ইতি নির্ভয়পুর – ১৭
১৭
“কীসের বিপদের কথা বলছ সুনীল? জলের মতো টাকা খরচ করছি কি তোমার ভ্রুর ভাঁজে দুশ্চিন্তার ছায়া দেখব বলে? কালকে ফুটবল টুর্নামেন্টটার অ্যারেঞ্জ করেছ তো?”
সুনীল সেনগুপ্ত গম্ভীরভাবে বলল, “সেটা নিয়ে চিন্তা নেই। সে সব হয়ে যাবে। কিন্তু একটা খবর আছে। কনকলতা ঘোষাল হঠাৎ সুজয় হাঁসদার পক্ষ নিয়েছে। ইলেকশনের জন্য কনকলতাও অর্থসাহায্য করছে সুজয়কে।”
পামেলা চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে বলল, “মানে? কিন্তু কেন? মিসেস ঘোষালের আবার কীসের স্বার্থ? ঘোষাল তো আমার সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। আর মিসেস ঘোষালের বিশাল কোনও প্রতিবাদী সত্তা আছে বলে তো শুনিনি 1 ওই তো শাড়ি জড়ানো পুঁটলি। স্বামীর কথাতে পরিচালিত জীববিশেষ। ও নিয়ে তুমি চিন্তা কোরো না সুনীল। আমি আজকেই ঘোষালের সঙ্গে বসে কথা বলে নেব। তুমি আমার পিঠে একটু ক্রিম ম্যাসেজ করে দাও প্লিজ।”
অন্যদিন হলে সুনীল পামেলার ঘনিষ্ঠ হবার ছুতো খোঁজে, কিন্তু আজ যেন ওর ভ্রুর ভাঁজ মেলাতেই চাইছে না।
সুনীল বলল, “আর-একটা খবর তোমায় দেবার আছে। নীহার কিন্তু ওই আদিবাসী মেয়েটার সঙ্গে গ্রিনভ্যালির রুমেও যাচ্ছে।”
পামেলা হেসে বলল, “আচ্ছা সুনীল তোমার কী মনে হয় আমায়? আমার কোনও সোর্স নেই? সব আছে। নীহারের যা বয়েস তাতে এসব একটু-আধটু তো করবেই। এখন যদি তুমি কুত্তলী নামের মেয়েটাকে আমার ভাইয়ের বউ করে নিতে বলো, তা হলে আমি অপারগ। ভোটে জেতার জন্য এতটা স্যাক্রিফাইস করা সম্ভব নয়।”
সুনীল বলল, “কিন্তু এটাকে যদি তোমার বিরুদ্ধে প্রচারে কাজে লাগায় তখন?”
পামেলা ক্রিমটা ড্রেসিং টেবিলে রেখে বলল, “মানে?”
সুনীল বলল, “আদিবাসী মেয়ের সঙ্গে ভালোবাসা করেছে পামেলা মিত্রর ভাই। এভাবে একটা মেয়ের সঙ্গে মেলামেশা করার পরে নীহারকেই বিয়ে করতে হবে বলে দাবি তোলে, তখন কীভাবে সামাল দেবে?”
পামেলার গ্লসি স্কিনেও এক চিলতে দুশ্চিন্তা হানা দিল যেন।
সুনীল বলল, “তাছাড়া নীহার আদিবাসীদের বাড়ি বাড়ি ঘোরে। এখানে ও বেশ পরিচিত। ওর পপুলারিটিও যথেষ্ট। আমি তোমাকে বলছি পামেলা, কুত্তলীর সঙ্গে নীহার বিয়ে করবে বলে মনস্থ করেছে।”
পামেলা ছিটকে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মিনিট দুয়েক পরে জুসের দুটো গ্লাস নিয়ে টেবিলে রেখে বলল, “নীহারকে ফোন করে বলো, এখনই যেন বাড়ি চলে আসে। দিদি খুব অসুস্থ।”
সুনীল জুসের গ্লাসটা হাত তুলেছিল, কিন্তু চুমুক দেবার আগেই টেবিলে ঠক করে রেখে দিয়ে বলল, “মানে? করতে কী চাইছ সেটা তো ক্লিয়ার করো। আমি এসব মিথ্যে বলতে পারব না নীহারকে। ও আমায় ভালোবাসে, সম্মান করে।”
পামেলা সুনীলের চওড়া বুকে আলতো করে হাত বুলিয়ে বলল, “তুমি বুড়ো হয়ে যাচ্ছ না আমি?”
সুনীল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, “পামেলা মিত্র পলাশবনার মতো এভারগ্রিন, সেটা সবাই জানে।”
পামেলা বর্ষার ভরা জলের রঙ্গিত নদীর মতো খিলখিল করে হেসে বলল, “তা হলে তুমিই চার্চটার মতো বুড়ো হচ্ছ। আমি আর আকর্ষণ করছি না তোমায়। এসব কেজো কথায় সন্ধেটা কাটিয়ে দিলে। সেই সুনীল কোথায়, যার হাতের ছোঁয়ায় আমার শরীরে আগুন ধরে যায়। প্লিজ সুনীল, হারিয়ে যেয়ো না। তুমি তো জানো, আমি তোমায় কতটা ভালোবাসি।”
ঘোষালের সঙ্গে পামেলার ঘনিষ্ঠ হয়ে বসার ছবিটা দেখার পর থেকেই সুনীলের মনে বিন্দু বিন্দু অভিমান জমেছিল। পামেলার বলা ভালোবাসি কথাটাতে সেই অভিমানের প্রাচীরে গিয়ে উষ্ণতার বাতাস বইয়ে দিল মুহূর্তে।
পামেলা সুনীলের কাঁধে মাথা রেখে বলল, “আমি কাউকে বিশ্বাস করি না সুনীল। নিরঞ্জন, ঘোষাল, মল্লিক কাউকে নয়। এরা সবাই ধান্দাবাজ। আমি শুধু তোমায় বিশ্বাস করি। এই বিশ্বাসটা কোথা থেকে এসেছে জানো? ভালোবাসা, অধিকারবোধ এগুলো থেকে। তোমার হয়তো মনে হচ্ছে আগাপাশতলা যান্ত্রিক, স্বার্থপর মহিলার মুখে এসব কী কথা? কিন্তু সুনীল, আমার এই মোম সাদা চামড়ার নিচে রক্ত-মাংসই তো আছে, তাই না? সে-ও তো একটা ভরসাযোগ্য কাঁধ চায় যেখানে পরিশ্রান্ত হয়ে মাথা রাখা যায় নিশ্চিন্তে। এই যে সেদিন ক্লাবে ঘোষাল আমার হাত ধরে আবেগ জানাতে এসেছিল, আমি তো জানি ও কী চায়? আমায় বিজনেস পার্টনার করতে চায়। না সুনীল ঘোষাল, সমাদ্দার কাউকেই আমি বিজনেস পার্টনার করব না। আমি আমার ভাই-বোনকে পার্টনার করিনি। যদি বিজনেস পার্টনার করতেই হয়, তা হলে আমি যাকে সব থেকে বিশ্বাস করি, যার নিজস্ব কোনও স্বার্থ নেই, যে আমার জন্য এনে দিতে পারে একশো আটটা নীল পদ্ম, তাকেই করব। তুমি হবে আমার বিজনেস পার্টনার। জানি তুমি না বলবে। কারণ, তুমি পামেলা মিত্রকে ভালোবাসো আর বাসো তোমার ফুটবল ক্লাবকে। তাই তোমার এসব সম্পত্তির দরকার নেই, তাই তো? কিন্তু আমি দিতে চাইলে অস্বীকার করার ক্ষমতাও তোমার নেই সুনীল। এটুকু আমি তোমায় চিনি।”
সুনীলের কাঁধ থেকে মাথা তুলে দেখল পামেলা, ওর চোখে বর্ষার মেঘ থই থই করছে। আর-একটু হলেই বৃষ্টি নামবে। সত্যি পুরুষমানুষগুলো বড়ো বেশি বিশ্বাস করে ওকে। ভাগ্যিস করে, তাই পামেলার কাজ এত সহজ হয়।
সুনীল ওকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আমি তোমায় হারতে দেব না পামেলা, নিজের সবটুকু দিয়েও তোমায় জয়ী করব।”
পামেলা বলল, “হার-জিতের লড়াই আমি জীবনে অনেক করেছি সুনীল। আমি শুধু তোমায় একটাই কথা বলতে চাই, তুমি আমার ছিলে, আছ আর থাকবে। আমি তোমার হাত ধরে বুড়ো হতে চাই। আমার চোখের নিচের ভাঁজ, কুঁচকে যাওয়া চামড়া, ঝুঁকে যাওয়া শিরদাঁড়া, চুল কমে যাওয়া সিঁথির অধিকার শুধু তুমিই নিয়ো প্লিজ। কারণ আমি জানি, তখন আমার পাশের ভিড় হালকা হয়ে গেলেও তুমি থেকেই যাবে।”
সুনীল বলল, “আমি না হয় নীহারকে ফোন করলামও, কিন্তু তারপর? কী বলবে তুমি ওকে?”
পামেলা বলল, “ওকে কলকাতা পাঠিয়ে দেব ভোট হওয়া পর্যন্ত। মায়ের শরীরটা খারাপ, বোন একা ব্যবসা সামলাবে না মাকে দেখবে?”
সুনীল বলল, “হ্যাঁ, এটা ভালো প্ল্যান।”
পামেলার কথা শেষ হবার আগেই বাইরে একটা গন্ডগোলের আওয়াজ পেল।
সুনীল বলল, “বাড়ির গেটে চেঁচামেচি কীসের?”
পামেলা অবিন্যস্ত পোশাকটা ঠিক করতে করতে বলল, “দেখো হয়তো ভিখারিরা এখন থেকেই লাইন দিয়েছে পঞ্চায়েত প্রধানের কাছে দাবি নিয়ে।” ব্যালকনি দিয়ে তাকাতেই দেখতে পেল বিশাল মিছিল বেরিয়েছে। সুজয় মাইকে বলতে বলতে চলছে। পিছনে নির্ভয়পুরের মানুষজন গলা মেলাচ্ছে। এই মিছিলে একজনকে দেখে চমকে উঠল পামেলা। সুজয়ের পাশে হাঁটছে কনকলতা ঘোষাল। কুত্তলীর গায়ের পোশাকটা পামেলাকে দ্বিতীয়বার চমকানোর সুযোগ করে দিল। এ ড্রেস তো ওর কলকাতার শো-রুমের ড্রেসটার দাম চোদ্দো হাজার টাকা। ওর নিজের একটা সেম সালোয়ার-স্যুট আছে। মাত্র তিনপিস ডিজাইন করে দিয়েছিল ওর নিজস্ব ডিজাইনার। ওরা দুই বোন দুটো নিয়েছিল। আর একটাই পড়ে ছিল পিঙ্ক কালারের। সেটাই পরে আছে কুন্তলী। অসহ্য রাগে মাথাটা গরম হয়ে গেল পামেলার।
ব্যালকনি থেকেই দেখল, নীহারের গাড়িটা ঢুকছে গ্যারেজে। তার মানে, সুনীলের ফোন পেয়েই চলে এসেছে। এখন মাথা গরম করলে চলবে না। মাথা ঠান্ডা করে পুরো বিষয়টা হ্যান্ডেল করতে হবে। নীহার বাড়িতে ঢোকার আগেই ছুটে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল পামেলা। সুনীলকে ইশারায় বলল, “বলবে খবরটা শোনার পর থেকেই টেনশন করে অসুস্থ হয়ে পড়েছে পামেলা।”
নীহার ঘরে ঢুকেই বলল, “কী হয়েছে বড়দি?”
পামেলা মাথাটা তুলে বলল, “মায়ের শরীর খারাপ হয়েছে রে। তুই কালকের ফ্লাইট ধরে কলকাতা চলে যা। বোন একা পারছে না।”
নীহার যেন একটু চমকেই বলল, “কিন্তু কখন হল? আমার সঙ্গে তো কাল রাতেই মায়ের কথা হল। তখন তো ঠিক ছিল।”
পামেলা বলল, “প্রেশার হাই হয়ে গেছে তোর চিন্তায়। ছেলে ছেলে করে মায়ের এই হাল। তোর ছোটদিই বলল, নিরুকে না দেখলে মায়ের প্রেশার কমবে না।”
নীহার বলল, “বেশ, আমি টিকিট বুক করে নিচ্ছি তৎকালে। কিন্তু এস্টেটের কিছু কাজ পেন্ডিং আছে তো।”
পামেলা বলল, “ওসব আমি দেখে নেব ভাই। দেখ না, তোর সুনীলদাকে তাই বলছিলাম, ভোট ভোট করে এস্টেটের কাজ দেখাই হয়নি কতদিন। ভাইটা আমার ছিল বলে, এ যাত্রা সব সামলে দিল।”
নীহার বলল, “দিদি, আমি তোকে একটা কথা বলব ভেবেছিলাম। সুনীলদাও আছে তোদের দুজনকেই বলি। আমি একটা মেয়েকে ভালোবাসি।”
পামেলা নীহারের কথা শেষ করতে না দিয়েই বলল, “দেখ ভাই, তুই আমার বড়ো আদরের। তাই তুই যাকে ভালোবাসিস, তাকে মেনে নিতে আমার কোনও আপত্তি নেই। তবে আজ মনটা ভালো নেই রে। তুই কলকাতা থেকে ঘুরে আয়, তারপর শুনব আমার ভাই কাকে পছন্দ করে রেখেছে।” নীহার লজ্জিত মুখে বলল, “বেশ তাই হবে। তুই যখন মেনে নিয়েছিস, আমার আর চিন্তা নেই।”
নীহার ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই পামেলা বলল, “কাল ফুটবল টুর্নামেন্টের অনুষ্ঠানে ভাবছি লাল-সাদা একটা ব্যাঙ্গালোর সিল্ক পরব। সঙ্গে ডিজাইনার ব্লাউজ। চুলে একটা এলো খোঁপা। কেমন লাগবে সুনীল আমায়? যাও যাও তুমি কেন বসে রইলে এখনও? কালকের প্রস্তুতি নাও।”
সুনীল ঘাড় নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, আমি এখন আসছি।”
সুনীল বেরিয়ে যেতেই নিজের ঘরে লক করে দিল পামেলা। ঘোষালকে ফোন করে বলল, “কী ব্যাপার ডার্লিং, কী সব দেখছি! এটা কিন্তু দারুণ উদ্যোগ। আরে তোমাদের মতো উদারমনস্ক ব্যবসাদারই তো সমাজের ভাবনাকে বদলে দেবে। আমি তোমায় স্যালুট জানাই।”
কনকলতার এই দুর্বিনীত ব্যবহারের কারণে যথেষ্ট বিরক্ত হয়ে আছে ঘোষাল। তার মধ্যে পামেলার হেঁয়ালি আরও বিষাক্ত করে দিল মনটাকে।
ঘোষাল রেগে গিয়ে বলল, “মেয়েমানুষের মতো জটিল প্রাণী এ পৃথিবীতে খুব কমই আছে। তোমাদের স্বয়ং ব্রহ্মা বুঝতে পারেন না, আমি তো কোনও ছার। যা বলার ঘুরিয়ে না বলে সোজাসুজি বলো।”
পামেলা খিল খিল করে হেসে বলল, “আরে নির্ভয়পুরের বাতাসেও খবর উড়ছে, মিসেস ঘোষাল সুজয় হাঁসদাকেই জামাই হিসেবে পছন্দ করেছে। সেই কারণেই তার সঙ্গে মিছিলে হাঁটছে। কনগ্র্যাচুলেশন ঘোষাল। আমরা নিমন্ত্রণ পাব তো তোমার মেয়ের বিয়েতে? নাকি উচ্চঘর বলে বাতিল করে দেবে তোমার বউ?”
ঘোষালের মাথাটা গরম হয়েই ছিল। কনকলতার এ হেন আচরণে সে অত্যন্ত লজ্জিত। আবার পামেলার এমন ব্যঙ্গাত্মক কথায় মেজাজ হারিয়ে বলেই ফেলল, “আরে পামেলা, তুমিই তো আমার পথপ্রদর্শক। আমার স্ত্রী সুজয়ের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছে কি না, এটা এখনও বাতাসে ওড়া কথা, কিন্তু তোমার ভাই যে মৃত বিজন মুর্মুর মেয়েকে বিয়ে করছেই, সে খবরে কিন্তু সিলমোহর পড়ে গেছে। তো বিয়েটা কি ভোটের আগেই দেবে? না পরে? যেভাবে ক্লাবের ওপরের একটা ঘর তোমার ভাই প্রতি সন্ধেতেই বুক করে রাখছে, তাতে গ্রিনভ্যালিতে তোমার মেম্বারশিপের চার্জ আরও বেশি হওয়া উচিত কিন্তু।”
পামেলা বুঝল, নীহারের কীর্তির কথা মোটামুটি এ চত্বরের সবাই জানে। দিদির টাকায় গাড়ি চড়ে ঘুরছে, আর দিদির সম্মান নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। আবার ওই আদিবাসী মেয়েটাকে পামেলার মতো ভিজাইনার ড্রেস গিফট করাও হচ্ছে। নিজের মুরোদ তো ওই সাদা কাগজে আঁকিবুকি কাটা। নির্ভয়পুরে এতদিন ধরে পামেলা যে ভাবমূর্তিটা তৈরি করেছিল, সেটা নিমেষে মাটিতে মিশিয়ে দিল নীহার। এই ঘোষাল, মল্লিক, সমাদ্দার, রায় এরা চোখে চোখ রেখে কথা বলতে ভয় পেত পামেলার সঙ্গে। সবাই এক কথায় স্বীকার করত, পারফেক্ট বিজনেস ওম্যান। যার সঙ্গে টেক্কা দিতে সাহস লাগে। নীহার নিজের পছন্দ দিয়ে বুঝিয়ে দিল, ওদের ছোটোবেলাটা কেটেছে বস্তির ঘুপচি ঘরে। রুচিটা কিছুতেই উন্নত করতে পারেনি ও। সেই কারণেই কুণ্ডলীর মতো একটা মেয়েকে বিয়ে করতে চাইছে। ছোটো থেকে নামী স্কুল-কলেজে পড়িয়েছে নীহারকে, যা চেয়েছে তার বেশিই দিয়েছে। তার পরেও যে চূড়ান্ত নিম্নমধ্যবিত্ত মানসিকতাটা ও বহন করে চলেছে, এটা ভাবতেই ঘৃণা হচ্ছে পামেলার। কী করে ভুলে গেল নীহার যে, ও দ্য পামেলা মিত্রর ভাই! ছি ছি, এভাবে ওর সম্মানকে মাটিতে মিশিয়ে দেবার আগে ওর একবার মনে হল না? হোয়াটসঅ্যাপে বেশ কিছু মেসেজ ঢুকেছে আননোন নম্বর থেকে। হোয়াটসঅ্যাপ ওপেন করতেই চমকে উঠল পামেলা, এসব কী? নীহার আর কুন্তলীর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ কিছু ছবি। কিন্তু কে পাঠাল এই ছবি? নম্বরটাতে কল করতেই বুঝল, সুইচড অফ। এই ছবি ভাইরাল হলে নীহারের সঙ্গে কুন্তলীর বিয়ে দিতে বাধ্য হবে পামেলা। আর তা হলে একদিনে ও মালিকপক্ষ থেকে নেমে আসবে। কুত্তলীর মা পামেলার টি-এস্টেটের একটা মজুর মাত্র। রোজ এসে চা পাতা তোলা, আর বাছাইয়ের জন্য দৈনিক মজুরির মজুর। কুন্তলী ওদের গ্রিনভ্যালি ক্লাবে ড্রিঙ্ক সার্ভ করে। সে হবে পামেলা মিত্রর ঘরের বউ? এর থেকে মৃত্যু শ্রেয়। ভাবনার মধ্যেই দরজায় নক করছে নীহার। পামেলার মনে হচ্ছে, ভাই নয়, সাক্ষাৎ শত্রু। পামেলার উচিত এখনই দমবন্ধ করে ওকে মেরে দেওয়া। পামেলার কাছে এ খবরও আছে, নীহার নির্ভয়পুরের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পামেলার নামে অপপ্রচার করছে। লোককে বলছে, আমার দিদি আপনাদের জন্য কিছুই করবে না। এরপরেও নীহারকে বাড়ি থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে না দিলে ও আরও বড়ো সর্বনাশের খেলায় নামবে
দরজা খুলতেই নীহার বলল, “দিদি আমি কাল ভোরের ফ্লাইট পেয়েছি। চারটের সময় বেরোতে হবে বাড়ি থেকে। তুই হয়তো তখন ঘুমাবি। তাই কয়েকটা কথা তোকে বলতে চাই।”
পামেলা জানে, নীহার কী বলবে। কুণ্ডলীকে বিয়ে করার কথাই বলতে এসেছে হয়তো।
কিন্তু পামেলাকে অবাক করে দিয়ে নীহার বলল, “আমি তোর কোম্পানি ছাড়তে চাই। নিরঞ্জন সমদ্দার আমায় অফার করেছে, আমি ওখানে জয়েন করতে চাই। দেখ দিদি, সারাটা জীবন তো তোর রোজগারের টাকাতেই খেলাম। নিজে কিছু উপার্জনের সুযোগ যখন পেয়েছি, তখন ছাড়ব কেন? ম্যানেজিং ডিরেক্টরের পোস্ট হোল্ড করে অস্মিতা, আমি ওরই সেক্রেটারি হয়ে জয়েন করছি। মাইনে পঞ্চাশ হাজার। আমায় মূলত রপ্তানির দিকটা দেখতে হবে। আমি জানি তোর একটা আংটির দাম একলাখ। তাই তোর কাছে এটা হাস্যাস্পদ। কিন্তু আমি এবারে পামেলা মিত্রর ছত্রছায়া থেকে বেরোতে চাই। প্লিজ, তুই রাগ করিস না। যদি অসুবিধা হয়, তুই তো রইলি। সামনের মাস থেকেই আমি ওখানে জয়েন করছি। তার আগে কলকাতা থেকে ফিরে তোর কোম্পানির পেন্ডিং কাজগুলো কমপ্লিট করে দেব।”
পামেলার উত্তরের অপেক্ষা না করেই চলে গেল নীহার। বিছানায় ধপ করে বসে পড়ল পামেলা, সহ্যের একটা সীমা আছে। নিরঞ্জন সমাদ্দার কম্পিটিশনে না জিততে পেরে এই চালটা চেলেছে। নীহার কোম্পানি জয়েন করার পরে পামেলার এক্সপোর্ট বেড়ে গেছে। সেটা খবর পেয়েই নীহারকে তুলে নিতে চাইছে সমাদ্দার। নির্ভয়পুরের লোকজন দেখবে, পামেলা মিত্রর সহোদর ভাই, মিত্র টি-এস্টেটের মালিক নীহার, মিত্র সমাদ্দারের মেয়ের সেক্রেটারির চাকরি করছে মাত্র পঞ্চাশ হাজারের বিনিময়ে। পুরোটাই চক্রান্ত। আর-একদিকে সমাদ্দার রটিয়ে দেবে, পামেলা নিজের ভাইকে তাড়িয়ে দিয়েছে, সে নির্ভয়পুরের মানুষের কী উপকার করবে? আর নিরঞ্জন দয়ার সাগর হয়ে অসহায় নীহার মিত্রকে আশ্রয় দিয়েছে। উফ কী তুখড় প্ল্যান! কিন্তু এরা ওর শত্রু হল কবে থেকে? ও ভোটে দাঁড়ানোর পর থেকে কি? রাজনৈতিক ক্ষমতা পাবে বলে? ঘোষাল একবার পামেলার সিটে দাঁড়িয়েই গো হারা হেরেছিল। তাই কি এদের এত হিংসা? কিন্তু পামেলাকে এভাবে শেষ করা যাবে না। পথের সব কাঁটাকে নির্মম হাতে তুলে ফেলেই ও আজকে এই জায়গায় রয়েছে। তাই আরও দু’-চারটে কাঁটাকে তুলে ফেলতে ওর বেশিক্ষণ লাগবে না। পামেলার বিশ্বস্ত দু’-চারজন আছে ওর বাড়িতেই। এমনিতে তারা ওর বাগানের মালি, ড্রাইভার, রাঁধুনি, সিকিউরিটি। কিন্তু এদের আর-একটা পরিচয় কেউ জানে না, এরাই পামেলাকে যাবতীয় গোপন খবর সরবরাহ করে অতি সাবধানে। আর পামেলা বললে এরা জীবন দিতেও পারে আবার নিতেও পারে এক নিমেষে।
কিষান পামেলার ঘরের দিকে এগিয়ে আসছে দেখেই বুঝল, খবর কিছু আছে।
কিষান কাছে এসে বলল, “ম্যাডাম, ওই কুত্তলী মেয়েটা পোয়াতি। আমায় মালতি বলল। কুত্তলী নাকি ওকে বলেছে, এ মাসেই নীহার দাদাবাবু ওকে বিয়ে করবে। মালতীকে নগদ একশো দিয়ে খবরটা বের করেছি। কুম্ভলী আর মালতী দুজনেই গ্রিনভ্যালিতে কাজ করে, এক সঙ্গেই বাড়ি ফেরে। মালতী বলছিল, দাদাবাবু রোজই অফিসের পরে ক্লাবের ঘরে যায় কুত্তলীকে নিয়ে।” পামেলা কিষানের হাতে দশ হাজার টাকা দিয়ে বলল, “আর-একটা কাজ তোকে করতে হবে। কাকপক্ষীও যেন টের না পায়।”
কিষান শুনে চমকে উঠে বলল, “খতম করে দেব? কিন্তু…
পামেলা বলল, “আমি ‘কিন্তু’, ‘না’ এসব শব্দগুলো শুনতে পছন্দ করি না। এখন যা। যেভাবে বললাম ওইভাবেই করো।”