ইতি নির্ভয়পুর – ৪
৪
“শৌনকদা আপনার বাবা ফোন করেছিলেন, মা-ও কথা বললেন। মাসিমার গলার আওয়াজেই বোঝা যাচ্ছিল উনি কাঁদছিলেন। একবার কল করে নিলে পারতেন।”
শৌনক ভিজে হাত-পায়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে বলল, “তুমি কার কাছ থেকে মাইনে পাও প্রলয়? আমার কাছ থেকে তো? তা হলে অন্যের হয়ে উমেদারি করা বন্ধ করো।”
প্রলয় বুঝল, ডাক্তারের মেজাজ আজ সপ্তমে। এমনিতেই একটু মুডি মানুষ। রেগে গেলে আরও মুশকিল। কথা না বাড়িয়ে নিজের কাজে মন দিল।
শৌনকের আজ একলা থাকতে ইচ্ছে করছে। তাছাড়া আজ নির্ভয়পুর প্রয়োজনের থেকে বেশিই শান্ত। হার্ট অ্যাটাক আর মৃত্যুর মধ্যে সম্পর্কটা এতটাই নিবিড় যে, সেই আতঙ্কটা থেকে এখনও বেরোতে পারেনি মানুষ।
অরুণাংশু মল্লিকের হৃদয়যন্ত্রে সমস্যা হয়েছিল গভীর রাতে ঘুমের মধ্যে। ভদ্রলোকের কপাল ভালো, তাই এ যাত্রা বেঁচে গেলেন। তবে স্টেন্ট বসবে। এ খবর নির্ভয়পুরের বাতাসকে বেশ আতঙ্কিত করে রেখেছে।
এখানে মানুষ মারা যায় অপুষ্ট শরীরে প্রসব করতে গিয়ে, পাহাড়ের বাঁকে গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করে, অপুষ্টিতে, অথবা নির্ভয়পুরের জঙ্গলে কাঠ চুরি করতে গিয়ে হাতির পায়ের চাপে বা সাপের কামড়ে। হার্ট অ্যাটাকের মতো কৌলীন্যযুক্ত রোগ এখানে হয় না বললেই চলে। নির্ভয়পুরের মানুষ ঘুম থেকে উঠে পান্তা খেয়ে চা-জমিতে যায়। অথবা কারখানায়। সারাদিন পরিশ্রম করে সন্ধেতে চোলাই খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। তাই এই জনপদ জানেই না, হৃদয়যন্ত্র বিকল হতে পারে। অরুণাংশু মল্লিকের রিসর্টের মালি অবধি চলে গিয়েছিল হসপিটালে। মালিকের শরীর নিয়ে তারও দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। ভুলেই গেছে, এ বছর কুয়াশার জন্য গোলাপ কম হওয়ায় মালিক তাকে ছাড়িয়েই দেবে বলেছিল কাজ থেকে। এরা অপমানগুলো ভুলে যায় বলেই হয়তো সর্বদা হাসে। তবে সব ক’টা উচ্চশিক্ষিত বাঙালি পরিবারের ভয় ধরেছে অন্য কারণে। মল্লিকের হলে আমারও হতে পারে। এই দুশ্চিন্তাতেই নিরঞ্জন সমাদ্দার বললেন, “চেকআপটা করতে হবে ঘন ঘন আমাদের সকলকে। বয়েস তো আমাদের সকলেরই উনিশ-বিশ। আজ হয়নি কাল হতে কতক্ষণ!”
নির্ভয়পুরের সাধারণ মানুষগুলো কতটা সরল! যারা এদের অধিকার কেড়ে নিচ্ছে প্রতি মুহূর্তে তাদের জন্যই পুজো দিচ্ছে মারাংবুরুর কাছে। কেন যে এখানে এতগুলো দিন কাটিয়েও এদের মতো ক্ষমাশীল হতে পারল না শৌনক, কে জানে! শোভন বসু আর নিবেদিতা বসু নাম দুটো ওর কাছে মিথ্যাবাদী আর অহঙ্কারে পরিপূর্ণ দুটো নাম। তাই এদের পরিচয়টা যত তাড়াতাড়ি গা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারবে ও, ততই মঙ্গল। কিন্তু এরা তো আবার তুখড় অভিনেতা। তাই জন্মদিনের দিনে পায়েস রেঁধে পথশিশুদের খাওয়ানো থেকে ওর জন্য মন্দিরে পুজো দেওয়া কিছুই বাদ দেয় না। আর শৌনককে কতটা ভালোবাসে সেটা বোঝানোর জন্যই প্রলয়ের কাছেও ফোনে নাটক করতে ছাড়েনি।
এসব পন্থা ওর জানা। তবুও যে কেন ও আজকে ফোনটা সুইচড অফ করে রাখতে পারল না কে জানে! কীসের কৃতজ্ঞতা! শৌনক তো ওদের হাতের পুতুল ছিল। যেভাবে ইচ্ছে ওকে প্রেজেন্ট করেছে আজীবন।
অন্যমনস্কভাবেই ফেসবুকটা খুলল ও। এই একটা জিনিসের থেকে ও পারতপক্ষে দূরে থাকে। কারণ এই ফেসবুক স্টেটাস একটা সময় ওর জীবনের বেশ কিছু মুহূর্তকে নষ্ট করে দিয়েছে। রণিতার পাগলের মতো অবসেশন ছিল ফেসবুক। প্রায়ই কলেজ থেকে ফেরার পথে আকাশছোঁয়া ইউক্যালিপটাস গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে সেলফি তুলে নিত। সন্ধেতে ফেসবুক খুলেই দেখত, রণিতা স্টেটাস আপলোড করেছে, ক্লাসের পর এক চিলতে অবসরে আমাদের বকবাকুম।’
নিচের কমেন্টে সবাই লিখত, ‘নাইস কাপল।’
আসলে ভালোবাসা জিনিসটাকে এতটা প্রকট করতে নারাজ ছিল শৌনক। ভালোবাসাকে উষ্ণ ঘরে একলা আদর করার পক্ষপাতী ছিল শৌনক। খোলা বারান্দায় বন্ধুত্বতে বিশ্বাসী ছিল ও। কিন্তু রণিতার প্রেমে গভীরতা বড়ো কম ছিল। স্বচ্ছ জলের মতো। ভিতর অবধি দেখা যায়। কোনও রহস্য নেই তাতে। আবিষ্কারের আনন্দ নেই, গোপনের উন্মাদনা নেই। আসলে রণিতা ছিল শৌনকের বেস্টফ্রেন্ড। মেডিকেল কলেজে গিয়ে টমবয় রণিতা নিজেই এসে আলাপ করেছিল মুখচোরা শৌনকের সঙ্গে। তখনও অবধি শৌনকের ছেলে বন্ধু থাকলেও মেয়ে বন্ধু ছিল না বললেই চলে। রণিতাই ওর প্রথম মেয়ে বন্ধু। তবে রণিতার প্রাণোচ্ছল স্বভবের জন্যই ক্লাসশুদ্ধু সবাই ওর বন্ধু ছিল। তারপরেও ও যেন শৌনককে একটু বেশিই গুরুত্ব দিত। শৌনক কোনও কারণে কলেজ না এলে সঙ্গে সঙ্গে কল করে জানতে চাইত কেন আসেনি? এভাবেই একদিন ওরা বেস্টফ্রেন্ড হয়ে গিয়েছিল। তারপর ওরা নিজেদের সবটুকু শেয়ার করত। তখনই এক সন্ধেয় ভিড় বাসে আচমকা রণিতা বলেছিল, “শৌনক, আমি তোকে ভালোবাসি জানিস।”
শৌনক আদৌ সিরিয়াসলি না নিয়ে বলছিল, “বাহ, প্রোপোজ করার জায়গাটা দারুণ বেছেছিস।”
কিন্তু সেদিনের পর থেকেই একটু একটু করে বদলে যাচ্ছিল রণিতার ব্যবহার। অদ্ভুত এক পজেসিভনেস তৈরি হয়েছিল শৌনককে ঘিরে। ফেসবুকে ছবি আপলোড করে করে সকলকে জানিয়ে দিচ্ছিল, ওরা রিলেশনশিপে আছে।
শৌনক একদিন বলার চেষ্টাও করেছিল, “রণিতা, এত ওপেন করার কী আছে? আমরা ফ্রেন্ড ছিলাম ওটাই তো ভালো ছিল। ফিলিংস তৈরি হলে না হয় রিলেশনশিপ নিয়ে ভাবা যেত।”
রণিতা সে কথায় পাত্তা না দিয়েই বলেছিল, “এই তুই থাম তো, জানিস আমাদের দেখে সবাই জ্বলে। এটা আমি এনজয় করি।”
কিছুটা যেন জোরজবরদস্তি করেই ওরা বেস্টফ্রেন্ড থেকে লাভ কাপল হয়েছিল। শৌনক চিরকালই মুখচোরা। ওর রাগ, অভিমান সবকিছুর অভিব্যক্তিই বেশ শীতল। নিজের বাইরে একটা বরফ-শীতল প্রাচীর টেনে দেয় ও। রণিতা আবার চিৎকার করে নিজের অধিকার স্থাপনে বিশ্বাসী।
শৌনক একদিন বলেছিল, “রণিতা, তুই আজও আমার বেস্টফ্রেন্ড আছিস, কেন কে জানে ঠিক ভালোবাসার অনুভূতি হয় না তোকে কেন্দ্র করে। হ্যাঁ রে, আমাদের ভবিষ্যৎ জীবনে আমার এই অনুভূতি কোনও প্রভাব ফেলবে না তো?”
একটু ম্যাচিওর উত্তর আশা করেছিল ও রণিতার থেকে। কিন্তু রণিতা ফুৎকারে কথাটা উড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, “আরে, আমি তো তোকে ভালোবাসি। দ্যাটস এনাফ। আর তুই আমায় ভালো বন্ধু ভাবিস। বাকিটা হয়ে যাবে। আরে রণিতা রায় তোকে ভালোবাসে, আর কী চাস তুই?”
নিজেকে নিয়ে অবসেস ছিল রণিতা। কেউ ওর কথা না শুনলে অসম্ভব রেগে যেত। হয়তো ছোটো থেকে সকলের কাছে বেশি গুরুত্ব পেয়ে পেয়ে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। তাই সেল্ফ লাভে এতটাই বিশ্বাসী ছিল যে, বাকি কে কী ভাবল নিয়ে মাথা ঘামানোর অবসর ছিল না। তাই শৌনকের দিক থেকে তেমন কোনও সাড়া না পেয়েও এটাকে ও লাভ রিলেশনশিপ বলতেই ভালোবাসত। তবে সম্পর্কটাও একটা অভ্যাস। রণিতার সঙ্গে থাকতে থাকতে শৌনকও বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল, ও ভালোবাসে রণিতাকে। অভ্যাস বোধহয় এভাবেই কাঁধে চেপে ঘাড় ধরে করিয়ে নেয় যেটা সে চাইছে। দুইবাড়ির সকলেই জেনে গিয়েছিল রণিতার আগ্রহে ওদের রিলেশনশিপে থাকার কথাটা। তাতে অবশ্য কারওরই কোনও আপত্তি ছিল না। থাকার কথাও নয়। শোভন বসু আর নিবেদিতা বসু দুজনেই প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার। জীবনে উপার্জন কিছু কম করেননি। এমনকি শৌনকের দাদু, যাঁকে শৌনক দেখতেই পায়নি তিনিও ছিলেন প্রফেসর। শৌনকের বাবা একমাত্র সন্তান হাওয়ায় সব সম্পত্তির উত্তরাধিকার তারই হয়েছিল। তবে কোনও এক অজ্ঞাত কারণে শৌনকের ঠাকুরমা নিবেদিতা আর শৌনককে সেভাবে সহ্য করতে পারতেন না। নিজের বাড়িতে গোটা পাঁচেক পরিচারিকা বেষ্টিত হয়ে দিন কাটাতেন। শৌনকদের বাড়িতে আসতেন না তেমন। বিজয়ায়, নববর্ষে ওরাই যেত ঠাকুরমাকে প্রণাম করতে। মা বলেছিল, “আমি পেশায় ডাক্তার বলে ওঁর অপছন্দের। বিয়ের আগে থেকেই সেটা অতি প্রকটভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন উনি। তাই আমার সন্তানও ওঁর পছন্দের নয়।”
এসব নিয়ে অবশ্য বেশি ভাবার অবকাশ কোনওদিনই শৌনক পায়নি। নিজের পড়াশোনা নিয়ে এতটাই ব্যস্ত থেকেছে ছোটো থেকে। তবে বনেদি বাড়ির, অবস্থাপন্ন বাড়ির ছেলে বলে ওকে সকলেই একটু ভিন গ্রহের বাসিন্দা ভাবত। শৌনক পুল কারে স্কুল যেত না। যেত নিজেদের গাড়ি করে। পরে অবশ্য জেদ করে ও পুলকারেই যাতায়াত করত। বাকিদের সঙ্গে মিশে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু ওর বংশ পরিচয়ই সেটা হতে দেয়নি। সবাই বলত, “তোর দাদু তো নামকরা প্রফেসর ছিলেন।”
দাদুর লেখা লাইফ সায়েন্স বই স্কুলের পাঠ্য ছিল। বাবা-মা দুজনেই শহরের নামী ডাক্তার। তাই পরিচয় গোপন করতে চাইলেই হত না। শৌনক নামী স্কুলে পড়ত, তাই বন্ধুদের পরিবারও যথেষ্ট ধনী ছিল। কিন্তু ওই যে বংশ মর্যাদায় ও ছিল বেশ উঁচুতে। যদিও মেডিকেল কলেজ হস্টেলে এই সমস্যা হয়নি ওর। তখন বন্ধুরা অনেক সংকীর্ণতা মুক্ত ছিল। তবে জানত সবাই। কারণ ছুটির দিনে বিশাল গাড়ি হাঁকিয়ে বাবা-মা আসত ওর হস্টেলে। তাই রণিতার বাড়ি থেকে শৌনককে নিয়ে আপত্তির কোনও জায়গা ছিল না। বরং রণিতা প্রায়ই এসে বলত, “জানিস শৌনক, আমায় লোকজন হিংসা করে বস। কারণটা হলি তুই। তুই এত ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট বলে নয়, তোর ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ডের জন্য করে।”
বাড়ির সকলকে নিয়ে যে একেবারেই গর্ব ছিল না এমন নয়, কিন্তু এত সবের ভিড়ে কেমন যেন হারিয়ে যাচ্ছিল ওর নিজস্বতা। বারবার মনে হত, যত ভালো ডক্টরই হোক, বিখ্যাত কার্ডিওলজিস্ট শোভন বসুর সঙ্গে ওর তুল্যমূল্য বিচার চলবেই। লোকে বলবেই, বাবার মতো তো হয়নি।
যত বড়ো গাইনোকলজিস্টই হোক লোকজন বলবেই, নিবেদিতা বসুর হাতই আলাদা। অদ্ভুত একটা তুলনা চলবেই ওকে নিয়ে। দিন-রাত “তোর যা ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড” শুনে শুনে বিরক্ত লাগত শৌনকের। একদিন রণিতাকে বলেই ফেলেছিল, “তুই আমায় ভালোবাসিস না আমার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ডকে?”
রণিতার সাফ কথা, “দুটোকেই।”
হয়তো এই কারণেই রণিতা ওর বেস্ট ফ্রেন্ড হতে পারলেও লাভার হয়ে উঠতে পারেনি। শৌনকের অব্যক্ত কষ্টগুলো বোঝার ক্ষমতা রণিতার কোনওদিনই ছিল না।
রণিতার কাছে একান্ত মুহূর্ত বলে কিছু ছিল না। সব সময়েই এক দঙ্গল বন্ধু নিয়ে হই হই করতেই ভালোবাসত।
শৌনক একদিন নিজের ঘরে বসে ওর শখের ক্যামেরাটা নিয়ে খুটখাট করছিল। প্রায় লাখ তিনেকের এই ক্যামেরাটা মা ও ডাক্তারি পাশ করার পরে গিফট করেছিল ওকে। মা কখন চুপচাপ ঘরে ঢুকেছে খেয়াল করেনি শৌনক। হঠাৎই কোনও ভনিতা ছাড়াই মা জিজ্ঞাসা করেছিল, “হ্যাঁ রে শানু, তুই কি আদৌ এই রণিতাকে ভালোবাসিস?”
মায়ের এ স্বভাবটা ওর ভীষণ পরিচিত। মায়ের মনের মধ্যে যখন এলোমেলো ভাবনা চলে, মা যখন একটু অস্থির থাকে, তখন এমন ভূমিকাবিহীন কথা বলে। এই নিয়ে ওর আর বাবার মধ্যে টুকটাক মজাও হয়েছে। বাবা বলে, “মাথা আর ল্যাজা ছাড়া কথা মানেই বুঝবি তোর মা প্রেশারে আছে। কলেজ জীবনে আমি যখন প্রেমের কথা বলছি, তখন একদিন আমায় এসে বলেছিল, ‘তুমি এক্সামের সময় ডিম খাও?’ বিশ্বাস কর শানু আমি প্রথম ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। পরে বুঝেছিলাম, ও বোঝার চেষ্টা করছিল আমি আস্তিক না নাস্তিক? তারপর অবশ্য তোর মায়ের এরকম স্কন্ধকাটা কথা শুনলে বুঝি মহিলা চাপে আছে।”
শৌনকও মায়ের এ স্বভাবের সঙ্গে পরিচিত। যেদিন ওর জয়েন্টের রেজাল্ট আউট হবে সেদিন মা হঠাৎ বলল, “আচ্ছা, ডাক্তারদের জীবনটা কি ভালো?”
বাবা চোখের ইশারায় বলেছিল, তোর মা ভীষণ চাপে আছে। কিন্তু হঠাৎ রণিতাকে ভালোবাসিস কি না জিজ্ঞাসা করার কারণটা শৌনকের বোধগম্য না হওয়ায় ও একটু অবাক হয়েই তাকিয়েছিল।
মা দম নিয়ে বলেছিল, “খুব সহজ একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে এত দেরি করছিস কেন? তুই আমায় বেশি ভালোবাসিস না বাবাকে?”
শৌনক হেসে বলেছিল, “ছোটোবেলায় তোমাদের ঝগড়ার ভয়ে বলতাম দুজনেই। এখন বলি, তোমাকে হাফ সেন্টিমিটার বেশি বাসি।”
মা একটুও না হেসে বলেছিল, “এটার উত্তর তার কাছে ক্লিয়ার তাই তুই সময় নিলি না। আমার আগের প্রশ্নের উত্তর কি তোর কাছে পরিষ্কার নয়?”
শৌনক মাকে পাশের চেয়ারে টেনে বসিয়ে বলেছিল, “মা রিলেশনশিপে থাকলে ঠিক কেমন অনুভূতি হয় আর গো?”
নিবেদিতা ভ্রু কুঁচকে বলেছিল, “বুঝেছি, তুই কনফিউজড। দেখ আমারও এটাই মনে হয়েছে। তুই যেমন, রণিতা সম্পূর্ণ তার বিপরীত। মেয়েটা খুবই মিশুকে কিন্তু গভীরতা বড়ো কম।”
শৌনক বলেছিল, “মা কী দেখে তোমার এটা মনে হল?”
নিবেদিতা হেসে বলেছিল, “তুই যখন কচি ছিলিস তখন অযথা কেঁদে উঠতিস। তোর বাবা বলত, ‘আরে, এই তো খাওয়া শেষ করল, কাঁদছে কেন?’ আমি জানতাম যতক্ষণ না ঘুমাবি, গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে হবে। তাই তোর স্বভাবগুলো যে আমার বড্ড পরিচিত। রণিতা তোর বেস্টফ্রেন্ড হলেও, বিশেষ একজন নয় সেটা ওর সঙ্গে কথা বলার সময় তোর মুখের অস্বস্তি দেখেই বুঝেছিলাম। তা হলে কেন টানছিস সম্পর্কটাকে? মেয়েটা তো কষ্ট পাবে শানু।”
শৌনক বলেছিল, “মা ও মানতেই তো চায় না যে, ওকে কেউ রিজেক্ট করতে পারে! অদ্ভুত এক অবসেশনে থাকে। দেখো, ও তো আমার ভালো বন্ধু, তাই আমি চিনি ওর স্বভাবগুলো। আমি ওকে রিজেক্ট করলে কিছুতেই মেনে নিতে পারবে না রণিতা।”
নিবেদিতা একটু ভেবে বলেছিল, “শানু, এটা তুই বন্ধুত্বের দিকে তাকিয়ে বলছিস। কিন্তু যে সম্পর্কে অনুভূতি তৈরি হয় না সেটা কি দীর্ঘদিন টানা সম্ভব?”
মা ওর সবটুকু বুঝে যেত না বলা সত্ত্বেও। তারপরেও কেন মা বুঝল না, ওর কাছে মিথ্যে বলার ফলটা ভালো হবে না। শৌনক কোনওদিন ক্ষমা করবে না নিবেদিতা আর শোভন বসুকে। এত বড়ো একটা সত্যি যারা দিনের পর দিন লুকিয়ে রাখতে পারে, তাদের ভালোবাসা নিয়েই আজকাল অনেক সন্দেহের উদয় হয়।
রণিতাকে ঠিকমতো বুঝতেই পারল না শৌনক। হঠাৎই একদিন ঝড়ের গতিতে ওর সামনে উপস্থিত হয়ে বলেছিল, “আচ্ছা আমি যদি বাইসেক্সুয়াল হই, তোর কোনও সমস্যা হবে? মানে জানিস তো শৌনক, আমার হস্টেলের রুম-পার্টনার ছিল না তোর সঙ্গে পরিচয় ছিল তো, আরে সুদক্ষিণা ওকেও আমি ভালোবাসি এখন ফিল করছি। অবশ্য সুদক্ষিণার দিক থেকেই প্রথম প্রোপোজাল আসে জানিস তো। আমরা যখন রুম শেয়ার করেছি, একে অপরের ব্রা-এর পিছনের হুক লাগিয়ে দিয়েছি, তখন কিন্তু আমরা এরকম কোনও টান অনুভব করিনি। কিন্তু এমবিবিএস পাশ আউট হওয়ার পরে ইন্টার্ন হয়ে যখন কাজ করছি, তখন ওর আর আমার মধ্যে অদ্ভুত একটা সাইকোলজি কাজ করছে। বেসিক্যালি সুদক্ষিণাও সিঙ্গল নয় রে। ওরও বয়ফ্রেন্ড আছে।”
শৌনক তখন ডাক্তারি পাস করেছে সদ্য। মানুষের এসব বিষয় ওর অজানা নয়। তাই বলে ওর প্রেমিকা অন্য আর-একজনকে ভালোবাসবে ওর পারমিশন নিয়ে এতটা উদারতা দেখাতে পারেনি ও।
রণিতা ওকে চুপ করে থাকতে দেখে বলেছিল, “কী রে, তুই আবার মা-মাসিদের মতো কথা বলবি নাকি? দেখ ও ছেলে নয়, তাই সেভাবে ফিজিক্যাল রিলেশন আমাদের হবে না তুই নিশ্চিত থাকতে পারিস। তবে মানসিকভাবে কিন্তু আমি তোদের দুজনকেই ভালোবাসব। তোর নিশ্চয়ই আপত্তি নেই।”
বিরক্ত হয়ে কফির কাপ ফেলে উঠে পড়েছিল শৌনক। এ কেমন সম্পর্ক যেখান থেকে বেরোনোর জন্য ও হাঁসফাঁস করছে? এ কেমন সম্পর্ক যেখানে ওর তথাকথিত গার্লফ্রেন্ড ওকে বলছে আমি দুজনের প্রেমিকা।
হন হন করে হাঁটছিল শৌনক, ছুটে এসে ওকে ধরেছিল রণিতা। হেসে বলেছিল, “বুঝিনি তো কোনওদিন তুই এত পজেসিভ! আই লাইক ইট। কিন্তু সুদক্ষিণাকে আমি হ্যাঁ বলে দিয়েছি রে। তাই সরে আসা সম্ভব নয়। সো আমাকে ভালোবাসলে তোকে এটুকু মেনে নিতেই হবে।”
শৌনক সেই প্রথম মুখ খুলেছিল। সোজা ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “রণিতা, তুই যখন আর-একজন পার্টনার পেয়েই গেছিস তখন আমার মনে হয় সত্যিটা আমার বলা দরকার। আমি ভাবতাম তুই আমায় খুব ভালোবাসিস, তুই হার্ট হবি তাই বিষয়টা হজম না হলেও হজমের ওষুধ খেয়েও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে তুই তো আমায় সব কিছুই নির্দ্বিধায় বলতে পারিস, তা হলে আমি কেন নয়? বিলিভ মি, তুই আমার ভালো বন্ধু হলেও প্রেমিকা হতে পারিসনি কোনওদিনই। আসলে তোকে ঘিরে আমার সব ফিলিংসদের আমি একসঙ্গে সাজিয়ে দেখেছি, সেখানে বন্ধুত্ব প্রকট হলেও, প্রেম, ভালোবাসা নামক অনুভূতিরা অনুপস্থিত। তুই হয়তো বলতেই পারিস, এতদিন কেন বলিনি? আসলে বলার সুযোগ দিসনি তুই। যতবার বলতে গেছি আকারে-ইঙ্গিতে, তুই বলেছিস, আমি জানি শৌনক ভালো তুই আমাকেই বাসিস, হয়তো বাসার স্টাইলটা একটু আলাদা। সেদিন তোর বার্থ ডে পার্টিতে তুই আমার কাছ থেকে কিস চেয়েছিলি। আমি দিতে পারিনি কারণ কিন্তু এটাই। আমি তোকে প্রেমিকার চোখে দেখি না রণিতা। তুই যদি সুদক্ষিণাকে ভালোবেসে থাকিস দ্যাটস গুড। কিন্তু ভালো করে বুঝে নিস ফিলিংসটা রুম-পার্টনার, বেস্ট ফ্রেন্ডের মতো নয়তো? তা হলে কিন্তু আমার মতোই বিপদে পড়বি।”
এই প্রথম রণিতা ওকে এতগুলো কথা বলতে দিয়েছিল। না হলে বেশি কথা বলাই যায় না ওর সামনে। যে যা-ই বলুক, তাকে থামিয়ে দিয়ে নিজেই বলতে শুরু করে।
সব কথাগুলো শুনে হো হো করে হেসে উঠেছিল রণিতা। তারপর আচমকাই ওর চুলটা ঘেঁটে দিয়ে বলেছিল, “এত রেগে গেছিস সুদক্ষিণার নাম শুনে যে এভাবে সম্পর্কটাকেই অস্বীকার করে দিলি? আমি কিন্তু তোর কাছে এরকমটা আশা করিনি। এনি ওয়ে, আপাতত আমি সুদক্ষিণার প্রতি একটু বেশি টান অনুভব করছি, তাই টেক ইয়োর টাইম। দেখ আমি ছাড়া তোর মতো মুখচোরা ছেলের আর কোনও গার্লফ্রেন্ড জোটে কি না। তারপর না হয় আবার অনুভূতি, আবেগ এসবের পশরা নিয়ে বসিস।”
শৌনক বুঝেছিল, রণিতা ওর কথাগুলোকে সেরকম গুরুত্ব দিল না। এটাই ভয় পেয়েছিল শৌনক। সেই কারণেই এতদিন বলা হয়ে ওঠেনি। রণিতার জীবনে এখন সুদক্ষিণা এসেছে বলেই এগুলো বলতে পারল শৌনক। তবুও রণিতা যখন কষ্টটা লুকিয়ে হাসছিল, তখন ওর নিজের বেশ খারাপই লাগছিল। কত ভালো সময় কাটিয়েছে ওরা বন্ধু হিসেবে। এই অপমানের পর রণিতা ওকে আর বন্ধু ভাববেও না। কিন্তু কিছু করার নেই শৌনকের। এ সম্পর্কের মধ্যে থাকতে থাকতে ওর দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছিল।
সেদিন সন্ধেতে ফিরে চুপ করে নিজের ঘরে বসেছিল শৌনক। মনটা বেশ খারাপই ছিল। একটা চিনচিনে অপরাধবোধ কাজ করছিল মনের মধ্যে। রণিতাকে হার্ট করতে চায়নি শৌনক। সেভাবে ফিলিং না থাকা সত্ত্বেও থেকে গিয়েছিল ওর আবদার মেনেই সম্পর্কটাতে। কিন্তু ওর ওই সুদক্ষিণাকেও ভালোবাসব একসঙ্গে বলার মধ্যে অদ্ভুত একটা অবজ্ঞা লক্ষ করেছিল শৌনক। মনে হচ্ছিল, শৌনককে ও টেকেন ফর গ্রান্টেড ধরে নিয়েছে। এটা মেনে নিতে না পেরেই একসঙ্গে সবটুকু উগরে দিয়ে এল। ও জানে রণিতা ওর নামে সকলের কাছে অনেক বানিয়ে মিথ্যে বলবে, সে বলুক মিথ্যে। এলোমেলোভাবে টেবিলের ওপরে রাখা পেপার ওয়েটটা ঘোরাচ্ছিল ও।
তখনই মা এসে ওর কাঁধে হাত রেখে বলল, “কী হয়েছে? ব্রেকআপ?”
শৌনক একটু অবাক হয়েই বলেছিল, “তুমি কি ম্যাজিক জানো নাকি? কী করে বুঝলে?”
মা গরম কফির কাপটা সামনে রেখে বলেছিল, “আমি তো আরও কিছু জানি রে। যেমন রণিতাকে তুই বন্ধু ভাবতিস, তাই ব্রেকআপে তোর তেমন কষ্ট হচ্ছে না, কিন্তু বন্ধুকে হার্ট করে ফেললি কি না ভেবে তুই কষ্ট পাচ্ছিস।”
শৌনক কোনও ভূমিকা ছাড়াই মাকে চেপে ধরে মায়ের পেটের কাছে মাথাটা গুঁজেছিল। মা ওর চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়েই মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। একটা কথাও বলেনি তখন। শৌনককে সময় দিচ্ছিল কষ্টটুকু সহ্য করার। তারপর নিবেদিতা আলতো করে নরম গলায় শৌনকের চেনা ভঙ্গিমায় বলেছিল, “আজ যে অনুভূতিটা তোকে কষ্ট দিচ্ছে কাল সেটাই রণিতাকে কষ্ট দিত। যখন তোরা একই ছাদের নিচে থাকতে শুরু করতিস তখন সবটাই প্রকট হত রণিতার সামনে। আসলে কী জানিস, দূরত্বের একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে, সে আড়ালটুকুকে বাঁচিয়ে রাখে সযত্নে। কিন্তু যখন একই ছাদের নিচে নিত্যদিনের জীবনটা চলমান হয় তখন ওই আড়ালটুকু বেআব্রু হয়ে যায়। তখন প্রকৃতভাবে বোঝা যায়, কে, কাকে, কতটা মানিয়ে নিতে পারবে। ভালোবাসার গভীরতা না থাকলে দুজন আলাদা পরিবেশে বড়ো হয়ে ওঠা মানুষ কোনওভাবেই এক ছাতার নিচে দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারে না শানু। তাই রণিতার চোখে তুই খুব সহজেই ধরা পড়ে যেতিস তখন। সেটা আরও দুঃখজনক হত ওর কাছে। ভুলে যাস না রণিতাও একজন হবু ডাক্তার। দিনের শেষে হাজার ঝঞ্ঝাট পার করে এসে যখন তোর শীতল ব্যবহার পেত, তখন ওর বুঝতে বাকি থাকত না তুই কিছুটা নিমরাজি হয়েই বিয়েটা করেছিলি। তাই বিবাহপরবর্তী সময় দূরত্বের আড়াল তোকে বাঁচাতে পারত না। তার থেকে বরং এই ভালো হল, বুঝলি?”
শৌনক বলেছিল, “মা, আমি জানি রণিতাকে আমি ভালোবাসি না। তবু ওকে এভাবে বলে ফেলায় কষ্ট কেন হচ্ছে?”
নিবেদিতা ছেলের মাথায় হাত রেখেই বলেছিল, “আসলে জীবনটা একটা অভ্যাস বুঝলি। এই যে গত চারবছর ধরে রণিতা তোর মধ্যে কিছু অভ্যেস ঢুকিয়ে দিয়েছিল। যেমন কলেজ থেকে বেরিয়ে একসঙ্গে ক্যান্টিনে যাওয়া, কারণে-অকারণে ফোন করা, তোর অপছন্দ জেনেই সেলফি তোলা, ফেসবুকে আপলোড করা এইসব কিছুতে তুই ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলি। কখন যেন বিরক্তিটুকু চলে গিয়ে ভাবতে শুরু করেছিলি, রণিতা আছে মানে এগুলো করবেই। তুই বুঝতে পারছিস, রণিতা আর তোর সঙ্গে আগের মতো বিহেভ করবে না। সেই স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করবে না তোর সঙ্গে থাকাকালীন, এই উপলব্ধিটাই তোকে কষ্ট দিচ্ছে।” শৌনক ফিসফিস করে বলেছিল, “সব মায়েরাই তাদের সন্তানকে এমন করেই বোঝে? নাকি শুধু তুমিই?”
বাইরে বেশ চিৎকার হচ্ছে, কানে হেডফোন লাগিয়ে ভাবনার জগতে বিচরণ করছিল বলেই শুনতে পায়নি শৌনক। এখন হেডফোন খুলে শুনতে পেল, বেশ কয়েকজন ওরই নাম ধরে ডাকাডাকি করছে। প্রথমেই বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। মল্লিকবাবুর কিছু হল না তো? ভদ্রলোকের বিপদ এখনও কাটেনি। মুশকিল হচ্ছে কার্ডিও সার্জন শ্রীনিবাস রাতে নির্ভয়পুরে নেই। সে যথারীতি কাল সকাল দশটার আগে আসবেই না হাসপাতালে। জলপাইগুড়ি থেকে তার আসতেও ঘণ্টা চারেক লাগবেই। এখন যদি মল্লিকবাবুর কিছু সমস্যা দেখা দেয় তার সব দায় নিতে হবে শৌনককেই।
বাইরে বেরোতেই দেখল, সুজয় আরও কয়েকজন ছেলেকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওরাই চেঁচামেচি করে ডাকছে শৌনককে।
ও বেরোতেই সুজয় বলল, “সর্বনাশ হয়ে গেছে ডাক্তারবাবু, কুন্তলীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এই খবরে ওর মা ঘন ঘন অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। জলের ঝাপটা দিয়ে জ্ঞান ফেরালেও দু’মিনিট ঘোলা চোখে তাকিয়ে আবার জ্ঞান হারাচ্ছে। ওকে একটু দেখে দিতে হবে ডাক্তারবাবু।”
শৌনক দেখল সারাদিনের ধকল সামলে প্রলয়ও ঘুমিয়ে পড়েছে।
শৌনক দেরি না করে নিজেই ওর ডাক্তারির ব্যাগটা নিয়ে বাইক বের করতে যাচ্ছিল, তখন সুজয়ই বলল, “ডাক্তারবাবু আমাদের সঙ্গে বাইক আছে। কাঞ্চনের বাইকে চেপে চলুন।”
কাঞ্চন বাইক চালাতে চালাতেই বলল, “কুত্তলীর হাবভাব ক’দিন ধরেই আমার ভালো ঠেকছিল না ডাক্তারবাবু। সুজয়দা হয়তো মানতে চাইছে না, কিন্তু সাজগোজ খুব বেড়েছে কুম্ভলীর। ওই ক্লাবে চাকরি পাওয়ার পর থেকেই। কিন্তু এই মাসখানেক দেখছিলাম বেশ রাত করে বাড়ি ফিরছিল। বার বন্ধ হয়ে যাবার পরে কোথায় থাকে কে জানে?”
শৌনকের এসব কথা মাথাতেই ঢুকছে না। পেশেন্ট কেমন আছে সেটাই ঘুরছে মাথায়। নির্ভয়পুরের নিম্ন মধ্যবিত্ত বাড়ির সুন্দরী মেয়েদের প্রতি এই তথাকথিত ভদ্রলোকদের একটা মোহ আছে। ওই বাগানের সযত্নে লালিত ফুলের থেকেও পাহাড়ের খাঁজে অযত্নে বেড়ে ওঠা নাম না জানা বুনো জংলি ফুলের প্রতি যেমন মানুষের আকর্ষণ থাকে, তেমনই। কুণ্ডলীকেও দেখতে যথেষ্ট আকর্ষণীয়। এখন আবার ক্লাবে কাজ করার ফলে বড়োলোকদের আদব-কায়দা শিখে বেশ আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। তার প্রতি যে মালিকপক্ষের কারও একটা নজর পড়বে সেটা স্বাভাবিক। তবে শৌনকের সাধারণ নজরে মনে হয়েছিল, সুজয় আর কুম্ভলীর মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে। সেই সম্পর্কটা শুধু কুন্তলীর মাকে বাঁচিয়েছে সেই কৃতজ্ঞতা নয়, বা কুন্তলীর চাকরি করে দিয়েছে সুজয় সেই ঋণস্বরূপও নয়, এ সম্পর্কে বেশ কিছুটা অধিকারবোধ আছে। অন্তত শৌনকের সেটাই মনে হয়েছিল। কুন্তলীদের বাড়ির সামনে দু’-চারজন লোকজন কৌতূহলবশতই ঘোরাফেরা করছে। বারান্দায় শুয়ে আছে কুন্তলীর মা। শৌনক গিয়ে প্রেশার চেক করেই দেখল বেশ লো, শরীর অতি দুর্বল। তাই একটু টেনশনেই জ্ঞান হারাচ্ছে।
শৌনক প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতেই কুন্তলী ঢুকল। ঢুকেই লোকজন দেখে বেশ ঘাবড়ে গেছে। সুজয়কেই প্রথম জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে? সুজয় ওর মায়ের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, “তোমার ফিরতে দেরি হচ্ছে দেখে তোমার মা জ্ঞান কান্নাকাটি করে জ্ঞান হারাচ্ছিল, কাঞ্চনকে খুঁজতে ও পাঠয়েছিল। ও ক্লাবে গিয়ে দেখে, ক্লাব বন্ধ হয়ে গেছে। এটা শুনে ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিল বারবার। তাই আমরা ডাক্তারবাবুকে ডেকে নিয়ে এসেছি।”
কুন্তলী এগিয়ে এসে বলল, “কী দেখলেন ডাক্তারবাবু?”
শৌনক প্রেসক্রিপশনটা কুম্ভলীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “শরীরটা খুবই দুর্বল। একটু ভালোমন্দ খাওয়াতে হবে।”
কুম্ভলীর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সুজয়। ভালো করে বুঝে নেবার চেষ্টা করছে, মেয়েটার ঠিক কতটা বদল হয়েছে? কুত্তলী আজ সুজয়ের চোখের দিকে যেন সোজাভাবে তাকাতে পারছে না। তবে কি কুন্তলী আর আগের মতো শ্রদ্ধা করে না ওকে? একদিন অন্ধকার রাতে ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেছিল সুজয়। তারপর থেকেই কি ওকে দুর্বল ভাবছে কুন্তলী? তাই আগের সম্মানটা হারিয়েছে সুজয় ওর চোখে? যদিও সুজয় জানে না আসল কারণটা কী, তবে ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে, কিছু একটা লুকোচ্ছে কুন্তলী। যদিও সুজয়ের কাছে আবেগ বেশিক্ষণ টিকতে পারে না। বাস্তবের সংঘাতে তা খুব সহজেই জায়গা বদল করে। নির্ভয়পুরের বেশিরভাগ মানুষ কষ্টে আছে। প্রতিমুহূর্তে প্রতারিত হচ্ছে মালিকপক্ষের কাছে। সেটা থেকে কী করে বাঁচাবে নির্ভয়পুরকে এটাই প্রাথমিক চিন্তা ওর। তাই কুন্তলী কেন বদলে যাচ্ছে সেটা নিয়ে বিস্তর ভাবার অবকাশ ওর নেই। তবে মেয়েটা যদি ক্লাবে কাজ করতে গিয়ে মালিকপক্ষে যোগ দেয়, তা হলে খবরগুলো আর পাবে না সুজয়। ওদের চক্রান্তগুলো না জানতে পারলে আগে থেকে সচেতন হওয়া মুশকিল। লোকবল, অর্থবল সবই বেশি ওদের। তাদের সঙ্গে পেরে উঠবে কেন সুজয়? আর নির্ভয়পুরের দুঃখ-কষ্টে দিন কাটানো মানুষগুলো তো একদিনের মাংস-ভাত বা মদের লোভে সুজয়কে খুন করতেও পিছ-পা হবে না। মল্লিক, সমাদ্দার, ঘোষালদের আসল অস্ত্রই তো এ অঞ্চলের অশিক্ষা আর দারিদ্র। এই দুটোকে কাজে লাগিয়ে কত কিছু করে ফেলল ওরা। সুজয় জানে, হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া নির্ভয়পুরের লোকজন বড়ো অল্পে বিক্রি হয়। হয়তো চিরকালীন অভাবই দায়ী এর জন্য।
কুন্তলী তখনও মাটির দিকে তাকিয়েই বলল, “আজ একটু কাজ পড়ে গিয়েছিল, তাই দেরি হল।”
সুজয় হেসে বলল, “বাবুদের সমগোত্রীয় হয়ে উঠেছ, কাজ তো পড়বেই। যাক গে, মাকে দেখাটাও একটা কাজ। সেটা পাড়ার লোকজন তখনই করত যখন তুমি তাদের একজন ছিলে।”
সুজয় আর না দাঁড়িয়েই হন হন করে চলে গেল।
কুন্তলীর এই প্রথম সুজয়ের ওপরে বেশ রাগ হল। সব সময় এমন কাঠখোট্টা করে কে কথা বলে? নীহার তো বলে না। সে তো কত নরম করে কথা বলে। ওর মুখ, চোখের প্রশংসা করে। ওর স্বভাবের প্রশংসা করে। আর সুজয় এক অদ্ভূত জেদ নিয়ে বসে আছে সবসময়। নীহার তো সেদিন বলল, “নির্ভয়পুর থেকে যদি সব ব্যবসাদাররা চলে যায়, তা হলে নির্ভয়পুরের লোকজন খাবে কী? যত ব্যবসা বাড়বে তত অভাব ঘুচবে এখানের লোকজনের।” ঠিকই তো বলছে নীহার। এই যে কুন্তলী এখন ক্লাবে কাজ করছে, ওদের বাড়িতে দুটো পয়সা বেশি আসছে বলেই তো পাকা বাথরুম করতে পারল ওরা। মায়ের একার রোজগারে তো নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যেত। এখন যদি এখানে ক্লাবটা তৈরিই না হত, তা হলে কি এটা হত? এদিকে সুজয় বলে, বাবুরা নাকি ওদের ন্যায্য পয়সা দিচ্ছে না। কুন্তলীর ইদানীং মনে হচ্ছে, সুজয় বড্ড গোয়ার। শুধু শুধু মালিকপক্ষের পিছনে পড়ে আছে। কুন্তলীর মা-ও তো চায়ের কারখানাতেই কাজ করে সংসার চালায়। ওই কারখানাটা যদি বাবুরা না করত, তা হলে ওর মা কোথায় কাজ করত? এসব ভাবে না সুজয়। ওর ধারণা, সবাই শুধু ঠকাচ্ছে। কুন্তলী অনেকরকম করে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল সুজয়কে যে, এবারে মা ওর বিয়ে দিতে চায়। পাত্র দেখবে বলছিল। তার পরেও সুজয় শান্ত গলায় বলেছিল, “পাত্র দেখলে আমায় বোলো, ভালো করে খোঁজখবর নিয়ে আসব পাত্রের। আজকাল তো মানুষ চেনা বড়ো বিপদ।” কুত্তলীই বলেছিল, “তুমি বিয়ে করবে না? তোমার মা-ও তো হাত পুড়িয়ে রেঁধে মরছে।” সুজয় একটু চুপ করে থেকে বলেছিল, “সংগ্রামী মানুষদের কোনও বন্ধনে জড়াতে নেই।” মাঝে মাঝে সুজয়ের বলা কথাগুলো মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে যায় কুন্তলীর।
হয়তো সুজয় শিক্ষিত ছেলে বলেই অনেকরকম করে কথা বলে, সব কিছু বোঝে না কুন্তলী। শুধু জানে, সুজয়কে ও ভালোবাসলেও সুজয় ওকে ভালোবাসে না। নির্ভয়পুরের বাসিন্দা বলে সাহায্য করে মাত্র। ওই পাড়ার মালতি, সুজাতা, মানসীর মতো একই চোখে দেখে ওকে। এই তো মানসী সেদিন বলছিল, “সুজয়দা মানুষটা বড়ো উপকারী। আমি উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পরে আর পড়ব না বলেছিলাম বলে আমায় সমাদ্দারদের কারখানায় চায়ের প্যাকেটের হিসেব লেখার কাজে ঢুকিয়ে দিল। মাইনেও বলে-কয়ে ভালোই করে দিল। এরকম মানুষ এই নির্ভয়পুরে আর একটাও নেই।” কেন কে জানে মানসীর কথা শুনে সেদিন আর গর্ব হয়নি কুত্তলীর, বরং একটা অদ্ভুত বিজবিজে রাগ ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে ধরেছিল। কুন্তলী অশিক্ষিত হয়েও বুঝেছিল, সুজয়ের চোখে ও আলাদা কিছু নয়।
সুজাতাও বলেছিল, “হ্যাঁ আমার বাবা অসুস্থ হয়েছিল, রাতদুপুরে তো সুজয়দাই হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিল। অমন মানুষ আর হয় না।”
মাঠে বসে গল্প করছিল ওরা। আচমকাই খুব কান্না পেয়েছিল কুণ্ডলীর তাই কাউকে কিছু না বলেই ছুটে চলে এসেছিল ওখান থেকে। না, সুজয় শুধু ওর নয়, সুজয় গোটা নির্ভয়পুরের। কিন্তু কুন্তলীর তো এমন কাউকে প্রয়োজন, যে দিনের শেষে একটু হলেও ওর হবে। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে চার ঘণ্টাও শুধু ওর হবে। বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠেছিল। সেই কারণেই সামান্য হলেও দূরত্ব বজায় রাখছিল কুন্তলী। সেটাই হয়তো সুজয়ের চোখে পড়েছে।
সে পড়ুক। সুজয়ের কোনও বিপদ কুম্ভলী হতে দেবে না। কিন্তু নীহারের বলা ওই স্বপ্ন স্বপ্ন কথাগুলোর মায়া কাটানো ওর পক্ষে সম্ভব নয়। মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতেই ভাবছিল, আজকে নীহার ঠিক কী কী বলল।