Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ইস্টিশন – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    মুহম্মদ জাফর ইকবাল এক পাতা গল্প155 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ০৭-৯. অসম্ভব শীত

    রিকশা থেকে নামতে নামতে ইভা টের পেল অসম্ভব শীত পড়েছে। এই দেশে এতো শীত পড়তে পারে সে কখনো কল্পনাই করতে পারে না। বড় একটা সোয়েটার পরেছে তার উপর একটা ভারি কোট। একটা স্কার্ফ দিয়ে মাথা-মুখ সবকিছু ঢেকে রেখেছে তারপরও সে ঠকঠক করে কাঁপছে। রিকশা দিয়ে আসার সময় হুডটা হাত দিয়ে ধরেছিল, মনে হচ্ছিল বরফের ছুরি দিয়ে হাতটাকে কেউ ফালি ফালি করে কেটে ফেলছে। গত সপ্তাহেও বোঝা যায়নি এরকম ঠাণ্ডা পড়বে, মাঝখানে হঠাৎ একটু বৃষ্টি হল তারপর থেকে এরকম ঠাণ্ডা। আজ সকাল থেকে কুয়াশায় সূর্যটা ঢেকে আছে, বাতাসটা কেমন জানি ভেজা ভেজা, দুপুর হয়ে গেছে এখনো সূর্যটার দেখা নেই। একটুখানি রোদের জন্যে ইভার সারা শরীর আঁকুপাকু করতে থাকে।

    স্টেশনে ঢোকার সময় ইভা বাচ্চাগুলোকে খুঁজল, এই শীতে তাদের কী অবস্থা কে জানে। আশেপাশে কেউ নেই, কিন্তু একটু পরেই নিশ্চয়ই সবাই এসে হাজির হবে।

    ইভা প্লাটফর্মের এক কোনায় হেঁটে যায়, হিল হিল করে কোথা থেকে জানি ঠাণ্ডা বাতাস আসছে, সেই বাতাস থেকে রক্ষা পাবার জন্যে তার ইচ্ছে করছিল ওয়েটিং রুমের ভেতরে ঢুকে অপেক্ষা করে, কিন্তু ঘিঞ্জি ঘরের ভেতরে তার ঢোকার ইচ্ছে হল না। তা ছাড়া সেখানেও কোনো ফাঁক দিয়ে যে বাতাস ঢুকবে না তার কোনো গ্যারান্টি নেই।

    ইভা প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে দুই হাত ঘষে হাত দুটো একটু গরম করার চেষ্টা করল তারপর মুখের কাছে এনে জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলল, মনে হয় নিশ্বাসের সাথে সাথে নাক-মুখ থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। ইভা প্লাটফর্মের চারিদিকে তাকায়, আজকে মানুষজন বেশ কম। অসম্ভব ঠাণ্ডা পড়েছে বলেই হয়তো কেউ বের হয়নি। ইভা দুই নম্বর প্লাটফর্মের দিকে তাকাল এবং হঠাৎ করে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল।

    তিন-চার বছরের কুচকুচে কালো একটা ছেলে দুই নম্বর প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে, তার শরীরে একটা সুতো পর্যন্ত নেই। এই ভয়ংকর শীতে পুরোপুরি উদোম গায়ে এই বাচ্চাটি উদাসমুখে দাঁড়িয়ে আছে-অবিশ্বাস্য একটি দৃশ্য। ইভা হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, এটি কেমন করে সম্ভব? সে এতোগুলো গরম কাপড় পরে ঠকঠক করে কাঁপছে, তার মাঝে এই তিন-চার বছরের বাচ্চা কেমন করে ন্যাংটা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে? বাচ্চাটি কার? মা-বাবা কই? তার ঠাণ্ডা লাগে না কেন?

    ঠিক এরকম সময় সে দূর থেকে বাচ্চাদের আনন্দধ্বনি শুনতে পেল, “দুই টেকি আপা! দুই টেকি আপা।”

    দেখতে দেখতে বেশ কয়েকটা বাচ্চা তাকে ঘিরে ফেলল। বাচ্চাগুলো নানা ধরনের ময়লা জাব্বাজোব্বা পরে আছে, তবে সবারই খালি পা। ছোট কয়েকজনের নাক থেকে সর্দি ঝুলে আছে। ইভার কাছাকাছি এসে নাকে টান দিয়ে সর্দিটা ভেতরে টেনে নিল, একটু পর আবার সর্দিটা বের হয়ে নাকের সামনে ঝুলতে থাকে, বিষয়টি নিয়ে বাচ্চাগুলোর খুব একটা মাথা ব্যথা আছে বলে মনে হয় না।

    মায়া তার ফোকলা দাঁত বের করে একটা হাসি দিয়ে বলল, “আমরা পেরতম আফারে চিনতি পারি নাই।”

    ইভা যেভাবে শীতের জন্যে জাব্বাজোব্বা পরেছে তাকে চেনার কথা না। সে বলল, “কী শীত পড়েছে, দেখেছ?”

    বাচ্চাগুলো মাথা নাড়ল, বলল, “জে আপা। অনেক শীত।”

    ইভা দুই নম্বর প্লাটফর্মের ন্যাংটা কুচকুচে কালো ছেলেটাকে দেখিয়ে বলল, “ঐ বাচ্চাটার ঠাণ্ডা লাগে না–এতো শীতে গায়ে কোনো কাপড় নাই, দেখেছ?”

    সবাই একসাথে হইহই করে উঠল, বলল, “ঐটা কাউলা।”

    “কাউলা? ওর নাম কাউলা?” জেবা মাথা নেড়ে বলল, “হের কুনো নাম নাই।”

    “নাম নেই?”

    “জে না। এর মা ফাগলি, হেরে কুনো নাম দেয় নাই।”

    “মা কোনো নাম দেয়নি?”

    “জে না।”

    “ওর ঠাণ্ডা লাগে না?”

    “জে না, হের ঠাণ্ডা-গরম কিছু নাই। হে কথাও কয় না।”

    ইভা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কথাও বলে না?”

    “জে না। হেরে কিছু জিগাইলে হে খালি চায়া থাকে।”

    “ওর মা কোথায়?”

    একজন দূরে সিঁড়ির দিকে দেখাল, “হুই যে ঐখানে থাকে। ফাগলি।”

    ইভা জানতে চাইল, “এখন কী আছে?”

    বাচ্চাগুলো মাথা নাড়ল, বলল, “জানি না।”

    “একটু দেখে আসি।”

    ইভা তার ব্যাগটা হাতে নিয়ে রেল লাইনগুলো পার হয়ে দুই নম্বর প্লটফর্মে গেল। তাকে ঘিরে অন্যান্য বাচ্চারাও সেখানে হাজির হল। কালো বাচ্চাটা এক ধরনের উদাস দৃষ্টিতে তাদের সবার দিকে তাকিয়ে থাকে। ইভা একটু কাছে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করল, “তোমার নাম কী?”

    বাচ্চাটা কোনো কথা না বলে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। ইভার কথাটা বুঝতে পেরেছে বলে মনে হল না। ইভা আবার জিজ্ঞেস করল, “তোমার ঠাণ্ডা লাগে না?”

    বাচ্চাটি এবারেও কোনো কথা বলল না। মজিদ দাঁত বের করে হি হি করে হাসল, বলল, “এর মা ফাগলি আর হে ফাগল!”

    পাগলের সাথে ঠাট্টা-তামাশা করার সবারই সবসময় একটা অধিকার আছে সেটা প্রমাণ করার জন্যেই মজিদ বাচ্চাটাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল এবং সেটা দেখে সবাই আনন্দে হি হি করে হেসে উঠল। ইভা হা হা করে উঠে বলল, “কী হল? কী হল? ওকে ফেলে দিলে কেন?”

    ইভা বাচ্চাটাকে তোলার জন্যে এগিয়ে যায় কিন্তু তার আগেই বাচ্চাটা নিজেই উঠে দাঁড়াল। তাকে দেখে মনে হল কিছুই হয়নি এবং চারপাশের লোকজন তার সাথে দেখা হলেই তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিবে সেটাই সে নিয়ম হিসেবে ধরে নিয়েছে।

    ইভা মজিদের দিকে তাকিয়ে একটু কঠিন গলায় বলল, “কাজটা ঠিক হয়নি। ছোট একটা বাচ্চাকে শুধু শুধু ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলে কেন?”

    জেবা মজিদকে সাহায্য করার চেষ্টা করল, বলল, “কাউলাকে মারলেও হে দুখ পায় না। আপনি দেখবার চান? দেখামু?”

    ইভা হা হা করে উঠল, বলল, “না, না! দেখাতে হবে না।”

    শাহজাহান বলল, “হের মা যখন মারে কাউলা কান্দে না।”

    “তার মানে না যে তোমরাও ওকে মারবে।”

    দাঁড়িয়ে থাকা বাচ্চাগুলো মনে হল তার কথা শুনে একটু অবাক, কিন্তু কেউ কিছু বলল না। যে মানুষ দেখা হলেই দুই টাকা দিয়ে দেয় তার কথাগুলো মেনে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। শুধু জালাল মাথা নেড়ে বলল, “ঠিক আছে।”

    ইভা জালালের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি ওকে দেখে রাখবে?”

    দেখে রাখা মানে কী এবং কীভাবে একটা পাগলি মায়ের ছেলেকে দেখে রাখতে হয় জালাল সেটা বুঝতে পারল না। তারপরও সে মাথা নাড়ল, বলল, “রাখমু আপা।–”

    “শুধু ওকে না, তোমাদের সবার সবাইকে দেখে রাখতে হবে। বুঝেছ?”

    ওরা কে কী বুঝল কে জানে কিন্তু সবাই গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়ল। ইভা তখন তার ব্যাগ খুলে সবাইকে তাদের পাওনা দুটি টাকা ধরিয়ে দিতে থাকে। পাগলি মায়ের উদোম ছেলেটার দিকেও সে দুই টাকার একটা নোট বাড়িয়ে দেয়, সাথে সাথে সে খপ করে টাকাটা নিয়ে হাতটা মুঠি করে ফেলল যেন কেউ তার টাকাটা নিয়ে নিতে না পারে।

    টাকা পাবার পর একজন একজন করে সবগুলো বাচ্চা এদিক-ওদিক সরে পড়ল শুধু জালাল ইভার কাছাকাছি থেকে গেল। ইভা জালালকে জিজ্ঞেস করল, “এই বাচ্চাটাকে একটা কাপড় দিলে কেমন হয়?”

    জালাল মাথা নাড়ল, “লাভ নাই।”

    “লাভ নেই?”

    “না, হে কিছু বুঝে না।”

    “তবু একটু চেষ্টা করে দেখি। কী বল?”

    জালাল মাথা নাড়ল। ইভা তখন তার ব্যাগ খুলে সেখান থেকে একটা চাদর বের করে, চাদরটা ভাঁজ করে একটু ছোট করে সে বাচ্চাটার গায়ে ভালো করে জড়িয়ে দিল। ছোট বাচ্চাটা মনে হল বেশ আগ্রহ নিয়ে পুরো ব্যাপারটা লক্ষ করল তারপর শরীর থেকে চাদরটা খুলে নিয়ে সেটাকে ধরে টেনে নিয়ে হাঁটতে শুরু করে। ইভা আর জালাল পিছু পিছু গেল, দেখল বাচ্চাটি চাদরটাকে মাটির সাথে ঘষতে ঘষতে টেনে নিয়ে সিঁড়ির নিচের দিকে যাচ্ছে। সেখানে গুটিশুটি মেরে তার মা বসে আছে, শীতে জবুথবু, চোখের দৃষ্টি অপ্রকৃতস্থ। ছোট বাচ্চাটি চাদরটা নিয়ে তার মায়ের গায়ে ফেলে দেয়, তার মা সাথে সাথে চাদরটা তার গায়ে ভালো করে জড়িয়ে নড়েচড়ে বসে বিড়বিড় করে নিজের মনে কথা বলতে লাগল। তাকে দেখে মনে হল এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার যে তার তিন-চার বছরের উদোম বাচ্চাটি একটা চাদর এনে তাকে সেটা দিয়ে ঢেকে দেবে। মা’কে চাদর দিয়েই বাচ্চাটি চলে গেল না, গোঙানোর মতো একটা শব্দ করল তারপর মুঠি করে ধরে রাখা দুই টাকার নোটটা তার মায়ের দিকে ছুঁড়ে দিল। মা নোটটা ধরে উল্টেপাল্টে দেখে তার পায়ের নিচে চাপা দিয়ে রেখে আবার কথা বলতে থাকে।

    ইভা কী করবে বুঝতে না পেরে একটা নিশ্বাস ফেলে সরে আসে, চাপা একটা বোটকা গন্ধ, বেশিক্ষণ থাকাও সম্ভব না। জালাল বলল, “কামটা ঠিক হয় নাই।”

    “কোন কাজটা ঠিক হয় নাই?”

    “আফনের এতো সোন্দর চাদরটা ফাগলিরে দিলেন। ফাগলি এইটারে নষ্ট করব।”

    “গায়ে দেবে। গায়ে দিলে তো নষ্ট হয় না। ব্যবহার হয়।”

    “কিন্তুক আফনের চাদর–”

    “আমার আরো চাদর আছে। এটা পুরানো একটা চাদর এমন কিছু না।”

    ইভা তারপর রেল লাইন পার হয়ে আবার তার নিজের পাটফর্মে ফিরে আসে, জালালও তার পিছু পিছু আসে। হাঁটতে হাঁটতে ইভা জিজ্ঞেস করল, “তোমার মিনারেল ওয়াটারের বিজনেস কেমন হচ্ছে?”

    জালাল উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করল। একটু পরে মাথা তুলে বলল, “আফা, আফনে কী আমারে ঘিন্না করেন?”

    “ঘেন্না? কেন, ঘেন্না করব কেন?”

    “এই যে আমি চুরি-চামারি করি। ভুয়া মিনারেল ওয়াটার বেচি।”

    ইভা জালালের মুখের দিকে তাকাল, তার কাচুমাচু অপরাধী মুখ দেখে হঠাৎ তার কেমন জানি এক ধরনের মায়া হয়। এই বাচ্চাগুলোর এখন বাবা-মা ভাইবোনের সাথে থাকার কথা, স্কুলে লেখাপড়া করার কথা, রাত্রে বাসার ভেতরে ছাদের নিচে ঘুমানোর কথা। তার বদলে এরা খোলা আকাশের নিচে থাকে, একটুখানি পেট ভরে খাবার জন্যে চুরি-চামারি করে, ঝগড়াঝাটি করে আবার সেই জন্যে নিজেকে অপরাধীও ভাবে!

    ইভা জালালের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “না। আমি তোমাকে মোটেও ঘেন্না করি না।” তারপর কী মনে হল কে জানে, এই বাচ্চাটা কথাটার অর্থ ভালো করে বুঝবে না জেনেও বলল, “আমি জানি তুমি যদি ভালো করে বেঁচে থাকার সুযোগ পেতে তা হলে তুমি নিশ্চয়ই চুরি-চামারি করতে না। ভুয়া মিনারেল ওয়াটার বিক্রি করতে না।”

    জালাল এই গুরুগম্ভীর কথাটা বুঝতে পেরেছে কি না কে জানে, কিন্তু ইভা দেখল সে গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ছে।

    ইভা জালালের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোমার বাবা-মা ভাইবোন নেই?”

    “খালি মা আছে।”

    “মায়ের কাছে যাও না?”

    “গেছিলাম–” তারপর যে কথাটা সে আর কাউকে বলে নাই সেটা ইভাকে বলে ফেলল, “আমার মায়েরে জুরে বিয়া দিয়া দিছে।”

    “তোমার মাকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে?”

    “জে।”

    ইভা কী বলবে বুঝতে পারল না। চুপ করে জালালের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। জালাল বলল, “হেইদিন মায়ের সাথে দেখা কইরা আইলাম।”

    “কেমন আছেন তোমার মা?”

    “ভালা নাই।” কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আমি মায়ের মন ভালা রাখনের লাগি তার লগে মিছা কথা কইয়া আইছি।”

    “কী মিছে কথা বলেছ?”

    “এই তো–” বলে জালাল একটু লজ্জা পেয়ে গেল।

    ”শুনি কী মিছে কথাটা বলেছ।”

    “আমি মায়েরে কইছি একজন বড়লোক বেটি আমারে নিজের ছাওয়ালের মতো পালে-” কথা শেষ করে জালাল অপ্রস্তুতভাবে হি হি করে হাসল।

    “তোমার মা তোমার কথা বিশ্বাস করেছে?”

    “জে, করছে। আমার মা বোকা কিসিমের। যেইটাই কইবেন সেইটাই বিশ্বাস করে।”

    ইভা কী বলবে বুঝতে পারল না, তাই মুখে জোর করে একটু হাসি টেনে এনে মাথা নাড়ল, ঠিক তখন একটা টেলিফোন চলে আসায় ইভাকে কোনো কথা বলতে হল না, সে টেলিফোনটা ধরল। অফিসের একজনের সাথে সে খানিকক্ষণ কাজের কথা বলল। যতক্ষণ সে কথা বলল ততক্ষণ জালাল ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করল। কথা শেষ হবার পর লাজুক মুখে বলল, “আফা। আমারে আফনার মোবাইল নম্বরটা দিবেন?”

    ইভা অবাক হয়ে বলল, “মোবাইল নাম্বার? আমার?”

    “জে।”

    “কেন? কী করবে?”

    “এমনিই। নিজের কাছে রাখুম। মাঝে মাঝে আফনেরে ফোন দিমু।”

    “আমাকে ফোন দেবে? কোত্থেকে?”

    “মোবাইলের দোকান থিকে।”

    ইভা একটু হাসল তারপর ব্যাগ থেকে নিজের একটা কার্ড বের করে উল্টোপিঠে তার মোবাইল টেলিফোনের নম্বরটা লিখে জালালের দিকে এগিয়ে দিল। জালাল কার্ডটা উল্টোপাল্টে দেখে নাম্বারটা পড়ার চেষ্টা করল।

    ইভা জিজ্ঞেস করল, “তুমি লেখাপড়া জান?”

    “একটু একটু।”

    ইভা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সে যেখানে কাজ করে সেখানে লেখাপড়ার ব্যাপারে সচেতনতা তৈরি করার উপর তাকে মাঝে মাঝেই বক্তৃতা দিতে হয়। এই বাচ্চাটির সামনে সে যদি লেখাপড়ার গুরুত্ব নিয়ে সেরকম একটা বক্তৃতা দেয় তা হলে সেটা কি একটা বিশাল ঠাট্টার মতো শুনাবে না?

    এরকম সময় দূর থেকে ট্রেনটার একটা হুইসিল শোনা গেল। সাথে সাথে জালাল চঞ্চল হয়ে ওঠে। সে সেলুট দেওয়ার ভঙ্গি করে ইভাকে বলল, “আফা। ট্রেন আইছে। আমি যাই।”

    ইভা বলল, “যাও।”

    সাথে সাথে জালাল দৌড়াতে থাকে। ইভা দেখল ট্রেনটা প্লাটফর্মে ঢোকা মাত্র জালাল কীভাবে লাফিয়ে চলন্ত ট্রেনটাতে উঠে পড়ল।

    .

    সন্ধ্যেবেলা শীতটা মনে হয় আরো তীব্রভাবে নেমে এলো। স্টেশনের বাচ্চারা তখন শরীর গরম করার জন্যে একটু আগুন জ্বালিয়ে নেয়। সবাই মিলে চারিদিক থেকে কাঠকুটো, কাগজ, গাছের শুকনো ডাল কুড়িয়ে আনে, তারপর সেগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়। দেখতে দেখতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে আর সবাই গোল হয়ে বসে আগুন পোহাতে থাকে।

    আগুনে হাত-পা গরম করতে করতে মায়া জেবাকে বলল, “আফা, একটা গফ করবা।”

    জেবা খুশি হয়ে বলল, “কীসের গফ?”

    মায়ার সবচেয়ে প্রিয় হচ্ছে পেত্নীর গল্প তাই সে বলল, “পেততুনীর।”

    “ডরাইবি না তো?”

    “না। ডরামু না। কও।”

    তখন জেবা সবাইকে একটা পেত্নীর গল্প বলে। তার গ্রামের বাড়িতে পাশের বাড়ির একটা বউ কীভাবে গলায় দড়ি দিয়ে মরে পেত্নী হয়ে গিয়েছিল সেই গল্প। এরপর থেকে অমাবস্যার রাতে সেই পেত্নী বাশঝাড়ের নিচে দাঁড়িয়ে থাকত। কেউ যখন সেই বাশঝাড়ের নিচে দিয়ে যেত তখন একটা বাঁশ নিচু হয়ে তার পথ আটকে দিত। মানুষটা যখন ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করত তখন পিছন দিকে আরো একটা বাঁশ নেমে এসে তাকে দুই বাঁশের মাঝখানে আটকে ফেলত। ভোরবেলা দেখা যেত মানুষটা মরে পড়ে আছে। ঘাড়টা ভাঙা আর সারা শরীরে কোনো রক্ত নাই, পেত্নী শুষে সব রক্ত খেয়ে নিয়েছে।

    সেই ভয়ংকর গল্প শুনে সবাই শিউরে ওঠে। মায়া ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে, “আফা। সবুজ ভাইও কী ভূত হইছে?”

    জেবা মাথা নাড়ল, বলল, “মনে হয় হইছে।”

    “হে কী আয়া আমাগো ডর দেহাইব?”

    জেবা গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল, বলল, “মনে লয় আইতেও পারে। তার হেরোইনের প্যাকেট খুঁজতি আইতে পারে।”

    জালাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, সবুজ যদি তার হেরোইনের প্যাকেট খুঁজতেও আসে, আর কোনোদিন সেটা খুঁজে পাবে না।

    .

    রাত্রিবেলা সবাই সারি সারি শুয়ে পড়ল। শীত থেকে বাঁচার জন্যে তারা বস্তা জোগাড় করেছে, তার ভেতরে খবরের কাগজ বিছিয়ে সেখানে গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকে। প্রচণ্ড শীতে ঘুম আসতে দেরি হয়, পাশাপাশি শুয়ে একজনের শরীরের উত্তাপ আরেকজন ভাগাভাগি করে নিয়ে কোনোমতে ঘুমানোর চেষ্টা করে।

    গভীর রাতে জালালের ঘুম ভেঙে যায়, জেবা তাকে ডেকে তোলার চেষ্টা করছে। চোখ খুলে বলল, “কী হইছে?”

    “কলেজের ছেইলে-মেয়েরা আইছে।”

    জালাল তখন ধড়মড় করে উঠে বসল, “কম্বল আনছে?”

    “মনে লয়।”

    প্রত্যেক বছরই যখন খুব শীত পড়ে তখন কলেজের ছেলেমেয়েরা শীতের। কাপড়, কম্বল এসব নিয়ে আসে, পথে-ঘাটে ঘুমিয়ে থাকা মানুষদের দেয়। কখনোই বেশি থাকে না সবাইকে দেওয়ার আগেই শেষ হয়ে যায়। তাই কার আগে কে নিতে পারে সেটা নিয়ে কাড়াকাড়ি লেগে যায়।

    জালাল তার বস্তা থেকে বের হবার আগেই কলেজের ছেলেমেয়েরা এগিয়ে আসে। একজন বলল, “এইখানে কয়টা বাচ্চা আছে।”

    আরেকজন বলল, “গুড। এটা চমৎকার একটা ছবি হবে।”

    কলেজের ছেলেমেয়েগুলো তাদের পাশে হাঁটু গেড়ে বসল। কম বয়সী সুন্দর একটা মেয়ে একটা কম্বল বের করে তাদের দিকে এগিয়ে দেয়। জেবা কম্বলটা ধরে রাখল তখন একজন একটা ছবি নিল। ফ্লাশের আলোতে তাদের চোখ ধাঁধিয়ে যায়–যে ছবি তুলেছে সে ছবিটা দেখে বলল, “বিউটিফুল!”

    জালাল ব্যস্ত হয়ে বলল, “আমারে–আমারে একটা।”

    সুন্দর মেয়েটা আরেকটা কম্বল বের করে তার দিকে এগিয়ে দিচ্ছিল তখন ক্যামেরা হাতে ছেলেটা তাকে থামাল, বলল, “না না, এখানে আর দিও না। স্টেশনের অলরেডি দুইটা ছবি হয়ে গেছে। এখন ফুটপাথের জন্যে রাখ। ফুটপাথের ছবি তুলতে হবে।”

    জালাল বলল, “খোদার কসম লাগে–একটা দেন–”

    ছেলেটা মাথা নাড়ল, বলল, “আর দেওয়া যাবে না।”

    তারপর ফুটপাথে কম্বল দেওয়ার”বিউটিফুল” আরেকটা ছবি তোলার জন্যে ছেলেমেয়েগুলো হইহই করে চলে যেতে লাগল।

    জালাল মনমরা হয়ে দাঁতের নিচ দিয়ে তাদের একটা গালি দেয়। জেবা হি হি করে হাসল, বলল, “জালাইল্যা-তোরেও মাঝে মাঝে এই কম্বল দিমু। বেজার হইস না।”

    জালাল তবুও বেজার হয়ে থাকল। ক্যামেরায় তার ছবিটা যদি সুন্দর আসত তা হলে তাকেই নিশ্চয়ই কম্বলটা দিত!

    জেবা অবশ্যি বেশিদিন কম্বলটা রাখতে পারল না। দুই সপ্তাহের মাঝে সেটা চুরি হয়ে গেল।

    .

    ০৮.

    মায়াকে দেখে জালাল অবাক হয়ে বলল, “তোর ঠোঁটে কী হইছে?”

    মায়ার ঠোঁট এবং তার আশেপাশের বেশ খানিকটা অংশ কটকটে লাল, সে তার কটকটে লাল ঠোঁট ফাঁক করে ফোকলা দাঁত বের করে একটা হাসি দিয়ে বলল, “লিপিস্টিক দিছি।”

    বড়লোকের মেয়ে কিংবা বউয়েরা ঠোঁটে লিপস্টিক দেয়, তার সাথে নিশ্চয়ই তাদের মুখে তারা আরো অনেক কিছু দেয়, যে কারণে তাদের দেখতে পরীর মতো সুন্দর দেখায়। মায়ার বেলায় সেটা ঘটেনি, তাকে দেখতে খানিকটা ভয়ংকর দেখাচ্ছে। মায়া জীবনে কখনো ঠোঁটে লিপস্টিক দেয়নি, কেমন করে দিতে হয় সেটা জানে না। তা ছাড়া এটা দেওয়ার জন্যে মনে হয় আয়নার দরকার হয়, কোথায় লিপস্টিক লাগানো হচ্ছে সেটা জানা থাকলে ভালো। মায়ার কোনো আয়না নেই, সে আন্দাজে দিয়েছে তাই শুধু ঠোঁট না–ঠোঁটের আশেপাশে বিশাল জায়গা জুড়ে লিপস্টিক থ্যাবড়া হয়ে লেগে আছে।

    জালাল জিজ্ঞেস করল, “লিপস্টিক কই পাইছস?”

    “একটা বেটি দিছে।”

    একজন মহিলা মায়ার মতো ছোট একটা মেয়েকে এতো জিনিস থাকতে লিপস্টিক কেন দিয়েছে জালাল বুঝতে পারল না, সেটা নিয়ে সে মাথাও ঘামাল না। মায়ার অবশ্যি অনেক উৎসাহ তাই সে তার প্যান্টে গুঁজে রাখা লিপস্টিকটা বের করে জালালকে দেখাল। ঢাকনা খুলে নিচে ঘোরাতেই টকটকে লাল লিপস্টিকটা লম্বা হয়ে বের হয়ে আসে, আবার অন্যদিকে ঘোরাতেই সেটা ভেতরে ঢুকে যায়। মায়া কয়েকবার লিপস্টিকটা বের করে আবার ভিতরে ঢুকিয়ে দেখাল। জালাল দেখল, এটা সত্যি সত্যি লিপস্টিক। কোনো একজন মহিলা সত্যি সত্যি মায়াকে একটা লিপস্টিক দিয়েছে।

    ঠোঁটে লিপস্টিক লাগানোর কারণেই কি না কে জানে মায়ার আজকের আয় রোজগার অন্যদিন থেকে বেশি হল।

    মায়ার লিপস্টিক দেখে জালাল যেরকম অবাক হয়েছিল, কয়দিন পর ঠিক সেরকম অবাক হল জেবার নেলপালিশ দেখে। একদিন রাতে ঘুমানোর আগে আগে জালাল অবাক হয়ে দেখল জেবা গভীর মনোযোগ দিয়ে তার নখে নেলপালিশ লাগাচ্ছে। জালাল জিজ্ঞেস করল, “নউখে কী লাগাস?”

    জেবা মুখ গম্ভীর করে বলল”নেইল ফালিশ।”

    “কই পাইলি?”

    “আমারে দিছে।”

    “কে দিছে?”

    “একজন বেটি।”

    জালাল বলল, “একজন বেটি তরে নেইল ফালিশ কেন দেয়?”

    “দিলে তর সমিস্যা আছে?” জেবা মুখ শক্ত করে বলল, “দুই টেহি আফা আমাগো সবাইরে দুই টেহা কইরা দেয় না?”

    কথাটা সত্যি, কোনো কিছুই তারা সহজে পায় না। আবার দুই টেকি আপার মতো মানুষও আছে যারা কিছু না চাইতেই দেয়। জালাল জিজ্ঞেস করল, “মায়ারে

    যে বেটি লিপিস্টিক দিছে তরে কী সেই বেটিই নেল পালিশ দিছে?”

    জেবা মাথা নাড়ল, বলল, “হ।”

    “আমাগো কিছু দিব না?”

    “হেইডা আমি কী জানি?”

    “আরেকদিন আইলে আমাগো কথা কইস।”

    জেবা বলল, “কমু। তোগো সবাইরে যেন একটা লিপিস্টিক দেয়। তারপর জেবা হি হি করে হাসতে থাকে।

    যেই মহিলা মায়াকে লিপস্টিক আর জেবাকে নেল পালিশ দিয়েছে তার সাথে জালালের দেখা হল দুইদিন পর। প্লাটফর্মের এক মাথায় সেই মহিলা মায়া আর জেবার সাথে কথা বলছে। মায়ার হাতে ঢলঢলে কয়েকটা চুড়ি, জেবার গলায় একটা প্লাস্টিকের মালা। কিছু একটা নিয়ে কথা হচ্ছে এবং সেই কথা শুনে মায়া আর জেবা দুইজনই হি হি করে হাসছে। মহিলাটির বয়স বেশি না, শক্ত-সমর্থ গঠন, পান খেতে খেতে পিচিক করে প্লাটফর্মের পাশের দেয়ালে পানের পিক ফেলে কী একটা বলল তখন মায়া আর জেবা দুইজনই আবার হেসে গড়িয়ে পড়ল।

    জালালকে আসতে দেখে তিনজনই হাসি থামিয়ে দেয়। জালাল কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হইছে? হাসির ব্যাপার কী হইছে?”

    মহিলাটি মুখ শক্ত করে ফেলল, মায়া কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল জেবা ঝপ করে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “তোর হেইডা জাননের দরকার কী?”

    এরকম একটা সহজ প্রশ্নের এরকম কঠিন একটা উত্তর শুনে জালাল একটু থতমত খেয়ে যায়। সে আস্তে বলল, “জাননের কুনো দরকার নাই, এমনি জিগাইলাম।”

    জালাল মহিলাটার দিকে তাকাল, পান খেয়ে দাঁতগুলো কালচে হয়ে আছে, মুখের কষে পানের পিকের চিহ্ন। পান চিবুতে চিবুতে মহিলাটি জালালের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকাল। জালাল বলল, “মায়া আর জেবারে এতো কিছু দিলেন, আমাগো কিছু দিবেন না?”

    মহিলাটি পিচিক করে আরেকবার পানের পিক ফেলে বলল, “তরে কেন দিমু?”

    “হ্যাগো কেন দিলেন?”

    “হ্যাগো ভালা পাইছি হের লাগি দিছি।”

    “আমাগো ভালা পান নাই?”

    মহিলা মাথা নাড়ল, বলল, “না।” আর এই কথা শুনে মায়া আর জেবা হি হি করে হেসে উঠল।

    জালাল তখন আর সময় নষ্ট করল না। মায়া আর জেবাকে সেই মহিলার সাথে রেখে সে ফিরে যেতে শুরু করল। খানিক দূর যেতেই সে আবার তিনজনের হাসি শুনতে পায়। সে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল, তার দিকে তাকিয়েই হাসছে, কী নিয়ে হাসছে কে জানে। অকারণেই জালালের মেজাজটা গরম হয়ে গেল।

    .

    সন্ধ্যাবেলা দেখা গেল মায়া আর জেবা খুব যত্ন করে নিজেদের নখে নেল পালিশ দিচ্ছে। শুধু তাই না তারা চিরুণী দিয়ে তাদের চুল আঁচড়াল এবং একটা আয়না দিয়ে নিজেদের চেহারা দেখল। জালাল জিজ্ঞেস করল, “আয়না কই পাইলি?”

    “জরিনি খালা দিছে।”

    কিছু বলে না দিলেও জালাল বুঝতে পারল যে মহিলাটি তাদের লিপস্টিক নেল পালিশ চুড়ি আর মালা দিয়েছে সেই হচ্ছে জরিনি খালা। জালাল জিজ্ঞেস করল, “তোগো জরিনি খালার মতলবটা কী?”

    “কুনো মতলব নাই।”

    “আছে।”

    “নাই।”

    “মতলব না থাকলে তোগো লিপিস্টিক নেইল ফালিশ আয়না চিরুণী দেয় কেন? আমাগো তো দেয় না।”

    জেবা মুখ শক্ত করে বলল, “তোগো ভালা পায় না হের লাগি দেয় না।”

    জালাল বড় মানুষের মতো বলল, “হেইডাই চিন্তার বিষয়। আমরা হগগলে এক লগে থাকি কিন্তু তোর জরিনি খালা খালি তোগো দুইজনরে ভালা পায়, আর কাউরে ভালা পায় না।”

    জেবা কোনো উত্তর না দিয়ে চুল আঁচড়াতে লাগল। এতোদিন তারা সবাইকে রুক্ষ উশকুখুশকো লাল চুলে দেখে এসেছে–হঠাৎ করে পরিপাটি চুল দেখে জেবা আর মায়াকে কেমন জানি অচেনা অচেনা লাগে।

    জালাল বলল, “তোরা কিন্তু সাবধান।”

    জেবা মুখ ভেংচে বলল, “কীসের লাগি সাবধান?”

    “তোর জরিনি খালা কিন্তু ছেলেধরা হতি পারে।”

    মায়া ভয়ে ভয়ে বলল, “ছেলেধরা হলি সমস্যা কী? আমরা তো মেয়ে।”

    জালাল হি হি করে হাসল, বলল, “ছেলেধরা খালি ছেলেদের ধরে না, মেয়ে ছাওয়ালরেও ধরে।”

    মায়া এইবার ভয়ে ভয়ে জেবার দিকে তাকাল, বলল, “আফা, জরিনি খালা কি ছেলেধরা?”

    জেবা বলল, “ধুর! জরিনি খালা ছেলেধরা হবি ক্যান?”

    “জরিনি খালা যে হুই সময় বলল আমাগো-” মায়ার কথা শেষ হবার আগে জেবা মায়ার মুখ চেপে বলল, “চোপ! কিছু বলবি না।”

    জালাল বলল, “কী বলিছে? তোগো জরিনি খালা কী বলিছে?”

    জেবা মুখ শক্ত করে বলল, “কিছু বলে নাই। তোগো সেটা শুনারও দরকার নাই।”

    .

    এর পরের কয়েকদিন মায়া আর জেবা একটু আলাদা আলাদা থাকল, অন্যদের সাথে বেশি কথা বলল না। এমনকি বৃহস্পতিবার যখন দুই টেকি আপা সবাইকে দুই টাকা করে দিল তখন তারা সেটা নিয়েই আলাদা হয়ে গেল। ট্রেন এলে প্যাসেঞ্জারদের সাথে বেশি দৌড়াদৌড়িও করল না। মাঝে মাঝে তাদের জরিনি খালার সাথে গুজগুজ ফুসফুস করতেও দেখা গেল। জালাল স্পষ্ট বুঝতে পারল মায়া আর জেবা জরিনি খালার সাথে কোনো একটা কিছু করতে যাচ্ছে–কী করতে যাচ্ছে সে এখনো বুঝতে পারছে না, কিন্তু কিছু একটা যে করবে তাতে কোনো সন্দেহ নাই।

    জালালের সন্দেহে কোনো ভুল নাই। দুইদিন পরে যখন জয়ন্তিকা ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে আর জালাল ট্রেনের পাশে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে তখন সে হঠাৎ করে দেখল জরিনি খালা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। জালাল চমকে উঠল আর অবাক হয়ে দেখল ট্রেনের ভিতর জরিনির পিছনে মায়া গুটিশুটি মেরে বসে আছে-তার পাশে আরেকজন, চেহারা দেখতে না পারলেও জালালের বুঝতে বাকি থাকল না সেটা হচ্ছে জেবা। জরিনি খালা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে পাটফর্মের দিকে তাকিয়ে রইল আর ঝিক ঝিক শব্দ করে ট্রেনটা জালালের সামনে দিয়ে চলে যেতে লাগল।

    জালালের হাতে কয়েকটা মিনারেল ওয়াটারের বোতল। তার কিছুক্ষণ লাগল বুঝতে যে জরিনি খালা নামের এই মহিলাটা জেবা আর মায়াকে নিয়ে চলে যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে? কেন যাচ্ছে?

    দেখতে দেখতে ট্রেনটা এত জোরে ছুটতে শুরু করল যে জালাল বুঝতে পারল সে আর কিছু করতে পারবে না। তার নিজের ভেতরে হঠাৎ এক ধরনের ভয় কাজ করতে শুরু করে। এখন কী হবে? মায়ার কী হবে? জেবার কী হবে?

    হঠাৎ জালালের কী হল কে জানে সে হাত থেকে তার পানির বোতলগুলো ফেলে দিয়ে ট্রেনের সাথে সাথে ছুটতে থাকে। সে অসংখ্যবার চলন্ত ট্রেনে উঠেছে, অসংখ্যবার চলন্ত ট্রেন থেকে নেমেছে কিন্তু এতো জোরে ছুটতে থাকা ট্রেনে কখনোই ওঠেনি। কেউ কখনো উঠতে পেরেছে কি না সে জানে না।

    জালাল মাথা থেকে সব চিন্তা দূর করে পাগলের মতো ছুটতে থাকে, প্লটফর্ম শেষ হবার আগে তার এই ট্রেনে উঠতে হবে, একবার প্লাটফর্ম শেষ হয়ে গেলে আর সে উঠতে পারবে না। ছুটতে ছুটতে সে একটা খোলা দরজার হ্যাঁন্ডেলের দিকে তাকাল, সে যদি হ্যাঁন্ডেলটা একবার ধরতে পারে তা হলেই শেষ একটা সুযোগ আছে। একবার চেষ্টা করল, পারল না, জালাল তবু হাল ছাড়ল না। সে শুনতে পেল ট্রেনের ভেতর থেকে মানুষজন চিৎকার করছে, “কী কর? কী কর? এই ছেলে? মাথা খারাপ না কি?”

    জালাল কিছু শুনল না, ছুটতে ছুটতে আরেকবার চেষ্টা করে হ্যাঁন্ডেলটা ধরে ফেলল। হাতটা ফস্কে যেতে যাচ্ছিল কিন্তু জালাল ছাড়ল না। তার পা দুটি তখনো পাটফর্মে, প্রাণপণে সে প্লাটফর্মের উপর দিয়ে ছুটে যেতে থাকে। এবারে লাফ দিয়ে তার পা দুটো পাদানিতে তুলতে হবে, পাদানিতে পা তোলার আগ পর্যন্ত শরীরের পুরো ভারটুকু থাকবে তার হাতের উপর। তখন যদি হাত ফসকে যায় তা হলে সে সোজা ট্রেনের চাকার নিচে চলে যাবে।

    অনেক মানুষ চিৎকার করছে, জালাল তার কিছুই শুনল না। সে হ্যাঁন্ডেলটা দুই হাতে শক্ত করে ধরে রেখে একটা লাফ দিল এবং পা দুটো সে পাদানিতে তোলার চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। জালালের পা শূন্যে ঝুলে যায়, সে হাতে একটা হ্যাঁচকা টান অনুভব করল, আর সাথে সাথে তার সারা শরীরটা একটা বস্তার মতো ঘুরপাক খেয়ে বগির দেয়ালে প্রচণ্ড জোরে আছড়ে পড়ল, ট্রেনের ভেতর থেকে সে অসংখ্য মানুষের আর্তচিৎকার শুনতে পেল।

    জালাল তখন হ্যাঁন্ডেলটা ধরে বিপজ্জনকভাবে ঝুলছে। সে ঝুলতে ঝুলতে তার পা দুটি পাদানিতে রাখার চেষ্টা করে। কানের খুব কাছে দিয়ে একটা সিগন্যাল লাইটের পোস্ট বের হয়ে গেল, আরেকটু হলে সেটাতে ধাক্কা খেয়ে সে নিচে ছিটকে পড়ত। প্রথমবার পাদানিতে পা রাখতে পারল না, তখন সে ঝুলে থাকা অবস্থায় আবার চেষ্টা করল, এবারে একটা পা রাখতে পারল–সাথে সাথে জালালের বুকে পানি আসে, সে হয়তো এ যাত্রা রক্ষা পেয়ে গেছে। খুব সাবধানে সে তার অন্য পা-টাও পাদানিতে রেখে দুই পায়ের উপর ভর দিল–একটু আগে মনে হচ্ছিল হাতটা ছিঁড়ে যাচ্ছে, আর বুঝি সে ঝুলে থাকতে পারবে না, সেই ভয়ংকর অনুভূতিটা দূর হবার পর জালাল বুঝতে পারে বুকের ভেতর তার হৃৎপিণ্ডটি ধক ধক করে শব্দ করছে এবং এই প্রথম সে ট্রেনের প্যাসেঞ্জারদের চিৎকার আর গালাগালি শুনতে পায়। তার শার্টের কলার ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে একজন তাকে ভেতরে তুলে আনে তারপর চুলের মুঠি ধরে তার গালে রীতিমতো একটা চড় বসিয়ে দেয়, চিৎকার করে বলে, “বদমাইসের বাচ্চা! আরেকটু হলে ট্রেনের চাকার নিচে চলে যেতি, সেইটা জানিস?”

    জালাল মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল, সে এটা জানে। কিন্তু মায়া আর জেবাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে জানতে হলে তার এটা করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না। যতক্ষণ সবাই মিলে তাকে বকাবকি করল ততক্ষণ সে মাথা নিচু করে সেগুলো শুনে গেল। সবাই মিলে রাগারাগি করলেও এই রাগারাগির ভেতরে কোথায় জানি তার জন্যে একটুখানি মমতা আছে, বিপদ থেকে সে বেঁচে গিয়েছে সেই জন্যে একটা স্বস্তি আছে তাই গালাগালটুকু সে একেবারেই গায়ে মাখল না। যখন গালাগাল একটু কমে এল তখন সে আস্তে করে সরে পড়ল।

    সে এখন মায়া, জেবা কিংবা জরিনি খালার চোখে পড়তে চায় না। তারা এই ট্রেনে আছে এটা সে জানে, তারা কোথায় নামে, কোথায় যায় সেটা সে জানতে চায়। খুব সাবধানে সে সামনের বগির দিকে এগিয়ে যায়। মাঝামাঝি একটা বগিতে সে মায়া, জেবা আর জরিনি খালাকে খুঁজে পেল। তারা তিনজন একটা ট্রেনের সিটে বসেছে, দেখেই বোঝা যাচ্ছে টিকেট কিনে এই সিটে বসতে হয়েছে। জরিনি খালা মোবাইল টেলিফোনে কথা বলছে। জেবা আর মায়া জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। তাদের চোখে-মুখে একটু একটু ভয় আর একটু একটু উত্তেজনার ছাপ।

    জালাল সেই বগি থেকে সরে এসে ঠিক আগের বগিতে বাথরুমের সামনের খোলা জায়গাটাতে গুটিশুটি মেরে বসে রইল। যখনই ট্রেনটা কোথাও থামে সে উঁকি মেরে দেখে জরিনি খালা মায়া আর জেবাকে নিয়ে নেমে পড়ছে কী না। যখনই ট্রেন থামছে তখনই জরিনি খালা স্টেশনের ফেরিওয়ালার কাছ থেকে মায়া আর জেবাকে চিনাবাদাম, ঝালমুড়ি এইসব কিনে কিনে দিচ্ছিল কিন্তু কেউ ট্রেন থেকে নামল না।

    ট্রেনটা যখন শেষ পর্যন্ত ঢাকা পৌঁছাল তখন জরিনি খালা মায়া আর জেবাকে নিয়ে ট্রেন থেকে নেমে পড়ল। জরিনি খালা এক হাতে একটা কালো ব্যাগ, অন্য হাতে মায়ার হাত ধরে ভিড় ঠেলে এগুতে থাকে–জেবা তাদের পিছু পিছু যেতে থাকে। গেটে টিকেট কালেক্টরকে টিকেট দেখিয়ে তিনজন বের হয়ে এলো। জালালের মতো রাস্তার বাচ্চাদের কাছে কেউ কখনো টিকেট চায় না–সে ভিড়ের সাথে বের হয়ে এল। একটু দূর থেকে জালাল তিনজনকে অনুসরণ করতে থাকে, স্টেশনের অনেক মানুষের মাঝেও সে তাদের চোখে চোখে রেখে এগুতে থাকে।

    স্টেশন থেকে বের হয়ে জরিনি খালা মোবাইল টেলিফোনে খানিকক্ষণ কথা বলল, তারপর আবার এগিয়ে গেল। প্লাটফর্মে রিকশা স্কুটার দাঁড়িয়ে আছে এখন যদি জরিনি খালা মায়া আর জেবাকে নিয়ে এগুলোতে উঠে যায় তা হলে জালাল কী করবে চিন্তা করে পেল না। তখন অন্য একটা রিকশা না হয় স্কুটারে উঠে তাকে বলতে হবে জরিনি খালাদের রিকশা বা স্কুটারের পিছু পিছু যেতে। তার কাছে মনে হয় রিকশা কিংবা স্কুটার ভাড়া হয়ে যাবে কিন্তু কেউ তার কথা শুনবে না। তাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিবে।

    জালালের কপাল ভালো জরিনি খালা রিকশা স্কুটারে উঠল না, মায়া আর জেবাকে নিয়ে সামনে হাঁটতে থাকে। মায়া আগে কখনো ঢাকা শহরে আসেনি তাই অবাক হয়ে এদিক-সেদিক তাকাতে তাকাতে জরিনি খালার হাত ধরে হাঁটতে থাকে।

    হাঁটতে হাঁটতে তারা একটা বাস স্টেশনে এসে দাঁড়াল, মনে হচ্ছে তিনজন এখান থেকে বাসে উঠবে। তিনজন উঠে যাবার পর জালাল একই বাসে উঠে যেতে পারে কিন্তু তাকে দেখে ফেললে সমস্যা হয়ে যাবে। চেষ্টা করতে হবে ভেতরে না ঢুকে দরজার কাছে ঝুলে থাকতে।

    জরিনি খালা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাসগুলো লক্ষ করে। প্রথম কয়েকটি বাসের নম্বর দেখে সে সেগুলোতে ওঠার চেষ্টা করল না। তখন একেবারে ভাঙাচুরা একটা বাস এসে দাঁড়াল, হেলপার নেমে ফকিরাপুল, ফার্মগেট, কাকলী, উত্তরা, টঙ্গী বলে চিৎকার করতে থাকে তখন জরিনি খালা মায়ার হাত ধরে সেই বাসে উঠে পড়ে। তাদের পিছু পিছু জেবাও বাসে উঠে পড়ল। জালাল লোকজনকে আড়াল করে কাছাকাছি দাঁড়িয়ে রইল, ঠিক যখন প্যাসঞ্জার বোঝাই করে বাসটা ছেড়ে দিল তখন জালাল লাফিয়ে বাসটাতে উঠতে গেল। কিন্তু হেলপার ধমক দিয়ে তাকে থামিয়ে দিল, বাসে উঠতে দিল না। তার চেহারা পোশাক দেখে হেলপারের মনে হয়েছে সে নিশ্চয়ই বাসে উঠে ভাড়া দিতে পারবে না।

    বাসটা চলেই যাচ্ছিল এবং জালাল প্রায় হাল ছেড়েই দিচ্ছিল তখন বাসের পিছনে বাম্পারটা তার চোখে পড়ল। লাফ দিয়ে সে বাম্পারটাতে উঠে দাঁড়িয়ে যেতে পারে, বাম্পার থেকে সে যেন পড়ে না যায় সেই জন্যে কিছু একটা হাত দিয়ে ধরে রাখতে হবে, ধরার সেরকম কিছু নেই-তবে ভাঙা ব্যাকলাইটটা কষ্ট করে ধরে রেখে মনে হয় সে ঝুলে থাকতে পারবে। সবচেয়ে বড় কথা বাসের পিছনে কোনো জানালা নেই সে যে এখানে ঝুলে আছে কেউ টের পাবে না।

    জালাল চিন্তা করে সময় নষ্ট করল না, দৌড়ে গিয়ে বাসটার বাম্পারের উপর দাঁড়িয়ে গেল। আরেকটু হলে পড়েই যাচ্ছিল, কোনোমতে ভাঙা ব্যাকলাইটটা ধরে সে তাল সামলে নিল।

    ঢাকার ব্যস্ত রাস্তা দিয়ে বাসটা ছুটতে থাকে, পিছনের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা হেলপারটা বাসের গায়ে থাবা দিয়ে চিৎকার করে আশেপাশের গাড়ি, টেম্পু, স্কুটারকে সরিয়ে দিতে থাকে। সে জানতেও পারল না, খুবই কাছাকাছি বিপজ্জনকভাবে বাম্পারে দাঁড়িয়ে জালাল এই বাসে করেই যাচ্ছে। তাকে উঠতে দিলে বাস ভাড়াটা পেত, এখন সেটাও পাবে না।

    প্রত্যেকবার বাসটা থামার আগেই জালাল বাম্পার থেকে নেমে একটু দূরে দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল, কে উঠছে সেটা নিয়ে তার কোনো মাথা ব্যথা নেই কিন্তু জরিনি খালা মায়া আর জেবাকে নিয়ে নামছে কি না সে দেখতে চায়। বাসটা ছেড়ে দিতেই আবার সে দৌড়ে গিয়ে বাম্পারের উপর দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল-দেখে মনে হতে পারে এটা খুবই বিপজ্জনক কাজ কিন্তু জালালের কাছে এটা ছিল খুবই সহজ একটা ব্যাপার। এর চাইতে অনেক বেশি বিপজ্জনক কাজ সে খুব সহজে করে ফেলতে পারে। জালাল জানে কেউ ধাক্কা দিয়ে ফেলে না দিলে কোনোদিনও সে এখান থেকে পড়ে যাবে না।

    টঙ্গির কাছাকাছি জরিনি খালা মায়া আর জেবাকে নিয়ে বাস থেকে নেমে এদিক-সেদিক তাকাল। জালাল একটু দূরে মানুষের ভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। জরিনি খালা একটু এগিয়ে গিয়ে আবার তার মোবাইল টেলিফোনটাতে কিছুক্ষণ কথা বলল, কথা বলার ভঙ্গি দেখে মনে হল কোনো কারণে সে রেগে গেছে। কথা বলা বন্ধ করে সে এবারে জোরে জোরে হাঁটতে থাকে, মায়াকে মাঝে মাঝে হ্যাঁচকা টান দেয়, মায়া জরিনি খালার সাথে তাল মিলানোর চেষ্টা করে, আরো জোরে হাঁটার চেষ্টা করে।

    খানিকদূর গিয়ে জরিনি খালা রাস্তা পার হল–বাস, গাড়ি, টেম্পুর ফাঁকে ফাঁকে হেঁটে হেঁটে জরিনি খালা খুব সহজেই ব্যস্ত রাস্তাটা পার হয়ে যায়। রাস্তা পার হয়ে তারা কোনোদিকে যাচ্ছে জালাল লক্ষ করল তারপর সেও রাস্তা পার হয়ে এলো।

    জরিনি খালা বড় রাস্তা থেকে একটা ছোট রাস্তায় ঢুকে একটা রিকশা ভাড়া করে মায়া আর জেবাকে নিয়ে সেটাতে উঠে পড়ল। জালাল এবারে একটু বিপদে পড়ে যায়–সে ইচ্ছে করলে আরেকটা রিকশা ভাড়া করতে পারে কিন্তু রিকশাওয়ালাকে সে কী বলবে? কোথায় যাবে? আর ততক্ষণে জরিনি খালা অনেকদূর চলে যাবে–পরে খুঁজেও পাবে না।

    তার থেকে মনে হয় রিকশাটার পিছনে পিছনে দৌড়ে যাওয়া সহজ। রাস্তাটা ছোট, আঁকাবাঁকা গলি, কাজেই রিকশাটা খুব জোরে যেতে পারবে না। সে ইচ্ছা করলে মনে হয় একটা রিকশার সাথে দৌড়াতে পারবে। চিন্তা করার খুব সময় নেই তাই সে আর দেরি না করে জরিনি খালার রিকশাটাকে চোখে চোখে রেখে পিছন পিছন দৌড়াতে থাকে।

    প্রথম প্রথম রিকশাটা একটু জোরে যাচ্ছিল, তার সাথে তাল মিলিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে জালাল প্রায় হাঁপিয়ে উঠছিল। একটু পরেই রিকশাটা আরো ছোট ঘিঞ্জি একটা গলিতে গিয়ে ঢুকল, রাস্তাটা খারাপ–তখন রিকশাটা আর জোরে যেতে পারছিল না, জালাল জোরে জোরে হেঁটেই রিকশার পিছনে পিছনে হেঁটে যেতে পারল।

    ঘিঞ্জি রাস্তাটা দিয়ে মনে হয় পাশাপাশি দুটো রিকশাই যেতে পারে না–সেখানে একটা পুরোনো বিল্ডিংয়ের সামনে একটা বিশাল ট্রাক দাঁড়িয়েছিল। রিকশাটা সেখানে দাঁড়িয়ে গেল তখন জরিনি খালা রিকশা ভাড়া মিটিয়ে রিকশা থেকে নামল। কালো ব্যাগটা ঘাড়ে ঝুলিয়ে মায়া আর জেবার হাত ধরে জরিনি খালা বিল্ডিংটার সামনে দাঁড়াল। বিল্ডিংয়ের মুখে একটা কোলাপসিবল গেট, ভেতরে একজন মানুষ টুলে বসে ছিল। জরিনি খালা মানুষটার সাথে নিচু গলায় কিছু একটা বলল, মানুষটা তখন গেটটা খুলে দেয়। জরিনি খালা মায়া আর জেবাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে যাবার পর মানুষটা আবার গেটটা বন্ধ করে দিল।

    বিল্ডিংয়ের ভেতরে জালাল ঢুকতে পারল না, ঢুকতে পারবে সেটা অবশ্যি সে আশাও করেনি। মায়া আর জেবাকে জরিনি খালা কোথায় নিয়ে আসতে চেয়েছে। জালাল শুধু সেটাই জানতে চেয়েছিল, সেটা সে এখন জেনে গেছে। হয়তো জরিনি খালা মায়া আর জেবাকে আসলেই নিজের মেয়ের মতো আদর করে, সেই জন্যে হয়তো এখানে নিজের কাছে নিয়ে এসেছে তা হলে জালালের কিছুই করতে হবে না। ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে জালাল নিজের জায়গায় ফিরে যাবে।

    জালাল নিজের মাকে বুঝিয়েছিল একজন মহিলা তাকে মায়ের মতো আদর করে। তার নিজের জন্যে না হয়ে মায়া আর জেবার জন্যে সেটা তো হতেও পারে! হয়তো সে মিছি মিছি সন্দেহ করে পিছু পিছু এতো দূর চলে এসেছে। আসলে হয়তো জেবা আর মায়া সত্যিকারের মায়ের মতো একটি মা পেয়ে গেছে।

    হতেও তো পারে।

    .

    ০৯.

    জরিনি খালা সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে দরজাটায় ধাক্কা দিতেই ভেতর থেকে একজন মোটা গলায় জিজ্ঞেস করল, “কে?”

    জরিনি খালা বলল, “আমি। আমি জরিনা।”

    “ও। জরিনা সুন্দরী না কি?”

    “হ। দরজা খুলো।”

    খুট করে দরজা খুলে গেল। মায়া আর জেবা দেখল দরজার অন্য পাশে কালো মোষের মতো একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। মানুষটা খাটো একটা লুঙি আর লাল রংয়ের একটা গেঞ্জি পরে আছে। মায়া আর জেবাকে দেখে মানুষটার চোখ দুটি চকচক করে ওঠে, জিব দিয়ে লোল টানার মতো শব্দ করে বলল, “জরিনা সুন্দরী! তুমি দেখি কামের মানুষ। দুইটা চিড়িয়া আনছ।”

    জরিনা কোনো কথা বলল না, হঠাৎ করে জেবার বুকটা কেঁপে উঠল, তার মনে হল ভেতরে অনেক বড় বিপদ, মনে হল তার এখন এখান থেকে ছুটে পালাতে হবে কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। জরিনি খালা দুইজনকে দুই হাতে ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে এসেছে আর সাথে সাথে ঘটাং করে পিছনের দরজাটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

    জরিনা দুইজনের হাত ধরে ভেতরের আরেকটা ঘরে নিয়ে গেল তখন পিছনের দরজাটা আবার বন্ধ করে দেওয়া হল।

    জেবা ঘরের ভেতরে তাকাল এবং হঠাৎ ভয়ানকভাবে চমকে উঠল। ঘরের ভেতরে একটা খাট সেখানে একটা ময়লা বিছানা, একপাশে একটা ভাঙা ড্রেসিং টেবিল, একটা টেবিল, সেখানে কিছু খালি খাবারের প্যাকেট, কয়েকটা পানির বোতল। ঘরের একপাশে একটা আধখোলা দরজা সেখান থেকে বোটকা দুর্গন্ধ ভেসে আসছে। জেবা অবশ্যি এসব দেখে চমকে উঠেনি, সে চমকে উঠেছে নিচের দিকে তাকিয়ে। মেঝেতে এবং দেয়ালে হেলান দিয়ে অনেকগুলো বাচ্চা চুপচাপ বসে আছে, বাচ্চাগুলোর চোখে-মুখে আতঙ্ক। বড় বড় চোখে তারা তাদের দিকে তাকিয়ে আছে।

    মায়াও চারিদিকে তাকাল, সেও একই দৃশ্যটা দেখল কিন্তু মনে হল সে কিছু বুঝতে পারল না। জরিনি খালার দিকে তাকিয়ে বলল, “জরিনি খালা, খিদা লাগছে।”

    মনে হল কথাটা শুনে জরিনি খালার খুব মজা লেগেছে, সে হি হি করে হাসতে থাকে, মনে হয় হাসি থামতেই পারে না। মায়া বলল, “হাসছ কেন জরিনি খালা?”

    জরিনি খালা বলল, “তোর কথা শুনে। কী খাবি? কোরমা-পোলাও না বিরানি?”

    মায়া তখনো কিছু বুঝতে পারেনি, সরল মুখে বলল, “বিরানি।”

    মায়ার কথা শুনে জরিনি খালা আবার হি হি করে হাসতে শুরু করে। তারপর যেভাবে হাসতে শুরু করেছিল ঠিক সেইভাবে হাসি থামিয়ে ফেলল এবং দেখতে দেখতে তার মুখটা পাথরের মতো থমথমে হয়ে ওঠে। খানিকক্ষণ সে মায়ার দিকে তাকিয়ে থাকে এবং সেই দৃষ্টি দেখে মায়া ভয় পেয়ে যায়। মায়া ভাঙা গলায় বলল, “জরিনি খালা, তোমার কী হইছে? তুমি ডর দেখাও কেন?”

    জরিনি খালা কিছু বলল না, স্থির চোখে মায়ার দিকে তাকিয়ে রইল। মায়া বলল, “তুমি কইছিলা আমাগো নতুন জামা দিবা। বিরানি খাইতে দিবা-”

    জরিনি খালা হঠাৎ হুংকার দিয়ে উঠে বলল, “চুপ কর আবাগীর বেটি। সখ দেইখা বাঁচি না-নতুন জামা লাগবি! বিরানি খাতি হবি! তোগো এখানে আনছি কীসের লাগি এখনো বুঝিস নাই?”

    মায়া ফ্যাকাসে মুখে বলল, “কীসের লাগি?”

    “তোগো বেচুম। ইন্ডিয়াতে বেচুম। কোরবানি ঈদের সময় গরু-ছাগল কেমনে বেচে দেখছস? হেই রকম!”

    এই প্রথম মনে হল মায়া ব্যাপারটা বুঝতে পারল, আর্তচিৎকার করে বলল, “তুমি ছেলেধরা?”

    “হ।” জরিনা খালা বুকের মাঝে থাবা দিয়ে বলল, “আমি ছেলেধরা। ছেলে আর মেয়ে ধরা। আমি তোগো ধরি আর কচমচ কইরা খাই! মাইনষে যেইভাবে মুরগির রান কচমচ কইরা খায় আমি হেইরকম তোগো ধইরা কচমচ কইরা খাই।”

    জরিনি খালার কথা শুনে মায়া দুই হাতে মুখ ঢেকে ভয়ে চিৎকার করতে থাকে। মায়ার চিৎকারটা মনে হয় জরিনি খালাকে খুব আনন্দ দেয়। সে দাঁত বের করে হি হি করে হাসতে থাকে।

    জরিনি খালা একসময় হাসি থামাল তারপর সবার দিকে একনজর দেখে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। খাটো করে লুঙি আর লাল গেঞ্জি পরা মানুষটা জরিনি খালার পিছু পিছু বের হয়ে যেতে যেতে দাঁড়িয়ে গেল। ঘর ভর্তি বাচ্চাগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, “তোগো কপাল খুব ভালা। ইন্ডিয়াতে আমাগো মাল সাপ্লাই দিবার তারিখ পেরায় শেষ। হের লাগি তোগো আমরা ইন্ডিয়া পাঠামু। তোরা সব দিল্লি, বোম্বাই যাবি?”

    মানুষটা বাচ্চাগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, এর আগেরবার তোগো মতোন আরও দুই ডজন ছাওয়াল-মাইয়া আনছিলাম। তাগো কী করিছিলাম জানস?”

    কেউ কোনো কথা বলল না। কালো মানুষটা হা হা করে হাসতে হাসতে বলল, “হাত-পা ভাইঙা লুলা বানাইছিলাম। ভিক্ষা করনের লাগি লুলার উপরে মাল নাই। চাইরজনের আবার ইস্পিশাল দাবাই দিছিলাম। কী দাবাই কইতে পারবি?”

    বাচ্চাগুলোর কেউ কথা বলল না। লাল গেঞ্জি পরা কালো মোটা মানুষটা বলল, “চোখের মাঝে এসিড! এখন আন্ধা ফকির! গান গাতি গাতি ভিক্ষা করে–পেরতেক দিন তাগো কয় টাকা ইনকাম শুনলি তোদের জিব্বার মাঝে পানি চলে আসবি! তোরা কইবি আমি হমু আন্ধা ফকির! আমি হমু আমি আন্ধা ফকির!”

    খুবই একটা হাসির কথা বলেছে এই রকম ভান করে মানুষটা হাসতে থাকে। তারপর হঠাৎ হাসি বন্ধ করে ঘর থেকে বের হয়ে গেল, তারা শুনতে পেল, বাইরে থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।

    মায়া জেবার দিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আফা খিদা লাগছে।”

    এরকম একটা সময়ে যে কারো খিদে লাগতে পারে জেবার বিশ্বাস হল না। সে কিছু না বলে মায়াকে ধরে রাখে–তার চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়তে থাকে। সে কেমন করে এত বোকা হল? কেন সে একবারও জালালের কথা শুনল না? কেন সে বুঝতে পারল না জরিনি খালা একটা ভয়ংকর মহিলা?

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleএকটুখানি বিজ্ঞান – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
    Next Article আরো একটুখানি বিজ্ঞান – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    Related Articles

    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    ছোটগল্প – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    সাদাসিধে কথা – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    মেকু কাহিনী – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    আমার বন্ধু রাশেদ – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    সায়েন্স ফিকশান সমগ্র ১ – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    টুনটুনি ও ছোটাচ্চু – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }