ইতি নির্ভয়পুর – ১৫
১৫
“কোনও সম্পর্কই চিরস্থায়ী নয় বাবা, তবে আমাদের উচিত টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করা। কিন্তু তুমি হঠাৎ তোমার এতদিনের বন্ধু মল্লিক-আঙ্কেলের সঙ্গে সম্পর্কটা ভাঙতে চাইছ কেন, সেটা আমার কাছে এখনও ক্লিয়ার নয় কিন্তু।”
একটু বিরক্তির স্বরেই কথাগুলো বলল অস্মিতা। ব্যালকনিতে আরামকেদারায় বসে নিজের মনেই গুনগুন করে গান গাইছিল অস্মিতা। নিরঞ্জন সমাদ্দার ক’দিন ধরেই মেয়ের আচরণে একটু ফারাক লক্ষ করেছে। সেই কারণেই চায়ের ট্রে হাতে নিজেই এসে বসেছে মেয়ের পাশে। পাশে বসতেই গুনগুন গান ছেড়ে বাবার দিকে বন্দুকের ট্রিগার ধরবে মেয়ে এটা অবশ্য বুঝতে পারেনি নিরঞ্জন। মেয়ের মুড দার্জিলিং-এর আবহাওয়ার থেকেও দ্রুত বদলায়, এটা নিরঞ্জনের অজানা নয়। মুড সুইং করাটা অস্মিতার সব থেকে বড়ো রোগ। এ নিয়ে কম ভোগেনি নিরঞ্জন। মেয়ে রেস্টুরেন্টে গিয়ে বলেছে চাইনিজ খাবে। চাইনিজ ডিশ আসার পরে হঠাৎ তার মত পরিবর্তন হয়ে গিয়ে ইন্ডিয়ান হয়ে গেছে। প্রন ফ্রায়েড রাইস আর গার্লিক চিকেন বদলে গিয়ে হয়েছে বাসন্তী পোলাও আর মটন কষা। তাই মেয়ের এ হেন মুড সুইং নতুন নয় ওর কাছে। আজ যেটা ভীষণ প্রিয়, কাল সেটাই সব থেকে অপছন্দের হয়ে যায়।
নিরঞ্জন চায়ের কাপটা মেয়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “তারপর বল, শৌনকের সঙ্গে বন্ধুত্ব হল?”
আচমকা যেন ব্যালকনিতে বিস্ফোরণ ঘটল। অস্মিতার নাকের পাটা ফুলে উঠেছে, উত্তেজনায় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “বন্ধুত্ব? তোমার কেন মনে হল যে, ওই সরকারি হাসপাতালে চাকরি করা ডাক্তারের সঙ্গে আমি বন্ধুত্ব করতে চাইছি? ও কোনদিক থেকে আমার বন্ধু হবার যোগ্য বাবা? শৌনক ডাক্তার হিসেবে যদি ভালো হয়, যদি মানুষ হিসেবে ভালো হয়, তবুও ও কি আমার ক্লাসের? নিরঞ্জন সমাদ্দারের মেয়ের যোগ্য বাবা?”
নিরঞ্জন চায়ে চুমুক দিয়ে নরম গলায় বলল, “সেটা হয়তো নয় মামণি, তবে আমি নতুন যে নার্সিংহোমটা বানাব ভাবছি, সেটা তা হলে ওর দায়িত্বেই দিয়ে দিতাম। ছেলেটা সৎ, শিক্ষিত, ডাক্তার হিসেবে বেশ ভালো। তাছাড়া আমার মামণি যার হাত ধরবে, তার হাতটা হীরে দিয়ে বাঁধিয়ে দিতে সমাদ্দারের দু’মিনিট লাগবে না। আর বাকি রইল সাহেব। মল্লিকদের ইচ্ছেই নেই নতুন বিজনেসে ইনভেস্ট করার। আর মল্লিকের দ্বিতীয়পক্ষটি ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের মা ছিলেন। তাই তিনি তাঁর স্বামীকে বেআইনি কিছুতে জড়াতে দেবেন না। মল্লিকের ব্যবসা এবারে পড়বে, বুঝলি। ঘোষালের ছেলে হোটেল ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পাশ করল। নির্ভয়পুরে রঙ্গিত নদীর ধারে হানিমুন কটেজের প্ল্যান ছকে ফেলেছে। মল্লিক বোঝেই না, মানুষের পছন্দ পরিবর্তন হচ্ছে। সেই আগেকার মতো ফুডিং লজিং-এর একঘেয়ে ব্যবসা চলবে না। আর সাহেবটাও হয়েছে তেমন। কলকাতায় থাকিস, পড়াশোনা করলি এতদূর, ইউনিক কিছু ভাবতে শেখেনি, বুঝলি? সেই বাবার পুরোনো ব্যবসাতেই ইনভেস্ট করে যাচ্ছে। না রে মামণি, মল্লিকরা এবারে পড়বে। সেই জন্যই তো আমি চাইছিলাম শৌনককে জামাই করতে। ডাক্তার জামাই, নার্সিংহোমের দায়িত্ব ওর ওপরে দেব। নির্ভয়পুরের মানুষ সবাই ভালোবাসে ওকে। এক সঙ্গে তিনটে তির গেঁথে ফেলতাম। আর তোর সঙ্গে মানাতও ছেলেটাকে। তুইও উচ্চশিক্ষিত, শৌনকও।”
কথাটা শেষ করার আগেই অস্মিতা বলল, “কিন্তু বাবা এটা আমার জীবন, তোমার বিজনেস ডিল নয়। তাই আমার লাইফের সিদ্ধান্ত আমিই নেব, এটা ভুলে যেয়ো না।”
নিরঞ্জন বুঝল, কিছু তো একটা সমস্যা হয়েছে। অস্মিতার ব্যবহার সেটাই বলছে। শুধু স্নেহপরায়ণ বাবা নয়, একজন তুখড় ব্যবসাদারের চোখ দিয়েও দেখেছে নিরঞ্জন, শৌনকের প্রতি অস্মিতার আগ্রহই ধরা পড়েছিল ওর সাদা চোখে। এমনকী, ওর ড্রাইভার এসেও জানিয়েছে দিদিমণি শৌনক ডাক্তারের কোয়ার্টারে গিয়েছিল আজ। তা হলে হল কী? অস্মিতাকে অপছন্দ করার কোনও কারণ তো চালচুলোহীন, অনাথ শৌনকের নেই। ছোটোবেলাতেই বাবা-মাকে হারিয়ে দাদুর বাড়িতে মানুষ হয়েছে শৌনক। সেই দাদু গত হবার পরেই কলকাতার মায়া ত্যাগ করে এই প্রকৃতির কোলে এসে স্থায়ী হয়েছে ছেলেটা। আত্মীয়-পরিজনহীন একটা ছেলে অস্মিতার মতো রাজত্ব আর রাজকন্যা একসঙ্গে পেলে ছেড়ে দেবার কথা তো নয়। তা হলে হল কী?
মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে নিরঞ্জন বলল, “শৌনক কি তোকে অপমান করেছে মামণি? তুই এত রেগে আছিস কেন?”
অস্মিতা ফুঁপিয়ে উঠল। এতক্ষণের রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটল চোখের কোণে জল দিয়ে। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “না, ঠিক অপমান নয়, বড়ো কঠিন আর শীতল গলায় বুঝিয়ে দিয়েছে, সে আমায় চায় না। সঙ্গে আর-একটা কথাও বলেছে, ওর প্রতি আমার আকর্ষণ নাকি সাময়িক মোহ। আর সাহেবের সঙ্গে আমার সম্পর্কটাই হচ্ছে ভালোবাসা। আমার নাকি বুঝতে কোথাও ভুল হচ্ছে। এটাকে তুমি কী বলবে বাবা? ইগনোরেন্স নাকি ইনসাল্ট?”
নিরঞ্জনের অবচেতনেই ওর হাতের মুঠো শক্ত হয়ে গেল। ওই চালচুলোহীন দু’পয়সা মাইনের ডাক্তারের এত স্পর্ধা যে, সে নিরঞ্জন সমাদ্দারের মেয়ের প্রপোজাল ফিরিয়ে দেয়?
নিরঞ্জন বলল, “এই কে আছিস, যা তো ডাক্তারকে ধরে বাড়িতে নিয়ে আয়। তারপর দেখি ওর কত সাহস হয়েছে!”
অস্মিতা বলল, “না বাবা, তুমি শৌনককে কিছু বলবে না। অযথা অপমানিত হতে আমার ভালো লাগছে না। তাছাড়া আমিও ভেবে দেখলাম, সাহেব আমাদের রিলেশনশিপটাতে এফোর্ট দিয়ে এসেছে বরাবর। আমি সাহেবকেই চাই জীবনসঙ্গী হিসেবে।”
নিরঞ্জন কোনও কথা না বলে নিচে নেমে গেল। অস্মিতা ব্যালকনিতে বসেই দেখছিল নিজেদের দিগন্ত বিস্তৃত চা বাগানে সবুজের সমারোহ। হঠাৎই খেয়াল হল ওর অজান্তেই নোনতা জলের ধারারা গাল বেয়ে চিবুক ছুঁতে বদ্ধপরিকর। বিরক্ত হয়েই হাত দিয়ে মুছে নিল। শৌনক এমন কেউ নয় যে, ওর জন্য চোখের জল ফেলবে অস্মিতা। নিজের অবাধ্য মনের ওপরে জোর করে রাশ টানার চেষ্টা করল ও। কেমন যেন একটা অনুভূতি হচ্ছিল অস্মিতার, বাবাকে এ বিষয়ে কিছু না বললেই হত। বাবা আবার শৌনকের কোনও ক্ষতি করে দেবে না তো? নিজের মনকে শান্ত করার জন্যই কানে হেডফোন গুঁজে গান চালিয়ে চোখ বন্ধ করল। কখন যে ঘুমিয়ে গিয়েছিল খেয়াল নেই। হঠাৎই নুপুরের ফোনে চমকে উঠল। ফোনটা রিসিভ করতেই হিসহিস করে উঠল নূপুর।
“লজ্জা করে না অস্মিতাদি তোমার? তুমি এত হিংস্র? গোটা নির্ভয়পুরের মানুষের সুস্থতা যার ওপরে নির্ভর করে আছে, তাকেই এমন আঘাত করতে তোমার বাধল না? গোটা নির্ভয়পুরের লোক দেখেছে, তোমাদের ড্রাইভার শৌনক ডাক্তারের বাইকটাকে সজোরে ধাক্কা মেরেছে। ছি অস্মিতাদি, এত প্রতিশোধস্পৃহা তোমার? ভাবতেই লজ্জা করছে, তোমায় আমার দাদাভাই নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে। ডাক্তারবাবু তোমার প্রোপজালে রাজি হয়নি বলে তুমি এভাবে প্রতিশোধ নিলে?”
অস্মিতার একটু তন্দ্রা এসেছিল। তাই মাথার মধ্যে একটা ঘুম ঘুম ঝিমঝিমে অনুভূতি ছিল। আচমকা নূপুরের এমন আক্রমণে ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “কী যা তা বকছিস তুই? আমি কেন কাউকে মারতে পাঠাব?”
নূপুর বলল, “থাক অস্মিতাদি, তুমি মিথ্যে বোলো না আর। আর ছোটো কোরো না নিজেকে। তুমি আসলে কাউকে ভালোবাসো না, বাসতে পারো না। সাময়িক চাহিদা পূরণের জন্য তুমি সব করতে পারো।”
নূপুর ফোনটা রেখে দিল কোনও কথা না বলেই। অস্মিতার পিঠ দিয়ে একটা শীতল স্রোত নেমে গেল। তবে কি বাবাই এটা করাল? অস্মিতাদের গাড়িই নাকি ধাক্কা দিয়েছে শৌনককে। ছি ছি, মেয়ের অপমানের বদলা নিতে গিয়ে বাবা আরও ছোটো করে দিল অস্মিতাকে।