Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ইট’স কমপ্লিকেটেড – খাদিজা মিম

    খাদিজা মিম এক পাতা গল্প477 Mins Read0

    ইট’স কমপ্লিকেটেড – ৫৫

    ৫৫

    সকাল এগারোটা। সাব্বির বসে আছে অমিতের বাসায়। গতকাল থেকে অমিতকে কয়েকবার টেক্সট করে, মোবাইলে কল করে পাওয়া যায়নি। তাই কল করেছিল অনির নাম্বারে। তখনই জানতে পারলো নবনীর চলে যাওয়া, অমিতের হাল অবস্থা। এক মুহূর্ত দেরী না করে চলে এলো অমিতের বাসায়। এখানে এসে অমিতকে পায়নি সে। কোথায় আছে সঠিকভাবে কেউ জানে না। অফিস থেকে পরশু রাতে ছুটি নিয়েছিল পাঁচদিনের। তবুও আজ সকালে তৈরী হয়ে ক্লান্ত মুখ, বসে যাওয়া লাল চোখজোড়া নিয়ে বেরিয়ে যাবার আগে বলে গেল, অফিসে যাচ্ছি। কথার সত্যতা জানা নেই ঘরের কারো। পাল্টা কেউ জিজ্ঞেসও করেনি। বাবা বাসার নিচ পর্যন্ত ছেলেকে এগিয়ে দিয়েছে শুধু। বাসায় এসে অমিতকে না পেয়ে আরো যেন দুশ্চিন্তা বাড়তে লাগলো সাব্বিরের। সেই সঙ্গে অনির প্রতি রাগটাও! বারবার অনিকে একই প্রশ্ন সে করতে লাগলো,

    — “তুই আমাকে একটা কল করবি না!”

    অনিও কোনো বিরক্তি ছাড়া বারবার মাথা নিচু করে একই উত্তর দিয়ে চলছে,

    — “এতকিছুর মাঝে কাকে কল করর কথা মাথায় আসেনি একদম।”

    এরশাদ সাহেব বললেন,

    — “সত্যিই বাবা। অনির ব্যাপারটা মাথায় থাকলে অবশ্যই তোমাকে কল করতো।”

    — “আমার চেয়ে বেশি জরুরি ছিল রুমানাকে ইনফর্ম করা।”

    — “হ্যাঁ তা তো ছিলই। সমস্যা এতদিন ছিল নবনীকে নিয়ে, এখন মনে হচ্ছে সমস্যা আমার ছেলেরও।”

    — “অমিত বাড়াবাড়ি রকমের স্বাভাবিক আচরণ করছে। কোনো কান্নাকাটি নেই, ভাঙচুর নেই। নবনীকে নিয়ে কোনো কথা নেই। মানে অমিত যেমনটা করে সবসময় তেমন না।

    — “সমস্যাটা তো ওখানেই আন্টি। কষ্ট ওর হচ্ছে কিন্তু প্রকাশ করছে না। অমিত এতটাও চাপা স্বভাবের না। প্রচন্ড এক্সপ্রেসিভ একটা ছেলে। ফ্যামিলির কাছে ইমোশন লুকায় তা ঠিক কিন্তু খুব একটা না। আমার সঙ্গে একবার হলেও শেয়ার করার কথা ছিল। বিশেষ করে নবনীর কাছে। নাছোড়বান্দা হয়ে পেছনে লেগে থাকতো। পরগাছা বললো বলে অমিত এভাবে ফিরে আসবে? এত অভিমান! মুনিয়া ওকে যাচ্ছে তাই গালিগালাজ করলো, কই কখনো তো ওর প্রতি অভিমান হলো না! আর নবনীর একদিনের মিসবিহেভেই সব শেষ করে দিতে চাইছে?”

    — “বুঝে পাচ্ছি না বাবা।”

    — “এত কল করছি, রিসিভই করছে না।”

    — “রুমানাকে জানিয়েছো?”

    — “ও চেম্বারে। কথা হয়নি।”

    — “নবনীর সঙ্গে ও কথা বললে ভালো হতো।”

    — “অমিতের সাথে আগে কথা বলা উচিত। চেম্বার শেষ হবে হয়ত দুইটা কিংবা আড়াইটা বাজে। আমি কল করে ওকে বলবো সবকিছু। অমিত ততক্ষণে বাসায় ফিরে এলে এখানে চলে আসতে বলবো নয়তো নবনীর বাসায় নিয়ে যাব ওকে।”

    .

    নবনীকে মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে জামিলা বেগম। গত দুইদিনের না খাওয়া আর মানসিক চাপে শরীর খারাপ করেছে নবনীর। মাথা ঘুরাচ্ছে বেশ। দরজা কিংবা ফার্নিচারের সাহায্য নিয়ে চলাফেরা করতে হচ্ছে। অবস্থার অবনতি দেখতে পেয়ে নবনীকে এক প্রকার জোর করেই মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছেন জামিলা বেগম। একটু পরপর নিতু এসে দেখে যাচ্ছেন নবনী খাচ্ছে কি না। নবনীর পাশেই বসে আছে নাতাশা। খাবার খেতে খেতে নবনী ওদের দুজনকে বললো,

    — “তোমাদেরও কি মনে হয় আমি এতদিন যাকে দেখেছি সে আমার ভ্রম?”

    প্রাণহীন হাসলেন জামিলা। নবনীর মুখে লোকমা তুলে দিতে দিতে বললেন,

    — “আমারে একটা কতা কও তো বইন, তোমার মন খারাপের কারণটা আসলে কী?”

    — “সামি আর আসছে না।”

    — “এইটাই? তুমি কি নিশ্চিত?”

    — “আর কী হবে?”

    — “তুমি সামিরে খুঁজতাছো?”

    — “হ্যাঁ!”

    — “কিন্তু আমি যে দেখতাছি তুমি অন্য কারো আশায় বইসা আছো।”

    — “কার আশায়?”

    জবাব দিলো নাতাশা,

    — “তুমি বারবার ফোনের স্ক্রিন চেক করছো। মেসেঞ্জারে অমিত ভাইয়ার সঙ্গে চ্যাটবক্সটা বারবার ওপেন করছো। তারপরও জিজ্ঞেস করছো কার আশায়? তারপরও বলছো সামি ভাইয়াকে তুমি খুঁজছো?”

    রেগে গেল নবনী। বললো,

    — “তোর কি মনে হয় আমি মিথ্যা বলছি? সামির সঙ্গে প্রতারণা করছি?”

    — “মিথ্যে বলছো তা তো বলিনি! সামি ভাইয়ার জন্য অপেক্ষা হয়তো করছো কিন্তু অমিত ভাইয়ার চেয়ে বেশি না। আর প্রতারণার প্রসঙ্গ কেন আসছে? কিসের প্রতারণা আপু? যে নেই তার সঙ্গে কেমন করে প্রতারণা হবে? যে চলে যায় তার বিপরীতে অন্য কাউকে জায়গা দিলে সেটাকে প্রতারণা বলে না। নাতাশার কথার জবাবে কিছু বললো না নবনী। দ্বিধাভরা চোখে চেয়ে রইলো তার দিকে। জামিলা বেগম বললেন,

    — “এত অবুঝ তুই? কেমনে নবনী? তোর মনের খবর দুনিয়ার সবাই জানে অথচ তুই নিজেই টের পাস না? তুই পুড়তাছোস এই কথাটা ঠিক। কিন্তু কারণটা নিজেও ভালো কইরা বুঝতাছোস না।”

    বিছানায় শুয়ে পড়লো নবনী। মুখ আড়াল করে বললো,

    — “আমার আর কিছু শুনতে ভালো লাগছে না। তোমরা যাও এখান থেকে।” নাতাশা কিংবা জামিলা বেগম কাউকেই বিছানা ছেড়ে উঠতে না দেখে চিৎকার করে উঠলো নবনী,

    — “যাচ্ছো না কেন তোমরা? এখানে বসে আছো আমার সমস্যা আরো বাড়ানোর জন্য?”

    বলতে বলতেই হাতের কাছে পড়ে থাকা পাঞ্চক্লিপটা সজোরে ছুঁড়ে মারলো ফ্লোরে। জামিলা বেগম কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলেন ফ্লোরে, ভাঙা পাঞ্চক্লিপটায়। ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার আগে বলে গেলেন,

    — “খোপার কাটা ভাঙছো, ভাঙো। কিন্তু অমন কইরা নিজের সবচেয়ে ভালো বন্ধুটারে ভাইঙো না। পরে কিন্তু নিজেই ভাইঙা পড়বা। সামলাইতে পারবা না নিজেরে।”

    .

    লাঞ্চ আওয়ারে চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে শুয়ে আছে অমিত। খাওয়া হয়নি দুপুরে। ইচ্ছে করেই খায়নি। এতদিনের অভ্যেসের বাইরে সে যাবে কেমন করে? নবনী ঘড়ি ধরে ঠিক দু’টো বাজে টেক্সট করবে, খেতে বসেছো? এপাশ থেকে সে উত্তর দিবে, এইতো বসছি এখনি। তারপর হবে তার মধ্যাহ্নভোজ। এইতো ছিল তার নতুন অভ্যেস, অথচ কী গাঢ়! যে অভ্যেস রক্তের মাঝে মিশে যায়, নিজের কাছ থেকে আলাদা করা যায় না কখনো। শুধু কি এই প্রশ্নটাই? নবনীর প্রতিটা যত্নই যে মিশে গেছে তার মাঝে। স্বয়ং নবনীই যে তার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে, যাকে মুছে ফেলা যায় না, ভুলে থাকা যায় না, কেটে আলাদা করে ফেলা যায় না। বুকের মধ্যে কখনো ভালোবাসা আর রক্তে নেশা হয়ে রয়। আবার কখনোবা পাহাড়সমান দুঃখের বোঝা আর কান্না হয়ে রয়। চোখের পাতায় বারবার শুধু নবনীর সঙ্গে কাটানো সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্তগুলো ভাসছে। এক মুহূর্তের জন্যও ভুলে থাকা যাচ্ছে না। মেয়েটা তাকে আর চায় না তবুও বারবার তাকে মনে পড়ছে। এ ভীষণ যন্ত্রণার! প্রচন্ড অভিমানে বারবার করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, যে ছেড়ে যেতে চায় তাকে ধরে রাখবো না। চলে যাক ও ওর ভালোবাসার কাছে। পরমুহূর্তেই পৃথিবীটা বুঝি মাথার উপর ভেঙে আসে নবনীকে হারানোর ভয়ে। নিজেকে ঘরছাড়া আশ্রয়হীন লাগে। বারবার নবনীর নাম্বারে ডায়াল করতে গিয়েও হাত গুটিয়ে নেয় সে। মনে পড়ে যায় নবনীর ফটফট করে বলে ফেলা ঐ কঠিন কথাগুলো। তবুও অপেক্ষায় চেয়ে থাকে ফোনের স্ক্রিনে নবনীর একটা কল কিংবা টেক্সটের আশায়। নিজের ঘর কি কেউ কখনো ভুলতে পেরেছে? মায়া ছাড়তে পেরেছে?

    ৫৬

    দিনশেষে অমিত ফিরে এসেছে বাসায়। বরাবরের মতন কাপড় ছেড়ে, ফ্রেশ হয়ে বেরিয়েছে। তবে অন্যসব দিনের মতো মুখে হাসি নেই। টিভির ঘরে আনাগোনা নেই। নবনীর ঘর, আর খাটটাই বুঝি তার ভীষণ আপন। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেল এই ঘরে আসেনি কেউ। অমিতও ডাকেনি কাউকে। গলায় চেপে ধরা নিঃশ্বাস আর বুকের উপর কষ্ট হয়ে থাকা নবনী এই দুই সামলাতে সামলাতেই শত বছর সমান লম্বা মুহূর্তগুলো কাটছে। নীরব কান্নায় ভিজে যাচ্ছে গাল, হাত। কে যেন একবার বলেছিল তাকে, আর যাই করো, চোখের পানি কখনো কাউকে মুছতে দিও না। যে চোখের পানি মুছে দিতে জানে সবচেয়ে বেশি কাঁদানোর ক্ষমতাটাও তাদের হাতেই। বয়স তখন কম ছিল। সদ্য স্কুল পেরিয়ে কলেজে পা রাখা যুবক, তাই এই কথার অর্থ তখন মাথায় আঁটেনি। মুখস্থ ব্যাকরনের মতন মাথায় গেঁথেছে শুধু। আজ এতবছর বাদে সেই অর্থ মাথায় এঁটেছে। অক্ষরে অক্ষরে উপলব্ধি হচ্ছে।

    দরজা ঠেলে ঘরে এল সাব্বির। আলো জ্বালালো সে। তার হাতে কফির ট্রে। তিনমগ কফি আছে ওখানে। চোখে চোখ পড়তেই মুচকি হাসলো সাব্বির। মিথ্যে অভিমানে অভিযোগ করতে লাগলো,

    — “তোকে কতগুলো কল করেছি দেখেছিস একবার?”

    সাব্বিরের পেছন পেছন এল রুমানা। সবসময়ের মতন প্রাণখোলা মিষ্টি হাসিতে বলল,

    — “চলো একসঙ্গে বসে কফি খাই।’

    কিছু বললো না অমিত। চোখ, গাল মুছে আসন পেতে বসলো। একমগ কফি অমিতের হাতে ধরিয়ে দু’পাশে সাব্বির, রুমানা বসলো।

    কফির মগে চুমুক দিতে দিতে রুমানা বললো,

    — “নবনী মেডিসিন নিচ্ছে ঠিকঠাক? খোঁজ নিয়েছো?”

    — “না।”

    — “তুমি ওর হাজবেন্ড, ও মেডিসিন নিচ্ছে কি না সেটা দেখবে তুমি। এটা তোমার দায়িত্ব।”

    — “আমি ওর কেউ না।”

    — “নবনী বলেছে?”

    — “হ্যাঁ।”

    — “নবনী কখনো বলেছিল ওকে ভালোবাসতে?”

    — “না।”

    — “তাহলে ভালোবেসেছো কেন?”

    — “ভালোবাসা কখনো কারো অনুমতি নিয়ে হয়?”

    — “ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ, কেয়ার করা এসবও কারো অনুমতিতে হয় না। তুমি ওকে ভালোবাসো, নবনী এখন সেটা জানে আর সামাজিকভাবে তোমাদের সম্পর্কের একটা নাম আছে। এবার তুমি তোমার ওয়াইফকে যেভাবে খুশি ভালোবাসো, যত্ন নাও। সেটা তোমার অধিকার। নবনী আপত্তি করলে ওকে বুঝাও ইউ লাভ হার। রাগ করে দূরে সরে এলে চলবে?”

    — “আচ্ছা তুই রাগ কেন করছিস বল তো? নবনীর সমস্যাটা তুই জানিস। তবুও কেন?”

    — “নবনীর জীবনে আমিই সমস্যা। এছাড়া আর কোনো সমস্যাই নেই। মানুষ মরে গিয়েও বেঁচে থাকে। সত্যিই থাকে। আগে তোদের মতো আমিও বিশ্বাস করতাম না কিন্তু এখন আমি করি। যার সঙ্গে যা ঘটেনি সে কেমন করে তা বিশ্বাস করবে? আমার সঙ্গে ঘটেছে, ঘটছে। বারবার এই ছেলেটা আমাদের মাঝে বাঁধা হতে হতে চিরতরে সম্পর্কটা মুছে ফেলার বন্দোবস্তও করে ফেলেছে। নবনীর তাতে কোনো আপত্তি নেই। ফেলুক। মেনে নিবো আমি। কারো সম্পর্কে থার্ড পার্সন কেন হবো আমি?”

    — “তুমি কাকে ব্লেইম করছো অমিত? যে মরে গেছে তাকে?”

    — “মরে গেছে? মরে গেলে নবনী ওকে এখনো ফিল করে কিভাবে? এত বছর পরও ভালোবাসা ঠিক আগের মতো গাঢ় থেকে যায় কেমন করে? নবনীর হাজবেন্ড আমি। একবারও কেন ওর মনে হয়নি আমি ওর আপন কেউ? ওর সঙ্গে খুব সুন্দর একটা সম্পর্ক আমার আছে। আমাদের এই সম্পর্কের একটা নাম আছে। ও কেন একবারও মানতে চায় না, ভাবতে চায় না। সাড়ে পাঁচমাস সময় কি কম? একই বাসায় ছিলাম আমরা, কাছাকাছি থেকেছি, সময় কাটিয়েছি। ওর কেয়ার করেছি। সময়ে, অসময়ে, রাত গভীরে দুজন মিলে পুরো শহর ঘুরে বেড়িয়েছি। ওকে ফেলে কখনো খেতে বসিনি। ওকে সঙ্গে না নিয়ে বাসায় ফিরিনি। রাতে কারখানায় কাজ থাকলে আমিও পড়ে থেকেছি ওখানেই, ওর সঙ্গে। শেষের সময়গুলোতে নবনীকে রাতেও আমি একা ছাড়িনি। ও ঘুমানোর আগ পর্যন্ত বসে থেকেছি ওর পাশে। এতকিছুর পরও ওর মনে একটুখানি জায়গা আমার হলো না! কেন হয়নি? সামির জন্য। আর নবনী? কি না করেছে ও আমাকে খুশি রাখতে? এলোমেলো আমাকে গুছিয়ে নিলো। আমার হারানো সম্পর্কগুলো ফিরিয়ে দিলো। হারানো আমিকে খুঁজে নিলো। এতকিছুর পরও আমাকে ছুঁড়ে দিলো ও। এতগুলো দিনে একটুও মায়া হলো না আমার জন্য? আলাদা করে ভাবতে ইচ্ছে হলো না আমাকে? কেন? সামির জন্য। ওর সবটা জুড়ে শুধু ঐ ছেলেটাই আছে। ওর বাইরে নবনী আর কাউকে ভাবতে পারে না। এক মুহূর্তের জন্যও না।

    — “তোমাকে নিয়ে ও অবশ্যই ভাবে। ওকে সময় দাও।”

    — “সেই এক কথা! বারবার মিথ্যা বলতে তুমি ক্লান্ত হও না রুমানা?”

    — “তুমি আমাকে ট্রাস্ট করতে পারছো না?”

    — “নবনী আমাকে এতকিছু বলে দেবার পর তোমাকে ট্রাস্ট করার প্রশ্নই আসে না।”

    — “ডক্টরকে ট্রাস্ট না করলে ট্রিটমেন্ট হবে কেমন করে? তোমাদের দুজনের কাউন্সেলিং প্রয়োজন। একজন কাউন্সেলিং নিতে চায় না, অন্যজন আমাকে বিশ্বাস করতে চায় না। হবে তাতে?”

    –…………..

    — “শোন না অমিত? কেন এভাবে বেঁকে বসেছিস বল তো? নবনী তোরই আছে। কোথায় ওকে আগলে রেখে ওর অসুস্থতা নিয়ে ওকে বুঝাবি। স্বাভাবিক একটা জীবনে ফিরে আসতে হেল্প করবি, ওকে কতটা ভালোবাসিস তা বুঝাবি। অথচ তুই কেমন উল্টে গেলি!”

    — “ও আমাকে কী বলেছে জানিস?”

    — “কী?”

    — “ওকে বললাম সামি তোমার হ্যালুসিনেশন। ও বললো, ভ্রম হোক কিংবা মৃত হোক ভালোবাসা ছাড়বে না কখনো। ওকে আর বুঝিয়ে লাভ কী? হয়তো নবনী সুস্থ হবে। ওর হ্যালুসিনেশন হবে না। কিন্তু ভালোবাসা? তার কী হবে? নবনী কখনো আমাকে ভালোবাসবে না। কিন্তু ওটাই যে আমার চাই!”

    আলাপ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে। অক্লান্তভাবে রুমানা তাকে বুঝিয়ে চলছে। তবুও কোনোকিছুতেই নবনীর চলে যাওয়া কিংবা চিরতরে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারে না অমিত। তীব্র কষ্ট আর অভিমান ছাড়ে না তাকে। রুমানার শত মিষ্টি কথায়, সুন্দর আশায় ক্ষয়ে যাওয়া ভেতরটা সেরে উঠে না। নিজেকে ঘুরেফিরে একটা ভাঙা পরিত্যক্ত বস্তু হিসেবে খুঁজে পায় অমিত। একসমুদ্র অভিমান হওয়া সত্ত্বেও বারবার নবনীকে খুঁজতে থাকে সে। তাকে সারিয়ে তুলবার সমস্ত ক্ষমতা যে সৃষ্টিকর্তা একমাত্র নবনীর হাতেই সঁপে দিয়েছে।

    ৫৭

    নবনীকে ছাড়া আজ অমিতের তৃতীয় সকাল। নবনী চলে যাবার পর এই ঘরেই রাতে ঘুমুচ্ছে অমিত। নবনীর বালিশটা বুকে আঁকড়ে কেটে যায় গোটা রাত। খাওয়ায় অনিয়ম, নির্ঘুম রাত আর ভাঙা মন নিয়ে আজ ঠিকঠাক বেশিক্ষন দাঁড়ানো যাচ্ছে না। সবকিছু চোখের সামনে ঝাপসা আবার কখনোবা অন্ধকার হয়ে আসছে হঠাৎ হঠাৎ। নবনী থাকলে হয়ত জোর করে এখন বিছানায় শুইয়ে রাখতো। দুইটা সেদ্ধ ডিম, বড় একগ্লাস স্যালাইন হাতে ধরিয়ে বলতো, খাও এগুলো। দুপুরে বিফ করবো, অনিকে ভার্সিটি থেকে ফেরার পথে বলবো মিষ্টি কিনে আনতে। বিকেলের মধ্যে একদম ফিট হয়ে যাবে।

    .

    শামীমা দরজা ঠেলে ঘরে এসেছিলেন অমিতকে নাস্তার জন্য ডাকতে। নবনীর ড্রয়ার খুলে ওর কাপড়গুলোর ভাঁজ খুলে ছুঁয়ে দিচ্ছে অমিত। ছেলের অসহায় মুখটা দেখে বুকের ভেতর মোচড় কাটলো শামীমার। মুখে হাত চেপে নীরবে কাঁদছেন তিনি। পেছনে মায়ের উপস্থিতি বোধহয় টের পেলো অমিত। ঘাড় ফেরালো সে। মা কাঁদছে। নবনীর জামাটা বুকে জড়িয়ে কাপাস্বরে বললো,

    — “আমার মাথার উপর ছাদ খুঁজে পাচ্ছি না আম্মু। ঘরবাড়িহীন, বেওয়ারিশ মনে হচ্ছে নিজেকে। নবনী আমাকে আশ্রয় দিয়ে এভাবে ছুঁড়ে দিলো কেন? আমার মাঝে, আমার ভেতর ওকে খুব যত্নে আমি গেঁথেছি। ওকে আমি ভুলে থাকবো কেমন করে?”

    ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন শামীমা। নবনীর জামাটা ওয়্যারড্রবে তুলে রেখে বললেন,

    — “অসুস্থ দেখাচ্ছে তোকে। বিপি লো হয়েছে নাকি আবার?”

    — “নবনীকে ভালোবাসি আম্মু। ও আমাকে না বাসলেও বাসি। ওকে ছেড়ে থাকতে পারছি না। কোথাও শান্তি পাচ্ছি না। এভাবে কেউ বাঁচে বলো? আমাকে ভালোবাসতে হবে না। ও শুধু ফিরে আসুক। আমার ঘর হয়ে থাকুক। দিনশেষে আমি আমার মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু পেলেই হলো।”

    — “নবনী আসবে। আমরা নিয়ে আসবো ওকে। তুই নিয়ে আসবি ওকে। আমরা আজ যাব নবনীর কাছে। ঠিক আছে? এখন খেতে চল। গতকাল রাতে খাসনি। দুপুরে অফিসে খেয়েছিস কি না তারও ঠিক ঠিকানা নেই।”

    — “আমি এখনই যাব আম্মু।”

    — “এখন কোথায় যাবি তুই? ওয়েদার ভালো না। বাইরে কী বৃষ্টি হচ্ছে!”

    — “বৃষ্টি দেখছো আর আমার মনে যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে তা দেখছো না আম্মু?”

    .

    বাইরে ঝুম বৃষ্টি। নবনীর বাসার নিচে দাঁড়িয়ে আছে অমিত কাকভেজা হয়ে। তাকিয়ে আছে নবনীর বারান্দায়। নবনীর কাপড় ঝুলছে সেখানে। ওকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে ভীষণ, মনের সমস্ত আঁকুতি বলে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে এক নিঃশ্বাসে। অথচ সিঁড়ি ভেঙে অমিতের উঠা হচ্ছে না নবনীর বাসায়। কী যেন আটকে রেখেছে তাকে। কিন্তু মনের গহীনে যে ভালোবাসা, তাকে কি আটকে রাখা যাচ্ছে? তোলপাড় করে প্রতি মুহূর্তে শেষ করে দিচ্ছে। সে এক অসহ্য যন্ত্রণা! এই যন্ত্ৰণা কমবে কিসে? বুকের বা পাশে নবনীর একটুখানি স্পর্শে নাকি নবনীর মনে একটুখানি আশ্রয় পেয়ে?

    বারবার ফোনের স্ক্রিন অন করছে নবনী। কোনো টেক্সট এসেছে অমিতের? গোটা দু’দিনে কোনো কল কিংবা টেক্সট আসেনি অমিতের। নবনী চায়ও না আসুক তবুও… তবুও মনের কোথায় যেন আশা জাগে অমিতের একটা ফোনকলের, কেমন আছো নবনী প্রশ্নের। ছেলেটা নিজেই বা কেমন আছে কে জানে! খুব করে ইচ্ছে হয় অনিকে কল করে একটাবার অমিতের খোঁজ নিতে। ভালো আছে তো ও? সামলে নিতে পারছে তো নিজেকে? নিজের সীমা অতিক্রম করেনা নবনী। দাঁতে দাঁত চেপে পড়ে আছে এই বাসায়, নিজের ঘরে। যার সঙ্গে সম্পর্কের সুতো নিজেই কেটে দিয়েছে সেই মানুষটার খোঁজ নেয়া আদিখ্যেতা ছাড়া আর কিই বা হতে পারে? সম্পর্ক ছেড়ে আসার পরও দু’জনের মাঝে যে এক আকাশ সমান মায়া রয়ে গেছে সে মায়া কাটাতে হবে। যতটা না তার মঙ্গলের জন্য, তার চেয়ে বেশি অমিতের ভবিষ্যতের জন্য। বহুভাবে মনকে বোঝায় নবনী। অনির নাম্বারে ডায়াল করতে গিয়েও বারবার ফোন থেকে দূরে সরে আসে। তবুও মনটা যে শান্ত হয় না! কষ্ট দলা পাকিয়ে গলার মধ্যে আটকে থাকে, ক্ষণে ক্ষণে কান্না পায়। ভীষণ অস্থিরতায় নিঃশ্বাসটাই বুঝি আটকে আসতে চায়। হঠাৎ ঝড়ের গতিতে ঘরে এল নাতাশা।

    — “আপু! অমিত ভাইয়া বাসার নিচে দাঁড়িয়ে আছে।”

    এক ছুটে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো নবনী। গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে অমিত তাকিয়ে আছে তার বারান্দায়। এক মুহূর্ত আর দাঁড়ালো না নবনী। দৌড়ে মায়ের ঘর থেকে ছাতা নিয়ে নেমে এল বাসার নিচে। অমিতের মাথায় ছাতা ধরে শক্ত করে তার হাত চেপে ধরলো নবনী।

    — “এক সপ্তাহ ধরে ঠান্ডা সর্দিতে ভুগছো। এই বৃষ্টিতে ভেজার সাহস কেমন করে হলো তোমার? বাসায় চলো।”

    — “আমাকে তো ঠান্ডা, সর্দি ভোগাচ্ছে না নবনী। ভোগাচ্ছো তুমি।”

    — “অমিত এসব কথা রাখো। আগে বলো কতক্ষণ ধরে ভিজছো তুমি? চোখ লাল হয়ে গেছে। মুখ শরীর ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। আঙুলের চামড়া কুঁচকে গেছে। আজকে তুমি জ্বর বাঁধাবে নিশ্চিত! উপরে চলো এক্ষুনি। একটানে নবনীকে আরো কাছে নিয়ে এল অমিত। নবনীর হাত বুকের উপর চেপে ধরে বললো,

    — “আমার সব সুখ, স্বস্তি তোমার কাছে জমা আছে নবনী। তুমি ছাড়া আমার আর কোথাও যাবার জায়গা নেই। আমার কোত্থাও শান্তি নেই। আমার ভেতরটা চৈত্রের দুপুর রোদের মতন খা খা করে। কষ্ট পাচ্ছি আমি। খুউব! যতটা কষ্ট পেলে মানুষ জীবিত থেকেও মরে যায় ঠিক ততটা। নিঃশ্বাস আটকে আসে আমার নবনী। আমি মারা যাচ্ছি তোমার জন্য। ভালোবাসি তোমাকে, যতটা ভালোবাসলে মানুষ অচল হয় ঠিক ততখানি। আমি জানি তুমি সামিকে ভালোবাসো, অসীম ভালোবাসা। যে ভালোবাসায় মৃত্যুও তোমার সামনে দেয়াল হতে পারেনি। আমাকে ভালোবাসতেই হবে সে দাবি আমি কখনো জানাবো না। তুমি আমাকে ভালো না বাসলেও চলবে। শুধু বলবো আমাকে ভালোবাসতে দাও। সম্পর্কটা বেঁচে থাকুক, এখন যেভাবে বেঁচে আছে সেভাবেই। থাকতে হবে না আমার সঙ্গে এক বিছানায়, আমাকে হাজবেন্ড বলে পরিচয়ও দিতে হবে না। তুমি বাসায় ফিরে এসো নবনী। আমরা আলাদাই থাকবো। আমি শুধু তোমাকে ভালোবাসবো। কখনো একটুখানি ছুঁয়ে দেখার আবদার করব না। স্বামীর কোনো অধিকার চাইবো না। তোমার কাছে শুধু একটাই চাওয়া রয়ে যাবে, তুমি আমার স্বস্তি হয়ে থাকো, এতদিন যেমনটা ছিলে ঠিক তেমন। প্লিজ নবনী, আমাদের ডিভোর্স না হোক। থেকে যাও আমার ঐ ছোটো ফ্ল্যাটটায় আমার স্বস্তি হয়ে।”

    অমিতের মুঠো থেকে হাত ছাড়িয়ে নিলো নবনী। দুই পা পিছু সরে বড্ড কঠিন করে বললো,

    — “তুমি ফিরে যাও অমিত। আমার কাছে তোমার কিছুই নেই। আমাদের মাঝেও আর কিছু নেই। যা ছিল সবটা শেষ করেই এসেছি। ভালো শুধু আমি একজনকেই বেসেছি, আর কাউকে ভালোবাসতে পারবো না। কারো ভালোবাসা আমি চাইও না।”

    নবনীর দুই কাঁধে শক্ত করে চেপে ধরলো অমিত। —

    — “আমি তোমার কেউ না নবনী?”

    — “না।”

    — “আমাদের বন্ধুত্ব, মায়া সবকিছু অস্বীকার করছো তুমি? আমাদের বিয়ে হয়েছিল নবনী। মিথ্যে ছিল না সেটা। সত্যি সত্যি আমাদের একটা বিয়ে হয়েছিল। তুমি আমি কবুল বলেছিলাম। অস্বীকার করবে তুমি?”

    — “হ্যাঁ করছি। আমি সবকিছু শেষ করতে চাই অমিত। কেন এসেছো তুমি? আমি চাই না আমাদের আর কখনো দেখা হোক, কথা হোক। ভুলে যাও সবকিছু।”

    — “যে ছেলেটা মরে গেছে আট বছর আগে তাকে তুমি আজও ভুলোনি। তুমি জীবিত মানুষ, আমার বিয়ে করা বউ তোমাকে আমি ভুলবো কেমন করে? সামিকে তুমি যতটা ভালোবাসো তার চেয়ে বেশি আমি তোমাকে ভালোবাসি। কিভাবে ভুলবো আমি সবকিছু?”

    — “কী করবো এখন? আমিও মরে যাবো? আমি মরে গেলে সব ঠিক হবে? ভুলে যাবে তুমি আমাকে?”

    — “নাহ্ নবনী! থেকে যাও আরো বহুবছর। বাঁচিয়ে রাখো তোমার ভালোবাসা। তুমি তো হেরে যাওনি, তুমি কেন মরবে? হেরেছি আমি। একজন মৃত মানুষের কাছে আমি বাজেভাবে হেরে গেছি। হেরে যাওয়া মানুষদের পৃথিবীতে বেঁচে থেকে কোনো কাজ নেই। শেষবারের মতো জিজ্ঞেস করছি। তোমার মনে কখনো কি একটুখানি জায়গা আমার জন্য হয়নি?”

    গলা ধরে এলো নবনীর। মাথা নিচু করে কাঁপাস্বরপ বললো, “না।”

    চিৎকার করে উঠলো অমিত।

    — “তাহলে কেন আমাকে আগলে রেখেছিলে এতগুলো মাস? মুনিয়ার কাছে হোঁচট খেয়ে পড়ে থাকতাম, খুবজোড় মরেই যেতাম। বেঁচে থাকলে একটু একটু করে নিজেকে সামলে নিতাম। কেন এসেছিলে দয়া করতে? তোমার দয়ার ভার আমি আর সইতে পারছি না নবনী। মরন যন্ত্রণা হয়ে গেছে আমার। কী করবো এখন বলো না? কে সামলাবে আমাকে? আমি যে তোমার উপর খুব ডিপেন্ডেড হয়ে গেছি নবনী!”

    — ……………….

    মুখে হাত চেপে চিৎকার করে কাঁদছে অমিত।

    — “আমি হেরে গেছি। একজন মৃত মানুষের কাছে আমার ভালোবাসা হেরে গেছে।” গোটা পৃথিবী উল্টেপাল্টে যেন কান্না পাচ্ছে নবনীর। চিৎকার করে কেঁদেই দিবে যখন তখন। আর দাঁড়ালো না নবনী। দৌড়ে চলে গেল বাসার দিকে। তিনতলার উপর থেকে দাঁড়িয়ে ওদের দেখছিলো নাতাশা আর নীতু। নবনী বাড়ির মেইন গেইটে ঢুকতেই শফিক সাহেবকে ডেকে নীতু বললেন,

    — “জলদি করে নিচে যাও। ছেলেটাকে বাসায় নিয়ে এসো।”

    শফিক সাহেব বাসার নিচে পৌঁছুবার আগেই অমিত চলে গেছে গাড়ি নিয়ে। বাসায় ফিরে নিজের ঘরে দরজা আটকে চিৎকার করে কাঁদছে নবনী।

    .

    শহর ছেড়ে সামিদের গ্রামের বাড়ি এল অমিত। মূল ফটকের বাইরে গাড়ি দাঁড় করিয়ে সামির কবরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে রইলো সে। ঝুম বৃষ্টি আজ দেশের বেশিরভাগ জুড়ে। বৃষ্টি হচ্ছে এখানেও। বাড়ির ভেতরের দরজা জানালা আটকে বসে আছে সামির মা বাবা। ভেতরে যাবার সময় অমিতকে দেখেছে বাড়ির দারোয়ান। অমিত তার পরিচিত মুখ। এসেছিল সেদিন নবনীকে সঙ্গে নিয়ে। শুনেছে এই ছেলেটা নবনীর স্বামী। ভেবেছিল ছেলেটা হয়তো বাড়ির ভেতরে যাবে। কিন্তু তার ধারণা ভুল করে ছেলেটা এই বাড়ির ছেলের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে ভিজছে। এসেছিলও সে কাকভেজা হয়েই, এখনো ভিজছে। এই বৃষ্টিতে অমন করে ভিজছে কেন, কে জানে! সে কি কবর জেয়ারত করছে? অনেক ফজিলতের কোনো দোয়া পড়ছে? ছাতা মাথায় দূর থেকে দাঁড়িয়ে সূক্ষ্মভাবে অমিতকে দেখার চেষ্টা করছে এই বাড়ির দারোয়ান। হঠাৎ ছেলেটা বসে পড়লো। মুখ দেখে মনে হচ্ছে ছেলেটা খুব চিৎকার করে কাঁদছে। বৃষ্টির শব্দে তার কান্নার শব্দ কানে এসে পৌঁছাচ্ছে না। অবস্থা সুবিধাজনক লাগছে না দারোয়ানের। কাদামাটির উপর পা চেপে চেপে এক প্রকার দৌড়ে বাড়ির ভেতর গেল দারোয়ান। এই বাড়ির মালিককে বিষয়টা জানাতে হবে!

    .

    — “তুমি চলে গিয়েও রয়ে গেলে কেন? বলো না সামি? আমার ওয়াইফ তোমাকে কেন ভালোবাসবে? লজিক্যালি তুমি এখন ওর কেউ না। আমি ওর হাজবেন্ড, আমিই ওর সব, তবুও তোমাকেই ও ভালোবাসে। কেন? বাজি ধরে বলতে পারি তোমার চেয়ে বেশি ভালো আমি ওকে বেসেছি। অথচ দেখো আমি হেরে গেছি তোমার কাছে। নবনী তোমাকে চায়, আমাকে না। এত ভালোবাসি তবুও নবনী আমাকে চায় না। আমাকে হারিয়ে দিলে তুমি! এত ভালোবাসি ওকে… অনেক অনেক… তোমার সঙ্গে আমি আমার ওয়াইফকে আর মানতে পারছি না।”

    .

    দারোয়ানের কথা শুনে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল সামির মা, বাবা। দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে অমিতের মাথায় ছাতা ধরলো দারোয়ান। ছেলের কবরের পাশে অমিতকে এভাবে কাঁদতে দেখে খেই হারালেন সামির মা-বাবা। নবনী চলে আসার প্রভাব কি খুব বেশিই পড়লো ওর উপর? সামির বাবা এগিয়ে এসে অমিতের কাঁধে হাত রাখলেন। বললেন,

    — “এখানে ভিজছো কেন বাবা? ভেতরে এসো।”

    — “আপনাদের ছেলে আমার পথ থেকে সরে কেন গেল না?”

    — “ভেতরে চলো। ভিজে গেছ একদম। শরীর খারাপ করবে না?”

    সামির বাবার কথার কোনো জবাব দিলো না অমিত। প্রচন্ড ঘৃণায় এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো কবরের দিকে। সামির মা অমিতকে ডাকলো এবার,

    — “বাবা আমার কথা শুনো। ভেতরে এসে কাপড় পাল্টে নাও। তারপর আমরা কথা বলবো।”

    একলাফে উঠে দাঁড়ালো অমিত। কারো সঙ্গে কিছু না বলে বেরিয়ে গেল এই বাড়ি ছেড়ে। যাবার সময় একপাটি জুতা ফেলে গেল কবরের পাশে, অন্যপাটি জুতা আটকে রইলো কাদায়।

    স্ত্রীকে তাড়া দিতে লাগলেন সামির বাবা,

    — “জলদি করে নবনীর বাসায় একটা কল করো তো। ওদের জানাও বিষয়টা। ছেলেটার হাল অবস্থা ভালো ঠেকেনি।”

    — “ওকে আটকানো উচিত ছিল বোধহয়।”

    — “রাখতে পারতাম না। উল্টো ঝামেলা করতো।”

    — “নেটওয়ার্কই তো নেই। ভোরের ঝড়ের পর নেটওয়ার্ক একেবার উধাও হয়ে গেছে। কল যাবে না তো।”

    দারোয়ানকে নিয়ে গেইটের দিকে পা বাড়ালেন সামির বাবা। আরেকবার বুঝিয়ে শুনিয়ে ছেলেটাকে যদি ঘরে আনা যায়! গেইটের বাইরে যেতে অমিত ততক্ষণে গাড়ি নিয়ে চলে গেছে মাটির রাস্তা পেরিয়ে বড় রাস্তার দিকে।

    বেলা গড়িয়ে দুপুর হলো। দুপুরের রান্না শেষে গোসলে যাবার আগে এরশাদ সাহেবকে ডেকে শামীমা বললেন,

    — “চুলায় ভাত বসিয়েছি। আমি গোসলে যাচ্ছি, চাল ফুটে গেলে মাড় ফেলে দিও।” ছেলের নাম্বারে ডায়াল করছিলেন এরশাদ সাহেব। শামীমার ডাক শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি।

    — “শুনছো? অমিত কি গিয়েছিল নবনীদের ওখানে? কোথায় আছে এখন? ওখানেই?”

    — “ওখানে নেই। বেরিয়ে গেছে আরো আগেই। ভাবী কল করেছিল। নিচে দাঁড়িয়ে কথা বলে চলে গেছে। উপরে উঠেনি।”

    — “কী মুসিবত! এই বৃষ্টি বাদলায় কোথায় ঘুরছে কে জানে?”

    দীর্ঘশ্বাস ফেললেন শামীমা। অমিতের ভাগ্যটাই খারাপ বুঝলে! নয়তো ছেলেটা বারবার কেন কষ্ট পাবে?

    এখনো নবনীর ঘরের দরজা বন্ধ। ভেতর থেকে আর কান্নার শব্দ আসছে না। শফিক সাহেবের বাসার পরিবেশ থমথমে। কেউ কারো সঙ্গে কথা বলছে না। গত দু’দিন ধরে অনবরত জামিলা বেগম জিকির করেই যাচ্ছেন। নবনীর বিষয়টা ছাড়াও আরেকটা ব্যাপারে মন তার ভীষণ অস্থির হয়ে আছে। বারবার মনে কু ডাকছে খুব খারাপ কিছু হতে চলেছে। কেউ বুঝি মারা যাবে! সামি মারা যাবার আগে ঠিক এমনই মনে হয়েছিল। শফিকের মা মারা যাবার আগেও। সেই থেকে মনে কু খেয়াল এলেই ভীষন ভয় হয় তার। কিন্তু কখনো মুখ খুলেন না তিনি চেপে যান পুরো ব্যাপারটা। মনে মনে ভীত অন্তরে বারবার সৃষ্টিকর্তার দরবারে প্রার্থনা করতে থাকেন। তাসবিহ হাতে মনকে শান্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করেন।

    অমিত চলে যাবার পর তিনি নিজেও ঘর থেকে বেরোননি। কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। আজ সামির মরা মুখটা বড্ড মনে পড়ছে। রোবটের মতন রান্নাঘরে রান্না করে চলছেন নীতু। নাতাশা জানে আজ মায়ের রান্নায় বিন্দুমাত্র মন নেই। রান্নায় ভুল হবে। কখনো লবন দেবে না, কখনো হলুদ দেবে না। মায়ের ভুল সংশোধন করবে বলে, কাজে হাত লাগাবে বলে পাশেই দাঁড়িয়ে রইলো নাতাশা। মনে তাদের অজস্র কথা, আর ভাগ করার মতো দুঃখ আছে, কান্না আছে। অথচ কেউ কাউকে প্রকাশ করছে না। পাশাপাশি দাঁড়িয়েও নিশ্চুপ দুজন। বারান্দায় পেপার হাতে বসে আছেন শফিক সাহেব। চেয়ে আছেন বাইরে। নবনীকে নিয়ে কতশত খেয়ালে জর্জরিত তার মন। সবটাই বিষাদের। হন্যে হয়ে খুঁজছেন, কখনো কি অনেক বড় পাপ হয়েছিল তার দ্বারা? জানা কিংবা অজানায়। কৈশোরে কিংবা যুবক বয়সে? নয়তো এই মন্দ দিনগুলো এত লম্বা কেন হবে? সুখের দিন, স্বাভাবিক জীবন কেন তাদের ফিরে আসছে না?

    বিছানায় গুটিসুটি হয়ে শুয়ে আছে নবনী। কাঁদতে কাঁদতে মাথা ধরে গেছে। অমিতের জন্য দুশ্চিন্তা হচ্ছে ভীষণ। ওর খেয়াল খুব পেয়ে বসেছে আজ। অমিতের অসহায় মুখটা কখনো সহ্য হয়নি, আজও হচ্ছে না। ভীষণ অভিমানে চলে গেল মানুষটা। অথচ কখনো ওর জানা হবে না বুকে পাথর বেঁধে অমিতকে আজ ফিরিয়ে দিয়েছে সে। কখনো ওর জানা হবে না ওর চোখের পানি নবনীকে ভীষণভাবে পোড়ায়। এখনও পুড়ছে সে। অন্যসব দিনগুলোর চেয়ে বেশিই পুড়ছে। চোখের পানির কারণটা যে সে নিজেই! অথচ দু’হাতে আজ সেই পানি মুছে দেয়া হলো না। নিজের হাতের মুঠোয় ওর হাত আঁকড়ে বলা হলো না, বলো তো অমিত কেন এত কষ্ট পাচ্ছো? মুখে হাত চেপে চিৎকার করে মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে অমিত কাঁদছিল। ওকে সেই অবস্থায় ফেলে আজ সে মুখ ফিরিয়ে চলে এসেছে। বাকি জীবনটা আত্মগ্লানিতে ভোগার জন্য এই কি যথেষ্ট না?

    এলোমেলো ঘুরছে অমিত। কোথায়, কোন গ্রামে আছে তার জানা নেই। কখনো গাড়ি থামিয়ে রাস্তার ধারে বসে থাকছে, কখনোবা ক্ষেতের আইল ধরে, কাদামাটি পাড়িয়ে হেঁটে চলছে। আবার গাড়িতে ফিরে গন্তব্যহীন ছুটছে। জানালার গ্লাস খোলা। মেঘলা আকাশ, বাইরে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি। ঠান্ডা বাতাস লাগামহীন ছুটে চলছে প্রকৃতিতে। গলায়, কানে প্রচন্ড ব্যথা হচ্ছে অমিতের। চোখ ঝাপসাও হচ্ছে বারবার। ভেজা শরীরে ঠান্ডা বাতাস মিশে গিয়ে শরীরটা বুঝি বরফে পরিণত হয়েছে। শ্যামলা চামড়া আজ সাদা রঙ ধারণ করেছে। শরীর কাঁপছে ভীষণ। হাতগুলো জমে আসছে বারবার। পায়ে আর পিঠের মাংসপেশিতে টান লাগছে কিছুক্ষণ পরপর। অথচ সেসব কিছুই অমিতকে ছুঁতে পারছে না। অসুস্থতা কিংবা খারাপ লাগা সবটাই হলো নবনী। ওসব শারীরিক জটিলতা নবনীর সঙ্গে এই বিচ্ছেদের সামনে কিছুই না। গ্রামের পথ ধরে চলতে চলতে কোনো এক বিয়ে বাড়ির সামনে গাড়ি থামালো অমিত। রওনকের বিয়েতে বাড়ির বাইরে ঠিক এমনি একটা গেট বানানো হয়েছিল। অমিতের মনে পড়ে গেল সেই দিনটা। চোখের সামনে ভাসতে লাগলো নবনীকে নিজের করে পাবার, কবুল বলার সেই মুহূর্তটা। গায়ে খুব একটা বল নেই। তবুও গায়ের সমস্ত জোর খাটিয়ে স্টিয়ারিংয়ে সজোরে ঘুষি দিলো অমিত। প্রচন্ড আক্ষেপে বলতে লাগলো, তুমি তো আমার হয়েছিলে নবনী। তুমি আমার হয়েছিলে…

    কয়েক মুহূর্ত বাদে অমিত পথ খুঁজতে লাগলো এখান থেকে বেরোবার। কুমিল্লার সেই গ্রামে, সেই বাড়িতে যাবে সে। যেখানে নবনী তার হয়েছিল। কিভাবে কোন পথ ধরে এই গ্রামে এসেছে তা মনে নেই অমিতের। পথে তেমন মানুষজনও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কাঁপা হাতে স্টিয়ারিং ঘুরাতে ঘুরাতে নিজের মতন করে পথ খুঁজছে সে।

    .

    বিকেলের দিকে এসে বৃষ্টি থেমেছে। সেই দুপুর থেকে এখন পর্যন্ত বারবার মোবাইল নেটওয়ার্ক চেক করছিলেন সামির মা। এইবেলা টু জি নেটওয়ার্ক ফিরে আসা মাত্র ডায়াল করলেন নবীনদের বাসায়।

    নাতাশা অনেক ডেকে নবনীর ঘরের দরজা খুলিয়েছে। সারাদিন না খেয়ে, কান্নাকাটি করে নবনীর দিকে তাকানো যাচ্ছে না। অনেকটা জোর করেই নবনীকে এককাপ চা আর দুইপিস বিস্কিট মুখে তুলতে নবনীকে রাজি করিয়েছে নাতাশা। বোনের সঙ্গে বসে চা খেতে খেতে নাতাশা বললো,

    — “কষ্টে মরে যাচ্ছো। কার জন্য বলো তো?”

    জবাব দিলো না নবনী। নাতাশা আবারও বলতে লাগলো,

    — “জবাব না দিলেও চলবে। আমি জানি উত্তরটা। অমিত ভাইয়ার জন্য এত কষ্ট পাচ্ছো তাহলে কেন উনাকে একটা কল করছো না? কেন তোমার কাছে ডাকছো না উনাকে?”

    — “ডেকে কী হবে? ও যা চাইছে তা ওকে কখনো দিতে পারবো না।”

    — “অমিত ভাইয়া একা মরছে না আপু, তুমিও মরছো। দুজনের চোখের পানির কারণ একই। দুজনই দুজনকে চাও। ভালোবাসো। তাহলে কেন উনাকে তুমি ভালোবাসা দিতে পারবে না বলছো?”

    — “আমি সামির সঙ্গে প্রতারণা করতে পারবো না।

    — “আবারও একই কথা! তোমার অদ্ভুত যুক্তি আর খন্ডাতে পারছি না আপু। মাথা কাজ করছে না। তোমার জন্য জ্বলজ্যান্ত একটা মানুষ মরে যাবে বুঝতে পারছো ব্যাপারটা? উনি কেমন সেনসেটিভ তুমি জানো না? উনি সত্যি সত্যিই মরে যাবে।”

    ‘মরে যাবে’ কথাটায় বুকের ভেতর ধুক করে উঠলো নবনীর। প্রকাশ করলো না সে। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বিস্কিট খাওয়ার চেষ্টা করছে।

    — “সামি ভাইয়া এসেছে?”

    — “না।”

    — “কেন আসছে না?”

    — “জানি না।”

    — “নাকি জানতে চাও না?”

    — “জানি না।”

    — “সবকিছু যেহেতু খোলাসা হয়েই গেছে এবার তবে এটাও শুনে রাখো, মরে গেলে যে কেউ ফিরে আসে না সে কথা একটু হলেও তুমি বুঝতে পারছো। আর সবচেয়ে বড় কথা, সামি ভাইয়াকে তুমি নিজেও আগের মতন চাও না। তাই দেখতেও পাও না। পয়েন্ট ঠিক এখানেই। তোমার অসুখটাও এখানে। মেনে নাও আপু। মানুষের জীবনে পরিবর্তন আসতেই পারে। প্রেমিক মরে গেলে, শোকের ক্ষত শুকিয়ে এলে, বছরের পর বছর পেরোলো একটা সময় এসে নতুন কারো সঙ্গে নিজের জীবন নিয়ে আরেকবার ভাবা যেতেই পারে। কেউ ভালোবাসলে তার ভালোবাসা আগলে নেয়া যেতেই পারে। এটা কোনোভাবেই প্রতারণা না। সেদিন ভাইয়ার বদলে তুমি মারা গেলে এতদিনে সামি ভাইয়া এমনই ডিসিশন নিতো। প্রকৃতি এমনই। ধীরে ধীরে ভালোবাসা ভুলিয়ে দেয়, শোক ভুলিয়ে দেয়। জানি সবাই চিরতরে ভুলতে পারে না। কিন্তু আবেগ আগের মতন আর থাকেও না। এটা দোষের কিছু না। বরং কোনো একটা ট্র্যাজেডির মাঝে জীবনকে আটকে রাখা দোষের। তুমি এতদিন একা ছিলে তাই আমরা কেউ কিছু বলিনি কখনো। থাকো তুমি তোমার খুশী। কিন্তু এখন জীবনটা আরেকজনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে যে তোমার অভাবে মরে যাবে। তার কথা ভাবো। বাজে কিছু হবার আগে উনাকে মেনে নাও, বাস্তবতা মেনে নাও। অমিত ভাইয়ার কিছু হয়ে গেলে মানতে পারবে তুমি?”

    ঝড়ের গতিতে নবনীর ঘরে এসে ঢুকলো নীতু

    — “নবনী! অমিত সামিদের বাড়িতে গিয়েছিল। খুব এ্যাবনরমাল বিহেভ করেছে ওর কবরের সামনে দাঁড়িয়ে। বৃষ্টিতে ভিজে টিজে একদম…. সামির বাবা বলছিল ও আউট অব সেন্স। ওখান থেকে বেরিয়েছে আরো অনেক আগে। দুপুর সোয়া বারোটার দিকে। এখনো ওর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। তোর চাচীকে কল করেছিলাম। এতক্ষণ রিং হয়েছে ওর নাম্বারে। আধঘন্টা ধরে সুইচড অফ। সন্ধ্যা হয়ে এল। তোর বাবা বেরিয়েছে এখন। তোর চাচাকে সঙ্গে নিয়ে খোঁজ করবে ওর। কোথায় আছে কে জানে!”

    আঁতকে উঠলো নবনী। কাঁপা হাতে মোবাইল নিয়ে অমিতের নাম্বারে দিশেহারা হয়ে বারবার কল করছে সে। সুইচড অফ, তবুও কল করছে। নাতাশার হঠাৎ মনে পড়লো সাব্বিরের কথা। সে কি জানে তার বন্ধুর খবর। তড়িঘড়ি করে সাব্বিরের নাম্বারে ডায়াল করলো সে।

    সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত বাড়ছে। বাদলা দিনেও পথে গাড়ির কমতি নেই। প্রতিদিনের মতন আজও এই পথে অসংখ্য গাড়ি আসছে, যাচ্ছে। ঢাকার দিকে বৃষ্টি থেমে গেলেও মেঘনা ব্রিজে এসে পৌঁছুতে পৌঁছুতে বৃষ্টির গতি বাড়লো। শরীর অবশ হয়ে আসছে অমিতের। নিঃশ্বাস নিতে পারছে না সে। শরীর কাঁপছে না আর। সাদা থেকে ধীরে ধীরে নীল বর্ণ ধারণ করছে। গায়ে আর ন্যূনতম শক্তি নেই। জিহ্বা জড়িয়ে গেছে। মনে হচ্ছে যেন কথা বলার ক্ষমতাও হারিয়েছে সে। সকাল থেকে থেমে থেমে চোখে ঝাপসা দেখলেও এখন আর চোখে স্পষ্ট কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। ব্রিজের উপরে সবকয়টা লাইট জ্বলছে না। কোনোটা একবার জ্বলছে নিভছে আবার কোনোটা একেবারে বন্ধ। গাড়ির হেডলাইটেই আলোকিত হয়ে থাকছে গোটা ব্রিজ। হঠাৎ ব্রিজের ঠিক মধ্যেখানে ব্রেক কষলো অমিত। চোখজোড়া ঝাপসা, ব্রিজের রেলিংয়ের ওদিকটায় পেছনের গাড়ির হেডলাইটের আলো পড়েছে। সেই আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে নবনীকে! কাঁদা মাখানো খালি পায়ে টলতে টলতে বেরিয়ে এল সে। নবনীর কাছে পৌঁছুবার আগেই রাস্তায় ঢলে পড়লো অমিত। আশপাশের গাড়িগুলো থেমে গেল তক্ষুনি। হৈ চৈ লেগে গেল ঝুম বৃষ্টির মাঝে ব্রিজের এই জায়গাটায়।

    ৫৮

    সম্ভাব্য সব জায়গায় খুঁজে সাব্বির, শফিক আর এরশাদ সাহেব হতাশ হয়ে রাত নয়টার দিকে বাসায় ফিরছিল তখনই কল এল এরশাদ সাহেবের নাম্বারে। কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে জানালো,

    — “কাঁচপুর হাইওয়ে পুলিশ স্টেশন থেকে বলছি। আপনি ইশতিয়াক রহমানের বাবা বলছেন?”

    — “জি।”

    — “আপনার ছেলেকে অসুস্থ অবস্থায় মেঘনা ব্রিজ থেকে গাড়িসহ উদ্ধার করা হয়েছে। উনার অবস্থা আশংকাজনক। এখানকার লোকাল হসপিটাল থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ঢাকা মেডিকেল পাঠানো হচ্ছে। ইতিমধ্যে হয়তো পৌঁছে ও গেছে। আপনারা হসপিটালে যোগাযোগ করুন।”

    — “কী হয়েছে ওর?”

    — “সঠিকভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না। আপনারা ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলুন।” এরশাদ সাহেবের গলার স্বরে শফিক আর সাব্বিরের বুঝতে বাকি রইলো না অমিতের কোনো খারাপ সংবাদ এসেছে। সাব্বির রাস্তার একপাশে গাড়ি থামিয়ে চেয়ে রইলো এরশাদ সাহেবের দিকে।

    — “অমিতকে মেঘনা ব্রিজের উপর থেকে উদ্ধার করেছে বললো। অবস্থা ভালো না। ঢাকা মেডিকেল নাকি শিফট করছে। কী হলো ওর!”

    এক মুহূর্ত দেরী না করে গাড়ি ঘোরালো সাব্বির। রুমানাকে কল করে বললো,

    — “তোমার হসপিটালে এসো। অমিতকে নিয়ে আসছি আমি।”

    — “কী হয়েছে ওর? সুইসাইড এটেম্পট?”

    — “জানি না। তোমার বাবাকে খবর দাও। হসপিটালে আসতে বলো। উনার কাছে অমিতের ট্রিটমেন্ট হবে।”

    — “আরে হয়েছেটা কী? সমস্যা বুঝে তারপর স্পেশালিস্ট ডাকতে হবে।”

    — “তোমার বাবা অ্যাক্সিডেন্ট কেইস সামলাতে পারবে না?”

    — “পারবে। অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে?”

    — “জানি না। তুমি উনাকে আসতে বলো। অমিতকে দেখে উনি অন্তত বুঝতে তো পারবে সমস্যা কোথায়, ট্রিটমেন্ট কী হতে পারে। কোন ডক্টরের কাছে রেফার করলে ভালো হবে। পারবে না?”

    — “হ্যাঁ।”

    — “উনাকে হসপিটালে আসতে বলো প্লিজ!”

    এরশাদ সাহেবকে একমনে দোয়া পড়তে শোনা যাচ্ছে। এখনো ভেঙে পড়েননি তিনি। মন শক্ত করে আছেন। কিন্তু গা ছেড়ে বসে আছেন শফিক সাহেব। মনে প্রাণে ধরেই নিয়েছেন অমিতের অ্যাক্সিডেন্টই হয়েছে। চোখের সামনে পুরোনো সেই দিন ভাসছে। সামি এভাবেই রোড অ্যাক্সিডেন্টে চলে গিয়েছিল। এবার কি তবে এই ছেলেটাও…

    বাসা তালা দিয়ে সপরিবারে অমিতের বাসায় এসেছেন নীতু। শামীমাকে সবাই ঘিরে থাকলেও নবনী যাচ্ছে না তার সামনে। লজ্জায় মুখ আড়াল করে অমিতের ঘরে বসে আছে নবনী। আলমারি খুলে ওর কাপড়গুলো, ওর প্রসাধনীগুলো, হাতঘড়িটা ছুঁয়ে দেখছে নবনী। এই ছেলেটার এত বেশী তীব্র অভাব অনুভূত কেন হচ্ছে আজ? মনে হচ্ছে যেন এই পৃথিবীর কোথাও অমিত নেই। তার সঙ্গে শেষ দেখা হয়ে গেছে আজ সকালে। তাকে শেষবারের মতন স্পর্শ করাও হয়ে গেছে। আর কখনো দেখা হবে না দু’জনের। গোটা পৃথিবীটা এলোমেলো করে কান্না পাচ্ছে নবনীর। কথায় কথায় একবার বলেছিল অমিত, আমার মাঝেমধ্যে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে হয়। কী ভেবে যেন বারবার রয়ে যাই সবার মাঝে। কিন্তু জানো? যেদিন হারাবো সত্যি সত্যি হারাবো। আর ফিরবো না। তবে কি অমিত সত্যিই হারিয়ে গেল? অমিতের বালিশে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিলো নবনী। অভিযোগ করে বলতে লাগলো, “এভাবে উধাও হয়ে যাওয়ার মানে কী, অমিত? ভয়ে জান বেরিয়ে যাচ্ছে আমার। এভাবে শাস্তি দিবে তুমি আমাকে?”

    হঠাৎ কোত্থেকে নাতাশা এল ঘরে। নবনীর হাত টানতে টানতে বের করে নিয়ে যাচ্ছে ওকে।

    — “কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস আমাকে?”

    — “হসপিটালে। অমিত ভাইয়াকে হসপিটাল নিয়ে যাচ্ছে। জলদি নিচে নামো। আমি বাসায় তালা দিয়ে আসছি।”

    থমকে দাঁড়ালো নবনী। ভীতস্বরে বললো,

    — “কী হয়েছে ওর?”

    — “জানি না সঠিক। তবে অবস্থা খারাপ।”

    এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না নবনী। লিফটের জন্য অপেক্ষা না করে সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নিচে নামছে সে।

    .

    আটতলায় অমিতকে ভি আই পি কেবিনে শিফট করা হয়েছে। শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে সাব্বির, শফিক আর এরশাদ সাহেব। বাসা থেকে এখনো কেউ এসে পৌঁছায়নি। ছেলের অক্ষত শরীরটা দেখে এরশাদ সাহেব কিছুটা নিশ্চিন্ত হলেও পরমুহূর্তেই চোখে পড়লো তার নীল বর্ণের বরফ হওয়া শরীরটা। মন শক্ত রাখা দায় হয়ে যাচ্ছে, তবুও তাকে রাখতে হবে। স্ত্রীকে সামলানোর জন্য হলেও নিজেকে সামলে রাখতে হবে।

    ভেতর থেকে বেরিয়ে এল রুমানা। তার চেহারা পড়তে অসুবিধা হচ্ছে না সাব্বিরের। ভালো সংবাদ নিয়ে আসেনি নিশ্চয়ই!

    — “খবর কী?”

    — “হাইপোথার্মিয়া।”

    — “এটা কী?”

    — “বডি টেম্পারেচার বিলো এইটি এইট ফারেনহাইট। এ্যান্ড ইট’স ডেঞ্জারাস। তবুও ভালো মডারেট লেভেলে আছে। এখনো সিভেয়ার লেভেলে যায়নি। কার্ডিয়াক এরেস্টে মারা যেত নয়তো। অলমোস্ট ৮-১০ ঘন্টা ভেজা কাপড়ে ছিল। দেখে মনে হচ্ছে বৃষ্টিতে ভিজেছে অনেকক্ষণ। তার উপর বাইরে ঠান্ডা বাতাস। জেনারেলি কোল্ড ওয়েদারের চেয়ে এই সমস্যাটা লং টাইম ভেজা কাপড়ে, স্যাতস্যাতে বাতাসে থাকার কারণে বেশি দেখা দেয়। তারউপর বিপি লো ছিল ওর। এটাও রিস্ক ফ্যাক্টর। যাদের ব্লাড প্রেশার লো তাদের অ্যাটাক করার চান্স বেশি থাকে।”

    এগিয়ে এলেন এরশাদ সাহেব। এই ব্যাপারে বিশেষ কোনো ধারণা তার নেই। রুমানাকে জিজ্ঞেস করলেন,

    — “আমাকে বলো তো মামণি ওর শরীরে সমস্যা এখন মূলত কী হচ্ছে? টেম্পারেচার লো হলে কী কী হতে পারে?”

    — “ওর পালস রেট, রেসপিরেটরি রেট দুটোই এ্যাবনরমাল। সাধারণত অতিরিক্ত ঠান্ডায় শরীর কাঁপে। কিন্তু ওর কাঁপছে না আপাতত। এটা গুড সাইন না। দ্যাট মিনস ওর ইন্টারনাল ফাংশন কাজ করছে না প্রপারলি। এই সমস্যায় এমনই হয়। সার্কুলেশন, বডি অর্গান কাজ করা বন্ধ করে দেয় ধীরে। শ্বাসকষ্ট হয়। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। মেমরি পাওয়ার লস হয়। আরো কিছু কমপ্লিকেশনস আছে। তবে পালস রেট কমে আসা বা বড়ি অর্গান এক্টিভিটি প্রোপারলি ওয়ার্ক না করার ব্যাপারটা বুঝতেই পারছেন?”

    — “আমার ছেলে বাঁচবে?”

    — “বাঁচবে না কেন?”

    — “সোজাসাপটা বলো আমাকে। সত্যিটা বলো। কথা লুকানোর কিছু নেই। ও কি বাঁচবে?”

    — “আব্বু আছে ভেতরে। দেখছে ওকে। বেস্ট ট্রিটমেন্ট ওকে দেয়া হবে।”

    — “আমি জানি তোমার বাবা বেস্ট মেডিসিন এ্যান্ড কার্ডিওলজি স্পেশালিষ্টদের একজন। উনি উনার বেস্টটাই দিবেন। কিন্তু অমিতের শরীর তো সায় দিতে হবে। ওর কপালে হায়াত থাকাও জরুরি। তুমি ছিলে ভিতরে, দেখেছো ওকে। বলো আমাকে, বাঁচবে ও?”

    সাব্বিরের দিকে অসহায় ভঙ্গিতে তাকালো রুমানা। শফিক সাহেব এরশাদকে এক প্রকার জোর করে এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে গেলেন। হাত কামড়ে কান্নার শব্দ আড়াল করছেন তিনি। এত যন্ত্রণা ভুগে তার ছেলেটা মরে যাবে? সাব্বিরের চোখে পানি ছলছল করছে। রুমানা তার পিঠে হাত বুলিয়ে বললো,

    — “নেক্সট তিন চারঘন্টা ক্রিটিকাল। হোপফুলি কন্ট্রোলে আনা যাবে। সমস্যা হচ্ছে অমিত ইমিডিয়েট ট্রিটমেন্ট পায়নি। বিলোও নাইনটি ফাইভ হলেই প্রপার স্টেপস নিতে হয়। ধুপ করে তো আর এইটি এইট হয়নি, ধীরে ধীরে হয়েছে। তার উপর কোথাকার কোন হসপিটালে নিয়েছে ওখানে ওরা কোনো চিকিৎসাই দেয়নি ওকে। জাস্ট একটা কম্বল পেঁচিয়ে, মুখে অক্সিজেন দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। ওখান থেকে আবার এখানে নিয়ে এলে টাইম ওয়েস্ট হলো না আরো! আচ্ছা তুমি ওকে কোত্থেকে নিয়ে এলে?”

    — “ঢাকা মেডিকেলে পাঠিয়েছিল। মেডিকেলে পৌঁছাবার আগেই আমি পৌঁছে গেছি। গেইট থেকে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে এসেছি এখানে।”

    — “আচ্ছা! থাকো এখানে। খেয়াল রেখো হসপিটালে যেন বেশি কেউ না থাকে। আর আঙ্কেল আন্টিকে সামলে নিও। নবনী জানে?”

    — “হ্যাঁ। আসছে ও।”

    — “ওকে সাবধানে। কোনো অবস্থাতেই আমার পেশেন্টের কন্ডিশন যেন খারাপ না হয়।”

    — “তুমি চলে যাচ্ছো?”

    — “একটু নিচে যাচ্ছি, কাজ আছে। আধঘন্টার মধ্যেই আসছি আমি। আর বাবা আছে ভেতরে। তোমার বিরাট ফ্যান আমার বাবা। তুমি কান্নাকাটি করে একটা আবদার করেছো, মনে হয় না তোমার বন্ধু ডেঞ্জার ফ্রি হওয়ার আগ পর্যন্ত বাবা আর এখান থেকে বেরোবে।”

    সাব্বিরের গালে আলতো হাত বুলিয়ে মুচকি হাসলো রুমানা।

    রুমানা বেরিয়ে যেতেই এখানে এসে পৌঁছালো সবাই। নবনী এক প্রকার দৌড়ে এল সাব্বিরের কাছে। হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করলো,

    — “কী হয়েছে অমিতের?”

    .

    বরফের পাহাড়চূড়ায় নিজেকে আবিষ্কার করলো অমিত। ঠিক চোখের কাছে অনেকগুলো সূর্য। কী কড়া রোদ ইশ্! চোখ মেলা যাচ্ছে না। ঐ তো শেষ সূর্যটার পরেই নবনী দাঁড়িয়ে! হাসছে, খিলখিল করে হাসছে। পিটপিট চোখে অমিত আপ্রান চেষ্টা করছে নবনীকে দেখার। প্রায় অবশ হয়ে আসা হাতটা বাড়িয়ে দিতে চাইছে নবনীর দিকে। হচ্ছেই না! কান্না পাচ্ছে অমিতের। ভাঙা কণ্ঠ, জড়ো জিহ্বায় নবনীকে ডাকলো সে, কাছে আসো না নবনী? চোখ মেলতে পারছি না। এতগুলো সূর্য কেন মাথার উপর? আমাকে ছায়া দাও। হাসছো কেন? কষ্ট হচ্ছে আমার! এ্যাই নবনী!

    .

    স্তব্ধ হয়ে দেয়ালে গা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো নবনী। ওকে শক্ত করে আঁকড়ে রেখেছে নাতাশা। ওয়েটিং রুমে শামীমা নীতুর কাঁধে মাথা রেখে কাঁদছে। অনি, জামিলা বেগম আর নীতুকে বারবার করে বলছে,

    — “নবনীকে বলো না, আমার ছেলেটার পাশে গিয়ে বসতে। ওকে পেলেই আমার অমিত সুস্থ হয়ে যাবে। খট করে কেবিনের দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন রুমানার বাবা, ডক্টর হাবিবুল্লাহ খান। সাব্বিরকে ডেকে বললেন,

    — “রুমানা কোথায়?”

    — “বেরিয়েছে একটু।”

    — “অমিত ওর ওয়াইফকে দেখতে চাচ্ছে।”

    — “জ্ঞান ফিরেছে?”

    — “আসছে যাচ্ছে। হ্যালুসিনেশন হচ্ছে ওর। এই সিচুয়েশনে হয় এমন। নবনীকে দেখছে,ওকে কাছে ডাকছে। ভাবছি একবার ভেতরে আসতে বলবো কি না। একটু দেখা হোক দু’জনের। তাই রুমানাকে খুঁজছি। ওর পেশেন্ট আমার পেশেন্টকে দেখতে পারবে কি না, কোনো সমস্যা হবে কি না সেটা ওর সঙ্গে ডিসকাস করতে হবে। রুমানা এলে ভেতরে পাঠিয়ে দিও।”

    সাব্বির আর শ্বশুরের কথোপকথনের সময় দরজার ফাঁক দিয়ে অমিতকে দেখছিল নবনী। অমিতের ফ্যাকাশে মুখ, অক্সিজেন মাস্ক দেখেই মাথাটা বাজেভাবে ঘুরিয়ে উঠলো। নিঃশ্বাস আটকে আসছে নবনীর। পায়ের তাল সামলে দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। নাতাশাকে ধরে দাঁড়িয়ে রইলো ও। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল মুহূর্তেই। নাতাশা জিজ্ঞেস করলো,

    — “ঠিক আছো তুমি?”

    দৃঢ়ভাবে ডানে বামে মাথা নেড়ে কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে এল নবনী। কান বন্ধ হয়ে আসছে তার। পাশ থেকে নাতাশা, সাব্বির ডাকছে ওকে। কারো ডাক কানে পৌঁছাচ্ছে না ওর। গন্তব্যহীন হাঁটছে নবনী। এখান থেকে পালাতে হবে ওকে।

    .

    বাসায় ফিরে এসেছে নবনী। ভয়ে পুরো শরীর কাঁপছে তার। প্রচন্ড অপরাধবোধে মাথার ভেতরটা বুঝি ফেটে যাচ্ছে। অমিতের মাস্ক লাগানো ফ্যাকাশে মুখটা এক মুহূর্তের জন্যও চোখের সামনে থেকে সরছে না। তীব্র কষ্টে অঝোরে কাঁদছে সে। যাকে একদিন এত চোখেচোখে রেখেছিল যেন নিজের কোনো ক্ষতি না করতে পারে সেই ছেলেটা কিনা আজ তারই জন্য মরতে বসেছে? এই পীড়া, আফসোস সে রাখবে কোথায়? কে বুঝবে? অমিত যদি মরে যায় তাহলে কি সে অমিতের খুনী হবে না? কী জবাব দিবে চাচীকে? কিংবা সে নিজেই কেমন করে মেনে নেবে? যাকে ছাড়া একদিন টিকে থাকাই মুশকিল হয়ে যাচ্ছে তার চিরপ্রস্থান কেমন করে সয়ে যাবে সে? বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা লাগছে! জীবন থেকে অমিত হারিয়ে যাচ্ছে। তার সবচেয়ে কাছের মানুষটা, সঙ্গীটা চলে যাচ্ছে তাকে একা করে। শরীর অসার হয়ে আসা কষ্টে কান্নার শব্দ ধীরে ধীরে বাড়তে লাগলো। চিৎকার করে নাতাশাকে বলতে লাগলো,

    — “অমিত চলে যাচ্ছে নাতাশা। ওকে আমি কষ্ট দিয়েছি। অসম্ভব সরল ছেলেটাকে আমি মরণের পথে ঠেলে দিয়েছি। আর কোনো কাছের মানুষের মৃত্যু আমি দেখতে চাই না। কী হাল করেছি আমি ওর! আমার শাস্তি কী?”

    নবনীকে স্বান্তনা দেবার মতো মানসিক জোর নাতাশার নেই। অমিতকে দেখেছে সেও। সেই থেকে ক্লান্ত লাগছে ভীষণ। ইচ্ছে হচ্ছে দরজা জানালা আটকে ফ্লোরে পা ছড়িয়ে বসে কাঁদতে। প্রিয় মানুষগুলোরই কেন এমন করুন পরিস্থিতি হবে সবসময়? কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠেছে নবনীর। পানির জগ নিতে রুম থেকে বেরিয়েছে নবনী তখনই বাসার কলিংবেল বাজলো। দারোয়ান এসেছে। নাতাশা দরজা খুলতেই তার হাতে একটা ব্যাগ ধরিয়ে বললো,

    — “পাশের বাড়ি থেকে সুমনা আপা আসছিল। বললো আপনাদের নাকি কল দিছে অনেকবার, কেউই কল রিসিভ করেন না! আপা আজকে শ্বশুরবাড়ি চইলা গেছে। ঐখান থেকে ডাইরেক বিদেশ। এদিকে আর আসবে না। আমারে বললো, এইটা খুব জরুরি জিনিস, নবনী আপারে দিতে। আর হ্যাঁ, এইটা যেন সে ছাড়া আর কেউ না খুলে। আপারে দিয়া দিয়েন এইটা।”

    দারোয়ান চলে যেতেই প্যাকেট খুলতে লাগলো নাতাশা। কৌতূহল সংবরন করতে পারেনি সে। চমকে গেল নাতাশা। সামির ডায়েরি প্যাকেটের ভেতর! যদিও ডায়েরি লেখার অভ্যেস কখনো তার ছিল না। কিন্তু টেবিল ভর্তি নানা রকম ডায়েরি সাজানো থাকতো। কী আছে ডায়েরিতে? এতবছর পর হঠাৎ এটা কেন? অজস্র কৌতুহল মনে জমা হলো ঠিকই কিন্তু প্রশ্রয় দিলো না সে। যাকে এটা দেয়া হয়েছে তার হাতেই তুলে দিলো নাতাশা। বললো,

    — “চিনেছো এটা?”

    অবাক চোখে নাতাশার দিকে তাকালো নবনী।

    — “এটা কোথায় পেলি?”

    — “সুমনা আপু দিয়েছে। পড়ো।”

    নবনীর একহাতে ডায়েরি অন্যহাতে পানির গ্লাস দিয়ে বেরিয়ে এল নাতাশা। একান্তে বসে পড়ুক নবনী। কে জানে এখানে হয়তো জাদুর কাঠি আছে যা কিনা পুরো ঘটনার মোড়টাই বদলে দিবে!

    তাড়াহুড়ো করে চোখের পানি মুছে ডায়েরিটা খুললো নবনী। প্রথম কয়েক পৃষ্ঠা পুরোপুরি সাদা। ৮-১০ পৃষ্ঠা পর সামির লেখা পাওয়া গেছে। নিঃশ্বাস আটকে পড়তে লাগলো সে।

    ‘এক সপ্তাহ বাদে বিয়ে। আমাদের সবচেয়ে আকাঙ্খিত দিন জীবন দুয়ারে চলে এসেছে। হুলস্থুল করে পুরো বাসা আমার মাথায় চড়ানোর কথা। অথচ আমি খুশি না। হতে পারছি না আমি। সবকিছু ঠিকঠাক আগাচ্ছে, দুই পক্ষের কখনো কোনো আপত্তি ছিল না। নবনী আমার মাঝে কখনো দ্বন্দ্ব ছিল না, আজও হচ্ছে না। বিয়ের প্রতিটা সিদ্ধান্ত দুই পরিবার দুই পরিবারের খুশির কথা মাথায় রেখে নিচ্ছে। এতটা ঝামেলাহীন বিয়ে কারো হয়? আমার হচ্ছে, তবুও আমি খুশি না। মনে মনে খুব ভয় হচ্ছে, এই বিয়েটা হবে না। আমাদের বিয়েটা হবে না নবনী। আমাদের আলাদা হবার সময় কাছাকাছি চলে এসেছে। সারাক্ষণ কী মনে হয়, জানো? আমি আর বাঁচবো না। মারা যাবো। হয়তো! খুব স্ট্রং ফিল পাই। জানি আমার কোনো অসুখ নেই। সেদিন রাতে জাস্ট একটা স্বপ্ন দেখেছি মাত্র। অন্য কারো সঙ্গে তোমার সংসারের স্বপ্ন। সেই থেকে আমি আর একটাদিনের জন্যও শান্তি পাচ্ছি না। অনেক কথা, অনেক ভয় মনের ভেতর লুকিয়ে রাখছি। কাউকে বলতে পারছি না। সবাই হেসে উড়িয়ে দিবে না বলো? তুমি আমাকে সবসময় বুঝো, জানি আমি। তবুও কেন জানি না আমি এই কথাগুলো তোমার সঙ্গেও শেয়ার করতে পারছি না। তোমাকে ছেড়ে চলে যাব, আমাদের আর কখনো দেখা হবে না, কথা হবে না ভাবতেই কেমন অসহ্য যন্ত্রণা হয়। তোমার অন্য কারো সঙ্গে সংসার হবে সে কথা ভাবতেই সবকিছু কেমন এলোমেলো লাগে। আমি কি মানসিক রোগী হয়ে গেছি? আমার জীবনে কোনো সমস্যা নেই। তুমি আছো, মিষ্টি দু’টো পরিবার আছে, স্বচ্ছলতা আছে, দেশের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সার্টিফিকেট আছে। বেকারত্ব কী জিনিস, বুঝিনি। পড়া হওয়া শেষ হওয়া মাত্র বাবার ব্যবসা সামলাচ্ছি। আমার কোনো অভাব নেই। এক জীবনে সুখে থাকার জন্য যা কিছু প্রয়োজন সব আমার আছে, তবুও পৃথিবীর সবচেয়ে অসুখী মানুষটা এখন আমি। আচ্ছা অনেক সুখে কি মানুষ মানসিকভাবে অসুস্থ হয়? কী জানি! অদৃশ্য কিছু একটার সঙ্গে আমার যুদ্ধ চলছে। যে সারাক্ষণ আমাকে ভয় দেখাচ্ছে, আমি মারা যাবো। তুমি আমার কাছ থেকে আলাদা হয়ে যাবে। তবে ভয়টা আমি আজ সকালে জয় করে ফেলেছি নবনী। এতদিন শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবছিলাম স্বার্থপরের মতো। তোমার কী হবে ভাবিইনি! মরে গেলে পৃথিবীর সব বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে তবেই যাব। কিন্তু তুমি তো থেকে যাবে, এইসব মায়া আর বন্ধনের মাঝে। আমার স্মৃতির মাঝে। তুমি কেমন করে বাঁচবে তখন? একটাদিনও থেকেছো কখনো আমাকে ছাড়া এতগুলো বছরে? সেই আমাকে ফেলে আমৃত্যু জীবন কাটাতে হবে, কষ্ট হবে না বলো? মরে টরেও যেতে পারো। তোমাকে দিয়ে বিশ্বাস নেই। তারপর মনে হলো এবার আমার একটু উদার হওয়া উচিত। শোনো রোদ্দুর, খুব কঠিন কিছু বলতে যাচ্ছি এবার। মন দিয়ে পড়বে। আর তারচেয়ে বড় কথা আমার এই কথাগুলো তোমাকে মানতে হবে। এটা আমার আবদার না, দাবি। জীবনে অনেক কিছু ঘটে। সবকিছু কি আর আমাদের হিসেবে হয়? উপরওয়ালার একটা সিদ্ধান্ত আছে না, বলো? সবশেষে উনার সিদ্ধান্তই শেষ সিদ্ধান্ত। এক জীবনে ভালো হবে, মন্দ হবে এবং সেটা আমাদের মেনে নিতে হবে। কেন হলো, এটা হলে কী হতো, ওটা হলে কী হতো না এত হিসেব নিকেশে না যাওয়াই ভালো। জীবন সহজ হবে। আমি চলে যাবার পর তুমিও এত হিসেব নিকেশে যেও না। মেনে নিও। ধরে নিও আমাদের সম্পর্কের পূর্ণতা ভাগ্যবিধাতা ভাগ্যেই লিখেননি। আমাদের একসাথে পথ চলা এপর্যন্তই ছিল। এরপর থেকে বাকি পথটা অন্য কারো সঙ্গে তোমার চলতে হবে। একই সুতোয় অন্য কারো সঙ্গে বাঁধা পড়বে তুমি। এমনটাই হয়তো ভাগ্য বিধাতা চেয়েছেন। জানি তুমি এখন এই লাইনগুলো পড়ে রেগে যাচ্ছো। ভ্রুর মাঝে হাজারটা ভাঁজ পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমার কথা শোনো মেয়ে। জীবনটা না এমনই! একজীবনে সবাই সবকিছু পায় না। বড় কোনো চাওয়া অপূর্ণ থাকেই। আমাদের বেলায় আমরা দু’জন দু’জনকে হারাবো, এটাই আমাদের অপ্রাপ্তি, আফসোস। দুর্ভাগ্যবশত সবচেয়ে বড় চাওয়াটাই আমরা পাচ্ছি না। কী আর করা বলো! উপরওয়ালার সিদ্ধান্তের বাইরে কে কবে যেতে পেরেছে? আমাকে হারাবার কষ্ট তুমি কখনো ভুলবে না সে কথা আমি জানি রোদ্দুর। তাই বলে সারাজীবন আমাকে নিয়েই পড়ে থেকো না। শুনেছি, সময়ের সাথে সাথে কষ্টগুলোও নাকি ফিকে হতে থাকে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। আর বছরখানেক বাদে যখন আমাকে হারাবার কষ্ট একটুখানি সেরে যাবে নিজের জীবনটা তখন সাজিয়ে নিও। যদি কখনো, কেউ একজন এক সমুদ্র ভালোবাসার আর্জি নিয়ে তোমার সামনে এসে দাঁড়ায় তাকে ফিরিয়ে দিও না। দু’হাতে আঁজলা করে তার ভালোবাসাটুকু নিও। তাকে আঁকড়ে রেখো। আমার দোহাই দিয়ে তাকে দূরে সরিয়ে দিও না। শুনেছি মানুষ মারা যাবার পরও নাকি প্রিয় মানুষদের দেখতে পায়। আমিও তোমাকে দেখবো কিন্তু! যদি কখনো দেখি আমার কারণে তুমি তোমার জীবনটা এক জায়গাতেই আটকে রেখেছো তাহলে কিন্তু খুব কষ্ট পাবো। ভীষণ অভিমান হবে আমার। তোমার জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে জানো! আমার সঙ্গে সঙ্গে তুমিও মরে যেও না কিন্তু। বেঁচে থেকো প্লিজ। আনন্দে, হাসিতে যেমনটা তোমাকে রেখে যাচ্ছি। আর আবারও মনে করিয়ে দিচ্ছি, আমি তোমাকে রিকুয়েস্ট করিনি। এটা আমার দাবি। ভালো থেকো রোদ্দুর। যতটা ভালো আমি তোমাকে দেখতে চাই ঠিক ততটা।’

    .

    ডায়েরীর লেখাগুলো ছুঁয়ে দিচ্ছে নবনী। সামির হাতের টানা টানা লেখা। কয়েক জায়গায় দুই চারটা শব্দের কালি পানি লেগে ছড়িয়ে গেছে। চোখের পানি হয়তো! সামি লেখার সময় কাঁদছিলো হয়তো! ডায়েরীর পাতা উল্টাতে লাগলো নবনী। আরো কিছু কি লেখা আছে তাতে? ডায়েরীর পেছনের মলাটে চোখ পড়লো ওর। সেখানে সাদা কাগজ আঠা দিয়ে লাগানো। কাগজে লেখা আছে, বালিশের নিচে ডায়েরিটা রেখে যাচ্ছি। আমি চলে যাবার পর যে আমার বিছানা গোছাতে আসবেন প্লিজ এই ডায়েরীটা নবনীর হাতে তুলে দেবেন।’ ডায়েরিতে মুখ গুঁজে আবারও অঝোরে কাঁদতে লাগলো নবনী। তার চোখের পানিতে ভিজে যাচ্ছে ডায়েরির মলাট।

    — “কত কাঁদো তুমি! ক্লান্ত লাগে না? বিরক্তি ধরে আসে না?”

    লাফিয়ে উঠলো নবনী। কান্না থেমে গেল এক মুহূর্তেই। অবাক চোখে চেয়ে রইলো সামনের চেয়ারে।

    — “তুমি!”

    — “না এসে উপায় আছে? যা ঝামেলা বাঁধিয়েছো না! কে সামলাবে তোমাকে? যে সামলে নিতে চেয়েছিল তাকে তো হসপিটাল পাঠিয়ে দিলে। এখন বাসায় বসে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদছো। তুমি এমন কাঁদুনি হলে কবে থেকে, বলো তো? কান্না ছাড়া আর কিছুই পারো না। বিরক্তিকর! নাক থেকে সর্দিও বেরুচ্ছে! মুছো শিগগির। “ ধমকে উঠলো সামি। তাড়াহুড়ো করে টিস্যু নিয়ে নাক চোখ মুছতে লাগলো নবনী।

    — “তুমি এতদিন কোথায় ছিলে? কেন আসোনি তুমি? কত খুঁজেছি তোমাকে!”

    — “কেন খোঁজো আমাকে?”

    — “রেগে আছো আমার উপর? বিশ্বাস করো সামি, কোনো প্রতারণা আমি করতে চাইনি তোমার সঙ্গে। কিভাবে যে কী হয়ে গেল!”

    — “এ্যাই, খবরদার উল্টাপাল্টা বকবে না। আমি একবারও বলেছি তুমি প্রতারণা করেছো?”

    — “তাহলে আসোনি যে!”

    চেয়ার ছেড়ে উঠে এলো সামি। নবনীর পাশে বসে বললো,

    — “তোমাকে সামলে নেবার, দেখে রাখার মানুষ যে এখন আছে!”

    — “এভাবে বলো না।”

    — “কেন বলবো না? তোমার একজন মানুষ আছে যে তোমাকে আগলে রাখতে চায়, তোমার সোলমেট হতে চায়, নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতে চায় এটা কি অপরাধ? একদম না। বরং সুন্দর। কিন্তু তুমি যা করছো সেটা অপরাধ। অকারণ অপরাধবোধে অন্ধ হয়ে নিজের ভালোবাসা আড়াল করছো, অমিত মেনে নিতে পারবে না জেনে বুঝেও ওকে দূরে সরিয়ে দিয়েছো। কিসের প্রতারণা? কিসের এত অপরাধবোধ বলো তো? আমি কি কখনো তোমাকে বেঁধে রাখতে চেয়েছি? আমি সবসময় চেয়েছি তুমি অতীত থেকে বেরিয়ে আসো। বাঁচো, ভালো থাকো। যাকে তোমার ভালো লাগবে, যে তোমাকে ভালোবাসবে তার সঙ্গে জীবন সাজাও। তবুও কেন বারবার বলছো প্রতারণা করেছো তুমি আমার সঙ্গে? অমিতকে ভালোবাসো তুমি বোকা মেয়ে! এই সহজ সত্যিটা মেনে নিতে তোমার এত কিসের দ্বিধা? কেন বারবার তোমাদের মাঝে আমাকে টেনে এনে দাঁড় করাচ্ছো?”

    — “সবাই বলে তুমি কোথাও নেই। আমি যা দেখি সবটাই ভুল। সত্যিই কি তুমি নেই?”

    — “কে বলে আমি নেই? আমি আছি না তোমার স্মৃতি হয়ে? আজীবন থাকবো। তোমার সুন্দরতম অতীতে। আমাকে অতীত হয়েই থাকতে দাও। আর হসপিটালের বেডে যাকে ফেলে এসেছো তাকে বর্তমান আর ভবিষ্যৎ হয়ে থাকতে দাও।”

    • ………………..

    — “যেই মানুষটা আর নেই তার জন্য জীবিত একটা মানুষকে শেষ করে দিবে তুমি? তোমাকে ভালোবাসার অপরাধে? কাউকে ভালোবাসলে এভাবে শাস্তি দিতে হয় বুঝি!”

    — “আমি কখনো চাইনি অমিতের এই হাল হোক। তুমি অন্তত আমাকে বুঝো!”

    — “বুঝি। তুমি কষ্ট পাচ্ছো বলেই তোমাকে দেখাচ্ছি তোমার ভুলটা কোথায় হলো, সংশোধন কেমন করে হবে। তুমি আমাকে ভালোবাসতে নবনী। এখন তুমি অমিতকে ভালোবাসো। এটাই সত্যি আর তাতে আমার আপত্তি হওয়ার প্রশ্নই আসে না। প্রতারণার ভূত কেন যে মাথায় চাপলো তোমার কে জানে! ঠিক এই কারণে যতসব ঝামেলা হলো। ছাড়ো সবকিছু। যে চলে গেছে তাকে চিরতরে সমস্ত আবেগ থেকে মুক্তি দাও, যে আছে তাকে তোমার জীবনে সমস্ত আবেগ দিয়ে জড়িয়ে রাখো।”

    — “তুমি চলে যাবে সামি?”

    — “কোথায় আর যাব! আছি তো আমি। তোমার মাঝে, তোমার সুন্দরতম স্মৃতিতে। বললাম না তখন! এবার তুমি যাও নবনী। হসপিটালে পড়ে আছে ছেলেটা। তোমাকে ওর ভীষণ প্রয়োজন।”

    ঘর থেকে বেরিয়ে গেল নবনী। হাসিমুখে ওকে বিদায় দিলো সামি। যে হাসিতে কোনো একসময় নবনী ডুবে মরতো।

    .

    মোবাইল হাতে স্ক্রিনে তাকিয়ে আছে নাতাশা। ঠোঁটের কোণে তার একটুখানি হাসি। সুমনা ম্যাসেজ পাঠিয়েছে অনেক আগেই। চোখে পড়েনি এতক্ষণ। এতটা সময় বাদে চোখে পড়তেই তড়িঘড়ি করে ম্যাসেজটা ওপেন করেছে সে।

    ‘একটা ডায়েরী রেখে যাচ্ছি। আমার ভাইয়ের শেষ কিছু কথা। এতদিন নবনীকে দেইনি। উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায় ছিলাম। এতবছর বাদে সময় হয়েছে। হয়তো এবার এই ডায়েরী একটা ম্যাজিক দেখাবে।’

    ৫৯

    অমিত ঘুমাচ্ছে। বেডের পাশে বসে আছে নবনী। অন্যপাশে শামীমা। ভোরের দিকে ডক্টর হাবিব বেরিয়ে গেছেন কেবিন থেকে। যাবার আগে মিষ্টি হেসে ডক্টর হাবিব বলে গেছেন,

    — “ভালো আছে ও। চাইলে পরশু নাগাদ বাসায় নিয়ে যেতে পারেন।”

    স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো দুই পরিবার। রুদ্ধশ্বাস এক রাতের শেষে নতুন ভোর যেন প্রাণ ফিরিয়ে দিলো তাদের। সবাই বাসায় ফিরে গেছে। হসপিটালে রয়ে গেছে সাব্বির, শামীমা আর নবনী। সাব্বির বাইরে গিয়েছিল চা আনতে। ফিরে এসে শামীমার হাতে চা ধরিয়ে বললো,

    — “একটা সিএনজি ঠিক করে দেই। বাসায় চলে যান আপনি।”

    — “আমার ছেলে আমার সঙ্গে কথা বলবে, ও নিজের মুখে বলবে ভালো আছে। তারপর আমি যাবো।”

    আর কথা বাড়ালো না সাব্বির। কাপ হাতে সোফায় গিয়ে বসলো। চায়ে চুমুক দিতে দিতে নবনীকে দেখছে সে। গতকাল রাত থেকেই দেখছে। চোখেমুখে তীব্র অপরাধবোধ ওর। সঙ্গে কষ্টটাও যেন চোখজোড়া স্পষ্ট পড়া যাচ্ছে। অমিত জেগে উঠার অপেক্ষায় বসে আছে ওর হাতটা ধরে। চলে যেতে চেয়েছিল মেয়েটা দূরে। একেবারে। কিন্তু আবার নিজেই ফিরে এল অমিতের কাছে। অবশ্য ফেরারই ছিল। ভালোবাসা থেকে কে কবে পালিয়ে থাকতে পেরেছে। শুধু শুধু মাঝে পড়ে অমিতটার একদম নাজেহাল অবস্থা হলো। তবুও এক হিসেবে ভালো, নবনী এই ধাক্কায় ফিরে তো এল! নয়তো কতদিন যে সময় লাগতো কে জানে?

    .

    চোখ মেললো অমিত। সামনে নবনী আর মা বসে আছে। নিজের হাতটা খুঁজে পেলো নবনীর হাতের মাঝে। ঠোঁট চেপে ফুঁপিয়ে কাঁদছে নবনী। শামীমা সঙ্গে সঙ্গে উঠে এলেন চেয়ার ছেড়ে। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

    — “শরীরটা ভালো লাগছে বাবা?”

    — “নবনী কি সত্যিই আমার হাত ধরে বসে আছে?”

    — “হ্যাঁ।”

    — “ও কি আবার চলে যাবে?”

    — “নবনীর সাহস আছে তোকে ছেড়ে যাবার? শেকল পরাবো ওকে এবার। কোত্থাও যাবে না ও।”

    — “তাহলে আমি ভালো আছি।”

    ফিক করে হেসে মুখ থেকে চা ফেলে দিলো সাব্বির। জোর করে হাসি চেপে রেখেছেন শামীমা। কপট রাগে সাব্বিরকে বললেন,

    — “চড় লাগাবো কিন্তু! হাসছিস কেন তুই?”

    — “সারারাত অকারণে আমার শ্বশুরকে জাগিয়ে রাখলাম। নবনীকে ওর পাশে বসিয়ে রাখলেই হতো। এমনি এমনি সুস্থ হয়ে যেত আপনার ছেলে।”

    — “আমার ছেলে বলেছে ও ভালো আছে, এবার আমার শান্তি। আমি এখন বাসায় যাবো। কাজ আছে অনেক। আমাকে নিয়ে চল বাসায়। আর এইযে অমিতের ওষুধ তোমাকে বলছি শোনো, এভাবেই আমার ছেলের হাত ধরে বসে থাকবে। নড়বে না একদম! দুপুরে খাবার নিয়ে আসবো আমি। তখন এসে যেন দেখি এখানে এভাবেই বসে আছো।”

    কিছু বললো না নবনী। মাথা নিচু করে বসে রইলো শুধু। সাব্বিরকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন শামীমা। নবনীর দিকে ঘাড় ফেরালো অমিত।

    — “কাঁদছো কেন?”

    — “জানি না।”

    — “আমাকে ভালোবাসো সে কথা জানো? ফিল করতে পারছো?”

    — “জানি না।”

    — “এমনিতে তোমার কান্না আমার পছন্দ না। কিন্তু এখন দেখতে ভীষণ ভালো লাগছে আমার জন্য কাঁদছো তুমি।”

    • …………………………..

    — “সত্যি সত্যি ফিরে এসেছো তো, তাই না? আমাকে ছেড়ে যেতে চাইবে না তো আর কখনো?”

    গলা ধরে এল অমিতের। সঙ্গে সঙ্গে অমিতের বুকে মাথা রেখে তাকে জড়িয়ে বসে রইলো নবনী। বেডের একপাশে সরে গেল অমিত। নবনীর হাতে টেনে নিজের পাশে শুইয়ে একহাতে বুকের মাঝে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ওকে।

    — “অমিত?”

    — “হুম?”

    — “অনেক কিছু বলার আছে তোমাকে। কিচ্ছু গুছিয়ে বলতে পারছি না। তুমি আমার সব কথা বুঝে নেবে প্লিজ!”

    নবনীর মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিলো অমিত। বললো,

    — “আচ্ছা বুঝে নিলাম।”

    .

    কার ড্রাইভ করতে করতে গল্প করছে শামীমা আর সাব্বির। পুরোনো ঘটনা মনে করে দুজনে হাসছে খুব। শামীমা হঠাৎ গল্পের প্রসঙ্গ বদলালেন।

    — “নবনী হঠাৎ কেমন বদলে গেল না?”

    — “হুম।”

    — “গতকাল বাসায় গেল, ফিরে এসে আমার কাছে মাফ চাইলো। অমিতকে ছেড়ে আর কখনো কোথাও যাবে না প্রমিজ করলো। হঠাৎ এমন কেন হলো বল তো? জাদুর কাঠির ছোঁয়া লাগলো নাকি!”

    — “হয় এমন। কারো প্রতি ভালোবাসা জন্মালে আমরা অনেক সময় বুঝতেই পারি না ঐ মানুষটার জন্য ভালোবাসা জন্মেছে। তারপর যখন সাময়িক বিচ্ছেদ আসে কিংবা বড় কোনো ক্ষতি হয় প্রিয় মানুষটার তখন ভালোবাসা বুঝতে পারি। নবনীর বেলায় ঠিক এটাই হয়েছে।

    — “ভালোবাসা এত কঠিনও হয়, জানতাম না। এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হইনি কখনো।”

    — “তবুও ভালো নবনী ফিরে এসেছে। অমিতের সঙ্গে এই সম্পর্কটা মেনে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এবার খালা একটা পার্টি কিন্তু আমি চাই।”

    — “পার্টি কী রে! পুরোদস্তুর বিয়ের আয়োজন করবো আমি। একবার আমার ছেলেটা বাসায় ফিরুক শুধু!”

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleবাইবেল কোরআন ও বিজ্ঞান – মরিস বুকাইলি
    Next Article বাতাসে গুনগুন – খাদিজা মিম

    Related Articles

    খাদিজা মিম

    রুদ্র – খাদিজা মিম

    August 6, 2025
    খাদিজা মিম

    বাতাসে গুনগুন – খাদিজা মিম

    August 6, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.