ইতি নির্ভয়পুর – ২৩
২৩
“সাহেব, আমি এখন কলকাতায়। আসলে নির্ভয়পুরের বাতাস আর আগের মতো নেই।” অস্মিতা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “তুমিও তো কলকাতায় শুনলাম। আগে হলে তো দেখা করার জন্য পাগল করতে, আজকাল কি কন্ট্যাক্ট লিস্ট থেকে ডিলিট করে দিয়েছ আমার নম্বরটা?”
সাহেব হেসে বলল, “আমি জানতাম, আমিই বাদ পড়েছি তোমার বন্ধুত্বের তালিকা থেকে। এখনও সেখানে রেখেছ দেখে ভালো লাগছে।”
অস্মিতা বলল, “আমি না হয় তোমায় বন্ধু ভাবতাম, কিন্তু তুমি? তুমি কী ভাবতে আমায়?”
সাহেব বলল, “সেটা বোধহয় খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয় তাই না অস্মি? ‘ অস্মিতা বলল, “নিজের ভাবনাকে এতটা অপ্রয়োজনীয় ভাবতে শুরু করেছ কবে থেকে? আমি ছোটো থেকে যে সাহেব মল্লিককে চিনি, সে তো নিজের ভাবনাকে বাস্তবায়িত করতে শেষ অবধি পৌঁছতে পারত। যা তার নিজের জিনিস বলে মনে হত, সেটার এক বিন্দু অধিকার সে কাউকে ছাড়তে নারাজ ছিল। তবে কি তুমি এখন নিজের সব কিছু বিনা যুদ্ধে ছেড়ে দিতে রাজি?”
সাহেব বলল, “যুদ্ধে নামতে আজও পারি, যদি বুঝি অনুভূতিটা শুধুই আমার ছিল না, কারণ যাকে নিয়ে লড়তে নামব, সে-ই যদি আমার না হয়, তা হলে যুদ্ধে লাভ কী?”
অস্মিতা বলল, “কেউ যদি বোকা হয়, তাকে বোঝানোটা বুঝি তোমার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে না? তাকে কখনও নিজের মুখে বলেছ তুমি তাকে ভালোবাসো? নাকি সেটাও নিজের মধ্যেই রেখে দিয়েছ?”
সাহেব বলল, “এত বছরে আমার সমস্ত আচরণে তার বুঝে যাওয়া উচিত ছিল, তবুও যদি সে না বুঝে থাকে, তা হলে মুখ ফুটে বললেই কি সে মেনে নেবে?”
অস্মিতা বলল, “ওয়েট, তুমি কোথায় দাঁড়িয়ে কথা বলছ সাহেব? আমার বাড়ির ঘড়ির মিউজিক কেন এল তোমার ফোনে?”
সাহেব বলল, “তোমার গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। নুপুর বলেছিল, তুমি কাল এসেছ। তাই নেহাতই বন্ধু হিসেবে দেখা করতে এসেছিলাম। সেই কারণেই মেসেজ করেছিলাম। মেসেজ দেখে তুমি কল করলে।”
অস্মিতা বলল, “বলরামদা, গেট খুলে সাহেবদাদাকে ওপরে নিয়ে এসো।” অস্মিতা ফোনটা রেখে আয়নার সামনে দাঁড়াল। মুখে-চোখে ক্লান্তি জমেছে। সাহেব নিঃশব্দে এসে দাঁড়িয়েছে ওর বেডরুমের দরজায়। নিজেকে সামলাতে পারল না অস্মিতা। ছুটে গিয়ে সাহেবকে জড়িয়ে ধরে বলল, “যাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসো, তাকে ক্ষমা করতে পারো না সাহেব? তার ক্ষণিকের ভুল সিদ্ধান্তকে ভুলে গিয়ে আবার আগের মতো আপন করে নিতে পারো না?”
সাহেব অস্মিতার পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, “আমি পর তো করিনি অস্মি। আমার কাছে তো তুমি একই আছ। তুমিই ক’দিন সময় চেয়েছিলে নিজেকে চেনার জন্য, সেটুকু দিতেই একটু দূরত্ব বাড়িয়েছিলাম মাত্র।”
অস্মিতা বলল, “আমি বললেই রাজি হবে না বুঝলে? পরিষ্কার বলবে, তুমি আমার অস্মি, সেই ছোটো থেকে আমার। আঙ্কেল এখন কেমন আছেন?”
সাহেব বলল, “বিপদ কেটেছে, এখন ভালো আছে বাবা।” সাহেব অস্মিতার বিছানায় বসে বলল, “পামেলা মিত্রর ভাই মারা গেছে। নীহার ছেলেটা কিন্তু মন্দ ছিল না।”
অস্মিতা বলল, “মন্দ ছিল না বলেই তো মরতে হল। নূপুর হঠাৎ নির্ভয়পুরের ওই ধ্বজা হসপিটালে জয়েন করল কেন সাহেব?”
সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “বোন কিছুটা বাবার মতো হয়েছে। নির্ভয়পুর দরদী। ওখানের মানুষকে চিকিৎসা দিতে হবে বলে এই ডিসিশন নিয়ে নিল। আমার সঙ্গে একচোট ঝগড়াও হয়েছে। আর ওই অনাথ ডাক্তারের সঙ্গে এখন খুব মাখামাখি হয়েছে দেখছি। কিছু একটা ব্যবস্থা করতে হবে। ওই ডাক্তারের বদলি করার ব্যবস্থা করতে হবে।”
অস্মিতা সাহেবের হাতের ওপরে নিজের হাত রেখে বলল, “প্লিজ সাহেব, এটা তুমি কোরো না। শৌনক সত্যিই খুব ভালো ছেলে। নূপুর ওকে ভালোবাসে।”
সাহেব ছিটকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “হোয়াট ডু ইউ মিন অস্মি? ভালোবাসে মানেটা কী? চাল-চুলো নেই, ওই সরকারি হাসপাতালের কোয়ার্টারে থাকে। বাপ-মায়ের ঠিক নেই। ওকে বিয়ে করবে নূপুর? আমি বেঁচে থাকতে এটা হতে দিতে পারি না।”
অস্মিতা বলল, “বংশপরিচয় আর টাকার বাইরে একটু ভাবতে শেখো সাহেব, প্লিজ। তাছাড়া বাবা রাগের মাথায় অলরেডি শৌনকের একটা ক্ষতি করেছিল, তাই আমি লজ্জায় মরে আছি। এবার যদি তুমি কিছু করো, তা হলে শৌনকের ধারণা হবে, সবই আমি রিভেঞ্জ নিচ্ছি। প্লিজ সাহেব, আমার রিকোয়েস্টটা শোনো। তুমি শৌনকের কোনও ক্ষতি করবে না। তাছাড়া নূপুর বড়ো হয়েছে। তুমি ওকে পরিচালিত করতে পারো না।”
সাহেব বলল, “আমি আমার বোনের সঙ্গে ওই অনাথ ছেলের বিয়ে দেব না।”
অস্মিতা সাহেবকে শান্ত করার জন্যই কথাটা ঘুরিয়ে বলল, “চলো একটা মুভি দেখে আসি নন্দনে। যাবে?”
সাহেব অস্মিতার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “মুখ-চোখের এমন হাল কেন তোমার? শরীর খারাপ ছিল? যত্ন নাওনি একদম, তাই না?”
অস্মিতা বলল, “মনখারাপ ছিল সাহেব। নিজের সব থেকে স্বাচ্ছন্দ্যের জায়গাটা হারিয়ে ফেলার কারণেই কেমন একটা শূন্যতা, একাকিত্বের চাদর ঘিরে ধরেছিল। হাঁসফাঁস করছিলাম জানো? আসলে সাহেব প্রেম বড়ো জটিল বস্তু। নিঃস্ব করে দেয়, জানো?”
সাহেব বলল, “জানি। তোমাকে হারিয়ে ফেলার ভয় আমাকেও তাড়া করে বেরিয়েছে চব্বিশঘণ্টা। অস্মিতা আমার মনে হয়, এবারে আমাদের এক হওয়া উচিত। দূরত্ব অনেক সময় বড়ো ভুল বোঝাবুঝি তৈরি করে। তাই না?”
অস্মিতা মুখে হালকা করে পাফটা বোলাতে বোলাতে বলল, “আমি তো বাবাকে বলেই এসেছি, বিয়ে করলে সাহেবকে করব। বাবা ইদানীং কোনও কারণে মল্লিক আঙ্কেলের ওপরে বিরক্ত। তাই আমাদের সম্পর্কটা মেনে নিতে চাইছে না। সেটা অবশ্য কোনও সমস্যা নয়। কারণ, নিরঞ্জন সমাদ্দার তার মেয়ের জেদ জানে।”
লাইট পিঙ্ক কালারের লিপস্টিকটা ঠোঁটে লাগাতেই সাহেব এসে বিনাবাক্যে অস্মিতার ঠোঁটে ঠোঁট রাখতে রাখতে ফুঁপিয়ে উঠে বলল, “আর কখনও আমায় ছেড়ে যাবে না, কথা দাও।”
অস্মিতা বলল, “তুমি ছাড়া আমি বড্ড একা সাহেব, সেটা এতদিনে উপলব্ধি করলাম আমি। তোমার মতো করে আমায় কেউ বুঝবে না।” অস্মিতা বলল, “চলো দেরি হচ্ছে তো।”
সাহেব মুচকি হেসে বলল, “লিপস্টিকটা আর-একবার লাগিয়ে নাও।”
অস্মিতা ঠিক এই সাহেবকেই চাইত, যে ওকে আগলে রাখবে, প্যাম্পার করবে। কিন্তু সাহেবের রাগটাকে যেভাবেই হোক সামলাতে হবে। নূপুরের চোখ দেখেই অস্মিতা বুঝেছে, ও শৌনককে ভালোবাসে, শৌনকও বেশ পছন্দ করে নূপুরকে সেটাও বোঝা যায়। ওদের সম্পর্কটা সাহেবের জন্য যেন নষ্ট না হয়ে যায়, সেটা খেয়াল রাখতে হবে অস্মিতাকেই।
সাহেব গাড়ি ড্রাইভ করতে করতেই বলল, “কী এত ভাবছ আকাশ-পাতাল?”