Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ইহুদি প্রশ্নে – কার্ল মার্কস

    জাভেদ হুসেন এক পাতা গল্প116 Mins Read0

    পরিভাষা পরিচয়

    নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রথমত মূল রচনায় বারবার ব্যবহৃত পরিভাষাগুলো নেয়া হয়েছে। এই শব্দগুলোকে ঘিরেই মূলত লেখাটি আকার নিয়েছে। লক্ষ্য করবেন দার্শনিক পদগুলোর একটির ব্যাখ্যা আরো পদার্থের সাথে যুক্ত। ফলে মূল রচনাতে না থাকা কিছু পরিভাষা এই অংশের আপাত স্বয়ংসম্পূর্ণতার জন্য গৃহীত হয়েছে। বর্ণনার সাথে মার্কস-এঙ্গেলসের মূল রচনাবলী হতে উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে। ইশতেহার ও হেগেলের অধিকার দর্শনের ভূমিকার উৎস রুশ সংস্করণ ও বাকিগুলোর ভাষান্তর সঙ্কলককৃত। বর্ণনার জন্য রোজেনথালের ‘ডিকশনারি অব ফিলজফি’, টম বটোমরের ‘ডিকশনারি অব মার্কসিস্ট থট’, মার্কসিস্ট আর্কাইভের ‘এনসাইক্লোপেডিয়া অব মার্কসিজম’, উইকিপেডিয়া ইস্তেভান মাসযারেস, এরিক ফ্রমের লেখা এবং বিশেষত লেনিনের ‘ফিলোজফিক্যাল’ নোটবুকের ধারণা কাজে লাগানো হয়েছে। ধারণা জোড় লাগানোর দায় সঙ্কলকের। এই পরিভাষা-বর্ণনা সমন্বিত পাঠে অধিক কার্যকর হবে। প্রয়োজনমতো অগ্রসর পাঠ সাহায্যার্থে মার্কস-এঙ্গেলস রচনাবলীর প্রাসঙ্গিক অংশ নির্দেশ করা আছে। যেসব পরিভাষার বর্ণনা এই সঙ্কলনেই মজুদ তাতে নজরটান দেখবেন।

    আধেয় এবং আঙ্গিক (Content and Form)

    এই দুই দার্শনিক পদ কোনো জিনিসের প্রতিভাস (বা বৈশিষ্ট্য) এবং তার সারসত্ত্বা বা অস্তিত্বের গড়মিল বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। আঙ্গিক হলো কোনো জিনিসের উপাদানের প্রকাশ বা ভেতরকার কাঠামো, তার অস্তিত্বের ধরন। অন্যদিকে আধেয় হলো ঐ জিনিসেরই যতরকম সম্ভাবনা এবং সম্পর্ক আছে তার যোগফল বা সমগ্রতা!

    একসময় আধেয়কে ধারণা করা হতো অরূপ এক বস্তু আর আঙ্গিকে ঐ বস্তুর কাঠামো হিসেবে। এমনি করে বাস্তবতাকে শুধু আঙ্গিক আর আধেয়কে একেবারে হাওয়াই সত্ত্বা বলে ধরলে সব বাস্তবতা অবাস্তব বা মায়া হয়ে যায়।

    আধেয় এবং আঙ্গিক একই জিনিসের দুই প্রেক্ষিত। কোনো জিনিসের বিকাশ এবং চিনে নেয়ার প্রক্রিয়ায় এগুলো একে অপরের মাঝে ঢুকে পড়ে—মানে আঙ্গিক হয় আধেয় আর আধেয় হয়ে যায় আঙ্গিক।

    আঙ্গিক ছাড়া আধেয় হয় না – কোনো জিনিস থাকলে তাকে কোনো না কোনো রূপে থাকতে হয়। আধেয় ছাড়া আঙ্গিক হয় না—কোনো জিনিসের যদি অন্য কিছুর সাথে সংযোগ থাকে তাহলে তা অন্য কিছুও হয়ে যেতে পারে।

    কোনো কাহিনী চলচ্চিত্র হিসেবে বেশ নাম করলেও উপন্যাস হিসেবে ব্যর্থ হতে পারে, হতে পারে উল্টোটাও। শ্রেণী সংগ্রামে কোনো দ্বন্দ্ব সুসংগঠিত সংগঠনের আঙ্গিকে অর্থবহ ফলাফল আনতে পারে। অন্য কোনো দ্বন্দ্ব হয়তো একই আঙ্গিকে ব্যর্থ হবে। প্রাকৃতিক বা সামাজিক প্রক্রিয়াতে অসত্য আঙ্গিককে আধেয়’র কাছাকাছি বলে মনে হতে পারে, মনে হয় যেন আধেয় আঙ্গিকের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, তাকে ছুঁড়ে ফেলে নতুন আঙ্গিক ধারণ করছে বা হয়ে উঠছে। উল্টোটাও হয়।

    হেগেলের দার্শনিক পদ্ধতিতে আঙ্গিক ও আধেয়’র দ্বন্দ্ব প্রতিভাসে নেতিবাচক প্রেক্ষিত, যার মধ্য দিয়ে প্রতিভাস বাস্তবতা বলে প্রমাণিত হয়।

    এই প্রসঙ্গে এঙ্গেলসের ‘লুডভিগ ফয়েরবাখের’ চতুর্থ অংশ দেখুন।

    ইতিবাচক এবং নেতিবাচক মুক্তি (Positive Freedom and Negetive Freedom)

    নেতিবাচক মুক্তি বলতে বোঝায় কোনো স্বতন্ত্রের ইচ্ছানুযায়ী কাজ করবার পথে ক্ষমতার ঘাটতি।

    ইতিবাচক মুক্তি হলো ব্যক্তির পছন্দসই ক্রিয়া করবার পথ বেছে নেয়ার সামর্থ, নিজের সম্পূর্ণ সম্ভাবনা বাস্তবায়নের জন্য সুযোগগুলোর বহাল থাকা।

    এই প্রসঙ্গে দেখুন মার্ক্স-এঙ্গেলসের ‘জর্মন ভাবাদর্শের ৩য় অধ্যায়, মার্ক্সের ‘ক্রিটিক অব গোথা প্রোগ্রামের ৪র্থ অধ্যায় ও ‘অন ফ্রিডম অব দি প্রেস’।

    কার্য ও কারণ (Cause & Effect)

    প্রতিটি কাজের পেছনে কোনো কারণ থাকে, আবার সেই কারণগুলো কোনো না কোনো কাজ হতে জন্ম নেয়। প্রতিটি কার্যও তাই নিজেরই অস্তিত্বের শর্তগুলোর আংশিক কারণ। এই সম্পর্ক বুঝতে গিয়ে মানুষ ও জগতের সম্পর্ক একটি অবিচ্ছেদ্য সমগ্র হিসেবে না বুঝলে সীমাবদ্ধতা উপস্থিত হয়। মার্ক্স এই সম্পর্ককে ক্রিয়াশীল মানুষের জগতের সম্পর্কের নিরিখে বুঝতে চাইতেন। ফলে ব্যক্তিসম্পত্তির ভিত্তিতে গড়া বিচ্ছিন্নতায় মানব সমাজ সম্পর্ক মানুষ এবং জগতের মাঝে মধ্যস্থতা সৃষ্টি করে যা চূড়ান্ত বা সম্পূর্ণ কার্য- কারণ সম্পর্ক বোঝার পথে চরম প্রতিবন্ধকতা।

    জর্মন-ফরাসি বর্ষপঞ্জি (Deutsh Eranzösische Jahrbücher )

    রাইন গেজেট (Rheinische Zeitung) সেন্সরশিপের কবলে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই বর্ষপঞ্জি প্রকাশের পরিকল্পনা করা হয়। তরুণ হেগেলিয়দের মাঝে তুমুল আলোড়ন শুরু হয় গেজেট বন্ধ হওয়ায়। অধিকাংশই কোন প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক কার্যকলাপ বা উদ্দেশ্য বাদ দিয়ে নিখাদ তত্ত্ব চর্চা শুরু করেন। মার্ক্স এবং আর্নল্ড রুগ এ পথে সম্মত না হয়ে বর্ষপঞ্জি প্রকাশের জন্য একত্রিত হন। পত্রিকাটি প্রথমে স্ট্রাসবুর্গ হতে প্রকাশের পরিকল্পনা থাকলেও তৎকালিন বিপ্লবী চিন্তার কেন্দ্র পারি হতে ১৮৪৪ এর ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশ হয়। প্রথম সংখ্যার পরেই পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায় মূলত দুটো কারণে- সেন্সরশিপের কারণে ফ্রান্স হতে জার্মানিতে গোপনে পত্রিকা বিলি করার ঝামেলা আর মার্ক্স ও রুগের মতবিরোধ।

    জাতি ( Nation)

    সাধারণত মনে করা হয় জাতি হলো একই উৎস ভাষা, সংস্কৃতির, একই ভূখণ্ড, একই নিয়মনীতি মেনে চলা বড় কোনো জনগোষ্ঠী, যাদের অন্য জাতির কাছে স্বীকৃতি আছে। ঠিক করে বলতে গেলে, আসলে এ সবই আসলে জাতি যা নয় সে কথাগুলো বলছে। একই ভাষা সংস্কৃতি কোনো গোত্রও ধারণ করতে পারে যারা একই সীমানায় একই রকম নিয়মনীতি মেনে থাকতে পারে। আসলে জাতি হতে হলে গোত্রগত সংকীর্ণ নিয়মনীতি, একবগ্গা সংস্কৃতিকে অতিক্রম করে বহুমুখীনতা ধারণ করবার ক্ষমতা থাকতে হবে। যেমন, ইসরাইলের মতো কোনো জাতিগত জনগোষ্ঠী পূর্ণ অর্থে জাতি হতে পারে না। যদি ফিলিস্তিন আর ইসরাইলিরা পরস্পরের অধিকার স্বীকৃতি দিয়ে বাস করা শুরু করতে পারে, তাহলেই কেবল ইসরাইলিরা গোত্রগত সংকীর্ণতা ভেঙে জাতি হয়ে ওঠার দিকে এগুতে পারবে। কোনো জনগোষ্ঠী সাধারণ আইন, ভাষা, সংস্কৃতি থাকা সত্ত্বেও কুর্দিদের মতো নিজস্ব ভূমিতে আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে না পারার কারণে জাতি হয়ে উঠার প্রক্রিয়া সম্পন্ন নাও হতে পারে। আবার অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের মতো নিজের ভূমিতে বহিরাগতদের অধীনস্ত হয়ে থাকার নজিরও পাওয়া যাবে। বলতে হয় এই জাতিসমূহের জাতিসত্ত্বা বাস্তবায়িত হয়নি।

    একই সঙ্গে নির্দিষ্ট ভূমিসীমার বাইরে কোনো জাতিকে অবশ্যই তার নাগরিকদেরকে নিরাপত্তা দিতে বা রক্ষা করতে হবে, এই অর্থে সম্প্রদায় ধারণাটি জাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে এমনকি জাতি-রাষ্ট্রও জাতির বিকাশের জন্য একটি অসম্পূর্ণতার লক্ষণ, কারণ রাষ্ট্রকে সম্প্রদায়ের ভিতরে শ্রেণীদ্বন্দ্বের মতো নিজের বহাল গঠন দিয়ে অসমাধানযোগ্য ঝামেলার স্বীকার হতে হয়। ফলে এই ধরনের সংঘাত মিলিয়ে না গেলে জাতি সবল হয় না। তবে এটা সম্ভব পুরো পৃথিবীজুড়ে শ্রেণী নামক বিভাজনটির মাত্রাগত পরিবর্তন হলে। ফলে কোনো পরিপূর্ণ বিকশিত জাতি মানুষের বিশ্ব- সম্প্রদায়ের মাঝে মিলিয়ে যাবে, আদৌ আর জাতি থাকবে না। এভাবে জাতি আসলে কোনো অনড় অস্তিত্ব নয়, প্রক্রিয়া।

    জ্যা জ্যাক রুশো (Jean Jack Rosseau)

    জন্ম ১৭১২, মৃত্যু ১৭৭৮। ফরাসি এনলাইটেনমেন্টের বামপন্থী ঘরানার দার্শনিক, ব্রহ্মবাদী, দ্বৈতবাদী (মন ও চিন্তা বিচারে), সংবেদনবাদী (সংবেদনই জ্ঞানের একমাত্র উৎস) তাঁর সামাজিক চুক্তি ও অসাম্যের উৎস নামক সামাজিক তত্ত্বের জন্য খ্যাত।

    দিদেরো, ভলতেরের সাথে এনলাইটেনমেন্টের অংশীদার হয়ে ফরাসি বিপ্লবের ভিত তৈরি করেন। তাঁর কালের চৈতন্য ও প্রকৃতির সম্পর্ক বিচারে যান্ত্রিক ধারণা ভেঙে বস্তুবাদী ভিত তৈরিতে তাঁর তীব্র সমাজ সমালোচনা খুবই প্রভাবক ছিল। ‘মানুষের মাঝে অসাম্যের উৎস’ রচনাতে তিনি দেখান, কেমন করে সামাজিক শর্তসমূহ, ব্যক্তিসম্পত্তি সামাজিক সব সমস্যা ও অসাম্য সৃষ্টি করে।

    এ প্রসঙ্গে এঙ্গেলসের এন্টি ডুরিং-এ তাঁর ওপরে মন্তব্য দেখুন।

    টমাস ম্যুনৎসের (Thomas Muntzer)

    জন্ম ১৪৮৯, মৃত্যু ১৫২৫। রিফর্মেশন জামানায় জর্মন ধর্ম প্রচারক, কৃষক যুদ্ধের বিদ্রোহী নেতা, প্রোটেস্ট্যান্ট সংস্কারক। মার্টিন লুথারের সঙ্গে রিফর্মেশন আন্দোলনে যোগ দেন। ১৫২১ সালে লুথারকে জনস্বার্থবিরোধী, রাজা-বাদশার ধামাধরা বলে আলাদা তরিকা প্রতিষ্ঠা করেন। কৃষক ও শ্রমিকদের মাঝে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। ১৫২৫ সালে ৮০০০ কৃষক নিয়ে যুদ্ধে নেমে পরাজিত হন। তাঁর দ্বিখণ্ডিত দেহ জনসমক্ষে প্রদর্শিত হয়।

    তিনি বলতেন, ঈশ্বরের বাণী মানুষের কাছে আসা বন্ধ হয়নি। বাইবেল ব্যাখ্যা করেই তিনি কৃষকদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধে উৎসাহিত করেন। এঙ্গেলস ‘জার্মানিতে কৃষক যুদ্ধ’ রচনায় তাঁকে বিপ্লবী নেতা বলে উল্লেখ করেন। তাঁর মতে, ম্যুনৎসের বাইবেলের ভাষায় কথা বলতেন কারণ কৃষকরা এই ভাষাই বুঝতো।

    টমাস হ্যামিলটন (Thomas Hamilton)

    জন্ম ১৭৮৯, মৃত্যু ১৮৪২। ইংরাজ লেখক। ইংরাজ বাহিনীর হয়ে আমেরিকান যুদ্ধে অংশ নেয়ার পর সাহিত্যে মনোনিবেশ করেন। তাঁর ১৮৩৩-৩৪-এর Man and Manners in America গ্রন্থটি নির্ভরযোগ্য দলিল বলে স্বীকৃত, তবে নিজ দেশে এর জন্য তিনি নিন্দিত হন।

    টাকা (Money)

    টাকা হলো এমন এক পণ্য যার ব্যবহার হলো মূল্য সংরক্ষণ ও মূল্য পরিশোধের মাধ্যম হিসেবে কাজ করা। তবে এই পণ্যটিকে অন্য সব পণ্যের সম্পর্কের হিসেবে বিশেষ এক ভূমিকা পালন করবার জন্য আলাদা করা হয়। ভূমিকাটি হলো -বাকি সব পণ্যের মূল্যের পরিমাপক হওয়া।

    টাকা প্রথমে সার্বিকভাবে সবকিছুর সমান। মূল্য হিসেবে বুর্জোয়া সমাজে সবকিছুই টাকা দিয়ে পরিমাপযোগ্য। মূল্যের আঙ্গিক হিসেবে টাকা কাজ করলে মূল্য বিশেষ ধাতুর সারবস্তুর আঙ্গিক গ্রহণ করে, যেমন—সোনা বা রূপা। বিংশ শতাব্দীর শেষদিকে টাকার আঙ্গিক বিকশিত হয়ে নিখাদ ভার্চুয়াল অস্তিত্ব পরিগ্রহ করে। তবে মার্কসের কালে কাগুজে টাকা ছিল মূল্যের অবিশ্বস্ত ধারক ও মাঝখানের সংরক্ষক, আন্তর্জাতিক বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে তখন ব্যবহৃত হতো সোনা-রূপা।

    ‘পুঁজি’র প্রথম অধ্যায়ের তৃতীয় অংশে মার্কস মূল্যের আঙ্গিকের ঐতিহাসিক বিবর্তন তুলে ধরেছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে কাগুজে টাকা ও মুদ্রা বাস্তবের চাইতে প্রথাগত মূল্য হিসেবে সাধারণভাবে ব্যবহৃত হতো। তবে কাগুজে টাকার মূল্যের প্রশ্নে তাকে ব্যবহারযোগ্য মূল্যে বদলে নেয়ায় বাস্তব ক্ষমতাটি বরাবরই মূল ব্যাপার ছিল।

    বিংশ শতাব্দীতে রিজার্ভ কারেন্সি হিসেবে আন্তর্জাতিক বোঝাপড়ার মাধ্যম হিসেবে সোনার বদলে মার্কিন ডলার প্রতিস্থাপিত হয় ব্রেটন উডের ১৯৪৪-এর কনফারেন্সে। ১৯৬৮-৭৩ সালের দিকে ব্রেটন উড চুক্তি ভেঙে গেলে এক গতিশীল, ভার্চুয়াল অর্থ প্রক্রিয়া শুরু হয়।

    পুঁজির বিকাশের জন্য টাকার অস্তিত্ব একটি পূর্বশর্ত। তবে ব্যাপারটি শুরু হয় তখনই, যখন শ্রমিকশ্রেণীর কাছে শ্রমশক্তি ছাড়া বিক্রির অন্যকিছু থাকে না আর অপর শ্রেণীর কাছে থাকে ব্যক্তিসম্পত্তি হিসেবে উৎপাদনী মাধ্যমের মালিকানা। কেবল তখনই গাদা গাদা টাকা আবর্তনের মধ্যে এসে মুনাফা করে আর পুঁজি হয়ে উঠে I

    যেহেতু মোট সামাজিক শ্রমের অনুপাত বাড়তে থাকে (তাকে আবার মানুষের অভাব পূরণ করার আগে অবশ্যই বিনিময় পদ্ধতির মাঝ দিয়ে আসতে হয়), যেহেতু বাজার (যার মাধ্যমে মানুষ নিজেদের অভাব প্রকাশ এবং পূরণ করে) জগৎব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে থাকে সেহেতু মূল্যের আঙ্গিক আবশ্যিকভাবেই ক্রমাগত বেশি করে হাওয়াই হয়ে উঠতে থাকে। কোনো কিছুর ওপর মূল্য আরোপের কাজটি একটা হাওয়াই কাজ, কারণ এতে ঐ জিনিসের সম্পূর্ণ নিরেট অস্তিত্ব হতে একটা নির্দিষ্ট গুণকেই কেবল আলাদা করে নেওয়া হয় মূল্য পরিমাপের স্বার্থে। একটা নির্দিষ্ট বস্তু, যেমন স্বর্ণের মধ্যে মূল্যের জমাটবদ্ধতা এই হাওয়াই করার এক বস্তুগত কাজ।

    পণ্যকে প্রথমে আলাদা করা হয় মূল্য পরিমাপের কাজটুকু করতে। এটি আঞ্চলিক উৎপন্নের জন্য খুবই কার্যকরী। পরে অর্থপণ্যটি প্রান্তিকভাবে ব্যবহৃত হতে থাকে। তখনো তা পুরোমাত্রায় শ্রমেরই এক উৎপন্ন। অর্থপণ্যটির প্রেক্ষিত হতে এর বিকাশ মূল্যের এক হাওয়াই প্রতীক হয়ে উঠার কাহিনী। এটি একটি সামাজিক ক্যাটেগরি যা সম্প্রদায়ের মূল্যবোধকে প্রকাশ করে, যে মূল্যবোধ হাওয়াই শ্রমের অর্থপণ্যের প্রেক্ষিতটিকে ছাপিয়ে যায়।

    আজকাল এই পরিবর্তন অনেক দূর এগিয়ে গেছে। আধুনিক জীবনের সমস্ত অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও সংরক্ষণ, পরিমাপ বা মূল্যের বাহক হিসেবে টাকা বা ক্রেডিট কার্ডের মতো অন্য কিছুই এত কার্যকরী নয়। মূল্যের এই বায়বীয়, হাওয়াই উত্তরণ আজকের যুগের শ্রমপ্রক্রিয়ার জন্য একেবারেই লাগসই। আজ উৎপাদনের প্রতিটি ক্রিয়াই প্রতিটি স্তরে পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্ত হতে শ্রমিকদের শ্রমকে সন্নিবেশিত করে। এই ই-কমার্স, ক্রেডিট কার্ডের মতো মূল্যের আঙ্গিকই পারে এই মাত্রায় পণ্য বিনিময়কে সচল রাখতে। টাকা বুর্জোয়া সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ, কারণ শ্রমক্ষমতা নিজেই এখানে একটি পণ্য। টাকার প্রবাহ ব্যবহারিক মূল্য গঠনের একটি বিশ্বস্ত আয়না। এই টাকা সম্পর্ক শ্রমকে কাজে লাগানোতে সহযোগিতা করার সঙ্গে সঙ্গে এর সারসত্ত্বাটিকে নাকচও করে দেয়। টাকা দিতে না পারলে বুর্জোয়া সমাজে কোনো কিছুই পাওয়া বা করা সম্ভব নয়। এই টাকার সম্পর্ক চক্রটি অতিক্রম করা ছাড়া পুঁজির উচ্ছেদ অকল্পনীয়। তবে একই সাথে এই উচ্ছেদের মানে সামাজিক শ্রমের নতুন কোনো উপায়ে সংগঠিত হওয়া।

    ধর্ম (Religion)

    “মানুষ ধর্ম তৈরি করে, ধর্ম মানুষকে তৈরি করে না। যে মানুষ হয় এখনো নিজেকে খুঁজে পায়নি কিংবা নিজেকে আবার হারিয়ে ফেলেছে ইতোমধ্যে, ধর্ম হলো তার আত্মচেতনা এবং আত্মসম্মান। কিন্তু মানুষ তো জগতের বাইরে তাঁবু খাটিয়ে থাকা কোনো বিমূর্ত সত্তা নয়। মানুষ হলো মানুষের জগৎ, রাষ্ট্র, সমাজ। এই রাষ্ট্র, এই সমাজ পয়দা করে ধর্ম, এক ওলটানো জগৎ-চেতনা, কেননা সেগুলো হলো একটা ওলটানো জগৎ। ধর্মীয় ক্লেশ হলো একই বাস্তব ক্লেশের অভিব্যক্তি এবং বাস্তব ক্লেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও। ধর্ম হলো নিপীড়িত জীবনের দীর্ঘশ্বাস, হৃদয়হীন জগতের হৃদয়, ঠিক যেমন সেটা হলো আত্মাবিহীন পরিবেশের আত্মা। ধর্ম হলো জনগণের জন্য আফিম। মানুষের মায়াময় সুখ হিসেবে ধর্মকে লোপ করাটা হলো মানুষের প্রকৃত সুখের দাবি করা। বিদ্যমান হালচাল সম্বন্ধে মোহ পরিত্যাগ করার দাবিটা হলো যে হালচালে মোহ আবশ্যক সেটাকে পরিত্যাগ করার দাবি। তাই ধর্মের সমালোচনা হলো ধর্ম যার জ্যোতির্মণ্ডল সেই আত্ম উপত্যকার (এই পার্থিব জীবনের) সমালোচনার সূত্রপাত। (মার্কস, হেগেলের অধিকার দর্শনের পর্যালোচনার ভূমিকা)

    “যেহেতু মানুষ এবং প্রকৃতির বাস্তব অস্তিত্ব, প্রকৃতির সত্ত্বা হিসেবে মানুষ মানুষের কাছে এবং মানুষের সত্ত্বা হিসেবে প্রকৃতি মানুষের কাছে হয়ে উঠেছে হাতে-কলমের, সংবেদনগত, প্রত্যক্ষণযোগ্য, সেহেতু কোনো বিজাতীয় সত্তার ব্যাপারে প্রশ্ন, প্রকৃতি এবং মানবঊর্ধ্ব কোনো সত্তার ব্যাপারে প্রশ্ন করা মানে প্রকৃতি এবং মানুষের অবাস্তবতাকে মেনে নেয়া বোঝায়। প্রশ্নটি প্রয়োগে অসম্ভব হয়ে গেছে। এই অবাস্তবতার অস্বীকৃতি হিসেবে নাস্তিকতা আর কোনো অর্থ বহন করে না, কারণ নাস্তিকতা হচ্ছে ঈশ্বরের নেতিকরণ, আর এই নেতিকরণের মাঝ দিয়েই মানুষের অস্তিত্ব স্বীকার্য করে নেয়া। কিন্তু সমাজতন্ত্র হিসেবে সমাজতন্ত্রের আর এমন কোনো ঘুরপথের দরকার হয় না। সে সারসত্ত্বা হিসেবে মানুষ এবং প্রকৃতির তাত্ত্বিক এবং প্রায়োগিক সংবেদনগত চৈতন্য হতে যাত্রা শুরু করে। সমাজতন্ত্র হলো মানুষের সদর্থক আত্মচৈতন্য, যার আর ধর্মকে উৎখাত করার মধ্যস্থতার দরকার পড়ে না। (মার্কস: ইকোনমিক এন্ড ফিলোজফিক ম্যানুস্ক্রিপ্ট, ১৮৪৪)

    নব্য হেগেলীয় (The Young Hegalians )

    নব্য হেগেলীয়রা ছিল ১৮৪০ দশকের জর্মন এক বুদ্ধিবৃত্তি চর্চাকারী দল। তাদের মূল বিষয়বস্তু ছিল হেগেলের দার্শনিক উপসংহার মেনে নেয়ার চাইতে তার দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির চলমান প্রয়োগ। দলের মূল লোক ছিলেন ম্যাক্স স্টার্নার, লুডভিগ ফয়েরবাখ, ব্রুনো বাউয়ের, ডেভিড স্ট্রস এবং আর্নল্ড রুগে। কম বয়সী সদস্য ছিলেন অগাস্ত ফন, সিয়েস্কোভস্কি, কার্লস্মিড, এডগার বাউয়ের, ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস এবং কার্ল মার্কস। তাঁরা ধর্মের র‍্যাডিকাল পর্যালোচনাকে গুরুত্ব দিতেন, যার প্রধান ফসল হচ্ছে ডেভিড স্ট্রসের ‘যীশুর জীবন’ এবং ফয়েরবাখের ‘খ্রিষ্টানত্বের সারসত্তা’।

    নয়া হেগেলীয়দের বিশ্ববীক্ষার মূল বিশ্বাস ছিল যে, হেগেলের দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি বোঝায় পৃথিবীর ইতিহাস দুটো স্তর পার হয়েছে। এক প্রাচীনকালের বস্তুবাদ আর দুই খ্রিষ্টানত্বে চিন্তাভাবনার আধুনিকতাবাদী কাল। এখন দার্শনিকদের কাজ হচ্ছে জটিল, প্রায়োগিক কাজগুলোকে সম্পন্ন করায়। এই মূল জায়গা থেকে তরুণ হেগেলীয়রা রাজনৈতিকভাবে অসহ্যরকম র‍্যাডিকাল হয়ে পড়েছিল। হেগেল বলতেন, ‘যা কিছু যৌক্তিক তাই বাস্তব, আর যা কিছু বাস্তব তাই যৌক্তিক।’ তারা বাস্তবকে যৌক্তিক করে পুনর্বিন্যাসের কাজ হাতে নিলেন

    স্পিনোজা বলেছিলেন, সবকিছুর মাঝে ঈশ্বর, মানে প্রকৃতির মাঝে, আমাদের মাঝেও তাকে দেখা যায়। এভাবে গভীরতর দৃষ্টিতে আমি আর তুমি অভিন্ন। হেগেলের অন্যতম পূর্বজ শেলিং এই প্রকল্পটি গ্রহণ করেছিলেন। অপর পূর্বজ ফিকটে কান্টের মন আর জগতের বিভাজনকে একত্রে আনার চেষ্টা করেছেন। তাঁর কাছে সবই হচ্ছে অহং। আমার বা তোমার অহং নয়, সর্বব্যাপী পরম অহং। যখন কেউ জগতের দিকে তাকায় যে তখন আসলে তার নিজের দিকেই তাকিয়ে থাকে।

    এভাবে ফিকটে এবং শেলিং দু’জনেই মন এবং বস্তুর অদ্বৈততার মাঝে ঐক্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছেন। হেগেল এই দুই প্রস্তাবনাকেই খুব একপাক্ষিক বলে ঘোষণা করলেন, চেষ্টা করলেন মনকে বস্তুতে (শেলিং) অথবা বস্তুকে মনে (ফিকটে) সংকুচিত করে আনতে। তাঁর মতে, মন ও বস্তু পরমের উভয়দিক। এই সংশ্লেষে হেগেল বিজ্ঞানের মতো ধর্মীয় চিন্তাকেও এক জায়গায় নিয়ে এলেন। দার্শনিক বিকাশ হচ্ছে মরমের দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ার মাঝ দিয়ে বিকাশ।

    হেগেল অন্তত এইটুকু ভেবেছিলেন। তার শিষ্যরা হয়ে গেল দু’ভাগ। একদিকে সনাতন হেগেলীয়রা বলতো, হেগেলের সাথে সাথে দার্শনিক বিকাশ পরিণতিতে পৌঁছে গেছে। নব্য হেগেলীয়রা বলতো যে, আমাদের চেষ্টা করা উচিৎ যে হেগেলের উপরেই হেগেলকে প্রয়োগ করা, মানে হেগেলের পদ্ধতি প্রয়োগ করেই হেগেলকে ছাপিয়ে যাওয়া।

    ডেভিড স্ট্রস হেগেলের পদ্ধতি প্রয়োগ করে বাইবেলের নতুন নিয়ম বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত টানলেন: ঈশ্বর যদি ধর্মতাত্ত্বিকদের বলা ঈশ্বরের মতো হন তাহলে খ্রিষ্টের মতো কারুর হয়ে উঠাটা অসম্ভব। যীশুখ্রিষ্ট আসল খ্রিষ্টের উপমার বেশি কিছু নন। আর এই আসল খ্রিষ্ট হচ্ছে স্বয়ং মানবজাতি। মানবজাতি নিজেই নিজের পাপের শাস্তি নিজে গ্রহণ করে, পুরাতনের বোঝা টেনে নিজেরই রক্তের বিনিময়ে নতুনকে প্রতিষ্ঠা করে।

    ল্যুডভিগ ফয়েরবাখ এরপর ঘোষণা করেন, মানবজাতি শুধু খ্রিষ্ট নয়, সেই স্বয়ং ঈশ্বর। তাঁর খ্রিষ্টানত্বের সারসত্ত্বা’য় তিনি দেখান, ঈশ্বরকে জানতে হয় অনুভব তথা স্বজ্ঞা দিয়ে। যদি এই অনুভবও ঈশ্বরের কাছ থেকেই আসে তাহলে অনুভবও কি ঐশ্বরিক নয়! এক ঝাঁক চতুর প্রস্তাবনার মধ্য দিয়ে ফয়েরবাখ বুঝিয়ে দেন, ঈশ্বর বা স্বর্গীয় বলতে আমরা যা বোঝাই তা সেইসবের অনুভব মাত্র!

    বিধেয় ছাড়া ঈশ্বর ফাঁকা উদ্দেশ্য মাত্র। এরকম কোনো কিছুই আমাদের মনোযোগ আকর্ষণের প্রশ্নই উঠে না। এমন ঈশ্বরের জন্য অনুভবের ঐশ্বরিকতাও তদ্রুপ। এই অনুভব আসলে আমাদের নিজেরই। মানুষের মধ্যেই আমাদের সারসত্ত্বার প্রকাশ। আমাদের ভেতরে ঈশ্বরের জন্য যে টান আমরা অনুভব করি, তা আসলে মানবজাতির জন্য, আমাদেরই সারসত্ত্বার জন্য।

    হেগেল একপাক্ষিকতা থেকে মুক্ত নন। তিনি সংবেদন এবং বুদ্ধিকে বিবেচনায় নেননি, মরমের ঘর-সংসারের মনটিকে তিনি দেহসম্পন্ন চিন্তাশীল মানুষের সঙ্গে জুড়ে দিতে ভুলে গিয়েছিলেন।

    এখান থেকে শুরু করেন স্টার্নার। হেগেলের ফেনোমেনলজি যদি এক এবং একক ‘আমি’ দিয়ে পাঠ করা যায় তাহলেই স্টার্নারকে ভালোমতো বোঝা যাবে। হেগেলের কাছে পরম হলো নেতিবাচকের ক্ষমতা, মানে যা নির্ধারণের মধ্যে নেই, বরং যা প্রতিটি নির্ধারণী চিন্তাকে সমালোচনা করে। স্টার্নারের কাছে এই নেতিবাচকের ক্ষমতা হলো একক চৈতন্য, মানে আমি নিজে।

    সিজোকোভস্কি হেগেলীয় আঙ্গিকের দর্শনের সঙ্গে আরো ভালোমতো খাপ খাওয়ানোর জন্য হেগেলীয় বিশ্বইতিহাস পরিমার্জন করে তৈরি করলেন। তিনি বললেন, আমরা অতীত (শিল্প) পার হয়ে এসেছি, যা ছিল বাস্তবের ধ্যানের স্তর। পৌঁছেছি বর্তমানে (দর্শন), যা আদর্শের ধ্যান। যেহেতু হেগেলের দর্শন ছিল দর্শনের যোগফল এবং নিখুঁত প্রকাশ সেহেতু দর্শনেরও কাল শেষ। এখন এসেছে নতুন যুগ, এই যুগ কর্মের। কিন্তু তাঁর এই কর্মের আহ্বান আমি করবো বলে না, বলে আমরা করা উচিৎ। এমনকি ফয়েরবাখের আমি, একটা প্রজাতি, একক মানুষ নয়। এভাবে শোনা গেল ব্যক্তির প্রজাতি স্বভাব বাস্তবায়নের ডাক। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় আমাদের সারসত্ত্বা সামগ্রিকতায় বাস করে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এখানে ব্যক্তির ইচ্ছা অসহায় হয়ে পড়ে।

    সামগ্রিকভাবে নব্য হেগেলীয়দের চিন্তার এসব কাঠামোর মাঝ হতেই কার্ল মার্কসের অভিযাত্রা শুরু।

    নাগরিক (Citizen )

    ইংরেজিতে নাগরিক শব্দটি মূলত অনেকগুলো মানেকে এক সাথে আধ-খ্যাচড়াভাবে প্রকাশ করে। এর আসল অর্থগুলো পাওয়া যাবে এর ফরাসি/জর্মন সমশব্দে।

    ফরাসি citoyen মানে সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক জীবনে অংশগ্রহণকারী, রাজনৈতিক অধিকারের বাহক ব্যক্তি, ইতিবাচক স্বাধীনতা ভোগকারী, ফরাসি বিপ্লবের কালে, অথবা মার্কস যখন ‘পুঁজি’ গ্রন্থের ফরাসি সংস্করণের মুখবন্ধে ‘নাগরিক’ শব্দটি ব্যবহার করেন তখন তা এই citoyen.

    অপর দিকে এর জর্মন সমশব্দ Burger পরিষ্কার ভাবে বোঝায় সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক জীবনে ব্যক্তি অংশগ্রহণকারী হিসেবে কাউকে যে সামাজিক অধিকারেরর বাহক, যে অধিকারে হস্তক্ষেপ করা যায় না আর যতক্ষণ তা অন্যকে ক্ষতি না করে ততক্ষণ তা রক্ষা করা যায়। মানে নেতিবাচক স্বাধীনতা ভোগকারী। এই Bürger এর ফরাসি ভাষান্তর হল Bourgeois- বুর্জোয়া, এভাবে বুর্জোয়া হল ব্যক্তিদের শ্রেণী। Burger কে কখনো ইংরেজিতে Indevidal করে ভাষান্তর করা হয়। Burgerlicher Gessellschaft এর আক্ষরিক মানে, ‘বুর্জোয়া সমাজ’, যাকে সাধারণত ইংরাজিতে ভাষান্তর করা হয় ‘Civil Society’ হিসেবে।

    দুই ভাষাতেই শব্দ দু’টির মানে অনেক বদলে গেছে। Büierger কে ইংরেজিতে বরং ‘Burgher’ করে অনুবাদ করা যায়, যার মানে বোঝায় সম্মানিত ব্যবসায়ী-যে কালে সম্পত্তি না থাকা মানে সমাজে, রাষ্ট্রে কোনো অধিকার না থাকা বোঝাত।

    জর্মন ভাষায় Staatsburger-কেও Citizen হিসেবে ভাষান্তর করা হয়, যার মানে Citoyen এর অনেক কাছাকাছি। বর্তমানে Staatsburger বলতে পাসপোর্টধারী, বৈধ জর্মন জাতির কাউকে বোঝায় শুধু জর্মন অধিবাসী যা নন।

    পূর্বানুমান (Presupposition)

    যা কিছু আমরা আগে থেকে আছে বলে মেনে নিই, সাধারণত আর বিচার বিশ্লেষণ করি না তাকে পূর্বানুমান বলে।

    প্রজা (Subject)

    প্রজা বলতে বোঝায় কোনো ব্যক্তি বা সত্ত্বা যে কোনো কাজ করে, সে কাজের জন্য দায়বদ্ধ থাকে, লক্ষণীয় সে কোনো বিষয় নয় যার ওপরে শুধু হুকুম বর্তাও হয়। ইতিহাসে প্রজা হলো কোনো ঘটনার সচেতন নির্মাতা, ঘটনার অচেতন হাতিয়ার নয়।

    কান্ট ‘প্রজা’ ধারণাকে নৈতিকতা দিয়ে, নৈতিক আইনের প্রতি বাধ্য-বাধকতা দিয়ে ব্যাখ্যা করেন। কিন্তু সমস্যা ছিল ব্যক্তি আর ব্যক্তি সমগ্রতে প্রজা ধারণা কিভাবে দেখা হবে তা নিয়ে। হেগেল বললেন, এই ‘প্রজা’ হলো কাজ-কারবারের এক আত্মচেতন পদ্ধতি যাতে স্বতন্ত্র, সার্বিক ও বিশেষ এর প্রেক্ষিতগুলো সমানে চালু থাকে। ঐতিহাসিকভাবে, স্বতন্ত্র প্রজা, সে যে সমাজ বিষয়ীর অংশ, তার কাছ হতে ক্রমাগত নিজেকে আলাদা করে।

    প্রত্যক্ষ জ্ঞান (Immediate Knowledge )

    প্রমাণ ছাড়া, সরাসরি সত্যের ধ্যানে পাওয়া জ্ঞান, যা কিনা অভিজ্ঞতার উপাত্ত কাজে লাগিয়ে, যৌক্তিকভাবে বুদ্ধি খাটিয়ে পাওয়া অপ্রত্যক্ষ জ্ঞানের বিপরীত

    প্রপঞ্চ (Phenomenon )

    ইন্দ্রিয়ের মাঝে প্রকাশিত কিছু, যা অভিজ্ঞতার সীমানা মানে না। প্রপঞ্চ প্রতিভাসের সমার্থক।

    বাজার ( Market)

    মূলত বাজার হলো ক্রেতা এবং বিক্রেতার একত্রিত হওয়া এবং দরাদরি করে দামের ব্যাপারে সমঝোতায় পৌঁছবার জায়গা। আধুনিককালে এই জায়গাটি হয়ে গেছে একটি সামাজিক ক্ষেত্র। বাজার হলো একটি বিস্তৃত সামাজিক গঠন যাতে মানুষের প্রয়োজন মেটে, অপর মানুষের শ্রম দিয়ে বিনিময় সম্পর্কের এক জটিল জালের মাধ্যমে যেখানে বাজারের প্রত্যেকেই একে অপরের সাথে সম্পর্কিত। বাজার একই সঙ্গে কার্যকরী চাহিদা অর্থাৎ কোনো নির্দিষ্ট পণ্যের জন্য মূল্য প্রদান করতে ইচ্ছুক এবং সক্ষম লোকদের উপস্থিতিও বোঝায়।

    উৎপন্ন বিনিময়ের কার্যকরী উপায় হওয়ার পাশাপাশি বাজার প্রতিটি ব্যক্তির বাজারে আনা উৎপন্নের দাম নির্দিষ্ট করার ব্যাপারেও কাজ করে। বাজার কেমন করে দাম নির্ধারণ করে, এডাম স্মিথ তা ব্যাখ্যা করেন:

    “… বাজার দর বড় মাপের উঠানামা দেখবে, কখনো তা হঠাৎ করেই বেশ নিচে নেমে যাবে, আবার কখনো স্বাভাবিক দরের চাইতে অনেক বেশি উপরে উঠে যাবে। অন্য প্রজাতির শিল্পে সমান পরিমাণ শ্রমের উৎপন্ন সবসময়ই প্রায় এক বা একই রকম। এখানে তা কার্যকরী চাহিদার সঙ্গে খাপ খেয়ে যাবে ভালো। যখন সেই চাহিদা একই রকম থাকতে থাকে, ফলে পণ্যসমূহের বাজার দর একই রকম থাকে তখন সব মিলিয়ে স্বাভাবিক দরের অনুরূপভাবেই তাকে বিচার করা যায়।” (এডাম স্মিথ, Wealth of the Nation 1776, Book, ch. 7 )

    জন স্টুয়ার্ট মিলের কাল হতে বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদরা দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে এডাম স্মিথের চেয়ে বাজারকে বেশি ক্ষমতা দিয়ে দেন। এডাম স্মিথ মূল্য বা স্বাভাবিক দরের মতো কিছু জিনিস মানতেন যার সাপেক্ষে দামের ওঠানামা হয়। পরের অর্থনীতিবিদরা বাজারকেই মূল্য নির্ধারণের একমাত্র ঠিকাদারী দিয়ে ফেলেন।

    আরো সাম্প্রতিক কালে ক্যানেথ অ্যারোর মতো অর্থনীতিবিদরা বাজারকে মনে করেন অর্থনৈতিক দালালদের এক নেটওয়ার্ক, যারা অপর দালালদের কাছে সংবাদ পাঠায় এবং বিনিময়ে পাওয়া সংবাদগুলোকে হিসেব করে সিদ্ধান্ত নেয় যার ফল হলো শৃঙ্খলাহীন, গতিশীল এক প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া ঊনবিংশ শতাব্দীর সাম্যাবস্থা বাজারের ধারণার চাইতে অনেকটাই ভিন্ন।

    শ্রমের বিনিময় হচ্ছে শ্রম সহযোগিতার সবচেয়ে মৌলিক আঙ্গিক, তাই বাজারের গঠন হচ্ছে সমাজ গঠনের দিকে প্রথম পদক্ষেপ। এভাবে বাজারের জায়গাগুলোই হয়ে উঠতো শহর এবং এখন খোদ জাতি গড়ে উঠছে সাধারণ বাজারকে ভিত্তি করে।

    “নিজেদের প্রস্তুতকৃত মালের অবিরত বেড়ে চলা বাজারের জন্যে তাগিদ বুর্জোয়া শ্রেণীকে সারা পৃথিবীময় দৌড় করায়। সর্বত্র তাদের ঢুকতে হয়, সর্বত্র গেড়ে বসতে হয়, যোগসূত্র স্থাপন করতে হয় সর্বত্র।”

    বুর্জোয়া শ্রেণী বিশ্ববাজারকে কাজে লাগাতে গিয়ে প্রতিটি দেশেরই উৎপাদনের আর পরিভোগে একটা বিশ্বজনীন চরিত্র দান করেছে। যে জাতীয় ভূমিটার ওপর শিল্প দাঁড়িয়েছিল সেটাকে শিল্পের পায়ের তলা থেকে কেড়ে নিয়ে তারা প্রতিক্রিয়াশীলদের ক্ষুব্ধ করেছে। সমস্ত সাবেকী জাতীয় শিল্পকে হয় ধ্বংস করা হয়েছে, নয় প্রত্যহ ধ্বংস করা হচ্ছে। তাদের স্থানচ্যুত করছে এমন এমন নতুন শিল্প যার প্রচলন সকল সভ্য জাতির পক্ষেই মরা-বাঁচা প্রশ্নের শামিল, যেসব শিল্পে কাজ চলে দেশজ কাঁচামাল নিয়ে আর নয়— দ্রুততম অঞ্চল থেকে আনা কাঁচামালে; যেসব শিল্পের উৎপাদন শুধু স্বদেশেই নয়, পৃথিবীর সর্বাঞ্চলেই ব্যবহৃত হয়। দেশজ উৎপন্ন যা মিটত তেমন সব পুরাতন চাহিদার বদলে দেখছি নতুন নতুন চাহিদা, যা মেটাতে দরকার দূর-দূর দেশের এবং আবহাওয়ার উৎপন্ন। আগেকার স্থানীয় আর জাতীয় বিচ্ছিন্নতা আর স্বয়ংসম্পূর্ণতার জায়গায় দেখা যাচ্ছে সর্বতোমুখী আদান-প্রদান, জাতিসমূহের পৃথিবীজোড়া পরস্পরনির্ভর, বৈষয়িক উৎপাদনে যেমন, তেমনই মানস উৎপাদনের ক্ষেত্রেও। এক-একটা জাতির মানসিক সৃষ্টি হয়ে পড়ে সকলের সম্পত্তি। জাতিগত একপেশেমি আর সংকীর্ণচিত্ততা ক্রমেই আরো অসম্ভব হয়ে পড়ে; বহু জাতীয় আর স্থানীয় সাহিত্য থেকে দেখা দেয় বিশ্বসাহিত্য। (মার্কস-এঙ্গেলস: কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার, প্রথম অধ্যায়)

    তবে বাজার নিয়ে সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো নিও-লিবারেলদের বাজারকে একেবারে ঐশ্বরিক সত্ত্বা বানিয়ে ফেলবার ঝোঁক। তারা এর মাঝেই মানবজাতির সমস্ত রোগের ওষুধ দেখেন। Wealth of Nation-এ এডাম স্মিথের কৌতূহল উদ্দীপক উদ্ধৃতি দেখুন:

    “…সে শুধু নিজের লাভই চায়, আর তা করতে গিয়ে অন্য অনেক কিছুর মতোই সে এক অদৃশ্য হাতের দ্বারা চালিত হয় এমন এক লক্ষ্যের দিকে যা তার অভিপ্রায়ের অংশ ছিল না। তবে তা এই অভিপ্রায়ের অংশ না হওয়ায় সব সময় তা সমাজের জন্য নিকৃষ্টতম নয়। নিজের স্বার্থ উদ্ধার করতে গিয়ে সে প্রায়ই সমাজের উদ্দেশ্যেও পূরণ করে, আর তা সে নিজে ইচ্ছে করলে যেমন হবে তার চেয়েও কার্যকর। জনগণের ভালো করতে যারা বাণিজ্য করেন তারা আসলেও কিছু করতে পেরেছেন, আমি অন্তত এমন দেখেনি। এমন মায়া-দয়া অবশ্য বণিকদের মাঝে দুর্লভ, তাদেরকে নিবৃত্ত করবার জন্যও বেশি কথা খরচ হয় না। (Adam Smith: Wealth of Nations, ch 2, Book 4 )

    একেবারে আকাট অর্থনীতিবিদরাই এখনো বাজারের মাধ্যমে সব সামাজিক সমস্যা সমাধানের গা জোয়ারি করেন :

    “পুঁজি কেবল সুবিধাজনক প্রচেষ্টাই গ্রহণ করে, পুঁজির সর্বোচ্চ বিকাশ তখনই হয় যখন সামাজিক উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় সাধারণ শর্তগুলো সামাজিক আয়ের হিসাব রাষ্ট্র কর হতে না করে বরং পুঁজি হিসেবে পুঁজি হতে পরিশোধিত হয়। পুঁজি যে সামাজিক উৎপাদনের শর্তগুলো কি মাত্রায় নিজের বশীভূত করেছে এ হতেই তা বোঝা যায়। অপরদিকে এ হতে বোঝা যায় সামাজিক সম্পদের পুনরুৎপাদন কি মাত্রায় পুঁজিকৃত হয়েছে। আর সমস্ত প্রয়োজনই তো পূরণ হয় বিনিময় আঙ্গিকের দ্বারা। (Marx: Grundrisse, Part 10 )

    মহামন্দার পরে, বাজার যে সবার প্রয়োজন মেটাবার মতো সাম্যাবস্থা কোনো না কোনো ভাবে খুঁজে নেয়, এই ধারণা চিরকালের মতো শেষ হয়ে যায়। জন মেনার্ড কেইন্স ১৯৩৫ সালে তার General theory of employment Interest & money গ্রন্থে দেখান যে, এমনকি মন্দার কালেও বেকারত্ব দূর করার মতো মাত্রায় মজুরি পৌঁছাতে পারে না। মন্দার সময় হয় ব্যক্তি বিনিয়োগ ব্যাপক হারে বাড়াতে হয়, নয়তো তার ঘাটতি পূরণের জন্যে সরকারি বিকল্প সৃষ্টি করতে হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিমা সরকারগুলো কেইন্সীয় অর্থনীতির প্রতি বিশ্বস্ত রেখেই বাজার ওঠাপড়ার ক্ষতিকর প্রভাবের সীমা বেঁধে দিতে থাকেন।

    তবে এখন পর্যন্ত শেষ কথা হচ্ছে পরিকল্পিত অর্থনীতির বিপরীতে বাজারকে বিলোপের ভাবনা বহুরকমের সাবধানতা দাবি করে।

    বাস্তব (Real / Actual )

    প্রক্রিয়া এবং ধারণা বিকাশের সাথে সম্পৃক্ত দার্শনিক ধারণা। দর্শনে বাস্তব বলতে চিন্তার বিপরীতে বস্তুময়তার দিকে নির্দেশ করা হয় না। মানসিক কারবারগুলো বস্তুগত জিনিসের মতোই বাস্তব, তা বরং সম্ভাবনাসমূহ হতে নির্দিষ্ট একটি বাস্তবতার দিকে চলমান। সমাজ বা প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াতে বাস্তবতা বোঝায় কোনো কিছুর আবশ্যক/অনাবশ্যক সমস্ত অবস্থার একত্রে আসাকে, সম্ভাবনা অতিক্রম করে বাস্তব হয়ে ওঠাকে।

    কোনো কিছু চিনে নেয়ার ক্ষেত্রে বাস্তবতা বোঝায় কোনো কিছুকে এমন বিন্দুতে অনুধাবন করা যেখানে সব কারণ ও কার্যগুলো পারস্পরিকভাবে আন্তঃসম্পর্কিত, আর ঐ জিনিসটির প্রত্যক্ষ রূপকে বুঝতে হয় তার অস্তিত্ব ও আবশ্যিক আধেয়’র সঙ্গে একেবারে অভিন্ন হিসেবে।

    বিকাশ (Development )

    বিকাশ বলতে বোঝায় এমন এক পরিবর্তনের প্রক্রিয়া যাতে কোনো কিছু ক্রমাগত আরো শক্ত-পোক্ত, পূর্ণাঙ্গ হয়ে ওঠে। এর বিপরীতে আছে একটি জিনিসের অস্তিত্বমানতার জন্য অন্য একটি জিনিসের জায়গা ছেড়ে দেয়া অথবা আঙ্গিক এবং আধেয়’র সংগ্রামের পথে বা কার্যকারণে’র অদল বদলে কোনো জিনিসের অন্য জিনিসে উত্তরণ ঘটা।

    বিচ্ছিন্নতা (Alienation)

    যে প্রক্রিয়ায় মানুষ নিজেরই বাস করা জগতে অচেনা হয়ে পড়ে তাকে বিচ্ছিন্নতা বলে। প্রতিটি সমাজে রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় তত্ত্বে বলা হয়ে থাকে কোনো এক সোনালী অতীতের কথা যখন মানুষ সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে বাস করতো। তারপর এতে অবনতি ঘটে। আবার কোনো এক সময় মানুষ সেই রকম সুখের দিন ফিরে পাবে নির্দিষ্ট কিছু শর্তে এভাবে প্রতিটি ঐতিহাসিক কালপর্বেরই একেকটি বিচ্ছিন্নতার ধারণা তৈরি হয়।

    মার্কস তার ইহুদি প্রশ্ন প্রসঙ্গে’ প্রথম বিচ্ছিন্নতার ধারণাটি ব্যবহার করেন। তিনি হেগেলের পর্যালোচনার মাধ্যমে আধুনিক বুর্জোয়া সমাজে সর্বব্যাপী বিচ্ছিন্নতা প্রদর্শন করেন। হেগেলের মতে, মানুষের নিজের কাজকর্মই একটা সংস্কৃতি গড়ে তোলে, যা পরে তাদের সামনে এক অচেনা বিজাতীয় শক্তি হিসেবে রুখে দাঁড়ায়। তবে মানুষের কাজকর্মকে হেগেল মরমের প্রকাশ হিসেবে দেখতেন।

    মার্কস প্রথমে দেখালেন, মানুষের শ্রমই সংস্কৃতি এবং ইতিহাস তৈরি করে অর্থাৎ মরম বা ভাব মানুষেরই উৎপন্ন। দ্বিতীয়ত হাতে-কলমের কাজ বস্তুগত দুনিয়াকে বদলে ফেলে, তাই হাতে-কলমের কাজ হলো বিষয়, আর তাই শ্রম-প্রক্রিয়া হলো মানুষের ক্ষমতার বিষয়করণ। কিন্তু যদি নিজেদের উৎপন্নের সঙ্গে শ্রমিকরা নিজেদের সারসত্ত্বার প্রকাশ হিসেবে সম্পর্কিত হয়, তাদের উৎপাদনের মধ্যেই নিজেদেরকে চিনে নিতে পারে, তেমনভাবেই অন্যদের দ্বারাও যদি সেই চিনে নেওয়াটি স্বীকৃত হয়, তাহলে তা বিচ্ছিন্নতার ভিত্তি না হয়ে খাঁটি মানবিক সম্পর্ক হবে।

    “আমার কাজ হবে আমার জীবনের মুক্ত প্রকাশ, মানে জীবনের উপভোগ। ব্যক্তিসম্পত্তি পূর্বানুমান করে নিলে আমার জীবন হবে জীবন থেকে বিচ্ছিন্নতা, কারণ আমি কাজ করি বেঁচে থাকার দায়ে, জীবিকা উপার্জনের জন্য। তখন আমার কাজ আমার জীবন নয়। “ ( K. Marx Comments on J. Mill)

    মার্কস দেখান যে, বুর্জোয়া সমাজে শ্রমের বিশেষ চরিত্র অর্থাৎ মজুরি-শ্রম বিচ্ছিন্নতার সবচেয়ে নিবিড়তম আঙ্গিক। মজুরি শ্রমিকরা জীবিকা অর্জনের জন্য তাদের শ্রম-ক্ষমতা বিক্রি করে, পুঁজিপতিরা শ্রম-প্রক্রিয়ার মালিক হয়। এখানে শ্রমিকের শ্রমের উৎপন্নটি বাস্তব অর্থেই শ্রমিকের কাছ হতে বিচ্ছিন্ন, তা আর শ্রমিকের উৎপাদন নয়, বরং পুঁজিপতির উৎপাদন। যে লাঠিটা শ্রমিকের পিঠে পড়বে, শ্রমিকেরা নিজের হাতেই তা বানায়। আর একবার সেই পণ্য যদি বাজারে ঢুকে যায় তখন তার ওপর কারোরই আর নিয়ন্ত্রণ নেই, সেই পণ্য তখন যেন গায়েবি নিয়মেই চলাচল করে। (বাজার, টীকা দেখুন)

    বিচ্ছিন্নতা আর তখন মানুষের উৎপাদন বলে মনে হয় না, কারণ পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে সম্পর্ক নির্ধারিত হয় দুটো জিনিসের মধ্যে, মানুষ সেখানে গৌণ। বিচ্ছিন্নতা অতিক্রম করা যাবে শ্রম-প্রক্রিয়াতে বাস্তব মানবিক সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে, মানুষ যদি নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে, শুধু জীবিকা অর্জন নয় বরং নিজের মানব স্বভাব প্রকাশ করার জন্য কাজ করে তাহলে।

    বিজ্ঞান (Science)

    বিজ্ঞান হলো সামাজিকভাবে অর্জিত জ্ঞানের সঞ্চয় এবং পর্যবেক্ষণ, শ্রেণীকরণ, পরীক্ষণ, যাচাই, পর্যালোচনার জন্য প্রতিষ্ঠান এবং চর্চা আর সেইসব চর্চার বিন্যাস এবং সামগ্রিক একটি পদ্ধতিতে সন্নিবেশিত তত্ত্ব। বিজ্ঞান হলো সামাজিক ক্রিয়াকর্ম সংগঠিত করবার বিভিন্ন উপায়ের একটি। যার অংশ হচ্ছে সমন্বিত সমগ্রের দিকে বিকাশমান তাত্ত্বিক জ্ঞান যা প্রমাণের আঙ্গিকে নিজেকে ধরে রাখে।

    বিষয় ও বিষয়ী (Object and Subject)

    জ্ঞানের প্রক্রিয়া বোঝার ক্ষেত্রে বিষয় ও বিষয়ীর ধারণা গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়ী বলতে বোঝায় চৈতন্য এবং ইচ্ছাসহ সক্রিয়, নিজেকে চিনতে থাকা স্বতন্ত্র বা সমাজদল। বিষয় মানে যার উপরে বিষয়ীর কাজকর্ম প্রযুক্ত হয়। বিষয় এবং বিষয়ী একটি ঐক্য। জগতের অস্তিত্ব নিরপেক্ষ বিষয়ী তার একটি অংশ।

    “পূর্ববর্তী সমস্ত বস্তুবাদের এবং ফয়েরবাখের বস্তুবাদও তার অন্তর্ভুক্ত-প্ৰধান দোষ এই যে, তাতে বস্তু, বাস্তবতা বা সংবেদ্যতাকে কেবল বিষয় রূপে বা ধ্যান রূপে ধরা হয়েছে, মানবিক সংবেদনগত ক্রিয়া হিসেবে, ব্যবহারিক কর্ম হিসেবে দেখা হয়নি, বিষয়ীগতভাবে দেখা হয়নি। ফলে বস্তুবাদের বিপরীতে সক্রিয় দিকটি বিকশিত হয়েছে ভাববাদে, কিন্তু তা কেবল অমূর্তভাবে। কেননা অবশ্যই ভাববাদ সংবেদনগত ক্রিয়া ঠিক যা সেইভাবে তাকে জানে না। ফয়েরবাখ চান সংবেদনগত বিষয়কে চিন্তাগত বিষয় থেকে সত্যই পৃথক করতে, কিন্তু খোদ মানবিক ক্রিয়াটাকে তিনি বস্তুগত ক্রিয়া হিসেবে ধরেন না। অতএব, Essence of Christianity (খ্রিষ্টধর্মের মর্মবস্তু) গ্রন্থে তিনি একমাত্র তাত্ত্বিক ক্রিয়াকেই খাঁটি মানবিক ক্রিয়া বলে গ্রহণ করেন; অপরপক্ষে ব্যবহারিক কর্মকে নোংরা দোকানদারি চেহারায় ধরা হয় এবং শুধু সেভাবেই তাকে স্থিরবদ্ধ করা হয়। তাই বৈপ্লবিক, ব্যবহারিক বৈচারিক ক্রিয়ার তাৎপর্য তিনি বুঝতে পারেন না।” (কার্ল মার্কস, ফয়েরবাখ সম্বন্ধে থিসিসসমূহ, ১নং থিসিস)

    বুর্জোয়া (bourgeois)

    মানব সমাজকে বিশ্লেষণ করবার জন্য ব্যবহৃত একটি শ্রেণীকরণ। মূল শব্দটি ফরাসি, বিপ্লবপূর্ব ফ্রান্সের সামন্ত প্রথায় ‘বুর্জোয়া’রা ছিল থার্ড এস্টেটের ধনী শ্রেণী গোষ্ঠী। তারা অভিজাততন্ত্রের কোন সুবিধা পেত না, বাড়তি করের বোঝায় অতিষ্ট ছিল। বসতভিটার আকার বা রোজগার-এসব দিয়ে কারা বুর্জোয়া তা নির্ধারিত হত। শব্দটি গড়ে উঠেছিলো বণিকদের বোঝাতে, উনবিংশ শতাব্দি পর্যন্ত শব্দটি মধ্যবিত্তের (অভিজাত আর ভূমিদাস বা সর্বহারা’র মাঝে বিশাল আর্থ-সামাজিক পটভূমিভুক্ত জনগোষ্ঠী) সমার্থক ছিলো। উনবিংশ শতাব্দির দ্বিতীয়ার্ধে অভিজাতদের ক্ষমতা ও সম্পদ মিলিয়ে গেলে বুর্জোয়ারা নতুন শাসক শ্রেণী হয়ে আবির্ভূত হয়।

    ফরাসি বুর্জোয়া bourgeois শব্দটি এসেছে পুরাতন ফরাসি burgeis থেকে যার মানে ‘শহরবাসী’ (তুলনীয় মিডল ইংলিশ burgeis, মিডল ডাচ burgher এবং জর্মন Büürger)। পুরাতন ফরাসী শব্দটি এসছে ক্ষয়িষ্ণু লাতিন burgus থেকে, যার মানে ‘দুর্গ’।

    য়ুরোপের মধ্যযুগে শহর গড়ে ওঠার সাথে কারুকর্মী আর বেনিয়ারা দৃশ্যমান অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে গড়ে উঠতে থাকে। ব্যবসা আর নিজেদের সামাজিক স্বার্থ রক্ষায় তারা সঙ্ঘ, গিল্ড, কোম্পানি গড়ে তোলে। এরাই ছিল প্রথম বুর্জোয়া।

    মধ্যযুগ শেষ হয়ে রেনেসাঁস শুরু হতে তারা ক্রমে অভিজাত শ্রেণীকে হটিয়ে ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজড জাতি রাষ্ট্রগুলোতে শাসক শ্রেণীতে রূপান্তরিত হয়। ১৭ ও ১৮ শতাব্দীতে চরম সামস্ত প্রথা বিলোপে তারা সাধারণভাবে ফরাসি ও আমেরিকান বিপ্লবকে সমর্থন করে দ্রুত বাণিজ্যের প্রসার ঘটায়, শেষে পুঁজিতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত করে। ঐ সময়েই মলিয়ের, ফ্লবার্টের মত সাহিত্যিকেরা বুর্জোয়াদের মানসিক সঙ্কীর্ণতা, লোভ, ভণ্ডামি, অপরিশিলিত সংস্কৃতির জন্য ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে গেছেন। সে সময় সফল বুর্জোয়া মানে ছিল লগ্নির উপার্জনে অলস জীবন কাটানো।

    বাণিজ্য এবং বাজার অর্থনীতি প্রসারের সাথে বুর্জোয়ারা আকারে, প্রভাবে এবং ক্ষমতায় বেড়ে ওঠে। প্রতিটি শিল্পায়িত দেশে অভিজাত তন্ত্র হয় মিলিয়ে যায় নয়তো বুর্জোয়া বিপ্লবের মাধ্যমে উৎখাত হয়। এভাবে বুর্জোয়ারা সামাজিক আধিপত্যের শিখরে পৌঁছয়।

    মার্ক্সপন্থীরা বুর্জোয়াদের সংজ্ঞায়িত করেন এমন সামাজিক শ্রেণী হিসেবে যাদের রোজগারের উৎস হচ্ছে পুঁজি সম্পদে মালিকানা বা ব্যবসা, অথবা ব্যবসায়িক কাজ-কারবার যেমন পণ্য এবং সেবা ক্রয় এবং বিক্রয়। মধ্যযুগে এরা ছিল স্ব-নিয়োজিত ক্ষুদ্র নিয়োগদাতা, উদ্যোক্তা, ব্যাঙ্কার, বণিক। শিল্প পুঁজিতন্ত্রের আমলে বুর্জোয়া হয়ে যায় শাসক শ্রেণী, মানে উৎপাদন উপকরণের (জমি, কারখানা, দফতর, পুঁজি, সম্পদ) মালিক। সেই সাথে জবরদস্তির মাধ্যমগুলোও (ফৌজদারি ব্যবস্থা, জাতীয় সশস্ত্র বাহিনী, জেল-জরিমানা) তার এখতিয়ারে থাকে। এর বিপরীতে থাকে বিশাল জনগোষ্ঠী যাদের সামনে সম্পত্তি, উৎপাদনি উপকরণের মালিকদের কাছে বেঁচে থাকার জন্য শ্রম বিক্রি করা ভিন্ন উপায় থাকে না।

    মার্ক্স বুর্জোয়া রাজনৈতিক তত্ত্ব, সিভিল সমাজ ও সংস্কৃতি নিয়ে এর দৃষ্টিভঙ্গিতে বুর্জোয়াদের নিজস্ব ধারণা আর এই সব ধারণা তেরি এবং জিইয়ে রাখার প্রতিষ্ঠানগুলোকে সার্বিকভাবে সত্য বলে প্রতিষ্ঠার চেষ্টাকে পর্যালোচনা করে দেখান যে এসব আসলে নতুন শাসক শ্রেণী হিসেবে তাদের ভাবাদর্শ মাত্র, যার ফিকির হল নিজের মত করে সমাজকে ছাঁচে ফেলা।

