ইতি নির্ভয়পুর – ৫
৫
বাবার অসুস্থতার খবর বোনকে দেবে না ঠিক করেছিল সাহেব। বোনের পড়াশোনার কোনও ক্ষতি হোক এটা ও একেবারেই চায় না। তাছাড়া বাবা একটু স্টেবল হয়ে গেলে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে ভালো ডক্টর দেখাতে হবে।
সাহেব আজ খোলাখুলি বলেওছে ডক্টর শৌনককে একটা ভালো কার্ডিওলজিস্ট দেখানোর কথা। শৌনক কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই সাহেব বলে দিয়েছে কলকাতা গিয়ে বিখ্যাত কার্ডিওলজিস্ট শোভন বসুকে একবার দেখিয়ে নেবে বাবাকে। ডাক্তারের মুখটা কেমন যেন একটু অন্ধকার হল মুহূর্তের জন্য। সে আর সাহেব কী করবে! শৌনক কলকাতায় পসার জমাতে পারেনি বলেই না এই নির্ভয়পুরে পড়ে আছে। না হলে আজ অবধি কোনও ডাক্তার এখানে এক বছরের বেশি টেকে না। সেখানে শৌনক দেখতে দেখতে প্রায় চার-পাঁচ বছর কাটিয়ে দিল এখানে। হ্যাঁ, এখানে আর যে তিনজন ডাক্তার আছে তাদের একেবারেই বিশ্বাস করা যায় না, সে তুলনায় শৌনক অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য। তবে ইদানীং কলকাতা থেকে সপ্তাহখানেকের জন্য এখানে এলেও সেভাবে ভালো লাগে না সাহেবের। মনে হয়, যেন জীবনটা থেমে গেছে মুহূর্তের জন্য। সন্ধে হলেই ঝিঁঝিপোকার একটানা কনসার্টে অদ্ভুত ছমছমে একটা পরিবেশ তৈরি হয়। সন্ধের পর থেকে পাহাড়ে গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায় বললেই চলে। চা-বাগানের কর্মীরা দিন শেষে হা-ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরে যে যার আস্তানায় সিঁধিয়ে বসে থাকে। নির্ভয়পুরে রাত নামে খুব তাড়াতাড়ি। রাত ন’টাতেই যেন মধ্যরাতের নিস্তব্ধতা এখানে। তিলোত্তমার আলো ঝকমকে প্রাণোচ্ছল জীবন ছেড়ে দু’দিনেই হাঁপিয়ে ওঠে সাহেব। সেখানে শৌনক খোদ সাউথ কলকাতার ছেলে হয়ে পাঁচটা বছর এখানে কাটিয়ে দিল কি এমনি? উঁহু, সাহেবকে বোকা বানানো অতটাও সহজ নয়। সাহেব ভালোই বোঝে, কলকাতা ছেড়ে কেউ এমনি এমনি এই নির্জনে এসে ডাক্তারি করতে বসেনি। এখানে না আছে মানুষর পয়সা, না বড়োলোকের হাবিজাবি সব রোগ। এরা তো সকালে আমানি পাত্তা খেয়ে জমিতে বা কারখানায় খাটতে যায়, সারাদিন পরে ফিরে বাংলা খেয়ে ঘুমিয়ে যায়। এদের ওসব বিলাসী রোগ কোথায়? তাই ডাক্তারের ফিজও তো অতি নগণ্য। এক হসপিটালের মাইনেটুকু সম্বল। সাউথ কলকাতার ছেলে হয়ে ওখানের চেম্বার ছেড়ে, পসার ছেড়ে এই ভিখিরির জায়গার পড়ে থাকার কারণটা সাহেবের জানা নেই যদিও। তবে শৌনকের বেশি বাড়াবাড়ি দেখলে কলকাতায় লোক লাগিয়ে সব হাঁড়ির খবর বের করে এনে প্রচার করে দিতে দশদিন লাগবে না সাহেবের। নির্ভয়পুরের লোকজনের চিকিৎসা করছে খুব ভালো কথা। ক্যামেরা নিয়ে নির্ভয়পুরের একঘেয়ে ঝরনা, পাহাড় আর চা-বাগানের ছবি তুলে নিজেকে স্টিভ ম্যাককারি ভাবছে, সে ভাবতেই পারে। এসবে সাহেবের কোনও আপত্তি নেই, তবে অস্মিতার ধারেকাছে ঘেঁষলে সাহেব কিন্তু ছেড়ে কথা বলবে না। গতবার অস্মিতা যখন এসেছিল, তখন নিরঞ্জনকাকু একটা ঘরোয়া আড্ডার আয়োজন করেছিল, তখনই সাহেব দেখেছিল, বলা নেই কওয়া নেই অস্মিতা এই ডাক্তারকে নিমন্ত্রণ করে বসেছে। আরে অস্মিতাকে বুঝতে হবে, শৌনক আর ওরা সমগোত্রীয় নয়। পেশায় ডাক্তার হলেই কেউ ব্লু-ব্লাড হয়ে যায় না। অস্মিতার মুখে অনবরত ডাক্তারের প্রশংসা শুনে বেশ বিরক্ত লেগেছিল সাহেবের। মোটামুটি এ চত্বরের সবাই জানে, ও অস্মিতাকে ভালোবাসে। আর সমাদ্দার আর মল্লিকরা যে প্রতিযোগিতা করে ব্যবসায় টাকা বাড়িয়েছে সেটাও জানে নির্ভয়পুরের লোকজন। তারপরে আচমকা এই অস্মিতার মনে এই শৌনকের আগমন একেবারেই মেনে নিতে পারেনি সাহেব। হয়তো সাহেবের বিরক্তি বুঝেই শৌনক অস্মিতার থেকে দূরে দূরে থাকছিল। কিন্তু অস্মিতা আবার শৌনক বলতে চারবার ঢোক গেলে। এই তো পরশুদিন ফোন করেছিল সাহেব অস্মিতাকে।
অদ্ভুত নিস্পৃহ ব্যবহার করছিল অস্মিতা। অথচ এই অস্মিতাই কিন্তু ছোটোবেলায় নিৰ্ভয়পুরে এসেই বায়না ধরত্ব, সাহেবের সঙ্গে খেলা করব। সেই কবে থেকে ওদের বন্ধুত্ব। সেই বন্ধুত্বই ভালোবাসায় রূপ নিয়েছিল। না সেভাবে হয়তো প্রপোজ করেনি কেউ কাউকেই, কিন্তু দুজনেই দুজনের প্রতি একটা টান তো অনুভব করতই। কত সন্ধে ওরা কাটিয়েছে নির্ভয়পুরের শেষ প্রান্তে পলাশবনা পাহাড়ের ধাপে বসে। পলাশবনাকে এ চত্বরের লোকজন পাহাড় বলে আখ্যা দিলেও পলাশবনা আসলে টিলা। সকলের কাছ থেকে পাহাড় আখ্যা পেয়েও গর্বে আটখানা হয়ে পলাশবনার মাথাটা একটুও বাড়েনি বা ছাতি চওড়া হয়নি। পলাশবনা যেন একগুঁয়ে আদিবাসী মেয়ের খোঁপায় গোঁজা মোরগ ফুল, ঘাড় গোঁজ করে নিজের সত্তা বজায় রেখে চলেছে বছরের পর বছর। গোলাপ হবার কোনও বাসনা নেই, সে মোরগফুল হয়েই শোভা পেতে চায়। তেমনই পলাশবনারও পাহাড় হবার ইচ্ছেই নেই। সে টিলা নামেই যেন বেশ খুশি। সেই পলাশবনার ধাপে বসে অস্মিতা আর সাহেব কত সন্ধে নামা দেখেছে একসঙ্গে। রঙ্গিত নদীর ক্ষীণ হয়ে যাওয়া জলধারা আবার কবে বর্ষার জল পেয়ে পরিপুষ্ট হবে সেটাও ভেবেছে একই সঙ্গে। কচি চা পাতা আর মধ্যবয়স্ক চা পাতার গায়ের রং দেখে তাদের বয়েস শনাক্ত করেছে দুজনে একসঙ্গে। সেই অস্মিতার এত নিস্পৃহতা কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছে না সাহেব। আর ও লক্ষ করেছে, শৌনকের প্রতি অস্মিতার একটা অদ্ভুত দুর্বলতা আছে, এবং দিন দিন সেই দুর্বলতা বেড়েই চলেছে। খোঁজ সাহেবও রেখেছে।
সমাদ্দারকাকু এখন খুব ভাব করেছে ডাক্তারের সঙ্গে। কারণটা ওর অজানা নয়। নির্ভয়পুরের উত্তর দিকে কয়েক বিঘে জমি পড়ে আছে সমাদ্দারকাকুর। ওখানে একটা নার্সিংহোম করতে চায় কাকু। তাই শৌনককে হাতে রাখার চেষ্টা। এ অঞ্চলে শৌনক খুবই পপুলার। ওদিকে ব্রিজের কাজ প্রায় শেষের দিকে। ব্রিজ হয়ে গেলেই রংবুল থেকে গড়ান্তি সব শহরের সঙ্গে যোগাযোগ হয়ে যাবে নির্ভয়পুরের। তখন যদি একটা সুযোগ-সুবিধা ওয়ালা নার্সিংহোম লোকজন পায় চিকিৎসার জন্য, তা হলে কি আর প্রায় দেড়শো কিলোমিটার উজিয়ে জলপাইগুড়ি যাবে? প্ল্যানটা মন্দ ভাঁজেনি সমাদ্দারকাকু। আবার পার্টনারও পেয়ে গেছে পামেলা-আন্টি আর ঘোষালকাকুকে। বাবাকেও বলেছিল সমাদ্দারকাকু, বাবা বোধহয় ততটা ইন্টারেস্ট দেখায়নি। সেই কারণেই ইদানীং সাহেবের চোখে পড়েছে, সমাদ্দারকাকু নিজের প্রেশার চেক করার জন্য শৌনকের বাড়িতে গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছে। এভাবেই আপন করে নেওয়ার চেষ্টা। সে সব নিয়ে সাহেবের কোনও সমস্যা নেই। শৌনক ডাক্তার ভালো, পরোপকারী। মানুষের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ে। গরিবদের কাছ থেকে সামান্য ফিজটুকুও নেয় না। শৌনককে অপছন্দ করার আলাদা কোনও কারণ নেই সাহেবের। এই যে গতকাল বাবার এমন বিপদে শৌনকই তো শেষ রক্ষা করল। সাহেবের পক্ষে তো আর ওই অবস্থায় কলকাতা নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। কলকাতা কেন? জলপাইগুড়ি নিয়ে যাওয়াও রিস্ক ছিল। শৌনকই এ যাত্রা বাঁচিয়ে দিল। তাই ব্যক্তিগতভাবে কোনও রাগই নেই সাহেবের, কিন্তু অস্মিতার ওই ডাক্তারপ্রীতি দেখে ভীষণ অসহ্য লাগছে। কিছু একটা করতেই হবে সাহেবকে। অস্মিতাকে হারাতে পারবে না সাহেব। কলকাতায় সাহেব নতুন যে ফ্ল্যাটটা কিনেছে, তার ইন্টিরিয়র অবধি করেছে অস্মিতার কথা ভেবেই। এখন যদি ওদের দুজনের মাঝে ওই ডাক্তার এসে জোটে, তা হলে তাকে নির্ভয়পুর ছাড়া করতে দ্বিতীয়বার ভাববে না ও। অস্মিতার ওপরে শুধুই সাহেবের অধিকার। এটা বুঝিয়ে দিতে হবে ওই ডাক্তারকে। প্রলয়কে একবোতল বিদেশি দিতেই গড় গড় করে বলে দিয়েছে সব। ডাক্তার বাড়ি ফিরে রাতে কারও সঙ্গে কথা বলে কি না সেটাও জানে সাহেব। অস্মিতা যে ফোন করে মাঝে মাঝে সেটা প্রলয়ই জানিয়েছে। ঠিক কী কথা হয়, সেটা অবশ্য প্রলয় বলতে পারেনি। অস্মিতার এই নিস্পৃহ ব্যবহার অনেক কিছু ইঙ্গিত দিচ্ছে সাহেবকে। সাহেবের কানে এটাও এসেছে, সমাদ্দারকাকু নাকি লোককে বলে বেড়াচ্ছে, “আরে, মল্লিকের দ্বিতীপক্ষের সঙ্গে তো প্রথমপক্ষের ছেলের সম্পর্কও ভালো নয়। দেখো সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ।” না, সাহেবের সঙ্গে আন্টির বিশাল কিছু আদরের সম্পর্ক না হলেও এমন কিছু খারাপ সম্পর্কও তো নয়। বরং আন্টি সাহেবকে নিজের ছেলের মতোই ভালোবাসে। আর নূপুর তো দাদাভাই বলতে অজ্ঞান। তা হলে এসব কথা রটানোর কারণ কী? সমাদ্দারকাকু বহুবার এসেছে ওদের বাড়িতে, খুব ভালো করে জানে, আন্টি বাবাকে শাসন করলেও ভালোবাসে খুবই। মোট কথা ওদের সংসারে বিশাল অশান্তি হয় এমন তো নয়। কেন যে কাকু এসব বলে বেড়াচ্ছে লোকজনকে, কে জানে! পামেলা-আন্টি সেদিন আচমকাই বলল, “আরে সাহেব, হঠাৎ কী হল? তোমার আর অস্মিতার কি ব্রেকআপ হয়ে গেল নাকি? আমাদের সমাদ্দার মেয়ের পাত্র নিয়ে বেশ চিন্তিত দেখলাম।”
সাধারণত গ্রিনভ্যালি এসব কূটকচালির জন্যই বিখ্যাত। হাতে গুনে জনা পনেরো বাঙালি বাড়ি আছে নির্ভয়পুরে। প্রত্যেকে ব্যবসাদার। নির্ভয়পুরে ব্যবসা করে এরা কলকাতায় বড়ো বড়ো সম্পত্তি করেছে। ক্রিরাত প্রতিযোগিতা চলে এদের মধ্যে। কার টাকা কত বেশির লড়াই। এসব ভালো লাগে না সাহেব মল্লিকের। গ্রিনভ্যালিতে লোকজন ব্যাডমিন্টন বা সুইমিং করতে যায় না, যার শুধু একে অপরের হাঁড়ির খবর সংগ্রহ করতে। এর মধ্যে এই পামেলা মিত্র মহিলাটি ভেঞ্জারাস। যেমন তুখড় ব্যবসাদার তেমনই পলিটিশিয়ান। শোনা যায়, অল্পবয়সে নাকি বড়োবাজারের এক বিশাল অবাঙালি ব্যবসায়ীকে বিয়ে করেছিল পামেলা। ব্যবসায়ীর বয়েস তখন প্রায় পঞ্চাশ, কিন্তু অবিবাহিত ছিলেন। বিয়ের সময় পামেলার মাত্র উনিশ। পামেলার বাড়ির অবস্থা তেমন ভালো ছিল না। পামেলার তিন ভাইবোন। একটাই ভাই আর দুই বোন। পামেলাই বড়ো। বিয়ের বছর তিনেক পরেই ওই ব্যবসায়ী হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। সমস্ত সম্পত্তির মালকিন হয় পামেলা। ব্যবসায়ীর ভাই নাকি পামেলার বিরুদ্ধে কেসও করেছিলেন, তাঁর দাবাকে হত্যা করা হয়েছে বলে। কিন্তু পোস্টমর্টেম রিপোর্টে হত্যার কোনও চিহ্ন পাওয়া যায়নি বলে সে কেস ধোপে টেকেনি। কলকাতার প্রাসাদোপম দু’খানা বাড়ি আর গার্মেন্টেসের বিশাল শো-রুমের মালিক হয় পামেলা। একটা বাড়িতে পামেলার ভাই, বোন আর বাবা-মা থাকে। আর-একটাতে পামেলা। অসম্ভব ব্যক্তিত্বময়ী চেহারার অধিকারিণী মহিলা। ব্যবসাতেও তুখড় বুদ্ধি। মি টি-এস্টেটের ব্যবসা পামেলা নিজেই শুরু করেছিল। এখন তার রমরমা। ওদিকে কলকাতায় আরও দু’খানা গার্মেন্টসের শো-রুম বাড়িয়েছে। দুটোই দেখাশোনা করে পামেলার বোন আর বোনের হাজবেন্ড। কিন্তু লাটাই নিজের হাতেই রেখে দিয়েছে মহিলা। রিমোটের সুইচ নিজেই প্রেস করতে পছন্দ করে। অসম্ভব ডমিনেটিং চরিত্রের। বয়েস আন্দাজ বছর বিয়াল্লিশ। যদিও দেখলে বত্রিশের বেশি কেউ বলবে না। রোজ ভোরে উঠে নিজস্ব জিমে ঘণ্টাখানেক কসরত করে মহিলা। সাহেব যদিও সামনে পামেলা-ম্যাম বলেই ডাকে। ওসব আন্টি, দিদি এসব শুনতে পছন্দ করে না। নিজের গাড়ি নিজেই ড্রাইভ করতে পছন্দ করে। সর্বত্র মিস পামেলা মিত্র লেখে। অল্পবয়সের বিয়েটা কেন জনসমক্ষে স্বীকার করে না মহিলা, সেটা অবশ্য সাহেবের জানা নেই। তবে এ মহিলার বুদ্ধিতে সমাদ্দারকাকু থেকে ঘোষালজেঠু চলে। বাবাকেও দেখেছে বেশ সমঝে চলে। আর সুনীল সেনগুপ্ত তো পামেলা নামেই চার ঢোক জল বেশি খায়।
ইনি আবার প্রাক্তন ফুটবলার। অবিবাহিত মানুষ। খেলাই জীবনের ধ্যান জ্ঞান। নির্ভয়পুরে একটা ফুটবলের কোচিং বানিয়েছে। নিজেই মাঠ কিনেছে। আদিবাসী ছেলেদের নিজের টাকাতেই জার্সি কিনে শুরু করেছিল। বার দুয়েক ট্রফি জিতেছে। আর দুটো ছেলে সুনীল সেনগুপ্তর কাছে ট্রেনিং নিয়ে মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল দলে নাকি চান্স পেয়েছে, তারপর থেকে কিছু কিছু সরকারি অনুদান পেয়ে থাকে সুনীল-স্যারের ‘ফ্রিডম ফুটবল অ্যাকাডেমি’। এছাড়া পামেলা মিত্র হঠাৎ করেই দয়ার সাগর হয়ে গিয়ে প্রতিমাসে বেশ মোটা টাকা ফ্রিডম ফুটবল অ্যাকাডেমিতে দান করে। কেন করে সেটা কেউ এখনও বুঝে উঠতে পারেনি। কারণ, যে পামেলা মিত্র কারখানার শ্রমিকদের সব থেকে কম মজুরিতে খাটিয়ে নিতে পারলে সব থেকে বেশি খুশি হয়, সে কেন এই ফুটবল ক্লাবের পিছনে টাকা ঢালছে সেটা বেশ রহস্যজনক। সুনীল-স্যার তো এক কথায় বলে, “এই নির্ভয়পুরে যদি একজনও সফট হার্টেড মানুষ থেকে থাকেন, সেটা পামেলাদেবী। সুনীল-স্যার আদিবাসীদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। তাদের ঘরের ছেলেদের খেলাধুলার মাধ্যমে উচ্চপর্যায়ে নিয়ে যেতে চাইছেন, রেলে চাকরিও পেয়েছে দুজন এই খেলার ব্যাকগ্রাউন্ডের জন্যই, তাই ডাক্তার শৌনকের মতোই সুনীল-স্যারও এদের ঘরের লোক। দুশমন তো সাহেবদের মতো ব্যবসাদাররা। যাদের টাকায় ওদের ঘরে হাঁড়ি চড়ছে, তাদেরই কী করে ক্ষতি করবে সেটাই ভাবছে ওই সুজয় হাঁসদা সর্বক্ষণ। শালা আবার নেতা হয়েছে। এবারের ভোটেও নাকি দাঁড়াবে শোনা যাচ্ছে। দিন কে দিন নির্ভয়পুরে শিক্ষিতের সংখ্যা বাড়ছে, আর এটাই সমস্যার কারণ।
সাহেব অন্যমনস্কভাবেই মোবাইল ঘাঁটছিল আর এসব ছাইপাঁশ ভাবছিল। নির্ভয়পুরে ইন্টারনেটের অবস্থা বেশ খারাপ। অর্ধেক দিন আকাশ মেঘলা থাকে, তাই নেটের সমস্যা লেগেই থাকে। আচমকাই চোখ আটকে গেল অস্মিতার প্রোফাইলে।
আজ বিকেলে ক্যাপশন দিয়ে যে ছবিটা পোস্ট করেছে, সেটা তো ওদের নির্ভয়পুরের বাড়ির ছাদের। তার মানে, ও এখন এখানে আছে। অথচ বাবার এমন খবর পেয়েও দেখতে পর্যন্ত এল না! বাহ, পরিবর্তনটা তো এবারে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে অস্মিতা। ওই কারণেই প্রেমের সংজ্ঞা বোঝাচ্ছিল সেদিন সাহেবকে। ভালোলাগা আর ভালোবাসার মধ্যে পার্থক্য চেনাচ্ছিল।
জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
ঠিক তখনই অতসী-আন্টি এসে সংকোচের সঙ্গে ওর ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বলল, “একটু ভিতরে আসব?”
সাহেবের বুকটা কেমন ফাঁকা লাগছে। নির্ভয়পুরের মধ্যরাতের নিশ্চুপ একাকিত্ব ওকে যেন হাঁ করে গিলতে আসছে। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল, কেউ একজন ওকে ডাকুক। এই কষ্টকর ভাবনার জাল কেটে বের নিয়ে যাক। কিন্তু বাড়িতে প্রাণী বলতে তো ওরা তিনজন। নুপুরটা থাকলে হই হই করে মাতিয়ে রাখে। সন্ধে হতেই দুটো বড়ো কাপে চা নিয়ে ওর ঘরে বসে আড্ডা জমায়। চায়ে চুমুক দিয়েই বলে, “যাই বলিস দাদাভাই, তোর শ্বশুর কিন্তু চারের কোয়ালিটিতেও মারছে বুঝলি। ভালো চা সব আমেরিকা যাচ্ছে। নির্ভয়পুরের লোকজন কমা চা খেয়ে মরছে। অস্মিদিকে বলতে হবে ব্যাপারটা।”
সাহেব যদি চুমুক দিয়ে বলত, “কেন রে, বেশ ভালো তো কোয়ালিটি।”
ব্যস, শুরু হত নূপুরের লেগপুলিং। “দাদাভাই তুই এখন থেকেই সমাদ্দার বাড়ির জামাইয়ের মতো আচরণ করছিল। ওদের দোষ ঢাকছিস।”
সাহেব মৃদু হেসে বলত, “তোদের মেডিকেল কলেজে বুঝি বড়ো দাদার পিছনে লাগা শেখায়?”
খুনসুটিতে, আদরে কেটে যায় দিনগুলো। কিন্তু এখন বাবা হসপিটালাইজড, ও আর আন্টি দুজনেই যে, যার নিজের পরিসরে। তাই এই গিলে খাওয়া একাকিত্ব কাটানোর জন্য কেউ ওর ঘরে আসবে এটা ভাবতেও পারেনি।
সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “এসো না আন্টি। বলো কী বলবে?” অতসী একটু ইতস্তত করে বলল, “শুনলাম, তুমি তোমার বাবাকে কলকাতা নিয়ে যাবে চেকআপের জন্য?”
সাহেব ঘাড় নেড়ে বলল, “হ্যাঁ ঠিকই, দেখো এখানে তো ডাক্তার বলতে ওই শৌনক। ওর যা বয়েস, তাতে তো খুব বেশি অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে বলেও মনে হয় না। তাই ভাবছি, কলকাতায় ডাক্তারদের একবার দেখিয়ে নেব।”
অতসী শান্ত গলায় বলল, “যদি তোমার আপত্তি না থাকে তা হলে আমাকেও কি একবার কলকাতায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব তোমার বাবার সঙ্গে? না মানে, আমি জানি তুমি হয়তো একাই সবটা সামলাতে পারবে, তবুও যদি কোনও প্রয়োজনে লাগি।”
সাহেব হেসে বলল, “এটা আবার বলার কী আছে আন্টি? তোমাকে তো যেতেই হবে বাবার সঙ্গে।”
অতসী বোধহয় সাহেবের কথাতে বেশ আশ্বস্ত হল। দরজা থেকে আর-একটু এগিয়ে এসে ঘরের মেঝেতে দাঁড়িয়ে বলল, “অস্মিতা দিল্লি থেকে ফিরেছে দিন তিনেক আগেই। আমাদের বিষ্ণু বলছিল। ও-ই নাকি গাড়ি ড্রাইভ করে আসছিল তোমার বাবার হোটেল থেকে, তখনই অস্মিতার গাড়ি ওকে পাশ দিয়েছে। আমায় এসে বলছিল, অস্মিতা দিদিমণি তো এখানেই আছে, সাহেবদাদার সঙ্গে দেখা করতে এল না তো।’ বুঝতেই তো পারছ ড্রাইভার মানুষ, সারাদিন চরে বেড়াচ্ছে। সব খবরই রাখে।” গলাটা খাদে নামিয়ে অতসী বলল, “তোমার কি কিছু হয়েছে অস্মিতার সঙ্গে? ঝগড়া করেছ নাকি? তোমাদের তো ভাই-বোনের বড়ো মাথা গরম, তাই ভয় হয়।”
অতসী-আন্টি এতদিন পর্যন্ত বেশ দূরত্ব মেইনটেন করেই কথা বলত ওর সঙ্গে। কিন্তু আচমকা বাবার এই অসুস্থতাই বোধহয় দুজনকে অনেকটা কাছে এনে দিয়েছে। আন্টি যখন এ বাড়িতে এসেছিল তখন সাহেব বেশ ছোটো। কিন্তু একটা কথা মনে আছে, সাহেবের মাথায় হাত রেখে বলেছিল, “তোমার মায়ের জায়গা নিতে আসিনি। যদি কখনও মনে করো আমায় প্রয়োজন, তা হলে নির্দ্বিধায় বলবে।” সাহেবের অবশ্য বেশ রাগই হয়েছিল আচমকা বাড়িতে আর-একজনকে দেখে। এমনিতেই মা চলে যাওয়ায় সাহেব বেশ একা হয়ে গিয়েছিল। তবে তার সাবস্টিটিউট খোঁজেনি কখনও। একটা ঠান্ডা দূরত্ব নিজেই তৈরি করেছিল সাহেব। অতসীও কর্তব্য করে গেছে, কিন্তু সেই বরফের পাঁচিল ভাঙতে সেভাবে আগ্রহী হয়নি। তাই আজ হঠাৎ এমন উষ্ণতা মিশ্রিত কথা শুনে সাহেবের গলাটা একটু ধরে এল। এমনিতেই অস্মিতার ব্যবহারে সজোরে আঘাতটা পেয়েছিল। সেই আঘাতের ওপরে নরম প্রলেপ পড়ল বলেই হয়তো বাঁধ ভাঙতে চাইছে অনুভূতিগুলো।
সাহেব সামলানোর চেষ্টা করতেই অতসী বলল, “কী হয়েছে সাহেব? আমায় কি বলা যায়?”
সাহেব অবসন্ন গলায় বলল, “অস্মিতা আর আমার নেই। সম্ভবত সে অন্য কোনও সম্পর্কে জড়িয়েছে। তাই দেখা করাটা তার কাছে আর আগের মতো বাধ্যতামূলক নয়। আমি আমাকে নিয়ে ভাবছি না আন্টি, ভাবছি এই মল্লিকবাড়ির সম্মান নিয়ে। নির্ভয়পুর এতটাই ছোটো জনপদ, যেখানে ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেকে প্রত্যেককে চেনে। আর বাবাকে তো লোকজন অন্যরকমভাবেই চেনে। তাই আমাদের সম্পর্কটাও কারওর অজানা ছিল না। এখন শুনছি নিরঞ্জনকাকু আমাদের ফ্যামিলি নিয়ে ফালতু রিউমার ছড়াচ্ছে। এদিকে অস্মিতার গলাতেও অন্য সুর। এত বছর পরে আমায় বন্ধুত্ব আর ভালোবাসার ডেফিনেশন শেখাচ্ছে সে।”
অতসী এগিয়ে এসে আচমকাই সাহেবের মাথায় হাত রাখল। প্রশ্রয়ের গলায় বলল, “যদি তোমাদের সম্পর্কটা মেলার হয় তা হলে আজ হোক আর কাল মিলবেই। কারণ আমি ডেস্টেনিতে বিশ্বাসী। আর যদি দেখো ভেঙে গেল, তা হলে বুঝবে অস্মিতা লুজার হল। কারণ, আমরা তার পিছনে ছুটি যাদের আমরা ভালোবাসি, আমরা তার দিকে ফিরেও তাকাই না যারা আমাদের ভালোবাসে। অথচ বাস্তব জীবনে আমায় যে ভালোবাসে, তাকেই প্রয়োজন হয় সব থেকে বেশি। আজ হয়তো অস্মিতা ঠিক বুঝতেই পারছে না ও কী চায়। কিন্তু একদিন বুঝবে। তখন অবশ্য আজকের এই মন তোমার না-ও থাকতে পারে। তবে সাহেব আমি একটা কথা বলব, তুমি শিক্ষিত, সুদর্শন, সুবংশের ছেলে। হ্যাংলামি তোমায় শোভা পায় না। কষ্ট হলেও সেটাকে হজম করার শক্তি তৈরি করো। এমন কোনও কাজ কোরো না যাতে অস্মিতা মনে করে, এ বিশ্বে ওর মতো গুণের মেয়ে আর নেই। নিজেকে ছোটো কোরো না।”
সংযম মানুষের সবচেয়ে বড়ো সম্পদ। সাহেব আজ নিজের আচরণ বিরুদ্ধ একটা কাজ করে ফেলল, আলতো করে আন্টির হাতের ওপরে নিজের হাতটা রাখল। খেয়াল করল, অতসীর চোখে জল। হয়তো অতসী চেয়েছিল, নূপুরের মতো সাহেবও তাকে মা বলে ভাকুক, সন্তানের মতোই আবদার করুক। কিন্তু সেই ছোটো থেকে সাহেবের বড়োপিসি সাহেবকে দায়িত্ব নিয়ে শিখিয়েছিল, অতসী শুধু বাবার সম্পত্তির লোভেই এ বাড়িতে এসেছে। বাড়ির সকলকে বিষ খাইয়ে মেরে দিয়ে সম্পত্তি হাতাবে। হা ঘরে বাড়ির মেয়েদের এটাই একমাত্র প্রায়োরিটি। ছোটোবেলায় সাহেব সেই ভয়ে অতসীর দেওয়া খাবার খেতে চাইত না। হস্টেলে থেকে পড়াশোনা করছিল সাহেব। যখন বাড়ি আসত, তখন আন্টি নিজে যত্ন করে ওর জন্য রান্না করলেও খেতে দিতে আসত না কখনও। হয়তো অপমানের ভয়ে। দুজনের মধ্যে কখনও বন্ধুসুলভ সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি ছোটোবেলায়। তবে বড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুঝেছে, অতসী মল্লিক আসলে খুব স্পষ্টবাদী মহিলা। বাবা যখন নূপুরের জন্মদিনে ওকে একটা দামি ল্যাপটপ গিফট করেছিল, তখন আন্টিই বাবাকে বলেছিল, “ভুলে যেয়ো না, তোমার দুই সন্তান। একজনকে এত দামি ল্যাপটপ আর-একজনকে দশ হাজারের ঘড়ি, এমন করলে তো চলবে না মল্লিকবাবু। একই ল্যাপটপ সাহেবের জন্য বাড়িতে ঢুকবে, তবে নূপুর ওটাতে হাত দেবে।” সাহেব লক্ষ করেছে কোনও একটা বিশেষ কারণে বাবা আন্টিকে একটু সমঝেই চলে। বিকেলের মধ্যে সাহেবেরও দামি ল্যাপটপ এসেছিল।
এমন অনেক উদাহরণ আছে। তারপর থেকেই সাহেব বিশ্বাস করেছিল, আন্টি ওর মা না হতে পারে, কিন্তু অন্যায় করে না। বড়োপিসির কথাকে ধূলিসাৎ করে দিয়ে কলকাতায় সাহেবের নামে একটা ফ্ল্যাটও কিনিয়ে দিয়েছে অতসী-আন্টি। সাহেব এখন সেই ফ্ল্যাটে থেকেই বাবার কলকাতার ব্যবসা দেখে। কিন্তু কোনওদিন এগুলো নিয়ে কোনওরকম অহংকারী কথা বলতে শোনেনি আন্টিকে। এক অদ্ভুত পার্সোনালিটি আছে মহিলার মধ্যে। খুব শীতল গলায় বলা কথাগুলো যেন সবাই শুনতে বাধ্য হয়।
সাহেবের মাথায় আর-একবার নরম হাত বুলিয়ে বলল, “এত ভেবো না। নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে শেখো। কেউ একজন চলে গেলেই জীবনটা অন্ধকার হয়ে যায় না।”
আন্টি আর না দাঁড়িয়ে চলে গেল ঘর থেকে।