ছিল ঘরের মাঝখানে যাতে কাউকেই কিনারে শুতে না হয়। ঘুমুতে যাবার আগে আপা আমার চুল বেঁধে দিত। এই সময় হালকা গলায় গল্প গুজব করত। একদিন হঠাৎ বলল, রেনু, এখন থেকে তুই কি ভাইয়ার ঘরে শুবি? ওখানে তো এক্সট্রা চৌকি আছে। আমার একা ঘুমুতে ইচ্ছে করে।

    আমি বললাম, আচ্ছা।

    তুই মন খারাপ করলি না তো?

    না।

    মাঝে মাঝে আমার খুব একা থাকতে ইচ্ছা করে। সব সময় না, মাঝে মাঝে।

    বুঝতে পারছি।

    না বুঝতে পারছিস না। এটা এত সহজে বোঝার জিনিস না।

     

    আমি চলে এলাম ভাইয়ার ঘরে। এম্নিতেই ঘরটা ছোট–তার উপর দুটা চৌকি। ঘরে ঢুকলেই দম বন্ধ হয়ে আসে। তার উপর রোজ ভাইয়া রাত করে ফিরে। আমাকে দরজা খুলে দেবার জন্যে জেগে থাকতে হয়। ইদানীং আবার সিগারেট ধরেছে। ঘুমুবার আগে বিছানায় শুয়ে সিগারেট হয়ে যায়। আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। কি বিশ্রী অবস্থা। আমি একদিন বললাম, সিগারেট বারান্দায় খেলে কেমন হয়?

    ভাইয়া পা নাচাতে নাচাতে বলল, ভালই হয় কিন্তু সব কিছুর একটা নিয়ম আছে। দিনের শেষ সিগারেট বিছানায় শুয়ে পা নাচাতে নাচাতে খেতে হয়, এটাই নিয়ম। নিয়ম তো ভঙ্গ করতে পারি না। এই জন্যেইতো পা নাচাচ্ছি।

    আমার তো ভাইয়া দম বন্ধ হয়ে আসছে।

    বুঝতে পারছি। বাট আই কান্ট হেল্প। আমার ঘরে বাস করলে এই কষ্ট সহ্য করতেই হবে। উপায় নেই।

    ভাইয়ার সঙ্গে বাস করার কিছু অসুবিধা যেমন আছে–সুবিধাও আছে। প্রায় রাতেই সে অনেকক্ষণ গল্প করে। মজার মজার গল্প। মুগ্ধ হয়ে শুনতে হয়। কিছু কিছু গল্প তার নিজের বানানো–যেমন আধুনিক কালের ঈশপের গল্প। পুরানো গল্প–কাক মাংসের টুকরা নিয়ে গাছে বসেছে, শিয়াল এসে বলল–কাক ভাই তোমার গলাটা বড় মিষ্টি। একটা গান গাও না। কতদিন তোমার গলার মধুর কী—কা ধ্বনি শুনি নি। ঈশপের গল্পে কাক তখন গান ধরে। কিন্তু ভাইয়ার গল্পে গান ধরে না। কারণ সৌভাগ্যক্রমে ঈশপের গল্পটি তার পড়া। সে এমন সব কাণ্ড কারখানা করে যে শুনে হাসতে হাসতে দম বন্ধ হয়ে আসে। এত কাণ্ড করেও কাকের শেষ রক্ষা হয় না–মাংসের টুকরা চলে যায় শিয়ালের পেটে। এই গল্পগুলি লিখে ফেললে চারদিকে হৈ চৈ পড়ে যেত কিন্তু সে লিখবে না।

    ভাইয়ার ঘরে একটা টেবিল ফ্যান আছে–এইটি সে দিয়ে রাখে আমার দিকে। সে না-কি হিট প্রুফ–গরমে তার কিছু হয় না, বরং সুনিদ্রা হয়। এটা অবশ্য মিথ্যা কথা। গরম অসহ্য বোধ হওয়াতেই সে তার কোন এক বন্ধুর কাছ থেকে এই যান নিয়ে এসেছিল। আমি তার ঘরে চলে আসায় বেচারাকে বাধ্য হয়ে যানটা আমাকে দিয়ে দিতে হয়েছে।

    আপনি বোধ হয় ভাবছেন–মেয়েটা কি স্বার্থপর! নিজে ফ্যানের বাতাস খাচ্ছে–বড় ভাই গরমে সিদ্ধ হচ্ছে।

    আসলে তা কিন্তু না। আমার ভাইয়ার মত চট করে ঘুম আসে না। ভাইয়া ঘুমুবার পরেও আমি অনেকক্ষণ জেগে থাকি। তারপর ফ্যানের মুখ ঘুরিয়ে দেই ভাইয়ার দিকে। ভাদ্রমাসের অসহ্য গরমে ছটফট করতে করতে ভাবি, একদিন যখন আমাদের খুব টাকা-পয়সা হবে তখন ঘরে ঘরে এয়ার কুলার থাকবে। সবগুলি ঘর থাকবে বরফের মত হিম শীতল। ভাদ্র মাসের গরমে লেপ গায়ে ঘুমুব।

     

    রাত এখন বাজছে একটা দৃশ। আমি ভাইয়ার জন্য অপেক্ষা করছি। বাবা অনেকক্ষণ C গে ছিলেন, কিছুক্ষণ আগে ঘুমুতে গেলেন। ভাইয়া রাতে ভাত খাবার সময় না থাকায় তিনি বেশ মন খারাপ করেছেন। কিছু দিন বাইরে কাটিয়ে ফিরলেই বাবা সবাইকে নিয়ে খাওয়ার ব্যাপারটায় খুব গুরুত্ব দিতে থাকেন। আজ বিকেলে তিনি নিউ মার্কেট থেকে কাতল মাছের একটা বিশাল মাথা কিনে এনেছেন। সেই মাথার মুড়িঘণ্ট রান্না হল। রান্নার সময় বাবা পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করলেন এবং মাকে নানান উপদেশ দিতে লাগলেন–একটু ঝোল ঝোল রাখ, শুকনো হয়ে খেয়ে আরাম পাওয়া যাবে না। কয়েকটা আলু কুচি কুচি করে দিয়ে। দাও–আলু গলে ঝোলটা ঘন করবে, খেতে আরাম হবে। পাচ ফোরণ আছে? এক চিমটি পাঁচ ফোরণ ডোজ দিয়ে দাও না–সুন্দর গন্ধ হবে। গোটা পাঁচেক আস্ত কাঁচামরিচ দিয়ে দাও কাঁচামরিচের সুঘ্রাণ তুলনাহীন।

    রান্নার এক ফাঁকে মা এসে আমাকে আর আপাকে চুপি চুপি বলে গেলেন, মাছের মাথাটা পচা ছিল–খেতে ভাল হবে না। তোর বাবাকে কিছু বলিস না, মনে কষ্ট পাবে। বেচারা শখ করে কিনেছে।

    আপা বলল, পচা মাছ খেয়ে তো অসুখ করবে মা।

    এত পচা না। কষ্ট করে খেয়ে নিস মা–

    খাবার সময় মোটামুটি করুণ দৃশ্যের অবতারণা হল বলা যেতে পারে–বাবা নিজেই মাছ মুখে দিতে পারলেন না–মুখ কুঁচকে বললেন–মাথাটা পচা নাকি?

    মা বললেন, না তো। টাটকা মাথা। কানকো লালটকটকে ছিল।

    খেতে এমন লাগছে কেন? পচা গন্ধ পাচ্ছি।

    আমি বললাম, তুমি উল্টা-পাল্টা ডিরেকশন দিয়ে মাছটা নষ্ট করেছ বাবা।

    আপা বলল, আমার কাছে খেতে তো ভালই লাগছে।

    বাবা বললেন, খেতে খারাপ হয় নি। গন্ধটা ডিসটার্ব করছে। রঞ্জু থাকলে এই গন্ধ নিয়ে কিছু একটা বলে সবাইকে হাসিয়ে মারত। ও কি রোজ ফিরতে দেরী করে?

    আমি বললাম, মাঝে মাঝে করে।

    এটা ঠিক না। ওকে বুঝিয়ে বলতে হবে। ঢাকা শহর এখন আগের মত সেফ না–। রাত বিরেতে চলাচল বন্ধ করতে হবে। আমি আজ ওকে বলব। কড়া গলায় বলব–অবশ্যি তাকে কড়া গলায় কিছু বলাও মুশকিল। ফানি ম্যান। এমন কিছু বলবে যে হাসতে হাসতে জীবন যাবে।

    বলেই বাবা হাসতে লাগলেন। সেই হাসি থামতে সময় লাগল। হাসি থামে, দুএক নলা ভাত খান। আবার হাসেন।

    ভাইয়া ফিরল রাত দেড়টায়। ঘরে ঢুকেই বলল, খুকী জেগে আছিস? আমার দুটা ডাক নাম, একটা খুকী, অন্যটা রেনু। খুকি নামে এখন কেউ ডাকে না, আমি নিষেধ করে দিয়েছি। কেউ যদি ভুল করেও ডাকে আমি রাগারাগি করি। শুধু ভাইয়া ডাকে। আমাকে রাগাবার জন্যেই ডাকে। রাগ করলে আরো বেশী ডাকবে বলে চুপ করে থাকি। ভাইয়া সার্ট খুলতে খুলতে বলল, কথা বলছিস না কেন? জেগে আছিস না-কি?

    না ঘুমিয়ে আছি। আচ্ছা ভাইয়া, এত দেরী করলে? বাবা তোমার জন্যে এতক্ষণ জেগেছিলেন। রাতে তোমার জন্য অপেক্ষা করে আমরা ভাত খেয়েছি এগারোটার সময়।

    মেনু ছিল কি?

    মাছের মাথা–মুড়িঘণ্ট। বাবা নিজে মাথা কিনে আনলেন।

    ভাইয়া শুকনো গলায় বলল, নিশ্চয়ই পচা ছিল। আজ পর্যন্ত কোনদিন বাবা টাটকা মাথা কিনতে পারেন নি। আমি একশ টাকা বাজি রাখতে পারি, মাথাটা ছিল পচা তোরা কেউ খেতে পারিস নি।

    মাথা ভালই ছিল। ভাইয়া তুমি কি খেয়ে এসেছ না খাবার গরম করব?

    খেয়ে এসেছি–আভা আজ তাদের বাসায় নিয়ে গেল। আভার মা খাইয়ে দিলেন।

    কোন আভা?

    এমন ভাবে বললি যেন দশ বারোটা আভার সঙ্গে আমার খাতির। কথাবার্তা চিন্তা-ভাবনা করে বল। প্রশ্ন করতে হয় বলেই যে বলতে হবে–কোন আভা?

    তাতো ঠিক না।

    সরি।

    সরি হলে ভাল–তুই এখন যা, আমার জন্য ফ্লাস্ক ভর্তি করে চা বানিয়ে আন। আজ সারারাত জাগতে হবে। পত্রিকায় একটা ভাল এ্যাসাইনমেন্ট পেয়েছি। প্রচ্ছদ কাহিনী–বিষয় হল, ঢাকা শহরে ভ্রাম্যমান পাগল। ঠিকঠাক মত নামতে পারলে এক হাজার টাকা পাওয়া যাবে। আভা আমাকে সাহায্য করছে। ও নেৰে চারশ–আমি দুশ …।

    আভা নামের মেয়েটির কথা ভাইয়ার মুখে কয়েকবার শুনেছি, এখনো দেখিনি। আমাদের বাসায় কখনো আসেনি। মেয়েটা শতদল পত্রিকায় কাজ করে। ভাইয়ার ভাষায় খুব ফাইটিং টাইপ মেয়ে–বেঁচে থাকার জন্য ফাইট দিয়ে যাচ্ছে। মানি প্ল্যান্ট জাতীয় মেয়ে না–ছোট ছোট তিনটা ভাই বোন, অসুস্থ মা–সে একা রোজগার করছে। দিন রাত পরিশ্রম করছে।

    কি রে খুকি এখনো দাঁড়িয়ে আছিস, ব্যাপার কি? চা নিয়ে আয়। ফ্লাস্ক ভর্তি করে আনবি?

    ফ্লাস্ক পাব কোথায়?

    ঐদিন যে একটা দেখলাম?

    দুলু আপাদের ফ্লাস্ক।

    ও আচ্ছা, তাহলে তো তোর কাজ বেড়ে গেল। তোকেও জেগে থাকতে হবে–ঘণ্টায় ঘণ্টায় আমাকে চা খাওয়াতে হবে। ছোট বোন হয়ে জন্মানোর অনেক যন্ত্রণা।

    আমি বললাম, আভা মেয়েটা দেখতে কেমন?

    ভেরি অর্ডিনারী। সাজলে জলে হয়ত সুন্দর দেখাবে। সাজার সময় কোথায়? সাজতে তো পয়সাও লাগে। পয়সা কোথায়? একটা মাত্র ঘর সাবলেট নিয়ে এতগুলি মানুষ থাকে। কি ভাবে বাস করে না দেখলে বিশ্বাস করবি না। আমি ওদের বাসায় গিয়ে অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গেলাম, বুঝলি খুকী? আমার ধারণা ছিল–আমরাই বোধ হয় সবচে গরীব। ওদের বাড়িতে রাতে কি রান্না হয়েছে জানিস–শুধু ভাত আর ডাল। স্বাস্থ্যবান ভাত ইয়া মোটা মোটা।

    তুমি ডাল ভাত খেয়ে এলে?

    না, আভা গিয়ে আমার জন্যে ডিম কিনে নিয়ে এল। সেই ডিম ভাজা হল। আভার একটা ছোট বোন আছে তার নাম শেফা। সে খুব গোপনে ফ্রকের আড়ালে একটা বাটি নিয়ে গেল পাশের বাড়ি। সেখান থেকে খানিকটা মাছের তরকারীও এল।

    ভাইয়া হাত-মুখ ধুয়ে কাগজ-কলম নিয়ে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। আমি চা বানিয়ে আনলাম। ভাইয়া বলল, এক কাজ কর তো খুকী। তোর ফ্যানটা আমাকে ধার দে। বড় বেশী গরম। আর শোন, একটা গামছা ভিজিয়ে আমার পিঠের উপর দিয়ে দে। তাহলে মশা বিশেষ কায়দা করতে পারবে না। শরীরটাও ঠাণ্ডা থাকবে।

    আমি ভাইয়ার পিঠে ভেজা গামছা দিয়ে বারান্দায় মোড়া পেতে বসলাম। ঘরে আলো থাকলে আমার ঘুম হয় না। এরচে বারান্দায় বসে থাকা ভাল। বারান্দায় খানিকটা বাতাস আছে। বসে থাকতে খুব খারাপ লাগছে না।

    আমি চুপচাপ বসে আছি। দুলু আপা গান বাজনো শুরু করেছেন। তার মন খারাপ ভাবটা সম্ভবত কেটেছে। একজন মানুষ বেশীক্ষণ যেমন মন ভাল রাখতে পারে না–বেশীক্ষণ মন খারাপও রাখতে পারে না। তিনি নিশ্চয়ই খাওয়া-দাওয়াও করেছেন। ক্ষুধার্ত অবস্থায় কেউ গান শুনতে পারে না। সংগীত ক্ষুধার্ত মানুষের বিষয় নয়।

    ওকে ধরিলে তো ধরা দেবে না–
    ওকে দাও ছেড়ে দাও ছেড়ে…

    দুলু আপার অসংখ্য রের্কড কিন্তু গভীর রাতে তিনি অল্প কিছু গান ঘুরে ফিরে বাজান। কোন কোন রাতে এমন হয় যে একই গান বার বার বাজাচ্ছেন। কে জানে আজ হয়ত এই গানটাই পঞ্চশবার বাজাবেন।

    বসে থাকতে থাকতে আমার ঝিমুনি ধরে গেল। ভাইয়ার ঘরের দরজা বন্ধ বলেই বারান্দা অন্ধকার হয়ে আছে। এখন বেশ বাতাস ছেড়েছে। বারান্দায় পাটি পেতে ঘুমুতে পারলে ভাল হত। আকাশে মেঘ করেছে। কয়েকবার বিদ্যুৎ চমকাল। বৃষ্টি নামলে খুব ভাল হয়। আরাম করে ঘুমানো যায়। এবার গরমটা বেশী পড়েছে। ভাইয়া ভেতর থেকে চেঁচাল।

    ও খুকি চা দে।

    আমি আবার চা বানিয়ে আনলাম। যা ভেবেছিলাম তাই। দুলু আপা একই গান বারে বারে বাজাচ্ছেন–

    ওকে ধরিলে তো ধরা দেবে না–
    ওকে দাও ছেড়ে দাও ছেড়ে…

    ভাইয়া চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে বলল, আমাকে যদি বলতো ঢাকা শহরের গৃহবন্দী পাগলের উপর প্রচ্ছদ কাহিনী লিখতে–আমি সবার প্রথমে লিখতাম তোর দুল আপার কথা। দেখ একই গান বার বার বাজাচ্ছে। এই ভাবে মানুষকে বিরক্ত করার কোন মানে হয়?–ওকে ধরিলে তো ধরা দেবে না … কান ঝালাপালা হয়ে গেল। যাকে ধরিলে ধরা দেবে না তাকে ধরার জন্যে এত মাতামাতি কেন? ছেড়ে দাও চড়ে খাক। ইশ কি বিরক্ত যে এই মেয়েটা করে।

    তুমি জেগে আছ তাতে আর উনি জানেন না? তোমার লেখা এগুচ্ছে কেমন?

    মোটেই এগুচ্ছে না। শুরুটা নিয়েই সমস্যা–একটা ইন্টারেস্টিং ওপেনিং দরকার–সেটা পারছি না। যাকে বলে শুরুতেই পাঠককে একটা চমক দেয়া–দেখ তো এই শুরুটা তোর কাছে কেমন লাগে–তুই পড়বি না আমি পড়ে শোনাব?

    তুমিই পড়ে শোনাও। তোমার হিজিবিজি হাতের লেখা আমি পড়তে পারি না।

    ভাইয়া পড়তে শুরু করল–ধরুন, আপনি ঢাকা শহরে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন। হঠাৎ দেখলেন পুরোপুরি নগ্ন একজন মানুষ আইল্যাণ্ডে পঁড়িয়ে হাত তুলে ট্রাফিক কনট্রোল করছে। ট্রাফিক পুলিশ যে ভাবে বাঁশি বাজায় সেই ভাবেই পিপ পিপ করে মুখে বাঁশি বাজানোর আওয়াজ করছে–তখন আপনি কি করবেন? বিরক্ত হবেন? তার সিগন্যাল উপেক্ষা করে গাড়ি নিয়ে পার হয়ে যাবেন নাকি সিগন্যাল মানবেন?

    নওয়াবপুর রোডের মোড়ে এক পাগল ট্রাফিক কনট্রোল করে–যার সিগন্যাল সবাই মানে। সে যখন হাত উঠিয়ে গাড়ি থামতে বলে তখন সব গাড়ি থামে। চলতে বললে চলে। বদ্ধ উন্মাদি এই ব্যক্তি ট্রাফিক কনট্রোল করে খুব সুন্দর ভাবে। মোড়ের ট্রাফিক পুলিশ তার কাছে দায়িত্ব দিয়ে চা-টা খেতে যায়। খুকি ঘুমিয়ে পড়েছিস?

    না–শুনছি।

    কেমন লাগছে?

    ভাল। সত্যি এমন কেউ আছে নাকি?

    অবশ্যই আছে। আমি তো গল্প লিখছি না। সত্য অনুসন্ধানী রিপোর্ট। আভা যখন এই লোকটার কথা বলল তখন আমি নিজেও বিশ্বাস করি নি। আভা আমাকে নিয়ে গেল। পাগলটার সঙ্গে কথাটথা বললাম। ভেরী ইন্টারেস্টিং ক্যারেকটার।

    সত্যি পাগল?

    হুঁ–যাই জিজ্ঞেস করি হাসে আর বলে–খিস খিস।

    ভাইয়া আমি বারান্দায় চাদর পেতে শুচ্ছি–তোমার লেখা শেষ হলে আমাকে ডেকে দিও।

    তোকে মনে হয় কষ্টের মধ্যে ফেললাম–কুলি ছুটি আছে সারাদিন ঘুমুতে পারবি। আজ একটু কষ্ট কর। শেষ বারের মত এক কাপ চা নিয়ে আয়।

    চা এনে দেখি লেখা খাতার উপর মাথা রেখে ভাইয়া ঘুমুচ্ছে–।

    ভাইয়াকে জাগালাম না। বাতি নিভিয়ে দিলাম। ঘড়িতে রাত সাড়ে তিনটা বাজে। এখন আর ঘুমুতে যাবার কোন মানে হয় না। ঘুম আসতে আসতে আধঘণ্টা লাগবে। তারপর যেই ঘুমটা আসবে, ভোর হবে। ঘরে রোদ ঢুকে যাবে। জেগে উঠতে হবে। আধঘণ্টা, একঘণ্টা ঘুমুনোর চেয়ে না ঘুমানো ভাল।

    আমি বারান্দায় চলে এলাম। এক মাথা থেকে আরেক মাথায় যাচ্ছি। চারদিক নীরব। দুলু আপা গান বাজানো বন্ধ করেছেন। যাকে তিনি ধরতে চাচ্ছেন তাঁকে ধরবার আশা ছেড়ে দিয়ে তিনি সম্ভবত ঘুমুতে গেছেন।

    এইখানে আমি আপনাকে একটা কথা বলি–সারারাত জেগে থাকার বিশ্রী অভ্যাস আমার আছে। কোনই কারণ নেই অথচ আমার ঘুম আসছে না। আমি বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছি এ রকম প্রায়ই হয়। হাঁটাহাঁটি করতে করতে আমি অনেক কিছু চিন্তা করি। আমার খুব ভাল লাগে। কি নিয়ে চিন্তা করি তার সব আপনাকে বলা যাবে না। আপনি হাসবেন। এবং মনে মনে বলবেন–মেয়েটা তো ভারী ইয়ে।

    শুধু একটা চিন্তার কথা বলি–চিন্তা না–কল্পনা। আমি কল্পনা করি যেন রাতের ট্রেনে আমি যাচ্ছি। কামরায় দুটি মাত্র মানুষ। আমি এবং একটি ছেলে। ছেলেটিকে আমি আগে কখনো দেখিনি। অল্প বয়স, সুন্দর চেহারা। বড় বড় চোখ। চোখে চশমা। খুব বৃষ্টি নেমেছে। ছেলেটা ট্রেনের কমিরর জানালা বন্ধ করছে। আমার জানালাটা খোলা। সে বিরক্ত হয়ে বলল, জানালা বন্ধ করছেন না কেন?

    আমি বললাম, তাতে আপনার কি কোন অসুবিধা হচ্ছে?

    আপনি তো ভিজে যাচ্ছেন।

    আমাকে শুকনা রাখার দায়িত্ব তো আপনাকে দেয়া হয় নি। আমার বৃষ্টিতে ভেজার ইচ্ছা হচ্ছে–ভিজছি …।

    এই কথায় ছেলেটা একটু যেন আহত হল। নিজের দিকের জানালা খুলে সেও আমার মত জানালা দিয়ে মাথা বের করে ভিজতে লাগল। আমি বললাম, আপনি ভিজছেন কেন?

    ইচ্ছে হচ্ছে ভিজছি।

    আপনার অসুখ করতে পারে। বৃষ্টির পানি সবার সহ্য হয় না। আমার অভ্যাস আছে। আমার কিছু হয় না।

    আমারো অভ্যাস আছে। আমারো কিছু হয় না।

    না আপনার অভ্যাস নেই। অভ্যাস থাকলে বৃষ্টি নাম মাত্র খটাখট জানালা বন্ধ করতেন না। তাছাড়া আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি শীতে আপনি কাঁপছেন। নির্ঘাৎ অসুখ বাঁধাবেন।

    অসুখ বাঁধালে আপনার কি?

    আচ্ছা আপনি এমন অবুঝের মত আচরণ করছেন কেন? কথা শুনছেন না কেন?

    আমার চিন্তাগুলি হচ্ছে এই রকম কথার পিঠে কথা তৈরি করা। ছেলেমানুষী খেলা। একা থাকলেই আমার এই খেলাটা খেলতে ইচ্ছা করে। সব খেলার শেষেই ক্লান্তি আসে। আমার এই খেলায় কখনো ক্লান্তি আসে না। যাই হোক, যা বলছিলাম–আমি বারান্দায় হাঁটছি–এক মাথা থেকে আরেক মাথায় যাচ্ছি–তখন হঠাৎ করেই ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ শুনলাম। একজন কে কান্না চাপতে চেষ্টা করছে–পারছে না। আমি পুরোপুরি হকচকিয়ে গেলাম–কাঁদছে আপা। এই কান্না প্রচণ্ড কষ্টের কান্না।

    আপা কেন এরকম করে কাঁদবে? এমন কি কষ্ট আছে তার? আমি অবাক হয়ে আপার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম। যাতে সে একা একা কাঁদতে পারে এই জন্যেই কি সে আমাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে? এই কারণেই কি তার মাঝে মাঝে একা থাকতে ইচ্ছা করে?

    আমি আপার দরজায় ধাক্কা দিয়ে ডাকলাম, আপা, আপা। কান্না থেমে গেল। আপা কোন উত্তর দিল না।

    কাক ডাকছে। ভোর হতে শুরু করেছে। আমি দাঁড়িয়ে আছি আপার ঘরের সামনে। যদিও ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে এতটুকুও ভাল লাগছে না। এই বাড়ির সঙ্গে গাছ গাছালিতে ভর্তি যদি কোন বাগান থাকতো আমি দাঁড়াতাম বাগানের ঠিক মাঝখানে।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleআসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ
    Next Article আমি এবং কয়েকটি প্রজাপতি – হুমায়ূন আহমেদ

    Related Articles

    হুমায়ূন আহমেদ

    আজ চিত্রার বিয়ে – হুমায়ূন আহমেদ

    December 26, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    আমাদের সাদা বাড়ি – হুমায়ূন আহমেদ

    December 26, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    আমি এবং কয়েকটি প্রজাপতি – হুমায়ূন আহমেদ

    December 26, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আজ চিত্রার বিয়ে – হুমায়ূন আহমেদ

    December 26, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আজ চিত্রার বিয়ে – হুমায়ূন আহমেদ

    December 26, 2025
    Our Picks

    আজ চিত্রার বিয়ে – হুমায়ূন আহমেদ

    December 26, 2025

    আমাদের সাদা বাড়ি – হুমায়ূন আহমেদ

    December 26, 2025

    আমি এবং কয়েকটি প্রজাপতি – হুমায়ূন আহমেদ

    December 26, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }