ইতি নির্ভয়পুর – ২৫
২৫
শোভন আনমনে ব্যালকনিতে বসে একটা জার্নালের পাতা ওল্টাচ্ছিল।
নিবেদিতা চায়ের ট্রে-টা বেতের টেবিলের ওপরে রেখে বলল, “তুমি কী এত ভাবছ বলো তো অন্যমনস্ক হয়ে?”
শোভন ইতস্তত করে বলল, “ভাবছি, কতটা পর হয়ে গেলে যোগাযোগ বিছিন্ন করে থাকা যায় পাঁচ বছর? সেদিন অরুণাংশু মল্লিক আমার চেম্বারে বসে থাকাকালীন ওঁর মেয়ে ওঁকে ফোন করেছিল। অরুণাংশু মল্লিক প্রায় চমকে উঠে বললেন, ‘সে কী! কেন? নিরঞ্জন শৌনকের সঙ্গে এমন কেন করল? অ্যাক্সিডেন্ট কখন হয়েছে? ডাক্তার এখন কেমন আছে?’ তো আমি বাধ্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কিছু হয়েছে?’ অরুণাংশু মানুষটা বেশ মিশুকে টাইপ। জিজ্ঞাসা করতেই বললেন, ‘আর বলবেন না, যত চিপ কাজকর্ম। আমাদের ডাক্তার শৌনকের একটা গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। হয়েছে বলব না, এক বিজনেসম্যান করিয়েছে বলা যায়। মানে, আমার মেয়ের তাই ধারণা। শৌনকের পায়ে লেগেছে। না ভাঙেনি, তবে চিড় এসেছে বলছে।’ না নিবেদিতা, আমি চমকে উঠিনি ওদের সামনে। নার্ভকে কন্ট্রোলে রেখেছিলাম। এমনকী, মুখের একটা শিরাতে উৎকণ্ঠা প্রকাশ পায়নি। ভাবলেশহীন গলায় জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘কেন, হঠাৎ ডাক্তারকে মারতে গেল কেন?’ অরুণাংশু বললেন, ‘নিরঞ্জন একটা নার্সিংহোম করবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেই নার্সিংহোমের দায়িত্ব দিতে চায় শৌনককে। শৌনক দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করে তাই আর-কি।’ আমার মনে হয়নি এটাই একমাত্র কারণ। আসলে অরুণাংশুবাবু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন। ওঁর স্ত্রী ইশারা করলেন, সেটা আর বললেন না। ওঁরা বেরিয়ে যেতে অন্তত বার দশেক আমি কল করেছিলাম শানুকে। রিসিভ করল না। এটা প্রায় মাসখানেক আগের ঘটনা। তোমায় বলিনি। অহেতুক চিন্তা করবে বলেই। আজ অরুণাংশুবাবুর শরীরের খোঁজ নিলাম ফোনে। সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনাদের ডাক্তার এখন কেমন আছেন? মাঝে মাঝে চেকআপ করিয়ে নেবেন ওঁকে দিয়ে।’ তো উনি বললেন, ‘শৌনক এখন পারফেক্ট আছে। হসপিটালে যাচ্ছে।’ ভাবো নিবেদিতা, আমার অবস্থাটা একবার! এতটা দূরে চলে গেলাম তার কাছ থেকে যে, অতগুলো মিসড কল দেখে একমাসেও একবার কল করল না সে।”
নিবেদিতা বলল, “আমি ওই প্রলয় বলে ছেলেটাকে মাঝে মাঝে করে জিজ্ঞাসা করি, শানু কেমন আছে? আসলে শানুর কম্পাউন্ডার টাইপের, বাইরের লোকের কাছ থেকে নিজের ছেলের খবর নিতে অস্বস্তি হয়। প্রলয় যা বলল, তাতে বুঝলাম, একাই থাকে। কই কোনও পরিবার ওর সঙ্গে থাকে বলে তো শুনলাম না।”
শোভন বলল, “সে কি রক্তের সম্পর্কের বাবা-মাকে পাঁচবছরেও খুঁজে বের করতে পারেনি তা হলে? আমরা তো তাকে মিথ্যের জালে আটকে রেখেছিলাম এতকাল।”
নিবেদিতা বলল, “নির্ভয়পুরে মেডিকেল ক্যাম্প না করতে গেলে আমি হয়তো নিঃসন্তান থেকে যেতাম শোভন। কিন্তু এভাবে পেয়ে হারানোর কষ্টে ক্ষতবিক্ষত হতাম না। আমি কি অত্যন্ত লোভী শোভন? আসলে নিজে গাইনোকোলজিস্ট হয়েও কোনওদিন মা হতে পারব না বোঝার পরে এই হীনমন্যতা ঢাকতেই এটা করেছিলাম।”
শোভন বলল, “আমরা কি স্বেচ্ছায় করেছিলাম? নাকি সেই গর্ভবতী মহিলা ওটিতে ঢোকার আগে তোমায় অনুরোধ করেছিল, তার বাচ্চাটাকে ওরা মেরে ফেলবে, তুমি তাকে নিয়ে নিয়ো।”
নিবেদিতা বলল, “অপারেট করতে গিয়ে দেখলাম যমজ বাচ্চা। কোনওরকম ইউএসজির বালাই নেই ওখানে। বোঝাই যায়নি, দুটো বাচ্চা আছে।”
শোভন বলল, “সেদিন মেডিকেল ক্যাম্প না থাকলে ওই পেশেন্ট বাঁচত? বাঁচত ওর দুটো বাচ্চা?”
