ইতি নির্ভয়পুর – ৩২
৩২
মাঝরাতে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ ঢুকল। নূপুর তখনও ঘুমায়নি। গান শুনছিল। শৌনক কী উত্তর দেবে সেটা জানার অপেক্ষায় নয়, বরং আজ বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাটানো সময়টা চোখের সামনে ভাসছিল। তাই হয়তো ঘুম আসতে একটু দেরি হচ্ছিল। মল্লিক-বাড়ির সবার মন-মেজাজ খুব ফুরফুরে। এ বাড়ির ছেলের বিয়ে। অতসী মল্লিক আর অস্মিতা সমাদ্দার এখন প্রায়ই গাড়ি হাঁকিয়ে শিলিগুড়ি যাচ্ছে শপিং করতে। ড্রাইভার অন্য কেউ নয়, সাহেব মল্লিক। তাই এ বাড়িতে নূপুরকে নিয়ে মাথা ঘামানোর ব্যাপারটা আপাতত বন্ধ আছে। আর সেটাই নূপুরের স্বস্তির জায়গা।
তবুও কলকাতা থেকে ফিরেই দাদাভাই বলতে এসেছিল, “নূপুর, তুই আচমকা নির্ভয়পুর হাসপাতালে চাকরি করার ডিসিশন কেন নিলি?”
নূপুর খুব শান্ত গলায় বলেছিল, “আচমকা তো নয় দাদাভাই। যেদিন ডাক্তারি পড়ব সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, সেদিনই ভেবেছিলাম নির্ভয়পুরের মানুষের জন্য কিছু করব। কারণ, নির্ভয়পুর আমাদের অনেক দিয়েছে।”
সাহেব একটু উত্তেজিত গলায় বলেছিল, “ভুলে যাচ্ছিস, আমাদের আসল বাড়ি কিন্তু কলকাতায়।”
নূপুর হেসে বলেছিল, “তা হলে আমরা এখানে কী করছি এতগুলো বছর ধরে? কলকাতায় ব্যবসা না বাড়িয়ে বাবা কেন এখানে হোটেলের পর হোটেল, রিসর্টের পর রিসর্ট বানিয়ে যাচ্ছে?”
সাহেব চুপ করে থেকে বলেছিল, “নিরঞ্জন-আঙ্কেল তো নার্সিংহোম বানাতে চাইছে, তা হলে তুই ওটার দায়িত্ব নে। তা হলেই তো নির্ভয়পুরের মানুষদের উপকারে আসবি।”
নুপুর হেসে বলেছিল, “তোর শ্বশুরের নার্সিংহোমে যা চার্জ লাগবে তাতে কি নির্ভয়পুরের ভূমিপুত্ররা আদৌ চিকিৎসা করাতে পারবে দাদাভাই? হ্যাঁ, নির্ভয়পুরের বাঙালি ব্যবসাদাররা হয়তো ট্রিটমেন্ট করাতে পারবে ওই নার্সিংহোমে। তাতে আমাদের ঋণ শোধ হবে না।”
সাহেব বলল, “ঋণ, কীসের ঋণ?”
নূপুর হেসে বলেছিল, “এখানের ভূমিপুত্রদের কাছে আমরা ঋণী। এরা যদি আমাদের আশ্রয় না দিত, তা হলে আমরাও আজ বিজনেস টাইকুন হতে পারতাম না, তাই না?”
সাহেব বিরক্তির গলায় বলেছিল, “আবেগে ভাসছিস তো, পরে বুঝবি। আর ওই হাসপাতালের দু’পয়সা মাইনের ডাক্তার শৌনকের কাছে তুই কীভাবে ঋণী? কারণ, ইদানীং শুনছি তুই ওর খুব যত্ন নিচ্ছিস। ভুলে যাস না, তুই মল্লিক-বাড়ির মেয়ে। একটা অনাথ ছেলে, যার আস্তানা ওই সরকারি কোয়ার্টার, তার সঙ্গে তোর এত বন্ধুত্বের কারণটা কী?”
নূপুর ফোন ঘাঁটতে ঘাঁটতে বলল, “দু’ব্যাপারে ঋণী। এক নম্বর, আমার বাবার জীবন ফিরিয়ে দেওয়া। দুই নম্বর, আমার দাদাভাইয়ের ভালোবাসা ফিরিয়ে দেওয়া। ওহ আর-একটা কারণ আছে। তিন নম্বর, ভালোবাসা শব্দের অর্থ আমায় বোঝানো।”
দাদাভাই রাগে গজগজ করতে করতে নূপুরের ঘর থেকে চলে গিয়েছিল। যাওয়ার সময় বলে গিয়েছিল, “তুই কি সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছিস? অস্মিতাও বলছিল তুই নাকি শৌনককে ভালোবাসিস?”
নূপুর বলল, “অস্মিতাদি ঠিক বলেছে।”
সাহেব কথা না বলে চলে গিয়েছিল। প্রায় দিন তিনেক কথাই বলেনি বোনের সঙ্গে। নূপুরও জোর করে কথা বলার চেষ্টা করেনি।
তারপর মা এসে বলল, “সাহেব বলছিল, তুই নাকি শৌনককে বিয়ে করতে চাস? যতদূর শুনেছি ছেলেটা অনাথ, অবস্থাও তো তেমন ভালো নয়।”
অতসী মল্লিককে কথা শেষ করতে না দিয়েই নূপুর বলেছিল, “মা, আমার দাদুভাই গরিব ছিল বলেই তো তুমি মল্লিক বাড়ির বউ হতে পারোনি ফার্স্ট চাদে, তাই না? বড়মা মারা যাবার পর সুযোগ পেয়েছিলে। তারপরেও তুমি মল্লিক-বাড়ির ঐতিহ্য নিয়ে গলা ফাটিয়ে চলেছ? তোমায় একটু আলাদা ভেবেছিলাম। এনিওয়ে, হ্যাঁ তুমি ঠিকই শুনেছ, আমি শৌনককে ভালোবাসি। যদি ওকে আলাদা করে ডেকে তুমি আর তোমার ছেলে হুমকি দিয়ে সরিয়ে না দাও, তা হলে জীবনটা ওর সঙ্গেই কাটাতে চাই। আর যদি ও আচমকাই সরে যায় আমার জীবন থেকে, তা হলে নিজের নামের শেষে মল্লিক সারনেমটা আর বসাব কি না ভাবব।”
একমাত্র বাবা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল, “বড়ো ভালো ছেলে শৌনক। বড়ো ভালো ডাক্তারও। বাকিটা তোরা দুজন মিলে গুছিয়ে নিস। যদি মনে করিস, আমার কিছু সাহায্য লাগবে বলতে দ্বিধা করিস না। এসবই তো তোর আর সাহেবের। তবে শৌনককে আমি যেটুকু চিনেছি, তাতে সে অন্যের অর্থে জীবনধারণ করবে না।”
বাবার বুকে মুখ গুঁজে নূপুর বলেছিল, “তুমি কি কষ্ট পেয়েছ আমার এমন সিদ্ধান্তে?”
অরুণাংশু মল্লিক নূপুরকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, “আমি প্রাউড ফিল করি তোর জন্য। তোর কোনও সিদ্ধান্ত ভুল হতেই পারে না।”
বাবার সমর্থন পেয়ে গেছে নুপুর। মা আর দাদা বিরক্ত হলেও মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে নূপুরের সিদ্ধান্ত। শুধু যাকে নিয়ে ওর এই লড়াই, সেই মানুষটাই স্বীকার করতে চায় না ওদের সম্পর্কটা। ভালোবাসি কথাটা বলতেই যেন তার যত সংকোচ। মেসেজটা ওপেন করতেই দেখল, শৌনক পাঠিয়েছে।
‘আচ্ছা, বেলফুলের মূল্য কি গোলাপ-না রজনীগন্ধা?”
নূপুরের ঠোঁটে হাসির ঝলক। যাক, রাগ কমেছে তা হলে। নূপুর লিখল, ‘বেলফুলের মূল্য ফেরত দিতে চাও? কিন্তু সেটা তো গোলাপ বা রজনীগন্ধা দিয়ে মেটানো যাবে না। বহুদিনের অব্যবহৃত ক্যামেরাটা আবার ব্যবহার করতে হবে এই মল্লিক বাড়ির মেয়ের ছবি তুলে দিয়ে। উঁহু, কথা শেষ হয়নি আমার। মূল্য ফেরত দেবার কথা ছিল তোমার। কারণ, তুমি বলেছিলে উপহার গ্রহণ করো না। মূল্য ধার্য করব আমি। ছবিটা তুলতে হবে রঙ্গিত নদীর ধারে। রাজি?’
শৌনক বলল, ‘অগত্যা। ঋণী আমি থাকতে চাই না। সুদে-আসলে শোধ করে দিতে চাই।’
নূপুর লিখল, ‘আমি তো আসল চাইলাম, সুদটা আবার কী?’
শৌনক একটা স্মাইলি পাঠিয়ে বলল, সুদটা অস্বীকার করলে কিন্তু আসলও ফেরত পাবার আশা কম। আসলটা ফেরত দেব দূর থেকে তোমায় ক্যামেরা বন্দি করে, আর সুদটা ফেরত দেব তোমায় আমার মধ্যে মিশিয়ে নিয়ে, কি রাজি তো?’
নূপুর লজ্জা পেয়ে চোখ বন্ধ করল।
সাময়িক বিরতি দেখেই, শৌনক লিখল, ‘ইশ, মল্লিক-বাড়ির অত স্মার্ট মেয়েটা আবার লজ্জাও পায় নাকি? তবে নূপুর তোমায় আমার কিছু বলার আছে। নিজের সম্পর্কে।”
নূপুর লিখল, ‘নিবেদিতা বসু আমায় সবটা বলেছেন। তুমি বড্ড বোকা শৌনক। একটা অবজ্ঞার দিকে ছুটে চলেছ ভালোবাসাকে উপেক্ষা করে। তোমার বায়োলজিক্যাল ফাদার অ্যান্ড মাদার তোমায় অবহেলা করে কাউকে দিয়ে দিয়েছিল। আর দুজন মানুষ তোমাকে ঘিরেই তাদের পৃথিবীটা তৈরি করেছিল। তুমি তাদের অবহেলা করে অপমানের দিকে ছুটে চলেছ। কিছু মনে কোরো না, আমি তোমায় ব্রিলিয়ান্ট বলেই জানতাম। তুমি এতটা বোকা বুঝতে পারিনি। আমি কিন্তু শোভন বসু আর নিবেদিতা বসুকেই বাবা, মা বলে মানব। কারণ, ওঁরাই সেদিন ওই সদ্যোজাতকে বুকে তুলে নিয়েছিলেন। তাই তুমি যদি কাল কাউকে খুঁজে এনে বলো, এ আমার গর্ভধরিণী, তা হলেও আমার সিদ্ধান্ত বদলাবে না। আমি এগুলো জানি সবই। তবে চাইছি না নির্ভয়পুরের আর কেউ জানুক। কারণ, যার কোনও ভিত্তি নেই সেটা নিয়ে কাটাছেঁড়া করা মানে আন্টি আর আঙ্কেলের সম্মানহানি। ভেবে দেখো।’
শৌনক শুধু ‘গুড নাইট’ লিখে অফ হল।
নূপুর মনে মনে বলল, আমি তোমায় ভালোবাসি শৌনক। কিন্তু তোমার গোঁয়ার্তুমিকে নয়। নিবেদিতা-আন্টি আর শোভন-আঙ্কেলের সঙ্গে কথা বলেই বুঝেছি, মানুষ দুটো ভীষণ রকমের কষ্ট আছেন। কোনও অন্যায় না করেও অপরাধবোধে ভুগছেন যেন। ভুল করছে শৌনক। যাঁরা ওকে এত বড়ো করলেন, তাঁদের এভাবে যন্ত্রণা দিয়ে অন্যায় করেছে। শোভন-আঙ্কেলের গলা কাঁপছিল, তার মধ্যেই বললেন, “তুমি আমাদের ছেলেটাকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দিয়ো নূপুর। হবু পুত্রবধূর কাছে এটুকু আমাদের আবদার।”
কত বড়ো একজন ডাক্তার কী ভীষণ যন্ত্রণা পেলে এভাবে ভেঙে পড়তে পারেন। অন্যায়কে কিছুতেই প্রশ্রয় দেবে না নূপুর। শৌনককে বুঝতে হবে, ও ভুল করছে।