Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ইট’স কমপ্লিকেটেড – খাদিজা মিম

    খাদিজা মিম এক পাতা গল্প477 Mins Read0

    ইট’স কমপ্লিকেটেড – ৫

    ৫

    গতকাল সাড়ে ছয়টায় বাসা থেকে বেরোবার কথা বললেও, বাবার পীড়াপীড়িতে ভোর সাড়ে পাঁচটায় বাসা থেকে বেরিয়েছে নবনীরা। পথে ব্যস্ততা বেড়ে যাবার আগেই শহর ছেড়ে গাড়ি গ্রামের পথ ধরেছে। বেলা দশটা বাজার আগেই ফুফুর বাড়ির চৌকাঠ পেরিয়েছে ওরা। নাস্তা শেষে পুকুরঘাটে এসে বসেছে নবনী। গুনগুন করতে করতে পুকুরঘাটের ওপাশে আম গাছটায় তাকিয়ে আছে সে। গাছের ডালে পাশাপাশি গা ঘেঁষে বসে আছে দু’টো শালিক। ওদের দেখে নিজের জন্য কেমন মায়া হচ্ছে নবনীর। পাশেই নাতাশা বসে কানে ইয়ারফোন গুঁজে গান শুনছিল। নবনী হাত চেপে ধরলো ওর। বোনের স্পর্শে পাশ ফিরে তাকালো সে। দূরে কোথাও দৃষ্টি তার। কী যেন বলছে! তড়িঘড়ি করে কান থেকে ইয়ারফোন খুলে বললো,

    — “কী বলছিলে আপু? আবার বলো।”

    — “শুনিসনি?”

    — “কানে ইয়ারফোন, শুনবো কী করে?”

    — “অহ্। খেয়াল করিনি আমি।”

    — “এবার বলো?”

    — “ঐ তো শালিক জোড়ার কথা বলছি। দেখতে পাচ্ছিস?”

    পুকুরের ওপারে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে শালিকজোড়া খুঁজতে লাগলো নাতাশা। চোখজোড়া ছোট করে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললো,

    — “হুম, হুম। ঐ তো দেখা যাচ্ছে।”

    — “ওদের দেখে নিজের কথা মনে পড়ে গেল।”

    — “কী কথা?”

    — “এনগেজমেন্টের মাসখানেক পর নানার মৃত্যুবার্ষিকীতে বড় মামা সামিদের দাওয়াত করে নানাবাড়ি নিয়ে গেল না?”

    — “হুম।”

    — “কাঁচা আমের সিজন ছিল।”

    — “হ্যাঁ মনে আছে।”

    — “বাগান থেকে আম পেড়ে ওখানেই ভর্তা মাখানো হলো।”

    — “আর সামি ভাইয়া তোমাকে বললো, গাছে বসে ভর্তা খেলে ভর্তার টেস্ট দ্বিগুন হয়। ভাইয়ার কথা শুনে উনার পেছন পেছন লাফাতে লাফাতে উঠে বসলে আমগাছের ডালে।”

    — “ও মা! মনে আছে তোর?”

    — “আমার সব মনে আছে আপু। সেদিন ভাইয়া এ্যাশ কালার টি শার্ট আর ব্লু জিন্স পরেছিল। আর তুমি পিংক কালার হাতের কাজের থ্রি পিস পরেছিলে। ভাইয়া তোমাকে কানে কানে কী যেন বলছিল একটু পরপর। আর তুমি হেসে কুটিকুটি হচ্ছিলে।”

    নবনীর চোখে আলোর ছটা, ঠোঁটে বিস্তৃত হাসির রেখা। নাতাশা দেখছে তাকে। চোখজোড়া যেন ভীষণ উচ্ছ্বাসে বলছে, তুই মনে রেখেছিস আমাদের গল্পটা! চোখ ফিরিয়ে নিলো নাতাশা। ভেজা চোখ বোনকে দেখাতে চায় না সে। মানুষটা নেই প্রায় আটবছর। তবুও তার কথা মনে পড়লেই ভেতর দুমড়ে মুচড়ে কান্না পায়। কত কত স্মৃতি ঐ মানুষটার সঙ্গে। বাসার কেউ আজও তাকে ভুলতে পারেনি। একদিনের জন্যও না। আর তার বোন! বেঁচে আছে তার রেখে যাওয়া সমস্ত স্মৃতি নিয়ে, কল্পনায় তাকে বাঁচিয়ে রেখে।

    — “কখন এসেছো তোমরা?”

    পেছন ফিরে তাকালো নবনী, নাতাশা। ভ্রু জোড়া নাচিয়ে নবনী বললো,

    — “আহ্! রিনরিনে কন্ঠের রিনি যে! কেমন আছো তুমি?”

    কানে স্বর্ণের ভারী ঝুমকায় হাত বুলাতে বুলাতে রিনি বললো,

    — “আছি, খুব ভালো আছি। তুমি?”

    — “এতক্ষণ খুব ক্লান্ত লাগছিল। এখন তোমাকে দেখে বেশ চাঙ্গা লাগছে। কী সুন্দর সেজেছো! ইশ্! কি মিষ্টি দেখাচ্ছে তোমাকে! কানের ঝুমকা জোড়ায় কত ভরি আছে?”

    — “এক ভরি চার আনা।”

    — “তোমাকে ভীষণ মানিয়েছে।”

    — “হ্যাঁ, বিয়েতে আসবো তাই বর কিনে দিলো।”

    — “কী জাদুসোনা বর তোমার! অবশ্য এত সুন্দর বউ পেলে সব ছেলেরাই জাদুসোনা হয়ে যায়। এইতো দেখোই না, আমাদের নাতাশাকে! ও তো তোমাকে দেখে আর মুখে কথাই ফুটছে না। হা হয়ে দেখছে তোমাকে।”

    — “হ্যাঁ আপু, ও আমাকে খুব ভালোবাসে। এই হাতের বালাগুলোও তো বানিয়ে দিলো বিয়েতে আসবো বলে।”

    — “ওহ্ নো! আমি তো চুড়িগুলো দেখিইনি। গ্রেট মিস।”

    — “চুড়ি না আপু, এগুলো বালা।”

    — “ওহ্ গড! কী মূৰ্খ আমি! কিছুই চিনি না।”

    — “বালা জোড়ায় তিন ভরি আছে।”

    — “অনেক সুন্দর, চমৎকার, ফ্যান্টাস্টিক! আর কয়দিন বাদে আমরা শুনবো রিনির রূপে পাগল হয়ে শাকিল ভাই তাজমহল বানিয়ে ফেলেছে।”

    রিনির পাশে এসে দাঁড়ালো তার মা রাশেদা খানম। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,

    — “হ্যাঁ দেবেই তো। এমন মেয়ে জগত সংসার ঘুরে কেউ কোথাও পাবে নাকি?”

    — “সে কথা তো আমিও বলছি চাচী।”

    — “চল রিনি, খাবি কিছু। তোর ফুফু টেবিলে খাবার দিয়েছে।”

    মায়ের হাত ধরে চলে যাচ্ছে রিনি। নাতাশা একরাশ বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে রইলো ওদের চলে যাওয়ার পথে। নিচুস্বরে বলতে লাগলো,

    — “দুই মা-মেয়ের শো অফ দেখলে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। দেখলি, সামনে এসেই কেমন ট্রিক্স করে কানের জিনিসগুলো দেখাচ্ছিল? মানুষ তো না, যেন স্বর্ণের দোকান! সারাদিন অকারণে এত ভারী গয়না পরে কিভাবে বেঁচে আছে, কে জানে? আমি হলে গরমে মারাই যেতাম।”

    — “এই হলো ফকিন্নির লক্ষ্মণ। তুই ফকিন্নি তাই গয়না পরলে মরে যাবি। আর চাচী হলো জমিদার বাড়ির লোক। শুনিস না, সুযোগ পেলেই কেমন গলা ছেড়ে চিৎকার করে বলতে থাকে, আমি জমিদার বাড়ির মেয়ে। আমার সঙ্গে এই বাড়ির কোনো বউদের তুলনা চলবে না। জমিদার বাড়ির লোকেরা গয়না না পরতে পারলে মরে যায়। তবে তুই একটা পাজি স্বভাবের ফকিনি। রিনি মেয়েটা একটু প্রশংসা শুনবে বলেই তো কানের জিনিস, হাতের বালা দেখাচ্ছিল। করলি না কেন একটুখানি প্ৰশংসা?”

    — “তুই প্রশংসা করেছিস না খোঁচা মেরেছিস, তা আমি ভালোই জানি।”

    .

    ঘরে ফিরে মেয়ের মাথায় সজোরে চাটি মারলেন রাশেদা। অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকালো রিনি।

    — “কী সমস্যা মা?”

    — “কোনটা প্রশংসা আর কোনটা টিটকারি এতটুকু বোঝার বয়স তোর হয়নি?”

    — “নবনী আপু আমাকে খোঁচা মেরে কথাগুলো বলছিল, তা আমি বেশ বুঝেছি মা। ও আমাকে নিয়ে জেলাস। ওকে আরো পোড়ানোর জন্যই ওখানে দাঁড়িয়ে আমার গোল্ডগুলো দেখাচ্ছিলাম।”

    — “জেলাস তো হবেই। নিজের বিয়ে শাদীর খবর নেই। ঘরে বসে বুড়ি হচ্ছে, স্বামী-সন্তান এখনো ভাগ্যে জোটেনি। অন্যের সুখ কি আর সহ্য হবে? আয় দেখি, কাছে আয়। একটু থুতু দিয়ে দেই। নজর-টজর লেগে গেলে আরেক বিপদ!”

    ৬

    কানে ইয়ারবাড গুঁজে গান শুনতে শুনতে নিজেও গুনগুন করে গাইছিল নবনী। দুপুরের খাওয়া শেষে একটু একটু ঝিমুনি লাগছে। যদিও দুপুরে ঘুমানোর অভ্যেস খুব একটা নেই। তবুও চোখ বুজে আয়েশ করতে বেশ লাগছে। হঠাৎ মা এসে কান থেকে টেনে একটা ইয়ারবাড খুলে ফেললো। প্রচন্ড বিরক্তিতে চোখ মেললেও পরবর্তীতে চোখ আর চেহারার ভাঁজ স্বাভাবিক করে ফেললো নবনী। মা একা আসেনি, সঙ্গে শামীমা চাচীকেও নিয়ে এসেছে!

    — “দেখ কে এসেছে!”

    একগাল হেসে সুন্দর আন্তরিকতায় শামীমাকে নবনী জিজ্ঞেস করলো,

    — “কেমন আছেন আপনি?”

    — “খুব ভালো মা। তুমি ভালো আছো?”

    — “জি। আপনাকে বহুবছর পর দেখছি চাচী!”

    — “হ্যাঁ। ৮-১০ বছর তো হবেই!”

    — “তোমার ছেলের ফ্ল্যাটে আসো অথচ তুমি আমার বাসায় আসো না! শুধু ফোনে ফোনেই তোমার কথা। মাঝেমধ্যে বাসায় আসতে হয় না!”

    — “থাকি না তো এখানে খুব একটা, আসি হয়তো তিন চারমাসে একবার। খুবজোর দুইদিন থেকে তারপর চট্টগ্রাম ফিরে যাই।”

    — “তবুও আসবেন চাচী। দুইদিনের মাঝেই একটুখানি সময় বের করে চলে

    আসবেন। নয়তো হাতে আরো দুইদিন সময় নিয়ে আসবেন শুধু আমাদের বাসায় বেড়ানোর জন্য।

    — “আসবো মা। কতবার তোমার মাকে বলি আপনারা আসবেন আমার ছেলের বাসায়, দেখা করে যাবেন আমার সঙ্গে। তোমার মা আসে না, তোমরাও আসো না। আমার মেয়েটা ভার্সিটি থেকে ফিরে এলে একাই থাকে। এদিকে তোমরা ছাড়া আর কোনো আত্মীয়রা কাছাকাছি থাকে না। তোমরা মাঝেসাঝে ওখানে গেলে আমার মেয়েটারও সময় কাটে।”

    — “ওহ হ্যাঁ! অনির কী খবর? ভালো আছে?”

    — “হ্যাঁ ভালো।

    — “ও কী করছে এখন?”

    — “অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে আছে। আসছে আগামীকাল। আমার ছেলেও আসছে ওর সঙ্গে। তুমি কী করছো? শুনলাম বুটিক আছে! অনি প্রায়ই তোমাদের লাইভ দেখে, আমাকেও দেখায়। ভালেই লাগে দেখতে।”

    — “বুটিক না আন্টি। আমি বুটিকগুলোতে সাপ্লাই দেই। বাসার কাছেই ছোট্ট একটা কারখানা আছে। আর লাইভ করি যে ড্রেসগুলো সেল হয় না সেগুলো নিয়ে। ছোট্ট কোনো ডিফেক্ট থাকে সেগুলো। তুলনামূলক কম দামে সেল করলে সব ড্রেস একদিনের ভেতর স্টক আউট হয়ে যায়।”

    — “বাহ্! বিজনেস করছো অনেকদিন হলো, তাই না?”

    — “জি।”

    .

    নবনীর সঙ্গে দীর্ঘ হচ্ছে কথোপকথন। ভীষণ ভালো লাগছে মেয়েটাকে। কথাবার্তা মার্জিত গোছানো। শিক্ষিত আর স্বনির্ভর। উজ্জ্বল শ্যামলা মিষ্টি মুখটার দিকে চেয়ে থাকতে ভালো লাগছে শামীমার। আচ্ছা, এই মেয়েটা অমিতের বউ হলে কেমন হয়? সুন্দর হবে ব্যাপারটা। পরিবার ভালো, জানাশোনা আছে তাদের, মেয়েটাও লক্ষ্মী। বলা যায় সবদিক প্রায় মিলেই যাচ্ছে। শামীমার কী যেন হলো! নবনীর সঙ্গে গল্পের ফাঁকেই জরুরি কাজের দোহাই দিয়ে বেরিয়ে এল সে। সঙ্গে নিয়ে এল নীতুকেও। মাথায় অমিত-নবনীর বিয়ের ভাবনাটার সঙ্গে সর্বোচ্চ দশ মিনিট এক্কাদোক্কা খেলে নীতুর কাছে এক্ষুনি এই মুহূর্তে প্রস্তাব দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো শামীমা। যে ঘরে তারা উঠেছে সেই ঘরে ফিরে নীতুকে শামীমা বললো,

    — “একটা কথা বলবো ভাবী?”

    — “কী?”

    — “ওরকম ঘটা করে কিছু না। তুমি যদি সায় দাও তাহলে ঘটা করে বলবো।”

    — “কী?”

    — “আমার অমিতকে দেখেছেন তো, তাই না?”

    — “হ্যাঁ।”

    — “আমার ছেলেটা দেখতে কিন্তু বেশ সুন্দর। চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটি থেকে ইংলিশে অনার্স-মাস্টার্স করেছে। এখন একটা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিতে আছে। মাসে বেশ মোটা অঙ্কের স্যালারী পাচ্ছে। ভালো সুযোগ-সুবিধাও পাচ্ছে। ফ্ল্যাট তো কিনেই দিয়েছি ওকে। গাড়িও কিনেছে আমার ছেলে। ওর আচার ব্যবহার ভীষণ অমায়িক।”

    হঠাৎ এ সমস্ত কথা বলার কারণ খুঁজে পায় না নীতু। তবুও মুখে হাসি ঝুলিয়ে রাখলো সে। মাথা ঝাঁকিয়ে শামীমার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বললো,

    — “ওমা তাই! ভালোই তো।”

    — “আপনার নবনীকে, অমিতের জন্য আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। সম্বন্ধটা হলে

    মন্দ হবে না। শামীমার আকস্মিক প্রস্তাবে অপ্রস্তুত হয়ে গেল নীতু। চেহারায় স্পষ্ট সেটা প্রকাশ পাচ্ছে। আশপাশ একবার দেখলো সে। নবনী কোথাও নেই তো? শুনে ফেলেনি তো কথাটা? শুনলে বিপদ হয়ে যাবে। কথার প্রসঙ্গ বদলাতে হবে। মেকি হাসলো নীতু। কৌশলে এড়িয়ে যেতে লাগলো প্রস্তাবটা।

    — “নবনী এখনই বিয়ে শাদী করবে না। “কেন? বিয়ের বয়স তো হয়েছেই।”

    — “ও আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে চায়।”

    — “আর কিসের অপেক্ষা? পড়া শেষ, ক্যারিয়ার গোছানো হয়ে গেছে, বাকি রইলো বিয়ে। এবার সংসার জীবন গুছিয়ে নিলেই হয়।

    — “যার জীবন সে গুছিয়ে না নিতে চাইলে আমি আর কী করবো,

    বলো?” নীতুর ক্রমশ শুকিয়ে আসা মুখ কিংবা হতাশ কন্ঠস্বর কোনোটাই চোখ এড়ায় না শামীমার। পরিস্থিতি হালকা করতে ব্যস্ত হয়ে বলে,

    — “আমি শুধু এমনিই বললাম আর কি! নবনীকে ভালো লেগেছে তাই। মিষ্টি মেয়ে! সবারই পছন্দ হবে। আপনি এত ভাববেন না তো। ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে। ওদের সিদ্ধান্তগুলো ওরাই ভালো বুঝবে।”

    *****

    — “তুমি পাগল?”

    অবাক ভঙ্গিতে শামীমাকে প্রশ্নটা করলো তার স্বামী এরশাদ। ফিক করে হেসে দিলো শামীমা।

    — “হ্যাঁ হঠাৎ কী কান্ড করে বসলাম না, বলো?”

    — “এভাবে বিয়ের প্রস্তাব কে দেয়?”

    — “আমি দেই।”

    — “সাহস কম না তোমার। ভাবী যদি রাজি হয়ে যেত? কেমন কেলেংকারী হতো, জানো? অমিত কখনোই রাজি হতো না। তখন শুধু শুধু দুই পরিবারে দ্বন্দ্ব হতো।”

    — “নবনীকে আমার কী যে ভালো লেগেছে! বারবার মনে হচ্ছে এই মেয়েটার সঙ্গে বিয়ে হলে আমার ছেলে সুখে থাকবে। মুনিয়া ওকে সুখ দিবে না। তুমি দেখো অমিতকে, কেমন কষ্টে থাকে ও? মুখে হাসি নেই, আগের মতো প্রাণোচ্ছলতা নেই। পুরোনো অমিত মরে গেছে মুনিয়ার পাল্লায় পড়ে।”

    — “নবনীকে দেখেছি আমি। তোমার আজ ইচ্ছে হয়েছে ওর সঙ্গে ছেলের বিয়ে দিতে। আমার সেই কবেই এমন ইচ্ছে হয়েছে। ঢাকায় গেলে আমি যাই মাঝে সাঝে শফিক ভাইয়ের ওখানে। মেয়েটাকে সে সুবাদে কয়েকবার দেখা হয়েছে। দারুণ লাগে আমার। কিন্তু কিছু করার নেই, অমিত ঐ পথ ছাড়ছে না। নিজের কপাল নিজেই পুড়তে চায়। হাজার বুঝিয়ে কোনো ফায়দা হয়নি। উল্টো তুমি আমি ওর কাছে খারাপ হয়ে গেছি। ভালোই হলো ভাবী রাজি হয়নি। বাদ দাও এসব।

    ৭

    আজ রওনকের গায়ে হলুদ। পুরো বাড়ি জুড়ে হৈ হুল্লোড় চললেও সবকিছু থেকে দূরে সরে আছে অমিত। মুনিয়ার সঙ্গে এখনো যোগাযোগ হয়নি। এই মুহূর্তে এইসব আনন্দ, হাসি, হৈচৈ বিষের মতন ঠেকছে অমিতের। বাড়ির পেছনে এই নির্জন দুপুরে পুকুর পাড়ে বসে আছে অমিত। পাখির ডাক আর বাতাসের শো শো শব্দে অবশ্য একেবারে নির্জনও লাগছে না। গাছের আড়াল গলে রৌদ্র-ছায়ার লুকোচুরি খেলা চলছে তার গায়ে। ঘরের ভেতর বসে, পেছনের জানালা দিয়ে সেই খেলা দেখছে নবনী। অনির সঙ্গে খুব একটা যোগাযোগ ছিল না এই কয়বছর। কিন্তু গতরাতে এখানে আসার পর ওর সঙ্গে ভীষণ ভাব হয়ে গেছে দুই বোনের। বিশেষ করে নাতাশার সঙ্গে। সারাক্ষণ একসঙ্গেই থাকছে দুজন। এই তো এখনও খেয়ে দেয়ে লুডো খেলছে একসঙ্গে বসে। নবনী কখনো বসে ওদের লুডো খেলা দেখছে আবার কখনো অমিতকে দেখছে। দেখতে দেখতে হঠাৎ অনিকে জিজ্ঞেস করে ফেললো নবনী,

    — “অমিত ভাইয়া কোনো কারণ আপসেট?”

    লুডোর গুটি চালতে চালতে অনি বললো,

    — “কেন বলো তো?”

    — “দেখে মনে হচ্ছে। এই সময়ে একা বসে আছে এখানে। কাকে যেন বারবার কল করছে। একা বসে আছে সেটা সমস্যা না। সমস্যা হলো উনাকে খুব উদাস দেখাচ্ছে। ঠিক দেবদাসের মতো। গতকাল চাচী যখন পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল তখনও দেখলাম মনে কোনো আনন্দ নেই। কারো সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে নেই। জোর করে কথা বলছে, পরিচয় হচ্ছে।”

    — “হ্যাঁ, ও একজন দুঃখী পুরুষ।”

    হেসে ফেললো নাতাশা আর নবনী। নাতাশা বললে,

    — “এভাবে খোঁচা দিয়ে বলছো কেন?”

    — “সেধে সেধে যে কষ্ট পায় তাকে এভাবেই বলবো।”

    — “কী হয়েছে?”

    — “গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে ঝগড়া। যদিও হরহামেশাই হয়। আর ভাইয়ার মন খারাপ নতুন কিছু না। ভাইয়া মন খারাপ করে বসে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। বরং ওকে হাসতে দেখলে অস্বাভাবিক লাগে।”

    — “গার্লফ্রেন্ড পাত্তা দেয় না?”

    — “একদম না। ও হাত-পায়ে ধরে ঐ মেয়ের সঙ্গে ঝুলে আছে।”

    — “টক্সিক রিলেশন টিকিয়ে রাখার মানে একদম বুঝি না!”

    — “ওর ভালো লাগে টিকিয়ে রাখতে।”

    লুডো খেলতে খেলতে অমিতকে নিয়ে অনি আর নাতাশার আলাপ আলোচনা চলছে। ওদের কথা এড়িয়ে কানে ইয়ারবাড গুঁজলো নবনী। ফেসবুকে ওর ক্লাইন্টদের পেজগুলো দেখতে লাগলো, কোন পেইজে ওর তৈরী করা কুর্তীগুলো কত দামে বিক্রি হচ্ছে। ফাঁকে ফাঁকে অমিতের দিকেও চোখ যাচ্ছে তার। ফোনটা এখন আর অমিতের হাতে নেই। রেখে দিয়েছে পাশে। ওর জন্য একটুখানি খারাপ লাগলো নবনীর। লোকে ভালোবাসে সুখী হওয়ার জন্য। ভালোবাসায় কেন কারো এত ঝগড়া হবে, কষ্ট পেতে হবে?

    ৮

    ভরা পূর্নিমার রাত। অক্টোবরের শেষ সময় চলছে। গ্রামে এই সময়টাতে রাতের বেলায় শীত-শীত লাগলেও, অমিতের বিন্দুমাত্রও তেমন অনুভূতি হচ্ছে না। মুনিয়া নামক দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে ক্ষণে ক্ষণে গলা টিপে ধরা অনুভূতি হচ্ছে। গত তিনরাত যাবৎ না ঘুমিয়ে ঘাড়ের পেছনে তীব্র ব্যথা চেপে বসেছে। সঙ্গে যোগ হয়েছে কিছুক্ষণ পরপর মাথা ঘুরিয়ে বমিভাব। গতরাতে নিচতলায় অপরিচিত কয়েকজনের সঙ্গে রুম শেয়ার করে বড্ড অস্বস্তি হয়েছে গোটা রাত। আজ তাই সন্ধ্যা বেলাতেই রওনককে বলে ছাদের চিলেকোঠার কামড়াটার তালা খোলার বন্দোবস্ত করেছে সে। বাড়ির কাজের লোক ঘর সাফ করে যাবার পরপরই ব্যাগ নিয়ে চলে এসেছে এখানে। মুনিয়ার সঙ্গে কথা হয় না আজ তিনদিন পেরিয়ে গেল। একে তো কল রিসিভ করছে না, তার উপর মরার উপর খাঁড়ার ঘা হলো নেটওয়ার্ক। এখানে আসার আগে একদম খেয়াল ছিল না, এই গ্রামে নেটওয়ার্কের ঝামেলা খুব বেশি। খেয়ালে থাকলে কখনোই বিয়েতে আসতো না। রওনকের বিয়ের চেয়ে মুনিয়ার এক মিনিটের ফোনকল অনেক বেশি ইম্পরট্যান্ট। মুনিয়া কি কল করেছিল? সুইচ অফ পেয়ে আবারও রেগে গেছে? এমন কিছু কি হলো? কাল্পনিক সব ভাবনায় রাগে এই এলাকার নেটওয়ার্ক টাওয়ার আছড়ে ভেঙে ফেলতে মন চাইছে অমিতের। ছাদ ঘরে আসার সময়ও ভেবেছিল গতরাতের মতো আজ রাতটাও হয়তো নেটওয়ার্ক ছিন্ন হওয়া মোবাইল হাতে সারারাত বসে থাকতে হবে না। খোলামেলা আর উঁচু জায়গায় থাকার সুবাদে হয়তো নেটওয়ার্ক পাওয়া যাবে। এখানে এসেও খুব একটা সুবিধা করা যাচ্ছে না। এই অন্ধকার মাঝরাতে ছাদে দুই পা ছড়িয়ে বসে আছে সে। সন্ধ্যা থেকেই শরীরটা বেশ খারাপ লাগছিল, অসুস্থতা বুঝি এখন আরো বেড়েছে। বিপি লো হয়েছে নিশ্চয়ই! জেগে থাকলে মুনিয়ার দেয়া কষ্ট কিংবা সিম কোম্পানির উপর তীব্র ক্ষোভ কোনোটাই কন্ট্রোল করা সম্ভব না। ঘাড় ব্যথা কিংবা মাথা ঘুরানো কোনোটাই আর সহ্য করাও সম্ভব হচ্ছে না। ঘুম প্রয়োজন তার, লম্বা ঘুম। ঢাকা থেকে আসার সময় ব্যাগে করে স্লিপিং পিল নিয়ে এসেছিল অমিত। ছাদ থেকে টলতে টলতে ঘরে এসে দু’টো স্লিপিং পিল পানির সঙ্গে ঘটঘট করে গিলে নিলো। গায়ের গেঞ্জিটা খুলে চেয়ারের উপর ছুঁড়ে, বিশাল আকৃতির খাটের ওপাশে, দেয়ালে গা ঘেঁষে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে পড়লো সে।

    .

    বিয়ে বাড়ির সবাই গভীর ঘুমের দেশে পাড়ি জমিয়েছে। নাতাশা আর অনির মাঝে শুয়ে আছে নবনী। মেয়ে দুটো দুপাশ থেকে তার উপর হাত-পা রেখে আরাম করে ঘুমুচ্ছে। নাতাশার কোলবালিশ জড়িয়ে ঘুমুবার অভ্যেস। অনিরও হয়তো তাই। বেচারীরা এ বাড়িতে কোলবালিশ না পেয়ে ঘুমের ঘোরে তাকেই কোলবালিশ বানিয়ে ফেলেছে। রাতে একা ঘুমুবার অভ্যেস নবনীর। গতরাতে মেয়েগুলো এভাবে ওকে জাপটে ধরে ঘুমুচ্ছিল, আজ রাতেও তাই করছে। গতকাল খুব একটা সমস্যা না হলেও আজ ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। অস্বস্তির কারণ দুপাশের মেয়ে দুটো নাকি অন্যকিছু সে কথা ভাবতে ভাবতেই খুব সাবধানে দু’জনকে ছাড়িয়ে, ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল নবনী। বারান্দায় মাত্রই একটু আয়েশ করে বসেছিল, তখনই গলা খাকাড়ির শব্দে উঠোনের বাম দিকে ঘাড় ফেরালো সে। দেখলো, রওনকের দাদা টর্চ হাতে এদিকেই আসছে। তড়িঘড়ি করে এক দৌড়ে ছাদের সিঁড়ির দিকে চলে গেল নবনী। এত রাতে তাকে বাইরে বসে থাকতে দেখে নিশ্চয়ই শ’খানেক প্রশ্ন করা হবে। তারচেয়ে বরং এখানে লুকিয়ে থাকাই ভালো।

    .

    রমিজ মির্জা ঘরের ভেতর চলে যাবার পর বারান্দার দিকে পা বাড়াতে গিয়েও থেমে গেল নবনী। বাড়ি ভর্তি মানুষ, যখন তখন যে কেউ প্রয়োজনে ঘর থেকে বেরিয়ে আসবে। তাদের মুখোমুখি হতে হবে, রাত কেন জাগছে সে প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। অহেতুক ঝামেলায় না জড়িয়ে ছাদে চলে গেলেই তো হয়! এতরাতে কেউ যাবে না সেখানে। মোবাইল টর্চ জ্বালিয়ে এক দৌড়ে ছাদে চলে এল নবনী। বাইরে বেশ ঠান্ডা। ছাদজুড়ে বিছিয়ে আছে জোৎস্না। চাঁদ তার রূপালী আলো ছড়িয়ে দিয়েছে এই প্রকৃতিতে। একটুখানি হাসি ছড়িয়ে পড়লো নবনীর ঠোঁটের কোণে। মৃদু শীতলতা, পূর্ণিমার আলো, ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক, হাসনাহেনার মিষ্টি ঘ্রাণ, কোলাহলহীন আশপাশ। অদ্ভুত সুন্দর এই রাতটা হয়তো গ্রামে না এলে দেখাই হতো না। ছাদের মধ্যখানে আসন পেতে বসে পড়লো নবনী। নিষ্পলক চেয়ে রইলো গোল চাঁদটার দিকে। রওনকের আজ বাসর। ওরা কি জেগে আছে নাকি ঘুমুচ্ছে, সে কথা জানা নেই নবনীর। সামি বলতো, ভাগ্য গুনে বিয়ের রাতে ভরা পূর্ণিমার আলো মেলে। বাসর ব্যাপারটাই সুন্দর, তার উপর যদি পূর্ণিমা থাকে তাহলে একদম জমে ক্ষীর। অমন সুন্দর রাতে ঘুমুতে হয় না। পূর্ণিমা প্রতিমাসে এলেও, বাসর জীবনে শুধু একবারই পাওয়া যায়। নবনীরও ইচ্ছে হচ্ছে রওনককে এক্ষুনি কল করে জিজ্ঞেস করতে, এই তোরা ঘুমিয়ে পড়েছিস? সামি বলেছে, অমন সুন্দর রাতে ঘুমুতে হয় না। বাসর জীবনে আর তোরা পাবি না। জেগে থাক, ভোর অব্দি জেগে থাক। চাঁদ ডুবে গেলে, প্রথম ভালোবাসার রাতটা কেটে গেলে তারপর ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দিস।

    .

    — “এতরাতে ছাদে এলে যে?”

    সামির কন্ঠ পেয়েও ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতে ইচ্ছে হয় না নবনীর। চেয়ে থাকে চাঁদের দিকে।

    — “কথা বলছো না কেন?

    — “অস্বস্তি লাগছিল খুব। অনি, নাতাশার কোলবালিশ হয়ে আর সাপোর্ট দিতে পারছিলাম না, তাই চলে এসেছি।”

    — “অস্বস্তির কারণ অনি, নাতাশা নাকি অন্যকিছু?”

    — “আমিও তাই ভাবছিলাম, জানো? অস্বস্তি আমার দুপুর থেকেই হচ্ছে। রওনকের বউ যখন কবুল বলছিল, আমি ওর সামনে ছিলাম। তখন থেকেই আমার অস্বস্তি হচ্ছে। ভালো লাগছে না কিছু।”

    — “সমস্যা অনি, নাতাশা না, সমস্যা একান্তই তোমার নিজের। এতগুলো বছরে সামনে দাঁড়িয়ে থেকে কাউকে কবুল বলতে শোনা হয়নি তোমার। ওর মুখে কবুল শুনে নিজের জন্য কষ্ট পাচ্ছো তুমি।”

    — “হ্যাঁ, সে কথা তো একটু-আধটু মনে পড়েছেই। রওনক সাদা শেরওয়ানিটা পরে, মাথায় পাগড়ি বেঁধে যখন ঘর থেকে বেরোলো, তোমাকে ভীষণ মনে পড়ছিল। আমিও তো তোমার জন্য সাদা শেরওয়ানি কিনেছিলাম। রওনকের বউয়ের মতোন লাল টুকটুকে একটা শাড়ী নিয়েছিলাম আমার জন্য। খুব শখ করে কিনেছিলাম বিয়ের শাড়ী আর শেরওয়ানি। আমাদের আর সেসব পরা হলো না সামি। কত স্বপ্ন আমাদের, কত প্ল্যানিং… সব শেষ! কয়েক সেকেন্ডে আমাদের সবকিছু শেষ হয়ে গেল।”

    — “আমাদের বাসর রাতটা ভরা পূর্ণিমার রাতে হবার কথা ছিল। ক্যালেন্ডার থেকে পূর্ণিমার সঙ্গে মিলিয়ে তুমি বিয়ে তারিখ ঠিক করলে। সেই রাতে ছাদে পাটি বিছিয়ে আমাদের জোত্স্নাবিলাস করার কথা ছিল। আমাদের একটা দীর্ঘ চুমু বাকি ছিল, এক সমুদ্র ভালোবাসায় ডুব দেয়া বাকি ছিল।”

    — “এক জীবনে সবাই সব পায় রোদ্দুর? যাদের ভালোবাসা পূর্ণতা পায়, পূর্ণতা কি তারা সত্যিই পায়? জিজ্ঞেস করো তাদের, দেখবে অভিযোগের ঝাঁপি খুলে

    বসেছে। সংসারে সুখ নেই, যত্ন নেই, সম্মান নেই, ভালোবাসা নেই, ভালোবাসার মানুষটা থেকেও নেই। কী লাভ সেই পূর্ণতার, বলো তো? আর আমরা? অপূর্ণ হয়েও পূর্ণ। আমাদের ভালোবাসা বেঁচে আছে, আমি তোমার মাঝে বেঁচে আছি। আমাকে তুমি মরতে দাওনি। আমাদের ভালোবাসা মুছে যেতে দাওনি। এখনো তোমার আমার গল্প লোকেরা চর্চা করে, আজও বন্ধু মহলে তোমার আমার প্রেমের প্রথম দিনগুলোর মতো গুঞ্জন উঠে- নবনী, সামি ভালোবেসেছিল, নিখাঁদ ভালোবাসা। আমরা পূর্ণতা পাইনি। তবে ভালোবাসা পেয়েছি রোদ্দুর, অসীম ভালোবাসা!”

    — “ঘুম পেয়েছে আমার। কিন্তু নিচে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না।”

    — “এখানে ঘুমাবে?”

    — “ছাদঘরের দরজা খোলা। ফুফু বললো এই ঘরে কাউকে থাকতে দেয়া হয় না। কে খুললো বলো তো?”

    — “হয়তো কোনো দরকারে খুলেছে, ভুলে লক না করেই চলে গেছে।”

    — “আমি যাবো না নিচে। ঐ ঘরটাতেই ঘুমাবো। তুমি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে সামি?”

    সামির পিছু পিছু ছাদঘরে এল নবনী। দরজা আটকে শুয়ে পড়লো বিছানার এপাশে। মাথার উপর সামির স্পর্শে পরম শান্তিতে চোখ বুজলো নবনী।

    ৯

    আঁধার কেটে সবে আকাশে আবছা আলো ছড়ানো শুরু করেছে। মির্জা বাড়ি এখনো জেগে উঠেনি। কাজের লোক চারজন, বাড়ির বড় আর মেজো বউ, রমিজ মির্জা বাদে বাকি সবাই ঘুম। টিউবওয়েল চাপার শব্দ, মোরগের ডাক, হাড়ি পাতিলের টুংটাং শব্দ ছাড়া আর কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না এই বাড়িতে। ঘুম থেকে জেগেই বেশ চটে আছেন রমিজ মির্জা। ফজর ওয়াক্তে অযু করতে গিয়ে পানি পাননি তিনি। বিগত কয়েকদিন যাবৎ পানির লাইনে ঝামেলা হওয়া সত্ত্বেও আজ করছি, কাল করছি বলে লাইন ঠিক করেনি এই বাড়ির কর্মচারী আব্বাস। নতুন বউ বাড়িতে, বাড়ি ভর্তি মেহমান; এমন সময়ে কল থেকে পানি আসাই কিনা বন্ধ হয়ে গেল! দাঁতে দাঁত চেপে ফজরের নামাজ শেষ করেই সোজা তিনি চলে গেলেন উত্তরের বারান্দায়। সেখানেই গতরাতে লেপ-তোশক নিয়ে ঘুমিয়েছে আব্বাস। একটানে আব্বাসের শরীর থেকে কাঁথা সরিয়ে পাছা বরাবর লাথি মেরে চিৎকার করে উঠলেন রমিজ মির্জা

    — “উঠ হারামজাদা!”

    ঘুম থেকে ধরফরিয়ে উঠলো আব্বাস। ভয়ে আতংকে পুরো শরীর কাঁপছে তার।

    — “কী হইছে কাকা?”

    — “তোরে কবে কইছিলাম পানির পাইপে ময়লা জমছে, সাফ করোন লাগবো।”

    — “এল্লিগা আমারে লাখি দিবেন? ডরে বুকটা কেমুন ধরফরাইতাছে। মা গো মা!”

    — “উঠ শিগগির, আরেকটা লাখি খাওনের আগে উঠ! এক্ষন তুই আমার লগে ছাদে গিয়া লাইন সাফ করবি।”

    .

    মোরগের ডাকে ঘুম খানিকটা ভেঙে এল নবনীর। আধবোজা চোখে পাশ ফিরতেই হুরমুরিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো সে। চোখ ভালোভাবে কঁচলে আরেকবার সামনে শুয়ে থাকা মানুষটার দিকে তাকালো। অমিত শুয়ে আছে! সত্যিই কি সারারাত অমিতের সঙ্গে এক বিছানায় কাটিয়েছে সে? কিভাবে সম্ভব? অমিত এল কখন এই ঘরে? কেন এল? যতদূর মনে পড়ে গতরাতে দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়েছিল সে। তাহলে অমিত? সে কি আগে থেকেই এই বিছানায় ছিল? নাহ্! আর কিছু ভাবা যাচ্ছে না। কেউ দেখার আগে এখান থেকে বেরোতে হবে। খাটের উপর থেকে ওড়না নিয়ে কোনোভাবে গায়ে জড়িয়ে, দরজা খুলে বাইরে পা বাড়াতেই রমিজ মির্জার মুখোমুখি হলো নবনী। একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনায় নিজেকে সামলে নিলেও, রমিজ মির্জাকে দেখে নিজেকে আর সামলাতে পারছেনা নবনী ভয়, আতংক দ্বিগুণ হয়ে যেন নিঃশ্বাসটাই আটকে যাচ্ছে।

    নবনীর চুল, ওড়না এলোমেলো। চোখ থেকে ঘুমের ছাপ যায়নি, মুখে আতংক লেপ্টে আছে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত তাকে দেখছে রমিজ মির্জা, বোঝার চেষ্টা করছে ঘুম থেকে জেগেই একটা মানুষকে কেন এত ভয়ে জড়োসড়ো দেখাবে? হাতজোড় পেছনে নিয়ে নবনীর সামনে বুক টানটান করে দাঁড়ালেন রমিজ মির্জা।

    — “কী গো বুবুজান? রাত্রে এনে ঘুমাইছিলেন?”

    মুখ ফুটে কথা বেরোচ্ছে না নবনীর। আসন্ন বিপদের কথা ভেবে মাথা ঘুরানো শুরু হলো তার। পেছন থেকে আব্বাস মিষ্টি করে বললো,

    — “খালাজান, কাকায় কী কইতাছে, শুনছেন? জবাব দ্যান।”

    কোনো উত্তর না দিয়েই, শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে এখান থেকে দৌড়ে পালালো নবনী।

    বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে আব্বাসের দিকে তাকিয়ে রমিজ মির্জা বললো,

    — “বেত্তমিজ মাইয়্যা! দিলের মইদ্যে আদব কায়দা নাই। ঘর এইডা তো তালা মারা আছিলো। ঘর সাফ করলো কহন? উপরে আইলো কহন? রাইতে তো দেখছিলাম নিচের ঘরে বইনের লগে শুইয়া আছে।”

    চিলেকোঠার ঘরে উঁকি দেয়া হয়নি বহুদিন। আজ দরজা খোলা পেয়ে ঘরের ভেতর পা রাখলেন রমিজ মির্জা। শান্ত চোখজোড়া যেন তার এখনই বিস্ফোরিত হয়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে! এ কী দেখছেন তিনি! এতবড় পাপকান্ড! দু’হাতে মুখ চেপে চিৎকার করে উঠলেন,

    — “আস্তাগফিরুল্লাহ্! আল্লাহ্ গো! এইডা কী হইয়া গেল! আমি রমিজ মাইনষের বিচার করি, আমার ঘরেই নি এই আকাম!”

    রমিজ মির্জার আর্তচিৎকারে একলাফে ঘরে এসে ঢুকলো আব্বাস। জিভ কামড়ে বললো,

    — “এহহে! ইন্না-লিল্লাহ!”

    — “ধরা খাইয়া গেছে ঐ ডরে এইহান থেইকা ছেমড়ি পালাইছে। বুঝছোস? আব্বাইচ্চা, আমি নিচে যাইতাছি। ছেমড়ি বাড়ি ছাইড়া পালানের আগে ওরে আটকাইতে হইব। আর তুই এই নাপাক ছেমড়ারে নিয়া নিচে আয়। আগে দুইটারে গোসল দেওয়ামু, তারপর বিচার করমু। সাহস কত্ত এ্যা! রমিজের বাড়িতে শুইয়া নাপাক কাম করোন! ছিঃ ছিঃ! মনে হইতাছে আমার সারা শইল্লে কেডায় জানি থু থু মাইরা দিছে।

    .

    সারা শরীর কাঁপছে নবনীর। নীতু তাকে শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছে বুকে। পাশেই পানির গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে আছে অনি। নাতাশা মাথায় হাত বুলিয়ে, আদুরে স্বরে অনবরত কত কী জিজ্ঞেস করে চলছে, কোনোকিছুরই উত্তর দিচ্ছে না নবনী মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে হেঁচকি তুলে কেঁদেই যাচ্ছে।

    — “ভাবী কী হয়েছে?”

    শামীমা এসেছে ঘরে। চোখে মুখে তার একরাশ কৌতুহল।

    — “দেখো না মা, নবনী আপুর কী যেন হয়েছে! আমি আর নাতাশা আপু ঘুমাচ্ছিলাম। হঠাৎ করে নবনী আপু নাতাশা আপুকে জড়িয়ে কান্নাকাটি শুরু করে দিলো। আপুর পুরো শরীর কাঁপছে মা।”

    চিন্তিত ভঙ্গিতে নীতুর পাশে এসে বসলেন শামীমা। নিচুস্বরে বললেন,

    — “তালই সাহেব আমাকে ডেকে তুললেন ঘুম থেকে। বললেন এই ঘরে আসতে। কী কথা নাকি আছে।”

    — “তালই? উনি আবার কী বলবেন?”

    — “কী জানি ভাবী। কথার ধরন শুনে মনে হলো খুব রেগে আছে।”

    মায়ের দিকে মুখ তুলে তাকালো নবনী। কী যেন বলতে চাইছে সে। মেয়ের চোখেমুখে তাকিয়ে দুশ্চিন্তায় দিশেহারা হয়ে যাচ্ছেন নীতু। কাতর হয়ে জানতে চাইলেন,

    — “বল না রে মা, কী হয়েছে তোর?”

    — “চলো আম্মু, আমরা এক্ষুনি বাসায় যাব। এখানে থাকবো না।

    — “ক্যান গো বুবুজান? বাসায় যাইবেন ক্যান? ধরা খাইয়া গেছেন তাই?”

    রমিজ মির্জাকে দেখে হঠাৎ কান্না থেমে গেল নবনীর। থেমে থেমে হেঁচকি তুলছে শুধু। তার সঙ্গে এসেছে ছোট ফুফুও। চোখজুড়ে শুধুই তার আতংক। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নবনীর দিকেই।

    — “যান বুবু, গিয়া গোসলটা আগে সাইড়া আসেন। তারপর করুম আপনের বিচার।”

    বিরক্ততে চোখ মুখ কুঁচকে এল নীতুর। লোকটাকে বরাবরই খুবই অপছন্দ তার। কথাবার্তা, চালচলন, চিন্তা ধারা সবকিছুই বিশ্রী। মেয়ের কান্নার কারণ অবশেষে খুঁজে পেলেন তিনি। এই লোকটা নিশ্চয়ই বাজে কিছু বলেছে তার মেয়েকে। কিন্তু কেন? এখন আবার গোসল করতে বলছে! সেটাই বা কেন?

    — “ওকে গোসল কেন করতে বলছেন তালই?”

    — “কারণ আপনার মাইয়্যা এহন নাপাক। তার গোসল করা ফরজ।”

    — “মানে? কী করেছে ও?”

    — “বিচারে সব কথা কওয়া হইবো। সব কথা কওয়ার লাইগাই আপনাগো এই ঘরে আমি ডাকাইছি। কই গো বুবু, যান। আর আহ্লাদ না কইরা গোসলে যান।” নবনীকে হাত ধরে এক টানে মায়ের কাছ থেকে আলাদা করলো রমিজ মির্জা। চেঁচিয়ে উঠলেন নীতু,

    — “কী পেয়েছেন আপনি? আমার মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। আর আপনি কিনা এই সকালে আমার মেয়েকে ধরে বেঁধে গোসল করতে পাঠাচ্ছেন!”

    এবার ভীত স্বরে নবনীর ফুফু সুরাইয়া বললেন,

    — “বাবা বলুন না কী হয়েছে? কী করেছে আমার ভাতিজি?”

    দাঁতে দাঁত চেপে নিতুর কাছে এগিয়ে এসে রমিজ মির্জা বললো,

    — “গলা বাড়াইয়ো না। একে তো সন্তানরে শিক্ষা দিতে পারো নাই, তার উপে আবার গলা বাড়াও!”

    — “কোন শিক্ষার অভাব রেখেছি? বলুন আমার মেয়ের অন্যায় কী?”

    — “ভুইলা যাইয়ো না তুমি আমার বাড়িতে আমার সামনে দাঁড়ায় আছো। আওয়াজ নিচে নামায়া কথা কও। তোমার ইজ্জত বাঁচাইতে আমি মজলিস না জমায়া, ঘরের দরজা আটকায়া কথা কইতাছি। আর তুমি নি চিল্লায়া সারা গ্রাম জানাইতে চাও? কী মাইয়্যা তুমি যাইবা গোসলে নাকি হেঁচড়ায়া নিমু?”

    দিশেহারা নবনী অসহায় চোখে মায়ের দিকে তাকালো। গলার সমস্ত আওয়াজ খুঁইয়ে সে বোবা হয়ে গেছে যেন!

    রমিজ মির্জার ঝাঁঝালো কথা আর নবনীর নিশ্চুপ কান্না মিলিয়ে নীতু মেজাজ হারালো। চেঁচিয়ে উঠলো মেয়ের উপর,

    — “চড় মেরে দাঁত ফেলে দেবো। এখানে কাকে ভয় পাচ্ছিস তুই? আমি থাকতে কারো সাহস আছে তোকে কিছু করার? কথা বলিস না কেন? লোকটা এমন আচরণ কেন করছে তোর সঙ্গে?”

    — “মা… আমি… আ আমি…”

    — “হইছে বুবুজান। আপনার আর তোঁতলাইতে হইব না। আপনের মায়রে আমিই কইতাছি।”

    ঘরের দরজা আটকে শামীমাকে টেনে এনে নীতুর পাশে দাঁড় করালেন রমিজ মির্জা। মনে মনে পুরো স্ক্রিপ্ট তৈরী করে রেখেছেন তিনি- কতটা মসলা মিশিয়ে, কেমন ভঙ্গিতে মায়েদের সন্তানের কুকর্ম সম্পর্কে তিনি জানাবেন। মাত্ৰই গলা ঝেড়ে বলতে যাচ্ছিলেন তখনই দরজায় ধাক্কা পড়লো। সুরাইয়া গিয়ে দরজা খুলতেই, আব্বাস আর মানিক দুপাশ থেকে অমিতকে ধরাধরি করে ঘরে ঢুকলো। রাগে বিরক্তিতে অমিতের চেহারা কুঁচকে আছে। মাকে দেখামাত্রই এক নিঃশ্বাসে সে বলতে লাগলো,

    — “হোয়াট দ্য হেল ইজ গোয়িং অন, আম্মু? এরা আমাকে ঘুম থেকে টেনে তুলে পুকুরে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে বললো ডুব দিয়ে জলদি গোসল সেরে নিতে গোসল শেষে আমার কিসের বিচার নাকি করা হবে। অমিতকে দেখা মাত্র কান্না বুঝি আরো বেড়ে গেল নবনীর। নীতু আর শামীমা একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। দু’জনের ছেলে মেয়েকে একই কথা বলা হচ্ছে কেন? কী দোষ তাদের?

    — “এইবার কই আসল কতা। তোমগো দুইজনের ঝি-পুত এহনো আবিয়াইত্তা হেইডাই আমি জানতাম। তুমরা নিজেরাই আমারে কইছো।”

    — “হ্যাঁ বলেছি। তো?”

    — “মেজো বউ, তুমার ভাবী কইলাম খুব চ্যাটাং চ্যাটাং করতাছে। গলা নামাইতে কও।”

    পেছন থেকে অসহায় চোখে নীতুর দিকে তাকালো সুরাইয়া। দাঁতে দাঁত চেপে চোখ নামিয়ে নিলো সে।

    — “তুমগো দুই পোলা-মাইয়্যা বিয়া ছাড়াই সারারাইত ছাদের ঘরে এক বিছানায় কাটাইছে। বিছানায় রাইত ভইরা কোন লীলা চালাইছে সেইটা নিশ্চয়ই আর কইতে হইব না।”

    — “মানে কী?”

    সমস্বরে চিৎকার করে উঠলো শামীমা, নিতু আর সুরাইয়া। রমিজ মির্জার কথায় স্তব্ধ হয়ে রইলো অমিত আর অনি। ঘৃণাভরা দৃষ্টিতে রমিজের দিকে তাকালো নাতাশা জিভ থেকে দলা পাকিয়ে থু থু বেরিয়ে আসতে চাইছে তার।

    সুরাইয়ার বহুবছরের দাবানো কন্ঠস্বর আজ যেন সমস্ত বাঁধ হারালো। যে চোখ কখনো মির্জা বাড়ির প্রধানের চোখ বরাবর উঠেনি, সে চোখে যেন আজ আগুন ঝরছে। শ্বশুরের দিকে রাঙা চোখে তাকালো সে।

    — “আপনাকে আমরা সবাই শ্রদ্ধা করি, আপনার সমস্ত অন্যায় মাথা পেতে মেনে নেই, তার মানে এই না, আপনি আপনার সীমা অতিক্রম করবেন।”

    — “ঐ মাগী, ঐ! চোক্ষে গরম শিক ঢুকাইয়া কানা বানাইয়া দিমু। কার দিকে চাইয়া কতা কইতাছোস, হুঁশ আছেনি? নিজে বেলাল্লাপনা কইরা আমার পুত ফাঁসাইছোস, এই ছেমড়ি তোরই তো রক্ত। ভালা আর হইবো কেমনে? বিয়ার আগে শইল্লের মধু খাওয়াইয়া বেড়াইতাছে পর পুরুষগো।”

    শান্ত স্বরে মেয়েকে নীতু জিজ্ঞেস করলো, — “বল তো মা, কী হয়েছে? আমি তোর কাছ থেকে জানতে চাই। “গতকাল রাতে আমি খুব সাফোকেট ফিল করছিলাম। তাই ছাদে গিয়েছিলাম কিছুক্ষণ বসবো বলে। ওখানে ঘুম পেয়ে গেল, চিলেকোঠা ঘরটার দরজা খোলা পেয়ে আমিও ওখানে ঘুমিয়ে গেলাম। ফুফু বলেছিল ঐ ঘরে কেউ থাকে না। ভেবেছি কেউ নেই, আমি একটু স্পেস নিয়ে ওখানে ঘুমাই। ঘুমানোর আগে দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়েছিলাম। ঘুম থেকে জেগে দেখি দরজা ভেতর থেকে আটকানো, অথচ আমার ওপাশে উনি শুয়ে আছে। তাড়াহুড়ো করে ঘর থেকে বেরোনোর জন্য দরজা খুললাম, অমনি দেখি দাদা আমার সামনে।

    — “কিহ্! আপনি সারারাত আমার সঙ্গে এক বিছানায় ছিলেন!”

    — “আমি আপনাকে দেখিনি।”

    — “একটা জ্বলজ্যান্ত মানুষ আমি। ছয় ফুট মানুষটাকে আপনি দেখতে পাননি? এটা কোনো বিশ্বাসযোগ্য কথা?”

    — “বিলিভ মি, আমি আপনাকে দেখিনি। ঘরে খুব একটা আলো ছিল না। আর আপনি যে পাশটায় শুয়েছিলেন ওখানে অন্ধকার ছিল। আমি কেন জেনেশুনে একটা ছেলের পাশে ঘুমাতে যাব?”

    — “হ্যাঁ তাও তো ঠিক! জেনেশুনে আপনি কেন আমার পাশে শোবেন? দাদা, আমরা কেউ কাউকে ওভাবে চিনিই না। দুজনের মাঝে সম্পর্ক থাকলে হয়তো আপনি এমন কিছু সন্দেহ করতে পারতেন। যেখানে সম্পর্কই নেই সেখানে এসব বাজে ব্লেইম করাও তো অন্যায়।

    — “ন্যায়-অন্যায় শিখাইবা আমারে? অত্র থানার ভিত্রে যত গ্রাম আছে সব গ্রামের বিচারে আমারে মাথা কইরা নিয়া যাওয়া হয়। রমিজ মির্জার মতামত ছাড়া কোনো গ্রামের পঞ্চায়েত, চেয়ারম্যান, মেম্বার কাউরে নির্দোষ বানাইতে পারে না, কাউরে দোষীও করতে পারে না। সেই আমারে কি না তুমি ন্যায় অন্যায় শিখাও?”

    — “দাদা আপনি কথা বুঝতে পারছেন না। মানুষের চোখের দেখায় অনেক ভুল

    থাকে। আমার গার্লফ্রেন্ড আছে। চার বছরের প্রেম আমার। আমি কেন অন্য কারো সঙ্গে….? আম্মু কিছু বলছো না কেন উনাকে?”

    — “তালই সাহেব আমার ছেলেটা সত্যিই বলছে। ও ওর প্রেমিকাকে ছাড়া চোখে আর কিছু দেখে না। ঐ মেয়ের কাছে ওর জান আটকে আছে। অমিত মুনিয়ার সঙ্গে চিট করবে এসব স্বপ্নেও ভাবা যায় না।”

    — “আমার মেয়েও কখনোই কোনো ছেলের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক দূরের কথা, প্ৰেম করার চিন্তাও কখনো মাথায় আনবে না। অকারণ মিথ্যা কথা রটানো বন্ধ করুন তালই। আমরা আপনার বাড়ির মেহমান, আমাদের এভাবে অপমান করার কোনো মানেই হয় না।”

    — “তোমরা তোমগো স্বপ্ন-চিন্তা লইয়া ভাবতে থাকো। আমি চোখে যা দেখছি তাই কমু। আকাম যেহেতু আমার বাড়িতে হইছে, বিচারও আমিই করমু।”

    রমিজ মির্জার বাড়াবাড়িতে চিৎকার করে উঠলো নাতাশা।

    — “বিচারের প্রশ্ন আসছে কোত্থেকে? আপু আর অমিত ভাইয়া তো বলছেই ওরা কিছু করেনি।”

    — “বুবুজান, এই বাড়িতে আমার কথার পিঠে আর কোনো কথা হয় না। আর তোমরা তর্ক কইরাই যাইতাছো। কী সাহস এ্যা? চাইলে তুমগো সবার একটা শাস্তি আমি দিতে পারি। কিন্তু মেহমান দাওয়াত কইরা আনছি, তার সম্মান আমি বজায় রাখমু। আর কোনো কতা কেউ কইবা না এই ঘরে। আমি এহন যা হুকুম করমু তাই মাইনা নিতে হইব। নয়তো পরিণাম খারাপ হইব। আজকে এক ঘন্টার ভিতরে ওগো দুইজনরে আমি বিয়া করায়া হালাল করমু।”

    আঁতকে উঠলো অমিত-নবনী। বড় মেয়েকে সুরাইয়ার কাছে দিয়ে, শফিক সাহেবকে কল করবেন বলে নিতু মোবাইল হাতে নিতেই ছিনিয়ে নিলেন রমিজ মির্জা।

    — “কারে কল দেও? জামাইরে?”

    — “দেবো না? কী বলছেন, কী করতে চাইছেন আন্দাজ আছে আপনার? আমার মেয়েকে কিভাবে ফাঁসাচ্ছেন, সে কথা ওর বাবাকে জানাবো না আমি?”

    এগিয়ে এল অমিতের মা। অমিত আর অনির হাত শক্ত করে ধরে বললো,

    — “দরজার সামনে থেকে আপনার লোকদের সরে দাঁড়াতে বলুন। আপনার মতো অসভ্য বেয়াদব লোকের বাড়িতে এক মুহূর্তও আমি থাকব না।”

    — “ঐ বেত্তমিজ বেডি, তুই অসভ্য কারে কছ? বিয়া ছাড়া কুন বেডির লগে কুকাম করছি? কইতে পারবি তুই? তুই অসভ্য, পেটে যেইডারে ধরছোস ঐডা অসভ্য। পোলায় আকাম করছে, মায় হেই কতা মাটিচাপা দিতাছে। কোমিনের দল!” রমিজ মির্জার পাঞ্জাবির কলার চেপে ধরলো অমিত।

    — “আপনি আমাকে চেনেন? আমার সম্পর্কে কোনো ধারণা আছে আপনার? আপনাকে এই গ্রামেই জ্যান্ত পুঁতে ফেলবে অন্তত এমন দশটা লোকের সঙ্গে আমার উঠাবসা। একটা কল করব, এখান থেকে ধরে নিয়ে আপনাকে কোথায় গুম করবে তার কিছুই আপনার ধারণায় নেই।’

    কালু কোমড়ে গুঁজে রাখা দেশি পিস্তল বের করে অমিতের মাথায় ঠেকিয়ে বললো,

    — “দে কল। তোর কোন বাপ আইসা মালিকরে গুম করবো আমরাও দেখি।”

    — “দাদাভাই, এমুন পঞ্চাশখানেক পিস্তল আমার উঠানে, গাছের তলে, আলমারিতে, চাইলের মটকায় ভইরা থুইছি। যেই বান্দা শ’খানেক মানুষ জীবনে গুম করছে তারে গুম করার ডর দেহায়া লাভ আছে? বেকুবের বেকুব! আর কতা বাড়াইয়ো না। চুপ কইরা বও খাটের উপ্রে। আমি বাজার থেইকা শাড়ী, পাঞ্জাবি আনাইতাছি। সাইজা গুইজা রেডি হও। মুয়াজ্জিনরে ডাইক্যা আনতাছি। সে আইসা বিয়া পড়াইবো।”

    — “আমরা আমাদের ছেলেমেয়ে বিয়ে দেবো না। এতবড় অন্যায় আপনি কী করে করতে পারেন তালই?”

    ফোঁপাতে ফোপাঁতে সুরাইয়া বললেন,

    — “বাবা এবার আপনি সীমা ছাড়াচ্ছেন। আপনি হয়তো আমার উপর রেগে আছেন। আমার শাস্তি আপনি আমাকে দিন। ওদের কেন দিচ্ছেন? এত নোংরা অপবাদ দিয়ে ছেলেমেয়ে দুটোকে এতবড় শাস্তি দেবেন না দয়া করে। আমার ভাইয়ের মেয়েটা মরে যাবে।”

    — “ও মা! ত্রিশ বছর আগে শুনছিলাম তুমি আমার পোলারে বিয়া না করতে পারলে মইরা যাইবা। তুমারে বাঁচাইতে গিয়া পোলা আমার বিপক্ষে গিয়া বিয়া করছে। ৩০ বছর পর আইসা শুনতাছি যার লগে তুমার ভাইঝির শোয়া-বসা তার লগে বিয়া দিলে তুমার ভাইঝি মইরা যাইব। এইডা কুন আলামত!”

    এবার নবনী বললো,

    — “আপনি বারবার একই কথা বারবার বলছেন। আমরা এতগুলো মানুষ আপনাকে কী বলছি, তা কেন বুঝতে চাইছেন না?”

    — “আর আমি যে নিজের চোক্ষে তুমগো দুইটারে একঘরে দেখছি সেইটা কী কইবা?”

    — “দাদা, সত্যি বলছি আমি উনাকে দেখিনি দাদা। আমি কাউকে বিয়ে করব না। তারচেয়ে বরং আমাকে মেরে ফেলুন, আমার শাস্তি আমাকে দিন। উনাকে যেতে দিন প্লিজ। সব দোষ আমার, আমি কেন খেয়াল করলাম না। আমার একটা ভুলের জন্য এভাবে সবাইকে শাস্তি দেবেন না।

    — “দেহো কেমুন কান্দা লাগাইছে! ঐ ছেমড়ি, বিয়া খুশির কাম, হালাল কাম। বিয়া করতে আপত্তি কী? বিয়া দিতাছি চুপচাপ বিয়া কইরালাও। নয়তো ঘটনা খারাপ হইব, খুব খারাপ!”

    নিতু দিশেহারা হয়ে বললেন,

    — “সুরাইয়া তুমি রাশেদ ভাইকে একটু ডাকো। উনাকে এসে বোঝাতে বলো।” রমিজ মির্জা তাচ্ছিল্যভাবে হেসে বলল,

    — “রাশেদরে জানাইয়া কী হইব? ওর সাহস আছে বাপের হুকুমের উপর কুনু কতা কওনের? আমি যতই চাইতাছি কতা এই ঘরের ভিত্রে আটকাইতে, তুমরা ততই সারা দুনিয়া জানাইতে চাইতাছো। কুকামের কথা পুরা গ্রাম জানাইতে চাও? আমি ব্যাপারটা ঢাইকা রাখতে চাইতাছি বুঝতাছো না? আমার বাড়িতে এই ঘটনা ঘটছে সেইটা মাইনষে জানুক, তা আমি চাই না। যেনা’র ঘটনা সারা দুইন্যা জানানোর কুনু বিষয় না। যদি জানাইতেই হয় তাইলে বিচার কইলাম ঘুইরা যাইবো। পুরা গ্রামবাসীর সামনে ওগো দুইটারে ৮০টা বেতের বাড়ি দেয়া হইব।

    অমিত এবার ক্ষেপে গিয়ে বলল,

    — “শালা বাস্টার্ড! পিস্তল মাথায় ঠেকিয়ে যা খুশি করার লাইসেন্স পেয়ে গেছিস? আমার ফোনটা শুধু একবার হাতে দে। দেখি তুই কোন বালটা ছেঁড়ার সাহস পাস।”

    — “এ্যাহ! গলায় খুব জোর এ্যা? রক্ত গরম, শইল গরম। গরমের ঠ্যালায় যহন তহন যার তার লগে শুইয়া শইলের গরম তেজ কমাও? এইবার তো দাদাজান ভুল জায়গায় কাম করছো। তুমারে এত সহজে আমি ছাড়তাছি না।

    — “বাবা মুখে লাগাম দিন আপনার। কথা বলার আগে নিজের বয়সের দিকটা একবার ভাবুন। আপনার হাঁটুর বয়সী ছেলেমেয়েগুলো সামনে দাঁড়িয়ে, ওদের সামনে কী করে এসব বাজে কথা মুখে আনছেন আপনি?”

    ননদের সঙ্গে তাল মেলালো নীতু।

    — “আপনি একটা অসভ্য পর্যায়ের মানুষ সেই কথা আমার ননদের বিয়ের পর প্রথম আপনার বাড়িতে আমার শ্বশুর পা রেখেই বুঝেছিল। বাসায় ফিরে বলেছিলও, এই বাড়িতে আত্মীয়তা বজায় রাখলে শুধু আমার ননদ কেন, আমরা সবাই জ্বলবো। এতগুলো বছর ধরে আপনার নানারকম যন্ত্রণা আমরা সহ্য করেছি। আপনার চাহিদা অনুযায়ী সব নিয়ম মেনে আপনার বাড়ি এসেছি, যখন যা চেয়েছেন তাই দিয়েছি। এখন আপনি আমার মেয়েকে শেষ করতে চাইছেন! সুরাইয়ার জীবন নরক বানিয়ে মনের আঁশ মেটেনি আপনার? মরতে হবে একদিন সে কথা খেয়াল আছে? এতসব অন্যায়, পাপের জবাবদিহি করবেন কী করে?”

    — “রওনককে আপনি জোর করে বিয়ে দিয়েছেন, আমরা আপনার সিদ্ধান্ত মাথা পেতে নিয়েছি। রওনক আপনার বংশের রক্ত, ওর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার আপনার আছে। নবনী কিংবা অমিত ওরা কেউ আপনার বংশের না কিংবা আপনি তাদের অভিভাবক না। আপনি এখানেই সব বন্ধ করুন বাবা। নয়তো আমি আপনার এই সংসার ছেড়ে চলে যাব। বুড়ো বয়সে মির্জা বাড়ির মেজো ছেলের ত্বালাক হয়েছে এটা লোকমুখে শুনতে নিশ্চয়ই আপনার ভালো লাগবে না।”

    — “কারে কী কইতাছো? বেড়া মাইনষে বুড়া হইলেও তেজ কমে না। বুড়াকালেও

    বাচ্চা পয়দা করার জোর আছে। বেডাগো ত্বালাক একটা ক্যান, দশটা হইলেও কেউ আঙুল তুলে না। ত্বালাক দিলে মাইনষে থুতু তুমারেই দিব। জামাই থুইয়া জ্বালাকের পর যাইবা কই? কুন বেডায় তোমারে ঘরণী করবো? যাও না, যাও। দাওগা ত্বালাক। আজকা একলগে ফুফু ভাতিঝির বিদায় হইব। একটারে বিয়া দিয়া বিদায় দিমু, আরেকটারে ত্বালাক দেওয়াইয়া। এমনিতেও তুমারে আমার সইহ্য হয় না মেজো বউ। খালি বংশের প্রথম বাত্তি দিছো দেইখা এই বাড়ির বউ হওয়ার সম্মান আমি তুমারে দিছি। নয়তো এই গ্রামের সীমানায় নি ঢুকতে দিতাম? তুমি গেলে আমার পুতরে আমি আরেকটা বিয়া দিমু। মরার আগে জ্বালা মিটবো এইটাই আমার শান্তি।’ পরিস্থিতি ক্রমশ আয়ত্ত্বের বাইরে যেতে দেখে রমিজ মির্জার পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লো নবনী। কাতর হয়ে বলতে লাগলো,

    — “দাদা, ফুফু রাগের মাথায় ওসব বলছে। আপনি বাদ দিন না। আপনার একটা ভুল ধারণার জন্য কতগুলো জীবন নষ্ট হবে একবার ভাবুন। সত্যি বলছি দাদা আমরা এতবড় অন্যায় কাজ করিনি। যেতে দিন আমাদের প্লিজ। আর কখনো আপনার বাড়ি আমরা পা রাখবো না, আমাদের ছায়াও আপনি দেখবেন না।”

    — “শাবানার মতোন কী সুন্দর কানতে পারো তুমি! কিন্তু আমি হইলাম এটিএম শামসুজ্জামান। আমার এইসব কান্দনে মন গলে না। হারাম কাম করছো, আমি হালাল কইরা দিতে চাইছি। ভালা কামের বিনিময়ে কত কতা শুনাইতাছে তুমার প্রেমিক, মা, ফুফু! এতকিছু সইহ্য কইরা তবুও সব রাখঢাক কেন রাখতে চাই জানো? রমিজ মির্জার বাড়িতে তারই আত্মীয়রা আকাম করছে, আমি চাই না এই কতাডা মাইনষের মুখে উঠুক। নয়তো কহন তুমগো দুইটারে গাছের লগে বাইন্দা বেতের বাড়ি দেয়া শুরু করতাম। এত প্যাঁচাল পারতে আর আমার ভাল্লাগতাছে না। সকালের নাস্তা অহনও করি নাই। পেটের ভিত্রে ইন্দুর দৌড়াইতাছে। শেষ কতা কমু, নিজেরাই ভাবো কুনডা করবা। তুমগো সিদ্ধান্ত শুইনা আমি খাইতে যামু। বিয়া যদি না করতে চাও, অন্য রাস্তাও আছে। সেটা হইলো তুমগো ঈদগাহ মাঠে নিয়া আশপাশের ৪-৫ গ্রাম মাইনষের সামনে বেত দিয়া পেটানো হইব। আর সঙ্গে তুমগো দুই মা আর বইনেগো মুখে কালি গলায় জুতার মালা দিয়া সারা গ্রাম ঘুরানো হইব। মুবাইল ফুনে তুমগো আর তুমগো মা বইনেগো ভিডু কইরা সারা বাংলাদেশ ছড়ানো হইব যাতে মানুষ যেনা করতে ডরায়। আর তুমগো বাড়িতে কুনু পোলা আত্মীয়তা করতে আওনের আগে যেন জানতে পারে কুন বাড়িতে তারা সম্পর্ক করতে আইতাছে।”

    অমিতের চোখে অসহায়ত্বের নোনাজল চিকচিক করছে। মা-বোনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো সে। চোখের সামনে মুনিয়ার হাসিমুখটা ভেসে উঠছে বারবার।

    রমিজ মির্জার পা ছেড়ে ফ্লোরে বসলো পড়লো নবনী। এই মুহূর্তে কান্নাও যেন থমকে গেছে। সবাই মিলে ঐ লোকটার সঙ্গে তুমুল তর্ক করছে। ধীরে ধীরে সে কোলাহল ক্ষীণ হতে হতে শূন্যে ঠেকলো। এই তো সামি বসে আছে শক্ত করে তার হাতজোড়া ধরে। ফিসফিসিয়ে বলছে,

    — “উপস্থিত বুদ্ধি আর কবে হবে তোমার? বড় হওনি? পরিস্থিতি সামলানো আর কবে শিখবে তুমি? তোমার একটা সিদ্ধান্তের উপর আরো দুটো মেয়ের জীবনের মোড় নির্ভর করছে। স্বার্থপরের মতন সিদ্ধান্ত নিও না। লোকটা যা বলছে তাই সে করবে। করার পর ভাবতে পারছো ওদের কোন মানসিক চাপের মাঝে কাটাতে হবে? সোশ্যাল মিডিয়া, রিলেটিভ সবাই মিলে জীবনটা নরক বানিয়ে দেবে ওদের। মেয়ে দুটোই বিয়ের উপযুক্ত। এখান থেকে বেরোতে হবে নবনী, ওদেরকে সেইভ করতে হবে। একটাই পথ খোলা, তুমি হ্যাঁ বলে দাও। আগে এখান থেকে বের হওয়া জরুরী, যাবার পর বিয়ে নিয়ে বাকিটা ভাবা যাবে। যত দ্রুত সম্ভব বিয়ের কাজ সেরে এখান থেকে সবাইকে নিয়ে বের হও। হ্যাঁ বলো নবনী। উঠে দাঁড়াও, বলো এই বিয়েতে তুমি রাজি।” একলাফে উঠে দাঁড়ালো নবনী। চিৎকার করে বললো, আমি রাজি। এক্ষুনি বিয়ের ব্যবস্থা করুন।

    সমস্ত তর্ক-কোলাহল এক মুহূর্তেই থেমে গেল। ঘরের ভেতর পুরোনো ফ্যানের খটখট আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। ঘরের সবাই তাকিয়ে রইলো নবনীর দিকে। অমিতের দিকে অসহায় চোখে তাকালো নবনী। ছলছল চোখজোড় যেন চিৎকার করে তাকে বলছে, আমাদের আর কোনো পথ খোলা নেই। নবনীর চোখের ভাষা হয়তো বুঝলো অমিত। বুকচিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল তার। নিচুস্বরে বললো,

    — “হুজুরকে ডাকুন।”

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleবাইবেল কোরআন ও বিজ্ঞান – মরিস বুকাইলি
    Next Article বাতাসে গুনগুন – খাদিজা মিম

    Related Articles

    খাদিজা মিম

    রুদ্র – খাদিজা মিম

    August 6, 2025
    খাদিজা মিম

    বাতাসে গুনগুন – খাদিজা মিম

    August 6, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.