ইতি নির্ভয়পুর – ৩
৩
“আরে শুনলাম তো মল্লিকের নাকি রাত থেকে বুকে ব্যথা উঠেছিল। আমাদের ডাক্তারই নাকি ভর্তি করার কথা বলেছিল। স্টেন্ট বসাতে হবে শুনলাম তো।”
নির্ভয়পুরের সীমানা শেষ হয়ে যেখানে রঙ্গিত নদীর বাঁধ শুরু হয়েছে সেই মনোরম জায়গায় বাঙালি উচ্চবিত্তরা নিজেদের মনোরঞ্জনের জন্য একটা ক্লাব বানিয়েছে। ক্যারম থেকে ব্যাডমিন্টন, কী নেই সেখানে? একমাত্র ক্লাব মেম্বারদের পরিবারের লোকজনেরাই এন্ট্রি পায় এখানে। অবশ্য ‘গ্রিনভ্যালি’ ক্লাবের কর্মী হিসেবে জনা পনেরো আদিবাসী কাজ পেয়েছে এখানে। সে ক্ষেত্রে দেখতে গেলে কর্মসংস্থান হয়েছে কয়েকজনের। নির্ভয়পুরের মতো অনুন্নত জায়গায় এসব বাঙালিরা এসে বসবাস করছে, ব্যবসা করছে বলেই এখানের মানুষজন কাজকর্ম পাচ্ছে। যদিও নির্ভয়পুরের ভূমিপুত্ররা মোটেই ভালো চোখে দেখে না এদের। এরা মনে করে, ওদের মাটি দখল করে আছে এরা। তাই মনে মনে বিদ্বেষ একটা রয়েই গেছে। চা-বাগানের কর্মীরা বারবার বিক্ষোভ দেখিয়েওছে। কিন্তু অভাবের সংসারের পেট ভরা খিদের কাছে প্রতিবাদী সত্তা বারবার হেরে গেছে। আজও ক্লাবের বারে ড্রিঙ্ক বানাতে বানাতে শুনছিল কুন্তলীবাবুদের আলোচনা। মদ খেয়ে মাতাল হয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথাই এরা বলে ফেলে বেখেয়ালে। কুন্তলী সব মনে গেঁথে রাখে। সবটুকু গিয়ে বলতে হবে সুজয়কে। কুম্ভলী জানে না সুজয় ওকে ভালোবাসে কি না, ওকে বিয়ে করবে কি না, শুধু জানে ও ভালোবাসে সুজয়কে। সুজয় যখন শ্রমিকদের হয়ে লড়াই করে, মাইক নিয়ে বক্তৃতা দেয় তখন কুন্তলীর ইচ্ছে করে ছুটে গিয়ে সুজয়ের বুকে মাথা রাখতে। সুজয় ঠিক কী চায় এটা বুঝতে পারে না কুন্তলী, তবে এটুকু বোঝে, সুজয় নির্ভয়পুরের মানুষকে ভালোবাসে, ডাক্তারবাবুর মতোই।
সুজয় হাঁসদার সঙ্গে কুন্তলীর পরিচয় হয়েছিল একটু নাটকীয়ভাবেই। নির্ভয়পুর ছোটো জনপদ। এমন কিছু বড়ো শহর নয় যে এ প্রান্তের লোক ও প্রান্তের লোককে চিনবে না। নির্ভয়পুরের পাড়াগুলোও বড়োই ছোট ছোট। তারই মধ্যে পাশের গ্রাম রংবুল নির্ভয়পুর পঞ্চায়েতের মধ্যে পড়লেও নিজেকে বেশ আধুনিক করে নিয়েছে। কিন্তু নির্ভয়পুরের আদি মানুষগুলো কিছুতেই নিজেদের আধুনিক সাজে সাজাতে চায় না। তাই কুম্ভলীর কাছেও অপরিচিত ছিল না সুজয়। নির্ভয়পুরের লোকজন একটা দরখাস্ত লিখতে গেলেও ছোটে সুজয়ের কাছে। সুজয়ের বাবা জবুথবু, আর মা-টা কেন যে অমন উদাস হয়ে বসে থাকে কেউ জানে না। অল্পবয়সে সুজয়ের মা হাসিনী যে দেখতে অপরূপা ছিল সেটা এখনও বেশ বোঝা যায়। টানা চোখ দুটোতে যেন রঙ্গিত নদীর উদাসীনতা। সুজয়ের বাবাটা কথা নেই বার্তা নেই, “নষ্টা মেয়েমানুষ’ বলে প্রায়ই মারত মা-টাকে। একদিন কলেজ থেকে ফিরে সুজয় নিজের বাপকে ধরে এত মেরেছিল যে, বাপটা অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল বেশ কিছুক্ষণ। খুব শক্ত জান, তাই সেবারে বেঁচে গিয়েছিল। তারপর থেকে আর কোনওদিনই ওর মায়ের গায়ে হাত তোলার বা জোরে কথা বলারও সাহস পায়নি সুজয়ের বাপ। সুজয় নিজে লেখাপড়া করে অনুপমা টি-এস্টেস্টে চাকরি নিয়েছিল। ওই চা কারখানা থেকেই সেদিনও সন্ধে করে ফিরছিল সুজয়। পথে কুত্তলীদের ঘরের সামনের উঠানে মেয়েটা দাঁড়িয়ে ছিল ভূতের মতো। আলো-আঁধারিতে ভালো চিনতে পারেনি সুজয়।
তবুও জোরেই বলেছিল, “কে রে ওখানে? কী মতলব?”
কুত্তলী ভয়ে ভয়ে বলেছিল, “আমার মাকে একবার ওঝার বাড়ি নিয়ে যেতে হবে। ভূতে পেয়েছে।”
সুজয় বলেছিল, “কোথায় তোমার মা?” মাকে দেখেই বলেছিল, “একে নিয়ে ডাক্তারখানায় যেতে হবে।”
সুজয় একটা ঠেলা ভ্যানে চাপিয়ে সোজা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে গিয়েছিল। কুন্তলীও ছুটেছিল পিছন পিছন। তখন এই নতুন ডাক্তারের সঙ্গেও দেখা হয়েছিল ওর।
কুণ্ডলীকে ধমকে থামিয়ে সুজয় বলেছিল, “চুপ করে ভ্যানে বসো। তোমার মায়ের প্রবল জ্বর এসেছে। তাই ভুল বকছে। ভূতে ধরেনি। চিকিৎসা দরকার।”
এ ঘটনা প্রায় বছর চারেক আগের। ডাক্তারবাবুর দশটা ট্যাবলেটেই কুন্ডলীর মায়ের জ্বর কমেছিল।
তারপর কুণ্ডলী একদিন গাছের বেগুন নিয়ে সুজয়ের হাতে দিয়ে বলেছিল, “এই নাও তোমার জন্য।”
সুজয় ওর দিকে চোখ সরু করে তাকিয়ে বলেছিল, “তোমার তো বাবা নেই। মা চা খেতে কাজ করে। লজ্জা করে না বাড়িতে বসে মায়ের ইনকামে খেতে?”
অপ্রস্তুত কুন্তলী কী বলবে বুঝতে না পেরে বলেছিল, “কী কাজ করব আমি? আমার যে বুকের ব্যামো আছে।”
বেশি পরিশ্রমের কাজে কুন্তলীর হাঁপ ধরে।
সুজয় একটু ভেবে বলেছিল, “বিদেশি মদে বরফ দিয়ে সাজিয়ে দিতে পারবে?” কুন্তলী অপলক তাকিয়ে খানিকটা অবাক হয়েই বলেছিল, “কাকে দেব মদ?”
সুজয় বিরক্ত মুখে বলেছিল, “ভদ্দরলোকদের। যারা আমাদেরই বাবা-দাদুর জমি দখল করে নির্ভয়পুরের রাজা সাজে তাদের। পারবে?”
ঠিক তখনই পাহাড়ের ঢাল বেয়ে সূর্যদেব অস্ত গিয়েছিল। বাড়িমুখো সূর্যদেবের যেন বড্ড তাড়া। বাড়িতে বোধহয় কেউ আছে অপেক্ষা করে। কুত্তলী ওই সিঁদুর রঙের আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবে, একদিন ঠিক অমন রঙের বেনারসি পরে ওর বিয়ে হবে। ওকে চুপ করে থাকতে দেখেই * কনো পাতায় আওয়াজ তুলে সুজয়ে সাইকেলের প্যাডেলে পা দিয়েছিল
কুন্তলী অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা না করেই ডেকেছিল, “সুজয়।”
সাইকেল থেকে মাটিতে পা রেখে সুজয় বলেছিল, “হ্যাঁ বলো।”
কুন্তলী নির্দ্বিধায় বলেছিল, “তুমি যা করতে বলবে, করতে পারব।”
সুজয় হেসে বলেছিল, “বেশ, কাল একটু সেজেগুজে থেকো। নিয়ে যাব কারখানা ফেরত এক জায়গায়।”
কুম্ভলীকে দেখতে মন্দ নয় বলে আর পাঁচটা লোক। মাকে এসে বলে মেয়ে তো দেখতে ভালোই, বিয়ে দিয়ে দাও। না অসহায় গলায় বলে, “বাপ মরা মেয়ে, আমি বাগানের কুলি। কে বিয়ে করবে ও মেয়েকে?” কুন্তলী আয়নার সামনে দাঁড়িয়েও দেখেছে, দেখতে তাকে মন্দ নয়। আয়না কেন মিথ্যে বলবে? আয়না কি ওর শত্রু না কি? তবে আয়নায় লেগে থাকা ওই অবাধ্য দাগগুলো ওর শত্রু তো বটেই। মুখটাও ঠিক করে দেখতে পায় না কুন্তলী। মায়ের কাছে অনেক বায়না করেছিল একটা বড়ো আয়না কিনে দিতে, মা দেয়নি। বলেছে, “পেটে জোটে না, আবার মুখ দেখবে!” বাজারের শেষপ্রান্তে কিষানকাকার দোকানে কত বড়ো বড়ো আয়না সাজানো আছে। শুধু মুখ নয়, গোটা কুন্তলী ধরা পড়বে সেই আয়নায়। কুন্তলী বাজার থেকে জিনিস কিনে আসার সময় ইচ্ছে করেই কিষানকাকার দোকানের সামনে থেকে ঘুরে আসে। একবার ওই আয়নায় নিজেকে পরিষ্কার দেখে আসে। নিজের গোটা শরীরটা আয়নায় দেখে ওড়নাটা ভালো করে জড়িয়ে নেয় কুন্তলী নরম লজ্জায়। একটু যেন শিরশির করে ওঠে স্তনবৃত্ত দুটো। কুড়ি বছরের কুন্তলীকে মা কোথাও যেতে দেয় না। শুধু বলে, “সোমত্ত মেয়ে, কার না কার নজর পড়বে, তারপর সর্বনাশ হয়ে যাবে।” সুজয় ওকে আগামিকাল সেজেগুজে থাকতে বলার পর থেকেই আয়নার ওই ছোপ ছোপ দাগগুলো দেখে বেশি রাগ হচ্ছে। যদি কোনও কাজ পায়, তা হলে তার মাইনে দিয়ে প্রথমেই ও একটা বড়ো আয়না কিনবে। তখন তো আর মা ওকে বকতে পারবে না। কিন্তু এই যে মাকে না বলেই ও সুজয়ের কথাতে রাজি হয়ে গেল, মা শুনলে কি আদৌ যেতে দেবে? মনের মধ্যে একটা অজানা আতঙ্ক এতক্ষণে কাজ করছে কুত্তলীর। মদের মধ্যে বরফ দিয়ে গ্লাসে ঢেলে কাদের দিতে হবে ওকে? সেই মাতালরা যদি ওর ইজ্জত নিয়ে টানাটানি করে, তখন?
এ প্রস্তাবে মা কিছুতেই রাজি হবে না। তবে মাকে ওই দিন ডাক্তার দেখিয়ে সুস্থ করার পর থেকেই মা সুজয়কে একটু অন্য চোখে দেখে। বলে, “অমন মাতাল বাপের এমন শিক্ষিত ছেলে যে কী করে হয়!” সুজয় বলেছে বললে যদি একমাত্র রাজি হয়। কুত্তলী সেদিন ঘর-বার করছিল। মা ফিরলেই বলতে হবে বিষয়টা। মা ঢুকেই স্নান করে প্রতিদিন। কাজ থেকে ফিরে মা ঘরে ঢোকার আগেই বলে, “কুত্তলী জামা-কাপড় দে।” আজ মা ঢুকে দুয়ারে বসে পড়ল। কুন্তলী ঘর থেকে মায়ের পোশাক হাতে দাঁড়িয়ে বলল, “বসলে যে, শরীর ঠিক আছে?” মা কুন্তলীর দিকে তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ রে, তুই সুজয়কে বলেছিস তুই চাকরি করতে চাস? তুই তো বাড়ির কাজটুকুই কষ্ট করে করিস। হাঁপ ধরে বুকে। তারপর চাকরি কীভাবে করবি? তারা কি তোকে বসিয়ে বসিয়ে মাইনে দেবে? সুজয় গিয়েছিল আমার কাছে। বলল, অল্প খাটুনির কাজই নাকি ঠিক করেছে তোর জন্য। মাইনে তো বেশ ভালো শুনলাম।” কুন্তলী বুঝল, সুজয়ের দায়িত্বজ্ঞান অনেক। শুধু কুন্তলীকে রাজি করিয়েই সে ক্ষান্ত হয়নি। মায়ের পারমিশন অবধি নিয়ে নিয়েছে। মা চানঘরে যেতে যেতে বলল, “তবে ছেলেটার ওপরে আমার বিশ্বাস আছে। সে খারাপ কিছু করবে না।” মায়ের মুখে সুজয়ের প্রশংসা শুনে সেদিন খুব নাচতে ইচ্ছে করেছিল কুন্তলীর। কেন সেটা ও নিজেও জানে না। কুন্তলী যখন বছর আটেকের, তখন ওর ড্রাইভার বাবা মাঝরাতে প্যাসেঞ্জার নামিয়ে বাড়ি আসত। কুত্তলীর মাথার কাছে এক মুঠো লজেন্স রেখে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিত। বাবার ছোঁয়ায় ঘুমটা পাতলা হয়ে যেত কুন্তলীর। চোখ পিটপিট করে বাবার হাতটা একবার ছুঁয়ে আবার পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ত কুন্তলী। সকালে উঠে মাথার কাছে লজেন্সের প্যাকেট দেখে বুকের মধ্যে এক অজানা আনন্দ হত। সে আনন্দ কাউকে কোনওদিন বোঝাতে পারেনি ও। যেহেতু নির্ভয়পুর পুরো সমতল এলাকা নয়। ছোটো-বড়ো পাহাড় আছে এখানে, তাই মেঘ-বৃষ্টির খেলা চলতেই থাকে। কাজে বেরোনোর সময় আচমকা বৃষ্টি এলে সকলে বিরক্ত হয়, কিন্তু কুন্তলী মনে মনে বড়ো খুশি হয়। সে খুশির কথাও কোনওদিন কাউকে বলতে পারেনি ও। আজও এমনিই এক অজানা আনন্দে মনটা ভরে গেল। এ আনন্দের কথাও কাউকে বলতে পারবে না কুন্তলী। পরদিন বিকেলে একটা চা-পাতা রঙের চুড়িদার পরে, কপালে ছোট্ট কালো টিপ পরে, চোখের কোণে কাজল লাগিয়ে অস্থির হয়ে বারবার আয়না দেখছিল ও। কান খাড়া করে রেখেছিল বাইরে সাইকেলের বেলের আওয়াজ শোনার জন্য। ক্রিং ক্রিং বেল বাজিয়ে সুজয় এসে দাঁড়িয়েছিল ওদের দরজার সামনে। ছুটে বেরিয়ে এসেছিল কুন্তলী।
ওকে একবার আপাদমস্তক দেখে সুজয় বলেছিল, “এমন সেজেগুজে থাকতে পারো না? অমন পাগলি সেজে বসে থাকো কেন বাড়িতে?”
