Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ইন্দিরা – বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    উপন্যাস বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এক পাতা গল্প98 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ইন্দিরা – ১১-১৫

    একাদশ পরিচ্ছেদ : একটা চোরা চাহনি

    এক দিবস প্রাতে উঠিয়া দেখিলাম, কিছু ঘটার আয়োজন। রমণ বাবু উকীল। তাঁহার একজন মোয়াক্কেল ছিল। দুই দিন ধরিয়া শুনিতেছিলাম, তিনি কলিকাতায় আসিয়াছেন। রমণ বাবু ও তাঁহার পিতা সর্বদা তাঁহার বাড়ীতে যাতায়াত করিতেছিলেন। তাঁহার পিতা যাতায়াত করিয়াছিলেন, তাহার কারণ এই যে, তাঁহার সহিত কারবার-ঘটিত কিছু সম্বন্ধ ছিল। আজ শুনিলাম, তাঁহাকে মধ্যাহ্নে আহারের নিমন্ত্রণ করা হইয়াছে। তাই পাকশাকের কিছু বিশেষ আয়োজন হইতেছে।
    রান্না ভাল চাই—অতএব পাকের ভারটা আমার উপর পড়িল। যত্ন করিয়া পাক করিলাম। আহারের স্থান অন্ত:পুরেই হইল। রামরাম বাবু, রমণ বাবু, ও নিমন্ত্রিত ব্যক্তি আহারে বসিলেন। পরিবেশনের ভার বুড়ীর উপর—আমি বাহিরের লোককে কখন পরিবেশন করি না।
    বুড়ী পরিবেশন করিতেছে—আমি রান্নাঘরে আছি—এমন সময়ে একটা গোলযোগ উপস্থিত হইল। রমণ বাবু বুড়ীকে বড় ধমকাইতেছিলেন। সেই সময়ে একজন রান্নাঘরের ঝি আসিয়া বলিল, “ইচ্ছে করে লোককে অপ্রতিভ করা।”
    জিজ্ঞাসা করিলাম, “কি হয়েছে?”
    ঝি বলিল, “বুড়ী দাদাবাবুর বাটিতে (বুড়া ঝি, দাদাবাবু বলিত)—বাটিতে ডাল দিতেছিল—তিনি তা দেখেও উঁহু! উঁহু! করে হাত বাড়িয়ে দিলেন—সব ডাল হাতে পড়িয়া গেল।”
    আমি এদিকে শুনিতেছিলাম, রমণ বাবু বামনীকে ধমকাইতেছিলেন, “পরিবেশন করতে জান না ত এসো কেন? আর কাকেও থাল দিতে পার নি?”
    রামরাম বাবু বলিলেন, “তোমার কর্ম নয়! কুমোকে পাঠাইয়া দাও গিয়া।”
    গৃহিণী সেখানে নাই; বারণ করে কে? এদিকে খোদ কর্তার হুকুম—অমান্যই বা করি কিপ্রকারে? গেলেই গিন্নী বড় রাগ করিবেন, তাও জানি। দুই চারি বার বুড়ীকে বুঝাইলাম—বলিলাম, “একটু সাবধান হয়ে দিও থুইও”—কিন্তু সে ভয়ে আর যাইতে স্বীকৃত হইল না। কাজেই, আমি হাত ধুইয়া, মুখ মুছিয়া, পরিষ্কার হইয়া, কাপড়খানা গুছাইয়া পরিয়া, একটু ঘোমটা টানিয়া, পরিবেশন করিতে গেলাম। কে জানে যে এমন কাণ্ড বাধিবে? আমি জানি যে, আমি বড় বুদ্ধিমতী—জানিতাম না যে, সুভাষিণী আমায় এক হাটে বেচিতে পারে, আর এক হাটে কিনিতে পারে।
    আমি অবগুণ্ঠনবতী, কিন্তু ঘোমটায় স্ত্রীলোকের স্বভাব ঢাকা পড়ে না। ঘোমটার ভিতর হইতে একবার নিমন্ত্রিত বাবুটিকে দেখিয়া লইলাম।
    দেখিলাম, তাঁহার বয়স ত্রিশ বৎসর বোধ হয়; তিনি গৌরবর্ণ এবং অত্যন্ত সুপুরষ; তাঁহাকে দেখিয়া রমণীমনোহর বলিয়া বোধ হইল। আমি বিদ্যুচ্চমকিতের ন্যায় একটু অন্যমনস্ক হইলাম। মাংসের পাত্র লইয়া একটু দাঁড়াইয়া রহিলাম, আমি ঘোমটার ভিতর হইতে তাঁহাকে দেখিতেছিলাম, এমত সময়ে তিনি মুখ তুলিলেন—দেখিতে পাইলেন যে, আমি ঘোমটার ভিতর হইতে তাঁহার প্রতি চাহিয়া আছি। আমি ত জানিয়া শুনিয়া ইচ্ছাপূর্বক তাঁহার প্রতি কোনপ্রকার কুটিল কটাক্ষ করি নাই। তত পাপ এ হৃদয়ে ছিল না। তবে সাপও বুঝি জানিয়া শুনিয়া ইচ্ছা করিয়া ফণা ধরে না; ফণা ধরিবার সময় উপস্থিত হইলেই ফণা আপনি ফাঁপিয়া উঠে। সাপেরও পাপহৃদয় না হইতে পারে। বুঝি সেইরূপ কিছু ঘটিয়া থাকিবে। বুঝি তিনি একটা কুটিল কটাক্ষ দেখিয়া থাকিবেন। পুরুষ বলিয়া থাকেন যে, অন্ধকারে প্রদীপের মত, অবগুণ্ঠনমধ্যে রমণীর কটাক্ষ অধিকতর তীব্র দেখায়। বোধ হয়, ইনিও সেইরূপ দেখিয়া থাকিবেন। তিনি একটু মাত্র মৃদু হাসিয়া, মুখ নত করিলেন। সে হাসি কেবল আমিই দেখিতে পাইলাম। আমি সমুদয় মাংস তাঁহার পাতে ফেলিয়া দিয়া চলিয়া আসিলাম।
    আমি একটু লজ্জিতা, একটু অসুখী হইলাম। আমি সধবা হইয়াও জন্মবিধবা। বিবাহের সময়ে একবার মাত্র স্বামিসন্দর্শন হইয়াছিল—সুতরাং যৌবনের প্রবৃত্তিসকল অপরিতৃপ্ত ছিল। এমন গভীর জলে ক্ষেপণীনিক্ষেপে বুঝি তরঙ্গ উঠিল ভাবিয়া বড় অপ্রফুল্ল হইলাম। মনে মনে নারীজন্মে সহস্র ধিক্কার দিলাম; মনে মনে আপনাকে সহস্র ধিক্কার দিলাম; মনের ভিতর মরিয়া গেলাম।
    পাকশালায় ফিরিয়া আসিয়া আমার যেন মনে হইল, আমি ইঁহাকে পূর্বে কোথাও দেখিয়াছি। সন্দেহভঞ্জনার্থ, আবার অন্তরাল হইতে ইঁহাকে দেখিতে গেলাম। বিশেষ করিয়া দেখিলাম। দেখিয়া মনে মনে বলিলাম, “চিনিয়াছি।”
    এমন সময়ে রামরাম বাবু, আবার অন্যান্য খাদ্য লইয়া যাইতে ডাকিয়া বলিলেন। অনেকপ্রকার মাংস পাক করিয়াছিলাম—লইয়া গেলাম। দেখিলাম, ইনি কটাক্ষটি মনে করিয়া রাখিয়াছেন। রামরাম দত্তকে বলিলেন, “রামরাম বাবু, আপনার পাচিকাকে বলুন যে, পাক অতি পরিপাটি হইয়াছে।”
    রামরাম ভিতরের কথা কিছু বুঝিলেন না, বলিলেন, “হাঁ, উনি রাঁধেন ভাল।”
    আমি মনে মনে বলিলাম, “তোমার মাথামুণ্ড রাঁধি।”
    নিমন্ত্রিত বাবু কহিলেন, “কিন্তু এ বড় আশ্চর্য যে, আপনার বাড়ীতে দুই একখানা ব্যঞ্জন আমাদের দেশের মত পাক হইয়াছে।”
    আমি মনে মনে ভাবিলাম, “চিনিয়াছি।” বস্তুত: দুই একখানা ব্যঞ্জন আমাদের নিজদেশের প্রথামত পাক করিয়াছিলাম।
    রামরাম বলিলেন, “তা হবে, ওঁর বাড়ী এ দেশে নয়।”
    ইনি এবার যো পাইলেন, একবারে আমার মুখ পানে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিয়া বলিলেন, “তোমাদের বাড়ী কোথায় গা?”
    আমার প্রথম সমস্যা কথা কই কি না কই। স্থির করিলাম, কথা কহিব।
    দ্বিতীয় সমস্যা, সত্য বলিব, না মিথ্যা বলিব। স্থির করিলাম, মিথ্যা বলিব। কেন এরূপ স্থির করিলাম, তাহা যিনি স্ত্রীলোকের হৃদয়কে চাতুর্যপ্রিয়, বক্রপথগামী করিয়াছেন, তিনিই জানেন। আমি ভাবিলাম, আবশ্যক হয়, সত্য কথা বলা আমার হাতেই রহিল, এখন আর একটা কথা বলিয়া দেখি। এই ভাবিয়া আমি উত্তর করিলাম, “আমাদের বাড়ী কালাদীঘি।”
    তিনি চমকিয়া উঠিলেন। ক্ষণেক পরে মৃদুস্বরে কহিলেন, “কোন্ কালাদীঘি, ডাকাতে কালাদীঘি?”
    আমি বলিলাম, “হাঁ।”
    তিনি আর কিছু বলিলেন না।
    আমি মাংসপাত্র হাতে করিয়া দাঁড়াইয়া রহিলাম। দাঁড়াইয়া থাকা আমার যে অকর্তব্য, তাহা আমি ভুলিয়াই গিয়াছিলাম। এই মাত্র যে আপনাকে সহস্র ধিক্কার দিয়াছিলাম, তাহা ভুলিয়া গেলাম। দেখিলাম যে, তিনি আর ভাল করিয়া আহার করিতেছেন না। তাহা দেখিয়া রামরাম দত্ত বলিলেন, “উপেন্দ্র বাবু, আহার করুন না।” আমি নাম শুনিবার আগেই চিনিয়াছিলাম, ইনি আমার স্বামী।
    আমি পাকশালায় গিয়া পাত্র ফেলিয়া একবার অনেক কালের পর আহ্লাদ করিতে বসিলাম। রামরাম দত্ত বলিলেন, “কি পড়িল?” আমি মাংসের পাত্রখানা ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিয়াছিলাম।

    দ্বাদশ পরিচ্ছেদ : হারাণীর হাসিবন্ধ

    এখন হইতে এই ইতিবৃত্তমধ্যে পাঁচ শত বার আমার স্বামীর নাম করা আবশ্যক হইবে। এখন তোমরা পাঁচজন রসিকা মেয়ে একত্র কমিটীতে বসিয়া পরামর্শ করিয়া বলিয়া দাও, আমি কোন্ শব্দ ব্যবহার করিয়া তাঁহার নাম করিব? পাঁচ শত বার “স্বামী” “স্বামী” করিয়া কাণ জ্বালাইয়া দিব? না জামাই বারিকের দৃষ্টান্তানুসারে, স্বামীকে “উপেন্দ্র” বলিতে আরম্ভ করিব? না, “প্রাণনাথ” “প্রাণকান্ত” “প্রাণেশ্বর” “প্রাণপতি” এবং “প্রাণাধিকে”র ছড়াছড়ি করিব? তাঁহাকে যে কি বলিয়া ডাকিব, এমন কথা পোড়া দেশের ভাষায় নাই। আমার এক সখী, (দাসদাসীগণের অনুকরণ করিয়া) স্বামীকে “বাবু” বলিয়া ডাকিত—কিন্তু শুধু বাবু বলিতে তাহার মিষ্ট লাগিল না—সে মনোদু:খে স্বামীকে শেষে “বাবুরাম” বলিয়া ডাকিতে আরম্ভ করিল। আমারও ইচ্ছা করিতেছে, আমি তাই করি।
    মাংসপাত্র ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিয়া, মনে মনে স্থির করিলাম, “যদি বিধাতা হারাধন মিলাইয়াছে-তবে ছাড়া হইবে না। বালিকার মত লজ্জা করিয়া সব নষ্ট না করি।”
    এই ভাবিয়া আমি এমত স্থানে দাঁড়াইলাম যে, ভোজনস্থান হইতে বহির্বাটিতে গমনকালে যে এদিক ওদিক চাহিতে চাহিতে যাইবে, সে দেখিতে পাইবে। আমি মনে মনে বলিলাম যে, “যদি ইনি ওদিক্ চাহিতে চাহিতে যাইবে, সে দেখিতে পাইবে। আমি মনে মনে বলিলাম যে, “যদি ইনি এদিক্ ওদিক্ চাহিতে চাহিতে না যান, তবে আমি কুড়ি বৎসর বয়স পর্যন্ত পুরুষের চরিত্র কিছুই বুঝি নাই।” আমি স্পষ্ট কথা বলি, তোমরা আমাকে মার্জনা করিও—আমি মাথার কাপড় বড় খাটো করিয়া দিয়া দাঁড়াইয়াছিলাম। এখন লিখিতে লজ্জা করিতেছে, কিন্তু তখন আমার কি দায়, তাহা মনে করিয়া দেখ।
    অগ্রে অগ্রে রমণ বাবু গেলেন; তিনি চারিদিক চাহিতে চাহিতে গেলেন, যেন খবর লইতেছেন, কে কোথায় আছে। তারপর রামরাম দত্ত গেলেন—তিনি কোন দিকে চাহিলেন না। তার পর আমার স্বামী গেলেন—তাঁহার চক্ষু যেন চারি দিকে কাহার অনুসন্ধান করিতেছিল। আমি তাঁহার নয়নপথে পড়িলাম। তাঁহার চক্ষু আমারই অনুসন্ধান করিতেছিল, তাহা বিলক্ষণ জানিতাম। তিনি আমার প্রতি চাহিবামাত্র, আমি ইচ্ছাপূর্বক—কি বলিব, বলিতে লজ্জা করিতেছে—সর্পের যেমন চক্রবিস্তার স্বভাবসিদ্ধ, কটাক্ষও আমাদিগের তাই। যাঁহাকে আপনার স্বামী বলিয়া জানিয়াছিলাম, তাঁহার উপর একটু অধিক করিয়া বিষ ঢালিয়া না দিব কেন? বোধ হয়, “প্রাণনাথ” আহত হইয়া বাহিরে গেলেন।
    আমি তখন হারাণীর শরণাগত হইব মনে করিলাম। নিভৃতে ডাকিবামাত্র সে হাসিতে হাসিতে আসিল। সে উচ্চ হাস্য করিয়া বলিল, “পরিবেশনের সময় বামন ঠাকুরাণীর নাকালটা দেখিয়াছিলে?” উত্তরের অপেক্ষা না করিয়া সে আবার হাসির ফোয়ারা খুলিল।
    আমি বলিলাম, “তা জানি, কিন্তু আমি তার জন্য তোকে ডাকি নাই। আমার জন্মের শোধ একবার উপকার কর। ঐ বাবুটি কখন যাইবেন, আমাকে শীঘ্র খবর আনিয়া দে।”
    হারাণী একেবারে হাসি বন্ধ করিল। এত হাসি, যেন ধুঁয়ার অন্ধকারে আগুন ঢাকা পড়িল। হারাণী গম্ভীরভাবে বলিল, “ছি! দিদি ঠাকরুন! তোমার এ রোগ আছে, তা জানিতাম না।”
    আমি হাসিলাম। বলিলাম, “মানুষের সকল দিন সমান যায় না। এখন তুই গুরুমহাশয় গিরি রাখ্—আমার এ উপকার করবি কি না বল।”
    হারাণী বলিল, “কিছুতেই আমা হইতে এ কাজ হইবে না।”
    আমি খালি হাতে হারাণীর কাছে আসি নাই। মাহিয়ানার টাকা ছিল; পাঁচটা তাহার হাতে দিলাম। বলিলাম, “আমার মাথা খাস্, এ কাজ তোকে করিতেই হইবে।”
    হারাণী টাকা কয়টা ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিতেছিল, কিন্তু তাহা না দিয়া, নিকটে উনান নিবাইবার এক ঝুড়ি মাটি ছিল, তাহার উপর রাখিয়া দিল। বলিল—অতি গম্ভীরভাবে, আর হাসি নাই—“তোমার টাকা ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিতেছিলাম, কিন্তু শব্দ হইলে একটা কেলেঙ্কারী হইবে, তাই আস্তে আস্তে এইখানে কুড়াইয়া লও। আর এসকল কথা মুখে এন না।”
    আমি কাঁদিয়া ফেলিলাম। হারাণী বিশ্বাসী, আর সকলে অবিশ্বাসী, আর কাহাকে ধরিব? আমার কান্নার প্রকৃত তাৎপর্য সে জানিত না। তথাপি তার দয়া হইল। সে বলিল, “কাঁদ কেন? চেনা মানুষ না কি?”
    আমি একবার মনে করিলাম, হারাণীকে সব খুলিয়া বলি। তার পর ভাবিলাম, সে এত বিশ্বাস করিবে না, একটা বা গণ্ডগোল করিবে। ভাবিয়া চিন্তিয়া, স্থির করিলাম, সুভাষিণী ভিন্ন আমার গতি নাই। সেই আমার বুদ্ধি, সেই আমার রক্ষাকারিণী—তাহাকে সব খুলিয়া বলিয়া পরামর্শ করি গিয়া। হারাণীকে বলিলাম, “চেনা মানুষ বটে—বড় চেনা, সকল কথা শুনিলে তুই বিশ্বাস করিবি না, তাই তোকে সকল কথা ভাঙ্গিয়া বলিলাম না। কিছু দোষ নাই।”
    “কিছু দোষ নাই” বলিয়া একটু ভাবিলাম। আমারই পক্ষে কিছু দোষ নাই, কিন্তু হারাণীর পক্ষে? দোষ আছে বটে। তবে তাকে কাদা মাখাই কেন? তখন সেই “বাজিয়ে যাব মল” মনে পড়িল। কুতর্কে মনকে বুঝাইলাম। যাহার দুর্দশা ঘটে, সে উদ্ধারের জন্য কুতর্ক অবলম্বন করে। আমি হারাণীকে আবার বুঝাইলাম, “কিছু দোষ নাই।”
    হা। তোমাকে কি তাঁর সঙ্গে দেখা করিতে হইবে?
    আমি। হাঁ।
    হা। একা?
    আমি। একা।
    হা। আমার বাপের সাধ্য নহে।
    আমি। আর বৌ ঠাকুরাণী যদি হুকুম দেন?
    হা। তুমি কি পাগল হয়েছ? তিনি কুলের কুলবধূ—সতী লক্ষ্মী, তিনি কি এ সব কাজে হাত দেন!
    আমি। যদি বারণ না করেন, যাবি?
    হারাণী। যাব, কিন্তু টাকা নিব না। তোমার টাকা তুমি নাও।
    আমি। আচ্ছা, তোকে যেন সময়ে পাই।
    আমি তখন চোখের জল মুছিয়া সুভাষিণীর সন্ধানে গেলাম। তাহাকে নিভৃতেই পাইলাম। আমাকে দেখিয়া সুভাষিণীর সেই সুন্দর মুখখানি, যেন সকালের পদ্মের মত, যেন সন্ধ্যাবেলার গন্ধরাজের মত, আহ্লাদে ফুটিয়া উঠিল—সর্ব্বাঙ্গ, যেন সকালবেলার সর্বত্র পুষ্পিত শেফালিকার মত, যেন চন্দ্রোদয়ে নদীস্রোতের মত, আনন্দে প্রফুল্ল হইল। হাসিয়া আমার কাণের কাছে মুখ আনিয়া সুভাষিণী জিজ্ঞাসা করিল, “কেমন চিনিয়াছ ত?”
    আমি আকাশ থেকে পড়িলাম। বলিলাম, “সে কি? তুমি কেমন করে জানলে?” সুভাষিণী মুখ চোখ ঘুরাইয়া বলিল, “আহা:, তোমার সোণার চাঁদ বুঝি আপনি এসে ধরা দিয়েছে? আমরা যাই আকাশে ফাঁদ পাততে জানি, তাই তোমার আকাশের চাঁদ ধরে এনে দিয়েছি!”
    আমি বলিলাম, “তোমার কে? তুমি আর র-বাবু?”
    সু। না ত আবার কে? তুমি, তোমার স্বামী শ্বশুরের আর তাঁদের গাঁয়ের নাম বলিয়া দিয়াছিলে, মনে আছে? তাই শুনিয়াই র-বাবু চিনিতে পারিলেন। তোমার উ-বাবুর একটা বড় মোকদ্দমা তাঁর হাতে ছিল—তারই ছল করিয়া তোমার উ-বাবুকে কলিকাতায় আসিতে লিখিলেন। তার পর নিমন্ত্রণ।
    আমি। তার পর পাতিয়া বুড়ীর দালটুকু নেওয়া।
    সু। হাঁ, সেটাও আমাদের ষড়্য়‍যন্ত্র।
    আমি। তা, আমার পরিচয় কিছু দেওয়া হয়েছে কি?
    সু । আ সর্বনাশ! তা কি দেওয়া যায়? তোমাকে ডাকাতে কেড়ে নিয়ে গিয়েছিল, তার পর কোথায় গিয়েছিলে, কি বৃত্তান্ত, তা কে জানে? তোমার পরিচয় পেলে কি ঘরে নেবে? বলবে একটা গছিয়ে দিচ্চে। র-বাবু বলেন, এখন তুমি নিজে যা করিতে পার।
    আমি। আমি একবার কপাল ঠুকিয়া দেখিব-না হয় ডুবিয়া মরিব। কিন্তু আমার সঙ্গে দেখা না হইলে, কি করিব?
    সু। কখন্ দেখা করবে, কোথায় বা দেখা করবে?
    আমি। তোমরা যদি এত করিয়াছ, তবে এ বিষয়েও একটু সাহায্য কর। তাঁর বাসায় গেলে দেখা হইবে না,–কেই বা আমাকে নিয়ে যাবে, কেই বা দেখা করাইবে? এইখানেই দেখা করিতে হইবে।
    সু। কখন্?
    আমি। রাত্রে, সবাই শুইলে।
    আমি। তা বৈ আর গতি কি? দোষই বা কি—স্বামী যে।
    সু। না, দোষ নাই। কিন্তু তাহা হইলে তাঁকে রাত্রে আটকাইতে হয়। নিকটে তাঁর বাসা; তা ঘটিবে কি? দেখি একবার র-বাবুর সঙ্গে পরামর্শ করে।
    সুভাষিণী রমণ বাবুকে ডাকাইল। তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা হইল, তাহা আমাকে আসিয়া বলিল। বলিল, “র”-বাবু যাহা পারেন তাহা এই—তিনি এখন মোকদ্দমার কাগজপত্র দেখিবেন না—একটা ওজর করিয়া রাখিবেন। কাগজ দেখিবার জন্য সন্ধ্যার পর সময় অবধারণ করিবেন। সন্ধ্যার পর তোমার স্বামী আসিলে, কাগজপত্র দেখিবেন। কাগজপত্র দেখিতে দেখিতে একটু রাত্র করিবেন। রাত্র হইলে আহারের জন্য অনুরোধ করিবেন। কিন্তু তার পর তোমার বিদ্যায় যা থাকে তা করিও। রাত্রে থাকিতে আমরা কি বলিয়া অনুরোধ করিব?”
    আমি বলিলাম, “সে অনুরোধ তোমাদের করিতে হইবে না। আমিই করিব। আমার অনুরোধে যাহাতে শুনেন, তাহা করিয়া রাখিয়াছি। দুই একটা চাহনি ছুঁড়িয়া মারিয়াছিলাম, তিনি তাহা ফিরাইয়া দিয়াছেন। লোক ভাল নহেন। এখন আমার অনুরোধ তাঁহার কাছে পাঠাই কিপ্রকারে? এক ছত্র লিখিয়া দিব। সেই কাগজটুকু কেহ তাঁর কাছে দিয়ে এলেই হয়।”
    সু। কোন চাকরের হাতে পাঠাও না?
    আমি। যদি জন্মজন্মান্তরেও স্বামী না পাই, তবুও পুরুষ মানুষকে একথা বলিতে পারি না।
    সু। তা বটে। কোন ঝি?
    আমি। ঝি বিশ্বাসী কে? একটা গোলমাল বাধাইবে, তখণ সব খোওয়াব।
    সু। হারাণী বিশ্বাসী।
    আমি। হারাণীকে বলিয়াছিলাম। বিশ্বাসী বলিয়া সে নারাজ। তবে তোমার একটু ইঙ্গিত পাইলে সে যাইতে পারে। কিন্তু তোমায় এমন ইঙ্গিত করিতে কি প্রকারে বলিতে পারি? মরি, ত আমি একাই মরিব।–পোড়া চোখে আবার জল আসিল।
    সু। হারাণী আমার কথা কি বলিয়াছে?
    আমি। তুমি যদি বারণ না কর, তবে সে যাইতে পারে।
    সুভাষিণী অনেক্ষণ ভাবিল। বলিল, “সন্ধ্যার পর তাকে এই কথার জন্য আসিতে বলিও।”

    ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ : আমাকে একজামিন দিতে হইল

    সন্ধ্যার পর আমার স্বামী কাগজপত্র লইয়া রমণ বাবুর কাছে আসিলেন। সংবাদ পাইয়া, আমি আর একবার হারাণীর হাতে পায়ে ধরিলাম। হারাণী সেই কথাই বলে, “বৌদিদি যদি বারণ না করে, তবে পারি। তবে জানিব, এতে দোষ নাই।” আমি বলিলাম, “যাহা হয় কর্—আমার বড় জ্বালা।”
    এই ইঙ্গিত পাইয়া হারাণী একটু হাসিতে হাসিতে সুভাষিণীর কাছে ছুটিল। আমি তাহার প্রতীক্ষা করিতে লাগিলাম। দেখিলাম যে, সে হাসির ফোয়ারা খুলিয়া দিয়া, আলু থালু কেশ বেশ সামলাইতে সামলাইতে, হাঁপাইতে হাঁপাইতে, ছুটিয়া আসিল। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “কি গো এত হাসি কেন?”
    হা। দিদি, এমন জায়গায়ও মানুষকে পাঠায়? প্রাণটা গিয়াছিল আর কি!
    আমি। কেন গো?
    হা। আমি জানি বৌদিদির ঘরে ঝাঁটা থাকে না, দরকারমত ঝাঁটা লইয়া গিয়া আমরা ঘর ঝাঁটাইয়া আসি। আজ দেখি যে, বৌদিদির হাতের কাছেই কে ঝাঁটা রাখিয়া আসিয়াছে। আমি যেমন গিয়া বলিলাম, “তা যাব কি?” অমনি বৌদিদি সেই ঝাঁটা লইয়া আমাকে তাড়াইয়া মারিতে আসিল। ভাগ্যিস পালাতে জানি, তাই পালিয়ে বাঁচলেম। নহিলে খেঙ্গরা খেয়ে প্রাণটা গিয়েছিল আর কি? তবু এক ঘা বুঝি পিঠে পড়েছে—দেখ দেখি দাগ হয়েছে কি না?’
    হারাণী হাসিতে হাসিতে আমাকে পিঠ দেখাইল। মিছে কথা—দাগ ছিল না। তখন সে বলিল, “এখন কি করতে হবে বল—করে আসি!”
    আমি। ঝাঁটা খেয়ে যাবি?
    হা। ঝাঁটা মেরেছে—বারণ ত করে নি। আমি বলেছিলাম, বারণ না করে ত যাব।
    আমি। ঝাঁটা কি বারণ না?
    হা। হা, দেখ দিদিমণি, বৌদিদি তখন ঝাঁটা তোলে, তখন তার ঠোঁটের কোণে একটু হাসি দেখেছিলাম। তা কি করতে হবে, বল।
    আমি তখন এক টুকরা কাগজে লিখিলাম।
    “আমি আপনাকে মন:প্রাণ সমর্পণ করিয়াছি। গ্রহণ করিবেন কি? যদি করেন, তবে আজ রাত্রিতে এই বাড়ীতে শয়ন করিবেন। ঘরের দ্বার যেন খোলা থাকে।
    সেই পাচিকা।”
    পত্র লিখিয়া, লজ্জায় ইচ্ছা করিতে লাগিল, পুকুরের জলে ডুবিয়া থাকি, কি অন্ধকারে লুকাইয়া থাকি। তা কি করিব? বিধাতা যেমন ভাগ্য দিয়াছেন! বুঝি আর কখন কোন কুলবতীর কপালে এমন দুর্দশা ঘটে নাই।
    কাগজটা মুড়িয়াসুড়িয়া হারাণীকে দিলাম। বলিলাম, “একটু সবুর।” সুভাষিণীকে বলিলাম, “একবার দাদাবাবুকে ডাকিয়া পাঠাও। যাহা হয়, একটা কথা বলিয়া বিদায় দিও।” সুভাষিণী তাই করিল। রমণ বাবু উঠিয়া আসিলে, হারাণীকে বলিলাম, “এখন যা।” হারাণী গেল, কিছু পরে কাগজটা ফেরত দিল। তার এক কোণে লেখা আছে, “আচ্ছা।” আমি তখন হারাণীকে বলিলাম, “যদি এত করিলি, তবে আর একটু করিতে হইবে। দুপুর রাত্রে আমাকে তাঁর শুইবার ঘরটা দেখাইয়া দিয়া আসিতে হইবে।”
    হা। আচ্ছা, কোন দোষ নাই ত?
    আমি। কিছু না। উনি আর জন্মে আমার স্বামী ছিলেন।
    হা। আর জন্মে, কি এ জন্মে, ঠিক বুঝিতে পারিতেছি না।
    আমি হাসিয়া বলিলাম, “চুপ।”
    হারাণী হাসিয়া বলিল, “যদি এ জন্মের হন, তবে আমি পাঁচ শত টাকা বখ‍‍শিশ নিব; নহিলে আমার ঝাঁটার ঘা ভাল হইবে না।”
    আমি তখন সুভাষিণীর কাছে গিয়া এসকল সংবাদ দিলাম। সুভাষিণী শাশুড়ীকে বলিয়া আসিল, “আজ কুমুদিনীর অসুখ হইয়াছে; সে রাঁধিতে পারিবে না। সোণার মাই রাঁধুক।”
    সোণার মা রাঁধিতে গেল—সুভাষিণী আমাকে লইয়া গিয়া ঘরে কবাট দিল। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “এ কি, কয়েদ কেন?” সুভাষিণী বলিল, “তোমায় সাজাইব।”
    তখন আমার মুখ পরিষ্কার করিয়া মুছাইয়া দিল। চুলে সুগন্ধ তৈল মাখাইয়া, যত্নে খোঁপা বাঁধিয়া দিল; বলিল, “এ খোঁপার হাজার টাকা মূল্য, সময় হইলে আমায় এ হাজার টাকা পাঠাইয়া দিস।” তার পর আপনার একখানা পরিষ্কার, রমণীমনোহর বস্ত্র লইয়া জোর করিয়া পরাইতে লাগিল। সে যেরূপ টানাটানি করিল, বিবস্ত্রা হইবার ভয়ে আমি পরিতে বাধ্য হইলাম। তার পর আপনার অলঙ্কাররাশি আনিয়া পরাইতে আসিল। আমি বলিলাম, “এ আমি কিছুতেই পরিব না।”
    তার জন্য অনেক বিবাদ বচসা হইল—আমি কোন মতেই পরিলাম না দেখিয়া সে বলিল, “তবে, আর এক সুট আনিয়া রাখিয়াছি, তাই পর।”
    এই বলিয়া সুভাষিণী একটা ফুলের জার্ডিনিয়র হইতে বাহির করিয়া মল্লিকা ফুলের অফুল্ল কোরকের বালা পরাইল, তাহার তাবিজ, তাহারই বাজু, গলায় তারই দোনর মালা। তার পর এক জোড়া নূতন সোণার ইয়ার‍রিং বাহির করিয়া বলিল, “এ আমি নিজের টাকায় র—বাবুকে দিয়া কিনিয়া আনাইয়াছি—তোমাকে দিবার জন্য। তুমি যেখানে যখন থাক, এ পরিলে আমাকে তুমি মনে করিবে। কি জানি ভাই, আজ বৈ তোমার সঙ্গে যদি দেখা না হয়—ভগবান তাই করুন,–তাই তোমাকে আজ ইয়ার্া‍রিং পরাইব। এতে আর না বলিও না।”
    বলিতে বলিতে সুভাষিণী কাঁদিল। আমারও চক্ষে জল আসিল, আমি আর না বলিতে পারিলাম না। সুভাষিণী ইয়ার‍‍রিং পরাইল।
    সাজসজ্জা শেষ হইলে সুভাষিণীর ছেলেকে ঝি দিয়া গেল। ছেলেটিকে কোলে লইয়া তাহার সঙ্গে গল্প করিলাম। সে একটু গল্প শুনিয়া ঘুমাইয়া পড়িল। তার পর মনে একটি দু:খের কথা উদয় হইয়াছিল, তাও এ সুখের মাঝে সুভাষিণীকে না বলিয়া থাকিতে পারিলাম না। বলিলাম, “আমি আহ্লাদিত হইয়াছি, কিন্তু মনে মনে তাঁহাকে একটু নিন্দা করিতেছি। আমি চিনিয়াছি যে, তিনি আমার স্বামী, এই জন্য আমি যাহা করিতেছি, তাহাতে আমার বিবেচনায়, দোষ নাই। কিন্তু তিনি যে আমাকে চিনিতে পারিয়াছেন, এমন কোন মতেই সম্ভবে না। আমি তাঁহাকে বয়:প্রাপ্ত অবস্থায় দেখিয়াছিলাম। এজন্য আমার প্রথমেই সন্দেহ হইয়াছিল। তিনি আমাকে একাদশ বৎসরের বালিকা দেখিয়াছিলেন মাত্র। তিনি আমাকে চিনিতে পারিয়াছেন, এমন কোন লক্ষণও দেখি নাই। অতএব তিনি আমাকে পরস্ত্রী জানিয়া যে আমার প্রণয়াশায় লুব্ধ হইলেন, শুনিয়া মনে মনে বড় নিন্দা করিতেছি। কিন্তু তিনি স্বামী, আমি স্ত্রী,–তাঁহাকে মন্দ ভাবা আমার অকর্তব্য বলিয়া সেকথার আর আলোচনা করিব না। মনে মনে সঙ্কল্প করিলাম, যদি কখনও দিন পাই, তবে এ স্বভাব ত্যাগ করাইব।”
    সুভাষিণী আমার কথা শুনিয়া বলিল, “তোর মত বাঁদর গাছে নাই, ওঁর যে স্ত্রী নেই।”
    আমি। আমার কি স্বামী আছে না কি?
    সু। আ মলো! মেয়ে মানুষে পুরুষ মানুষে সমান! তুই কমিসেরিয়েটের কাজ করে টাকা নিয়ে আয় না দেখি?
    আমি। ওরা পেটে ছেলে ধরিয়া, প্রসব করিয়া, মানুষ করুক, আমি কমিসেরিয়েটে যাইব। যে যা পারে, সে তা করে। পুরুষ মানুষের ইন্দ্রিয় দমন কি এতই শক্ত?
    সু। আচ্ছা, আগে তোর ঘর হোক, তারপর ঘরে আগুন দিস। ও সব কথা রাখ।কেমন করে স্বামীর মন ভুলাবি, তার একজামিন দে দেখি? তা নইলে ত তোর গতি নেই।
    আমি একটু ভাবিত হইয়া বলিলাম, “সে বিদ্যা ত কখনও শিখি নাই।”
    সু। তবে আমার কাছে শেখ। আমি এ শাস্ত্রে পণ্ডিত, তা জানিস?
    সু। তবে শেখ। তুই যেন পুরুষ মানুষ। আমি কেমন করিয়া তোর মন ভুলাই দেখ।
    এই বলিয়া পোড়ারমুখী, মাথায় একটু ঘোমটা টানিয়া, সযত্নে স্বহস্তে প্রস্তুত সুবাসিত একটি পান আনিয়া আমাকে খাইতে দিল। সে পান সে কেবল রমণ বাবুর জন্য রাখে, আর কাহাকেও দেয় না। এমন কি, আপনিও কখনও খায় না। রমণ বাবুর আলবোলাটা সেখানে ছিল, তাহাতে কল্কে বসান; গুলের ছাই ছিল মাত্র; তাই আমার সমুখে ধরিয়া দিয়া, ফুঁ দিয়া ধরান, সুভাষিণী নাটিত করিল। তার পর, ফুল দিয়া সাজান তালবৃন্তখানি হাতে লইয়া বাতাস করিতে লাগিল। হাতের বালাতে চুড়িতে বড় মিঠে মিঠে বাজিতে লাগিল।
    আমি বলিলাম, “ভাই! এ ত দাসীপনা—দাসীপনায় আমার কতদূর বিদ্যা, তারই পরিচয় দিবার জন্য কি তাঁকে আজ ধরিয়া রাখিলাম?”
    সুভাষিণী বলিল, “আমরা দাসী না ত কি?”
    আমি বলিলাম, “যখন তাঁর ভালবাসা জন্মিবে, তখন দাসীপনা চলিবে। তখন পাখা করিব, পা টিপিব, পান সাজিয়া দিব, তামাকু ধরাইয়া দিব। এখনকার ওসব নয়।”
    তখন সুভাষিণী হাসিতে হাসিতে আমার কাছে আসিয়া বসিল। আমার হাতখানা আপনার হাতের ভিতর তুলিয়া লইল, মিঠে মিঠে গল্প করিতে লাগিল। প্রথম প্রথম, হাসিতে হাসিতে, পান চিবাইতে চিবাইতে, কাণবালা দোলাইয়া, সে যে সং সাজিয়াছিল, তারই অনুরূপ কথা কহিতে লাগিল। কথায় কথায় সে ভাব ভুলিয়া গেল। সখীভাবেই কথা কহিতে লাগিল। আমি যে চলিয়া যাইব, সে কথা পাড়িল। চক্ষুতে তার এক বিন্দু জল চক চক করিতে লাগিল। তখন তাহাকে প্রফুল্ল করিবার জন্য বলিলাম, “যা শিখাইলে, তা স্ত্রীলোকের অস্ত্র বটে, কিন্তু এখন উ-বাবুর উপর খাটিবে কি?”
    সুভাষিণী তখন হাসিয়া বলিল, “তবে আমার ব্রহ্মাস্ত্র শিখে নে।”
    এই বলিয়া, মাগী আমার গলা বেড়িয়া হাত দিয়া আমার মুখখানা তুলিয়া ধরিয়া, আমার মুখচুম্বন করিল। এক ফোঁটা জল, আমার গালে পড়িল।
    ঢোক গিলিয়া আমার চোখের জল চাপিয়া, আমি বলিলাম, “এ যে ভাই সঙ্কল্প না হতে দক্ষিণা দেওয়া শিখাইতেছিস।”
    সুভাষিণী বলিল, “তোর তবে বিদ্যা হবে না। তুই কি জানিস, একজামিন দে দেখি। এই আমি যেন উ-বাবু এই বলিয়া সে সোফার উপর জমকাইয়া বসিয়া,–হাসি রাখিতে না পারিয়া, মুখ কাপড় গুঁজিতে লাগিল। সে হাসি থামিলে বলিল, “একজামিন দে”| তখন যে বিদ্যার পরিচয় পাঠক পশ্চাৎ পাইবেন,সিভাষিনীকেও তাহার কিছু পরিচয় দিলাম।সুভাষিনী আমাকে সোফা হইতে ঠেলিয়া ফেলিয়া দিল—বলিল “দূর হ পাপিষ্ঠা! তুই আস্ত কেউটে!”
    আমি বলিলাম, “কেন ভাই?”
    সুভাষিণী বলিল, “ও হাসি চাহনিতে পুরুষ মানুষ টিকে? মরিয়া ভূত হয়।”
    আমি। তবে একজামিন পাস?
    সু। খুব পাস—কমিসেরিয়েটের এক-শ ঊনসত্তর পুরুষেও এমন হাসি চাহনি কখন দেখে নাই। মিন্খ‍সের মুণ্ডটা যদি ঘুরে যায়, ত একটু বাদামের তেল দিস্।
    আমি। আচ্ছা। এখন সাড়া শব্দে বুঝিতে পারিতেছি, বাবুদের খাওয়া হইয়া গেল। রমণ বাবুর ঘরে আসিবার সময় হইল, আমি এখন বিদায় হই। যা শিখিয়াছিলে, তার মধ্যে একটা বড় মিষ্ট লাগিয়াছিল—সেই মুখচুম্বনটি। এসো আর একবার শিখি।
    তখন সুভাষিণী আমার গলা ধরিল, আমি তার গলা ধরিলাম। গাঢ় আলিঙ্গনপূর্বক পরস্পরে মুখচুম্বন করিয়া, গলা ধরাধরি করিয়া, দুই জনে অনেক্ষণ কাঁদিলাম। এমন ভালবাসা কি আর হয়? সুভাষিণীর মত আর কি কেহ ভালবাসিতে জানে? সুভাষিণীর মত আর কি কেহ ভালবাসিতে জানে? মরিব, কিন্তু সুভাষিণীকে ভুলিব না।

    চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ : আমার প্রাণত্যাগের প্রতিজ্ঞা

    আমি হারাণীকে সতর্ক করিয়া দিয়া আপনার শয়নগৃহে গেলাম। বাবুদের আহারাদি হইয়া গিয়াছে। এমন সময়ে একটা বড় গণ্ডগোল পড়িয়া গেল। কেহ ডাকে পাখা, কেহ ডাকে জল, কেহ ডাকে ঔষধ, কেহ ডাকে ডাক্তার। এইরূপ হুলস্থূল। হারাণী হাসিতে হাসিতে আসিল। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “এত গণ্ডগোল কিসের?”
    হা। সেই বাবুটি মূর্চ্ছা গিয়াছিলেন।
    আমি। তার পর?
    হা। এখন সামলেছেন।
    আমি। তার পর?
    হা। এখন বড় অবসন্ন—বাসায় যাইতে পারিলেন না। এখানেই বড় বৈঠকখানায় পাশের ঘরে শুইলেন।
    বুঝিলাম, এ কৌশল। বলিলাম। “আলো সব নিবিলে, সবাই শুইলে আসিবে।”
    হারাণী বলিল, “অসুখ যে গা।”
    আমি বলিলাম, “অসুখ না তোর মুণ্ড। আর পাঁচ-শ খানা বিবির মুণ্ড, যদি দিন পাই।”
    হারাণী হাসিতে হাসিতে গেল। পরে আলো সব নিবিলে, সবাই শুইলে, হারাণী আমাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া ঘর দেখাইয়া দিয়া আসিল। আমি ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, তিনি একাই শয়ন করিয়া আছেন। অবসন্ন কিছুই না; ঘরে দুইটা বড় বড় আলো জ্বলিতেছে, তিনি নিজের রূপরাশিতে সমস্ত আলো করিয়া আছেন। আমিও শরবিদ্ধ; আনন্দে শরীর আপ্লুত হইল।
    যৌবন প্রাপ্তির পর আমার এই প্রথম স্বামিসম্ভাষণ। সে যে কি সুখ, তাহা কেমন করিয়া বলিব? আমি অত্যন্ত মুখরা—কিন্তু যখন প্রথম তাঁহার সঙ্গে কথা কহিতে গেলাম, কিছুতেই কথা ফুটিল না। কণ্ঠরোধ হইয়া আসিতে লাগিল। সর্বাঙ্গ কাঁপিতে লাগিল। হৃদয়মধ্যে দুপ দুপ শব্দ হইতে লাগিল। রসনা শুকাইতে লাগিল। কথা আসিল না বলিয়া কাঁদিয়া ফেলিলাম।
    সে অশ্রুজল তিনি বুঝিতে পারিলেন না। তিনি বলিলেন, “কাঁদিলে কেন? আমি ত তোমাকে ডাকি নাই—তুমি আপনি আসিয়াছ—তবে কাঁদ কেন?”
    এই নিদারুণ বাক্যে বড় মর্মপীড়া হইল। তিনি যে আমাকে কুলটা মনে করিতেছেন—ইহাতে চক্ষুর প্রবাহ আরও বাড়িল। মনে করিলাম, এখন পরিচয় দিই—এ যন্ত্রণা আর সহ্য হয় না, কিন্তু তখনই মনে হইল যে, পরিচয় দিলে যদি ইনি না বিশ্বাস করেন, যদি মনে করেন যে, “ইহার বাড়ী কালাদীঘি, অবশ্য আমার স্ত্রীহরণের বৃত্তান্ত শুনিয়াছে, এক্ষণে ঐশ্বর্যলোভে আমার স্ত্রী বলিয়া মিথ্যা পরিচয় দিতেছে”—তাহা হইলে কি প্রকারে ইঁহার বিশ্বাস জন্মাইব? সুতরাং পরিচয় দিলাম না। দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া, চক্ষুর জল মুছিয়া, তাঁহার সঙ্গে কথোপকথনে প্রবৃত্ত হইলাম। অন্যান্য কথার পরে তিনি বলিলেন, “কালাদীঘি তোমার বাড়ী শুনিয়া আমি আশ্চর্য হইয়াছি। কালদীঘিতে যে এমন সুন্দরী জন্মিয়াছে, তাহা আমি স্বপ্নেও জানিতাম না।”
    তাঁর চক্ষের প্রতি আমি লক্ষ্য করিতেছিলাম, তিনি বড় বিস্ময়ের সহিত আমাকে দেখিতেছিলেন। তাঁর কথার উত্তরে আমি নেকী সাজিয়া বলিলাম, “আমি সুন্দরী না বান্দরী। আমাদের দেশের মধ্যে আপনার স্ত্রীরই সৌন্দর্যের গৌরব।” এই ছলক্রমে তাঁহার স্ত্রীর কথা পাড়িয়াই জিজ্ঞাসা করিলাম, “তাঁহার কি কোন সন্ধান পাওয়া গিয়াছে?”
    উত্তর। না।–তুমি কতদিন দেশ হইতে আসিয়াছ?
    আমি বলিলাম, “আমি সে সকল ব্যাপারের পরেই দেশ হইতে আসিয়াছি। তবে বোধ হয়, আপনি আবার বিবাহ করিয়াছেন।”
    উত্তর। না।
    বড় বড় কথায়, উত্তর দিবার তাঁহার অবসর দেখিলাম না। আমি উপযাচিকা, অভিসারিকা হইয়া আসিয়াছি,–আমাকে আদর করিবারও তাঁর অবসর নাই। তিনি সবিস্ময়ে আমার প্রতি চাহিয়া রহিলেন। একবারমাত্র বলিলেন, “এমন রূপ ত মানুষের দেখি নাই।”
    সপত্নী হয় নাই, শুনিয়া বড় আহ্লাদ হইল। বলিলাম, “আপনারা যেমন বড়লোক, এটি তেমনই বিবেচনার কাজ হইয়াছে। নহিলে যদি এর পর আপানার স্ত্রীকে পাওয়া যায়, তবে দুই সতীনে ঠেঙ্গাঠেঙ্গি বাধিবে।”
    তিনি মৃদু মৃদু হাসিয়া বলিলেন, “সে ভয় নাই। সে স্ত্রীকে পাইলেও আমি আর গ্রহণ করিব, এমন বোধ হয় না। তাহার আর জাতি নাই বিবেচনা করিতে হইবে।”
    আমার মাথায় বজ্রাঘাত হইল। এত আশাভরসা সব নষ্ট হইল। তবে আমার পরিচয় পাইলে, আমাকে আপন স্ত্রী বলিয়া চিনিলেও, আমাকে গ্রহণ করিবেন না! আমার এবারকার নারীজন্ম বৃথা হইল।
    সাহস করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “যদি এখন তাঁহার দেখা পান, তবে কি করিবেন?”
    তিনি অম্লানবদনে বলিলেন, “তাকে ত্যাগ করিব।”
    কি নির্দ্দয়! আমি স্তম্ভিতা হইয়া রহিলাম। পৃথিবী আমার চক্ষে ঘুরিতে লাগিল।
    সেই রাত্রিতে আমি স্বামিশয্যায় বসিয়া তাহা অনিন্দিত মোহনমূর্তি দেখিতে দেখিতে প্রতিজ্ঞা করিলাম, “ইনি আমায় স্ত্রী বলিয়া গ্রহণ করিবেন, নচেৎ আমি প্রাণত্যাগ করিব।”

    পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ : কুলের বাহির

    তখন সে চিন্তিত ভাব আমার দূর হইল। ইতিপূর্বেই বুঝিতে পারিয়াছিলাম যে, তিনি আমার বশীভূত হইয়াছেন। মনে মনে কহিলাম, যদি গণ্ডারের খড়্গ-প্রয়োগে পাপ না থাকে, যদি হস্তীর দন্ত-প্রয়োগে পাপ না থাকে, যদি ব্যাঘ্রের নখব্যবহারে পাপ না থাকে, যদি মহিষের শৃঙ্গাঘাতে পাপ না থাকে, তবে আমারও পাপ হইবে না। জগদীশ্বর আমাদিগকে যে সকল আয়ুধ দিয়াছেন, উভয়ের মঙ্গলার্থে তাহা প্রয়োগ করিব। যদি কখন “মল বাজিয়ে” যেতে হয়, তবে সে এখন। আমি তাঁহার নিকট হইতে দূরে আসিয়া বসিলাম। তাঁর সঙ্গে প্রফুল্ল হইয়া কথা কহিতে লাগিলাম। তিনি নিকটে আসিলেন, আমি তাঁহাকে কহিলাম, “আমার নিকটে আসিবেন না, আপনার একটি ভ্রম জন্মিয়াছে দেখিতেছি,” [হাসিতে হাসিতে আমি এই কথা বলিলাম এবং বলিতে বলিতে কবরীমোচনপূর্বক (সত্য কথা না বলিলে কে এ ইতিহাস বুঝিতে পারিবে?) আবার বাঁধিতে বসিলাম,] “আপনার একটি ভ্রম জন্মিয়াছে। আমি কুলটা নহি। আপনার নিকটে দেশের সংবাদ শুনিব বলিয়াই আসিয়াছি। অসৎ অভিপ্রায় কিছুই নাই।”
    বোধ হয়, তিনি একথা বিশ্বাস করিলেন না। অগ্রসর হইয়া বসিলেন। আমি তখন হাসিতে হাসিতে বলিলাম, “তুমি কথা শুনিলে না, তবে আমি চলিলাম, তোমার সঙ্গে এই সাক্ষাৎ,” এই বলিয়া আমি যেমন করিয়া চাহিতে হয়, তেমনি করিয়া চাহিতে চাহিতে, আমার কুঞ্চিত, মসৃণ, সুবাসিত অলকদামের প্রান্তভাগ, যেন অনবধানে, তাঁহার গণ্ড স্পর্শ করাইয়া সন্ধ্যার বাতাসে বসন্তের লতার মত একটু হেলিয়া, গাত্রোত্থান করিলাম।
    আমি সত্য সত্যই গাত্রোত্থান করিলাম দেখিয়া তিনি ক্ষুণ্ণ হইলেন, আসিয়া আমার হাত ধরিলেন। মল্লিকাকোরকের বালার উপর তাঁর হাত পড়িল। তিনি হাতখানা ধরিয়া রাখিয়া যেন বিস্মিতের মত হাতের পানে চাহিয়া রহিলেন। আমি বলিলাম, “দেখিতেছ কি?” তিনি উত্তর করিলেন, “এ কি ফুল? এ ফুল ত মানায় নাই। ফুলটার অপেক্ষা মানুষটা সুন্দর। মল্লিকা ফুলের চেয়ে মানুষ সুন্দর এই প্রথম দেখিলাম।” আমি রাগ করিয়া হাত ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিলাম, কিন্তু হাসিলাম, বলিলাম, “তুমি ভাল মানুষ নও। আমাকে ছুঁইও না। আমাকে দুশ্চরিত্রা মনে করিও না।”
    এই বলিয়া আমি দ্বারের দিকে অগ্রসর হইলাম। স্বামী—অদ্যাপি সে কথা মনে পড়িলে দু:খ হয়—তিনি হাতযোড় করিয়া ডাকিলেন, “আমার কথা রাখ, যাইও না। আমি তোমার রূপ দেখিয়া পাগল হইয়াছি। এমন রূপ আমি কখন দেখি নাই। আর একটু দেখি। এমন আর কখন দেখিব না।” আমি আবার ফিরিলাম—কিন্তু বসিলাম না—বলিলাম, “প্রাণাধিক! আমি কোন্ ছার, আমি যে তোমা হেন রত্ন ত্যাগ করিয়া যাইতেছি, ইহাতেই আমার মনের দু:খ বুঝিও। কিন্তু কি করিব? ধর্মই আমাদিগের একমাত্র প্রধান ধন—একদিনের সুখের জন্য আমি ধর্ম ত্যাগ করিব না। আমি না বুঝিয়া, না ভাবিয়া, আপনার কাছে আসিয়াছি। না বুঝিয়া, না ভাবিয়া, আপনাকে পত্র লিখিয়াছিলাম। কিন্তু আমি একেবারে অধ:পাতে যাই নাই। এখনও আমার রক্ষার পথ খোলা আছে। আমার ভাগ্য যে, সেকথা এখন আমার মনে পড়িল। আমি চলিলাম।”
    তিনি বলিলেন, “তোমার ধর্ম তুমি জান। আমায় এমন দশায় ফেলিয়াছ যে, আমার আর ধর্মাধর্ম জ্ঞান নাই। আমি শপথ করিতেছি, তুমি চিরকাল আমার হৃদয়েশ্বরী হইয়া থাকিবে। এক দিনের জন্য মনে করিও না।”
    আমি হাসিয়া বলিলাম, “পুরুষের শপথে বিশ্বাস নাই। এক মুহূর্তের সাক্ষাতে কি এত হয়?” এই বলিয়া আবার চলিলাম—দ্বার পর্যন্ত আসিলাম। তখন আর ধৈর্যাবলম্বন করিতে না পারিয়া তিনি দুই হস্তে আমার দুই চরণ ধরিয়া পথরোধ করিলেন। বলিলেন, “আমি যে এমন আর কখন দেখি নাই।” তাহার মর্মভেদী দীর্ঘনিশ্বাস পড়িল। তাঁহার দশা দেখিয়া আমার দু:খও হইল। বলিলাম, “তবে তোমার বাসায় চল—এখানে থাকিলে তুমি আমার ত্যাগ করিয়া যাইবে।”
    তিনি তৎক্ষণাৎ সম্মত হইলেন। তাঁহার বাসা সিমলায়, অল্প দূর। তাঁর গাড়িও হাজির ছিল, এবং দ্বারবানেরা নিদ্রিত। আমরা নি:শব্দে দ্বার খুলিয়া গাড়িতে গিয়া উঠিলাম। তাঁর বাসায় গিয়া দেখিলাম, দুই মহল বাড়ী। একটি ঘরে আমি অগ্রে প্রবেশ করিলাম। প্রবেশ করিয়াই ভিতর হইতে দ্বার রুদ্ধ করিলাম। স্বামী বাহিরে পড়িয়া রহিলেন। তিনি বাহির হইতে কাতরোক্তি করিতে লাগিলেন। ‍ আমি হাসিতে হাসিতে বলিলাম, “আমি এখন তোমারই দাসী হইলাম। কিন্তু দেখি, তোমার প্রণয়ের বেগ কাল প্রাত:কাল পর্যন্ত থাকে না থাকে। যদি কালও এমনি ভালবাসা দেখিতে পাই, তখন তোমার সঙ্গে আবার আলাপ করিব। আজ এই পর্যন্ত।”
    আমি দ্বার খুলিলাম না; অগত্যা তিনি অন্যত্র গিয়া বিশ্রাম করিলেন। জ্যৈষ্ঠ মাসের অসহ্য সন্তাপে, দারুণ তৃষাপীড়িত রোগীকে স্বচ্ছ শীতল জলাশয়তীরে বসাইয়া দিয়া, মুখ বাঁধিয়া দাও, যেন সে জল পান করিতে না পারে—বল দেখি, তার জলে ভালবাসা বাড়িবে কি না?
    অনেক বেলা হইলে দ্বার খুলিলাম, দেখিলাম, স্বামী দ্বারে আসিয়া দাঁড়াইয়া আছেন। আমি আপনার করে তাঁহার কর গ্রহণ করিয়া বলিলাম, “প্রাণনাথ, হয় আমাকে রামরাম দত্তের বাড়ী পাঠাইয়া দাও, নচেৎ অষ্টাহ আমার সঙ্গে আলাপ করিও না। এই অষ্টাহ তোমার পরীক্ষা।” তিনি অষ্টাহ পরীক্ষা স্বীকার করিলেন।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleবিষবৃক্ষ – বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
    Next Article যুগলাঙ্গুরীয় – বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    Related Articles

    উপন্যাস বুদ্ধদেব গুহ

    কোয়েলের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ

    May 23, 2025
    চলিত ভাষার বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    যুগলাঙ্গুরীয় – বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (চলিত ভাষায়)

    May 7, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }