ইতি নির্ভয়পুর – ১০
১০
“আচ্ছা পামেলা, এই যে আমি তোমার দুয়ারে ভিখিরির মতো আসি, তুমি কখনও অবচেতন মনেও আমার কথা ভাবো?”
প্রাক্তন ফুটবলার সুনীল সেনগুপ্তর চোখ দুটো ছল ছল করছে। পুরুষ মানুষদের কাঁদাতে পামেলার ভীষণ আনন্দ হয়। ওর সামনে মৃণাল ঘোষালের মতো জাঁদরেল লোকও কাঁদতে শুরু করে। বলে, “পালো, তুমি কেন আমার হলে না?”
পামেলা ওর মাখনের মতো হাত দুটো দিয়ে ঘোষালের চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলে, “কে বলল হইনি? তোমাকেই আমি সব থেকে কাছের বন্ধু ভাবি মৃণাল। আমার কাছে আসার চেষ্টা তো সমাদ্দারও কম করেনি। ঘেঁষতে দিয়েছি কখনও?”
মৃণাল উত্তেজিত হয়ে বলে, “শুয়োর একটা, ধান্দাবাজ। ওটাকে একেবারেই ঘেঁষতে দেবে না।”
সুনীল সেনগুপ্তর সামনে ফরেন লিকারের গ্লাসটা তুলে দিয়ে পামেলা বলে, “আহা সুনীল, তুমি এমন ছিঁচকাঁদুনে কেন বলো তো? স্পোর্টসম্যান স্পিরিট কই? সামনে ইলেকশন, এখন কি এসব কান্নাকাটির সময় আছে? ভোটে জিতলে আমি প্রধান আর তুমি উপপ্রধান হবে সুনীল। দেখো, এতদিন রাঘব সান্যালের অনেক অত্যাচার সহ্য করেছে নির্ভয়পুরের লোকজন। রাঘব থাকে জলপাইগুড়িতে। আর নির্ভয়পুর নাকি ওর জন্মভূমি, তাই ইলেকশন লড়ে এখান থেকে। নির্ভয়পুরের কোনও প্রয়োজনে আসে রাঘবরা? জল থেকে পাওয়ার প্রতিটা বাড়িতে পৌঁছে দেব আমরা। এটাই প্রচার করো।”
সুনীল পামেলার ডান হাতটা খপ করে ধরে বলল, “আমি শুধু আমার প্রাণটাই দিতে বাকি রেখেছি তোমার জন্য। বলো তো সেটাও দিই।”
পামেলা ওর ঘায়েল করা রহস্যময় হাসিটা হেসে বলল, “আমি জানি সুনীল, নির্ভয়পুরের লোকজন তোমায় ঘরের ছেলে মনে করে। সেটাই কাজে লাগাও।”
সুনীল নেশা লাগা গলায় বলল, “তোমার সিট সিকিওর পামি। রংবুলে আমার সিট নিয়ে একটু চিন্তায় আছি। রংবুলে রাঘব যাকে দাঁড় করিয়েছে সে একজন সমাজসেবী মহিলা। কারও কিছু হলে সকলেই সবিতা দস্তিদারের কাছেই ছোটে। মহিলার বিশাল ইমেজ। নির্ভয়পুর পঞ্চায়েত ছোট হলে কী হবে তিনটে পার্টিই স্ট্রং। খুব কম মার্জিন থাকে একে অপরের থেকে। দু চারজন ভোটার এদিক-ওদিক করলেই হেরে যাবার চান্স।”
পামেলা হেসে বলল, “মহিলার হাজবেন্ড কী করে খোঁজ নাও। মহিলা রাজনীতি করে বেড়াচ্ছে, স্বামী নিশ্চয়ই বাড়িতে অবহেলিত হচ্ছে। খোঁজ নাও সুনীল। একদিন ক্লাবে ভেকে ড্রিঙ্ক করাও, টাকাপয়সা লাগলে দাও। তোমায় নিয়ে আর পারি না। আর ওই শৌনক বসুকেও একদিন ভিনারে ডাকো। নির্ভয়পুর হসপিটালে কী কী লাগবে তার একটা লিস্ট দরকার আমার।”
সুনীল পামেলার গালে নিজের রুক্ষ হাতটা বুলিয়ে বলল, “তোমার মধ্যে আমি শুধুই সম্ভাবনা দেখতে পাই পামি। ইউ আর রিয়েলি ব্রিলিয়ান্ট।”
সুনীল যখন একটু বেশিই আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠে তখন পালোকে পামি বলে ডাকে। এক্স ফুটবলার বলেই শরীরচর্চাটা এখনও বজায় রেখেছে সুনীল। আর ওর এই টান টান চাবুকের মতো শরীরটাই বেশি পছন্দের পামেলার। সরাসরি না বললেও ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেয় পামেলা।
পামেলা পরিষ্কার বলে, “সুনীল আমি বেডরুমের কথা বেডরুমে রাখতেই পছন্দ করি। যদি কোনওদিন পাঁচকান হয়, জানবে সেদিন থেকে তুমি আমার বেডরুমে ঢোকার অধিকার হারালে।”
সুনীল অনুভব করে, বিছানায় পামেলা যেন একুশের তন্বী। সুনীল হাঁপিয়ে যায় ওকে খুশি করতে গিয়ে। কিন্তু যখনই ওয়াশরুম থেকে ফিরে পোশাক বদলে নেয় পামেলা, তখনই ওর গলার স্বর আবার সেই সাবধানি বিজনেস ওম্যানের মতো। পামেলার ওই যত্ন করে গড়ে তোলা শরীরটার অধিকার সুনীল মাসে দু’বারের বেশি পায় না।
পামেলা বলে, “বয়েস হচ্ছে সুনীল, সংযম দরকার।”
সংযমের সেই জীবনই তো পালন করছিল সুনীল। অবিবাহিত জীবনই কাটাচ্ছিল। কোনওদিন কেউ বলতে পারবে না সুনীলের কোনও মহিলাঘটিত দুর্নাম আছে। কিন্তু ওর ব্রহ্মচারী জীবন ভাঙল তো পামেলা। পামেলাকেও ও সম্মানের চোখেই দেখেছিল।
ওর ফুটবল ক্লাবের জন্য মোটা অঙ্কের অর্থ ডোনেট করার পরেই পামেলা একদিন ওকে বাড়িতে ডেকে এনেছিল। না ড্রয়িংরুমে নয়, সোজা বেডরুমে নিয়ে গিয়েছিল। স্বচ্ছ পোশাক পরে ওর সামনেই বিছানায় শুয়ে বলেছিল, “পরখ করছি নিজের সৌন্দর্য, তোমার মতো সুপুরুষকে যদি আকৃষ্ট করতে না পারি তা হলে কাল থেকে ছেড়েই দেব রূপচর্চা।”
এ ইঙ্গিতে যে কোনও কেউ ঘায়েল হবেই। সাড়া দিতে বাধ্য হয়েছিল সুনীল। ঠিক যেন সম্মোহনী ডাক।
রতিক্লান্ত পামেলা বলেছিল, “সুনীল, আমি যে তোমার ভার্জিনিটি নষ্ট করে ফেললাম, দুঃখ হচ্ছে নাকি?”
সুনীল বলেছিল, “স্বপ্ন মনে হচ্ছে।”
সেই শুরু ওদের গোপন সম্পর্কের। বাইরে ওরা বিজনেস পার্টনার, সোশ্যাল ওয়ার্কার, কিন্তু বেডরুমের নীল আলোর ওরা বেড পার্টনার 1
সুনীল বলেছিল, “পামেলা, আমরা বিয়ে করতে পারি না?”
পামেলা হেসে বলেছিল, “আমি মিস পামেলা মিত্ৰতেই অভ্যস্ত। ভবিষ্যতে আর এসব সম্পর্ক পাতানোর কথা বলবে না।”
পামেলা রহস্যময়ী। ঠিক শীতকালে চার্চের মাঠে জমে থাকা ভোরের কুয়াশার মতোই। মনে হয়, বুঝি একটু এগোলেই গোটা মাঠ দেখা যাবে, কিন্তু যত এগিয়ে যায় ততই যেন চাপ চাপ কুয়াশা আরও অন্ধকার করে দেয়। সুনীল ভয় পায় পামেলাকে। হারানোর ভয়। ইদানীং আর-একটা ভয় যোগ হয়েছে, কোনও কারণে যদি ইলেকশনে পামেলা হেরে যায়, তা হলে হয়তো সুনীলকে আর চিনতেই পারবে না পামেলা। নির্ভয়পুরে সুনীলের ইমেজটাকে কাজে লাগিয়েই ভোটে জয়ী হতে চাইছে পামেলা। কিন্তু সুনীলের অবজারভেশন বলছে, সুজয় হাঁসদার পপুলারিটি অনেক বেশি। নির্ভয়পুরের লোকজন পামেলাকে মালিকপক্ষই ভাবে। নিজেদের ঘরের লোক কেউ মনে করে না। সুজয়ের সামনে দাঁড়ানো মুশকিল। এছাড়াও এখানের বর্তমান জয়ী দলের রাঘব তো আছেই। পামেলার এই ক্ষমতার প্রতি আসক্তিকে বড়ো ভয় করে সুনীলের। কিছুতেই যেন তৃপ্ত হয় না পামেলা। টাকার গদিতে শুয়ে আরও টাকার স্বপ্নই দেখে ও। পাওয়ার, পজিশন, মানি আর গ্ল্যামারের প্রতি অদ্ভুত নেশা পামেলার। জীবনের একটা দিনও বোধহয় ও নির্ভেজাল আনন্দ উপভোগ করতে পারেনি, কারণ ওর মাথায় চব্বিশঘণ্টা ঘুরছে, কেউ ওর থেকে এগিয়ে গেল না তো!
নিজের মুখে ব্র্যান্ডেড একটা ক্রিম ঘষতে ঘষতে পামেলা বলল, “এই সুনীল, আমায় বয়স্ক লাগে নাকি আজকাল? হাঁপিয়ে যাই নাকি?”
সুনীল অন্যমনস্কভাবে বলল, “তুমি হলে গ্ল্যামার কুইন। আর এনার্জি নিয়ে কোনও কথা হবে না।”
পামেলা সুনীলের হাতটা ধরে বলল, “কী গো, এত অন্যমনস্ক হয়ে ভাবছটা কী?”
সুনীল বলল, না ভাবছি, এবারের ইলেকশনে বেশ লড়াই হবে। প্রতিবার তো প্রায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রাঘব জিতে যায়। মৃণাল ঘোষাল যেবার দাঁড়িয়েছিল সেবারেও গোহারা হেরেছিল। আসলে নির্ভয়পুরের লোকজনের মাথায় ঢুকেই গেছে, তোমরা হলে বাইরের লোক।”
পামেলা ক্রিম মাসাজ বন্ধ করে সোজাসুজি সুনীলের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি বোধহয় এতদিনে জানো, আমি পরাজয় শব্দটাকে অত্যন্ত ঘৃণা করি। তাই আমার সামনে এসব নেগেটিভ কথা বলবে না। টাকা নাও, প্রচার করো। এনি কস্ট আমার পোস্ট চাই। নির্ভয়পুর ছোটো জায়গা। রংবুল ইদানীং আয়তনে বাড়ছে, কিন্তু নির্ভয়পুরের প্রতিটা ঘর তুমি চেনো। প্রতিটা ঘর ঘুরতে তোমার সময় লাগবে বড়োজোর তিন দিন। ওদের ঘরে গিয়ে ওদের সমস্যার কথা শোনো। ওদের বোঝাও, পামেলা-ম্যাম এলেই ওদের এই ভিখিরি অবস্থার উন্নতি হবে। সুজয় হাঁসদা ওদের কোনও স্বর্গ দর্শন করাবে না। এটা বোঝাও সুনীল। আর শোনো, তোমার ক্লাবে একটা ফুটবল টুর্নামেন্ট অ্যারেঞ্জ করো। নির্ভয়পুরের বাচ্চাদের মাংস-ভাত খাওয়াও। পুরস্কার আমি দেব। খাওয়ার টাকাও আমি দেব। তাড়াতাড়ি করো।”
সুনীল বলল, “এটাতে লাভ হবে?”
পামেলা হেসে বলল, “কীসের লাভ সুনীল? বাচ্চাগুলোকে একদিন খাওয়াব, সেখানেও লাভ-লোকসান হিসেব করব? তুমি কি আমায় চামার সমাদ্দার পেলে নাকি? আর শোনো সুজয়ের দুর্বলতা কী, সেটা খুঁজে বের করো।”
সুনীল একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে উঠে পড়ল। এত দিনে ও জেনে গেছে, পামেলার চাওয়া মানে আবদার নয়, আদেশ। সুনীলের খারাপ লাগছে, নির্ভয়পুরের মানুষগুলো ওকে বিশ্বাস করে, ভালোবেসে তাদের ঘরের ছেলেদের ওর কাছে পাঠায়। সেটুকুও স্বার্থের কাজে লাগাতে হচ্ছে বলেই অন্তর্দ্বন্দ্বে ভুগছে ও। একদিকে পামেলার আকর্ষণ, বিলাসবহুল জীবনের হাতছানি, অন্যদিকে নির্ভয়পুরের ফুটবলপ্রেমী ছেলেগুলোকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত করে নিজের স্বপ্নটুকু বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা। এমন দ্বন্দ্বে পড়ে হাঁসফাঁস করছে সুনীল। প্লেয়ার বানাতে গেলে টাকা লাগে, তার জোগান দেবে পামেলা। কিন্তু যদি হেরে যায় তা হলে তো আর ফুটো কড়ি দাম থাকবে না সুনীলের ওর কাছে। ব্যবহার করা টয়লেট পেপারের মতো ওকে ছুড়ে ফেলে দিতে দু’বার ভাববে না পামেলা মিত্র। বড্ড নিষ্ঠুর মহিলা। সেন্টিমেন্টের কোনও মূল্য নেই ওর কাছে।
সুনীল ওকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল, “নির্ভয়পুরের মতো ছোটো জায়গার পঞ্চায়েত প্রধান হয়ে কী হবে পামেলা? তুমি কলকাতায় দাঁড়িয়ে রাজনীতি করতে পারতে। তাছাড়া নির্ভয়পুর পঞ্চায়েতের আন্ডারে বুরগুন্দি, রংবুল, নিশান, দক্ষিণপাড়ার ক্যান্ডিডেটদের মধ্যে থেকে যে কাউকে প্রধান করবে না তার কি গ্যারেন্টি আছে?”
পামেলা নিজের কোম্পানির গোল্ডেন কালারের চায়ে চুমুক দিয়ে বলেছিল, “কলকাতায় চেষ্টা করিনি, সেটা তোমায় কে বলল? টাকাও ঢেলেছিলাম। কিন্তু টিকিট পাইনি। ওটা বড়ো মাঠ সুনীল। ওখানে শুধু ব্যবসাদার হলে টিকিট পাওয়া যায় না। পরিচিত ফেস হতে হবে। নির্ভয়পুর দিয়েই আমি আমার রাজনীতির কেরিয়ার শুরু করতে চাই। পঞ্চায়েত প্রধান থেকে একদিন মন্ত্রী হব। এটাই আমার চ্যালেঞ্জ। তখন আমার রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড আছে কি না, সেটা নিয়ে প্রশ্ন করার লোক থাকবে না। আরেকটা কথা হিমসাগর পেলে কেউ পেয়ারাফুলি খাবে? বীরেনদা আমায় কথা দিয়েছে, আমি জিতলে প্রধান হিসেবে আমাকেই সিলেক্ট করবে পার্টি।”
সুনীল বুঝেছিল, পামেলা ছক কষেই নেমেছে। সিঁড়ি বেয়ে উঠবে। সুনীল হচ্ছে সেই সিঁড়ির একটা ধাপ মাত্র।
পামেলার বাড়ি থেকে বেরোনোর সময়ই নীহারের সঙ্গে দেখা। দেখে তো মনে হল না অফিস থেকে এল, মনে হল, ছবি আঁকার জন্য মডেল খুঁজতে গিয়েছিল। সমুদ্রনীল রঙের টি-শার্টের ওপরে সাদা পাতার প্রিন্ট আর কার্গো প্যান্ট পরে নিশ্চয়ই মিত্র এস্টেটের মালিক অফিসে যাবে না। সেটা পামেলার মতো নিখুঁত মহিলা মেনেও নেবে না। সে যতই ভাই হোক।
দামি গাড়ি থেকে নামল নীহার, পিঠে ওর আঁকার সরঞ্জাম। সুনীলের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, “ম্যাডামের মুড এখন কেমন সুনীলদা?”
নীহার ছেলেটা দিদির মতো নাক উঁচু নয়। ডাউন টু আর্থ বলেই এই ক’মাসেই নির্ভয়পুরের মানুষদের কাছে বেশ আপন হয়ে উঠেছে। সেদিন সুনীল দেখেছে, ফুলমণিকে সামনে বসিয়ে ছবি আঁকছিল। মাটির ওপরে চাটা বিছিয়ে বসেছিল নীহার। সুনীলের বেশ পছন্দ নীহারকে। পামেলার আওতায় থাকলেও নীহার বেশ স্বতন্ত্র। অর্থ ছাড়াও পৃথিবীর অন্য রূপ নজরে পড়ে ওর। নির্ভয়পুরের ঘরে ঘরে ঘুরে বেড়ায় ছেলেটা। এখানের বাসিন্দাদের সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গেছে। এদিকে ওর দিদি মনে করছে, এসি ঘরে বসে ইলেকশন জিতবে শুধু সুনীলের ইমেজের জোরে। নিজে একদিনও নির্ভয়পুরের মানুষদের বাড়ির উঠোনে অবধি পা রাখেনি পামেলা। সুনীল প্রস্তাব দেওয়ায় হেসে বলেছিল, “দুঃখিত সুনীল, আমি ওই ভিখারিদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে ভোট চাইতে পারব না। একটা জনসভা অ্যারেঞ্জ করো, সেখানে এদের জড়ো করো, তখন না হয় একটা জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে দেব।” সুনীল বোঝানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিল।
নীহার বলল, “সুনীলদা একটা কথা বলুন, আপনি যদি নির্ভয়পুরের মানুষ হতেন, তা হলে পামেলা মিত্রকে ভোট দিতেন? দিলে কেন দিতেন?”
সুনীল মাথা নিচু করতেই নীহার বলল, “নিজেই যখন বিশ্বাস করেন না, তখন তার হয়ে প্রচার করছেন কেন? ভায়? শুনুন, পামেলা মিত্রকে যত ভয় পাবেন, তত ভয় দেখাবে ও। আমিও ঘুরি এই অসহায় মানুষগুলোর বাড়িতে বাড়িতে। দেখি এদের জীবনযাত্রা। কতটা কষ্টে আছে এরা। বর্তমান প্রধান রাঘব এদের জন্য কিছুই করেনি বলতে গেলে। পামেলাও করবে না। আর এমএলএ তো জলপাইগুড়ি শহরে বাড়ি হাঁকিয়ে আছে। ওই রাঘবের কাছ থেকেই শুনে নেয় এখানের লোকজন কত সুখে আছে। নিজে এসে তো
দেখার প্রয়োজনও মনে করেন না গ্রামের মানুষগুলো কেমন আছে? পামেলা এখানে অনেকটা জায়গা কিনে রেখেছে। সেখানে দুটো হ্যান্ডলুম কারখানা খুলতে চায়। পুরো উত্তরবঙ্গকে ওর কারখানার তৈরি চা আর কাপড় বেচতে চায়। মুশকিল হচ্ছে, রাঘব কী সব গ্যাঁড়াকল করে ওই হ্যান্ডলুম কারখানার পারমিশন বাতিল করিয়ে দিয়েছে। তাই দিদি এখন রাঘবের জায়গায় বসতে চাইছে। খুব সিম্পল হিসেব। না হলে পঞ্চায়েত প্রধানের মতো সামান্য পদে বসার জন্য দিদি এত মাথা খারাপ করত না।”
সুনীল বলল, “আমি জানি। রাঘব অন্যায় কিছু করেনি। পলাশবনার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাবে ওখানে যদি হ্যান্ডলুম কারখানা হয়। পাকা সড়কের সঙ্গে মেশাতে হবে পলাশবনার পাশের রাস্তাটা। সেই কারণ দেখিয়েই রাঘব পারমিট বাতিল করিয়ে দিয়েছে ওপর মহল থেকে। এই থেকেই রাঘবকে সরানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছে পামেলা।”
নীহার বলল, “আমার দিদি তো, তাই জানি সুনীলদা, স্বার্থ ছাড়া এক পা-ও হাঁটে না। নির্ভয়পুরে যদি পামেলা মিত্র জয়ী হয়, তা হলে এদের আরও দুর্দশা হবে। অথচ এরা বুঝতেও পারবে না, ঠিক কী ঘটে চলেছে এদের সঙ্গে। আপনাকে এরা বিশ্বাস করে সুনীলদা, আপনি এদের এত বড়ো ক্ষতি করবেন?”
সুনীল ভীত গলায় বলল, “না হলে যে তোমার দিদি আমায় শেষ করে দেবে নীহার। পামেলার সাজানো চক্রব্যূহের মধ্যে যেদিন পা রেখেছিলাম, সেদিন ওর এই নিখুঁত প্ল্যানের খবর আমার কাছে অজানা ছিল। যখন জানলাম, তখন আমার আর কিছু করার নেই। স্রোতের টানে ভেসে যাওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।”
নীহার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “জানি সুনীলদা। আমিও দিদির দাবার একটা ঘুঁটি। জানি না দিদি হঠাৎ নির্ভয়পুরের মিত্র এস্টেটের দায়িত্ব আমায় কেন দিতে চাইছে। এ ধাঁধার হদিশ এখনও আমি পাইনি। পামেলা মিত্র কাউকে এক চুল জায়গা ছাড়ে না, যদি সে দিদির কেনা গোলাম না হয়। মেজদি, জামাইবাবু দিদির দাসত্ব স্বীকার করেছে বলেই দিদি দরাজ হাতে ওদের দায়িত্ব ছেড়েছে। কিন্তু আমি তো এখনও দিদির ক্রীতদাসে পরিণত করিনি নিজেকে, তাও কেন দিদি আমায় এত যত্ন করে এখানের কোম্পানির এমডি করে দিল, বুঝলাম না। যদিও প্রতিটা কাগজে সাইন করার জন্য পিয়নের মতো আমায় ফাইল বয়ে পামেলা মিত্রর কাছেই নিয়ে আসতে হচ্ছে, কিন্তু তবুও আমার রুমের সামনে যে নেমপ্লেটটা লাগানো হয়েছে তাতে আমায় এমডি বলেই উল্লেখ করা হয়েছে। এ রহস্য আমি এখনও ভেদ করতে পারিনি। তবে আমি এটুকু বলতে পারি সুনীলদা, পামেলা মিত্র এখন যতই বড়ো বড়ো কথা বলুক, নির্ভয়পুরের লোকেদের জন্য কিছুই করবে না ভবিষ্যতে।”
সুনীল বিমর্ষ মুখে বলল, “এটা আমি জানি নীহার। আসলে গরিব মানুষদের নিয়ে আর্টিকেল লিখলে লেখকের নাম হয়, কিন্তু তাদের একটা পাঁচ টাকার কেক কিনে দেবার লোক খুঁজে পাওয়া যায় না। যদি বা পাওয়া যায়, সেটাও কেক হাতে ছবি পোস্ট করার জন্য। আসলে এদের দুঃখ বিক্রি করে নাম কিনতে চায় অনেকেই, কিন্তু এদের দুঃখ কমানোর ব্যাপারে সবাই বড়ো উদাসীন।”
নীহার বলল, “আমার খুব খারাপ লাগে সুনীলদা আপনার জন্য, আমার জন্য। আমরা যারা পামেলা মিত্রর কাছের লোক, তাদের জন্য খারাপ লাগে।”
সুনীল মাথা নিচু করে চলে এল। খারাপ লেগে তো লাভ নেই। টার্গেট ফুলফিল না করতে পারলে পামেলা ওই খাদের ধার থেকে ছুড়ে ফেলে দেবে সুনীলকে। না, ওর হাত কাঁপবে না। তাই বিবেকের কথা শোনার সময় এখন নেই সুনীলের। একটা ফুলবল টুর্নামেন্ট, একটা জনসভা আর রংবুলের প্রার্থী সবিতার হাজবেন্ডকে কবজা করার লক্ষ্যে দৌড়াতে হবে সুনীলকে। সবিতা যাতে হারে সেই চেষ্টা করতে হবে, এদিকে সুজয়কে হারাতে হবে। আজকাল বড়ো ক্লান্ত লাগে সুনীলের। বয়েসকালে এসে কেন যে লোভ ওকে গ্রাস করল কে জানে! ওর স্বাভাবিক জীবনটাই হারিয়ে ফেলেছে ও।