ইতি নির্ভয়পুর – ৯
৯
অস্মিতা যেন চলমান জীবন থেকে বিছিন্ন হয়ে পড়েছে।
অতীত, ভবিষ্যৎ সবকিছুই তার কাছে আজ মূল্যহীন। বর্তমানটুকুকে নিয়েই সে বাঁচতে চায়। নিজেকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়েছে, অন্ধকার, নিस ঘরে নিজের সঙ্গে বোঝাপোড়া করেছে, তবুও কোথাও ও সাহবকে খুঁজে পায়নি। সেখানে বারবার উঁকি দিচ্ছে শৌনক। যতবার ওর বন্ধ চোখের সামনে শৌনকের মুখটা ভেসে উঠেছে, ততবারই ও চেষ্টা করেছে চোখ খুলে নিজের ভুলটুকুকে মুছে দিতে। এ নির্ভয়পুরের সকলে জানে, ও সাহেবের প্রেমিকা কলকাতায় ওদের আত্মীয়রাও বোঝে, সাহেবের সঙ্গে ওর একটা সম্পর্ক আছে। সর্বোপরি সাহেব এত বছর ধরে জানে, অস্মিতা ওর। কিন্তু মাত্র মাস পাঁচেকে অস্মিতার সমস্ত হিসেব-নিকেশ ঘেঁটে যেতে বসেছে। অস্মিতা সত্যিটা বুঝতে পেরেও অস্বীকার করছিল। কিন্তু তবুও বারবার ওর অনুভূতিগুলো সজাগ হয়ে ওকে বুঝিয়ে দিচ্ছিল, শৌনককে ও ভালোবেসে ফেলেছে। নিজের ওপরেই বিরক্তি তৈরি হচ্ছিল অস্মিতার। এটা কী করে সম্ভব?
দিশাহারা চোখ দুটো নির্ঘুম হয়ে প্রহর গুনে চলেছিল। মনের মধ্যে উথালপাতাল করে খুঁজে চলেছিল অব্যক্ত কষ্টের উৎসদের। শেষ পর্যন্ত দাঁড়ি চিহ্ন এসে থেমেছিল শৌনক নামেই। তবুও মানতে চায়নি অস্মিতা। নিজেকে বুঝিয়েছিল, এটা সাময়িক মোহ। টর্নেডোর মতোই সব লন্ডভন্ড করে ফিরে যাবে। বিধ্বস্ত অস্মিতা একা বসে থাকবে। না না, এ মোহকে জিততে দিলে চলবে না। তাই কাজের ছুতোয় নির্ভয়পুর ত্যাগ করে চলেও গিয়েছিল কলকাতা। কথায় আছে, আউট অফ সাইট আউট অফ মাইন্ড। কিন্তু অস্মিতা দেখল, প্রেম জিনিসটা বড়ো অভদ্র, নাছোড়বান্দা বিষয়। কলকাতা গিয়েও রেহাই পায়নি অস্মিতা। হাজার কাজের মধ্যেও শৌনকের অবয়ব ওকে উত্তেজিত করেছে। সফেদ, শৌখিন বিছানায় শুয়েও এপাশ-ওপাশ করেছে ও। অনুভূতি জুড়ে তখন এই নির্ভয়পুরের মুখচোরা ডাক্তারের অনুভূতিই ঘুরপাক খেয়েছে। সে এক অবর্ণনীয় যন্ত্রণা। কাউকে মন থেকে চিরদিনের জন্য বিতাড়িত করতে চাইছে অস্মিতা, আর ওর অজান্তেই সে চিরস্থায়ী সাম্রাজ্য বিস্তার করে চলেছে।
শেষ পর্যন্ত মনের কাছে মস্তিষ্কের পরাজয় ঘটেছে। তাই অস্মিতা ছুটে এসেছে নির্ভয়পুরে। দিন দুই একান্তে দেখাও করে ফেলল শৌনকের সঙ্গে, কিন্তু সেভাবে কিছুই বলা হল না। আর এই ডাক্তার তো বোধহয় ডাক্তারি ছাড়া জীবনে আর কোনও কিছুর অস্তিত্ব সম্পর্কেই অজ্ঞ। এখন কি একে পূর্বরাগ, প্রেম, ভালোবাসা এসব হাতে-কলমে শিখিয়ে তারপর প্রপোজ করতে হবে নাকি অস্মিতাকে, কে জানে! আরে একটা মেয়ে কারণে-অকারণে তোমার কাছে ছুটে আসছে সেটা কি শুধুই প্রেশার মাপাতে? অদ্ভুত লোক তো!
গতকাল সন্ধেতে শৌনকের বাড়িতে ধাওয়া করেছিল অস্মিতা।
ওকে দেখেই ডাক্তার বলে উঠল, “এ কী আপনি? কারও কিছু হল না কি? নিরঞ্জনবাবু ঠিক আছেন তো? আপনাকে কেমন একটা বিধ্বস্ত লাগছে কেন? বসুন বসুন। প্রলয় এক গ্লাস জল নিয়ে আয় তো। মনে হচ্ছে ম্যাডামের প্রেশারের প্রবলেম হচ্ছে।”
ওকে একটা কাঠের চেয়ারে বসিয়ে বার তিনেক প্রেশার মেপে হেসে হেসে বলল, “উঁহু, বেশি ক্র্যাশ ডায়েট করলে কিন্তু চলবে না, খেতে হবে। না হলে কিন্তু প্রেশার ফল করবে। আপনার প্রেশার লো কিন্তু। ফিগার মেইনটেন করতে গিয়ে শেষে মাথা ঘুরে পড়ে যাবেন। আমি একটা প্রপার ডায়েট চার্ট বানিয়ে দিচ্ছি। বাই দ্য ওয়ে, আপনার গা-টা একটু গরম, জ্বর নেই তো?”
অদ্ভুত এক পরিস্থিতি। ডাক্তার প্রেসক্রিপশন করতে ব্যস্ত, প্রলয় জল নিয়ে হাজির, ওদিকে অস্মিতা বলতে চাইছিল, আজ আমার আসার কারণটা একটু আলাদা। এ জ্বরে থার্মোমিটার লাগবে না, বিশেষ একজনের ঠান্ডা হাতের স্পর্শেই মুহূর্তে কমে যাবে এই উত্তজনার উত্তাপ। কিন্তু অস্মিতার মতো স্মার্ট মেয়ের সমস্ত গর্ব ক্ষুণ্ণ করে ওর ঠোঁট দুটো কিছুতেই বাঙ্ময় হল না। ঠোঁটের কোণে এসে থমকে গেল ওর সমস্ত কথারা।
শৌনক এক মনে ওর ডায়েট চার্ট বানাতে ব্যস্ত। মাঝে মাঝে জেনে নিচ্ছিল কোনও খাবারে ওর অ্যালার্জি আছে কি না। অস্মিতা আপ্রাণ চেষ্টা করেও বলতে পারল না, মনকে বশ করার কোনও ওষুধ জানা আছে আপনার? যে ওষুধ খেলে শৌনক নামক মানুষটা আমার ঘুম বা জাগরণেও সামনে এসে দাঁড়াবে না?
শৌনকের সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমে ক্লান্ত মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতে থাকতে অস্মিতা ভুলেই গেল, ঠিক কী বলতে এসেছিল এখানে। মনে হল, শৌনক যেন চা-বাগানের মাঝে মাঝে ওই বড়ো বড়ো গাছগুলো। যাদের নিচে চা পাতাগুলো একটু ছায়া পায়। এর নিচে দু’দণ্ড বসলেও শাস্তি। চা পাতার ভিড়ে এদের লোকজন সেভাবে গুরুত্ব দেয় না ঠিকই, কিন্তু এরা না থাকলে প্রখর রৌদ্রে মরেই যেত সদ্য গজানো আলটুসি চা পাতাগুলো। শৌনককেও অস্মিতার শেভ টি মনে হয়। নির্ভয়পুরের মানুষ খুব বিশ্বাস করে তাদের ডাক্তারবাবুকে। এত কম বয়সে এমন অভিজ্ঞ ভাক্তার এ চত্বরে এর আগে আসেনি কখনও
প্রেসক্রিপশনটা ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে শৌনক বলল, “ফলো করবেন জি।”
আনমনা অস্মিতা বলল, “আপনি চান কড়ই, শিরীষ এদের নাম শুনেছেন?”
শৌনক একটু অবাক হয়েই বলল, “কেন বলুন তো?”
অস্মিতা বলল, “এরা হল শেড ট্রি। কচি চা গাছগুলোকে রোদ, ঝড় থেকে এরাই বাঁচায়। এদের ছায়ায় বসলে বড়ো নিশ্চিত্ত লাগে। ঠিক যেমন আপনার পাশে বসে থেকেই আমার শরীর বেশ চাঙ্গা হয়ে গেল, তেমনই।”
শৌনক একটু অপ্রস্তুত গলায় বলল, “কী যে বলেন! আমি সামান্য মানুষ। ক্ষমতা খুব সামান্য।”
অস্মিতা বলতে যাচ্ছিল, ওই অতি সামান্য ক্ষমতা থেকেই আমায় একটু ধার দেওয়া যাবে? আপনার সাধ্যের মধ্যেই যদি কিছু চাই দেবেন? কিন্তু বলার আগেই প্রলয় এসে বলল, “শৌনকদা, মল্লিকবাবু একবার ডেকে পাঠিয়েছে তোমায়। গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।”
শৌনক বলল, “হ্যাঁ, বলো আসছি।”
এরপরে ওখানে বসে থাকাটা নিতান্ত অশিক্ষিতের লক্ষণ, তাই অস্মিতা হাতে প্রেসক্রিপশনটা নিতে নিতে বলল, “আপনার ফিজটা তা হলে প্রলয়কেই দিয়ে দিচ্ছি।”
মনে একটা ক্ষীণ আশা ছিল, হয়তো শৌনক বলবে, আপনার সঙ্গে কি আমার ফিজের সম্পর্ক? তবুও অস্মিতা ফিজটা দিয়েই যাবে, কিন্তু ওই একটা বাক্যের প্রত্যাশা করেছিল।
কতটা ভুল প্রত্যাশা সেটা শৌনক চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে বলল, “হ্যাঁ, প্রলয়কেই দিয়ে যান।”
আর দাঁড়ায়নি শৌনক। মল্লিককাকুর পাঠানো গাড়িতে চেপে রওনা দিয়েছিল সাহেবদের বাড়ি। বাবার কাছে শুনেছিল মল্লিককাকুর আচমকা হার্টের প্রবলেম ধরা পড়েছে। সাহেব নাকি এখানের ট্রিটমেন্টে খুশি নয়, তাই কলকাতা নিয়ে যেতে চায় বাবাকে। তারপরেও অস্মিতা দেখতে যায়নি মল্লিককাকুকে। এ বড়ো অসভ্যতা হচ্ছে। সাহেব ওর সব থেকে কাছের বন্ধু, তার বাবার এমন অবস্থায় অস্মিতা পাশে গিয়ে দাঁড়াবে না, এটা যেন ওর নিজেরই ভাবনার বাইরে। কিন্তু অস্মিতা জানে, সাহেবের কাছে গেলেই এখন যে প্রশ্নগুলোর ও সম্মুখীন হবে সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর ওর কাছে নেই। না, সাহেবের ভালোবাসার কোনও ফাঁকি নেই। কিন্তু অস্মিতার ভালোবাসায় নিশ্চয়ই ছিল। সাহেবকে ও কেন বন্ধুত্বের গণ্ডির বাইরে বের করতেই পারল না কে জানে! কেন ও সাহেবকে প্রেমিক হিসাবে দেখতে পারল না, তারও কোনও উত্তর ওর সামনে নেই। সাহেব যদি ওকে প্রশ্ন করে, কেন অস্মিতা ওদের সম্পর্কটাকে পরিণতি দিতে চাইছে না, তা হলে ঠিক কী উত্তর দেবে অস্থিতা? সেই ছোটো থেকে পরিচিত সাহেবকে ফেলে ও শৌনককে ভালোবাসে? যাকে এখনও পর্যন্ত ও ঠিক করে চিনলই না! অস্মিতার নিজের কাছেই যে বিষয়টা বড়ো ধোঁয়াশার। শৌনকের এই সৌম্য, শান্ত, গম্ভীর রূপটাতে কেন যে ও এইভাবে আবিষ্ট হয়ে পড়ল, সেটাও অজানা ওর কাছে। আসলে অস্মিতা সাহেবের মুখোমুখি হতেই ভয় পাচ্ছে। তাই কিছুটা হলেও এড়িয়ে এড়িয়ে থাকছে। নূপুরের সঙ্গেও অস্মিতার খুবই ভালো বন্ধুত্ব। বয়সে বছরকয়েকের ছোটো হলেও ওদের সম্পর্কটা খুবই খোলামেলা। অস্মিতা জানে, সাহেবের প্রশ্ন যদি বা এড়িয়ে যাওয়া যায়, নূপুরকে ফেস করতেই হবে ওকে।
সুজয়ের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে এসব ভেবে চলেছিল অস্মিতা। হঠাৎই খেয়াল করল, শৌনক ক্যামেরা নিয়ে এগিয়ে গেছে বেশ কিছুটা অস্মিতা অনুভব করছে শৌনক ওকে কিছুটা যেন ইগনোর করতেই চাইছে। কথার সুর কেবলই অন্য দিকে নিয়ে যাচ্ছে। নির্ভয়পুরের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে এখানের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অবহেলা নিয়েই কথা চালানোর চেষ্টা করছে।
অস্মিতা হেসে বলল, “আপনার কি মনে হয় ডক্টর, আমি বাড়ি থেকে চার মাইল রাস্তা গাড়ি ড্রাইভ করে, অন্তত একশোটা সিঁড়ি নেমে আপনার সঙ্গে কথা বলতে এসেছি নির্ভয়পুরের ভবিষ্যৎ নিয়ে?”
শৌনক পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি ঠিক জানি না আপনি কেন এত দূরে এলেন। আপনি আমায় কল করে জিজ্ঞাসা করলেন চেম্বারে না হসপিটালে। আমি স্বাভাবিকভাবেই বললাম, বাঁকতলার চা বাগানে আছি। আপনি ফোনটা কেটে দিলেন। ছবি তুলতে তুলতেই দেখলাম, আপনি চলে এসেছেন। সত্যিই জানি না আপনি কী বিষয়ে কথা বলতে এসেছেন! আপনি কি অরুণাংশু মল্লিকের শারীরিক অবস্থার কথা আলাদাভাবে জানতে চান?”
অস্তমিত সূর্যের তাপ বিকিরণের ক্ষমতা নেই, তাছাড়া ফাঁকা মাঠে হাওয়াও দিচ্ছে। একটু যেন শিরশির করছিল অস্মিতার শরীরটা। নির্ভয়পুর সারাবছরই শীতলতাকে কবজা করে রেখেছে নিজের জিম্মায়। তাতে রোদ পড়ে যেতে বেশ ঠান্ডা লাগছিল, কিন্তু শৌনকের কথাতেই আচমকা রক্তটা গরম হয়ে গেল।
শুধু উপেক্ষা নয়, কিছুটা যেন অপমানের গন্ধ পেল অস্মিতা ওর কথায়। একটু ঝাঁজালো গলাতেই বলল, “আপনি এবারে ডাক্তারি ছেড়ে জ্যোতিষ চর্চা করুন মিস্টার শৌনক। সেদিন সন্ধেতে আপনার কোয়ার্টারে গেলাম, কিছু বলার আগেই আপনি বুঝে গেলেন আমার প্রেশার লো, তাই জোর করে ডায়েট চার্ট গুঁজে দিলেন। আজও আমি কিছু বলার আগেই আপনি বুঝতে পারলেন, আমি অরুণাংশুকাকুর শারীরিক অবস্থা জানার জন্য আপনার কাছে ধরনা দিয়েছি! অদ্ভুত ক্ষমতা কিন্তু আপনার! ভালো রোগ নির্ণয় করেন, ভালো ছবি তোলেন, এবারে ভালো ভবিষ্যৎ দেখেন সেটাও জানলাম। এই পেশার কথা নির্ভয়পুরের লোকজন জানলে তো আপনাকে ডবল ফিজ দেবে। কারণ, এখানের লোকজন এখনও বেশ কুসংস্কারী।”
শৌনক ক্যামেরার স্ট্যান্ডটা বগলে ভরে হেসে বলল, “সর্বনাশ! আপনি দেখছি ভয়ানক রেগে গেছেন। সাহেবের সঙ্গে ঝগড়া করলেন বুঝি? শুনুন আপনার চিন্তার কারণ নেই, মল্লিকবাবু একেবারে ঠিক আছেন। স্টেন্ট বাসাতে হবে দুটো। তা হলেই ফিট। সেদিন ওটিতে নিয়ে গিয়ে অ্যানজিওগ্রাম করার সময়েই এটা বলেছিলাম। সাহেবের ইচ্ছে কলকাতায় আর-একবার দেখিয়ে বসাবে। আমি ওষুধ স্টার্ট করেও দিয়েছি। এখন টেনশনের কোনও কারণ নেই।”
অস্মিতা অপলক তাকিয়ে আছে শৌনকের দিকে। লোকটা কি বোকা নাকি মারাত্মক চালাক? নাকি কোনও মনের মানুষ আছে অলরেডি। যদি এনগেজড হত তা হলে কি আর এই পাহাড়তলিতে পড়ে থাকত দিনের পর দিন? নাকি অস্মিতাকে পছন্দ নয়? যা-ই হোক না কেন, অস্মিতা যখন কিছু বলতে এসেছিল সেটা শোনাটা একজন ভদ্রলোকের দায়িত্ব। তাছাড়া অস্মিতার সঙ্গে সাহেবের ঝগড়া হয়েছে বলে ঠিক কী বোঝাতে চাইল শৌনক? অস্মিতার সম্পর্কের কথা জানে ও সেটাই কি বোঝাতে চাইল?
শৌনক অস্ফুটে বলল, “আমরা এমন বহু ভুল করি জানেন? মোহ আর ভালোবাসাকে এক ভেবে নিই। আমার এক বান্ধবী ছিল রণিতা। আমি ওকে বান্ধবী ভাবলেও ও আমায় প্রেমিক ভাবত। তারপর একদিন ও রিয়ালাইজ করল, ও আর-একজনকে ভালোবাসে। তার প্রতি ওর ফিলিং বেশি। তার মানে, আমি ওর সাম হাও একটা অ্যাট্রাকশন ছিলাম মাত্র। তাই বলছি অস্মিতা, মোহ বড়ো সাময়িক, ভালোবাসা দীর্ঘস্থায়ী।”
অস্মিতার ছুটে পালাতে ইচ্ছে করছে এখন। এতটা অপমান ওকে বোধহয় এর আগে কেউ কখনও করেনি। এত ঠান্ডা গলায় এভাবে ইনডিরেক্টলি অপমানের কোনও অভিজ্ঞতাই নেই অস্মিতার। চুপ করে আছে অস্মিতা।
শৌনক বলল, “সাহেব আপনাকে সত্যি ভালোবাসে, আমার মনে হয় আপনিও বাসেন। সাময়িক রাগ-অভিমান সব সম্পর্কেই হয়।”
অস্মিতার সহ্য ক্ষমতাও এবারে বিদ্রোহ করে উঠল। ও নিরঞ্জন সমাদ্দারের মতো শিল্পপতির মেয়ে। সুন্দরী, বিদূষী শুনতেই অভ্যস্ত। জীবনে অভাব কার নাম দেখেনি। কম ছেলে ওর জন্য পাগল হয়নি। কম সুপুরুষ ওকে প্রেম নিবেদন করেনি, তার পরেও ওই দু’কামরার সরকারি কোয়ার্টারে থাকা ডাক্তারের সাহস দেখে ও বিস্মিত!
অস্মিতা বলল, “কিছু কিছু কথা কারও মুখে মানায় না মিস্টার শৌনক যেন সম্পর্কের ওঠাপড়ার কথা আপনার মুখে মানায় না যার তিনকুলে কেউ নেই। আসলে আপনি তো অনাথ, তাই সম্পর্ক আসলে কী আপনি জানেনই না। সুতরাং এসব ঝগড়া-অভিমান নিয়ে অভিমত দেওয়াটা ঠিক শোভা পায় না আপনার।”
ঝড়ের বেগে ওই খাড়া সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে লাগল অস্মিতা।
শৌনক পিছন থেকে বলল, “আরে পড়ে যাবেন যে। আস্তে যান, পড়ে গেলে ভাঙা পা নিয়ে এই অনাথের কাছেই আসতে হবে।”
একটু জোরেই হাসল শৌনক। অনাথ কথাটা শোনার পরে মুহূর্তের জন্য নিবেদিতা বসুর মুখটা দৃশ্যপটে উঁকি দিয়ে গেল।
অস্মিতা ঘুরেও তাকাল না। শৌনক একলা বসে রইল পাহাড়ের ঢালে। এই পথে কোলাহল নেই। নিস্তব্ধে সন্ধে নামবে। কারখানা থেকে শ্রমিকরা বাড়ি ফিরবে এখনই, কিন্তু সেটাও এই পথে নয়। এটা ওদের জন্য ঘুরপথ হয়। এটা বরং ট্যুরিস্টদের আকর্ষণ। কারণ, এখানেই একটা পাহাড়ি ঝরনার ধারে শিবমন্দির আছে। এখানের লোকজন বলে মহাকালের মন্দির। ভিতরে বিগ্রহ নেই, আছে একটা কষ্টিপাথর। তাতেই এখানের অধিবাসীরা সিঁদুর লেপে দিয়ে যায় সকালে। জঙ্গলে বুনো হাতির থেকে নাকি এই মহাকালই এদের বাঁচিয়ে রাখেন বলেই বিশ্বাস করে এরা। শৌনক নাস্তিক মানুষ। ঈশ্বরে বিশ্বাসী নয়। ওর মতে, মানুষ নিজের ভাগ্য নিজেই তৈরি করে। তবে আজ অবধি কারও ঈশ্বর বিশ্বাসে কখনও আঘাত করেনি। মাঝে মাঝেই এখানে চলে আসে শৌনক। বেলা পড়ে এলে চা পাতার ওপরে রোদের আলপনা আঁকা হয়, সেই দেখতেই চলে আসে। কিছু ছবি তুলে আবার ফিরে যায়। না, এ ছবি কোনও এগজিবিশনে যাবে না, আলাদা ফোল্ডারেও গুছিয়ে রাখা হয় না। ছবি তোলাটাই নেশা ওর, তার আর পর নেই। আনমনে বসে বসে ভাবছিল শৌনক, অস্মিতাকে এভাবে বলাটা বোধহয় ঠিক হয়নি ওর। মেয়েটা একটু বেশিই অপমানিত বোধ করল। কিন্তু এছাড়া আর কিছু উপায় ছিল না শৌনকের। নিজের ভালোলাগা, না লাগার থেকেও বেশি গুরুত্ব দিতে হল একজন মানুষের অনুরোধকে। সাহেবদের গাড়ি এসে ওকে বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল মল্লিকবাবুর চেকআপের জন্য নয়, সেটা ও বাড়িতে পা দিয়ে বুঝেছিল।
বাড়িতে ঢুকতেই মল্লিকবাবুর স্ত্রী অতসীদেবী নিজে লুচি-মাংস-মিষ্টির থালা সাজিয়ে ওকে বলেছিল, “আগে খাও দেখি বাবা। এ দেখো বয়েস হলে ছেলের বয়েসি সবাইকেই বাবা-বাছা বলে ফেলি। সরি সরি ডাক্তারবাবু। যা-ই হোক, হসপিটাল থেকে ফিরেছ আর আমি তুলে এনেছি, আগে খেয়ে নাও।”
শৌনক এর আগেও এসেছে মল্লিকদের বাড়িতে। চা-মিষ্টি অবশ্যই খেয়েছে, কিন্তু এমন থালা সাজিয়ে স্বয়ং মালকিন এসে অনুরোধ করছে, এমন ঘটনা তো কখনও ঘটেনি।
শৌনকের চোখে প্রশ্নচিহ্ন উঁকিঝুঁকি দেবার আগেই অতসী বলল, “এত ভাবার কী হয়েছে? তুমি গৃহকর্তার প্রাণ ফিরিয়ে দিলে, তুমি তো স্বয়ং নারায়ণ, তোমার সেবা না করলে স্বয়ং ঈশ্বর পাপ দেবেন যে।”
শৌনক হেসে বলেছিল, “আপনি আমার বাবা সম্বোধন করতেই পারেন।” অতসী যেন খুব বড়ো পুরস্কার পেয়েছে এভাবেই বলেছিল, “বাঁচালে বাবা। এ বড়ো পুরোনো রোগ, যাকে আপন মনে হয় তাকে আর দূরে সরিয়ে রাখতে পারি না।”
শৌনক খেতে শুরু করেছিল। এমন সুস্বাদু খাবার বহুদিন খাওয়া হয় না। অতসী পাশে বসে টুকিটাকি গল্প করছিল। মল্লিকবাবুর একমাত্র নেশা পাঁঠার মাংস খাওয়া, কী করে যে এ ভয়ঙ্কর নেশা বন্ধ করবে কে জানে! এদিকে তো হার্ট জানান দিল, সে ক্লান্ত। আগে তো ক্লাবে গিয়ে মাঝে মাঝে ওসব ছাইপাঁশ খেত, সে সব বন্ধ করেছে বেশ কিছু মাস আগেই।
অতসীর এসব টুকটাক গল্পের মধ্যেই শৌনককে বলছিল, “আর দুটো লুচি দিতে বলি বাবা? আরে তোমাদের বয়েস কম, তোমরা এত কম খেলে যে খাবারের অপমান হয়।”
খাওয়া শেষ হতেই হাত ধুয়ে বসল শৌনক
অতসী বলল, “কী বুঝছ বাবা ওর শরীর? বড়ো কাজের ঝামেলা নিতে পারবে? সাহেব আর অস্মিতার বিয়েটা দিয়ে দিতে চাইছি। দেখো, এখনকার ছেলেমেয়েদের তো কোনও বিশ্বাস নেই, আজ বলছে ভালোবাসি, কাল বলবে ব্রেকআপ। সাহেব দেখছি ক’দিন ধরেই মনখারাপ করে বসে আছে। কারও সঙ্গেই ভালো করে কথা বলছে না ছেলে। পরে বুঝলাম, অস্মিতার ওপরে তার অভিমান হয়েছে। সে হতেই পারে। ওদের বন্ধুত্ব তো আজকের নয়। সেই কোন ছোটোবেলার বন্ধু ওরা। তখন তুমি হয়তো নির্ভয়পুরের নামও শোনোনি। জানি না সাহেব কিছু বলেছে কি না অস্মিতাকে। সেই রাগেই হয়তো ও পাগলি মেয়ে যার-তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করে সাহেবকে রাগাতে চাইছে। আমার ড্রাইভার বলল, তোমার সঙ্গেই নাকি ঘোরাফেরা করছে আজকাল। দেখো মানুষে মানুষে বন্ধুত্ব হবে এটাই তো স্বাভাবিক, কিন্তু অস্মিতা যে সাহেবের ওপরে রাগের মাথায় তোমার মতো পরোপকারী একজনকে ব্যবহার করতে চাইছে, এটা বড়ো ভুল করছে মেয়েটা। আরে তোদের সম্পর্ক কি একদিনের? এ নির্ভয়পুরের প্রতিটা মানুষ জানে যে, সমাদ্দার আর মল্লিকরা সবেতেই সমগোত্রীয়, তাই বিয়েটা হবে। মাঝখান থেকে তোমার নামে একটা বদনাম রটবে, সেটা কি ভালো হবে? আসলে বাবা সবই বড়োলোকদের মনমর্জি। তুমি-আমি মধ্যবিত্ত মানসিকতায় এর তল পাব না। অস্মিতা একবারও ভেবে দেখল না, যে মেয়েটা গাড়ি ছাড়া এক পা চলতে পারে না, নিজস্ব বিশাল ঘর ছাড়া থাকতে পারে না, সে ওই ছোটো কোয়ার্টারে থাকবে কী করে? না বাবা, এটাই এখনকার ছেলেমেয়েদের দোষ, এরা একেবারেই অগ্রপশ্চাৎ ভাবে না। আর সাহেবকেও বলি, তোর বাগদত্তা, তার ওপরে এমন রাগ দেখাতে আছে? যা-ই হোক বাবা, অস্মিতা তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে এলে একবার মনে করিয়ে দিয়ো সে মল্লিক বাড়ির বউ হতে চলেছে, পথে-ঘাটে এভাবে ঘুরে বেড়ানো শোভা পায় না। বন্ধুত্ব সে করুক, তাতে আমার কোনও আপত্তি নেই, তোমরা তো সমবয়েসি। তুমি, সাহেব, অস্মিতা, নূপুর সবাই মিলে একসঙ্গে গল্পগাছা করো না, কারও কিছু বলার নেই। শৌনক, তুমি আমার কথাতে রাগ করলে না তো বাবা? আমি তোমাদের মতো উচ্চশিক্ষিত নই, মায়ের মতো মনে করে ক্ষমা করে দিয়ো বাবা।”
শৌনক শুধু বলেছিল, “চিন্তা করবেন না, আমি অস্মিতাকে বুঝিয়ে বলব। তাছাড়া অস্মিতার আমার প্রতি কোনও অনুভূতি থাকলেও আমার সামান্যতমও নেই। আর আমি সমগোত্রীয় বন্ধুত্বে বিশ্বাসী। ডাক্তারি আমার শুধু পেশা নয়, নেশাও। সে নেশায় শামিল হবার মতো মানুষ যদি কখনও পাই, তা হলেই বন্ধুত্ব গভীর হবে, নচেৎ নয়। আর মল্লিকবাবু সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবেন কদিনেই। তাই আপনি নিশ্চিন্তে বিয়ের প্রিপারেশন নিতেই পারেন।”
অতসীর শেষের কথাগুলো আর শুনতে ইচ্ছে করছিল না শৌনকের। নিজেদের সাউথ কলকাতার বিশাল বাড়ি, তিনটে দামি গাড়ি আর নিজের ব্যালকনি সমেত ঘরটার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। সঙ্গে মনে পড়ছিল, শোভন বসু আবার ওই বাড়িটা শৌনকের নামেই রেজিস্ট্রি করে দিয়েছিল ওর আঠারো বছর হতেই। বলেছিল, “ছেলে আমাদের তাড়িয়ে দিলেও তো ফ্ল্যাট কিনে রেখেছি, ওখানেই বুড়োবুড়ি চলে যাব না হয়।”
মা বলেছিল, “তোমার সবেতেই নাটকীয়তা। আমাদের যা কিছু সবই তো শানুর। এত ঘটা করে ওর নামে করার কী আছে?”
বাবা বলেছিল, “না গো, দিনকাল ভালো নয়, আর আমাদের আত্মীয়রাও সব নিজের ধান্দায় থাকে। তাই এসব কাজ ফেলে রেখে লাভ নেই।”
শৌনক হেসে বলেছিল, “এই যে তোমাদের বাড়িটা আমি নিতে রাজি হলাম এই জন্য আজ ডিনারে একটু মটন বিরিয়ানি খেলে হয় না?”
মা হাসতে হাসতে বলেছিল, “বাপ-বেটা দুজনেরই আলোচনার কনক্লুশন এসে পৌঁছায় খাওয়াতে।”
না, ওরা শিল্পপতি নয় ঠিকই। কিন্তু অতসীদেবী যেভাবে যার-তার সঙ্গে অস্মিতার বন্ধুত্বের কথাটা বললেন এতটাও অযোগ্য বোধহয় শৌনক নয়। তবে সে সব ভাবনা থাক। দুজন মুখোশধারী মিথ্যুক মানুষকে বাবা-মা পরিচয় দেওয়ার থেকে অনাথ পরিচয় অনেক ভালো।
অস্মিতা রাগে, অপমানে বিরক্ত হয়ে ফিরে গেছে। শৌনক ছাইপাঁশ ভাবা বন্ধ করে ক্যামেরা স্ট্যান্ডটা কাঁধে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল।
হঠাৎই এক ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা বলে উঠলেন, “আরে, শৌনক না?”
শৌনক ঘাড় ঘোরাতেই ভদ্রমহিলা বললেন, “চিনতে পারছিস শৌনক?” শৌনক ঘাড় নেড়ে বলল, “আপনাদের কোথাও একটা ভুল হচ্ছে।” ভদ্রলোক বললেন, “আপনি কার্ডিওলজিস্ট শোভন বসুর ছেলে নন? কী বলছেন? আপনার সঙ্গে একই ক্লাসে আমার ছেলে পড়েছে। ঋতমকে মনে নেই?”
ভদ্রমহিলা বললেন, “তোরা তো বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলি। মনে পড়ছে না? কতবার তোদের বাড়ি আমরা গেছি, তুইও আমাদের বাড়িতে এসেছিস। ঋতম বলেছিল, তুই ডাক্তার হয়েছিস। ঋতম এখন অস্ট্রেলিয়াতে। আমরা দুজনে অফবিটে ঘুরে বেড়াই।”
শৌনক গম্ভীর গলায় বলল, “আপনাদের ভুল হচ্ছে। শোভন বসু বলে আমি কাউকে চিনি না।”
কথাটা বলেই দ্রুত গতিতে ওঁদের পিছনে ফেলে এগিয়ে এল।
ঋতমের মা শর্মিলা-আন্টি আর ঋতব্রত-আঙ্কেলকে না চেনার কোন কারণ নেই। ঋতম আর ওর মাধ্যমেই দুই ফ্যামিলির মধ্যেই বেশ হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিল। পরবর্তী সময়েও ঋতমের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ ছিল। নির্ভয়পুরে আসার পর কলকাতার সব যোগাযোগ স্বেচ্ছায় ছিন্ন করেছে ও। ওই জীবনটাতে আর ফিরতে চায় না বলেই বিচ্ছিন্ন করেছিল যোগাযোগগুলো। তবে ইদানীং দেখছে, নির্ভয়পুর বেশ ভালো ট্যুরিস্ট স্পট হয়ে উঠছে। লোকজনের আবার অফবিটের প্রতি নেশা চেপেছে তাই হয়তো। শর্মিলা-আন্টি আর ঋতব্রত-আঙ্কেলের কথাটা ফাঁকা জায়গায় প্রতিধ্বনিত হয়ে এল শৌনকের কানে।
“শোভনের ছেলেটার কি মাথাখারাপ হয়ে গেল নাকি?”
শর্মিলা-আন্টি বলল, “নিবেদিতাকে একটা কল করব? ফোন নম্বর আছে আমার কাছে।”
পিছনের স্মৃতিকে আরও পিছনে ফেলে এগিয়ে এল শৌনক। ওর কোয়ার্টারের রাস্তার ধারেই একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখে চমকে উঠল। সাহেব পকেট থেকে একটা পাঁচশো টাকার নোট নিয়ে প্রলয়কে দিচ্ছে। প্রলয়ও টাকাটা একটু যেন আড়াল করেই পকেটে ঢোকাল। সাহেবদের গাড়িটা বেরিয়ে গেল। আজই ওদের কলকাতা যাওয়ার কথা। তার মানে, এয়ারপোর্টে যাবার আগে কোনও কারণে প্রলয়কে টাকা দিয়ে গেল সাহেব। কিন্তু কারণটা কী?
শৌনক ক্যামেরাটা যথাস্থানে রাখার আগেই একটু হন্তদন্ত হয়ে প্রলয় ঢুকল। শৌনককে দেখে একটু চমকেছে সেটা ওর চোখ বলে দিচ্ছে। তড়িঘড়ি বলল, “তুমি চলে এসেছ? বসো, চা দিই।”
শৌনক একটু শীতল গলায় বলল, “প্রলয়, ধরো আমি যদি কাল তোমায় আমার চেম্বার থেকে ছাড়িয়ে দিই, তা হলে তুমি কোথায় কাজ করবে? মল্লিকদের রিসর্টে?”
প্রলয় একটু থতমত খেয়ে বলল, “ছাড়িয়ে কেন দেবে শৌনকদা? আমি কি কাজে কোনও ভুল করেছি?”
শৌনক বলল, “উঁহু, ভুল তুমি কেন করবে? ভুল তো আমার। আমি ভেবেছিলাম, নির্ভয়পুরের মানুষের অর্থের অভাব আছে ঠিকই কিন্তু এরা বেইমান নয়। অর্থের অভাব মেটার পরেও যে মানুষ বাড়তি ইনকামের জন্য আমায় বেচে দিতে পারে, সেটা কখনও ভাবিনি। ফুলমণি আর তোমাকে আমি আমার পরিবার মনে করতাম। কিন্তু দেখলাম সেটা ভুল। আমি আমার পরিবারকে ছেড়েছি শুধু মিথ্যে বলার কারণে। তাই তোমাকে ছাড়তে আমার বেশি সময় লাগবে না প্রলয়। তুমি হয়তো জানো না, মিথ্যাকে আমি সব থেকে বেশি ঘৃণা করি। যারা মিথ্যে বলে সেই সম্পর্ককে আমি গলা টিপে মেরে দিই। ডাক্তাররা শুধু মানুষের জীবনই বাঁচায় না প্রলয়, তারা প্রয়োজনে মারতেও পারে। যাকে প্রত্যক্ষভাবে খুন না বললেও পরোক্ষভাব খুন বলাই যায়। এ মাসের মাত্র দশদিন হয়েছে, তবুও আমি তোমায় পুরো মাইনেই দেব, তুমি তোমার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ো আজ রাতেই।”
শৌনক ফুলমণির করে দেওয়া চায়ের ফ্লাক্সটা নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।
নিবেদিতা বসু বলেছিল, “তুই হয়তো মনে করছিস, এ পৃথিবীতে আমরাই সব থেকে নিকৃষ্ট মানুষ, বাকি সবাই খুব পবিত্র। সে ধারণা তোর ভেঙে যাবে নির্ভয়পুরে বছরখানেক থাকলেই। ওখানের মানুষজনও মিথ্যে বলে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে। ওখানের মানুষও লোককে ঠকায়। তাই তুই যদি মনে করে থাকিস, নির্ভয়পুরের লোকজন রঙ্গিত নদীর জলের মতো স্বচ্ছ, সেটা তোর ভুল ধারণা।”
“শৌনক বলছিল, মানতে পারলাম না। তারা ডক্টর নিবেদিতা বসু আর ডক্টর শোভন বসুর মতো নিজেদের স্বার্থে দুর্নীতি করবে, মিথ্যে বলবে।”
মা শান্ত গলায় বলেছিল, “তুই ছোটো থেকেই প্রমাণ ছাড়া কিছু বিশ্বাস করতিস না। তোর বাবা বলত, ‘তোমার ছেলেকে ঠকানো মুশকিল, নিজে দেখে তবে বিশ্বাস করে।’ আমি বলতাম, ‘এরাই আবার ঠকে বেশি, যতক্ষণ পর্যন্ত না নিজে দেখতে পাচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত ঠকেই যাবে। এ সুযোগ অনেকেই নেবে।’ তুই যা নির্ভয়পুর, দেখ যেটা খুঁজতে যাচ্ছিস পাস কি না।”
আজ প্রলয়ের ব্যবহারে শৌনকের মনে হচ্ছে, মা বোধহয় ঠিকই বলেছিল। এখানের মানুষও বেইমান হয়। প্রলয়কে নিজের হাতে তৈরি করেছিল শৌনক। বুনো হাতির উপদ্রবে জঙ্গলের ধারের ঘর প্রায়ই ভেঙে যেত প্রলয়দের। একবার নাকি এক খ্যাপা হাতি রাতের অন্ধকারে ঘুমন্ত অবস্থায় প্রলয়ের ঘরে ঢুকে যায়। তার পায়ের চাপেই ওর বাবা মারা গিয়েছিল। ওর মা কোনওমতে বছর আটের প্রলয়কে নিয়ে পালিয়ে বেঁচেছিল। তারপর থেকেই প্রলয়ের মা এর-ওর দুয়ারে কাজ করে ওকে মানুষ করেছিল। লেখাপড়ায় ভালো ছিল বলে মিশনারি স্কুলে বিনামূল্যে পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়েছিল। খুবই অভাবে আর কষ্টে কেটেছিল ওর ছোটোবেলা। প্রলয় আর পাঁচজনের মতো শক্তপোক্ত নয় বলেই কারখানার কাজ করতে পারত না। ওই দু’দিন যেত তো তিনদিন কামাই। শৌনকই ওকে কম্পাউন্ডার তৈরি করে কাজ দিয়েছিল। সারাদিন শৌনকের বাড়িতেই থাকত। ফুলমণি ওদের দুজনের জন্যই একই রান্না করত। নিজের ভাইয়ের মতোই স্নেহ করত শৌনক ওকে। কমবয়েসি ছেলে শখ-আহ্লাদ থাকবে ভেবেই মাঝে মাঝে ছুটিও দিত। প্রলয় ছুটত সিনেমা দেখতে। প্রলয় বলত, “তুমি আমায় কাজ দিয়েছ শৌনকলা, ভরা পেট খাবার দিয়েছ, তোমার জন্য আমি জান দিতে পারি।”
প্রলয়ের সেই আবেগ কবেই চলে গেছে। এখন মাইনে পায় তাই কাজটুকু করে। না, কৃতজ্ঞতা শৌনকও চায় না, তাই বলে ওর খবর টাকার বিনিময়ে সাহেবকে বেচে দেবে, এটা যেন কল্পনারও বাইরে!
চা-টা ফুলমণি মন্দ বানায় না। কিন্তু আজ কেমন যেন তেতো লাগছে। ঠিক প্রলয় আর ওর সম্পর্কের মতো তিক্ত। সাহেবের চোখে শৌনক এখন শত্রু। ওরও হয়তো ধারণা হয়েছে, অস্মিতাকে শৌনকই ডাকছে বা ফোন করছে। এদের কী করে বোঝাবে শৌনক, অস্মিতাকে দেখে কোনওদিনই আলাদা কোনও অনুভূতি জন্মায়নি শৌনকের মধ্যে? নিরঞ্জন সমাদ্দারও হঠাৎ করেই শৌনকের ওপরে একটু বেশিই দৃষ্টি দিচ্ছিলেন। সেটা হয়তো মেয়ের মনের খবর পেয়েই। শৌনকের তো অস্মিতাকে বেশ মুডি টাইপের মেয়ে মনে হয়েছে। কাল সাহেবকে ভালো লাগছিল, আজ ওকে। বড়োলোকের আদুরে মেয়ের মনমর্জিতে শৌনক মোটেই প্রভাবিত হয়নি। অথচ একবার সাহেব, একবার সাহেবের মা অকারণে ওকেই সন্দেহ করছে। যেন মনে হচ্ছে, মল্লিক-বাড়ির হবু বউমাকে ও ছিনিয়ে নিতে চলেছে। কী অদ্ভুত এরা। আর তাতে আর-একটু আগুন জ্বালাচ্ছে প্রলয়।
দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ শৌনকের ভাবনার সুতোতে একটা গিঁট ফেলে দিল। নিশ্চয়ই প্রলয় ক্ষমা চাইবে একটা বাহানা করে। বিরক্ত হয়েই শৌনক বলল, “তুমি এখন এসো প্রলয়, আমার কথা বলতে ভালো লাগছে না।”
একটা সুরেলা মহিলা কণ্ঠ দরজার বাইরে থেকেই বলে উঠল, “ডাক্তারদের এমন মুড পরিবর্তন হলে রোগীদের তো মহাবিপদ।”
গলাটা শৌনকের চেনা নয়। অস্মিতা নয়, তা হলে কে এল?