ইতি নির্ভয়পুর – ২০
২০
‘কী ব্যাপার সুনীল, তোমার মাঠ এত ফাঁকা কেন? গ্রামের লোকজন কোথায়?”
পামেলা আজ কোনও ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরেনি। পরেছে খাঁটি বাংলাদেশি তাঁত। সঙ্গে ফুলস্লিভ অফ হোয়াইট একটা ব্লাউজ। ওর পার্সোনাল ডিজাইনার মিসেস সঞ্চারী দেবনাথকে ও ক’দিন আগেই ফোন করেছিল। সঞ্চারীই ওকে গাইড করে কোন অনুষ্ঠানে কী ধরনের পোশাক পরলে পামেলাকে পারফেক্ট লাগবে। সঞ্চারীর কথামতোই কালো চওড়া পাড়ের অফ হোয়াইট বাংলাদেশি তাঁতটা বেছে নিয়েছে আজকে। সঞ্চারী বলেছে, “ভোটের প্রচারে যখন বেরোবে তখন একটু ট্রাডিশন্যাল পোশাক পরবে। তা হলে সাধারণ মানুষদের মনে হবে, তুমি ওদেরই একজন।”
সঞ্চারীর কথামতো আজকের পোশাক পরেছে পামেলা। এমনকী, ওর স্ট্রেটনিং করা চুল খোলা না রেখে একটা হাত খোঁপা করে নিয়েছে ঘাড়ের কাছে। যতটা সিম্পল লুক ক্রিয়েট করা যায় আর কি!
ফুটবল মাঠে সামিয়ানা টাঙানো আছে। সামনে তিনটে দামি চেয়ার রাখা। তারই মাঝখানের নীল ভেলভেটের চেয়ারটা দেখিয়ে সুনীল বলল, “তুমি ছায়ায় বোসো।”
টেবিলে চকচকে শিল্ড রাখা। কিন্তু সুনীলের ক্লাবের ছেলেরাও নেই প্লেয়ার হিসেবে। আর দর্শকাসনও বলতে গেলে ফাঁকা। প্রায় দিন পনেরো ধরে দু’বেলা মাইকিং করা হয়েছে। ফুটবল ক্লাবের ছেলেদেরও প্র্যাকটিস করানো হয়েছে। আজ টুর্নামেন্ট। আসলে টুর্নামেন্টকে সামনে রেখে পামেলার নির্বাচনী প্রচারই মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল। সুনীল যা টাকা চেয়েছিল, পামেলা সবটাই দিয়ে দিয়েছিল। তার পরেও মাঠ এমন ফাঁকা কেন? হাতে গোনা কয়েকজন প্লেয়ার দাঁড়িয়ে আছে জার্সি পরে। যারা খেলা দেখতে আসবে, তাদের টিফিনের প্যাকেটও করেছে সুনীল। ফ্রিতে খাবারের গন্ধ আছে, ফুটবলের মতো বিনোদন আছে, তারপরেও নির্ভয়পুরের লোকজন আসেনি?
সুনীল বলেছিল, “রংবুল, ধোলা আর নির্ভয়পুর তিনটি গ্রামের লোক আসবে দেখো পামেলা। আমরা জায়গা দিতে পারব না। আর মাইক থাকবে তোমার হাতে। বাকি খেলাটা তোমায় খেলতে হবে।”
পামেলা স্ক্রিপ্ট লিখে মুখস্থ করে রেখেছে। ঈশ্বর ওকে একটা জিনিসই অফুরন্ত দিয়েছে, ব্রেন। লোকে অবশ্য বলে ব্রেন উইথ বিউটি।
সুনীল হস্তদন্ত হয়ে ঘুরছে। চারজন ভলান্টিয়ারকে জিজ্ঞাসা করছে, “আরে ম্যাচ শুরু হতে তো আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি। বাকি প্লেয়াররা কোথায়? আর দর্শকশূন্য কেন মাঠ? গ্রামের লোকজন কি একসঙ্গে মরেছে নাকি? যা একজন আমার বাইকটা নিয়ে গিয়ে খবর নিয়ে আয়, আর-একজন অ্যানাউন্স করতে শুরু কর। দেরি করিস না। ম্যাডাম কিন্তু এবারে খুব রেগে যাচ্ছে।”
পামেলার মেজাজ চড়ছে। সুনীলকে এতটা বিশ্বাস করা মনে হচ্ছে ভুল হবে। ওর মিটিং-এ আগের দিনও সুনীল লোক জোগাড় করতে পারেনি। অথচ সুজয়ের মিছিল লম্বা হয়েছিল।
ক্রমাগত অ্যানাউন্স করা হচ্ছে, “পামেলা মিত্র এসে উপস্থিত হয়েছেন আমাদের মধ্যে, শুরু হচ্ছে আমাদের আজকের বিশেষ আকর্ষণ ‘পায়ে পায়ে ফুটবল।”
এত অ্যানাউন্স করার পরেও লোকের সংখ্যা বাড়ানো গেল না দেখে সুনীল বলল, “কী হল বলো তো?”
পামেলার ভ্রুর ভাঁজে চূড়ান্ত বিরক্তি দলা পাকিয়ে রয়েছে।
পামেলা বলল, “বাই এনি চান্স, প্রশ্নটা কি তুমি আমায় করছ সুনীল? কী হল সেটা দেখার দায়িত্ব যে আমার ছিল, সেটা কিন্তু আমি জানতাম না।”
সুনীল ভীতু গলায় বলল, “বিলিভ মি পামেলা, আমি আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলাম। কিছুতেই বুঝতে পারছি না, ঠিক কী হল!”
ঠিক সেই সময়েই সুনীলের বাইক নিয়ে যাওয়া ছেলেটি ফিরে এসে বলল, “স্যার আজ আর খেলা হবে না। চার্চের মাঠে বিরাট পিকনিক হচ্ছে। মাংস-ভাত খাওয়া, গান, নাচ সব কিছু। গোটা নির্ভয়পুরের লোকজন ওখানেই ভিড় করেছে। বিশাল প্যান্ডেল বাঁধা হয়েছে রাতারাতি।”
সুনীল বিস্মিত হয়ে বলল, “কীসের পিকনিক? কারা করছে?”
ছেলেটা পামেলার দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে বলল, “সুজয় হাঁসদা।”
পামেলা চমকে উঠে বলল, “সুজয়? ও এত টাকা পেল কোথায়? এর পিছনে কে আছে সুনীল? সুজয় মাস গেলে পনেরো হাজার টাকা মাইনে পায়। নিজের সংসারই চলে টেনেটুনে। তারপর এত লোককে মাংস-ভাত খাওয়াবে কোথা থেকে?”
সুনীল চিত্তিত মুখে বলল, “একদম ঠিক। সুজয়ের এত ক্ষমতাও নেই। পামেলা কেউ পিছন থেকে খেলছে আমাদের সঙ্গে।”
পালো হিসহিস করে বলল, “সেটা কে? খোঁজ নাও কে? আমায় ইচ্ছাকৃত অপমান করবে বলেই আজকের ডেটটা সে চুজ করেছে। সুনীল, আমি এর প্রতিশোধ চাই।”
পামেলার কথা শেষ হবার আগেই দেখল, এক কোণে মুখ নিচু করে কুত্তলী দাঁড়িয়ে আছে।
সুনীল বলল, “পামেলা, মেয়েটা তোমায় কী যেন বলবে বলে এসেছে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছে। একবার ডাকব?”
পামেলা তখনও অপমানে গনগনে হয়ে আছে। তবুও বলল, “হ্যাঁ ভাকো।” কুন্তলী ধীর পায়ে এগিয়ে এসে বলল, “ম্যাডাম, নীহার কোথায়? ও আজ ভোরে কলকাতা যাবে এটা বলেছিল, কিন্তু পৌঁছে কল করবে জানিয়েছিল। এখনও ওর ফোন সুইচড অফ বলছে কেন?”
পামেলা অবজ্ঞার ঢঙে বলল, “তুমি জানো আমি কে? নীহারের দিদি ছাড়াও আমার আর-একটা পরিচয় আছে। যে সে যখন-তখন আমার সামনে এসে প্রশ্ন করে না। তোমার মা যে মিত্র টি-এস্টেটের শ্রমিক, আমি সেটার মালিক। আশা করি, এবারে ক্লিয়ার হয়েছে?”
কুত্তলী ভূমিকা না করেই বলল, “আমার পেটে নীহারের সন্তান। আমি কাল রাতে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম। ডাক্তার ইউরিন টেস্ট দিয়েছিল। আজ জানলাম, আমি মা হতে চলেছি। নীহারের সঙ্গে আমার এই মাসেই বিয়ে হবার কথা ছিল। এটা জানলে ও হয়তো আজকেই আমায় বিয়ে করবে। কিন্তু ওর ফোন অফ বলছে।”
সুনীল চমকে উঠে বলল, “কী বলছ এসব? নির্ভয়পুরের কাকে কাকে বলেছ এসব কথা?”
কুম্ভলী বলল, “কাউকে বলিনি। আমি প্রথমেই নীহারের খোঁজে এসেছি। এ কলঙ্ক থেকে একমাত্র ও-ই আমায় উদ্ধার করতে পারবে।”
পামেলার মুখটা রাগে থমথম করছে। কুত্তলীর পরনে এখনও পামেলার কলকাতার শো-রুমের ডিজাইনার পোশাক। নীহার ইচ্ছে করে এক্সকুসিভ ডিজাইনার পোশাকগুলোই মেয়েটাকে দিয়েছে। দেখেই রাগে গাটা রি রি করে উঠল পামেলার। এখন যদি এই মেয়ে নির্ভয়পুরে রটিয়ে দেয়, তার গর্ভের সন্তান নীহারের, তা হলে তো পামেলাকে নির্ভয়পুর ছাড়তে হবে।
পামেলা শান্ত গলায় বলল, “নীহারের সঙ্গে তোমার বিয়ে দিতে পারি একটাই শর্তে। তোমায় নির্ভয়পুরে ওই চার্চের মাঠে গিয়ে বলতে হবে, তোমার গর্ভের সন্তান সুজয়ের। আমি জানি, সুজয় সেটা অস্বীকার করবে। তখন আমি তোমার পাশে দাঁড়াব। আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দেব তোমার আর নীহারের। দেখো, এই শর্তে যদি রাজি না থাকো, তা হলে নীহার যেমন কলকাতা চলে গেছে তেমন ওখানেই থাকবে। তখন কুমারী অবস্থায় প্রেগন্যান্ট হয়ে তুমি কী পুরস্কার জিতবে গ্রামবাসীদের কাছ থেকে, দেখো।” কথাটা এক নিশ্বাসে বলেই পামেলা ফিসফিস করে বলল, “সুনীল, লাস্ট সুযোগ আমাদের হাতে সুজয়কে নির্ভয়পুরবাসীর কাছে ছোটো করার। এ সুযোগ আমি ছাড়ব না।”
সুনীল বলল, “কিন্তু সুজয় তো শিক্ষিত ছেলে, যদি ডিএনএ টেস্ট করাতে চায়, তখন?”
পামেলা বলল, “উফ সুনীল, তুমি যে কেন ভুলে যাও মিথ্যের গতিবেগ উল্কার মতো। সত্য প্রমাণ হতে হতে এই বোকা লোকগুলোর মাথায় যা ঢোকার ঢুকে যাবে। ডোন্ট ওয়ারি ডিয়ার। বাকিটা পরে দেখা যাবে। আজকের অপমানের প্রতিশোধ এর থেকে বেশি কিছু হয় না।”
কুত্তলী কেঁপে উঠল। সুজয়দা কোনওদিন ওর হাত অবধি ধরেনি, তাকে এভাবে গাঁ সুদ্ধু লোকের কাছে বদনাম করবে? এর থেকে মরে যাওয়া ভালো কুন্তলীর। কুত্তলী বলল, “কিন্তু এটা তো মিথ্যে?”
পামেলা হেসে বলল, “তো তুমি যেটা বলছ সেটাই যে সত্যি, তার কী প্রমাণ আছে? আমার ভাই তোমার কথা আমায় বলেনি কখনও। তাছাড়া ওকে কলকাতা পাঠিয়েছি, আমার মা, বোন ওর জন্য ভালো পাত্রী দেখেছে। আমাদের স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী। আর তুমি যদি বাচ্চাটাকে নষ্ট করে দিতে চাও তো বলো আমি ডাক্তারের খরচ দিয়ে দেব। আমি এমনিতেও অসহায় মেয়েদের পাশে দাঁড়াই নিঃস্বার্থে। তুমি এখন এসো, আমার অন্য কাজ আছে।”
কুন্তলী হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। আর-একবার বোধহয় নীহারকে ফোনে চেষ্টা করল। পামেলা জানে, এই সময় নীহার ফ্লাইটে তাই ওর ফোন সুইচড অফ। আর কলকাতায় নামলে জীবনটাই অফ করে দেবে পামেলা। ভাই বলে ওর অনেক অসভ্যতা সহ্য করেছে পামেলা। কিন্তু নীহার যেভাবে অ্যান্টি পামেলা গ্রুপে জয়েন করে এসব আদিবাসী মেয়ের সঙ্গে সংসার পাতার স্বপ্ন দেখেছে, তাতে এত বছর ধরে তিল তিল করে গড়ে তোলা সাম্রাজ্যের পতন অনিবার্য। না থাকবে কলকাতার সোসাইটিতে সম্মান, না নির্ভয়পুরে। গ্রিনভ্যালি ক্লাবের ড্রিঙ্ক সার্ভ করা মেয়ে হবে পামেলার বাড়ির বউ! ওই গ্রিনভ্যালিতে রেড ওয়াইন হাতে সমাদ্দার আর ঘোষাল আলোচনা করবে পামেলার ফ্যামিলির রুচিবোধ নিয়ে। হাসি-মজা করবে ওকে নিয়ে। কিছুতেই না। বস্তির বাড়িতে যেদিন আগুন ধরেছিল, সেদিনই পামেলা মারা যেতে পারত। বেঁচে যখন ফিরেছে, তখনই প্রতিজ্ঞা করেছিল, বাঁচার মতো বাঁচবে। সম্মান-প্রতিপত্তি নিয়ে বাঁচবে। আজকের পামেলা মিত্র হতে ওকে কম লড়াই করতে হয়নি। তাই এই বাঁচার পথে যে প্রাচীর হয়ে দাঁড়াবে, তাকে সরিয়ে দিতে দু’মিনিট ভাববে না পামেলা। সে রক্তের সম্পর্কের হলেও না। নীহারকে বড়ো যত্নে মানুষ করেছিল পামেলা। নিজে নামী স্কুলে পড়তে পারেনি বলেই ভাইকে নামী স্কুলে পড়িয়েছিল। দামি দামি পোশাক, ইলেক্ট্রনিক গ্যাজেট, যখন যা প্রয়োজন তার বেশিই দিয়েছে নীহারকে। ভাইকে আগলে রাখত পামেলা। কিন্তু নীহার একটু বড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পামেলকেই বড়ো শত্রু ভাবতে শুরু করল। পামেলাই নাকি ওর সাদাসিধে জীবনটাকে সোনা-চাঁদি দিয়ে মুড়িয়ে জটিল করে দিয়েছে। নীহারের নাকি দম বন্ধ হয়ে আসে এই জীবনে। অথচ দামি গাড়িতে চড়ে বন্ধুদের নিয়ে লং ড্রাইভে যেতে তার ভালোই লাগে। অফিসের কিউবে এসিতে বসে থাকতেও তার মন্দ লাগে না। দিদির টাকায় বিদেশ থেকে আঁকার রং আনাতেও তার দম বন্ধ লাগে না। দিদির মেম্বারশিপে গ্রিনভ্যালির ওপরের ঘরে কুন্তলীর সঙ্গে বেড শেয়ার করতেও তার দমবন্ধ লাগে না। দমবন্ধ লাগে শুধু লেকচার দেওয়ার সময়। আসলে বড়দির মতো সাকসেসফুল ও কোনওদিনই হতে পারবে না। সে যোগ্যতা যে ওর নেই, সেটা হাড়ে হাড়ে বোঝে নীহার। তাই আড়ালে আবডালে বড়দির সমালোচনা করে তৃপ্তি পাওয়া আর কি! দিদির ছত্রছায়ায় থেকে পামেলার সম্মান নিয়ে খেলার অধিকার পামেলা ওকে দেয়নি।
সুনীল বলল, “পামেলা; চলো আজ বাড়ি চলো। এখানে দাঁড়িয়ে থাকার দরকার নেই।”
কথাটা শুনেই কুন্তলী বলল, “স্যার, আপনি ওঁকে একটু বোঝান না। নীহার সত্যিই আমায় ভালোবেসে বিয়ে করতে চায়।”
সুনীল বলল, “এটা মিত্র ফ্যামিলির ব্যাপার কুন্তলী, আমি ওদের ফ্যামিলি ফ্রেন্ড হলেও এ ব্যাপারে কিছু বলাটা শোভা পায় না। এটা পামেলার সিদ্ধান্ত। আমি ওকে যতদূর চিনি, তাতে ওর সিদ্ধান্ত বদলায় না। তুমি বরং অপেক্ষা করো, নীহার মাসখানেক পরে ফিরবে বলে গেছে। তখনই যা বলার বলবে।” পামেলা গাড়ির দিকে পা বাড়াতেই কুন্তলী বলল, “আমি যদি বলিও এ বাচ্চা সুজয়দার, সুজয়দা মানবে কেন?”
পামেলা জটিল হেসে বলল, “মানবে না তো, না মানলে না মানবে। তখনই তো আমি নীহারের সঙ্গে তোমার বিয়ে দেব। নির্ভয়পুরের মানুষ জানবে, পামেলা মিত্র তাদেরই একটা অসহায় মেয়ের পাশে দাঁড়াল।”
কুন্তলী কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমি এই একটা কথা বললেই আপনি নীহারের সঙ্গে আমার বিয়ে দেবেন?”
সুনীল বিরক্ত হয়ে বলল, “পামেলা মিত্র কথার খেলাপ করে না।”
সুনীলেরও আজ মারাত্মক রাগ হয়েছে সুজয়ের ওপরে। ওর এত প্ল্যানড ম্যাচটা নষ্ট করে দিল ওই ছেলেটা। সুজয়ের সঙ্গে সুনীলের কোনওদিনই প্রতিযোগিতার সম্পর্ক নয়। বরং সুনীল-স্যার বলে বেশ সম্ভ্রমের সঙ্গেই কথা বলে সুজয়। তা হলে আজ নির্ভয়পুরের ছেলেদের নিয়ে ফুটবল ম্যাচ অ্যারেঞ্জ করা হয়েছে জানার পরেও, আজকের তারিখেই ফ্রি-তে বনভোজনের ব্যবস্থা করাটা নেহাতই সরল মস্তিষ্কের কাজ বলে মেনে নিতে পারছে না সুনীল। তাই সুনীল নিজেও চায়, সুজয় একটু শিক্ষা পাক। সাধারণত পামেলা কথা দিলে সেটা রাখে। হয়তো নিজের ভাবমূর্তিটা নির্ভয়পুরে আরও শক্ত করার জন্যই অনিচ্ছা সত্ত্বেও নীহারের সঙ্গে কুন্তলীর বিয়েটা দেবে। কারণ, পামেলা নিজের ইমেজটাকে বড়ো ভালোবাসে।
কুন্তলী কেঁদেই চলেছে। চোখ দুটো লাল। মুখে ভয়ের চাপ চাপ চিহ্ন।
পামেলা বলল, “সুনীল, ওকে তা হলে গাড়িতে তোলো। চলো চার্চের মাঠে যাই আমরা তিনজন। মেয়েটাকে তো সব জানার পরে আমরা এভাবে একা ফেলে দিতে পারি না, তাই না? বিশেষ করে আমি নির্ভয়পুরের ভবিষ্যতের পথপ্রদর্শক হতে চলেছি।”
কুন্তলী ফুঁপিয়েই যাচ্ছে।
পামেলা বলল, “চিন্তা কোরো না। তুমি তোমার কাজটা যতটা নিখুঁত করবে, আমার কাজটাও ততটাই ত্রুটিহীন হবে।”
পামেলার হাতের ছোঁয়া পেয়ে কুন্তলী বোধহয় একটু সাহস পেল। বলল, “সুজয়দাকে আমি দোষী করছি, যে কাজটা সুজয়দা করেইনি।”
পামেলা হেসে বলল, “প্রেমে আর যুদ্ধে অন্যায় বা পাপ বলে কিছু হয় না বোকা মেয়ে। তুমি নীহারকে পাবে বলে এটা করছ। এতে কোনও পাপ নেই, ভালোবাসার জন্য যা করবে, সব ন্যায়।”
সুনীল বলল, “দেখো কুত্তলী, আজ যদি পামেলা মিত্রর বাড়ির বউ হও তুমি, আর কাল পামেলা ইলেকশন হেরে যায়, তা হলে বড়ো ননদের হার তোমায় কষ্ট দেবে না? আর তুমি যখন মালিকপক্ষের হয়ে যাবে, তখন কি ওই সুজয় তোমায় আর বন্ধু মনে করবে? পামেলা যেমন ওর শত্রু, তুমিও তেমনই হবে ওর শত্রু। দামি গাড়ি থেকে নেমে, দামি বাংলোর থেকে সুজয়ের বন্ধু হওয়া যায় না। এখন তুমি ডিসাইড করো নীহারের স্ত্রী হবে, না সুজয়ের বন্ধু?”
কুন্তলী হাত মুঠো করে বলল, “নীহারের স্ত্রী।”
গাড়িটা চলল চার্চের মাঠের দিকে। পামেলা ঘন ঘন মোবাইল দেখছে। এতক্ষণে হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। প্রশান্ত কাজ হলেই কল করবে বলেছে।
কুত্তলীর মুখে বিভ্রান্তি। কী করবে বুঝতে পারছে না। গাড়িতে যাওয়ার সময়টুকুও বারবার নীহারের ফোন নম্বর ডায়াল করছে ও।
সুনীল আর পামেলা ফিসফিস করে কিছু একটা বলছে।
পামেলা বলল, “বুঝলে, ভাগ্যিস নির্ভয়পুরের মানুষগুলো আজও বোকা আছে, তাই আমরা করে খাচ্ছি।”
গাড়িটা থামতেই পামেলা বলল, “কথা আমিই বলব, কুন্তলী শুধু সহমত হবে। ব্যস, বাকিটা সুনীল সামলে নেবে।”
চার্চের মাঠে গাড়ি থামতেই কুন্তলী ফুঁপিয়ে উঠল। সুজয়কে ও আজও ভালোবাসে। না, বিয়ে করার মতো হয়তো নয়, কিন্তু মানুষটা ওর কাছে ভগবানের মতো। সুজয়ের জন্যই ও গ্রিনভ্যালির চাকরি পেয়েছিল। অবস্থা ফিরেছিল ওদের সংসারের। গ্রিনভ্যালিতে গিয়েছিল বলেই নীহারকে পেয়েছে কুণ্ডলী। সেই মানুষটাকে বদনাম করতে বুকটা কাঁপছে। কিন্তু এটা না বললে এই গর্ভবতী অবস্থায় যাবে-ই বা কোথায়? নীহারের দিদি যদি ওদের বিয়ে না দেয়, তা হলে তো মৃত্যু ছাড়া আর কোনও রাস্তাই খোলা নেই কুণ্ডলীর সামনে। কারণ ডাক্তার বলেছে, ওর শরীরে রক্ত কম, হার্টের সমস্যা তো আছেই। যে কারণে ভারী কাজ করলেই হাঁপ ধরে। আরও কী সব সমস্যা আছে। বাচ্চা নষ্ট করা সম্ভব নয়। নিরুপায় কুত্তলী ভাবছিল, পরে না হয় সুজয়দাকে বিষয়টা বুঝিয়ে বলা যাবে। নীহারের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যাবার পরে আসল কথাটা বলেই দেবে সবাইকে। আপাতত পামেলা মিত্রর কথা শোনা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।