ইতি নির্ভয়পুর – ১১
১১
“স্বাভাবিক, কোনটা স্বাভাবিক মৃণাল? মহিলাদের প্রতি এই বয়সেও তোমার দুর্বলতা স্বাভাবিক। তুমি বোধহয় ভুলে যাও, তোমার বয়েসটা পঁয়ষট্টি, তোমার ছেলের বয়েস বাইশ, মেয়ে চব্বিশ। এখনও তুমি ওই পামেলা মিত্রর আশেপাশে ঘুরঘুর করো কী করে?”
কনকলতা এমনিতে খুবই শান্ত মহিলা। কিন্তু স্বামীর নামে মহিলা ঘটিত কোনও কথা শুনলেই সজাগ হয়ে ওঠেন। কারণ, মারা যাবার আগে মৃণালের মা মানে কনকলতার শাশুড়িমা নিজে বলে গিয়েছিলেন, “ছেলের আমার অনেক কুকীর্তি আছে গো মা। মা হয়ে সেসব বউমার কাছে বলি কী করে? এসব হল এই ঘোষাল বংশের দোষ। টাকা আর মেয়েমানুষের নেশা এ পরিবারের সবার ছিল। আমার শ্বশুরেরও ছিল, তোমার শ্বশুরেরও ছিল। মৃণালেরও কম বয়েস থেকেই মেয়ে মানুষের নেশা। তোমার শ্বশুরমশাই টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করাতেন। তিনি আজ স্বর্গে না হয় নরকে গেছেন। আমিও আর বেশিদিন নেই। তোমার মতো লক্ষ্মীমন্ত বউমা পেয়েছিলাম আমার কপাল ভালো তাই। না হলে নিজের ছেলের দোষ ঢাকতে ঢাকতে জীবন কাটে? তোমায় একটা কথা বলে যাই বউমা, এত নরম-সরম হলে কিন্তু চলবে না গো। মৃণালকে কোনও মেয়ের কাছে ঘেঁষতে দেখলেই ফোঁস করে উঠবে। না হলে তোমার সংসারখানা ভেসে যাবে। তবে এরা এমনিতে খুব টনটনে। বিয়ে তাকে করবে না। কিন্তু মজা নেবে। কনক, আমার একটা কথা মাথায় রেখো মৃণালকে মহিলাদের সঙ্গে মিশতে দেবে না। ছেলের আমার চরিত্র মোটেও ভালো নয়।”
স্বভাবভীরু কনকলতা তখন শাশুড়ির গায়ের কাছে ঘেঁষে বলেছিল, “কী হবে মা, আমার যে ভয় করছে। ও কত রাগি মানুষ। আমি কি ওর সামনে মুখ খুলতে পারব?”
শাশুড়ি বলেছিলেন, “শোনো কনক, এই বাড়ি আমি তোমার নামে করেছি। ব্যাঙ্কে টাকাও কিছু কম রইল না তোমার নামে। রাস্তার ধারের জমিও তোমার নামে করে দিয়েছি। আমার যা ছিল একটাও মৃণালকে দিইনি। সব তোমার নামে আছে। ভয় কীসের? অর্থই বল। হ্যাঁ, মৃণালের যা আছে তাতে হয়তো এমন বাড়ি ও পাঁচটা হাঁকাতে পারে, কিন্তু তোমার মাথার ওপরের ছাদ কেড়ে নিতে পারবে না। তাই প্রতিবাদ করবে।”
শাশুড়িমা কনককে বরাবরই খুব স্নেহ করতেন। মেয়ে ছিল না বলেই হয়তো নিজের মেয়ের মতোই প্রশ্রয় দিতেন। কনকও খুব শ্রদ্ধা করত। তাই মৃণাল ওর ব্যবসার ব্যাপারে যা ইচ্ছে করুক, কনক ঘুরেও দেখত না। কিন্তু কোনও মহিলার সঙ্গে মৃণালের ঘনিষ্ঠতা দেখলেই ফোঁস করে উঠেছে। শান্ত হলেও কনককে বেশ ভয়ই পায় ঘোষাল। ঘোষালের ট্রান্সপোর্টের ব্যবসার নামই কনকলতা ট্রাভেলস। এ নাম ওর বাবার দেওয়া। কনকলতাকে বাবা বলত, ঘোষাল বাড়ির লক্ষ্মী। কারণ কনক এ বাড়িতে আসার পরেই ওদের ব্যবসা ফুলে-ফেঁপে উঠেছিল। বাবা-ই তখন শখ করে ঘোষাল ট্রাভেলস নাম বদলে রেখেছিলেন কনকলতা ট্রাভেলস। মৃণালের কোনও ব্যাপারে কনক কিছুই বলে না, শুধু কোনও মহিলাসঙ্গী দেখলেই তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে।
মৃণাল বলল, “ভুলভাল কথা বোলো না কনক। তোমার গুপ্তচরকে বোলো, ভুল খবর দিয়ে তোমার কাছ থেকে যেন টাকা না নেয়।”
কনকলতা সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “গতকাল সন্ধেতে গ্রিনভ্যালি ক্লাবের পুল সাইডে তুমি আর পামেলা মিত্র ঠিক কীসের আলোচনা করছিলে?”
মৃণাল দীর্ঘশ্বাসটা বেশ জোরেই ফেলে বলল, “কনক, ঠিক কত টাকা তুমি স্যালারি দাও তোমার এই গুপ্তচরকে?”
কনকলতা গম্ভীর স্বরেই বলল, “সেটা তো তোমার ব্যবসার আওতায় পড়ে না, তাই তোমায় না বললেও চলবে। তুমি বরং আমায় বলো, ঠিক কী আলোচনা হচ্ছিল পামেলা মিত্রর হাতে হাত দিয়ে?”
মৃণাল এবারে একটু নড়েচড়ে বসে বলল, “এসব সম্পূর্ণ ভুলভাল তথ্য তোমায় কে দেয় বলো তো? তুমি তোমার স্পাইয়ের মাইনে কেটে নিয়ো। গতকাল কেন, এক সপ্তাহ আমার সঙ্গে পামেলার দেখাই হয়নি। সে এখন ভোটের প্রচারে ব্যস্ত। হ্যাঁ, ক্লাবে এলে অবশ্যই হাই-হ্যালো হয় বই-কি, কিন্তু না এলে তো আমি তার বাড়িতে চলে যাব না।”
কনকলতা হেসে বলল, “আমি ঈশ্বরের কাছে চব্বিশ ঘণ্টা ডাকি, তোমার ছেলে-মেয়ে যেন তোমার মতো দুশ্চরিত্র, মিথ্যেবাদী না হয়। মৈনাক আর মৌবনী অবশ্য এখনও তোমার আসল রূপটা জানেই না। বলতে পারো আমিই লুকিয়ে রেখেছিলাম। ভেবেছিলাম দুই ছেলে-মেয়ের বাপ হওয়ার পরে হয়তো তোমার স্বভাবের পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু না, সেটা তো হবার নয়! তুমি পাল্টাবে না। মৈনাক আর মৌবনীকে তা হলে এবারে বিষয়টা পরিষ্কার করে জানানো দরকার, তাই না? ছেলে-মেয়ে বড়ো হয়েছে, তাদেরও একটা সম্মানের বিষয় আছে। ওদের এবারে লোকে বলবে বাবা সম্পর্কে, তার থেকে বরং আমিই সবটা বলে দিই। তাতে আচমকা আঘাত লাগবে না।”
মৃণাল ঘোষাল ছটফট করে উঠল। রাগি গলায় বলল, “ভুলভাল তথ্য পেয়ে সন্তানদের সামনে আমার বদনাম করতে তোমার লজ্জা করবে না
কনক? ঘোষাল বাড়ির বনেদিয়ানার বিন্দুমাত্র ও শিখতে পারোনি তুমি এতগুলো বছরে।”
কনকলতা নিজের ফুলিয়ার তাঁতের শাড়ির ভারী আঁচলটা সামলে মৃণালের সামনে গিয়ে বলল, “দেখো তো ছবির লোকটাকে তোমার মতো দেখতে কি না? লভিবক্সে এই জামাটা বোধহয় এখনও পড়ে আছে।”
