Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ইস্টিশন – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    মুহম্মদ জাফর ইকবাল এক পাতা গল্প155 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ০৪-৬. গোডাউনের পিছনে আবছা অন্ধকার

    জালাল গোডাউনের পিছনে আবছা অন্ধকার জায়গাটায় নিঃশব্দে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে, সে এখানে সবুজকে দেখেছিল। সবুজ এখানে এসেছিল কিছু একটা লুকিয়ে রাখতে-জালালকে দেখে তাই সবুজ এরকম চমকে উঠেছিল। শেষ পর্যন্ত এখানে লুকিয়ে রেখেছে কী না কে জানে কিন্তু জালাল তবুও একটু খুঁজে দেখতে চাইল।

    এখানে লুকিয়ে রাখার জায়গা খুব বেশি নেই। গোডাউনের পুরাননা দেয়ালের ক্ষয়ে যাওয়া ইটের কারণে মাঝে মাঝে কিছু ফাঁক-ফোকর তৈরি হয়েছে, এর ভেতরে ইচ্ছে করলে কিছু একটা লুকিয়ে রাখা যায়। সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ফাঁক ফোকরগুলো দেখল। কোথাও কিছু নেই–শুধু একটা গর্তে খোঁচা দিতেই সেখান থেকে একটা গোবদা মাকড়শা বের হয়ে তির তির করে ছুটে গেল।

    পুরো দেয়ালটা দেখে কিছু না পেয়ে, সে যখন চলে যাচ্ছিল তখন হঠাৎ করে একটা ইটের দিকে তার চোখ পড়ল, অন্য সবগুলো ইট রং ওঠা বিবর্ণ, শ্যাওলায় ঢাকা তার মাঝে এই ইটটা একটু পরিষ্কার। জালাল কাছে গিয়ে ইটটাকে ভালো করে লক্ষ করে, মনে হয় এটাকে পরে এখানে ঢোকানো হয়েছে। সে ইটটা ধরে একটু টানাটানি করতেই সেটা ছুটে এলো, পেছনে দোমড়ানো-মোচড়ানো একটা পাস্টিকের প্যাকেট। জালাল প্যাকেটটাকে টেনে আনে, এর ভেতরে খানিকটা সাদা পাউডার–ঠিক যেরকম সে ভেবেছিল।

    জালাল কিছুক্ষণ প্লাস্টিকের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে এদিক-সেদিক তাকাল, কেউ তাকে এখানে এটা হাতে দেখলে অনেক বড় বিপদ হয়ে যাবে, তাই সে প্যাকেটটাকে তাড়াতাড়ি শার্টের নিচে প্যান্টের ভাঁজে খুঁজে ফেলল, তারপর ইটটা আগের জায়গায় বসিয়ে গোডাউনের পিছনের নির্জন জায়গাটা থেকে বের হয়ে আসে।

    .

    পাটফর্মে তার মজিদের সাথে দেখা হল, সে খুব মনোযোগ দিয়ে এক টুকরো আখ চিবাচ্ছিল, জালালকে দেখে বলল, “খাবি?”

    ঠিক কী কারণ জানা নেই, লাশকাটা ঘরের ঘটনার পর থেকে সবাই তাকে একটু অন্য চোখে দেখে।

    জালাল অন্যমনস্কভাবে মাথা নেড়ে এগিয়ে যায়। একটু এগুতেই মায়ার সাথে দেখা হল, মায়া চোখ বড় বড় করে বলল, “একটা স্যার আমারে দশ টেহা দিছে!” সে উত্তেজিত ভঙ্গিতে তাকে নোটটা দেখাল, নোটটা দশ টাকার নয়–পাঁচ টাকার, তারপরেও জালাল মায়াকে এটা শুদ্ধ করে দিতে ভুলে গেল।

    জালাল প্লাটফর্মের একেবারে শেষ মাথায় গিয়ে রেলিঙে পা ঝুলিয়ে বসে। তার শার্টের নিচে প্যান্টের ভঁজে সে যে প্লাস্টিকের প্যাকেটটা খুঁজে রেখেছে সেখানে নিশ্চয়ই কয়েক লক্ষ টাকার হেরোইন-ব্যাপারটা চিন্তা করেই তার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। তার চারপাশে কতো মানুষ হাঁটাহাঁটি করছে কেউ একবারও নিশ্চয়ই অনুমানও করতে পারবে না যে তার মতো একজন মানুষের কাছে এরকম লক্ষ টাকার মূল্যবান একটা জিনিস থাকতে পারে। এটার জন্যে সবুজকে মরতে হয়েছে–তাই এটা শুধু যে দামি তা নয় এটা মনে হয় একই সাথে খুব ভয়ংকর একটা জিনিস।

    সে এটা নিয়ে এখন কী করবে? কাগজের মতোন ফর্সা মানুষটার কাছে গিয়ে সে যদি বলে, “আপনারা যে জিনিসটা খুঁজছেন সেটা আমার কাছে আছে। সেটা যদি আপনাদেরকে দেই তা হলে আপনি কত টাকা দিবেন?” জিনিসটার দাম যদি কয়েক লক্ষ টাকা হয় তা হলে তারা তো চোখ বন্ধ করে তাকে কয়েক হাজার টাকা দিতে পারে। কতদিন থেকে সে টাকা জমানোর চেষ্টা করছে–একটু একটু করে সে টাকা জমাচ্ছে, এখন ইচ্ছে করলে একসাথে তার হাজার হাজার টাকা হয়ে যাবে।

    উত্তেজনায় জালালের হাত অল্প অল্প কাঁপতে থাকে। বেশ খানিকক্ষণ পর অনেক কষ্ট করে সে নিজেকে শান্ত করল, তারপর সে উঠে দাঁড়াল, এক ব্যাগ হেরোইন নিয়ে সে কী করবে শেষ পর্যন্ত চিন্তা করে বের করেছে।

    সবুজের সাথে রেললাইন ধরে হেঁটে হেঁটে সে যে কালভার্টে গিয়েছিল আজকে সে একা একা সেই কালভার্টের দিকে যেতে থাকে। সেদিন দুজন মিলে কথা বলতে বলতে গিয়েছিল, পথটাকে খুব বেশি দূর মনে হয়নি। আজকে মনে হল জায়গাটা অনেক দূর।

    কালভার্টের উপর দাঁড়িয়ে জালাল এদিক-সেদিক তাকাল, আশেপাশে কেউ নেই, কেউ তাকে লক্ষ করছে না। তখন সে তার প্যান্টের ভঁজে গুঁজে রাখা হেরোইনের প্যাকেটটা বের করল, তারপর সেটা খুলে পুরো হেরোইনটুকু কালভার্টের নিচের ময়লা পানিতে ফেলে দিতে থাকে। বাতাসে হেরোইন উড়ে যায় আশেপাশে মাটিতে ঘাসেও কিছু ছড়িয়ে পড়ে। জালালের নিজেরও বিশ্বাস হয় না সে এইরকম মূল্যবান একটা জিনিস নর্দমায় পানির মাঝে ফেলে দিতে পারে।

    পুরো হেরোইনটা পানিতে ফেলে দেবার পর সে প্লাস্টিকের ব্যাগটাও পানিতে ছুঁড়ে দিল। যতক্ষণ পর্যন্ত না প্যাকেটটা ভাসতে ভাসতে অদৃশ্য হয়ে গেল জালাল কালভার্ট থেকে নড়ল না।

    .

    জালাল যখন প্লাটফর্মে ফিরে এসেছে তখন মজিদ একটা আমড়া খাচ্ছে। জালালকে দেখে বলল, “এক কামড় খাবি?”

    জালাল বলল, “দে।” মজিদ আমড়াটা এগিয়ে দেয় জালাল এক কামড় খেয়ে মজিদকে ফিরিয়ে দিতে গিয়ে হঠাৎ একটু হেসে ফেলল। সে একটু আগেই একজন লক্ষপতি ছিল এখন সে আবার হতদরিদ্র ছেলে!

    মজিদ জিজ্ঞেস করল, “হাসিস ক্যান?”

    জালাল বলল, “এমনিই!”

    .

    ০৫.

    ইভা ব্যাগটা পাশে রেখে খবরের কাগজটা খোলে। কোন দিন রাস্তাঘাটে কী রকম ট্রাফিক জ্যাম হবে আগে থেকে অনুমান করা যায় না–তাই যেখানেই যেতে চায় সেখানে একটু আগে না হয় একটু পরে পৌঁছায়। ট্রেন ধরতে হলে একটু পরে পৌঁছানোর কোনো উপায় নেই তাই সে সাধারণত একটু আগেই পৌঁছে যায়। আজকেও সে একটু আগেই পৌঁছে গেছে, স্টেশনটা এখনো মোটামুটি ফাঁকা, প্যাসেঞ্জাররা আসেনি।

    খবরের কাগজের হেড লাইনগুলো পড়া শেষ করার আগেই সে বাচ্চাদের কণ্ঠে আনন্দধ্বনি শুনতে পেল। ছোট-বড় নানা বয়সী ছেলে এবং মেয়ে তার দিকে ছুটে আসছে, তাদের ময়লা কাপড়, খালি পা এবং নোংরা শরীর কিন্তু মুখগুলো আনন্দে ঝলমল করছে। ”দুই টেকি আপা দুই টেকি আপা” বলে চিৎকার করতে করতে তারা ইভাকে ঘিরে ফেলল।

    ইভা হাসি হাসি মুখ করে বলল, “কী খবর তোমাদের?”

    সাথে সাথে সবার মুখ শক্ত হয়ে যায়, মায়া সবার আগে বলল, “সবুজ ভাইরে মাইরা ফালাইছে।”

    অন্যেরাও তখন সবুজকে মেরে ফেলার ঘটনাটা নিজের মতো করে বলতে থাকে। সবাই কথা বলছে, একজন থেকে আরেকজন বেশি উত্তেজিত। ইভা কাউকেই বাধা দিল না। সে স্থানীয় পত্রিকায় ঘটনাটার কথা পড়েছে আর সাথে সাথে এই বাচ্চাগুলোর কথা মনে পড়েছে। ছোট বাচ্চাদের সাধারণত এরকম ভয়ানক ঘটনার মুখোমুখি হতে হয় না–মাঝখানে বড়রা থাকে। তারা ছোটদের আড়াল করে রাখে। কিন্তু এই বাচ্চাদেরকে আড়াল করে রাখার কেউ নেই। ইভা অবশ্যি বেশ অবাক হয়ে আবিষ্কার করল বাচ্চাগুলো নিজেরাই বেশ সামলে উঠেছে। পথে-ঘাটে থাকতে হয় বলে এই বাচ্চাগুলোরা মনে হয় অনেক তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যায়।

    সবুজের গল্প শেষ হতে অনেকক্ষণ সময় লাগল-কারণ সবারই কিছু না কিছু বলার ছিল আর যতক্ষণ পর্যন্ত না”দুই টেকি আপা” পুরোটুকু শুনে মাথা না নাড়ছে ততক্ষণ পর্যন্ত তারা বলেই গেছে। ইভা যে তাদের সবার কথা বুঝেছে তা নয়, বাচ্চাগুলো প্রাণপণে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করেছে তার কারণে কথাগুলো আরো দুর্বোধ্য হয়ে গেছে, সরাসরি নিজের মতো করে কথা বললে মনে হয় বোঝা সহজ হত। ইভা অবশ্যি বর্ণনার খুঁটিনাটি থেকে বাচ্চাগুলোর মুখের ভাবভঙ্গি চকচকে চোখ কথা বলার আগ্রহ এগুলোতেই বেশি নজর দিচ্ছিল। তবে যখন সে লাশকাটা ঘরের সামনে কাগজের মতো ফর্সা মানুষটার সাথে জালালের কথাবার্তা এবং কুক্কু নামের তেজস্বী কুক্কুরের বিশাল বীরত্বের কাহিনী শুনতে পেল তখন হঠাৎ করে সে গল্পের বিষয়বস্তুতে আগ্রহী হয়ে উঠল। ইভা ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “মানুষ দুজন এসে তোমাদের কী জিজ্ঞেস করেছে?”

    মজিদ বলল, “জিগাইছে আমাগো কাছে সবুজ ভাই হেরোইনের প্যাকেট দিছে কী না!”

    জেবা মাথা নেড়ে বলল, “না-না-হেরোইন কয় নাই। কইছে পেলাস্টিকের ব্যাগে সাদা পাউডার।”

    অন্যেরা মাথা নেড়ে জেবাকে সমর্থন করল, বলল, “সাদা পাউডার, সাদা পাউডার।”

    “তোমরা হেরোইন চিননা?”

    “দেখি নাইক্কা। কিন্তুক হেরোইনখোর চিনি। হেরা খুবই ডরের। দেখতে এইরকম–” বলে জেবা হেরোইনখোরের চেহারা কেমন হয় সেটা দেখাল, জিব বের হয়ে এসেছে, চোখ ঢুলুঢুলু, দুই হাত বুকের কাছে ঝুলে আছে। জেবার অভিনয় নিশ্চয়ই নিখুঁত হয়েছে কারণ সবাই আনন্দে হি হি করে হাসল এবং সবাই তখন হেরোইনখোর সেজে অভিনয় করতে লাগল। একজন আরেকজনকে দেখে তখন হেসে গড়াগড়ি খেতে থেকে। শুধুমাত্র এই বাচ্চাগুলোর পক্ষেই মনে হয় এতো অল্পে এতো আনন্দ পাওয়া সম্ভব।

    ইভা তখন জালালের সাথে কাগজের মতো ফর্সা মানুষের ঘটনাটা আরো একবার শুনল এবং তাদের মাঝে জালাল কে ইভা জানতে চাইল। জালাল তখন সেখানে ছিল না তাই সাথে সাথে কয়েকজন জালালকে খুঁজে আনতে চলে গেল।

    জালাল তার ভেজাল মিনারেল ওয়াটার বিক্রি করছিল, যখন খবর পেল দুই টেকি আপা তাকে দেখতে চাইছে তখন তখনই সে হাজির হয়ে যায়। ইভা জিজ্ঞেস করল, “তুমি জালাল?”

    “জে।” জালাল মাথা নাড়ে।

    ”তোমার কুক্কু নামের একটা তেজি কুকুর আছে?”

    জালাল দাঁত বের করে হাসল, বলল, “জে। কুকুর তেজ খুব বেশি!”

    ইভা বলল, “সেটা ঠিক আছে, কিন্তু সবসময় তো তোমাকে বাঁচানোর জন্যে কুক্কু তোমার সাথে থাকবে না, তাই খুব সাবধান।”

    জালাল বলল, “জে আপা। আমি সাবধান থাকি।”

    “ভুলেও কখনো ওরকম মানুষের ধারেকাছে যাবে না।” জালাল মাথা নাড়ল, বলল, “যাই না।”

    “তোমাদের বন্ধু সবুজ গিয়েছিল বলে তার কী অবস্থা হয়েছে দেখেছ?”

    “জে আপা।”

    ইভা বলল, “গুড।” তারপর সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “এবার একজন একজন করে এসো, তোমাদের দুই টাকা করে দিই।”

    বাচ্চাগুলোর মুখে হাসি ফুটে ওঠে। প্রথম প্রথম ঘাড় বাঁকা করে বুকের কাছে হাত এনে কাতর ভঙ্গিতে সবাই তার কাছে ভিক্ষা চাইত। এখন তার সাথে সবার পরিচয় হয়েছে ঘনিষ্ঠতা হয়েছে এখন আর কেউ তার কাছে কিছু চায় না। আগে সম্পর্ক ছিল বড়লোক মহিলা আর গরিব ছেলেমেয়ের সম্পর্ক। এখন সম্পর্কটা অনেকটা পরিচিত বন্ধুর মতো। বন্ধুর কাছে তো আর টাকা চাওয়া যায় না! ইভা দেখেছে এখন তারা কাড়াকাড়ি করে টাকা নেয় না। নেওয়ার সময় তাদের মুখে একটু লাজুক লাজুক ভাব চলে আসে। এমনকি একজনকে যদি ভুল করে সে দিতে ভুলেও যায় সে নিজে কখনো কিছু বলে না, অন্যেরা ইভাকে মনে করিয়ে দেয়।

    .

    সবাইকে দেওয়া শেষ হবার পর ইভা জালালকে ডাকল, বলল, “জালাল, আমাকে এক বোতল মিনারেল ওয়াটার দাও দেখি।”

    জালাল কেমন যেন থতমত খেয়ে যায়। আমতা আমতা করে বলে, “মিনারেল ওয়াটার?”

    “হ্যাঁ।”

    “আপা আপনারে এনে দিই।”

    “কেন? এনে দিতে হবে কেন? তোমার হাতের বোতলগুলো দোষ করল কী?”

    জালাল কোনো উত্তর না দিয়ে ছুটে চলে গেল। কয়েক মিনিটের মাঝেই দোকান থেকে সত্যিকারের একটা বোতল এনে ইভার হাতে দিল। ইভা পানির বোতলটা হাতে নিয়ে একটু অবাক হয়ে বলল, “তোমার হাতেরগুলোর সাথে এটার পার্থক্য কী?”

    জালাল কোনো কথা না বলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।

    জেবা দাঁত বের করে হেসে বলল, “আফা, ওর হাতের গুলান ভুয়া! ভেতরে কলের পানি।”

    জালাল চোখ পাকিয়ে জেবার দিকে তাকাল, কিন্তু জেবা সেটাকে পাত্তা দিল, বলল, “হে শহর থাইকা এই ভুয়া পানি আনে।”

    ইভা হাসি হাসি মুখে জালালের দিকে তাকাল, “সত্যি?”

    জালাল কোনো কথা না বলে মাথা নিচু করে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে রইল, তারপর মাথা তুলে বলল, “আফনারে কুনোদিন আমি ভেজাল পানি দিমু না আপা।”

    “ঠিক আছে। থ্যাংকু। কাউকেই দিলে আরো ভালো!”

    ঠিক তখন দূরে ট্রেনের হুইসেল শোনা গেল এবং সাথে সাথে বাচ্চাদের মাঝে একটা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। তারা প্রাটফর্মের নানা জায়গায় দাঁড়িয়ে ট্রেনটা থামা মাত্র সেটাতে ওঠার প্রস্তুতি নিতে থাকে।

    দেখতে দেখতে বিশাল ট্রেনটা প্লাটফর্ম কাপিয়ে স্টেশনে ঢুকে গেল, ট্রেনটার গতি কমতে শুরু করেছে বাচ্চাগুলো নিজেদের জায়গা ভাগাভাগি করে দাঁড়িয়ে আছে। ইভা হঠাৎ করে লক্ষ করল মায়ার সাথে একটা ছেলের কী একটা নিয়ে ঝগড়া লেগে গেছে এবং কিছু বোঝার আগে ছেলেটা ধাক্কা দিয়ে মায়াকে চলন্ত ট্রেনের নিচে ফেলে দিল। ঘটনাটা এতো তাড়াতাড়ি ঘটেছে যে মায়া চিৎকার করার পর্যন্ত সময় পেল না, দুই হাতে মুখ ঢেকে সে বসে পড়ে। তার চোখ খোলার সাহস হয় না। মানুষজনের উত্তেজিত কথাবার্তা শুনে কয়েক সেকেন্ড পর চোখ খুলে সে দেখল জালাল লাফ দিয়ে প্লাটফর্মে শুয়ে মায়াকে ধরে ফেলেছে। এবং চিৎকার করে কিছু একটা বলছে, ট্রেনের শব্দের জন্যে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। জালাল ভয়ানক বিপজ্জনক ভঙ্গিতে শুয়ে আছে, তার ঠিক মাথার উপর দিয়ে ট্রেনের পাদানিগুলো প্রায় ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে, একটুখানি উনিশ-বিশ হলেই জালালের মাথা গুঁড়ো হয়ে যাবে।

    ইভা ছুটে গেল এবং নিচের দৃশ্যটা দেখে তার রক্ত জমে গেল। রেল লাইনের উপর দিয়ে ট্রেনের ধাতব চাকাগুলো বিকট শব্দ করতে করতে যাচ্ছে এবং তার এক ইঞ্চিরও কাছে মায়া ঝুলে আছে, জালাল তাকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। একটু নড়লেই মুহূর্তের মাঝে বাচ্চা মেয়েটি ট্রেনের চাকার নিচে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাবে। ট্রেনটি থামছে, কেন আরো তাড়াতাড়ি থামছে না ভেবে সে অস্থির হয়ে যায়। যতক্ষণ পুরোপুরি না থামছে জালাল কি মায়াকে ধরে রাখতে পারবে? শেষ পর্যন্ত ট্রেনটি থামল এবং ইভার কাছে মনে হল তার মাঝে বুঝি অনন্তকাল পার হয়ে গেছে।

    ইভার পাশাপাশি আরো অনেকে উবু হয়ে দৃশ্যটা দেখছিল, ট্রেনটা থামার পর সবাই মিলে মায়াকে টেনে উপরে তুলে আনে। জালাল এদিক-সেদিক তাকিয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়া তার ভুয়া পানির বোতলগুলো উদ্ধার করে হাতে নিয়ে যে ছেলেটি ধাক্কা দিয়ে মায়াকে ট্রেনের নিচে ফেলে দিয়েছে তাকে খুঁজতে থাকে। বেশি খুঁজতে হল না ছেলেটি কাছাকাছি অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে ছিল। কোনোকিছু নিয়ে গোলমাল হলে একজন আরেকজনকে ধাক্কা দেওয়া এমন কোনো বিচিত্র বিষয় না, কিন্তু মায়া যে ধাক্কা খেয়ে একেবারে ট্রেনের নিচে পড়ে যাবে সেটা সে নিজেও বুঝতে পারেনি।

    জালাল এবারে সেই ছেলেটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং মুহূর্তের মাঝে তুলকালাম কাণ্ড শুরু হয়ে গেল। ছেলেটাকে নিচে ফেলে জালাল তার বুকের উপর বসে হাত মুঠি করে তার মুখের মাঝে মারে। চিৎকার করে তার চুলগুলো ধরে হিংস্র ভঙ্গিতে ছেলেটার মাথা মাটিতে ঠুকতে থাকে। একজন যে আরেকজনকে এরকম নির্দয়ের মতো মারতে পারে ইভা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারত না। ইভা ছুটে গিয়ে কোনোমতে জালালকে টেনে সরিয়ে আনে। জালাল রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বলে, “এই হারামজাদা সবসময় এইরকম করে, আরেকদিন এইরকম করে ধাক্কা দিছিল–”

    ইভা জালালের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “ব্যস! অনেক হয়েছে। ছেড়ে দাও। তুমি এইমাত্র এই মেয়েটার জীবন বাঁচিয়েছ। তুমি না থাকলে এই মেয়েটা মরে যেত। আমরা সারাজীবনেও কারো জীবন বাঁচাতে পারি না-তুমি এতোটুকুন ছেলে হয়ে আরেকজনের জীবন বাঁচিয়েছ। তোমার রাগ করা মানায় না–”

    জালালের রাগ একটু কমে আসে। মায়া কাছে দাঁড়িয়ে ছিল-সে এখনো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ইভা তাকে ডেকে এনে জড়িয়ে ধরে বলল, “কাঁদে না বোকা মেয়ে। খুব বাচা বেঁচে গিয়েছ। তোমার মতো লাকি মেয়ে আমি জীবনে দেখিনি।”

    আশেপাশে যাত্রীরা নানা ধরনের মন্তব্য করতে থাকে কিন্তু বাচ্চাগুলোর সেগুলো নিয়ে কোনো মাথাব্যথা দেখা গেল না–তারা আবার নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল। মায়াকে কিছুক্ষণের মাঝেই দয়ালু টাইপের প্যাসেঞ্জারদের পিছনে পিছনে ভাত খাওয়ার টাকার জন্যে ছুটতে দেখা গেল। জালাল তার ভুয়া মিনারেল ওয়াটার বিক্রি করতে শুরু করে দিল। দেখে বোঝাই যায় না কয়েক মুহূর্ত আগে এখানে এতো বড় একটা ঘটনা ঘটেছে। ইভা অবাক হয়ে ভাবে না জানি প্রতিদিন কতবার এরা মৃত্যুর এতো কাছাকাছি থেকে ফিরে আসে।

    .

    ট্রেন ঢাকা পৌঁছাল সন্ধের একটু পর। ইভার বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত আটটা হয়ে যায়। বাসায় গিয়ে দেখে তার ভাই এবং ভাবী তাদের বাচ্চা দুটোকে নিয়ে এসেছে। ইভাকে দেখে সবাই খুব খুশি হয়ে উঠল। ভাবী বলল, “ভালোই হল তোমার সাথে দেখা হল। আমি খবর পাই তুমি প্রতি সপ্তাহে আস কিন্তু দেখা হয় না!”

    ইভা বলল, “কেমন করে দেখা হবে, সবাই এতো ব্যস্ত!”

    ভাবী মাথা নাড়ল, “তোমার এনার্জি আছে। আমি হলে কিছুতেই পারতাম না। প্রতি সপ্তাহে এরকম ট্রেন জার্নি। বাবারে বাবা!”

    ইভা হাসল, “আমার সময় কেটে যায়। ট্রেন জার্নির কারণে বইপড়া হচ্ছে। অনেকদিন থেকে পড়ব পড়ব বলে যে বইগুলো জমা করে রেখেছিলাম এই ধাক্কায় সব পড়া হয়ে যাচ্ছে!”

    ভাবীর বাচ্চা দুইজন এই সময় ছুটে এলো, বড়টি ছেলে বয়স তেরো–মাত্র টিনএজার হয়েছে কিন্তু চেহারায় ভাবভঙ্গিতে এখনো তার ছাপ পড়েনি। ছোটজন মেয়ে, বয়স আট। ছেলেটি বলল, “ফুপ্পি তুমি আমার বার্থডে-তে আসনি।”

    ইংরেজি মিডিয়ামে পড়ে তাই তার বাংলা উচ্চারণে একটা ইংরেজি ইংরেজি ভাব। ইভা মুখে অপরাধীর ভাব করে বলল, “আই অ্যাম সরি! তোমরা সব প্ল্যান করে উইক ডে’তে জন্ম নিচ্ছ আমি কেমন করে আসব? এর পরের বার থেকে উইক এন্ডে জন্ম নিবে। আমি উইক এন্ডে ঢাকা থাকি!”

    ছেলেটি হাসল, ইংরেজি বলল, “যা মজা হয়েছিল! একটা নতুন গেম বের হয়েছে, নেট ব্যবহার করে খেলা যায় আমরা সেটা দিয়ে খেলেছি।”

    মেয়েটি আদুরে গলায় বলল, “আমাকে নেয়নি।”

    “তোকে কেমন করে নিব? তুই কি খেলতে পারিস?”

    ইভা জিজ্ঞেস করল, “অনেক গিফট পেয়েছ?”

    ছেলেটি মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ ফুপ্পি। অনেক। একটা এমপি থ্রি প্লেয়ার দিয়েছে। আমার ফ্রেন্ডরা–যা কিউট!”

    ইভা বলল, “আমার কাছ থেকে তোমার একটা গিফট পাওনা থাকল। বল কী চাও।”

    ছেলেটি হাসি হাসি মুখে বলল, “থ্যাংকস ফুপ্পি। তোমার যেটা ইচ্ছা দিও।”

    “বই?”

    ছেলেটার খুব পছন্দ হল না কিন্তু সেটা প্রকাশ করল না, বলল, “হ্যাঁ। অফকোর্স বই দিতে পার।” ইংরেজিতে যোগ করল, “বই আমার খুব পছন্দ।”

    মেয়েটা বলল, “আমার বই ভালো লাগে না।” ইভা বলল, “তুমি আরেকটু বড় হও তখন তোমারো বই ভালো লাগবে।”

    ছেলেটা হঠাৎ ইভার একটু কাছে এগিয়ে এসে ইংরেজিতে বলল, “ফুপ্পি, তুমি আমার একটা উপকার করতে পারবে?”

    “কী উপকার?”

    “তুমি আম্মুকে একটা জিনিস বোঝাতে পারবে?”

    “কী জিনিস?”

    “আমাদের পুরো ক্লাশ একটা ট্রিপে যাচ্ছে, কিন্তু আম্মু আমাকে যেতে দিতে চায় না।”

    “কেন?”

    “আম্মু বলে আমি না কী নিজে নিজে ম্যানেজ করতে পারব না। সিক হয়ে যাব। হ্যাঁনো তেননা। সবাই যাচ্ছে–কী মজা হবে আর আমি যেতে পারব না!”

    ইভা বলল, “ঠিক আছে ভাবীকে বলব।”

    ঠিক তখন ভাবী এক কাপ চা খেতে খেতে এদিকে আসছিল। ইভা বলল, “ভাবী, তুমি না কি সাদকে তার ক্লাশের বন্ধুদের সাথে ট্রিপে যেতে দিচ্ছ না?”

    “কেমন করে দিব? এখনো তুলে না দিলে খেতে পারে না। ট্রিপে গিয়ে নিজে নিজে কেমন করে ম্যানেজ করবে?”

    “পারবে ভাবী, পারবে। যখন নিজের উপর পড়বে তখন নিজেই ম্যানেজ করতে পারবে।”

    ভাবী দুশ্চিন্তিত মুখে মাথা নাড়ল, বলল, “জানি না বাপু। টিভি খুললেই দেখি কিছু না কিছু হচ্ছে, এই অ্যাকসিডেন্ট ওই অ্যাকসিডেন্ট ভয় লাগে। কখন যে কী হয় শান্তিতে ঘুমাতে পারি না।”

    “এতো ভয় পেলে হবে না। টিভিতে তো আর ভালো জিনিসগুলো দেখায় না, খালি খারাপগুলো দেখায়–”

    “তা ছাড়া লেখাপড়া নিয়েও তো ঝামেলা। ম্যাথ-এর খুব ভালো একটা টিউটর পেয়েছি, ঝুম্পা মিস-খুব রাশ। একদিন অ্যাবসেন্ট থাকলে রাগ করে।”

    ইভা কিছু বলল না, এই বিষয়গুলো সে বুঝতে পারে না। একজন একটা স্কুলে পড়লেও কেন আলাদা কোচিং করতে হবে? ভাবী চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, “একটা গাড়ি একটা ড্রাইভার চরকির মতো দৌড়াচ্ছে। স্কুলে নিয়ে যাও, স্কুল থেকে আন, কোচিংয়ে নিয়ে যাও সেখান থেকে অন্য কোচিংয়ে নিয়ে যাও, তোমার ভাইয়ের অফিস, গ্রোসারি–অন্য কিছু করার সময় কোথায় বল?”

    ইভা এবারেও কিছু বলল না। সংসারের ঝামেলার কথা ভাবীর প্রিয় বিষয়, ভাবী একবার বলতে শুরু করলে সহজে থামতে পারে না। ভাবী বলেই যেতে থাকে, ইভা শুনতে শুনতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে যায়। সে একবার সাদ আরেকবার মাহরীনের দিকে তাকাল। কয়েক ঘণ্টা আগেই স্টেশনে এদের থেকেও ছোট ছোট বাচ্চাদের দেখে এসেছে-তাদের নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই, কী অবলীলায় কী বিচিত্র একটা জীবন কাটিয়ে যাচ্ছে। আর তার ভাইয়ের ছেলেমেয়েরা কী বিচিত্র আরেকটা জীবনের ভেতর দিয়ে বড় হচ্ছে। সাদ আর মাহরীনকে যদি একদিন জালাল আর মায়ার সাথে বসিয়ে দেওয়া হয় তা হলে কী তারা নিজেদের ভেতর কথা বলার কোনো একটা কিছু খুঁজে পাবে?

    মনে হয় না। প্রায় একই বয়সের বাচ্চা কিন্তু তাদের জীবনের মাঝে এতোটুকু মিল নেই।

    .

    ০৬.

    জালাল ঘুম থেকে উঠে একটা থাম্বায় হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে রইল। গত রাতে সে তার মা’কে স্বপ্নে দেখেছে। মা পাটফর্মের কাছে দাঁড়িয়েছিল, ঝিকঝিক শব্দ করে ট্রেন আসছে তখন জালাল বলল, “মা এতো কাছে খাড়াইও না, দূরে থাকো।” মা বলল, “ক্যান? দূরে খাড়াইতে হবি ক্যান?” জালাল বলল, “অ্যাকসিডেন্ট হতি পারে।” মা তখন দূরে সরে যেতে চাচ্ছিল ঠিক তখন কোথা থেকে কাগজের মতো সাদা কয়েকজন মানুষ এসে মাকে ধরে রাখল। ট্রেনটা যখন খুব কাছাকাছি এসেছে তখন তারা ধাক্কা দিয়ে মা’কে ট্রেনের নিচে ফেলে দিল। চোখের নিচে ট্রেনের চাকার নিচে মা কেটেকুটে খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে গেল। জালাল”মা মা চিৎকার করে ঘুম থেকে জেগে উঠেছে। তারপর অনেকক্ষণ ঘুমাতে পারেনি, কী ভয়ংকর একটা স্বপ্ন।

    সকালবেলা ঘুম থেকে ওঠার পর জালালের স্বপ্নটার কথা মনে পড়ে মনটা আবার খারাপ হয়ে গেল। কতোদিন সে তার মাকে দেখেনি–শেষ পর্যন্ত যখন দেখল তখন এরকম খারাপ একটা স্বপ্ন দেখল। পুরো স্বপ্নটা মনে হচ্ছে একেবারে সত্যি।

    জালালকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে জেবা জিজ্ঞেস করল, “এই, জালাইল্যা, কী হইছে তোর?”

    জালাল বলল, “রাত্রে খুব খারাপ একটা স্বপ্ন দেখছি।”

    জেবার মনে হয় একটু কৌতূহল হল। সে স্বপ্ন, জ্বিন, পরী, ভূত, পীর, ফকির, তাবিজ এইসব খুব পছন্দ করে। জালালের সামনে বসে জিজ্ঞেস করল, “কী স্বপ্নে দেখছস?”

    জালাল তখন জেবাকে পুরো স্বপ্নটা বলল। শুনে জেবার মুখটা একটু গম্ভীর হয়ে গেল। সে মাথা নেড়ে বলল, “স্বপ্নটা খারাপ। তোর একটা সদকা দেওন দরকার।”

    “সদকা?”

    “হয়। তয় আরো একটা কথা আছে।”

    “কী কথা?”

    “স্বপ্নে যদি কেউরে মরতে দেখস তা হলে তার আয়ু বাড়ে। মনে লয় তর মায়ের আয়ু বাড়ছে।” জেবা তখন এর আগে কাকে কাকে স্বপ্নে মরতে দেখেছে এবং তাদের সবাই কেমন হাট্টাকাট্টা জোয়ান হয়ে বেঁচে আছে জালালকে তার একটা লম্বা তালিকা শোনাল।

    শুনে জালালের মনটা একটু শান্ত হয়। জেবা অবশ্যি তারপরেও গম্ভীর মুখে বলল, “স্বপ্নের কথা কাউরে কয়া ফেললে হেইডা আর সত্যি হয় না। ঘুম থাইকা উইঠাই বলতি হয়।”

    জালাল বলল, “তাইতো বলছি।”

    জেবা বলল, “হেইডা বালা কাম করছস। তয়–”

    “তয় কী?”

    “মনে লয় মাজারে কয়টা টেহা দিয়া আয়।”

    জালাল মাথা নাড়ল, বলল, “দিমু। আইজকেই দিমু।”

    .

    জালাল বিকালবেলা শহরে গিয়ে মাজারের বিশাল বাক্সের ভেতর দশ টাকার একটা নোট ফেলে দিল। সেখানে উরস না কী যেন হচ্ছে তাই সবাইকে খাওয়াচ্ছে, জালাল অন্যদের সাথে কলাপাতা পেতে বসে পড়ল। ভাত, ডাল আর গরুর মাংস–তবে তার পাতে মাংস পড়ল না শুধু ঝোল আর এক টুকরা আলু। এতো মানুষ খাচ্ছে যেখানে সত্যি সত্যি সে গোশতের টুকরা পাবে সেটা অবশ্যি সে আশাও করেনি।

    জালাল ভেবেছিল মাজারে দশ টাকার নোটটা দিয়ে আসার পর তার মায়ের বিপদ কেটে যাবে কিন্তু পরের রাতেও সে তার মা’কে স্বপ্নে দেখল। তার মা ধবধবে সাদা চুল আর একটা ময়লা শাড়ি পরে বিলাপ করছে। ভোরবেলা জেবা স্বপ্নের কথা শুনে গম্ভীর হয়ে গেল, বলল, “এই স্বপ্নের নিশানা ভালা না।”

    জালাল বলল, “কী নিশানা?”

    “মনে হয় তর মায়ের বিপদ হইছে।”

    “বিপদ? কী বিপদ?” জালাল তার মায়ের কী বিপদ হতে পারে, বুঝে পেল না। তার বাবা মারা যাবার পর চাচাঁদের সংসারে মা লাথি-ঝাটা খেয়ে কোনোমতে টিকে আছে। ছোট বোনটা খেতে না পেয়ে শুকিয়ে কাঠি হয়ে গেল। কী কারণ কে জানে বড় চাচার পুরো রাগটা ছিল জালালের উপর কিছু হলেই জালালকে ধরে গরুর মতো পেটাত। সেই জন্যে জালাল শেষ পর্যন্ত বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে–ভেবেছিল পালানোর আগে বড় চাচার বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিবে কিন্তু মায়ের কথা ভেবে শেষ পর্যন্ত আর লাগায়নি। এই মায়ের নতুন করে আর কী বিপদ হতে পারে?

    জেবা গম্ভীর হয়ে বলল, “সদকা দে।”

    “সদকা?”

    “হ। একটা মুরগি।”

    একটা মুরগি কিনতে যত টাকা বের হয়ে যাবে তার থেকে কম টাকা খরচ করে সে বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে পারে। বাড়ি থাইকা পালানোর পর সে আর একবারও বাড়ি যায়নি–একবার গিয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে আসার সময় হয়েছে। যদি দেখা যায় আসলেই মায়ের বিপদ তা হলে তখন না হয় সদকা দেওয়া যাবে।

    জালাল একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “বাড়ি থাইকা ঘুরি আসি।”

    জেবার মুখে দুশ্চিন্তার একটা ছাপ পড়ল, “ঘুরি আসবি না কি আর আসবি না?”

    “আসমু।”

    জেবা জানে তাদের জীবনে কোনো নিয়ম-শৃঙ্খলা নেই, জালাল একবার বাড়ি গেলে হয়তো আর কোনোদিন ফিরেই আসবে না। স্টেশনে তারা যারা থাকে ঝগড়াঝাটি আর মারামারি যাই করুক সবাই মিলে তাদের একটা পরিবার। একজন চলে গেলে পরিবারের একজন কমে যায়। জালালের মাথা থেকে বাড়ি যাওয়ার বুদ্ধিটা সরানোর জন্যে বলল, “কোটের সামনে তাবিজ বিক্রি হয়। বাড়ি যাওনের দরকার কী? ভালা দেইখা একটা তাবিজ কিন। গরম তাবিজ আছে, আসল সোলেমানি তাবিজ।”

    জালাল মাথা নেড়ে বলল, “মায়ের যদি বিপদ হয় তা হলে আমার তাবিজ পইরা কী লাভ?”

    যুক্তিটা ফেলে দেবার মতো না। তাই জেবা আর কোনো কথা বলল না।

    .

    দুপুরবেলা জালাল আবার জেবার কাছে এল, বলল, “জেবা তুই একটা কাম করতি পারবি?”

    “কী কাম?”

    জালাল একটু লাজুক মুখে বলল, “মায়ের জন্যি একটা শাড়ি কিনি দিতি পারবি?”

    জেবা চোখ কপালে তুলে বলল, “তুন শাড়ি?”

    “হয়।”

    জেবা তখনো বিশ্বাস করতে পারে না যে জালাল তার মায়ের জন্যে নতুন একটা শাড়ি কিনতে পারে। অবাক হয়ে বলল, “তোর কাছে টেহা আছে?”

    অনেকদিন থেকে জালাল টাকা জমিয়ে আসছে, তার ইচ্ছে সে একটা পান সিগারেট না হলে চায়ের দোকান দিবে। বেশ কিছু টাকা জমা হয়েছে। সেখান থেকে সে ইচ্ছে করলেই মায়ের জন্যে শাড়ি কিনতে পারে। জালাল মাথা নেড়ে বলল, “হয়ে যাবি মনে লয়।”

    জেবা তখনো আপত্তি করল, “তুন শাড়ির দরকার কী? অনেক ভালা পুরান শাড়ি পাওয়া যায়।”

    জালাল মাথা নাড়ল, বলল, “না। লতুন শাড়ি কিনমু।”

    কাজেই বিকালবেলা জেবাকে নিয়ে জালাল শাড়ি কিনতে বের হল। জেবার সাথে মায়া চিনে জোঁকের মতো লেগে থাকে তাই তাকেও সাথে নিতে হল।

    বড় বাজারের শাড়ির দোকানের মানুষেরা তাদেরকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল–তারা নতুন শাড়ি কিনতে পারে সেটা তারা বিশ্বাসই করল না। জালাল তার প্যান্টের সেলাই থেকে কিছু টাকা বের করে হাতে শক্ত করে ধরে রেখেছিল সেই নোটগুলো দেখানোর পরও দোকানদার তাদের বিশ্বাস করল না। জেবা একটা ঝগড়া শুরু করে দিতে যাচ্ছিল জালাল শুধু শুধু সময় নষ্ট করল না। জেবাকে নিয়ে টিএন্ডটি বস্তির কাছে গরিব মানুষদের জামা-কাপড়ের দোকানে হাজির হল। বুড়ো দোকানি তাদেরকে শাড়ি নামিয়ে দেখাল, জেবা শাড়ির কাপড় পরীক্ষা করে দেখল, শরীরের সাথে লাগিয়ে দেখল তারপর নীল জমিনের উপর কমলা রঙের বড় বড় ফুলওয়ালা একটা শাড়ি পছন্দ করে দিল। দোকানের নতুন নতুন কাপড় দেখে জালাল তার ছোট বোনটার জন্যেও একটা ফ্রক কিনল। চলে আসার সময় তার কী মনে হল কে জানে নিজের জন্যেও একটা জিনসের প্যান্ট আর শার্ট কিনে ফেলল! এই বিলাসিতার জন্যে তার পান-সিগারেটের কিংবা চায়ের দোকান হয়তো আরো ছয় মাস পিছিয়ে গেছে, কিন্তু কী আর করা!

    ফিরে আসার সময় মায়া বলল, “ভাই।”

    জালাল উত্তর দিল, “কী?”

    “তোমার এতো টেহা, আমাগো বিরানি খাওয়াবা?”

    মুখ খিঁচিয়ে ধমক দিতে গিয়ে জালাল থেমে গেল। কয়দিন আগে মায়া সবুজের কাছে বিরিয়ানি খেতে চেয়েছিল, সেই সবুজ এখন দশ হাত মাটির নিচে। জালাল মনে মনে হিসাব করে দেখল যে তার কাছে যত টাকা আছে ইচ্ছে করলে সে একটা বিরিয়ানির প্যাকেট কিনতে পারে, তিনজনে মিলে সেটা খেতেও পারে। তারপরেও তার মনটা একটু খুঁতখুঁত করতে থাকে–এতোগুলো টাকা বিরিয়ানির প্যাকেট কিনে নষ্ট করবে?

    জেবা বলল, “বড় বাজারের মোড়ে বিরানির দোকান আছে। এই এত্তোগুলা কইরা দেয়।”

    জেবা বিরিয়ানির যে পরিমাণটা দেখাল সেটা সত্যি হবার সম্ভাবনা কম। তারপরেও জালাল শেষ পর্যন্ত রাজি হল। তখন তিনজন মিলে হেঁটে হেঁটে বড় বাজারে বিরিয়ানির দোকানটিতে হাজির হল। বাইরে বিশাল একটা ডেকচিতে বিরিয়ানি রান্না করা আছে। কেউ ইচ্ছা করলে প্যাকেটে করে কিনতে পারে কিংবা ভেতরে বসে খেতে পারে। তাদেরকে ভেতরে ঢুকতে দিবে না জেনেও তিনজন একবার ভিতরে ঢুকতে চেষ্টা করল। ডেকচির সামনে বসে থাকা কালো মোটা মানুষটা খেঁকিয়ে উঠল, “কই যাস?”

    জেবা মুখ শক্ত করে বলল, “বিরানি খামু।”

    মানুষটা মুখ শক্ত করে বলল, “ইহ! বিরানি খামু! যা ভাগ।”

    জালাল বলল, “টেহা দিয়া বিরানি খামু, আপনাগো সমিস্যা কী?”

    জালালের কথায় মানুষটা মনে হয় খুব মজা পেল, বলল, “বেশি টাকা হইছে? ভাগ এইখান থেকে।”

    তাদেরকে ভেতরে ঢুকতে দিবে সেটা অবশ্যি তারাও আশা করেনি তাই আর তর্ক-বিতর্কের মাঝে গেল না। জালাল তার মুঠি থেকে একটা নোট বের করে কালো মোটা মানুষটার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “এক প্যাকেট বিরানি।”

    মানুষটা নোটটা নিয়ে পরীক্ষা করে দেখল তারপর একটা প্যাকেট নিয়ে সেটাতে বিরিয়ানি ভরে দেয়। জেবা বলল, “কম দিছেন। আরো দেন।”

    মানুষটা চোখ পাকিয়ে জেবার দিকে তাকাল তারপর সত্যি সত্যি প্যাকেটটাতে আরেকটু বিরিয়ানি ঠেসে দিল। মায়া বলল, “গোশতু বেশি কইরা দেন।”

    মানুষটা মায়ার দিকে ঘুরে তাকাল, মায়ার সাইজ দেখে তার মুখে একটা আজব ধরনের হাসি ফুটে উঠে। কিন্তু সত্যি সত্যি ডেকচির ভেতরে তাকিয়ে আরেক টুকরা গোশত এনে বিরিয়ানির প্যাকেটে ঢুকিয়ে দিল। মানুষটি তারপর প্যাকেটটা বন্ধ করে জালালের দিকে এগিয়ে দেয়।

    জালাল প্যাকেটটা হাতে নেয়, গরম গরম বিরিয়ানি। প্যাকেটটা খুলতেই ভেতর থেকে অপূর্ব একটা ঘ্রাণ বের হয়ে আসে। তাদের তিনজনের জিবেই পানি এসে যায়। কোথায় বসে খাবে সেটা নিয়ে চিন্তা করে তারা সময় নষ্ট করল না তখন তখনই রাস্তার পাশেই বসে পড়ে। প্যাকেটটা মাঝখানে রেখে তারা সেটাকে ঘিরে বসে পড়ল। এরকমভাবে খেতে হলে সবসময় কাড়াকাড়ি করে কে কার আগে কত বেশি খেতে পারে সেটা নিয়ে একটা প্রতিযোগিতা হয়। আজকে সেরকম কিছু হল না, তারা কাড়াকাড়ি করল না, একটু একটু করে খেল। সিদ্ধ ডিমটা জেবা সমান তিনভাগ করে দিল, সেটা তারা আলাদা করে খেল। গোশতের টুকরোগুলো অনেকক্ষণ ধরে চিবাল, হাড়ের টুকরোগুলো চুষে চুষে খেল। প্যাকেটটার শেষ ভাতটাও তারা ঝেড়েপুছে খেয়ে শেষ করল।

    মায়া হাত চাটতে চাটতে বলল, “আমি যহন বড় হমু তখন পেরতেক দিন বিরানি খামু।”

    সে বড় হলে কেন তার প্রত্যেকদিন বিরিয়ানি খাওয়ার মতো ক্ষমতা হবে সেটা নিয়ে কেউ প্রশ্ন করল না। তিনজন উঠে দাঁড়াল, জেবা বিরিয়ানির ডেকচির পাশে বসে থাকা কালো মোটা মানুষটাকে বলল, “পানি খামু।”

    জালাল হাত চাটতে চাটতে বলল, “হাত ধুমু।”

    মানুষটা কয়েক সেকেন্ড তাদের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “ভিতরে যা। হাত ধুয়ে পানি খায়া বিদায় হ।”

    তিনজন ভেতরে ঢুকল, বেসিনে রগড়ে রগড়ে সাবান দিয়ে হাত ধুলো, ট্যাপ থেকে পানি খেল তারপর বের হয়ে এলো। আসার সময় জালাল সাবানের টুকরোটা পকেটে করে নিয়ে এলো।

    .

    বিরিয়ানির দোকান থেকে নিয়ে আসা সাবানটা দিয়ে জালাল পরের দিন স্টেশনের পাশের ডোবাটাতে গোসল করল, তারপর তার নতুন কাপড় পরল। জিনসের প্যান্ট আর শার্ট পরে সে যখন স্টেশনে ফিরে এলো তখন তাকে দেখে চেনা যায় না। স্টেশনের সবাই তাকে ঘিরে খানিকটা বিস্ময় আর অনেকখানি ঈর্ষা নিয়ে তাকিয়ে থাকে। জালালের একটু লজ্জা লজ্জা করছিল, কৈফিয়ত দেওয়ার মতো করে বলল, “বাড়ি যামু তো হের লাগি কিনছি।”

    জেবা সবাইকে জানাল, “জালাইল্যা খালি নিজের কাপড় কিনে নাই–হের মায়ের লাইগাও শাড়ি কিনছে।”

    মায়া বলল, “তার বইনের জামাও কিনছে।”

    জালাল ভয়ে ভয়ে ছিল জেবা আর মায়া তার বিরিয়ানি খাওয়ানোর কথাটাও সবাইকে বলে দিবে কি না। তা হলে অন্যেরা হইহই করতে থাকবে। জেবা আর মায়ার বুদ্ধি আছে তারা বিরিয়ানি খাওয়া নিয়ে কিছু বলল না।

    জেবা বলল, “হের মায়ের শাড়িটা আমি কিনা দিছি।”

    মায়া মাথা নাড়ল, “অনেক সোন্দর।”

    জালালকে তখন শাড়িটা দেখাতে হল আর সবাই তখন মাথা নেড়ে স্বীকার করল যে শাড়িটা আসলেই খুবই সুন্দর।

    .

    জয়ন্তিকার প্যাসেঞ্জারদের কাছে যখন সবাই ছোটাছুটি করছে তখন জালাল ট্রেনের ছাদে গিয়ে উঠল। হাতে একটা পলিথিনের ব্যাগ, ব্যাগের ভিতর তার মায়ের শাড়ি আর বোনের ফ্রক। এই এক ট্রেনে সে বাড়ি যেতে পারবে না–দুইবার ট্রেন বদলাতে হবে, শেষ অংশ যেতে হবে বাস কিংবা টেম্পুতে। ট্রেনের অংশটুকু ফ্রি, বাস-টেম্পুতে কিছু পয়সা খরচ হবে।

    ঠিক যখন হুইসেল দিয়ে ট্রেনটা ছেড়ে দিচ্ছে তখন হাচড়-পাঁচড় করে মজিদ আর শাহজাহানও ট্রেনের ছাদে ওঠে পড়ল। জালাল অবাক হয়ে বলল, “তোরা কই যাস?”

    “তরে একটু আগাইয়া দেই।”

    “ফিরতি দেরি হবে কিন্তু, লোকাল টেরেনে ফিরতি হবি।”

    শাহজাহান বলল, “সমিস্যা নাই। দরকার হলি কাল ফিরুম।”

    কথাটা সত্যি, তারা এই স্টেশনে থাকে তার অর্থ এই নয় যে প্রতি রাতেই তাদের এখানে থাকতে হবে। যখন যেখানে খুশি তারা রাত কাটাতে পারে।

    জালাল খুশি হল, একা একা ট্রেনে যাওয়া থেকে কয়েকজন মিলে যাওয়া অনেক নিরাপদ। ট্রেনের ছাদে বসে যারা যাতায়াত করে তার মাঝে অনেক রকম মানুষ থাকে-কয়দিন আগেই একজন আরেকজনের সবকিছু কেড়ে নিয়ে ধাক্কা দিয়ে ছাদ থেকে ফেলে দিয়েছিল।

    ট্রেনটা ছেড়ে দেবার পর প্রথম একটু হেলতে দুলতে যেতে থাকে তারপর ধীরে ধীরে তার গতি বাড়তে থাকে। শহরের ভেতর দোকানপাট বাড়িঘর ঘিঞ্জি রাস্তা পার হয়ে দেখতে দেখতে ট্রেনটা গ্রামের ভেতর চলে আসে। দুই পাশে ধান ক্ষেত, বাঁশঝাড়, ছোট ছোট নদী–দেখে জালাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বাড়ি থেকে পালিয়ে স্টেশনে থাকতে শুরু করার আগে সেও এরকম একটা গ্রামে থাকত, যতবার এরকম একটা গ্রাম চোখে পড়ে জালালের মন কেমন কেমন করে।

    শাহজাহান ট্রেনের ছাদে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। মজিদ পকেট থেকে একটা আমড়া বের করে কামড়ে কামড়ে খেতে শুরু করে। জালাল জিজ্ঞেস করল, “মজিদ, তোর বাড়িতে কে কে আছে?”

    মজিদের মনে হয় উত্তর দেবার ইচ্ছে নেই, বলল, “জানি না।”

    “জানিস না?”

    “এই তো। বাপ-মা ভাই বুন–”

    ”তয় তুই বাড়ি যাস না কেন?”

    “আমার বাপ হইছে আজরাইল–মাইরতে মাইরতে শেষ করে দেয়।”

    “ও।” জালাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, তার বেলায় ঘটনাটা ঠিক তার উল্টো। যতদিন বাবা বেঁচে ছিল কোনো ঝামেলাই ছিল না, তাকে কত আদর করত। বাবা মরে যাবার পর চাচাঁদের অত্যাচারে আর বাড়ি থাকতে পারল না।

    শাহজাহান ট্রেনের ছাদে শুয়ে শুয়ে আকাশের মেঘের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলল, “মেঘগুলারে মনে হয় জ্যান্ত। মনে লয় এইগুলা হাটে, লড়াচড়া করে।”

    জালাল আর মজিদও আকাশের দিকে তাকাল, আকাশে তুলার মতোন মেঘ, কয়দিন আগেও কী সাংঘাতিক বর্ষা ছিল এখন বর্ষা শেষ হয়েছে, সামনে শীত। বর্ষাকালে তাদের কষ্ট, শীতেও তাদের কষ্ট। মাঝখানের এই সময়টাতে তাদের আরাম। শাহজাহানের দেখাদেখি জালাল আর মজিদও ট্রেনের ছাদে শুয়ে শুয়ে আকাশের মেঘ দেখতে লাগল। শাহজাহান ঠিকই বলেছে, একটা মেঘকে মনে হচ্ছে ঘোড়ার মতোন, সেটা দেখতে দেখতে প্রজাপতির মতোন হয়ে গেল একটু পরে সেই প্রজাপতিটাকে একটা মুরগির রানের মতো দেখাতে থাকে। মনে হচ্ছে একটা বিরিয়ানির প্যাকেট থেকে এই মুরগির রানটা বের হয়ে এসেছে!

    .

    শাহজাহান আর মজিদ দুই স্টেশন পর ট্রেন থেকে নেমে একটা লোকাল ট্রেনের ছাদে রওনা দিয়ে দিল। মজিদ রাত্রে টিএন্ডটি বস্তিতে থাকে, কাজেই সে ফিরে যেতে চাইছিল।

    সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে জালাল সন্ধ্যার মাঝে বাড়ি পৌঁছে যেত কিন্তু সে বাড়ি পৌঁছাল পরের দিন সকালে। মাঝখানে ট্রেনটা এক জায়গায় তিন ঘণ্টা আটকে থাকল, একটা মালগাড়ি উল্টে সবকিছু বন্ধ হয়ে ছিল। তিনঘণ্টা দেরি হওয়ার কারণে পুরো সময়টা উলটপালট হয়ে তার সবকিছু দেরি হয়ে গেল। মাঝ রাতে ট্রেন থেকে নেমে তাকে স্টেশনে রাত কাটাতে হল–সেটা এমনিতে তার জন্যে কোনো সমস্যা না কিন্তু মাত্র নতুন শার্ট-প্যান্ট কিনে এনেছে, প্লটফর্মে শুয়ে সেগুলো ময়লা করতে চাচ্ছিল না–তাই একটা বেঞ্চে হেলান দিয়ে আবোঘুম আধোজাগা অবস্থায় রাতটা কাটিয়ে দিল।

    জালাল সকালে প্রথম বাসটাতে উঠে বসে–দুই ঘণ্টার মাঝে বাড়ি পৌঁছে যায়। বাস থেকে নেমে ক্ষেতের আল ধরে মাইলখানেক হাঁটার পর সে তার বাড়ি পৌঁছাল, এক বছরের বেশি হল সে তার মাকে দেখে না, মা কেমন আছে কে জানে। ছোট বোনটা কী তাকে চিনবে? যখন সে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছে তখন বোনটা খুব দুর্বল হয়েছিল। খেতে না পারলে দুর্বল তো হবেই।

    বাড়ির কাছাকাছি এসে জালালের একটু ভয় ভয় করে। বাইরে বাংলাঘর, পার হয়ে ঢোকার পর সেখানে উঠান, চারপাশে তাদের চাচাঁদের ঘর। উঠানের মাঝখানে আসার পর তার একজন চাচাতো ভাই প্রথম তাকে দেখতে পেল। গলা উঁচিয়ে বলল, “আরে! এইটা জালাইল্যা না?”

    জালাল মাথা নাড়ল। চাচাতো ভাই জালাল থেকে অনেক বড়। কাছে এসে বলল, “তুই কোন দুইন্যা থেকে হাজির হলি?”

    জালাল কী বলবে বুঝতে পারল না। কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল তখন বাড়ির ভেতর থেকে তার কয়েকজন চাচি, চাচাতো ভাইবোন বের হয়ে এসে তাকে ঘিরে দাঁড়াল। জালাল তাদের ভেতর তার মাকে খুঁজল, পেল না। তখন জিজ্ঞেস করল, “মা কই?”

    সবাই কেমন যেন থতমত খেয়ে গেল। বড় চাচি বলল, “তোর বইন যখন মরল–”

    জালালের মাথাটা কেমন যেন চক্কর দিয়ে ওঠে। তার বোন মরে গেছে? যার জন্যে একটা লাল টুকটুকে ফ্রক কিনে এনেছে সে মরে গেছে? জালাল ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ করে জালাল কোনো কথা আলাদা করে শুনতে পায় না। একসাথে সবাই কথা বলছে, তার বোনটা কেমন করে মারা গেছে সবাই সেটা বলছে কিন্তু কিছুই জালালের মাথায় ঢুকছে না। একজন মানুষ মরে গেলে সে কীভাবে মারা গেল সেটা জানলেই কী আর না জানলেই কী?

    কিন্তু তার মা? তার মায়ের কী হল? জালাল তখন আবার চারিদিকে সবার মুখের দিকে তাকাল, তারপর জিজ্ঞেস করল, “আর মা? মা কই?”

    সবাই হঠাৎ করে চুপ করে যায়। বড় চাচি বলল, “তোর বইনটা যখন মরল তখন তোর মা খালি কান্দে–” এইটুকুন বলে বড় চাচি থেমে যায় মনে হয় কী বলবে বুঝতে পারে না।

    মেজো চাচি বলল, “তুইও নাই। তোর মা একলা একলা থাকে। কান্নাকাটি করে।”

    বড় চাচি বলল, “মুরুব্বিরা কইল, একলা থাকা ঠিক না–”

    মেজো চাচি বলল, “তখন, তখন,-” বাক্যটা শেষ করতে পারল না মেজো চাচি থেমে গেল।

    তখন ছোট একটা বাচ্চা আনন্দে হি হি করে হেসে বলল, “তখন বিয়া দিয়া দিছে!”

    জালাল কথাটা শুনে বিশ্বাস করতে পারল না, বলল, “বিয়া?”

    একবার বিষয়টা বলে দেওয়ার পর কথা বলা সহজ হয়ে গেল। বড় চাচি বলল, “হ। জামাইয়ের অবস্থা বালা। বয়স একটু বেশি। তর মাও তো আর কমবয়সী ছেমরি না–”

    মেজো চাচি বলল, “আগের বউয়ের বয়স হইছে, দেখনের একটা মানুষও তো লাগে–”

    জালাল শুকনো গলায় বলল, “বিয়া? মায়ের বিয়া দিছ? আমার মায়ের?”

    ঠিক কী কারণ কে জানে ছোট একটা বাচ্চা হি হি করে হেসে উঠল আর জালাল তখন দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। কাঁদতে কাঁদতে সে তখন উঠান থেকে ছুটে বের হয়ে যায়-বাংলাঘরের পাশ দিয়ে ছুটতে ছুটতে সে একেবারে সড়কের পাশে গেল, তারপর সেই সড়কের একপাশে বসে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। বোনটা মারা গেছে সেই জন্যে কাঁদছে, না মাকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে সেই জন্যে কাঁদছে, সে নিজেও জানে না।

    তার পিছু হাঁটতে হাঁটতে এবং দৌড়াতে দৌড়াতে বেশ কিছু বাচ্চা এসে হাজির হয়েছে। তাদের জন্যে জালালের ফিরে আসাটা অনেক বড় ঘটনা। তারা জালালের থেকে একটু দূরে বসে খুব মনোযোগ দিয়ে তাকে লক্ষ করতে থাকে।

    বেশ খানিকক্ষণ পর জালাল চোখ মুছে একটু শান্ত হল। তখন মুখ তুলে সে বসে থাকা বাচ্চাগুলোর দিকে তাকাল। তার একজন চাচাত বোন বলল, “কান্দিস না। কাইন্দা কী লাভ?”

    “আমার বইনরে কই কবর দিছে?”

    “পুষুনি পাড়ে।”

    “বাবার কবরের লগে?”

    “হ।”

    “আর মায়ের বিয়া?”

    “কচুখালি।”

    জালাল মাথা নাড়ল। কচুখালি কাছাকাছি একটা গ্রাম। কচুখালি গ্রামের মানুষ একটু বোকা ধরনের হয় বলে সবাই জানে।

    “বিয়ার সময় মা কী কানছিল?”

    চাচাতো বোন মাথা নাড়ল, বলল, “হ। অনেক কানছিল। বিয়া করবার চায় নাই। জোরে বিয়া দিছে।”

    “কেন বিয়া দিল? বিয়া দেওনের কী দরকার হইছিল?”

    জালালের কথার কেউ উত্তর দিল না।

    .

    দুপুরবেলা জালাল হেঁটে হেঁটে পাশের কচুখালি গ্রামে হাজির হল। তার মায়ের যার সাথে বিয়ে হয়েছে তার নাম আসাদ্দর আলী। আসাদ্দর আলী এমন কিছু গণ্যমান্য মানুষ নাকচুখালি গ্রামের মতো ছোট একটা গ্রামেও মানুষজন তাকে ভালো চিনে না। শেষ পর্যন্ত গ্রামের এক কোনায় একটা ডোবার সামনে জালাল আসাদ্দর আলীর বাড়িটা খুঁজে পেল, তার বড় চাচি বলেছিল অবস্থা ভালো কিন্তু দেখে সেটা মনে হল না। বাড়ির সামনে দুইটা হাড়জিরজিরে গরু বেঁধে রাখা আছে। কয়েকটা বাচ্চা কাদামাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে খেলছে।

    ।জালাল কিছুক্ষণ বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, ঠিক কীভাবে এই বাড়ি থেকে তার মাকে খুঁজে বের করবে বুঝতে পারছিল না। ঠিক তখন ভেতর থেকে একজন বুড়ো মানুষ হুঁকো খেতে খেতে বের হয়ে এলো। জালালকে দেখে ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “কারে চাও?”

    “আমার মায়েরে।”

    “তোমার মা কেডা?”

    জালাল ঠিক বুঝতে পারল না সে কীভাবে মায়ের পরিচয় দিবে। এ বাড়িতে আসাদ্দর আলীর সাথে বিয়ে হয়েছে বলতে তার কেমন জানি লজ্জা লাগল। এই বুড়ো মানুষটাই আসাদ্দর আলী কী না কে জানে। আমতা আমতা করে বলল, “আমার মা–আমার মা–হের নাম–” জালাল হঠাৎ করে আবিষ্কার করল সে তার মায়ের নাম জানে না। তখন বাধ্য হয়ে তাকে বলতেই হল, “এই বাড়িত বিয়া হইছে–”

    তখন হঠাৎ করে মানুষটা জালালের মাকে চিনতে পারল। সে মাথা নাড়তে নাড়তে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল এবং একটু পরেই জালাল দেখল তার মা সবুজ রঙের একটা শাড়ি পরে বের হয়ে এসেছে। শুকনো মুখ, চোখে-মুখে এক ধরনের ক্লান্তির ছাপ। জালালকে দেখে মা কেমন যেন চমকে উঠল, কাছে এসে অবাক হয়ে বলল, “জালাল! তুই?”

    জালাল মাথা নাড়ল। তার খুব ইচ্ছা করছিল মা’কে জাপটে ধরে কিন্তু সে পারল না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। মা কাছে এসে তার হাত ধরে বলল, “বাবা! তুই বাইচা আছস? আমারে যে সবাই কইল তুই মইরা গেছস?”

    জালাল মাথা নাড়ল, বলল, “না। মরি নাই।”

    মা জালালের গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে দিল তারপর হঠাৎ শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। জালালও তখন তার মা’কে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। মা কাঁদতে কাঁদতে তার বোনের কথা বলতে লাগল, কেমন করে না খেতে পেয়ে শুকিয়ে কাঠির মতো হয়ে গিয়েছিল তখন বড় বড় চোখে শুধু তাকিয়ে থাকত। মারা গিয়ে সে শান্তি পেয়েছে কাঁদতে কাঁদতে ঘুরে ফিরে সেই কথাটাই বারবার করে বলল।

    একটু পর কান্না থামিয়ে মা জালালকে জিজ্ঞেস করল, “তুই কই থাকস? কী করস? তোর চিন্তায় বাবা আমার মনে কুনো শান্তি নাই।”

    “তুমি আমার লাগি চিন্তা কইর না। আমি ভাল আছি।”

    “কই থাকস?”

    স্টেশনের প্লাটফর্মে একটা কুকুরকে জড়িয়ে ঘুমায় কথাটা বলতে জালালের লজ্জা করল। তার কী হল কে জানে, হঠাৎ করে বলে ফেলল, “আমি একজনের বাড়িতে থাকি মা।”

    “কার বাড়ি?”

    একটা মিথ্যা কথা বললে আরো অনেক মিথ্যা কথা বলতে হয়। তাই সে মিথ্যা বলতে শুরু করল, “স্কুলের মাস্টারনি। আমারে নিজের ছেলের মতো দেখে।”

    “সত্যি?” আনন্দে মায়ের চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।”তোরে আদর করে?”

    “অনেক আদর করে।”

    “মাস্টারনির জামাই কী করে?”

    “ঢাকা শহরে চাকরি করে।”

    “বাড়ি থাকে না?”

    “না। ছুটি হইলে আহে।”

    “খাওয়া-দাওয়ার কষ্ট হয় না তো?”

    “কী বল মা। কুনু কষ্ট নাই। কুনোদিন মাছের ছালুন, কুনোদিন মুরগির গোস্ত–খাওয়ার কুনো কষ্ট হয় না।”

    মা জালালের মুখে হাত বুলিয়ে বলল, “এতো খাওয়া-দাওয়া হলে স্বাস্থ্যটা আরো ভালা হয় না কেন?”

    “কয়দিন আগে জ্বর হইছিল, হেই জন্যে মনে হয় শুকনা লাগে।”

    মা বোকাসোকা মানুষ। কোনো সন্দেহ না করে জালালের কথা বিশ্বাস করে ফেলল। জালাল তখন পলিথিনের ব্যাগ থেকে মায়ের শাড়িটা বের করে দিল, বলল, “মা এইটা আনছি তোমার লাগি।”

    মা অবাক হয়ে বলল, “আমার লাগি?”

    “হ মা।”

    “টেহা কই পাইলি?”

    জালাল ইতস্তত করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তখন মা নিজেই বলল, “মাস্টারনি কিন্যা দিছে?”

    জালাল জোরে জোরে মাথা নাড়ল, বলল, “হ।”

    মা শাড়িটা খুলে দেখল, নীল জমিনের উপর কমলা রঙের ফুল ফুল শাড়িটা দেখে তার মুখে হাসি ফুটে উঠল, বলল, “মাস্টারনির মনটা খুব ভালা?”

    “হ।”

    “তুই মাস্টারনিরে কী ডাকস?”

    “খালা।”

    “তোরে ছেলের মতো আদর করে–তুই মা ডাকস না কেন?”

    “শরম করে।”

    “শরমের কী আছে? মা ডাকবি।”

    “ঠিক আছে।”

    “মাস্টারনির আর ছেলেমেয়ে নাই?”

    “আছে, আরো দুইটা মেয়ে আছে।”

    “কী নাম?”

    একটুও দেরি না করে জালাল বলল, “বড়জনের নাম জেবা, ছোটজন মায়া।”

    মা মাথা নাড়ল, বলল, “তাগো সাথে রাগারাগি মারামারি করস না তো?”

    জালাল একটু হাসল, বলল, “মাঝেমধ্যে একটু করি। আবার মিলমিশ হয়া যায়।”

    “তরে স্কুলে পাঠায় না?”

    “পাঠাইবার চায়। সবসময় স্কুলে যাবার কথা বলে।“

    ”তুই যাইবার চাস না?”

    জালাল মাথা নাড়ল, “না।”

    “কেন?”

    “লেখাপড়া ভালা লাগে না।”

    মা তখন লেখাপড়ার গুরুত্ব নিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলল, “তারপর বলল, “স্কুলে যাবি। অবশ্যি স্কুলে যাবি।”

    জালাল বলল, “ঠিক আছে মা। যামু।”

    মা তখন জালালের শার্ট-প্যান্টটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। তারপর বলল, “এই জামা-কাপড় তোর খালায় দিছে?”

    “হ।“

    “তয় একজোড়া জুতা দিল না কেন?”

    “দিছে তো। আমার পরবার মন চায় না।”

    “জুতা পাও দেওয়া অভ্যাস করা দরকার। ভদ্রলোকেরা সবসময় জুতা পরে।”

    জালাল মাথা নাড়ল। মা বলল, “বড়লোক আর ছোটলোকের মাঝে পার্থক্য হইল জুতার মাঝে। বুঝছস?”

    জালাল মাথা নেড়ে জানাল সে বুঝেছে।

    বিকালবেলা জালাল তার মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে এলো। জালাল তার বোনের জন্যে কেনা লাল ফ্রকটাও তার মাকে দিয়ে দিল। আসাদ্দর আলীর অনেকগুলো ছেলেমেয়ে–কোনো একজনের গায়ে লেগে যাবে। মা তার খালার জন্যে দুইটা পেঁপে দিয়ে দিল–জালাল নিতে চাচ্ছিল না কিন্তু মা জোর করল, জালাল তখন না করল না।

    জালাল যেতে যেতে একবার পিছন ফিরে তাকায়, ডোবার পাশে নারকেল গাছটার নিচে মা দাঁড়িয়ে আছে, অনেক দূর থেকেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে টপ টপ করে মায়ের চোখ থেকে পানি পড়ছে।

    জালাল একটু নিশ্বাস ফেলল, তার মা কয়দিন বাঁচবে কে জানে–কিন্তু যে কয়দিনই বাঁচুক মনের মাঝে একটা শান্তি থাকবে, তার ছেলেটা খুব ভালো আছে। কোনো একজন মহিলা নিজের ছেলের মতো আদর করে তাকে বড় করছে। এইটা সত্যি না হলে কী আছে? মা জানবে এটা সত্যি। জালাল ফিরে যাবার সময়ে পেঁপে দুইটা নগদ বারো টাকায় বিক্রি করে ফেলল।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleএকটুখানি বিজ্ঞান – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
    Next Article আরো একটুখানি বিজ্ঞান – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    Related Articles

    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    ছোটগল্প – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    সাদাসিধে কথা – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    মেকু কাহিনী – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    আমার বন্ধু রাশেদ – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    সায়েন্স ফিকশান সমগ্র ১ – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    টুনটুনি ও ছোটাচ্চু – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }