ইতি নির্ভয়পুর – ২৯
২৯
নির্ভয়পুরের আকাশে সন্ধে নামার তোড়জোড় চলছে। পলাশবনার চূড়ার পিছনে এখনই সূর্যটা টুপ করে ডুবে যাবে। রয়ে যাবে আকাশ লাল করা একটুকরো ওড়না। যেটা বেশ কিছুক্ষণ পশ্চিমাকাশকে জড়িয়ে রাখবে। নুপুরের বিশ্বাস, শৌনক আসবে। আজকের সবটুকু আয়োজন শুধু ওর জন্য। যদি না আসে তা হলে বুঝবে ও যেটাকে ভালোবাসা ভাবছিল, সেটাও ক্ষণিকের মোহ ছিল শৌনকের কাছে। চার্চের মাঠের এদিকটা তেমন লোকজন আসে না, অনুষ্ঠান না হলে। হঠাৎই চোখে পড়ল, সুজয়দা আর সুনীল-স্যার কিছু একটা বিষয় নিয়ে বেশ উত্তেজিত হয়ে আলোচনা করছে। বিষয়টা ঠিক কী বোঝার আগেই সুজয়দা হন্তদন্ত হয়ে চলে গেল।
একটু বোধহয় অন্যমনস্ক হয় গিয়েছিল নূপুর। তখনই ঠিক ওর পাশে বাইক থেকে নামল শৌনক। এসেই কাঠখোট্টার মতো জিজ্ঞাসা করল, “এখানে ডাকার কারণ?”
নূপুর বিরক্ত মুখে বলল, “ডাকলেই আসতে হবে, এমন মাথার দিব্যি তো দিইনি।”
শৌনক বলল, “তো ডাকলে কেন?”
নূপুরও জোর গলায় বলল, “কী আশ্চর্য! আমি ডেকেছিটা যদি দোষের হয়, তা হলে তোমার আসাটাও দোষের।”
শৌনক বলল, “বেশ, প্রয়োজন যদি না থাকে তা হলে আমি চললাম।”
নূপুর বলল, “প্রয়োজন নেই এটা তো আমি বলিনি। আমি শুধু বলছি, তার মানে নূপুর মল্লিকের আহ্বানকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা মিস্টার শৌনক বসু এখনও অর্জন করে উঠতে পারেনি। বাই দ্য ওয়ে, এই হলুদ চুড়িদারটায় আমায় কেমন লাগছে?”
শৌনক নুপুরকে ভালো করে দেখে বলল, “তুমি কি চুড়িদার দেখানোর জন্য আমায় এখানে ডেকেছিলে? তা হলে দেখা হয়ে গেছে। ভালো লাগছে।”
নুপুর হেসে বলল, “এই সুযোগে আট দিন পরে তুমিও আমায় ভালো করে দেখার সুযোগটা হাতছাড়া করলে না, তাই না?”
শৌনক রাগি গলায় বলল, “আমি কাউকে দেখতে চাই না। একলা আমি যথেষ্ট ভালো আছি।”
নুপুর হেসে বলল, “হ্যাঁ সে তো দেখতেই পাচ্ছি। কোনওসময় ইগো তোমায় বলছে, আমি জিতে গেছি। কোনওসময় তুমি ইগোকে বলছ, তুমি জিতে গেছ। একদম একলা নও, বলো ইগোর সঙ্গে বসবাস করছ। এনিওয়ে, এতক্ষণে হয়তো ঠান্ডা হয়ে গেছে, তবুও খেয়ে দেখো। ইউটিউব দেখে বানিয়েছি।” শৌনকের হাতে দুটো রোল ধরিয়ে দিয়ে নূপুর বলল, “খাও।”
শৌনকের রাগি রাগি ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটেছে ওর অজান্তেই। কথা না বলে কামড় দিয়ে চোখ বন্ধ করে বলল, “বাড়িতে বানালে? জাস্ট ফাটাফাটি। কতদিন পরে খেলাম।”
নূপুর তাকিয়েছিল ওর তৃপ্ত মুখটার দিকে। ছেলেমানুষি অভিমান জমেছে নাকের ডগায়। নিজের মনেই হেসে উঠল নূপুর। সাধারণত প্রেমিক, প্রেমিকার অভিমান ভাঙাতে সবরকম চেষ্টা করে, আর ওর ক্ষেত্রে উল্টো। ওকেই এই গোঁয়ার গোবিন্দকে বোঝাতে হচ্ছে, ভালোবাসা লুকোনো যায় না, প্রকাশ পেয়েই যায়।
রোল দুটো খেয়ে নিয়ে শৌনক বলল, “তোমার কই?”
নূপুর মুচকি হেসে বলল, “আজ গিনিপিগ তুমি ছিলে। ভালো হয়েছে বললে যখন তখন আর-একদিন বানিয়ে খাব।” শৌনকের হাতে টিস্যু দিয়ে নূপুর বলল, “কেমন আছ? খুব ভালো? মল্লিক বাড়ির মেয়ে জ্বালাতন করতে যাচ্ছে না আর তোমার কোয়ার্টারে, নিশ্চিন্ত যাপনে কেমন আছ?”
শৌনক মাটির দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি তো কাউকে যেতে বারণ করিনি। তোমার ইচ্ছে হয়নি তাই যাওনি।”
নূপুর হেসে বলল, “আমি তো শৌনক বসুর শুধুমাত্র বন্ধুত্বের পরিচয় নিয়ে ওই ঘরে যাব না। মল্লিক-বাড়ির মেয়ের পরিচয় নিয়েও যাব না। সবাইকে ফাঁকি দিলেও, নিভৃতে নির্জনে নিজের মনকে তো আর ফাঁকি দিতে পারি না। মন তো আমায় একবারও বলেনি, তুই শৌনকের শুধুই বন্ধু। যেদিন বলবে সেদিন নিশ্চয়ই যাব।”
শৌনক বলল, “তো এখন তোমার মন কী বলছে?”
নুপুর লাজুক গলায় বলল, “তুমি যে সম্পর্কটা জোর করে অস্বীকার করতে চাইছ, সেটাতেই সায় দিচ্ছে আমার মন। তবে ভালোবাসায় জোর চলে না। তাই তোমাকেও যে বাসতে হবে, এমন কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। কিন্তু তোমার একলা যাপনের মতো আমারও একতরফা ভালোবাসায় আশা করি কারওর আপত্তি থাকবে না।”
শৌনক বলল, “তোমার দাদার অসম্মান হবে না?”
নুপুর হেসে বলল, “একটাই তো জীবন, নিজেকে সুখী করব না অন্যকে? দাদাভাইয়ের জীবনে অস্মিতাদি আছে, কিন্তু নিরঞ্জনকাকুকে আমি ব্যক্তিগতভাবে একেবারেই অপছন্দ করি। তাই বলে কি ওদের বিয়েটা বন্ধ করে দিচ্ছে দাদাভাই? এই তো আর মাত্র দু’মাস পরেই ওদের বিয়ে। আমি দাদাভাইয়ের জীবনে ইন্টারফেয়ার করছি না, দাদাভাই করলে সেটা আমিও মানতে বাধ্য নই। সে যা-ই হোক, দাদাভাই, বাবা, মা বা আত্মীয়স্বজনের থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ যে মানুষটা, সে-ই যখন এই সম্পর্কে জড়াতে চায় না, তখন আনুষঙ্গিক বিষয় নিয়ে আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। ওহ তোমায় ডেকে এনে এতক্ষণ সময় নষ্ট করার জন্য দুঃখিত। তুমি এসো শৌনক। এই নাও, এটাও এনেছিলাম তোমার জন্য।”
শৌনক বলল, “আমি কোনও উপহার নিতে পারব না।”
নূপুর নিজের চোখের জল লুকিয়ে বলল, “তেমন দামি কিছু নয়। এর দামটা না হয় কাল হাসপাতালে দিয়ে দিয়ো। তা হলে তো আর উপহার নেওয়া হল না। কিন্তু তোমার নাম করে এনে, ফেরত নিয়ে যাই কী করে?”
নূপুর লাল ভেলভেটের ব্যাগটা শৌনকের হাতে ধরিয়ে দিয়ে স্কুটিতে উঠে স্টার্ট দিতে দিতে বলল, “এত দুশ্চিন্তা কোরো না, আমি কিছু পাবার লোভে তোমায় ডাকিনি আজ। এমনি অকারণেই।”
চলে গেল নূপুর।
সন্ধ্যা নেমেছে নির্ভয়পুরে, চার্চের ঘড়িতে ঢং ঢং করে ছ’টা বাজল। নূপুর চলে যেতেই বুকের মধ্যে মুচড়ে উঠল শৌনকের। অদ্ভুত এক শূন্যতা যেন আবার গিলে খেতে আসছে ওকে। নূপুর এতদিন আকারে-ইঙ্গিতে বুঝিয়েছিল নিজের মনের কথা। আজ জলের মতো পরিষ্কার স্বীকার করল, ও শৌনককে ভালোবাসে। এর থেকে স্পষ্টভাবে বলা সম্ভব নয়। ভালো তো শৌনকও বাসে ওকে। কিন্তু মল্লিকরা যখন জানবে ও পিতৃপরিচয়হীন, তখন কি আদৌ মেনে নেবে ওকে? নুপুরই কি মানতে পারবে? শৌনক নিজেই তো মেনে নিতে পারেনি সত্যটাকে। শোভন বসু আর নিবেদিতা বসু যে ওর বায়োলজিক্যাল পেরেন্টস নয়, এটা ও জেনেছে মাত্র বছর পাঁচেক আগে।
তার আগে পর্যন্ত বসু বাড়ির সন্তান বলে গর্ব কম ছিল না ওর। ওর জীবনের এত বড়ো একটা সত্যিকে কেন লুকিয়ে রেখেছিল শোভন আর নিবেদিতা? শৌনকদের স্কুলে অরিত্র নামের একটা ছেলে ছিল। অরিত্র নিজে জানত সে অ্যাডপটেড। তাই এটা নিয়ে ওর কোনও সমস্যাই ছিল না। ছোটো থেকে এটা জেনেই ও বড়ো হয়েছে। কিন্তু শৌনককে আসল সত্যটা জানানোই হয়নি। একটা মিথ্যের ঘেরাটোপে বড়ো হয়েছে ও। শৌনককে সকলে বলত, ও নাকি নিবেদিতার মতো দেখতে হয়েছে। শৌনক বিশ্বাসও করত সে কথা। কখনও ভাবতেই পারেনি, ওর বাবা-মা এভাবে মিথ্যের পর মিথ্যে বলতে পারে। না, শোভন বসু এর বায়োলজিক্যাল ফাদার নয় বলে শৌনকের রাগ নেই, রাগ ওদের মিথ্যে বলাতে। এতগুলো বছর কাটিয়ে ফেলল নির্ভয়পুরে, কিন্তু আজও শৌনক জানতে পারল না কে ওর আসল বাবা, মা। নিবেদিতা বলেছিল, শৌনকের মা নাকি জমজ বাচ্চা প্রসব করেছিল। কিন্তু নির্ভয়পুরে ওর মতো দেখতে তো কেউই নেই। এতদিনের চেষ্টায় ও জানতেও পারেনি কিছুই। এখানের পুরোনো লোকজনও বলতে পারেনি ওই সময় কে যমজ বাচ্চা প্রসব করেছিল। এমনকী, হাসপাতালের যাবতীয় পুরোনো ডকুমেন্টও খুঁজেছিল শৌনক। কিছুই খুঁজে পায়নি। ওর ধারণা, শোভন আর নিবেদিতা সবই জানে, ইচ্ছে করেই ওর বাবা-মায়ের নামটা বলেনি। নিবেদিতা বসু বলেছিল, শৌনকের মা নিজেই নাকি একটা সন্তানকে ওর হাতে তুলে দিয়ে বলেছিল, নিয়ে যাও এখান থেকে। এখানে থাকলে ওকে মেরে ফেলবে। কে মেরে ফেলত ওকে? আদৌ কি নিবেদিতা বসু ওকে সত্যি বলেছিল? না কি পুরোটাই সাজানো? ডেলিভারির সময়েই শৌনককে লুকিয়ে ফেলেছিল? নিজের মা হতে না পারার অক্ষমতা ঢাকতেই কি এমন কাজ করেছিল দুই ডাক্তার মিলে? মেডিকেল ক্যাম্পের নাম করে সদ্যোজাতকে চুরি করে পালিয়েছিল হয়তো। বিশ্বাস করে না শৌনক ওদের। যারা একটা মিথ্যে বলতে পারে, তারা অনেক মিথ্যে বলতে পারে। শৌনক চার্চের দিকে তাকিয়ে বসেছিল। অনেক পরিচিত মুখকেই দেখছিল, হাতে মোমবাতি নিয়ে ঢুকছে চার্চে। কী বলে মানুষ প্রভু যিশুর কাছে? নিজের অপরাধ স্বীকার করে? তা হলে তো শৌনকও অপরাধী। নূপুরকে তীব্রভাবে ভালোবাসার পরেও সেটা স্বীকার না করাও তো এক ধরনের অপরাধ। নূপুরের মনে কষ্ট দেওয়াও তো অপরাধ। তা হলে তো ওর উচিত চার্চে গিয়ে সব সত্যি স্বীকার করে ক্ষমা চাওয়া। হাতের মধ্যে নূপুরের দেওয়া উপহারটা। লাল ভেলভেটের গয়নার ব্যাগটা জানান দিচ্ছে, এতে কোনও মহামূল্যবান দামি বস্তুই আছে। কাল হাসপাতালে গিয়ে আগে এটা নূপুরকে ফেরত দিতে হবে। পিতৃপরিচয়হীন ছেলেকে নূপুর মেনে নেবে কি না সেটা আগে জানতে হবে। ওর বার্থ সার্টিফিকেট থেকে আধার কার্ড সবেতে শোভন বসু আর নিবেদিতা বসুর নাম। নিজেকে অনাথ বললেও, মেনে নেবে না কেউ। আর শোভন বসু তো বলেই দিয়েছে, শৌনক আমায় স্বীকার না করলেও আমিই ওর বাবা। হ্যাঁ মেনে নেবে শৌনক, কারণ শোভন আর নিবেদিতার মতো ভালো এ পৃথিবীতে ওকে আর কেউ বাসবে না। কিন্তু ওদের বলা কথাটা যদি সত্যি হয়, যদি সত্যিই শৌনকের গর্ভধরিণী ওকে কোনও বিশেষ কারণে নিবেদিতার হাতে তুলে দিয়ে থাকে, তা হলে বিনাবাক্যব্যয়ে ও ফিরে যাবে ওর নিজের বাড়ি কলকাতাতে। কিন্তু সেই সত্যটা ওকে বলবে কে?
অন্যমনস্কভাবেই শৌনক ভেলভেটের ব্যাগটা খুলে ফেলল। ভিতর থেকে বেরিয়ে এল একটা সেলোফেন পেপারে মোড়া প্যাকেট। প্যাকেটটা ছিঁড়তেই এক মুঠো টাটকা বেলফুল। নাকের কাছে নিয়ে যেতেই মা মা গন্ধটা পেল শৌনক। ছোটোবেলায় রোজ ঘুম থেকে উঠে দেখত, মা ওর ঘরের টেবিলে কাচের বাটিতে জল দিয়ে অনেকগুলো বেলফুল রেখে দিয়েছে। সেই হাতেই মা ওর চুলের মধ্যে বিলি কাটতে কাটতে বলত, “শানু উঠে পড়। টিউশন আছে তো।” সেই থেকেই শৌনকের মনে হত, মায়ের গায়ের গন্ধ আর বেল ফুলের গন্ধ একদম এক। ওর খুব প্রিয় ফুল। কিন্তু এত কথা নূপুর জানল কী করে? হলদে রঙের চুড়িদার, বাড়িতে বানানো রোল, এখন উপহার হিসেবে বেলফুল! যেভাবেই জানুক আজ বহুদিন পরে মনটা বড়ো হালকা হয়ে গেছে ওর। নূপুরকে এভাবে আঘাত করাটা ঠিক হয়নি। বাইকটা নিয়েই ও চার্চের দিকে এগোল। চার্চ প্রায় ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। দু’-একজন চুপচাপ বসে আছ চোখ বন্ধ করে।
ফাদার ওকে দেখেই হাসলেন। ওকে কাছে ডেকে বললেন, “তুমি হচ্ছ মানুষের চোখে জীবন্ত ভগবান। নির্ভয়পুরের মানুষদের জীবন ফিরিয়ে দাও।”
শৌনক বলল, “ফাদার আমি তিনজন মানুষকে কষ্ট দিচ্ছি। না ইচ্ছাকৃত নয়, আমার মনের দ্বন্দ্বই ওদের যন্ত্রণার কারণ। আমি জানি ফাদার, তারা আমায় ভালোবাসে। কিন্তু তারপরেও আমি স্বাভাবিক থাকতে পারছি না একটা বিশেষ কারণে।”
ফাদার শৌনকের কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, “তুমি বড়ো অস্থির হয়ে আছ ডাক্তার। সুস্থ হয়ে বসো। আমি তোমার সব কথার উত্তর দেব।”
শৌনক কিছু বলার আগেই হন্তদন্ত হয়ে ঢুকল সুজয়। ভনিতা না করেই বলল, “ফাদার, এখুনি খবর পেলাম পামেলা মিত্র কুন্তলীকে খুন করে দেবে। লোক লাগিয়েছে। সুনীল-স্যার লুকিয়ে এসে খবরটা দিয়ে গেল।”
ফাদার বললেন, “সুজয়, তুমি কুণ্ডলীকে নিয়ে আজকের রাতটা আমার ঘরে এসে থাকো। কাল সকালে একটা ব্যবস্থা করা যাবে। ভোট তো পরশু। ভোটের আগে এসব ঘটাতে চাইবেই পামেলা।”