নিবেদিতা বলল, “জ্ঞান ফিরে পেয়েই মহিলা একটি সন্তান আমার কোলে তুলে দিয়ে বলেছিল, ‘ওকে মানুষ করবেন। এরা হয়তো সুযোগ পেলেই মেরে দেবে। একজন তবু বড়ো হোক।’ হ্যাঁ আমি লোভী, তাই সেদিন ওই ফুটফুটে বাচ্চাটাকে নিয়ে এসেছিলাম।”
শোভন বলল, “তোমায় দিল্লিতে রেখে বাড়ি এসে সকলকে বলেছিলাম তুমি প্রেগনেন্ট। কিন্তু দিল্লিতে তোমার একটা এক্সাম আছে তাই যাতায়াত করতে অসুবিধা হবে। আপাতত ওখানেই থাকবে। শানুকে নিয়ে তুমি দিল্লি থেকে যখন ফিরেছিলে, তখন সেভাবে কেউ শানুর বয়েস বুঝতে পারেনি। ওকে নিজেদের পরিচয়ে বড়ো করার সময় আমরা কি কোনও কার্পণ্য করেছি নিবেদিতা? কোনওদিন মনেই করিনি ওর জন্মবৃত্তান্ত। শুধু জানতাম, ও আমাদের সন্তান।”
নিবেদিতা বলল, “তার পরেও তো শৌনক আমাদের দোষ দিল, বলল আমরা নাকি মিথ্যাচার করেছি ওর সঙ্গে। এটা নাকি ঘৃণারও অযোগ্য। ওর মাকে আমরা ঠকিয়েছি। আমি কিন্তু টাকাও দিতে গিয়েছিলাম মহিলাকে, কিন্তু উনি বলেছিলেন, ‘সন্তানকে বেচছি না ডাক্তারদিদিমণি, বাঁচানোর জন্যই আপনার হাতে দিলাম।”
শোভন বলল, “নিবেদিতা, এই ঘটনা নির্ভয়পুরের কে কে জানে বলে তোমার মনে হয়?”
নিবেদিতা বলল, “কেউ জানে না। তুমি আর আমি জানি যমজ বাচ্চার কথা। আর খুব হেল্প করেছিলেন ওখানের ফাদার। উনি একমাত্র জানতেন। আর শানুর সঙ্গে ওই বাচ্চাটার চেহারার মিল তেমন ছিল না। যমজ হলেও চেহারা আলাদা ছিল। যদিও অত কচিতে চেহারা বোঝা সম্ভব ছিল না। তবুও মনে হয়েছিল।”
শোভন বলল, “মহিলার নাম তোমার মনে আছে?”
নিবেদিতা বলল, “মনে ঠিক নেই, লিখে রেখেছিলাম। বহু বছর আগের কথা শোভন, তাছাড়া জীবনে কোনওদিন কল্পনাই করিনি শানু আমাদের ভুল বুঝতে পারে!”
শোভন বলল, “আমি ওকে নির্ভয়পুরে যেতে বারণ করেছিলাম একটাই কারণে, তোমার মনে আছে ওর বায়োলজিক্যাল মাদার ডেলিভারির আগে কেমন ভয় পাচ্ছিল। বারবার বলছিল, কেউ একজন মেরে ফেলবে ওর বাচ্চাকে। তখন হয়তো যমজ বাচ্চাদের একইরকম দেখতে ছিল না। কিন্তু সে তো সদ্যোজাত ছিল নিবেদিতা। বড়ো হয়ে হয়তো আর-একটা শৌনককে দেখতে পেল নির্ভয়পুরে গিয়ে। তখন যদি ওর কোনও বিপদ হয়! এই দেখো এখন শুনছি, ওকে কেউ গাড়ি চাপা দিতে চেয়েছিল। সঠিক কারণ আমাদের অজানা কিন্তু।”
নিবেদিতা ভয়ে ভয়েই বলল, “আচ্ছা শোভন, ওই মহিলা কেন ভয় পাচ্ছিলেন? কেন কেউ ওঁর সন্তানকে মেরে দেবে ভাবছিলেন?”
শোভন বলল, “সেটা বলতে পারব না। ওর স্বামীকে দেখেছিলাম বাইরে দাঁড়িয়েছিল। মাতাল টাইপের। ওই জন্যই কি ভয় পাচ্ছিল? কে জানে!”
নিবেদিতা বলল, “আসলে আমি এতটাই উত্তেজিত ছিলাম সেদিন যে, এসব বাহ্যিক জিনিস দেখিনি। প্রথমত, ওটাকে আমি ওটি বলব না। কোনও ফেসিলিটিজ নেই। কী করে যে ডেলিভারি করিয়েছিলাম, আমি জানি। তারপর ওই মহিলার ওরকম আতঙ্কিত গলা, অদ্ভুত এক রহস্য তৈরি করেছিল। ফুটফুটে শানুকে কোলে নেবার পরে আমার জীবন কানায় কানার পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল।”
শোভন বলল, “কিন্তু ওর স্বামী আমায় বলেছিল, ‘পাপটার গলার আওয়াজ পেলাম যে, বেঁচে আছে তাই না? এত মার খেয়েও বেঁচে আছে। থাকুক, ও আমার তুরুপের তাস হবে।’ তখনই বুঝেছিলাম, কেন ওই মহিলা বাচ্চাটাকে আমাদের দিয়ে দিয়েছিল। মারধর করত ওর স্বামী।”
নিবেদিতা বলল, “কিন্তু আমার ধারণা ওই আর-একটি বাচ্চাকে শানুর মতো দেখতে হয়নি বলেই শানু এত বছর নির্ভয়পুরে থেকেও তাকে খুঁজে পায়নি। সেই কারণেই ও একা থাকে এখনও।”
শোভন বলল, “ত্রিশ বছর পরে কেউ গিয়ে হঠাৎ যদি বলে, আমি তোমার ছেলে, সে মেনে নেবে নিবেদিতা? বিশেষ করে তার আর-একটা সম্ভানও আছে। সেই সন্তানই বা কেন মেনে নেবে আর-একজন উত্তরাধিকারীকে? আর-একটু অপেক্ষা করো, শানু তোমার কোলেই ফিরবে। আমি তোমায় বলছি, অভিমানের চুপটি দুপুরগুলোতে ও তোমাকেই ভাবে।”
নিবেদিতা চায়ের কাপটা নিয়ে ভিতরে আসার সময় একঘেয়ে দীর্ঘশ্বাসটা সশব্দেই ছাড়ল। শোভন নিবেদিতার চলে যাওয়া দেখতে দেখতে ভাবছিল, এত লুকোচুরির থেকে একটা বাচ্চা অ্যাডপ্ট করলে হয়তো ওদের এতটা আঘাত পেতে হত না। অরুণাংশু মল্লিক সেদিন বলছিলেন, ‘আহা রে অনাথ ছেলে, নির্ভয়পুরের কত মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে, এখন তারই মাথার কাছে বসার কেউ নেই। ‘
শোভন নিস্পৃহ থাকার অভিনয় চালিয়ে যেতে যেতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল কয়েক মিনিটেই। শানু নির্ভয়পুরে নিজেকে অনাথ বলে প্রচার করেছে। এতটা অপমান ওরা বোধহয় ডিজার্ভ করে না। তবে শোভন এই সপ্তাহেই একটি বিশ্বস্ত ছেলেকে পাঠিয়েছে নির্ভয়পুরে, শৌনকের সম্পর্কে সবটুকু খবর পাবার জন্য। এটা অবশ্য নিবেদিতাকে বলেনি। তা হলেই ও বলবে, ছেলের পিছনে স্পাই লাগালে? বাধ্য হয়েছে শোভন, কারণ এইভাবে দুশ্চিন্তা নিয়ে বাঁচা বড়োই দুষ্কর হয়ে উঠছে। কে ওকে মারতে চেয়েছিল এবং কেন, সেটা শোভনকে জানতেই হবে। শৌনক যতই অভিমান করুক, বাবা হিসেবে ওরও কিছু কর্তব্য থেকে যায়।