ইতি নির্ভয়পুর – ১৬
১৬
“আপনি এত ব্যস্ত হবেন না নুপুর, আমি এখন ঠিক আছি। সামন্ত তো পা-টা আপাতত প্লাস্টার করে দিয়েছে।”
নুপুর ব্যাকুল গলায় বলল, “আপনার পেইন হচ্ছে না? কিন্তু সামন্তদা তো অর্থোপেডিক নন। আপনাকে কাল আমার সঙ্গে শিলিগুড়ি যেতে হবে। ওখানে অর্থোপেডিক দেখাতে হবে।”
শৌনক ক্লান্ত গলায় বলল, “ভাঙেনি হয়তো, ক্র্যাক হয়েছে। ভাঙলে পেইনটা বেশি হত। তবে গোড়ালিতে তো, বেশ ভোগাবে। কিন্তু আপনাকে কে খবর দিল?”
নূপুর বলল, “কেউ দেয়নি। আমি তখন ওখানেই ছিলাম। মার্কেটে গিয়েছিলাম একটা প্রয়োজনে। তখনই দেখলাম আপনি বাইক নিয়ে এসে চায়ের দোকানটায় দাঁড়ানোর উদ্যোগ করছেন, কোথাও কিছু নেই, আচমকা জিতেন্দ্র এসে আপনাকে ধাক্কা দিল। জিতেন্দ্র অস্মিতাদির গাড়ির ড্রাইভার।”
শৌনক ক্লান্ত গলায় বলল, “আপনি বাড়ি যান নূপুর। না হলে আপনার দাদাভাইও রাগ করবে।”
নূপুর বলল, “প্রথমত, ওরা ফিরতে এখনও কদিন দেরি আছে। দ্বিতীয়ত, আমি সারাজীবন নিজের মাথারও নয়, মনের কথা শুনে চলেছি। তাই আপনি জাস্ট চুপ করে বসুন। ভুলে যাবেন না, আমি নির্ভয়পুর হাসপাতালের নতুন ডাক্তার। হ্যাঁ এমবিবিএস ঠিকই, আপনার মতো এমএস নই। তবে যেহেতু আপনি এখন রোগী, তাই সাইলেন্ট মোডে থাকুন। আমায় দেখতে দিন।”
নূপুর হাতটা বাড়িয়ে শৌনকের হাতটা ধরে বলল, “উঁহু ওই পায়ে প্রেশার নয়। আমার ঘাড়ে প্রেশার দিয়ে বিছানা অবধি চলুন।”
শৌনকের কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। এত স্বল্প পরিচয়ে একটা মেয়ের সাহায্য নেওয়া কি ঠিক হচ্ছে? কিন্তু প্রলয় যেহেতু নেই, তাই বাধ্য হয়েই নূপুরকে ধরল শৌনক।
নূপুর বড়ো যত্ন করে ওকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বলল, “আপনার পারমিশন না নিয়েই একটা কাজ করেছি। বকবেন না প্লিজ। প্রলয়কে ডেকেছি। দেখুন, ও আপনার সবটুকই জানে। দু’দিন এসে দাঁড়িয়ে ছিল কোয়ার্টারের বাইরে। আপনাকে ডাকার সাহস হয়নি। আমার কাছে কাকুতি-মিনতি করছিল। আজ এই বিপদের দিনে ও থাকুক। একটা ভুল তো, তাই ক্ষমা করে দিন প্লিজ। ও বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। আপনি ডাকলে ভিতরে আসবে।”
শৌনক বলল, “আর না বললে?”
নূপুর বলল, “তা হলেও আসবে। মানে আমি ডাকব।”
শৌনক বলল, “তা হলে আপনিই ডাকুন।”
পেইন কিলারের জন্যই শৌনকের চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। তারই মধ্যে অনুভব করল, নূপুর চামচে করে একটা গরম স্যুপ জাতীয় কিছু মুখে দিচ্ছে। নরম, উষ্ণ হাতের ছোঁয়ায় নিশ্চিত্তে চোখ বন্ধ করল শৌনক। বহুদিন পরে যেন আপনজনের যত্ন পেল ও।
ঘুমিয়ে গেছে শৌনক। সেটাই তো স্বাভাবিক। পেইন কিলার দেওয়া হয়েছে। মোবাইল স্ক্রিনের দিকে চোখ পড়ল নূপুরের। সন্ধে সাড়ে সাতটা বাজে। শৌনকের মুখের ওপরে নাইট ল্যাম্পের আলোটা পড়েছে। নূপুর সেদিকে তাকিয়েই স্থির হয়ে গেল। মানুষটাকে ও চেনেই কতটুকু? তবুও সেই বিকেল চারটের থেকে সন্ধে সাড়ে সাতটা পর্যন্ত হসপিটাল আর কোয়ার্টারে কাটিয়ে দিল নূপুর। এখন ওর বাড়ি যাওয়া দরকার। কিন্তু ঘুমন্ত মানুষটাকে কার কাছে-ই বা রেখে যাবে! শৌনকের কপালের ওপরে কয়েকটা বিচ্ছিন্ন চুল এসে পড়েছে। নূপুর হাত দিয়ে সরিয়ে দিতে গিয়েই দেখল, গায়ে জ্বর রয়েছে। ব্যথার কারণেই হয়তো জ্বরটা এসেছে। তেমন বেশি নয়, ওই গা-টা ছ্যাঁক ছ্যাঁক করছে।
নূপুর হাত সরিয়ে নেবার আগেই শৌনক ওর হাতের ওপরে হাতটা রেখে বলল, “লোভ ধরানো কি উচিত? একলা জীবন, একাকিত্ব, অযত্ন, অনাদরের সঙ্গেই তো সহবাস করছি পাঁচ বছর। তবুও মাত্র পাঁচ ঘণ্টায় কেন এত লোভ হল কে জানে! ঘুমানোর আগে মনে মনে ভেবেছিলাম, ঘুম থেকে উঠে কি দেখতে পাব? এ আশাটাই তো লোভী করে তুলবে আমায়।”
নুপুর হাতটা সরিয়ে না নিয়েই বলল, “নিজেকে ঈশ্বর ভাবা বন্ধ করলেই মিটে যায়। রক্ত-মাংসের মানুষের ভুল-ঠিক, লোভ-পাপ সবই থাকবে জীবনে। সেটাই তো স্বাভাবিক। সন্ন্যাসী তো নয়, তা হলে একলা থাকতে মাথার দিব্যিই বা কে দিল?”
শৌনক ক্লান্ত হেসে বলল, “রাত হচ্ছে, আপনার দেরি হচ্ছে, আপনি এবারে আসুন। বাই দ্য ওয়ে, থ্যাঙ্ক ইউ।”
নূপুর বলল, “জানতাম আপনার ঘুম ভাঙলেই আমায় তাড়াতে ব্যস্ত হবেন। কিন্তু তার আগে বলুন, ওয়াশরুমে যাবেন তো?”
শৌনক বেড সুইচটা দিয়ে আলো জ্বেলে বলল, “প্রলয় এসেছে? ওকে বলছি নিয়ে যেতে।”
নূপুর হেসে বলল, “আপনি কি জন্ম থেকেই লাজুক? নাকি আমায় দেখে লজ্জা পাচ্ছেন? বারবার ভুলে যাচ্ছেন, আমি একজন ডক্টর।”
শৌনক চোখ নামিয়ে বলল, “কেন ডাক্তারদের নির্লজ্জ হতে হয় বুঝি?”
নূপুর লজ্জা পেয়ে কথাটা ঘোরানোর জন্যই বলল, “প্রলয় বাইরেই অপেক্ষা করছে, আমি তাকে বাজারে পাঠিয়েছিলাম কিছু বাজার করার জন্য।”
শৌনক বলল, “কত টাকার বাজার করালেন? ওই দেখুন টেবিলে আমার ওয়ালেট আছে, ওটা একবার দিন।”
নূপুর বলল, “আচ্ছা অকৃতজ্ঞ মানুষ তো আপনি! ঘুম থেকে উঠেই আমায় তাড়িয়ে দিতে চাইছেন। বাজারের টাকা ধরিয়ে ঋণ শোধ করে দিতে চাইছেন, কেন বলুন তো? শুনুন, আমি এত সহজ মেয়ে নই। বিজনেসম্যানের মেয়ে। সব হিসেব সুদে-আসলে নেব। তাই চিন্তা করবেন না। প্রলয় এসেছে, ওয়াশরুমটা ঘুরে আসুন।”
প্রলয় খুব সাবধানে যত্ন করে শৌনককে ধরে ধরে বাথরুমে নিয়ে গেল। নুপুর রান্নাঘরে গিয়ে দেখল, ফুলমণির রান্না করা সকালের সয়াবিন-আলুর তরকারি রয়েছে আর ভাত। এটাই বোধহয় ডিউটি থেকে এসে খেয়ে নেবে ভেবেছিল শৌনক। ইস, ফুলমণির চা যদি বা খাওয়া যায়, তরকারির রং দেখেই তো কেমন লাগছে নুপুরের। ও নিজেও অবশ্য বিশাল কিছু রন্ধনপটিয়সী নয়, তবে মেসে থাকাকালীন টুকটাকি শিখে নিয়েছিল নিজের প্রয়োজনেই। প্রলয়কে দিয়ে চিকেন আর ব্রেড আনিয়েছে। আর কিছু ফ্রেশ ভেজিটেবল। চিকেন স্ট্যু আর টোস্ট বানিয়ে দিলেও হয় শৌনককে। নিজের মনেই ভাবছিল নূপুর, শৌনক কি ওকে বেশিই আদেখলা ভাবছে? স্বল্প পরিচিত একজন মানুষের বাড়িতে এতক্ষণ কাটানো কি ওর উচিত হচ্ছে? প্রলয় এসে গেছে। এবারে বোধহয় ওর চলে যাওয়া উচিত। আনমনে ভাবতে ভাবতেই ব্রেড আর বাটারটা সাইডে রাখল নূপুর। খুব যে মিশুকে স্বভাবে মেয়ে নূপুর, তাও নয়। অপছন্দের মানুষদের সঙ্গে ও হাই, হ্যালো দিয়েই কথা শেষ করে। আর পছন্দের হলে আর-একটু কথা এগোয়। নিজেকে ও খুব ভালো করেই চেনে। মেডিকেল কলেজে পড়াকালীন রাজীব কমবার তো প্রপোজ করেনি। কিন্তু নূপুরের সামান্যতম আগ্রহ ছিল না প্রেম-ভালোবাসার মতো আবেগসর্বস্ব বিষয়ে। তাই নিজের ওপরে সম্পূর্ণ বিশ্বাস ওর আছে। মনের ওপরে কন্ট্রোলও ওর আছে। ডক্টর হিসেবে একজন অসুস্থ মানুষের প্রতি কর্তব্য ছাড়া এটাকে ও অন্য কোনও নামে অভিহিত করতেও চায় না। বড়ো বড়ো করে পেঁয়াজ, গাজর, বিনস কেটে একটু চিকেন দিয়ে একটা স্ট্যু বানিয়ে ফেলল। বাটার আর গোলমরিচ ছড়িয়ে, চার পিস ব্রেড টোস্টের সঙ্গে প্লেটে সাজিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল শৌনকের রুমের দিকে। আচমকাই কী মনে হতে প্রলয়কে ডাকল। প্রলয়ের হাতে প্লেটটা ধরিয়ে দিয়ে বলল, “তোমার শৌনকদাকে খাইয়ে দিয়ো। আমি এলাম, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
বাইরের টেবিল থেকে নিজের পার্স আর ফোনটা নিয়ে শৌনককে কিছু না বলেই বেরিয়ে এল নূপুর। মানুষটা যখন ওর উপস্থিতিতে এতটাই অস্বস্তি বোধ করছে, ওকে বাড়ি পাঠানোর জন্য উদ্গ্রীব হচ্ছে, তখন তার বিরক্তি বাড়াতে নারাজ নুপুর। মনের মধ্যে যদিও দ্বন্দ্ব কাজ করছে, এটা বোধহয় অভদ্রতা হল। দেখা যাক, শৌনক নিজে ওকে একটাও ফোন করে কি না। যদি না করে তা হলে নূপুর বুঝবে, মা আর দাদাভাইয়ের অপমানটা মন থেকে আদৌ সরাতেই পারেনি শৌনক। মল্লিক বাড়ির উন্নাসিক সদস্য হিসেবেই গণ্য করছে ওকেও। সেই কারণেই বারবার বলছিল, আপনার দেরি হচ্ছে এবারে আসুন। একবার তো বলতেও পারত, আর-একটু থাকুন, প্রলয় এগিয়ে দিয়ে আসবে। যাক গে, শৌনককে নিয়ে এত ভাবছে কেন নূপুর? যেটুকু কর্তব্য করা উচিত ছিল করেছে।
প্রলয় খাবারের প্লেটটা শৌনকের সামনে রেখে বলল, “খেতে পারবে শৌনকদা?”
শৌনক বলল, “আমার লেগেছে পায়ে, হাতে নয়। তোমার নূপুরদিদি এসব বানাল বুঝি? তো শুধু আমার জন্যই বানাল নাকি তোমরাও খাবে? তা হলে তোমাদেরটাও এখানেই আনো, একসঙ্গে খাই।”
প্রলয় বলল, “আমার জন্যও বানিয়ে দিয়ে গেছে। কিন্তু খাবারের প্লেটটা ধরিয়ে দিয়ে দিদি তো চলে গেল। বলল, দেরি হয়ে গেছে, খাইয়ে দিয়ো।”
শৌনক চামচে করে স্ট্যুটা মুখে দিয়েই বুঝল, খেতে বেশ সুস্বাদু হয়েছে। বড়ো যত্নে বানানো হয়েছে। কিন্তু কোনও কথা না বলে নূপুর এভাবে চলে গেল কেন? হ্যাঁ, দেরি তো হচ্ছিলই ওর, কিন্তু বাই বলে গেলে কি বড্ড দেরি হত! নাকি এসবের ভিড়ে মনে পড়ে গেছে, ও মল্লিক-বাড়ির মেয়ে। যতই ডাক্তারি পেশায় আসুক, শৌনকের সরকারি কোয়ার্টারের রান্নাঘরে এতক্ষণ কাটানোটা একেবারেই উচিত নয়, এটাই বোধহয় মনে হতে দেখা না করেই
চলে গেল।
শৌনক খাবারের প্লেটটা নামাতেই প্রলয় বলল, “ওষুধগুলো দেব? নূপুরদিদি দেখিয়ে দিয়ে গেছে আমায় কোনটা কখন দিতে হবে।”
শৌনক বিরক্ত মুখে বলল, “আমি তো একজন ডক্টর, বুঝি কোনও ওষুধ কখন খেতে হয়। আর তোমার নুপুরদিদির থেকে আমার এক্সপিরিয়েন্স যথেষ্ট বেশি। তুমি এখন যাও। বাকিটা আমি ম্যানেজ করে নেব।”
প্রলয় প্লেটটা নিয়ে চলে গেল। শৌনক আলো নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল। কোনও কারণ ছাড়াই একটা অদ্ভুত অভিমান হচ্ছিল নূপুরের ওপরে। শৌনক তো চায়নি এমন আন্তরিকতা, এমন সহৃদয় বন্ধুত্বের সম্পর্কও চায়নি। নূপুরই উপযাচিত হয়ে এই অসম বন্ধুত্বের হাতছানি দিয়েছিল। শৌনক নিজের পরিধি জানে বলেই রাশটুকু টেনে রাখে। এসব শিল্পপতিদের হাউজ ফিজিশিয়ান হলেও এরা যে ওকে তেমন উচ্চজাতের কেউ ভাবে না, সেটুকু বুঝতে ওর বাকি নেই। তাই দূরত্ব মেইনটেন করেই থাকে শৌনক। কিন্তু এসবের ব্যবধান তো নূপুর স্বেচ্ছায় ঘুচিয়ে দিতে এসেছিল। শৌনক নিজের মনেই বলল, এটা হয়তো সাময়িক ইচ্ছে হল তাই করল, তারপরেই নির্ভয়পুরের আবহাওয়ার মতোই নুপুরের মনটাও পালটে গেল। যাক গে, এটাই ভালো হল, কী হবে সম্পর্কের মায়ায় জড়িয়ে? একাকিত্ব যাপনে অভ্যস্ত মনটা অবাধ্য হয়ে গেলে শৌনকেরই বিপদ।