ইতি নির্ভয়পুর – ২
২
“কী গো, একটা ফোন করতে তো পারতে ছেলেটাকে আজ? না হয় রিস্ক নিয়েই করতে। হয় রিসিভ করত, নয় করত না।”
শোভন চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে বলল, “প্রতিবারই তো রিস্ক নিয়েই ফোন করি। যেন মনে হয় কোনও ক্রিটিক্যাল পেশেন্টের অপারেশন করতে ওটিতে ঢুকছি। নিজের সন্তানকে ফোন করার জন্য এত ভাবতে হবে কেন বলবে নিবেদিতা? তাছাড়া তুমিও তো তার মা, তুমি তার জন্মদিনে শুভকামনা জানাতে ফোন করো। আমাকে এগিয়ে দিচ্ছ কেন? কারণ, তুমি আজও সত্যিটা মেনে নিতে পারবে না বলে। তুমি জানো তোমার গুণধর গোঁয়ার পুত্রটি ফোন রিসিভ করলেও ঠিক কী বলবে। সেই অপমানটা হজম করার ক্ষমতা তোমার নেই বলেই পায়েস রান্না করলেও ছেলেকে ফোন করতে সাহসে কুলাচ্ছে না।”
নিবেদিতা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “দোষটা তোমার শোভন আমি ওকে ডাক্তারি পড়াতেই বারণ করেছিলাম। না, আমরা দুজনে ডাক্তার, আমাদের ছেলেও ডাক্তারি পড়বে এসব ফালতু জেদ তুমি ধরেছিলে কি না?”
শোভন আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “ওই দেখো নিবেদিতা, আজও সূর্য উঠেছে আগে আগেই। এটাও আমার দোষ তাই না? আজ অবধি যা যা আমাদের জীবনে ঘটেছে তার একটারও দোষ কি আদৌ তোমার ছিল? সবই তো আমার। আমি তো মেনে নিয়েছি সে কথা। কিন্তু ডাক্তার না হয়ে ইঞ্জিনিয়ার বা প্রফেসর হলেও যে তোমার ছেলে নির্ভয়পুরের মানুষদের শিক্ষিত বানাতে বা ওখানের পাহাড়ি নদীর ওপরে বাঁধ দিতে ছুটত না, তার গ্যারান্টি কে দেবে নিবেদিতা?”
নিবেদিতা ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ে বলল, “হ্যাঁ গো, কতদিন ছেলেটাকে দেখিনি। শানুরও কি আমায় দেখতে ইচ্ছে করে না? যেদিন প্রথম হস্টেলে গিয়েছিল, সেদিন তো কী কান্না। পরেরদিনই আমাদের সব ফেলে ছুটতে হয়েছিল হস্টেলে। ছেলে নাকি কিছুই খায়নি। আমি যেতে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, ‘মা আমি বাড়ি ফিরে যাব। তোমায় ছেড়ে কিছুতেই থাকতে পারব না।’ সেই ছেলে কী করে এত কঠিন হয়ে গেল সেটাই তো টের পেলাম না।”
শোভন বলল, “তুমি ভুল করছ নিবেদিতা। তারপর আমরা বলেছিলাম, ক’দিন থাক তা হলেই মন বসে যাবে। তখন আমাদের দিকে কঠিন শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল শানু। ঠান্ডা গলায় বলেছিল, ‘হ্যাঁ পারব।’ তারপর প্রায় মাসখানেক ফোনে ঠিক করে কথাও বলত না। সেদিনই বুঝেছিলাম, ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু করলে ও কঠিন হয়ে যায়।”