কুন্তলী লজ্জা পেয়ে বলেছিল, “অত ভালো ভালো পোশাক পাব কোথায়? আছেই তো হাতে গুনে দুটো-তিনটে।”
সুজয় বলেছিল, “এবারে কিনবে, ভালো পোশাক তো পরতেই হবে। বড়োলোকদের ক্লাবে কাজ করবে, যেমন তেমন গেলে বাবুদের মানে লাগবে যে!”
কুম্ভলী জানে না, বাবুদের ওপরে সুজয়ের কেন এত রাগ। বড়োলোক, ভদ্দরলোক কথাগুলো উচ্চারণের সময় ওর চোয়াল শক্ত হতে দেখেছিল কুন্তলী। এদের চা জমিতে কাজ করেই ওদের মা-মেয়ের পেট ভরে। তাই এঁদের ওপরে ওর কোনও রাগ নেই।
কিন্তু সুজয়কে মোড়ের মাথায় মাইক নিয়ে বলতে শুনেছে, আমাদেরই জমিতে দাঁড়িয়ে আমাদের শোষণ করলে সব জ্বালিয়ে দেব। সুজয়ের এইসব শক্ত শক্ত কথার মানে বোঝে না কুম্ভলী। শুধু জানে, সুজয় এই নির্ভয়পুরের সবাইকে তার হক পাইয়ে দিতে চায়।
সুজয় ধমকে বলেছিল, “হাঁ করে কী ভাবছ? তাড়াতাড়ি ওঠো সাইকেলে।” কুন্তলী সাইকেলের কেরিয়ারে না বসে রডে উঠে বসেছিল। হ্যান্ডেলে ওর হাতের পাশেই ছিল সুজয়ের বলিষ্ঠ হাতদুটো। সুজয় অনেক কথা বোঝাতে বোঝাতে যাচ্ছিল। কুণ্ডলী অর্ধেক শুনছিল, অর্ধেক নয়। কারণ সুজয়ের গায়ের ঘেমো পুরুষালি গন্ধটা তখন ওকে অবশ করে রেখেছিল। লোকে বলে, সোমত্ত মেয়েদের শরীরে নাকি চুম্বকের মতো টান থাকে। কিন্তু কুত্তলীর তো মনে হচ্ছে জোয়ান মরদের গায়ের গন্ধেও মাতাল করার শক্তি থাকে।
সুজয় ধমকে বলেছিল, “এই কুন্তলী, তোমাকে কি আমি ওখানে পদ্য লেখার জন্য নিয়ে যাচ্ছি? এত কী ভাবছ? শুনছ না আমার কথা? ওখানে মল্লিকবাবু থাকবে, সমাদ্দারবাবু থাকবে আর থাকবে ট্রান্সপোর্টের ব্যবসা করা ঘোষালবাবু। এরা তিনজন তোমার দেখে তবে চাকরি দেবে। ঘোষালবাবুর ট্রান্সপোর্টের গাড়িই চালাত তোমার বাবা। যেহেতু তোমার বাবা অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে কাজ করতে করতে, তাই তোমার একটা চাকরির ব্যবস্থা করা কর্তব্য ছিল ঘোষালেরই। কিন্তু তোমার মাকে অল্প কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে দায় সেরেছে। আমি সব খোঁজ নিয়ে তবে নেমেছি। যখন বলবে ‘কাজটা পারবে তো?” বলবে, “বাবাও তো আপনাদের কাজ করতে করতেই জীবন দিল, আমি কেন পারব না? বেইমানি রক্তে নেই, তাই ওসব থানা-পুলিশ করতে যাইনি, যাবও না। কাজটা হলে মায়ের পাশে দাঁড়াতে পারব।’ বুঝলে?”
সংবিৎ ফিরে পেয়ে কুন্তলী দম দেওয়া পুতুলের মতো ঘাড় নেড়ে বলেছিল, “হ্যাঁ বুঝেছি।”
নির্ভয়পুরে যে এমন একটা ঝকঝকে রাজপ্রাসাদের মতো ক্লাব আছে, ধারণাও ছিল না কুত্তলীর। গেট দিয়ে ঢুকেই বিশাল একটা গোলাপের বাগান। বাগানের পাশে ফোয়ারা। আর-একপাশে সাঁতারের জায়গা। সুজয় বলেছিল, “ওটা হল সুইমিংপুল। ওদিকে ব্যাডমিন্টন, ক্রিকেট খেলার জায়গা আছে। ওই যে মাথায় ছাতাওয়ালা টেবিলগুলো দেখছ, ওখানে বসেই লনপার্টি হয়। খানা-পিনা চলে বাবুদের।” কুন্তলীর চোখে অপার বিস্ময়। এদিক দিয়ে যাতায়াত করেনি এমন নয়। কিন্তু গেটের বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই ভিতরে এমন রাজকীয় ব্যাপার। কুন্তলী ভাবছিল, মানুষের কত টাকা থাকতে তবে এমন বাড়ি বানাতে পারে। ওদের একটা পাকা বাথরুম করার সামর্থ্য নেই।
সুজয় বলল, “এ কার জমি জানো? আমাদের পাড়ার ফুলমণির বাবার। মদ গিলে ফুলমণির বাবা নিজের সব জমি লিখে দিয়েছিল ঘোষালকে। যে ফুলমণি ডাক্তারের ঘরে রান্না করে। এত এত সমতল জমি লিখে দিয়েছিল মাত্র কুড়ি হাজার টাকায়। ভাবতে পারো, কেমন ঠকিয়েছে! এর বদলা নিতে হবে আমাদেরই। ছাড়ব না কুন্তলী, আমাদের হক কেড়ে নিয়েছে এরা আমাদের বোকা পেয়ে। নির্ভয়পুরে জায়গার দাম যত কমই হোক, এ জায়গার বর্তমান দাম কত জানো কুন্তলী? এর দাম অন্তত কোটি টাকা। ফুলমণি আজ লোকের ঘরের রাঁধুনি। কেন যে নির্ভয়পুরের লোকজন এত বোকা হল কে জানে! বোঝালেও এরা বোঝে না। ভাবে, বাবুদের দুয়ারে কাজ করে পেট চলে তাই এরা ভগবান। কিছুতেই বোঝাতে পারি না, এত সস্তায় কুলি, শ্রমিক এরা কোথাও পাবে না বলেই এখানে এসেছে। কেউ বোঝে না কুন্তলী। তুমি অন্তত বুঝো। নিজের অধিকার নিজেকেই কেড়ে নিতে হয়।”
কুন্তলীর চোখ তখন সুইমিংপুলের জলে। দুটো ছেলেমেয়ে প্রায় উলঙ্গ হয়ে সাঁতার কাটছে। ইস, ওদের লজ্জা করছে না? কথাটা বোধহয় মুখ ফসকেই বেরিয়ে গিয়েছিল কুন্তলীর।
সুজয় সেদিকে তাচ্ছিল্যের চোখে তাকিয়ে বলল, “লজ্জা কেন করবে? ওরাই তো সভ্য মানুষজন। আমরা তো অসভ্য, অশিক্ষিত আদিবাসী। ওই যে তিন বাবু বসে আছে। সামনের কাচের গ্লাসের মতো দেখতে ওগুলোকে বলে পেগ। ওতে রয়েছে দামি মদ। ভুল কোরো না, আমার বাবা যে হাঁড়িয়া খেয়ে মাকে মারে, ওটা নয়। এর বহু দাম। এক বোতলের যা দাম সেটা দিয়ে তোমার-আমার গোটা মাসের সংসার খরচ চলে যাবে।”
কুন্তলীর চোখে রাজ্যের বিস্ময়। এমন একটা জগৎ আছে, এটাই তো অজানা ছিল ওর। বিশাল একটা হল ঘরে গদি আঁটা লাল ভেলভেট জড়ানো দামি কাঠের চেয়ার রাখা। সামনে সব কাচের গোল টেবিল। সাইড বেশ কিছু দোকানের মতো কাউন্টার। ওখানে খাওয়ার জিনিস বিক্রি হচ্ছে। কুন্তলী ওই কাউন্টারে বসে থাকা দুজনকে বোধহয় চিনতেও পেরেছে।
একটু উশখুশ করতেই সুজয় বলল, “উত্তেজিত হবার কিছু হয়নি। এখানের কাউন্টারে যারা বসে আছে খাবর সাজিয়ে, তারা সবাই আমাদের নির্ভয়পুরের আদিবাসী। এরা ভালো পোশাক পরিয়ে সাজিয়ে রেখেছে বলেই চিনতে কষ্ট হচ্ছে। ওপর তলায় আছে বেশ ক’টা বেডরুম, যাতে মালিকপক্ষের লোকজন অবাধে বেলেল্লাপনা করতে পারে। অবশ্য এদের পরিচিত লোকজন কলকাতা থেকে বেড়াতে এলে ক্লাবের ওপরের রুমে ফ্রি-তে ব্যবস্থা করে দেয় এরা। শহরের পরিচিত লোকদের দেখাতে হবে তো, পাহাড়ে কত সম্পত্তি করেছে, তাই আচমকা উদার হয়ে যায় এরা। শোনো, দু’মাস কাজ করলেই এদের মুখোশ খোলা রূপটা তুমি দেখতে পাবে। তাই একদিনে বেশি খেয়ে লাভ নেই, বদহজম হবে।”
কুন্তলীকে আপাদমস্তক দেখে মল্লিকবাবু বলেছিলেন, “সুজয় ও কি পারবে? মানে আমাদের অনেক বিজনেস ডিল হয় এই ক্লাবে। অনেক ভিআইপি লোকজন আসেন আশেপাশের শহর থেকে। তাঁদের খুব স্মার্টলি ড্রিঙ্ক সার্ভ করতে হবে। তাঁদের অর্ডার মতো পেগ বানাতে হবে। ফরেন লিকারের নাম পড়তে পারবে এ?”
সুজয় একটু ভেবে বলেছিল, “কেন পারবে না? নির্ভয়পুরে তো আগে আমরা বাইরের লোকজনদের ঢুকতেই দিতাম না শুনেছি। তির-ধনুক উঁচিয়ে নাকি তাড়িয়ে দিয়েছে আমাদের দাদুরা। তারপর আপনারা এ অঞ্চলের লোকেদের বশ করে ফেলতে পেরেছেন তো? আপনাদের এই ক্লাবে এই যে এত এত লোকজন রয়েছে, মালি থেকে রাঁধুনি যারা সব কম মাইনেতে খাটছে, এরা কি পারছে না?”
সুজয় চোখের ইশারা করতেই কুম্ভলী বলল, “আমার বাবা বিজন মুর্মু তো আপনাদের ব্যবসার গাড়িই চালাত। গাড়িতে ধাক্কা লেগেই তো খাদে পড়ল। তারপরেও কি আমরা কোনও জবাব চাইতে এসেছি?”
কুম্ভলীর কথা শেষ হবার আগেই মৃণাল ঘোষাল ব্যস্ত হয়ে বললেন, “আহা মল্লিক, এ আমাদের বিজনের মেয়ে। আমায় সুজয় বলেছিল। আরে জন্মেই কেউ শেখে না। ও শিখে নেবে ধীরে ধীরে।”
কুন্তলী শিখে নিয়েছে। সেই বোকা কুম্ভলী আর নেই। গত তিনবছরে এই গ্রিনভ্যালিতে বসে ও বুঝেছে, সুজয়ের বলা কথার অর্থ। আসলে অভিজ্ঞতা মানুষকে শিক্ষিত করে। এই ক্লাবের আনাচে-কানাচে চলা ঘটনার মধ্যে দিয়েই কুন্তলী চিনেছে, শিক্ষিত, ধনী সমাজের মুখোশধারী মানুষগুলোর আসল রূপ
সুজয় বলে, “কান খোলা রাখবে কুন্তলী, এরা আমাদের কেড়ে নিয়ে নিঃস্ব করার ফন্দি আঁটে।”
সেবারে যখন সুজয় চা মালিক নিরঞ্জন সমাদ্দার আর পামেলা মিত্রর কারখানায় শ্রমিকদের বেশি মজুরির দাবিতে স্ট্রাইক ডেকেছিল, তখন এই ক্লাবেই পামেলা মিত্র আর নিরঞ্জন সমাদ্দারের আলোচনা শুনেছিল কুন্তলী। দুজনেই মদ্যপ অবস্থায় বলছিল, “ছেলেটার ঘরে একটা মেয়ে ঢুকিয়ে দিয়ে বদনাম করে দিলেই তো হয়। তা হলে আর নির্ভয়পুরের মানুষ ওকে বিশ্বাস করবে না। সুজয়ের বিষদাঁত ভাঙাও হল, আবার রক্তারক্তিও হল না।”
পামেলা মিত্র বলেছিল, “আমার বাড়িতে যে মেড আছে, সে এই নির্ভয়পুরেরই বাচ্চা মেয়ে। টুসুকে পাঠিয়ে দেব বুঝিয়ে-সুঝিয়ে?”
গ্লাসে বরফ মেশাতে মেশাতে হাত কেঁপে উঠেছিল কুন্তলীর। সুজয়ের বিপদে নিজেকে সংযত রাখতে পারছিল না। কিন্তু সুজয়ই বলেছিল, ওদের কথা শুনবে কিন্তু শুনছ এটা যেন ওরা সন্দেহ না করে। তাই চুপচাপ কাজ সেরে নির্দিষ্ট সময়েই বাড়ির পথ ধরেছিল কুন্তলী। সুজয়ের বাড়ি হয়ে যাবে কি না ভাবতে ভাবতে আনমনেই পথ হাঁটছিল। তখনই কানের কাছে জোরে বেল বেজেছিল।
“কী, আজ সাইকেল আনোনি?”
কুন্তলী চেনা গলা শুনেও চমকে উঠেছিল সেদিন। সুজয়ের হাতটা ধরে বলেছিল, “তোমার বিপদ। ওরা তোমার চরিত্রের বদনাম করতে চাইছে। পামেলা মিত্র তার কাজের মেয়েকে রাতে তোমার ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে লোক জমায়েত করতে চাইছে।”
সুজয় থমকে দাঁড়িয়েছিল। নির্ভয়পুরের নিস্তব্ধতাকে ভেঙে দিয়েই কুন্তলীকে আচমকা জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেছিল সুজয়। বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে কেঁদেছিল।
কুন্তলী ঠিক কী করবে বুঝতে পারেনি। এমন শক্ত মানুষটা যে এভাবে কাঁদতে পারে, সেটাই তো ধারণার বাইরে ছিল। কুন্তলীদের পাকা বাথরুম হয়েছে, ঘরে রং হয়েছে। বড়ো আয়না লাগিয়েছে ও নিজের ঘরে। মা বলে, “সবই ওই ছেলেটার কৃপায়।” কুন্তলীর মাইনের টাকা মা কিছু কিছু করে জমায়। মেয়ের বয়েস বাড়ছে, বিয়ে দিতে হবে বলে। কুন্তলীর মা বলে, “সুজয়কেই বলব একটা ছেলে দেখে দিতে।” কুণ্ডলী রাগ করে বলেছিল, “একদম বলবে না ওকে এসব কিছু।” তখনও কি জানত, সকলের উপকার করে বেড়ানো, মালিক পক্ষের ওপরে রেগে থাকা ছেলেটা ওকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো কাঁদতে পারে!
কুত্তলী ওর পিঠে হাত বুলিয়ে বলেছিল, “আজ বাড়ি ফিরতে হবে না। চলো আমাদের বাড়িতে রাতটা থাকবে।”
সুজয় নিজেকে সামলে নিয়ে বলেছিল, “উঁহু, আজ নয় কাল, ওরা যখন ভেবেছে তখন এটা করেই ছাড়বে। আমি ওদের পথের কাঁটা। আমাকে সরাতে চাইবেই। তাই এভাবে হবে না কুত্তলী। পামেলা মিত্রর বাড়িতে কাজ করা মেয়েটার মা আমাদের কারখানার এক কর্মী। ওকে দিয়েই ব্যবস্থা করতে হবে। তুমি বাড়ি যাও, আমি সব ভেবে নিয়েছি।”
কুন্তলী তবুও বলেছিল, “সাবধানে থেকো।”
সুজয় বোধহয় আরও কিছু বলতে চাইছিল কুন্তলীকে, কিন্তু বলতে পারেনি। বাড়ি এসেও চুড়িদারটা খুলতে ইচ্ছে করছিল না কুন্তলীর। সুজয়ের চোখের নোনা জল আর উষ্ণ ছোঁয়া মিশে ছিল জামাটায়। সারারাত দু’চোখ এক করতে পারেনি কুন্তলী।
কান খাড়া করে শুয়েছিল, যদি কোথাও গন্ডগোলের আওয়াজ পায়, তবে দৌড়ে যেতে হবে। গত মাসের মাইনে দিয়ে একটা ছোটো ফোন কিনেছে ও। ক্লাবের অফিস থেকেই বলেছিল ফোন নম্বর দিয়ে যেতে। যদি এক্সট্রা ডিউটি দিতে হয় তা হলে ফোন করে জানিয়ে দেবে। সেই কারণেই ফোনটা কিনতে হয়েছে ওকে।
সুজয়ের ফোনে একটা কল করল কুণ্ডলী। সুজয় ফোনটা ধরল না। এভাবেই উত্তেজনায় কেটেছিল সেই রাত। ভোরের দিকে একটু তন্দ্ৰা এসেছিল ওর। তখনই মা এসে বলেছিল, “আমরা ধরনায় বসতে যাচ্ছি।” কুন্তলী ছুটে বাইরে বেরিয়ে দেখেছিল, পামেলা ম্যাডামের বাড়িতে কাজ করে যে মেয়েটা ও আর ওর মা মিছিলের আগে আগে হাঁটছে। সুজয়ের হাতে মাইক।
“নির্ভয়পুরের মা-বোনদের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে তাদের পরিশ্রমের অর্থ কেউ চুরি করবে এটা আমি থাকতে হতে দেব না।”
নির্ভয়পুরের সব মহিলারা হাঁটছিল সে মিছিলে। কুন্তলীও সুজয়ের একান্ত গোপন নরম মুহূর্তের স্পর্শ লেগে থাকা চুড়িদারটা পরেই সেদিন হেঁটেছিল ওই মিছিলে। পামেলা মিত্রর টি-এস্টেটের অফিসের সামনে এসেই থেমেছিল সে মিছিল। বসেছিল ধরনা। মাত্র চার ঘণ্টায় হার স্বীকার করেছিল পামেলা। বাইরে বেরিয়ে এসে সুজয়ের দাবির কয়েকটা পয়েন্ট মেনে নিয়েছিল তখনই। মহিলা শ্রমিকরা আবার যে যার কাজে লেগেছিল। সে সব দিন আজও ভোলেনি কুন্তলী। ওই রাতটাও ভোলেনি। প্রচণ্ড কঠিন সুজয়ের আশ্রয় হতে পারার মুহূর্তটুকু কুন্তলীর সম্পদ।
এমন কত খবর সংগ্রহ করে কুন্তলী এই ক্লাবের থেকে। রঙিন নেশায় বুঁদ হয়ে মানুষ মনের সব কথা উজাড় করে বলে দেয়। কুন্তলীর সদা জাগ্ৰত কান সেগুলো সুজয়কে দেয়।
আজও কান খাড়া করে শুনছিল কুন্তলী, নিরঞ্জন সমাদ্দার বলছে, “মল্লিকের এই হার্ট অ্যাটাকের কারণ কী ঘোষাল? মেয়ে ডাক্তারি পড়ছে, ছেলে কলকাতায় ব্যবসা করছে। দ্বিতীয়পক্ষ তো শুনলাম মুখ ঝামটা দিলেও যত্নই করে। তা হলে হৃদয়ে এত দুঃখ পুষে কেন রেখেছিল বলো দেখি?”
ঘোষাল আর-এক পেগ গলায় ঢেলে বলল, “আছে আছে, তারও অনেক গল্প আছে।”
সমাদ্দার বলল, “সুজয় যা হোক জানে না তোমার আসল পরিচয়টা, কী বলো ঘোষাল? না হলে কিন্তু তোমায় রাস্তায় নামিয়ে দিত।”
ঘোষাল খানিকক্ষণ চুপ করে ঝিম মেরে বসে থেকে ঝট করে উঠে বলল, “আমিও জানি না সুজয়ের আসল বা নকল পরিচয়টা, আজ চলি।”
সেই থেকেই মাথার মধ্যে একটাই কথা ঘুরছে, সুজয়ের আসল পরিচয় বলতে? ঠিক কী বলল সমাদ্দার? কেন ঝট করে চলে গেল ঘোষাল? সুজয় তো কারখানার শ্রমিকদের জন্যই লড়াই করছে সেই কবে থেকে? তবে কি এর বাইরেও ওর আলাদা পরিচয় আছে? প্রায়ই মালিকপক্ষের সঙ্গে মিটিং-এ বসে ও। তা হলে কি সুজয়দা আসলে মালিকপক্ষের লোক?
কেন যে কুন্তলী চালাক হল এই ক’বছরে? কেন যে এত ভাবতে শেখাল সুজয় ওকে! বেশ সহজ-সরল ছিল ও। আজকাল ভদ্রলোকদের দেখে দেখে আদব-কায়দা শেখার সঙ্গে সঙ্গে জটিল হয়ে যাচ্ছে ও। তাই তো সুজয়কে সন্দেহ করছে। যাকে দু’দিন না দেখলে ওর ভিতরটা হাঁসফাঁস করে, তাকেই সন্দেহ করছে কুন্তলী। এর থেকে অজ্ঞ থাকাই ভালো ছিল ওর।
নিজের মনেই কাচের গ্লাসগুলো গুছিয়ে রাখছিল কুন্তলী। আজ ক্লাবের বারে ভিড় নেই একেবারেই। মল্লিকবাবুর স্ট্রোকের খবরে সবারই বোধহয় একটু ভয় করছে। বয়েস তো প্রায় কাছাকাছি। তাই সব মদ্যপান বাদ দিয়ে স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে উঠেছে বোধহয়। ব্যাডমিন্টন খেলার আওয়াজ আসছে। সবই ঠিক আছে, সুজয়কে যে কুন্তলী ভালোবাসে না এমন নয়। সুজয়ের বিপদ শুনলে আজও বুকের ভিতর তোলপাড় করে। কিন্তু ইদানীং আর-একটা মানুষকেও কুন্তলীর খুব ভালো লাগছে। এই মানুষটা বাকি সকলের মতো নয়। অমন সুপুরুষ, অত ধনী কোনও ছেলে এর আগে কুন্তলীর সঙ্গে এত ভালো করে কথাই বলেনি। বাবুদের ছেলেমেয়েরা তো ওদের মানুষই মনে করে না। কর্মচারী ছাড়া কোনও পরিচয়ই নেই ওদের। কুণ্ডলীকে অনেকেই “এই মেয়েটা এদিকে একটা হুইস্কি দে” বলেই ডাকে সাধারণত। এই প্রথম কোনও ভদ্রলোকের ছেলে এসে ওর নাম জানতে চাইল। ওর দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে বলল, “নামের মতোই সুন্দরী তুমি।”
গত তিনমাসে কুন্তলীর মনে নীহার একটা স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে। এই প্রথম কোনও কথা সুজয়কে বলেনি কুন্তলী। কারণ নীহার বাকিদের মতো নয়। সে কারওর ক্ষতি চায় না। সুজয় বলেছিল, যারা ওদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে তাদের খবর দিতে, কিন্তু নীহার তো কোনও চক্রান্ত করেনি। তা হলে অযথা সুজয়কে বলে লাভ কী? এমনিই একটা আবছা যুক্তির পাঁচিল খাড়া করেছে কুম্ভলী। নীহার বার বন্ধ হয়ে যাবার পরে পুল সাইডে একা একা বসে ছবি আঁকে। কুণ্ডলীকে ফিসফিস করে বলে, “আমার মডেল হবে? হুবহু আর-একটা কুন্তলী এঁকে দেব। তাকে দেখে তুমি হিংসে কোরো না কিন্তু।
নীহারের বলা কথাগুলোতে কেমন যেন মহুয়ার গন্ধ মেশানো থাকে। মাথাটা ঝিমঝিম করে কুন্তলীর। চোখ দুটোতে রঙিন স্বপ্ন এঁকে দেয় নীহার। ওকে কলকাতা ঘোরাতে নিয়ে যাবে বলেছে নীহার। কলকাতার কত ছবি দেখিয়েছে ওকে। আলোয় আলোয় ঢাকা। সন্ধে নামলেই নির্ভয়পুরের মতো নিস্তব্ধ হয়ে যায় না সে শহর। সন্ধেতেই নাকি আর-একটা দিন শুরু হয় সেখানে। কুত্তলী অবাক হয়ে শোনে।
কুন্তলী জিজ্ঞাসা করেছিল, “আপনি বিয়ে করেননি?”
নীহার আলতো হেসে বলেছিল, “তোমার মতো পাহাড়ি ঝরনা খুঁজে পাইনি যে।” আঠাশের নীহার দিদি পামেলা মিত্রর টি-এস্টেটের দায়িত্ব নিয়েছে। কিন্তু ব্যবসায় তার মন নেই। তার মন ছবি আঁকে আর কবিতা লেখে।
আজও মল্লিকবাবুর হার্ট অ্যাটাকের খবরে বার তাড়াতাড়ি বন্ধ হয়ে গেলে কুন্তলীও ফিরে আসার জন্যই বেরিয়েছিল। তখন নীহার পথ আটকে বলেছিল, “চলো গল্প করি। আমি তো মাত্র পাঁচমাস এসেছি নির্ভয়পুরে, তাই কিছুই চিনি না। তুমি আমায় চেনাও এখানের পাহাড়, নদী, জঙ্গলকে।”
নীহারের কথার আবেশেই থেমে গিয়েছিল কুন্তলীর বাড়িমুখো গতিশীল পা দুটো।