ইতি নির্ভয়পুর – ২৬
২৬
“কর্তব্য? কীসের কর্তব্য সুনীল? ওই মেয়েটাই হচ্ছে আসল অপয়া। ওর জন্যই আমার ভাইটাকে এভাবে অকালে চলে যেতে হল।”
সুনীল বলল, “তবুও পামেলা, নীহারের সন্তান ওর গর্ভে। ওকে মোটা অঙ্কের একটা টাকাও যদি দেওয়া যেত গোপনে। মেয়েটা মুখটাও বন্ধ রাখত, আর তুমি তোমার কর্তব্য করতে। নীহারের আত্মার শান্তির জন্য।”
পামেলা বিরক্তির চোখে তাকিয়ে বলল, “সুনীল, এই বুদ্ধি নিয়ে তুমি রাজনীতিতে কী করবে বলো দেখি? তুমি বরং ফুটবল শেখাও এই আদিবাসীদের। মেয়েটাকে এখন টাকা দিতে যাওয়া মানেই নীহারের দোষটা স্বীকার করে নেওয়া, তাই না? এতে ও আর-একটু আস্কারা পেয়ে যাবে। সুজয় যখন একবার নিজের সন্তান বলে লোকের সামনে স্বীকার করেই নিয়েছে, তখন আর বিষয়টা নিয়ে জলঘোলা কেন করছ? বাকি খবর বলো। নীহারের মৃত্যুর পরে নির্ভয়পুরে কী আলোচনা হচ্ছে? ভোটের হাওয়া আমার দিকে ঘুরেছে?”
সুনীল দেখল, চোখে জল নিয়েও পামেলা মিত্র কী তুখড় অভিনয় করতে পারে! নীহারের জন্য মনটা খারাপ হয়ে আছে সুনীলের। ছেলেটা ওকে দাদার মতো সম্মান করত। নীহারের পারলৌকিক কাজ তিনদিনের মাথায় মিটিয়ে পামেলা আবার ভোটের প্রচারে বেরিয়েছে। ভাইয়ের মৃত্যুই ওর এখন তুরুপের তাস। সহানুভূতি কুড়াচ্ছে এই বলে, “নীহার চলে গেল, যাবার আগেও প্রায়ই বলত, “দিদিভাই ভোটে জিতে তুই নির্ভয়পুরের মানুষদের জন্য কাজ করবি।’ আসলে তোমাদের বড়ো আপন করে নিয়েছিল ছেলেটা। ওর আত্মার শান্তির জন্যই ভোটে জিতে তোমাদের জন্য কাজ করতে হবে আমায়। আমার ভাইকে দেওয়া কথা রাখতেই হবে। তোমরা আমার পাশে থেকো, শোকতপ্ত একজন দিদিকে জিতিয়ে দিয়ো। তোমরা ছাড়া আর এই নির্ভয়পুরে আর তো কেউই রইল না।”
সুনীলের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই চোখ টিপে বলেছিল, “কী গো, সব পারফেক্ট?”
নীহারের এমন আকস্মিক মৃত্যুর পর থেকেই সুনীলের ভয় করে পামেলাকে। ঘুমের মধ্যেই চমকে ওঠে। মনে হয়, এই বুঝি নীহারের মতো ওকেও সরিয়ে দেবে পামেলা। না, সুনীল শিওর নয় যে, পামেলাই নীহারকে খুন করিয়েছে, তবে ওর সিক্সথ সেন্স বলে, পামেলার হাত আছে এর পিছনে। নীহার বলেছিল, “দিদি খুন করালেও সেটাকে অ্যাক্সিডেন্টই মনে হবে সুনীলদা।’
পামেলা কালকে নিঝুম দুপুরে ওকে জড়িয়ে ধরেছিল। আগে পামেলার স্পর্শে ওর শরীর জেগে উঠত, ছাড়তে ইচ্ছে করত না পামেলার মাখন পেলব শরীরটাকে। কিন্তু গতকাল প্রথম পামেলার ছোঁয়ায় ওর শরীরে একটা শিরশিরে ভয় অনুভূত হল। চোখের সামনে বিষধর সাপ দেখলে যেমন হয়। কিন্তু সুনীল নিরুপায়, পামেলাকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। পামেলাকে ইগনোর করার শাস্তি বড়ো ভয়ানক
পামেলা বলল, “আরে সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে তুমি কী এত ভাবছ সুনীল? রংবুলে তুমি জিতছ। নির্ভয়পুরে আমি। এখন ছোটো খেলছি। এরপর এমএলএ, এমপি-র টিকিট পাব। পাওয়ার আমার খুব প্রিয়, জানো সুনীল। টাকার থেকেও বেশি প্রিয়। নীহারও আমার ভীষণ প্রিয় ছিল। কিন্তু পাওয়ারের থেকে বেশি নয়। তাই একটা ভুল সিদ্ধান্ত আমাদের এখন শেষ করে দিতে পারে। সুজয় ইস্যু চায়। কুন্তলীকে টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করানোর কথা ভুলেও ভেবো না। ও এখন সুজয়ের বিবাহিত স্ত্রী। সব কথা সুজয়কে বলবে। আমরা ওকে কেন টাকা দিতে গিয়েছিলাম, সেটা নিয়েই উত্তাল হবে সুজয়ের নেক্সট মিটিং। তাই বলছি সুনীল, তোমার ওই নরম মনটা আপাতত লুকিয়ে রাখো। এমন কোনও ভুল কোরো না, যাতে আমরা জেতা গেমটা হেরে যাই।”
সুনীল আমতা আমতা করে বলল, “বুঝেছি। তোমার সব পোস্টার রেডি ডিজাইনটা একবার দেখে নিলেই ছাপতে বলে দেব।”
পামেলা বলল, “হ্যাঁ দেখাও।”
সুনীল ফোনটা ওর সামনে ধরে বলল দেখো। পোস্টারে নীহারের ছবিতে একটা মালা পরাচ্ছে পামেলা। সাদা শাড়ি পরিহিতা পামেলার চোখেমুখে কষ্টের ছাপ। নিচে লেখা, ‘শোকতপ্ত এক দিদির পাশে থাকুন। এই চিহ্নে ভোট দিয়ে।’
ডিজাইনটা পামেলারই করে দেওয়া। সুনীল শুধু ডিজাইনার এক শিল্পীকে দিয়ে একটু ফিনিশ করিয়ে এনেছে।
পামেলা মুচকি হেসে বলল, “এই জন্যই তোমায় আমি এত ভালোবাসি সুনীল। আমি যা বলি, তুমি সবটা বুঝতে পারো।”
সুনীল বেশ বুঝতে পারছে, নির্বাচনে পামেলা হেরে গেলে সব আক্রোশ পড়বে ওর ওপরেই। মাঝে মাঝেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সেই পায়ে বল নিয়ে মাঠ দাপিয়ে বেড়ানো সুনীল সেনগুপ্তকে খুঁজে বেড়ায় ও। সহজ-সরল স্বপ্ন দেখা চোখ দুটো কবে যেন বদলাতে বদলাতে এতটাই বদলে গেল যে, চোখের দিকে তাকাতে ওর নিজেরই লজ্জা করে। এই চোখে শুধুই লোভ, পাপ, আর বিশ্বাসভঙ্গের কালো ছায়া দেখতে পায় ও। ঘুমের ঘোরেও এখন আর জেতার স্বপ্ন আসে না ওর, বরং কেউ একজন ওকে শেষ করে দিতে চাইছে এই স্বপ্নই দেখে
পামেলা বলল, “কুন্তলীকে শেষ করে দিয়ে সুজয়কে ফাঁসিয়ে দেওয়াও যায় অবশ্য। দেখো সেই রিস্কটা তুমি নিতে পারবে কি না?”
সুনীল চমকে উঠে বলল, “কী বলছ তুমি পামেলা? ওইটুকু একটা মেয়েকে খুন করাবে? তোমার কোনও কাজে আমি বাধা দিইনি। কিন্তু তাই বলে খুন?” পামেলা শীতল, কঠিন গলায় বলল, “পামেলা মিত্রর বদনাম হতে পারে যে যে ঘটনায়, সেগুলোকে আমি নিশ্চিহ্ন করে দিই সুনীল। তোমার যা মায়া দেখছি তাতে তোমায় দিয়ে হবে না। ব্যাপারটা আমাকেই দেখতে হবে।”
সুনীল আবার বলল, “প্লিজ পামেলা, তুমি এটা কোরো না। সন্তানসম্ভবা মেয়ে। সুজয় তো ওকে বিয়ে করে নিয়েছে। নীহারও নেই এই পৃথিবীতে। ও কার, কী ক্ষতি করতে আসবে বলো তো?”
পামেলা বলল, “সুনীল, বয়েসটা তো তোমার মন্দ হল না। বাচ্চাটা জন্মানোর পরে ও যে প্রমাণ করতে চাইবে না এটা মিত্র বংশের সন্তান, সেটা কে বলতে পারে? কারণ, পামেলা মিত্রর সম্পত্তির অধিকার চাওয়ার তো ওই একটাই রাস্তা। আমার সঙ্গে বাচ্চাটার ডিএনএ টেস্ট করিয়ে সহজেই প্রমাণ করে দেবে, ওটা নীহারের ছেলে ছিল। তারপর প্রপার্টি ক্লেম করবে ডিয়ার। তাই ওই বাচ্চাটাকে জন্ম নিতে দিলে হবে না বেবি। সে যা-ই হোক, ও ব্যবস্থা আমি করব। তুমি আগামিকাল প্রচারের ব্যবস্থা করো। আমি রংবুলে যাব তোমার হয়ে প্রচার করতে। কী, খুশি তো? মুখে হাসি নেই কেন?” পামেলা মুখে একটা আবেদনময়ী ভঙ্গিমা করে বলল, “যখন দেখি তোমার চোখে আমার জন্য আর আগ্রহ নেই, তখনই মনে হয় আমি বুড়ি হচ্ছি।”
সুনীল হেসে বলল, “আসলে সব কিছু নিয়ে একটু দুশ্চিন্তায় আছি গো। অনেক কাজ বাকি, এখন এলাম।”
পামেলাকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়েই সুনীল হন হন করে বেরিয়ে গেল।
পামেলা মনে মনে হেসে ফেলল। ধুর ধুর, ওর কপালেই কেন যে এমন নরম স্বভাবের পুরুষ জোটে কে জানে! শিরদাঁড়ায় জং ধরা পাবলিক। খুন, রক্ত শুনলেই সব প্যান্টে প্রস্রাব করে ফেলে। এর থেকে ঘোষাল অনেক স্টেডি পাবলিক। নেহাত বউটা হঠাৎ বিদ্রোহিনী হয়ে উঠেছে, তাই বেচারা একটু ঝিমিয়ে পড়েছে। ঘোষালকেই ডেকে পাঠাতে হবে। পামেলা ডাকলে অস্বীকার করবে এমন জোর ঘোষালের নারী-শরীরপ্রেমী বুকে এখনও তৈরি হয়নি।