নিবেদিতা বলল, “কতটা কঠিন হয় শোভন? যে মা-বাবার পরিচয়টুকু অবধি মুছে দিতে চায়! তুমি জানো রণিতার বছরখানেক আগেই বিয়ে হল। মেয়েটা তো এমনিতে বেশ ভালো ছিল। ওদের সম্পর্কও প্রায় বছর চারেকের। যদিও শানু বলত বন্ধুত্ব। মেয়েটা আমাকে খুবই সম্মান করত। তাকেও গিয়ে বলেছে, আমি আজীবন নির্ভয়পুরে থাকব। থাকতে পারবি আমার সঙ্গে? কোনওদিন কলকাতা ফিরব না। রণিতা কান্নাকাটি অবধি করেছিল। তুমিই বলো, ও কেরিয়ারটা শুরুই করল না, ওই নির্ভয়পুরে গিয়ে শেষ করে দেবে এখুনি? রণিতা রাজি হয়নি বলে এক কথায় নাকি ওর সঙ্গে ব্রেকআপ করেছে শানু। আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল যখন, তখনই কফি খেতে খেতে সবটা বলল। সব গল্পই করেছে দেখলাম। মানে তুমি যেগুলো বলতে বারণ করেছিলে সেগুলোও। রণিতা আমাদের দোষারোপ করল। ওই ছেলে আমার সম্মান বলে কিছু রাখল না। একটা হাঁটুর বয়েসি মেয়ে আমার কাজের ভুলত্রুটি ধরে অপমান করল! অবশ্য শানু আমায় বলেছিল, ওর নাকি রণিতা সম্পর্কে কোনো ফিলিংস নেই। তখন আমিই ওকে বলেছিলাম তাহলে এই সম্পর্ক টানিস না। তারপর তো ব্রেকআপ হয়েই গিয়েছিল। কবে আবার নির্ভয়পুরের গল্প ওকে করলে কে জানে! এদের কোনটা যে প্রেম আর কোনটা যে বন্ধুত্ব সেটা বোঝাই দায়।”
শোভন বার দুয়েক ফোনটা তুলে আবার নামিয়ে রাখল। তারপরেই দ্বন্দ্ব ভরা হাতে প্রেস করল শৌনকের নম্বর।
নিবেদিতা বলল, “স্পিকারে দাও।”
শোভন হেসে বলল, “ডোন্ট ওয়ারি। ফোন রিসিভ করবেই না, অন্তত আজকে।”
শোভনের ভাবনাকে মিথ্যে করে দিয়ে ফোনটা রিসিভ করল শৌনক। কিন্তু এটা কে কথা বলছে? এটা তো শানুর গলা নয়। তবে কি শানু নম্বর বদলে ফেলল? কেন? বাবা-মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন করবে বলেই হয়তো। শোভনের ঠোঁট দুটো তিরতির করে কাঁপছে। গলা দিয়ে স্বর বেরোচ্ছে না। এতটা নিষ্ঠুর কী করে হল শৌনক!
ফোনটা রেখে দেবে ভাবার আগেই ওদিক থেকে ছেলেটি বলে উঠল, “কাকু, আমি প্রলয়। শৌনকদার অ্যাসিস্টেন্ট। শৌনকদা ফোনটা অ্যামার হাতে দিয়ে বলে গেল, আপনারা ফোন করবেন, ফোন বন্ধ থাকলে কাকিমা টেনশন করে প্রেশার বাড়াবে। শৌনকদা এমার্জেন্সিতে বসে আজ। ফোন সুইচ অফ করে দেয়। আজকেই কেবল অফ করেনি।”
শোভনের দু’চোখ ভরে উঠেছে। কোনওমতে চোখের জলকে সম্বরণ করছে। প্রলয়ের কথাতে একটু টান রয়েছে ঠিকই, বাংলা মোটামুটি ভালোই বলে। আসলে নির্ভয়পুরে অনেক বাঙালিরা ব্যবসাসূত্রে স্থায়ী বসবাস করে। তাই বাঙালি কালচারটা ধীরে ধীরে ওদের মধ্যে ঢুকে গেছে।
নিবেদিতা কাঁপা গলায় বলল, “প্রলয়, তোমার শৌনকদা খাওয়া-দাওয়া কোথায় করে?”
প্রলয় খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, “এই তো ফুলমণি রেঁধে দিয়ে যায়। আজকে রেঁধে দিয়ে গেল ডিমের ঝোল আর বেগুনের তরকারি।”
চোখটা বন্ধ করে নিল নিবেদিতা। শৌনক ইচ্ছে করেই আজ ডিম রান্না করিয়েছে।
নিবেদিতা বলল, “প্রলয়, আমাদের নামে আর কিছু বলে?”
প্রলয় বলল, “হ্যাঁ, মাঝে মাঝে বলে। কেউ যদি তোকে করুণা করে প্রলয়, তাদের থেকে দূরে সরে যাবি। আমিও সরে এসেছি দুজন করুণা করা মানুষের থেকে।”
নিবেদিতা ঠান্ডা গলায় বলল, “বেশ বাবা। আজ রাখছি।”
ফোনটা কেটে গেছে প্রায় চোদ্দো মিনিট মতো, কিন্তু দুজনের একজনও এখনও কথা শুরু করে উঠতে পারেনি। দুজনের মুখের সব কথা যেন হারিয়ে গেছে মুহূর্তের জন্য। বাইরের গ্রিলে একটা মা পাখি তার ছোট্ট সন্তানকে মুখে করে কিছু খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। সেদিকেই অপলক তাকিয়ে আছে নিবেদিতা। শৌনককে মানুষ করবে বলেই প্রাইভেট প্র্যাকটিস ছেড়ে দিয়েছিল নিবেদিতা বহু বছর। আবার যখন শৌনক ক্লাস সেভেনের স্টুডেন্ট তখন প্রাইভেট চেম্বারে বসেছিল প্রায় তেরো বছর পরে। তেরোটা বছর শৌনকই ছিল নিবেদিতার একমাত্র লক্ষ্য। খাওয়া নিয়ে খুব জ্বালাত শানু। কিছুতেই লক্ষ্মীর মায়ের কাছে খেত না। নার্সিংহোমে যাবার আগে প্রায় প্রতিদিনই শানুকে গল্প বলে খাইয়ে তবে বেরোতে পারত। মা বাইরের ড্রেস পরেছে দেখলেই ছেলে আরও জেদ ধরত, ‘মায়ের কাছেই খাব।’ এভাবেই মাকে আরও কিছুক্ষণ বাড়িতে রাখার ফন্দি বের করত সেই ছোটো থেকেই।
শোভন অবসন্ন গলায় বলল, “আশা করি, কেন ফোন করছিলাম না সেটা আর নতুন করে বুঝিয়ে বলার দরকার নেই তোমায়। আচ্ছা নিবেদিতা, শৌনক ছাড়া কি আমাদের জীবনে আর কিছুই নেই? তোমাকে আমি চিনি সেই মেডিকেল কলেজ থেকে। কত কত কথা বলতাম আমরা একটু সুযোগ পেলেই। তারপর এত বছরের বিবাহিত জীবনে কিছুই কি সঞ্চয় করিনি? এত এত স্মৃতি রয়েছে যে লিখতে গেলে একটা দীর্ঘ উপন্যাসের আকার নেবে। আমরা কেন সে সব স্মৃতির পাতার ধুলো কোনওদিন ঝেড়ে দেখি না নিবেদিতা? আমাদের এই দীর্ঘ ডাক্তারি জীবনে কত কত পেশেন্টের কেন হিস্ট্রি আছে, কই আমরা তো সে সব কথাও কখনও বলি না? বিয়ের পরে আমার এক রাঙা বউদি তোমার খুব লেগপুলিং করেছিল বলে তুমি তো বাসর ঘরে একটাও কথা বলোনি আমার সঙ্গে। তোমার মনে আছে নিবেদিতা?”
নিবেদিতা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মা পাখির দিকে। ছোটো ঠোঁটে করে কী আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে ছানাটাকে খাওয়াতে! আচ্ছা এই মা পাখিটা কি আদৌ কোনও প্রত্যাশা করছে ওই ছোট্ট ছানার কাছে? আদৌ কি ভাবছে এই ছানা বড়ো হয়ে তাকেও এভাবে খাবার এনে ঠোঁটে করে খাইয়ে দেবে যখন তার ডানার জোর কমবে? যখন তার দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হবে তখন কি এই ছানা তার মাকে বাসায় পৌঁছে দিতে সাহায্য করবে? নাকি উড়তে শিখলেই নিজের জগৎ তৈরি করে নেবে? যে জগতে এই মায়ের কোনও স্থান থাকবে না। এই যে বড়ো করে তোলার চেষ্টাকে কি করণা ভাববে তখন? নাকি মাকে স্বার্থপর ভাববে তাকে আগলে রাখার কারণে।
শোভন বলল, “আমি তো এখনও বদ্ধ উন্মাদ হইনি নিবেদিতা যে, দেওয়ালের সঙ্গে কথোপকথন, স্মৃতি রোমন্থন, গল্প-গুজব চালিয়ে যাব। আরে আমিও একটা মানুষ। এতক্ষণ তোমার সঙ্গে গল্প করছি, আর তুমি অন্য এক ভাবনার জগতে পড়ে আছ।”
নিবেদিতা বলল, “তুমি জানো, আজ শানু কেন ওর লাঞ্চের মেনুতে ডিম রেখেছে?”
শোভন হতাশ গলায় বলল, “তুমি ভুলে যাচ্ছ, আমি ওর বাবা। তুমি যতগুলো বছর ওকে মানুষ করেছ ততগুলো বছর সমানভাবে আমিও ছিলাম। শানু প্রায় বলত, “বাবা, ক্যান ইউ ইমাজিন, একজন ডক্টর কতটা কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়?” আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলতাম, ‘এটা তোর ভুল ধারণা। ডক্টর নিবেদিতা বসু কোনও সংস্কারের ধার ধারে না। শুধু মা নিবেদিতা বসু তার সন্তানের জন্য ভীত থাকে সর্বদা। আর তার ওই নরম ভীত মনে যত রাজ্যের কুসংস্কার এসে বাসা বাঁধে।’ শানু ফাজিল হেসে বলত, ‘আর স্ত্রী নিবেদিতা বসু কি সংস্কার মুক্ত বাবা?’ আমি বলতাম, ‘বাবার সঙ্গে ফাজলামি হচ্ছে?’ শানু বলত, উঁহু, ইউ আর মাই বেস্ট ফ্রেন্ড। যাদের মধ্যে কোনও পর্দা নেই। সব কথা শেয়ার করা যায়।’ বলত, ‘জানো বাবা, আমার এক্সামের দিন, জন্মদিনের দিন কিছুতেই মা ডিম দেবে না। ওদিকে আমরা হস্টেলে এক্সামের দিনেও ডাবল ডিম খেয়ে যাই।’ আমি বলেছিলাম, ‘জন্মদিনটা মানিস অন্তত। যেহেতু তোর মা তোকে বিশ্বাস করে, তাই তার বিশ্বাসটুকু ভেঙে দিস না।’ শানু হেসে বলেছিল, ‘এই যে লয়্যাল প্রেমিক কাম হাজব্যান্ড, জন্মদিনে আজ অবধি মা আমায় বাইরে থাকতে দিয়েছে কখনও যে অন্য কিছু করব? প্রতিবারের খাবারের থালা তো মা সাজিয়ে দেয়। আচ্ছা বাবা, এই ধেড়ে ছেলের জন্মদিন করাটা কেমন একটা দৃষ্টিকটু নয়? মাদার ইন্ডিয়াকে বলতে গেলে তো সেন্টিমেন্টাল হয়ে কেঁদেই ফেলবে। তুমি একটু বুঝিয়ে বলো না প্লিজ।’ আমি বলতাম, ‘তুই আমাকে এতটা ভরসা করিস দেখে খুশি হলাম। কিন্তু এ কথা তোর মায়ের সামনে বলার ক্ষমতা ঈশ্বর এখনও আমায় দিয়ে উঠতে পারেননি রে। ডিম খাওয়ার কথা ছাড়, তুই যে ডিম ফুটে বেরিয়েছিস, ধেড়ে হয়েছিস, এটাই তো বলা যাবে না।’ শানু আমার পিঠে চাপড় মেরে বলত, ‘মাই বেস্ট পাপা। শুধু একটু ভীতু।’
তোমার আড়ালে আমাদের এমন কথা হত তার ইয়ত্তা নেই জানো নিবেদিতা। বিশেষ করে ওকে যখন সুইমিং ক্লাসে নিয়ে যেতাম। আসলে একটা বয়সের পরে বাবা আর ছেলে বোধহয় বন্ধু হয়ে যায়। তোমার মনে আছে, যেদিন আমি পার্টিতে যাব বলে আমার পছন্দের স্যুটটা খুঁজে না পেয়ে চেঁচামেচি করছিলাম, সেদিন গায়ে পারফিউম লাগাতে লাগাতে শানু বাইরে এসে বলল, ‘আমি রেডি।’ আমি ওর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলছিলাম, তুই আমার স্যুট কেন পরেছিস?’ ও হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘গায়ে ফিট করে গেছে তাই।’ তারপর নিজের একটা বদখত রঙের স্যুট আমার হাতে ধরিয়ে বলল, ‘আজ তুমি মেডিকেল স্টুডেন্ট শৌনক সাজো।’ সেদিনই বুঝেছিলাম, আমার সব কিছুর ওপরে ওর অধিকার আছে এটা ও বোঝাতে চেয়েছে।”
নিবেদিতা শান্ত স্থির গলায় বলল, “তুমি একদিন বন্ধুদের সঙ্গে ক্লাব পার্টিতে যাবে বলে ওর একটা ইয়েলো টি-শার্ট পরে বেরোচ্ছিলে। শানু তোমায় দেখে বলল, ‘কী ব্যাপার, ডেট করছ নাকি কারওর সঙ্গে? হঠাৎ এত ইয়ং হবার শখ? সে করতেই পারো, তবে নিবেদিতা বসু ঘাড় থেকে নামবে বলে মনে হয় না।’ আমি একটা ডায়েরিতে কিছু লিখছিলাম, পেনটা ছুড়েছিলাম ওর দিকে। ও প্রতিবারের মতো দুর্দান্ত কায়দায় ক্যাচ করে নিয়ে বলেছিল, ‘আরে রাগছ কেন, হতেই তো পারে বাবা কাউকে ডেট করছে।’ আমি বলেছিলাম, ‘পাকামি বন্ধ কর।’ শানু আমার গলা জড়িয়ে ধরে বলেছিল, ‘আচ্ছা মা ফ্র্যাংকলি স্পিকিং, তুমি বাবাকে বেশি ভালোবাসো না আমায়?’ তুমি আমার দিকে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে বলেছিলে, ‘হ্যাঁ দিতা আজ বলেই দাও। আমিও চক্ষু-কর্ণের বিবাদ মিটিয়ে বেরোই। অরিন্দম কল করছে, তাড়াতাড়ি বলো দিতা।’ শানুর মুখে দুষ্টু হাসি। বলেছিল, ‘আমি কিছু মাইন্ড করব না, বলে দাও।”
শোভন কথাটা নিবেদিতাকে শেষ না করতে দিয়ে বলল, “তুমি বলেছিলে, তুই আসার আগে অবধি তোর বাবাকে বাসতাম। তুই আসার পরে একটু হলেও তোকে বেশি বাসি।’ শানু তোমার সামনে নিজের কলার তুলে এক পাক ঘুরে বলেছিল, ‘এই যে ডক্টর বসু, এবারে আপনি আপনার ওই বোরিং ক্লাব মিটিং-এ যেতেই পারেন।’ আমি ওর ওই আনন্দে ভরা মুখটার দিকে তাকিয়ে বলেছিলাম, ‘তোর মা যখন বলেই দিল আজ, তখন তোরা মা-বেটাতেই থাক। আমি চললুম।’”
নিবেদিতা বলল, “শোভন, একটা পারফেক্ট ফ্যামিলি ছিল আমাদের। কোথাও কোনও ছিদ্র ছিল না যেখান দিয়ে বিষাক্ত কিছু ঢুকতে পারে, তাই না? দেখো শোভন আমাদের এত বছরের সব স্মৃতি থাকতেও আমরা ঘুরে-ফিরে শানুকে নিয়েই আলোচনা করে ফেলি।”
শোভন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “এটার জন্য তুমি দায়ী। ওই যে তোমার শানু প্রলয়কে বলে গিয়েছিল যে, আমরা ফোন করবই, এটা হল তার বিশ্বাস। আজ যদি একটা ফোনও না যেত তার ফোনে, তা হলে শানুর বিশ্বাসভঙ্গ হত। আমি এটাই চাই দিতা। সম্পর্ক, ভালোবাসা, এফোর্ট এসব জোর করে আদায় করার জিনিস নয়। আমরা কেমন ভিখারি হয়ে যাচ্ছি ক্রমশ নিজেদের চোখেই। ও যদি আমাদের ছেড়ে ভালো থাকতে পারে, তা হলে আমরা কেন নয় বলবে? টান তো দু’তরফেই থাকা উচিত তাই না? নিজের ছেলে একটা বাইরের লোকের কাছে বলে যাচ্ছে, ফোনটা রিসিভ করো। এটা অপমান নয়? নিশ্চয়ই এমার্জেন্সি সারাদিন চলে না। আমি নিশ্চিত ও কল ব্যাক করবে না। বরং প্রলয়ের কাছ থেকে শুনে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে জাস্ট এনজয় করবে আমাদের যন্ত্রণাটা। না নিবেদিতা, আমি ওর বাবা। ও স্বীকার করুক আর না-ই করুক। বারবার আমি ওর কাছে এভাবে হারতে পারব না। ভবিষ্যতে আর কোনওদিন আমায় কল করতে বলবে না ওই নম্বরে। যদি একান্ত আত্মসম্মান না থাকে তোমার তা হলে তুমি কোরো। প্লিজ আমায় শিখণ্ডি বানিও না।” শোভন এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে ঘরে ঢুকে গেল।
নিবেদিতা তখনও অলসভাবে বাড়ির বাইরের দিকে উদ্দেশ্যহীনভাবে তাকিয়ে এলোমেলো ভাবছিল। হঠাৎই মাথায় এল শৌনকের জন্মদিন বলে পায়েস বানিয়েছিল। সেটা তো আর ওরা খাবে না। কাদের দেওয়া যায়? গাড়ির ড্রাইভার বিমলকে ডেকে পায়েসের হাঁড়িটা ধরিয়ে দিয়ে বলবে, পথশিশুদের দিয়ে দিতে। ডাক্তার হলেও এসব ব্যাপারে একটু সংস্কারী নিবেদিতা। সন্তানের জন্মদিনের পায়েস কোনওদিনই মা হিসেবে স্পর্শ করে না ও। শৌনকের এক বছরের জন্মদিন থেকেই এটা পালন করে আসছে। গতবছরও শৌনকের জন্মদিনের পায়েস পথশিশুদের মধ্যেই বিলিয়ে দিয়েছিল নিবেদিতা। বিমল এসে বলেছিল, “ম্যাডাম, বাচ্চারা মিষ্টি আর পায়েস পেয়ে বেজায় খুশি।”