Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ইনফার্নো – ড্যান ব্রাউন

    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন এক পাতা গল্প657 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ২০. ফ্লোরেন্স – প্রাচীরঘেরা একটি শহর

    অধ্যায় ২০

    এক সময় ফ্লোরেন্স ছিলো প্রাচীরঘেরা একটি শহর, এর প্রধান প্রবেশদ্বার ছিলো পাথরে তৈরি পোর্তা রোমানা, ১৩২৬ সালে এটি নির্মাণ করা হয়। যেখানে বেশিরভাগ শহরের সীমানাপ্রাচীর শত শত বছর আগেই ধ্বংস হয়ে গেছে সেখানে পোর্তা রোমানা এখনও টিকে আছে সগৌরবে। আজকের দিনেও এ শহরে যানবাহন প্রবেশ করে বিশাল দূর্গের খিলানযুক্ত টানেলের মধ্য দিয়ে।

    প্রবেশপথটি পঞ্চাশ ফুট উঁচু, প্রাচীন ইট আর পাথরে তৈরি। এখনও এর বোল্টযুক্ত বিশাল কাঠের দরজাটি টিকে আছে। তবে সেগুলো সব সময় ভোলাই থাকে। দরজার সামনে এসে মিলিত হয়েছে ছয়টি আলাদা আলাদা সড়ক। একটা চত্বরের মাঝে এসে সড়কগুলো একত্রিত হয়েছে, চত্বরের মাঝখানে রয়েছে বিশাল একটি মূর্তি-এক নারী দরজাটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে মাথায় বড়সড় একটি বোঝা নিয়ে।

    যদিও আজকাল এখানে যানবাহনের ভীড়ে যানজট লেগে থাকে কিন্তু এক সময় এ জায়গাটি ছিলো ফিয়েরা দেই কনত্রাত্তি-দ্য কন্ট্রাক্টস ফেয়ার অর্থাৎ চুক্তির মেলা-যেখানে বাবারা নিজেদের কন্যাদেরকে ক্ষণস্থায়ী বিয়ের জন্যে বিক্রি করে দিতো-অনেকটা কন্ট্রাক্ট ম্যারেজের মতো। প্রায়শই বেশি দাম পাবার আশায় তাদেরকে বাধ্য করতে উদ্দাম নৃত্য করতে।

    আজ সকালে প্রবেশদ্বার থেকে কয়েক শ’ গজ দূরে থাকতেই সিয়েনা তার ট্রিকিটা থামিয়ে দূরে কিছু একটার দিকে ইশারা করলো। পেছনে বসা ল্যাংডন সামনে তাকিয়ে বুঝতে পারলো মেয়েটার উদ্বিগ্ন হবার কারণ কি। তাদের সামনে। দিয়ে যানবাহনের দীর্ঘ সারি চলে গেছে। সবগুলো গাড়িই থেমে আছে রাস্তার উপর। প্রবেশদ্বারের সামনে যে চত্বরটি আছে সেখানে পুলিশের ব্যারিকেড। এরইমধ্যে অনেক পুলিশ এসে জড়ো হয়েছে সেখানে, আরো গাড়ি আসছে। তাদের সাথে যোগ দিতে। সশস্ত্র অফিসাররা এক এক করে সবগুলো গাড়ির কাছে গিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করছে।

    এটা আমাদের জন্যে হতে পারে না, ভাবলো ল্যাংডন। নাকি আমাদের জন্যই?

    এক ঘর্মাক্ত সাইক্লিস্ট প্যাডেল মারতে মারতে তাদের সামনে আসতেই সিয়েনা চিৎকার করে তাকে বললো, “কস এ সাকসেসো?”

    “এ চি লো সা!” চিন্তিত মুখে চিৎকার করেই জবাব দিলো সে। “ক্যারাবিনিয়েরি,” বলেই তাদের অক্রিম করে চলে গেলো সে।

    চিন্তিত ভঙ্গিতে ল্যাংডনের দিকে তাকালো সিয়েনা। “রোডব্লক। মিলিটারি পুলিশ।”

    তাদের পেছনে বহু দূরে গর্জন করে উঠলো কতোগুলো সাইরেন। সেদিকে তাকালো সিয়েনা, সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেলো তার মুখ।

    আমরা মাঝখানে ফাঁদে পড়ে গেছি, ভাবলো ল্যাংডন। এখান থেকে বের হবার কোনো পথ আছে কিনা দেখলো-একটি সংযোগ সড়ক, পার্ক কিংবা ড্রাইভওয়ে-কিন্তু সে শুধু দেখতে পেলো তাদের বাম দিকে অসংখ্য বাসাবাড়ি আর ডান দিকে উঁচু পাথরের দেয়াল।

    সাইরেনের আওয়াজ আরো বাড়তে লাগলো।

    “ওখানে,” তাড়া দিলো ল্যাংডন, ত্রিশ গজ দূরে জনমানুষবিহীণ একটি কন্ট্রাকশন সাইটের দিকে ইঙ্গিত করলো সে। ওখানে ভ্রাম্যমান সিমেন্ট মিক্সার আছে, যার পেছনে তারা লুকাতে পারে।

    সিয়েনা আর দেরি না করে তার বাইকটা স্টার্ট করে ফুটপাতের উপর উঠে গেলো। সিমেন্ট মিক্সারের আড়ালে ট্ৰিকিটা পার্ক করতেই দ্রুত বুঝে গেলো এর পেছনে তারা লুকিয়ে থাকতে পারবে না। শুধু ট্রিকিটা রেখে দিলো।

    “আমার সাথে আসো,” বললো সিয়েনা। দৌড়ে চলে গেলো পাথরের দেয়ালের কাছে ঝোঁপঝাঁড়ের মাঝে একটি ভ্রাম্যমান টুলশেডের কাছে।

    এটা তো কোনো টুলশেড নয়, বুঝতে পারলো ল্যাংডন। কাছে যেতেই নাক কুচকে ফেললো সে। এটা একটা ভ্রাম্যমান টয়লেট-পোর্তা পোত্তি।

    কন্সট্রাকশন কাজের শ্রমিকদের ব্যবহারের জন্য যে কেমিকেল টয়লেটটা আছে তার সামনে চলে এলো সিয়েনা আর ল্যাংডন, এখান থেকে তারা শুনতে পেলো তাদের পেছনে ধেয়ে আসছে কতোগুলো পুলিশের গাড়ি। দরজার হাতল ধরে জোরে টান দিলো সিয়েনা কিন্তু সেটা খুললো না। ভারি চেইন আর লক দিয়ে দরজা লাগানো। মেয়েটার হাত ধরে তাকে টেনে টয়লেটের পেছনে নিয়ে গেলো ল্যাংডন। পাথরের দেয়াল আর টয়লেটের মাঝখানে যে সঙ্কীর্ণ জায়গাটা আছে সেখানে কোনোরকমে সেঁটে রইলো তারা। তীব্র কটু গন্ধে দম বন্ধ হবার জোগার হলো তাদের।

    ল্যাংডন মেয়েটার পেছনে লুকাতেই ক্যারাবিনিয়েরি লেখা কালো রঙের একটি সুবারু ফরেস্টার তাদের পাশ দিয়ে চলে গেলো। ইটালিয়ান মিলিটারি পুলিশ, ভাবলো ল্যাংডন। অবিশ্বাস্য। আরো ভাবলো, এইসব অফিসারদেরও কি তাদেরকে দেখামাত্র গুলি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে?

    “আমাদেরকে খুঁজে বের করার ব্যাপারে কেউ মনে হয় মরিয়া হয়ে উঠেছে, সিয়েনা ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো। “আর তারা এ কাজে সফলও হয়েছে।”

    “জিপিএস?” চিন্তা করে বললো ল্যাংডন। “হয়তো প্রজেক্টরটির মধ্যে এরকম কোনো ট্র্যাকিং ডিভাইস রয়েছে?”

    মাথা ঝাঁকালো সিয়েনা। “বিশ্বাস করো, ওটাতে কিছু থাকলে এতোক্ষণে পুলিশ আমাদের পাকড়াও করে ফেলতো।”

    নিজের বিশাল শরীরটা একটু নড়চড়া করে ঠিক করে নিলো সঙ্কীর্ণ জায়গাটায়। এবার তার চোখ গেলো পোর্তা-পোত্তির পেছনে। সেখানে চমৎকারভাবে কিছু গ্রাফিটি আঁকা আছে।

    এটা কেবল ইটালিয়ানদের পক্ষেই সম্ভব।

    বেশিরভাগ আমেরিকান পোর্তা-পোত্তির গায়ে আনাড়ি হাতে কার্টুন আঁকা থাকে, আর তাদের বিষয়বস্তু সাধারণত বিশাল বক্ষা আর পুরুষলিঙ্গ। কিন্তু এই গ্রাফিটিটি দেখে মনে হচ্ছে না কাঁচা হাতের কাজ। নির্ঘাত চারুকলার ছাত্ররা এঁকেছে এটা। অনেকটা তাদের স্কেচবুকে যেরকম অনুশীলন থাকে ঠিক সেরকম-মানুষের চোখ, সূক্ষ্মভাবে আঁকা হাত, সম্পূর্ন মানুষের অবয়ব এবং চমৎকার একটি ড্রাগন।

    “ইটালির সব জায়গায় কিন্তু এভাবে সম্পদের বিনাশ করতে দেখা যায় না,” বললো সিয়েনা, ল্যাংডনের চিন্তাটা সে ধরতে পেরেছে বলে মনে হলো। “এই দেয়ালের ওপাশেই রয়েছে ফ্লোরেন্সের আর্ট ইন্সটিটিউট।”

    যেনো সিয়েনার কথাটাকে নিশ্চিত করার জন্যেই একদল ছাত্রছাত্রিকে দেখা গেলো তাদের দিকে এগিয়ে আসতে। প্রত্যেকের হাতে আর্ট পোর্টেফোলিও। তারা কথা বলছে, হাসাহাসি করছে, সিগারেট ফুকছে। সামনে পোর্তা রোমানার কাছে রোডব্লক দেখে একটু অবাকও হলো তারা।

    এইসব ছাত্রছাত্রিরা যাতে তাদের দেখে না ফেলে সেজন্যে ল্যাংডন আর সিয়েনা একটু নীচু হয়ে গেলো। এই অবস্থায়ই একটা কৌতূহলোদ্দীপক চিন্তা ভর করলো হারভার্ডের প্রফেসরের মাথায়।

    মাটিতে পুঁতে রাখা পাপী আর মাটি থেকে তাদের বের হয়ে থাকা পা গুলো।

    হতে পারে মানুষের মলমূত্রের প্রকট গন্ধ কিংবা একটু আগে দেখা সাইক্লিস্টের নগ্ন পা তার মধ্যে এই চিন্তাটা উসকে দিতে সাহায্য করেছে হয়তো।

    হঠাৎ করে সঙ্গিনীর দিকে ফিরলো সে। “সিয়েনা, আমাদের কাছে যে লা মাপ্পা রয়েছে তাতে উল্টো করে পুঁতে রাখা পাপীরা ছিলো নরকের দশম গর্তে, তাই না? ম্যালেববাজেসের সবচাইতে নীচের স্তরে?”

    অবাক হয়ে তাকালো সিয়েনা, যেনো এরকম অবস্থায় এসব কথা বলাটা অদ্ভুতই বটে। “হ্যাঁ, একেবারে নীচের স্তরে।”

    সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যেই ল্যাংডন চলে গেলো ভিয়েনাতে দেয়া তার লেকচারের সময়টাতে। মঞ্চে দাঁড়িয়ে আছে সে, বক্তৃতা শেষ করার ঠিক আগ মূহুর্তে। একটু আগে শ্রোতাদেরকে দোরি’র এনগ্রেভিং করা ডানাবিশিষ্ট গ্রিক মিথলজির দৈত্য জিরিউন দেখিয়েছে। এই দৈত্য বাস করে নরকের সব থেকে উপরের চক্রে।

    “শয়তানের সাথে সাক্ষাত হবার আগে,” লাউডস্পিকারে বলেছিলো ল্যাংডন, “আমাদেরকে ম্যালেবোজেসের দশটি গর্ত পেরোতে হবে, যেখানে শঠ প্রতারকদের কঠিন শাস্তি দেয়া হয়।”

    ল্যাংডন স্লাইড শো’র মাধ্যমে মালেবোজেসের এক এক করে দশটি গর্ত বিস্তারিতভাবে দেখালো উপস্থিত দর্শক-শ্রোতাদেরকে। “উপর থেকে নীচে ক্রমানুসারে বলছি : প্রলুব্ধকারীরা দানবের হাতে চাবুক খাচ্ছে…তোষামোদকারীরা। মানববিষ্ঠার মধ্যে পতিত…ভণ্ড যাজকদেরকে উল্টো করে মাথা থেকে কোমর পর্যন্ত মাটিতে পুঁতে রাখা হয়েছে, তাদের পা-গুলো কেবল মাটি থেকে বের হয়ে আছে…ডাইনীবিদ্যার চর্চা করেছে যারা তাদের মাথা ঘুরিয়ে পেছন দিকে করে রাখা হয়েছে…দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকদেরকে নিক্ষেপ করা হয়েছে গরম পানির কুয়ায়…ভণ্ডরা পরে আছে ভারি আর কালো রঙের আলখেল্লা…চোরদেরকে দংশন করছে সাপ…শঠ কাউন্সেলরদেরকে আগুন গিলে খাচ্ছে …চুক্তিভঙ্গকারীদেরকে দানবেরা করাত দিয়ে দু টুকরো করে ফেলছে…আর শেষ গর্তে মিথ্যেবাদীদেরকে এমনভাবে জীবাণু আক্রান্ত করা হয়েছে যে তাদের দেখে চেনাই যায় না।” শ্রোতাদের দিকে ফিরে তাকালো ল্যাংডন। “দান্তে মিথ্যেবাদীদের জন্যে এই দশম গর্তটি বরাদ্দ করেছেন কারণ মিথ্যেবাদীদের ক্রমাগত মিথ্যে অপবাদের কারণেই তাকে তার প্রিয় জন্মভূমি ফ্লোরেন্স ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিলো।”

    “রবার্ট?” এই কণ্ঠটা সিয়েনার।

    চট করে সম্বিত ফিরে পেলো ল্যাংডন।

    সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে ভুরু কুচকে চেয়ে আছে মেয়েটি। “কি হয়েছে?”

    “আমাদের কাছে থাকা লা মাপ্পা,” উত্তেজিত কণ্ঠে বললো সে। “মানে ওই ছবিটা বদলে দেয়া হয়েছে!” পকেট থেকে ক্ষুদ্র প্রজেক্টরটি বের করে ঝাঁকাতে শুরু করলো সে। ভেতরে থাকা এজিটেটর বলটি সশব্দে নড়লেও সাইরেনের কারণে সেটা চাপা পড়ে গেলো। “এই ছবিটা যারা-ই তৈরি থাকুক না কেন তারা ম্যালেববাজেসের স্তরগুলোর ক্রম বদলে দিয়েছে!”

    প্রজেক্টরটির সম্মুখপ্রান্ত জ্বলে উঠলে ল্যাংডন তার সামনে থাকা দেয়ালের উপর প্রক্ষেপ করতেই লা মাপ্পা দেল ইনফানে ভেসে উঠলো, জায়গাটা অন্ধকারাচ্ছন্ন বলে বেশ উজ্জ্বল দেখালো ছবিটা।

    বত্তিচেল্লির ছবি টয়লেটের গায়ে, লজ্জিতভাবেই মনে মনে বলে উঠলো ল্যাংডন। এরকম খারাপ জায়গায় বত্তিচেল্লির ছবিটি কখনও প্রদর্শিত হয় নি, এ। ব্যাপারে সে একদম নিশ্চিত। দশটি গর্তের দিকে মনোযোগ দিলো ল্যাংডন। তারপর উত্তেজিত হয়ে মাথা নেড়ে সায় দিতে শুরু করলো সে।

    “হ্যাঁ!” জোরেই বললো। “এটা আসল ছবি নয়! ম্যালেববাজেসের শেষ গর্তটি হবার কথা জীবাণুতে আক্রান্ত লোকজনের জায়গা, উল্টো করে মাটিতে পুঁতে রাখা পাপীদের নয়। দশম গর্তটি মিথ্যেবাদীদের জন্যে বরাদ্দ, ভণ্ড যাজকদের জন্যে নয়!”

    সিয়েনা কৌতূহলী চোখে তাকালো। “কিন্তু…এ কাজ কেউ করতে যাবে কেন?”

    “Catrovacer,” ফিসফিসিয়ে বললো ল্যাংডন। নরকের প্রতিটি চক্রে যে অক্ষরগুলো যোগ করা হয়েছে সেগুলোর দিকে তাকালো। “আমার মনে হয় না এটা দিয়ে আসলে ঠিক এটাই বোঝানো হয়েছে।”

    মাথায় আঘাতের কারণে বিগত দু’দিনের স্মৃতি হারিয়ে ফেলা সত্ত্বেও মনে হচ্ছে এখন তার স্মৃতি বেশ ভালোভাবেই কাজ করতে শুরু করেছে আবার। চোখ বন্ধ করে লা মাপ্পা’র দুটো ভার্সন পাশাপাশি রেখে মনের চোখে দেখার চেষ্টা করলো। বোঝার চেষ্টা করলো পার্থক্যগুলো। ল্যাংডন যেমনটি আশা করেছিলো। তার চেয়ে ম্যালেববাজেসের পরিবর্তন অনেক কম করা হলেও তার কাছে মনে হলো একটা রহস্য উন্মোচন হয়ে গেছে।

    আচমকা এটা ক্রিস্টালের মতো পরিস্কার হয়ে ধরা দিয়েছে।

    খুঁজলেই পাবেন!

    “সেটা কি?” জানতে চাইলো সিয়েনা।

    ল্যাংডনেরে মুখ শুকিয়ে গেলো। আমি জানি আমি কেন ফ্লোরেন্সে এসেছি।”

    “তুমি জানো!”

    “হ্যাঁ, জানি। এও জানি আমাকে কোথায় যেতে হবে।”

    সিয়েনা তার হাতটা ধরে ফেললো। “কোথায়?!”

    ল্যাংডনের মনে হলো হাসপাতালে জ্ঞান ফিরে পাবার পর থেকে তার পা দুটো যেনো এই প্রথম শক্ত মাটি স্পর্শ করেছে। “এই দশটি অক্ষর,” চাপাস্বরে বললো সে। “আসলে পুরনো শহরের একটি নির্দিষ্ট স্থানকে নির্দেশ করছে। ওখানেই রয়েছে সব প্রশ্নের জবাব।”

    “পুরনো শহরের কোথায়?!জানতে চাইলো সিয়েনা। “তুমি কি বের করেছো?”

    পোর্তা-পোত্তির অন্যদিক থেকে হাসাহাসির শব্দ ভেসে এলো। আরেকদল হাত্রছাত্রি তাদের কাছ দিয়ে চলে যাচ্ছে বিভিন্ন ভাষায় কথা বলতে বলতে। ভ্রাম্যমান টয়লেটের পেছন থেকে সতর্কভাবে উঁকি মেরে ল্যাংডন তাদেরকে দেখলো। এরপর আশেপাশে পুলিশ আছে কিনা সেটাও দেখে নিলো। “আমাদেরকে এখান থেকে চলে যেতে হবে। যেতে যেতে আমি তোমাকে সব বলবো।”

    “যেতে যেতে বলবে??” মাথা ঝাঁকালো সিয়েনা। “আমরা কোনোভাবেই পোর্তা রোমানা পেরিয়ে যেতে পারবো না!”

    “ত্রিশ সেকেন্ডের জন্য এখানে চুপ মেরে বসে থাকো,” মেয়েটাকে বললো সে, “তারপর আমি কি করি সেটা দেখে কাজ কোরো।”

    এ কথা বলে টয়লেটের পেছন থেকে বের হয়ে গেলো ল্যাংডন, পেছনে পড়ে রইলো তার নতুন বন্ধু, বিস্মিত আর একা।

    .

    অধ্যায় ২১

    “স্কুজি!” একদল ছাত্রছাত্রিকে পেছন থেকে ডেকে বললো ল্যাংডন। “স্কুসাতে!”

    সবাই তার দিকে ফিরে তাকালো। ল্যাংডন এমন ভাব করলো যেনো পথ হারিয়ে ফেলা কোনো পর্যটক সে।

    “দোভেল ইসতিতুতো স্তাতালে দার্তে?” ভাঙা ভাঙা ইতালিতে বললো ল্যাংডন।

    ট্যাটু আঁকা এক ছেলে সিগারেটে টান মেরে জবাব দিলো, “নন পারলিয়ামো ইতালিয়ানো।” তার বাচনভঙ্গি শুনে মনে হলো সে একজন ফরাসি।

    মেয়েদের মধ্যে একজন ছেলেটাকে মৃদু ভৎর্সনা করে সামনে এসে পোর্তা রোমার দিকে আঙুল তুলে দেখালো। “পিউ আভাস্তি, সেপ্র দ্বিত্তো।”

    সোজা ঐদিকে, অনুবাদ করে নিলো ল্যাংডন। “গ্র্যাজি।”

    এমন সময় পোর্তা-পোত্তির পেছন থেকে বেরিয়ে এলো সিয়েনা। বত্রিশ বছরের দীর্ঘাঙ্গি মেয়েটি ছাত্রছাত্রিদের কাছে চলে এলে ল্যাংডন তার কাঁধে হাত রেখে হাসিমুখে বললো, “আমার বোন সিয়েনা। সে একজন আর্টের শিক্ষক।

    ট্যাটু আঁকা ছেলেটা বিড়বিড় করে বললো, “টি-আই-এল-এফ।” সঙ্গে সঙ্গে তার ছেলেবন্ধুরা হেসে ফেললো একসাথে।

    তাদেরকে আমলে নিলো না ল্যাংডন। “আমরা ফ্লোরেন্সে এসেছি বিদেশে টিচিং দেয়ার উপর একটি রিসার্চ করার জন্য। আমরা কি তোমাদের সাথে একটু হাঁটতে পারি?”

    “মা সার্তো,” হেসে বললো ইতালিয়ান মেয়েটি।

    তাদের দলটি পোর্তা রোমানার দিকে এগিয়ে যেতেই সিয়েনা তাদের সাথে আলাপ জমাতে শুরু করলো আর ল্যাংডন যতোদূর সম্ভব ছাত্রছাত্রিদের ভীড়ের মাঝখানে লুকিয়ে রাখলো নিজেকে। কিছুটা নীচু হয়ে পুলিশের দৃষ্টি থেকে আড়ালে থাকার চেষ্টা করলো সে।

    খোঁজো, তাহলেই তুমি পাবে, ভাবলো ল্যাংডন। একটু আগে দেখা দশম গর্তের ছবিটি তাকে বেশ উত্তেজিত করে ফেলেছে।

    Catrovacer। ল্যাংডন বুঝতে পারলো এই দশটি অক্ষর এ বিশ্বের সবচাইতে রহস্যময় একটি আর্টের মূল প্রতিপাদ্য, শত শত বছরের একটি পাজল যা এখনও সমাধান করা যায় নি। ১৫৬৩ সালে ফ্লোরেন্সের প্রাচীরের অভ্যন্তরে অবস্থিত বিখ্যাত পালাজ্জো ভেচ্চিও’র চল্লিশ ফুট উপরে এই দশটি অক্ষর মেসেজ আকারে লেখা হয়। দূরবীন ছাড়া এটা চোখে পড়ে না। ১৯৭০-এর দশক পর্যন্ত এটা কারো চোখে পড়ে নি। তারপর একজন জগদ্বিখ্যাত আর্ট ডায়াগনোশিয়ানের চোখে ধরা পড়ে, এরপর থেকে প্রায় কয়েক দশক ধরে তিনি এর মমার্থ উদ্ধারে ব্যস্ত আছেন। অসংখ্য তত্ত্ব থাকা সত্ত্বেও এই মেসেজটির সত্যিকারের অর্থ এখনও রহস্যাবৃতই রয়ে গেছে।

    ল্যাংডনের কাছে কোড-সিম্বল হলো নিজের একটি ক্ষেত্ৰ-অনেকটা এই অদ্ভুত আর উত্তাল সমুদ্র তীরে অবস্থিত বন্দরের মতোই নিরাপদ। শিল্পকলার ইতিহাস আর প্রাচীন সিক্রেট তার কাছে বায়োহ্যাজার্ড টিউব এবং গোলাগুলির চেয়ে অনেক বেশি বোধগম্য বিষয়।

    সামনে পোর্তা রোমানার দিকে আরো কিছু পুলিশের গাড়ি ছুটে যাচ্ছে।

    “হায় ঈশ্বর,” ট্যাটু আঁকা ছেলেটি বললো। “তারা যাকে খুঁজছে সে নিশ্চয় বিরাট কোনো ঘটনা ঘটিয়েছে।”

    তাদের দলটি আর্ট ইন্সটিটিউটের প্রবেশদ্বারের সামনে এসে গেলো, আরেক দল ছাত্রছাত্রি জড়ো হয়ে পুলিশের কর্মকাণ্ড দেখছে। ইন্সটিটিউটের সামান্য বেতনের সিকিউরিটি গার্ডটি দায়সারা গোছের মতো করে ছাত্রছাত্রিদের আইডি দেখলেও তার আসল মনোযোগ পুলিশের জটলার দিকে।

    গাড়ি ব্রেক করার প্রচণ্ড শব্দ শুনে সেদিকে তাকিয়ে দেখা গেলো কালো রঙের ভ্যানটি পোর্তা রোমানার দিকে ছুটে যাচ্ছে।

    দ্বিতীয়বার দেখার দরকার পড়লো না ল্যাংডনের। দেরি না করে সিয়েনা আর সে তাদের নতুন বন্ধুদের সাথে দ্রুত ঢুকে পড়লো ইন্সটিটিউটের ভেতরে।

    ইস্তিতুততা স্তাতালে দার্তের এন্ট্রি রোডটা অসাধারণ সুন্দর, একেবারে রাজকীয়। পথের দুপাশে দীর্ঘকায় ওক গাছের সারি চলে গেছে দূরের মূল ভবনের দিকে। বিশাল লন আর তিনটি পোর্টিকো আছে ভবনটির।

    ল্যাংডন জানে এই শহরের আরো অনেক ভবনের মতো এই ভবনটি এক সময় ফ্লোরেন্সে রাজত্ব করতে যে সম্ভ্রান্ত পরিবার তাদের অধীনে ছিলো। সেটা পনেরো থেকে ষোলো এবং সতেরো শতকের কথা।

    মেদিচি।

    শুধু এ নমাটাই ফ্লোরেন্সের একটি প্রতীক হয়ে উঠেছে। এই পরিবারের তিন-শতাব্দীর শাসনকালে মেদিচি’র রাজকীয় প্রাসাদ অকল্পনীয় সম্পদ আর ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠে। চারজন পোপ, ফ্রান্সের দু’জন রাণী এবং ইউরোপের সবচাইতে বৃহৎ অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান এদের অবদান। আধুনিক যুগের সমস্ত ব্যাংক যে একাউন্টিং পদ্ধতি ব্যবহার করে সেটা মেদিচিরাই প্রবর্তন করেছিলো-ক্রেডিট এবং ডেবিটের দ্বৈত এন্ট্রি সিস্টেম।

    অবশ্য মেদিচি’দের সবচাইতে বড় লিগ্যাসি অর্থনৈতিক শক্তি কিংবা রাজনীতি ছিলো না, সেটা ছিলো শিল্পকলা। তাদের মতো আর কোনো রাজপরিবার শিল্পকলার এতো বড় পৃষ্ঠপোষক ছিলো না। রেনেসার আবির্ভাবেও মেদিচি পরিবারের উদার সাহায্য-সহযোগীতা ছিলো। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি থেকে শুরু করে গ্যালিলিও এবং বত্তিচেল্লি পর্যন্ত অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিত্বই মেদিচি’দের বদান্যতা লাভ করেছে। বত্তিচেল্লির বিখ্যাত পেইন্টিং বার্থ অব ভেনাস লোরেঞ্জো দা মেদিচির প্রত্যক্ষ নির্দেশেই সৃষ্টি হয়েছিলো। উনি শিল্পীকে অনুরোধ করেছিলেন তার এক কাজিনের বাসরঘরের বিছানার উপর যৌন উত্তেজক আর ইন্দ্রিয়পরায়ন একটি পেইন্টিং যেনো থাকে, এটা উনার তরফ থেকে একটা উপহার হিসেবে দেয়া হবে।

    লরেঞ্জো দা মেদিচি-যিনি দানশীলতা আর উদারতার জন্য সুপরিচিত লরেঞ্জো দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট নামে নিজেও একজন উঁচুমানের চিত্রকর এবং কবি ছিলেন। বলা হয়ে থাকে উনার চোখ ছিলো অসাধারণ শৈল্পিক। ১৪৮৯ সালে লরেঞ্জো এক অল্পবয়সী ফ্লোরেস্তাইন ভাস্করের কাজ দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকে নিজের প্রাসাদে আসার আমন্ত্রণ জানান। এরপর নিজের প্রাসাদে রেখে ঐ বালক ভাস্করকে নিজে দীক্ষা দেন, পরিচয় করিয়ে দেন সেরা সেরা সব কাজ, কবিতা আর সংস্কৃতির সাথে। ধীরে ধীরে সেই বালক পরিণত হয়ে ওঠে এবং ডেভিড আর পিয়েতা নামের অসাধারণ ভাস্কর্য সৃষ্টি করে ইতিহাসের সবচাইতে বিখ্যাত ভাস্করে পরিণত হয়-যাকে আমরা সবাই চিনি মাইকেলেঞ্জেলো নামে। অনেকে মনে করে, মানবসভ্যতায় মেদিচিদের সেরা উপহার হলো এই অমর শিল্পী।

    ল্যাংডন কল্পনা করতে পারলো, মেদিচিদের শিল্পকলার প্রতি যে অনুরাগ সেটা বিবেচনায় নিলে তাদের এক সময়কার ঘোড়ার আস্তাবল হিসেবে ব্যবহৃত ভবনটিকে এখন বিশ্ববিখ্যাত আর্ট ইন্সটিটিউট হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেখে তারা নিশ্চয় যারপরনাই খুশি হতো। এ ভবনটি ঘোড়ার আস্তাবল হিসেবে বানানোর কারণ, এর খুব কাছেই ঘোড়া চালনার জন্য ফ্লোরেন্সের সবচেয়ে সুন্দর আর। মনোরম একটি ময়দান ছিলো।

    ববোলি গার্ডেন।

    বাম দিকে তাকালো ল্যাংডন, উঁচু দেয়ালের উপর দিয়ে লম্বা লম্বা বৃক্ষরাজি দেখা যাচ্ছে। ববোলি গার্ডেনের বর্ধিত অংশ এই সবুজ অঞ্চলটি এখন পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় জায়গা। ল্যাংডন একদম নিঃসন্দেহ যে, সিয়েনা আর সে যদি কোনোভাবে এই গার্ডেনে ঢুকে পড়তে পারে তাহলে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে খুব সহজেই পোর্তা রোমানা পার হয়ে যেতে পারবে। গার্ডেনটি যেমন বিশাল তেমনি লুকানোর জন্য জায়গার কোনো অভাব নেই-বনভূমি, গোলকধাঁধা, ছোটো ছোটো গুহা, জলপদ্মে পরিপূর্ণ। তারচেয়েও বড় কথা, ববোলি গার্ডেন দিয়ে সোজা চলে যাওয়া যায় মেদিচিদের পাথরের দূর্গ পালাজ্জো পিত্তিতে। এর ১৪০টি ঘর ফ্লোরেন্সে আসা পর্যটকদের কাছে আরেকটি আকর্ষণীয় স্পট।

    আমরা যদি পালাজ্জো পিত্তিতে পৌঁছাতে পারি, ভাবলো ল্যাংডন, পুরনো শহরের সেতুটা তখন হাতের নাগালে চলে আসবে।

    গার্ডেনের চারপাশ জুড়ে যে উঁচু দেয়াল আছে সেদিকে তাকিয়ে ছাত্রদেরকে জিজ্ঞেস করলো ল্যাংডন, “এই গার্ডেনে কিভাবে ঢুকতে পারবো? এই ইন্সটিটিউটটা ঘুরে দেখার আগে আমার বোনকে এটা দেখাতে চাইছি।”

    মাথা ঝাঁকালো ট্যাটুওয়ালা। “এখান থেকে গার্ডেনে যেতে পারবেন না। প্রবেশপথটা পিত্তি প্যালাসের ওখানে অবস্থিত। আপনাকে গাড়ি চালিয়ে পোর্তা রোমানা হয়ে ওখানে যেতে হবে।”

    “বাল, মুখ ফসকে বলে ফেললো সিয়েনা।

    ল্যাংডনসহ সবাই তার দিকে তাকালো।

    “আরে বাবা,” দুষ্টুমিমাখা হাসি দিয়ে সে বললো। “তোমরা আমাকে বলতে চাচ্ছো ওখানে গিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে গাঁজা-টাজা কিছু খাও না, আড্ডাবাজি করো না?”

    ছেলেমেয়েরা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে হাসিতে ফেঁটে পড়লো সবাই।

    ট্যাটু আঁকা ছেলেটিকে এবার খুব আমুদে ভঙ্গিতে দেখা গেলো। “ম্যাম, মনে হচ্ছে আপনি এখানে শিক্ষকতা করতে পারবেন।” সিয়েনার সামনে গিয়ে ভবনের একপাশে যে পার্কিংটটা আছে সেদিকে আঙুল তুলে দেখালো। “ঐ যে বাম দিকে ছাউনীটা আছে না? ওটার পেছনে পুরনো দিনের একটি প্ল্যাটফর্ম আছে। ওটার ছাদে উঠতে পারলে দেয়ালের ওপাশটায় লাফিয়ে নেমে যেতে পারবেন।”

    সিয়েনা এরইমধ্যে হাটা শুরু করে দিয়েছে। পেছনে ফিরে ল্যাংডনের দিকে চেয়ে চোখ টিপে দিলো। “ব্রাদার বব, আসো। যদিনা লাফ দেবার জন্য তোমার বয়সটা বেশি হয়ে থাকো।”

    .

    অধ্যায় ২২

    ভ্যানে বসে থাকা সাদা চুলের মহিলা তার মাথাটা বুলেটপ্রুফ জানালার কাঁচে হেলান দিয়ে রেখে দু’চোখ বন্ধ করে আছে। তার কাছে মনে হচ্ছে পায়ের নীচে থাকা পুরো দুনিয়াটা যেনো ঘুরছে। যে ড্রাগ দেয়া হয়েছে সেটা তাকে পুরোপুরি অসুস্থ করে ফেলেছে।

    আমার চিকিৎসা করানো দরকার, ভাবলো সে।

    তার পাশে বসা সশস্ত্র গার্ডকে কঠোরভাবে অর্ডার দেয়া হয়েছে : তাদের কাজ সফলভাবে শেষ হবার আগপর্যন্ত তার কোনো প্রয়োজনই আমলে নেয়া যাবে না। চারপাশে যা শুনতে পাচ্ছে তাতে পরিস্কার সে-সময় খুব সহজে আসছে না।

    ঘোর ঘোর ভাবটা এখন আরো বেড়ে যাচ্ছে, শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে তার। বমি বমি ভাবটা অনেক কষ্টে দমন করার চেষ্টা করলো। অবাক হয়ে ভাবতে লাগলো জীবন তাকে কিভাবে এই পরাবাস্তব পথে নিয়ে এসেছে। জবাবটা এই ঘোরলাগা পরিস্থিতিতে এতোটাই জটিল যে এর মমোৰ্দ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে এটা কোত্থেকে শুরু হয়েছিলো সে ব্যাপারে তার কোনো সন্দেহ নেই।

    নিউইয়র্ক।

    দু’বছর আগে।

    তাকে জেনেভা থেকে বিমানে করে ম্যানহাটনে চলে আসতে হয়েছিলো। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পরিচালক হিসেবে দীর্ঘ এক দশক কাজ করেছে সে। খুবই সম্মানজনক একটি চাকরি ছিলো সেটা। ছোঁয়াচে রোগ আর রোগ-জীবাণুর মহামারির একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এসব রোগের। হুমকি নিরূপণ করার উপর একটি লেকচার দিতে জাতিসংঘ তাকে আমন্ত্রণ জানায়। তার মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে বেশ কিছু রোগের আগাম প্রাদুর্ভাব চিহ্নিত করার সিস্টেম প্রণয়ন এবং কিছু ট্রিটমেন্ট প্লান্ট করে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাসহ অন্যান্য কিছু সংস্থা। এসব কারণে তাকে বেশ উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হয় সেখানে।

    লেকচার শেষে বিশাল হলে কিছু আগ্রহী বিশেষজ্ঞের সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলছিলো সে, এমন সময় জাতিসংঘের এক উচ্চপদস্থ কর্মকতা উপস্থিত হয়ে তাদের কথাবার্তায় বিঘ্ন ঘটায়।

    “ডা: সিনস্কি, এইমাত্র কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স আমাদের সাথে যোগাযোগ করেছে। ওখানকার একজন আপনার সাথে কথা বলতে চাইছে। এক্ষুণি। বাইরে আপনার জন্য গাড়ি অপেক্ষা করছে।”

    কিছুটা বিস্মিত হলেও ডা: এলিজাবেথ সিনস্কি অতিথিদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিজের ব্যাগটা হাতে নিয়ে নেয়। তার লিমোটা যখন ফার্স্ট এভিনু ধরে যেতে থাকে তখন কিছুটা নার্ভাস বোধ করতে শুরু করে সে।

    কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স?

    অন্য অনেকের মতো এলিজাবেথ সিনস্কিও অনেক কিছু শুনেছিলো এ ব্যাপারে।

    এই প্রাইভেট থিঙ্ক ট্যাঙ্কটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২০-এর দশকে, সংক্ষেপে সিএফআর হিসেবে পরিচিত এই সংস্থায় প্রায় প্রত্যেক আমেরিকান সেক্রেটারি অব স্টেট, আধ-ডজন প্রেসিডেন্ট, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সিআইএ প্রধান, সিনেটর, বিচারপতিসহ ধনকুবের হিসেবে পরিচিত মরগ্যান, রথচাইল্ড আর রকাফেলার কোনো না কোনো সময় সদস্য ছিলো। সদস্যদের অতুলনীয় মেধাবী মস্তিষ্ক, রাজনৈতিক ক্ষমতা আর সম্পদের প্রাচুর্যের কারণে এই কাউন্সিল বিশ্বের সবচাইতে ক্ষমতাশালী প্রাইভেট ক্লাব হিসেবে বিবেচিত হয়।

    বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পরিচালক হিসেবে এলিজাবেথকে এসব হোমরাচোমরাদের সাথে প্রায়শই কাজ করতে হয়েছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাতে তার দীর্ঘদিনের চাকরি আর একজন উচ্চকণ্ঠের মহিলা হিসেবে তার সুনাম এতোটাই ছড়িয়ে পড়েছিলো। যে, কয়েকদিন আগে নামকরা একটি ম্যাগাজিন তাকে এ বিশ্বের বিশজন প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকায় ঠাঁই দিয়েছিলো। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মুখ, তার ছবির নীচে এ কথাটা লিখে দিয়েছিলো। এলিজাবেথের কাছে এটা নির্মম পরিহাসের বিষয় বলে মনে হয়েছিলো তখন, কারণ তার পুরোটা শৈশব কেটেছে অসুখ বিসুখে।

    মাত্র ছয় বছর বয়স থেকে ভয়ঙ্কর হাপানী রোগে ভুগতে শুরু করে সে, তাকে চিকিৎসা দেয়া হয় সম্পূর্ণ নতুন উচ্চমাত্রার একটি ড্রাগের মাধ্যমে-এ বিশ্বের প্রথম স্টেরয়েড হরমোন-এই ডোজ ব্যবহার করার পর বিস্ময়কর দ্রুততায় সেরে ওঠে। তবে কপাল খারাপ, ওষুধটির সাইড অ্যাফেক্ট সম্পর্কে তখনও কোনো স্পষ্ট ধারণা ছিলো না। কয়েক বছর পর সিনস্কি যখন সাবালিকা হবার বয়সে পৌঁছায় তখন তার স্বাভাবিকভাবেই ঋতুস্রাব শুরু হওয়ার কথা কিন্তু সেটা আর হয় না। উনিশ বছর বয়সে এসে ডাক্তারের কাছ থেকে এলিজাবেথ জানতে পারে তার প্রজনন ক্ষমতা চিরকালের জন্য নষ্ট হয়ে গেছে।

    সে আর কখনও মা হতে পারবে না।

    সময় একাকীত্বকে সারিয়ে দেবে, তাকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন ডাক্তার। কিন্তু তাতে তার মনের গভীরে জমে ওঠা রাগ আর বিষাদকে এতোটুকুও প্রশমিত করতে পারে নি। নির্মম সত্য হলো, ওষুধ তার প্রজনন ক্ষমতা কেড়ে নিলেও মাতৃত্বের প্রত্যাশা তিরোহিত করতে পারে নি। যুগের পর যুগ ধরে অসম্ভবকে সম্ভব করার বাসনায় কাটিয়ে দিয়েছে সে। এমনকি এই একষট্টি বছর বয়সেও কোনো মা আর শিশুকে দেখলে তার মধ্যে সুতীব্র বেদনা জেগে ওঠে।

    “এই তো সামনেই, ডা: সিনস্কি,” লিমোর ড্রাইভার বললো তাকে।

    আয়নায় মুখ দেখে নিজের চুল আর বেশভূষা দ্রুত ঠিক করে নিলো এলিজাবেথ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই গাড়িটা থেমে গেলো। ড্রাইভার নিজে দরজা খুলে তাকে বের হতে সাহায্য করলো হাসিমুখে। জায়গাটা ম্যানহাটনের একটি সেকশন।

    “আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করবো,” বললো ড্রাইভার। “আপনি বললেই এখান থেকে সোজা এয়ারপোর্টে চলে যাবো আমরা।”

    নিউইয়র্কের পার্ক আর সিক্সটি-এইটথ এভিনুর মাঝখানে অবস্থিত কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স-এর হেডকোয়ার্টারটি একেবারেই সাদামাটা আর ননক্লাসিক্যাল একটি বিল্ডিং। এটা এক সময় এক অয়েল টাইকুনের বাড়ি ছিলো। এর বাইরের দিকটায় রয়েছে অভিজাত ল্যান্ডস্কেপ, দেখে মনে হবে না এটা আহামরি কিছু!

    “ডা: সিনস্কি,” নাদুসনুদুস রিসেপশনিস্ট মেয়েটি তাকে অভ্যর্থনা জানালো। “আমার সাথে আসুন, প্লিজ। উনি আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।”

    ঠিক আছে, কিন্তু এই উনিটা কে? রিসেপশনিস্টকে অনুসরণ করে জমকালো একটি করিডোর পেরিয়ে চলে এলো বন্ধ দরজার সামনে। রিসেপশনিস্ট মেয়েটা আস্তে করে দরজায় নক করেই এলিজাবেথকে ইশারা করলো ভেতরে ঢুকে পড়ার জন্য।

    ভেতরে ঢুকতেই তার পেছনে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেলো।

    ছোট্ট আর অন্ধকারে ঢাকা কনফারেন্স রুমটিতে শুধুমাত্র একটি ভিডিও স্ক্রিন জ্বল জ্বল করছে। সেই পদার সামনে দীর্ঘদেহী এক লোক দাঁড়িয়ে আছে মুখোমুখি। তার আবছায়া অবয়বটি শুধু দেখা যাচ্ছে। মুখটা পরিস্কার দেখা না গেলেও এলিজাবেথ লোকটার ক্ষমতা আঁচ করতে পারলো।

    “ডা: সিনস্কি,” গমগমে কণ্ঠে বলে উঠলো সেই অবয়ব। “এখানে আসার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।” লোকটির বাচনভঙ্গি শুনে এলিজাবেথের মনে হলো এ তার নিজের দেশ সুইজারল্যান্ড কিংবা জার্মানির নাগরিক হবে।

    “প্লিজ বসুন,” রুমের একটি চেয়ারের দিকে ইশারা করলো আবছায়ার অবয়বটি।

    কোনো পরিচয় পর্ব নেই? বসে পড়লো এলিজাবেথ। এ সময় ভিডিও স্ক্রিনে উদ্ভট একটা ছবি ভেসে উঠলে ভড়কে গেলো সে। এসব কী?

    “আজ সকালে আপনার প্রেজেন্টেশনে উপস্থিত ছিলাম আমি,” অবয়বটি বললো। “অনেক দূর থেকে আপনার লেকচার শোনার জন্য আমি এসেছি। আপনার পারফর্মেন্স দারুণ ছিলো।”

    “ধন্যবাদ আপনাকে,” জবাবে সে বললো।

    “আমাকে বলতেই হচ্ছে, যেমনটি কল্পনা করেছিলাম আপনি তার চেয়ে অনেক বেশি সুন্দরী. আপনার বয়স আর বিশ্বস্বাস্থ্য সম্পর্কে অদূরদর্শীতা সত্ত্বেও।”

    এলিজাবেথ হা-করে রইলো। এসব কী শুনছে! মন্তব্যটি অপমানজনক। “ক্ষমা করবেন?” অন্ধকারে চোখ কুচকে তাকিয়ে বললো সে। “আপনি কে? আর কেনই বা আমাকে এখানে ডেকে এনেছেন?”

    “হাসি-ঠাট্টা করার ব্যর্থ প্রচেষ্টার জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন, দীর্ঘদেহী অবয়বটি জবাব দিলো। “পদায় যে ছবিটা দেখতে পাচ্ছেন সেটা ব্যাখ্যা করবে কেন আপনি আজ এখানে এসেছেন।”

    ভীতিকর ছবিটার দিকে তাকালো সিনস্কি-পেইন্টিংটাতে অসংখ্য রুগ্ন মানুষ একজন আরেকজনের শরীরের উপর বেয়ে উপরে ওঠার চেষ্টা করছে। তারা সবাই নগ্ন।

    “মহান শিল্পী দোরি,” লোকটা বললো। “দান্তের নরক দর্শনের ভয়াবহ চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। আশা করি এটা দেখে আপনার কাছে স্বস্তিদায়কই মনে হচ্ছে…কারণ আমরা তো সেই গন্তব্যের দিকেই যাচ্ছি।” একটু থেমে লোকটা আস্তে করে তার দিকে তাকালো। এবার আমাকে বলতে দিন।”

    তার দিকে ধীরপদক্ষেপে এগিয়ে এলো সে। “আমি যদি এই কাগজটা মাঝখান থেকে দু’ভাগে ছিঁড়ে ফেলি…” একটা টেবিলের সামনে থামলো, হাতে তুলে নিলো একটা কাগজ। সেটাকে সশব্দে ছিঁড়ে অর্ধেক করে ফেললো। “এবার যদি আমি এই দুই টুকরোকে একে অন্যের উপর রাখি…” একটার উপর আরেকটা টুকরো রাখলো। তারপর আবারো মাঝখান থেকে ছিঁড়ে ফেলি…” আগের মতোই মাঝখান থেকে ছিঁড়ে ফেললো সে। “তাহলে চার টুকরো কাগজ পাবো। যা কিনা আসল কাগজের চেয়ে চারগুন পুরু, ঠিক বলেছি না?” অন্ধকারে তার চোখ দুটো জ্বল জ্বল করে উঠলো যেনো।

    লোকটার ভাবসাব আর আক্রমণাত্মক ব্যবহার পছন্দ হলো না। এলিজাবেথের। সে কিছুই বললো না।

    “যদি ধরে নেই,” বলতে শুরু করলো সে, “আসল কাগজটির পুরুত্ব এক মিলিমিটারের দশ ভাগের এক ভাগ, আর আমি এভাবে পঞ্চাশ বার ছিঁড়তে থাকি…তাহলে কাগজের স্তূপটি কতো পুরু হবে জানেন?”

    এলিজাবেথ নড়েচড়ে উঠলো। “জানি,” জবাব দিলো সে। তার মধ্যেও এখন রাগের বহিপ্রকাশ দেখা যাচ্ছে। “এটার পুরুত্ব হবে এক মিলিমিটারের দশ ভাগের এক ভাগ টু টু দি ফিফটিয়েথ পাওয়ার। এটাকে বলে জ্যামিতিক হার। আমি কি জানতে পারি আমি এখানে কি করতে এসেছি?”

    মুচকি হেসে মাথা নেড়ে সায় দিলো লোকটি। “হ্যাঁ, আপনি কি অনুমাণ করতে পারেন কতোটা পুরুত্ব হতে পারে? তাহলে আমাদের কাগজের স্তূপটি কতো উঁচু হবে?” একটু থেমেই আবার বললো সে, “এভাবে মাঝখান থেকে মাত্র পঞ্চাশ গুন ছিঁড়তে শুরু করলে আমাদের কাগজের স্তূপটির উচ্চতা প্রায়…সূর্যকে ছুঁয়ে ফেলবে।”

    এলিজাবেথ মোটেও অবাক হলো না। জ্যামিতিক হারের বৃদ্ধি কতোটা অবিশ্বাস্য হতে পারে সে সম্পর্কে তার ভালো ধারণাই রয়েছে। তার কাজের ক্ষেত্রেও প্রতিনিয়ত এরকম জ্যামিতিক হারের ঘটনা দেখতে হয়। সংক্রমণের চক্র…আক্রান্ত কোষের জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি…মৃত্যু-হারের আনুমাণিক ধারণা। “ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, আপনার কথাবার্তা আমি বুঝতে পারছি না।”

    “আমর কথা?” নিঃশব্দে হাসলো সে। “আমার কথা হলো, এ পৃথিবীর জনসংখ্যা এই জ্যামিতিক হারের চেয়েও বেশি দ্রুত গতিতে বাড়ছে। কাগজের পুরুত্বের মতোই শুরুতে পৃথিবীর জনসংখ্যা একদম মামুলি ছিলো…কিন্তু এটার বৃদ্ধি খুবই উদ্বেগজনক।”

    আবারো পায়চারি করতে শুরু করলো সে। “এ কথাটা একটু বিবেচনা করুন। মানুষের আর্বিভাবের পর থেকে আধুনিককালের ১৮শতক পর্যন্ত পৃথিবীর জনসংখ্যা এক বিলিয়ন হতে সময় নিয়েছে কয়েক হাজার বছর। তারপর চমকে যাবার মতো ব্যাপার হলো, এটা দ্বিগুন হয়ে দুই বিলিয়নে পৌঁছাতে সময় নেয় মাত্র একশ’ বছর। সেটা ১৯২০’র দশকের কথা। এরপর মাত্র পঞ্চাশ বছরে সেই সংখ্যাটা দ্বিগুন হয়ে চার বিলিয়ন হয়ে যায় ১৯৭০’র দশকে। আপনি নিশ্চয় জানেন, খুব জলদিই এই সংখ্যাটা আট বিলিয়ন হয়ে যাবে। শুধু আজকের দিনটার কথা ধরলেও এ পৃথিবীতে আরো আড়াই লাখ নতুন মানবসন্তান যোগ হয়েছে। আড়াই লাখ। আর এটা ঘটছে প্রতিদিন-রোদ হোক বৃষ্টি হোক, কোনো থামাথামি নেই। বর্তমানে আমরা প্রতি বছর সমগ্র জার্মানির লোকসংখ্যার সমান জনসংখ্যা যোগ করছি পৃথিবীতে।”

    লম্বামতো লোকটি থেমে এলিজাবেথের দিকে ঝুঁকলো। “আপনার বয়স কতো?”

    আরেকটি আপত্তিকর প্রশ্ন। অবশ্য বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান হিসেবে এলিজাবেথ এরকম পরিস্থিতির সাথে অভ্যস্ত, সব সময় ডিপ্লোমেসির সাহায্যে এটা তাকে মোকাবেলা করতে হয়। “একষট্টি।”

    “আপনি কি জানেন, আপনি যদি আরো ঊনিশ বছর বেঁচে থাকেন তাহলে আশি বছর বয়সে এক জীবনে পৃথিবীর জনসংখ্যা তিনগুন হতে দেখবেন-এক জীবনে তিন গুন! ব্যাপারটা একবার ভাবুন। আপনার বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাই অনুমাণ করছে এই শতকের মাঝামাঝি সময়ে পৃথিবীর জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে নয় বিলিয়নে। বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীকূল বিলুপ্ত হতে শুরু করবে দ্রুত গতিতে। প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক সম্পদের চাহিদা বেড়ে যাবে অকল্পনীয় হারে। খাওয়ার পানি হয়ে পড়বে দুপ্রাপ্য। সহ্য করার সীমা ছাড়িয়ে যাবে আমাদের মানবপ্রজাতির সংখ্যা। আর এই বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা-যারা নিজেদেরকে মনে করে এই গ্রহের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়ে একমাত্র অভিভাবক-তারা টাকা-পয়সা খরচ করছে ডায়াবেটিস রোগ থেকে মুক্তি, ব্লাড ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা, ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য।” একটু থেমে সরাসরি এলিজাবেথের দিকে তাকালো সে। “তাই আপনাকে ডেকে এনে আমি সরাসরি একটা প্রশ্ন করতে চাচ্ছি, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা কেন এতোবড় একটি সমস্যাকে প্রাধান্য দিচ্ছে না?”

    এলিজাবেথ রেগেই গেলো। “আপনি যে-ই হোন না কেন ভালো করেই জানেন বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা জনসংখ্যা বৃদ্ধির ইসুটাকে বেশ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছি আফ্রিকা মহাদেশে ডাক্তার পাঠিয়ে বিনামূল্যে কনডম দিতে এবং ওখানকার লোকজনকে জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে শিক্ষা দেবার জন্য।”

    “আহ, ঠিক বলেছেন?” তেঁতে উঠলো লোকটা। “আপনারা যতো ডাক্তার ওখানে পাঠিয়েছেন তার চেয়ে বড় ক্যাথলিক মিশনারীদের দল আফ্রিকায় গিয়ে কনডম ব্যবহারের বিরুদ্ধে মাঠে নেমে পড়েছে। তারা লোকজনকে বলে বেড়ায় এই কনডম জিনিসটা ব্যবহার করলে সোজা নরকে যেতে হবে। এখন তো আফ্রিকায় নতুন একটি পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দিয়েছে-অব্যবহৃত কনডমে সয়লাব মাঠঘাট।”

    মুখ বন্ধ রাখতে বেশ বেগ পেলো এলিজাবেথ। লোকটা অবশ্য ঠিকই বলেছে। তবে এটাও ঠিক, আধুনিক ক্যাথলিকরা ভ্যাটিকানের এই গোড়ামীর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে শুরু করেছে। এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে বিল গেটসের স্ত্রী মেলিন্ডা গেটসের কথা। একজন ধর্মপ্রাণ ক্যাথলিক হয়েও তিনি। সাহসের সাথে ভ্যাটিকানের ক্রোধের মুখে পড়ার ঝুঁকি নিয়ে ৫৬০ মিলিয়ন ডলার দান করেছেন সারা বিশ্বে জন্মনিয়ন্ত্রণ কর্মকাণ্ড বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে। এলিজাবেথ। সিনস্কি অনেকবারই প্রকাশ্যে বলেছে, বিল আর মেলিন্ডা যা করেছে তার জন্যে তাদের দু’জনকে সেন্ট উপাধি দেয়া উচিত। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, এ কাজটা করে একটিমাত্র প্রতিষ্ঠান-ভ্যাটিকান-আর সেই প্রতিষ্ঠান তাদের অবদান যেনো চোখেই দেখছে না।

    “ডা: সিনস্কি,” অবয়বটি বললো। “এ পৃথিবীতে যে একটামাত্র বৈশ্বিক-ইসু রয়েছে এটা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা।” পর্দায় ভেসে ওঠা অপ্রীতিকর ছবিটার দিকে আবারো ইঙ্গিত করলো সে-নগ্ন মানব সন্তানদের স্তূপ। “আর এটাই হলো সেটা। আমি জানি আপনি একজন বিজ্ঞানী, ক্লাসিক অথবা ফাইন আর্টসের ছাত্রি ছিলেন না, তাই আপনাকে আমি আরেকটি ছবি দেখাচ্ছি যাতে করে খুব সহজেই পুরো বিষয়টা বুঝতে পারেন।”

    ঘরটা কয়েক মুহূর্তের জন্য অন্ধকারে ঢেকে গেলো, পদায় ভেসে উঠলো নতুন একটি ছবি।

    এই ছবিটি এলিজাবেথ অনেকবার দেখেছে…ছবিটা দেখামাত্রই এক ধরণের ভীতিকর অসহায়ত্ব বোধ তৈরি হয়।

    ঘরে নেমে এলো পিনপতন নীরবতা।

    “হ্যাঁ,” অবশেষে বললো লোকটি। “এই গ্রাফটা দেখলেই এক ধরণের নিঃশব্দ ভীতি জেগে ওঠে মনে। যেনো সামনের দিকে ধেয়ে আসা কোনো গাড়ির হেডলাইটের দিকে চেয়ে আছি।” আস্তে করে এলিজাবেথের দিকে তাকিয়ে নীরব হাসি দিলো সে। “কোনো প্রশ্ন আছে আপনার, ডা: সিনকি?”

    “একটাই প্রশ্ন আমার,” চট করে বললো সে। “আপনি কি আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন লেকচার দিতে নাকি অপমান করতে?”

    “এর কোনোটাই না।” তার কণ্ঠ অদ্ভুতভাবেই আন্তরিক শোনালো। “আমি আপনাকে এখানে নিয়ে এসেছি আপনার সাথে কাজ করার জন্য। আমার কোনো সন্দেহ নেই, এই অতিরিক্ত জনসংখ্যার বোঝা যে একটি হেলথ-ইসু সেটা আপনি জানেন। কিন্তু আমার ভয় আপনি বুঝতে পারছেন না এটা একজন মানুষের আত্মাকেও বিনষ্ট করে দেবে। বাড়তি জনসংখ্যার চাপে পড়ে যারা কোনো দিন চুরি করে নি তারাও নিজের পরিবারের জন্য হয়ে উঠবে চোর। যারা কোনোদিন খুন-খারাবির কথা কল্পনাও করে নি তারা সন্তানসন্তদিদের জন্য সেই কাজটাই করবে। দান্তের সবগুলো মহাপাপ-লোভ, পেটুক অতিভোজ, বিশ্বাসঘাতকতা এবং বাকি যেসব পাপ আছে-ক্রমাগত হারে বাড়তে থাকবে…বাড়তে বাড়তে মানবিকতাকে ডুবিয়ে দেবে। মানুষের আত্মা বাঁচাতে লড়াই করতে হবে আমাদেরকে।”

    “আমি একজন বায়োলজিস্ট। আত্মা নয়…আমি জীবন বাঁচাই।”

    “আমি আপনাকে আশ্বস্ত করে বলতে পারি সামনের দিনগুলোতে জীবন বাঁচানোটা ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠবে। অতিরিক্ত জনসংখ্যা অনেক বেশি আধ্যাত্মিক অতৃপ্ততার জন্ম দেবে। ম্যাকিয়াভেলির একটি উক্তি আছে।”

    “হ্যাঁ,” তার কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বললো এলিজাবেথ। উক্তিটা তার মনে পড়ে গেছে। “ যখন এ বিশ্বের সব জায়গা এমনভাবে মানুষে পরিপূর্ণ হয়ে যাবে যে তারা বুঝে উঠতে পারবে না কোথায় তারা আছে অথবা অন্য কোথাও যেতে পারবে না…তখন এ পৃথিবী নিজেই নিজেকে শুদ্ধ করে নেবে। “ লোকটার দিকে তাকালো সে। “বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থায় আমরা যারা কাজ করি তারা সবাই এই উক্তিটার সাথে পরিচিত।”

    “ভালো, তাহলে তো আপনি এও জানেন, ম্যাকিয়াভেলি বলেছিলেন প্লেগ। হলো এ বিশ্বের শুদ্ধি করার প্রাকৃতিক নিয়ম।”

    “হ্যাঁ, জানি। আমি আমার লেকচারেও বলেছি, আমরা সবাই সচেতন আছি জনসংখ্যার বৃদ্ধির সাথে বৃহৎ পরিসরে ছড়িয়ে পড়া মহামারির সরাসরি সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু আমরা বিরামহীনভাবেই নতুন নতুন ডিটেকশন এবং ট্রিটমেন্ট মেথড প্রণয়ন করার কাজ করে যাচ্ছি। ভবিষ্যতের মহামারি থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করার ব্যাপারে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী।”

    “আপনাদের জন্য আমার করুণাই হচ্ছে।”

    অবিশ্বাসে চেয়ে রইলো এলিজাবেথ। “আপনি কি বললেন, বুঝলাম না?”

    “ডা: সিনস্কি,” অদ্ভুতভাবে হাসি দিয়ে লোকটা বললো, “আপনি এমনভাবে মহামারিকে নিয়ন্ত্রণ করার বলছেন যেনো ওটা কোনো ভালো জিনিস।”

    অবিশ্বাস নিয়েই লোকটার কথা অনুধাবন করে গেলো সে।

    “এখানে আমি বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার প্রধানের সাথে দাঁড়িয়ে আছি-” লোকটা এমনভাবে কথা বললো যেনো সে কোনো আইনজীবি। আদালতে মামলা লড়ছে। “তার সংস্থা দারুণ একটি প্রস্তাব দিয়েছে। এটাকে মনে করতে পারেন। খুবই ভীতিকর একটি চিন্তা। আমি আপনাকে আসন্ন দুর্দশার উপর একটি ছবি দেখাবো এখন।” পদায় আরেকটি ছবি ভেসে উঠলো। অসংখ্য লাশের ছবি। “আমি আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছি অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়ে যাওয়া জনসংখ্যার চমৎকার শক্তি রয়েছে।” কাগজের ছোটোখাটো স্তূপটার দিকে ইঙ্গিত করলো না সে। “আমি আপনাকে আধ্যাত্মিক বিপর্যয়ের ব্যাপারে সম্যক ধারণা দিয়েছি।” এবার সরাসরি এলিজাবেথের দিকে মুখ করে দাঁড়ালো লোকটি। আর আপনি কি প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন? আফ্রিকায় বিনামূল্যে কনডম দেয়া।” নাক সিটকালো সে। “এটা অনেকটা ধেয়ে আসা গ্রহাণুপুঞ্জের দিকে মশা-মাছি মারার ব্যাটন তাক করে রাখার মতো ব্যাপার। টাইমবোমাটা কিন্তু আর টিক টিক করছে না। ওটা এরইমধ্যে বিস্ফোরিত হয়ে গেছে। কঠিন কোনো পদক্ষেপ না নিলে এক্সপোনেনশিয়াল ম্যাথমেটিক্স হয়ে উঠবে আপনাদের নতুন ঈশ্বর…আর ‘সে’ খুবই প্রতিহিংসাপরায়ণ ঈশ্বর। আপনাদের কাছে সে দান্তের নরককে নিয়ে আসবে এই পার্ক এভিনুতে…গাদাগাদি করে থাকা মানবসন্তানের দল নিজেদের মলমূত্রে হুড়োহুড়ি করবে। প্রকৃতি নিজে বিশ্বময় বিনাশের সুর বাজাতে শুরু করবে।”

    “তাই নাকি?” রেগেমেগে বললো এলিজাবেথ। “তাহলে আমাকে বলুন সুন্দর, নিরাপদ আর স্থায়ী ভবিষ্যতের জন্য এ পৃথিবীতে কি পরিমাণ মানুষ থাকা বাঞ্ছনীয়? ঐ ম্যাজিক নাম্বারটি বলুন, যার ফলে মানবজাতি ভালোমতো টিকে থাকতে পারবে এই গ্রহে…অপেক্ষাকৃত আরাম-আয়েশে?”

    দীর্ঘদেহী লোকটি হেসে ফেললো। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে প্রশ্ন শুনে খুশি হয়েছে সে। “যেকোনো এনভাইরোনমেন্টাল বায়োলজিস্ট অথবা পরিসংখ্যানবিদ আপনাকে বলে দিতে পারবে এ পৃথিবীতে মানবজাতিকে ভালোমতো দীর্ঘদিন পর্যন্ত টিকে থাকতে হলে এর জনসংখ্যা চার বিলিয়নের মধ্যে রাখতে হবে।”

    “চার বিলিয়ন?” রেগেমেগে বললো এলিজাবেথ। “আমরা এ মুহূর্তে সাত বিলিয়ন আছি, সুতরাং একটু বেশিই দেরি হয়ে গেছে।”

    লম্বামতোন লোকটির সবুজ চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠলো। “তাই নাকি?”

    .

    অধ্যায় ২৩

    রবার্ট ল্যাংডন দেয়ালের উপর থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়লো ববোলি গার্ডেনের বৃক্ষশোভিত দক্ষিণ সীমানার ভেতরে স্পঞ্জের মতো নরম ঘাসের মাটিতে। সিয়েনা আগে লাফ দিয়ে নেমে গেছে, এখন দাঁড়িয়ে আছে সে, শরীর থেকে ময়লা ঝেড়ে আশেপাশে তাকিয়ে দেখছে।

    ছোটোখাটো একটি বনবাদারের শেষপ্রান্তে ফার্ন আর ঘাসের আধিক্য। বড় বড় গাছের কারণে এখান থেকে পালাজ্জো পিত্তি দেখা যায় না। ল্যাংডন আঁচ করতে পারলো, তারা প্রাসাদ থেকে খুব বেশি দূরে নয়। আশেপাশে কোনো শ্রমিক কিংবা পর্যটকও চোখে পড়ছে না।

    পাথরে বিছানো পথটা দেখলো ল্যাংডন, সেটা চলে গেছে সামনের গভীর অরণ্যের দিকে। পথটা যেখানে গিয়ে হারিয়ে গেছে সেখানে রয়েছে একটি মার্বেলের মূর্তি। এটা চোখে না পড়ে যায়-ই না। অবাক হলো না সে। ববোলি। গার্ডেন যেসব বিখ্যাত প্রতিভাবানের নক্সা ধারণ করে আছে তাদের মধ্যে রয়েছে নিক্কোলো ত্রিবোলো, গিওর্গিও ভাসারি আর বানারদো বুয়োনতালেন্তি-এইসব উন্নত মস্তিষ্ক ১১১ একরের সবুজ ক্যানভাসের প্রান্তরে তাদের নান্দনিকতার বহিপ্রকাশ ঘটিয়েছেন।

    “আমরা যদি উত্তর দিকে যাই তাহলে প্রাসাদে পৌঁছে যাবো,” ল্যাংডন পাথরের পথটি দেখিয়ে বললো। “ওখানে আমরা পর্যটকদের সাথে মিশে যেতে পারবো, কারো চোখে না পড়েই বের হয়ে যেতে পারবো অনায়াসে। আমার ধারণা ওটা খোলে নয়টা বাজে।”

    মিকি মাউস হাতঘড়ির দিকে তাকালো সে কিন্তু ঘড়িটা ওখানে নেই। ওটা কি হাসপাতালেই আছে, তার অন্যান্য কাপড়চোপড়ের সাথে? আর কখনও ফিরে পাবে ওটা? ভাবতে লাগলো ল্যাংডন।

    হাত-পা ঝাড়া দিয়ে দৃঢ়ভাবে দাঁড়ালো সিয়েনা। “রবার্ট, কোথাও রওনা দেবার আগে আমি জানতে চাইবো আমরা আসলে কোথায় যাচ্ছি। তখন তুমি। কিছু একটা বের করতে পেরেছিলে, সেটা কি? ম্যালেবোজেসের কথা বলছি। তুমি বললে ওটা নাকি সঠিক ক্রমানুসারে ছিলো না?”

    ঘনবন আচ্ছাদিত জায়গাটা দেখিয়ে ল্যাংডন বললো, “আগে এখান থেকে চলো অন্য কোথাও যাই।” পাথরের পথটি দিয়ে এগিয়ে যেতে শুরু করলো তারা। একটু সামনে গিয়ে বিরাট একটা চত্বরের মতো জায়গায় চলে গেছে সেটা-প্রকৃতির মধ্যে একটি ‘রুম’-ওখানে কিছু কৃত্রিম কাঠের বেঞ্চ আর ছোট্ট একটি ফোয়ারা রয়েছে। গাছপালার নীচে বাতাস অনেকটাই ঠাণ্ডা।

    পকেট থেকে প্রজেক্টরটি বের করে ঝাঁকাতে লাগলো ল্যাংডন। “সিয়েনা, এই ডিজিটাল ইমেজটি যে-ই বানিয়ে থাকুক সে কেবল ম্যালেবোজেসের পাপীদের গায়ে অক্ষরগুলোই যোগ করে নি, পাপের ধারাক্রমও বদলে দিয়েছে।” উঠে দাঁড়িয়ে সিয়েনার দিকে ঝুঁকে পায়ের কাছে প্রজেক্টরের আলো ফেললো সে। বত্তিচেল্লির মাপ্পা দেল ইনফার্নো সিয়েনার পাশে সমতল বেঞ্চের উপর ভেসে উঠলো।

    ফানেল সদৃশ্য নরকের একেবারে নীচের দিকে ইঙ্গিত করলো ল্যাংডন। ‘ম্যালেববাজেসের দশটি গর্তের অক্ষরগুলো দেখেছো?”

    সিয়েনা অক্ষরগুলো পড়তে শুরু করলো : “Catrovacer।”

    “ঠিক। একেবারেই অর্থহীন একটি শব্দ।”

    “এরপরই তুমি বুঝতে পারলে দশটি গর্তকে ওলট-পালট করে বদলে দেয়া হয়েছে?”

    “বলতে পারো তারচেয়েও সহজ। স্তরগুলোকে যদি তুমি এক একটি তাসের সাথে তুলনা করো তাহলে সবগুলো তাস ওলপ-পালট করা হয় নি। কেবল একটা তাস নীচ থেকে টেনে উপরে এনে রাখা হয়েছে। তাতেই স্তরগুলোর সিরিয়াল বদলে গেছে।” ম্যালেবোজেসের দশটি গর্ত দেখালো ল্যাংডন। “দান্তের ইনফার্নো’তে সবার উপরের স্তরে প্রলুব্ধকারীদের রাখা হয়েছে। যাদেরকে দানবেরা চাবুক পেটা করছে। কিন্তু এই ছবিতে দেখা যাচ্ছে প্রলুব্ধকারীরা…সপ্তম গর্তে রয়েছে।”

    বেঞ্চের উপর প্রক্ষেপিত ইমেজটা ভালো করে দেখে মাথা নেড়ে সায় দিলো সিয়েনা। “হুম, দেখতে পাচ্ছি। প্রথম গর্তটা এখানে সপ্তম গর্ত হয়ে গেছে।”

    পকেটে প্রজেক্টরটা ভরে আবারো পাথরের পথের উপর দাঁড়ালো ল্যাংডন। হাতে একটা শুকনো গাছের ডাল তুলে নিয়ে পথের ময়লার উপর অক্ষরগুলো আঁকতে শুরু করলো। “এই যে অক্ষরগুলো…মোডিফাই করা নরকে যেভাবে লেখা আছে।”

    C
    A
    T
    R
    O
    V
    A
    C
    E
    R

    “Catrovacer,” বললো সিয়েনা।

    “হ্যাঁ। আর এখানেই একটা স্তর কেটে বদলে দেয়া হয়েছে।” সপ্তম অক্ষরের নীচে দাগ দিয়ে সিয়েনা যেনো দেখতে পায় সেজন্যে অপেক্ষা করলো ল্যাংডন।

    “ঠিক আছে,” চট করে বললো মেয়েটি। “Catrova – Cer।”

    C
    A
    T
    R
    O
    V
    A
    —
    C
    E
    R

    “হ্যাঁ, আর এখন কার্ডগুলো যেভাবে আছে সেভাবে রেখে যদি উল্টিয়ে দেই…তাহলে Catrova-Cer শব্দটার দুটো অংশ একে অন্যের জায়গায় চলে যাবে।”

    অক্ষরগুলোর দিকে তাকালো সিয়েনা। “Cer। Catrova।” কাঁধ তুললো সে। তাকে দেখে মনে হলো না সন্তুষ্ট হতে পেরেছে। “এখনও অর্থহীন বলেই মনে হচ্ছে।”

    “Cer catrova,” ল্যাংডন আবারো উচ্চারণ করলো। একটু থেমে শব্দটা এবার একসাথে মিলিয়ে উচ্চারণ করলো সে। “Cercatrova।” অবশেষে মাঝখানে বিরতি দিয়ে উচ্চারণ করলো। “Cerca … trova।”

    সিয়েনার কাছে এবার বোধগম্য হলো, বড়বড় চোখ করে ল্যাংডনের দিকে তাকালো সে।

    “হ্যাঁ,” হেসে বললো সিম্বলজিস্ট। “Cerca … trova।”

    এই দুটো ইতালিয়ান শব্দ Cerca আর trova-এর আক্ষরিক অর্থ হলো ‘খোঁজো এবং পাবে। শব্দ দুটো একত্রে মিলে যে পদবাচ্য তৈরি করে-cerca trova-সেটা বাইবেলে বিবৃত উপদেশ খুঁজলেই পাবে’র সমার্থক হয়ে যায়।”

    “তোমার হেলুসিনেশান?” সিয়েনার দম বন্ধ হবার জোগার হলো। বিস্ময়ে চেয়ে রইলো সে। “ঘোমটা দেয়া ঐ মহিলা! সে তোমাকে বার বার বলে, খোজো, তাহলেই পাবে!” লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো মেয়েটি। “রবার্ট, তুমি কি বুঝতে পারছো এর মানে কি? এর মানে cerca trova শব্দটি ইতিমধ্যেই তোমার অবচেতন মনে ছিলো! তুমি কি বুঝতে পারছো না? তুমি হাসপাতালে আসার আগেই এই পদবাচ্যটির মর্মোদ্ধার করেছিলে! হয়তো এই প্রজেক্টরের ইমেজটি তুমি এর আগেই দেখেছো…কিন্তু ভুলে গেছিলে!”

    বুঝতে পারলো ল্যাংডন। এটার মর্মোদ্ধার করা নিয়ে এতোটাই মগ্ন ছিলো যে তার মনেই আসে নি এরইমধ্যে এটার অর্থ সে বের করে ফেলেছে।

    “রবার্ট, তুমি একটু আগে বলেছিলে লা মাপ্পা পুরনো শহরের একটি নির্দিষ্ট জায়গাকে নির্দেশ করে। কিন্তু আমি এখনও বুঝতে পারছি না সেটা কোথায়।”

    “Cerca trova শব্দটি তোমার মাথায় কিছু উসকে দিচ্ছে না?”

    কাঁধ তুললো সিয়েনা।

    চওড়া হাসি দিলো ল্যাংডন। অন্তত কিছু কিছু জিনিস সিয়েনা জানে না তাহলে! “এই পদবাচ্যটি একদম নির্দিষ্ট করে পালাজ্জো ভেচ্চিও’র একটি বিখ্যাত মুরালকেই নির্দেশ করে-হল অব দি ফাইভ হাড্রেডে রাখা গিওর্গিও ভাসারির বাত্তাগলিয়া দি মার্সিয়াননা। পেইন্টিংটির একটু উপরে, প্রায় চোখই পড়ে না

    এমনভাবে cerca trova শব্দটি ছোটো ছোটো অক্ষরে লিখে রেখেছেন শিল্পী। তিনি কেন এটা করেছেন সে নিয়ে অনেকগুলো মতবাদ প্রচলিত রয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত অকাট্য কোনো প্রমাণ হাজির করা যায় নি।”

    আচমকা শব্দ করতে করতে তাদের মাথার উপর ছোট্ট একটি এয়ারক্রাফট এসে পড়লো। চারপাশে বড় বড় গাছের কারণে কোত্থেকে এটার উদয় হলো সেটা বুঝতে পারলো না তারা। এয়ারক্রাফটি তাদের উপর দিয়ে চলে যাওয়ার সময় ল্যাংডন আর সিয়েনা বরফের মতো জমে রইলো।

    এয়ারক্রাফটি চলে যাওয়ার সময় গাছের ফাঁক ফোকর দিয়ে তাকিয়ে দেখলো ল্যাংডন। “খেলনার হেলিকপ্টার,” হাফ ছেড়ে বললো সে। তিন ফুট দৈর্ঘ হবে খেলনাটার, রেডিও-কন্ট্রোলড, শব্দ শুনে মনে হবে বিশাল আকারের মশা উড়ছে যেনো।

    সিয়েনাকে দেখে মনে হচ্ছে সে এখনও উদ্বিগ্ন। “নীচু হয়ে থাকো।”

    অবশ্যই, ছোট্ট কপ্টারটি আবার ফিরে আসছে তাদের দিকে। গাছগাছালির উপর দিয়ে চলে গেলো সেটা।

    “এটা কোনো খেলনার কপ্টার নয়,” ফিসফিসিয়ে বললো সে। “এটা নজরদারি কাজে ব্যবহৃত একটি ড্রোন। সম্ভবত এটাতে ভিডিও ক্যামেরা আছে, লাইভ ফুটেজ পাঠাচ্ছে…কারোর কাছে।”

    ল্যাংডনের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। কপ্টারটি যে-দিকে চলে গেলো সেদিকে তাকিয়ে রইলো সে। পোর্তা রোমানায় অবস্থিত আর্ট ইন্সটিটিউটের দিক থেকে এসে আবার ওখানেই চলে গেছে।

    “আমি জানি না তুমি কি করেছো,” বললো সিয়েনা, “তবে ক্ষমতাশালী কিছু লোক তোমাকে খুঁজে পাবার জন্য ভীষণ মরিয়া হয়ে উঠেছে।”

    হেলিকপ্টারটি আবারো উদয় হলো, এবার স্থির হলো যে দেয়ালের উপর থেকে তারা লাফ দিয়েছিলো ঠিক সেখানে।

    “আর্ট ইন্সটিটিউটের কেউ হয়তো আমাদের কথা বলে দিয়েছে, সিয়েনা বললো। পাথরের পথ দিয়ে দ্রুত নামতে শুরু করলো সে। “এখান থেকে আমাদেরকে এক্ষুণি বের হতে হবে।”

    ড্রোনটা গার্ডেনের অন্যপ্রান্তে ছুটে গেলে ল্যাংডন পাথরের পথের উপর আঁকা অক্ষরগুলো পা দিয়ে মুছে ফেললো দ্রুত, তারপর দৌড়ে চলে গেলো সিয়েনার পিছু পিছু। কিন্তু তার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো cerca trova, গিওর্গিও ভাসারির মুরাল আর সিয়েনার বলা কথাগুলে-ল্যাংডন অবশ্যই প্রজেক্টরের মেসেজটার মর্মোদ্ধার এর আগেই করেছে। খোঁজো, তাহলেই পাবে।

    তারা আরেকটি খোলা জায়গায় এসে পড়তেই হঠাৎ করে ল্যাংডনের মনে একটা চিন্তার উদয় হলো। থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। তার চোখেমুখে গভীর চিন্তায় ডুবে থাকার অভিব্যক্তি।

    সিয়েনাও তাকে দেখে থমকে দাঁড়ালো। “রবার্ট? কি হয়েছে?!”

    “আমি নিদোষ,” বললো সে।

    “তুমি কী বলছো?”

    “যারা আমার পেছনে লেগেছে…মনে হচ্ছে আমি সাংঘাতিক কিছু একটা করে ফেলেছি।”

    “হ্যাঁ, হাসপাতালে আসার পর তুমি বার বার বলছিলে ‘ভেরি সরি।”

    “জানি। কিন্তু আমি ভেবেছিলাম সেটা ইংরেজিতে বলেছি।”

    অবাক হয়ে তাকালো সিয়েনা। “তুমি ইংরেজিতেই বলছিলে!”

    ল্যাংডনের দু’চোখ উত্তেজনায় ভরে উঠলো। “সিয়েনা আমি যে বার বার ‘ভেরি সরি’ বলছিলাম সেটা ক্ষমা চাওয়ার জন্যে নয়। আমি আসলে পালাজ্জো ভেচ্চিও’তে রাখা ম্যুরালের সেই সিক্রেট মেসেজটার কথা বলছিলাম?” তার কানে বেজে উঠলো হাপাতালের ডাক্তারের রেকর্ডিং করা কথাগুলো। তখন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলো সে। ভে…সরি। ভে…সরি।

    সিয়েনা হতভম্ব হয়ে চেয়ে আছে।

    “তুমি বুঝতে পারছো না?!” এবার ল্যাংডনের মুখে হাসি দেখা দিলো। “আমি আসলে ‘ভেরি সরি, ভেরি সরি’ বলার চেষ্টা করছিলাম না। আমি বলতে। চাচ্ছিলাম সেই আর্টিস্টের নাম-ভা…সারি, ভাসারি!”

    .

    অধ্যায় ২৪

    সজোরে ব্রেক করলো ভায়েন্থা।

    তারপরও মোটরসাইকেলটি কিছুটা সামনে এগিয়ে গেলে ভিয়ালে দেল পোগ্নিও ইম্পেরিয়ালের রাস্তায় টায়ারের দাগ পড়ে গেলো। বাইকটা ঝাঁকি খেয়ে থামলো যানবাহনের সুদীর্ঘ সারির পেছনে এসে। ভিয়ালে দেল পোগ্নিও ইম্পেরিয়ালে যেনো ছবির মতো নিশ্চল হয়ে আছে।

    জ্যামে বসে থাকার সময় আমার হাতে নেই!

    ঘাড় উঁচু করে ভায়েন্থা সামনের যানবাহনের সারি পেরিয়ে দেখার চেষ্টা করলো কেন গাড়িগুলোকে থামিয়ে রাখা হয়েছে। এসআরএস টিমকে এড়াতে গিয়ে বেশ কিছুটা ঘুরপথে বাইক চালিয়ে এসেছে সে। এখন তাকে যেতে হবে। পুরনো শহরে। ওখানে গিয়ে হোটেল রুমটা ক্লিয়ার করা দরকার। এই মিশনে নামার পর থেকে কয়েকটা দিন সে ঐ হোটেলেই থেকেছে।

    আমাকে অস্বীকার করা হয়েছে-আমাকে এই শহর থেকে দ্রুত বের হয়ে যেতে হবে!

    মনে হচ্ছে তার মন্দভাগ্যের রেশ এখনও কাটে নি। পুরনো শহরে যাবার জন্য যে রুটটা সে বেছে নিয়েছে সেখানে এখন রোডব্লক বসানো হয়েছে। সামনের দিকে ছয়টি রাস্তা চলে গেছে একটি গেটের দিকে-এটা হলো পোর্তা রোমা-ফ্লোরেন্সের সবচাইতে ব্যস্ততম একটি মোড়-পুরনো শহরে ঢোকার প্রবেশপথ।

    এখানে হচ্ছেটা কি?!

    ভায়েন্থা এবার দেখতে পেলো পুরো এলাকায় পুলিশে গিজগিজ করছে। কয়েক মুহূর্ত পরই সে অতি পরিচিত কালো ভ্যানটিকে দেখতে পেয়ে বিরাট একটা ধাক্কা খেলো। পুলিশের গাড়িগুলোর মাঝখানে আছে সেটা।

    এটা এসআরএস টিমের গাড়ি, এ ব্যাপারে তার মনে কোনো সন্দেহ নেই। তারপরও সে বুঝতে পারলো না তারা এখানে কি করছে।

    যদি না…

    বহুকষ্টে ঢোক গিললো ভায়েন্থা, তারপরও সাহস করে একটা সম্ভাবনার কথা। ভেবে দেখলো। ল্যাংডন কি ব্রুডারকেও ফাঁকি দিয়েছে? এটা প্রায় অচিন্তনীয়। ওদের টিমের হাত থেকে পালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শূন্যের কোঠায়। কিন্তু এটাও ঠিক, ল্যাংডন একা নেই। তার সাথে যে সোনালি চুলের মেয়েটি আছে সে খুবই চটপটে। ল্যাংডনকে বেশ ভালোভাবেই হাসপাতাল থেকে পালাতে সাহায্য করেছে।

    কাছেই এক পুলিশ অফিসারকে দেখা গেলো প্রত্যেক গাড়ির কাছে গিয়ে বাদামী চুলের হ্যান্ডসাম এক লোকের ছবি দেখিয়ে প্রশ্ন করছে। ছবিটা দেখেই ভায়েন্থা চিনে ফেললো। এটা পত্রিকায় ছাপা হওয়া রবার্ট ল্যাংডনের একটি ছবি। তার হৃদয় উথলে উঠলো।

    ব্রুডার তাকে ধরতে পারে নি…

    ল্যাংডন এখনও পালিয়ে বেড়াচ্ছে!

    একজন অভিজ্ঞ স্ট্রাটেজিস্ট হিসেবে ভায়েন্থা দ্রুত হিসেব করতে শুরু করে দিলো ঘটনা যদি তা-ই হয়ে থাকে তাহলে তার পরিস্থিতি কতোটা বদলে গেছে।

    এক নাম্বার অপশন-পাততাড়ি গুটাতে হবে। চলে যেতে হবে শহর ছেড়ে।

    প্রভোস্টের দেয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ভায়েন্থা ভেস্তে দিয়েছে, সেজন্যে তাকে ঝেড়ে ফেলা হয়েছে কনসোর্টিয়াম থেকে। ভাগ্য যদি ভালো হয় তাহলে একটি আনুষ্ঠানিক এনকোয়ারির মুখোমুখি হতে হবে তাকে, তারপর চাকরিটা হারাতে হবে অবধারিতভাবে। আর ভাগ্য যদি খারাপ হয়ে থাকে, বাকি জীবনটা বার বার পেছন ফিরে দেখতে হবে কনসোর্টিয়াম তার পেছনে লেগেছে কিনা।

    দ্বিতীয় একটা অপশনও আছে এখন।

    নিজের মিশনটা ভালোমতো শেষ করো।

    এ কাজে লেগে থাকা মানে হলো অস্বীকৃতি প্রটোকলের সরাসরি বিরুদ্ধে। চলে যাওয়া, কিন্তু ল্যাংডন যেহেতু এখনও কনসোর্টিয়ামের নাগালের বাইরে আছে, পালিয়ে বেড়াচ্ছে তাই তাকে ধরার মিশনে লেগে থাকলে ভায়েন্থার কোনো সমস্যা হবে না বরং নতুন একটা সুযোগ আসার দারুণ সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। ব্রুডার যদি ল্যাংডনকে ধরতে ব্যর্থ হয়ে থাকে, ভাবলো সে, টের পেলো তার পাস বেড়ে গেছে। আর আমি যদি সফল হই…ভায়েন্থা জানে এটা এখনও দূরকল্পনা, কিন্তু ল্যাংডন যদি ব্রুডারের হাত থেকে সটকে পড়তে পারে। আর ভায়েন্থা যদি তার কাজটা শেষ করতে উদ্যোগী হয়, তাহলে এই মিশনে সে একক প্রচেষ্টায় কনসোর্টিয়ামকে বাঁচিয়ে দিতে পারবে। সেক্ষেত্রে তাকে ফিরিয়ে নেয়া ছাড়া প্রভোস্টের আর কোনো উপায় থাকবে না।

    আমি আমার চাকরি টিকিয়ে রাখবো, মনে মনে বললো সে। সম্ভবত আরো একধাপ প্রমোশনও পাবো।

    মুহূর্তেই ভায়েন্থা বুঝতে পারলো তার সমগ্র ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে একটা বিষয়ের উপর। ল্যাংডনের অবস্থান খুঁজে বের করতে হবে আমাকে…আর সেটা ব্রুডারের আগে।

    কাজটা সহজ হবে না। ব্রুডারের রয়েছে সীমাহীন জনশক্তি আর অগ্রসর প্রযুক্তি। ভায়েন্থা কাজ করছে সম্পূর্ণ একা। তবে তার কাছে রয়েছে এক টুকরো তথ্য যা ব্রুডার, প্রভোস্ট এবং পুলিশের কাছে নেই।

    ল্যাংডন কোথায় যেতে পারে সে-ব্যাপারে আমার বেশ ভালো ধারণা আছে।

    বিএমডব্লিউ বাইকটা স্টার্ট দিয়ে পুরো ১৮০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে ফেললো সেটা, তারপর যেখান থেকে এসেছিলো সেখানেই রওনা দিলো। পন্তে আলে গ্রাজি, ভাবলো সে। উত্তরে যে বৃজটা আছে সেটা তার চোখে ভেসে উঠলো। পুরনো শহরে ঢোকার আরো একটি পথ আছে।

    .

    অধ্যায় ২৫

    ক্ষমা প্রার্থনা ছিলো না, আপন মনে বললো ল্যাংডন। ওটা ছিলো এক শিল্পীর নাম।

    “ভাসারি,” থতমত খেয়ে এক পা পিছিয়ে বলে উঠলো সিয়েনা। “যে শিল্পী তার মুরালে cercatrova শব্দটি লুকিয়ে রেখেছিলেন।”

    না হেসে পারলো না ল্যাংডন। ভাসারি। ভাসারি। এরফলে তার অদ্ভুত আচরণের ব্যাখ্যা পাওয়া গেলো, এর মানে ল্যাংডন আসলে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটিয়ে ফেলার জন্য অনুশোচনা করছিলো না…যেমনটি মনে করা হয়েছিলো আগে।

    “রবার্ট, তুমি আহত হবার আগেই বত্তিচেল্লির এই ছবিটা দেখেছিলে, তুমি এও জানতে এতে একটা কোড আছে যা ভাসারির মুরালকে নির্দেশ করছে। এজন্যেই তুমি জ্ঞান ফিরে পাবার পর ভাসারির নামটা বার বার বলছিলে!”

    এসবের কি অর্থ দাঁড়াতে পারে সেটা হিসেব করার চেষ্টা করলো ল্যাংডন। গিওর্গিও ভাসারি-ষোড়শ শতকের একজন শিল্পী এবং লেখক-কয়েক শত পেইন্টিঙের শিল্পী হবার পরও ল্যাংডন যাকে উল্লেখ করে থাকে এ বিশ্বের প্রথম শিল্পকলার ইতিহাসবিদ হিসেবে। ছবি আঁকার পাশাপাশি এই শিল্পী কয়েক ডজন ভবনেরও স্থপতি ছিলেন, তবে সব কিছু ছাপিয়ে গেছে তার লেখা লাইভস অব দি মোস্ট এক্সিলেন্ট পেইন্টার্স, স্কাল্পচার্স অ্যান্ড আর্কিটেক্টস নামের ইটালিয়ান শিল্পীদের জীবনীমূলক একটি সংকলনগ্রন্থ। এমনকি বর্তমান সময়কালেও ছাত্রছাত্রিরা শিল্পকলার ইতিহাস জানতে এই বইটি পড়ে থাকে।

    আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে পালাজ্জো ভেচ্চিও’র হল অব দি ফাইভ হান্ড্রেড-এর মুরালে লুকিয়ে রাখা ‘সিক্রেট মেসেজ’ cerca trova শব্দটি ভাসারিকে বিজ্ঞসমাজে প্রতিষ্ঠিত করে তোলে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অক্ষরগুলো সবুজ রঙের একটি যুদ্ধ নিশানের উপরে লেখা আছে, যুদ্ধদৃশ্যের ভীড়ে এটা খালি চোখে ধরাই পড়ে না। ভাসারি কেন অদ্ভুত এই মেসেজটি নিজের মুরালে জুড়ে দিয়েছেন সে ব্যাপারে কেউই একমত হতে পারে নি, তবে অনেকগুলো তত্ত্বের মধ্যে সবচাইতে উল্লেখযোগ্য একটি হলো, দেয়ালের তিন সেন্টিমিটার পেছনে যে লিওনার্দো দা ভিঞ্চির একটি হারানো ফ্রেসকো রয়েছে সেটার কু দেয়া হয়েছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে।

    গাছের উপর দিয়ে নাভাসভাবে তাকাচ্ছে সিয়েনা। “একটা জিনিস আমি এখনও বুঝতে পারছি না। তুমি যদি ভেরি সরি, ভেরি সরি’ না বলে থাকো…তাহলে তোমাকে খুন করার জন্য লোকজন চেষ্টা করে যাচ্ছে কেন?”

    ল্যাংডন নিজেও এটা নিয়ে ভেবে যাচ্ছে।

    দূর থেকে সার্ভিলেন্স ড্রোনের শব্দটা আবারো ধেয়ে আসছে তাদের দিকে, ক্রমশ বাড়ছে সেটার আওয়াজ। ল্যাংডন জানে এখন সিদ্ধান্ত নেবার সময় এসে গেছে। ভাসারির বাত্তাগলিয়া দি মার্সিয়াননা কিভাবে দান্তের ইনফার্নোর সাথে। সম্পর্কিত হতে পারে, অথবা এক রাত আগে তার গুলিবিদ্ধ হবার ঘটনাটি। এসব কিছুই সে মেলাতে পারছে না, অথচ সামনে দেখতে পাচ্ছে বোধগম্য একটি পথ।

    Cerca trova।

    খুঁজলেই পাবে।

    ল্যাংডন আবারো দেখতে পেলো নদীর ওপার থেকে সাদা-চুলের সেই মহিলা তাকে ডাকছে। সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে! ল্যাংডন আঁচ করতে পারলো, এসব প্রশ্নের জবাব যদি থেকে থাকে তবে সেগুলো আছে পালাজ্জো ভেচ্চিওতে।

    প্রাচীনকালে এজিয়ান সাগরের প্রবালগুহার মধ্যে থেকে চিংড়ি মাছ ধরে আনতো যেসব গ্রেশিয়ান ডাইভার তাদের একটি প্রবাদপ্রতীম উক্তি মনে পড়ে গেলো তার। অন্ধকার টানেলের মধ্যে সাঁতার কাটার সময় যখন এমন একটি অবস্থা চলে আসে, ফিরে যাবার কোনো পথ নেই কারণ ফিরে যাওয়ার মতো দম তোমার নেই তখন কেবল একটাই কাজ করার থাকে, সাঁতার কেটে সামনের অজানার পানে এগিয়ে যাওয়া…আর মনে মনে প্রার্থনা করা যেনো বের হবার একটি পথ ওখানে থাকে।

    ল্যাংডনের মনে হলো তারাও এরকম একটি অবস্থায় এসে পড়েছে কিনা।

    চোখের সামনে বাগানের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া গোলকধাঁধাতুল্য পথগুলোর দিকে তাকালো সে। সিয়েনা আর সে যদি পিত্তি প্যালেসে পৌঁছাতে পারে, এই গার্ডেন থেকে বের হতে পারে তাহলে পুরনো শহরে ঢোকার যে বিখ্যাত পন্তি ভেচ্চিও ব্রিজটি আছে সেখানে যেতে পারবে। ঐ জায়গাটা সব সময়ই লোকজনে ভরপুর থাকে, জনমানুষের ভীড়ে খুব সহজেই মিশে যাওয়া যাবে। ওখান থেকে পালাজ্জো ভেচ্চিও মাত্র কয়েক ব্লক দূরে।

    ড্রোনের আওয়াজ ক্রমশ বাড়তে থাকলে ল্যাংডনের মধ্যে অদ্ভুত একটি অনুভূতির সৃষ্টি হলো। সে যে ‘ভেরি সরি’ কথাটা বলে নি এটা তাকে স্বস্তি দিলেও এখন আবার নতুন একটি ভাবনায় পড়ে গেলো। তাহলে পুলিশের হাত থেকে সে কেন পালাচ্ছে?

    “শেষ পর্যন্ত তারা আমাকে ধরবেই, সিয়েনা,” বললো ল্যাংডন। “এভাবে পালিয়ে না বেড়ানোটাই আমার জন্য ভালো হবে।”

    আৎকে উঠে তার দিকে তাকালো মেয়েটি। “রবার্ট, তুমি যখনই পালানোর চিন্তা বাদ দেবে কেউ না কেউ এসে গুলি চালাবে তোমার উপর! তোমাকে আগে বের করতে হবে তুমি কিসের সাথে জড়িয়ে পড়েছিলে। ভাসারির মুরালটি আগে দেখা উচিত তোমার, হয়তো এরফলে তোমার স্মৃতি ফিরে আসতে পারে। হতে পারে এই প্রজেক্টরটি তুমি কেন বহন করছিলে আর ওটা কোত্থেকে এসেছে সেটাও জানা যাবে।”

    ল্যাংডনের চোখে ভেসে উঠলো স্পাইক করা চুলের মেয়েটি ঠাণ্ডা মাথায় ডাক্তার মারকোনিকে খুন করছে.. সৈনিকেরা তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ছে…পোর্তা রোমানায় জড়ো হয়েছে ইটলিয়ান মিলিটারি পুলিশ…আর এখন এই ববোলি গার্ডেনে তাদের মাথার উপর চক্কর দিচ্ছে একটি সার্ভিলেন্স ড্রোন। চুপ মেরে গেলো সে। ক্লান্ত চোখ দুটো ডলতে ডলতে অপশনগুলো নিয়ে ভাবলো।

    “রবার্ট?” সিয়েনার কণ্ঠ তাড়া দিলো তাকে। “আরেকটা ব্যাপার আছে…ওটা খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয় নি, তবে এখন তাই মনে হচ্ছে।”

    চোখ খুলে তাকালো ল্যাংডন। মেয়েটার কণ্ঠে যে তাড়া আছে সেটা বুঝতে পেরেছে।

    “কথাটা আমি তোমাকে অ্যাপার্টমেন্টেই বলতে চেয়েছিলাম,” বললো সে, “কিন্তু…”

    “কি?”

    নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো সিয়েনা। মনে হচ্ছে অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গেছে। “তুমি যখন হাসপাতালে এলে তখন বেঘোরে ছিলে, কিছু বলার চেষ্টা করছিলে।”

    “হ্যাঁ,” বললো ল্যাংডন, “বিড়বিড় করে বলছিলাম ‘ভাসারি, ভাসারি।”

    “হ্যাঁ, কিন্তু তার আগে…মানে আমরা রেকর্ডরটা নিয়ে আসার আগে তুমি আরেকটা কথা বলেছিলে। সেটা আমার মনে আছে। হাসপাতালে আসার পর প্রথম ঐ কথাটাই বলেছিলে তুমি। মাত্র একবারই বলেছিলে সেটা। তবে আমি নিশ্চিত, কথাটা বুঝতে পেরেছিলাম।”

    “আমি কি বলেছিলাম?”

    মাথার উপরে থাকা ড্রোনটার দিকে চকিতে তাকিয়ে ল্যাংডনের দিকে ফিরলো সে। “তুমি বলেছিলে, ওটা খুঁজে পাবার চাবি আমার কাছে আছে…আমি যদি ব্যর্থ হই তাহলে সবাই মারা যাবে। “

    স্থিরচোখে চেয়ে রইলো ল্যাংডন।

    সিয়েনা বলতে লাগলো, “আমি ভেবেছিলাম তুমি তোমার পকেটে রাখা জিনিসটার কথা বলছিলে, তবে এখন আমি অতোটা নিশ্চিত নই।”

    আমি যদি ব্যর্থ হই তাহলে সবাই মারা যাবে? কথাটা ল্যাংডনকে বেশ নাড়িয়ে দিলো। চোখের সামনে ভেসে উঠলো মৃতদের ভয়াবহ সেই ছবিটা…দান্তের ইনফার্নো, বায়োহ্যাজার্ড সিম্বল, প্লেগ ডাক্তার। আবারো সাদা চুলের সেই অপরূপ সুন্দরী মহিলা রক্তলাল নদীর ওপার থেকে আকুতি জানাচ্ছে তাকে।

    খুঁজলেই পাবেন! সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে।

    সিয়েনার কণ্ঠ তাকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনলো। “এই প্রজেক্টরটি শেষ পর্যন্ত যা-ই নির্দেশ করে থাকুক…অথবা তুমি যা খোঁজার চেষ্টা করছো সেটা নিশ্চয় বিপজ্জনক কিছুই হবে। সত্যিটা হলো লোকজন আমাদেরকে খুন করার চেষ্টা। করছে…” তার কণ্ঠ কিছুটা কেঁপে উঠলো যেনো। নিজের চিন্তাভাবনা গুছিয়ে। নিতে কয়েক মুহূর্ত সময় নিলো সে। “ভেবে দেখো। তারা দিনে-দুপুরে তোমাকে গুলি করেছে…আমাকে গুলি করেছে-যে কিনা এসবের সাথে মোটেও জড়িত নয়, একেবারেই নিরীহ একজন। মনে হচ্ছে না কেউ আলাপ-আলোচনা করতে চাইছে। তোমার নিজের দেশের সরকার তোমার বিরুদ্ধে চলে গেছে…তাদের কাছে তুমি সাহায্য চাইলে আর তারা তোমাকে খুন করার জন্য এক খুনিকে পাঠিয়ে দিলো।”

    ফাঁকা দৃষ্টি নিয়ে সামনে চেয়ে রইলো ল্যাংডন। ইউএস কনসুলেট ল্যাংডনের অবস্থানের কথা খুনিকে জানিয়ে দিয়েছে নাকি তারাই তাকে খুন করার জন্য তাকে পাঠিয়েছে সেটা ভাবা অবান্তর। ফলাফল তো একই। আমার নিজের দেশের সরকার আমার পাশে নেই।

    সিয়েনার বাদামী চোখের দিকে তাকালো ল্যাংডন, সেখানে দেখতে পেলো। নির্ভয়। আমি তাকে কিসের মধ্যে জড়িয়ে ফেলেছি? “আমি যদি জানতাম আমি কী খুঁজে বেড়াচ্ছি তাহলে সবটাই পরিস্কার হয়ে যেতো।”

    সায় দিলো সিয়েনা। “সেটা যা-ই হোক না কেন, আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। অন্তত এটা আমাদেরকে সুবিধা দেবে।”

    তার যুক্তিটা উড়িয়ে দেয়া কঠিন। তারপরও ল্যাংডনের মনে একটা খচখচানি হতে লাগলো। আমি যদি ব্যর্থ হই, তাহলে সবাই মারা যাবে। সারাটা সকাল সে বায়োহ্যাজার্ডের বিপজ্জনক সিম্বল, প্লেগ আর দান্তের নরক নিয়ে ভেবে গেছে। তারপরও স্বীকার করতেই হবে, কিসের পেছনে ছুটছে, কি খুঁজে বেড়াচ্ছে। সে সম্পর্কে কোনো ধারণাই তার নেই। তবে পরিস্থিতিটা যে বিপজ্জনক মহামারি, মরণঘাতি জীবাণু কিংবা রোগের হুমকির সাথে সম্পর্কিত সে ব্যাপারে তার মনে এখন কোনো সন্দেহ নেই। তা-ই যদি সত্যি হয়ে থাকে তার নিজের দেশের সরকার কেন তাকে শেষ করে দিতে চাইবে?

    তারা কি মনে করছে আমি কোনো না কোনোভাবে সম্ভাব্য একটি আক্রমণের সাথে জড়িত?

    মাথামুণ্ডু কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। অন্য কিছু ব্যাপারও আছে এখানে।

    ল্যাংডন আবারো সাদা-চুলের মহিলার কথা ভাবলো। “হেলুসিনেশানে এক মহিলাকেও দেখি। তাকে দেখলেই আমার মনে হয় তাকে সাহায্য করা দরকার।”

    “তাহলে নিজের অনুভূতির উপর আস্থা রাখো,” সিয়েনা বললো। “তোমার যে অবস্থা তাতে তোমার অবচেতন মনই তোমার সেরা কম্পাস। এটা বেসিক মনোবিজ্ঞান-তোমার মন যদি বলে ঐ মহিলাকে সাহায্য করতে হবে তাহলে আমিও মনে করি তোমার তা-ই করা উচিত।”

    “খুঁজলেই পাবে,” একসাথে তারা দুজনে বলে উঠলো।

    হাফ ছাড়লো ল্যাংডন, পরিস্কার হয়ে গেছে তার পথটা কি।

    আমাকে শুধু টানেলের ভেতর দিয়ে সাঁতরে যেতে হবে।

    এসপার ওসপার করতে হবে এমন ভঙ্গি করে ল্যাংডন তার চারপাশটা দেখে নিলো। নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করলো সে। এই গার্ডেন থেকে বের হবার পথ কোনটা?

    তারা দাঁড়িয়ে আছে গার্ডেনের একটি খোলা প্রান্তরের শেষদিকে কিছু গাছের নীচে, এখান থেকে বিভিন্ন দিকে চলে গেছে বেশ কয়েকটি রাস্তা। দূরে একটি ডিম্বাকৃতির লেগুন দেখতে পেলো সে, ওটার মাঝখানে ছোট্ট একটি দ্বীপের মতো আছে, লেবু গাছ আর কিছু মূর্তিতে জায়গাটা ভরপুর। আইসোলোত্তো, ভাবলো সে। দেবতা জিউসের ছেলে পারসিয়াসের বিখ্যাত ভাস্কর্যটির কথা মনে পড়ে গেলো। ডুবন্তপ্রায় ঘোড়ার পিঠে সওয়ার সে। পানি ফুড়ে ওঠার চেষ্টা করছে।

    “পিত্তি প্যালেস ঐ দিকে,” আইসোলেত্তো থেকে একটু দূরে পূর্ব দিকটা দেখিয়ে বললো ল্যাংডন। গার্ডেনের মেইন রোড ভিওত্তোলোনির দিকে। এই রাস্তাটি পূর্ব থেকে পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত চলে গেছে। ভিওত্তোলোনি দুই লেনের একটি রাস্তা, দু’পাশে চারশত বছরের পুরনো সাইপ্রেস গাছের সারি।

    “ওখানে তো লুকানোর মতো কোনো জায়গা নেই,” বললো সিয়েনা। মাথার উপরে চক্কর দিতে থাকা ড্রোন আর খোলা রাস্তাটার দিকে ইঙ্গিত করলো।

    “ঠিক বলেছো,” বাঁকা হাসি দিয়ে বললো ল্যাংডন। “আর সেজন্যে আমরা ওখান দিয়ে না গিয়ে টানেল ব্যবহার করবো।”

    আবারো জায়গাটা দেখালো সে তবে এবার ভিত্তোলোনির মুখে লম্বা লম্বা ঘন ঘাসের দিকে। সবুজের এই দেয়াল কেটে তৈরি করা হয়েছে একটি খিলানসদৃশ্য প্রবেশপথ। সেই খোলাপথের পরেই আছে একটি ফুটপাত, সেটা চলে গেছে বহু দূরে-যেনো কোনো টানেল ছুটে চলেছে ভিওত্তোলোনির সমান্তরালে। সেই ষোড়শ শতক থেকেই এর দু’দিকে থাকা ওক গাছের ডালপালাগুলো কেটে চমৎকারভাবে জট পাকিয়ে দেয়া হয়েছে, ফলে মাথার উপরে গাছপালার ডালগুলো ছাউনির মতো কাজ করে। এই পথটির নাম লা সার্কিয়াতা-আক্ষরিক অর্থ সার্কুলার’, মানে বৃত্তাকার।

    সিয়েনা দৌড়ে ছুটে গেলো সেখানে। উঁকি মেরে দেখলো ছায়াঘেরা চ্যানেলের ভেতরে। সঙ্গে সঙ্গে পেছন ফিরে হাসি দিলো সে। “দারুণ।”

    দেরি না করে ভেতরে ঢুকে পড়লো মেয়েটি, গাছগাছালির নীচ দিয়ে দ্রুত হাঁটতে শুরু করলো এবার।

    ল্যাংডন লা সার্কিয়াতা’কে সব সময়ই ফ্লোরেন্সের সবথেকে শান্ত আর নিরিবিলি জায়গা হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। তবে এ মুহূর্তে সিয়েনাকে ওটার ভেতর দিয়ে দ্রুত ছুটে যেতে দেখে আরো একবার তার মনে পড়ে গেলো। গ্রেসিয়ান ডাইভারদের সেই প্রার্থনাটির কথা।

    দ্রুত নিজের প্রার্থনাটি করে নিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লো সে।

    .

    তাদের থেকে আধ মাইল পেছনে, আর্ট ইন্সটিটিউটের বাইরে এজেন্ট ব্রুডার একদল পুলিশ আর ছাত্রছাত্রিদের মাঝখান দিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে বের হয়ে এলো, তার শীতল দু’চোখের চাহনীতে ভীড়টা দু’দিকে সরে গেলো মুহূর্তে। একটু দূরে রাখা কালো রঙের ভ্যানের সমানে চলে এলো সে, এটা এখন তাদের কমান্ডপোস্ট। একজন সার্ভিলেন্স স্পেশালিস্ট কাজ করে যাচ্ছে সেখানে।

    “আমাদের ড্রোন থেকে পেয়েছি,” ব্রুডারকে বললো সার্ভিলেন্স স্পেশালিস্ট। “কয়েক মিনিট আগে।”

    পজ্‌ করা ভিডিওটার দিকে তাকালো ব্রুডার। দুটো মুখের ছবি দেখা যাচ্ছে-কালচে চুলের এক পুরুষ আর সোনালি চুলের পনিটেইল করা এক মেয়ে-তারা দু’জনেই গাছের ছায়ার নীচ থেকে উপরে আকাশের দিকে চেয়ে আছে।

    রবার্ট ল্যাংডন।

    সিয়েনা ব্রুকস।

    সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।

    ববোলি গার্ডেনের ম্যাপটার দিকে তাকালো ব্রুডার। ভ্যানের হুডের উপর সেটা মেলে রাখা হয়েছে। তারা খুব খারাপ একটি পথ বেছে নিয়েছে, ভাবলো সে। গার্ডেনের লে-আউটের দিকে ভালো করে চোখ বুলালো এবার। ভেতরে অসংখ্য পথ, গাছপালা আর লুকাবার জায়গা থাকলেও এর পুরোটা সীমানা উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। ব্রুডার যতোটা ভেবেছিলো তারচেয়ে এই ববোলি গার্ডেন শিকার করার জন্য অনেক বেশি সহজ একটি জায়গা।

    তারা কখনও এখান থেকে বের হতে পারবে না।

    “স্থানীয় কর্তৃপক্ষ সবগুলো এক্সিট সিল করে দিয়েছে,” এজেন্ট বললো। “তারা এখন ভেতরে তল্লাশী করছে।”

    “আমাকে সবকিছু জানিও,” বললো ব্রুডার।

    আস্তে করে ভ্যানের জানালা দিয়ে পেছনের সিটে বসে থাকা সাদা-চুলের মহিলার দিকে তাকালো সে।

    যে ড্রাগ তাকে দেয়া হয়েছে সেটা কাজ করতে শুরু করেছে। মহিলা এখন আধো-অচেতন-এতোটা ভালো কাজ করবে ব্রুডার কল্পনাও করতে পারে নি। তাসত্ত্বেও মহিলার ভয়ার্ত দু’চোখের দিকে তাকিয়ে সে বুঝতে পারলো চারপাশে কি ঘটছে না ঘটছে সেসবই পুরোপুরি বোধগম্য করতে পারছে সে।

    তাকে দেখে সুখি মনে হচ্ছে না, ভাবলো ব্রুডার। কিন্তু কথা হলো, এরকম হবার তো কারণও নেই।

    .

    অধ্যায় ২৬

    পানির ফোয়ারা বিশ ফুট উপরে উঠে গেলো।

    ল্যাংডন দেখতে পেলো আস্তে আস্তে সেগুলো নেমে আসছে নীচের মাটিতে। বুঝতে পারলো তারা কাছাকাছি এসে পড়েছে। লা সার্কিয়াতা’র বৃক্ষশোভিত টানেলের শেষপ্রান্তে এসে কর্ক গাছেঘেরা খোলা প্রান্তরে চলে এলো। এখন ববোলি গার্ডেনের সবচেয়ে বিখ্যাত পানির ফোয়ারাটা দেখতে পেলো-স্তলদো লরেঞ্জি’র ব্রোঞ্জ অব নেপচুন তিনমাথার একটি বর্শা ধরে রেখেছে। অপ্রাসঙ্গিকভাবেই স্থানীয়রা এটাকে বলে কাটাচামচের ফোয়ারা। এই ফোয়ারাটি গার্ডেনের ঠিক মাঝখানে অবস্থিত।

    টানেল থেকে বের হয়ে সিয়েনা দাঁড়িয়ে পড়লো। উপরের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখলো সে। “ড্রোনটা দেখতে পাচ্ছি না।”

    লাংডনও ওটার শব্দ শুনতে পাচ্ছে না এখন, অবশ্য ফেয়ারার পানির শব্দ হচ্ছে বেশ।

    “মনে হয় রিফুয়েল করার দরকার পড়েছে,” সিয়েনা বললো। “এটাই আমাদের সুযোগ। কোন্ দিকে যাবো এবার?”

    ল্যাংডন তাকে নিয়ে বাম দিকে চলে গেলো। একটা সরু পথ বেয়ে একটু উপরে উঠতেই তাদের চোখে পড়লো পিত্তি প্যালেস।

    “চমৎকার তো,” ফিসফিস করে বললো সিয়েনা।

    “একেবারে টিপিক্যাল মেদিচি বললেও কম বলা হবে,” তীর্যকভাবে বললো সে।

    সিকি মাইল দূর থেকেও পাথরে তৈরি পিত্তি প্যালেসটা পুরো ল্যান্ডস্কেপের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার করে আছে। দিগন্তের ডান থেকে বামে ছড়িয়ে আছে সেটা। পাথরে তৈরি এর বাইরের অংশ খোদাই করে নক্সা করা, এক ধরণের কর্তৃত্বপরায়ন ভাব রয়েছে। প্রথাগতভাবে সাবেক প্রাসাদগুলো তৈরি হতো খানিকটা উঁচু জায়গায় যাতে করে নীচের বাগান থেকে ওগুলো ভালোভাবেই দেখা যায়, কিন্তু পিত্তি প্যালেস আরনো নদীর কাছে নীচু সমতলভূমিতে বানানোর উদ্দেশ্য ছিলো ববোলি গার্ডেন থেকে লোকজন নীচের দিকে তাকিয়ে প্রাসাদটি যেনো দেখতে পায়।

    এর ফলে আরো বেশি নাটকীয়তা তৈরি হয়েছে। প্রকৃতি নিজে এই প্রাসাদটাকে নির্মাণ করেছে বলে একজন স্থপতি বর্ণনা করেছিলো…যেনো বড় বড় পাথরগুলো ভূমিধ্বসের ফলে গড়িয়ে চলে এসেছে এখানে, তারপর একত্র হয়ে তৈরি করেছে এই প্রাসাদ।

    নীচু জমিতে অবস্থিত বলে এর সুরক্ষার ঘাটতি আছে, তাসত্ত্বেও সলিড পাথরে তৈরি পিত্তি প্যালেস এতোটাই মনোমুগ্ধকর যে নেপোলিওন বোনাপার্ট ফ্লোরেন্সে থাকার সময় তার ঘাঁটি হিসেবে এটাকেই বেছে নিয়েছিলেন।

    “দেখো, প্রাসাদের সবচাইতে কাছের একটি দরজা দেখিয়ে বললো সিয়েনা। “ভালো খবর।”

    ল্যাংডনও এটা দেখেছে। সকালের এ সময়টাতেও পর্যটকের দল প্রাসাদের সামনে বাগানে ঘুরেফিরে দেখছে। প্রাসাদটি খোলা আছে, তার মানে ল্যাংডন। আর সিয়েনা খুব সহজেই ভেতরে ঢুকে ভবনটির ভেতর দিয়ে বাগান পেরিয়ে পালিয়ে যেতে পারবে। ল্যাংডন জানে তারা ডান দিকে আরনো নদীটা দেখতে পাবে, ওটা পেরোলেই পুরনো শহরটা।

    সিয়েনা আর ল্যাংডন প্রায় জগিংয়ের মতো করে এগোতে লাগলো প্রাসাদের দিকে। একটু এগোতেই ববোলি অ্যাম্ফিথিয়েটারটি অতিক্রম করে গেলো তারা-ইতিহাসের প্রথম অপেরার পারফর্মেন্স এখানেই হয়েছিলো-ঘোড়ার খুড়ের মতো আকৃতির এই স্থাপনাটি পাহাড়ের পাশে অবস্থিত। এরপর তারা পেরিয়ে গেলো দ্বিতীয় রামেসিসের অবিলিস্ক এবং ওটার পাদদেশে রাখা দুর্ভাগ্যজনক একটি আর্ট। গাইডবুক এটিকে বলছে ‘রোমের বাগ্‌স অব কারাকাল্লা’র একটি বিশালাকৃতির পাথরের বেসিন। কিন্তু ল্যাংডন এটাকে এ বিশ্বের সবচাইতে বড় বাথটাব ছাড়া আর কিছুই মনে করে না। সত্যি বলতে কি, এটা আসলে তা-ই ছিলো। তাদের উচিত এই জিনিসটা অন্য কোথাও রাখা।

    অবশেষে প্রাসাদের পেছন দিকটায় চলে এলে হাটার গতি কমিয়ে দিলো তারা, কারোর চোখে যেনো না পড়ে সেজন্যে সকালের প্রথম দিকে আসা পর্যটকদের ভীড়ে মিশে গেলো। জনস্রোতের বিরুদ্ধে সরু টানেল দিয়ে এগিয়ে গেলো প্রাসাদের ভেতরের খোলা প্রাঙ্গনে, এখানে দর্শনার্থীরা বসে বসে রেডিমেড এসপ্রেসো কফিতে চুমুক দিচ্ছে আর সকালের সময়টা উপভোগ করছে। কফির টাটকা গন্ধে বাতাস ভরে আছে, হঠাৎ করেই ল্যাংডনের ইচ্ছে করলো বেঞ্চে আরাম করে বসে সকালের নাস্তা করবে। কিন্তু আজ নয়, প্রাসাদের ভেতর দিয়ে প্রধান প্রবেশদ্বারের দিকে যেতে যেতে ভাবলো সে।

    দরজার সামনে আসতেই ল্যাংডন আর সিয়েনা থমকে দাঁড়ালো। অসংখ্য পর্যটক সরু দরজাটার সামনে জড়ো হয়ে উৎসুকভাবে বাইরের দিকে চেয়ে আছে।

    ভীড়ের মধ্য দিয়ে প্রাসাদের সামনের দিকটা দেখলো ল্যাংডন।

    পিত্তির রাজকীয় প্রবেশপথটি আর আগের মতো নেই। সামনের সবুজ লনের ঘাস আর গাছপালা কেটে ফেলা হয়েছে, সামনের প্রাঙ্গণটি এখন কংক্রিটের গ্রাউন্ড, পাহাড়ের দিক থেকে ভায়া দেই গুইচ্চিয়ারদিনির দিকে চলে গেছে সেটা, অনেকটা সুবিশাল স্কি স্লপের মতো।

    পাহাড়ের পাদদেশে তাকাতেই ল্যাংডন বুঝতে পারলো পর্যটকেরা উৎসুক হয়ে কি দেখছে।

    নীচের পিয়াজ্জা দেই পিত্তি’র সামনে চতুর দিক থেকে ছুটে এসেছে আধ ডজনের মতো পুলিশের গাড়ি। অফিসারদের একটি দল ঢালু পথ বেয়ে উঠে আসছে উপরে। নিজেদের হোলস্টার থেকে অস্ত্র বের করে নিচ্ছে তারা, হাত নেড়ে প্রাসাদের সামনে থেকে পর্যটকদের সরে যেতে ইশারা করছে।

    .

    অধ্যায় ২৭

    পিত্তি প্যালেসে পুলিশের দলটি ঢোকার আগেই সিয়েনা আর ল্যাংডন সটকে পড়তে শুরু করলো। যেখান থেকে এসেছিলো সেখানেই আবার ফিরে গেলো তারা। প্রাসাদের ভেতরের প্রাঙ্গণে ক্যাফের কাছে আসতেই শুনতে পেলো লোকজন কানাঘুষা করছে পুলিশের আগমন নিয়ে। ভেতরের পর্যটকেরা বাইরের দিকে ছুটে যাচ্ছে কি হয়েছে দেখার জন্য।

    এতো দ্রুত পুলিশ তাদের অবস্থান জানতে পেরেছে বলে সিয়েনা একটু অবাকই হলো। ড্রোনটা আমাদের অবস্থান চিহ্নিত করতে পেরেছে বলেই উধাও হয়ে গেছে।

    গার্ডেন থেকে যে সঙ্কীর্ণ টানেলের ভেতর দিয়ে এসেছিলো সেটা দিয়েই আবার ফিরে যেতে শুরু করলো তারা। কোনো রকম দ্বিধাগ্রস্ত না করেই পাথরের পথ দিয়ে এগোতে লাগলো এবার। ওখানকার সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় সিঁড়িসংলগ্ন দেয়ালের উপর দিয়ে ববোলি গার্ডেনের বিশাল প্রান্তরটি চোখে পড়লো।

    সিয়েনার হাত ধরে ল্যাংডন টান মেরে তাকে নীচু হয়ে যেতে বললো যাতে করে দেয়ালের ওপাশ থেকে তাদেরকে না দেখা যায়। দৃশ্যটা সিয়েনাও দেখেছে।

    তিনশ’ গজ দূরে আম্ফিথিয়েটারের পাশে যে ঢালুপথটি আছে সেখান দিয়ে একদল পুলিশ ঢুকে পড়েছে। তল্লাশী করছে তারা, পর্যটকদের এটা ওটা জিজ্ঞেস করছে। ওয়্যারলেসের সাহায্যে যোগাযোগ করছে একে অন্যের সাথে।

    আমরা ফাঁদে পড়ে গেছি!

    ল্যাংডনের সাথে পরিচয় হবার সময় সিয়েনা ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারে নি এই লোকের সাথে তাকে এভাবে এতোদূর চলে আসতে হবে, তাও আবার এরকম পরিস্থিতিতে। এটা আমার কল্পনার চেয়েও অনেক বেশি কিছু। হাসপাতাল থেকে যখন ল্যাংডনকে নিয়ে পালিয়ে আসে তখন সে ভেবেছিলো স্পাইক-চুলের মেয়ের হাত থেকে বুঝি বাঁচা গেলো। কিন্তু এখন দেখতে পাচ্ছে মিলিটারির একটি দল নেমে পড়ছে তাদের পেছনে, সঙ্গে ইটালিয়ান পুলিশ। সে বুঝতে পারছে এ মুহূর্তে তাদের পালিয়ে যাবার সম্ভাবনা প্রায় শূন্যের কোঠায়।

    “বের হবার আর কোনো পথ আছে?” হাফাতে হাফাতে জানতে চাইলো সিয়েনা।

    “মনে হয় না,” বললো ল্যাংডন। “এই গার্ডেনটি প্রাচীরঘেরা শহরের মতো…” আচমকা থেমে পূর্ব দিকে তাকালো সে। “ঠিক…ভ্যাটিকান সিটির মতোই।” তার চোখেমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, যেনো হঠাৎ করেই আশার আলো দেখতে পাচ্ছে।

    সিয়েনা বুঝতে পারলো না তাদের বর্তমান কঠিন অবস্থার সাথে ভ্যাটিকানের কি সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু ল্যাংডন আপন মনে মাথা নেড়ে সায় দিতে দিতে পূর্ব দিক থেকে প্রাসাদের দিকে তাকালো আবার।

    “আমি পুরোপুরি নিশ্চিত নই,” সিয়েনার সাথে সাথে আবার চলতে শুরু করলো ল্যাংডন। “তবে এখান থেকে বের হবার অন্য একটা পথ আছে হয়তো।”

    আচমকা তাদের সামনে পড়ে গেলো দুজন মানুষ। ওরা সীমানাপ্রাচীরের দিক থেকে এসেছে, আরেকটুর জন্যে ল্যাংডন আর সিয়েনার সাথে ধাক্কা লেগে যেতো। দু’জনেই পরে আছে কালো চামড়ার পোশাক, কয়েক মুহূর্তের জন্য লোক দুটোকে সিয়েনার মনে হলো তার অ্যাপার্টমেন্টে ঢোকা সৈনিকে বলে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই ভুল ভাঙলো। এরা দু’জন নিছক পর্যটক-সম্ভবত ইটালিয়ান। তাদের পরনে স্টাইলিশ কালো চামড়ার জামা দেখে আন্দাজ করলো সে।

    মাথায় একটা আইডিয়া চলে আসতেই স্মিত মুখে একজন পর্যটকের হাত ধরে ফেললো সিয়েনা। তার চোখেমুখে আন্তরিকতার বহিপ্রকাশ। “পুয়ো দিরচি দোভেলা গ্যালারিয়া দেল কস্তিউম?” ইতালিয়ান ভাষায় বলে গেলো সে। কস্টিউম গ্যালারি হিসেবেখ্যাত জায়গাটি কোন দিকে জানতে চাইলো। “ইয়ো এ মিও ফ্রাতেল্লো সিয়ামো ইন রিতাদৌ পার উনা ভিসিতা প্ৰিভাতা।” আমি এবং আমার ভাই প্রাইভেট টুরে দেরি করে ফেলেছি।

    “সাতো!” লোকটা হেসে বললো। তাকে দেখে মনে হলো সেও সাহায্য করতে উদগ্রীব। “প্রসেগুইতি দ্বিত্তো পার ইল সেস্তিয়েরো!” সীমানাপ্রাচীরের পশ্চিম দিকটা দেখিয়ে বললো সে, ল্যাংডন যেমনটি ভেবেছিলো জায়গাটা তার চেয়ে কিছুটা দূরে।

    “মল্‌তে গ্রাজি!” আরেকটা স্মিতহাসি দিয়ে ধন্যবাদ জানালো তাদেরকে।

    সিয়েনার দিকে তাকিয়ে ল্যাংডন প্রশংসাসূচকভাবে মাথা নাড়লো। সে বুঝতে পেরেছে তার উদ্দেশ্যটা কি ছিলো। পুলিশ যদি এই দুই পর্যটককে জিজ্ঞাসাবাদ করে তাহলে তারা জানতে পারবে ল্যাংডন আর সিয়েনা কস্টিউম গ্যালারির দিকে গেছে, সেটা প্রাসাদের থেকে বেশ দূরে পশ্চিম দিকে অবস্থিত…তারা এখন যেখানে যাবার জন্য পা বাড়াচ্ছে সেখান থেকে প্রায় বিপরীত দিকে।

    “ওই পথ দিয়ে যেতে হবে আমাদের,” ল্যাংডন সামনের একটি ভোলা চত্বরের কাছে হাটারপথটি দেখিয়ে বললো। ওটা নীচু হয়ে চলে গেছে আরেকটি পাহাড়ের কোল ঘেষে, প্রাসাদ থেকে অনেক দূরে। পাথরে বিছানো পথটি পাহাড়ের কোলঘেষে এঁকেবেঁকে চলে গেছে, একপাশে উঁচুগাছের বেড়া থাকার করণে এটা তাদের আড়াল হিসেবে কাজ করবে। পাহাড় থেকে নেমে আসা। পুলিশের দলটি মাত্র একশ গজ দূরে।

    সিয়েনা হিসেব করে দেখলো খোলা চত্বরটি পেরিয়ে ঐ পথে যাবার সম্ভাবনা তাদের খুবই কম। পর্যটকের দল ওখানে জড়ো হয়েছে, পুলিশের কর্মকাণ্ড দেখছে উৎসুক হয়ে। ড্রোনের মৃদু শব্দও শোনা যাচ্ছে আবার। অনেক দূর থেকে আসছে ওটা।

    “হয় এখন হবে নয়তো হবে না,” কথাটা বলেই ল্যাংডন মেয়েটার হাত ধরে ছুটে গেলো বোলা চত্বরটি দিয়ে। পর্যটকদের ভীড়ের মধ্যে এঁকেবেঁকে যেতে হলো তাদেরকে। সিয়েনা দৌড়ে যাবার চেষ্টা করলেও ল্যাংডন তার হাতটা শক্ত করে ধরে যথাসম্ভব শান্তভাবে হাটার চেষ্টা করলো।

    পাথুরেপথের কাছে আসতেই সিয়েনা পেছন ফিরে দেখলো তাদেরকে পুলিশের দলটি দেখে ফেলেছে কিনা। একমাত্র পুলিশের যে লোকটিকে দেখতে পেলো সে আকাশের দিকে তাকিয়ে কী যেনো দেখছে। ড্রোনের শব্দ ক্রমশ বাড়ছে এখন। আর কোনো দিকে না তাকিয়ে ল্যাংডনের সাথে ছুটে চললো সে।

    তাদের সামনে গাছপালার ফাঁক দিয়ে পুরনো ফ্লোরেন্সের আকাশটা দেখা যাচ্ছে এখন। দুমো’র লাল-টাইলসের গম্বুজ আর গিওত্তো’র বেল টাওয়ারের সবুজ, লাল আর সাদা টাওয়ারটি দেখতে পেলো সিয়েনা। এ মুহূর্তের জন্য পালাজ্জো ভেচ্চিও’র টাওয়ারটিও তার চোখে পড়লো-ওটার অবস্থান বেশ দূরে কিন্তু তারা পথ বেয়ে যতোই নীচের দিকে নামতে লাগলো উঁচু প্রাচীরের কারণে সেই দৃশ্য ঢাকা পড়ে যেতে লাগলো আস্তে আস্তে।

    পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছাতেই হাফিয়ে উঠলো সিয়েনা, ভাবতে লাগলো তারা কোথায় যাচ্ছে সে সম্পর্কে ল্যাংডনের আসলেই কোনো ধারণা আছে কিনা। পথটি চলে গেছে গোলকধাঁধার বাগানের দিকে, তবে ল্যাংডন বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে বাম দিকে মোড় নিয়ে পাথরে তৈরি প্রশস্ত একটি জায়গার দিকে এগিয়ে গেলো। এটা দেখতে অনেকটা বাড়িঘরের সামনে যে পাকা মেঝে। থাকে সেরকম বলে মনে হচ্ছে। ওটা পেরিয়ে গাছের বেড়ার যে হেজ রয়েছে সেখানে থামলো সে। মাথার উপরে ঝুলছে কিছু গাছের ডালপালা। জায়গাটা একেবারে ফাঁকা আর নিরিবিলি। গাছের ছায়াতল বলে কিছুটা অন্ধকারও বটে। এটা সম্ভবত এখানকার কর্মচারীদের পার্কিংলট।

    “আমরা কোথায় যাচ্ছি?!” দম ফুরিয়ে জানতে চাইলো সিয়েনা।

    “প্রায় পৌঁছে গেছি।”

    কোথায়? এই কংক্রিটের লনটি তিনদিক দিয়ে উঁচু দেয়ালে ঘেরা, আর দেয়ালগুলোর উচ্চতা তিনতলার নীচে হবে না। একমাত্র যে জায়গাটি দিয়ে বের হওয়া যাবে সেটা বাম দিকে গাড়ি আসা-যাওয়ার পথ। কিন্তু সেখানে রয়েছে বিশাল রট-আয়রনের একটি গেট। দেখে মনে হচ্ছে গেটটা প্রাসাদের মতোই পুরনো। সিয়েনা দেখতে পেলো গেটের ওপাশে পিয়াজ্জা দেই পিত্তিতে পুলিশ জড়ো হয়ে আছে।

    গাছের বেড়া ধরে তাদের সামনে যে দেয়াল আছে সেদিকে এগিয়ে গেলো ল্যাংডন। ওখানে খোলা কোনো জায়গা কিংবা দরজার মতো আছে কিনা ভালো করে দেখে নিলো সিয়েনা। কিন্তু সে কেবল দেখতে পেলো একটি প্রকোষ্ঠের মতো জায়গা, যেখানে রয়েছে তার দেখা সবচাইতে জঘন্য আর অশ্লীল একটি ভাস্কর্য।

    হায় ঈশ্বর, মেদিচিরা এ পৃথিবীর এতো শিল্পকর্ম থাকতে এটাকে বেছে নিলো?

    তাদের সামনে যে ভাস্কর্যটি আছে সেটা এক মোটা, নগ্ন আর বামন আকৃতির লোকের, বিশালাকারে একটি কচ্ছপের পিঠের উপর বসে আছে সে। তার অণ্ডকোষ চেপে রেখেছে কচ্ছপের খোলসের সাথে। কচ্ছপটির মুখ দিয়ে পানি চুঁইয়ে পড়ছে, যেনো ওটা বেশ অসুস্থ।

    “আমি জানি,” হাটা না থামিয়ে বললো ল্যাংডন। “এটা ব্রাচ্চিও দি বাতোলো-রাজসভার বিখ্যাত বামন। তুমি যদি আমাকে জিজ্ঞেস করো তাহলে আমি বলবো, এটাকে ঐ বিশাল বাথটাবে রাখালেই ভালো হতো।”

    ল্যাংডন ডান দিকে মোড় নিয়ে একটা সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলো। এই সিঁড়িটা একটু আগে পর্যন্ত সিয়েনার চোখে পড়ে নি।

    বের হবার পথ!

    কিন্তু আশার আলোটি বেশিক্ষণ টিকে থাকলো না।

    ল্যাংডনের পেছন পেছন সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে সে বুঝতে পারলো তারা আসলে একটি কানাগলির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে-এই কানাগলির দেয়ালগুলো আবার অন্যগুলোর তুলনায় দ্বিগুন উঁচু। তারচেয়েও বড় কথা, সিয়েনা আঁচ করতে পারলো তাদের দীর্ঘ ভ্রমণটি শেষ হতে যাচ্ছে একটি গুহার মুখের কাছে গিয়ে…দেয়ালে খোদাই করা আছে সুগভীর একটি গুহা। এখান দিয়ে কোথায় যাবো আমরা।

    গুহার মুখের উপরে চাকুসদৃশ্য অসংখ্য ফলা ঝুলে আছে। ভেতরটায় কিছু পাথুরে আকৃতির বস্তু দুমরেমুচরে দেয়ালে গেঁথে আছে যেনো পাথরগুলো গলে গলে পড়ছে…আকৃতিগুলো ক্রমশ মানুষ্য রূপ ধারণ করছে, মাটিতে পুঁতে রাখা মানবদেহের বের হয়ে থাকা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মতো লাগছে দেখতে, যেনো দেয়ালগুলো তাদেরকে গিলে খেয়ে ফেলছে। পুরো দৃশ্যটা সিয়েনাকে স্মরণ করিয়ে দিলো বত্তিচেল্লির সেই লা মাপ্পা দেল ইনফার্নো’র কথা।

    কিন্তু ল্যাংডনকে দেখে মনে হচ্ছে কোনো ভাবান্তর নেই তার মধ্যে, সে গুহার মুখের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। একটু আগে সে ভ্যাটিকান সিটির কথা বলেছিলো কিন্তু সিয়েনা একদম নিশ্চিত ওখানকার চারদেয়ালের ভেতরে এরকম উদ্ভট গুহা নেই।

    আরো কাছে এগোতেই সিয়েনার চোখে পড়লো প্রবেশপথের উপরে থাকা কারুকাজ করা বিমের দিকে বের হয়ে থাকা পাথরের অদ্ভুত আকৃতিগুলো যেনো দুই নারীকে ঘিরে রেখেছে, যাদের দুই পাশে একটি ঢাল রয়েছে, তাতে স্থাপিত আছে ছয়টি বল, অথবা পাল্লে নামে পরিচিত মেদিচিদের বিখ্যাত ক্রেস্ট।

    আচমকা প্রবেশপথ থেকে সরে বাম দিকে মোড় নিয়ে একটা জিনিসের দিকে এগিয়ে গেলো ল্যাংডন। সিয়েনা এটা দেখতে পায় নি এর আগে-গুহার বাম দিকে ধূসর রঙের ছোট্ট একটি দরজা। কাঠের তৈরি এই দরজাটি একেবারেই জীর্ণ আর ক্ষয়িষ্ণু। দেখে মনে হয় না গুরুত্বপূর্ণ কিছু হবে, অনেকটা স্টোরেজ ক্লোসেট কিংবা মালপত্র রাখার ঘরের দরজার মতো।

    দরজাটা খোলার জন্য ল্যাংডন দৌড়ে গেলো সেটার দিকে, কিন্তু দেখতে পেলো দরজায় কোনো হাতল নেই-শুধুমাত্র পিতলের একটি চাবি ঢোকানোর ফুটো আছে-বোঝাই যাচ্ছে এটা ভেতর থেকে খোলা যাবে শুধু।

    “ধুর!” চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে উঠলো ল্যাংডন। এতোক্ষণ ধরে তার মধ্যে যে আশার সঞ্চার হয়েছিলো সেটা উবে গেছে নিমেষে। “আমি ভেবেছিলাম-”

    কথা নেই বার্তা নেই ড্রোনের তীক্ষ্ণ শব্দটা তাদের চারপাশে থাকা দেয়ালের উপরে প্রতিধ্বনি করে উঠলো। সিয়েনা মুখ তুলে চেয়ে দেখলো ড্রোনটা প্রাসাদের উপর থেকে তাদের দিকে ছুটে আসছে।

    ল্যাংডনও ওটা দেখতে পেয়েছ। সিয়েনার হাত ধরে গুহার দিকে ছুটে গেলো সে। গুহার মুখের কাছে এসে মাথা নীচু করে রাখলো যাতে উপর থেকে তাদেরকে দেখা না যায়।

    একেবারে উপযুক্ত জায়গায় এসে পড়েছি, ভাবলো সে। নরকের দরজা দিয়ে হুরমুর করে ঢুকে পড়া!

    .

    অধ্যায় ২৮

    সিকি মাইল পূর্বে, ভায়েন্থা তার বাইকটা পার্ক করলো। পুরনো শহরের পন্তে আল্লে গ্রাজি হয়ে এই পন্তে ভেচ্চিও’র বিখ্যাত পায়েহাটার ব্রিজটির কাছে এসেছে। এই ব্রিজটি পুরনো শহরের সাথে সংযোগ হিসেবে কাজ করে। বাইকের সাথে হেলমেটটা লক করে সকালে বেড়াতে আসা পর্যটকদের ভীড়ে মিশে গিয়ে ব্রিজের দিকে এগোলো সে।

    নদী থেকে মার্চের ঠাণ্ডা বাতাস এসে ঝাঁপটা মারছে চোখেমুখে। ভায়েন্থার ছোটো ছোটো করে ছাটা চুলগুলোকেও নাড়িয়ে দিচ্ছে সেই বাতাস। এরফলে তার মনে পড়ে গেলো, সে দেখতে কেমন সেটা ল্যাংডন জানে। ব্রিজের গোড়ার দিকে অসংখ্য ভ্রাম্যমান দোকানের একটির কাছে এসে থামলো, ঝটপট কিনে নিলো আমো ফ্রিরেঞ্জি’র একটি বেইজবল ক্যাপ। এমনভাবে ক্যাপটা পরলো যাতে চোখ দুটো দূর থেকে দেখা না যায়। ব্রিজের মাঝখানে এসে চামড়ার সুটের উপর হাত বুলিয়ে ভেতরে রাখা পিস্তলটি অনুভব করলো সে। খুবই হালকাঁচালে ব্রিজের একটি পিলারের গায়ে হেলান দিয়ে পিত্তি প্যালেসের দিকে। মুখ করে রইলো। এখান থেকে সে আরনো নদী পার হওয়া লোকজনকে দেখতে পাচ্ছে। এরা সবাই যাচ্ছে পুরনো শহরের প্রাণকেন্দ্রে দিকে। ল্যাংডন পায়ে হেঁটে যাতায়াত করছে, নিজেকে সুধালো। সে যদি পোর্তা রোমানা থেকে বের হতে পারে তাহলে এই ব্রিজটি হবে সবচাইতে যৌক্তিক একটি রুট।

    পশ্চিমে পিত্তি প্যালেসের দিক থেকে পুলিশের সাইরেনের আওয়াজ শুনতে পেলো সে। তবে বুঝতে পারলো না এটা তার জন্যে ভালো নাকি খারাপ সংবাদ। তারা কি এখনও তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে? নাকি এরইমধ্যে ধরে ফেলেছে? কান পেতে কিছু শোনার চেষ্টা করতেই ভায়েন্থা নতুন আরেকটি শব্দ শুনতে পেলো-মাথার উপরে যান্ত্রিক গুঞ্জনের শব্দ। সঙ্গে সঙ্গে আকাশের দিকে তাকাতেই জিনিসটা দেখতে পেলো সে-একটা ছোট্ট রিমোট-কন্ট্রোলড হেলিকপ্টার, প্যালাস থেকে গাছগাছালির উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে উত্তর-পূর্বে ববোলি গার্ডেনের দিকে।

    একটা সার্ভিলেন্স ড্রোন, ভাবলো সে। আবারো আশার আলো দেখতে পেলো ভায়েন্থা। এটা এখনও আকাশে চক্কর দিচ্ছে, তার মানে ব্রুডার এখনও ল্যাংডনকে খুঁজে পায় নি।

    ড্রোনটা প্রচণ্ড গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে, ওটা গার্ডেনের উত্তর পূর্ব দিকটা সার্ভে করছে, জায়গাটা পন্তে ভেচ্চিও আর ভায়েন্থা এখন যেখানে আছে সেখান থেকে খুব কাছেই। এরফলে কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থায় আছে সে।

    ল্যাংডন যদি ব্রুডারকে ধোঁকা দিয়ে থাকে তাহলে সে অবশ্যই এই দিকেই যাচ্ছে।

    ভায়েন্থা দেখতে পেলো ড্রোনটি হঠাৎ করেই ডাইভ দিয়ে উঁচু প্রাচীরের দিকে নেমে যাচ্ছে। এরপর আর দেখতে পেলো না। তবে শব্দ শুনে বুঝতে পারলো ওটা কোনো গাছের নীচে ভেসে আছে…তার মানে গুরুত্বপূর্ণ কিছু চিহ্নিত করতে পেরেছে।

    .

    অধ্যায় ২৯

    খোঁজো, তাহলেই তুমি পাবে, ভাবলো ল্যাংডন, অন্ধকার গুহায় সিয়েনার সাথে গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে আছে সে। আমরা একটা বের হবার পথ খুঁজছিলাম…আর খুঁজে পেলাম কিনা কানাগলি!

    গুহার মাঝখানে আকৃতি হারিয়ে ফেলা ফোয়ারাটি লুকোনোর জন্য ভালো জায়গা ছিলো কিন্তু ল্যাংডন পেছনে উঁকি মেরে বুঝতে পারলো বড্ড দেরি হয়ে গেছে।

    কানাগলির ঠিক উপরে যে দেয়াল আছে সেটার উপর স্থির হয়ে আছে ড্রোনটি। মাটি থেকে মাত্র দশ ফিট উঁচুতে। গুহার দিকে মুখ করে রেখেছে ওটা, যেনো ক্ষিপ্ত কোনো কীটপতঙ্গ রাগে ফুঁসছে আর চেয়ে আছে তাদের। দিকে…অপেক্ষা করছে শিকারের জন্য।

    ল্যাংডন সিয়েনার কানে কানে বললো, “আমার মনে হয় ওটা জানে আমরা এখানে আছি।”

    ড্রোনের তীক্ষ্ণ গুঞ্জনটি গুহার ভেতরে এতোটা জোড়ালো শোনালো যে কানে তালা লাগার জোগার হলো। ল্যাংডনের বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তারা দুজন মানুষ একটি ছোটোখাটো মেকানিক্যাল হেলিকপ্টারের কাছে জিম্মি হয়ে আছে। তারপরও সে জানে, দৌড়ে অন্য কোথাও চলে যাবার চেষ্টা করলেও কোনো লাভ হবে না। তাহলে আমরা এখন কি করবো? এখানে বসে বসে অপেক্ষা করবো? তার পেছনে থাকা ধূসর রঙের কাঠের দরজাটি দিয়ে খুব সহজেই পালানো যেতো, এরকমই পরিকল্পনা করেছিলো সে কিন্তু এটা বুঝতে পারে নি দরজাটা অন্য দিক থেকে খোলা যায়।

    অন্ধকার গুহার ভেতরে ল্যাংডনের চোখ সয়ে এলে চারপাশটা ভালো করে তাকিয়ে দেখলো বের হবার আর কোনো পথ আছে কিনা। এমন কিছুই তার চোখে পড়লো না। গুহার ভেতরে রয়েছে জন্তু-জানোয়ার আর মানুষের ভাস্কর্য, সবগুলোকেই যেনো গুহার দেয়াল গিলে ফেলছে। হতাশ হয়ে ছাদের দিকে তাকালো সে। মাথার উপর ঝুলে আছে অসংখ্য চাকুসদৃশ্য পাথরের ফলার মতো কিছু জিনিস। পানির গুহাতে এরকম জিনিস দেখা যায়। যেনো গলিত পাথর চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়তে গিয়ে জমাট বেধে গেছে বহুকাল আগে।

    মরার জন্য উপযুক্ত জায়গা।

    বুয়োনতালেন্তি গুহা-যার নামকরণ করা হয়েছে এর স্থপতি বানার্দো বুয়োনতালেন্তির নামানুসারে-নিঃসন্দেহে এটি ফ্লোরেন্সের সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক জায়গা। পিত্তি প্যালেসে আসা অল্পবয়সী অতিথিদের মনোরঞ্জনের জন্য এই তিন কক্ষবিশিষ্ট গুহাটি নির্মাণ করা হয়েছিলো। এর সাজসজ্জা করা হয়েছে প্রাকৃতিক আর কল্পরাজ্যের মিশ্রণে গোথিক স্টাইল ব্যবহার করে। মেদিচিদের সময়কালে গুহাটিতে পানির প্রবাহ ছিলো, এরফলে গ্রীষ্মকালে যেমন গুহার ভেতরটা ঠাণ্ডা অনুভূত হতো তেমনি এর পরিবেশও হয়ে উঠতো একেবারে সত্যিকারের গুহার মতো।

    ল্যাংডন আর সিয়েনা লুকিয়ে আছে তিনটি কক্ষের মধ্যে প্রথম কক্ষটিতে, একটা ফোয়ারার ঠিক পেছনে। তাদের চারপাশে মেষপাল, কৃষক, সঙ্গিতজ্ঞ, জন্তু-জানোয়ার, এমনকি মাইকেলাঞ্জেলোর চারজন বন্দীর একটি নকল প্রতিরূপসহ বর্ণিল সব চরিত্র। এরা সবাই যেনো তরলসদৃশ্য দেয়ালের ভেতর থেকে বের হতে চাইছে, মুক্তি পেতে চাইছে। উপরে সকালের আলো ছাদের অকুলাস অর্থাৎ ছোটো ছোটোর ভেতর দিয়ে ফিল্টার হয়ে এসে পড়েছে, এক সময় ওটার মধ্যে বিশাল আকৃতির একটি কাঁচের বল ছিলো। বলের ভেতরে পানিতে সূর্যের আলো এসে পড়তো আর সেটার ভেতরে ঘুরে বেড়াতো লাল টকটকে কার্প মাছ।

    অবাক হয়ে ল্যাংডন ভাবতে লাগলো, রেনেসাঁ আমলের লোকজন যদি এখানে বেড়াতে এসে সত্যি সত্যি কোনো হেলিকপ্টার দেখতো তাহলে কী হতো যেটা কিনা ইটালির জগদ্বিখ্যাত সন্তান লিওনার্দো দা ভিঞ্চির স্বপ্ন ছিলো।

    ঠিক এ সময় ড্রোনের আওয়াজটা থেমে গেলো। একেবারে আচমকা।

    হতভম্ব ল্যাংডন ফোয়ারার পেছন থেকে উঁকি মেরে বাইরের দিকে তাকালো। ড্রোনটা লাভ করেছে পাথরের প্লাজার উপরে। এখন আর সেটাকে ভয়ঙ্কর কিছু বলে মনে হচ্ছে না, এর কারণ সামনের ভিডিও ক্যামেরার লেন্সটি তাদের দিকে তাক করা নেই। অন্য দিকে ঘুরে আছে সেটা। ধূসর রঙের ছোট্ট কাঠের দরজাটার দিকে।

    ল্যাংডনের স্বস্তিদায়ক ভাবটি একেবারেই ক্ষণস্থায়ী হলো। ড্রোনের পেছনে একশ গজ দূরে, বামন আর কচ্ছপের ভাস্কর্যের কাছে তিনজন সশস্ত্র সৈনিক বড়। বড় পা ফেলে এগিয়ে আসছে গুহার দিকে।

    তাদের সবার পরনে অতি পরিচিত কালো ইউনিফর্ম আর কাঁধে সবুজ রঙের মেডালিওন। সামনে যে সৈনিকটি আছে তার পেশীবহুল শরীর আর ফাঁকা দৃষ্টি ল্যাংডনকে স্মরণ করিয়ে দিলো প্লেগ মুখোশের কথা।

    আমি মৃত্যু। ল্যাংডন অবশ্য তাদের ভ্যান কিংবা রহস্যময় সেই সাদা-চুলের মহিলাকে আশেপাশে দেখতে পেলো না।

    আমি জীবন।

    সৈনিকের দল সামনে এগোতেই তাদের মধ্যে একজন সিঁড়ির গোড়ায় থমকে দাঁড়িয়ে আশেপাশে তাকালো। তারপর পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে। অন্য কাউকে এখান দিয়ে নেমে যেতে দেবে না। বাকি দু’জন সৈনিক সিঁড়ি দিয়ে নেমে গুহার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো।

    ল্যাংডন আর সিয়েনা এবার উঠে ভেতরের দিকে দৌড়াতে শুরু করলো-তাদের লক্ষ্য গুহার দ্বিতীয় প্রকোষ্ঠ। এটা একটু ছোটো, গভীর আর বেশি অন্ধকারাচ্ছন্ন। এ জায়গার মাঝখানেও একটি ভাস্কর্য রয়েছে-এক জোড়া নারী-পুরুষ গভীরভাবে আলিঙ্গনাবদ্ধ-এর পেছনেই তারা লুকোবার নতুন জায়গা পেয়ে গেলো।

    মূর্তিটার নীচের বেইজে, অন্ধকারের মধ্যে ল্যাংডন তাকিয়ে দেখলো তাদের আক্রমণকারীরা এদিকেই আসছে। সৈনিক দু’জন ড্রোনের কাছে আসতেই তাদের একজন থেমে নীচু হয়ে ওটা হাতে তুলে নিলো। ক্যামেরাটা পরীক্ষা করে দেখলো সে।

    এই জিনিসটা কি আমাদের অবস্থান চিহ্নিত করতে পেরেছে? চিন্তিত হয়ে ভাবলো ল্যাংডন, সে জানে এর জবাবটা কি।

    পেশীবহুল আর শীতল চোখের তৃতীয় সৈনিকটি না থেমে ল্যাংডনদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। সৈনিকটি গুহার মুখের কাছে এসে পড়লো এখন। সে এসে পড়ছে। ল্যাংডন পেছন ফিরে যে-ই না সিয়েনাকে বলতে যাবে, আর কোনো লাভ হবে না, সব শেষ, ঠিক তখনই অপ্রত্যাশিত একটি জিনিস দেখলো সে।

    সৈনিকটি গুহার ভেতরে না ঢুকে বাম দিকে মোড় নিয়ে উধাও হয়ে গেলো। কোথায় যাচ্ছে?! ও জানে না আমরা কোথায় আছি?

    কয়েক মুহূর্ত পরেই দরজায় জোরে আঘাতের শব্দ শুনতে পেলো ল্যাংডন। ছোট্ট ধূসর দরজাটি, ভাবলো সে। ঐ সৈনিক অবশ্যই জানে ওটা দিয়ে কোথায় যাওয়া যায়।

    .

    পিত্তি প্যালেসের সিকিউরিটি গার্ড আর্নেস্তো রুশো সব সময়ই চাইতো। ইউরোপিয়ান ফুটবল খেলতে কিন্তু ঊনত্রিশ বছর বয়সে অতিরিক্ত ভারি শরীরটা নিয়ে অবশেষে সে বুঝতে পেরেছে তার শৈশবের স্বপ্নটা আর পূরণ হবার নয়। বিগত তিন বছর ধরে আর্নেস্তো পিত্তি প্যালেসে গার্ডের কাজ করে যাচ্ছে, সব সময়ই ক্লোসেট-সাইজের একটা অফিসে বসা আর প্রতিদিন ঐ একই বিরক্তিকর কাজ। কৌতূহলী পর্যটকেরা যে মাঝে মাঝেই তার অফিসের ছোট্ট ধূসর রঙের দরজাটি নক করে এতে আর্নেস্তো মোটেও অবাক হয় না। সাধারণত সে ব্যাপারটা আমলে নেয় না। কিছুক্ষণ ধাক্কাধাক্কি করে ওরা ক্ষান্ত দেয়। তবে আজকের আঘাতগুলো বেশ জোরে জোরে করা হচ্ছে, আর ক্রমাগতভাবেই বাড়ছে সেটা।

    বিরক্ত হয়ে টিভি সেটের দিকে আবার মনোযোগ দিলো আর্নেস্তো, চড়া ভলিউমে ফুটবল খেলা দেখছে সে-ফিওরেন্তিনা বনাম জুভেন্টাস। দরজার আঘাত এবার আরো বেড়ে গেলো। অবশেষে পর্যটকদের গালি দিতে দিতে সঙ্কীর্ণ করিডোর দিয়ে এগিয়ে গেলো সে। মাঝখানে থাকা বিশাল স্টিলের গেটের সামনে এসে থামলো। নির্দিষ্ট কিছু সময় ছাড়া এই গেটটা বন্ধই থাকে।

    প্যাডলকে কম্বিনেশনটা এন্ট্রি করে গেটটা খুলে ফেলে ভেতরে ঢুকে প্রটোকল অনুযায়ী আবারো গেটটা বন্ধ করে কাঠের দরজার দিকে পা বাড়ালো।

    “এ চিউসু!” বন্ধ দরজার এপাশ থেকে চিৎকার করে বললো সে। আশা করলো দরজার ওপাশে যে বা যারা আছে তারা এটা শুনতে পাবে। “নন সি পুয়ো এনারে!”

    দরজায় আঘাত চলছে তো চলছে।

    দাঁতে দাঁত পিষে ফেললো আর্নেস্তো। নিউইয়র্কার, সে একদম নিশ্চিত। তারা যেটা চাইবে সেটাই দিতে হবে। ওদের রেড বুল সকার টিম যে বিশ্বক্রীড়াঙ্গনে সফলতা পায় সেটার একমাত্র কারণ ইউরোপের সেরা সেরা কোচদের নিয়োগ দেয় তারা।

    দরজায় আঘাত অব্যাহতভাবেই চলছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আর্নেস্তো দরজার তালা খুলে কয়েক ইঞ্চি ফাঁক করলো। “এ চিউসু!”

    দরজার আঘাতটি থেমে গেলো অবশেষে, আর ঠিক তখনই আর্নেস্তো দেখতে পেলো তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে শীতল চোখের এক সৈনিক। ভয় পেয়ে এক পা পিছিয়ে গেলো সে। সৈনিকটি তার পরিচয়পত্র তুলে দেখালো কিন্তু আর্নেস্তো সেটা দেখে চিনতে পারলো না।

    “কোসা সাকসিদা?!” সতর্ক হয়ে জানতে চাইলো আর্নেস্তো। কি হচ্ছে কি??

    সৈনিকটির পেছনে আরেকজন হাটু গেড়ে বসে আছে, হাতে একটা জিনিস নিয়ে নাড়াচাড়া করছে সে, দেখে মনে হচ্ছে হেলিকপ্টারের মতো কোনো খেলনা হবে। তার থেকে আরো দূরে আরেকজন সৈনিক সিঁড়ির উপরে দাঁড়িয়ে আছে। আশেপাশে পুলিশের সাইরেনের শব্দ শুনতে পেলো আর্নেস্তো।

    “আপনি কি ইংরেজি জানেন?” সৈনিকটির উচ্চারণ শুনে বোঝা গেলো এটা কোনো নিউইয়কারের নয়। ইউরোপের কোথাও হবে?

    মাথা নেড়ে সায় দিলো আর্নেস্তো। “একটু আধটু জানি।”

    “আজ সকালে কি এই দরজা দিয়ে অন্য কেউ ঢুকেছিলো?”

    “না, সিনর। নেসুনো।”

    “বেশ। তাহলে এটা তালা মেরে রাখুন। কাউকে ঢুকতে কিংবা বের হতে দেবেন না। বুঝতে পেরেছেন?”

    কাঁধ তুললো আর্নেস্তো। আরে, এটাই তো তার কাজ। “সি, বুঝতে পেরেছি। নন দেভে এনত্ৰারে, নে উসিরে নেসুনো।”

    “এখন আমাকে বলুন, এই দরজাটা কি একমাত্র প্রবেশপথ?”

    প্রশ্নটা একটু ভেবে দেখলো আর্নেস্তো। টেকনিক্যালি আজকাল এই দরজাটাকে এক্সিট হিসেবে ধরা হয়, এজন্যে বাইরের দিকে এটার কোনো হাতল নেই, তবে সৈনিকটি তার কাছে কি জানতে চেয়েছে সেটা বুঝতে পেরেছে সে। “হ্যাঁ। এই দরজাটিই একমাত্র প্রবেশপথ। আর কোনো পথ নেই। প্রাসাদের ভেতরে যে আসল প্রবেশপথটি রয়েছে সেটা অনেক বছর ধরেই বন্ধ করে রাখা হয়েছে।

    “ববোলি গার্ডেনে কি আর কোনো লুকানোর জায়গা আছে? মানে যেসব গেট রয়েছে সেগুলো বাদে?”

    “না, সিনর। চারদিকে বড়বড় দেয়াল। এটাই একমাত্র গোপন পথ।”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো সৈনিকটি। “সাহায্য করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।” এরপর আর্নেস্তোকে দরজা বন্ধ করে তালা মেরে রাখার ইশারা করলো সে।

    হতভম্ব আর্নেস্তো কথামতো কাজ করে নিজের অফিসে বসে টিভি’তে ফুটবল ম্যাচ দেখতে লাগলো আবার।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleডিসেপশন পয়েন্ট – ড্যান ব্রাউন
    Next Article রহস্যের ব্যবচ্ছেদ অথবা হিরন্ময় নীরবতা – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    Related Articles

    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    অরিজিন – ড্যান ব্রাউন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    নেমেসিস (বেগ-বাস্টার্ড – ১) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    কন্ট্রাক্ট (বেগ-বাস্টার্ড ২) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    নেক্সাস (বেগ-বাস্টার্ড ৩) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }