Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ এক পাতা গল্প122 Mins Read0
    ⤶

    ০৯. আমাদের স্কুল ছুটি হয়ে গেল

    এসেমব্লির পর পর আমাদের স্কুল ছুটি হয়ে গেল। মেট্রিকের রেজাল্টের পর আমাদের স্কুল সবসময়ই একদিনের ছুটি হয়। ভালো রেজাল্টের ছুটি। আজকেরটা তেমন না। আজ স্কুল ছুটি হয়েছে কারণ বদরুল আলম স্যার মারা গেছেন। রোগে শোকে মৃত্যু না–রেলে কাটা পড়ে মৃত্যু। তিনি রেল লাইনে মাথা দিয়ে শুয়েছিলেন। ধড় থেকে মাথা আলাদা হয়ে গেছে। হেড স্যার এসেমব্লিতে বক্তৃতা দিলেন।

    বদরুল আলম সাহেব এই স্কুলের আদর্শ শিক্ষক ছিলেন। দীর্ঘ তেইশ বছর তিনি। অতি নিষ্ঠার সঙ্গে শিক্ষকতা করেছেন। তার মৃত্যুতে স্কুল একজন নিবেদিত প্রাণ শিক্ষক হারিয়েছে। এই ক্ষতি পূর্ণ হবার না। যাই হোক এখন অন্য একটা প্রসঙ্গ, বদরুল আলম সাহেব সম্পর্কে কিছুদিন ধরে সামান্য দুঃখজনক কথাবার্তা শোনা গেছে। সবই রটনা। রটনায় সত্যতার লেশমাত্রও নাই। এই জাতীয় দুঃখজনক রটনা যেন প্রশ্রয় না পায় সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। সম্মানিত লোকের সম্মান রক্ষা করা আমাদের সকলের কর্তব্য।…

     

    বদরুল স্যারকে নিয়ে কানাঘুষা অনেক দিন থেকেই শোনা যাচ্ছিল। তিনি নাকি খারাপ জায়গায় ঘোরাঘুরি করেন। অনেকেই দেখেছে। সবদিন না, বুধবার রাতে তিনি নাকি ধলা সামছুর বৌ এর ঘরে যাবেনই। এ জাতীয় গুজবের কথা। যেই শুনে সেই রেগে উঠে। ধমকের গলায় বলে- একজন মানী লোক সম্পর্কে এইসব কী কথা? ছিঃ। বদরুল স্যারকে আমরা চিনি না। ঘর সংসার আছে। সুখী সংসার। এক মেয়ের বিবাহ হয়েছে, আরেকটা মেয়ে বিবাহের উপযুক্ত হয়েছে… তাকে নিয়ে এইসব কী কথা। এইগুলা আর কিছুই না। কিয়ামতের নিশানা। কিয়ামতের আগে আগে মানী লোক মান হারায়। দুষ্ট লোক মান পায়।।

    বদরুল স্যার সম্পর্কে এইসব ভালোভালো কথা যিনি বলেন তিনিই আবার গলা নিচু করে অন্যদের বলেন ঘটনা শুনেছেন? বুধবার রাতে রাতে কি ঘটনা। ঘটে শুনেছেন? ছিঃ ছিঃ কী কেলেংকারী।

    অনেকদিন পর রেল লাইনে মানুষ কাটা পড়ল। অপঘাতের ঘটনা সবসময় দুবার করে ঘটে। পুকুরে ড়ুবে একজন কেউ মারা গেলে ধরেই নেয়া যায় খুব। শিগগিরই আরেকজন মারা যাবে।

     

     

    রহমান চাচা খুবই চিন্তিত। রেলে কাটা পড়ে আরেকজন মারা যাবে। সেই আরেকজন কে? ঠাণ্ডা মাথায় হিসাব করলেই বের করা যায়। রহমান চাচা চিন্তিত মুখে হিসেব করেন। দ্বিতীয়জন যে মারা যাবে সে বদরুল স্যারের পরিচিত হতে হবে। সে পুরুষও হবে না। একজন পুরুষের পর একজন নারী, মৃত্যুগুলি এইরকম হয়। এই সব মৃত্যু নারীপুরুষ মিলিয়ে জোড়ায়-জোড়ায় হয় এটাই নিয়ম।

    রহমান চাচা আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললেন, তার হিসাবে বলে বদরুল স্যারের পরিবারের ওপর এই ঘটনা ঘটবে।

    ঘটনা শেষ পর্যন্ত ঘটল।

    ভোর রাতে হইচই চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙ্গে গেল। মগরা ব্রিজের কাছ থেকে চিৎকার আসছে। লোকজন ছুটে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ভয়ংকর কিছু ঘটেছে। ব্রিজটা, কি ভেঙ্গে পানিতে পড়ে গেছে? জাপানি ইঞ্জিনিয়ার বলেছিলেন, ব্রিজের যে অবস্থা যে কোনো মুহূর্তে ভেঙ্গে পানিতে পড়ে যাবে। বিরাট ক্যালামিটি হবে।

    কুসুম আপু বলল, টগর দৌড়ে যা, খোঁজ নিয়ে আয় কী হয়েছে। আমি যাবার আগেই রহমান চাচা উপস্থিত হলেন। তার মুখ হাসি হাসি। এই সকাল। বেলাতেই মুখ ভর্তি পান। পানের রস ঠোঁট গড়িয়ে নিচে পড়ছে। রহমান চাচা আনন্দিত গলায় বললেন, বলেছিলাম না ঘটনা ঘটবে। ঘটনা ঘটেছে। আরেকজন মানুষ রেলে কাটা পড়ছে। এক্কেবারে চইদ্দ টুকরা। গোশতের দলা।। চিননের কোনো উপায় নাই।

    কুসুম আপু হতভম্ব গলায় বললেন, কে কাটা পড়েছে?

    রহমান চাচা পানের পিক ফেলতে ফেলতে বললেন–নাক চ্যাপা চীন দেশের অবিছার স্যার। কই দেশ, আর মরল কই। জম্নের সময়ই নির্ধারণ হয়ে থাকে, কে কই মরব। আমরার করনের কিছুই নাই।

    কীভাবে কাটা পড়ল?

     

     

    সঠিক হিস্টরি কেউ জানে না। মনে হয় ব্রিজে উঠছিল পিসাব করনের জন্যে। এই ব্যাটার অভ্যাস ছিল ব্রিজের উপরে খাড়াইয়া পিসাব করনের। অতি অসভ্য। আমি এখন আবার যাইতেছি আসল খবর আনব। খবর কিছু পাব কিনা বুঝতে পারতেছি না। থানাওয়ালা চইল্যা আসছে। পুলিশ পাহারা বসছে। কাউরে যাইতে দেয় না।

    দুর্ঘটনা কীভাবে ঘটল তার নানান কথা শোনা যেতে লাগলো। রাত তিনটার সময় টর্চ হাতে চীনাম্যানকে ব্রিজের দিকে যেতে দেখা গেছে। ক্রেনের ড্রাইভার জমশেদ বলেছে, স্যার কই যান? চীনাম্যান তাকে একটা গালি দিয়ে বলেছে, আমি কোথায় যাই তা দিয়ে তোমার কী দরকার? তারপরই দুর্ঘটনা। এগারো সিন্দুর এক্সপ্রেস ঘটনা ঘটায়।

    আরেকটা ভাষ্য হল–ঘটনা কখন ঘটে। কীভাবে ঘটে কেউ জানে না। চীনাম্যান খুব ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই মগ ভর্তি এক মগ কফি খান। লোকমান বাবুর্চি কফি হাতে ব্রিজের দিকে যায়। সকালবেলা ব্রিজের উপর হাঁটাহাঁটি করাও নাকি উনার অভ্যাস। বাবুর্চি ব্রিজে উঠে চিৎকার দেয়। তার চিৎকার শুনে সবাই ছুটে আসে।।

    আমাদের এদিকে রেলের নিচে আগেও মানুষ কাটা পড়েছে। মুহূর্তের মধ্যে হাজার-হাজার মানুষ জড় হয়েছে। কাটা পড়া মানুষের লাশ সরিয়ে নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষজন চলে গিয়ে রেল লাইন আবার ফাঁকা হয়ে গেছে। আজ সে রকম হল না। মানুষ বাড়তেই থাকল। সকাল দশটায় ময়মনসিংহ থেকে রিলিফ ট্রেন চলে এল। ট্রেন লাইন থেকে উল্টে পড়লে রিলিফ ট্রেন আসে। সে-রকম কিছু হয় নি। কিন্তু রিলিফ ট্রেন চলে এসেছে। দুপুরবেলা একটা হেলিকপ্টার নামল আমাদের স্কুলের মাঠে। হেলিকপ্টারে করে দুজন বিদেশী এবং তিনজন বাঙালি নামলেন। বাঙালি তিনজনের একজন আমাদের পরিচিত সেলুন কারে করে এসেছিলেন। লোকজন সব চলে এল হেলিকপ্টার দেখতে। মগরা ব্রিজ খালি হয়ে গেল। আমাদের এ দিকের মানুষ এত কাছ থেকে কখনো হেলিকপ্টার দেখে নি। এত বিরাট একটা জিনিস, কিন্তু দেখাচ্ছে খেলনার মতো। খুব সুন্দর রঙচঙা খেলনা।

    কুসুম আপু বলল, আয় তো আমার সঙ্গে। ঘটনা কী জেনে আসি।

    আমি বললাম, তোমাকে যেতেই দেবে না। পুলিশ পাহারা। কাউকে যেতে দিচ্ছে না।

     

     

    তুই আয় আমার সঙ্গে। অবিশ্যিই আমাকে যেতে দেবে।

    কার কাছে যাবে? জাপানি ইঞ্জিনিয়ারের কাছে?

    হ্যাঁ। বোকা লোক তো, আমার ধারণা সে বিরাট বিপদে পড়তে যাচ্ছে।

    কুসুম আপু ঠিকই পুলিশের লোকজন পার হল। তার কোনো অসুবিধা হল না। জাপানি ইঞ্জিনিয়ারকে খুঁজে বের করতেও সমস্যা হল না। তিনি অন্ধকার তাঁবুতে একা-একা চুপচাপ বসে আছেন। হাতে পানির বোতল। চোখ লাল, চোখের কোণে ময়লা জমে আছে। চুল উস্কু খুস্কু। বাকি সবাই নদীর পারে।

    নদীতে জাল ফেলা হচ্ছে। চীনাম্যানের শরীরের কাটা বড় অংশই নাকি নদীতে পড়ে গেছে। সেটা তোলার চেষ্টা। হেলিকপ্টার আসা লোকজন নদীর পাড়ে বসে আছেন। তাদের জন্যে চেয়ারের ব্যবস্থা হয়েছে। বাবাকেও দেখলাম তাদের সঙ্গে। বাবার পেট ব্যথাটা যে আবার উঠেছে তা দূর থেকেই বোঝা যাচ্ছে। তিনি উবু হয়ে বসে আছেন। একটু পর পর ঘড়ি দেখছেন। পেটে ব্যথা শুরু হলেই তিনি ঘড়ি দেখেন। ব্যথাটা কখন থাকে মনে হয় তার হিসাব রাখেন।

    জাপানি ইঞ্জিনিয়ার মনে হল আমাদের চিনতে পারছেন না। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। চোখে পলক পর্যন্ত পড়ছে না। কুসুম আপু বললো, আপনার। কি শরীর খারাপ?

    জাপানি ইঞ্জিনিয়ার বিড়বিড় করে বললেন, টেনশনে জ্বর এসেছে। সকালে নাস্তা টাস্তা কিছুই খাই নি। তারপরেও এক গাদা বমি করেছি। উঠে দাঁড়াতে পারি না। মাথা ঘুরে। সবাই নদীর পারে গিয়েছে। আমি যেতে পারি না। এর অন্য কোনো অর্থ করে কিনা কে জানে।

    কুসুম আপু বলল, অন্য কী অর্থ করবে?

    বলতে পারে সবাই এসেছে, সে কেন আসে নি? নিশ্চয়ই কোনো কিন্তু আছে।

     

     

    কিন্তু থাকবে কেন? আপনি নিশ্চয়ই তাকে ধাক্কা দিয়ে ট্রেনের নিচে ফেলে দেন নি?

    আমি কেন ধাক্কা দিয়ে ফেলব?

    কিংবা আপনি নিশ্চয়ই লোকজনদের শিখিয়ে দেন নি–এই চীনাম্যান। আমাকে খুবই যন্ত্রণা করে তোমরা একে ধাক্কা দিয়ে চলন্ত ট্রেনের সামনে ফেলে দিও।

    কুসুম তুমি এইসব কী বলছ?

    কথার কথা বলছি।

    এ ধরনের কথা ভুলেও উচ্চারণ করবে না। কেউ না কেউ বিশ্বাস করে ফেলতে পারে।

    কুসুম আপু কঠিন গলায় বলল, আপনার হাত কাঁপছে কেন ঘটনা কি দয়া করে বলবেন?

    কোন ঘটনা না কুসুম। আমার পক্ষে কোনো অন্যায় করা সম্ভব না। সব মানুষ অন্যায় করতে পারে না।

    আপনার হাত কাঁপছে কেন?

    জানি না কেন কাঁপছে। খুবই ভয় লাগছে।

    পুলিশ কি আপনার জবানবন্দি নিয়েছে?

    হুঁ।

    তাদেরকে কি বলেছেন?

     

     

    বলেছি আমি কিছুই জানি না। ঘুম থেকে উঠে খবর পেয়েছি। যা সত্য তাই বলেছি।

    পুলিশ আপনার কথা বিশ্বাস করেছে।

    বিশ্বাস করবে না কেন?

    কারণ আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। আমার মনে হয় আপনি সব কথা বলছেন।

    কুসুম আমার জ্বর এসেছে। সকাল থেকে মাথা ঘুরাচ্ছে। কোনো নাশতা খাই নি। কিন্তু একগাদা বমি করেছি। এখন আবার বমি আসছে। খুবই পানির পিপাসা হচ্ছে। পানি খেতে পারি না। একটু পানি মুখে দেই, মনে হয় পানি না, চিরতার পানি মুখে দেয়েছি।

    কুসুম আপু কিছু বলল না, চুপ করে রইল। নদীর পাড় খুব হই চই শোনা যেতে লাগল। মনে হয় ডেড বডির অংশ পাওয়া গেছে। হই চই শুনে জাপানি ইঞ্জিনিয়ারের মুখ হঠাৎ ছাই বর্ণ হয়ে গেল। তিনি বিড়বিড় করে বললেন–রাত তিনটার সময় জমশেদ এসে আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল। মদ খেয়ে ভূত হয়ে এসেছে। তার মুখ দিয়ে মদের গন্ধ আসছে। ঠিকমতো দাঁড়াতেও পারছে না, টলছে। আমাকে বলল, চীনাম্যানকে সে মগরা ব্রিজের লাইনের উপর দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছে। একটু পরেই এগারো সিন্দুর এক্সপ্রেস আসবে। তখন ঘটনা ঘটবে। আমি তার কথা বিশ্বাস করি নি। ভেবেছি মাতালের প্রলাপ। তারপরেও টর্চ লাইট নিয়ে বের হয়েছি। ততক্ষণে এগারো সিন্দুর এসে গেছে। দূর থেকে সার্চ লাইট দেখা যাচ্ছে। আমি ব্রিজে টর্চ মেরে দেখি সত্যি-সত্যি চীনাম্যানকে পুলের উপর শুইয়ে বেঁধে রেখেছে। সে চিৎকার করে তার ভাষায়। কি সব বলছে। কাঁদছে। সে যত কাঁদে জমশেদ আর তার লোকজন তত হাসে। ওদের মাথার ঠিক নাই। গলা পর্যন্ত মদ খেয়েছে। তুমি তো জান কুসুম আমার কোনো সাহস নাই যে আমি ব্রিজের উপর উঠে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করব। এগারো সিন্দুর এক্সপ্রেস আমার চোখের সামনে তার উপর দিয়ে চলে। গেছে। শেষের দিকে চীনাম্যান কোনো চিকারও করে নাই। কান্নাকাটিও করে। নাই। রেল ইঞ্জিনের দিকেও তাকায়ে থাকে নাই। আমার দিকে তাকায়ে ছিল।

     

     

    জাপানি ইঞ্জিনিয়ার বমি করলেন। নদীর পার থেকে আবার হল্লার শব্দ শোনা গেল। কুসুম আপু বলল, তুই একটু বাইরে গিয়ে বসতো টগর। আমি না। ডাকলে তাঁবুতে ঢুকবি না।

    আমি বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। দূর থেকে দেখছি—একটা কাটা হাত নিয়ে কে একজন তাঁবুর দিকে আসছে আর পেছনে অসংখ্য মানুষ। কাটা হাতটা থেকে টপ টপ করে পানি পড়ছে।

    এক বর্ষা পার হয়ে আরেক বর্ষা এসেছে। সেই বর্ষা চলে গিয়ে আরো এক বর্ষা আমাদের নান্দাইল রোড স্টেশনে এসেছে। সব আগের মতোই আছে। আবার কিছুই আগের মতো নেই।

    মগরা ব্রিজের কাছে আবারো তাঁবু পড়েছে। অন্য এক ইঞ্জিনিয়ার সেই তাঁবুতে থাকেন। ভদ্রলোক বয়স্ক। মুখ ভর্তি ধবধবে শাদা দাড়ি। তাঁরও অভ্যাস জাপানি ইঞ্জিনিয়ারের মতো ব্রিজের স্প্যানে সন্ধাবেলা বসে থাকা। তাঁর সঙ্গে জায়নামাজ থাকে। সন্ধ্যা মিলালে তিনি জায়নামাজ পেতে নামাজ পড়েন। দৃশ্যটা দেখতে আমার কেন জানি ভালো লাগে। আমি সুযোগ পেলেই দৃশ্যটা দেখতে যাই।

    কুসুম আপুকে তার বাবা নিজের কাছে নিয়ে গেছেন। তিনি তার বাবার সঙ্গে রাজশাহীতে থাকেন। সেখানের কলেজে পড়েন। ছুটি ছাটায় আমাদের দেখতে আসবেন বলে চিঠি লেখেন, কিন্তু আসেন না।।

    বাবার পেটের ব্যথাটা সেরে গেছে। কোনো রকম অষুধপত্র ছাড়াই সেরেছে। তবে অসুখ সারলেও হঠাৎ করে বুড়ো হয়ে গেছেন। মাথার চুল সব পেকে গেছে। সামনের পাটির দুটা দাঁতও পড়ে গেছে। যখন কথা বলেন দাঁতের ফাঁক দিয়ে জিহ্বা দেখা যায়। খুবই অদ্ভুত লাগে। তিনি রাতে ইস্টিশনেই ঘুমান। আরেকটা মেল ট্রেনের স্টপেজ এখানে দিয়েছে। কারণ একজন মন্ত্রীর বাড়ি এই অঞ্চলে। মন্ত্রী চেষ্টা তদবির করে নান্দাইল রোড স্টেশনে মেল ট্রেন থামাবার ব্যবস্থা করেছেন। কাজেই এখন নান্দাইল রোড স্টেশনে রাতে তিনটা মেল ট্রেন থামে। বাবাকে স্টেশনে না ঘুমিয়ে উপায় কী।।

    বাসায় আমি এবং রহিমা ফুপু আমরা দুজন শুধু ঘুমাই। রহিমা ফুপুর অঘুমা রোগ হয়েছে। সারারাত তিনি হাঁটাহাঁটি করেন। ভাইয়া চলে গেছে বিদেশে। এখন আছে নিউজিল্যান্ডে। তিনি চেষ্টা করে ভাইয়াকে বিদেশে নিয়েছেন। ভাইয়া বরফে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছেন এমন একটা ছবি পাঠিয়েছেন। বাবা সেই ছবি দেখে বলেছেন—গাধাটাকে তো চেনা যায় না। করছে কী সে? বরফ খাচ্ছে নাকি? আমি আর বাবা আমরা দুজন মাকে দেখতে গিয়েছিলাম। বাবা, মাকে এই ছবিটা দিয়ে বললেন, সুরমা বলতো কে?

     

     

    মা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, রঞ্জু। পাক্কার মধ্যে শুইয়া আছে কেন? তার কী। হয়েছে?

    বাবা বললেন, পাক্কা না। বরফে শুয়ে আছে। রঞ্জু বিদেশে আছে। খুব ভালো আছে। তোমার জন্যে টাকা পাঠিয়েছে।

    মা ভাইয়াকে চিনতে পারলেও আমাকে বা বাবাকে একেবারেই চিনতে পারলেন না। আমাকে রাগী গলায় বললেন—এই ছেলে তুমি একটু দূরে সরে বস। গায়ের উপর উঠে যাচ্ছ কেন? বাপ-মা সহবত শিক্ষা দেয় নাই?

    জাপানি ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের কথা বলা হয় নি। তার কথা বলি। চীনাম্যান হত্যা মামলায় তাকেও আসামি করা হয়। জমশেদ জবানবন্দিতে বলে, সে যা করেছে সাইট ইঞ্জিনিয়ার কামরুল ইসলাম সাহেবের নির্দেশে করেছে। মামলা অনেক দিন চলে। রায় হয়। জাপানি ইঞ্জিনিয়ারের যাবজ্জীবন কারাদন্ড এবং তিনজনের ফাঁসির হুকুম হয়। জাপানি ইঞ্জিনিয়ার হাজত থেকে কুসুম আপুকে একটা চিঠি লেখেন। কুসুম আপু থাকেন রাজশাহীতে সেই চিঠিটা আমি নিজের কাছে রেখে দেই। চিঠিতে তিনি লিখেছেন–

    প্রিয় কুসুম

    Miss Flower,

    আমাদের মামলার রায় হয়েছে। সেই খবর নিশ্চয়ই পত্রিকা মারফত জেনেছ।। সবার ধারণা বিদেশী নাগরিক হত্যার কারণে রায় অত্যন্ত কঠোর হয়েছে। আমার দুর্ভাগ্য আমি যে নির্দোষ এটা প্রমাণ করতে পারি নাই। অবশ্য যাবজ্জীবন কারাদন্ড শুনতে যেমন ভয়াবহ আসলে তা না। ভালো ব্যবহারের কারণে জেলখানায় অনেক রেয়াত পাওয়া যায়। যাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রাপ্ত আসামিদের কেউই দশ থেকে এগার বছরের বেশি জেল খাটে না। আমি অনেক চিন্তা ভাবনা করে দেখেছি দশ বছর পর তোমার বয়স হবে মাত্র ২৭, এইটা কোনো বয়সই না। দশ বছর জেলে আমার খুব কষ্টে কাটবে। এটা ঠিক। কষ্টের পরেই সুখ। যার যত কষ্ট। তার তত সুখ। সেই সুখের কথা ভেবেই আমার ভালো লাগছে।

    এখন একটা আনন্দের সংবাদ দেই। মামলার রায়ের বিরুদ্ধে আমার ব্যারিস্টার (মশিহুজামান, লিংকনস পাশ করা ব্যারিস্টার। ঝানু লোক। মামলার শুরুতে তাঁকে পেলে খুবই উপকার হত। যাই হোক, আল্লাহর অসীম রহমত তাঁকে এখন পাওয়া গেছে।) হাইকোর্টে আপিল করেছেন। তিনি একশ ভাগ নিশ্চিত হাইকোর্টের রায়ে আমি খালাস পেয়ে যাব। আমার নিজেরো তাই ধারণা।

     

     

    কুসুম তুমি ভালো থেকো। হতাশ হবে না। আল্লাহ্ পাক যা করেন মানুষের মঙ্গলের জন্যে করেন।

    আমি সারাক্ষণই তোমার কথা ভাবি। ঐ ভয়ংকর দিন তাঁবুতে তুমি হঠাৎ কাঁদতে শুরু করলে। ছবিটা এখনো আমার চোখে ভাসে। দুঃখের মধ্যেও আনন্দ পাই।

     

    হাইকোর্টের আপিলের রায় জাপানি ইঞ্জিনিয়ারের জন্যে খুব খারাপ হয়। তিনজনের ফাঁসির জায়গায় হাইকোর্ট জাপানি ইঞ্জিনিয়ার সহ চারজনের ফাঁসির আদেশ দেয়।

    কুসুম আপুকে লেখা জাপানি ইঞ্জিনিয়ারের চিঠিটা আমি মগরা ব্রিজ থেকে নদীতে ফেলে দেই। এই চিঠিটার কথা কুসুম আপুর না জানাই ভালো।

    কুসুম আপু রাজশাহী থেকে মজার মজার চিঠি লেখেন।

    এই টগর। রাতে ট্রেনের শব্দ শুনলেই কিন্তু লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসবি। কারণ তোদের সবাইকে চমকে দেবার জন্যে কোনো এক রাতে আমি হুট করে উপস্থিত হব। আমি এসে যদি দেখি তুই ঘুমাচ্ছিস, তাহলে কিন্তু অসুবিধা আছে। স্যাম্পল হিসেবে একটা চুল ছিড়ে পাঠালাম। খবর্দার হারাবি না। আমি এলে আমাকে ফেরত দিতে হবে।

    রাতে ট্রেনের শব্দ শুনলেই আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। আমি অপেক্ষা করি। অপেক্ষা করতে করতেই মনে হয় সব মানুষের মধ্যে একটা ইস্টিশন থাকে। সেই ইস্টিশনের সিগন্যাল ডাউন করা। ইস্টিশনে সবুজবাতি জ্বলছে।

    আনন্দময় ট্রেনের জন্যে অপেক্ষা। কারো কারো স্টেশনে ট্রেন সত্যি সত্যি এসে থাকে। কারো কারো স্টেশনে ট্রেন আসে ঠিকই, কিন্তু মেল ট্রেন বলে থামে না। ঝড়ের মতো উড়ে চলে যায়।

    রাতের বেলা ট্রেনের শব্দ শুনলে আমি বিছানায় উঠে বসি ঠিকই কিন্তু স্টেশনে যাই না। ধলা সামছু যায়। হাতে হারিকেন ঝুলিয়ে ছুটে যায়। প্রতিটি কামরা লণ্ঠন উঁচিয়ে দেখে। তার স্ত্রী বাজার ছেড়ে চলে গেছে। ধলা সামছুর ধারণা, কোনো এক রাতের ট্রেনে সে আবারো এখানে ফিরে আসবে। তার স্ত্রী যেহেতু খারাপ মেয়ে মানুষ, সে দিনের ট্রেনে আসবে না। রাতের ট্রেনে আসবে। লম্বা ঘোমটা দিয়ে ট্রেন থেকে নামবে। লম্বা ঘোমটা টানা কাউকে নামতে দেখলেই ধলা সামছু তার কাছে ছুটে যায়। গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলে, আপনার নাম? আপনার পরিচয়?

    ⤶
    1 2 3 4 5 6 7 8 9
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleউড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ
    Next Article আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    Related Articles

    হুমায়ূন আহমেদ

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই বসন্তে – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই মেঘ, রৌদ্রছায়া – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এইসব দিনরাত্রি – হুমায়ূন আহমেদ

    December 23, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    একটি সাইকেল এবং কয়েকটি ডাহুক পাখি – হুমায়ূন আহমেদ

    December 23, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Our Picks

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }