Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ইমদাদুল হক মিলনের বিবিধ রচনা

    ইমদাদুল হক মিলন এক পাতা গল্প213 Mins Read0

    বন্ধুবান্ধব

    আফজালকে প্রথম কবে দেখি! দিনটির কথা পরিষ্কার মনে আছে। তিয়াত্তর সালের শেষ দিককার কথা। অবজারভার ভবনের দোতলায় ‘দৈনিক পূর্বদেশ’ পত্রিকার অফিস। পূর্বদেশের ছোটদের পাতার নাম ‘চাঁদের হাট’। সেই পাতা ঘিরে একটি সাহিত্যের অনুষ্ঠান। হাতে লেখা পোস্টার ফেস্টুনে ছেয়ে আছে চারদিক। আমার বয়সী বহু ছেলেমেয়ে ভিড় করে আছে দোতলার হলরুমে। হলরুমটা পুবে পশ্চিমে লম্বা। পশ্চিম দিককার দেয়াল ঘিরে স্টেজ। উঁচু স্টেজ না। মেঝেতে ফরাশ বিছানো, পেছনে দেয়ালের সঙ্গে টাঙানো হয়েছে ব্যানার। তাতে কী লেখা ছিল সে কথা আমার আর এখন মনে নেই।

    মনে আছে আফজালের কথা।

    তার আগে আমার প্রথম লেখা ছাপা হয়েছে চাঁদের হাটের পাতায়। গল্পের নাম ‘বন্ধু’। ডাকে পাঠিয়েছিলাম। যে সপ্তাহে পাঠিয়েছি তার পরের সপ্তাহেই ছাপা হয়ে গেছে। গল্পের ইলাসট্রেশন করেছিলেন কাজী হাসান হাবিব। পরবর্তীকালে হাবিবের সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব হয় আমার। কিন্তু আমার নামের বানানটা ভুল করেছিল হাবিব। ই এর পরে ম এর জায়গায় হাবিব লিখেছিল ক।

    তাতে কী!

    গল্প ছাপা হয়েছে, এই খুশিতে আমি পাগল। অন্যান্য পত্রিকার ছোটদের পাতা দেখি বা না দেখি পূর্বদেশের ‘চাঁদের হাট’ দেখিই। এই পাতায় সাহিত্যবিষয়ক অনুষ্ঠানের সংবাদটা বেরিয়েছিল। চাঁদের হাটে যাঁরা লেখালেখি করেন সবাইকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আমি তখন থাকি গেণ্ডারিয়াতে। গেণ্ডারিয়ার রজনী চৌধুরী রোডের একটা বাড়িতে। সেখান থেকে সদরঘাট গিয়ে বাসে চড়লাম। গুলিস্থানে নেমে হেঁটে গেলাম অবজারভার হাউসে।

    কিন্তু আমাকে কেউ চেনে না।

    লম্বা মতন এক ভদ্র্রলোককে ঘিরে আমার বয়সী বেশ কয়েকজন ছেলেমেয়ে। ভদ্রলোকের মাথায় লম্বা চুল। পরনে কালো প্যান্ট আর সাদা ফুলহাতা শার্ট। মুখে পান আছে। পান চিবাতে চিবাতে তিনি ছেলেমেয়েগুলোকে নানা রকম কাজের অর্ডার দিচ্ছিলেন। তাঁর অর্ডারে বর্তে যাচ্ছিল সবাই। যেন তাঁকে খুশি করতে পারলেই হলো।

    এদের মধ্যে ছোটখাটো একজন আমাকে খেয়াল করল। আমার বয়সী অথবা আমার চেয়ে বছর খানেকের ছোট হবে। আকৃতিতে ছোট কিন্তু তার গলার আওয়াজ বেশ ভারি, চালচলনে কেউকেটা ভাব। গায়ের রং শ্যামলা। সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরা। মাথায় অতি ঘন চুল। জিজ্ঞেস করল, তুমি কোত্থেকে আসছ?

    বললাম।

    নাম কী?

    বললাম।

    নাম বলার সঙ্গে সঙ্গে সে আমাকে চিনল। ও তোমার গল্প তো চাঁদের হাটে ছাপা হয়েছে। ‘বন্ধু’ না গল্পের নাম?

    হ্যাঁ।

    আরে আসো আসো।

    প্রথমে সে আমাকে নিয়ে গেল পান চিবানো ভদ্রলোকের কাছে। দাদুভাই, এ হচ্ছে বন্ধু।

    অনুষ্ঠানের কাজে মহাব্যস্ত ভদ্রলোক। তবু আমার দিকে তাকালেন। বন্ধু মানে?

    কিছুদিন আগে নতুন একটা ছেলের গল্প ছাপলেন না! গল্পের নাম ছিল…

    বুঝেছি বুঝেছি।

    শুধু ওটুকুই। ব্যস্তভঙ্গিতে অন্যদিকে চলে গেলেন তিনি।

    ছেলেটি আমাকে বলল, ইনিই চাঁদের হাট পাতা দেখেন। বিরাট ছড়াকার। নাম রফিকুল হক। আমরা সবাই দাদুভাই ডাকি। ইত্তেফাকের ‘কচিকাঁচা’র পাতা চালান আরেক ছড়াকার, রোকনুজ্জামান খান। তাঁকে সবাই দাদাভাই ডাকে। তিনি দাদাভাই, আর ইনি দাদুভাই।

    বলে মিষ্টি করে হাসল।

    টের পেয়ে গেলাম ছেলেটির কথায়, আচরণে মজার একটা ভঙ্গি আছে। তার রসবোধ চমৎকার।

    কিন্তু তখনও পর্যন্ত তার নাম আমি জানি না।

    আমি জগন্নাথ কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। চেহারা সুবিধার না। গুণ্ডা গুণ্ডাভাব আছে। শিল্পসাহিত্যের সঙ্গে আমার চেহারাটা ঠিক যায় না। দাদুভাই বোধহয় এজন্য আমাকে তেমন পাত্তা দিলেন না। আমার অবশ্য ওসব তখন খেয়াল করার সময় নেই। ছেলেটির আচরণ আমার ভালো লাগছে। খুবই আন্তরিকভাবে কথা বলছে। খানিক আগেই যে পরিচয় হয়েছে মনেই হচ্ছে না। মনে হচ্ছে সে আমার বহুদিনের পরিচিত। বহুদিনের পুরনো বন্ধু।

    এই ছেলেটির নাম আবদুর রহমান।

    আজকের বিখ্যাত আবদুর রহমান। অসাধারণ ছড়া লিখত, মুখে মুখে দুর্দান্ত সব ছড়া বানাত। কিন্তু তার কোনও বই নেই। এত ভালো লেখে, কিন্তু লেখালেখিতে আগ্রহ নেই। ওই বয়সেই চমৎকার বক্তৃতা দিত রহমান, সাংগঠনিক দক্ষতা অতুলনীয়। পরবর্তী জীবনে অনেক কিছু করেছে। মতিঝিলে নার্সারি এবং বীজের দোকান রহমানদের। ঢাকা সীড স্টোর। দৈনিক বাংলা থেকে গভর্নর হাউসে যাওয়ার রাস্তায়। সেই দোকানের জায়গায় এখন চৌদ্দতলা বিল্ডিং রহমানদের। কিন্তু নিচতলায় দোকানটা আছে। রহমানের বাবা বসেন। আমাদের খুবই প্রিয় মানুষ তিনি।

    এই দোকানের পাশে ছোট্ট একটা দোকান নিল রহমান। সাতাত্তর আটাত্তর সালের কথা। তাজাফুলের দোকান দিল। ঢাকায় তখনও ফুলের দোকানের কনসেপসান আসেনি। রহমানের মাথা থেকে এলো। উৎসব আনন্দ বিয়ে এবং জন্মদিনে তাজাফুল কিনে নিয়ে উপহার দেবে লোকে। আমরা রহমানের দোকানে বসে তুমুল আড্ডা দেই। চা সিঙারা খাই। রহমান সারাদিনে যত টাকার ফুল বিক্রি করে তার চেয়ে অনেক বেশি খেয়ে ফেলি। বাকি টাকা বাবার কাছ থেকে নিয়ে আসে রহমান। বন্ধুদের জন্য ভর্তুকি দেয়।

    কিন্তু কতদিন?

    নির্বিকার ভঙ্গিতে রহমান একদিন দোকানে তালা ঝুলিয়ে দিল। কত টাকা লস হলো কোনও হিসাবই নেই। আমার ‘ও রাধা ও কৃষ্ণ’ উপন্যাসে এই দোকানের কথা আছে।

    তারপর রহমান হয়ে গেল চিত্রসাংবাদিক, চলচ্চিত্র সাংবাদিক। অবজারভার হাউসের বিখ্যাত সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘চিত্রালী’। রহমান কন্ট্রিবিউটর হিসেবে ‘চিত্রালী’তে ববিতা শাবানা এইসব বিখ্যাত নায়িকাদের নিয়ে লেখে। ববিতার বোন চম্পার সঙ্গে তার বন্ধুত্ব। চম্পা তখনও নায়িকা হয়নি। রোজিনা নামে একজন নায়িকা এসেছে তখন, রহমানের সঙ্গে তাঁরও বন্ধুত্ব। আমরা তখন যাদের কাছে পৌঁছাবার কথা ভাবতেই পারি না, রহমান কেমন কেমন করে তাদের কাছে পৌঁছে যায়, বন্ধুত্ব করে ফেলে। বিরাট বিরাট নায়িকাদের তুই-তোকারি করে। ঘরের মানুষের মতো কাঁধে হাত দিয়ে কথা বলে। আমরা জুল জুল করে রহমানের দিকে তাকিয়ে থাকি।

    এই সেই রহমান!

    এই সেই ছেলেটি, চাঁদের হাটের অনুষ্ঠানে যার সঙ্গে আমার পরিচয়। পরিচয়ের কয়েক মিনিটের মধ্যেই বন্ধুত্ব।

    ভাবতে ভালো লাগছে, আমার প্রথম গল্পের নাম ‘বন্ধু’। সেই গল্পের সুবাদে চাঁদের হাটে গিয়ে আমি পেয়ে গেলাম আমার পরবর্তী পুরো জীবনের প্রিয় সব বন্ধুকে। প্রথম বন্ধু রহমান। রহমানের কল্যাণে অন্যরা।

    রহমানের অন্যান্য কীর্তির কথা পরে বলি। আগে সেই প্রথম দিনটির কথা বলি। আফজালের সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা বলি।

    দাদুভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়ের পর রহমান আমাকে নিয়ে গেল গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা দেয়া কয়েকজন ছেলেমেয়ের সামনে। এই, এই যে দেখ। এ হচ্ছে বন্ধু।

    মানে আমার গল্পের নাম দিয়েই রহমান আমাকে পরিচয় করাচ্ছে।

    সঙ্গে সঙ্গেই আমাকে চিনল অনেকে। একটি ছেলে কোমরে হাত দিয়ে বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটু জোরে জোরে কথা বলার স্বভাব। রহমান পরিচয় করিয়ে দিল, ওর নাম গোলাম মাওলা শাহজাদা। ছড়া কবিতা গল্প সব লেখে। আমার গল্পটা সে পড়েছে। হৈ হৈ করে সেকথা বলল।

    প্রিয় পাঠক, এই গোলাম মাওলা শাহজাদা কে জানেন? আজকের বাংলাদেশের, বাংলাভাষার বিখ্যাত কবি হাসান হাফিজ। বাংলা কবিতায় নিজের দক্ষতা পুরোপুরি প্রমাণ করেছেন তিনি। শিশুসাহিত্যে তাঁর অবদান যথেষ্ট। কৃতী সাংবাদিক হিসেবে তিনি শ্রদ্ধেয়। খেলাধুলায় আগ্রহী, পরিবেশ নিয়ে কাজ করেছেন পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সাংবাদিকদের সঙ্গে। বহু কাব্যগ্রন্থ এবং শিশুতোষগ্রন্থের পাশাপাশি ম্যারাডোনাকে নিয়ে বই লিখেছেন, পরিবেশ নিয়ে বেশ স্বাস্থ্যবান বই সম্পাদনা করেছেন। যেসব বন্ধুর পরিচয় দিতে আমি গৌরববোধ করি, শাহজাদা মানে হাসান হাফিজ তাদের একজন। সে নারায়ণগঞ্জের ছেলে। একবার মুন্সিগঞ্জের এক সাহিত্য সম্মেলনে গেছি তার সঙ্গে। উদ্যোক্তাদের একজনের বাড়িতে আমাদের দুজনকে রাতে থাকতে দেয়া হয়েছে। খেয়ে-দেয়ে শুয়েছি আমরা, শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে, বোধহয় তিরিশ সেকেন্ডও লাগেনি, ঘুমিয়ে গেল শাহজাদা। তাও হালকা পাতলা ঘুম না। গভীর ঘুম। মৃদু নাকও ডাকাচ্ছে।

    আমি অবাক।

    শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে এইভাবে ঘুমিয়ে পড়তে পারে মানুষ!

    আমি পাতলা ঘুমের মানুষ। ছেলেবেলা থেকেই, বিছানায় শোয়ার অনেক পরে আমার ঘুম আসে। নতুন জায়গা হলে ঘুম সহজে আসতেই চায় না। একা রুমে থাকতে পারি না। আমার একটু ভূতের ভয়ও আছে। একা রুমে থাকলেই মনে হয়, ওই তো, কে একজন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। একটু যেন বেশিই লম্বা। মাথাটা ছাদের সিলিংয়ে গিয়ে ঠেকেছে না! কখনও মনে হয় নিঃশব্দ পায়ে কে যেন হাঁটছে রুমে। রবীন্দ্রনাথের গানের মতো, ‘প্রেম এসেছিল নিঃশব্দ চরণে’। আমার মনে হয় ভূত এসেছে নিঃশব্দ চরণে।

    পায়ের পাতা দুটো লেপ কম্বল কিংবা চাদরের বাইরে রেখে শোয়ার অভ্যাস আমার। কখনও কখনও মনে হয় পায়ের তলায় কে যেন সুড়সুড়ি দিচ্ছে।

    এইসব কারণে বিদেশে গেলে বেশ একটা ফাপরে পড়ি। হোটেলের রুমে ফকফকা লাইট জ্বালিয়ে রাখি। বন্ধুবান্ধবের বাড়িতে থাকলেও একই কাজ। তারপরও ঘুম পুরোপুরি হয় না। রাত কাটে আধো ঘুমে আধো জাগরণে।

    অথচ শোয়ার তিরিশ সেকেন্ডের মধ্যে গভীর ঘুমে ডুবে যায় শাহজাদা!

    আফজালের স্বভাবও এই রকম। শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে তো বটেই, যখন চাইবে তখনই ঘুমাতে পারবে সে। আবার তিন চার রাত একনাগাড়ে জেগেও থাকতে পারবে। মুখ দেখে বোঝা যাবে না তিন চার রাত ঘুমায়নি সে।

    এ এক ঐশ্বরিক ক্ষমতা।

    শাহজাদার পাশে সেদিন দাঁড়িয়ে ছিল তেল চকচকে এক যুবক। উত্তম কুমার টাইপের ব্যাক ব্রাশ করা চুল। শ্যামলা রঙের মুখে আমার মতোই মোচ রেখেছে। পরনে কালো প্যান্ট আর নীল রঙের শার্ট। ফুলি ভ শার্টের হাতা তখন অনেকেই গুটিয়ে রাখে। সে রাখেনি। কব্জির বোতাম লাগানো। পায়ে স্যান্ডেল। অর্থাৎ নিপাট ভদ্রলোক।

    রহমান পরিচয় করিয়ে দিল। আলীমুজ্জামান হারু।

    আমরা খুব কাছের বন্ধু যারা তারা ছাড়া হারুকে কেউ আর এখন হারু ডাকে না। জুনিয়ররা ডাকে জামানভাই, কলিগরা ডাকে আলীমুজ্জামান সাহেব। হারু সাংবাদিকতা করে। যুগান্তর পত্রিকার সঙ্গে আছে। ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে বাংলায় মাস্টার্স করেছে। দিদার, স্বপন, হারু ওরা একই ব্যাচের।

    সেদিনকার সেই অনুষ্ঠানে দিদার ছিল না। দিদারের সঙ্গে আমার পরিচয় আরও পরে। দিদারের পুরো নাম দিদারুল আলম। এখন শিক্ষাভবনের ঊর্ধ্বতন একজন। খুবই প্রিয়বন্ধু আমার। দিদারের সঙ্গে অনেক ঘটনা, অনেক মধুর স্মৃতি। সেইসব স্মৃতির কথা অবশ্যই এই লেখায় লিখব। পর্যায়ক্রমে লিখব। আগে সেই প্রথম দিনটির কথা বলি।

    ফরিদুর রেজা সাগরের মা যে বাংলাভাষার বিখ্যাত ঔপন্যাসিক রাবেয়া খাতুন এই তথ্য আমি জেনেছি সাগরের সঙ্গে পরিচয়ের অনেক পরে। সাগরের বাবা ফজলুল হক সাহেব প্রথম চলচ্চিত্রবিষয়ক পত্রিকা বের করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানে। সমগ্র পাকিস্তানের প্রথম ছোটদের চলচ্চিত্র ‘প্রেসিডেন্ট’ তৈরি করেছিলেন, যে ছবির নায়ক কিশোর ফরিদুর রেজা সাগর।

    সাগর যে দেখতে কী সুন্দর ছিল!

    টকটকে ফর্সা গায়ের রঙ। গোলগাল মিষ্টিমুখ। একটু মোটা ধাঁচের শরীর। তখনও সাদা পাঞ্জাবি পাজামা ধরেনি সাগর। সুন্দর হাওয়াই শার্ট আর প্যান্ট পরা। পায়ে স্যান্ডেল সু। চেহারায় আশ্চর্য রকমের বনেদিআনা। নিচুগলায় সুন্দর করে কথা বলে। লেখে খুব ভালো। চাঁদের হাটের পাতায় সাগরের লেখা আমি পড়েছি। ছোটদের উপযোগী একটা মুক্তিযুদ্ধের গল্পের কথা আমার এখনও মনে আছে। সাগরের হয়তো নিজেরও মনে নেই সেই গল্পের কথা। কোনও বইতেও দেয়নি। কোথায় হারিয়ে গেছে সাগর জানেও না। ছোট্ট একটা রাখাল ছেলে গ্রামের বিলবাওড়ে গরু চড়ায়। দেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছে সে খবর রাখে না। একদিন নির্জন বিলে চার মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে তার দেখা। মুক্তিযোদ্ধাদের কাঁধে রাইফেল, মাথায় চুল লম্বা, চোখ লাল। বালক বিস্ময়ভরা চোখে তাঁদেরকে দেখে। গভীর কৌতূহল নিয়ে জানতে চায় তাঁরা কারা। এই বালকের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন মুক্তিযোদ্ধারা। অতিসরল ভাষায় কেন তাঁরা যুদ্ধ করছেন, কেন তারা এই দেশটিকে স্বাধীন করতে চান সেই বালককে তা বোঝান। সব শুনে বুঝে সেই বালকের ভেতর তৈরি হয় গভীর দেশাত্মবোধ। সেও তৈরি হয় শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য। তার ছোট্ট শরীর এবং হাতের লাঠিটি নিয়ে তৈরি হয়।

    তখন এতটা বুঝিনি।

    এখন ভাবলে মনে হয়, কী দুর্দান্ত আইডিয়ার গল্প। হয়তো কাঁচা হাতে লিখেছিল সাগর। কিন্তু আইডিয়াটা অসাধারণ। ওই বয়সে এরকম একটা গল্পের আইডিয়া যার মাথায় আসে সে যে বড় ক্রিয়েটার তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

    সাগরের পরবর্তী জীবনের দিকে তাকালে তার বহু ক্রিয়েটিভিটির সঙ্গে আমরা পরিচিত হই। যেমন ‘খাবার দাবার পিঠাঘর’। যেমন ‘চ্যানেল আই’। সাগর যেখানে হাত দিয়েছে, অতিযতেœ সেখানে সোনা ফলিয়েছে। এমন কি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের চেহারাটাও সে বদলে দিয়েছে। আর শিশুসাহিত্যে সাগর যোগ করেছে এক দুর্দান্ত চরিত্র ‘ছোটকাকু’।

    একজন মানুষ কোন মন্ত্রবলে, মাত্র দুটো হাত নিয়ে এত কাজ করতে পারে ঠিক বুঝতে পারি না। সাগরকে দেখে আমি বিস্মিত হই, আফজালকে দেখে আমি বিস্মিত হই। এদের দুজনের কাউকেই আমার একজন মানুষ মনে হয় না। মনে হয় ফরিদুর রেজা সাগর নামে আট-দশজন অতি মেধাবী মানুষ কাজ করছে, আফজাল হোসেন নামে আট-দশজন অতি মেধাবী মানুষ কাজ করছে। কোথায় সেদিনকার সেই সাগর, আর কোথায় আজকের সাগর। মেধা এবং শ্রম একজন মানুষকে কোথায় নিয়ে আসতে পারে সাগর এবং আফজাল তার প্রমাণ।

    প্রথম দিনই সাগরকে আমার খুব ভালো লেগেছিল।

    রহমান পরিচয় করিয়ে দেয়ার পর সাগর তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে দুয়েকটা কথা বলেছিল। সে তো বরাবরই কথা বলে কম। অতি মেধাবী কাজের মানুষরা কথায় বিশ্বাসী নন, বিশ্বাসী কাজে। শুরু থেকেই সাগরের মধ্যে এই ব্যাপারটা ছিল।

    সাগরের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল শাহানা বেগম। নারায়ণগঞ্জ থেকে এসেছে। গল্প লেখে। স্মার্ট সুন্দর মেয়ে। পরবর্তীকালে ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে পাবলিক এডমিনিসট্রেশনে, নাকি কেমিস্ট্রিতে মাস্টার্স করল। বিখ্যাত সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকীর সঙ্গে বিয়ে হলো। আমাদের খুবই প্রিয়বন্ধু।

    শাহানা এখন কানাডায়। কিছুদিন আগে দেশে এসেছিল মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান করতে। আমার সঙ্গে দেখা হয়নি।

    এই লেখা লিখতে বসে কত প্রিয়বন্ধুর কথা যে মনে পড়ছে।

    সাগরকে ঘিরেই সেদিন মেয়েদের ভিড়।

    লিজি নামে ছবির মতো সুন্দর এক মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাগর আর শাহানার মাঝখানে। একটু ডাকাবুকো টাইপের একটা মেয়ে প্রায় ভিড় ঠেলে ঢুকে গেল। কী কথায় খিলখিল করে হাসতে লাগল।

    রহমান বলল, ওর নাম শুশুমণি। কাদের সিদ্দিকীর ছোটবোন।

    শুনেই আমি ভয় পেয়ে গেলাম। কাদের সিদ্দিকীর বোন!

    কাদের সিদ্দিকী তখন আমাদের হিরো। বিশাল মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান অতুলনীয়। তাঁর কাদেরীয়া বাহিনী পাকিস্তান আর্মির বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে প্রতিদিন বহুবার তাঁর নাম এবং কৃতিত্বের কথা প্রচারিত হতো। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের এক কিংবদন্তির নাম কাদের সিদ্দিকী। তাঁকে প্রথম দেখেছি আমাদের জগন্নাথ কলেজে। কলেজের কোনও একটা অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরা, লম্বা ি ম একজন বাঙালি। মুখভর্তি দাড়ি। কলেজের মাঠে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তুলছিলেন তিনি। হাজার হাজার ছাত্রের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমি তাঁকে দেখছিলাম। সেদিনের পর, বেশ অনেক বছর পর তাঁর দুখণ্ডে লেখা বই ‘স্বাধীনতা ’৭১’ হাতে এলো। কলকাতার ‘দে’জ’ প্রকাশন সংস্থা বের করেছে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়লাম সেই বই। দুয়েকটি অনুষ্ঠানে এই মহান বীরের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। এত সুন্দর করে তিনি আমার সঙ্গে কথা বলেন। ভাবতে ভালো লাগে, গৌরববোধ করি। কাদের সিদ্দিকীর ছোটবোন আমার বন্ধু।

    সেই বন্ধুকে প্রথম চিনিয়েছিল রহমান।

    কাদের সিদ্দিকীর ছোটবোন শুনে আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। সরাসরি তাকানো যাবে তো এই মেয়ের দিকে? রেগে যাবে না তো? ভাইয়ের কাছে গিয়ে বিচার দেবে না তো?

    শুশুর দিকে আমি খুবই সমীহের চোখে তাকিয়েছিলাম।

    চাঁদের হাটের দিনগুলোতে শুশুর সঙ্গে আমার তেমন দেখা হয়নি। দু চার বার যাও দেখা হয়েছে তেমন কথাবার্তা হয়নি। দেখেছি শুশু তুমুল আড্ডা দেয় বন্ধুদের সঙ্গে। হৈ হল্লা হাসি আনন্দে মেতে থাকা অতি প্রাণবন্ত মেয়ে। খুবই ঠাট্টাপ্রিয়, শুশুর রসবোধ তীব্র।

    শুশুর সঙ্গে বহু বহু বছর পর দেখা হলো চ্যানেল আইতে, সাগরের রুমে। শুশুর চেহারা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। সাগর বলল, দেখো তো চেন কি না!

    চিনতে পারিনি।

    সেই কিশোর বয়সের মতো শুশু আমার বাহুর কাছে একটা ধাক্কা দিল। বড় লেখক হয়ে গেছ! বন্ধুদের চিনতে পারো না। আমি শুশু।

    শুশুর এই আচরণে আমি মুহূর্তে ফিরে গেলাম তিয়াত্তর সালের সেই দিনে।

    আহা রে! কত কতগুলো দিন চলে গেছে আমাদের জীবন থেকে। সেই দিনকার বন্ধুদের মুখ দেখলে দিনগুলো ফিরে পাই।

    শুশুকে পেয়ে সাগর খুব উচ্ছ্বসিত। তৃতীয় মাত্রার জিল্লুরকে বলল, শুশু আর মিলনকে তৃতীয় মাত্রায় আনো। ওরা বন্ধুত্ব ইত্যাদি নিয়ে কথা বলবে, দুজনেই প্রবাসে জীবন কাটিয়েছে, প্রবাস জীবন নিয়ে কথা বলবে।

    মিডিলইস্টের অনেক দেশ ঘুরে শুশু এখন কানাডায় সেটেলড। আর আমি বহু বছর আগে দুবছর জার্মানিতে ছিলাম।

    আমরা দুই বন্ধু তারপর তৃতীয় মাত্রায় হাজির হলাম। শুশু কথা বলতে শুরু করল। শুশুর কথাবার্তা শুনে আমি মুগ্ধ। কী সুন্দর উচ্চারণ, কী সুন্দর বাচনভঙ্গি, কী সুন্দর যুক্তি দিয়ে কথা বলে।

    আমি শুশুর কাছে ম্লান হয়ে গেলাম।

    আরে শুশু এত সুন্দর করে কথা বলতে শিখল কবে? কোথাও কোনও জড়তা নেই, কোনও দ্বিধা নেই। যা বিশ্বাস করে তাই স্পষ্ট উচ্চারণে বলে!

    সাগর বলল, মিডিলইস্টে থাকার সময় শুশু নিয়মিত রেডিও প্রোগ্রাম করত।

    শুনে এত ভালো লাগল। তার মানে আমার বন্ধুরা যে যেখানে আছে সেটুকু জায়গা আলোকিত করেই আছে!

    শুশু তিয়াত্তর সালের সেই দিনটির কথা কি তোমার মনে আছে? আমার একদম পরিষ্কার মনে আছে। ওই একটি দিনেই জীবনের অনেক বন্ধুকে আমি একত্রে পেয়েছিলাম। আমার জীবনের সবচাইতে বড় অর্জনের দিন সেটি।

    ‘তৃতীয় মাত্রা’ নিয়ে আর একটা মজার স্মৃতি আছে। রবীন্দ্র জন্মদিবস। সাগর প্ল্যান করল আমরা তিন বন্ধু মিলে অনুষ্ঠান করব। সাগর উপস্থাপক, আমি আর আফজাল আলোচক। যথাসময়ে সেটে হাজির আমরা। সাগর মাঝখানে আমি আর আফজাল দুইপাশে। সাগর শুরু করল মজাদার এক চমক দিয়ে। ‘আমরা তিন বন্ধু আজ একত্রিত হয়েছি আমাদের আরেকজন বন্ধু সম্পর্কে কথা বলার জন্য। প্রিয়দর্শক, আমাদের সেই বন্ধুর নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’।

    আমি আর আফজাল চমকিত।

    আবার ফিরি উনিশশ’ তিয়াত্তরের সেই দিনে।

    অনুষ্ঠান শুরুর সময় ঘনিয়ে আসছে। কখন কোন ফাঁকে ভরে গেছে হল। এই ভিড়ের একপাশে দাঁড়িয়ে টেবিলের ওপর পোস্টার পেপার ফেলে খুবই মনোযোগ দিয়ে কী কী লিখছে এক যুবক। লম্বা টিং টিংয়ে। খয়েরি রংয়ের প্যান্টের ওপর গেরুয়া খদ্দরের পাঞ্জাবি পরা। দেখে মনে হচ্ছে একটি বাঁশের গায়ে প্যান্ট পাঞ্জাবি পরানো হয়েছে। যুবকের মাথার চুল ঘাড় ছাড়িয়ে নেমেছে। গায়ের রং মাজা মাজা। মুখের প্যাটার্ন রেডইন্ডিয়ানদের মতো। চোখ দুটো বড় বড়। চোখে এক ধরনের নিরীহ এবং কৌতূহলী দৃষ্টি।

    রহমান আমাকে সেই যুবকের কাছে নিয়ে গেল। পরিচয় করিয়ে দিল। আজকের বিখ্যাত আফজাল হোসেনের সঙ্গে এই আমার পরিচয়। সাতক্ষীরার ছেলে। আমার দুবছরের সিনিয়র। আর্ট কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র। তখন কে জানত এই নরম নিরীহ যুবকটি শিল্পের যে শাখায় হাত দেবে সেখানেই সোনা ফলবে! তার একার আলোয় অনেকখানি আলোকিত হবে আমাদের সময়।

    চাঁদের হাটের সেদিনকার সেই অনুষ্ঠানে তখনকার পাঁচজন বিখ্যাত তরুণ লেখককে দেখলাম। আলী ইমাম, সালেহ আহমেদ, সিরাজুল ইসলাম, মুনা মালতি এবং ফিউরি খোন্দকার। সালেহ আহমেদ শুধুই ছোটদের লেখা লেখেন। চাঁদের হাট, কচিকাঁচার মেলা, সাতভাই চম্পা, এসব পাতায় তো তাঁর লেখাই বেরোয়ই, এখলাসউদ্দিন আহমেদ সম্পাদিত ‘টাপুর টুপুর’ পত্রিকাতেও বেরোয়। রহমানকে দেখলাম লেখক হিসেবে খুবই সমীহ করে তাঁকে।

    সালেহ আহমেদ বক্তৃতা করলেন। সাহিত্য নিয়ে ভালো ভালো কথা বললেন। তারপর বক্তৃতা দিল সিরাজুল ইসলাম। সিরাজ তখন বড়দের গল্পও লেখে। দৈনিক বাংলার সাহিত্য সম্পাদক কবি আহসান হাবীব সিরাজের লেখা খুবই পছন্দ করেন। সিরাজ তখন বুয়েটের ছাত্র। ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে। পুরনো ঢাকার বেগমগঞ্জের ছেলে। আমাদের গেণ্ডারিয়ার কাছে বেগমগঞ্জ। গেণ্ডারিয়া এবং বেগমগঞ্জের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে ধোলাইখাল। সিরাজ ছোটখাটো মানুষ, রহমান আকৃতির। অতি রোগা। পরনে ঢলঢলে শার্টপ্যান্ট, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, চোখে মোটা কাচের চশমা। কথা খুবই কম বলে, হাসে বেশি। ঘন ঘন সিগ্রেট খায়।

    সিরাজের সঙ্গে পরে গভীর বন্ধুত্ব হয় আমার।

    জীবনের অনেকগুলো বছর প্রতিটা দিন আমার সিরাজের সঙ্গে কেটেছে। চাঁদের হাটের বাইরে আমাদের পাঁচ বন্ধুর একটা দল হয়েছিল। কাজী হাসান হাবিব, সিরাজুল ইসলাম, মুহম্মদ জুবায়ের, ফিরোজ সারোয়ার এবং আমি। কী যে উন্মাদনার দিন আমাদের তখন। প্রতিদিনই পাঁচজন একসঙ্গে হচ্ছি। তুমুল আড্ডা, হৈ চৈ। একত্রে রাত্রিযাপন। আমাদের মধ্যে তখন শুধুমাত্র হাবিবই বিবাহিত।

    তেরো বছর আগে হাবিব আমাদের দলটা ভেঙে দিল।

    চার বন্ধুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিল হাবিব। সিরাজ আমি জুবায়ের সারোয়ার চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছিলাম হাবিবকে। হাবিব কোনও কিছুই তোয়াক্কা করল না, চারজনের মাঝখান থেকে উধাও হয়ে গেল। হাবিবকে আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিল ক্যান্সার।

    হাবিবের কথা ভাবলেই ছেলেবেলার একটা খেলার কথা মনে পড়ে আমার। পাঁচজনের খেলা। হাতে হাত ধরে চারজন ঘেরাও করে রাখবে একজনকে। চারজনেরই চোখ বন্ধ থাকবে। মাঝখানের খেলোয়াড় এই চারজনের ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে যাবে। এমন ভাবে বেরুবে, কারও গায়ে ছোঁয়া লাগতে পারবে না। কেউ টের পাবে না কোনদিক দিয়ে বেরিয়েছে। তারপর সে প্রশ্ন করবে, বলো তো আমি কোনদিক দিয়ে বেরিয়েছি? যার উত্তর সঠিক হবে সে জিতবে খেলায়।

    হাবিব ছিল আমাদের চারজনের মাঝখানকার সেই খেলোয়াড়।

    হাবিব বেঁচে থাকতেই জুবায়ের চলে গিয়েছিল আমেরিকায়। স্ত্রী শাহিন, দুই সন্তান ডোরা এবং অর্নবকে নিয়ে তার সংসার। ডালাসের এলেন এলাকায় সুন্দর বাড়ি জুবায়েরের। বছর পাঁচেক আগে জুবায়েরের কাছে গিয়ে আমি দশদিন ছিলাম। কী যে আনন্দের দিন সেসব, কী যে ভালোবাসার দিন।

    জুবায়েরের ছেলে অর্নব তখন বেশ ছোট। তার একমাত্র নেশা ডাইনোসর। যত রকমের পুতুল ডাইনোসর পাওয়া যায় সব তার আছে। অর্নবের এইম ইন লাইফ হচ্ছে, বড় হয়ে সে ডাইনোসর হবে।

    ফিউরি খোন্দকার তখন দুহাতে লেখে। ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্র। যেমন ছোটদের গল্প, তেমন বড়দের গল্প। সাহিত্য মহলে ফিউরি তখন বেশ পরিচিত। সিরাজের সঙ্গে তার স্বভাবের খুব মিল। সেও কথা বলে কম, হাসে বেশি। ফিউরির হাসি একটু লাজুক টাইপের, মিষ্টি। কথা বলতে গিয়ে সামান্য তোতলায়।

    এইসব লেখককে দাদুভাই সেদিন হাজির করেছিলেন আমাদের মতো যারা লেখালেখিতে আগ্রহী তাদেরকে উৎসাহিত করার জন্য। সাহিত্য নিয়ে তাঁদের চিন্তা ভাবনা, তাঁদের পড়াশোনা কিংবা কীভাবে লেখালেখি করেন তাঁরা, তাঁদের মুখ থেকে এসব শোনাবার জন্য।

    পাঁচজনের একজন মুনা মালতি। অসাধারণ সুন্দরী। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ফিজিক্সে পড়ে। ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র। ছোটদের লেখায় চমৎকার হাত। রেডিও টেলিভিশনে প্রোগ্রাম করে। এত সুন্দর করে কথা বলল! মুনা কথা বলবার সময় কোথাও কোনও শব্দ ছিল না। পিন পড়লে শব্দ হবে না, এমন নিঃশব্দ।

    মুনার সঙ্গে সেদিনই রহমান আমার পরিচয় করিয়ে দিল। কিন্তু মুনা আমাকে তেমন পাত্তা দিল না। পাত্তা দেয়ার কোনও কারণও নেই। আমি তখন কে? অবশ্য সুন্দরী মেয়েদের একটা ভাবও থাকে। পরিচয়ের মুহূর্তে অনেকের দিকেই তারা এমন করে তাকায়, যেন খুবই দয়া করে তাকাচ্ছে।

    মুনার সেদিনকার তাকানো অনেকটাই ওরকম।

    ডালাসে গিয়েছি ফোবানা সম্মেলনে। ওই যে জুবায়েরের ওখানে যেবার দশদিন থাকলাম, সেবারের কথা। মুনা মালতির সঙ্গে দেখা হলো। সে আমেরিকাতেই থাকে। কোন স্টেটে থাকে মনে করতে পারছি না। আমেরিকার কোনো এক ইউনিভার্সিটির টিচার মুনা। মাইক্রোটেল ইন নামে এক হোটেলে উঠেছে। আমিও সেই হোটেলেই উঠেছি। পরে জুবায়ের আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে যায়। ওই হোটেল লাউঞ্জে বসে এক দুপুরে মুনার সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়েছিলাম। প্রথম দিন মুনাকে দেখার স্মৃতিচারণ করলাম। মুনা যে আমার দিকে তাকায়নি বা পাত্তা দেয়নি, শুনে মুনা এত হাসলো!

    বন্ধুদের মিষ্টি হাসির রেশ সবসময় আমার কানে লেগে থাকে। মুনার হাসির রেশও লেগে আছে।

    যে মানুষটি আমাকে সেদিন সবচাইতে বেশি মুগ্ধ করেছিল তাঁর নাম আলী ইমাম। এত সুন্দর বক্তৃতা সেদিন দিলেন আলী ইমাম। শুধু আমাকে কেন, সবাইকে মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেললেন। আলী ইমাম লেখেন ভালো, তখন থেকেই ছোটদের খুবই প্রিয় লেখক তিনি। লেখা পড়ে আমিও তাঁর ভক্ত। সেদিন কথা শুনেও ভক্ত হয়ে গেলাম। যে মানুষ এত সুন্দর লেখেন সেই মানুষ এত সুন্দর কথাও বলেন!

    বক্তৃতা শেষ করে বসতে পারেন না আলী ইমাম, ছেলেমেয়েরা ঝাঁপিয়ে পড়ল অটোগ্রাফের জন্য।

    সেই প্রথম একজন লেখককে অটোগ্রাফ দিতে দেখলাম আমি।

    আলী ইমামের ডাকনাম হেলাল। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি আমার হেলাল ভাই হয়ে গেলেন। এখনও আমি তাঁকে হেলাল ভাই বলেই ডাকি।

    ঠাঁটারি বাজারে হেলাল ভাইদের বাড়ি। অন্য একটি দিক দিয়েও তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হলো। আমার বাবা চাকরি করতেন ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটিতে। বাবা মারা গেছেন একাত্তর সালে। বাবাকে খুবই ভালো চিনতেন হেলাল ভাইয়ের বাবা। কারণ তিনিও মিউনিসিপ্যালিটিতে চাকরি করেন। বাবার জায়গায় চাকরি হয়েছে আমার বড়ভাইয়ের। হেলাল ভাইয়ের বাবা আমার বড়ভাইকেও চেনেন।

    আমার সঙ্গেও একদিন পরিচয় হয়ে গেল।

    শেকড়ের টান মীর সাব্বির

    আমি এ লেখাটা যখন লিখতে শুরু করি তখন একটা নাটকে অন্ধের চরিত্রে অভিনয় করছিলাম। জীবনে প্রথম এই ধরনের চরিত্রে অভিনয় করছি। অন্ধ মানুষ কেমন হয় আমি জানি না। তারা কীভাবে কথা বলে, কীভাবে অনুভূতিগুলো শেয়ার করে কোনো ধারণাই আমার ছিল না। কিন্তু দীর্ঘসময় চোখ বন্ধ করে শুধু ফিল করার চেষ্টা করেছি। আমি দেখলাম সবকিছুই কেমন অন্ধকার আর সেই অন্ধকারের মাঝেই কেমন অদ্ভুত চিকচিক করছে আলো। আমি চোখ খুলে ফেলি। পাঁচ মিনিট অন্ধকার সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই। মনে মনে ভাবলাম, অন্ধকার আসলে কী? অন্ধকারেই কী আলো থাকে? বিশ্বাস থেকে একটা জায়গায় নিজেকে স্থির করলাম সেটা হলো ‘চেনা পৃথিবীতে অচেনা মানুষ আমি’।

    যখন আমার চোখ বন্ধ হয় সব অচেনা লাগে যখন আমার চোখ খুলে যায় সব চেনা মানুষদের ভিড়। হঠাৎ ভাবলাম তাহলে মৃত্যুর পর মানুষ কোথায় যায়? যারা নেই পৃথিবীতে তাদের সাথে যদি ৫ মিনিট কথা বলতে পারতাম? আচ্ছা এমন কী হয় না যদি সৃষ্টিকর্তা মৃত্যুর ১ দিন পর ৫ মিনিট অথবা ১০ মিনিট সময় দিতেন তাহলে কত মজা হতো? সব মানুষগুলোকে কত রকমভাবে দেখা যেত। মৃত্যুর পর কে খুশি হলো কিংবা কে কষ্ট পেল অথবা মৃত্যুর কারণে কারো কিছু কী আসল? কী গেল? জানি না। কত কিছু দেখা যেত? চেনা পৃথিবীতে আবার কিছু অচেনা মানুষকে সুন্দরভাবে দেখা যেত তাই না?

    আচ্ছা এই প্রশ্ন যে করছি আমি, কাকে করছি? সত্যিই কাকে করলাম? নিজেই নিজের প্রশ্নকর্তা আবার নিজেই উত্তরদাতা। মনে হচ্ছে আমি কোনো এক স্কুলের শিক্ষানবিশ শিক্ষক। শিক্ষকের কথাই যখন এলো তাহলে একটা ঘটনা বলি- আমি যে স্কুলে ছোটবেলায় পড়াশোনা করেছি হঠাৎ করেই সেই স্কুলে বেড়াতে গেলাম। বরগুনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। স্কুলের বর্তমান প্রধান শিক্ষিকা রাজিয়া আপা তিনি আমাকে দেখে আবেগ আপ্লুত হয়ে গেলেন। আমরা ছোটবেলায় দেখতাম বিভাগীয় কমিশনার কিংবা ডিসি সাহেব শিক্ষকদের নিয়ে যেভাবে রুমে রুমে ঘুরতেন, প্রশ্ন করতেন ঠিক সেভাবে রাজিয়া আপা আমাকে নিয়ে প্রতিটি ক্লাসে ঘুরলেন কিন্তু রাজিয়া আপাকে কেউ মানছে না। সবাই চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিল। সব ক্লাসের ছাত্রছাত্রীরা এক হয়ে হলরুমে গেল, কারণ বিভাগীয় কমিশনারদের মতো ঘোরার কোনো উপায় আমার নেই। কী আর করা। রাজিয়া আপা আমার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে আর আমি মনে মনে ভাবছি আপা কত যে কাঠের স্কেলের মার আমাকে দিয়েছেন বৃত্তি পরীক্ষার আগে। আপার প্রতিটি স্কেলের মার এক একটা আশীর্বাদ হয়ে ধরা দিয়েছিল যখন ক্লাস ফাইভে আমি বৃত্তি পেলাম। সব কৃতিত্ব রাজিয়া আপার। এখন আমি সেই আপার পাশে দাঁড়িয়ে। আমার চেনা সেই স্কুলের হলরুমের ভেতর কয়েকশ ছাত্রছাত্রীর সামনে দাঁড়িয়ে আমি কত কিছু ভাবনার ভেতর চলে গেলাম। আমার কানে ভাসছে বাচ্চাদের চিৎকার চেঁচামেচি, শোরগোলের শব্দ আর মনে ভাসছে এই স্কুলে আসার প্রথমদিনের রাস্তার কথা। স্কুলের সামনে সেই দোকানটার কথা যেখানে আটআনা দিয়ে চৌকা বিস্কুট খেতাম, স্কুলের পেছনে ছোট রাস্তার কথা, যেখান থেকে অনেকদিন স্কুল ফাঁকি দিয়েছিলাম। সেই জায়গাগুলো নেই ঠিক সেইমতো কিন্তু স্মৃতিগুলো সবই আছে। স্মৃতি ভেঙে গেল একজনের প্রশ্নে আচ্ছা আপনি অভিনয়ে ঢুকলেন কীভাবে? আমি বললাম লঞ্চে করে সোজা ঢাকা গেলাম তারপর স্কুটারে করে গেলাম বিটিভিতে। তারপর কত মানুষের সঙ্গে পরিচয়। কত মানুষের ভিড়, কত পরিচালক, প্রযোজক, নায়ক, নায়িকা। আস্তে আস্তে এরাই সবাই আমার কেমন যেন আপন হয়ে গেল। কিন্তু স্কুলের সেই মানুষগুলো, রাস্তাঘাটগুলো, সবাই কেমন যেন অচেনা হয়ে গেল। জীবন কী এরকমই? একদল মানুষ হারিয়ে যায় আর আরেকদল মানুষ আপন হয়। কিন্তু সবকিছু কী হারিয়ে যায়?

    প্রথম যেদিন প্লেনে উঠলাম সেদিনও মনে হলো আমার বোধহয় শেষ। একবার যদি পাখায় আগুন লাগে তাহলে কী হবে? আমার আব্বা, আম্মু, ভাইবোন কারও সাথে কোনো কথা হলো না। কিন্তু ভাগ্য ভালো কিছুই হয়নি।

    প্লেনে বসে যখন জানালা দিয়ে তাকালাম দেখি সাদা মেঘের ভেলা। কী অদ্ভুত কী সুন্দর সে দৃশ্য। মনে হতে লাগল একটু লাফ দিয়ে জায়গাটা যদি দেখে আসতে পারতাম? কিন্তু পারলাম না। মনে মনে ভাবি পাখি হলেই বোধহয় ভালো হতো। উড়ে উড়ে ভেসে যেতাম মেঘের দেশে। একটু সময় থেকে আবার চলে আসতাম নিজের বাড়িতে।

    আমার শৈশব-কৈশোর সব কেটেছে বরগুনাতে। আমি প্রায়ই সেখানে যাই। খুব বেশি ঘোরাঘুরি করি না। কিছু বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দেই আর বিকেল হলে নদীর পাড়ে ঘুরতে যাই। আমার ভীষণ ভালো লাগে। ছয় বছরের বিবাহিত জীবনে আমার বউকে নিয়ে দু’বার গিয়েছি বিয়ের পর। আর বউ ছাড়া তিনবার। আমাকে আমার বউ জিজ্ঞেস করে আচ্ছা এই যে বরগুনাতে যাও বাবা, মা, ভাইবোন কেউ থাকে না। একা গিয়ে কী মজা পাও? আমি মুচকি হাসি দিয়ে চলে যাই, উত্তর দেই না। মনে মনে বলি ‘শেকড় বড় মারাত্মক’। এর টানে সব ভুলে যাই। আমি শিকড়ের টানে বরগুনাতে যাই। আমার বাচ্চা হবার পর এখনো ওকে নিয়ে যেতে পারিনি। আমি না যেতে পারলেও আমার বাচ্চা একদিন ঠিকই যাবে। কারণ শেকড় বড় বিস্ময়কর মায়া। আমি ঘ্রাণ নেই আমার হেঁটে যাওয়া সব রাস্তার ঘাসের উপর আমি মজা করে দেখি আমার প্রিয় সব জায়গাগুলো। বাতাসের কি অদ্ভুত চেনা ঘ্রাণ আমি পাই। সে ঘ্রাণ অনেক দামি ফরাসি পারফিউম-এ আমি পাই না। আমার বউকে এ কথাটি কে বোঝাবে বলুন? শুধু একটি কথা বলেছি- তোমার গ্রামে যখন যাও কেমন লাগে? একটু চোরা দৃষ্টি দিয়ে বলে ভালোই। আমার প্রশ্নের উত্তর আমি পেয়ে যাই।

    একবার শমী কায়সার বরগুনাতে বেড়াতে গেলেন। খেলাঘর আসরের সম্মেলন উপলক্ষে। সম্ভবত ৮৯/৯০-এর দিকে। ‘যত দূরে যাই’ খ্যাত শমী কায়সার বরগুনাতে আসবেন, এক ধরনের উৎসব আমেজ। উনি লঞ্চে করে আসছেন। আমরা বিকেল ৩টা থেকে অপেক্ষা করছি শমী কায়সারকে দেখব বলে। দীর্ঘ লাইন হলো। পান্না কায়সার এবং শমী কায়সারকে ফুল ছেটানোর জন্য। আমি অনেক গাঁদা ফুলের পাপড়ি হাতের মুঠোয় নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। যাই হোক তারা পৌঁছানোর পর শমী কায়সারের ভক্তকুল তাকে একনজর দেখার জন্য পাগল হয়ে গেল। তাকে উৎসুক জনতার মাঝখান থেকে আমিও উঁকি দিয়ে দেখতে লাগলাম। তারা বরগুনাতে ২ দিন ছিলেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিলেন। ঘুরলেন ফিরলেন এবং অবশেষে ঢাকায় ফিরে গেলেন।

    কিন্তু আমার মনে শমী কায়সার হয়ে রইলেন স্বপ্নের দেবী। উনি চলে আসার পর আমি শয়নে-স্বপনে শমী কায়সারকে দেখি। তার ভিউকার্ড জোগাড় করি, তার নাটক থাকলে সন্ধ্যার পড়াশোনা বন্ধ করি। মোটামুটি উন্মাদ হয়ে গেলাম। খেলাঘরের সেক্রেটারি চিত্তদার কাছ থেকে পান্না কায়সারের বাসার ঠিকানা জোগাড় করলাম। তারপর যেটা করলাম সেটা একেবারেই সিনেমা। চার পাতার একটি চিঠি লিখলাম শমী কায়সারকে। শুরুটা ছিল এমন-

    শ্রদ্ধেয় শমী আপু, পত্রে আমার সালাম নিবেন। আশাকরি আম্মুকে নিয়ে ভালোই আছেন। আমার নাম সাব্বির। ঐ যে টাউন হলের নিচে সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে কথা হয়েছিল। আমার গায়ে নীল রঙের শার্ট পরা ছিল। আপনি বলছিলেন ঢাকায় এসে যোগাযোগ করতে…

    শেষটা যতদূর মনে পড়ে…

    আপু আমি আপনার ছোট ভাই। যদি আমাকে আপনি ছোটভাই হিসেবে গ্রহণ করেন তাহলে ১ পাতার একটা চিঠির উত্তর দিয়েন। আমি সারাজীবন আপনার কথা মনে রাখব। আমি আপনার উত্তরের আশায় আগামী তিনদিন পর থেকে পোস্ট অফিসে যোগাযোগ করতে শুরু করব। ইতি আপনার প্রাণপ্রিয় ছোটভাই খেলাঘরের বন্ধু সাব্বির।

    এরপর থেকে স্কুলে যাওয়া আসার পথে আমাদের পোস্ট অফিসে পোস্টমাস্টার কালাম ভাইকে বললাম ঢাকা থেকে শমী কায়সারের চিঠি আসবে। আমি বাসায় না থাকলে আপনার কাছে রেখে দিয়েন। বাসার মুরব্বিদের কাছে আবার দিয়েন না, একটু সমস্যা আছে। কালাম ভাই বলল ঠিক আছে। দিন যায় মাস যায় বছর যায় ইস্কাটন থেকে কোনো চিঠি আর আসেনি। শমী কায়সার বুকের গহীনেই রয়ে গেল। মাঝে মাঝে এখনও ভাবি শমী কায়সার যদি ২ লাইনের কোনো একটি চিঠিও দিত খুব ভালো লাগত।

    কত চেনা কত কাছের একজন মানুষ শমী কায়সার। কতবার তার সাথে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে কিন্তু কথাগুলো বলা হয়নি। চেনা মানুষ আপন মানুষ অথচ অচেনা কত দূরের। মাঝে মাঝে ভাবি একটা নাটকে যদি একসাথে কাজ করতে পারতাম? তাহলে ২০ বছর পর আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে আনন্দ আলোতে আর একটা লেখা লিখতে পারতাম।

    সবাই বলে জীবন খুব অল্প সময়ের। এই এক জীবনে দেখার কত কী আছে। আবার অনেকে বলে কিছুই দেখতে পারলাম না। কত কিছুই করার ছিল? শুধু পাওয়া আর না পাওয়ার দোলাচল। আমি বাস্তববাদী, আবার অনেকটা স্মৃতিকাতর। চলার পথে কত স্মৃতি যে মাথায় ভোঁ ভোঁ করতে থাকে। ভাবি যেটা মনে পড়বে সেটাই লিখে ফেলব। অনেক উদ্যম, অনেক উৎসাহ নিয়ে ভাবি কিছু একটা করব। কিন্তু কিসের কি? সব ভুলে যাই। জীবন বোধহয় এমনই, ভুলে যাওয়া আবার মনে পড়া।

    যেমন এখন আমার খুব দাদা-দাদীর কথা মনে পড়ছে। আমার বটগাছ ছিল আমার দাদা দাদী। কত মার যে খেয়েছি আমার বাবার। সব দাদা উদ্ধার করত। এমনও হয়েছে দাদা পারলে আমার আব্বাকে মারে। আমার আব্বার অনেক রাগ ছিল। এখন নেই। এখন মাঝে মাঝে আব্বাকে দেখে মনে হয় আমার দাদা। আমার ছেলেকে আমি মারব না কখনও কিন্তু আমার বাবা কেন জানি মনে হয় আমার সন্তানকে সবসময় আগলে রাখবে, উদ্ধার করবে ভালোবাসা দিয়ে। দান প্রতিদানের মতো।

    একবার হঠাৎ ইচ্ছে হলো বাঁশের বাঁশি বাজানো শিখব। সুর যে কীভাবে আমাকে টানে আমি জানি না। অনেক কষ্টে বাশি জোগাড় করলাম। বরগুনার মনোয়ার ভাই, মিঠুদা এদের কাছে বাঁশি বাজানো শিখতে শুরু করলাম। সেকি প্রাণান্ত চেষ্টা। আমার দাদা দেখেছে। কিন্তু আব্বা দেখেনি। কারণ আব্বা বাসায় থাকলে জীবনেও এ চেষ্টা আমি চালাইনি। কারণ বাঁশ আমার পিঠ ভেদ করে সুর হয়ে যেত। রক্তাক্ত সুর। আমার মা ‘নো প্রবলেম’ যত কিছুই করি কোনো কিছুই বলে না। শুধু বলত পড়াশোনাটা ঠিকমতো করো কারণ তাদের আশা আমি অনেক বড় ডাক্তার হব। কেননা আমি সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করি। আমার সায়েন্স যে কী সেটা তো কেবল আমিই জানতাম। সুর, গান, নাটক, কবিতা এই সায়েন্স ছাড়া কোনো কিছুই মাথায় ঢোকে না। আমি প্রতিদিন সকাল বিকাল চান্স পেলেই বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে প্র্যাকটিস চালিয়ে যাচ্ছি। ভাবখানা এমন আমার বাঁশির সুরে অনেক মেয়ে পাগল হয়ে আমার পেছনে ঘুরবে। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো অনেক ইঁদুর আমার পেছনে দৌড়াবে। আমার কত ভাব হবে। যাই হোক আমার দাদা একদিন এমন এক আশীর্বাদ দিলেন আমি ভড়কে গেলাম। দাদা বললেন, ‘তুমি যা বাজাইন্যার চেষ্টা করতে আছো হেইডা না বাজাইয়া চুঙ্গা ফুয়া। তাইলে তোর মার কষ্ট কোমবে। চুলায় ধারে যাইয়া চুঙ্গা ফুয়া।’

    বাঁশি বাজানোর সমস্ত আশা-ভরসা মাটিতে ধূলিস্যাৎ হয়ে গেল। অনেক কষ্টে আমি বাঁশি বাজানোর চেষ্টা কমিয়ে দিলাম। ওভাবে ফুঁ ফা করতাম না কিন্তু লুকিয়ে লুকিয়ে চেষ্টা করতাম।

    আজ আমার দাদা বেঁচে নেই। আমার অভিনয় তিনি দেখেননি। আমার টুকটাক বাঁশি বাজানোও তিনি দেখেননি। দেখতে পারলে আমার আজ অনেক ভালো লাগত। আনন্দে হয়তো চোখ ভিজে যেত। জীবনে প্রথম ঢাকায় যখন আসি বয়স তখন ৬/৭। দাদার হাত ধরেই এসেছিলাম। আরিচা ফেরিতে বসে দাদা আমাকে ৮টা ডিম খাইয়ে ছিলেন। ডাব খেয়েছি ৩/৪টা। যা খেতে চেয়েছি দাদা সব খাইয়েছেন। আরিচা ঘাট পার হলেই দাদার কথা মনে পড়ে। শিশুপার্কের সামনে গেলে দাদাকে মনে পড়ে। আজ আমার দাদা বেঁচে থাকলে তাকে নিয়ে গাড়িতে চড়ে ঘুরতে পারতাম। তার অজানা অনেক জায়গায় আমি নিয়ে যেতে পারতাম। তিনি যা খেতে চাইতেন তাই খাওয়াতাম। আসলে জীবন এটাই- যা ভাবি তা হয় না, যা ভাবি না তাই হয়।

    আমার প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে ঠিক করলাম মালয়েশিয়া যাব। গেলাম মালয়েশিয়া। প্রায় ১৪ দিন আমরা ঘুরব বলে ঠিক করলাম। সময়মতো আমরা গেলাম, অনেক মজা করে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরলাম। কুয়ালালামপুর, বোনাং, লাংকাউ এরকম কয়েকটি জায়গায় আমরা ঘুরলাম। লাংকাউতে আমার অনেক ভালো লাগল কারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এত সুন্দর হতে পারে চোখে না দেখলে বিশ্বাসই হতো না। অনেক বাংলাদেশী মানুষের সাথে দেখা হলো, কথা হলো। আমরা অজানা অচেনা অনেক মানুষের সাথে কথা বললাম। দাওয়াত খেলাম। বিদেশে বসে দেশী মানুষের আতিথেয়তায় মুগ্ধ হলাম আমরা। আমার বউ আমাকে বলল, নাটক করে যে অনেক মানুষের ভালোবাসা পাওয়া যায় সেটা তোমার সাথে ঘুরতে না আসলে বুঝতাম না। অপরিচিত জায়গা অনেক পরিচিত হয়ে গেল দেশী মানুষের সহযোগিতায়। বাসে ঘুরলাম, ট্রেনে ঘুরলাম, কত কম টাকায় যা এই সহযোগিতা ছাড়া হতো না। একদিন আমরা কয়েকটি দ্বীপ ঘোরার জন্য মনস্থির করলাম। ৫ ঘণ্টার ঘোরাঘুরি। প্রতিটি দ্বীপে ঘুরেফিরে বিশ্রাম নিয়ে বেশ মজাতেই দিনটা কাটছিল। সুন্দর একটা দ্বীপে ঘুরছি, তখন চুমকি বলল চলো কোক খাই। দ্বীপের মাঝখানে ছোট্ট একটি দোকান। সবাই ভিড় করে খাবার দাবার কিনছে। আমরাও কোক কিনে যখন দাম দিতে যাব তখন তামিল চেহারার একজন মানুষ যিনি বিক্রি করছিলেন তিনি টাকাটা না নিয়ে ইশারায় বললেন একটা জায়গায় গিয়ে বসতে। একটু অবাকই হলাম। সবাই টাকা দিচ্ছে লোকটি নিচ্ছে কিন্তু আমরা দিলাম আমাদেরটা নিল না। আমরা কি কোনো অপরাধ করলাম?

    কিছুক্ষণ পর লোকটি এলো। অবাক বিস্ময় নিয়ে লোকটির দিকে তাকালাম কারণ লোকটি বাংলায় আমাদেরকে বলল, সাব্বির ভাই কেমন আছেন? আমরা অবাক হলাম, বিস্মিত হলাম কারণ লোকটি অবিকল শ্রীলংকানদের মতো দেখতে। ১০ মিনিটের মাথায় লোকটির সাথে খুব খাতির হলো এবং তিনি বললেন, দেশী মানুষের কাছ থেকে কী করে টাকা নেই বলেন? আপনিতো অতিথি। আমি একটু লজ্জাই পেলাম কারণ লোকটি অনেক বিনয়ী, ভদ্র এবং আবেগপ্রবণ। লোকটিকে বললাম, ভাই দেশে যাবেন কবে? বলল যেতে তো চাই কিন্তু অনেক খরচ। সবাই মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ভাবে আমার তো অনেক টাকা। কিন্তু এই দেশে অনেক খরচ। দেশে ২ মাস অন্তর টাকা পাঠাই। একবার ঘুরতে গেলে অনেক খরচ হয়। ৫ বছর হয় দেশে যাই না। তারপর যে ঘটনাটি ঘটল সেটি একদমই অপ্রত্যাশিত। লোকটি হাউমাউ করে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। বলল, ভাই মাকে খুব মনে পড়ে। কতদিন মাকে দেখি না। আমাকে জড়িয়ে ধরল। তখন আমার চোখ জলে ভিজে উঠল। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। আড়চোখে দেখি চুমকি ওর আইলেশ ঠিক করছে। আমি ভাবি, ও কি আসলে আইলেশ ঠিক করছিল নাকি আমার মতোই চোখের পানি সরিয়ে দিচ্ছিল? প্রশ্নটা কোনোদিন ওকে করিনি।

    লাংকাউয়ের একটা ছোট্ট দ্বীপ সেদিনের সেই স্মৃতি আজও আমাকে ভাবায়। মনে করিয়ে দেয় অজানা অচেনা জায়গায় একজন মানুষের সাথে পরিচয়ের পরও লোকটিকে অচেনা মনে হয়নি। মানুষ পৃথিবীতে সবচেয়ে তাড়াতাড়ি যে কাজটি পারে সেটা হলো ভুলে যেতে। আমিও ভুলে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু পারিনি। কারণ মাকে ভুলে যাওয়া যায় না। অচেনা অনেক মানুষের ভিড়ে একজন মানুষকে ঠিকই চেনা যায়। মাকে চেনা যায়। আমি লেখার শুরুতে বলেছিলাম মৃত্যুর ১ দিন পর যদি বিধাতা ৫ মিনিট সময় দিত তাহলে কত মজা হতো? আমি মজা করতে চাই না আমি ৫ মিনিট কথা বলতে চাই। আমার মায়ের সাথে কথা বলতে চাই।

    কত জায়গায় যাই, কত মানুষের সাথে মিশি, কত যে দৃশ্য চোখে ভাসে, রাতে ঘুমাতে যাবার আগে ভাবি কাল সকালে আর যদি উঠতে না পারি আমার চাওয়াটা কী সত্যি হবে। কত কত মানুষের ভিড়ে নিজেকে আবার হারিয়ে ফেলব না তো? সত্যি এত প্রশ্নের উত্তর আমি খুঁজে পাই না। অচেনা দেশে এক অচেনা মানুষ হয়ে আমি ঘুরে বেড়াই। স্মৃতি আমাকে ভবিষ্যতের পথে হাঁটতে শেখায়। আমার সন্তানের আঙুল ধরে অনেক দূর হেঁটে যেতে চাই মাইলের পর মাইল।

    সন্তানের কথাই যখন এলো আরেকটি ঘটনা বলি- আমার সন্তানের জন্মদিন ১১ নভেম্বর ২০০৬। তখন দেশের পরিস্থিতি ভয়াবহ। চারিদিকে মিছিল-মিটিং, হরতাল, অবরোধ কত কী। অবরোধের মধ্যেই পৃথিবীতে এলো আমার সন্তান। আমার বাবা-মা চুমকির মা, ভাইবোন সবাই হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে। আমিও সেদিন প্রচণ্ড পেটের ব্যথা নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছি। আমার অ্যাপেন্ডিসের ব্যথা। পরে অপারেশন হয়েছিল। লাক্স-চ্যানেল আই-র দুবাই যাওয়ার কথা সেটাও হলো না। ঈশিতার সাথে একটা নাচের রিহার্সেলও করেছিলাম। ঈশিতা খুব মন খারাপ করেছিল। পরে আবার মন ভালো হয়েছিল আমার সন্তান হবার খবর পাবার পর। যাই হোক হাসপাতালে আমি প্রচণ্ড টেনশন নিয়ে, যখন দৌড়াদৌড়ি করছি তখন অপারেশন থিয়েটারের সামনে আমার সমস্ত আত্মীয়-স্বজন অপেক্ষা করছে। কিন্তু আমি ভয়ে সেখানে যাই না। কিসের ভয়, কেন ভয় আমি জানি না। সন্তান পৃথিবীতে আসার আগে বাবাদের কী এই ধরনের ভয় হয়? আমি ঠিক জানি না। আমি ভীত হয়ে দূরে বসে আছি। কিছুক্ষণ পর দূরে শুনলাম, সিস্টার মীর সাব্বিরকে ডাকছে। আমি কাছে যাই না। আমার বড়বোন দীবা আপু চিৎকার করে বলছে- সাব্বির তোর ছেলে হয়েছে, ছেলে হয়েছে। আমি অনেক ভয়ে কেমন যেন কুঁকড়ে গেলাম। সবাই আমার সন্তানকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে গোল হয়ে। একটু পেছনে দু’পা উঁচু করে দাঁড়িয়ে দূর থেকে আমার সন্তানকে দেখতে লাগলাম। তারপর কি পরম ভালো লাগায় সিস্টার আমার সন্তানকে আমার কোলে তুলে দিলেন। বুকের ভেতরে নিয়ে যখন ওকে জড়িয়ে ধরলাম আমার সমস্ত ভয় শেষ হয়ে গেল। দুচোখে অনুভব করলাম কেমন যেন ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে। আমি কি কাঁদছিলাম তখন? জানি না, তবে সাহসী বীর মনে হলো আবার, আমাকে।

    আমার ছেলে আর আমি। যুদ্ধে লড়াই করার জন্য আমরা দুজন আর পৃথিবীর অন্যরা সবাই একসাথে ‘নো প্রবলেম। ’আমি মনে মনে একথা যখন ভাবছি তখন দেখলাম আমার আব্বা আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। আমার সন্তান আমার বুকের মধ্যে, আর পেছনে আমার বাবা। আমার মনে হলো আমি আরও অনেক বেশি শক্তিশালী, অনেক বেশি সাহসী। কারণ আমার সামনে আমার সন্তান, মাঝখানে আমি আর পেছনে আমার বাবা। এর চেয়ে বড় সত্য আর কী হতে পারে? এর চেয়ে বড় সাহস আর কী হতে পারে?

    ‘শেকড়ের টান বড় মারাত্মক,
    শেকড়ের টান বড় ভয়ঙ্কর মায়া।’

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঅন্তরে – ইমদাদুল হক মিলন
    Next Article শুনছ, কোথাও আছো কি কেউ?

    Related Articles

    ইমদাদুল হক মিলন

    অন্তরে – ইমদাদুল হক মিলন

    July 10, 2025
    ইমদাদুল হক মিলন

    এসো – ইমদাদুল হক মিলন

    July 10, 2025
    ইমদাদুল হক মিলন

    প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ – ইমদাদুল হক মিলন

    July 10, 2025
    ইমদাদুল হক মিলন

    গোপনে – ইমদাদুল হক মিলন

    July 10, 2025
    ইমদাদুল হক মিলন

    দুই বাংলার দাম্পত্য কলহের শত কাহিনী – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও ইমদাদুল হক মিলন সম্পাদিত

    July 10, 2025
    ইমদাদুল হক মিলন

    প্রিয় – ইমদাদুল হক মিলন

    July 10, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.