ইতি নির্ভয়পুর – ২২
২২
নীহারের নিথর দেহটা শোয়ানো আছে পামেলার বাড়ির বিশাল উঠানে। নীহার নির্ভয়পুরের সব বাড়িতে ঘুরে বেড়াত। কখনও কাউকে বসিয়ে ক্যানভাসে আঁকত তার ছবি। তাই ছেলেটাকে সবাই নিজের ঘরের ছেলে ভাবত। এত কমবয়েসি একটা ছেলে এভাবে গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে মারা যাবে ভাবা যায়নি। মানুষের ঢল পামেলার বাড়ির সামনে। নীহারের মৃতদেহের সামনে স্থবির হয়ে বসে আছে পামেলা। দু’চোখের জল পামেলাকে মেকআপবিহীন করে দিয়েছে। নীহারের দিদি-জামাইবাবুই পুলিশকে খবর দিয়েছে। পোস্টমর্টেম হবে। নীহারের মাকে নিয়ে আসা হয়নি কলকাতা থেকে। এই প্রথম পামেলাকে কেউ এমন আকুলিবিকুলি করে কাঁদতে দেখল। আর-একজনও কাঁদছে, বুকের কাপড় ভিজিয়ে কাঁদছে। কিন্তু প্রেমিকার সে অধিকার কোথায় যে, সর্বসমক্ষে সে কাঁদবে! কুত্তলীর শরীরে বেড়ে উঠছে নীহারের সন্তান। গোটা নির্ভরপুর আজ দুপুরেই জেনেছে এ সন্তান সুজয়ের, একমাত্র কুণ্ডলী জানে এ সন্তান নীহারের। খুব ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে নীহারের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলতে, ‘তুমি বলেছিলে আমাদের ঘর হবে রঙ্গিতের ধারে। শুধু তোমার আর আমার একটা অগোছালো সংসার হবে। সেসব প্রতিশ্রুতি ভেঙে এভাবে চলে গেলে কেন নীহার?’ সর্বসমক্ষে কান্নারও অধিকার নেই কুত্তলীর। সুজয়দার চোখে ঘৃণার অভিব্যক্তি ছাড়া আর কিছুই দেখেনি এই মুহূর্তে, আর নীহারের মুখে তো শুধুই প্রশান্তি। সব দায়ভার ছেড়ে, কুত্তলীকে একলা লড়াই করতে হবে বুঝিয়ে দিয়ে, চলে গেল নীহার। চূড়ান্ত মিথ্যুক পামেলা মিত্রর নাটক দেখতে ইচ্ছে করছে না কুন্তলীর। ওর তো সন্দেহ হচ্ছে ভাইকে পামেলা কতটা ভালোবাসত। নীহার কেন বারবার বলত, “বড়দিকে চেনা অত সহজ নয়, বড়দি ঠান্ডা মাথার খুনি। মেয়েদের যে স্বাভাবিক মায়া-মমতা জন্মগত, আমার দিদির সেটা নেই। বড়দি নিজের সুবিধার জন্য কতটা নিচে নামতে পারে, তা এই নির্ভয়পুরের মানুষরা জানে না।” কুন্তলী তখন ঠিক বোঝেনি, আজ বুঝল, পামেলা ঠিক কীভাবে ওকে ব্যবহার করে সুজয়কে বদনাম করে দিল মুহূর্তে।
কুত্তলী খেয়াল করেনি কখন একটা হাত ওর কাঁধে এসে পড়েছে। কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, “পালাও এখান থেকে, না হলে পামেলা মিত্র তোমার সন্তানকেও মেরে দেবে।”
পিছন ঘুরতেই দেখল সুজয়দা দাঁড়িয়ে আছে। আলতো করে ওর কাঁধে হাত দিয়ে বলল, “প্রথমে তোমার ওপরে খুব রাগ হয়েছিল, ঘৃণা হয়েছিল। কিন্তু এখন বুঝলাম, তুমি নিরুপায় ছিলে।”
ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল কুন্তলী। অস্ফুটে বলল, “বিশ্বাস করো, আমি জ্ঞানত তোমার কোনও ক্ষতি কোনওদিন চাইনি। আমি জানি, তুমি আমায় ঘেন্না করো।”
সুজয় বলল, “পালাও এখান থেকে। নিজের ভাইকে যে খুন করাতে পারে, সে ভাইয়ের অনাহূত সন্তানকে গর্ভেই মেরে ফেলতে পারে অনায়াসে।”
কুত্তলী বলল, “তুমি জানতে? আমার আর নীহারের সম্পর্কের কথা জানতে?”
সুজয় উদাস গলায় বলল, “বিশ্বাস করিনি প্রথমে, জানো? ভেবেছিলাম কুন্তলী আমায় ভালোবাসে, পলাশবনায় যেদিন নীহারের সঙ্গে তোমায় বসে গল্প করতে দেখলাম, সেদিনও বিশ্বাস করিনি জানো। কিন্তু আজ বুঝলাম, তোমাদের সম্পর্কটা অনেকদূর এগিয়েছিল খুব কম সময়েই। নীহার ছেলেটা কিন্তু খারাপ ছিল না, ওর একটাই দোষ ছিল, সেটা হল, ও পামেলা মিত্রর ভাই। পামেলা বেঁচে থাকতে তোমাদের সম্পর্কে মান্যতা দিত না। সেই কারণেই হয়তো নীহারকে অকালে চলে যেতে হল। আমি যদি তোমার সন্তানকে নিজের বলে স্বীকার না করতাম, তা হলে তোমার গর্ভের সন্তানকে মারার জন্য উঠেপড়ে লেগে যেত। মালিকপক্ষের হিংসার রূপ তুমি দেখোনি কুন্তলী, তাই জানো না। নীহার বেঁচে থাকলেও তোমায় বিয়ে করতে পারত না। পামেলা মিত্র হতে দিত না।”
কুন্তলী আচমকাই সুজয়ের বুকে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ফিসফিস করে ব্লল, “তুমি আমায় কেন বিয়ে করবে সুজয়দা? অন্যের সন্তানকে কেন তুমি নিজের পরিচয় দেবে? আমার মতো একটা নষ্ট মেয়েকে কেন তুমি স্ত্রীর সম্মান দেবে? নীহার চলে গেল, আমিও মরে যাব, কিন্তু এ অন্যায় তোমার সঙ্গে আমি করতে পারব না। তুমি আমার উপকার করেছিলে, আর আমি ভরা সভায় তোমাকেই বদনাম করতে গিয়েছিলাম ওই পামেলা মিত্রর কথাতে।”
সুজয় কুম্ভলীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “একটা প্রশ্নের উত্তর দেবে? আমি কি এতদিন ভুল জানতাম, মানে আমার বোঝায় কি ভুল ছিল কুম্ভলী? ভয় নেই, নির্ভয়ে বলতে পারো। তুমি কি আমায় কোনওদিন ভালোবাসোনি?”
কুত্তলী ফুঁপিয়ে উঠে বলল, “নির্ভয়পুরের আকাশ সাক্ষী, নীহারের মৃতদেহ সাক্ষী, আমি তোমাকেই ভালোবেসেছি, যবে থেকে প্রেম নামক কথাটার মানে বুঝেছি। কিন্তু তোমার দিক থেকে কখনও কোনও সাড়া পাইনি। আর নীহার আমার জীবনে এসেছে মাত্র ছয় মাস। আমায় একটা স্বপ্নের মতো ঘোরে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। এ অনুভূতি আমার বড্ড অচেনা। তাই আমিও ভেসে গেছি অগ্র-পশ্চাৎ না ভেবেই।”
সুজয় কুন্তলীকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আসলে আজ বুঝতে পারছি, কিছু অনুভূতিকে সযত্ন লালিত না করে, প্রকাশ করা উচিত।”
কুন্তলী ফুঁপিয়ে উঠে বলল, “সুজয়দা আমার গর্ভে তো পামেলা মিত্রর মতো নোংরা মহিলার রক্ত বইছে। এ সন্তান কি ভালো হবে?”
সুজয় বলল, “উঁহু, এভাবে ভাবতে হয় না। ওকে আমরা যেভাবে মানুষ করব সেভাবেই বড়ো হবে। পামেলা মিত্রর নিজের ভাই তা হলে কেন এমন দলছাড়া হয়েছিল? তুমি জানো, নীহার একদিন আমার কাছে এসেছিল। গোপনে দেখা করে বলে গিয়েছিল পামেলার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী। কেন ও নির্ভয়পুরের রাজনীতি নিয়ে এত মাথা ঘামাচ্ছে তার কারণও বলে গিয়েছিল। চলো কুত্তলী, তোমার এখানে দাঁড়িয়ে থাকা সেফ নয়।”
কুন্তলী আর-একবার পিছন ঘুরে নীহারের ঘুমন্ত মুখটা দেখে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সুজয়ের হাত ধরে চলে এল। নীহার এভাবে চলে যেতে পারে, মুহূর্তের জন্যও কল্পনা করেনি কুত্তলী। তাই বলে আজ সকাল থেকে পামেলা আর সুনীল-মাস্টার যেভাবে ওকে সামনে রেখে মিথ্যের জাল বুনে নিজেদের কার্যসিদ্ধি করতে চাইল, সেটার কথা কিছুতেই ভুলতে পারছে না কুন্তলী। সুজয়দা চিরকাল অসহায় মানুষের পাশে থেকেছে, ওর জায়গায় জবা বা মালতী হলেও হয়তো সুজয়দার উত্তর একই হত। তাই বলে কুন্তলী ওই পামেলার কথায় বিশ্বাস করে এমন একটা কাজ করল কী করে! মাথাটা ঝিম ঝিম করছে। সকল থেকে খাওয়া নেই। তারপর এত কিছু ঘটে গেল ঝড়ের মতো, ওর সহজ সরল জীবনটাকে যেন মুহূর্তে পাহাড়ি বাঁকের মতো জটিল করে দিল। সুজয়দা ওকে ক্ষমা করল ঠিকই, কিন্তু কুন্তলীর বাচ্চা যখন উঠোনময় ঘুরে বেড়াবে, তখন কি সুজয়দার মনে পড়বে না এ সন্তান ওর নয়, দায়ে পড়ে মেনে নিতে হয়েছিল! পড়বে, পড়বে, নিশ্চয়ই পড়বে। আজকের ঘটনা ভোলা অত সহজ নয়।
সুজয়দা বলল, “জানি কুন্তলী, তোমার মন খুব খারাপ। নীহারের মৃত্যু মেনে নেওয়া সহজ নয়। তবুও বলব, কষ্ট পেয়ো না। আমরা কাল চার্চে গিয়ে বিয়েটা সেরে নেব। তারপর তোমায় ডাক্তারের কাছেও নিয়ে যাব। যত্নে থাকতে হবে এ সময়। কুত্তলী নিজের সঙ্গেই চোখ মেলাতে পারছে না, সুজয় তো দূরের কথা। সুজয়ের চোখে ও চিরকালের মতো ছোটো হয়েই গেল।
বাড়ির সামনে আসতেই মা এক মুখ হেসে বলল, “তোরা বললে আমি দাঁড়িয়ে থেকে তোদের বিয়ে দিতাম। এত লুকোচুরির কী ছিল!”
সুজয় মাথা নিচু করে বলল, “আমরা একটা অন্যায় করে ফেলেছি কাকিমা, এবারের মতো ক্ষমা করে দেবেন। কাল আমরা চার্চে গিয়ে নিয়ম মেনেই বিয়ে সেরে নেব। কুন্তলীকে এখন কিছু খেতে দিন। বড্ড ধকল গেছে ওর ওপর দিয়ে।”
সুজয় আর দাঁড়াল না। কুন্তলী ওর চলে যাওয়ার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকল।