ইতি নির্ভয়পুর – ৮
৮
সুজয় চোখের সামনে দেখল, মা চুপচাপ বসে ছিল উঠোনে, আচমকা রাস্তার দিকে তাকিয়ে ব্যবহারটা কেমন অস্বাভাবিক হয়ে গেল। হাসিনীকে পাড়ার লোকে পাগল বলে। সুজয়েরও মনে হয়, ওর মা আর পাঁচজনের মতো স্বাভাবিক নয়। ঘরের কাজ-কর্ম করলেও সবসময় কী সব বিড়বিড় করে বলে চলে। কী যে বলে কিছুই বোঝে না সুজয়। জন্মে থেকে দেখছে, ওর মা এমন আনমনা, অস্বাভাবিক ব্যবহার করত হঠাৎ হঠাৎ। রাতে ঘুমের ঘোরে ডুকরে কেঁদে উঠত। সুজয় যখন ছোটো তখন ওর দিদা বলেছিল, “সবই কর্মফল। হাসিনী নিজের বাবাকে খেলি, আবার নিজেও পাগল হলি।” শোনা যায়, অপরূপা হাসিনীর জন্য তার বাবা এক প্রাইমারি শিক্ষক পাত্র ঠিক করেছিল। কিন্তু কী সব গন্ডগোলের কারণে সে সম্বন্ধ নাকি ভেঙে যায়। তারপরেও ওই জুবথবু, চিররুগ্ণ মানুষটার সঙ্গে হাসিনীর বিয়ে হয়ে যায়। বিয়েটা ভেঙে যাবার পরেই নাকি দাদু হার্ট অ্যাটাক করে মারা যায়। অপয়া মেয়ে বলে আর পাত্র পাওয়া যাচ্ছিল না হাসিনীর। তখন বাবুরাই নাকি সুজয়ের বাবাকে কারখানায় একটা কাজ দেয়, তার বিনিময়ে হাসিনীকে বিয়ে করার শর্ত দিয়েছিল। সুজয়ের যাবতীয় লেখাপড়ার খরচ বাবার চা-কোম্পানিই দিয়েছিল।
সুজয় এক অদ্ভুত পরিবেশের মধ্যে বড়ো হয়েছিল। বাড়িতে দিনরাত ঝগড়া হচ্ছে। একতরফা ঝগড়া। বাবা চেঁচাচ্ছে আর মাকে পেটাচ্ছে। মা চুপ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে কাঁদছে। মাকে চিরটাকাল সুজয় এমনিই দেখে গেল। মায়ের মাথায় যে ঠিক কী সমস্যা, সেটা বোঝাও গেল না। সুজয় ডাক্তারের কাছেও নিয়ে গিয়েছিল কয়েকবার। ডাক্তাররা ঘুমের ওষুধ দিয়ে ছেড়ে দিয়েছিল। সুজয়ের মা হাসিনী পাড়ার কোনও অনুষ্ঠানে যায় না, পুজো-পার্বণেও যায় না। ঘরেই বসে থাকে। মাঝে মাঝে বিড়বিড় করে বলে, “পাহাড়ের রাস্তা কখনও চওড়া হয় না গো, সরু হয়। পাশে খাদ থাকে। এক ধাক্কায় নিচে পড়ে যায়। ঘাসের বুনন থাকে, সবুজ ঘাস। হাত ধরে বসে থাকতে থাকতেই ঠেলে দেওয়া যায়।”
সুজয় বহুবার কান করে শোনার চেষ্টা করেছে, কারও নাম বলছে কি না মা। কিন্তু হাসিনী শুধু এটুকুই বলে। শেষে বলে, “মরে গেল।”
কান্নাকাটি করলেও খুব বেশি উত্তেজিত হতে দেখেনি মাকে। কিন্তু আজ হঠাৎ কী এমন দেখল রাস্তায় যে, এমন অস্থির হয়ে উঠল? বাবা যথারীতি দড়ির খাটে শুয়ে আছে। মাঝে মাঝে গজ গজ করছে। সম্ভবত মাকেও কিছু বলছে। কিন্তু অস্পষ্ট উচ্চারণ। কারণ সুজয় বড়ো হবার পর থেকেই বাবা মাকে মারধর করা, গালাগাল করা বন্ধ করেছে। জানে, সুজয় ছেড়ে কথা বলবে না।
হঠাৎই খুব শান্ত হয়ে গেল মা। ছুটে এসে সুজয়ের কোলে মুখ গুঁজে বসল। ভয়ার্ত গলায় বলল, “মারিস না। আমি বলব না কাউকে।”
সুজয়ের বড্ড মায়া লাগে এই শিশুর মতো আশ্রয় খোঁজা মা-টাকে। সুজয় শান্ত করে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “কেউ মারবে না তোমায়, কেউ না। আমি আছি না তোমার পাশে। কাকে দেখে ভয় পেলে তুমি মা? কে গেল রাস্তা দিয়ে?”
মা ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলল, “বলব না। আমায় মেরো না। আমি কাউকে বলব না।”
সুজয় মাকে একটু জল খাইয়ে শান্ত করে বলল, “পরব আছে তো, তোমার জন্য নতুন শাড়ি কিনে দেব। কী রঙের শাড়ি নেবে তুমি?”
হাসিনীর চোখে তখনও পড়ন্ত সূর্যের মনখারাপি চলে যাওয়ার চিহ্ন। ঠোঁটের কোণে শেষ বিকেলের ক্লান্তি। নাকের ওপরে ভয়ের কারণেই ঘামের বিন্দুদের আনাগোনা। চুলগুলোতে অযত্নের ছায়া। হাতের রোদে পোড়া বাদামি রঙের ওপরে লাল দুটো পলা নিজেদের বেমানান প্রমাণ করতে উদ্গ্রীব। নখগুলোর হলদে ছোপ বুঝিয়ে দেয়, এ সংসারে তার অবদানও কম নয়।
কিন্তু নির্ভয়পুরে হাসিনী পাগলি নামে পরিচিত। এমনকী, সুজয় যখন স্কুলে যেত, তখনও ওর বন্ধুরা কেউ ওর বাড়িতে আসতেই চাইত না। ভয়ে ভয়ে বলত, “তোর মা কামড়ে দেবে না তো?” গলাটা বুজে আসত সুজয়ের। বলতে ইচ্ছে করত, আমার মা কামড়ায় না, বরং কামড়ানোর ভয় পায়। বাড়িতে কেউ এলে মা তাকে খুব যত্ন করে চিনির বাতাসা আর কুঁজোর ঠান্ডা জল দিত। যেহেতু পড়াশোনায় ভালো ছিল সুজয়, তাই স্কুলে ওর শত্রুর অভাব ছিল না। অন্য পাড়ার ছেলেরা ওকে নিয়ে হাসাহাসি করত। বলত, “পাগলির ছেলে।”
বোবা কান্নায় বুকের ভিতরটা নির্ভয়পুরের মধ্যরাতের মতো খাঁ খাঁ করত। শূন্য শূন্য একটা অনুভূতিতে ঘিরে ধরত ওকে। বিকেলে স্কুল ফেরত ও ছুটত চার্চে। চার্চের ফাদার জর্জ ফিলিপের সামনে গিয়ে বসত।
ফাদার চার্চের সংলগ্ন ঘরে ওকে ডেকে বসাতেন। নিজের দৈনন্দিন কাজ করতে করতেই জিজ্ঞাসা করতেন, “কী ব্যাপার, আজ রাজকুমারের মন খারাপ কেন?”
সুজয় বলত, “আমার মা পাগলি তাই সবাই লেগপুল করে ফাদার। আসলে ফাদার, আমার মা একটু বোকা, পাগল নয়। কষ্ট হয় আমার।”
ফাদার মাথায় হাত রেখে বলতেন, আমরা সবাই তো গড়ের সন্তান। গড যাকে যেমন তৈরি করেছে, সে তেমন হয়েছে। সবাই যদি চালাক হয় তা হলে তো এ পৃথিবীর কিছুই চলবে না। এই ধরো, যদি গড মনে করতেন, এ আকাশ শুধু উনি একটাই উপভোগ করবেন, এ বাতাস শুধু ওঁকেই ঠান্ডা করবে, এই জলধারা শুধু ওঁরই পিপাসা মেটাবে, এই সূর্য শুধু তাঁকেই উষ্ণতা দেবে তা হলে আমরা, এই অতি চালাক মানুষগুলো কোথায় যেতাম বলো দেখি? গড তো তা হলে বোকা, তাই না? সেই কারণেই সব কিছু অকৃপণ হাতে পৃথিবীর মানুষকে দান করছেন। আর এসব পেয়ে পৃথিবীর মানুষ হিংসা, হানাহানি করে চলেছে।”
সুজয় বলত, “কিন্তু ফাদার, আমার মা বোকা কেন?”
ফাদার একটু অন্যমনস্কভাবে বলতেন, “যারা ভালোবাসতে জানে তারাই বোকা হয়। তুমিও বড়ো হয়ে বোকা হয়ো সুজয়। নির্ভয়পুরের মানুষদের কথা ভেবো। চালাক হয়ে শুধু নিজের কথা ভেবো না।”
তখন থেকেই সুজয়ের বেস্টফ্রেন্ড ফাদার। এখন ফাদারের বয়েস প্রায় সত্তর। এই নির্ভয়পুরের চার্চেই কাটিয়ে দিলেন প্রায় চল্লিশ বছর। সুজয় যখন স্কুল থেকে চার্চে যেত, তখন ফাদার ছিলেন বছর পঁয়তাল্লিশের কর্মঠ পুরুষ। এখন সেই ফাদারই মেরুদণ্ড একটু ঝুঁকিয়ে হাঁটেন। এখনও সুজয় একইরকমভাবে ফাদারের কাছে যায়। মন চঞ্চল হলে ওর একমাত্র আশ্রয়স্থল ফাদারের ছোটো ঘরটা। ফাদার কখনও নিজের অতীত নিয়ে কিছু বলেননি। শুধু নির্ভয়পুরের জঙ্গল কেটে কীভাবে রাতারাতি এখানে বড়ো বড়ো বাড়ি তৈরি করেছিল মালিকপক্ষ, সে সব গল্প শুনেছে ফাদারের মুখে। এই নির্ভয়পুরের অনেকের গোপন কথা জানেন ফাদার, কিন্তু স্মিত হেসে সে সব উড়িয়ে দেন। সুজয়ের শুধুই মনে হয়, ফাদার অনেক কিছু জানেন।
“হাসিনী তো এরকম পাগল ছিল না, মিষ্টি একটা মেয়ে ছিল। কী সুন্দর গানের গলা ছিল। রোজ বিকেলে রঙ্গিত নদীর ধারে বসে গান গাইত।” এইটুকু বলেই থেমে গিয়েছিলেন ফাদার।
তখন সুজয়ের ক্লাস ইলেভেন। তখন থেকে ও বারবার ছুটে গেছে ফাদারের কাছে, মায়ের এমন হবার কারণ জানতে, কিন্তু জানতে পারেনি।
ফাদার গম্ভীর স্বরে বলেছেন, “কিছু সত্যকে রাতের অন্ধকারে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে হয় সুজয়। সব প্রকাশ্যে এলে প্রাণহানির সম্ভাবনা আছে। তুমি কি চাও তোমার মা প্রাণে মারা যাক? এসব মন থেকে সরিয়ে পড়াশোনায় মন দাও। চাকরি করে মায়ের মানসিক চিকিৎসা করাও। তাছাড়া হাসিনী তো নরম স্বভাবে মানুষ, ও তো কোনওদিন কারওর ক্ষতি করেনি, করবেও না। তা হলে আর নির্ভয়পুরের লোকেদের ওকে নিয়ে চিন্তা কীসের? পাগলই তো ভালো, সুস্থ হলে অনেকের বিপদ।”
সুজয় ফাদারের পায়ে অবধি ধরেছিল।
ফাদারের সেই এক কথা, “কিছু সত্য নিজেই প্রকাশ পেতে অনিচ্ছুক সুজর। সেগুলোকে অহেতুক বিরক্ত কোরো না। ঈশ্বরও চান না, তাই তো সব সত্যি আমাদের সামনে আসে না। সুজয় হাসিনী তোমার জন্মদাত্রী, সে যেমনই হোক, তাকে যত্ন করাটা সন্তান হিসেবে তোমার কর্তব্য।”
তাও সুজয় জেদ ধরে বলেছিল, “বলুন না ফাদার, কেন আমার মায়ের এমন হয়ে গেল? কেউ কি মায়ের সঙ্গে অন্যায় কিছু করেছিল? কেউ কি ধাক্কা দিয়ে পাহাড় থেকে ফেলে দিয়েছিল? মা প্রায়ই আতঙ্কিত হয়ে বলে, ‘ফেলে দিয়ো না আমায়’ কেন বলে ফাদার?”
ফাদার চার্চের সামনের সবুজ চ্যাটালো বুগিয়ালের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, “এই যে হাওয়ায় ঘাসগুলো আন্দোলিত হচ্ছে, এটা কি কোনও বিশেষ উদ্দেশ্যে হচ্ছে সুজয়? না এরা হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গত দিচ্ছে? বলতে পারো, এরা পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে। এ তৃণভূমি আমাদের চোখের আরাম। তেমনই সব কিছুর তো কোনও কারণ হয় না সুজয়। হাসিনীর সব কথার মানে খুঁজতে যেয়ো না। ওগুলোকেও পরিস্থিতির ওপরে ছেড়ে দাও।”
সুজয় নিজের সঠিক প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে রাগ করে উঠে চলে এসেছিল ফাদারের কাছ থেকে। তারপর আবারও গেছে, বারবার গেছে। কীসের টানে, কেউ জানে না। ফাদার তারপর ওর অসমবয়েসি বন্ধু হয়ে উঠেছেন। আজও সেই বন্ধুত্ব অবিচল আছে।
আনন্দে-দুঃখে সুজয় ছুটেছে ফাদারের কাছে। অনুভূতি ভাগ করে নিতে অনুভূতি বড়ো বিচিত্র জিনিস। একজনের আনন্দের অনুভূতি অনেকসময় অন্যকে হিংসাপরায়ণ করে তোলে, আবার দুঃখের অনুভূতিতে সুযোগসন্ধানীরা সুযোগ খোঁজে। তাই ভুল মানুষের কাছে অনুভূতি প্রকাশ করাও একটা বড়ো সমস্যা। কিন্তু ফাদারের সে সব সমস্যা নেই। কারণ, নির্লোভ জীবন কাটানো একজন মানুষের কাছে হিংসার কোনও স্থান নেই। তাই ফাদারের কাছে সমস্ত অনুভূতি নির্দ্বিধায় প্রকাশ করতে পারে সুজয়।
হাসিনী এখনও ছেলের বুকে মুখ গুঁজে বসে আছে।
সুজয় মাকে শান্ত করে বলল, “এক জায়গায় যাবে? পলাশবনার নিচে, চার্চের পিছনে, সেখানে সবুজ বুগিয়াল গালিচার মতো পাতা রয়েছে। যাবে মা? চলো ফাদারের সঙ্গে গল্প করব আমরা।”
মা স্বাভাবিক গলায় বলল, “ফাদার? ওই ঘরেই থাকেন এখনও? এই লোকটার আর বুদ্ধি হল না।”
মা মাঝে মাঝেই এরকম খুব স্বাভাবিক গলায় কথা বলে। তখন বোঝাই যায় না, মানুষটার কোনও মানসিক সমস্যা আছে।
সুজয় বলল, “চলো মা ঘুরে আসবে?”
হাসিনী আবার নিজেকে ভরে ফেলল সেই খোলসটার ভিতরে, যেখানে ছেলে হয়েও কখনও পৌঁছতে পারবে না সুজয়। আবারও ঘাড় নেড়ে বলল, “আমি যাব না।”
কেমন একটা দমবন্ধ লাগছিল সুজয়ের। ছুটির দিনটা বড়ো দীর্ঘ হয়, কাটতেই চায় না ওর। জামা-প্যান্ট গলিয়ে সাইকেলটা নিয়ে ফাদারের উদ্দেশেই রওনা দিল। যাওয়ার পথে একবার কুন্তলীর মাকে দেখে যেতে হবে। শরীরটা কেমন আছে জানা হয়নি। তারপর থেকে কুত্তলীর সঙ্গেও দেখা হয়নি। আজ নির্ভয়পুরের সব বন্ধ থাকে। কল-কারখানা, দোকান-বাজার সব বন্ধ। মঙ্গলবারে নির্ভয়পুরে হাট বসত আগে। হাতে তৈরি জিনিসপত্রের হাট। পাশাপাশি ট্যুরিস্টরা এসেও কিনত। তাই এখানের বাসিন্দারা ও দিন কাজে যেতে চাইত না। সেই কারণেই মালিকপক্ষ এই দিনটাকে ছুটি ঘোষণা করে দিয়েছে। যদিও এখন আর ওই হাট গুরুত্ব হারিয়েছে, কারণ এখন বাজার চত্বরে অনেক স্থায়ী দোকান তৈরি হয়েছে। তবু হাট বসে। অল্প সংখ্যক ব্যাপারী জিনিস নিয়ে বসে। কুত্তলীদের ঘরের পাশেই বসে নির্ভয়পুরের হাট। ওদের ঘরে ঢোকার আগেই সুজয়ের চোখে পড়ল ভাঙা ভাঙা হাটের পশরা
কুন্তলীর মা উঠোনে বসে উনোনে মুড়ি ভাজছিল। অন্যদিন চা তুলতে বেরিয়ে যেতে হয় সকাল সকাল, তাই এসব ঝামেলার কাজ করাই হয় না। মঙ্গলবারের ছুটিতে এসব কাজে হাত দিয়েছে। সুজয়কে দেখেই একটা অ্যালুমনিয়ামের বাটিতে গরম মুড়ি দিয়ে বলল, “বসো বাবা।”
সুজয় বলল, “আপনার শরীরটা তো দুর্বল, এখনই এত খাটছেন কেন? ক’দিন বিশ্রাম নিতে হত। কুন্তলী কোথায়? আজ তো ছুটি, সে তো আপনাকে সাহায্য করতে পারত।”
কুন্তলীর মা বালি ঝেড়ে মুড়িগুলো ধামায় তুলতে তুলতে বলল, “সে বাড়িতে কোথায়? তার তো ছুটি নেই। আজ বরং দুপুর দুপুর বেরিয়ে গেছে সে। ক্লাবে কী একটা পার্টি আছে বলে সেজেগুজে বেরিয়ে গেল তো। মালিকদের ফূর্তির যেন শেষ নেই। ছুটির দিনেও ছুটি দেবে না।”
শরীরের যত্ন নেওয়ার কথা বলে সুজয় কুত্তলীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। চার্চমুখো যেতে গিয়েও মনে হল একবার গ্রিনভ্যালি ঘুরে আসা দরকার। আদিবাসীদের বোকা পেয়ে মালিকপক্ষ যদি ছুটির দিনেও খাটায় তা হলে এক্সট্রা মজুরি দিচ্ছে কি না সেটাও খোঁজ নিতে হবে। গ্রিনভ্যালির প্রায় সমস্ত কর্মীই এই নির্ভয়পুরের ভূমিপুত্র। একমাত্র ক্যাশিয়ার আর ম্যানেজার দুজন মালিকপক্ষের। ঘোষালের শালা বসে আছে ম্যানেজারের পোস্টে। আর ক্যাশিয়ারও মল্লিকবাবুর দূর সম্পর্কের আত্মীয়। ওই দুটো জায়গা এরা কাউকে ছাড়তে রাজি নয়। বাকি যত পরিশ্রমের কাজ, সেগুলো করে নির্ভয়পুরের বোকা অধিবাসীরা। সুজয় যতই বলুক, “তোমাদের শ্রম আর সময়ের দাম আছে। সেটার মূল্য তোমাদেরই বুঝে নিতে হবে।” তবুও কে বোঝে কার কথা! এরা বাবুদের নির্দেশের অপেক্ষাতেই থাকে যেন। অম্লানবদনে অমানুষিক খেটে যায়। গ্রিনভ্যালির মালি রঘু তো দিনরাত ক্লাবের বাগানে খেটে খেটে গোলাপ গাছে হরেক রঙের গোলাপ আর ডালিয়া গাছে বিরাট আকারের ডালিয়া ফুটিয়েই চলে, কিন্তু রঘুর হাত দুটো মাটি মাখা, ধূসর হয়েই থেকে যায়। বাহারি ফুলের সব রং, গন্ধ, রূপের ভাগীদার শুধুই বাবুরা। কিন্তু রঘুকে বোঝাবে কে? বললেই বলে, “গাছেরা যে আমায় চেনে সুজয়, আমি ওদের যত্ন না করলে ওরা তো রাগ করবে আমার ওপরে।” বড়ো সরল এই নির্ভয়পুরের মানুষগুলো। রঙ্গিত নদীর জলের মতো স্বচ্ছ।
সুজয় গ্রিনভ্যালির সামনে গিয়ে দেখল, ভিতরটা একটু ফাঁকা ফাঁকা। রঘু শুধু কোদাল দিয়ে মাটি কুপিয়ে চলেছে। সুজয়কে দেখে কোদাল ফেলে এগিয়ে এল।
সুজয় বলল, “মঙ্গলবারেও কাজ করছ কেন রঘুদা? আজ ছুটি নেই?”
রঘু বোকা বোকা হেসে বলল, “ক্লাব তো বন্ধ আছে আজ। ছুটি তো। কেউই আসেনি। কিন্তু আমার জিনিয়ার বেডটা না বানালে রাতে ঘুম হবে না। তাই পামেলা ম্যাডামের কাছ থেকে চাবি চেয়ে নিয়ে এসে গেট খুলে কাজ করছি। ক্লাবের গেটে তালা ঝুলছে। আমি শুধু বাগানটাই খুলেছি।”
বেলা পড়ে এল, আকাশটা লালচে হয়ে আছে এখনও। সূর্য ফিরে যাওয়ার পরেও স্মৃতি আঁকড়ে কিছুক্ষণ পড়ে থাকার মতো। কিছু স্মৃতি বুকের বাম দিককে বড়ো রক্তাক্ত করে। কিন্তু নাছোড় হয় বলেই দূর হ বলে তাড়াতেও পারে না। ঠিক যেমন কুত্তলীর সঙ্গে পথ চলাগুলো ঘায়ের মতো দগদগ করছে সুজয়ের বুকে। এই গেট দিয়েই ওই ভীতু ভীতু মেয়েটার হাত ধরে একদিন এনেছিল গ্রিনভ্যালিতে। আজ সে বাড়িতে মিথ্যে বলে, সুজয়কে লুকিয়ে কোথাও একটা গেছে। কেমন যেন অপমানের একটা চিরচিরে জ্বালা আহত করছে ওর পুরুষত্বকে। গেট দিয়ে বেরোতে বেরোতেই ভাবছিল সুজয়, আচ্ছা এমন তো হওয়ার কথা নয়। কত ছেলে-মেয়েকেই তো ও ডেকে এনে চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছে। তারা রাস্তায় দেখা হলে, “সুজয়দা কেমন আছ?” জিজ্ঞাসা করে। সম্মান করে। এর বাইরে তো তাদের জীবন সম্পর্কে কিছুই জানে না সুজয়। তারা সন্ধেবেলায় বাড়িতে থাকে নাকি বাজারে, সে খোঁজ তো সুজয় নিতেও যায় না। তাদের চাকরি করে দিয়েছে বলে আলাদা অধিকারবোধও তো জন্মায়নি কারওর উপরে। তা হলে কেন কুন্তলীকে নিয়ে এত ভাবছে? কুন্তলীর জীবন সে কীভাবে কাটাবে, সেটা তো সে-ই ঠিক করবে। না, কেউই কৃতজ্ঞতার ভার নিয়ে বাঁচুক, এমন তো কখনওই চায়নি সুজয়। কুন্তলী কোথায় যাচ্ছে তার জবাবদিহি করতে বাধ্য নয় ও। সুজয়ের কাছে তো নয়ই। তা হলে এই চিনচিনে অপমানবোধ কীসের? কেন-ই বা কুন্তলীকে নিয়ে এত পজেসিভনেস কাজ করছে সুজয়ের মনে? না না, এ দোষ সুজয়ের নিজের। কুন্তলীর এখানে কোনও দোষ নেই। ছুটির দিনে অনেকেই রংবুলে যায় বায়োস্কোপ দেখতে। কুন্তলীও হয়তো গেছে। মেয়েটা জীবনে কী-ই বা পেয়েছে! আজ যদি একমুঠো রং এসে ওর জীবনের ধূসরতাগুলোকে রাঙিয়ে দিতে চায়, ক্ষতি কী?
হয়তো পাড়ার মেয়েদের সঙ্গে বায়োস্কোপ দেখতে গেছে। তাই মিথ্যে বলে পালিয়েছে। সুজয় খেয়াল করেনি, কখন ওর নিজের ঠোঁটেই এক চিলতে হাসির আনাগোনা শুরু হয়েছে।
রাস্তায় উঠে সাইকেলের প্যাডেলে পা দেওয়ার আগেই দেখল, শৌনক ডাক্তার আকাশের দিকে ক্যামেরা তাক করে ছবি তুলছে। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে সমাদ্দারের মেয়ে অস্মিতা। রূপে-গুণে যাকে বলে সরস্বতী। অস্মিতা বোধহয় এ চত্বরের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে। তেমনই শিক্ষিত। কী করে যে ওই নিরঞ্জন সমাদ্দারের মতো চামারের ঘরে এমন লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে জন্মায় কে জানে!
সুজয়ের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই শৌনক বলল, “কী ব্যাপার, খবর কী? শুনলাম নির্ভয়পুরের ইলেকশনে নাকি এবারের ক্যান্ডিডেট তুমি? খুব ভালো। আশা করি নির্ভয়পুরের মানুষ এতদিনে তাদের একজন জনপ্রতিনিধি পাবে।” সুজয় হেসে বলল, “অন্যদিকের প্রতিনিধির নাম শুনেছেন তো? টাকা আর রাজনীতি দুটোকেই যে নিজের বশে এনে ফেলেছে।”
অস্মিতা বলল, “পামেলা-আন্টি জিতবে না। তুমিই জিতবে।”
শৌনকের মুখে একটু অপ্রস্তুত ভাব। সুজয় ওদের মূল্যবান বিকেলটুকুকে কেড়ে নেবে না বলেই বলে উঠল, “আজ যাই ডাক্তারবাবু। একটু কাজ আছে।”
চার্চের দিকে জোরে সাইকেল চালাল।