Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ী

    উপন্যাস কল্লোল লাহিড়ী এক পাতা গল্প203 Mins Read0

    ৭. চন্দ্রপুলি 

    ধনঞ্জয় বাজার থেকে এনেছে গোটা দশেক নারকেল। কিলোটাক খোয়া ক্ষীর। দশ কেজি মতো চিনি। আরও অনেক কিছু। ইন্দুবালা ফর্দ করে দিয়েছিলেন। সেগুলো দেখে দেখে সে নিয়ে এসেছে। কিন্তু না নিয়ে আসা জিনিসও আছে তার মধ্যে অনেক। যেমন ইন্দুবালা ফর্দে লেখেননি ছোটো এলাচের কথা। সেটা মুখে বলে দিয়েছিলেন। ভুলে গেছে ধনঞ্জয়। জোয়ানের কথা বলেছিলেন। একবার নয়, অন্তত বার তিনেক–সেটাও আনেনি। একটু দাঁড়িয়ে গেলে এগুলোও সব লিখে দিতে পারতেন ইন্দুবালা। কিন্তু সে সময়টাও ধনঞ্জয় দেয়নি। তাড়াতাড়ি বাজারে বেরিয়েছে সে। নেশায় টান পড়েছে যে তার। আগের রাত থেকে গুড়াকু ফুরিয়েছে। কাজেই তখন তার প্রাণ সংশয়ের অবস্থা। দিনে অন্তত বার আষ্টেক গুড়াকু দিয়ে দাঁত না মাজলে মেজাজ ভালো থাকে না ধনঞ্জয়ের। সকালে উঠে কৌটো কেঁখে যেটুকু পেয়েছে তাতেই কাজ চালিয়েছে। কিন্তু যত বেলা বেড়েছে তত মনে হয়েছে হাত পা যেন চলতে চাইছে না আর। মাথা ঝিমঝিম করছে। এইসব কাটাতে ধনঞ্জয় তাই বার দুয়েক জর্দা খেয়েছে। উলটো দিকে ভুবনের পানের দোকান থেকে কাঁচা সুপারি খেয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। গুড়াকুর নেশা বেড়েছে বই কমেনি। তাই কোনো মতে সে মায়ের কাছ থেকে ফর্দ নিয়ে দৌড় লাগিয়েছে বাজারের দিকে। এদিকে ইন্দুবালা যে সমানে বলে চলেছেন আরও কী কী আনতে হবে, কী কী লেখা হয়নি খাতায় সেগুলো কিছুই প্রায় কানে ঢোকেনি ধনঞ্জয়ের। যেন হাওয়ায় ভেসে বেরিয়েছে সে। ফল হয়েছে মারাত্মক। ভুলে যাওয়া জিনিসপত্রের তালিকা অনেক। তার মধ্যে আছে ছোটো এলাচ, লবঙ্গ, জোয়ান, গোল মরিচ, আরও কত কী! এদিকে বয়েস বেড়েছে ধনঞ্জয়ের। ইন্দুবালারও ধিকি ধিকি করে অনেক। দুজনের বাক যুদ্ধ শুরু হলে থামানোর কেউ নেই। রান্নার কোনো জিনিস কিনে আনতে ভুলে গেলেই ইন্দুবালা প্রচণ্ড রেগে যান।

    তাঁর হাতের কাছে সব ঠিকঠাক মতো থাকা চাই। রান্নার সময় এটা নেই ওটা নেই তিনি একদম সহ্য করতে পারেন না। এই নিয়ে সকালে ধনঞ্জয়ের সাথে একপ্রস্থ কথা কাটাকাটি হয়েছে। ছোটোখাটো ঝগড়াও। সপাটে ইন্দুবালা বলে দিয়েছিলেন “মুখের ওপর কথা বলবি না ধনা”। এটা যে কতবার দিনে বলেন আর কতবার যে নিজেই ধনঞ্জয়কে ডেকে কথা বলেন তার ইয়ত্তা নেই। প্রত্যেকদিন নিজে খেতে বসার আগে এখনও পর্যন্ত ধনঞ্জয়কে খাওয়ান। হ্যাঁ, নিজে বসে থেকে। সবার খাওয়া হলে তারপর ইন্দুবালা ভাত নিয়ে বসেন। আজকাল খাবারেও রুচি নেই। ভালো লাগে না কিছুই। সব কিছু ফেলে রেখে একদলা আচার দিয়ে কোনোমতে ভাতগুলো খান। এইসব ধনঞ্জয় জানে না। জানলে আর রক্ষে থাকবে না। ইন্দুবালার ভালো-মন্দ সব কিছুর ওপর প্রচণ্ড নজর ধনঞ্জয়ের। একটু এদিক থেকে ওদিক হলেই ছেলেদের ফোন করে মাথা খারাপ করে দেবে। তারাও ধনাদা বলতে প্রাণ। এতকাল একটা লোকের থাকা মানে বাড়ির সাথে, বংশের সাথে শিকড় গজিয়ে যাওয়া। নিজের সন্তানদের থেকেও বেশি বিশ্বাস আর ভরসা করেন ইন্দুবালা তাকে। তবুও কথা কাটাকাটি, ঝগড়া, কথা বন্ধ হয় দিনে বেশ কয়েকবার। না

    হলেই বিপত্তি ঘটে। ধনঞ্জয় বার বার তখন জিজ্ঞেস করে, “হাঁ গো মা, তোমার শরীর ঠিক আছে তো? বড় খোকাকে ফোন করি? ডাক্তার ডাকুক।” এর উত্তরে ইন্দুবালা মুখ ঝামটা দিলে ধনঞ্জয় ভাবে, না বুড়ি ঠিক আছে। সুস্থ আছে। কোনো অসুবিধে কিছু নেই।

    পুজো এলেই ইন্দুবালার মন ভালো থাকে না। কেমন যেন খিটখিটে হয়ে যান। পইপই করে ধনঞ্জয় বলেছিল, “খুকি ডাকছে এত করে, ঘুরে এসো।”ইন্দুবালার একমাত্র মেয়ে ইতু থাকে ব্যাঙ্গালোরে। এ বছরেই তাদের সেখানকার পাট উঠবে। জামাই চলে যাবে ইউক্রেনে। মেয়ে তার ছেলেপুলে নিয়ে এসে উঠবে দিল্লির শ্বশুরবাড়িতে। তারপর সেখান থেকে সোজা স্বামীর কাছে। তাই ওরা বারবার বলেছিল একবার আসতে। বিশেষ করে জামাই সুকান্ত। “একবার আসুন মা। অনেকদিন আপনার সাথে দেখা হবে না।” আবদার করেছিল। ছোটো খোকা ধরিয়ে দিয়েছিল হাতের ফোনটা। সেখানেই তিনি ভিডিও কলে দেখতে পাচ্ছিলেন জামাইকে, খুকিকে, তাদের ছেলেপুলেদের। সবাই চাইছিল ইন্দুবালা যেন ওদের ওখানে যান। একটু থেকে আসেন ওদের সংসারে। খুকি কেঁদেছিল, “সেই কবে বিয়ে দিয়েছ একবার দেখতে পর্যন্ত আসেনি। এবার বাইরে চলে যাচ্ছি আবার কবে

    দেখা হবে …” কথা শেষ করতে পারেনি খুকি। ইন্দুবালা খুব শান্তভাবে বলে দিয়েছিলেন, “এবার ছুটি দে না তোদের মাকে। আর ধরে রাখিস না। এই তো তুই, ছোটো খোকা, বড় খোকা সবাই কেমন মিলেমিশে আছিস। সেইভাবেই থাকবি। আমাকে ছেড়ে দে।” খুকি এরপরে একটুও কথা বলতে পারেনি। তার কান্না আরও বেড়েছিল। জানতো তার মা কোনদিন আসবেন না তার কাছে। দাদাদের কাছেই যায়নি। তার কাছে আসবে কেন? কিন্তু এবার যে চলে যাচ্ছে সে অনেক দূর। হুট করে মায়ের কিছু হলে আসতে তো তিন দিন চলে যাবে।

    ফোন রেখে দেওয়ার পরে ছোটো খোকা সুদীপ বেশ কড়া করেই বকে দিয়েছিল ইন্দুবালাকে। একমাত্র তিন ছেলে মেয়ের মধ্যে সুদীপই একটু শাসন করে ইন্দুবালাকে। বিভিন্ন সময়ে নানা ঘটনা ঘটলে, মনোমালিন্য চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছালে দাদা, বোন যখন কেউ পারে না সামাল দিতে মাকে তখন সব শেষে আসে সুদীপ। ছোট খোকা এসে বেশি কিছু করে না। হোটেলের রান্না ঘরে একটা মোড়া নিয়ে চুপ করে বসে থাকে গ্যাঁট হয়ে। শুধু নজর রাখে ইন্দুবালাকে পুলিশ ইন্সপেক্টারের মতো। যদিও অনেক ছোটো থেকে সে তার দাদা বা বোনের চেয়ে এই ঘরে কাটিয়েছে অনেকটা সময়। রান্না করতে ভালোবাসে সুদীপ। মায়ের অনেক রান্না তার জানা। বাড়ির লোকজনও বেজায় খুশি হয় তার রান্না খেয়ে। অনেকে বলে ইন্দুবালার রান্নার হাত নাকি এই ছেলেই পেয়েছে। একটু বড় হওয়ার পরে সুদীপের খুব ইচ্ছে ছিল হোটেল ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়ার। ইন্দুবালা সেসব হতে দেননি। কে যেন তাঁর মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিল ভালো করে পড়ে, সরকারি পরীক্ষায় বসে বাঁধা চাকরির কথা। হয়তো কালেক্টার অফিসের বাবুদের দেখে তাঁর মাথায় আসতে পারে। কাজেই সুদীপকে সরকারি পরীক্ষায় বসতে হয়েছিল। চাকরি করতে হয়েছিল মায়ের কথা শুনেই। তিন ভাইবোন কেউই মায়ের অবাধ্য ছিল না। তারা একটু সময়ের জন্যেও মাকে কষ্ট দেয়নি। যা বলেছেন ইন্দুবালা তাই করেছে। এমনকি বিয়ে দিয়ে আলাদা করে দিলেও মুখে কিছু বলেনি। কিন্তু সুদীপ তাও মাঝে মাঝে এসে গায়ের ওপরে পড়ে থেকেছে। হম্বিতম্বি করেছে। আরও দুটো বেশি কাজের লোক রাখতে বলেছে। টেবিলগুলো সানমাইকা দিয়ে ঠিক করতে বলেছে। মিস্ত্রি নিয়ে এসে বসে থাকলেও ইন্দুবালা নিজের হোটেলে তাকে নাক গলাতে দেননি। তিনি জানেন ভালোবেসেই করছে সে। তবুও তাঁর রক্তরা যেন আর এই ছেনু মিত্তির লেনের মায়া জালে না জড়ায় আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন। আর তত দুই ছেলে, মেয়ে সবাই খুঁজে বেড়িয়েছে তাদের চিলেকোঠা, আচারের বয়াম, নীচে রান্না ঘরে ঝুড়ি চাপা দেওয়া মাছের ডিমের বড়া। মায়ের কাঠের আলমারিতে থরে থরে সাজানো নাড়, নিমকি, কুচো গজা। এর থেকে তাদের যে নিস্তার নেই। সুদীপ মোড়াটা এগিয়ে আরও উনুনের ধারে নিয়ে এসেছিল। “দাও দেখি মৌরলা মাছগুলো ভাজি”। ইন্দুবালার প্রচণ্ড অস্বস্তি হয়। বাইরের কাপড়ে, স্নান না করে তুই রান্না ঘরে বসিস কী করে?” সুদীপ বলে “যাই তাহলে স্নান করে আসি। রান্না করতে দেবে তো?” ইন্দুবালা বলেন “কক্ষনও না। নিজের কাজ করোগে যাও।” রান্নার সময়ে কেউ যদি তাকে বিরক্ত করে মোটেই সহ্য হয় না তাঁর। সেটা সুদীপ জানে। আর জানে বলেই সে ইচ্ছে করেই আজ এইসব করছে। “টক করবে না ঝোল? আর একটু বড় সাইজের কেনা উচিত ছিল মা তোমার।” সকালে মাছগুলো দেখে ইন্দুবালার মনে হয়েছিল একবার। টকের জন্য আর সামান্য বড় হলে ভালো হতো। নিজের মনের কথাগুলো যেন পড়ে ফেলছে ছোটো ছেলে। লছমী বলতো “ওটাকেই তুই বেশি ভালোবাসিস মা।” ইন্দুবালা বলতেন, “ধুর ওইভাবে ভালোবাসা ভাগ হয় নাকি। একটাকে বেশি আরেকটাকে কম। বলতে পারিস আমি কাউকেই ভালোবাসি না।” লছমী চোখ বড় বড় করে বলেছিল “আচ্ছা? তাই তুই ওদের জন্য এতো কিছু করিস তাই না?” ইন্দুবালাও চুপ করে থাকার মানুষ ছিলেন না। জীবনটাকে যে দেখে ফেলেছেন অনেকটা, “কর্তব্য করি রে লছমী। এইটুকু যদি ওরা মনে রাখতে পারে, তাই অনেক।” মনে রেখেছিল সন্তানরা। ভোলেনি কেউই। ছোটোবেলায় সুদীপ যখন এসে দাঁড়াতো মায়ের সামনে। বায়না করতো একসাথে বাজার যাওয়ার। ইন্দুবালার মোটেই সেগুলো প্রশ্রয় দিতেন না। “যখন যা বলবো সেটাই করবে। বাড়তি কাজের তো দরকার নেই। সেই সময়টা পড়াশুনা করো”। ছেলেটা লুকিয়ে চুরিয়ে তবুও চলে যেত ধনঞ্জয়ের সাথে। বাজার করতো। ইন্দুবালা অবাক হয়ে যেতেন অত ছোট্ট ছেলের গুছিয়ে বাজার করা দেখে। পরীক্ষার পরে অন্যান্য বন্ধুরা যখন নানা খেলায় মেতে আছে; দাদা, বোন সবাই আঁকার ক্লাসে, তখন সুদীপ রান্না ঘরে। মায়ের সাথে পোস্ত বড়া করেছে। প্রচণ্ড রেগে গেলেও, চিৎকার চেঁচামেচি করলেও ছোটো খোকাকে নিরস্ত করতে পারেননি। মাছের টকে বড় না ছোটো মাছ সেই দিকে আলোচনা না এগিয়ে, উনুন থেকে কড়া নামিয়ে এসে বসলেন

    ইন্দুবালা ছোটো খোকার সামনে। তিনি জানেন এই ছেলে সহজে ছেড়ে দেওয়ার নয়। ইতুর বাড়ি যাওয়ার ফয়সালাটা সেরেই তারপর এখান থেকে উঠবে।

    “কী চাস কি তুই?”

    “পুজোয় খুকির কাছ থেকে ঘুরে এসো। ততদিন আমি হোটেল চালাবো”।

    “তোর অফিস?”

    “বন্ধ থাকে মা।”

    “এর আগে কোনোদিন হোটেল চালিয়েছিস?”

    “দেখেছি তো তোমাকে। তাছাড়া ধনাদা আছে। কিরে পারবো না?”

    ধনা মাথা নাড়লে কড়া চোখে তাকান ইন্দুবালা।

    “তুই পুজোতে এখানে পড়ে থাকবি…আর ছেলে মেয়ে বউ এরা কী করবে?”

    “সেটা তোমাকে ভাবতে হবে না। আমি সামলে নেবো।”

    “আমাকে করুণা করছিস তাই না?”

    “যাহ বাব্বা…করুণার ব্যাপার এলো কোথা থেকে?”

    “আমার হোটেল নিয়ে তোমাদের কাউকে ভাবতে হবে না। যাও বেরিয়ে যাও এক্ষুনি বাড়ি থেকে।”

    “যাবো না। তুমি কী করবে করে নাও।”

    কেন খুকির বাড়ি ইন্দুবালা যাবেন না তাই নিয়ে অশান্তি চরমে উঠেছিল। সুদীপের বউ পর্যন্ত ছুটে এসেছিল। “কেন তোমরা মাকে জোর করছো? যেতে চাইছেন না যাবেন না। মিটে গেল। তুমি দাদাভাই দেখা করে এসো না ইতুর সাথে। আমি আর দিদিভাই না হয় দিল্লিতে গিয়ে ওদের সি অফ করবো।” ইন্দুবালার ছোটো ছেলের বউ খুব একটা এই বাড়িতে আসে না। পালা পার্বণে নমস্কার, খাওয়া দাওয়া ছাড়া বড় একটা ঘেঁষতে দেখেন না। কিন্তু খোঁজ রাখে ইন্দুবালার সে। দিনে অন্তত একবার ফোন করে। কী কী রান্না করলেন ইন্দুবালা, নতুন কিছু হল কিনা সব। তার সাথে কথা না হলেও ধনঞ্জয়ের সাথে তো হয়ই। বড় ছেলের মেয়ে সুনয়নী যখন বিদেশ থেকে অতদিন পরে এলো, সেই খবর প্রথমে পেয়েছিল এই ছোটো ছেলের বউ নন্দিতা। সেই সবাইকে জড়ো করে। বড় ছেলে, বউমারা রাগ মিটিয়ে আবার সুনয়নীকে টেনে নিয়েছিল নিজেদের মধ্যে। ছোটো খোকা যা রগচটা। এই বউ সামলে রেখেছে তাকে সব দিক থেকে। তাই মুখে কিছু না বললেও ছোটো বউকে সমীহ করেন ইন্দুবালা। আর সেও বেশ দূর থেকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা ভক্তি দেখায়। আর দেখাবেই বা না কেন। ইন্দুবালার সাথে তার যে আছে এক অন্তরের যোগ। সে অনেকদিন আগের কথা। নন্দিতা তখন কলেজের গণ্ডি সবে পেরিয়েছে। মল্লিক বাড়ির যে ছেলেটাকে সে ভালোবাসে তার সাথে বাড়িতে বিয়ে দিতে চাইছিল না মোটেই। মেয়ের সাথে বাবা-মায়ের মুখ দেখাদেখি যখন বন্ধ হবার যোগাড়, খবর কাগজের বিজ্ঞাপন দেখে যখন বাড়ির সামনে ছেলের বাড়ির লোকজন এবং ছেলেরাও লাইন দিতে শুরু করেছে নন্দিতাকে দেখবে বলে। সেই রকমই একদিন সে সটান চলে এসেছিল এই ইন্দুবালা ভাতের হোটেলে। সুদীপ নামের যে ছেলেটাকে সে ভালোবাসে তার মায়ের সাথে কথা বলতে। সদর দরজা হাট করে ভোলা ছিল। ওটাই যে হোটেলে ঢোকার রাস্তা সে জানতো না। ঘরের মধ্যে ঢুকে খাবারের কাঠের পংক্তিগুলোর মধ্যে দিয়ে এগিয়ে গেলে ডান হাতে পড়ে রান্নাঘর। সেই ঘরে ঢুকে নন্দিতা দেখেছিল সন্ধ্যের আঁচে চিঁড়ের পায়েসের দুধ জাল দিচ্ছেন ইন্দুবালা। কয়লার আগুনের লাল আভা ছড়িয়ে আছে ভদ্রমহিলার সারা মুখ জুড়ে। এত শান্ত কেউ হতে পারে নন্দিতা ভাবতেও পারেনি। কারণ এমন মানুষের সংস্পর্শে সে এর আগে আসেনি। সব খুব একটা যে গুছিয়ে সেদিন বলতে পেরেছিল নন্দিতা তেমনটাও নয়। ইন্দুবালা এটুকু বুঝেছিলেন, তাঁর ছেলেকে ভালোবাসে এই মেয়েটি। বিয়ে করতে চায়। বাড়ির লোক দিতে চাইছে না বলে সোজা ছেলের মায়ের কাছে চলে এসেছে। তাও ছেলেকে না জানিয়ে অনেক আঁটঘাট বাঁধা বন্ধের চিন্তা না করেই। অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলেন নন্দিতার মুখের দিকে ইন্দুবালা। তাঁর কোনোদিন সাহস হয়নি বাড়িতে বলার যে, ভালোবাসেন মনিরুলকে। বিয়ে করতে চান। পালিয়ে বিয়ে করতে গিয়ে স্বর্ণলতাকে মরতে হয়েছিল পুকুরে ডুবে। মনিরুলকে ছেড়ে আসতে হয়েছিল কপোতাক্ষের তীরে। তাদের সবার প্রতিনিধি হয়েই কি মেয়েটা এই সন্ধ্যেবেলায় তাঁর কাছে এসেছে? চিড়ের পায়েসটা শেষ করে জানতে চেয়েছিলেন, তাকে ভালোবাসে তো তাঁর ছেলে? থাকতে পারবে তারা দুজনে সুখী হয়ে? মেয়েটা ঘাড় নেড়েছিল। আর ইন্দুবালা সেই সন্ধ্যের প্রথম আঁচে চিড়ের পায়েস নামিয়ে অল্প একটু অগ্নিকে উৎসর্গ করে বাটি ভরে এগিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর ছোটো বউয়ের দিকে। বলেছিলেন, “চিন্তা করো না। আমি বড় খোকাকে চিঠি লিখছি দিল্লিতে। সে এলে তাকে নিয়ে তোমাদের বাড়ি যাবো। কথা বলে আসবো তোমার বাবা মায়ের সাথে।” অবাক হয়েছিল মেয়েটি। এতো নির্বিবাদে কোনো প্রশ্ন না করে মেনে নিলেন সব কিছু ইন্দুবালা? কোনো প্রশ্ন করলেন না কোথায় থাকে নন্দিতা। কী জাত? বাবা মায়ের পরিচয়। আদৌ কিছু পড়ে কিনা। দু সপ্তাহ পরে ইন্দুবালা চলে গিয়েছিলেন বড় খোকা আর খুকিকে নিয়ে নন্দিতার বাড়ি। নন্দিতা অবাক হয়ে গিয়েছিল ওই একলা একটা ভাতের হোটেল চালানো মেয়েমানুষের কথা শুনে। যে মহিলাকে না দেখেই তার বাবা মা হতচ্ছেদা করেছে। সেই মহিলাই রাজি করিয়ে নিলেন বাড়ির লোককে। শুধু তাই নয় এক সপ্তাহের মধ্যে বাবা-মা বিয়ের পাকা কথা বলার জন্যে চলে এলেন ইন্দুবালা ভাতের হোটেলে। সেই থেকে নন্দিতা আরও অনেক কাছের হতে পারতো ইন্দুবালার। কিন্তু বিয়ের পরে কিছু দিন ছেনু মিত্তির লেনে থেকেই সে বুঝে গিয়েছিল এই পৃথিবীতে কিছু মানুষ আছেন যাঁরা চিরকালের জন্য একা হয়ে যান। তখন তাঁরা সেই একাই একটা জগতের মধ্যে বাঁচতে ভালোবাসেন। ইন্দুবালার সেই নির্জন জগৎ হলো তাঁর ভাতের হোটেল। জোর করে তাই সেখানে প্রবেশ করতে চায়নি নন্দিতা। সুদীপকেও বুঝিয়েছিল তার মতো করে।

    বউয়ের কথা মতো সুদীপ ফোন করে মায়ের সাথে কথা বলিয়েছিল খুকির। ভেবেছিল খুকি ঠিক রাজি করিয়ে নিতে পারবে মাকে। উলটে মা-ই কাঁদিয়ে ছাড়লো খুকিকে। কেমন যেন মেনে নিতে পারে না সুদীপ। দুই ভাইয়ের বোন অন্ত প্রাণ যে! “সব কিছুর একটা লিমিট আছে মা। খুকিকে এইভাবে না বললেও পারতে।” ভারী ফ্রেমের চশমায় ছোটো খোকাকে কেমন যেন মাস্টার রতনলাল মল্লিকের অল্প বয়সের মতো লাগে ইন্দুবালার। হাব ভাব, ঘাড় ঘুরিয়ে কথা বলা। ঠাকুরের কৃপায় শুধু স্বভাবটা বাবার মতো না। চলে যাচ্ছিল রেগে মেগে সুদীপ। ইন্দুবালা খেয়ে যেতে বললেন। থেকে যেতেই হলো সুদীপকে। মুখের ভাতকে অগ্রাহ্য করার মতো সাহস তার নেই। মাকে অসম্মান করা তো নয়ই। তাছাড়া অনেক দিন সে মায়ের হাতে মাছের টক খায়নি। ছোটো ছেলে এসেছে। বলে ইন্দুবালা সেদিন জম্পেশ করে বেঁধেছিলেন মুড়ি ঘন্ট। সুদীপ বড় ভালোবাসে যে। গরম মশলার হালকা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছিল সারা ঘরটা জুড়ে। আসন পেতে বাবু হয়ে বসে খেতে ভালো লাগে সুদীপের। যদিও বাত ধরতে শুরু করেছে তারও। রান্না ঘরের মেঝেতে থালার পাশে যখন বাটিগুলো সাজিয়ে দিলেন ইন্দুবালা, চোখে জল এল ছোটো খোকার। খেতে খেতে বিষম খেলে বার দুয়েক ষাট ষাট বললো তার মা। মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। বারবার মনে মনে সুদীপ ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলো তার মা যেন এইভাবেই রয়ে যায় চিরটা কাল। ভর দুপুরে এক পেট খেয়ে, ইন্দুবালার দোতলার ঘরে খাটের ওপর টানটান হয়ে ঘুমিয়ে সন্ধ্যের সময় যখন বাড়ি যাবে বলে নীচে নামলো সুদীপ, তখন সত্যি তার আর কোথাও যেতে ইচ্ছে করছিল না। ওই সন্ধ্যেতেই ইন্দুবালার উনুনে নতুন আঁচের কয়লা পড়েছিল। তার সত্তর পেরেনো মা কতকগুলো নাতির বয়সী ছেলে মেয়ের আবদার মেটাচ্ছিল। আর সুদীপের সেই মুহূর্তে খুব হিংসে হচ্ছিল ছেলে মেয়েগুলোকে। সেও যদি তার মায়ের চারপাশে এইভাবে ঘুরে বেড়াতে পারতো। তার স্ত্রী নন্দিতা ঠিকই বলে “তোমাদের থেকেও মা ভালোবাসেন ওই হোটেলটাকে। ওর থেকে মাকে আলাদা করার কথা স্বপ্নেও ভেবো না। তাহলে আর বেশি দিন রাখতে পারবে না মাকে।” ইন্দুবালা ছোটো খোকার হাতে ধরিয়ে দেন খাবারগুলো। ছোটো বউমা, নাতি নাতনিরা খাবে। রাতে ফোন করে বোনকে সুদীপ বোঝাতে পেরেছিল “মা যেমন আছে থাকতে দে। পারলে তোরা বিদেশ যাওয়ার আগে একবার দেখা করে যাস। সেটাই ভালো হবে”।

    অনেক রাতে শুতে এসে ইন্দুবালা ভেবেছিলেন ছোটো খোকাকে বললে সে কি থেকে যেতো আজকে? কতদিন তো দুই ছেলে, মেয়েকে পাশে নিয়ে ঘুমোননি তিনি। তালপাতার পাখা নেড়ে নেড়ে বাতাস করেননি। বড় খোকাকে তো ডেকে নেওয়া যেত ফোন করেই। দুই ছেলেকে পাশে নিয়ে ইন্দুবালা শুয়ে আছেন। নিজের ভাবনাতেই কেমন যেন খটকা লাগে তার। যা তিনি সন্তানদের ছোট্ট বেলাতেই করেননি আজ কেন সেগুলো করতে চাইছেন? তাহলে এই কি তাঁর সত্যিকারের শেষের সময়? ছ্যাঁৎ করে ওঠে গা টা। তিনি না থাকলে এই বাড়িটার কী হবে? কী এক বিষণ্ণতা যেন ঘিরে ধরে ইন্দুবালাকে। এমন পাথর কেন হয়ে গেলেন তিনি? এই বাড়িটায় থাকতে থাকতেই এমনটা হলো কি? আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে গেলেন এই বাড়িটার সাথেই? কোথাও কোনোদিন তাঁর যাওয়া হল না। সেটা কি নিজের ইচ্ছেতেই? নাকি সত্যি তাঁর যাওয়ার জায়গা ছিল না। চিলেকোঠার ছাদ থেকে বাড়ির পেছনের বাগান। হোটেলের রান্নাঘর। খাবার ঘর। রাস্তার ওপারে কাশী মুদির দোকান। বড়জোর রেল লাইনের ধারে সকালের বাজার। এইটুকু ভৌগোলিক আলোছায়ার মধ্যে ইন্দুবালা নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছিলেন। কেন রেখেছিলেন? তাহলে বাইরে যেতে ভয় করতো কি তাঁর? ধুর কী সব ভাবছেন। ফুরসত পেতেন না অন্য কোথাও যাওয়ার। প্রাপ্তবয়েস না হওয়া পর্যন্ত ছেলে-মেয়েদেরও কোথাও যেতে দেননি তিনি। আগলে রেখে ছিলেন কঠিন কঠোর শাসনে। কারণ তিনি জানতেন এই মল্লিক বাড়ির রক্ত খারাপ। একটু আলগা দিয়েছো কি সবাই মাস্টার রতনলাল মল্লিক তৈরী হবে। ইন্দুবালা তাই তাঁদের কবেকার খুলনার বাড়িতে বসা দাদুর টোলটাকে ওপরের ঘরে গড়ে তুলেছিলেন নিজের মতো করে। ছোটো ছোটো বাচ্চাগুলোকে নিয়ে এক পুব বাংলার বিধবা যখন হোটেল চালাচ্ছে তখন তাঁর বাড়ি থেকে ভেসে আসছে কচি গলায় পড়ার আওয়াজ। “ছোট্ট মেয়ে রোদ্দুরে দেয় বেগুনী রঙের শাড়ি…চেয়ে চেয়ে চুপ করে রই…তেপান্তরের পার বুঝি ওই…”। বড় খোকা হেরিকেনের আলোয় পড়ছে সহজ পাঠ। ছোটো খোকা স্লেটে লিখছে অ আ ক খ। আর পুঁচকে মেয়েটা কাঁথায় শুয়ে ঘুমোচ্ছে অকাতরে। জাগলেই দাদারা কেউ না কেউ তাকে দুধ খাইয়ে দেবে। আর ইন্দুবালা তখন দুটো গনগনে উনুনের সামনে। কোনোটাতে ফুটছে সোনা মুগের ডাল। কোনোটাতে বা ভাত। এটা ছিল খুব চেনা একটা ছবি। ইন্দুবালার ভাতের হোটেলের অনেক দিনের খদ্দের যাঁরা তাঁদের কারও কারও মনে থাকার কথা। গরিবের একমাত্র হাতিয়ার লেখাপড়া। সেটা যদি তাঁর সন্তানরা করে উঠতে পারে তাহলে এই যে দিন রাতের পরিশ্রম করছেন ইন্দুবালা তা সার্থক হয়।

    বোনকে বেশ খানিকটা বড় করে তুলেছিল দাদারাই। তাই মেয়ে মায়ের থেকেও দাদাদের ন্যাওটা বেশি। সেই ছোটো থেকেই। দাদারাও খুকি বলতে প্রাণ। তিনজনের বড় হয়ে ওঠাটা একে অন্যকে অবলম্বন করে। তার মাঝে খাড়া হয়ে বট গাছের মতো আছে যেন মা। ঝুরির সাথে বট গাছের যেমন সম্পর্ক ঠিক তেমনি ছিল ইন্দুবালার সাথে ছেলে মেয়েদের সম্পর্ক। মা আছে জানলে ওরা নিশ্চিন্ত হতো। আর ইন্দুবালা নিশ্চিন্ত হতেন ওদের সারাক্ষণ চোখের সামনে দেখে। খুব যে হুজ্জতি ওরা করতে তেমনটা নয়। সেই সময়ও ওরা পেত না। ছোটো থেকেই ওরা জেনে এসেছে ওদের মা বাবা একজনই। আর তিনি হলেন ইন্দুবালা। যার আবার একটা হোটেল আছে। সেই হোটেল না চললে ওদের ভাতও জুটবে না। কেমন করে যেন ফুস মন্তরের মতো কানে ঢুকিয়ে দিতে পেরেছিলেন ইন্দুবালা। তাই ছোটো থেকেই ওদের চাহিদা ছিল খুব কম। মাঝে মাঝে নিজেই অবাক হয়ে যেতেন। ওরা যখন একটু একটু করে বড় হচ্ছিল ওদের দেখে নিজের ছোটোবেলার কথা মনে পড়তো তাঁর। নিজেও তো ভাইকে একদিকে দিদি আর একদিকে মায়ের মতো বড় করে তুলছিলেন। তবুও যেটুকু স্নেহ পরশ শীতের হিমের মতো তাঁদের গায়ে লেগে থাকতো এই বাচ্চাগুলোর কপালে তাও জোটেনি। সেই স্নেহ কোমলতা ইন্দুবালা নিজের শরীরের অন্তঃপুরে লুকিয়ে রেখেছিলেন। কখনও কোনো দুর্বলতার মুহূর্তেও তিনি প্রকাশ করেননি। ইন্দুবালাকে কোনোদিন কাঁদতে দেখেনি তাঁর তিন ছেলে মেয়ের কেউই। শুধু তারা দেখেছে মায়ের অমানুষিক পরিশ্রম। নিয়মের একটু এদিক ওদিক হতে দেননি তিনি। ছোটো, বড় নানা অনুশাসনে মানুষ হয়েছে প্রদীপ, সুদীপ আর ইতু। পান থেকে চুন খসার জো ছিল না। মিথ্যে কথা বলা ছিল আরও অপরাধের। কোনো দিন অবশ্য তা বলতে হয়নি তাদের। চোখের দিকে তাকাতেই মা কেমন যেন বুঝে যেত মনের কথা সব। নিয়মিত ছেলেদের স্কুলে গিয়ে খোঁজ খবর নিতেন ইন্দুবালা। ঠিক মতো পড়ছে কিনা। বড় ছেলেও সামলাতে অনেকটা। কিন্তু সেও তো তখন অনেক ছোটো। শুধু স্কুলের ভরসাতেই বাচ্চাদের লেখাপড়া ছেড়ে দেননি ইন্দুবালা। বাড়িতে এক সময়ে তাঁকে পড়াতেন বাবা। তারও আগে দাদু। কিন্তু এখানে তাঁর বাচ্চাদের কে পড়াবে? ইন্দুবালার হাতে সময় নেই একটুও। তা সত্ত্বেও বর্ণপরিচয় নিজেই পড়িয়েছিলেন ছেলেদের। আর ছেলেরা পড়িয়েছিল বোনকে। স্কুলে ভর্তি করার অনেক আগেই বাড়িতে রেখেছিলেন পড়ানোর জন্য মাস্টার। খোঁজ নিয়েছিলেন ছেনু মিত্তির লেনে পুব দিকে যে স্কুলটা আছে সেটা নাকি কর্পোরেশানের স্কুল। ওখানে পড়তে টাকা পয়সা তো লাগেই না তার ওপরে আবার কোন এক সংস্থা থেকে দুপুর বেলা বাচ্চাদের ভাত খেতে দেয়। ওই স্কুলের এক অঙ্কের স্যার মাঝে মাঝেই ইন্দুবালার হোটেলে খেতে আসতেন। ইন্দুবালা তাঁর কাছ থেকে সব নিয়ম নীতি শুনে স্কুলে চলে গিয়েছিলেন নিজেই। দুই ছেলেকে সেই স্কুলে ভর্তি করেছিলেন। প্রথম দিকে ধনা গিয়ে দিয়ে আসতো তাদের। কয়েকদিনের পরে নিজেরাই যেতে শিখলো।

    ছেলেদের হাতে ধরে শিখিয়েছিলেন ঘরের কাজ। রান্না-বান্না। কাপড় কাঁচা। বাসন মাজা। বড়টা অতটা গুছিয়ে করে উঠতে না পারলেও ছোটোটি শিখেছিল খুব মন দিয়ে। তার ওইসব বেশ ভালো লাগতো। বড়টা আগলে রাখতে শিখেছিল ভাই বোনকে। কখনও কখনও মাকেও। কাজ না পারা নিয়ে বড় খোকা কম মার খেয়েছে ইন্দুবালার কাছে? ধনঞ্জয়ের আবার এইসব কিছু সহ্য হতো না। “ওইটুকু ছোটো ছোটো হাতে ছাই ঘাঁটবে মা?” ইন্দুবালার জবাব ছিল, “না হলে পদ্ম হবে কী করে?” ইন্দুবালা ছেলে মেয়েদের সামনে যে কঠোর কঠিন অনুশাসন রেখেছিলেন আমাদের বাঙালি ঘরে সেটা বড় একটা দেখা যায় না। কেন এমন কঠোর হয়েছিলেন ইন্দুবালা? তাঁকে তো এমন অনুশাসনের মধ্যে বড় হতে হয়নি। একটা নয় একাধিক কারণ এর পেছনে ছিল। তিনটে নদী পেরিয়ে যেদিন তিনি কলকাতায় এসে এই মল্লিক বাড়িতে ঢুকেছিলেন সেদিন থেকেই বুঝেছিলেন তার ভাগ্য কলাপোতায় যেমন টিমটিম করে জ্বলছিল এখানে এসে বুঝি তা নিভলো। কলকাতার বাবুরা বিকেলে গলায় পাউডার মেখে তাস পেটায়। রাতে বউ পেটায়। ভোরে সোহাগ করে। আর গোটা দিন পাশ বালিশ বুকে জড়িয়ে ঘুমোয়। কিংবা চিৎপুরে কোনো মনের মানুষের বাড়িতে মাছের তেল চচ্চড়ি খেয়ে গা-হাত-পা মালিশ করায়। ইন্দুবালার এই বাড়িতে নানা রকমের প্রতিবন্ধকতা ছিল। জীবনের নানা চড়াই উতরাই বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যে ইন্দুবালাকে করে দিয়েছিল ক্ষতবিক্ষত। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যদি কোনোদিন কোনো সন্তান আসে তাঁর জীবনে তাহলে এই বাড়ির কোন পূর্ব পুরুষের ছায়া তিনি তাদের ওপর পড়তে দেবেন না। বড় ছেলে যখন পেটে শাশুড়ি তখন সবে তাঁর চলৎশক্তি হারাতে বসেছেন। তাও তাঁর খানদানি মেজাজে তখনও বয়সের জং পড়েনি। নাতির মুখ যে বুড়ি দেখতে পাবেন সেই আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন তিনি। কাজেই বাড়িতে পিতৃপুরুষের মুখে জল দেওয়ার লোক এসেছে শুনে তিনি আহ্লাদিত হয়েছিলেন। কিন্তু নাতিকে তেল মাখানো ছাড়া বড় বেশি সোহাগ করার সময় পাননি। ছোটো ছেলে যখন হলো শাশুড়ি বিছানা নিলেন। আর মেয়েকে দেখে যাওয়ার অবকাশ তাঁর হয়নি। যে বাড়িতে মা ষষ্ঠী বিরূপ বলে দোজবরে ছেলের আবার বিয়ে দিয়েছিলেন সেই বাড়ির উঠোন জোড়া বাচ্চাদের কলকাকলি শুনে যাওয়ার সৌভাগ্য তাঁর হয়নি। কিন্তু মনে মনে এক পরম শান্তির গিঁট দিয়েছিলেন তিনি। এক গুষ্টি ঘটির মাঝে এক বাঙাল মেয়ে নিয়ে আসার দূরদর্শিতার বাহবা দিতে দিতে বুড়ি চোখ বুজেছিলেন। মাস্টার রতনলাল মল্লিক পরলোকে গিয়েছিলেন তারও কিছুদিন পরে। ইন্দুবালা নিজে হাতে মুখাগ্নি থেকে শুরু করে শ্রাদ্ধ শান্তি তো করে ছিলেনই এমনকি এখনও পর্যন্ত প্রত্যেক মহালয়ায় বাড়িতে পুরোহিত ডেকে বাপের বাড়ি আর শ্বশুরবাড়ির স্বর্গীয় আত্মীয়স্বজনদের জলের ব্যবস্থা করেন। নিজে দিতে পারেন না বলে পুরোহিতকে দিয়ে দেওয়ান। ছেলেমেয়েদের সেই দিকে ঘেঁষতে দেন না একটুও। বড় হলেও না। এই নিয়ে তাদের অনেক প্রশ্ন ছিল। সব জবাব থেমে যেত ইন্দুবালা যখন বলতেন “আগে মরি তারপর নিজেরাই সব সামলিও”। প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ছেলেরা মল্লিক বাড়ির শেকড়ের উৎস সন্ধানে নিজেরা যখন আগ বাড়িয়ে গেছে আশেপাশের আত্মীয়স্বজনের সাথে মিশতে তখন হোঁচট খেয়েছে বারে বারে। তারা বুঝতে পেরেছে মা কেন তাদের বাড়ির চারপাশের জমাট অন্ধকার থেকে এইভাবে দূরে রেখেছে। কেন তাদের কাছে স্বপ্নের মতো হয়ে উঠেছে। খুলনার কোন এক অখ্যাত অজ গাঁ কলাপোতা। বাবার থেকে তারা না-দেখা মামার বাড়ির গ্রামটাকে যেন বেশি করে চেনে। মাস্টার রতনলাল মল্লিক তাদের কাছে বাবা হিসেবে কাগজে কলমে পরিচয় ছাড়া আর কিছুই কোনো দিন ছিলেন না। মাঝে মাঝে ঝোড়ো হাওয়ার মতো শ্বশুরবাড়ির কোনো দূর সম্পর্কের বদ আত্মীয় এসে সম্পত্তি বাগাতে চেষ্টা করেছে। ছেলেদের উস্কিয়ে দিয়েছে। লোভ দেখিয়েছে। ইন্দুবালা নিজে সেই সব ফাটল মেরামতি করেছেন। এখানে এইগুলো হয়তো বিস্তারে বলা যেতে পারতো তাহলে আর পাঁচটা ঘরের কূটকচালির মতো শোনাতো ব্যাপারটা। লাউয়ের খোসা পোস্ত দিয়ে ভাজার স্বাদটা আর থাকতো না। গরম ভাতও হয়ে যেত জুরোনো। ছোটো থেকে বাচ্চারা এই ছেনু মিত্তির লেন ছেড়ে বেরোয়নি খুব একটা। বাবা বাছা করে আদর করেনি তাদের কেউ। মামার বাড়ি থেকে আসেনি তাদের জন্য কোনোদিন পুজোর জামা। কিংবা বাবার দিকের কোনো কুটুম পয়লা বৈশাখে পাঠায়নি মিষ্টির হাঁড়ি। অথচ তারা জানতো খুলনা বলে একটা জায়গা আছে। কলাপোতা বলে একটা গ্রাম। সেই গ্রামে একটা বড় উঠোনওয়ালা বাড়ি আছে। সেই বাড়িতে একটা তুলসী মঞ্চ আছে। কপোতাক্ষ নদের পাড়ে আছে মায়ের স্কুল। একটা নতুন রাষ্ট্রের স্বপ্ন বুকে নিয়ে বাংলা ভাষার জন্য তাদের মামা, দিদা সবাই শহীদ হয়েছে। তাদের মা আসলে শহীদ পরিবারের মেয়ে।

    আদর আহ্লাদে ইন্দুবালা বড় করেননি ছেলে মেয়েদের ঠিকই তাই বলে ভাব ভালোবাসা ছিল না বললে কথকের পাপ বাড়বে। ইন্দুবালার ভালোবাসা সেই ছোট্ট থেকে ছেলে মেয়েরা বুঝে গিয়েছিল অন্যরকম ভাবে। তাদের জন্য বড় বড় বয়ামে, কাঁচের শিশিতে, অ্যালুমিনিয়ামের কৌটোয় ইন্দুবালা যত্ন করে কত কিছু যে খাবার করে রাখতেন। কোনটাতে নাড়ু, কোনটাতে মুড়ির মোয়া, চিড়ে ভাজা, কুচো নিমকি, গজা। আরও কত কী যে! আজ তা নিজেও মনে করতে পারেন না। বড় ছেলে যেবার বি এ পরীক্ষা দিল সেবার নিজে গিয়ে কালীঘাটের মায়ের কাছে পুজো দিয়ে এসেছিলেন। বলে এসেছিলেন কোনোদিন নিজের জন্য তিনি কিছু চাননি কিন্তু ওকে দাঁড়াবার জায়গাটুকু করে দিও মা। ছেলে ভালোভাবে পাশ করেছিল। ইন্দুবালা জানতেন একটাকে দাঁড় করাতে পারলে বাকিগুলোও ঝপঝপ করে দাঁড়িয়ে পড়বে। বাস্তবে তাই হয়েছিল। বড় ছেলে প্রথম চাকরির মাইনে সবটাই মাকে মানি অর্ডারে পাঠিয়ে ছিল দিল্লি থেকে। ইন্দুবালা খুশি হয়েছিলেন মনে মনে। কিন্তু মুখে কিছু প্রকাশ করেননি। টাকা তো তিনি নেননি। বরং কয়েক মাসের মধ্যে ছেলের বিয়ে দিয়ে আলাদা করে দিয়েছিলেন। বাকি দুটো কথা শোনাতে এলে ইন্দুবালা তাদের মুখের ওপর সোজাসাপটা বলে দিয়েছিলেন নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে এবার নিজেদের পথ দেখতে হবে। তাঁর চারপাশে থেকে ভিড় বাড়ানো বরদাস্ত করবেন না তিনি। বড় রুক্ষ মনে হয়েছিল সেদিন কি ইন্দুবালাকে? তা তো হয়েছিলই। কিন্তু তিনি জানতেন প্রথম থেকে দূরে না সরালে আর কোনোদিনই যে ওরা নিজেদের গুছিয়ে উঠতে পারবে না। নিজের সংসার হবে না। মাথা গোঁজার জায়গাও।

    আস্তে আস্তে বাড়ি ফাঁকা হয়ে গেল ইন্দুবালার। জীবনটা তো তারও অনেকদিন আগেই ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। ধনঞ্জয় শাপশাপান্ত করলো। “কেমন মা তুমি? ছেলে মেয়েদের দূর করে দিলে? মরার সময় জল পাবে না দেখে নিও”। ভর সন্ধেবেলায় ধনঞ্জয়ের কথাটা বুকে বড় বেজেছিল। কিন্তু ইন্দুবালা জানতেন তাঁর দুই কূলে কেউই মরার আগে জল পায়নি। তিনিও যে পাবেন সেই আশাও করেন না। ইন্দুবালা তাই প্রতি বছর মহালয়ায় পিতৃপক্ষে কালো তিলের সাথে গঙ্গাজল উৎসর্গ করেন। কলাপাতার ডোঙায়, কুশের আংটি পরে পিতামহ থেকে শুরু করে মাতামহ, শ্বশুর বাড়ির তিনকূলের কেউই বাদ পড়ে না। এমনকি মনিরুল, সেই কবেকার একাত্তরের যুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া নিজের প্রথম প্রেমকে পর্যন্ত সারাদিন নির্জলা থেকে ইন্দুবালা জল দেন। প্রথম প্রথম লোকজনের খুব চোখ টাটিয়ে ছিল। “মেয়ে মানুষ আবার তর্পণ করবে কি গো?” আত্মীয় কুটুমরা যাঁরা তখনও সাপে নেউলের মতো পেছনে পড়েছিল, কথা শোনাতে ছাড়েনি। ইন্দুবালা কারোর কথা কিছু শোনেননি। একটা লম্বা নামের তালিকা তৈরী করে চারপাশের অসংখ্য পরিচিত অপরিচিত আত্মার মুখে কালো তিল আর গঙ্গা জল কুশের আংটি পড়ে ঢেলে গেছেন। “তোমরা যারা জল পাওনি জল খাও। ইন্দুবালাকে ক্ষমা করে দিও।” গড় হয়ে প্রণাম করে শেষে এই কথাগুলো বলতেন তিনি। কাজেই যাদের কাছে মহালয়া ছিল সকালে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের চণ্ডীপাঠ, “জাগো তুমি জাগো…” গানের ধুয়ো। ইন্দুবালার কাছে ছিল সেটা মৃত্যুর উৎসব। অতি প্রিয়জন থেকে শুরু করে অচেনা লোকদের আবাহন করা। এক বিস্মৃত স্মৃতির পথে নিরন্তর পরিক্রমণ। মনটা ঝুপ করে খারাপ হয়ে যায় ইন্দুবালার। ধনঞ্জয় সেটা বুঝতে পারে। বিরক্ত করে না তখন সে একটুও। নিজে নিজে উনুন ধরায়। সবজি কাটে। আটা মাখে। ইন্দুবালা নীচে নামেন অনেক দেরি করে। মহালয়ায় ইন্দুবালার হোটেলের মেনু সাদা তিলের বড়া, নারকেল ডাল, কুচো মাছের চচ্চড়ি আর চালতার চাটনি। মেসের ছেলে মেয়েগুলো হাপুস হুপুস করে খেয়ে আঙুল চাটতে চাটতে চলে যায়। চাঁদপানা মুখগুলো আবার কয়েকদিন দেখতে পাবেন না ইন্দুবালা। সবাই বাড়ি যাবে যে পুজোর ছুটিতে। যাওয়ার আগে কেউ প্রণাম করে। কেউ আবার বা আদর করে জড়িয়ে ধরে। কেউ চুমু খায়। কেউ আবার সেলফি তোলে। দিদাকে তারা নাকি খুব মিস করবে। “ভালো থেকো তুমি। আর পুজোয় একদম ভালো ভালো রান্না করো না। তাহলে ওই ধনাদাই সব খাবে”। কত কী সব কলবল করতে করতে বেরিয়ে যায় ওরা। আরও ফাঁকা হয়ে যায় ইন্দুবালার চারপাশ।

    কিচ্ছুটি মুখে না দিয়ে ইন্দুবালা ওপরের ঘরে গিয়ে চুপটি করে বসেন। কাদের জন্য তার এত ফাঁকা ফাঁকা লাগে? সব্বাইকে নিয়ে থাকলে আজ এই নিশুতি রাতে বাড়ি গমগম করতো। কোনো ঝগড়া নেই, ঝাঁটি নেই, মনের কোনো মালিন্য নেই। তবুও ছেলে মেয়েগুলোকে এত দূরে সরিয়ে রেখে কি পেলেন তিনি? একা বাঁচার সুখ? কার ওপর অভিমান করে একা হয়ে গেলেন তিনি? বাবা? মনিরুল? মাস্টার রতনলাল মল্লিক? নাকি অদৃষ্ট? দম বন্ধ হয়ে আসে তাঁর। রাতগুলোতে দুচোখের পাতা এখন আর এক করতে পারেন না। ঘুম যেন তাঁর থেকে দূরে পালায়। সাত পাঁচ চিন্তা মাথার মধ্যে পাক খেতে থাকে কপোতাক্ষের ঘোলা জলের মতো। ঠিক এইরকম সময়ে ইন্দুবালার যেটা হয় তিনি আর চুপ করে বসে থাকতে পারেন না। কাজ করতে হয় তাঁকে। প্রচুর কাজ। মনে পড়ে যায় দশটা নারকেলের কথা। কিলোটাক ক্ষোয়া ক্ষীর। কেজি খানেক চিনি। ধনঞ্জয় মাঝরাতে শুনতে পায় রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে খড়খড় আওয়াজ। চোর ঢুকলো নাকি পুজোর আগে রান্নাঘরে। একটা বড় গামলা নিয়ে গেলেও তো অনেক। পা টিপে টিপে এগিয়ে দেখে দরজা হাট করে খোলা। রান্নাঘরের মেঝেতে সব কিছু সাজিয়ে নিয়ে নারকেল কুরছেন ইন্দুবালা। খিঁচিয়ে ওঠে ধনঞ্জয়। “নিজে তো শান্তি পাবেই না। আমাকেও শান্তি দেবে না তুমি?” ইন্দুবালা মুখ না তুলেই বলেন “তুই শুতে যা ধনঞ্জয়। আর যাওয়ার সময় রান্না ঘরের দোরটা দিয়ে যা”। ধনঞ্জয় যেতে চায় না। “কাল সকালে এইসব নিয়ে বসলে হতো না? এই এতো গুলো নারকেল এখন কুরবে? বাটবে?” ইন্দুবালা বলেন “আমার ঘুম আসছে না।” ধনঞ্জয় বিরক্ত হয়। “তা আসবে কেন? ঘুমের ওষুধ খেয়েছো?” ইন্দুবালা এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দেন না। অনেকবার তাকে ডাক্তার ঘুমের ওষুধ দিয়েছে কিন্তু তিনি একবারের জন্যেও সে ওষুধ খাননি। তাঁর মনে হয় একবার খেলে আর যদি কোনোদিন ঘুম না ভাঙে? এই তো কয়েকদিন পরেই হয়তো ঘুমিয়ে পড়বেন চিরকালের জন্যে। তার আগে ওষুধ খেয়ে কী হবে? তার চেয়ে এই ভালো। সারা রাত ধরে কাজ করবেন। ধনঞ্জয়ের মেজাজ তিরিক্ষে হয়। “ওঠো তো এবার। যাও ঘরে যাও। ঘুম না আসে তো ছেলে মেয়েরা পুজোয় কত কী পাঠিয়েছে সেগুলো দেখো গিয়ে। প্যাকেট পর্যন্ত খোলার সময় হয়নি তোমার।” প্রত্যেক বছর ছেলের বউরা কত দামি দামি শাড়ি দেয়। সেগুলো পরা হয় না তেমন ইন্দুবালার। আলমারি ঠাসা হয়ে পড়ে থাকে। বড় নাতনি সুনয়নী আলমারি খুলে একবার অবাক হয়ে গিয়েছিল। এত এত কাপড় তার ঠাম্মি জমিয়ে রেখে দিয়েছে? ইন্দুবালা হেসে বলেছিলেন “একটা সময় ছিল দুটো কাপড়ে সারা বছর চালিয়েছি। এখন ওগুলো দেখেও সুখ। কোথাও কি যাই যে পরবো?” সুনয়নী তাঁকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল কোথাও না সিনেমা দেখতে। “যাবে ঠাম্মি? একবার চলো না। কী বিশাল বড় মল। তার মধ্যে সিনেমা হল। চলন্ত সিঁড়ি দিয়ে তোমাকে উঠিয়ে নিয়ে যাবো দোতলায়। মোটা গদিওয়ালা সিটে হেলান দিয়ে বসবে।” ইন্দুবালা যাননি। লছমীও তাকে বলেছিল সিনেমা দেখাতে নিয়ে যাবে সেবার। টিকিট কেটে এনেছিল। কিন্তু কলকাতা তখন জ্বলছে। সিনেমার হলের সামনে থেকে ফিরে আসতে হয়েছিল তিনটে বাচ্চাকে সঙ্গে নিয়ে। বোম পড়েছিল। কারা যেন বাসে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। একটা বড় মিছিলের ওপর পুলিশ লাঠিচার্জ করেছিল। কোন রকমে বাড়ি পৌঁছাতে পেরেছিলেন ওরা। তারও অনেক পরে অলোকরা ভাত খেতে এলে বুঝেছিলেন কলকাতার পরিস্থিতি। না হলে এই ছেনু মিত্তির লেনে দিন দুনিয়ার খবর তিনি পাবেন কী করে? ধনঞ্জয় আবার ঘ্যানঘ্যান করে। “ঘুম না এলে সেলাই-ফোঁড়াই করো। সেটাও ভালো না লাগলে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকো। আমি গরম জল করে হট ব্যাগে ঢেলে দিচ্ছি। পিঠে নিয়ে শোও আরাম পাবে”। ইন্দুবালা খুব শান্তভাবে তাকান ধনঞ্জয়ের দিকে। এই সময়ে তাঁর একটুও ঝগড়া করতে ইচ্ছে করে না। “আমি কী করবো না করবো সব তুই বলে দিবি নাকি ধনা?” ইন্দুবালার এই চাহনি ধনঞ্জয় চেনে। মনে যা ভেবেছে তাই করবে। সে দাঁড়ায় না। রান্নাঘরের দোর এঁটে চলে যায়। নারকেল কুরতে কুরতে কোথা থেকে ইন্দুবালা যেন বাতাসে পান শিউলি ফুলের গন্ধ। চোখ বন্ধ করলে হরি বোষ্টমীর গান ভেসে আসে। “যাও গিরিরাজ আনিতে গৌরী… উমা আমার কত কেঁদেছে”। ঠাম্মার হাতে সিধে। মায়ের চোখ জলে ভরো ভরো। কপোতাক্ষের ধার ধরে কাশ ফুলের মাঠ পেরিয়ে আসছে ঢাকির দল। বাবা এনেছে নতুন শাড়ি ইন্দুর জন্য। লাল পাড়ের ওপর ডুরে কাটা। কখন সেটা পরবে ভেবেই আর ঘুম আসছে না তার। ওদিকে চণ্ডীমণ্ডপে অধিবাসের ঘট বসে গেছে। মহালয়াতে পুজোও হয়েছে কাঁসর ঘন্টা পিটিয়ে। তিনটে গ্রাম পেরিয়ে ঠাকুর গড়তে আসা কুমুদ পালের তখনও চোখ আঁকা হয়নি মা দুর্গার। তাঁর ছানাপোনাদের। অনেকের সাথে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে ইন্দুবালাও চণ্ডীমণ্ডপে থামের সামনে। টিমটিম করে জ্বলছে কুপি। কুমুদ পাল তোরজোড় করছে কাজ শুরু করার। ঠিক সেই সময়ে কেউ একজন খোঁচা মারে ইন্দুবালাকে। সে বিরক্ত হয়। পেছন ফিরে দেখে অতসী। স্কুলে একই ক্লাসে পড়ে। তারই দিকে তাকিয়ে। “মুখে বল না অতসী ওমন খোঁচাচ্ছিস কেন?” অতসী ফিসফিস করে বলে, “বাড়ি চল। মেয়েদের ন্যাংটা হঠাকুর দেখতে নেই। মা বলেছে”। ইন্দুবালা বলে “তোর মা বলেছে যখন তুই যা না। আমি এখন চোখ আঁকা দেখবো। তারপর দুগগার শাড়ি পরাও”। অতসী মুখ বাঁকায়। “এইজন্যে সবাই তোকে ঢুলুনি বলে। ব্যাটাছেলেদের গায়ে পড়া। ওই দ্যাখ কে এসেছে। ডাকছে তোকে”। ইন্দুবালা ফিরে তাকায়। দূরে অন্ধকারে বড় জাম গাছটার নীচে টিপ টিপ জোনাকির আলোর মধ্যেই সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মনিরুল। যদিও মনিরুল তাকে ডাকছে না একটুও। অনেক দূর থেকে সে দেখছে ঠাকুরের রঙ করা। তার সমবয়সী অনেক মুসলমান ছেলে এইসব দেখা হারাম বলে এই পথ মাড়ায় না বড় একটা। কিন্তু মনিরুলের কেমন যেন অদ্ভুত ভালো লাগে। ওই টানা টানা চোখ দুটোতে লাল কালির কাজল পরানো। কোন মায়া যেন তাকে ডাকে। ঠিক তার ইন্দুবালার চোখ দুটোর কথা মনে পড়ে যায় তখন। ভাবতে অবাক লাগে তার একটা মাটির তাল কীভাবে হয়ে ওঠে ঠিক রক্ত মাংসের মানুষের মতো। তার মধ্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা পায়। ঘরের মেয়ে বলে পুজো করা হয় তাকে। হনহন করে এগিয়ে আসে ইন্দুবালা মনিরুলের দিকে। এত রাতের আঁধারে ওইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার রাগটা যেন চড়াং করে মাথায় ওঠে। “এখানে কী করছিস তুই?” মনিরুল যে তৈরী ছিল না এই অতর্কিত আক্রমণের জন্য। সে ভেবেছিল তাকে যদি দেখতে পায় ইন্দুবালা, তাহলে হয়তো ভালো লাগবে তার। কিন্তু যেভাবে ইন্দুবালা ঝাঁপিয়ে এসে পড়লো তার সামনে ব্যাপারটা একটুও সুবিধের বলে মনে হলো না মনিরুলের। এমনিতেই হিন্দু পাড়ায় পুজোর সময়ে চণ্ডীমণ্ডপের সামনে ঘোরাঘুরি অনেকেই পছন্দ করে না। এমনকি তার ধর্মের মাতব্বর লোকজনও না। কাজেই বেশ ঝুঁকি নিয়েই আসে মনিরুল। তার ওপরে আবার ইন্দুবালার রাগ। আমতা আমতা করে বলে, “ঠাকুরের রঙ করা দেখছিলাম ইন্দু।” ইন্দুবালা আরও রেগে যায়। “তোর আবার ঠাকুরের রঙ করা দেখার কী আছে? আমি যা করবো তোকেও তাই করতে হবে মনিরুল?” রাগলে মেয়েটার নাকটা ফুলে ওঠে। মনিরুলের সেটা দেখতে ভালো লাগে। কিন্তু এখন একটুও তাকাতে পারছে না সে ইন্দুবালার মুখের দিকে। সবে গোঁফ ওঠা ছেলেটা মাথা নীচু করেই বলছে “তোর খারাপ লাগবে জানলে আসতাম না”। ইন্দুবালা আরও ঝাঁঝিয়ে বলে ওঠে “আসবি না”। চলে যাচ্ছে মনিরুল আস্তে আস্তে সাইকেল নিয়ে হেঁটে হেঁটে। ইন্দুবালাও ফিরে যাচ্ছে চণ্ডীমণ্ডপে। কিন্তু সে দেখতে তো পাচ্ছে না মনিরুলের চোখে তখন শরতের জলে ভরা মেঘ। দু চোখ ছাপিয়ে গাল বেয়ে নামছে জলের ধারা। সবে ওঠা দাড়িগুলো ভিজে যাচ্ছে ভালোবাসার অভিমানে। জোনাকিগুলো ফিসফিস করে বলছে “ভালোবাসিস নাকি মনিরুল তুই ইন্দুকে…?”

    ওদিকে চণ্ডীমণ্ডপে ততক্ষণে মা দুগগার চোখ আঁকা হচ্ছে। কুমুদ পাল তার শিল্পী হাতের ছোঁওয়ায় দেবীর প্রাণ প্রতিষ্ঠা করছেন। কপোতাক্ষের মাটির ঠাকুরও যেন জ্যান্ত হয়ে উঠছে একটু একটু করে। কিন্তু এইসব তখন আর ভালো লাগছে না ইন্দুবালার দেখতে। মনটা কেমন যেন খারাপ হয়ে গেছে তার। বাড়ি চলে যাচ্ছে ইন্দুবালা। কেন অমন করে বলতে গেল সে মনিরুলকে? কী ক্ষতি হতো মনিরুল দুগগার চোখ আঁকা দেখলে? সবাই তো দেখছিল। ওই অতসীটাই হচ্ছে যত নষ্টের গোড়া। ইন্দুবালাকে বলে কিনা ছেলে ঢলানি? যত রাগটা সে অতসীর দিকে নিয়ে যেতে চায় তত রাগ গড়িয়ে আসে নিজের দিকে। ঠিক করলো কী ইন্দুবালা? নিজের সবচেয়ে কাছের বন্ধুকে অমন করে বললো সে? প্রত্যেক বছরই তো মনিরুল চণ্ডীমণ্ডপে আসে। ওদের সাথেই ঠাকুরের রঙ করা দেখে। এবার কেন মনিরুলকে তার অন্যরকম মনে হচ্ছে? কেন বারবার মনে হচ্ছে এইসব কিছু আসলে মনিরুলের জন্যে করছে সে। মা দুর্গার চোখ আঁকা দেখে এসে ভেবেছিল সে একটা বড় চিঠি লিখবে মনিরুলকে। এবার যদি মনিরুল সেখানেই এসে গেল তাহলে লিখবে কী করে? আর যদি লেখেও তাহলে কী থাকবে সেই চিঠিতে! এমন কিছু তো আর নেই যা দেখেনি মনিরুল! “আমি তোকে ওইভাবে বলতে চাইনি মনিরুল। আমি আসলে আমার আনন্দগুলো তোকে লুকিয়ে চিঠিতে লিখতে চেয়েছিলাম”। থমকে দাঁড়ায় ইন্দুবালা অন্ধকারে আমলকি গাছটার নীচে। এইসব কী ভাবছে সে? নিজের গোপন আনন্দগুলো লিখতে চায় মনিরুলকে? ভালোবেসে ফেললো নাকি ছেলেটাকে? অন্ধকারে পুকুর পাড়ের সেই আমলকি গাছের তলায় দাঁড়িয়ে নিজেই যেন নিজের মুখ চাপা দেয় ইন্দুবালা। কী বলছে সে? এক মুসলমান ছেলের সাথে এক হিন্দু মেয়ের বিয়ে? এই গ্রামের কেউ হতে দেবে না। কোনোদিন না। ঠিক সেই সময়ে ঝোঁপ থেকে বুড়ো তক্ষকটা যেন বলে উঠছিল ঠিক ঠিক। এই নিস্তব্ধ রাত্রে পুকুরে জলের মধ্যে ঢেউ তুলে সেই কবে রিয়াজকে ভালোবাসতে গিয়ে মরে যাওয়া স্বর্ণলতা ভেসে উঠে বলেছিল “সাবধান ইন্দু… সাবধান..ওরা তোকে বাঁচতে দেবে না…।” প্রচণ্ড ভয়ে সেই আঁধার রাতে ছুটেছিল ইন্দুবালা। প্রথম ভালোবাসার আবিষ্কার যেন তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল গোটা পথ জুড়ে।

    খিড়কির দরজা খুলে তার মনটা অবশ্য ভালো হয়ে গেল। ঠাম্মা উঠোন জুড়ে বসে নারকেল কুরছে। আর একদিকে দুধ জ্বাল দিচ্ছে কাঠের উনুনে। “কী করবে ঠাম্মা?” ঠাম্মা হাসে “দ্যাখ না কী করব”। ইন্দুবালা নাছোড়। না আমাকে বলতেই হবে কী করছো তুমি”। ঠাম্মা বলে “ওই বারকোষটা তোল তো ইন্দু”। এগিয়ে যায় ইন্দুবালা। বারকোষ তোলে। তার নীচে সাজানো ছোটো ছোটো ছাঁচ। কোনোটা ময়ূর। কোনোটা পান পাতা। কোনোটা আলপনার নক্সা। ইন্দুবালার মুখটা যেন এই অন্ধকারে আরও আলো হয়ে ওঠে। “তুমি চন্দ্রপুলি গড়বে ঠাম্মা?” সরাসরি কোনো উত্তর দেয় না ইন্দুবালার ঠাম্মা। “মা দুগগাকে দেখেছিস তো দিদিভাই? কেমন এক চালার নীচে স্বামী সন্তানদের নিয়ে শান্তিতে আছে। ওই শান্তিটাই বড় জিনিস। ওটা না থাকলে জীবনে কিছুই থাকবে না”। ইন্দুবালা নড়ে চড়ে বসে। “অশান্তির কী হলো ঠাম্মা? আমি কি কিছু করেছি?” ঠাম্মা নারকেল বাটতে বাটতে বলে “না তুই কেন করবি দিদিভাই। মানুষ করে। মানুষ মানুষের নামে বদনাম রটায়। এতো রাতে সোমত্ত মেয়ে বাইরে থাকলে বাড়ির অমঙ্গল হয়। গাঁয়ের লোকে দু চার কথা বলে”। ইন্দুবালার চোখ ফেটে জল আসে। “আমি কিছু করিনি ঠাম্মা। মনিরুলকে চলে যেতে বলেছিলাম।”। মেয়ের সরলতা দেখে ঠাম্মা কী করবে বুঝতে পারে না। বাড়ির ভেতরে যাতে আওয়াজ না যায় তাই তক্ষুনি ইন্দুবালার হাতে ধরিয়ে দেয় হাতাখানা। “দুধটা আস্তে আস্তে ঘন হয়ে উঠছে দিদিভাই। যতক্ষণ না ক্ষীর হচ্ছে নাড়তে হবে। তলায় লেগে গেলেই মুশকিল। ধরা দুধের গন্ধ হলে চন্দ্রপুলি কেউ খাবে না যে”।

    নারকেল কোরা হয়ে গেছে ইন্দুবালার। এই বয়সে দশটা নারকেল কোরা চাড্ডিখানি কথা নয়। ঘামছেন তিনি। এবার বাটতে হবে শিলে ফেলে পুরোটা। মিহি করে। যাতে একটু এবড়ো খেবড়ো কুচি না পড়ে মুখে। জিভে দেওয়ার সাথে সাথে যাতে গলে যায় চন্দ্রপুলি। দিনের বেলা হলে ধনঞ্জয় জোর করে মিক্সিতে বাটতে বলতো। কিন্তু ইন্দুবালা জানেন প্রাচীন এক শিলায় নারকেল বাটা আর যন্ত্রে বাটার মধ্যে অনেক তফাত থাকে। পাথরের ওই স্বাদটা কি তিনটে স্টেনলেস স্টিলের ব্লেড দিতে পারে? কখনোই না। ইন্দুবালা তাঁর শ্বশুরবাড়ির সেই কবেকার ভারি শিলখানা পাতেন। বাটতে বসেন। আর ওই দিকে তখন কবেকার যুগ এফাল ওফাল করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসে বড় খোকা, ছোট খোকা তার কোলে আবার খুকি। “আমরাও খাবো মা”। ইন্দুবালা বলেন “আগে হোক। তারপর খেও। এখন ঘুমিয়ে পড়ে যাও”। কিন্তু কেউ যেতে চায় না। তিনজনেই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে ইন্দুবালার দিকে। ইন্দুবালা বুঝতে পারেন এরা এখান থেকে কেউ নড়বে না। মায়ের জেদ আর ধৈর্য দুটোই তারা পেয়েছে যে। বড় ছেলেকে উনুনে দুধটা নাড়তে দিয়ে ছোটো ছেলেকে এলাচ ছাড়াতে বলেন। মেয়েটা কোলে ঢুললেও বারবার জেগে উঠছে। ছোটোর দিকে তাকিয়ে দাদ-দা বলছে। ও বাবা বলতে শেখেনি। কারণ বাবাকে ও দেখেনি। তাছাড়া এই বাড়িতে বাবা বলে কেউ কাউকে ডাকে না। তাই ওই শব্দটা আপাতত ওর জীবন থেকে উধাও। দুধ উথলে ওঠার মতো হলে বড় খোকা ফুঁ দেয়। ইন্দুবালা বকেন। “ওইভাবে মুখের হাওয়া দিতে আছে? ঠাকুর খাবে না?” ছোটো খোকা “এলাচ ছাড়াতে ছাড়াতে বলে, “তাহলে আমরা কখন খাবো মা?” মেয়েটা কোল থেকে “মা…মা..” বলে ডেকে ওঠে। ইন্দুবালা নারকেল বেটে চলেন। রাত বাড়তে থাকে। ঘন দুধ ক্ষীর হলে তার মধ্যে ওই নারকেল বাটা চিনি দিয়ে ভালো করে নাড়তে থাকেন। যতক্ষণ না মণ্ডটা শক্ত হয়। ছেলে দুটো ততক্ষণ বসে থাকে। রান্নাঘরের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে ঢোলে। মেয়েটা ঘুমের মধ্যে কাদা। ছোটো ছোটো ছাঁচে পুরগুলো পোরেন ইন্দুবালা। বড় কাঁসার থালায় ভর্তি হতে থাকে ময়ূর, নক্সাকাটা নৌকা, পাঁপড়ি মেলা ফুল, জলের মধ্যে হাঁস, পদ্মপাতার আলপনা আরও কত কত কী! ঘুম থেকে তুলে দেখান দুই ছেলেকে। মেয়েটার তো তখন অত বোঝার বয়েস হয়নি। হাঁ করে তাকিয়ে থাকে ছেলে দুটো। অবাক হয়ে। আর ইন্দুবালার ঠিক সেই মুহূর্তে কান্না পায়। ভীষণ কান্না। ফাঁকা রান্না ঘরে থালা ভরা চন্দ্রপুলি নিয়ে সত্তর পেরোনো ইন্দুবালা মুখে কাপড় খুঁজে হাহাকার করেন। পাছে ধনঞ্জয় শুনতে পায়। ছেলেদের ফোন করে ডাকে। ওরা যদি জেনে যায় ওদের মা সত্যি কত ভালোবাসে। ইন্দুবালা জানতে দিতে চান না তাঁর এই ভালোবাসা কাউকে। যাঁদেরই ভালোবাসতে গেছেন তারাই চলে গেছে পৃথিবী ছেড়ে। এটা যে অভিশাপ তাঁর জীবনে। উনি এই বয়সে সন্তান শোক পেতে চান না।

    ঠাম্মা তাকিয়ে থাকে ফর্সা হয়ে আসা আকাশের দিকে। কাঠের উনুন প্রায় নিভে গেছে। উঠোনখানা ভর্তি হয়ে আছে হাতে গড়া ঠাম্মার চন্দ্রপুলিতে। “মেয়ে মানুষের এত কান্না কিসের? বুকে পাথর না বসাতে পারলে মেয়ে মানুষ হয়েছিস কী জন্য তুই? যা সাজি ভরে শিউলি ফুল তুলে নিয়ে আয়তো দিদিভাই। বোধনের পুজোতে লাগবে। সঙ্গে কয়েকটা চন্দ্রপুলি নিয়ে যা। যাকে ভালো লাগবে তাকে দিস। জীবনে বিলিয়ে দেওয়ার চেয়ে আনন্দ আর কিছুতে নেই রে”। ইন্দুবালা শাড়ির আঁচলে বাঁধে চন্দ্রপুলি। সাজি নিয়ে সারা রাত না ঘুমোনো চোখে কন্যে চলে ফুল তুলতে। কিন্তু কোনদিকে যাচ্ছে সে? এ তো ভটচাজ পাড়া নয়। বিশালক্ষ্মী তলা পেরিয়ে সে যাচ্ছে মোক্তার পাড়ায়। কেন যাচ্ছে সে? অনেক ভোরে মোক্তার পাড়ার মাঠে শিউলি গাছটার নীচে কারা যেন সাদা চাদর মেলে বসে থাকে। সেই চাদরের টুকরোগুলো কুড়িয়ে সাজিতে ভরতে ভালো লাগে ইন্দুবালার। শরতের এই ভোরেও কেমন যেন হেমন্তের হাওয়া দিচ্ছে। শিরশির করছে গা। চারিদিকে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের মতো কুয়াশা জমাট বেঁধে আছে। থমকে দাঁড়ায় ইন্দুবালা শিউলি গাছটার সামনে এসে। কে ওখানে দাঁড়িয়ে? কে? এগিয়ে আসে মনিরুল। “এতো ভোরে এখানে কী করছিস?” কোনো কথা না বলে চলে যাচ্ছিল মনিরুল। যদিও সে জানতো এই গাছেরই ফুল কুড়োতে আসবে ইন্দুবালা। তাকে আসতেই হবে। সারা রাত তো ঘোরের মধ্যে এঁকেছে ইন্দুবালার চোখ। কাজল দিয়ে। টানা টানা। ইন্দুবালা ডাকে “মনিরুল…”। দাঁড়িয়ে পড়ে ছেলেটা। এগিয়ে আসে ইন্দুবালা। মনিরুল বিড়বিড় করে। কোনো এক শরৎ সকালে জীবনের প্রথম ভালোবাসার জন্য মিথ্যে কথা বলে “আমি জানতাম না তুই এখানে আসবি…। আমি তো…।” ইন্দুবালা হাত দিয়ে চাপা দেয় মনিরুলের ঠোঁট। যেন ছ্যাঁকা লাগে মনিরুলের। এতো তাপ কীসের? ইন্দুবালার হাত কাঁপছে। সে তাকিয়ে আছে মনিরুলের দিকেই। “আমাদের ঠাকুর ঘরে নবদ্বীপ থেকে আনা অনেক পুরোনো একটা কেষ্ট ঠাকুর আছে। ঠাম্মার শাশুড়ি তার শাশুড়ির ঠাকুর সেটা। তুই তার মতো চোখ কেন পেলি রে মনিরুল? সারাক্ষণ আমার চোখে ভাসে।” আস্তে আস্তে সরিয়ে নিয়েছিল ঠোঁটের ওপর থেকে হাতটা। বাড়ি ফিরে কতবার সেই হাত নিজের ঠোঁটের উপর রেখেছিল ইন্দুবালা। তার আগে শাড়ির খুঁট খুলে মনিরুলের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল সারা রাত ধরে তার আর ঠাম্মায় মিলে করা চন্দ্রপুলি। “ঠাম্মা বলেছে যাকে ভালো লাগবে তাকে দিস”। আর একটাও কথা না বলে, একটাও শিউলি ফুল না কুড়িয়ে খালি সাজি নিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিল মেয়ে। সেবার ইন্দুবালা বিছানায় শুয়ে কাটিয়েছিল পুজোটা। ধুম জ্বরে দশমীর সকালে দেখেছিল তার জানলার কাছে রাখা আছে এক মুঠো শিউলি ফুল। ছোট্ট চিরকুটে লেখা ছিল, “মা দুগগা বললো যাকে ভালো লাগে তাকে দিও”। সেদিন মনিরুলের হাতের লেখা চিনতে একটুও দেরি হয়নি ইন্দুবালার। দুজনের ভালো লাগা কোনো এক শরতের সকালে চন্দ্রপুলি আর শিউলি ফুলে মিলে গিয়েছিল। তারও অনেক দিন পরে কোনো এক শরতের মন কেমন করা দিনে কপোতাক্ষের পলি কাদা মেখে পড়ে ছিল মুক্তিযোদ্ধা মনিরুলের দেহ। সে বছর সেই গ্রামে কোনো দুর্গাপুজো হয়েছিল কিনা জানেন না ইন্দুবালা। সেই বছর তো যুদ্ধ। নতুন দেশ গড়ার স্বপ্ন সবার চোখে। সেই চোখগুলো খুঁজে খুঁজে গঙ্গা জলে কালো তিল দিয়ে তর্পণ করেন ইন্দুবালা। পুজোতে তাই মন ভালো থাকে না তাঁর। পুজো কাটে বিষণ্ণতায়।

    সকালে উঠে ধনঞ্জয় দেখে কাঁচের বয়ামে ভর্তি করে রাখা আছে চন্দ্রপুলি। ইন্দুবালা তখন কুচো গজা ভাজছেন। ঠিক করে রেখেছেন ওবেলায় লবঙ্গ লতিকা করবেন। ধনঞ্জয় বুঝতে পারে না এটা কি ইন্দুবালার পাগলামো না জেদ? “সারা রাত এইসব করে তুমি তো মরবেই। তোমার ছেলেরা আমাকে জেলে দেবে।” ইন্দুবালা কুচো গজা ছাঁকনি দিয়ে তুলে চিনির রসে ভিজিয়ে দিয়ে বলেন, “আহা ধনা তুই ওইভাবে বলিস না। ছেলে-মেয়েগুলো বিজয়ার পরে এসে একটু মিষ্টি মুখ করবে না? ওই যে চাঁদা তুলতে এসেছিল নন্টু পিন্টু। বাজারের লোকগুলো। কালেক্টার অফিসের বাবুরা। এদের একটু দেবো না হাতে তুলে?” হোটেল যবে থেকে শুরু হয়েছিল সেই বছর পুজো থেকেই বিজয়ার মিষ্টি শুরু করেছিলেন ইন্দুবালা। সেই সময়ে লছমী থাকতো। হাতে হাতে কাজগুলো করে দিত মাঝে মাঝে। দুই ছেলে, মেয়েও সাহায্য করতো অল্প স্বল্প। একটু বড় হলে তারা ঠাকুর দেখার নাম করে কেটে পড়তো যে যার মতো। শুধু ইন্দুবালা থেকে যেতেন একা। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমী কেটে যেত তাঁর রান্নাঘরে বিজয়ার মিষ্টি তৈরীতে। তাঁর না ছিল নতুন কাপড় পরা। না ছিল প্যাণ্ডেলে গিয়ে অঞ্জলি দেওয়া। সেসব তিনি বিয়ের আগে কলাপোতার কপোতাক্ষে বিসর্জন দিয়ে এসেছিলেন অনেক দিন আগেই।

    দশমীর সন্ধ্যেতে বৃষ্টি নামে ঝমঝম করে। সেই বৃষ্টির মধ্যেই ইন্দুবালা ভাতের হোটেলের সামনে এক এক করে গাড়ি এসে দাঁড়ায়। বড় খোকা আসে। ছোটো খোকা। তাদের বউরা। নাতি-নাতনি সবাই। প্রণাম করে। একতলা থেকে দোতলা সবাই হইচই করে দাপিয়ে বেড়ায়। মায়ের হাতে তৈরী চন্দ্রপুলি, কুচোগজা, লবঙ্গ লতিকা, নিমকি সবাই পেট পুরে খায়। ব্যাগ ভর্তি করে নিয়ে যায়। ওরা সবাই গল্প করে। ওদের মাঝে বসেই ইন্দুবালা চুপ করে শোনেন সেই গল্প। কোথায় কোন ঠাকুর কত বড় হলো। কে প্রাইজ পেলো। তাঁতের সবচেয়ে দামি শাড়িটা পরতে গিয়ে বড় বউয়ের কী হলো? নাতি নাতনিরা কীভাবে পুজো কাটালো। কোথায় কত লোক হলো। অঞ্জলি দিতে গিয়ে পুরোহিত কেমন বাজে করে মন্ত্র পড়ছিল। ছোটো বউরা কোন রেস্টুরেন্টের খাবার খেতে গিয়ে একেবারে মুখে তুলতে পারেনি এইসব। তার মধ্যে খুকি ব্যাঙ্গালোর থেকে ভিডিও কল করলে ওদের নিজেদের মধ্যে গল্প আরও বাড়ে। সবাই সবার সাথে কথা বলে। কিন্তু ওদের সবার মধ্যে বসে থেকেও ইন্দুবালার কিছু গল্প করার থাকে না। ছেলেরাও একবারের জন্যেও জানতে চায় না তাদের মা কোথাও গিয়েছিল কিনা। অঞ্জলি দিয়েছে কিনা। তারা জানে তাদের মায়ের ধর্ম কর্ম সব ওই একটিই। ইন্দুবালা ভাতের হোটেল। ঠাকুরের আপ্ত বাক্য যা সারা জীবন ধরে মেনে চলেছেন, “জীবে প্রেম’। আর কে না জানে খাওয়া ছাড়া প্রেম সম্পূর্ণ হয় না? তাই ‘ইন্দুবালা ভাতের হোটেল’ নামের এক নির্জন দ্বীপে ইন্দুবালা সেই ভালোবাসার পসরা সাজিয়ে রাখেন। সবাই আসে তাদের ভালোবাসা ভাগ করে নেয়। কিন্তু ইন্দুবালার কিছু ভাগ করার থাকে না। তিনি শুধু অফুরন্ত বিলিয়ে চলেন তাঁর স্মৃতি রান্নার এক পদ থেকে অন্য পদে। যারা বুঝতে পারে তারা একটু বেশি আনন্দ পায়। আর যারা খাবারের সাথে মজে থাকে তারা শুধু রসনায় মজা পায়। ভেতরের মানুষটার নয়।

    অনেক রাতে শুতে এসে প্রতি বছরের মতো এই বছরেও ইন্দুবালা তার হিসেবের খাতা টেনে নেন। একটা সাদা পাতায় লাল কালিতে লেখেন ‘শুভ বিজয়া। সেটা যে কাকে লেখেন, কেন লেখেন আজ পর্যন্ত কেউ জানে না।

     

    ৮. কচু বাটা 

    বয়েস বাড়ার সাথে সাথে বেশ কিছু উপসর্গ দেখা দিয়েছে ইন্দুবালার জীবনে। যেগুলো আগে ছিল না। কিন্তু এখন আছে। সারাদিন এক নাগাড়ে কাজ করে বেড়ানো মানুষটার এখন বেলার দিকে একটু ঝিমুনি ধরে। ইদানিং ভাত খেয়ে উঠলে হয়। তখন ইন্দুবালার আর কিছু করতে ইচ্ছে করে না। শরীর যেন আর চলে না। তার সাথে কলকাতার বাতাসে উত্তরের শিরশিরানি খেললে শরীরটা একটু রোদ চায়। হাত-পাগুলো মনে হয় রোদে পোহাই। কিন্তু সেই ফুরসত কি আছে ইন্দুবালার? তাঁর হোটেলে আসা মানুষগুলো তো সবে ভাত খেয়ে যে যার কাজে গেছে। দুপুরের পড়ন্ত রোদে তার একটা হিসেব রাখার আছে। কজন খেলো। কজন এলো না। কারা আবার ওবেলা আসবে। কাদের বাড়িতে পাঠাতে হলো। কাদের শুধু ঘন্ট আর পোস্তোর বড়া অর্ডার হলো। কতটা বাঁচলো। কতটা না। এইসব বিস্তারিত লেখালেখির একটা খাতা ইন্দুবালার আছে। সেই একাত্তর সন থেকে। এটা যদি হিসেবের খাতা হতো তাহলে কিছু বলার ছিল না। কিন্তু এখানে টাকার অঙ্কে কিছু মেলানো থাকে না। যা থাকে তাতে আরও নানান কিছু যোগ হয়। এত পুরনো এক জাদা খাতা এতদিনে শেষ হয়ে যাবারই কথা ছিল, কিন্তু হয়নি। তার কারণ বছর বছর ইন্দুবালা সেই খাতার সঙ্গে আবার পাতা জোড়েন। মোড়ের মাথায় গণেশ বাইণ্ডিং থেকে আগে হারান আসতো। পয়লা বৈশাখের আগের দিন সেই খাতায় বড় ঝুঁচ ঢুকিয়ে ফুটো করে জোড়া হতো পাতা। সেলাই করে আবার খাতার গায়ে জামা করে দিতেন ইন্দুবালা। সেই নতুন জামা আবার পরের বছরে পালটে যেত। গেলবার হারান চোখ বোজার পর তার ছেলে শিব আসে। ইন্দুবালা নিজে সেই খাতা নাড়া চাড়া করতে পারেন না এখন আর। ওপরের ঘরে টেবিলের ওপরে রাখা থাকে। প্রতিদিন সেই খাতায় ইন্দুবালা নানা কিছু লিখে রাখেন। তার সাথে ফুল তোলা নক্সা। সোয়েটারের মাপ। দিদা বলে ঝাঁপিয়ে পড়া ছেলে-মেয়েগুলোর ফোন নাম্বার, আরও কত হিজিবিজি।

    ধনঞ্জয় বলে ওটা নাকি চিত্রগুপ্তের খাতা। বুড়ি পরপারে গিয়েও হিসেব মেলাবে। কিন্তু কী হিসেব, সেটা ধনঞ্জয় জানে না। বড় নাতনি সুনয়নী একবার দেখেছে সেই খাতায় আছে নানা রান্নার কথা। কিছু কিছু ইন্দুবালার কথাও। সেই যে গেলবার সে বিদেশ থেকে এসে তার ঠাম্মার কাছে থাকলে বেশ কয়েকমাস তখন এটা সেটা নেড়ে চেড়ে দেখেছে মেয়ে। আর অবাক হয়েছে। এতো সুন্দর গুছিয়ে লিখতে পারে তার ঠাম্মি? একটা সাদা কালো ছবিও পেয়েছিল সে খাতাটার মধ্যে। ইন্দুবালার বিয়ের আগের ছবি। কোনো এক নড়বড়ে স্টুডিওতে গিয়ে তোলা। তাঁকে দেখালে বলেছিলেন কলাপোতা থেকে নৌকা করে টাউনে গিয়ে কোনো এক স্টুডিওতে তুলেছিলেন ছবিটা। এই ছবি দেখেই নাকি তাঁর শাশুড়ি শেফালীরানীর পছন্দ হয়েছিল। সুনয়নী জানতে চেয়েছিল “আর দাদু? তিনি কিছু বলেননি?” ইন্দুবালা কোনো উত্তর দেননি নাতনির কথার। “কাজের সময় বিরক্ত করিস না” বলে বড়জোড় একটু ধমকে দিয়েছিলেন। সুনয়নী এই বাড়িতে তার দাদুর ছবি দেখেনি। এমনকি বাবা, কাকা, পিসি কারও কাছেই নয়। “কেমন ছিল দাদুকে দেখতে ঠাম্মি? কেন দাদুর ছবি একটাও নেই বাড়িতে?”পাগল করে দিত মেয়েটা প্রশ্ন করে করে। এমনকি বিয়ের একটা ছবি পর্যন্ত নেই কেন? আশ্চর্য হতো সুনয়নী। এটা কিছুতেই সে বুঝতে পারতো না থাকবে কী করে? সেই অজ গাঁয়ে কি আর ফটোগ্রাফার ছিল? খুলনা শহর থেকে কিংবা ঢাকা থেকে নিয়ে আসতে হতো তাদের। ইন্দুবালাকে বিয়ে দিতে গিয়ে বাবার আর একটুও খরচ করার মতো অবস্থা ছিল না তখন। ছেলেকে পণ না দিতে হলেও মেয়ের গয়না গড়ার ছিল। ইণ্ডিয়াতে মেয়েকে পাঠানোর খরচ ছিল। তার সাথে আশেপাশে গ্রামের মানুষদের আপ্যায়ন, খাতির যত্নে কম খরচ হয়েছে নাকি? কাজেই কোনো ছবি ওঠেনি। এমনকি শ্বশুরবাড়িতে এসেও না। বউভাত হয়নি। লোকজন আসেনি। তাহলে আর ছবি উঠবে কোথা থেকে? ফুলশয্যার দিন অনেক রাতে বাড়ি ফিরেছিলেন মাস্টার রতনলাল মল্লিক। তার পরদিন বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়ে আবার বেরিয়ে গিয়েছিলেন। শাশুড়ি কতবার বলেছিলেন ছেলেকে, “রতন বৌমাকে নিয়ে একটা ফটো তুলে আয় বাবা”। আজ যাবো কাল যাবো বলে আর যাওয়া হয়নি রতনের। নিমতলা শ্মশানে যেদিন মড়ার খাট ধরে বসেছিলেন ইন্দুবালা, একটি সিঁড়িঙ্গে মতো লোক গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে এসে বলেছিল “কি গো মা ছবি তুলবে নাকি? শেষ স্মৃতি বলে কথা”। লছমীর মুখ ঝামটায় পালানোর পথ পায়নি সে। কাজেই ইন্দুবালার এই বাড়িতে তাঁর স্বামীর কোনো ছবি নেই। আলতা ছাপ পায়ের চিহ্ন নেই। যাবতীয় যা কিছু তিনি সেই শ্মশানেই অস্থির সাথে ভাসিয়ে দিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু সত্যিই কি তাই? তার বংশরাই তো ঘুর ঘুর করে বেড়াচ্ছে চোখের সামনে। ঠাম্মা, দিদা, মা বলে ডেকে চলেছে। জানতে চাইছে মাস্টার রতনলাল মল্লিকের ছবির কথা। এইসব কিছু ওই খাতায় লেখা নেই। ইন্দুবালা লেখেননি। নিজের মনের রাগ, দুঃখ, অভিমান, কষ্ট সেগুলো বড় আপনার। নিজের কাছেই রেখে দিতে হয়। না হলে যে মানুষটাকে তার বংশের কেউ দেখলো না জানলো না তার সম্পর্কে খারাপ কথা তাদের মনে বাজবে। ইন্দুবালা কোনোদিন ছেলে মেয়েদের কাছে তার বাবার কোনো প্রসঙ্গ উত্থাপন করেননি। নিন্দা মন্দও না। এই বাড়ির রেওয়াজ মেনে শুধু মৃত্যুদিন পালন হয়েছে। শাশুড়ির আমলে ব্রাহ্মণ খাওয়ানো হতো। সবাই চলে যাওয়ার পর ইন্দুবালা সেইসব প্রথা তুলে দিয়েছেন। অনেক দিন পরে সুনয়নী প্রশ্ন করলে একবার ভেবেছিলেন সব বলবেন। তারপর ভাবলেন থাক। যা মা গঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়ে এসেছেন তার দিকে ফিরে তাকাবেন না। ওটা নিজের কাছে খুব সংগোপনে থাক।

    খাতাটা এতটাই ভালো লেগে গিয়েছিল সুনয়নীর সারাদিন সেটা নিয়ে বসে থাকতো। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তো সব কিছু। দেখতো। নোট রাখতো তার আই প্যাডে। ঠাম্মিকে যেন একটু একটু করে চিনতে পারছিল সে। বারবার মনে হয়েছিল কেন আগে তার ঠাম্মিকে সে এত কাছ থেকে দেখেনি। কেন আরও অনেক অনেক কথা জানতে চায়নি। সবটা যে পেরেছিল তা নয়। কিন্তু সুনয়নী এটা বুঝেছিল তার চারপাশে দেখা মানুষগুলোর থেকে ইন্দুবালা কতটা আলাদা। চিন্তায়, ভাবনায়, জীবনে চলার পথে। এই খাতাটা নিয়ে সুচিন্তিত পরিকল্পনা ছিল তার। একদম যেমন আছে এই জাবদা খাতাটা ঠিক সেই ভাবে যদি তাকে ছাপানো যায়। তাহলে তো একটা সময়ের ইতিহাস বেরিয়ে আসবে। যে ইতিহাসের কথা কোন পাঠ্য বইতে লেখা থাকে না। এমনকি সমাজ ইতিহাসের গভীরে যাঁরা উঁকি দেন সেই সব গম্ভীর প্রবন্ধেও না। তার চেয়ে এই খাতাটা ছাপা হলে একজন একলা মহিলার পথ চলাটা বেশ পরিষ্কার ধরা পড়বে সময়ের নিরিখে। নিজের মতো করে বোঝাতে চেষ্টা করেছিল সুনয়নী তার ঠাকুমাকে। এমনকি এটাও বলেছিল যেগুলো পছন্দ নয় সেগুলো রাখা হবে না বইটাতে। ইন্দুবালার একটুও পছন্দ হয়নি ব্যাপারটা। “হিসেবের খাতা কার কোন কাজে লাগে দিদিভাই? তুই আর নাড়াঘাঁটা করিস না ওটাকে। একেই যা অবস্থা।” সুনয়নী তবুও হাল ছাড়েনি। শেষ খড়কুটো আঁকড়ে থাকার মতো বলেছে, “অন্তত রান্নাগুলো ছাপাই। সবাই তো ভুলে গিয়েছে ঠাম্মি। তোমার মতো ছাঁচড়া কেউ রান্না করতে পারে? সেটাই না হয় জানুক লোকজন।” ইন্দুবালা হেসেছেন মেয়ের কথা শুনে। “ছ্যাঁচড়ার কথা কেউ পড়বে না দিদিভাই। তুই বরং তার লেখা পড়ার বই বার কর। সবাই পড়বে।” নাতনি থামতে চায় না। বারবার ফোন করে। বন্ধুদের দেখাবে বলে বায়না করে। ইন্দুবালা একদিন নিরুপায় হয়ে বলে দেন, “আমি আগে মরি, তারপর না হয় যা খুশি করিস তোরা”। এরপর আর কোনো কথা বলা যায় না। মোক্ষম বার্তাটা তাই এক্কেবারে শেষেই দ্যান। ইন্দুবালার হোটেলে যে কটা জিনিস সেই পুরোনো আমল থেকে রয়ে গেছে এই খাতা খানাও তার মধ্যেই পড়ে। সেটাকে কী করে তিনি বাইরের লোকের হাতে তুলে দেন? সুনয়নী পড়ছে পড়ুক। কিন্তু তার সাথে তার বন্ধু বান্ধবরাও পড়বে? রাজ্যের যত লোক জেনে যাবে ওই খাতাটার মধ্যে কী আছে। ওমা তাই কখনও হয় নাকি? ওর পাতায় যে জিরান দেওয়া আছে মনিরুলের বকুল ফুল। লছমীর বাড়ির তেজপাতা। তিন ছেলে-মেয়ের হাত ছাপ। অলোকের ফেলে যাওয়া নিষিদ্ধ ইস্তেহারের একটা পাতা। আরও যে কত কী, তা না দেখলে কল্পনাও করা যাবে না। অলোক খুব সুন্দর শিস দিয়ে একটা গান করতো। কীসের ভয় সাহসী মন লাল ফৌজে লাফিয়ে হই পার’। গানটাও লেখা আছে সেখানে। চোখ বন্ধ করেন ইন্দুবালা। সুরটা খোঁজার চেষ্টা করেন। পারেন না। কারেন্ট অফের সেই রাতগুলোকে হাতড়ান। কোথায় তারা? যে দিনগুলোকে ইন্দুবালা নিজেই ফিরে পান না, সেইসব কিছু তিনি দুহাত উজিয়ে দিয়ে দেবেন কী করে? থাকবার বলতে এইটুকুই তো তাঁর নিজের। স্মৃতির বিসর্জন মানে নিজেকে নিঃশেষ করে দেওয়া।

    ধনঞ্জয় ছাদ থেকে কাপড় তুলতে এলে বুড়িকে দেখে মায়া হয় তার। বারান্দায় মাদুর পেতে বসে বুড়ি ঝিমোচ্ছে। মাথা নেমে এসেছে পায়ের কাছে। একটা বালিশ নিয়ে রোদটায় শুলে কী হয়? সারা জীবন কারোর কথা কোনোদিন শুনলো না। দুপুরের পর কতবার সে বলেছে “ওগো মা একটু এলিয়ে এসো দিকিনি গা খানা বিছানায়”। বুড়ি কথা শোনেননি। এত কাজ কাজ করে মাথা খায় বুড়ি যে কারো দম ফেলার সময় থাকে না। ঘর থেকে বালাপোশটা এনে বুড়ির গায়ে চাপা দেয় ধনঞ্জয়। যত্ন করে পায়ের ওপর দিয়ে টেনে দেয় তা। মুখের দিকে হাঁ করে চেয়ে বসে থাকে। যার সব থাকতেও কেউ নেই। যার ঘর আলো করা সংসার। দুই ছেলে, মেয়ে তাদের সব বাচ্চারা। হইহই করে মাথায় করে তুলে রাখতো তোমাকে। এইভাবে কেন এত কষ্ট করে আছো মা? একবার মুখ ফুটে বললেই তোমার সন্তানরা চলে আসবে তোমার কাছে। যা চাইবে তাই দেবে। রাজরানী হয়ে থাকবে মা। এক বিশাল সংসারের মধ্যমণি হয়ে। ভালো লাগবে না তখন? চাল ধুতে ধুতে ইন্দুবালা ধনঞ্জয়কে বলেছিলেন, “ওরকমটা সবার মনে হয় রে ধনা। বোঝাকে বেশিক্ষণ মানুষ ঘাড়ের ওপর চাপিয়ে রাখতে পারে না। মনে হয় কতক্ষণে নামাবে সে মাটিতে। আমি কারো বোঝা হতে চাইনা রে”। ধনঞ্জয় কী বুঝেছিল কে জানে, শুধু সেদিন আর আগ বাড়িয়ে ঝগড়া করতে যায়নি। বুড়ি নিজেই তার কাজ খুঁজে নিয়েছিল বিস্তর। যত খাটছিলেন ইন্দুবালা হোটেলকে নিয়ে, তত তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ছিল দিকে দিকে। এবেলার রান্না কোনদিন ওবেলা কাউকে খাওয়াননি তিনি। কোনো খাবার নষ্ট হতে দেননি কোনোদিন। বেঁচে যাওয়া খাবার কোথায় কোথায় যাবে তারও একটা নির্দিষ্ট ঠিকানা তৈরী করে ফেলেছিলেন। সেইসব মানুষগুলো আজও অনেক আশা নিয়ে বসে থাকে।

    রান্নাঘরের উনুনটা এখনও আগের মতো নিজের হাতেই পরিষ্কার করেন। মাঝে মাঝে ধনঞ্জয় করে না এমনটা নয়। কিন্তু নিজে করলে সুখ পান ইন্দুবালা। যত্ন করে মাটির প্রলেপ বোলান উনুনের গায়ে। আজকের উনুন? কত জন্ম জন্মান্তর ধরে মল্লিক বাড়ির লোকজন এই উনুনে চাল ফুটিয়ে দুবেলা ভরপেট খেয়েছে। রান্না তো আর শুধু রান্না নয়। যেন অগ্নিকে উপাসনা। আঁচের একটু এদিক ওদিক হলে সব ভণ্ডুল হবে। নড়ে চড়ে বসে বুড়ি। বালাপোশের গরমে আরাম পেয়েই হোক কিংবা ঝিমিয়ে পড়া দুপুরে ঘুমন্ত আঁচের কথা ভাবতে ভাবতেই হোক ইন্দুবালার ঘুম কাটে। সামনে দেখেন হাঁ করে চুপটি করে বসে আছে ধনঞ্জয়। মুখের দিকে তাকিয়ে। ইন্দুবালা হাসেন। “এখনও বেঁচে আছি রে ধনা। মরিনি। এই দ্যাখ শ্বাস প্রশ্বাস চলছে এখনও”। বিকেলের শেষ আলো তখন জানলার ওপর ঘেঁষে চলে যাচ্ছে। ইন্দুবালা হুড়মুড় করে উঠতে যান। “আমার না হয় ভিমরতি ধরছে তাই বলে তোর কোনো আক্কেল জ্ঞান থাকবে না? বেলা যে পড়ে এলো। কাজ কত বাকি তার কি খেয়াল আছে?” ইন্দুবালা চাটাই গোটান। বালাপোশ ভাঁজ করেন। ধনঞ্জয় সুড়সুড় করে সরে পড়ে সেখান থেকে। বসে থাকলে বুড়ির গজগজ কানে শেলের মতো বিধবে। তখন আবার দুটো কথার উত্তর না দিয়ে ঝগড়া না করে স্বস্তি পাওয়া যাবে না।

    ইন্দুবালার কাজের কোনোদিন শেষ বা শুরু বলে কিছু নেই। সারাদিনটাই পড়ে থাকে কাজের জন্য। দুপুরে সব খদ্দের খেয়ে চলে গেলে আনাজ দেখে, মিলিয়ে কী কী আনতে হবে আর না হবে তার একটা ফর্দ করার থাকে। রাতের রান্না কী হবে তাও ভাবতে হয়। সেই মতো ধনঞ্জয়কে নানা কিছু বলার থাকে। কী কী ভেজাতে হবে। ছোলা, মটর, বাদাম, হিঙ, কিসমিস, কাজু। কী কুটনো কাটতে হবে। কোন রান্নাটা গ্যাসে হবে আর কোনটা উনুনে। কয়লা আর গ্যাস ঠিক আছে কিনা। মানে যার যেমন দিনের বরাদ্দ সেটাই আছে কিনা। মাঝপথে ফুরিয়ে যাওয়াটা অলুক্ষুণে। কাজেই আগে ভাগে সব দেখে রাখা চাই। ইন্দুবালা সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন। এতটুকু এদিক ওদিক হবার জো নেই। যদি কোনোদিন ইন্দুবালার সাথে সারাদিন ঘুর ঘুর করা যায়, তাঁর হেঁশেলে উঁকি দেওয়া যায় তাহলে একটা দিনলিপি লেখার ইচ্ছে করবে। এমন যে কেউ করেনি সেটাও বলা যায় না। অনেক কাগজেই ইন্দুবালার ভাতের হোটেলের কথা ছাপা হয়েছে। তার সাথে তার বড় বড় দুটো উনুন, গ্যাস, সেই প্রাচীন শিলনোড়া, মশলা রাখার বাক্স, পেল্লাই সাইজের ভাতের ডেকচি, হাঁড়ি, কড়াই, রান্নার ছবি, খাবারের ছবিও ছাপা হয়েছে। শুধু যদি এটা হতো তাহলে তো কথাই ছিল না। এমনটা তো অনেকের ক্ষেত্রেই হয়েছে। এই শহরে তার উদাহরণ আছে ঝুড়ি ঝুড়ি। কিন্তু যেটা হয়নি সেটা হলো একদল মানুষ সে বুড়ো থেকে শুরু করে ছেলে মেয়ে বাচ্চাকাচ্চা সমেত এতো হুজুগ একটা ভাতের হোটেলকে নিয়ে খুব কমই হয়েছে। যারা অনেক দূরে থাকে বা অনেক কাছে, যারা কলেজে পড়ে, হোস্টেল বা মেসে থাকে, যারা অফিস করে, ব্যবসা করে মানে যারাই ইন্দুবালার সংস্পর্শে একবার এসেছে তারা আবার ইন্দুবালাকে যেন দুচোখে হারায়। ফলে এই যুগে চ্যাটাং ট্যাটাং করে কথা বলা ছেলে মেয়েগুলো ফেসবুকে ইন্দুবালা ভাতের হোটেলের একটা কমিউনিটি পর্যন্ত খুলে ফেলেছে। সেখানে যেমন প্রতিদিনের মেনু আপডেট হয় ঠিক তেমনই রান্নার ছবি থাকে। তার সাথে সেই রান্নার গল্প। এমনকি সেই দিন ইন্দুবালার মেজাজ কতটা উনুনের আঁচের সাথে ওঠানামা করছে সেটাও। কত কত মানুষ যে এই পেজ লাইক করেছে তার ইয়ত্তা নেই। ইন্দুবালার কাছে তাদের ভাত খাওয়ার কথা লিখেছে। গল্প লিখেছে। বাড়ি থেকে অনেক দূরে স্বজন-পরিজন ছেড়ে চলে আসা এক অচেনা অজানা শহরে শুধুমাত্র একটা ভাতের হোটেল কীভাবে তাদের বাড়ির কথা, মায়ের কথা, ঠাম্মার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে সেই নিয়ে ভুরি ভুরি লেখা আছে। কমেন্ট আছে। জাঁকিয়ে চলছে গ্রুপটা।

    ইন্দুবালা এতো কিছু জানেন না। তাঁর ইচ্ছেও করে না এইসব নিয়ে মাতামাতি করতে। হোটেলে অনেক কাজের মধ্যে তিনি অন্য কিছু যেন ভাবতেও পারেন না। তবুও কি ভাবতে হয় না তাঁকে? হয়। এই ফেসবুকের পেজ হওয়ার পর থেকে নানা রকমের বিপদ নানা দিক থেকে আসতে থাকে। এই যেমন সেদিনকে সবে রোদে পা ছড়িয়ে একটু ঝিমোতে বসেছেন অমনি সামনের মেসের নতুন মেয়েটা এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো। চশমার ভেতর থেকে গোল গোল চোখ করে বললো “তুমি কচু বাটা কেন আর করো না ঠাম্মা?” ইন্দুবালা ঝিমোচ্ছিলেন। ঘোর লাগা চোখে বোঝার চেষ্টা করেন কী বলছে মেয়েটা। “কোথায় থাকো? খাওয়া হয়েছে? খিদের পেটে কচু খাবে কেন? ধনাকে বলো ভাত গরম করে দেবে। আর অবেলায় ভাত খেতে ইচ্ছে না করলে রুটি করে দেবে। চাও যদি বেগুন পোড়াও খেতে পারো। অল্প করে কুলের তেল দিয়ে মেখেছি। গন্ধ হয়েছে বেশ”। মেয়েটা আরও চোখ গোল গোল করে বলে “ধুর তুমি কি সব ভুলে যাও নাকি ঠাম্মা? এই তো খেয়ে গেলাম। রুটি না খেলেও বেগুন পোড়া ছাড়বো তুমি ভাবলে কী করে? খেয়েছি। কী করে যেসব অদ্ভুত জিনিস মাথা থেকে বার করো বেগুন পোড়ায় কুলের তেল। জাস্ট ফাটাফাটি”। ইন্দুবালা হাসেন।

    বড় বড় বয়ামে কুল জিরানো থাকতো তেল দিয়ে। ঠাম্মার যে কত রকমের আচারের আহ্লাদ ছিল। প্রত্যেক ঋতুতে আলাদা আলাদা ফল। তাদের আচার। তার সাথে তেল। সেই তেল আবার রান্নার সাথে মেশানো। “সে অনেক ঝক্কি ঝামেলার কাজ। আমি অত পারি না। তা কোথায় থাকো তুমি?” মেয়েটা হাত তুলে দেখায় “ওই তো রাস্তার ওই দিকের মেসে থাকি। সঞ্চারী। খাতায় যে নাম লিখলাম”। ইন্দুবালা এগোন রান্নাঘরের দিকে। “বাহ সুন্দর নাম তো সঞ্চারী। কে রেখেছিল, মা?” সঞ্চারী বলে “ধুর…মা রাখবে কোথা থেকে? সে তো জন্মের দিনই মারা গেছে”। থমকে দাঁড়ান ইন্দুবালা চৌকাঠের কাছে। ঘুরে তাকান মা মরা মেয়েটার দিকে। সঞ্চারী এগিয়ে আসে। “বাবা দিয়েছিল নাম। তা বাবাও এখন আর নেই। একটা কঠিন অসুখ হয়েছিল। চলে গেছে। মামা-মামীর কাছে থাকি। মানে ওরা আমাকে দেখে। লোকাল গার্জেন। এমনিতে আমার কেউ নেই জানো। কিন্তু অনেক অনেক বন্ধু আছে। এখন তো কলেজ। তাই মেসে থাকতে হয়”। বকবক করে সরলতায় ভরা চোখ মেয়েটা। ইন্দুবালা কিছু বলেন না। এগিয়ে যান রান্নাঘরের দিকে আস্তে আস্তে। পেছনে থাকে সঞ্চারী।

    প্রত্যেকদিন এই হোটেলে যারা খায় তাদের একটা মাসিক টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। নিজেরাই খাতায় নাম লেখে। নিজেরাই হিসেব রাখে। ওই দেনা পাওনার হিসেব ইন্দুবালাকে কোনো দিন মেলাতে হয়নি। কোনো দিনই না। তাঁর পয়সা মেরে দিয়ে পালানোর লোকের সংখ্যা হাতে গোনাও যাবে না। ইন্দুবালা মনেও রাখেন না। দু মুঠো ভাত খেয়ে যার ইচ্ছে হয় পয়সা দেবে। যার ইচ্ছে না হয় দেবে না। ঠাম্মার কথাগুলো আজও তাঁর কানে বাজে। মহাভারতের সেই কবেকার পুরোনো বইটা খুলে গড়গড় করে পড়ে চলতো। “বনপর্বে যুধিষ্ঠির কী বলছে জানিস? শোন ইন্দু। সব তো আমাদের ঘরের কথাই লিখে গেছে। মানুষের ধর্ম কী? মানুষের ধর্ম হল মোদ্দা কথায় অপর মানুষের সেবা করা। সেই সেবা কেমন? যেমন ধর যুধিষ্ঠির শুধু বলছেন না। মনে করিয়ে দিচ্ছেন” অন্ধকারে প্রদীপ জ্বলছে টিম টিম করে। কাঠের উঁচু পাটাতনের ওপরে রাখা কবেকার মহাভারত। ধূপ দানিতে ধূপ, মাটির ধুনুচিতে ধুনো সব জ্বলছে। বারকোষে রাখা সন্ধ্যামণি ফুল। ঠাম্মা সেই ঘোর লাগা পরিবেশে যুধিষ্ঠিরের কথা উচ্চারণ করছে, “সাধুগণের গৃহে তৃণ, ভূমি, জল, ও সুশৃতবাক্য এই চারি দ্রব্যের কোনোকালেই কোনো অপ্রতুল থাকে না। গৃহস্থ ব্যক্তি পীড়িত ব্যক্তিকে শয্যা, শ্রান্ত ব্যক্তিকে আসন, তৃষিত ব্যক্তিকে পানীয়, ক্ষুধিত ব্যক্তিকে ভোজন ও অভ্যাগত ব্যক্তির প্রতি নয়ন, মন ও প্রিয় বচন প্রয়োগ এবং উত্থান পূর্বক আসন প্রদান করিবে। ইহাই সনাতন ধর্ম।” ঠাম্মা যেন বারবার মনে করিয়ে দিত মানুষকে সেবা করে আরাম পাওয়া যায়। মনের আরাম। ইন্দুবালা কি সেই জীবে প্রেম করছেন না? কোথায় করছেন? এটা কি জীবে প্রেম? প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজেন ইন্দুবালা। আর ঠিক তখনই ঘোর কাটে, “কি গো ঠাম্মা কচুবাটা করবে কিনা বলো”। সামনে দাঁড়ানো মেয়েটা নাছোড়। ইন্দুবালা রাতের আনাজ মিলিয়ে দেখছিলেন। রোদটা আস্তে আস্তে পশ্চিমে ঘুরছে। এবার ছাদের আলসের মাথায় চড়ে এক্কেবারে হারিয়ে যাবে। আর দেখা যাবে না। “ওইদিকের বড় ঝুড়িখানায় দেখতে গোটা বিশেক আলু আছে কিনা?” সঞ্চারী গোনে ঠিক বাচ্চাদের মতো করে। ইন্দুবালা মশলার বাক্স হাঁটকান। দেখে নেন সব ঠিক করে। সঞ্চারী এগিয়ে আসে। “বিশটারও বেশি আলু আছে”। ইন্দুবালা বিড়বিড় করেন, “তাহলে আনাতে হবে আরও। সর দেখি ধনাকে বলি”। সঞ্চারী হাত ধরে নেয় ইন্দুবালার। “বললে না তো কচুবাটা করো না কেন এখন?” ইন্দুবালা বঁটিখানা নিয়ে এসে আলুর খোসা ছাড়াতে বসেন। “ওইসব আমি করেছি নাকি কোনোদিন? তোর পড়াশুনো নেই? যা গিয়ে পড়তে বোস। আমাকে কাজ করতে দে”। সেই মেয়েও ছাড়বার নয়। “কচুবাটা করোনি মানে? এই দেখো ফেসবুকে একজন লিখেছে নারকেল আর কাঁচা লংকা দিয়ে তোমার হাতের কচুবাটা যে খায়নি সে তো ইন্দুবালা ভাতের হোটেলের কিছুই জানে না”। এবার একটু বিরক্ত হন ইন্দুবালা। “এইসব আবার কে লিখেছে? তোরাই বা এইসব লিখতে বলিস কেন?” মেয়েটা অবাক হয়। “আমরা লিখতে বলেছি নাকি? এই যে দেখো অমলেন্দুবাবু কৃষ্ণনগরে থাকেন। কলেজে ফিজিক্স পড়ান। তিনি লিখেছেন। এখানে থেকে পড়ার সময় এইট্টিজে রোজ ভাত খেতে আসতেন তোমার হোটেলে। চিনতে পারছো?” ইন্দুবালা মেয়েটার ফোনের মধ্যে থেকে একটা অস্পষ্ট মুখ দেখেন। “এতো কিছু কি মনে থাকে দিদিভাই? কত লোকতো আসে। কত লোক চলে যায়। মেয়েটা শুনবে না। “ওসব জানি না কিছু। কচুবাটা খাওয়াতে হবেই হবে। আমি আজই লিখে দিচ্ছি ফেসবুক পেজে তুমি আবার কচুবাটা খাওয়াচ্ছো আমাদের। বুঝলে?”

    ইন্দুবালা ভাতের হোটেলের নোনাধরা সিমেন্টের কালো বোর্ডটা যে কবে থেকে ফেসবুকের বোর্ড হয়ে গেছে ইন্দুবালা সেটা জানেন না। জানার কথাও না। এখনকার ফোন ইন্দুবালা ব্যবহার করেন না। তাঁর আছে সেই কবেকার ল্যাণ্ড লাইন। সরকারের ফোনের ব্যবসা লাটে উঠলেও ইন্দুবালা সেই ফোনে আজও কাজ চালান। ছেলেরা, মেয়েরা ওই ফোনেই মায়ের খবর নেয়। ইন্দুবালা দুটো কথা বলে শান্তি পান। তবে এই এখনকার ছেলে মেয়েদের ফোন ব্যবহার না করলেও তিনি বুঝতে পারেন এর মাহাত্ম কী! ওখানে কিছু লেখা হয়ে গেলেই গোটা বিশ্বের লোক জানতে পারবে। আর ঠিক তখন থেকেই বাড়বে উৎপাত। সেই কবেকার পুরোনো ল্যাণ্ড লাইন ফোনটা আবার বাজতে থাকবে। ক্রিং ক্রিং ক্রিং। বাড়ির সামনে ভিড় হবে। দশ জনের বদলে একশোজন ভাত খেতে চলে আসবে। পাড়ার লোক বিরক্ত হবে গাড়ি রাখার জায়গা পাবে না বলে। ধনঞ্জয় বড় খোকা, ছোট খোকা, খুকি সবাইকে ফোন করবে। নালিশ জানাবে। আর কেউ না আসুক বড় খোকা এসে বসে থাকবে ঠায়। নজর রাখবে। তাকে নজরে রাখার জন্য তার বাড়ি থেকে বউ ফোন করবে। ছেলে ফোন করবে। সে এক অদ্ভুত পরিস্থিতি। এইসব ভেবেই শীত আসা সন্ধ্যেয় ইন্দুবালা ঘামতে শুরু করেন। আগে এমন হতো না। কেউ খেতে চাইলেই ইন্দুবালার আনন্দ হতো। এখনও হয়। কিন্তু এত বড় হয়ে যায় ব্যাপারটা সব কিছু ইন্দুবালা যেন সামলাতে পারেন না। তবুও বাইরে থেকে কিছু বোঝা যায় না বুড়ির। এখনও সাধারণ দিনে ভাতের হোটেলে পাত পড়ে কম করে তিনশো মানুষের। বুড়ি এই বয়সে উনুনের সামনে এসে যখন কড়াই পেতে দাঁড়ান সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা মেনে গড় করে অনেকে।

    “কী হলো? কিছু বলছে না যে?” সঞ্চারী তাকিয়ে থাকে ইন্দুবালার দিকে। ইন্দুবালার মুখে হাসি ফোটে। “কোথা থেকে আমার ঠাম্মার মতো অমন চোখ পেয়েছিস বলতো? আর অমন পাড়া গেঁয়ে বিধবাদের মতো চুল কেটেছিস কেন?” সঞ্চারী বলে “ইশ। পাড়াগেঁয়ে বিধবাদের মতো লাগছে নাকি? কত টাকা দিয়ে চুল কেটেছি জানো? শুনলে মামা বাড়ি থেকে বার করে দেবে। কেন খারাপ লাগছে দেখতে?” ইন্দুবালা হাসেন। “মোটেই না। মিষ্টি লাগছে। মামা না হয় চুল কাটার দাম জানতে পারলো না। কিন্তু এই যে দিন নেই রাত নেই মেসের জানলার ধারে দাঁড়িয়ে ফস ফস করে সবাই মিলে সিগারেট টানা হয় সেটার কথা জানে তো?” মেয়েটা জিভ বার করে। “তুমি কি সব খেয়াল রাখো ঠাম্মা?” ইন্দুবালা হাসেন। “একদিন সময় করে নিশ্চয়ই কচুবাটা খাওয়াবো দিদিভাই। কিন্তু আজকে ওই সব তোমাদের কি সব পেজ-টেজে লিখোনা কিছু কেমন?” মেয়েটা বলে “কেন লিখলে কী হবে?” ইন্দুবালা বোঝান। “আগে ওই নরম কচুটাকে আমায় পেতে হবে তো। সেই শহর কি আছে? বললেই কেউ ছাই গাদায় হওয়া একটা কচু গাছ অমনি উপড়ে নিয়ে চলে আসবে? আর যে সে কচু হলে তো হবে না। সেই মানকচুর ভেতরে দুধে টইটম্বুর হতে হবে। গাছ দেখলে বুঝতে হবে গর্ভিনী সে। অনেক তরিজুত করে তাকে তুলতে হবে। রান্না করতে হবে। তবেই না অনেক দিন পর তুইও আমাকে মনে রাখবি? তখন হয়তো কোনো বিদেশ বিভুই থেকে আমার কথা লিখবি”। এই ভর সন্ধ্যে নামার আগে এক অচেনা মেয়ের চোখ চিক চিক করে ওঠে। “আমি কোথাও যাবো না ঠাম্মি। কোথাও না। আমি শুধু ওই মেসবাড়িটায় থাকবো আর তোমার রান্না খাবো”। ছুট্টে চলে যায় সঞ্চারী। অমন ছলছল চোখ করে একদিন ইন্দুবালাও বলেছিল সে কলাপোতা ছেড়ে কোথাও যাবে না। কোনোদিন না। ঠাম্মাকে জড়িয়ে ধরেছিল সেদিন। ঠাম্মা বলেছিল “মেয়েদের প্রাণ হল কই মাছের জান। কত কী যে করতে হবে আর দেখতে হবে জীবনে। এই ছোট্ট গ্রামটায় আমার মতো কেন পড়ে থাকবি বলতো?” সবে শীত আসা সন্ধ্যেয় কবেকার ঠাম্মার মুখ মনে করায় এক অচেনা ছোট্ট মেয়ে। কার বেশ ধরে এসে তুমি আমার কাছে আজ খেতে চাইছে ঠাম্মা? আমি যে বড় বুড়ি হয়ে গেছি। তোমার ইন্দু যে আগের মতো আর নেই গো। চোখ থেকে জল পড়ে। ধনঞ্জয় ঘরে এলে বুড়ি চোখ মোছে। “একটু পরে দেওয়া যেত না আঁচটা? ধোঁয়ায় চোখ জ্বলে গেল যে ধনা”।

    লছমীও মাঝে মাঝে এমন ছলছল চোখে তাকাতো। কী হয়েছে জানতে চাইলে কিছুতেই বলতো না। স্বামীটা যে তার কোথায় পালিয়েছিল কেউ জানে না। অতগুলো বাচ্চা নিয়ে লছমী সেই কতদূর থেকে মাছ নিয়ে এসে বাজারে বিক্রি করতো। ইন্দুবালা বুঝতে একজন একা থাকা মানুষই বুঝতে পারে আর একজনের একার লড়াইয়ের মর্ম। ওরা যেন দুজনে দুজনের পরগাছা হয়ে জড়িয়ে থাকতো একে অপরকে। খুব টানাটানির সময়ও কিছুতেই লছমীকে টাকা পয়সা দেওয়া যেত না। ইন্দুবালার হোটেল শুরু হবার পর লছমীর কোচড়ে বেঁধে দিত তার ছেলে মেয়েদের জন্য খাবার। লছমী নেবে না কিছুতেই। ইন্দুবালা বলতো এক মা তার সন্তানদের দিচ্ছে। তুই নিবি না তো? লছমী তার প্রতিদানে ফিরিয়ে দিয়ে যেত অনেক কিছু। মাছ ছাড়াও কচু, মেটে আলু যেগুলো চট করে বাজারে পাওয়া যেত না। কবে সে যেন একবার নিয়ে এলো কোথা থেকে জোগাড় করে চুইঝাল। ইন্দুবালার সেদিন যেন সারাদিন ঘোরের মধ্যে কাটলো। এক টুকরো খুলনাকে যেন লছমী বয়ে নিয়ে এলো আঁচলে করে। ইন্দুবালা কিছুটা রান্না করলেন চুইঝাল দিয়ে। একটু তুলে রাখলেন। আর বাকিটা বসিয়ে দিলেন নারকেল গাছের কাছে। ভাবলেন একবার যদি চুইঝাল গাছটা বেঁচে যায় তাহলে তিনি সেটাকে নারকেল গাছে ওঠাবেন। আর সব রান্নায় চুইঝালের মিষ্টি গন্ধে ভরিয়ে দেবেন। কিন্তু সেটা আর হয়নি। বাঁচেনি গাছটা। সেও হয়তো বুঝেছিল উদ্বাস্ত হয়ে বাঁচার দায় অনেক।

    একটা সময় ছিল যখন লছমী নানা রকমের খবর রাখতো। কার বাড়িতে কচু হয়েছে। কার বাড়িতে লাউ। কে কুমড়ো শাক ফেলে দিতে চায়। সব কুড়িয়ে বাড়িয়ে নিয়ে আসতো লছমী। এই হোটেল মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর পেছনে লছমীর অবদান কম নয়। ও না থাকলে আজ এই হোটেল হতোই না। এক মাছওয়ালী কেমন যেন ইন্দুবালার মনের কথা সব জেনে যেতো। টের পেত ইন্দুবালা কী ভাবছে। “তুই কি ঝাড়ফুক তুকতাক জানিস লছমী?” বারান্দায় পা ছড়িয়ে বেলা শেষে বাড়ি যাওয়ার আগে গল্প করতো সে। “ওইসব জানলে সেই কোথা থেকে এসে মাছের টুকরি নিয়ে দোরে দোরে ফিরি মা?” ইন্দুবালা ভাবেন তাও ঠিক। তাঁর গল্প লছমী জানে। কিন্তু লছমীর গল্প তাঁর তো জানা নেই। এমনকি লছমী কোথায় থাকে সেটাও জানেন না ইন্দুবালা। “এই লছমী তোর বাড়ি কোথায় রে?” লছমী হাসে। “কেন তুই যাবি?” ইন্দুবালা বলেন “হাঁ যাবো। তুই আগে বল কোথায় থাকিস?” লছমী বলে “শোনো তাহলে। এখান থেকে ইস্টেশন”। ইন্দুবালা বলেন “মানে শিয়ালদা?” লছমী ঘাড় নাড়ে। “হ্যাঁ গো। সেখান থেকে ক্যানিং লোকালে চড়ে একেবারে লাস্ট স্টেশনের আগে তিনটে স্টেশন। ওখান থেকে আবার রিক্সাভ্যান। চল যাবি আজকে?” হাসে লছমী। ইন্দুবালা বলেন “আজ তো যাবো না। তোকেও যেতে দেবো না। এতো দূর থাকিস তুই? একটু পরেই সন্ধ্যে নামবে। তার ওপরে ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। থেকে যা লছমী। এই শীতের দিনে নাই বা এতটা দূরের পথে বাড়ি গেলি?” লছমী অবাক হয়ে বলে “হাই রাম। কী বলছিস তুই মা? বাড়ি না গেলে মাছ আনবো কী করে? মাছ না আনলে খাবো কী? তুই হোটেল চালাবি কী করে?” লছমী সেই শীতের বাদলে বেরিয়ে যায়।

    অনেক সকালে এসে দরজা হাটকায় লছমী, “মা..ওই মা..এখনও তুই শোয়ে আছিস?” ইন্দুবালা বেরিয়ে দেখেন মাছের সাথে একটা মস্ত মানকচু। “তুই এটার কথাই বলেছিলিস না মা?” ইন্দুবালা অবাক হয়ে যান। “এটাকে কোথায় পেলি তুই?” লছমী বলে যায় “সে অনেক বড় গল্প আছে মা। বাজার ফেরতা পথে বলবো।” লছমী চলে যায়। দুই ছেলে মেয়েকে স্কুলে পাঠিয়ে ইন্দুবালা কচু কাটতে বসেন। সেগুলোকে জলে ভেজান। কুরনি নিয়ে এসে টুকরোগুলো কুরতে বসেন। ধনঞ্জয় নেয়ে ধুয়ে এসে ভীষণ চোটপাট করতে শুরু করে। কোনো সহজ রান্না তোমার হেঁশেলে নেই না? একে কচু। তার ওপর এই নারকেল। কী হবে শুনি?” ইন্দুবালা গম্ভীর হয়ে বলেন, “কয়লার বস্তার মুখ ঢেকেছিলি কাল রাতে? সব তো জলে চিপসে হয়ে গেছে। রান্না হবে কী দিয়ে? লছমী কচু না আনলে লোকগুলো ফিরে যেত। অনাচ্ছিস্টি হতো। এখন কথা না বাড়িয়ে উনুন ধরাও গে। দেখো ঠাকুরের কৃপায় ভাতটা হয় কিনা”। ধনঞ্জয় কথা বাড়ায় না। নিজে ভুল করেছে। কয়লার বস্তা ঢাকেনি। ভিজে গেছে সব। মাথা নীচু করে উনুন ধরাতে চলে যায় ধনঞ্জয়।

    ইন্দুবালা কুরনিতে কচু আর নারকেল কোরান। সেই কচু আর নারকেল সরষে, কাঁচা লঙ্কা দিয়ে বড় শিলটায় বাটতে থাকেন। চারপাশটা ভরে উঠতে থাকে এক বুনো গন্ধে। অনেকদিন পর খুলনার কলাপোতা যেন হাতছানি দেয় তাঁকে। ইন্দুবালাকে ডাকে বোসপুকুরের পাশে বাঁশঝাড় পেরিয়ে কচু বন। শীতের অবেলার বৃষ্টি। মাথায় দুটো বড় কচুপাতা নিয়ে দুই ভাইবোন কচু তুলতে যায়। গা হাত পা চুলকোয়। মা বকে। ঠাম্মার কাঁদো কাঁদো মুখটা আজও কেমন যেন মনে পড়ে যায় ইন্দুবালার। জ্বরের পরে স্বাদহীন মুখে খেতে চেয়েছিলেন কচুবাটা। মাকে বলেননি। জানেন এই বাদলায় কিছুতেই তিনি ইন্দুবালাকে পাঠাবেন না। ইন্দুবালাকে ডেকে বলেছিলেন “নিয়ে আসবি নাকি ইন্দু? বোসেদের বাগান থেকে একটা কচু তুলে?” ইন্দু না বলতে পারেনি। ভূতের ভয় ছিল তার। তাই ভাইকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল সে। কিন্তু ইন্দু চিনবে কী করে ভালো মানকচু? সেসব তো অনেক দিন আগেই ঠাম্মা নিজে হাতে করে শিখিয়েছে। “চারপাশ থেকে ছড়ার মতো পাতা যার বেরিয়েছে। ফুলের মতো হয়ে আছে গাছ। সে জানবি গর্ভবতী। মাটির নীচে লুকিয়ে রেখেছে সন্তানকে। তার মধ্যে টইটম্বুর দুধ। গোড়ায় ডেউ পিঁপড়েগুলোকে দেখেছিস? লোভীর মতো কেমন ঘুরে বেড়াচ্ছে?” ঠাম্মা বড় শাবল নিয়ে এসেছিলেন। ভিজে মাটিতে তাড়াতাড়ি বসে যাচ্ছিল শাবল। উঠে আসছিল ঘন কৃষ্ণকায় মাটি। গর্ত যত গম্ভীর হচ্ছিল দেখা যাচ্ছিল শিকড়টাকে। যেখানে লুকিয়ে রেখেছে তার খাবার। একটু পরেই মাটি খুঁড়ে গর্ত করে কচু বের করা হল। গায়ে শক্তি ছিল বুড়ির। সেই কচু কেটে বেটে গাঁ সুষ্ঠু লোক খেলো। আর আজ ঠাম্মার জ্বর। তাকে মা একটু কচু বেটে দিতে পারছে না? ভাইটা পাশে দাঁড়িয়ে খালি গা চুলকোচ্ছে। কচুর রস লেগে লাল হয়ে গেছে তার হাত পা। চুলকোতে চুলকোতে ফুলে গেছে হাতের ওপর দিকটা। তার সাথে মা গাঁ মাথায় করছে চিল চিৎকার করে। “বুড়ির মরার সময় এল, নোলা গেল না”। ইন্দুবালা চুপি চুপি রান্না ঘরে ঢোকে। পিঁড়ি পেতে বসে। কচু কেটে, কুরে বাটতে বসে। কচুর ওপর ছড়িয়ে দেয় কাঁচা তেল। অনেক দিন পর দুপুর বেলা ধোঁয়া ওঠা ভাতে কচুবাটা খেতে বসে ঠাম্মার চোখে জল। সেটা কাঁচা লঙ্কা সর্ষের তেলের? নাকি আনন্দের বুঝতে পারে না ইন্দুবালা। খাওয়া হয়ে গেলে এক পরিতৃপ্তির মুখ নিয়ে জড়িয়ে ধরেন ইন্দুবালাকে। তার হাত দুটো বুকের কাছে নিয়ে কীসব বিড়বিড় করে বলেন। আশীর্বাদ করেন। ঠাম্মা কি জানতো একদিন ইন্দুবালাকে এই হাত দুটোই বাঁচিয়ে দেবে? তারই কি ডাল সাঁতলানোর প্রস্তুতি সেরে রাখছিল ঠাম্মা?

    বিকেলের দিকে চাদর গায়ে দিয়ে ইন্দুবালাকে বেরোতে দেখে পথ আটকায় ধনঞ্জয়। “চললে কোথায় শুনি?” ইন্দুবালা বলেন “হেতালের মাকে একটু বলে আসি। যদি একটু কচি কচু পায়”। ধনঞ্জয় রেগে যায়। “সেটা কাল সকালে বললেও হবে। এক্ষুনি সন্ধ্যে নামবে। রাতে ভালো দেখতেও পাও না। আমি হোটেল ছেড়ে বেরোতে পারবো না। একা কী করে যাবে শুনি?” ইন্দুবালা ধনঞ্জয়ের নাক ফোলানো দেখে হাসেন। “জানিস না আমার যে একজোড়া বেড়ালের চোখ আছে। রাতেও দেখতে পায় ভাল”। ধনঞ্জয় বিরক্ত হয়। “কচুবাটা করতেই হবে? যে যা বলবে তোমাকে তাই করতে হবে? না বলতে পারো না তুমি, তাই না?” ইন্দুবালা বলেন, “ওমা সে কী কথা! মেয়েটা মুখ ফুটে একটু কচুবাটা খেতে চেয়েছে, না বলবো কী করে?” ধনঞ্জয় চিৎকার করে। “তুমি কিন্তু বলেছিলে লছমী মারা যাওয়ার পরে এই বাড়িতে কচুবাটা হবে না”। কেমন যেন ধাক্কা খান ইন্দুবালা। সন্ধ্যে নামছে সবে শীত আসা শহরে। ছেনু মিত্তির লেনে যে কটা পুরোনো বাড়ি রয়ে গেছে, যেগুলো এখনও ফ্ল্যাট হয়ে যায়নি সেগুলোর জানলা বন্ধ। অনেক উঁচু উঁচু

    ফ্ল্যাটগুলোতে বাইরে থেকে বোঝা যায় না সেখানে মানুষ থাকে কিনা। কিংবা থাকলেও প্রাণের কোনো অস্তিত্ব আছে কিনা। মাঝে মাঝে কাপড়জামা জানলা কিংবা বারান্দায় ঝুললে বোঝা যায় ওখানে কেউ বাস করে। ইন্দুবালার এই মুহূর্তে নিজেকে বড় একা মনে হয়। কবেকার লছমীর কথা মনে পড়ে যায়। সারাক্ষণ চারপাশে যাদের সাথে কথা বলেন তাদের মধ্যে যে লছমী নেই সেটাই ভাবতে পারেন না তিনি। চান না। কেন তিনি এতদিন বেঁচে আছেন এই ভাবনা মাথায় চাগাড় দেবার আগেই হনহন করে হাঁটতে থাকেন ইন্দুবালা হেতালের মায়ের ঝুপড়ি ঘরের দিকে।

    বাজার থেকে ফেরার পথে লছমী বলে “কই মা দাও দেখি ভাত খাই তোমার কচুবাটা দিয়ে”। শীতের বৃষ্টিতে ভিজে চুপসে গেছে লছমী। ইন্দুবালা আলমারি থেকে নিজের একটা কাপড় বের করে দেন। লছমীর বারণ করা সত্ত্বেও গরম জল করে দেন স্নানের জন্য। আসন পেতে গরম ভাত খেতে দেন লছমীকে। কচুবাটা দিয়ে ভাত মেখে লছমী মুখে তোলে। “এটা কী করেছিস মা?” অবাক হয়ে তাকায় ইন্দুবালার দিতে। “ভালো লাগেনি তোর?” ভয়ে ভয়ে জানতে চান ইন্দুবালা। লছমী বলে “ভালো মানে বহুত ভালো”। শুধু কচুবাটা দিয়ে সব ভাতটা খেয়ে নেয় লছমী। কত দিন পরে তাকে এইভাবে বসে কেউ খাওয়ালো। কতদিন পর? বয়েস যখন বারো কি চোদ্দ শাদি হয়ে গিয়েছিল তার। ইন্দুবালা অবাক হন “এত ছোটোবেলায়?” লছমী বলে “তা নয়তো কি? বাপ তো মেয়েকে বিদাই দিতে পারলে বাঁচে। গ্রামে তো আর আমার বয়সী একটা মেয়েও ছিল না। তারপর বাবা চারটে ভইষ সওদা করে টাকা দেয় আমার মরদকে। তখন রাজি হয় সে। তোমার কত সওদা হয়েছিল মা?” ইন্দুবালা হাসেন। সবটা তো আর বাবা বলেনি। তবে গা ভর্তি গয়না পরিয়ে দিয়েছিল মা। সেই গয়নার আজ একটাও নেই। বাবু মাস্টার রতনলাল মল্লিকের হাত দিয়েই সব খরচ হয়ে গেছে অনেক দিন আগে। লছমীরও কোনো গয়না নেই। মন খারাপ করে বসে থাকে দুজনে। গয়নার জন্য কি শুধু? মোটেই না। “কবে তুই শেষ তোর গ্রামে গেছিস লছমী?” লছমী বলে “তাও বছর দশ আগে। বাবা মা কলেরায় মারা গেল। তারপর কমলা নদীতে বান এলো। ভাসিয়ে নিয়ে চলে গেল। সব কুছ। আমাদের গাঁওটা আছে জানি। কিন্তু আর কার কাছে যাবো মা?” লছমীর গল্পে ইন্দুবালাও যেন কেমন খুঁজে পান নিজেকে। বিয়ের পরে একবারও যাওয়া হয়নি কলাপোতায়। কার কাছে যেতেন? কেউ ছিল না সেই পোড়া ভিটেয়। সেদিন ইন্দুবালা লছমীকে আর যেতে দেননি। পরের দিন বনধ। অনেক করে বলেছিলেন থেকে যা না লছমী। সারা রাত দুজনে গল্প করবো। সত্যি করেও ছিলেন তাই। কত কত যে গল্প দুজন দুজনের জন তুলে রেখেছিলেন তার হিসেব ওই জাবদা খাতাও দিতে পারতো না। “তুই যদি আমাদের গাঁও কি দরওয়াজার কাহানী শুনিস না মা তাজ্জব বনে যাবি”। ইন্দুবালা অতশত হিন্দি জানেন না। লছমীর সাথে থেকে একটু একটু করে কয়েকটা শব্দ বোঝেন। “গাঁও কি দরওয়াজা সে আবার কী রে?” শুনে লছমী জিভ কেটেছিল লম্বা করে। “হাই রাম! তুই গাঁও কি দরওয়াজা জানিস না মা? তাহলে শোন। গাঁওয়ের বাইরে একটা ছাউনি করে রাখা থাকে। সেখানে এসে বসে দূর গাঁও থেকে আসা মেহমান। রাম দুলার ওখানে বসেই ভজন করে। বরাতির থাকা হুয়া মেহমান ওখানেই রাতে নিন্দ যায়। ছররা সিং ওখানেই রাতে ছাগলগুলোকে বেঁধে রাখে। আরও কত কী যে হয়! ওখানেই তো আমাদের মুখিয়া তার মেয়ের শাদিতে দশ গাঁওয়ের লোককে বৈঠ কর খিলালো। ওটা যখন দূর থেকে দেখতে পেতাম না মা, মনে হতো আমার গাঁও চলে এসেছি। আর যাবার সময় মনে হতো এই যে ছেড়ে যাচ্ছি আবার কখন ফিরতে পারবো?” মাঝরাতে ঘরের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। ইন্দুবালা হালকা করে দেন। “আরে আমাদের জলসত্রের মতো। বিশালাক্ষ্মী তলায় ছিল তো। দূরের অচেনা অজানা পথিক তেষ্টার জল পেয়ে বিশ্রাম করতো। বোষ্টম বোষ্টমী ওখানেই সিধে পেয়ে দুটো চালে ডালে ফুটিয়ে খেত। গাঁয়ের বুড়োরা আচ্ছা জমাতো ওখানেই”। দুটো মেয়ে তাদের দুজনের সবচেয়ে ভালোলাগা জায়গা দুটোর গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে।

    সকালে উঠে ইন্দুবালা দেখেন লছমী নিজে উনুন ধরিয়েছে। আটার বড় বড় গোল গোল লেচি বানিয়েছে। তার মধ্যে ছাতু দিয়ে উনুনের আঁচে সেঁকছে। দিশি টমেটো সেদ্ধ করেছে। তার মধ্যে ধনে পাতা, কাঁচা লঙ্কা এইসব দিয়ে একটা চাটনি করেছে। “তোকে আমার কমলা গাঁওয়ের একটা খানা খাওয়াবো মা”। ইন্দুবালা চেখে দেখেছেন অন্যরকম স্বাদ তার। শুকনো পিঠে যদি এইভাবে করা যেত? ছাতুর বদলে নারকেলের পুর। “কী বলে রে এই খাবারটাকে লছমী?” লছমী জানতে চায় “আগে বলো ভালো লাগছে কি? আমার মরদ এক সাথে কত খেয়ে নিতো। বাচ্চারা আমার এই লিট্টি খাওয়ার জন্য বসে থাকে মা। আর চাটনি? পসন্দ হয়নি?” খুব ভালো লেগেছে ইন্দুবালার। “লছমী আমি তোর এই কমলা গাঁওয়ের চাটনিটা নিয়ে নিলাম রে। লিট্টি তো আর তোর মতো বানাতে পারবো না। চাটনিটা চেষ্টা করে দেখতে পারি”। সেদিন বিকেলে বাস ট্রেন চলার পরে লছমী চলে গিয়েছিল। কিন্তু গোটা বাড়িতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে গেল ইন্দুবালার একটা না দেখা কমলা গ্রামকে। তার পাশ দিয়ে তিরতির করে বয়ে চলা কমলা নদীকে। নদীর ধারে ছট পুজো, হোলিকে।

    আজ যেন মনে হচ্ছে হেতালের মায়ের দোকানটা বড্ড বেশি দূরে। ধনঞ্জয়কে সঙ্গে আনতে পারলে ভালো হতো। রাগ করে এইভাবে ছুটে বেরিয়ে আসা মোটেই উচিত হয়নি ইন্দুবালার। যদি রাস্তায় পড়ে যান তাহলে একটা কাণ্ড ঘটবে। ঠিক যেমন হয়েছিল লছমীর। বুঝতে পারেনি ট্রেন আসছে। মাথায় ছিল মাছ ভর্তি ঝুড়ি। তাড়া ছিল বাজারে আসার। সেদিন আবার কালেক্টার অফিসের বড়বাবু বলেছিলেন কচুবাটা খেতে আসবেন। লছমীর ঝুড়িতে ছিল মাছ। কাঁধের বস্তার বোঁচকায় ছিল বড় কচু, দিশি ছোট টমেটো, খুব ঝাল লঙ্কা, ধনে পাতা। অনেক ভোরে, কুয়াশার মধ্যে অন্যমনস্ক লছমী বুঝতে পারেনি ট্রেন এসে পড়েছে খুব কাছেই। পার হতে পারেনি লাইন। ছিটকে পড়েছিল মাছের ঝুড়ি। কাঁধের বস্তা। দেহ থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিল ওই হাসিখুশি মুখটা। অনেক বেলায় খবরটা এসেছিল। ইন্দুবালা তখন কালেক্টার অফিসের লোকজন নিয়ে হিমসিম খাচ্ছেন। ভেবেছিলেন লছমী আসেনি হয়তো শরীর খারাপ করেছে। কিন্তু মনে মনে দুশ্চিন্তাও করেছেন এমন কথার খেলাপ তো লছমী করে না। সব ভাবনা চিন্তা চাপা দেওয়ার জন্য ইন্দুবালা আরও রান্নার পদ বাড়িয়ে নিয়েছেন ততক্ষণে। কচুবাটার জায়গায় ঢুকে পড়েছে ছ্যাঁচড়া। সবাই যখন গরম গরম ভাত দিয়ে খাবে এতসব রান্না ঠিক সেই সময়ে রান্নাঘরের পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকলো দয়ারাম। লছমীর সাথেই আসতো সে। তার পাশে বসেই মাছ বিক্রি করতো। দুজনের যত ঝগড়া ছিল তত ভাব। শুকনো মুখে দয়ারামকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ছাঁক করে উঠেছিল বুক। “কী হয়েছে রে দয়ারাম? ওরকম শুকনো মুখ কেন তোর?” দয়ারাম বসে পড়েছিল দোরগোড়ায় মাথায় হাত দিয়ে। ডুকরে ডুকরে কেঁদে বলেছিল পুরো ঘটনাটা। চুপ করে শুনেছিলেন ইন্দুবালা। নিজের মনের ভেতরের তোলপাড় কাউকে বুঝতে দেননি তিনি। নিজের সব সময় ভেবে এসেছেন এই হোটেলের যদি কেউ অংশীদার থেকে থাকে তাহলে সে হলো লছমী। তার সেই প্রথম দিনের টাকায় হোটেল শুরু না হলে কোনদিন ইন্দুবালা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারতেন না। শান্তভাবে সবাইকে খাইয়ে, স্নান করে নতুন কাপড় পরলেন ইন্দুবালা। দয়ারামকে নিয়ে নিজে গেলেন মর্গে। সেখানে একবার শেষ দেখা দেখবেন ভাতে কাপড়ে তাঁকে বাঁচিয়ে যাওয়া বিহারের সেই কোন অজ কমলা গ্রামের মেয়েটিকে। যার বাবা মা বিয়ে দেওয়ার নামে পণ দিয়ে বেচে দিয়েছিল কোনো এক নেশাখোর মানুষের কাছে। লছমী চুপ করে শুয়ে ছিল মর্গের মেঝেতে তার হাসি হাসি মুখ নিয়ে। শুধু গলার কাছে। ছিল একটা চওড়া সেলাই। বসে পড়েছিলেন ইন্দুবালা ঠিক লছমীর পাশে মর্গের মেঝেতেই। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন মৃত সখীর। “এমন তো কথা ছিল না রে। উনুন ধরিয়ে বসেছিলাম তোর জন্যে। তুই এলি না। কথা রাখলি না”। এত শুকনো চোখেও জল পড়ে ইন্দুবালার। ভেপসে ওঠা মর্গটাও যেন শোকের সজীবতা পায়।

    লছমীকে দেখেই কাজ শেষ হয়ে যায়নি ইন্দুবালার। পুলিশের কাছে যে ফর্ম থাকে অশনাক্ত বডির সনাক্তকরণের সেইসব কিছু ফর্মালিটি করতে হল তাঁকেই। বাজারের একগাদা গরীব গুর্বো লোকের সাথে ভদ্রঘরের এক বিধবাকে দেখে পুলিশের লোকজন একটু অবাক হয়েছিল বটে তবে বিস্তারিত প্রশ্ন করার অবকাশ ছাড়েনি। লছমী যে তাঁর আত্মীয় হয় পুলিশের কাছে বলেছিলেন ইন্দুবালা। “ঠিক কি ধরনের আত্মীয় যদি একটু বলেন দিদি?” জানতে চেয়েছিল লোকাল থানার ওসি বিষ্ণুপদ হাজরা। ইন্দুবালা বলেছিলেন “বোন..”। ঘুরিয়ে জানতে চেয়েছিল ওসি, “একজন বিহারী বাঙালির বোন?” ইন্দুবালা সরাসরি তাকিয়ে বলেছিলেন “কেন হতে পারে না? আমার আপনার রক্তের হিসেব কার কাছে লেখা আছে স্যার? রক্তের আত্মীয়তাই কি সব?” ওসি কথা এগোয়নি। এমনিতে বেশি মাল কড়ি পাওয়া যাবে না এদের কাছে। ফর্মে সই করে ছেড়ে দিয়েছিল। বেরিয়ে আসার সময় ইন্দুবালা দেখেছিলেন দরজার কাছে পড়ে আছে কচুটা, ঝুড়িটা। আইডেন্টিফিকেশানের জন্য নিয়ে আসা হয়েছে। কাউকে কিছু না বলে কচু আর ঝুড়ি দুটোই নিয়ে এসেছিলেন ইন্দুবালা। যিনি কোনোদিন তাঁর স্বামীর একটা ছবি বাড়িতে রাখেননি তিনি তাঁর সখীর শেষ চিহ্নটুকু নষ্ট হতে দেননি।

    দয়ারামকে সব খরচ দিয়েছিলেন ইন্দুবালা। লছমীর অন্ত্যোষ্টি, শ্রাদ্ধ সব কিছু। এমনকি লছমীর ছেলেকে ডেকে হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন সেই সময়ের দশ হাজার টাকা। মায়ের জায়গায় ব্যবসা শুরুর জন্য। বাড়ি ফিরে খুব হালকা লেগেছিল তাঁর। খুব কাছের মানুষ চলে গেলে যেমন চারপাশ ফাঁকা হয়ে যায়। লছমী চলে যাওয়ার পরেও তাই মনে হয়েছিল। কিছু খাননি সেদিন সারাদিন। পরের দিন সকালে স্নান করে, উনুন ধরিয়ে কচু বাটতে বসেছিলেন। সেদিন হোটেলের মেনু ছিল গরম ভাত, কচুবাটা আর দেশি কাঁচা টমেটোর চাটনি। পরে সেটা নাম বদল করে রেখেছিলেন লছমী চাটনি। চাটনি হয়ে গেলে তার ওপরে ছড়িয়ে দিতেন গন্ধরাজ লেবুর সুবাস। প্রথম ভাত নামার পরেই শাল পাতার থালায় তুলে নিয়েছিলেন সেদিন ইন্দুবালা। কচুবাটা আর চাটনি পাশে দিয়ে বাগানের নারকেল গাছটার তলায় রেখে এসেছিলেন। মাটির গ্লাসে ছিল জল। গড় হয়ে প্রণাম করে সেই খোলা বাগানে লছমীকে অনুরোধ করেছিলেন শেষবারের মতো ভাত খেয়ে যেতে। আর পেছন ফিরে তাকাননি। বাগানের দরজা বন্ধ করে ধনঞ্জয়কে বলেছিলেন আজকের পর থেকে কচুবাটা রান্নাটা বন্ধ তাঁর হোটেলে।

    তাহলে এখন হঠাৎ এই অবেলায় অচেনা এক মেয়ের অনুরোধে ইন্দুবালা রাজি হয়ে গেলেন কেন আবার সেই রান্না করতে? কে জানে কার মধ্যে দিয়ে কে বারবার এই পৃথিবীতে ফিরে ফিরে আসে। সেদিনে বিকেলে বাগান থেকে এসে ধনঞ্জয় বলেছিল, “মা শালপাতার থালা পরিষ্কার। একটা ভাতও নেই। শুধু কি তাই? জলটা পর্যন্ত খেয়ে গেছে গো”। ইন্দুবালা ধমকে ছিলেন ধনঞ্জয়কে। “ওইভাবে বলতে নেই ধনা। মানুষ মারা গেলে ঈশ্বর হয়ে যান”। এখনও কাঁচা মাছ আসলে প্রথমে ওই লছমীর ঝুড়িতেই রাখা হয় সব। তারপর সেখান থেকে সব ধুতে যায়। ভাজতে যায়। কিছু কিছু অদ্ভুত সংস্কার ইন্দুবালা আজও মনে মনে মেনে চলেন।

    সেদিন হেতালের মায়ের দোকান বন্ধ ছিল। কাজেই ইন্দুবালাকে বেশ কয়েকদিন পর পর নতুন কচুর জন্য বাজারে হেতালের মাকে বলে রাখতে হলো। সেই বউটি অনেক খুঁজে পেতে সোনারপুর পেরিয়ে আরও কোন অজ গাঁয়ের থেকে কচু এনে দিলে ইন্দুবালা পরপর কয়েকদিন কচুবাটা করেলেন। ঝামেলা হলো বিস্তর। চারপাশের লোকজন তো এলোই। কৃষ্ণনগর থেকে এলেন সেই অধ্যাপক অমলেন্দু। সঞ্চারী পরিচয় করিয়ে দিলো। কাঁচা পাকা দাড়ি, চোখে ভারী পাওয়ারের চশমা। “চিনতে পারছেন না আমাকে দিদি?” যখন পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো তখনও বুঝতে পারেননি ইন্দুবালা। চশমা খুলতেই ঝন্টুকে চিনতে পারলেন তিনি। এমন জ্বর বাধিয়ে ছিল ছেলেটা নিজে গিয়ে খাবার দিয়ে আসতেন ইন্দুবালা। “তোর মনে আছে লছমীকে ঝন্টু? ওই যে ঝুড়ি করে মাছ দিয়ে যেতো আমাকে?” ঝন্টু মনে করার চেষ্টা করে, পারে না। ধনঞ্জয় খ্যাচ খ্যাচ করে। কচুর ডাঁই পড়ে আছে। সেগুলো কখন কাটা হবে, বাটা হবে কে জানে। ঝন্টু তার ব্যাগ থেকে কৃষ্ণনগরের সরভাজা বার করে দেয়। ইন্দুবালা সবাইকে বসতে বলেন। কচি কচুকে ভালো করে ধুয়ে, কুরে, নারকেল, সর্ষে আর কাঁচা লঙ্কা দিয়ে মিহি করে বেটে ওপরে ছড়িয়ে দেন কাঁচা সরষের তেল। গরম ভাতে সেই কচুবাটা নিমেষে শেষ হয়। সবাই হাপুস হুপুস শব্দ তোলে। কচি দেশি টমেটোর চাটনি লোকজন চেটেপুটে খায়। অনেকদিন পরে পড়ন্ত বেলায় রান্না ঘরের দরজায় লছমী এসে দাঁড়ালে ইন্দুবালা একটুও অবাক হন না। শুধু বিড়বিড় করে বলেন তোকে আজ আর কেউ মনে রাখেনি রে লছমী। লছমী হাসে। কোনো কথা বলে না। শুধু চেয়ে থাকে ইন্দুবালার দিকে। কী বলতে চাইছে লছমী ইন্দুবালাকে? বিদায় বেলার আমন্ত্রণ?

    ইন্দুবালার কেমন যেন শীত করে। তড়িঘড়ি দোতলায় ওঠেন। ধনঞ্জয়ের বেড়ে দেওয়া ভাতের থালা সরিয়ে রেখে কিচ্ছুটি না খেয়ে বারান্দায় একচিলতে রোদে আচার, কাসুন্দি আর বড়ির পাশে ঘুমিয়ে পড়েন। পশ্চিম দিকে পাটে যাওয়া বেলাশেষের একটু রোদ এসে পড়ে তাঁর পরিতৃপ্ত শঙ্কাহীন মুখে।

     

    1 2 3 4 5 6 7
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleবাবলি – বুদ্ধদেব গুহ
    Next Article কড়ি দিয়ে কিনলাম ২ – বিমল মিত্র

    Related Articles

    উপন্যাস বুদ্ধদেব গুহ

    কোয়েলের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ

    May 23, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    ফেলুদা এণ্ড কোং – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }