Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ইট’স কমপ্লিকেটেড – খাদিজা মিম

    খাদিজা মিম এক পাতা গল্প477 Mins Read0

    ইট’স কমপ্লিকেটেড – ৫০

    ৫০

    আজ গুনে গুনে তিনদিন পেরোলো নবনী বাসায় নেই। প্রতিদিন বাসায় ফেরার পর বিশাল শূন্যতা বুকে চেপে বসে। সকালে গাড়িতে বসার পর বামপাশের সিটটা বড্ড খালি খালি লাগে। নিত্যদিনের মতো বাসায় ফিরে নবনীকে দেখা হয় না, রোজ সকালে নবনীকে সঙ্গে নিয়ে বাসা থেকে বেরোনো হয় না। ভালো লাগে না অমিতের। একটুও না। সাব্বির গতকাল রাতে খুব হাসছিল তাকে নিয়ে। বলছিল, “বেচারী কি তোর জন্য বাপের বাড়ি গিয়ে শান্তিতে দুইদিন থাকতে পারবে না?” সাব্বিরের রসিকতা একদম ভালো ঠেকেনি অমিতের কাছে। এলোমেলো কিসব বলে বেরিয়ে এল সাব্বিরের অফিস থেকে। কী কী যে বলেছিল তা ঠিক মনেও নেই অমিতের। আজকাল মাঝেমধ্যে পাগল পাগল লাগে নিজেকে। সময় যত ফুরিয়ে আসছে নবনীর ছেড়ে যাওয়া কিংবা থেকে যাওয়া, তাদের সম্পর্কের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ততই পোঁড়াচ্ছে তাকে। এই যন্ত্রণা থেকে নিস্তার কি কখনো নবনী তাকে দেবে?

    সোফায় বসে, সেন্টার টেবিলে পা তুলে একের পর এক চ্যানেল বদলে যাচ্ছে অমিত। অনি হঠাৎ কোত্থেকে ছুটে এসে পাশে বসলো।

    — “ভাইয়া, আম্মু ভিডিওকলে।”

    স্ক্রিনে তাকিয়ে মলিন হাসলো অমিত।

    — “কেমন আছো আম্মু?”

    — “আগে তোর কথা বল। বউ কি একটু বাপের বাড়িও যাবে না? বিরহে মরে যাবি তুই? নিজের হাল দেখেছিস একবার? অফিস থেকে ফিরে জামা কাপড়ও ছাড়িসনি। চুল এলোমেলো হয়ে আছে, চোখ দু’টো গর্তে ভেতর ঢুকে গেছে, মুখ শুকনো লাগছে। মানে কিসব!”

    — “আমার কিচ্ছু ভালো লাগে না আম্মু। ও কেন চলে যাবে? আমি কি ওর মাঝে একটুখানি জায়গাও করে নিতে পারিনি?”

    — “সময় আছে তো বাবু। এখনই ধৈর্য্যহারা হলে চলবে? প্রয়োজনে কিছু একটা কারসাজি করে আমরা আরো ছয়মাস বাড়িয়ে ফেলবো। এত ভাবিস না তো! নবনী এখানেই থাকবে, তোর সঙ্গে।”

    — “ছয়মাস বাড়িয়ে কী হবে? আমি যে সারাক্ষণ ইনসিকিউর ফিল করছি তার কোনো সমাধান হবে না। আবারও সময় গুনতে হবে আমাকে, এইতো আর কয়দিন বাদেই নবনী চলে যাবে। নবনীও অপেক্ষায় থাকবে চলে যাওয়ার। সময় ফুরিয়ে আসার ভয়, ওকে নিয়ে ইনসিকিউর ফিল করা আমি আর এসব সয়ে যেতে পারছি না। একটা সমাধান আমি চাই। নবনীকে চাই আমি। ওকে আমার লাগবেই।”

    — “নবনী বাসায় নেই, ওকে চোখের সামনে দেখছিস না তাই সবকিছু এত জটিল লাগছে।”

    — “ইটস ট্রু। ও আমার পাশে বসলেই মনে হয় অর্ধেক প্রবলেম সলভ হয়ে গেছে। বাসা থেকে তো গেলই, যাবার আগে মাথায় পোকা দিয়ে গেল একমাস পরই ও একেবারে চলে যাবে”।

    — “বাবু তুই একটু ঢং করতে পারবি?”

    — “কিসের ঢং?”

    ভেংচি কাটলো অনি,

    — “তুমি মরে যাচ্ছো। বাঁচাতে হবে না তোমাকে? তাই আম্মু আর আমি ছোট একটা ফন্দি এঁটেছি।”

    — “কী?”

    — “অনি, নবনীকে কল করে বলবে তুই অসুস্থ। তোর ভীষণ মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা। জ্বর আসতে পারে। তুই শুধু বিছানায় চোখ বুজে শুয়ে থাকবি। তোর চেহারার নকশা অসুস্থই দেখাচ্ছে। কন্ঠটা শুধু নিচু রাখবি, ব্যস।”

    — “সত্যি বলবো আম্মু?”

    — “কী?”

    — “বিকেলে একবার আমিও ভেবেছিলাম এমন কিছু করবো।”

    একসঙ্গে হেসে উঠলো অমিত, অনি আর তাদের মা। শামীমা বললেন,

    — “লোকে শুনলে বলবে পুরো ফ্যামিলি ভাঁওতাবাজ।”

    — “তোমার ছেলে এমনভাবে বাসায় ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে ওকে দেখে মনে হয় এই বাসায় কেউ মরে গেছে। ভালো লাগে ওকে এভাবে দেখতে? খাবে না, কথা বলবে না, হাসবে না। ওর এসব নাটক দেখতে দেখতে আমি টায়ার্ড আম্মু। জলদি করে ওর সংসারের একটা বন্দোবস্ত করো। আমাকে এসব থেকে মুক্তি দাও। ওর মন খারাপ নবনী আপুই সামলাক। আমাকে দিয়ে ওসব হবে না।”

    *****

    — “এক কথায় অমিত অসাধারণ! ওর সঙ্গে সময় কিভাবে যে কেটে যায়, টেরই পাই না। এই ছেলেটার এত খারাপ অভ্যেস আমাকে পেয়ে বসেছে ওর সঙ্গে দুই তিনদিন সময় বেঁধে গল্প না করলে, কথা না বললে অস্থির লাগে। মনে হয় কখন সময় হবে? কখন ওর সঙ্গে বসে একটু গল্প করবো কিংবা দু’জনে হাঁটতে বেরোবো।

    — “খুব ভালো একটা বন্ধু পেয়েছিস, দেখছি।”

    — “হ্যাঁ, বহুবছর পর। আমার ছোট ছোট সব বিষয় খেয়াল থাকে ওর। জানো, আমি কখনো রাত জেগে কাজ করলে অমিত আমার পাশে বসে থাকে যতক্ষণ না কাজ শেষ হচ্ছে। বারবার বলি, তুমি গিয়ে ঘুমাও। ও যেতেই চায় না। বলে, আমার ঘুম আসছে না। থাকি এখানে কিছুক্ষণ। মিথ্যে বলে ও। মাঝে মাঝে ঘুমে চোখ বুজে আসে ওর, তবুও বসে থাকে। হয়তো ভাবে আমি একা বোর হবো। তাই বসে থাকে আমার সঙ্গে। আমার কোন কাচের চুড়িটায় ফাটা দাগ পড়েছে, কানের জিনিসের কোন স্টোনটা পড়ে গেছে, কোন খাবারটা খেতে আমার খুব একটা ভালো লাগছে না, আমার মাথা ধরেছে কি না সবকিছু ও এমনি এমনি বুঝে ফেলে। আমার কখনো কিছু বলতেই হয় না।”

    — “ঝগড়া করিস?”

    — “করি না আবার! সিরিয়াস কিছু না। ছোট ছোট ব্যাপারে গাল ফুলাই আমরা। অমিতের রাগ….”

    অনর্গল বলে চলছে নবনী, তার সঙ্গে অমিতের দিনরাত্রি। যতটা মনোযোগে সুমনা নবনীকে শুনছে তার চেয়ে মনোযোগে নবনীকে সে দেখছে। কন্ঠে উচ্ছ্বাস, চোখে মুখে আনন্দ। কার গল্প বলতে গিয়ে একটা মেয়ের চোখ মুখ ওভাবে জ্বলে উঠে? খুব প্রিয় মানুষের গল্প। কিংবা ভালোবাসার মানুষের গল্প। প্রাণপণে সকলে দোয়া করছিল, চলে যাওয়া যার ভাগ্যে ছিল সে চলে গেছে। কিন্তু যাকে রেখে গেছে সে বাঁচার মতন বাঁচুক। এভাবে আর কতদিন? কেউ আসুক, সাজিয়ে দিক রাঙিয়ে দিক মেয়েটার নিষ্প্রাণ ধূসর জীবনটাকে। অবশেষে ভাগ্যবিধাতার সিদ্ধান্ত দু’চোখে দেখা হলো। নবনীর জীবন যত্নে সাজাতে উপরওয়ালা অমিতকে পাঠিয়েছেন। কিন্তু নবনী কি জানে সে কথা? বুঝতে পারে অমিত তার মনের উঠোনে কতটা জায়গা দখল করে নিজের নামে ঘর বানিয়েছে? প্রাক্তনের জায়গাটুকুতে অজান্তেই তার বর্তমানের একচ্ছত্র আধিপত্যের ক্ষমতা দিয়ে দিয়েছে?

    মোবাইল কল আসায় গল্প থামালো নবনী। হাসিমুখে কল রিসিভ করলেও ধীরে ধীরে ভ্রু কুঁচকে আসছে ওর। ওপাশ থেকে কে কী বলছে কে জানে! একটানা শুধু বলেই যাচ্ছে আর নবনী শুনছে। জানার জন্য কৌতুহল জাগছে সুমনার। ইশারায় নবনীকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই নবনী মুখ খুললো,

    — “বিপি চেক করেছো? লো হয়নি তো?”

    — “ওর নাটক ছোটাচ্ছি আমি। বেশি সময় লাগবে না আসতে। ব্যাগ প্যাক করতে যতক্ষণ সময় লাগে আরকি! ততক্ষণ ওকে ছাড়ো। যা খুশি করুক। আমি এসে বাকিটা দেখছি।”

    নবনী কল কাটতেই সুমনা জিজ্ঞেস করলো,

    — “কে কল করেছে?”

    — “অনি। অমিত অসুস্থ। আমাকে এখনই ফিরতে হবে।”

    — “এখনই চলে যাবি?”

    — “হ্যাঁ। ও কারো কথা শোনে না। খাবার, মেডিসিন কিছুই খাচ্ছে না। আমাকে আবার ভয় পায় ও। দুই একটা ধমক দিলেই কাজ হয়ে যাবে। ফোনে ফোনে সম্ভব না। তাই বাসায় যাবো।”

    — “যা তাহলে। আর গ্রামে যাওয়ার প্ল্যানটা মাথায় রাখিস।”

    — “হ্যাঁ অমিতের ছুটির দিন ধরে প্ল্যান করতে হবে। তুমি বসো তাহলে। আজ রাতটা এই বাসায় থাকো। আম্মু, নানী গল্প করবে তোমার সঙ্গে।”

    — “দেখি।”

    — “দেখি টেখি না, থাকো আজ। আমি আমার গোছগাছ সেরে ফেলি। ফোনে কথা হবে তোমার সঙ্গে। অমিতের বাসা এখান থেকে খুব একটা দূরে না। নাতাশাকে নিয়ে কাল পরশু একবার ঘুরে এসো। তারপর তোমার যখন ইচ্ছে হবে যেও।”

    বিছানায় শুয়ে নিউজফিড স্ক্রল করছিলো অমিত। কলিংবেলের শব্দ পাওয়া মাত্ৰ তাড়াহুড়ো করে ফোন রেখে চোখ বুজে শুয়ে রইলো। প্রায় ঝড়ের গতিতে অমিতের ঘরে এল নবনী। অমিতের পাশে বসে গালে কপালে ছুঁয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলো,

    — “মাথাব্যথা কখন থেকে? জ্বর এসেছিল আজ সারাদিনে বা গতকাল রাতে?”

    — “হুম।”

    — “বলোনি কেন আমাকে?”

    — “নিজেই জ্বর হইয়েনে আরা গাত চড়ি বইসু। আঁর জ্বর তো তুঁ-ই। আথাম থাম জ্বরত ভিতুরে ফুড়ি যার আঁর। আর তুঁই গওর উদ্দি জ্বর মাইপতে লাইগ্গ? ভিতুর দি ফুড়ি মরির দি, ইয়ান মাফি ন চাইবে? ছুঁইয়েনে ন চাইবে? তুঁই আঁর জ্বর ন হয়েনে ঝড় হই জ গুই। আঁরে ভিজায়েনে শান্ত গরো। আর পুইড়তো ন দিই উ।”

    অমিতের দিকে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইলো নবনী। বড্ড অসহায় দেখাচ্ছে অমিতকে। ক্লান্ত চোখজোড়ায় কী যেন এক অস্থিরতা, দুশ্চিন্তা লেগে আছে! নিজের ভাষায় এক নিঃশ্বাসে কী যে বললো! খুব মনোযোগে কান পেতেও তিনটে চারটে শব্দ ছাড়া আর কিছুই ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না নবনী। অমিতকে ধমকে জিজ্ঞেস করলো,

    — “আবারও সেই মিনমিন করে নিজের ভাষায় কথা বলা তোমার! জানোই তো বুঝি না, তবুও কেন বলো?”

    — “যাতে না বুঝো।”

    — “তাহলে বলার কী প্রয়োজনটা ছিল?”

    — “এত কথা পেটে চেপে রাখা যায় না। অন্তত তোমার কাছে না। আবার সব কথা তোমাকে বলাও যায় না। তাই ওভাবে বলি, মনকে শান্ত করি।’

    — “কী এমন কথা অমিত যেটা আমাকে বলা যায় না? তোমার কোন কথাটা আমি না জেনে বসে আছি? তোমার একান্ত ব্যক্তিগত কথাগুলোও আমি জানি। তবুও যে কী লুকাতে চাও, কে জানে!”

    — “ব্যাগ ট্যাগ গুছিয়ে চলে এসেছো দেখছি! তোমার একসপ্তাহ তো এখনো পেরোয়নি।”

    — “অনির কথা শুনলে আমাকে আর আসতে হতো না। অফিস থেকে ফিরে শার্টপ্যান্টও চেইঞ্জ করোনি। উঠো, জামা কাপড় ছাড়ো। হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হও। আমি তোমার মাথায় গরম তেল মালিশ করে দিচ্ছি।”

    — “বলেছিলাম, ইউ আর ইন লাভ উইথ মি। পাত্তাই দাওনি সেদিন। অথচ আজ ভালোবাসার উদাহরণ জ্বলজ্বল করছে।”

    — “কিসের উদাহরণ?”

    — “এই যে আমি অসুস্থ শুনে ছুটে এসেছো আমার সেবা করতে। এটা ভালোবাসা নাতো আর কী?”

    — “অমিত! তোমার নাটক আমি বুঝি। খাবার খাবে না, ওষুধ খাবে না তাই এমন নাটক করছো। আর একটা কথাও বলবে না তুমি। এক মিনিটের মধ্যে বিছানা ছেড়ে ওয়াশরুমে যাবে। কুইক!”

    — “এই যে গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছো, শাসাচ্ছো এসব কে করে? বউরা করে। এবার বলো তুমি আমার বউ নয়তো আর কে?”

    — “আলী ফজলের নতুন ওয়েব সিরিজ রিলিজ হয়েছে। তুমি কি আমার সঙ্গে বসে কাল রাতে সেটা দেখতে চাও?”

    — “ওহহো! আমি ভুলেই গিয়েছিলাম।”

    — “দেখতে চাও?”

    — “অবশ্যই!”

    — “এক্ষুনি ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হও, ভাত খাও, ওষুধ খাও। নয়তো আমি বাসায় ফিরে যাচ্ছি।”

    বিনাবাক্যে নবনীর হাত থেকে তোয়ালে, ট্রাউজার আর গেঞ্জি নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল অমিত। খানিকবাদে ছিটকিনি খুলে দরজার একটুখানি ফাঁক দিয়ে মুখ বের করে বললো,

    — “ঝগড়ায় হেরে যাবার আগ মুহূর্তে মেয়েরা বাপের বাড়ি যাওয়ার হুমকি কাকে দেয়? হাজবেন্ডকে দেয়। বলো তো নবনী, আমি তোমার হাজবেন্ড নয়তো আর কে?”

    নবনী বালিশ ছুঁড়ে মারার আগেই দরজা আটকে দিলো অমিত। এপাশে নবনী, ওপাশে অমিত দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে প্রাণখোলা হাসিতে মেতে উঠেছে।

    *****

    — “নবনীর অতীত, অসুস্থতা মেনে নিয়েই ছেলেটা ওকে ভালোবেসেছে, সংসার করতে চাইছে। ও নবনীর জন্য ব্লেসিং। নয়তো কোন ছেলেটা এতকিছু মেনে নেয়, বলুন তো?”

    — “নাহ্, আমার নাতিনের কপাল ভালো। নয়ত এমন সোনালক্ষ্মী পোলা জুটতো নাকি!”

    পান চিবুতে চিবুতে সুমনার সঙ্গে গল্প করছেন জামিলা বেগম। সঙ্গে তার মেয়ে আর ছোট নাতনিও আছে। নানীর সঙ্গে তাল মেলালো নাতাশা। বললো,

    — “সত্যিই! আপুর সঙ্গে ঐ বাসায় আমিই বেশি থাকি। বাসার সবার চেয়ে ভাইয়াকে আমি বেশি জানি। এত ভালো মানুষটা! আর আপু উনার সঙ্গে খুব হ্যাপি থাকে। এটাই আমরা চেয়েছিলাম সবাই।”

    — “আমার দেবর, জা সবাই খুব ভালো। আমার মেয়েটাকে একদম নিজের মেয়ের মতন আগলে রাখে। আমার মেয়ের ভাগ্যে তোমাদের আদর ছিল না। সামি ছিল না। শুধু ভাবতাম আর কে আছে আমার মেয়েকে নিজের মেয়ের মতন, নিজের বোনের ভালোবাসবে? সামির মতন আগলে রাখবে? অবশেষে উপরওয়ালা আমাদের ডাকে সাড়া দিয়েছে। মেয়ে নিয়ে এক আনা দুশ্চিন্তাও এখন আমরা করি না। নবনীর বাবা তো সারাক্ষণ একটা কথাই বলে, অমিত আছে, ও সামলে নেবে।”

    — “মা একবার অমিতকে খুব দেখতে চাইছে। আমরা জানতাম নবনীই আমাদের ঘরের বউ। ভাগ্যে ছিল না আমাদের, তাই হয়নি। মা আসলে ওসব কিছু থেকে এখনো ঠিক বেরিয়ে আসতে পারেনি। নবনীর জন্য কাঁদে প্রায়ই। অমিতকে নিয়ে গতকাল লম্বা আলাপ হলে মায়ের সঙ্গে। মজার ব্যাপার হলো কেন যেন মা একদম কাঁদেনি। বরং মনে হলো মা খুব খুশি। এখন বায়না করছে অমিতকে এক নজর দেখবে বলে। নিজের হাতে রেঁধে খাওয়াতে চায়। বলে কিনা, ও কি আমার ছেলে হবে? যদি মা ডাকতে বলি ডাকবে আমাকে? কিসব বাচ্চাদের মতন আবদার বলুন তো আন্টি!”

    — “জোয়ান পোলা যার গেছে সে কইতে পারবো তার মনের অবস্থাটা কেমন। তোমার মায়ের মনে কী চলে সেইটা আর কেউ বুঝতে পারবো না। কতদিন হইলো সামির মুখে মা ডাক শোনেনাই। বুকের ভিতর হাহাকার তো লাগেই। তাই একটু শখ করছে অমিতের কাছে মা ডাক শোনার।”

    — “না নানী। হুট করে একটা আবদার করলে কি আর চলে? অমিত আমাদের কাউকে খুব একটা চেনে না। মায়ের আবদারে হয়তো বিব্রত হতে পারে। মাকে আমি বুঝিয়ে বলবো। কিন্তু, অমিত আমাদের ওখানে যেতে রাজি হবে তো?”

    ৫১

    প্রকৃতিতে আজ চৈত্রের সপ্তম ভোর। দখিন হাওয়ায় ভেসে আসে সামনের বাড়ির গাছ থেকে আমের মুকুলের মিষ্টি ঘ্রাণ। পাশের বারান্দা থেকে কামিনী ফুলের ঘ্রাণ। ভোরের এই সময়টায় শুদ্ধ বাতাসে,আবছা আলোর মাঝে অমিতের বড্ড নেশা লাগে। প্রিয় কাউকে নিয়ে প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যাবার নেশা। লম্বা আঁকাবাঁকা পথ ধরে তার সঙ্গে হেঁটে যাবার নেশা। হাঁটতে হাঁটতে পূর্বাকাশে একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়তে থাকা সূর্য কিরণ দেখার নেশা। সারারাত নির্ঘুম কাটিয়ে এই ভোরে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিল অমিত একটা সিগারেট ধরাবে বলে। সিগারেটে আগুন দিতে দিতে খেয়াল হলো, প্রিয় মানুষ ঘরেই আছে। যখন তখন ঘুম থেকে টেনে তুলে তাকে সঙ্গে নিয়ে প্রকৃতির মাঝে হারাবার প্রশ্রয়, অধিকার দুটোই আছে। হাতের সিগারেটটা ফেলে দিলো অমিত। নক ছাড়াই সোজা ঢুকে পড়লো নবনীর ঘরে। লাইট জ্বালিয়ে নবনীর কাঁধে মৃদু ধাক্কা দিয়ে ডাকতে লাগলো,

    — “নবনী… এ্যাই নবনী…”

    চোখ মেলে তাকালো নবনী। জানালার বাইরে চোখ যেতেই লাফিয়ে উঠলো বিছানা থেকে।

    — “কী হয়েছে? কোনো সমস্যা?”

    — “উঠো। ১৫ মিনিটের মধ্যে ফ্রেশ হও, জামা বদলাও। সাজগোজের প্রয়োজন নেই। মাথার চুলটা জাস্ট বেঁধে নাও।”

    — “কোথায় যাচ্ছি? কারো কিছু হয়েছে অমিত?”

    — “না। আমরা বিরুলিয়া যাবো এখন।

    — “বিরুলিয়া কেন?”

    — “কেন আবার? ঘুরতে।”

    — “তুমি না অসুস্থ?”

    — “সুস্থ হয়ে গেছি। চলো তুমি।

    — “আমি ঘুমাবো!”

    — “ভোরে ঘুরতে বের হইনি বহুদিন। গ্রামেও যাওয়া হচ্ছে না আমার। চলো না প্লিজ!”

    — “অফিস নেই তোমার?”

    — “এখন সাড়ে পাঁচটা বাজে। সাড়ে নয়টা নাগাদ ফিরে আসতে পারবো। বেশিক্ষণ লাগবে না। যাবো, তুমি আমি একটু ফুল ক্ষেতের আইল ধরে হাঁটবো, এক কাপ চা খাবো। সময় পেলে নাস্তা করবো নয়তো বাসায় ফিরে করবো।

    — “যেতেই হবে?”

    — “হ্যাঁ।”

    একরাশ বিরক্তি নিয়ে কাথার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো নবনী। ওয়্যারড্রব থেকে কাপড় বের করতে করতে বললো,

    — “কিসব আবদার যে করো বসো না তুমি! আরাম করে ঘুমাচ্ছিলাম। ঘুমটাই বরবাদ। আমিও আরেক ছাগল, তোমার সব বায়না বসে বসে পূরণ করি।

    — “কেন করো? নিজেকে জিজ্ঞেস করোনি কখনো? কেন অমিতের সমস্ত বায়না আমি পূরণ করি? কেন ওকে এত মাথায় তুলে রাখি? শুধু অমিতকেই কেন? আর কাউকে তো এতখানি প্রশ্রয় কখনো দেই না?”

    একমুহূর্ত দাঁড়ালো নবনী। বোকা চোখে তাকিয়ে রইলো অমিতের দিকে। অমিত জানে কোনো উত্তর নবনী দেবে না। তবুও চেয়ে রইলো নবনীর দিকে উত্তরের আশায়।

    বরাবরের মতো এবারও উত্তর দিলো না নবনী। ওয়াশরুমে যাবার আগে শুধু বলে গেল,

    — “মাত্র ঘুম থেকে জেগেছি। আপাতত ব্ৰেইন কাজ করছে কম। পরে তোমার প্রশ্ন ভেবে উত্তর দিবো।”

    .

    কুয়াশার দাপট খুব একটা নেই। তবুও সূর্যালোক ঐ দূর আকাশ থেকে এই গ্রামে পৌঁছুতে পৌঁছুতে অনেকটাই হালকা হয়ে গেছে। একটা আঁকাবাঁকা পথ ধরে হাঁটছে নবনী। পথের দুই পাশে বিস্তীর্ন জমিতে গোলাপ আর গাদা ফুলের চাষ। ফুলগুলোর পাতায়, পাঁপড়িতে, পথের কিনার ঘেষে বেড়ে উঠা ঘাসের মাঝে জমে আছে বিন্দু বিন্দু শিশির। জুতা হাতে নিয়ে খালি পায়ে হাঁটছে নবনী। এই পথে নেমেই ঝট করে জুতোজোড়া খুলে ঘাসের উপর হাঁটতে লাগলো। শিশিরে পা ভেজানো নবনীর ভীষণ প্রিয়। নাহ্, নবনী সে কথা অমিতকে বলেনি। ওর চঞ্চল হাসিতে অমিত ঠিক বুঝে নিয়েছে সে কথা। হাঁটতে হাঁটতে গায়ের চাদরটা আরেকটু আটসাঁট করে বারবার গায়ে জড়াতে লাগলো নবনী। শীতল বাতাস ছুঁয়ে যাচ্ছে ওদের। ভাগ্যিস বেরোবার সময় পাতলা চাদরটা গায়ে পেঁচিয়ে বেরিয়েছিল! নয়তো আজ ঠান্ডা লেগে যেত নিশ্চিত। অমিত মাথা নিচু করে হাঁটতে হাঁটতে বললো,

    — “বলেছিলাম না এখানে বেশ ঠান্ডা। দেখলে তো?”

    — “অথচ আমাদের ওখানে ঠান্ডা নেই।”

    — “এটা গ্রাম নবনী।”

    — “শহরের ভেতরই তো।”

    — “শহর কোথায়? দূর দূরান্তে কোনো উঁচু দালান, অফিস কিংবা বাস, প্রাইভেট

    কারের জ্যাম দেখতে পাচ্ছো? বলতে পারো শহরের কাছাকাছি কিন্তু এটা গ্রামই। ওখানকার ওয়েদার আর এখানকার ওয়েদার খুব একটা ম্যাচ হবে না। তুমি এসেছো এর আগে?”

    — “না। প্রতিবছরই নাতাশা আর আমি প্ল্যান করি কিন্তু আসা হয়নি কখনো। তুমি এরআগে এখানে এসেছিলে?”

    — “হুম এসেছি দুইবার। মুনিয়াকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলাম।”

    — “একটা ব্যাপার বলো তো অমিত?”

    — “হুম?”

    — “মেয়েটা এত হম্বিতম্বি করলো, বাসা পর্যন্ত চলে এল। আমার জাস্ট একটা থ্রেটে থেমে গেল কেন? যতোটা বেপরোয়া আচরণ মুনিয়া করছিল আমার একটা হুমকিতে ওভাবে থেমে যাবার কথা না।

    — “ও তোমার হুমকিতে ভয় পায়নি, ভয় পেয়েছে আমাকে। মুনিয়ার আমার উপর খুব বিশ্বাস ছিল, যত যাই হোক ওর ক্ষতি আমি করবো না। কত কী করলো, আজ পর্যন্ত আমি সব সয়ে গেছি। চাইলে ওকে মিডিয়া থেকে ভ্যানিশ করতে পারতাম। করিনি। এতকিছুর পরও যেহেতু কিছু করিনি, ভেবেছিল এবারও কিছু করবো না। মানুষের সামনে ওভাবে ওর স্কার্ফ, মাস্ক আমি খুলে ফেলবো ও ধারণা করতে পারেনি। শত হোক মুনিয়া পাবলিক ফিগার। সিঁড়িভর্তি লোকের সামনে ওর সম্মান নষ্ট হলো না? আমাদের এডভারটাইজিং ইউনিটের সঙ্গে ওর দুটো চুক্তি হওয়ার কথা। একটা টেলিকম এড অন্যটা সাবানের। ইন্টারন্যাশনাল ব্র্যান্ড। এড দুটো থেকে বেশ ভালো এমাউন্ট পাবার কথা। তার উপর এমন ইন্টারন্যাশনাল ব্র্যান্ডের সঙ্গে কাজ করা প্রতিটা মডেলের ড্রিম। যেদিন ঝামেলা হলো ঠিক তার পরদিনই এডভারটাইজিং সেক্টর থেকে হাওয়ায় খবর ভেসে এল মুনিয়ার সঙ্গে এগ্রিমেন্ট হবে। কথাবার্তা ফাইনাল। পেপার ওয়ার্ক বাকি। মাথায় কী ভূত চাপলো কে জানে? সরাসরি প্রজেক্ট হেডকে কল করে বলে দিলাম ওকে বাদ দিতে। তার প্রজেক্টের জন্য তিনদিনের মাঝে বেস্ট মডেল আমি এনে দেবো।”

    — “ব্যস! ঐ লোক রাজি হয়ে গেল?”

    — “একই কোম্পানিতে আছি আমরা বহুবছর যাবৎ। ভাই ব্রাদার টাইপ রিলেশন পুরোনো এমপ্লয়িদের মাঝে। যদিও আমাদের সেক্টর ডিফারেন্ট কিন্তু সম্পর্কে দূরত্ব নেই। উনার প্রয়োজন আমি দেখব, আমার প্রয়োজন উনি দেখবে। উনার রিকোয়েষ্ট আমি রাখবো, আমার রিকোয়েষ্ট উনি রাখবে এভাবেই তো আমাদের সম্পর্কগুলো টিকে আছে। নয়তো এক অফিসে এতবছর কাজ করা মুশকিল হয়ে যেত না?”

    — “তারপর?”

    — “মুনিয়ার ড্রিম প্রজেক্ট ক্যান্সেল। ও বুঝতে পেরেছে কাজটা আমিই করেছি। সোজা অফিসে চলে এল। স্যরি বললো। কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুখ ফুলিয়ে নাজেহাল অবস্থা। বারবার করে প্রমিজ করলো আর কখনো আমাকে ডিস্টার্ব করবে না। প্রয়াজনে আমার বাসায় এসে সবার সামনে স্যরি বলবে। তারপর আরকি! ওর কাজ ওকে ফিরিয়ে দিয়েছি।”

    — “ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করেনি কেন আবার প্রজেক্ট ওকে দিতে চাইছো?”

    — “উনি জানেন আমাদের ব্যাপারটা। শুধু উনি না, অফিসের অনেকেই একটু আধটু জানে আমাদের ব্যাপারে।”

    — “এতকিছু হয়ে গেল, বলোনি তো আমাকে?”

    — “ওর কথা বলতে ইচ্ছে হয়নি তাই। ওকে ভাবতে ভালো লাগে না, বলতে ভালো লাগে না। আমাদের ভালো স্মৃতিগুলোও কেমন আবছা হয়ে আসছে। কিন্তু খারাপ স্মৃতিগুলো এখনো দগদগে ঘা হয়ে রয়ে গেছে মাথার ভেতর। তবে সেসব কষ্টহীন।”

    — “আচ্ছা ছাড়ো সে কথা।”

    কয়েক মুহূর্ত কেটে যায় নিশ্চুপ। দু’জনে একই তালে পায়ে পা মিলিয়ে হেঁটে চলছে ঐ দূর গ্রামের দিকে। ধীরে ধীরে বাড়ছে সূর্যের দাপট। আপন আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে এই ধরণীর বুকে। মাটির উপর দু’জনের ছায়া পড়ছে। সেই ছায়াতেই নজর আটকে আছে অমিতের। যতটা দূরত্বে ওরা হাঁটছে, ছায়ার মাঝে দু’জনকে আরো বেশি কাছাকাছি দেখাচ্ছে। ঠিক গায়ে গা ঘেঁষে। কী হতো যদি এই ছায়ার মতন তাদের মাঝে একমিটার দূরত্বটা মিটে যেত? গায়ে গা ঘেঁষে কিংবা নবনী তার হাতটা শক্ত করে জড়িয়ে এই শীতের সকালে হেঁটে বেড়াতো মেঠো পথ ধরে? ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ সেই মুহূর্তটাকে করে নিতো ষোলোআনা পূর্ণ। পথ চলতে চলতে এক মুহূর্তের জন্য লোকচক্ষুর আড়াল হলে, সুযোগ বুঝে হয়তো সে এঁকে দিতো নবনীর কপালে ছোট্ট চুমু। অসম্ভব সুন্দর একটা মুহূর্ত তৈরী হতে পারতো আজ। স্মৃতির ঘরে তোলা থাকতো আদুরে এই মুহূর্তটা। নীরবে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল অমিতের। নবনীকে খুব করে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে, আমাদের এই দূরত্ব আর কতদিন?

    হঠাৎ নবনী দৌড় দিলো পথের ওধারে, নীল টিনের বড় বাড়িটার দিকে। বাড়ির গা ঘেঁষে বেড়ে উঠেছে জবা গাছ। আট নয় বছরের ছোট্ট মেয়েটা ফুল ছিঁড়ছিল। ওর কাছে চেয়ে রক্তজবা নিয়ে এল নবনী। কানে গুঁজতে গুঁজতে আবার ছুটে এল অমিতের কাছে। নিজের ফোনটা অমিতের হাতে ধরিয়ে বললো,

    — “জলদি করে আমার একটা ছবি তুলে দাও তো!”

    ছবি তুলতে গিয়ে থেমে গেল অমিত। স্নিগ্ধ মুখটাতে লেপ্টে আছে মিষ্টি রোদ। বেণী ছেড়ে বেরিয়ে আসা চুলগুলো যেন হাত পা ছড়িয়ে এলোমেলো হয়ে ঢলে পড়েছে ডানপাশের কানের উপর, কাঁধের উপর। বাম কানে গুঁজে আছে টকটকে লাল জবা। ঘুম থেকে জাগার পরের স্নিগ্ধতা এখনও ওকে ছেড়ে যায়নি। চোখে-মুখে এখনো লেগে আছে। হঠাৎ ভ্রু কুঁচকে চেঁচিয়ে উঠলো নবনী।

    — “কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবো? এখনও তোলা হয়নি তোমার?”

    — “এই তো তুলছি। তুমি আবার দাঁড়াও না আগের মতন!”

    দ্রুত নবনীর তিনটে ছবি নিয়ে নিলো অমিত। নবনীর হাতে মোবাইল দিয়ে খানিকটা ঝুঁকে দাঁড়ালো তার সামনে। চোখে চোখ রেখে বললো,

    — “তোমাকে নিয়ে আস্ত একটা কবিতা লিখে ফেলা যাবে নবনী।”

    — “তাই? কে লিখবে? তুমি?”

    — “প্রেয়সীর গালে কপোলে সোনালি রোদ,

    প্রেমিকের বুকে অনল।

    প্রণয়িনীর কানের ভাঁজে লাল টকটকে জবা,

    এলোমেলো চুল গোছানোর বাহানায় কপোল ছোঁয়ার অভিলাষ।

    নিঃশ্বাসের পার্থক্য মিটবে কবে?

    প্রতীক্ষায় অপেক্ষায় প্রেমিকের দীর্ঘশ্বাস!”

    অবাক হাসিতে, চোখজোড়া ছোট করে অমিতের দিকে চেয়ে রইলো নবনী।

    — “তুমি কবিতা লিখতে জানো অমিত!”

    — “না তো!”

    — “কার লিখা ছিল কবিতাটা?”

    — “কেউ লিখেনি। মাথার ভেতর দুই চারটা লাইন ভোঁ করে দৌড় দিলো। আমিও ফটফট করে বলে দিলাম।”

    — “তুমি কবিতা লিখো আমাকে আগে বলোনি কেন?”

    — “লিখিনি কখনো। বলবো কেমন করে?”

    — “ধূর্ছাই! যতসব ঢঙ তোমার।”

    — “ঢঙ সবাই করে। তুমিও করো। এইতো সকালে খুব ঢঙ করছিলে আসবে না এখানে। বলো তো, ভালো লাগছে না তোমার?”

    — “ঢঙ কোথায় করলাম? একবার দুইবার বারণ করেছি শুধু। রাতে ঘুমিয়েছি দুইটা বাজে। এত ভোরে এসে ডাকাডাকি করলে কার যেতে ইচ্ছে করবে বলো?”

    — “দেখছি তো কেমন আনন্দে শিশিরে পা ভিজিয়ে হাঁটছো। ভালো লাগছে সে কথা তো মুখে বলবে না।

    — “তোমাকে কিছু বলতে হয় নাকি! এমনি এমনিই তো বুঝে নাও।”

    — “তাই বলে বলবে না? আমার মাঝে মাঝে তোমার মুখ থেকে শুনতে ইচ্ছে হয়। হাসলো নবনী। অমিতের কাঁধে আলতো করে হাত বুলিয়ে বললো,

    — “হুম ভালো লাগছে। তবে তারচেয়ে বেশি ভালো ছিল তোমার কবিতা।”

    — “কী ভাগ্য গো তোমার নবনী! অমন সুন্দর কবিতা বলা বর পেয়েছো।”

    — “হ্যাঁ ভাগ্য তো আমার বটেই। হাজারটা পাত্র বেছেও মেয়েরা ভালো একটা হাজবেন্ড পায় না। অথচ আমার বিয়ে হলো ঝড়ের গতিতে, জোর করে কিন্তু বরটা ভীষণ ভালো জুটে গেল। আফসোস! এই ভালো বরটা এমন কেউ পেলো না যে এই বিয়েটা, সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখতো। তোমার সঙ্গে যা কিছু হচ্ছে না অমিত, এসব তুমি ডিজার্ভ করো না। ইউ ডিজার্ভ মার্চ বেটার। আমি কিংবা মুনিয়া আমরা কেউই তোমার উপযুক্ত না। মুনিয়া তোমাকে ভেঙেচুরে রেখে গেল আর আমার কারণে তোমার নামের পরে ডিভোর্সি শব্দটা ঝুলে যাবে। অথচ ভালো একজন লাইফ পার্টনার, সুন্দর সরল একটা জীবন তোমার হবার কথা ছিল। তোমার মতো ছেলেকে পাওয়া, এ্যাজ এ্য লাইফ পার্টনার প্রতিটা মেয়ের স্বপ্ন।”

    — “আমাকে পছন্দ তোমার?

    — “ভীষণ। তোমাকে কে না পছন্দ করবে বলো তো?”

    — “তাহলে ছেড়ে যেতে চাইছো কেন? থেকে যাও আমার কাছে।”

    চোখ টিপলো অমিত। অমিতের চোখের ইশারায়, দুষ্ট হাসিতে হেসে ফেললো নবনীও।

    — “খুব দেরী হয়ে গেল যে অমিত! তোমার বউকে বহু আগে অন্য কেউ নিজের নামে করে নিয়েছে।” ,

    — “সত্যিই নবনী! আমরা কাজিন। তুমি যখন গ্রামের ঈদগুলোতে ফ্রক পরে, দুই ঝুটি করে ঘুরে বেড়াতে তখন তোমাকে দেখেছিলাম। সামির আগে তোমার আমার দেখা হওয়া, পরিচয় হওয়া অথচ আমি কখনো আলাদাভাবে ভাবিইনি। মুখ কুঁচকালো নবনী।

    — “ঐ বয়সে কে, কাকে আলাদাভাবে ভাববে অমিত? তুমি আমি দুজনেই ছোট!”

    — “সামি যখন প্রপোজ করলো তখনও তুমি ছোটই ছিলে।”

    — “ছিলাম, তবে এতটাও না। আমি তোমাকে গ্রামে শেষবার দেখেছি খুব সম্ভবত ক্লাস ফোরে পড়ি যখন। এরপর দাদী মারা গেল, আমাদের আর ওখানে ঈদ করতে যাওয়া হয়নি। তারপর দেখেছিলাম ১১-১২ বছর আগে, শুভ ভাইয়ার রিসেপশনে। দূর থেকে দেখেছিলাম শুধু। কথা হয়নি আমাদের। এবার বলো ক্লাস ফোরে পড়ুয়া মেয়েকে আলাদা চোখে দেখবে কেমন করে? এমন হয় কখনো?”

    — “জানি না হয় নাকি হয় না। কিন্তু আমার ভীষণ আফসোস হয় নবনী।”

    — “আফসোস!”

    অবাক চোখে অমিতের দিকে তাকিয়ে রইলো নবনী। আজ এই মুহূর্তে হাসতে হাসতে আর প্রসঙ্গ বদলাতে ইচ্ছে করছে না অমিতের। ইচ্ছে করছে গড়গড় করে মনের হাল অবস্থা বিশদ বর্ণনা নবনীকে শোনাতে। তবুও মনের বিরুদ্ধে গিয়ে কথা ঘোরাতে ব্যস্ত হলো অমিত।

    — “এভাবে তাকিয়ে আছো যে! ভুল বললাম?”

    — “আফসোস কেন হবে তোমার?”

    — “আমার আগে সামি তোমাকে নিজের করে নিলো অথচ জানাশোনা পুরোনো ছিল তোমার আমার। তবুও কেন তুমি আমার হলে না?”

    — “অমিত! কিসব বলছো?”

    — “যা মাথায় কিলবিল করছে তাই বলছি। লাইফ পার্টনারের কাছ থেকে মানসিক শান্তি পাওয়া অনেক বড় ব্লেসিং। আমরা একসঙ্গে আছি পাঁচমাস। এই কয়েকমাসের এক্সপেরিয়েন্স থেকে বলছি, তোমার সঙ্গে আমার সংসার হলে আমার বাকি জীবনটা শান্তিতে কাটিয়ে দিতে পারতাম। না চাইতেও আমাদের বিয়েটা হলো। ভাগ্যে ছিল বলেই হলো। অথচ দেখো তো! সংসার আমাদের ভাগ্যে নেই। এই বিয়েটা, দু’জন দুজনকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে, একই ফ্ল্যাটে থাকার ব্যাপারটা এক্সেপ্ট করতে আমাদের কতটা মানসিক অশান্তির মাঝে সময় পার করতে হয়েছে ভাবো তো? তুমি চলে যাবে, পুরো সমাজে, আত্মীয়-বন্ধু মহলে দু’জনে নামের পেছনে যুক্ত হবে ডিভোর্সি। তুমি আমি যতই কুল থাকি না কেন, এগুলোর প্রভাব জীবনে পড়বেই। তারচেয়ে বরং ভালো হতো না, যদি সামির বদলে মানুষটা আমি হতাম? এসব আর পোহাতেই হতো না।

    — “বাদ দাও না অমিত! যা হয়ে গেছে বদলে ফেলা যাবে? যদি প্রভাব পড়ে তো পড়বে! সামলে নিবো আমরা। সামলাতে হবে আমাদের। একদিন দুইদিন এসব চর্চা চলবে। তারপর সব ঠিক হবে দেখে নিও।”

    — “হুম।”

    — “আচ্ছা শোনো না?”

    — “হুম?”

    — “আজ তুমি আমাকে বেড়াতে নিয়ে এলে। চলো এই শুক্রবার তোমাকে আমি নিয়ে যাই।”

    — “কোথায়?”

    — “সামিদের গ্রামের বাড়ি, মানিকগঞ্জ।”

    পথ চলতে চলতে নবনীর কথায় থমকে দাঁড়ালো অমিত।

    — “সামিদের গ্রামের বাড়ি কেন?”

    — “আন্টি কল করেছিল। খুব করে বলছে তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে। আপুও বারবার করে বলছে। আমরা সকালে যাবো, বিকেলেই ব্যাক করবো।

    — “আচ্ছা।”

    *****

    বাহারি নাস্তায় সাজানো টেবিল। নাস্তা খেতে খেতে গল্পে মেতে উঠেছে নবনী, সুমনা আর তার মা। গল্পের ফাঁকে সমস্বরে হেসে উঠছে ওরা তিনজন। তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মেকি হাসছে অমিত। গল্পে তার মন নেই। মন পড়ে আছে সামনের দেয়ালে ঝুলে থাকা ফটোফ্রেমে। ছেলেটা দেখতে বড্ড মিষ্টি। পুরুষ ধাঁচের কঠিন চেহারা না। দেখলে মায়া হয়, কথা বলতে ইচ্ছে হয়, ঠিক তেমন। প্রায় দেড় আঙুল সমান সিল্কি চুলগুলোর বাম পাশে সিঁথি কাটা। ক্লিন শেইভড। চোখের নিচে ছোট্ট লাল তিল। কালো চেহারার ঝকঝকে দাঁতের প্রাণবন্ত হাসিটা ভীষণ মানাচ্ছে। শার্টের বাটন দু’টো খোলা। বুকের পশম দেখা যাচ্ছে একটু আধটু। আচ্ছা ওর পরনে নীল শার্টটাই কি নবনী প্রায়ই নিজের গায়ে জড়িয়ে বসে থাকে? হ্যাঁ সেই শার্টটাই তো বোধহয়! আরো একটু মনোযোগী হলো অমিত।

    .

    গল্পের ফাঁকে অমিতকে বারবার দেখছে সুমনা। এই ঘরে এসেছে পর থেকে সামির ছবির দিকেই সমস্ত মনোযোগ তার। চোখজোড়া তার ঈর্ষাকাতর। ভীষণ হাসিখুশি ছেলেটা যেন পুড়ে যাচ্ছে। অমিতের চোখজোড়া স্পষ্ট পড়তে পারছে সুমনা। মনে মনে হাসলো সে। প্রেমে পড়লে মানুষ তার ভালোবাসার মানুষটার মৃত প্রাক্তনকেও জীবিত ভেবে হিংসা করে। কী অদ্ভুত রকমে পাগলামি!

    সবজি বাগান দেখাবার বাহানায়া নবনীকে সঙ্গে নিয়ে বেরোলেন সামির মা। চোখের সামনে নবনী উঠে চলে গেল অথচ তাকে চোখেই পড়লো না অমিতের। এখনো তার চোখ আটকে আছে সামনের দেয়ালে। অমিতের পাশে এসে বসলো সুমনা। সিঙারার বাটিটা অমিতের সামনে ধরে বললো,

    — “খাচ্ছো না যে!”

    সুমনার ডাকে ঘোর কাটলো অমিতের। পাশে নবনী নেই। চোখ ঘুরিয়ে এদিক ওদিক খুঁজতে লাগলো সে। সুমনা হেসে বললো,

    — “নবনী মাত্রই উঠে চলে গেল অথচ তুমি খেয়ালই করোনি! কোন খেয়ালে ডুবে ছিলে, বলো তো?”

    — “ওহ! না, তেমন কিছু না।”

    অমিতের হাতে সিঙারা দিয়ে সুমনা বললো,

    — “আমি কিন্তু দেখছিলাম তোমাকে।”

    — “কী?”

    — “আমার ভাই নেই অমিত। আর কখনো ফিরবে না। নবনী তোমার, একান্তই তোমার। তবুও কেন ইনসিকিউর ফিল করো, বলো তো?”

    — “না না! ওসব কেন ভাবতে যাবো?”

    — “অমিত! পাগল অনেক দেখেছি আমি। এক পাগলের সংসার করছি। আরেক পাগল মানে আমার ভাইয়ের কথা বলছি, তাকেও দেখেছি। ভালোবাসায় একটা মানুষ কতবড় পাগল হতে পারে আমি জানি। আরো কতজনকে দেখলাম! তবে সবচেয়ে কাছ থেকে দেখেছি আমার হাজবেন্ড আর আমার ভাইকে। ওদের চোখ, চাহনি, চেহারার ভাঁজ এত বেশি দেখেছি যে আমি এখন পাগলদের খুব বুঝতে পারি। এই যেমন ধরো তুমি। তোমাকেও বেশ বুঝতে পারছি আমি।” ঠোঁট চেপে হাসলো সুমনা। ধরা পড়ে যাবার ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে ফেললো অমিত। হাসছে সেও।

    — “তুমি নিজেকে কেন সামির সঙ্গে মেলাচ্ছো, বলো তো? সম্পূর্ণ আলাদা চেহারার, আলাদা ব্যক্তিত্বের দুজন মানুষ তোমরা। দুজনই দু’জনের জায়গায় সেরা।

    — “পার্থক্যটা দেখতে চাইছিলাম। বিশেষত্ব কী, বুঝতে চাইছিলাম। হয়তো আপনার শুনতে একটুখানি খারাপ লাগবে তবুও বলি?”

    — “অবশ্যই!”

    — “আপনি কাউকে ভীষণ ভালোবাসেন। তার ভালোবাসা আপনি খুব করে চাইছেন। অথচ সে ভালোবাসে অন্য কাউকে। তখন কি আপনিও আপনার আর সেই মানুষটার মাঝে পার্থক্য খুঁজতে চাইতেন না? হয়তো এই পৃথিবীর কাছে সামি নেই, কিন্তু আমার আর নবনীর জীবনে ও আছে। ঠিক আমাদের দুজনের মাঝখানে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই মুহূর্তে এমন একজনকে আমার ডিল করতে হচ্ছে যে কিনা এক্সিস্ট করে না। যাকে আমি দেখতে পাচ্ছি না, ছুঁতে পারছি না। তাকে কিছু বলতে পারছি না, তার কাছ থেকে কিছু শুনতেও পারছি না।”

    — “এবং তুমি ওকে পজিটিভলি নিতেও পারছো না। একজন মানুষ যে কিনা এই পৃথিবীতে নেই তার সঙ্গে মনে মনে ঠান্ডা যুদ্ধ চলছে তোমার।”

    — “হ্যাঁ। এ্যান্ড আ’ম স্যরি ফর দ্যাট। একটা ব্যাপার কি জানেন? আমিও জানি সামি নেই। কিন্তু আজকাল আমি ওকে ফিল করতে পারি। যতবার আমি নবনীকে কাছে পেতে চাই, একটা সংসারের স্বপ্ন সাজাতে চাই, ততবার আমি ওকে ফিল করি। যতবার নবনী ওর প্রাক্তনের গল্প আমাকে শোনায়, ততবার আমি ওকে ফিল করি। মনে হয় যেন, সামি কোত্থাও যায়নি। রয়ে গেছে এখানেই ঠিক আমার আর নবনীর মাঝখানে। আমাদের দূরত্ব আজীবন রয়ে যাবে শুধুমাত্র এই মানুষটার কারণে।”

    — “ক্যান আই হোল্ড ইউর হ্যান্ডস অমিত?”

    — “সিওর!”

    অমিতের হাতজোড়া নিজের মুঠোবন্দি করলো সুমনা।

    — “আমার ভাইটা তোমার বয়সী ছিল। তোমাকে দেখলে মনে হয় সামি দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে। হয়তো তুমি নবনীর হাজবেন্ড তাই! নবনীর পাশে তোমার বদলে অন্য কেউ দাঁড়ালে হয়তো আমার ঠিক এমনটাই মনে হতো। নবনী আমাদের খুব আপন, জানো তো?”

    —”হুম।”

    — “সামি মারা যাওয়ার পর যতটা না আমরা সামির জন্য ভেবেছি তার চেয়ে বেশি ভেবেছি নবনীর জন্য। ওর জীবন থেকে এমন একজন চলে গেছে যাকে ঘিরে ওর গোটা পৃথিবী ছিল। আমার ভাই নেই তাই বলে নবনীকে নিয়ে আমরা ভাববো না তেমন সম্পর্ক কিন্তু আমাদের না। সামি চলে যাবার পর থেকে এখন পর্যন্ত আমরা চেয়েছি নবনী সুখে থাকুক। এমন কেউ আসুক যে কিনা আগলে রাখতে জানে, আমার ভাইয়ের চেয়েও বেশি। যাকে নবনী ভালোবাসতে বাধ্য হবে। সামিকে ভুলে যাবে। শুনতে অদ্ভুত লাগলেও, এটাই সত্যি। আমার পরিবার সবসময় চেয়েছে নবনী সামিকে ভুলে যাক। নবনী যেহেতু বেঁচে আছে, বাঁচার মতই বাঁচুক। অবশেষে তুমি এলে অমিত। আমরা যেমন চেয়েছিলাম ঠিক তেমন। তুমি ভাবছো নবনী তোমাকে ভালোবাসে না? ভুল অমিত! ও ভালোবাসে তোমাকে। বাসতে

    বাধ্য হয়েছে ও।

    — “ও আমাকে ভালোবাসে না আপু। হ্যাঁ, আমি ওর জীবনে অবশ্যই বিশেষ কেউ। কিন্তু ভালোবাসা কিংবা সংসার ওসবের ধারে কাছেও নবনী নেই। ও এখনো সামির মাঝেই বেঁচে আছে।”

    — “সামির মাঝে নবনীর চেয়ে এখন তুমিই বেশি বেঁচে আছো। যতটা না নবনী ওকে ভাবে তার চেয়ে বেশি ভাবো তুমি। এত বেশি ভাবছো যে তুমি নবনীকে ঠিকঠাক দেখতেই পাচ্ছো না। সামিকে একপাশে রেখে তুমি শুধু নবনীকে একবার ভাবো তো। পরিবর্তন কি সত্যিই দেখতে পাও না?”

    — “জানি না আমি।”

    — “তুমি অবশ্যই জানো। নবনী আর সামিকে দেখতে পায় না আগের মতন। ওদের কথাও হয় না। কারণ নবনী সামিকে আর খোঁজেই না। ওর সবটা জুড়ে এখন শুধু আমি তোমাকেই খুঁজে পাই। আগে নবনীর গল্পজুড়ে সামিকে খুঁজে পেতাম। এখন ও তোমার গল্প বলে, বলতেই থাকে ক্লান্তিহীন। ওর চোখে অন্য এক আলো দেখতে পাই। রঙীন, সুন্দর, উচ্ছাসের আলো। ভালোবাসার প্রথম দিনগুলোতে এমনই হয় সবার, জানো তো সে কথা? নবনীরও তাই হচ্ছে। নবনীর পরিবর্তন তুমি দেখতে পাচ্ছো, ওর কাছে ভালোবাসার উষ্ণতা খুঁজে পাচ্ছো কিন্তু তবুও তোমার মন মানতে নারাজ নবনী সামিকে ভুলে যাচ্ছে। সমস্যাটা কোথায় জানো?”

    — “কোথায়?

    — “তুমি নবনীকে এখনই এই মুহূর্তে পুরোপুরি নিজের করে পেতে চাও। নবনীর মুখে আজই ভালোবাসার কথা শুনতে চাও। তোমাদের সম্পর্কের স্থায়ীত্ব চাও। অপেক্ষাটা আর হচ্ছে না তোমাকে দিয়ে।”

    — “নবনী নিজের মুখে বলেছে ও চলে যাবে। আমি থাকতে পারবো ওকে ছাড়া? আপনার হাজবেন্ড যদি বলে একমাস পরই আপনাকে ডিভোর্স দিয়ে দিবে আর আপনার কাছে স্ট্রং কোনো রিজন নেই এই সংসার টিকিয়ে রাখতে আবদার করার তখন আপনি কী করবেন?”

    — “তুমি ওকে ভালোবাসো, ও তোমাকে ভালোবাসে এরচেয়ে স্ট্রং রিজন আর কী হতে পারে?”

    — “আমি ওকে ভালোবাসি সেই কথা কি ওকে আমি জানাতে পারছি? ও আমাকে ভালোবাসে সেটা কি ও ফিল করতে পারছে? মোস্ট ইম্পর্ট্যান্টলি, ও কি সত্যিই আমাকে ভালোবাসে? এটা নিছক আপনার ভুল ধারণাও হতে পারে। এবার বলুন আমার কাছে আর কোন পথটা খোলা আছে? অপেক্ষা, ধৈর্য্য কোনোটাই আমাকে দিয়ে হবে না। নবনীকে আমার চাই, ব্যস চাই।”

    — “এত অধৈর্য হলে চলবে নাকি বোকা! সময় আছে তো হাতে। ভালোবাসা অনুভব করার জন্য এক মুহূর্তই যথেষ্ট। হতেও পারে এই ক’টাদিনে এমনকিছু ঘটে গেল। নয়তো নবনী যদি চলে যায়, ও নিজেই আবার ফিরে আসবে তোমার কাছে।”

    — “কিভাবে? দূরে গেলে ভালোবাসা অনুভব করা যায় সেই যুক্তিতে বললেন?”

    — “বিশ্বাস করো না?”

    — “একদম না। আপাতত কোনো যুক্তি তর্কেই আমি সহমত হতে পারছি না।”

    — “আর ক’টা দিনই তো। আমিও আছি আরো মাস দুয়েক। দেখে নিও আমার কথা সত্যি হয় নাকি।”

    .

    মরহুম মোঃ মেহরাব হোসেন সামি
    পিতা মোঃ মাহফুজ হোসেন
    মাতাঃ শবনম আফরোজ
    মৃত্যু : ২৩ এপ্রিল, ২০১৪ ইং

    বিশাল আমগাছের নিচে সমতলে নেমে আসা একটি কবর। এপিটাফে বড় অক্ষরে লেখা মৃতের নাম পরিচয়ে এক দৃষ্টিতে স্তব্ধ হয়ে চেয়ে আছে নবনী। অঝোরে কাঁদছেন শবনম। নবনীর পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলছেন,

    — “সামি চলে গেছে আম্মু। ও নেই। সত্যিই ও নেই। যে মারা যায় সে কখনো ফিরে আসে না। ফিরে আসার কোনো পথ উপরওয়ালা খোলা রাখেননি। কোনো চমৎকার তোমার জীবনে হয়নি আম্মু। যা হয়েছে পুরোটাই তোমার কল্পনা, তোমার ভ্রম। একবার ছুঁয়ে দেখো ওর কবরটা! ওকে আমরা এখানে শুইয়ে দিয়েছি চিরতরে। ওর ফিরে আসা সম্ভব না। মেনে নাও ওর মৃত্যু। এভাবে আর কত? এবার তো জীবনে আগে বাড়তে হবে, সংসারী হতে হবে। বিয়ে শাদী হয়েছে তোমার। আর কত অতীত নিয়ে পড়ে থাকবে বলো? মানুষের জীবনে কত দুর্ঘটনা ঘটে, তোমার সঙ্গেও ঘটেছে। মেনে নিতে হবে তোমার। জীবনের সঙ্গে, উপরওয়ালার ফয়সালার সঙ্গে আপোষ করতে হবে। উপরওয়ালা কাউকে ঠকান না। তিনি সামিকে নিয়ে গেছেন, অমিতকে দিয়েছেন। ভীষণ লক্ষ্মী ছেলেটা। তুমিই না কত প্রশংসা করো ছেলেটার! তাহলে ওকে মেনে নিচ্ছো না কেন? খুব সুখী হবে তুমি, খুব! একটু মনটা শক্ত করো। আমার ছেলেকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করো।”

    নবনী এখনো চেয়ে আছে এপিটাফের দিকে। শবনম আন্টি কিসব বলে যাচ্ছে কখন থেকে? কেন বলছে? এমন কেন কথাগুলো? মাথায় ভীষণ যন্ত্রণা করছে। বুকের ভেতর কী এক হাহাকার সমুদ্রের ঢেউ হয়ে আছড়ে পড়ছে। পা কাঁপছে নবনীর। জিহ্বায় সমস্ত কথা যেন জড়িয়ে আসছে। শূণ্য চোখে শবনমের দিকে তাকালো নবনী। প্রায় তোঁতলাতে তোঁতলাতে বললো,

    — “ও আমার ভ্রম না। ও সত্যি।

    — “মা গো, এমন কখনো হয়? মিথ্যা নিয়ে আর কতদিন বাঁচবে তুমি? বাস্তবের মুখোমুখি হতে হবে না?”

    — “এভাবে বলছেন কেন আন্টি? এতদিন তো এসব বলতে শুনিনি। আজ হঠাৎ কেন সবকিছু মিথ্যা বলছেন?”

    — “আমি চাই না আর মিথ্যা নিয়ে বাঁচো। বিয়ে হয়েছে, জীবনে নতুন মানুষ এসেছে। তাকে নিয়ে জীবন সাজাও। তোমার গোছানো একটা জীবন আমি দেখতে চাই।”

    — “ও আসে আন্টি। আমি ওকে ছুঁতে পারি, ওর কন্ঠ শুনতে পারি। অনেক অনেক কথা হয় আমাদের!”

    ছেলের কবরের পাশে বসলেন শবনম। একটানে নবনীকেও সামির পাশে বসালেন। নবনীর হাত কবরের উপর রেখে বললেন,

    — “ছুঁয়ে দেখো কবরটা। সামিকে স্পর্শ করতে পারছো? জিজ্ঞেস করো, ও কেমন আছে? কোনো উত্তর আসে কিনা দেখো?”

    — “আমার সামনে আসে তো ও!”

    — “আসে না নবনী! ও চলে গেছে অন্য পৃথিবীতে। শরীরটা শুধু ছেড়ে গেছে আমাদের কাছে। ছেলের শরীরটা বাড়ির সবচাইতে সুন্দর জায়গাটাতে তোমার আংকেল মাটি দিয়েছে। আর কখনো আমাদের বাচ্চাকে চোখের দেখা দেখতে পারবো না, কথা বলতে পারবো না তবুও রয়ে গেছি এখানে। ঢাকার বাড়ি ফেলে আজ আটবছর ধরে এখানে আমরা থাকছি শুধু কবরের পাশে বসবো বলে। কবরটা যত্নে রাখবো বলে। এতটুকুই আমাদের শান্তি। এর বাইরে আমরা আর কিছু পাইনি। সামিকে কখনো একনজর দেখার সুযোগ হয়নি। ভালো কি শুধু তুমিই বেসেছো? আমরা ওকে বাসিনি? একনজর ওকে দেখবো বলে ছটফট করে শেষ হইনি? তবুও কেন দেখতে পাই না ওকে? উপরওয়ালার কি এই বুড়ো বাপ মায়ের প্রতি একটু দয়া করে চমৎকার ঘটাতে ইচ্ছে হয়নি? চমৎকার হয় না নবনী, মৃত মানুষকে নিয়ে চমৎকার হয় না। সামি মরে গেছে। তোমার সামনে ও চলে গেছে চিরতরে। শরীর যা ছিল তাও মিশে গেছে এই মাটিতে।”

    গলা ফাটিয়ে একবার সামিকে ডাকতে চাইছে নবনী। চোখের সামনে এক্ষুনি এই মুহূর্তে দেখতে চাইছে ভীষণ ভালোবাসার প্রাক্তনকে। প্রচন্ড অভিমান নিয়ে জানতে ইচ্ছে করছে, তুমি নাকি চিরতরে চলে গেছ? তুমি নাকি আমার ভ্রম? কথাটা কি সত্যি? কিন্তু কই আজ তো সে চোখের সীমানায় ধরা দিচ্ছে না! গলার স্বরও যে ফুটছে না! আটকে আছে গলার মাঝখানে, সঙ্গে নিঃশ্বাসটাও। পায়ের কাঁপুনি ছড়িয়ে পড়ছে পুরো শরীরজুড়ে। চোখের সামনে সবকিছু ঘোলা হতে হতে শবনমের গায়ের উপর ঢলে পড়লো নবনী।

    .

    শক্ত করে নবনীর হাত নিজের হাতের মুঠোয় আঁকড়ে ধরে রেখেছে অমিত। সুমনা একটু পরপর চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে দিচ্ছে। জ্ঞান ফিরছে না নবনীর। বারবার দেখছে সে অমিতকে। চোখে-মুখে তার প্রিয় মানুষ হারাবার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসা আতংক। সুমনার নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে। কেন যে মায়ের সঙ্গে ওকে একা যেতে দিলো! সপ্তাহখানেক ধরে মা খুব আবোলতাবোল বলছিল। সত্যি সত্যিই অঘটন ঘটিয়ে দিবে কে জানতো! ইশ্, এখানে কেন যে আসতে বললো ওদের দু’জনকে! মায়ের উপর ভীষণ মেজাজ খারাপ হচ্ছে সুমনার। রেগে গিয়ে সে বললো, —

    — “তুমি ওকে সামির কবরে কেন নিয়ে গেলে মা?”

    — “আমি তো চেয়েছিলাম নবনী বাস্তবতা বুঝুক। সেজন্যই তো…”

    — “মা আজ আটবছর হয়ে গেছে ঐ ঘটনার। এতগুলো বছরে নবনী এসেছে কখনো সামির কবরে? না আমরা কখনো নিয়ে এসেছি ওকে? তুমি জানতে না নবনী নিজ চোখে ওর কবরটা দেখলে নিজেকে সামলাতে পারবে না? কেন পরিস্থিতি বিগড়ে দিলে, বলো তো?”

    — “আমি ওকে বুঝাতে চেয়েছিলাম সামি নেই। ওকে বুঝতে হবে তো ব্যাপারটা। আর কতদিন এভাবে? সংসারী হতে হবে না?”

    — “মা সেজন্য ডক্টর আছে। তুমি আমি বুঝিয়ে যদি কাজ হতো তাহলে নবনী এতবছর ভুগতোই না। সামলে নিতো নিজেকে আরো বহু আগেই। সেই কবে কী বলেছি নবনীকে, তার উল্টাপাল্টা অর্থ বের করে এতগুলো বছর ধরে সামিকে নিজের কল্পনায় বাঁচিয়ে রেখে নিজে বেঁচে আছে। আজ অব্দি সেই সমস্যার সুরাহা হলো না। এরমাঝে তুমি আবার কিসব বললে! এখন তোমার কথায় কী কী করে বসবে, কে জানে!”

    — “আমি কেন যে এসব বলতে গেলাম, বুঝে পাচ্ছি না একদম।”

    হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলেন শবনম। তার কান্না দেখে মায়া হলো সুমনার। নবনীকে নিয়ে মায়েরও যে দুশ্চিন্তার সীমা নেই। ভালো ভাবতে গিয়ে অজান্তেই ঝামেলা বাঁধিয়ে ফেললো। অমিতের কানে শবনমের কথা, কান্না সবাটাই পৌঁছাচ্ছে। কিন্তু সেদিকে মন নেই তার। এক কানে পৌঁছে অন্য কানে বেরিয়ে যাচ্ছে। সমস্ত ধ্যান জ্ঞান আটকে আছে শুধু নবনীর চোখে। চোখ মেলছে না কেন ও? আরো কিছু সময় পর জ্ঞান ফিরলো নবনীর। চোখ মেলেই নিঃশ্বাসের কাছাকাছি সে আবিষ্কার করলো অমিতকে। দিশেহারা হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকেই।

    — “শরীর খুব খারাপ লাগছে নবনী? মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে তোমার?”

    অমিতের প্রশ্ন শুনতেই দুই চোখ বেয়ে পানি ঝরলো নবনীর। মুখ ফুটে কিছু বললো না সে। নবনীর অসহায় মুখটা দেখে কান্না পাচ্ছে অমিতের। কতশত প্ৰশ্ন, কথা ওর চোখে ছুটে ছুটে বেড়াচ্ছে। অথচ মুখ ফুটে বলছে না কিছুই। সব কথারা আটকে আছে বুঝি গলার মধ্যেখানে? ঠিক আটবছর আগের মতন? নবনী কি তবে সেই মুহূর্তটায় আবার ফিরে যাচ্ছে? আবারও পরিবার আর পৃথিবী থেকে আলাদা করে ফেলবে নিজেকে? ভয় আর সংশয়ে অমিতের হাত পা অসাড় হতে লাগলো। কী করবে, কী করবে না ভেবে অস্থির হলো অমিত। এখান থেকে বেরোতে হবে তাকে, এক্ষুনি বের হতে হবে। নবনীকে বিছানা থেকে তুলতে তুলতে অমিত সুমনাকে বললো,

    — “আমি ওকে নিয়ে এখুনি বাসায় ফিরবো। আপনি কি আমার সঙ্গে ঢাকায় ফিরবেন প্লিজ? আমি ড্রাইভ করবো। নবনীর পাশে থাকার জন্য একজন মানুষ লাগবে।”

    — “সিওর!”

    — “আমি যাচ্ছি। আপনি আসুন।”

    অমিত বেরিয়ে যাবার সময় তার হাত চেপে ধরলেন শবনম। মিনতি করে বলতে লাগলেন,

    — “স্যরি বাবা! খুব ভুল হয়ে গেছে আমার।”

    প্রত্যুত্তরে কিছু বলেনি অমিত। অসহায় চোখে তার দিকে একবার তাকালো শুধু।

    .

    গাড়ির ব্যাকসিটে বসে আছে সুমনা। তার কাঁধে মাথা ফেলে চোখ বুজে আছে নবনী। ফ্রন্ট মিররে ড্রাইভ করতে করতে নবনীকে বারবার দেখছে অমিত। ভেতরটা ভেঙে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে তার। কোন অনুভূতিটা এত ভাঙছে তাকে? ক্ষোভ নাকি কষ্ট? নাকি দুটোই? নবনীর সমস্তটা তার জানা আছে। ভাগ্যের নির্মমতায় কতটা সয়ে যেতে হয়েছে, হচ্ছে সেসবের প্রতি অমিতের পূর্ণ সহমর্মিতাও আছে। এই যে নবনীটা চোখের সামনে কষ্ট পাচ্ছে, সেই কষ্টে পুড়ছে সে নিজেও। এই ত্রিভুজ গল্পে সামি নামের ঐ মিষ্টি হাসির ছেলেটার কোনো দোষ নেই, নেতিবাচক ভূমিকা নেই। তবুও তার প্রতি পাহাড়সম ক্ষোভ হয় অমিতের, হিংসে হয় খুব। ঘুরেফিরে সামিকেই এই গল্পের খলনায়ক খুঁজে পায় সে। কেন এসেছিল এই ছেলেটা ওদের গল্পে? কেন এখনো দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওদের মাঝে? নাকি এই ত্রিভুজ গল্পের তৃতীয় ব্যক্তিটা সে নিজে? ওদের মাঝের দেয়ালটাও কি সে-ই? নিজেকে পাগল পাগল লাগছে অমিতের। চোখের সামনে অন্য কারো জন্য নবনীর পুড়ে ছারখার হওয়া কিংবা মাথার ভেতর কিলবিল করতে থাকা প্রশ্নগুলো সহ্যসীমার বাইরে চলে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে ব্রেক ছেড়ে, হাত গুটিয়ে বসে থাকতে। পড়ুক গিয়ে গাড়ি কোনো খাদে-খালে। কিংবা মুখোমুখি সংঘর্ষ হোক গাছ কিংবা ট্রাকের সঙ্গে। সমস্ত প্রশ্ন, যন্ত্রনার ইতি হোক এখানেই। নবনী বারবার তাকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় তোমার সঙ্গে কোনোদিন কিচ্ছু হওয়া সম্ভব না। বহু বহুবছর আগে আমি বাঁধা পড়েছি অন্য কারো সঙ্গে। অনন্তকাল নিজেকে বেঁধে রাখবো তার সঙ্গেই। তুমি আমার জীবনে একটা পরগাছা মাত্র যাকে রমিজ মির্জা জোর করে আমার সঙ্গে বেঁধেছে। সময় হলেই তোমাকে ছেটে ফেলা হবে চিরতরে।

    .

    নিজের ঘরে ঘুমাচ্ছে নবনী। বাসায় ফিরেই সর্বপ্রথম রুমানাকে কল করেছে অমিত। ওষুধের নাম টেক্সট করে তক্ষুনি নবনীকে একটা খাইয়ে দিতে বললো রুমানা। দেরী করেনি অমিত, তৎক্ষনাৎ ওষুধ এনে খাইয়ে দিয়েছে ওকে। আধঘন্টা পরই নীরবে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেছে নবনী। খবর পেয়ে বাসা থেকে ছুটে এসেছে নাতাশা আর নীতু। রুমানাও এসেছে সাব্বিরকে নিয়ে কিছুক্ষণ আগেই। বসার ঘরে অমিতকে ঘিরে বসেছে সবাই। পুরো ঘটনা কারোই জানা নেই। নানা প্রশ্ন জমে আছে উপস্থিত সবার নবনীকে ঘিরে। চরম বিরক্তি নিয়ে রুমানা অমিতকে বললো,

    — “উইথআউট মাই পারমিশন, তুমি ওকে সামির কবরের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলে কেমন করে অমিত? নবনীর কন্ডিশন ট্রিগারড হতে পারে তা কি একবারও তোমার মনে হয়নি?”

    — “আমি দাঁড় করিয়েছি?”

    — “তাহলে?”

    — “সামির মা নিয়ে গেছে ওকে। ঐ বাড়িতে সামিকে দাফন করা হয়েছে সে কথা আমি একদম জানতাম না।”

    রুমানা কিছু বলার আগেই নীতু বলতে লাগলো,

    — “আর কী হয়েছে সেখানে? কেউ এমন কিছু বলেছে ওকে যেটা বলা উচিত হয়নি?”

    — “হ্যাঁ উনিই বলেছেন। সামি মরে গেছে আর ফিরবে না, এসব তোমার ভ্রম, বাস্তবে ফিরে এসো, সংসারে মন দাও। এসবই বলেছেন ওকে।”

    — “উফ শবনম আপা! ছেলে মারা গেছে পর থেকে বোধবুদ্ধি লোপই পাচ্ছে

    দিনদিন। আমাকে বারবার বলছিল নবনীকে আমি বুঝাবো স্বামী সংসার মেনে নিতে। আমিও বারবার উনাকে বুঝিয়ে বলেছি এভাবে হবে না আপা, সময় সুযোগ বুঝে আস্তে আস্তে অমিতই ওকে সংসারে ফেরাবে। ওর ট্রিটমেন্ট চলছে, ধীরে ধীরে সব ঠিক হবে। তবুও উনি পাগলামি করলোই! ধুর ছাই। খুব ভুল হয়েছে, নবনীকে আমার যেতে দেয়াই উচিত হয়নি।”

    — “আমি তোমাকে তখনই বারণ করেছিলাম ভাইয়া। বলেছিলাম যেও না ওখানে। খুব একটা পজিটিভ ভাইভ পাইনি আমি। এখন দেখো তো, সত্যি সত্যি একটা ঝামেলা বাঁধিয়ে ফিরে এলে।”

    অনির সঙ্গে তাল মেলালো সাব্বির।

    — “হ্যাঁ ঠিকই তো! কেন নিয়ে গেলি ওকে সেখানে?”

    — “নবনী বললো যাবে, সামির মা ওকে খুব দেখতে চাইছেন। ভাবলাম ছুটির দিন আছে, এক বাহানায় দু’জনের বেরিয়ে আসা হবে। কখনো কোনোকিছুতে নবনীকে বারণ করেছি আমি?”

    সামনের সময়গুলো কেমন হবে সে কথা ভেবে স্থির হতে পারছে না নাতাশা।

    একবার উঠে দাঁড়াচ্ছে তো আরেকবার বসছে। অমিতকে সে বললো,

    — “বাবা ভীষণ ভয় পাচ্ছে ভাইয়া। আপু আগের মতন না আবার হয়ে যায়!”

    ডানে বামে মাথা নাড়লো রুমানা। নাতাশাকে আশ্বাস দিলো,

    — “এতটাও সিরিয়াস হবে না। তবে সমস্যা একটু হবেই। সামিকে নিয়ে আজকাল ওর ভাবনা কমে যাচ্ছিল। দেখা, কথা বলা এসবও অনেকটা কমে এসেছে। হতে পারে আজকের পর সেই সমস্যা আগের অবস্থায় ফিরে যাবে। আবার নাও হতে পারে। লেটস সি! অবস্থা বুঝে তখন একটা ব্যবস্থা আমাদের নিতে হবে।” ভয়ে মুখ শুকিয়ে আসছে অমিতের। নবনী ঘুম থেকে জাগার পর সময়গুলো কেমন হবে? খুব কঠিন? নাগালের বাইরে? নবনী হাসবে তো? মন খুলে কথা বলবে তো? তাকে হাসিমুখে মেনে নিবে? এতদিন সম্পর্কটা যেভাবে যাচ্ছিলো সেভাবেই যাবে? অমিতের পাশে এসে বসলো সাব্বির। পিঠ চাপড়ে বললো,

    — “এত ভয় পাচ্ছিস কেন?”

    — “পাবো না? এটা নবনী! অন্য কেউ না। ও বদলে গেলে আমার সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাবে।”

    — “এখনই নেগেটিভ কিছু ভাবিস না। আগে দেখ না কী হয়!”

    — “কাজের লোকের চেঁচামেচি শুনে আমি আর সুমনা আপু দৌড়ে বের হলাম। দেখি, ও আন্টির গায়ের উপর পড়ে আছে। তখনও সেন্স ছিল ওর। পুরোপুরি জ্ঞান হারায়নি। বিড়বিড় করে কী বলছিল কিছুই বুঝিনি। ওকে কোলে নিয়ে ঘরে ফিরছিলাম। মেয়েটা কাঁপতে কাঁপতে আমারই চোখের সামনে সেন্সলেস হয়ে গেল। আমার ওয়াইফ! নবনী আমার ওয়াইফ! ও ওর পাস্ট থেকে বেরোতে পারছে না, দ্যাটস ওকে। আছি আমি। ওকে দেখবো, সামলে নিবো। পাস্ট থেকে বেরিয়ে আসতে যতটা হেল্প ওর দরকার আমি করতে রাজি আছি। বাট নবনী আমার জীবনে থাকবে কি না, আদৌ কখনো আমি ওর ভালোবাসা পাবো কি না এই অনিশ্চয়তা আমি আর নিতে পারছি না। নবনীকে আজ দেখে মনে হচ্ছিল ও মারা যাচ্ছে। এই মরণ আমার জন্য না। অন্য কারো জন্য। আমি মানতে পারছি না। আর কিছুদিন বাদে নবনী আমার বউ হয়ে থাকবে কি না তাও আমি জানি না। নবনী এই প্রসঙ্গ যেদিন উঠালো সেদিনের পর থেকে আমার ঘুম উড়ে গেছে। ঘুমাতে পারছি না আমি। আজেবাজে স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যায় বারবার। এক জায়গায় স্থির হতে পারছি না। কাজে মন বসাতে পারছি না। আমি জানি ও আমাকে ভালোবাসে না। ও এখনো সামিকেই ভালোবাসে। আমি শুধু জানতাম, কখনো চোখে দেখিনি। আজ দেখেছি নবনী ঐ ছেলেটাকে কতটা ভালোবাসে। কতটা মরে ওর জন্য। এই ছেলেটার প্রতি আমার কোনো একসময় সিম্প্যাথি ছিল। ওকে ভেবে খুব মন খারাপ হতো আমার। কিন্তু আজ নিজের চোখে দেখার পর সামিকে আমি আর সহজভাবে নিতে পারছি না। ও আমার সহ্যসীমার বাইরে চলে গেছে। এ্যান্ড আই হেইট হিম! সম্ভব হলে এক্ষুনি এই মুহূর্তে আমার ওয়াইফ ওর কাছ থেকে আমি ছিনিয়ে নিতাম।”

    সাব্বির আর রুমানা একে অপরের দিকে চেয়ে রইলো এক মুহূর্ত। নবনীকে সামলাতে গিয়ে অমিত নিজেই কি অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে?

    অমিতের পাশে এসে বসলো রুমানা। — “অমিত! আমি বলেছিলাম ধৈর্য্য রাখতে হবে। সামি নেই। একজন মৃত মানুষকে

    তুমি কিভাবে ঘৃণা করতে পারো! আর ছিনিয়ে আনার প্রসঙ্গই বা কেন আসছে?”

    — “ও নেই এই কথাটা আমি আর বিশ্বাস করতে পারছি না রুমানা। আই ক্যান ফিল হিজ এক্সজিসটেন্স বিটউইন আস। আমার তো মনে হয় যখন তখন ওকে আমি আমার চোখের সামনে দেখতেও পাবো যেমনটা নবনী দেখে।”

    — “কাম ডাউন। নবনী তোমারই আছে। সময়ের ব্যবধানে পুরো গল্পটা তোমার সাইডে চলে আসবে। ওকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে একটু সময় কি তুমি দিবে না?”

    — “দিবো। অবশ্যই দিবো। আজীবন সময় দিবো। কিন্তু নবনীকে আমি আমার পাশে চাই। কোনো একদিন ও আমাকে ভালোবাসবে সেই নিশ্চয়তা চাই। যেই মুহূর্তে নবনী আমার এই ফ্ল্যাটের দরজা পেরিয়ে বেরিয়ে যাবে সেই মুহূর্তে আমিও আর থাকবো না রুমানা।

    — “কোথায় যাবে তুমি?”

    — “আই ডোন্ট নো।”

    — “এই মুহূর্তে নবনীর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তোমাকে। অথচ তুমিই কিসব ভাবছো, বলছো! নিজেকে সামলে না রাখলে অন্যকে সামলাবে কেমন করে?”

    — “তোকে এভাবে দেখতে একদম ভালো লাগছে না আমার। তোকে ভরসাও করতে পারছি না। কখন কী করে বসবি, কে জানে!”

    — “বললাম তো, নবনী যতক্ষণ আছে ততক্ষণ আমিও আছি। নবনী নেই তো আমিও নেই।”

    — “দেখো অমিত, একদম পাগলামি করবে না বলছি। পরিস্থিতি বোঝো। নাজুক সময় যাচ্ছে। এই মুহূর্তে নবনীকে তোমারই দেখে রাখতে হবে। আপাতত তুমিই ওর মেডিসিন। ওর সমস্ত ক্ষত সারিয়ে তুলবার দায়ও কিন্তু তোমারই। আমি আমার পেশেন্ট তোমার দায়িত্বে রেখে যাচ্ছি। নবনী ঘুম থেকে জাগার পর এক মুহূর্তও তুমি ওকে একা ছাড়বে না। ও কথা বলতে চাইবে না কিন্তু তুমি বলবে। ও মুখ ফুটে কিছু বলার আগ পর্যন্ত তুমি একাই কথা বলবে। যা মাথায় আসে তাই বলবে এবং অবশ্যই ভালো কিছু। ও যদি কাঁদে তো কাঁদবে। ওকে থামাবার প্রয়োজন নেই, কাঁদতে দিও যতক্ষণ খুশি। ওকে জড়িয়ে ধরে রেখো। ওকে অনুভব করাতে হবে তুমি আছো ওর পাশে। ইউ হ্যাভ এমপ্যাথি ফর হার।”

    রুমানা অনর্গল বলে চলছে। নীতু মাথা নিচু করে বসে আছে সোফায়। রুমানার কথা, অমিতের পাগলামি সবটাই মন দিয়ে শুনছেন তিনি। চোখ বেয়ে নীরবে পানি গড়িয়ে পড়ছে তার। মনে ভীষণ কু ডাকছে। অমিতের মতন তারও ভীষণ ভয় হচ্ছে। তার মেয়েটা কি এতবছর পরও একটা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে না? নিজেকে উজাড় করে ভালোবাসার পরও কি নবনীকে সারাজীবন নিজের সঙ্গে বেঁধে রাখতে পারবে না? কী হবে এই সম্পর্কের ভবিষ্যৎ? কী আছে এই ছেলেটার ভাগ্যে?

    ৫২

    — “আমি আর তোর বাবা ব্যাগ গুছিয়ে আবার সিদ্ধান্ত বদলালাম। তোর কল পেয়ে ভয় পেয়েছিলাম খুব। তাড়াহুড়ো করে কী করবো না করবো ভাবতে ভাবতে ব্যাগ গুছানোর পর মনে হলো আমাদের এই মুহূর্তে যাওয়া উচিত হবে না।”

    — “কেন?”

    — “বাসা ভর্তি এত মানুষের কাজ নেই। নবনীর এই সময়টাতে শুধু তুই থাক। ওর দরকারও শুধু তোকেই। একান্তে এই সময়টা কাটা। বাসায় শুধু অনি আর নাতাশা থাকুক। রান্নাবান্নার একটা ব্যাপার আছে। মাঝেসাঝে ওরাও একটুখানি নবনীর সঙ্গে বসলো, কথা বললো। কিন্তু এর বেশি কেউ না। আমি ভাবিকেও কল করে বলেছি আপাতত বাসায় যেন কেউ না যায়। অফিসে কল করেছিলি বাবু? ছুটি নিয়েছিস কয়েকদিন?”

    — “আম্মু! আমার ভয় লাগছে। মিনিমাম কনফিডেন্স পাচ্ছি না।”

    — “বাবু গলা কাঁপছে তোর। কাঁদছিস, তাই না?”

    — “তুমি এলে ভালো হতো না? একা কিভাবে সামলাবো আমি?”

    — “ওখানে আমাদের প্রয়োজন নেই আপাতত। বরং কাবাব মে হাড্ডির মতন দেখাবে আমাদের। শোন বাবু, আমাদের মন যখন ভেঙে যায়, অথৈ সাগরে ভাঙা মন নিয়ে আমরা ভাসতে থাকি তখন মনে মনে আমরা হন্যে হয়ে একজন মানুষ খুঁজি। যে আমাদের শুনবে, মন খারাপের সঙ্গী হবে। আমাদের হাত ধরে বলবে, আছি তো আমি তোমার পাশে। এই মানুষগুলোর প্রতি আমাদের আলাদা মায়া কাজ করে, তাকে জন্ম জন্মান্তর নিজের সঙ্গে বেঁধে রাখতে ইচ্ছে হয়। সেই মানুষটা যে কেউ হতে পারে- মা, বাবা, কাজিন, বন্ধু কিংবা অপরিচিত কেউ। আমরা চাই না এই মানুষটা কখনো আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে যাক। তার সঙ্গে অজান্তেই আমাদের সম্পর্ক গাঢ় হতে থাকে, সম্পর্কের গভীরতা বাড়তে থাকে। নিজেকেই দেখ না বাবু! নবনীকে কেমন এড়িয়ে চলতিস, মনে হতো যেন ও কোনো ছোঁয়াচে রোগ। কাছে গেলেই তোর সর্বনাশ হয়ে যাবে। তারপর নবনী তোর খারাপ সময়টাতে পাশে দাঁড়ালে, তোর সঙ্গে সঙ্গে থাকলো। এক মুহূর্তের জন্যও তোকে মনে হতে দেয়নি তুই একা। এখন কী হলো, দেখতো! নবনীকে ছাড়া তুই আর কিছু ভাবতেই পারিস না। এখন নবনীরও খারাপ সময় যাচ্ছে, সামিকে হারাবার পুরোনো সেই সময়টা আবার ওর সামনে এসেছে। তখন তুই ওর পাশে ছিলি না। এখন তো আছিস। দেখ না চেষ্টা করে নবনীকে শান্ত করতে পারিস কি না। ওর ভাঙা মনটা জোড়া লাগাতে পারিস কি না। ওর মনের মানুষের অভাব একটু হলেও মেটাতে পারিস কি না। আমি কিন্তু জানি অমিত, তুই পারবি। একমাত্র তুই-ই পারবি। তোর কেন যে মনে হচ্ছে নবনী চলে যাবে! সময় আছে তো হাতে আরো কিছুদিন।

    — “না আম্মু। সময় নেই। ও ঘুম থেকে জেগেই চলে যেতে চাইবে।”

    — “কচু চাইবে! কথা শোন তো আম্মুর। কিচ্ছু হবে না বললাম তো। তুই শুধু ওকে ছেড়ে কোথাও যাবি না। নবনীর রুমেই থাক কয়েকদিন। নয়তো নবনীকে তোর ঘরে নিয়ে যা। রাতে ওর কাছেই থাকিস।”

    — “রাতে একসঙ্গে থাকবো?”

    — “হ্যাঁ। কিছু…”

    শামীমা কথা শেষ করবার আগেই নবনীর ঘর থেকে শব্দ এল। হাউমাউ করে কাঁদছে নবনী। ফোন ডাইনিং টেবিলে রেখে অমিত ছুটলো নবনীর ঘরে। রান্নাঘরে রাতের রান্না সেরে নিচ্ছিলো নাতাশা আর অনি, কান্নার শব্দে অমিতের পেছন পেছন ছুটলো ওরা দু’জনও। ফ্লোরে গুটিসুটি মেরে বসে আছে নবনী। উসকো খুশকো চুলগুলো নিজের মুঠোবন্দি করে টানছে আর চিৎকার করে কাঁদছে। পরনে তার সামির নীল ঢিলাঢালা শার্ট। পায়ের কাছে পড়ে আছে সামির রক্তমাখা সাদা শার্টটা। নবনীকে এভাবে কাঁদতে দেখে বুক ভেঙে আসে অমিতের। মুখে ওড়না চেপে ডুকরে কেঁদে উঠলো নাতাশা। অমিত নবনীর পাশে বসে তার গালে হাত রেখে মৃদু স্বরে ডাকলো, “নবনী?”

    অমিতকে সামনে পেতেই যেন একটুখানি আশ্রয় খুঁজে পেলো নবনী। অমিতের হাতের মাঝে মুখ গুঁজলো সে। নবনীকে কাছে টেনে শক্ত করে দু’হাতে জড়িয়ে ধরলো অমিত। দু’চোখে পানি ছলছল করছে তার। নাতাশাকে নিয়ে বেরিয়ে এল অনি। যাবার আগে দরজা টেনে গেল। দুজনের এই মুহূর্তটা কাটুক একান্তে। নবনী তার চোখের সীমানায় শুধু অমিতকেই খুঁজে পাক।

    নবনীর চোখের পানিতে অমিতের ঘাড়ের ডানপাশ, কাঁধ ভিজে যাচ্ছে। নবনীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো অমিত। আদুরে স্বরে বললো,

    — “খুব কষ্ট হচ্ছে?”

    — “ও আসছে না কেন?”

    — “কে?”

    — “সামি।”

    — “এই মুহূর্তে ওকে চাই তোমার?”

    — “হ্যাঁ।”

    দীর্ঘশ্বাস ফেললো অমিত। নবনীর হাত ধরে খাটে বসালো সে। নবনীর পিছনে বালিশ রেখে বললো,

    — “এখানে হেলান দাও। অমিতের কথায় নড়লো না নবনী। ঠায় বসে রইলো আসন পেতে। নবনীর হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিলো অমিত। কিছু বলছে না সে। নবনীর মুখ ফুটে কিছু

    বলার অপেক্ষায় আছে।

    — “এমন কখনো হয়নি অমিত। ও সবসময় আমার আশপাশেই থাকতো। ওকে যখনই দেখতে ইচ্ছে হতো আমি ওকে আমার পাশেই পেতাম। অথচ আজ ও নেই। এত করে চাইছি ও আসুক অথচ ও আমার সামনে আসছেই না। সবাই বলে সামি আমার ভ্রম। সত্যিই কি ও আমার ভ্রম? কোনো মিরাকেল কি হয়নি আমার জীবনে? আমাদের সম্পর্কে?”

    বলতে বলতে আবারও হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো নবনী। নবনীর মাথাটা টেনে নিজের কাঁধে রাখলো অমিত। ওর এলোমেলো চুলগুলো আঙুল চালিয়ে গুছিয়ে দিতে দিতে অমিত বললো,

    — “তুমি আমার কাছে উত্তর চাইছো? নাকি এই উত্তরটা সামির কাছে জানতে চাও?”

    — “তুমি বলো।”

    — “খুব দ্বিধায় ফেলে দিলে যে!”

    — “আমি উত্তর চাই অমিত।”

    — “আগে একটা কথা বলো তো নবনী, তুমি আমাকে বিশ্বাস করো?”

    — “করি।”

    — “কতটা?”

    — “যতটা বিশ্বাস করার ক্ষমতা আমার আছে তার সম্পূর্ণটা দিয়েই তোমাকে বিশ্বাস করি।”

    — “তোমার জন্য যেটা বেস্ট সেটাই আমি করবো, তা মানো?”

    — “হুম।”

    — “আমি যা উত্তর দিবো সেটাই তুমি মেনে নিবে?”

    — নিবো।”

    — “তোমার ভালোবাসার মানুষটাকে আমি কখনো দেখিনি নবনী। তুমি যখন ওর সঙ্গে গল্প করো, হাসো আমি প্রায়ই আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখি তোমাকে। তোমার ভালোবাসার মানুষটাকে একনজর দেখবো বলে হন্যে হয়ে খুঁজি। তাকে বলবো বলে অনেক কথা জমে আছে আমার। কথাগুলো বলার জন্য তাকে খুঁজি। আজ পর্যন্ত তাকে আমি দেখতে পাইনি। শুধু আমি কেন? এই ছেলেটা চলে যাবার পর ওকে আর কেউ কখনো দেখেনি। মানুষ মরে গেলে আর কখনো ফেরে না।

    পৃথিবীর চিরন্তন সত্য এটাই আমরা জানি। তুমি সামিকে দেখার জন্য যতটা মরো ঠিক ততটা ওর পরিবারও মরে, আমিও মরছি। অথচ আমরা কেউই ওকে দেখতে পাই না। তাই এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে এটাই সত্যি, যে মরে যায় সে একেবারেই যায়। আর কখনো ফেরে না। কিন্তু তোমার বেলায় সত্যিটা বদলে গেল। শুনেছি ভালোবাসায় নাকি সব সম্ভব। ঠিক কী কী যে সম্ভব সে কথা কখনো জানা হয়নি। হয়তো মৃত ব্যক্তির ফিরে আসাও সম্ভব! আমার কাছে সামি শুধুই ভ্রম, আর তোমার কাছে সে সত্যি।’

    — “একটা সহজ উত্তর দাও।”

    — “তোমার প্রশ্নটাই জটিল ছিল। উত্তর সহজ হবে কেমন করে?”

    — “সবকিছু কঠিন লাগছে অমিত। মিথ্যে কেমন করে হবে? সামি মিথ্যে কেমন করে হবে? আন্টি খুব জোর গলায় বলছিল সামি আমার ভ্রম। আমি অসুস্থ। আমি কি সত্যিই অসুস্থ? সামি কেন আসছে না অমিত?”

    — “সামির ঠিকানা আমার জানা নেই। জানলে ঠিক ওকে ধরে নিয়ে আসতাম তোমার সামনে।

    — “আজ ষোলোটা বছর ও আমার ছায়া হয়ে আছে। আমার হাসি কান্না, দ্বিধা, ভালোমন্দ সবকিছুতে এই মানুষটাকে আমি আমার পাশে পেয়েছি অমিত। ওর অ্যাক্সিডেন্টের পর আমিও শেষ হয়ে গেছিলাম। আমি তো দেখেছি ওকে। আমারই সামনে কেমন ছটফট করতে করতে ছেলেটা চলে গেল। ওর মায়া মুখটা রক্তে লাল হয়ে ছিল। আমার সবচেয়ে প্রিয় মুখের অমন কুৎসিত রূপ আমি দেখতে চাইনি কোনোদিন, তবুও আমাকে দেখতে হয়েছে। ওর সেই মুখটাই যেন আমার চোখের সামনে বিঁধে রইলো রাত দিন ২৪ ঘন্টা। হাজার চেষ্টায়ও ওর মায়ামুখটা আমি স্মরণ করতে পারিনি। সামি আমাকে ছেড়ে চলে গেছে! আমাকে! সম্ভব এটা? এত ভালোবেসেছে যে, আগলে আগলে রেখেছে যে তাকে ছাড়া আমি বেঁচে থাকি কী করে? যার সঙ্গে কথা বলে আমার সকাল হয়েছে, যার সঙ্গে কথা না বলে আমি কখনো ঘুমাইনি তার সঙ্গে কথা না বলে কাটাতে হয়েছে আমাকে পুরো দশ মাস! ওর মতন আর কাউকে তো এত ভালোবাসিনি আমি। আমার এত ভালোবাসার মানুষটা কিনা মরে গেল! এই যন্ত্রণার কোনো ব্যাখ্যা হয়? মুখ ফুটে কাউকে বলা যায়? বুঝানো যায়? আমাদের পথচলা শেষ। আমাদের সম্পর্কটা পূর্ণতা পায়নি। এত এত ভালো স্মৃতি আমাদের! একটা খারাপ স্মৃতিও আমাদের নেই। সব ভালোর শেষটা কিনা এত কুৎসিতভাবে শেষ হলো? আমার সামির রক্তে ভেজা মুখ! আমার সবকিছু তো সেদিনই ওর সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে গেল। ও মরে গেল আর আমাকে করে গেল প্রাণহীন। আমার এত এত গল্প আমি বলবো কাকে? আমার খুশির দিনে কিংবা মন খারাপের দিনে আমি জড়িয়ে ধরবো কাকে? ঝগড়া করবো কার সঙ্গে? অভিমানে গাল ফুলাবো কার সঙ্গে? আমার মানুষটা যে আর নেই! নিজের নিঃশ্বাস নিজের কাছেই ভীষণ বোঝা মনে হতে থাকলো। এই এক নিঃশ্বাসের দায়েই তো বেঁচে আছি এই পৃথিবীতে, সামিকে ছাড়া, এক সমুদ্র ভালোবাসা ছাড়া। কাউকে আমি আমার কষ্টগুলো বলতে পারিনি তখন। আমার কষ্ট শোনার মানুষ যে ঐ একজনই ছিল- আমার কাছের মানুষ, আমার সামি। আচ্ছা অমিত, তুমি কি আমার কষ্ট বুঝতে পারছো?” ,

    — “কেন পারবো না নবনী? তোমাকে আমি আমার নিজের অংশ ভাবি। ভিন্ন কেউ তো তুমি না!”

    — “এই কথাগুলো আমি সামিকেও কখনো বলিনি। বলছি শুধু তোমাকে।”

    — “কেন বলোনি ওকে? যার অভাবে তুমি মরছিলে তাকে একটাবার জানানো দরকার ছিল না, বলো?”

    — “পুরো দশমাস পর ও আমার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল সেদিন, ঘুটঘুটে অন্ধকারের মাঝে আলো হয়ে। কাঁদছিলাম আমি। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে মিষ্টি করে ডাকলো আমাকে, রোদ্দুর তুমি কাঁদছো? ও এসেছিল অমিত। আমার জন্য এসেছিল। যা কোনোদিন সম্ভব ছিল না তাই ই সম্ভব হয়েছিল সেদিন। এত খুশি আমি কোথায় রাখতাম বলো? আমার মানুষটা আমার কাছে ফিরে এসেছে। আমার বিশ্বাস মিথ্যে হয়নি। ওকে ফিরে আসতেই হতো।”

    — “তোমার কষ্টের গল্প ওকে বলোনি কেন নবনী?”

    — “ও শুনতে চাইতো না। বলতো, এসেছি তো আমি। বাজে স্মৃতি আর মনে করো না তো। যেই মানুষটা এত এত বছর আমার ছায়া হয়ে আছে সে কেন আজ এল না অমিত? আমার যে ওকে ভীষণ প্রয়োজন! তুমি জানো, ওর সঙ্গে সম্পর্ক হবার পর…”

    মোবাইল আড়াল করে রুমানাকে নবনীর বর্তমান অবস্থা জানিয়ে টেক্সট করলো অমিত। সঙ্গে সঙ্গেই ওপাশ থেকে রিপ্লাই এল, ‘গুড সাইন। ওকে বলতে দাও। যে কথাগুলো এতবছর চেপে রেখেছিল সেগুলো শেয়ার করছে, তার মানে ও তোমাকে এমন একজন ভাবে, যার কাছে নিজেকে জমা রাখতে পারছে নির্দ্বিধায়। নবনী আজ শুধু তোমাকে ওর গল্প শোনাচ্ছে না, নবনীর নিজের সবচেয়ে গোপন অংশ জমা রাখছে তোমার রাখছে যার অর্থ নবনী নিজেকেই তুলে দিচ্ছে তোমার হাতে। তুমি বুঝতো পারছো ব্যাপারটা? শি ফাইন্ডস হার পিস ইন ইউ। ও চাইছে তুমি ওকে সামলে নাও। হৃদয় নিঙড়ানো উষ্ণতা আজ ওকে দেবার সময় হয়েছে অমিত। বি হার হোম, বি হার পিস।’

    .

    নবনীকে আরো একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো অমিত। হাত বাড়িয়ে ড্রেসিংটেবিলের উপর থেকে টিস্যুবক্স নিয়ে নবনীর চোখ-নাক মুছে দিচ্ছে সে।

    — “ও তো আমার ভ্রম না, তাই না অমিত?”

    — “তোমার কী মনে হয়?”

    — “বুঝতে পারছি না। ও আসছে না কেন? আমার এখন একটু আধটু মনে পড়ছে। ও বেশ কিছুদিন যাবৎ আসছে না। ও আসেনি কেন? আমারই বা চোখে পড়েনি কেন ব্যাপারটা? এতগুলো বছরে এমনটা তো হয়নি!”

    — “যদি জানতে পারো ও সত্যিই ভ্রম, তখন?”

    অমিতের কাঁধ থেকে মাথা তুললো নবনী। অসহায় চোখে অসীম দ্বিধা নিয়ে তাকিয়ে রইলো অমিতের চোখে। নবনীর মাথাটা চেপে আবার নিজের কাঁধে রাখলো অমিত। নবনীর ঐ চোখে চোখ রাখার সাধ্য তার নেই। চোখ ভিজে আসছে তার বারবার। মনে মনে উপরওয়ালার সঙ্গে চলছে তার নীরব কথোপকথন। নবনী বেঁচে ছিল, এতকিছু সয়ে গিয়েও ও বেঁচে ছিল। আমি পারবো না। নবনী আর আমার সেপারেশন আমি ভাবতেও পারি না। যদি কখনো আলাদা হতেই হয় সেটা যেন শুধু আমার মৃত্যুতেই হয়। আমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত ওকে আমি চাই।

    ৫৩

    জানালায় পাখির কিচিরমিচিরে ঘুম ভাঙলো নবনীর। ঘরে বাতি নেভানো। সূর্য সবে জাগতে লেগেছে। স্নিগ্ধ আলো বিলিয়ে দিচ্ছে প্রকৃতির মাঝে। তারই একটুখানি রেশ এসে পৌঁছে গেছে এই ঘরে, জানালা গলে। আবছা আলোয় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে নবনী অমিতের মুখটা। বেঘোরে ঘুমোচ্ছে ছেলেটা। তারই দু বাহুতে বন্দী হয়ে, বুকে মুখ গুঁজে ঘুমিয়ে ছিল সে! আঁতকে উঠলো নবনী। দ্রুত সরে এল অমিতের কাছ থেকে। কাছাকাছি আসতে আসতে এতখানি বাড়াবাড়ি! শেষমেশ কিনা একই বিছানায় ওর বুকে মুখ গুজে…! এতবড় ভুলটা হলো কেমন করে? চোখটাই বা বুজে এল কখন? চূড়ান্ত অপরাধবোধে ভুগতে ভুগতে হঠাৎ যেন সমস্ত হিসেব মিলতে লাগলো। আজকাল অমিতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা কি একটু বেশিই হয়ে যাচ্ছে না? বন্ধুত্বের গন্ডি পেরিয়ে তাদের সম্পর্কটা কি আরেকটু গভীরতা দাবি করছে না? দু’জনের প্রতি দুজনের অধিকারবোধ বাড়ছে। যত্ন বাড়ছে। গভীর রাত পর্যন্ত একে অন্যের সঙ্গে গল্প করে সময় কেটে যাচ্ছে। ভাবনায় অমিতের অবাধ বিচরণ চলছে। এসব কি শুধুই বন্ধুত্ব? না তো! অজান্তেই সীমা ছাড়িয়ে গেছে বোধহয়। যে সম্পর্কে নিজেদের কখনো ওরা বাঁধতে চায়নি সেই সম্পর্কেই বোধহয় বাঁধা পড়ে যাচ্ছে। সামি না আসার কারণ কি তবে এই? হ্যাঁ এটাই তো! অমিতকে নিয়ে এতবেশি ব্যস্ত থাকছে যে সামির অনুপস্থিতি কিনা চোখেই পড়লো না তার! এত বড় অন্যায় কী করে সম্ভব! তক্ষুনি মন ছুটে গেল নবনীর। এই ঘর থেকে, অমিতের কাছ থেকে।

    .

    নিঃশব্দে পা ফেলে অমিতের বাসা ছেড়ে বেরিয়ে এল নবনী। পিচঢালা পথে খালি পায়ে হাঁটছে ও। রাস্তায় তখনো মানুষের চলাচল শুরু হয়নি। মুক্ত শীতল বাতাস গা ছুঁয়ে যাচ্ছে। মাথার উপর মিষ্টি রোদ ছড়িয়ে পড়ছে। এসব কিছুই নবনীকে স্পর্শ করতে পারছে না। সে শুধু হেঁটে চলছে উদ্ভ্রান্তের মতন। মাথার ভেতর কিলবিল করছে তীব্র অপরাধবোধের লার্ভা। অমিতকে এত কেন ভাবছে সে? কেন এত এত কথা বলতে ইচ্ছে হয় ওর সঙ্গে? কেন একবেলা কথা না হলেই মনে হয় যেন কতদিন কথা হয়নি? কেন এত মায়া হয় এই ছেলেটার জন্য? কেন গতকাল আশ্রয় খুঁজতে গিয়েছিল তার কাছে? আশ্রয় তো সামির কাছেই খুঁজে বেরিয়েছে এতগুলো বছর। তবে কেন গতকাল আশ্রয়ের জায়গাটুকু বদলে গেল?

    সকালের চা বানাচ্ছেন নীতু। এত সকালে কলিংবেলের শব্দ পেয়ে একটুখানি চমকে উঠলেন তিনি। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে দরজা খুলতেই যেন মনে হলো তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে।

    ফোনকলে ঘুম ভাঙলো নাতাশার। পিটপিট চোখে স্ক্রিনে দেখতে পেলো মায়ের কল। রিসিভ করে হ্যালো বলার আগেই ওপাশ থেকে মা বলতে লাগলো,

    -– “কোথায় তোরা? নবনী এই সকালে একা বেরোলো কী করে বাসা থেকে?”

    মুহূর্তেই চোখ থেকে ঘুম উড়ে গেলো নাতাশার। শোয়া থেকে লাফিয়ে উঠলো সে।

    — “আপু বেরিয়ে গেছে মানে? কখন? কোথায় গেছে?”

    — যায়নি কোথাও। বাসায় এসেছে একটু আগে। কিন্তু ও একা বেরিয়ে এল, খেয়াল রাখবি না একটু! অমিত কোথায়?”

    — “তুমি রাখো। দেখছি আমি।”

    নাতাশার শব্দ পেয়ে ততক্ষণে ঘুম ভেঙে গেছে অনিরও। কল কাটার আগেই অনি চলে গেছে নবনীর ঘরে। পেছন পেছন গেছে নাতাশাও।

    — “ভাইয়া, এ্যাই ভাইয়া?”

    অনির ডাকে ঘুম ভাঙলো অমিতের। চোখ মেলেই খুঁজতে লাগলো নবনীকে।

    অমিত কিছু জিজ্ঞেস করবার আগেই অনি বললো,

    — “আপু বেরিয়ে গেছে বাসা থেকে।”

    — “মানে কী?”

    — “হ্যাঁ। একাই চলে গেছে ও। আম্মু কল করে জানালো আমাকে।”

    — “কখন?”

    — “কিছুক্ষণ আগে।”

    — “ও বেরিয়েছে কখন?”

    — “জানি না! আম্মু বললো একটু আগেই নাকি গেছে।”

    — “তুমি ঘুমিয়েছো কখন?”

    — “শেষরাতে। চারটায় খুব সম্ভবত। নবনী কাঁদতে কাঁদতে সাড়ে তিনটায় ঘুমিয়ে পড়লো। তারপর আমারও ঘুম লাগছিল, তাই চোখ বন্ধ করেছিলাম।

    — “কী বিপদ হতো জানো, যদি ও অন্য কোথাও চলে যেত? কোথায় খুঁজতাম

    ওকে? পাশেই তো শুয়ে ছিলে। ও ঘর থেকে বেরিয়ে গেল অথচ তুমি টেরই পেলে না ভাইয়া!”

    — “অদ্ভুত কথা বলছো অনি! ভাইয়া ঘুমিয়ে ছিল। টের পাবে কেমন করে?” মাথা কাজ করছে না অমিতের। অনি কিংবা নাতাশা কারো কথার বিপরীতে আর কিছু না বলে সে চলে গেল ফ্রেশ হতে। নবনীর কাছে যেতে হবে তাকে। হয় নবনীকে নিয়ে আসবে নয়তো সে থেকে যাবে নবনীর কাছে ওখানেই। এক মুহূর্তও চোখের আড়াল হতে দিবে না তাকে।

    .

    অমিত এসেছে, নবনী দেখেও না দেখার ভান করে মুখ গুঁজে রইলো নানীর কোলে। ফুঁপিয়ে কাঁদছে ও। অমিতকে জামিলা বেগম শুকনো হেসে জিজ্ঞেস করলেন,

    — “ভালো আছো ভাই?”

    — “জি।”

    চোখের ইশারায় নবনীর পাশে এসে অমিতকে বসতে বললেন তিনি। নিজের কোল থেকে খুব ধীরে নবনীর মাথাটা নামিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিতে দিতে বললেন,

    — “আমার নাস্তার সময় হইয়া আসতাছে, গ্যাসের ওষুধটা খাইতে হইবো। তোমরা কথা কও।”

    ওষুধের বাহানায় ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন জামিলা। যাবার আগে দরজা চাপিয়ে, পর্দাগুলো ভালোভাবে টেনে রেখে গেলেন। নবনীর পাশে এসে বসলো অমিত। ওর মাথায় হাত রাখতেই দূরে সরে গেল নবনী। অমিত চেয়ে রইলো নবনীর দিকে। চোখে মুখে ওর এত সংকোচ কেন? ফিরিয়ে দেয়া সত্ত্বেও নবনীর আরো কাছে এল অমিত। মাথার উপর আরো গাঢ় স্পর্শে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

    — “ওভাবে না বলে চলে এলে কেন নবনী?”

    বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো নবনী। অমিতের চোখের দিকে তাকাতে পারছে না ও। অস্বস্তি হচ্ছে ভীষণ। মাথা নিচু করে বললো,

    — “আমাদের সম্পর্কটা কী, অমিত?”

    — “হঠাৎ এমন প্রশ্ন!”

    — “বলো না?”

    — “আমরা খুব ভালো বন্ধু।”

    — “তোমার কাছে কি মনে হচ্ছে না আমরা আমাদের সম্পর্কে অনেক বেশি এগিয়ে গেছি? লিমিট ক্রস করছি?”

    — “লিমিট ক্রস! কেমন?”

    — “আমি এত কথায় যেতে চাচ্ছি না অমিত। যতটুকু ভুল হয়েছে অজান্তেই হয়ে গেছে। কথা ছিল ছয়মাস সংসারের। ছয়মাস হতে আর এক দেড় সপ্তাহ বাকি। এবার আমাদের একটা সিদ্ধান্তে আসা উচিত।”

    নবনীর ইঙ্গিতে বুঝি হৃদস্পন্দন এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল অমিতের। মনের মধ্যে তার ভীষণ ঝড় উঠলো।

    — “কিসের সিদ্ধান্ত?”

    — “ডিভোর্স।”

    ডিভোর্স! নবনী ডিভোর্সের বায়না তবে করেই বসলো। গলা শুকিয়ে এল অমিতের। ঠিক এই ভাবনাই তো বারবার আসছিল মনে। মন তবে ভুল কিছু জানান দেয়নি। নিজেকে ধরে রাখা বড্ড কঠিন হয়ে যাচ্ছে। মাথা ঠান্ডা রেখে আর কথা বলার মত ধৈর্য্য হচ্ছে না। অবস্থা, পরিস্থিতি কিচ্ছু আর দেখতে ইচ্ছে করছে না, মানতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কাতর হয়ে অমিত নবনীকে বললো,

    — “ডিভোর্স কেন নবনী?”

    — “এটাই তো কথা ছিল!”

    — “সেটা তো অনেক আগের কথা। তখন পরিস্থিতি ভিন্ন ছিল। এখন সেই পরিস্থিতি কিংবা দূরত্ব কি আমাদের মাঝে আছে?”

    — “পরিস্থিতি শুধু তোমার বদলেছে, আমার না। তখন এই বিয়েটা আমরা কেউ মানতে চাইনি কারণ আমাদের দু’জনের ভালোবাসার মানুষ ছিল। এই কয়মাসে তোমার ব্রেকআপ হয়েছে, আমার হয়নি। আমার ভালোবাসা আগের মতই আছে। সো, ডিসিশন আমার আগেরটাই আছে।”

    কিছু বলছে না অমিত। অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলো নবনীর শুকনো কঠিন মুখটায়। কী অবলীলায় বলে দিচ্ছে সে চলে যেতে চায়! তবে কি এতদিনের সবকিছু মিথ্যা? সে কি নবনীর হৃদয় ছুঁয়ে দিতে পারেনি? একবারের জন্যও না? অমিতের তরফ থেকে কিছু শুনতে না পেয়ে একবার তার দিকে তাকালে নবনী। চোখ সরিয়ে নিলো সঙ্গে সঙ্গেই। অমিতের বিষণ্ন চোখ জোড়া দেখে বুকের ভেতর কেমন হাহাকার করে উঠলো! বেশিক্ষণ ঐ চোখে তাকাবার সাধ্য হয়নি নবনীর। অমিতের মন খারাপ সহ্য হয় না কখনো। অথচ আজ অমিতের মন খারাপের কারণ সে নিজেই! গলা ধরে আসছে নবনীর। নিজের সঙ্গে প্রায় যুদ্ধ করে কন্ঠস্বর যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে নবনী।

    — “যা হয়ে গেছে তা বদলাতে পারবো না। কিন্তু আসছে দিনগুলো বদলাতে পারবো। আমি অপরাধবোধে শেষ হয়ে যাচ্ছি। সামির সামনে দাঁড়াবার মতো মুখ আমার নেই। যত দ্রুত সম্ভব আমাদের ব্যাপারটা এখানেই ক্লোজ করা উচিত।”

    — “কিসের অপরাধবোধ নবনী? এমন কী হয়ে গেছে আমাদের মাঝে যেটা তুমি বদলে ফেলতে চাইছো?”

    — “জানি না আমি। আই ওয়ান্ট ডিভোর্স, দ্যাটস ইট।”

    — “জানি না বললেই হলো? ডিভোর্স চাইছো তুমি আমার কাছে! জবাব তো দিতেই হবে।”

    — “চাইবো না? ডিভোর্স আরো আগেই হবার কথা ছিল। জাস্ট ফ্যামিলির কথা ভেবে আমি তোমার ওখানে যেতে রাজি হয়েছি। এখন কেন তুমি ডিভোর্স নিয়ে প্রশ্ন তুলছো?”

    — “তোমার সঙ্গে আর লুকোচুরি খেলতে পারছি না নবনী। স্যরি। জানতে চাইলে না তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা কী? তুমি আমার বউ। বিয়ে করেছি তোমাকে ৫০ জন মানুষের সামনে। ভালোবাসি তোমাকে। তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক এটাই। ভালোবেসেছি যেহেতু ছেড়ে দেবার জন্য নিশ্চয়ই বাসিনি।”

    নিষ্পলক অমিতের দিকে চেয়ে রইলো নবনী। সম্পর্কের গভীরতা তবে অজান্তে হয়নি? অমিতের কাছে প্রথম থেকেই এই গভীরতা স্পষ্ট ছিল! জেনে-বুঝেই সে এগিয়ে গেছে এই সম্পর্কে! বড্ড হতাশ লাগছে নবনীর। অমিতের চোখে চোখ রেখে সে বললো,

    — “কেন অমিত? কোনোকিছু কি অজানা ছিল তোমার? তবুও কেন জেনেশুনে…”

    — “কী জানবো? কার কথা বলছো তুমি? সামি? ও তোমার প্রাক্তন। মরে গেছে ও বহুবছর আগে। ও কোথাও নেই। যদি থাকতো কোনোদিনও আমি আসতাম না তোমাদের মাঝে। ভালোবাসতাম না তোমাকে।”

    — “অমিত!”

    — “চিৎকার করে কী প্রমাণ করতে চাও? তুমি যাকে দেখতে পাও সে সত্যি? কিভাবে সত্যি হয় বলো আমাকে? মানছি ভালোবাসো খুব। তাই বলে পৃথিবীর নিয়মটাই বদলে যাবে? হয় কখনো এমন? হয়েছে আগে কখনো?”

    — “তুমি না বলেছিলে আমি তোমার অংশ। আমাকে তুমি অনুভব করতে পারো? তাহলে এখন কেন পারছো না? সামি আছে এটা মেনে নিতে কেন চাইছো না?”

    — “সামি নেই। তুমি নিজেও সন্দেহে ভুগছো। ভুগছো না? বলো? নয়তো গতকাল আমাকে কেন বারবার বলছিলে সামি সত্যি নাকি তোমার ভ্রম?”

    — “তুমি যাও এখান থেকে।”

    — “কেন যাব?”

    — “তোমার সঙ্গে মিসবিহেভ হয়ে যাবে। যাও তুমি এখন।”

    — “করো মিসবিহেভ। সেই অধিকারও তোমার আছে। নেই শুধু আমাকে ছেড়ে যাবার।”

    — “আমি কাকে ছাড়বো কাকে ছাড়বো না সেটা তুমি ডিসাইড করবে?”

    — “তাহলে তুমি কেন মুনিয়াকে ছেড়ে দেবার জন্য বারবার করে বলছিলে? আমি আবারও না মুনিয়ার সঙ্গে রিলেশনে জড়িয়ে পড়ি সেটা নিয়ে তুমি কেন ভয় পেতে? আমার সঙ্গে অভিমান করতে?”

    — “মুনিয়া আর সামির মাঝে আকাশ পাতাল পার্থক্য! মুনিয়া তোমাকে ভালোবাসতো না। সামি আমাকে ভালোবাসে।”

    — “ভালোবাসতো! এখন আর ভালোবাসার জন্য সামি এখানে নেই। এখন তোমাকে ভালোবাসার জন্য আমি আছি। একবার এই সম্পর্কটা মেনেই দেখো! আমাকে কাছে আসার সুযোগ দাও! দেখোই না কত ভালোবাসি তোমাকে! তোমার হাজবেন্ড আমি। আমাদের সম্পর্কটা এতটাও হালকাভাবে নিও না।

    — “আর একটা কথাও বলবে না তুমি। লিমিট ক্রস করছো। অসহ্য লাগছে তোমাকে। চলে যাও এক্ষুনি।”

    — “কোনোদিন কল্পনাও করতে পারিনি একটা মৃত মানুষের সঙ্গে আমার প্রতিদ্বন্দ্বীতা করতে হবে।”

    — “প্রতিদ্বন্দ্বী! এই শব্দটা এলো কোত্থেকে? ভালোবাসি আমি তোমাকে? বেসেছি কোনোদিন? আমি আগে সামিকে ভালোবাসতাম, এখনো তাই বাসি। আমাদের গল্পে শুধুমাত্র আমরা দুজনই আছি, তুমি কোথাও নেই। সামি মরে গেছে বলছো? ওকে আমার ভ্রম বলছো? বেশ, মরে গেছে ও। তবুও ওকে আমি ভালোবাসি, আজীবন বেসে যাবো। হোক সে মৃত, আমার ভালোবাসার মানুষ তো! মরে গেছে বলে ওকে ভালোবাসা ছেড়ে তো আর দিতে পারি না। খুব ভালো বন্ধু ছিলে তুমি আমার অথচ আজ তোমাকে পরগাছা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছি না, যাকে জীবন থেকে ছেটে ফেলা ছাড়া আর কিছুই করার নেই আমার। আজকের পর থেকে তুমি আমার কেউ না। আমি কখনো সামিকে ভালোবাসা ছাড়বো না। তোমার সঙ্গে আমার কোনোদিন কিছু হওয়া সম্ভব না। হ্যাঁ ভুল আমারও ছিল। সম্পর্ক গভীর হচ্ছে সেটা আমার আরো খেয়ালে রাখা উচিত ছিল। সেজন্য আমি স্যরি। তুমি আর কখনো আমার সামনে এসো না অমিত। আমি চাই না আর কখনো আমাদের দেখা হোক কিংবা কথা হোক।”

    পরগাছা শব্দটা যেন বুকের ভেতর বড্ড বিধলো অমিতের। যার সঙ্গে কথা না বলে একবেলাও কাটেনা সেই মেয়েটা আর কোনোদিন কথা বলতে চায় না? যাকে এতবেশি ভালোবেসেছে সে আর কখনো তাকে দেখতে চায় না। ভেতরটা ভেঙে সহস্র টুকরো হয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা নবনী কি বুঝতে পারছে তার ভেঙে গুঁড়িয়ে যাওয়া? মেয়েটা কি জানে এক আকাশ ভালোবাসার বিনিময়ে আজ তাকে কতটা কষ্ট সে ফিরিয়ে দিলো? এই জীবনটা শেষ করে দেবার জন্য এতটুকু কি যথেষ্ট না? চোখে পানি ছলছল করছে অমিতের। কিন্তু চোখের সীমানা পেরিয়ে এই অশ্রু নবনীর সামনে সে বেরোতে দিবে না। কোনোভাবেই না। ভালোবাসার কিংবা বাকি জীবনটা একসঙ্গে কাটিয়ে দেবার পেছনে কোনো যুক্তি, ব্যাখ্যা, অনুরোধ কিছুই করতে ইচ্ছে করছে না। যে অধিকার নবনী তাকে দিয়েছিল সেই অধিকার ছিনিয়ে নেবার অর্থ কী? যে স্বস্তি হয়ে নবনী তার মনের সবটা জুড়ে দখল করে রেখেছিল, সেই মনটা শূন্য করে চলে যাবার মানে কী? মেয়েটার উপর বড্ড অভিমান হলো আজ। এই অভিমান নবনী ভাঙতে পারবে না। কোনোদিনও না। এক আকাশ ভালোবাসার বিনিময়েও না। নিঃশ্বাস ধরে আসা কষ্ট গলায় আটকে রেখে অমিত তার শেষ প্রশ্ন করলো,

    — “তোমার জীবনে আমি এত তুচ্ছ নবনী? কোনো মায়া নেই আমার জন্য? এতগুলো দিনে এক মুহূর্তের জন্যও কি আমি তোমার মনকে স্পর্শ করতে পারিনি?”

    জবাবের জন্য আর অপেক্ষা করলো না অমিত। বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। চলে যাবার সময় তার কান্নার সাক্ষী হয়ে রইলো নীতু, শফিক সাহেব আর জামিলা বেগম। এক মুহূর্ত দেরী না করে অমিতের পেছন পেছন গেলেন শফিক সাহেব। মায়ের দিকে তাকিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন নীতু।

    — “এই সংসারে কি আর কোনোদিন সুখ আসবে না আম্মা? নবনীকে কী করবো আমি? অসুস্থতার দোহাই দিয়ে আর কত ওর জেদ আর পাগলামির কাছে হেরে যাবো?”

    জবাবে কিছুই বললেন না জামিলা বেগম। মেয়েকে আর ধৈর্য্য ধরতে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। অমিতের চোখের পানি যেন আজ তারও ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে দিচ্ছে।

    ৫৪

    ঢাকা এসে পৌঁছুতে পৌঁছুতে শামীমা আর এরশাদের সন্ধ্যে হলো। কলিংবেল চাপতেই এসে দরজা খুলে দিলো নাতাশা। হাতের পার্সটা সোফায় ছুঁড়ে দ্রুত পায়ে ছেলের ঘরে গেলেন শামীমা, পেছন পেছন গেলেন এরশাদও। আলো নিভিয়ে, জানালার পর্দা আটকে নিজের ঘরটাকে একদম ঘুটঘুটে অন্ধকার করে রেখেছে অমিত। সিগারেটের তীব্র গন্ধ ছড়িয়ে আছে এই ঘরে। শামীমা ঘরে পা রাখতেই তার মাথা ধরে গেল সঙ্গে সঙ্গে। বাতি জ্বালিয়ে অমিতকে ডাকলেন তিনি,

    — “বাবু…”

    মাথার উপর বালিশ চেপে শুয়ে ছিল অমিত। মায়ের ডাক শুনেও মাথা তুললো না। শুয়েই রইলো মুখ ঢেকে। জানালার পর্দাগুলো সরিয়ে, বারান্দার দরজা খুলে দিয়ে খাটে উঠে বসলেন এরশাদ সাহেব। ছেলের মাথার উপর থেকে বালিশটা একটুখানি জোর করেই সরালেন শামীমা।

    — “আমাদের দিকে তাকা একবার!” ডানে বামে মাথা নেড়ে অমিত বললো,

    — “কেন এসেছো? চলে যাও তোমরা।”

    ছেলের পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন এরশাদ সাহেব।

    — “কেন যাব? আমাদের ছেলের বাসায় এসেছি আমরা থাকবো বলে। আমরা এখানেই থাকবো।”

    — “তাকা না অমিত!”

    রেগে গেল অমিত। একলাফে শোয়া থেকে উঠে চিৎকার করতে লাগলো সে।

    — “আমি তোমাদের ছেলে না।”

    — “তাহলে কে তুই?”

    — “আমি কারো কিছুই না। কারো সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।”

    — “এত রেগে যাচ্ছিস কেন বাবু? এমন করলে অসুস্থ হয়ে যাবি না?”

    — “আমি মরবো না আম্মু। আমার কৈ মাছের প্রাণ। শত কষ্টেও আমি মরবো না, হাজার অসুস্থ হয়েও মাথা টানটান করে বেঁচে থাকবো। উপরওয়ালা আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে নবনী আর সামির ভালোবাসা কেয়ামত পর্যন্ত নিজের এই দুইচোখে দেখার জন্য।”

    — “গতকাল না বলছিলি তোর গলাব্যথা? গলাটা কেমন বসেও আছে তোর। এভাবে চিৎকার করলে তোর গলাব্যথাটা কিন্তু আরো বাড়বে।”

    — “আমার গলাব্যথা নিয়ে ভাবছো তুমি আম্মু! নবনী আমাকে ছুঁড়ে ফেললো তা তুমি দেখলে না? ও আমাকে কেমন ভেঙে গুঁড়িয়ে দিলো তা দেখতে পাচ্ছো না?”

    — “আপাতত ও চলে গেছে তাই বলে ও আর ফিরবে না এমন কোনো কথা তো নেই। ব্যাপারটা একটু সহজভাবে ভাবতে চেষ্টা কর।”

    — “জটিল ব্যাপারটাকে আমি কেন সহজভাবে ভাববো আব্বু? আমি বারবার বলছিলাম আম্মুকে নবনী চলে যাবে। আম্মু আমার কথা পাত্তাই দিলো না! হেসে উড়িয়ে দিলো। এখন? গেল তো সত্যি সত্যি? এটাও শুনে রাখো, নবনী ফিরে আসবে বলে যায়নি, ও একেবারে চলে গেছে। কেন আসবে এখানে ও? কে আছে ওর এই বাসায়? কিসের টানে, কার মায়ায় ফিরবে? এখানে ওর কেউ নেই, কিচ্ছু নেই।”

    — “হাল ছাড়লে চলবে অমিত? পুরো পরিস্থিতি একটু বুঝবি না তুই? নবনীর অবস্থাটা বিবেচনা করবি না?”

    — “পারছি না আব্বু। এতগুলো দিনে নবনীর মাঝে ন্যূনতম জায়গা আমি করে নিতে পারিনি। আমি ওর কেউ না। ওর আর সামির মাঝে আমি পরগাছা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। কোনোদিন আমি ওর ভালোবাসা পাবো না। ওর সব ভালোবাসা তোলা আছে সামির জন্য, বলেছে ও আমাকে। এই কথার পরও কি আরো কিছু বলার বাকি থাকে? বিবেচনা করার বাকি থাকে?”

    অমিতের চোখ গড়িয়ে কয়েক ফোঁটা পানি ঝরে পড়লো। ঠোঁট চেপে জোর করে কান্না আটকে রাখলেন শামীমা। ছেলের সামনে কাঁদলে ও আরো ভেঙে পড়বে না! অমিতকে জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিলেন এরশাদ সাহেব। বাবার হাত সরিয়ে বিছানা থেকে নেমে গেল অমিত। খাটের পাশ থেকে ওয়ালেট, সিগারেট আর লাইটার নিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে কাঁপাস্বরে বললো,

    — “নবনী ফিরে আসবে, ও আমাকে নিয়ে ভাবে এইসব প্রসঙ্গে কেউ কথা না বললে আমি খুশি হবো। ওদের বাসায় ফোন করে ডিভোর্সের দিনক্ষণ জেনে নিও। সাইন করে ওকে মুক্তি দিয়ে দিবো। ওর জীবনে আমি আর পরগাছা হয়ে থাকতে চাই না।”

    দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল অনি আর নাতাশা। বেরিয়ে যাবার সময় এক মুহূর্ত দরজায় দাঁড়িয়ে অমিত ওকে বললো,

    — “নবনী চলে গেছে। তুমি এখানে কী করছো? ডিনার করে বাসায় ফিরে যেও। যেখানে নবনী নিজেই সম্পর্ক রাখতে চায় না শুধু শুধু তোমরা আর জোর করে আত্মীয়তা ধরে রেখে কী করবে?”

    — “আপনি আমার ভাই না? শুধু কি নবনী আপুর হাজবেন্ড? এর বাইরেও তো সম্পর্ক আছে আপনার আর আমার। আমি কি ভাইয়ের বাসায় থাকতে পারি না?” নাতাশার কথার প্রত্যুত্তরে কিছু বললো না অমিত। ঠোঁটের ভাঁজে সিগারেট জ্বালাতে জ্বালাতে বেরিয়ে গেল বাসা থেকে।

    ছেলে বেরিয়ে যেতেই মুখে হাত চেপে কাঁদতে লাগলেন শামীমা। অনি আর নাতাশা দু’পাশ থেকে জড়িয়ে ধরলো তাকে। এরশাদ সাহেব নাতাশার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

    — “এই সময়টাতে অনির পাশে ছিলে সেজন্য ধন্যবাদ মামনি। অমিতের এমন পাগলামি অনি একা একা সামলাতে প্রায় অধৈর্য্য হয়ে গেছে। ভয়ও পায় খুব! কখন কী করে বসে! তুমি আমার ছেলের কথায় কিছু মনে করো না কিন্তু।”

    — “কী বলছেন চাচ্চু! আপু আজ যা করলো তাতে ভাইয়ার এভাবে রিএ্যাক্ট করা খুব স্বাভাবিক। বেচারা খুব কষ্ট পাচ্ছে।”

    — “নাতাশা আমার পার্সটা নিয়ে আসবে আম্মু? তোমাদের বাসায় একটু কথা বলবো।”

    .

    মায়ের ঘরে বসে আছেন নীতু আর শফিক। একমনে তাসবিহ্ জপছেন জামিলা বেগম। মনটা বড্ড অস্থির হয়ে আছে, শরীরটা অসুস্থও লাগছে বেশ। তবুও কাউকে বলছেন না তিনি। এমন বাজে সময়ে নিজের অসুস্থতা নিয়ে কথা বলা নিরর্থক তার কাছে। খারাপ সময়ে বরাবরই শাশুড়ির সঙ্গে আলাপ আলোচনা ঝামেলা মিটিয়ে ফেলেন শফিক সাহেব। ঠান্ডা মেজাজের এই মানুষটার কাছে যেকোনো সমস্যার সমাধান পাওয়া যায়। কিন্তু আজ আর শাশুড়ির কাছে কোনো সমাধান পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি নিজেই কেমন মনমরা হয়ে বসে আছেন। যতবারই নবনী অমিত প্রসঙ্গে তাকে কিছু জিজ্ঞেস করা হচ্ছে প্রতিবারই উদাস হয়ে জবাব দিচ্ছেন, আমি কিচ্ছু বুঝতাছি না।

    জামিলা বেগমের এমন জবাবে নীতু আর শফিকের সাহস দ্বিগুন ভাঙছে। কিভাবে কী করবেন ভেবে না পেয়ে এক পর্যায়ে রাগ ঝারতে লাগলেন একমাত্র শালা শিপনের উপর। প্রচন্ড বিরক্ত নিয়ে নীতুকে অভিযোগ করলেন,

    — “তোমার ভাইটা বউ নিয়ে বেড়াতে গেছে ভালো কথা, ফোনের সুইচ কেন অফ রাখবে? এই মুহূর্তে পাশে একটা মানুষ পেলেও তো সাহস পাই আমি, তাই না?”

    নীতু কিছু বলার আগেই কল এল তার মোবাইলে। শামীমা কল করেছেন।

    তড়িঘড়ি করে কল রিসিভ করলেন তিনি,

    — “পৌঁছেছো শামীমা?”

    — “হ্যাঁ, আধঘন্টা হলো।”

    — “অমিত ঠিক আছে?”

    অমিতের নাম শুনতেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো শামীমা।

    — “ও ঠিক নেই ভাবী। এক্কেবারে ঠিক নেই। ওকে ঠিক রাখার মানুষটাই যে চলে গেছে।”

    মেয়ের এমন কান্ডে নিজেকেই বড্ড অপরাধী লাগছে নীতুর। সকালে নবনীর বলা প্রতিটা কথা বাইরে বসে শুনেছে তারা। এতটা তিরস্কারের উপযুক্ত কি অমিত ছিল? তবুও কেন করলো ও এমন? অমিত নিশ্চয়ই মাকে বলেছে সব? লজ্জায় আর মুখ ফুটে শব্দ বেরুচ্ছে না নীতুর। কিছু সময় নীরব থাকার পর শামীমা আবার বলতে লাগলো,

    — “নবনী কোথায় ভাবী? ও ঠিক আছে?”

    — “দরজা আটকে বসে আছে নিজের ঘরে। আজ সারাদিনে ঘর থেকে বেরোয়নি খাওয়া দাওয়া বন্ধ।”

    — “ও খেতে চাইলো না আর আপনারাও ওকে জোর করে কিছু খাওয়ালেন না?”

    — “আমাদের আর ধৈর্য্য হচ্ছে না শামীমা। বয়স হয়েছে আমাদের, জোয়ান মেয়ের অসুখের বোঝা আর কতদিন টানবো?”

    বলতে বলতে গলা কেঁপে উঠলো নীতুর। অভিমানী স্বরে ওপাশ থেকে শামীমা বললো,

    — “এসব কিন্তু ঠিক হচ্ছে না। সবাই এভাবে হাল কেন ছেড়ে দিচ্ছে? যার বউ সে আর এই প্রসঙ্গে কথা বলতে চায় না। যার মেয়ে তারাও আর মেয়েকে সামলাতে চাইছে না। এভাবে চলবে? গতকালই কি একটা কান্ড ঘটে গেল নবনীর সঙ্গে! ওকে এই মুহূর্তে এক্সট্রা কেয়ার করা উচিত না? ওর অবস্থা আবারো খারাপ হতে কতক্ষণ? আমাদের কোলে উপরওয়ালা সন্তান দিয়েছেন, মরণের আগ পর্যন্ত সন্তানকে ওভাবে কোলে করেই রাখতে হবে। ভুল করলে পথ দেখাতে হবে। বড় হয়েছে বলে কি ওদের পাগলামি, জেদ, ভুলগুলো মেনে নিবো না। এভাবে দূরে সরিয়ে দিবো? আমরা ওদের আগলে না রাখলে কে রাখবে বলুন তো ভাবী? অমিত নবনী দুজনকেই এখন আমাদের দেখে রাখতে হবে, বোঝাতে হবে নয়তো জীবনটা ওদেরই নষ্ট হবে। ওরাই কষ্ট পাবে। সাথে আমরাও। এসব জেদ ছাড়ুন ভাবী। আমাদের মাথায় এখন অনেক বড় দায়িত্ব। নবনী আর অমিতের সংসারটা বসাতে হবে।”

    — “ওকে বুঝাবার সাধ্য আমাদের নেই। চোখে অন্ধকার দেখছি। আর ভালো লাগছে না। এসবের শেষ কবে কে জানে!”

    — “হয়ে যাবে। এইতো আর কিছুদিন। সব ঠিক হবে। আপনি নবনীর ঘরে যান। ওর সঙ্গে কথা বলুন, মুখে তুলে একটু কিছু খাওয়ান ওকে।”

    জানালার বাইরে ঐ দূর আকাশটা দেখা যাচ্ছে। সেদিকেই নিষ্পলক চেয়ে আছে নবনী। বহুবছর আগে সামি বলেছিল, ও এসেছে সেখান থেকে। গত কয়েকদিনে যেহেতু আসেনি তাহলে কি ফিরে গেছে ওর পৃথিবীতে? দূর আকাশে মেঘের ওপারে? এখান থেকে প্রশ্ন পাঠালে, ঐ পৃথিবী থেকে কি জবাব দেবে ও? মনের ভেতর যে অনেক প্রশ্ন, অনেক দ্বিধা, তীব্র অস্থিরতা আর বিষণ্নতা। এক মনে এতকিছু সয়ে যাওয়া, বয়ে যাওয়া যে কষ্ট হয়ে যাচ্ছে ভীষণ। প্রশ্নগুলোর জবাব পেয়ে গেলে, বিষন্নতাটুকু ভাগ করে নিতে পারলে নিঃশ্বাস নেয়া সহজ হতো। অজান্তেই মোবাইল স্ক্রিন অন করলো নবনী। অমিতকে কি কল করেছে? কিংবা কোনো মেসেজ? পরমুহূর্তেই মোবাইল স্ক্রিন লক করে তীব্র অপরাধবোধে আবারও ভুগতে লাগলো নবনী। ডুকরে কেঁদে উঠলো ও। আকাশের দিকে চেয়ে বলতে লাগলো,

    — “আমি তোমার সঙ্গে প্রতারণা করতে চাইনি সামি। কোনোদিনও না। তবুও কেন এমন হচ্ছে বারবার? আমি অমিতকে ভুলে কেন থাকতে পারি না? কেন ওকে বারবার মনে পড়ে? কেন ওর জন্য আমার বুকভাঙা কষ্ট হচ্ছে? কেন ওর অপেক্ষা করছি সারাটাদিন জুড়ে? শুনতে পাচ্ছো তুমি? বিশ্বাস করছো আমাকে? আমি তোমার সঙ্গে প্রতারণা করতে চাইনি।”

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleবাইবেল কোরআন ও বিজ্ঞান – মরিস বুকাইলি
    Next Article বাতাসে গুনগুন – খাদিজা মিম

    Related Articles

    খাদিজা মিম

    রুদ্র – খাদিজা মিম

    August 6, 2025
    খাদিজা মিম

    বাতাসে গুনগুন – খাদিজা মিম

    August 6, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.