ইতি নির্ভয়পুর – ২৮
২৮
“হ্যালো, আমি নূপুর মল্লিক কথা বলছি নির্ভয়পুর থেকে। আমি নির্ভয়পুর হাসপাতালের ডাক্তার। আপনি কি নিবেদিতা বসু বলছেন?”
নিবেদিতা ভয়ার্ত গলায় বলল, “কী হয়েছে শানুর? মানে, শৌনক বসু ভালো আছে তো?”
নূপুর একটু থেমে বলল, দেখুন ফিজিক্যালি শৌনক সুস্থই আছে। কিন্তু মানসিকভাবে ও একেবারেই ঠিক নেই। ফুলমণি বলল, প্রায় সাতদিন ধরে ভালো করে খাওয়া-দাওয়া অবধি করে না। প্রলয় বলছিল, কারণে-অকারণে রেগে যাচ্ছে। অদ্ভুত অস্থিরতা কাজ করছে ওর মধ্যে। আপনি তো শৌনকের মা, মা হয়ে এই সময় ওর পাশে নেই কেন?”
নিবেদিতা ধীর গলায় বলল, “আমি জানি না আপনি শৌনকের শুধুই কলিগ না বন্ধু, যদি বন্ধু হন, তা হলে একটা কথা বলতে পারি।”
নূপুর বলল, “আমি বন্ধু ভাবলেও, তিনি ভাবতে নারাজ। তবে আপনি বলতে পারেন নিশ্চিন্তে।”
নিবেদিতা বলল, “আমি ওর মা হয়তো আপনি জানেন।”
নূপুর মাঝপথে থামিয়ে বলল, “প্লিজ আন্টি, আমায় তুমি বলুন।”
নিবেদিতা বলল, “আমি এমন মা যার অধিকার নেই সন্তানের কাছে যাবার, তার পরিচয় দেবার। শৌনক বলে গেছে, আমরা যদি কোনওদিন ওর পরিচয় নিয়ে নির্ভয়পুরে যাই, তা হলে ও নিজেকে শেষ করে দেবে। এরপর কোনও বাবা-মা কি এটা করতে পারে? শুধু ভয় পেয়ে পেয়ে রয়ে গেছি এত বছর।”
নূপুর বলল, “আন্টি, শৌনক ভালো নেই। কিন্তু কিছুতেই সেটা স্বীকার করবে না। আমাকেও দূরে সরিয়ে দিয়েছে। এভাবে একা একা নিজেকে একটু একটু করে শেষ করছে। আমি দূরে দাঁড়িয়ে দেখছি। ঠিক কী করব, বুঝতেও পারছি না। খুব দুশ্চিন্তায় আছি। সেই কারণেই বাধ্য হয়ে আপনাকে ফোন করলাম।”
নিবেদিতা শান্তস্বরে বলল, “বুঝলাম। তুমি ওর কলিগও নও, বন্ধুও নয়। তার থেকে আরও অনেকটা বেশি। শোনো নূপুর, শৌনকের প্রিয় ফুল হল বেলফুল, প্রিয় রং হলুদ। আর ভীষণ পছন্দের খাবার বাড়িতে বানানো এগরোল, বেশি করে পেঁয়াজ দিয়ে। আর ও যখন সব থেকে বেশি রাগ করে কারও ওপরে, তখন সে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে কিছুক্ষণের মধ্যে রাগটা কমে যায়।”
নূপুর মুচকি হেসে বলল, “এত প্যাম্পার্ড চাইল্ডের আবার একাকিত্ব যাপনের শখ! আন্টি চিন্তা করবেন না, খুব তাড়াতাড়ি আমি এই গোঁয়ারকে একদম সোজা করে আপনার কাছে পাঠাব। বাই দ্য ওয়ে, আমার ওপরে রাগের কারণ, আমি বিজনেসম্যান অরুণাংশু মল্লিকের মেয়ে। আমার বাবার অনেক টাকা আছে, তাই আমি ব্রাত্য।”
নিবেদিতা বলল, “তোমার এই নম্বরে ফোন করলে তুমি আমায় শানুর খবর দেবে?”
নূপুর বলল, “স্বচ্ছন্দ্যে। আজ থেকে তুমি আর আমি দুজনে মিলে ওই ইগো সর্বস্ব মানুষকে সোজা করব।”
নিবেদিতা আলতো হেসে বলল, “আমি নিশ্চিন্ত হলাম। নির্ভয়পুরে শানুর খবর নেওয়ার কেউ একজন আছে জেনে। ভালো থেকো মা।”
ফোনটা কেটে নূপুর ভাবছিল, এমন মিষ্টি মা থাকতে অসভ্য ভদ্রলোক নিজেকে অনাথ বলে কোন সাহসে?
নূপুর হাসপাতালের আউটডোরে বসতেই দুজন পেশেন্ট এসে বলতে শুরু করল, “ডাক্তারবাবু আসেননি?”
নূপুর হেসে বলল, “কী হয়েছে আপনার? আমিও ডাক্তার, বলতে পারেন।”
কিন্তু সেই বয়স্ক ভদ্রলোক ও তার স্ত্রী আমতা আমতা করে বলল, “দিদিমণি আমরা জলপাইগুড়ি থেকে আসছি গো, শৌনক বসুকে দেখাব বলে। আমার বোনের অত বড়ো রোগ ঠিক করে দিয়েছেন ডাক্তারবাবু।”
নুপুর বলল, “তা হলে আপনারা ওয়েট করুন। ডাক্তারবাবু এখনও আসেননি।”
ওর কথা শেষ হবার আগেই হাসপাতালের নার্স হীরা বলল, “ম্যাডাম, ডাক্তারবাবু তো রাউন্ডে গেছেন। বলে গেছেন সেরকম কোনও পেশেন্ট এলে কল করে নিতে।”
নুপুর পরের পেশেন্ট দেখার ফাঁকে বলল, “তা হলে কল করে জানাও ওঁর পেশেন্ট এসেছেন।”
হীরা সংকোচের সঙ্গে বলল, “জানিয়েছিলাম ম্যাডাম। উনি বললেন, নূপুর মল্লিক যথেষ্ট এফিসিয়েন্ট ডাক্তার। পেশেন্টদের বলতে নূপুর মল্লিককেই দেখিয়ে নিতে। কিন্তু পেশেন্ট তো কিছুই শুনতে চাইছেন না। তা হলে কি উনি যেদিন বসবেন সেদিন আসতে বলব?”
নূপুর বয়স্ক মানুষগুলোর অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি কল করে বলো, নূপুর ম্যাডাম দুজন পেশেন্টকে দেখতে চাইছেন না। বলছেন, ওঁর নলেজের বাইরে।”
হীরা হেসে বলল, “ঠিক আছে ম্যাডাম।”
নূপুর মনে মনে ভাবছিল, হঠাৎ ওর এত প্রশংসা কেন? গত আট দিন তো ওর সঙ্গে যাতে কোনওভাবেই দেখা না হয় সেভাবেই হাসপাতালে চলাফেরা করেছে শৌনক। সামনাসামনি হলেও “মর্নিং” বলে চলে গেছে পাশ কাটিয়ে। কেন সেদিন যে খুব বড়ো মুখ করে বলেছিল, নূপুর মল্লিক শুধুই আমার বন্ধু। তো এটা কি বন্ধুর সঙ্গে আচরণ? আসলে শৌনক যেটা জানে না সেটা হল, একবার যাকে ভালোবেসে ফেলে মন, তাকে আচমকা বন্ধুত্বের তকমা দিয়ে সরিয়ে রাখা যায় না। তাকে বাদ দিতে হলে একেবারেই বাদ দিয়ে দিতে হয়। শৌনক জানে, ও নূপুরের সম্মুখীন হলে দুর্বল হয়ে পড়বেই। তাই ওকে এড়িয়ে চলছে এই ক’দিন। নূপুরও আগ বাড়িয়ে কথা বলতে যায়নি। অপেক্ষার ঘড়িতে দীর্ঘ দম দিয়েছে। ঘড়ির কাঁটা যত ঘুরছে, ততই অধৈর্য হচ্ছে শৌনক। প্রলয় বলছিল, হাসপাতাল থেকে এসে আজকাল আর ছবি তুলতেও বের হয় না। একলা একলাই ঘরের মধ্যে বইয়ের পাতা উল্টে যায়। মনোযোগ দিয়ে পড়ে না কিছুই। ফুলমণি কী রান্না করবে জিজ্ঞাসা করলে বলে, খিদে নেই, যা হোক কিছু করে দিতে। নূপুরের নিজেরও যে মন খুব ভালো আছে, তা নয়। কিন্তু ও নিজে জানে, ওর মনখারাপের কারণটা। শৌনককে মিস করছে, সেটা ও অস্বীকারও করে না। কিন্তু শৌনক মানতে নারাজ যে, সে নুপুরকে ভালোবেসে। সেই কারণেই নূপুর অপেক্ষার ঘড়িতে দম দিয়েছে। দেখছে, ঠিক কবে হার মানে শৌনকের জেদ।
নির্ভয়পুর হাসপাতালের পরিধি এতটাই কম যে, আউটডোরে একজন ডাক্তার থাকলে তার পাশের চেয়ারে বসেই অন্য ডাক্তারকে পেশেন্ট দেখতে হবে। নুপুরের পাশে এসেই বসল শৌনক। ওর দিকে তাকিয়ে সামান্য সৌজন্য বিনিময়ের ধার ধারল না। নূপুর মনে মনে হাসছিল। এতটা ছেলেমানুষি নিয়ে একজন মানুষ নাকি একাকিত্ব যাপনের স্বপ্ন দেখে। বয়স্ক স্বামী-স্ত্রীকে দেখার পর হঠাৎই বলল, “সাধারণ ভাইরাল ফিভারের ট্রিটমেন্ট করতে আপনার বাধা কোথায় ছিল মিস মল্লিক?”
নূপুর হেসে বলল, “সব বাধা কি সাদা চোখে দেখা যায় মিস্টার বসু? আসলে আপনার পেশেন্টদের ট্রিটমেন্ট করার অধিকার আমার নেই। অধিকারবোধ সম্পর্কে জ্ঞান কি শুধু আপনার একারই আছে? বাই দ্য ওয়ে, আজ সন্ধ্যার সময় চার্চের মাঠে একবার আসতে পারবেন? আমার একটু দরকার ছিল।”
শৌনক নূপুরের দিকে না তাকিয়েই বলল, “এখনই বলতে পারছি না।”
নূপুর হালকা গলায় বলল, “আমি অপেক্ষা করব, তবে না এলেও ক্ষতি কিছু নেই। আপনার যেমন ইচ্ছে।”