সেন্টার টেবিলের ওপরে নিজের স্মার্ট ফোনটা ঠক করে রেখে দিয়ে ধীর পায়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা লক করে দিল কনক। দরজা বন্ধের আওয়াজটা ওর চলে যাওয়ার মতো নরম হল না, বেশ জোরেই শোনা গেল ড্রয়িংরুম থেকে। কনকের ফোনটা হাতে নিয়েই স্থবির হয়ে গেল মৃণাল। পামেলার হাত ধরে ঘনিষ্ঠভাবে বসে আছে মৃণাল, পরিষ্কার ছবি। কাউকে না চেনার কোনও কারণ নেই। মৃণালের হাতটা কেঁপে উঠল। কে তুলল এ ছবি? না কোনও সস্তার ক্যামেরায় তো-তোলা নয় এ ছবি, বেশ দামি রেজোল্যুশনওয়ালা ক্যামেরায় তোলা। পুল সাইডে হালকা আলোতেও বেশ স্পষ্ট ছবিটা উঠেছে। না, যতদূর মনে পড়ছে সামনে দাঁড়িয়ে ওদের কেউ ছবি তুলছিল না। ইনফ্যাক্ট কালকে ক্লাবে লোকজনও কমই ছিল। তা হলে এ ছবি যে তুলেছে, সে বেশ দূর থেকেই তুলেছে। তারপরেও এত স্পষ্ট ছবি তুলল কে? দামি ক্যামেরা তো থাকার মধ্যে আছে ওদের কয়েকজনেরই। মল্লিকের মেয়ের দামি ক্যামেরার শখ। মল্লিক বলেছিল বিদেশ থেকে মেয়ের জন্মদিনে ক্যামেরা আনিয়ে দিয়েছে। মৃণালের ছেলে মৈনাকের আছে একটা দামি ক্যামেরা। পামেলার ভাই নিয়ে ঘোরে মাঝে মাঝে। আর আছে ডাক্তার শৌনকের বেশ দামি একটা ক্যামেরা। নুপুর এখন নির্ভয়পুরে নেই। মৈনাকও নেই। ডাক্তার শৌনক ওই সময় নিজের চেম্বার সামলায়। তা হলে কি ছবিটা পামেলার ভাই তুলল? কিন্তু ছবিটাতে তো মৃণালের একার বদনাম হচ্ছে না, পামেলা মিত্ররও হচ্ছে। পামেলা এবারের ক্যান্ডিডেট। তাই এ ছবি ভাইরাল করে ওর বদনাম করবে না নীহার। তা হলে ছবিটা তুলল কে? না, কোনও সস্তার মোবাইলে তোলা নয়। কনকের রাগ ভাঙানোর থেকেও মৃণালের কাছে জরুরি হয়ে গেছে, ছবিটা তুলল কে? আর কনককে-ই বা পাঠাল কেন? হরেক প্রশ্ন মাথার মধ্যে কিলবিল করে উঠল। নির্ভয়পুরের বাতাসে এখন অনেকরকম রাজনীতি ঢুকে গেছে। সেই আগের নির্ভয়পুর আর নেই। এখানের সহজ-সরল মানুষগুলোও এখন জটিল হয়ে উঠছে। সুজয়ের মুখটা মনে পড়তেই ভাবনায় ছেদ পড়ল মৃণালের। যত নষ্টের গোড়া ওই সুজয়। নির্ভয়পুরের আদিবাসীদের শিক্ষিত করে তোলার পিছনে সুজয়ের হাত আছে। এখন এরা মুখের ওপরে কথা বলে, নিজের পাওনা বুঝে নিতে শিখে গেছে। এই তো সেদিন ধনঞ্জয়ের ছেলেটা মৃণালের মুখের ওপরে বলে দিল, “ড্রাইভারদের স্ট্রাইক করে দিলে তোমার একদিনে কত লোকসান হবে একবার হিসেব করো দেখি? যদি বোঝো আমাদের পরবে বোনাস দেওয়ার থেকে বেশি ক্ষতি হচ্ছে না, তা হলে বোনাস দিয়ো না। আমরা বরং একদিনের জন্য স্ট্রাইক ডেকে দিই। তোমার সব বাস-চার চাকা বন্ধ থাকুক।” এদের কে উস্কাচ্ছে সেটা জানতে মৃণালের বাকি নেই। কিন্তু এখন তো সন্দেহ হচ্ছে, নীহারকে সুজয় হাত করে নিল না তো? নীহার নির্ভয়পুরের আদিবাসী পাড়ায় খুবই ঘোরাঘুরি করে। পামেলা যতই ওকে মিত্র এস্টেটের এমডি-র আসনে বসাক, ছেলের মতিগতি মোটেই ভালো নয়। সুজয়ের সঙ্গে তলায় তলায় হাত মিলিয়ে দিদির বদনাম করতে নামল কি না কে জানে! না হলে এ ছবি তুলল কে?
ফোনটা হাতে নিয়েই কনকের দরজায় মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলল, “আরে সবকিছুকে এত সিরিয়াসলি নেওয়ার কী আছে? ড্রিঙ্ক করেছিলাম, কোনও কথাতে হয়তো ওর হাতটা ধরেছিলাম। এতে হয়েছেটা কী?”
কথা বলতে বলতেই কনকের হোয়াটস অ্যাপটা খোলার চেষ্টা করল মৃণাল। তা হলে বোঝা যাবে, এ ছবি কার কাছ থেকে এসে পৌঁছেছে কনকের কাছে। হোয়াটস অ্যাপ ওপেন করতে গিয়েই ধাক্কা খেল মৃণাল। লক করা আছে। কনক এত জটিল হল কবে? বিয়ের পর থেকে তো মৃণালের কথাকেই ধ্রুবসত্যি মনে করে জীবন কাটিয়েছে। হ্যাঁ ছেলে-মেয়েরা বড়ো হতে কনকের মধ্যেও একটা ব্যক্তিত্ব এসেছে ঠিকই, কিন্তু তাই বলে ফোনে পাসওয়ার্ড দিয়ে রেখেছে কনক, এটা যেন ভাবনার অতীত। বদলে যাচ্ছে সব কিছু। এ নির্ভয়পুরের বাতাসে বিষ উৎপাদন হচ্ছে। সেই বিষ ছড়িয়ে যাচ্ছে সকলের মনে। আরও বারপাঁচেক ডাকল মৃণাল কনককে। কোনও সাড়া নেই।
বাড়ির পরিচারিকারা এগিয়ে এসেছে দেখেই মৃণাল বলল, “তোমাদের বউদি মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে অবেলায়। ডেকে দেখো তো একটু।”
মণিমালা কনকের খুব কাছের মানুষ। মেয়েটার বয়েস প্রায় বিয়াল্লিশ। স্বামী পরিত্যক্তা। কনকের বাপের বাড়ির মেয়ে। ছোটোবেলায় নাকি কনকের পায়ে পায়ে ঘুরত। তাই মণিমালা যখন সংসার হারাল, তখন কনকই ওকে নিয়ে এল নির্ভয়পুরের বাড়িতে। মেয়েটা সেই একুশ বছর থেকেই এ বাড়িতে রয়ে গেছে। কনক ওকে কখনওই পরিচারিকা মনে করে না। এ বাড়ির কাউকেই মনে করতে দেয় না। মৈনাক আর মৌবনীর যাবতীয় আবদার মণিমালাই মেটায়। কনক চেষ্টা করেছিল মণিমালার বিয়ে দেবার। কিন্তু মণিমালা বেঁকে বসেছিল। বলেছিল, “কনকদি আমি যদি বোঝা হই, তা হলে তাড়িয়ে দিয়ো, গতর আছে খেটে খাব। কিন্তু বিয়ে দিয়ে আর অপমান কোরো না।” কনক আর চেষ্টা করেনি মণিমালার বিয়ের। বরং এ সংসারের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিল মণিমালার ওপরে। বাড়িতে কী রান্না হবে, আত্মীয় এলে কী ব্যবস্থা হবে, বিশ্বকর্মা পুজোয় মেনু কী হবে সবই মণিমালার দায়িত্বে। মণিমালাও ঘোষালবাড়ির একজন এখন। এ বাড়ির তিনজন পরিচারিকাকে দিয়ে কাজ করানোর দায়িত্বও স্বেচ্ছায় মণিমালাই নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। মোট কথা, মণিমালা ছাড়া ঘোষালবাড়ি অন্ধকার।
মৃণালের নরম গলা শুনেও মণিমালা কঠিন স্বরেই বলল, “না জামাইবাবু, দিদি অবেলায় ঘুমায়নি। তাই ডাকলেও উঠবে না। আমি কাজের মেয়েদের নিয়ে সরে যাচ্ছি। আপনিই বরং ডাকুন। দিদির রাগ হয়েছে।”
মৃণাল ভাবছিল, এবারে হয়তো মণিমালা ওকে দিদির রাগের কারণটা বলে ভর্ৎসনা করবে। কারণ, কনক মণিমালার কাছে কিছুই লুকিয়ে রাখে না। সম্ভবত মণিমালাই সহবতবশত সে কারণটা আর মৃণালকে বলল না। কনকের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আরও বারদুয়েক ডাকল মৃণাল, কিন্তু ভিতর থেকে কোনও সাড়া এল না।
মৃণাল একটু ভয়ার্ত গলাতেই বলল, “মণিমালা, দরজাটা ভাঙতে হবে মনে হচ্ছে।”
কথা শেষ হবার আগেই কনকলতা দরজা খুলে বেরিয়ে এল। বেশ সাজগোজ করে বেরিয়েছে। দামি শাড়ি, চোখে বাইরে বেরোনোর চশমা। এমনকী, আটপৌরে কানের দুলটা অবধি পালটে হিরের একজোড়া দুল পরেছে। হঠাৎ এত সেজেগুজে বিকেলবেলা যাচ্ছে কোথায় কনকলতা?
মৃণাল মৃদু স্বরে বলল, “কোথাও যাচ্ছ?”
কনকলতা গম্ভীর গলায় বলল, “হ্যাঁ যাচ্ছি। পামেলা মিত্রকে সত্যনারায়ণের পুজোয় নিমন্ত্রণ করতে যাচ্ছি। সামনের পূর্ণিমায় ভেবেছি বাড়িতে একটা সত্যনারায়ণের কথা দেব। তাই ভাবলাম, পামেলাকেও একটু নিমন্ত্রণ করে আসি। ওরে কে আছিস, গাড়ি বের করতে বল। মণিমালা তুইও চল।”
মৃণাল অত্যন্ত চমকে গিয়ে বলল, “এ কী ধরনের রসিকতা কনক? তুমি হঠাৎ পামেলার বাড়ি যাবে কেন?”
কনকলতা হেসে বলল, “সে কী! আমার স্বামী গাছতলায় তার হাত ধরে বসে সুখের-দুঃখের কথা বলতে পারে, আর আমি তাকে আপন ভেবে বাড়িতে আসার নিমন্ত্রণ করতে পারি না? এসব তুমি যে কী বলো না মৃণাল! তোমার থেকে তো দেখছি মণিমালার বুদ্ধি বেশি।”
মৃণাল বেগতিক দেখেই কনকের হাত দুটো খপ করে ধরে বলল, “প্লিজ এভাবে আমার সম্মান নিয়ে ছিনিমিনি খেলো না।”
কনক হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, “সম্মান শুধু তোমার একার নেই মৃণাল পামেলার হাত ধরে একান্তে বসে থাকার সময় মনে রাখা উচিত ছিল, সম্মান কনকলতা ঘোষালেরও আছে।”
মৃণাল স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এ কনককে সে চেনে না। এত সাহসী, স্পষ্টবক্তা মহিলাকে নিয়ে তো ও এতগুলো বছর ঘর করেনি। তা হলে এই আচমকা পরিবর্তনের কারণ কী?
.
কনকলতা আর মণিমালা দাঁড়িয়ে আছে চার্চের সামনেই।
কনক বলল, “হ্যাঁ রে মণিমালা, চার্চ আর মন্দির কি আলাদা কিছু? দুটোতেই তো ঈশ্বরের বাস, তাই না?”
মণিমালা বলল, “বড়োদিনে যখন কেক আমরা খাই, তখন যিশু তো আমাদেরও দেবতা।”
কনকলতা বলল, “তবে আমরা বাইরে কেন দাঁড়িয়ে আছি? চল, একবার ভিতরে ঢুকে দর্শন করে আসি।”
দুজনে ভিতরে ঢুকেই দেখল, সুজয় শান্ত হয়ে বসে আছে। সামনে ফাদার ওকে কিছু পড়ে শোনাচ্ছেন। এ পরিবেশে কনক সেভাবে আসেইনি। বহু বহু মন্দির দর্শন করেছে শাশুড়িমায়ের সঙ্গে, কিন্তু কখনও চার্চে ঢোকা হয়নি। নির্ভয়পুরেই কত সুন্দর একটা চার্চ আছে বেশ নিরিবিলি জায়গায়, অথচ কনকের আসা হয়নি। ঘোষালবাড়ির হেঁশেল সামলাতে সামলাতে জীবনটাকেই তো দেখা হয়নি কনকের। অথচ যার জন্য সবটুকু ছেড়ে দেওয়া, সে কিন্তু কিছুই ছাড়েনি। বুড়ো বয়সে এসেও নিজের শখ নিয়ে মশগুল থেকেছে।
ছবিটা দেখার পর থেকেই কনকের মাথায় আগুন জ্বলছে। তাই সুজয়ের এক ডাকে হাজির হয়েছে চার্চের সামনে। ছেলেটা ছবিটা পাঠিয়েই বলেছিল, “মৃণাল ঘোষাল আর পামেলা মিত্রর সম্পর্কটা বেশ ভালোই গড়ে উঠেছে ম্যাডাম। যদি আরও খবর পেতে চান তা হলে আগামিকাল চার্চের মাঠে আসুন।”
মৃণালকে কোনওদিনই সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে পারেনি কনক। তার অনেক কারণও আছে। তাই বলে এই বয়সে এসে হাঁটুর বয়েসি ওই মহিলার সঙ্গে এসব অসভ্যতা সহ্য করবে না কনক। তাই মৃণাল যে কারণে পামেলার ঘনিষ্ঠ হচ্ছে সেটাকেই ভেঙে দেবে ও। মণিমালার কাছ থেকেই নির্ভয়পুরের যাবতীয় খবর পায় ও। মণিমালাই বলেছিল, পামেলা মিত্র ভোটে দাঁড়িয়েছে সুজয়ের বিরুদ্ধে।
সুজয় ওদের নিয়েই বাইরে এল। গুটিগুটি পায়ে সন্ধে নামছে নির্ভয়পুরের আকাশে। একটা সিমেন্টের বেদি দেখিয়ে বলল, “বসুন ম্যাডাম। আর-একজন আসবে এখানে, তাকেও আপনি চেনেন।”
কনকলতা বলল, “কে?”
সুজয় হেসে বলল, “ডাক্তারবাবু।”
শৌনক ডাক্তারের ক্যামেরাতেই ছবিটা তোলা হয়েছিল। ওদের কথা শেষ হবার আগেই বাইকের আওয়াজ পেল সুজয়। শৌনক আসছে। শৌনককে বিলক্ষণ চেনে কনক। অসুখে-বিসুখে ও-ই তো ভরসা।
সুজয় বলল, “এসো শৌনকদা। তুমি বলবে ম্যাডামকে, না আমি?”
শৌনক হেসে বলল, “আগামীর নেতাই বলুক।”
শনশনে ঠান্ডা হাওয়ায় সন্ধে নামা নির্ভয়পুরের মাঠে ওরা চারজন সবার অলক্ষে প্রতিজ্ঞা করল, নির্ভয়পুরকে সবরকম ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাবে। শৌনক আর কনক বেশ কিছু টাকা তুলে দিল সুজয়ের হাতে। ইলেকশন লড়ার খরচ।
কনক বলল, “টাকা নিয়ে ভেবো না বাবা, পামেলাকে হারাও। ওই মহিলা এখানের বাতাসকে ভারী করে তুলেছে।”
ফিরে আসতে আসতে মণিমালা শক্ত করে ধরল কনকের হাতটা। ফিসফিস করে বলল, “এই কনকলতাকেই তো আমি চিনতাম ছোটোবেলায়। তাই তো পায়ে পায়ে ঘুরতাম। ঘোষালবাড়িতে এসে দেখি কেমন একটা পালটে যাওয়া, ভয়ে থাকা কনকদিদি। আজ আমি খুব খুশি গো দিদি। জামাইবাবুর সব অপমান তুমি মেনে নাওনি দেখে।”
কনকলতা বলল, “গাড়িতে উঠে এসব কথা বলবি না একদম। বরং আমরা হাটে গিয়েছিলাম সেটাই গল্প করবি। সব খবর যাবে কিন্তু তোর জামাইবাবুর কানে।”
মণিমালা বলল, “সেই জন্যই তো রাস্তায় গাড়ি থেকে নেমে গলির পথ ধরেছিলাম।”
কনকলতা বলল, “জানিস মণি, সেদিন আমি শুনলাম সমাদ্দারের সঙ্গে তোর জামাইবাবু আলোচনা করছিল, নির্ভয়পুরে নাকি একটা নার্সিংহোম খুলবে। মোটা খরচ নেবে চিকিৎসার। শৌনককে মোটা মাইনে দিয়ে রাখবে। আরও কিছু ভালো ডাক্তার আনবে। দিয়ে আবার সরকারি হাসপাতালটাকে কানা করে রাখবে।”
মণিমালা বলল, “কিন্তু এখানের গরিব মানুষগুলো নার্সিংহোমে চিকিৎসার টাকা পাবে কোথায়?”
কনক শীতল গলায় বলল, “বাবুদের কাছে ভিটে, জমি বাঁধা দেবে। টাকার অভাবে এরা সেগুলো আর ছাড়াতে পারবে না। তার ওপরে এরা ইমারত বানাবে। তাই নির্ভয়পুরের মানুষের জন্য খুব দরকার পামেলার হেরে যাওয়া আর সুজয়ের জেতা। কারণ, হাসপাতালের জন্য যা সরকারি অনুদান আসে সেগুলো এতদিন রাঘব আত্মসাৎ করত, এবারে পামেলা করবে। একমাত্র সুজয়ই এদের কষ্ট বুঝবে মণি।”
মণিমালা বলল, “রংবুল আর নির্ভয়পুরের মাঝে হসপিটালটা। এতেই লোক অসুস্থ হলে নিয়ে যেতে অসুবিধা হয়, কত রুগিকে এরা ভ্যানরিকশা করে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে নিয়ে যায়, এরা কোথায় পাবে নার্সিংহোমের খরচ? মানুষ মারার কল করবে বাবুরা, আর এরা ওদের ভোট দেবে?”
কনকলতা বলল, “এরা বোকা বলেই না ভুল বোঝানো সহজ হয় এদের। না মণি, আমি ওই পামেলা মিত্রকে কিছুতেই জিততে দেব না।”
মণিমালার চোখদুটো আনন্দে ভরে উঠল। এই কনকদিদিকেই সে ভালোবাসত ছোটোবেলায়। যে পাড়ায় কিছু অন্যায় দেখলেই দলবল নিয়ে চড়াও হয়ে বলত, “অন্যায় আমি হতে দেব না।”
মণিমালা বলল, “ফুচকা খাবে? ওই দেখো দেবার ফুচকার গাড়ি।”
কনক হেসে বলল, “অম্বল হবে যে, বয়েস কথা শুনবে কি?”
মণিমালা বলল, “সে আমি তোমায় বাড়ি গিয়ে ওষুধ দেব। এখন চলো তো।”
মণিমালা ফুচকার অর্ডার দিয়েই বলল, “ওই দেখো, ফুটবল-স্যার আর পামেলা মিত্র একসঙ্গে নামল গাড়ি থেকে। বাপ রে, বাপ রে, মহিলার সাজের কী বাহার! মনে হয় যেন কুড়ি বছরের ছুঁড়ি।” মণিমালা বলল, “ওই দেখো, এদিকে আবার কেন আসে গো?”
কনকলতা ফুচকার শালপাতাতে মনোনিবেশ করল। কনকলতার ঠিক পাশে এসেই দাঁড়িয়েছে পামেলা। কনক ইচ্ছে করেই সেদিকে তাকাচ্ছে না।
পামেলাই বলল, “আরে মিসেস ঘোষাল, আপনি রাস্তায় দাঁড়িয়ে এভাবে আনহাইজিনিক ফুচকা খাচ্ছেন কেন?”
কনকলতা হেসে বলল, “আমার নাম কনকলতা ঘোষাল। দেখুন পামেলা, নির্ভয়পুরের সবই এখন বড়ো বিষাক্ত। সামান্য ফুচকা আর কতটা ক্ষতি করবে বলুন তো? বিষাক্ত মানুষের থেকে তো বেশি নয়।”
পামেলার মুখের দীপ্তিটা আচমকাই নিভে গেল। তবুও স্মার্টলি সামলে নিয়ে বলল, “এবারের নির্বাচনের প্রার্থী হয়েছি জানেন নিশ্চয়ই। ঘোষালদা বলেছে আশা করি। ভোটটা যেন পাই, আমরা কয়েকটা ফ্যামিলিই তো আছি নির্ভয়পুরে।”
পামেলার কথা শেষ হবার আগেই কনক বলল, “আরে আর-একটু ঝাল দাও দেখি। হ্যাঁ কী যেন বলছিলেন? ওহ ভোট দেবার কথা? দেখুন, আমি আবার একটু স্পষ্ট কথা বলতে পছন্দ করি। মুখোশ আমার কোনওদিনই তেমন পছন্দের জিনিস নয়। আপনার ঘোষালদা হয়তো আপনাকেই ভোট দেবে, তবে নির্ভয়পুরের স্বার্থে আমি আর আমার ছেলে-মেয়েরা, মণিমালা সবাই সুজয়কেই ভোট দেব। আমি মনে করি পামেলা, আপনারও সুজয়কেই ভোট দেওয়া উচিত, কারণ আপনিও নিশ্চয়ই আমার মতোই নির্ভয়পুরের ক্ষতি চান না, তাই না?”
আধো অন্ধকারেও পামেলা মিত্রর মুখটা দেখা গেল, অপমানে থমথম করছে। হিলের আওয়াজ তুলে নিজের গাড়িতে গিয়ে উঠল।
কনক বলল, “এই সুনীলবাবুর আবার এই বয়সে হল কী? ইনি শেষ অবধি পামেলার পাল্লায় পড়লেন কেন?”
মণিমালা ঝালে হুশহাশ করতে করতে বলল, “ফুটবল-স্যার মনে হয় মাঠে বসে স্বপ্ন দেখছেন, পামেলা মিত্র ওঁকে বিয়ে করছে।”
কনক ফুচকার দাম মিটিয়ে গাড়িতে উঠতেই মৃণালের ফোন। ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করেও রিসিভ করল না কনক।
মণিমালা বলল, “ফোনটা ধরবে না?”
কনক বলল, “না, ধরব না। পামেলা মিত্রকে কেন রাস্তার মাঝে অপমান করেছি তার কৈফিয়ত আমি মৃণালকে দিতে বাধ্য নই।”