ইতি নির্ভয়পুর – ৩৩
৩৩
সুজয় বলল, “ভুল নয় ফাদার, এটা সত্যি। ফাদার, আপনি জানেন কুন্তলীকে খুন করার জন্য লোক লাগিয়েছে পামেলা মিত্র! ওকে খুন করে আমায় ফাঁসিয়ে দেবে। সামান্য চেয়ারের লড়াইয়ে মানুষ এত নিচে নামতে পারে ফাদার? আজকের রাতটা তাই বাড়িতে থাকার রিস্ক নিলাম না। আপনি বললেন আর আমি সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়ে গেলাম। কুন্তলীকে আপনার কাছে রেখে আমি একবার বেরোব ভাবছি।”
ফাদার হেসে বললেন, “আজ তুমিও এখানে থেকে যাও সুজয়। বিপদ তোমারও। কনকলতা ঘোষাল তোমার নামে অনেক সম্পত্তি লিখে দিয়েছে, মৃণাল ঘোষাল এটা মেনে নেবে না। তাই বিপদ তোমারও।”
ফাদার ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, ক্লান্ত কুন্তলী অকাতরে ঘুমাচ্ছে রাত আট টাতেই। সুজয় আর ফাদার ভোটের আগের দিন বারান্দায় বসে রাত জাগছেন। কুন্তলীর খুন হবার ভয়ে একটু বোধহয় আতঙ্কিত হয়ে আছে সুজয়। তবুও আনমনে বলল, “ও সম্পত্তি আমি নিতে পারি না ফাদার। আমি ওঁকে জেঠিমা ডাকি, উনি আমায় স্নেহ করেন। এটুকুই যথেষ্ট। আমি কারও কাছে ভিক্ষা নিতে পারব না।”
ফাদার সুজয়ের কাঁধে হাত রেখে বললেন, “ওটা তোমার ন্যায্য অধিকার। না, শুধু তোমার দাদুর সম্পত্তি ছিল বলে নয়, মৃণাল ঘোষালের সমস্ত সম্পত্তিতে তোমার অধিকার আছে।”
সুজয় একটু অবাক হয়েই বলল, “কেন ফাদার?”
ফাদার বললেন, “তোমায় বলেছিলাম এমন একটা সত্যি আমি লুকিয়ে রেখেছি, যেটা সময় বিশেষে বলব। আজ সেই সময় উপস্থিত। কুন্তলীকে ওরা মেরে দিতে চায় কারণ ওর গর্ভে নীহারের সন্তান। ঠিক একইভাবে হাসিনীকেও একদিন মেরে ফেলতে চেয়েছিল। সেদিন আমি ওকে বাঁচিয়েছিলাম। কারণ সন্তানসম্ভবা হাসিনী সেদিন জানতে পেরেছিল, ওর প্রেমিক ওকে বিয়ে করবে না। সেই রাতে ও চার্চে এসে বসেছিল। কারণ, হাসিনীর বাবাও তার অবিবাহিত গর্ভবতী মেয়েকে মেনে নেবে না। সুরেশ হাঁসদা বরাবরই একটু স্থূল বুদ্ধির মানুষ ছিল। আর শরীরেও ছিল অনেক রোগ। ওকেই একটা চাকরির ব্যবস্থা করে ঘরবাড়ি করে দিয়েছিল মৃণাল ঘোষাল। সেই শর্তেই সে গর্ভবতী হাসিনীকে বিয়ে করে। মৃণালের বাবা হাসিনীকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল ঘোষাল বাড়ির বদনাম ঘোচাতে। কিন্তু আমি সেদিন বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। কারণ আমি জেনে গিয়েছিলাম। তাই মৃণাল ঘোষালের বাবা বাধ্য হয়েছিল চাকরি আর ঘর করে দিতে। তারপর থেকেই হাসিনী কেমন যেন পাগল পাগল হয়ে গেল। ওদিকে সুরেশও রেগে গেলে মারধর করত হাসনীকে। হাসিনীও ভয়ে থাকত, এই বোধহয় ঘোষাল মেরে দেবে ওর সন্তানকে। তারপর সন্তান প্রসব করল হাসিনী। যমজ সন্তান। আর-একটি বাচ্চাকে হাসিনীই এক কলকাতার ডাক্তার দম্পতির হাতে তুলে দিয়েছিল, ভেবেছিল একজনকে যদি ঘোষাল মেরেও দেয়, আর-একজন বাঁচুক ওদের চোখের আড়ালে। তারপর তুমি বড়ো হলে। ঘোষালের বিয়ে হল, সংসার হল। বহুদিন কলকাতায় ছিল। তারপর বউ নিয়ে নির্ভয়পুরে এসে স্থায়ী হল। হাসিনী ততদিনে নিজের পরিচয়টুকুও ভুলে গেছে দেখে ওকে রেহাই দিল।”
সুজয় বলল, “মৃণাল ঘোষালের মতো নোংরা লোকের থেকে বোকা সুরেশ হাঁসদার ছেলে হওয়া অনেক গর্বের, ফাদার। আমার মা বড়ো দুঃখিনী।”
ফাদার বললেন, “ঠিক যে কারণে ওরা হাসিনীকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল, সেই কারণেই কুন্তলীকে মেরে ফেলতে চায়। ওদের ভয়, ওদের সম্পত্তি দাবি করবে এরা পরে। কনকলতা সবটা জানে, ওর শাশুড়ি ওকে বলে গিয়েছিল। তাই তোমায় সম্পত্তি লিখে দিয়েছে।”
সুজয় বলল, “যে আমার মাকে স্বীকার করেনি, তার সম্পত্তি আমি নিতে পারব না ফাদার। আর তাছাড়া সত্যি বলতে কী, এই সত্যি জেনে আমার কোনও লাভ নেই। বরং আমি বিরক্ত হলাম আমার শরীরেও ওই বাবুদের রক্ত আছে জেনে। সুরেশ হাঁসদা যদি অন্যের সন্তানকে নিজের পিতৃপরিচয়ে বড়ো করতে পারে, তা হলে আমিই বা কেন কুত্তলীর সন্তানকে নিজের নাম দিতে পারব না? মৃণাল ঘোষাল আমার আসল বাবা জানার পরে প্রথম যে অভিব্যক্তিটা হল, সেটা একরাশ ঘৃণা।”
ফাদার বললেন, “কিন্তু তুমি তো হয়েছ হাসিনীর মতো। ওর মনেও খুব দয়ামায়া ছিল। বড়ো প্রাণচঞ্চল মেয়ে ছিল। এই মাঠে ছুটে বেড়াত।”
সুজয় বলল, “ফাদার আমার মায়ের আর-একটা সন্তান কোথায় আপনি বলতে পারবেন? না, পরিচয় করতে যাব না, শুধু দেখব একই সঙ্গে পৃথিবীর আলো দেখা মানুষটা কেমন আছে।”
ফাদার বললেন, “হাসিনীর যে যমজ সন্তান হয়েছিল এটাই নির্ভয়পুরের কেউ জানে না। তখন তো এসব ইউএসজি ছিল না। মেডিকেল ক্যাম্প করতে দুজন ডাক্তার এসেছিলেন নির্ভয়পুরে। তাই বেঁচে গিয়েছিল হাসিনী, না হলে ওর শরীরের অবস্থা যা ছিল, তাতে বাঁচার কথায় নয়। আমি, হাসিনী আর সেই ডাক্তার দম্পতি ছাড়া এ সত্য আর কেউ জানে না।”
সুজয় উদাস গলায় বলল, “ফাদার জীবন থেকেই তো গল্প তৈরি হয়, কিন্তু আমার জীবন তো গল্প, নাটক সবাইকে ছাপিয়ে গেছে। আমি নিজেও বাবুদের সন্তান, আবার আমার সন্তানও বাবুদেরই হবে। একেই বোধহয় বলে ডেস্টিনি। মা যদি সেদিন দুজনকেই ওই ডাক্তার দম্পতির হাতে তুলে দিত, তা হলে আমিও আজ বাবুদের দলেই নাম লেখাতাম।”
ফাদার বলল, “সেই জন্যই বলছি, কনকলতার সম্পত্তি ফেরত দেবার দরকার নেই। ও তোমার অধিকার।”
সুজয় বলল, “ফাদার সেই ছোটো থেকে আপনি আমার বন্ধু। আমার সুখ-দুঃখের সাথী। এমনকী, আমার জন্মবৃত্তান্তেরও সাক্ষী। এত দিন পর্যন্ত আপনি যা যা বলেছেন, সব আমি শুনেছি। কিন্তু আজ আপনার এই কথাটা আমি রাখতে পারব না। আমি সুরেশ হাঁসদার ছেলে, মৃণাল ঘোষাল আমার কেউ নয়। তাই জেঠিমার দেওয়া সম্পত্তি আমি নেব না। আর-একটা অনুরোধ ফাদার, হাসিনীর যন্ত্রণাময় ঘটনাটা আর কাউকে বলার দরকার নেই। এমনকী, ওই যমজ বাচ্চার কথাও।”
ফাদার হেসে বলল, “আর কোনও ব্যক্তি জানবে না। শুধু ঋণ ছিল তোমার কাছে, তাই তোমায় বলে গেলাম।”
সুজয় আড়চোখে দেখল, কুত্তলী অকাতরে ঘুমাচ্ছে। নিজের মনেই হাসল সুজয়। এখানের মানুষগুলো বড়ো বোকা, হাসিনী বিশ্বাস করেছিল মৃণাল ঘোষালকে আর কুন্তলী নীহারকে। এরা একবারও ভাবে না, বাবুরা কখনও একটা আদিবাসী মেয়েকে বাড়ির বউ করে নিয়ে যাবে না। ভোটে জিতে সুজয়ের প্রথম কাজ হবে ঘোষালের গাড়ির পারমিট চেক করা। বে-আইনি পারমিটগুলো ক্যানসেল করে দেবে সুজয়, এমএলএ বিজয়কৃষ্ণদার সাহায্যে।
বাইরে কিছু একটা হট্টগোল হচ্ছে। তবে কি ওরা জেনে গেল কুন্তলী এখানে লুকিয়ে আছে সন্ধ্যা থেকেই? কিন্তু জনসমক্ষে খুন করতে আসবে না। তা হলে সুজয়কে ফাঁসানোর নতুন ছক কিছু করেছে নাকি পামেলা? আজকের রাতটা খুব গুরুত্বপূর্ণ পামেলা মিত্রর মতো চক্রান্তবাজ মহিলার জন্য। সুজয়ের কাছে হেরে যাবে, এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারবে না পামেলা। সজাগ হল সুজয়।
ফাদার ওকে ইশারায় ভিতরে যেতে বলে নিজে বাইরে গেলেন।
মাত্র মিনিট দুয়েক পরে হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকে ফাদার বললেন, “সুজয়, একটা মিসহ্যাপ হয়েছে। পামেলা মিত্রর অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, স্পট ডেড।”
সুজয় চমকে বলল, “কী করে হল?”
বাইরে বেরিয়েই শুনল, একদল লোক বলছে, “উনি তো প্রাইমারি স্কুলে আসছিলেন। তখনই একটা লরি এসে পিষে দিয়ে গেছে। হাইরোড থেকে আচমকাই নাকি লরিটা এদিকে টার্ন নিয়েছিল। দু’-তিনজন ঘটনাটা দেখেছে। পুলিশ চেষ্টা করছে লরিটা কার সেটা খোঁজার। নির্ভয়পুর ঘিরে ফেলেছে পুলিশে।”
সুজয় বলল, “ফাদার আমি চললাম। কুত্তলীকে দেখবেন।”
দু’-একজন বলল, “আরে সুনীল-মাস্টার তো মহিলাদের ডেকে ডেকে প্রাইমারি স্কুলে নিয়ে গেল। বলল, পামেলা-ম্যাডাম এসে ভোট কেমনভাবে দেয় সেটা শেখাবে ভালো করে। যাতে একটা ভোটও নষ্ট না হয়। তারপরেই তো এমন হই হই। বডি পুলিশ নিয়ে যাবে পোস্টমর্টেমের জন্য।”
সুজয় বলল, “পামেলা মিত্র ভোটে জিততে পারত না, কিন্তু এভাবে মৃত্যু আমি চাইনি।”
সুজয় ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখল, সুনীল-মাস্টার বেশ বিমর্ষ মুখে দাঁড়িয়ে আছে। মৃণাল ঘোষালও দাঁড়িয়ে তাছে, তবে মুখটা থমথম করছে, চোখে ভয়। লোকটাকে দেখেই সুজয়ের মনে হল এক ধ্যাবড়া থুথু মুখে ছিটিয়ে দিতে। ঘোষালের মুখে আজ একটা অদ্ভুত ভয় কাজ করছে যেন। সুজয় সেদিকে নজর না দিয়েই বলল, “অফিসার, কিছুদিন আগে পামেলা মিত্রর ভাইও কার অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। ব্যাপারটা কাকতালীয়, না ঘটানো হয়েছে এটা একটু তদন্ত করে দেখুন। ইনি এবারে আমার বিপরীতে ক্যান্ডিডেট ছিলেন। না, খুব স্ট্রং ক্যান্ডিডেট নন। কিন্তু ঠিক আজ সন্ধেতে এমন অ্যাক্সিডেন্ট একটু যেন অস্বাভাবিক।”
অফিসার বললেন, “আপনার কি কাউকে সন্দেহ হয়?”
সুজয় হেসে বলল, “আসলে এঁরা সব বড়ো বড়ো বিজনেসম্যান। কার সঙ্গে কার ঝামেলা লেগেছিল কে বলতে পারে! পামেলা মিত্রর বাড়ির সামনে তো সিসিটিভি লাগানো আছে। আজ কে কে ওর বাড়িতে গেছে, খবর নিন অফিসার।”
মৃণাল ঘোষাল বলে উঠল, “কেন, বাড়িতে যাওয়ার সঙ্গে এই অ্যাক্সিডেন্টের কী সম্পর্ক? পথচলতি মানুষ লরির ধাক্কায় মারা গেছে, তার সঙ্গে তার বাড়িতে যাওয়ার সম্পর্কটাই তো ক্লিয়ার হল না।”
পুলিশ অফিসার বলল, “তদন্তটা আমাদের করতে দিন।”
ঘোষাল চুপ করে গেল। মৃণাল ভেবেছিল, কুন্তলীর মতো চারআনার পার্সোনালিটির মেয়ে মরে গেলে নির্ভয়পুরের মানুষদের তেমন হেলদোল হবে না। সুজয়কে বিয়ে করতে বাধ্য করা হয়েছে বলে ও কুণ্ডলীকে এভাবে লরিতে ধাক্কা দিয়ে মেরে দিল। এসব ভেবেই তেমন সতর্কতা নেয়নি মৃণাল। নম্বর প্লেট ছাড়া গাড়ি নয়, নম্বর প্লেট সমেত গাড়ি দিয়েই অপারেশনটা করতে পাঠিয়েছিল ওরই কোম্পানির ড্রাইভারকে। কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না, পামেলা ওই সময় কী করছিল এই রাস্তায়? এখন যেহেতু কুত্তলীর বদলে পামেলা মিত্রর অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, সুতরাং ইনভেস্টিগেশনে জোর পড়বেই। প্রত্যক্ষদর্শীরা আবার লরির নম্বর অবধি টুকে রেখেছে। মৃণাল কী করবে বুঝতে পারছিল না। আজই সকালে পামেলার বাড়ি গিয়েছিল, তার ফুটেজ পাবে পুলিশ। গাড়িটাও ওরই কোম্পানির। দুইয়ে দুইয়ে চার করে নেবে পুলিশ। ওদিকে সেদিন মিটিং-এ কনকলতার সঙ্গে সামনাসামনি সংঘর্ষটাও লোকে দেখেছে। তাই অনেকগুলো অ্যাঙ্গেল বের করবে পুলিশ ঘোষালের বিরুদ্ধে পামেলাকে খুন করার কারণ হিসেবে। বিধ্বস্ত লাগছে। পামেলার কথায় রাজি হয়ে কুন্তলীকে খুন করার প্ল্যান করাটাই ভুল হয়েছিল। হাসিনীকে অনেক চেষ্টা করেও সেদিন মারতে পারেনি বলেই, এই সুজয় এখন বুকের ওপরে বসে লোম উপড়াচ্ছে। কিন্তু ঘোষাল এটা লক্ষ করেছে, এই আদিবাসীদের ওপরে নির্ভয়পুরের মাটির আশীর্বাদ আছে। এদের সহজে বিপদে ফেলা যায় না। এই বয়সে এসে জেল খাটতে হবে নাকি সেটাই চিন্তার।