ইতি নির্ভয়পুর – ১৯
১৯
“কী ব্যাপার, শুনলাম নাকি ওই ভাঙা পা নিয়েই আপনি আজ ছবি তুলতে বেরিয়েছিলেন রাস্তায়? ওষুধপত্রও নাকি ঠিক করে খাচ্ছেন না, কেন? নির্ভয়পুরের রোগীদের ওপরে রাগ করে বুঝি? এদিকে এমার্জেন্সিতে বসে দেখলাম গোটা নির্ভয়পুরবাসী তো শুধু শৌনক-ডাক্তারকেই ভরসা করে। তো শৌনক-ডাক্তার তাদের ভরসার জায়গাটা রাখছে কি?”
নূপুরের ফোনটা দেখে ধরবে কি ধরবে না ভেবেও রিসিভ করল। সেই যে চারদিন আগে সন্ধেতে না বলে চলে গিয়েছিল, তারপর আর কোনও ফোন বা মেসেজ শৌনকও করেনি, নূপুরও করেনি। শৌনক সম্পর্কটা ওখানেই দ্য এন্ড টানতে চেয়েছিল। নূপুর কী চেয়েছিল সেটা অবশ্য শৌনকের অজানা। তবে গত চারদিনে শৌনকের ভাবনায় নূপুর এসেছিল বারবার। নূপুরের যত্নের উষ্ণ ছোঁয়াটাও পেতে ইচ্ছে করেছিল, কিন্তু ও এসব স্বপ্নীল ইচ্ছেকে ফুঁ দিয়ে দূরে সরিয়ে দিয়েছে বারবার। তবুও খুব চাইছিল, নূপুর ওকে একবার ফোন করুক। কেন চাইছিল সেটা অবশ্য শৌনকের ডাক্তারি বিদ্যায় জানা নেই! তাই নূপুরের নামটা স্ক্রিনে উঠতে একটু বোধহয় হাসির আভাস ফুটেছিল শৌনকের ঠোঁটের কোণে। তারপরে মস্তিষ্কের দ্বিধা কাটিয়ে রিসিভ করেই ফেলেছিল। নূপুর তার নিজস্ব ঢঙে শাসন করতে শুরু করেছিল শৌনককে। শুনতেই বেশি ভালো লাগছিল শৌনকের, বলতে নয়।
নূপুর বলল, “কী হল, বললেন না তো সুস্থ হবার ইচ্ছে আছে না নেই?”
শৌনক বলল, “আজ আপনি জয়েন করলেন তো নির্ভয়পুর হসপিটালে, আর চিন্তা কী? তবে আপনাকে ওয়েলকাম করতে পারলাম না ভেবে খারাপ লাগছে।”
নূপুর বলল, “এসব কথা ঘুরিয়ে লাভ নেই, আগে বলুন ওষুধ খাচ্ছেন না কেন? আর বাইরেই বা বেরিয়েছিলেন কেন?”
শৌনক বলল, “শাসন করার কেউ নেই বলে। কিন্তু প্রলয়কে তো এতদিন সাহেব টাকা দিয়েছিল আমার খবর নেওয়ার জন্য। এখন কি আপনি দিচ্ছেন?”
নূপুর ফোনের অন্য প্রান্তে হেসে বলল, “প্রলয় ওই পাঁচশো টাকা আমায় ফেরত দিয়ে গেছে। ভুল হয়েছে বলে ক্ষমাও চেয়েছে। তখনই আমি সুযোগ নিয়েছি। বলেছি ক্ষমা আমি করতেই পারি, কিন্তু তোমার শৌনকলার সব খবর আমার লাগবে। সে ঠিক করে খাওয়া-দাওয়া করছে কি না, ওষুধ খাচ্ছে কি না, পা-কে রেস্ট দিচ্ছে কি না, সব খবর যদি ঠিক করে পাই তবেই ক্ষমা করব।”
শৌনক বলল, “সে তো আপনি এসেও নিতে পারতেন।”
নুপুর একটু দম নিয়ে বলল, “আমার উপস্থিতি আপনাকে অস্বস্তিতে ফেলে যে। বিরক্ত করে ফেলি হয়তো, তাই বাড়ি চলে যেতে বলেন ঘন ঘন। সেই কারণেই যাওয়া থেকে বিরত রয়েছি। আজ হসপিটালের এমার্জেন্সিতে যে ক’জন রোগী এলেন সবাই দেখলাম, আপনাকেই খুঁজছেন। তাই ভাবলাম, ডাক্তারবাবুর খোঁজটা ফোনেই নিই, তা হলে হয়তো বিরক্ত হবেন না।”
শৌনক বলল, “নির্ভয়পুরের রোগীদের বলবেন, ডাক্তারবাবু বাড়িতে দেখবেন ওদের আগামিকাল থেকেই। আর হসপিটালে যেতে দিন দশেক আরও লাগবে মনে হচ্ছে।”
নুপুর বলল, “আমি কিন্তু অর্থোপেডিকের সঙ্গে কথা বলে রেখেছিলাম। আপনি যদি যেতে চান তো প্রলয়কে নিয়েও চলে যেতে পারেন একটা গাড়ি করে।”
শৌনক বলল, “আপনি তা হলে আমার খবর নিতে এসেছিলেন শুধুই একজন দায়িত্বশীল ডক্টর হিসেবে, তাই তো?”
নূপুর কথাটা ঘুরিয়ে বলল, “কীসের ছবি তোলার জন্য রাস্তায় নেমেছিলেন বললেন না তো?”
শৌনক স্থির গলায় বলল, “ছবি তুলতে রাস্তায় যাইনি। আমি গিয়েছিলাম বড়ো রাস্তার মোড়ে। প্রলয় ভেবেছে, আমি ছবি তুলতে গিয়েছিলাম, কারণ ক্যামেরাটা আমার গলায় ছিল।”
নূপুর বলল, “তা হলে গিয়েছিলেন কেন?”
শৌনক একটু থেমে বলল, “একজনকে দেখতে পাবার ইচ্ছে নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমি পৌঁছনোর আগেই তার গাড়ি বেরিয়ে গেল। গ্রে কালারের হুন্ডাই গাড়িটার পিছনটা দেখতে পেলাম।”
নুপুর বলল, “ফুলমণিকে দিয়ে একটু বেশি করে চা করিয়ে রাখবেন। সন্ধেতে ওখানেই চা খেয়ে ফিরব। এখন রাখলাম।”
কোনটা একটু তাড়াহুড়ো করেই কেটে দিল নূপুর। ফোনটা রাখার পরেই লজ্জা করছে শৌনকের। এ কী বলে দিল ও! ক্রাচে ভর দিয়ে বড়ো রাস্তার মোড়ে ও আজ সত্যিই গিয়েছিল নুপুরকে কনগ্র্যাচুলেট করবে বলে। নুপুরের জয়েনিং ডেটে ও নিজে হাসপাতালে থাকতে পারল না, সেটা যথেষ্ট পীড়া দিয়েছে ওকে। তাই গলায় ক্যামেরাটা ঝুলিয়ে প্রলয়কে বলেছিল, “এই সামনেই থাকছি। দুটো ছবি তুলব আকাশের।” আসলে শৌনক বেরিয়ে বড়ো রাস্তার মোড় অবধি গিয়েছিল কারণ, নূপুর সেদিন বলেছিল, “ঠিক নয়টায় পৌঁছব হসপিটাল।” সেই হিসেব মতোই সাড়ে আটটা নাগাদ পৌঁছেছিল শৌনক। আসলে নূপুরকে দেখতেও ইচ্ছে করছিল কেন কে জানে! শৌনক ভেবেছিল, শেষ পর্যন্ত হয়তো নূপুর ওর বাড়ির অমতে গিয়ে নির্ভয়পুরের হসপিটালে জয়েন করতেই পারবে না। হয়তো কলকাতার নামী কোনও ক্লিনিকে ঢুকবে। সেই কৌতূহল থেকেই শৌনক দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু ও একটু দূর থেকেই দেখল, মল্লিকদের গ্রে কালারের হুন্ডাই গাড়িটা হুশ করে বেরিয়ে গেল হসপিটালের দিকের রাস্তা ধরবে বলে। কিন্তু এ কথাটা তো নুপুরকে কোনওদিন জানতেও দেবে না ভেবেছিল শৌনক। নূপুরের একটা ফোনে কেন উজাড় করে ফেলল নিজের সবটুকু অনুভূতি? নূপুর সন্ধেতে এসে কী বলবে ওকে? চাঁদ ধরার ইচ্ছেটাকে পরিত্যাগ করতে বলবে? নাকি অবাস্তবের পিছনে ছুটতে বারণ করবে? কী ভাবছে নুপুর ওর সম্বন্ধে? মল্লিকদের টাকার লোভে ও নুপুরের দিকে হাত বাড়াচ্ছে? ছি ছি, কী ভাবছে নূপুর ওর সম্পর্কে! এভাবে বলাটা অত্যন্ত ভুল হল। কী যে হচ্ছে শৌনকের কে জানে! নিজের ওপরে সব কন্ট্রোল যেন নষ্ট হতে বসেছে।
মনকে শান্ত করবে বলেই একটা বই নিয়ে বসল ও। বইয়ের পাতায় মনঃসংযোগ করতেও যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে ওকে। এই দোলাচল অবস্থার সঠিক কারণ ব্যাখ্যা করতে পারত একজনই, শৌনকের মা ডক্টর নিবেদিতা বসু। কারণ শৌনকের মনের খবর অবধি মহিলার অজানা ছিল না। অন্যমনস্ক শৌনক বারবার ভাবছে, এই অনুভূতির নাম কি প্রেম? কিন্তু কতটুকুই বা চেনে ও নুপুর মল্লিককে? ওই দু’দিনের ব্যবহারেই প্রেমে পড়ার মতো অপরিণত শৌনক কোনওদিনই ছিল না। উঁহু, এটা কিছুতেই প্রেম হতে পারে না।
গল্পের বইয়ে মন বসছে না বলেই নিজের সাবজেক্টের একটা বই খুলে বসল ও। এই বইটা গত সপ্তাহেই কলকাতা থেকে ক্যুরিয়ারে আনিয়েছিল শৌনক। তখনই বাইরে প্রলয়ের গলার আওয়াজ পেল শৌনক। প্রলয় বেশ নালিশের সুরেই বলছে, “না নুপুর দিদিমণি ফাঁকিবাজি আমি করছি না। কিন্তু শৌনকদার মেজাজ তো আপনি জানেন না। না বললে সেটাকে হ্যাঁ করার ক্ষমতা কারও নেই।”
নূপুর বলল, “তিনটে প্লেটে এটা ভাগ করে নাও। দুটো আমাদের দিয়ে যাও।”
শৌনক চুপচাপ বই ঘাঁটছিল। মনের মধ্যের উথাল-পাতাল ঝড়কে আপ্রাণ চেষ্টায় আটকে রাখছিল। আগল ভেঙে যেন নূপুরের সামনে বেরিয়ে না আসে সেই চেষ্টাই করছিল ও।
নূপুর ঘরে ঢুকেই বলল, “আচ্ছা অবাধ্য মানুষ তো আপনি, আজও ওষুধ খাননি? ভালো হবার ইচ্ছে নেই বুঝি? এমন ডক্টর আমি জীবনে দেখিনি যার ওষুধের ওপরে ভরসা নেই।”
শৌনক বলল, “বসুন। আপনার বাবা কেমন আছেন? ফিরছেন কবে?” নূপুর বলল, “আজ স্টেন্ট বসছে। ডক্টর শোভন বসু এখন আর সার্জারি করেন না। তাই অন্য একজন ডক্টরকে রেফার করেছেন। ডক্টর বসুর নাকি গত পাঁচবছর ধরে একটু নার্ভাস ব্রেকডাউন হয় ওটিতে ঢুকলে, তাই বিদ্যুৎ রায়কে রেফার করেছেন। এই একটু আগেই দাদাভাই ফোন করে বলল, বাবা ঠিক আছে। ওহ, আপনাকে তো বলাই হয়নি দাদাভাই আপনার ওপরে ভীষণ রেগে আছে।”
শৌনক কৌতূহলী হয়ে বলল, “কেন? আমি আবার কী করলাম? আপনার বাবার ভুল ট্রিটমেন্ট করেছি নাকি?”
নূপুর হেসে বলল, “করলে ভালো করতেন, দাদাভাই রাগত না। কিন্তু নির্ভয়পুরের হাতুড়ে ডাক্তার যা যা মেডিসিন প্রেসক্রাইব করেছে কলকাতার বিখ্যাত কার্ডিওলজিস্টও সেগুলোই রিপিট করেছেন, শুধু ওঁর নিজস্ব প্যাডে। ব্যস, সাহেব মল্লিক খেপে গেছে। হাতুড়ে ডাক্তারের এত সাহস হয় কী করে? সে কেন পারফেক্ট ট্রিটমেন্ট করল বাবার?”
শৌনক বলল, “তা হলে ভুল করেছি বলছেন?”
নুপুর বলল, “তা একটু করেছেন বই-কি। সেই কারণেই তো শাস্তি দিতে ছুটে এলাম।” প্রলয় চিকেন পকোড়ার প্লেট নিয়ে ঢুকতেই নূপুর বলল, “চলুন, শাস্তির ফার্স্ট ধাপটা পেরোন আগে।”
শৌনক হেসে বলল, “কী করে জানলেন আমি এই বস্তুটির প্রতি অনুরাগী?”
প্রলয় চলে যেতেই নুপুর বলল, “আপনি মাঝে মাঝেই রাধাশ্যামের রেস্টুরেন্টে দাঁড়িয়ে এটাই কিনে খান যে।”
শৌনক চমকে গিয়ে বলল, “এটা আপনাকে কে বলল? আপনার চর প্রলয়?”
নূপুর পকোড়াতে কামড় দিয়ে বলল, “না মশাই, এসব বহুদিনের হোমওয়ার্ক। নুপুর মল্লিক নেট প্র্যাকটিস না করে মাঠে নামে না।”
শৌনক চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, “তো এই এত নেট প্র্যাকটিসের কারণটা জানতে পারি কি?”
নূপুর চায়ের কাপটা নামিয়ে বলল, “সব কিছুর কি কারণ থাকতেই হয়? অকারণেও তো ঘটে কত কিছু। ক্যামেরা গলায় ঝুলিয়ে লোকজন বড়ো রাস্তার মোড়ে গ্রে হুন্ডাইয়ের ছবি তুলতেও যায়, তারই কি কোনও কারণ আছে? সব কিছুর কারণ থাকতে নেই।”
শৌনক বলল, “আচ্ছা, এই যে আপনি আমার কোয়ার্টারে আসছেন এতে নিশ্চয়ই আপনার মা বা দাদাভাই খুবই রাগ করবে।”
নূপুর বলল, “সে তো করবেই। আমি নির্ভয়পুরে চাকরি নিয়েছি শুনেই দাদাভাই চেঁচামেচি করছিল। বলছিল, কলকাতায় নিজস্ব বড়ো চেম্বার করে দেবে। কিন্তু আমি বলেছি, উঁহু, আগে নিজের অঞ্চলের মানুষদের সুস্থ করি, তারপর অন্য কিছু ভাবব। তবে আমার বাবা কিন্তু এমন নয় জানেন। বাবা চেয়েছিল আমি নির্ভয়পুরে অন্তত সপ্তাহে একদিনও যেন চেম্বার করি। আর এ ব্যাপারে মা তেমন কিছু বলেনি। শুধু বলেছিল, যেটা ভালো বোঝো করো। তবে হ্যাঁ এখানে আসা নিয়ে নিশ্চয়ই বকুনি খাব। কারণ আপনি তাদের বাড়ির হবু বউমাকে ভাগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তাই আপনার থেকে শতহস্ত দূরে থাকারই নির্দেশ আছে।”
শৌনক বলল, “তো নির্দেশ অমান্যের কারণটা কী?”
নুপুর হেসে বলল, “আপনি এত প্রশ্ন করেন কেন বলুন তো? প্রশ্ন কিন্তু আমারও আছে।”
শৌনক বইটা পাশে সরিয়ে রেখে বলল, “আপনার সব প্রশ্নের উত্তর দিতে প্রস্তুত। বলুন কী জানতে চান?”
নূপুর বলল, “ওষুধ খাচ্ছেন না কেন?”
শৌনক সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি জানি না কোনটা কখন খেতে হবে। আমি ডক্টর নই, পেশেন্ট। দায়িত্বশীল ডক্টরের উচিত ছিল যাবার আগে এগুলো বুঝিয়ে দেওয়া। তা না করে দায়িত্বশীল ডক্টর কিচেন থেকেই সেদিন বাড়ি পালিয়েছিল।”
নূপুরের ঠোঁটে লজ্জা জড়ানো হাসির রেখা। বলল, “বাহ রে, রোগী যদি ডাক্তারকে তাড়ানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে, তা হলে সে বেচারি কী করে?”
শৌনক বলল, “একজন দায়িত্বশীল ডাক্তারের উচিত রোগীর বাহ্যিকটুকু না দেখে তার মনকে চেনা।”
নূপুর টেবিল থেকে ওষুধ আর জল নিয়ে এসে বলল, “প্রলয় ঠিকই বলে, আপনি বড়ো জেদি। নিন, রাতের ওষুধ দুটো খান। সকালে খালি পেটে এটা খাবেন, আমি মেসেজ করে জানতে চাইব কিন্তু খেয়েছেন কি না। আমার অভিজ্ঞতা কম ঠিকই, কিন্তু আমি বেশ কড়া ডাক্তার, ভুলে যাবেন না।”
শৌনক ওষুধ দুটো খেয়ে বলল, “অন্যায় আবদার করছি তাই না? অবাস্তব কল্পনা তাই না? বন্ধুত্বের দাবি করা আমার মতো নগণ্য মানুষের বোধহয় সাজে না।”
নূপুর বলল, “এত ভাবার কি খুব দরকার? জীবনটাকে এত জটিল করে ফেলছেন কেন? একাকিত্ব যাপনেও কিন্তু একঘেয়েমি আসে, জানেন তো? বন্ধুত্বের দাবিতেই তো আসছি বারবার। আপনার চাওয়ার ভরসায় তো আমি থেমে থাকিনি। আর আপনি নগণ্য কি না সেটা না হয় আপনার আশেপাশের মানুষদের বিচার করতে দিন। শুধু একটাই অনুরোধ করব, এভাবে নিজের আষ্টেপৃষ্ঠে ভেদ করা যাবে না এমন বর্মটা পরার দরকার নেই। নিজেও হাঁসফাঁস করবেন, আর বাকিদেরও দূরে ঠেলে দেবে ওই কঠিন দেখতে বৰ্মটা। সবাই তো আর নূপুর মল্লিক নয় যে, জেদ করে ওই বর্মটাকে কেটে ফালা ফালা করে ভিতরের নরম মনটার কাছে পৌঁছতে পারবে? তাই বলছি, ওটা খুলে রাখুন। প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিন, মন খুলে বাঁচুন। সব ব্যাপারে এত হেজিটেশন কীসের? অতসী মল্লিক যখন আপনাকে একতরফা অপমান করছিল তখন কেন বললেন না, অস্মিতাই আপনাকে প্রপোজ করেছিল, আপনি লেস ইন্টারেস্টেড ওর ব্যাপারে। কীসের এত সংকোচ আপনার? আপনি যেখানে কোনও অন্যায় করেননি, সেখানে চোখে চোখ রেখে কথা বলুন। এই দুর্ভেদ্য আবরণে নিজেকে ঢেকে রাখবেন না প্লিজ।”
শৌনক বলল, “সবাই তো নূপুর মল্লিক নয় যে, তাকে এ আবরণ খোলার অধিকার দেব।”
নূপুর লাজুক হেসে বলল, “বেশ, কিছু অধিকার তবে একান্ত আমারই থাকুক।”
ওদের কথার মাঝেই প্রলয় এসে বলল, “শৌনকদা অস্মিতাদি এসেছেন। একবার দেখা করতে চান। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন।”
অস্মিতার নামটা শুনেই নূপুরের মুখটা কঠিন হয়ে গেল। কোমল শিরা-উপশিরা যেগুলোর দিকে এতক্ষণ অপলক তাকিয়েছিল শৌনক, সেগুলো যেন আচমকা নিজেদের প্রয়োজনের থেকে বেশিই কঠিন করে নিল।
নূপুর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি আজ আসি। আপনারা কথা বলুন।” শৌনক নূপুরের হাতটা ধরে বলল, “প্লিজ বসুন। আমি চাই না অস্মিতার সঙ্গে একলা কথা বলতে।”
নূপুর আবার বসে প্রলয়কে বলল, “নিয়ে এসো।”
অস্মিতা ধীর পায়ে ঢুকল ঘরে। নুপুরকে ভিতরে দেখবে এটা যে কল্পনা করেনি সেটা অস্মিতার বিস্মিত চোখের চাউনি বলে দিচ্ছে।
অস্মিতা ঢুকেই বলল, “নূপুর তুই এখানে?
নূপুর হেসে বলল, “ভুলে অযেয়ো না আমি সিএকজন ডক্টর। আপাতত নির্ভয়পুর হসপিটালে চাকরি করছি। সেই হসপিটালেরই আর-একজন ডক্টর অসুস্থ থাকলে যে বেসিক কর্তব্যটুকু পালন করা উচিত সেটাই করছি।”
অস্মিতা অস্বস্তি মেশানো গলায় বলল, “শৌনক আমি আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।”
শৌনক নির্লিপ্ত গলায় বলল, “বলুন কী বলতে চান?”
অস্মিতা নুপুরের দিকে তাকাতেই নূপুর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি এখন আসছি। আপনি মেডিসিনগুলো খাবেন মনে করে।”
শৌনক বলল, “আর-একটু বসুন প্লিজ, কথা আছে। তাছাড়া অস্মিতার সঙ্গে আমার এমন কোনও পার্সোনাল কথা নেই যেটা ও আপনার সামনে
বলতে পারবে না।”
অস্মিতা একটু থেমে বলল, “আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি। প্লিজ আমায় ক্ষমা করে দেবেন, আপনার এই অ্যাক্সিডেন্টের জন্য আমিই দায়ী। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি এসব চাইনি। বাবা বোধহয় আমার মুখ দেখে কিছু আঁচ করেছিল। তাই কথায় কথায় বলে ফেলেছিলাম, আপনি আমায় ডেলিবারেটলি অপমান করেছেন। বাবা যে রেগে গিয়ে এমন একটা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলবে সেটা আমি ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি। আমি যেন নিজের কাছেই বড়ো ছোটো হয়ে গেছি।”
শৌনক বলল, “আচ্ছা ম্যাডাম, সত্যিই কি আমি আপনাকে অপমান করেছিলাম?”
অস্মিতা মাথা নিচু করে বলল, “না করেননি। আমি সেটা নুপুরকেও বলেছি। আসলে ছোটো থেকে যা চেয়েছি পেতে পেতে পাওয়াটাই অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। না শুনতে অনভ্যস্ত আমার কান তাই আপনার অসম্মতিটাকেই অপমান বলে ধরে নিয়েছিল। আমি খুবই দুঃখিত। আপনি আমাদের সকলের সুস্থতার দায়িত্ব নিয়েছেন আর আমরা কিনা আপনাকেই…. আসলে সব অপরাধের বোধহয় ক্ষমা হয় না।”
শৌনক হেসে বলল, “কে বলল হয় না? আমাকে একজন বলেছেন একাকিত্ব যাপন থেকে বেরিয়ে আসতে। জীবনটাকে জটিল না করতে। তার কথাকে মান্যতা দিয়েই আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিলাম। তবে হ্যাঁ, আপনার উডবি মিস্টার সাহেব মুল্লিদ বক্তিত্ব একী স্বাসত বেশ রেগে আছে। তাকে সামলানোর দায়িত্বটা আপনার। ওকে বুঝিয়ে বলবেন, আমি তার প্রেমিকার দিকে কোনও প্রলোভনের দৃষ্টিতে তাকাইনি। কারণ আমি যে কোনও সম্পর্ককে সম্মান করি।”
শৌনকের কথা শেষ হতেই অস্মিতা বলল, “সাহেবের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। সব ভুল বোঝাবুঝির অবসান হয়েছে। আসলে ভুলটা আমার, সাহেব বরাবরই পজেসিভ, লয়্যাল।”
নূপুর অস্মিতার হাতটা ধরে বলল, “ভুলে যাও অস্মিতাদি মাঝের এই ভাঙাগড়াটা। আবার পুরোনো সুরেই বাজাও তানপুরাটা। দেখো দাদাভাই সেই পুরোনো তোমাকেই চায়।”
অস্মিতা বলল, “আমি কাল কলকাতা যাচ্ছি। কাকুকেও দেখে আসব, আর সাহেবের সঙ্গেও দেখা হবে। ওর ফিরতে এখনও চারদিন লাগবে বলল।”
নূপুর মুচকি হেসে বলল, “সেই ভালো, তুমিই ঘুরে এসো।”
অস্মিতা বলল, “আমি আসছি শৌনকদা। সুস্থ হয়ে উঠুন তাড়াতাড়ি।” অস্মিতা বেরিয়ে গেল। শৌনক আর নূপুর দুজনেই চুপ। কে আগে কী কথা বলবে বুঝতে পারছে না হয়তো। অথবা কিছু কিছু সময় চুপকথারাই দায়িত্ব নেয় অনুভূতি আদান-প্রদানের। নূপুরের চোখ ফোনের স্ক্রিনে থাকলেও ও বেশ বুঝতে পারছে, দুটো চোখের দৃষ্টি ওর ওপরেই স্থির হয়ে আছে। কেউই নিস্তব্ধতা ভাঙতে চাইছে না যেন। শৌনক নিউরোলজিস্ট নয় ঠিকই, কিন্তু এই মুহূর্তে একজনের অবয়বের প্রতিটি শিরা-উপশিরার গোপন কার্যকলাপ ওর সামনে দৃশ্যমান। দুই গালের শিরাতে অহেতুক লোহিত রক্তকণিকারা দামালপনা শুরু করেছে। সেই কারণেই গালদুটো হালকা লালচে হয়েছে। কপালের বিজবিজে ঘামের উপস্থিতি বুঝিয়ে দিচ্ছে, উষ্ণতা ছুঁয়ে রয়েছে তাকে। শৌনকের মনে হচ্ছে, তার এই ছোট্ট সরকারি কোয়ার্টারে আচমকাই যেন বসন্তের প্রবেশ ঘটেছে। পড়ন্ত বিকেলে রঙ্গিত নদীর স্বচ্ছ জলে যখন বাড়িমুখো সূর্য নিজেকে একবার দেখে নিতে চায়, তখন জলের মধ্যে যে আলপনা তৈরি হয়, সেটাই এখন দেখা যাচ্ছে নূপুরের মুখে। সুখ, আনন্দ, অভিমান, কষ্টের এক অদ্ভুত মিশেল। আবিষ্ট হয়ে সেদিকেই তাকিয়েছিল শৌনক
নুপুর হেসে বলল, “আপনাদের বুঝি একটি সিলেছে দায়িত্ববান ডক্টররা লজ্জা পায় না? মানে কোনও পরিস্থিতিতেই তারা লজ্জিত হয় না।”
শৌনক মুচকি হেসে বলল, “না তো, এমন কথা তো শুনিনি কখনও। বরং জানি অতি বড়ো স্মার্ট মানুষও বিশেষ একজনের সামনে এলে তার স্মার্টনেস হারিয়ে লজ্জা পেতে শুরু করে। কিন্তু সেই বিশেষ মানুষ তো সবার থাকে না। এই যেমন আপনার লজ্জার কোনও কারণ দেখি না।”
নুপুর বলল, “বড়ো বোদ্ধা আপনি। আমি আজ চলি। ভালো ছেলে হয়ে থাকবেন। প্রলয় আমায় খবর দেবে।”
শৌনক বলল, “সেটা তো নির্ভর করছে শিক্ষিকার ওপরে। সে যদি তার দায়িত্ব পালন করে, তা হলে ছাত্রও মনোযোগী হবে বই-কি।”
নুপুর এক চিলতে হাসি ছড়িয়ে চলে গেল। শৌনকের ছোটো ঘরটাকে মুহূর্তে রামধনু তার রঙে রাঙিয়ে দিল যেন। বদ্ধ জানালার সামনে ঠক ঠক আওয়াজ শুনতে পেল শৌনক। জানালা খুলতেই এক মুঠো বসন্ত বাতাস এসে ঝাপটা দিল ওর মুখে। কিছু কিছু অনুভূতি বড়োই মূল্যবান। না ভাগ করতে ইচ্ছে করে, না খরচ করতে। কৃপণের মতো অঁকড়ে ধরে রাখতে ইচ্ছে করছে শৌনকের আজকের হঠাৎ পাওয়া সন্ধেটাকে। এতদিন শৌনক ভাবত, ওকে বোধহয় নিবেদিতা বসু ছাড়া আর কেউই বোঝে না এ দুনিয়ায়। কিন্তু কেন জানে না আজ মনে হচ্ছে, আর-একজনও বোঝে। নূপুরের উপস্থিতি কেন ওকে এতটা আনন্দ দিচ্ছে, ও নিজেও জানে না। এই নতুন পাওয়া অনুভূতির কারণটাও ওর অজানা। ডাক্তারি বিদ্যার অ্যাড্রিনালিন হরমোন ক্ষরণ হচ্ছে সেটা ও বেশ বুঝতে পারছে। তাই তো নুপুর মল্লিকের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার সাহস পাচ্ছে। ধুর, এত ভাবছে কেন? নুপুর তো বলল, জীবনটাকে যেন জটিল না করে ফেলে। এই হঠাৎ আসা মুহূর্তটুকুকেই উপভোগ করতে চায় শৌনক। ইশ, অস্মিতাকে একটা থ্যাঙ্কস জানানো উচিত ছিল। ওর জন্যই এই অ্যাক্সিডেন্ট হল, তাই তো এমন দায়িত্ববান ডাক্তারের সেবা পেল শৌনক।
ভাবনার মধ্যেই ডুবে ছিল শৌনক। হঠাৎই প্রলয় এসে বলল, “শৌনকদা সমাদ্দারের ড্রাইভার ওই জিতেন্দ্র এসেছে তার বাচ্চাকে নিয়ে। বলছে বাচ্চাটা নাকি সন্ধে থেকে বমি করতে করতে ঝিমিয়ে পড়েছে। হসপিটালে গিয়েছিল, এমার্জেন্সিতে কোনও ডক্টর নেই। নার্স বলেছে আপনি সিক লিভে আছেন, তাই বাড়ি চলে এসেছে। ভাগিয়ে দেব শৌনকলা? জিতেন্দ্রই সেদিন তোমায় ইচ্ছে করে ধাক্কা মেরেছিল। সেই কারণেই তোমার পায়ের এই অবস্থা হয়েছে। এখন এসেছে কাঁদতে, ছেলে বাঁচবে না বলে।”
শৌনক বলল, “বাইরে চেম্বারে বসাও, দেখছি।”
প্রলয় একটু বিরক্তি প্রকাশ করেই বলল, “আরে জিতেন্দ্র, যে তোমায় ধাক্কা মেরেছিল, সে এসেছে।”
শৌনক ঘাড় নেড়ে বলল, “বুঝেছি। বাচ্চাটার দোষ কী?”
শৌনক বাইরে বেরোতেই জিতেন্দ্র এসে সোজা ওর পা দুটো জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করল। কাঁদতে কাঁদতেই বলল, “আপনি আমাদের ভগবান ডাক্তারবাবু। আমাদের কতবার জীবন দিয়েছেন, আর আমি আপনার জীবন নিতে গিয়েছিলাম। কী করব ডাক্তারবাবু, আমি নিরঞ্জন সমাদ্দারের গাড়ি চালাই। ওই মাইনেতেই সংসার চালাই। তবুও আমি বাবুর পায়ে ধরেছিলাম, বলেছিলাম, এই পাপ কাজ আমি করতে পারব না।’ বাবু বলল, ‘তা হলে ঘরে ফিরে বাচ্চাটাকে দেখতেই পাবি না।’ একবার ভাবলাম পুলিশবাবুর কাছে যাই, তারপরেই মনে পড়ল, ক্লাবের পার্টিতে পুলিশগুলো এসে বাবুর সঙ্গেই মদের গ্লাসে চুমুক দেয়। সে কেন শুনবে আমার মতো মুখ্যু মানুষের কথা? বাবু আমার নির্দেশ দিয়েছিল, ‘এমন মারবি যেন মাথাটা ফেটে যায়।’ আমি সেটা করতে পারিনি। মনে পড়ে যাচ্ছিল বউয়ের যখন ধুম জ্বর, তখন মাঝরাতে আপনি ওষুধ দিয়েছিলেন। বউ চোখ মেলে তাকিয়েছিল। এই দেখুন, প্রভুর কী ইচ্ছে দেখুন, আজ ছেলেটার শরীর খারাপ, সেই আপনার দুয়ারেই আসতে হল। এখন আপনি যদি ফিরিয়ে দেন, তা হলে ছেলেটা আমার বাঁচবে না।”
শৌনক বলল, “বমি কখন থেকে করছে? কোথাও পড়ে যায়নি তো?” জিতেন্দ্র বলল, “না ডাক্তারবাবু, পড়ে যায়নি। তবে ইস্কুলে গিয়ে আচার খেয়েছিল বলছে ওর মা।”
শৌনক প্রেসক্রিপশন লিখে বলল, “ওষুধগুলো এখুনি খাইয়ে দেবে। আর ORS (ওআরএস) খাওয়াবে। ঠিক হয়ে যাবে, চিন্তা নেই।
জিতেন্দ্র আবারও প্রণাম করে ছেলেকে নিয়ে চলে গেল।
শৌনক ঘরে ঢুকতে যাবে সেই সময়েই দেখল, প্রলয়ের ফোনটা ভাইব্রেট করছে। স্ক্রিনে নাম উঠছে নূপুরদিদি। শৌনক ইচ্ছে করেই দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে গেল। খুব ইচ্ছে করছিল, আড়াল থেকে ওদের দুজনের কথোপকথন শুনতে। ওদের দুজনের কথার মধ্যে নিজের নামটা নিশ্চয়ই একবার শুনতে পাবে। প্রলয় দেখল সাতকাহন করে জিতেন্দ্রর আসা, ওর ছেলের ট্রিটমেন্ট করার গল্প করছে। তারপর বলল, “হ্যাঁ, এই তো শৌনকদাকে খেতে দিয়ে আমি আমি খাব। না না গরম করেই দেব। হ্যাঁ হ্যাঁ, খাবার পরের ওষুধও দেব। খেতে না চাইলে আপনাকে ফোন করব।”
শৌনক নিজের মনেই হাসতে হাসতে বিছানায় গিয়ে বসল। ওকে ফোন করতে লজ্জা করছে বলে প্রলয়কে নির্দেশ দিচ্ছেন ম্যাডাম।