ইতি নির্ভয়পুর – ৩৭
৩৭
“তুমি এত চিন্তা কোরো না সুজয়, এই নির্ভয়পুরের যদি একজনও তোমায় ভোট না দেয়, আমি দিয়েছি। আর যদি তুমি হেরেও যাও, তা হলেও আমি তোমার সঙ্গেই আছি। সারাটারাত কাল ছটফট করেছ তুমি।”
সুজয় দেখল, কুন্তলী সদ্য স্নান করে একটা কাচা শাড়ি পরেছে, কপালে লাল টিপ। ওর ভিজে চুল থেকে জল চুঁইয়ে পড়ছে। বড়ো পবিত্র লাগল সুজয়ের এই কুন্তলীকে। মেয়েটা সারাদিন সুজয়ের বাবা, মা, ওর খুব যত্ন করে। মায়ের সঙ্গী হয়েছে। মা এখন হাসে, গল্প করে। বাবাও কুন্তলীর যত্নে নিজেকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ মানুষ ভাবতে পারছে বলেই হয়তো খুশি খুশি আছে। দু’দিন আগেই বলছিল, “বাজার থেকে বড়ো মাছ এনেছি বুঝলি, বউমার হাতের রান্নাটি বেশ।”
সুজয় বলল, “আজ তো ভোটের রেজাল্ট বেরোবে, তাই একটু টেনশনে আছি। আসলে নিরঞ্জন সমাদ্দার এখানের পুরোনো লোক, আর পামেলার মতো অহংকারীও নয়, তাই লোকজন ওকে তেমন অপছন্দ করে না। নির্ভয়পুরের লোকজনের ধারণা, সমাদ্দার সকলের পেটের ভাত জোগায় ওর কোম্পানিতে চাকরি দিয়ে। আমিও কখনও ভাবিনি, স্বয়ং মালিকের এগেনস্টে লড়ব। আচ্ছা কুন্তলী, তুমি যে এখন আর চাকরি করো না, সারাদিন বাড়ির কাজ করো, তোমার মন খারাপ করে?”
কুন্তলী বলল, “মিথ্যে বলব না, একটু ফাঁকা তো লাগেই। তবে আমার মতো বোকা মেয়ের চাকরি না করাই ভালো। দেখলে তো, তুমি আমায় বিশ্বাস করে চাকরিটা করে দিয়েছিলে, আর আমি কী সব বোকামি করে বসলাম! আমার একটা ভুলের জন্য এত খুনোখুনি হয়ে গেল। না গো, আমার আর চাকরির দরকার নেই।”
সুজয় কুন্তলী নিজের কাছে টেনে নিয়ে বলল, “আগে আমাদের বাচ্চাটা হোক, তারপর ও একটু বড়ো হয়ে গেলেই তুমি আবার চাকরি করবে। এবারে তুমি অনুপমা টি-এস্টেটেই কাজ করবে, দেখো।”
কুন্তলী বলল, “কনকলতা ঘোষাল তোমায় যে সম্পত্তি দিয়েছেন, ওটা কি ফিরিয়ে দেবে?”
সুজয় বলল, “দিতে চেয়েছিলাম তো। কিন্তু কনকজেঠিমা মাথার দিব্যি দিয়ে বলেছেন, এ সম্পত্তি আমার দাদুকে ঠকিয়ে নিয়েছিল ঘোষাল বংশ। তাই এটা আমায় ফেরত দিলেন। কিন্তু কুন্তলী, ওই কোটি টাকার জমি নিয়ে আমি কী করি বলো তো?”
কুন্তলী বলল, “এমন কিছু করো যাতে এখানের মানুষের উপকার হয়। যাতে লেখাপড়া না জানা মানুষগুলো কিছু কাজ করতে পারে। বেশিরভাগ বাড়িতেই তো অভাব।”
সুজয় বলল, “কথাটা তো খারাপ বলোনি।”
কুন্তলী বলল, “ঘোষালকে অ্যারেস্ট করার পর থেকেই মা খুব নিশ্চিন্তে আছে জানো। শুধু বলছে, ‘আর কেউ মারবে না আমাদের।’ এটাই আমার শান্তি।”
সুজয় বলল, “আমার মাকে একটু দেখো কুন্তলী। বড়ো দুঃখিনী।”
কুন্তলী হেসে বলল, “সবাই কি আর আমার মতো ভাগ্যবতী হবে?”
সুজয় জানে, রংবুলে সুনীল-স্যার জিততে পারবে না। ওখানে সুজয়দের পার্টির নার্গিস ইসলাম ভালো ক্যান্ডিডেট, ও-ই জিতবে নাহলে সবিতা দস্তিদার। সুনীল-স্যার একটু চুপচাপ হয়ে গেছে। এমনকী, ভোটের দিনেও নিজের ভোটটা দিয়ে বাড়িতে চলে গিয়েছিল। একবার বোধহয় রংবুল কেন্দ্রে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল দশ মিনিটের জন্য। সুজয়ের জেতাটা জরুরি। এটা শুধু রাজনৈতিক মঞ্চ নয়, এ যেন লড়াই নির্ভয়পুরের ভূমিপুত্রদের সঙ্গে বহিরাগত মালিকপক্ষের, যারা সুজয়দের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে মাত্র একশো দুশো টাকায় কিনে নিয়েছিল লক্ষ লক্ষ টাকার সম্পত্তি। তারপর কম মাইনেতে তাদেরই খাটিয়েছে দিনের পর দিন। এমনকী, ওই ঘোষালরা নিজেদের কুয়ো থেকে কাউকে জল অবধি নিতে দিত না। অথচ সেই কুয়োর জায়গাটা এককালে এই ভূমিপুত্রদের কাছ থেকেই আত্মসাৎ করেছিল ওরা। নিজেদের অধিকার বুঝে নিতে গেলে রাজনৈতিকভাবেও স্ট্রং হতে হবে। কিন্তু এই নির্ভয়পুরের অশিক্ষিত বোকা মানুষগুলো ভাবছে, নিরঞ্জন সমাদ্দার ওদের খাওয়ায়। কত কম মাইনেতে ওরা যে দিনরাত খাটছে, আর ওদের এই পরিশ্রমে ঠিক কত টাকা যে লাভ করছে সমাদ্দার, সেটুকু বোঝার বুদ্ধি এদের নেই।
সুজয় রেডি হচ্ছিল। গণনাকেন্দ্রে যেতে হবে। তার আগেই দেখল ওর বাড়ির সামনে একটা গাড়ি এসে থামল। গাড়ি থেকে নামছে অস্মিতা। সুজয় একটু চমকেই গেছে।
অস্মিতা সোজা ওর সামনে এসে বলল, “ভোট গণনা চলাকালীন এদিক ওদিক যাবে না সুজয়দা। এমনকী, কেউ যদি এসে বলে তোমার মায়ের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, কুন্তলীকে তুলে নিয়ে গেছে, তা হলেও নয়। দরকার হলে তোমার দুটো বন্ধুকে বাড়ির সামনে বসিয়ে রেখে যাও, কিন্তু তুমি আর তোমার কাউন্টিং এজেন্ট কোথাও যাবে না। ভোট চুরি হতে পারে।”
অস্মিতা আর না দাঁড়িয়ে যেমন এসেছিল তেমন চলে গেল।
সুজয় বুঝল, নিরঞ্জন সমাদ্দার এমনই কিছু প্ল্যান কষেছে ওকে হারাতে তাই অস্মিতা ছুটে এসেছে খবরটা দিতে। সুজয় নিজের মনে মনেই বলল, উঁহু, নিরঞ্জন সমাদ্দার, তুমি নিজেই জানো না তোমাদের মালিকপক্ষের কতজন আমায় সমর্থন করে! কনকজেঠিমা, অরুণাংশু মল্লিক, নূপুরদি, সুনীল-স্যার, শৌনকদা এখন তো দেখছি অস্মিতাদিও আমার পাশেই আছে।
.
সুজয়ের কেন্দ্রে ভোট গণনা শুরু হবার কিছুক্ষণ পরেই নির্ভয়পুরেরই একটি ছেলে অশোক, যাকে সুজয় এককালে অনুপমা টি-এস্টেটে বেশ লড়াই করে ঢুকিয়েছিল সে এসে বলল, “সুজয়দা তোমার বাবাকে দেখলাম হাসপাতালে নিয়ে গেল। ভ্যানে তুলতে পারছিল না। খুব কাঁপছিল। তুমি শিগগির যাও। তোমায় কুন্তলীবউদি ফোনে পাচ্ছে না।”
সুজয় বলল, “অশোক, তোর চাকরিটা আমিই লড়াই করে করে দিয়েছিলাম মনে আছে তো? আজ বুঝি সেই উপকারের প্রতিদান দিচ্ছিস?” অশোক আমতা আমতা করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই সুজয়ের বন্ধুরা চিৎকার করে উঠল, “জিতছি! আমরা জিতছি!”
গণনার শেষে দেখা গেল, মাত্র ত্রিশ ভোটে জিতেছে সুজয়। নিরঞ্জন সমাদ্দারের লোকজন চেঁচামেচি জুড়েছে, গণনায় নাকি ভুল আছে। আবার গুনতে হবে।
সুজয় হাসতে হাসতেই বলল, “আর হেরে গেলেও আমার দুঃখ নেই। এখানের মানুষ আমায় ঠকায়নি, এটাই প্রাপ্তি।”
দ্বিতীয়বার গণনাতেও সুজয় ত্রিশ ভোটেই জয়ী হল। সবার আগে ওর গলায় মোটা রজনীগন্ধার মালাটা পরিয়ে কপালে চন্দনের টিপ পরিয়ে দিল কনকলতা। ফিসফিস করে বলল, “নির্ভয়পুরের মানুষদের তুই দেখিস বাবা।”
সুজয় কনকলতাকে প্রণাম করে বলল, “জেঠিমার শেষেও কিন্তু মা আছে।”
সুজয়কে জড়িয়ে ধরে শৌনক বলল, “তুমি পেরেছ।”
সুজয় সোজা ছুটল ফাদারের কাছে, ওর সব সুখ-দুঃখের সঙ্গীর কাছে। ফাদারের ঘরে রয়েছে শৌনকের বাবা-মা।
ফাদার বললেন, “আপনারা যেমন হাসিনীর কাছে কৃতজ্ঞ, তেমনই হাসিনীও তো আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ। তাই এসব পুরোনো কথা ভুলে গিয়ে যে যার নিজের জীবনে ফিরে যান। আমি বলছি, হাসিনীকে অর্থসাহায্য করতে হবে না। সুজয় সেটা নেবে না। আমি আপনাদের চিনতে পারিনি, বহু বছর আগের কথা তো। হাসিনী তো রত্নগর্ভা!”
সুজয় চুপচাপ চলে এল ওখান থেকে। কিছু সত্য গোপন থাকাই শ্রেয়। শৌনকের মতো মানুষ কোনও কষ্ট ডিজার্ভ করে না। শৌনক ওর কাছে ডাক্তারবাবু হিসেবেই থাকুক। ভালো থাকুক নূপুর আর শৌনক। সুজয় এগিয়ে
চলল, জয়ের আনন্দে।
মাইকে গান বাজছে –
“প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে
মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ।
তব ভুবনে তব ভবনে
মোরে আরো আরো আরো দাও স্থান
আরো আলো আরো আলো
এই নয়নে, প্রভু, ঢালো।”
***