ইতি নির্ভয়পুর – ১৪
১৪
এমন আদর, ভালোবাসার স্বাদ নিতে বারবার ইচ্ছে করে কুত্তলীর। নীহার ওকে ভরিয়ে দিয়েছে। ওরা বিয়েও করবে খুব তাড়াতাড়ি। সুজয়কে অনেকদিন ধরেই এড়িয়ে চলে কুন্তলী। না, বাবুদের বিরুদ্ধে ওর কোনও রাগ নেই। বাবুদের ক্লাবে চাকরি করেই ওর বাড়ির উন্নতি হয়েছে, বাবুদের চায়ের বাগানে কাজ করেই মা ওদের সংসার চালিয়েছে। তাই সুজয়ের ওইসব ভুলভাল কথাতে সাড়া দিতে মন চায়নি কুন্তলীর। আর এখন তো ও নিজেও বাবুদের বাড়ির বউ হয়েই যাবে, রাগ করে লাভ আছে? আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখছিল কুন্তলী। নীহারের দেওয়া কাচের সেন্টের শিশিটার আকৃতিটা ঠিক একটা মেয়ের নগ্ন শরীরের।
নীহার ওর হাতে দিয়ে এটা দিয়ে বুকের মধ্যে মুখ ঘষতে ঘষতে বলেছিল, “এই কাচের মেয়েটার কোমরটাও তোমার মতোই সরু। দেখি মেপে কারটা বেশি সরু।”
অদ্ভুত উত্তেজনায় শিহরিত হয়েছিল কুন্তলী। নির্ভয়পুরের গ্রিনভ্যালি ক্লাবের ওপরের তলায় সব থেকে বড়ো ঘরটাতে এসির মধ্যেও বিজবিজে ঘামে ভিজে গিয়েছিল ওর গোলাপি ব্লাউজটা। নরম বিছানায় শুয়ে নীহারের বুকের পুরুষালি গন্ধে কুন্তলী ভুলেই গিয়েছিল ওর জীবনের এত বছরের না পাওয়ার বেদনাগুলো। নীহার ওকে আদরে আদরে পাগল করে দিয়েছিল। নীল আলোয় মায়াময় সন্ধেতে কুন্তলী সম্পূর্ণ ভুলেই গিয়েছিল নিজের অস্তিত্ব। নীহারের মধ্যেই নিজেকে মিশিয়ে দিয়েছিল, নিজের সবটুকু উজাড় করে দিয়ে তৃপ্তি দিতে চেয়েছিল নীহারকে। জীবনে এই প্রথম কেউ ওকে এতটা ভালোবেসেছে, বিনিময়ে ও কিছুই দিতে পারেনি, তাই সেই রাতে আর কোনও কার্পণ্য করেনি।
ক্লাবের রুম থেকে ফেরার আগে কেন কে জানে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলেছিল কুণ্ডলী।
নীহার ওর মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে বলেছিল, “ভয় কীসের? আমি আছি তো। খুব তাড়াতাড়ি আমরা বিয়ে করব।”
কুণ্ডলী ভয়ে ভয়ে বলেছিল, “তোমার দিদি আমাকে মেনে নেবে না গো। নীহার হেসে বলেছিল, “বিয়েটা দিদি করবে না আমি? তুমি আমায় ভরসা করো না কুন্তলী?”
কুত্তলী নীহারকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, “ভরসা করি বলেই তো তোমার সবটুকু দিতে পারলাম।”
নীহার বলেছিল, “বলো কুণ্ডলী, এই নির্ভয়পুরের কোন জায়গাটা তোমার পছন্দের? তুমি যেখানে বলবে সেখানেই উঠবে আমাদের ভালোবাসার বাড়ি। না, আমি পামেলা মিত্র নই। আমি তার বেতনভুক কর্মচারী মাত্র। তাই আমার সাধ্য কম। বিশাল বাড়ি আমি গড়তে পারব না তোমার জন্য, ছোটো বাড়িতেই থাকব আমরা। কিন্তু সেটা বানাব তোমার পছন্দের জায়গায়। বলো তোমার পছন্দের জায়গাটা।”
কুণ্ডলীর আবার আলাদা পছন্দ-অপছন্দ আছে সেটাই তো এত বছরে কখনও জানতেই পারেনি ও। সারাদিন ঘরের কাজ করেছে, রান্না করেছে, আর লোকের মুখে শুনেছে বয়েস তো হল, বিয়ে তো হবে বলে মনে হয় না। শুধু সুন্দরী হলেই হয় না, টাকাপয়সা তো ঘরে নেই, কে বিয়ে করবে কুত্তলীকে? যেদিন যেটা হাতে করে বাজার থেকে এনেছে মা, সেটাই সোনামুখ করে খেয়েছে ও। জানতেই পারেনি, কোনটা ওর অপছন্দের ছিল। হ্যাঁ, একটা জিনিস ওর চূড়ান্ত অপছন্দের ছিল, সেটা হল পেট ভর্তি খিদে। খিদে কুণ্ডলী মোটেই সহ্য করতে পারত না। আর আয়নাটা যখন পুরোনো হয়ে গিয়েছিল, ঘষা আয়নায় যখন নিজের মুখ দেখা যেত না, তখন ও আয়নাটাকে অপছন্দ করত। এছাড়া তো সবই কুন্তলীর পছন্দের। আসলে পছন্দ আর অপছন্দের মধ্যে ফারাক করার বিশেষ সুযোগ ও পায়নি। তবুও নীহারের কৌতূহলী দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বলল, “ঠিক যেখানে রঙ্গিত নদীর একটা শাখা রংবুলের দিকে মোড় নিয়েছে, যেখান থেকে পলাশবনা পাহাড়ের চূড়াটা দেখা যায়, ওখানে ঘর বানালে কেমন হবে?”
নীহার কুন্তলীর ঠোঁটটা নিজের ঠোঁটে মধ্যে ডুবিয়ে নিয়ে সম্মতি জানিয়েছিল। মাত্র দেড় মাসে কুত্তলীর জীবনের হিসেবনিকেশগুলোই ধীরে ধীরে বদলে দিয়েছে নীহার। ওর ভাবনার সুতোগুলোতে আগের মতো জট লাগে না। এখন ও পরিষ্কার দেখতে পায়, মাথায় সিঁদুর, লাল বেনারসি পরা টুকটুকে বউটার মুখ। কপালে চন্দন আঁকা মেয়েটা আর কেউ নয়, ও নিজেই। সুজয় নিজেই কুত্তলীর সঙ্গে দূরত্ব মেইনটেইন করে চলে, এটাও যথেষ্ট সুবিধা করে দিয়েছে কুত্তলী আর নীহারের মেলামেশার ক্ষেত্রে। সুজয়ের প্রতি যেটুকু অনুভূতি ছিল, সেটুকুও নিজের দখলে নিয়ে নিয়েছে নীহার। না, কুন্তলী সুজয়ের কোনও ক্ষতি চায় না। কিন্তু ভালো ও একমাত্র নীহারকেই বাসে। ও বুঝেছে, সুজয়ের প্রতি ওর ভালোবাসাটা বড়ো একতরফা ছিল, অন্যদিকের কোনও আবেগ ছিল না ওকে কেন্দ্র করে। কিন্তু নীহারের সব অনুভূতিগুলো কুণ্ডলীকে স্পর্শ করে চব্বিশ ঘণ্টা। ঝকঝকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কাচের ওই মেয়ে আকৃতির পারফিউমের শিশিটা ঘাড়ের কাছে এনে স্প্রে করল কুত্তলী। নীহারের সব থেকে পছন্দের জায়গায় প্রথম লাগল সেন্টটা। গন্ধটা ভীষণ মিষ্টি। কুন্তলীর এখন অনেক জামা-কাপড়। কাজের জন্যই কিনতে হয়েছে ওকে। কিন্তু গত পরশু নীহার যা একখানা কাণ্ড করেছে, সে আর বলার নয়। মাকে কীভাবে লুকোবে সেটাই বড়ো ভাবনার বস্তু হয়ে গেছে ওর কাছে। নীহারদের কলকাতায় বড়ো বড়ো জামাকাপড়ের দোকান আছে। নীহার কলকাতা গিয়েছিল ক’দিন আগেই। গত পরশু ফিরে কুন্তলীর জন্য প্রায় পনেরোটা দামি দামি চুড়িদার, শাড়ি নিয়ে এসেছে। আর যেটা এনেছে সেটা দেখে কুন্তলী লজ্জায় লাল হয়েছিল।
নীহার হেসে বলেছে, “এই স্বচ্ছ নাইট ড্রেসটা শুধু আমার সামনে পরার জন্য। আয়নাও যেন না দেখে আমার কুত্তলীকে। এ পোশাকে দেখার অধিকার শুধু আমার।”
কুত্তলীর চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গেছে ওইসব চুড়িদার দেখে। নির্ভয়পুরের নারায়ণী বস্ত্রালয় তো দূর, রংবুলের দোলনচাঁপা গার্মেন্টসের মতো বড়ো দোকানেও এসব পাওয়া যায় না। এমন পোশাক কুন্তলী শুধু সিনেমাতেই দেখেছে। নির্ভয়পুরের পামেলা মিত্র, অস্মিতা সমাদ্দার, নূপুর মল্লিক, ঘোষালের মেয়েটা এরাই কেবল পরে। এখন থেকে নূপুর পরবে। কিন্তু মাকে বলবে কী? মা তো দেখেই সন্দেহ করবে। অনেক ভেবেচিন্তে কুন্তলী একটা বুদ্ধি বের করেছে। মাকে বলবে, গ্রিনভ্যালি কোম্পানি থেকেই ওকে এগুলো দিয়েছে। বাবুদের বড়ো বড়ো পার্টির দিনে ওর কমা পোশাক পরা চলবে না বলে। ফ্রি-তে পেয়েছে শুনলে মা খুব খুশি হয়। কিন্তু কুন্তলীর সমবয়েসিরা বা গ্রিনভ্যালির অন্য এমপ্লয়িরাও তো জিজ্ঞাসা করবে, তাদের বলবে কী? মায়ের মুখে শুনেছিল, কুন্তলীর এক কাকা নাকি কলকাতার বড়ো বাজারের কোনও কাপড়ের দোকানের ম্যানেজার। মায়ের বিয়ের পরে সেই কাকা নাকি মায়ের জন্য একসঙ্গে তিনখানা দামি শাড়ি এনেছিল। মায়ের কাছে সেটা ছিল চূড়ান্ত বিস্ময়। মা আজও কেউ দামি শাড়ির গল্প করলে ওই উদাহরণটা দেবেই। কুন্তলীও ভেবে নিল, বাকি সবাইকে বলবে ওই কাকাই এসব পোশাক ওকে উপহার স্বরূপ দিয়ে গেছে।
পেঁয়াজের খোসা রঙের চুড়িদারটা নিজের গায়ে ফেলে এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে দেখতেই বাইরে সুজয়ের গলা পেল। একটু যেন ভয় পেল কুন্তলী। পরক্ষণেই ভাবল, ভয়ের কী আছে? সুজয় কি ওর অভিভাবক নাকি? তাছাড়া পরের মাসেই তো নীহার ওকে বিয়ে করছে, তখন তো সুজয় সব জানবেই, তা হলে এত লুকোচুরির কী আছে? ভোটটা মিটে গেলেই দিদিকে ওদের সম্পর্কের কথা বলবে নীহার। দিদি যেহেতু এবারের প্রার্থী, তাই এখন খুবই ব্যস্ত। এই ক’টা দিন কেটে গেলেই ওর হাত ধরে দিদির সামনে দাঁড়াবে নীহার। পামেলা যদি মানে ভালো, না হলে রেজিস্ট্রি করে কাগুজে বিয়ে করবে ওরা। নীহার সব প্ল্যান করে রেখেছে।
সুজয়ের সঙ্গে আরও কয়েকজন এসেছে সম্ভবত, তাদেরও গলা পেল কুন্তলী ঘর থেকেই। মা উঠোনে বসে মুড়ি ভাজে এই সময়। পাশে রাখা দড়ির খাটিয়াতেই বসল সুজয়। মা আবার সুজয়কে দেখলেই আহ্লাদে গদ গদ হয়ে যায়। আজও মায়ের গলা পেল কুন্তলী।
“এবারে একটা বিয়ে করো সুজয়। তোমার মায়ের শরীর ভালো নয়, বাবারও বয়েস হয়েছে, বিয়ে করলে সে-ই সংসারের হাল ধরবে। তাছাড়া ইনকাম তো তুমি মন্দ করো না। লেখাপড়া জানা ছেলে তুমি। আমাদের মতো মুখ্যু তো নও। দিন দিন তোমার উন্নতি হবে বাবা।”
সুজয় বলল, “কাকিমা আমার মতো উড়নচণ্ডীকে বিয়ে করবে কেন কোনও মেয়ে? আমার যা শত্রু, তাতে কে কবে পাহাড় থেকে ঠেলে ফেলে দেবে সেটাই জানি না। একটা মেয়ের জীবন কেন নষ্ট করি? তার থেকে আপনারা সবাই আছেন তো আমার পাশে, কাটিয়ে দেব যে কদিন বাঁচি।” মা রাগি গলায় বলল, “এ কেমন কথা সুজয়? মায়ের সামনে বসে মরার কথা বলছ কী করে?”
সুজয় হেসে বলল, “বেশ, ভালো হয়েছে আর বলব না। কাকিমা কুন্তলী আছে? ভোট দেওয়ার স্লিপ দুটো দিয়ে যাচ্ছি। যদি বোঝেন আমায় ভোট দিলে আপনাদের কিছু উপকারে লাগব, তা হলে ভোটটা দেবেন।
কুন্তলী ঘর থেকে বেরিয়ে খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, “তুমি ছাড়া নির্ভয়পুরের মানুষের বড়ো বন্ধু আর কেউ আছে নাকি?”
সুজয় সোজাসুজি তাকাচ্ছে কুত্তলীর চোখের দিকে। কুত্তলী মাটির দিকে চোখ নামিয়ে বলল, “পামেলা মিত্রকে এমনিতেও কেউ ভোট দেবে না। রাঘব হয়তো দু’-চারটে পাবে।”
সুজয় হেসে বলল, “ভাবা যায় কাকিমা, আপনার মেয়ে এখন রাজনীতির উত্থান-পতনও বুঝতে পারছে! না, গ্রিনভ্যালি তোমার অনেক মডার্ন করে দিয়েছে। আর ইদানীং তোমার পোশাক দেখলে তো মনে হয়, বাবুদের ঘরের মেয়ে। খুব ভালো লাগে তোমার এই উন্নতি দেখে। আমি চাই নির্ভয়পুরের সকলে তোমার মতো সুখে বাঁচুক।”
কুন্তলী বলল, “সবই তোমার দয়ায়। তুমি যদি সেদিন জোর করে গ্রিনভ্যালিতে কাজটা জুটিয়ে না দিতে, তা হলে কি আর পেতাম এত কিছু?” সুজয় হেসে বলল, “কাকিমা আজ চলি গো, অনেকগুলো বাড়িতে যেতে হবে।”
কুম্ভলী বলল, “তুমিই জিতবে। ক্লাবেও সবাই ভয়ে আছে তোমায় নিয়ে। বলাবলি করছে, নির্ভয়পুরের লোকজন ঘরের লোক বাদ দিয়ে কেন বাইরের লোককে ভোট দেবে? এতদিন সুজয়ের মতো শিক্ষিত, পপুলার ছেলে দাঁড়ায়নি তাই রাঘব জিতে গেছে। এবারে আর সে সুযোগ নেই। নির্ভয়পুর এবারে সুজয়ের দখলে থাকবে।”
সুজয় দায়সারা হেসে বলল, “দেখা যাক। অনেকে আবার আমাকেই নির্ভয়পুরের শত্রু ভাবে। বাবুদের মিত্র। দিনে একশো টাকা মাইনেতে চা-বাগানের কাজ সেরে পারলে বাবুদের জুতো অবধি পরিষ্কার করে দেয়। নির্ভয়পুরের মানুষ যতদিন পর্যন্ত নিজেদের গুরুত্ব না বুঝবে, ততদিন পর্যন্ত এদের এভাবেই ঠকতে হবে। কেউ বাঁচাতে পারবে না।”
কুন্তলী বলল, “কেন মালতী তো বলল, তুমি ওদের সন্ধেবেলা লেখাপড়া শেখাও, নিজেদের অধিকার বুঝে নিতে শেখাও, তারপরও শিখছে না?”
কুন্তলীর ঠোঁটের কোণে একটা অহংকারী হাসির ঝিলিক দেখেও না দেখার ভান করল সুজয়। হয়তো ওরই চোখের ভুল। কুন্তলী হয়তো একইরকম আছে, সুজয়ই ভুল বুঝছে। গ্রিনভ্যালির মাইনেতে এতদিনের অপূর্ণ স্বাদগুলো যদি পূরণ হয়, তো হোক না। বিজন মুর্মুর অ্যাক্সিডেন্টের সময় কুন্তলী তো বেশ ছোটো। বাবার আদর, যত্ন কিছুই পায়নি। শুধু বাবা মারা যাওয়ার পরে সংসারের গিলে খেতে আসা অভাব দেখেছে, মাকে দুটো পেটের ভাত জোগানোর জন্য দিনরাত এক করে পরিশ্রম করতে দেখেছে। আজ একটু সুখের মুখ দেখেছে নিজের পরিশ্রমের টাকায়, এতে সুজয়ের সমস্যা কোথায়? আসলে সমস্যা ঠিক এটা নয়, সেটা যে কী নিজেও জানে না ও। শুধু অনুভব করে কুন্তলীর সঙ্গে আগেকার সম্পর্কের উষ্ণ সুভোটা কোথাও যেন জট পাকিয়ে গেছে। গিঁটগুলো হয়তো খালি চোখে দেখা যায় না ঠিকই, কিন্তু উপলব্ধি করা যায়। আগে যেমন সুজয়ের সঙ্গে দেখা হলেই কুত্তলীর চোখে একটা আলাদা খুশির বন্যা বয়ে যেত, সেটা এখন আর নেই। খুব কেজো কথায় সময়টুকুকে পার করে দিতে চায় কুন্তলী। হয়তো এর নামই বদল। অথবা নিত্যদিনের অভ্যাসে বাসন-কোসন যেমন ঔজ্জ্বল্য হারায়, তেমনই সুজয়কেও রোজ দেখে দেখে কুত্তলীও সেই আবেগ হারিয়েছে।
সুজয়ের দলের ছেলেরা দুটো স্লিপ কুণ্ডলীর হাতে দিয়ে বলল, “ভোটটা তা হলে দিয়ো দিদি।”
কুম্ভলী স্বাভাবিকভাবে ঘাড় নেড়ে বলল, “আরে এতবার বলার কী আছে বলো দেখি? সুজয়দাকে ছাড়া অন্য কাউকে ভোট দিলে আমার মা আমায় বাড়ি ছাড়া করবে।”
সুজয় হেসে বেরিয়ে এল ওদের বাড়ি থেকে।
কুত্তলী জানে, নীহারও চায় সুজয় জিতুক। নীহারও বলছিল, “আমার দিদি জিতলে নির্ভয়পুরের লোকেদের কোনও লাভ নেই কুণ্ডলী। লাভ ওই মল্লিক, ঘোষাল, মিত্র, ভট্টাচার্যদের। কারণ, আমি জানি আমার দিদি কোনওদিন নির্ভয়পুরের লোকেদের উপকার করবে না। তা হলে মিত্র টি-এস্টেটে সস্তায় শ্রমিক পাবে কী করে?”
কুন্তলী ওর হাতটা ধরে বলেছিল, “তুমি সকলের থেকে আলাদা। কেন জানি না মনে হয় তুমি নির্ভয়পুরের আমাদেরই একজন।”
নীহার হেসে বলেছিল, “তোমাদের কি না জানি না, তবে তোমার জন তো বটেই।”
জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত এখন কুন্তলীর কাছে স্বপ্নের মতো মনে হয়। কচি চা পাতার মতো হালকা। একটু হাওয়াতেই যেন দুলে ওঠে। কোনও ভার নেই। এই জীবনটা বড়ো যত্নে রাখতে চায় কুণ্ডলী। নীহারকে আঁচলবন্দি করতে চায় না ও, শুধু নীহারের মনে চিরস্থায়ী হয়ে রয়ে যেতে চায়।