    সাধারণভাবে মার্ক্স ‘বুর্জোয়া’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন একটি সামাজিক শ্রেণীর বিষয়গত বর্ণনা এবং ব্যক্তি পুঁজি মালিকানা নির্ভর জীবনধারা বোঝাতে। তিনি তাদের পরিশ্রমী চরিত্রের স্বভাবের তারিফ করে তাদের নৈতিক ভণ্ডামির সমালোচনা করেছেন (যেমন কমিউনিস্ট ইশতেহারে)। এই শ্রেণীর ভাবাদর্শ বর্ণনা করতেও শব্দটি ব্যবহার করেছেন; যেমন, তাদের স্বাধীনতা সংক্রান্ত ধারণাকে বলেছেন “বুর্জোয়া স্বাধীনতা”। তিনি বুর্জোয়া স্বাধীনতা, বুর্জোয়া পরিবার প্রথা, বুর্জোয়া সম্পত্তি ইত্যাদি বিষয়েও লিখেছেন, সব ক্ষেত্রেই এই সব আদর্শকে তিনি শ্রেণী-সমাজের বহাল থাকার সাপেক্ষে অস্তিত্বশীল বলে উপস্থাপন করেছেন।

    বুর্জোয়া সমাজ বা পুঁজিতন্ত্র- হল এমন সমাজ সংগঠন যাতে পণ্য সম্পর্ক, মানে কেনা আর বেচা’র সম্পর্ক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়ে। এখানেও পরিবার ও রাষ্ট্র থাকে। তবে পরিবার ক্রমাগত ক্ষুদ্র নিঃসঙ্গ পর্যায়ে নিছক বাণিজ্যিক বোঝাপড়ার জায়গায় গিয়ে ঠেকে। রাষ্ট্র এখানে জবরদস্তির হাতিয়ারগুলো ধরে রাখে, তবে ক্রমেই সে বাণিজ্যিক স্বার্থের খপ্পরে পড়ে, তার কার্যক্রম সম্প্রদায়ের পক্ষ হতে সেবা কেনা-বেচার দালালিতে গিয়ে ঠেকে।

    বুর্জোয়া সমাজে শাসক শ্রেণী বুর্জোয়ারা ব্যক্তিসম্পত্তি হিসেবে উৎপাদন মাধ্যমগুলোর মালিক। অথচ এখানে উৎপাদন শক্তিগুলো পুরোপুরি সমাজিকৃত, তার কাজ-কারবার চলে বিশ্ববাজারে।

    এখানে উৎপাদন করে সর্বহারা, যে শ্রেণীর কাজ করবার সামর্থ্য ছাড়া বিক্রি’র আর কিছু নেই, সমস্ত উৎপাদন মাধ্যমের মালিকানা বুর্জোয়াদের হাতে থাকার ফলে শ্রমিকদের শ্রম-শক্তি বুর্জোয়াদের কাছে বিক্রি ছাড়া উপায় থাকে না। শ্রম শক্তির এই কেনা-বেচার পদ্ধতিকে বলে মজুরি-শ্রম।

    বুর্জোয়া সমাজে টাকা ও বিভিন্ন রকমের ক্রেডিট পদ্ধতি চূড়ান্তভাবে বিকশিত হয়। ফলে মনে হয় টাকা যেন জলের মতই নিজের ধর্মে চলে, আবহাওয়ার মতই মানুষ তার সাথে খাপ খাইয়ে নেয়, তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, নিজে তার হাতে নিয়ন্ত্রিত হয়।

    আদিম গোত্রগুলো যেমন বিশ্বাস করতো যে তাদের জীবন নির্ধারিত হয় মানব ক্ষমতা সম্পন্ন বৃক্ষ, প্রাণী আর প্রাকৃতিক শক্তির হাতে, বুর্জোয়া সমাজে তেমনি চালু থাকে ‘পণ্য পূজা’। মানুষের জীবন এখানে পরিচালিত হয় টাকা ও অন্যান্য পণ্যের জোরে, এদের মূল্য নির্ধারিত হয় যেন অতিজাগতিক নিয়মে। আগের কালে নীতি যেমন নিয়ন্ত্রিত হত বিশ্বাস আর কাল্পনিক শক্তির প্রথাগত পদ্ধতিতে, এই সমাজে তার জায়গা নেয় নগদ লেন-দেনের নীতি।

    ব্যক্তিসম্পত্তি (Private Property )

    ব্যক্তিসম্পত্তি হলো কোনো ব্যক্তির কোনো বিষয়কে অপরের ব্যবহার করবার ব্যাপারটি বাদ দেয়ার অধিকার, তার সূত্র ধরে সমাজকে শ্রেণীতে বিভক্ত করা। ব্যক্তিসম্পত্তি অনিবার্যভাবে অপরের ব্যক্তিসম্পত্তির অস্বীকার, যার চূড়ান্ত প্রকাশ হচ্ছে মজুরি শ্রম ও পুঁজির সম্পর্ক।

    “শ্রম এবং পুঁজির এন্টিথিসিস হিসেবে অনুধাবন করতে না পারলে সম্পত্তিহীনতা এবং সম্পত্তির মাঝের এন্টিথিসিসটি একটি অবিচ্ছেদ্য এন্টিথিসিস হিসেবে থেকে যায়। তখন এদের সক্রিয় সংযোগে, তাদের অন্তর্গত সম্পর্কে বোঝা যায় না। আর তা না হলে একে দ্বন্দ্ব হিসেবেও অনুধাবন করা যায় না। এটা প্রকাশিত হতে পারে এই প্রথম আঙ্গিকেও; এমন কি ব্যক্তিসম্পত্তির অগ্রসর বিকাশ ছাড়াই—যেমন প্রাচীন রোম, তুরস্ক ইত্যাদিতে। এটি তখনো খোদ ব্যক্তিসম্পত্তি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হিসেবে প্রতীয়মান হয় না। কিন্তু শ্রম (সম্পত্তির বর্জন হিসেবে ব্যক্তিসম্পত্তির বিষয়ীগত সারসত্ত্বা) এবং পুঁজি (শ্রমের বর্জন হিসেবে বিষয়গত শ্রম) ব্যক্তিসম্পত্তি গঠন করে এর দ্বন্দ্বের বিকশিত দশা হিসেবে আর তাই তা হয় সমাধানের দিকে ধাবমান এক গতিশীল সম্পর্ক। [মার্কস: ব্যক্তিসম্পত্তি এবং কমিউনিজম।

    ব্যক্তিসম্পত্তির উচ্ছেদ একই সাথে মানবতার মুক্তি, কারণ তখন ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির সম্পর্ক হবে সরাসরি, কোনো জিনিসের মধ্যস্থতা ছাড়া।

    “তাই ব্যক্তিগত সম্পত্তির অতিক্রম হলো সমস্ত মানবিক সংবেদন এবং গুণাবলীর পরিপূর্ণ মুক্তি। তবে এটা যে এমন এক মুক্তি সংক্ষেপে তার কারণ হলো—তখন এসব সংবেদন এবং গুণাবলী বিষয়ীগত এবং বিষয়গতভাবে মানবিক হয়ে যায়। চোখ হয়ে যায় মানবিক চোখ, ঠিক যেমন এর বিষয় হয়ে যায় সামাজিক, মানবিক বিষয় মানুষ দ্বারা মানুষের জন্য তৈরি করা বিষয়। তাই সংবেদনগুলো সরাসরি তাদের প্রয়োগে তাত্ত্বিক হয়ে যায়। তারা নিজেদেরকে জিনিসের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে জিনিসটার খাতিরে, কিন্তু জিনিসটা নিজে নিজের সঙ্গে এবং মানুষের সঙ্গে একটা বিষয়গত মানবিক সম্পর্ক এবং এর উল্টোটাও। প্রয়োজন অথবা উপভোগ ফলতই তাদের অহমগত স্বভাব হারায় আর প্রকৃতি হারায় এর নিছক উপযোগ, তা হয় ব্যবহার মানবিক ব্যবহার হওয়ার ফলে।

    একই পথে, অন্য মানুষের সংবেদন এবং উপভোগ আমার নিজের যথার্থকরণ হয়ে যায়। তাই এইসব সরাসরি অঙ্গের পাশাপাশি সামাজিক অঙ্গও সমাজের আঙ্গিকে বিকশিত হয়। যেমন অন্যদের সঙ্গে সরাসরি সম্মিলনে ক্রিয়াকাণ্ড আমার নিজের জীবন প্রকাশের একটা অঙ্গ, আর মানবজীবনকে যথার্থকরণের একটা ধরন হয়ে যায়। [মার্কস: ব্যক্তিসম্পত্তি ও কমিউনিজম

    ব্রুনো বাউয়ের (Bruno Baeur, 1809-1882)

    ১৩ এপ্রিল বার্লিনে এক ব্যক্তি মারা গেছেন, যিনি এক সময়ে দার্শনিক হিসেবে এবং ব্রহ্মবিদ্যাবিদ হিসেবে একটা ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। রেনাঁ সমেত সরকারি ব্রহ্মবিদ্যাবিদেরা তিনি আর নেই বলে ধরে নিয়েছিলেন…। অথচ যোগ্যতায় তিনি ছিলেন তাঁরা সবাই মিলে যা তার চেয়ে বেশি।… (এঙ্গেলস, ব্রুনো বাউয়ের এবং গোড়ার খ্রিষ্টধর্ম)

    জর্মন দার্শনিক, ঐতিহাসিক এবং ধর্মতাত্ত্বিক। বাবা ছিলেন পোর্সেলিন কারখানার রঙমিস্ত্রি। ১৮৩১ সালে হেগেলের মৃত্যু পর্যন্ত সরাসরি তাঁর ছাত্র ছিলেন। হেগেল একবার ইমানুয়েল কান্টকে পর্যালোচনা করে এক রচনার জন্য তরুণ বাউয়েরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে পুরস্কার দেন। তিনি বার্লিনের ফ্রেডরিখ ভিলহেল্ম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে রক্ষণশীল হেগেলীয় ঘরানায় যোগ দেন। তাঁর জীবনের মধ্যখানে আছে ১৮৪৮-এর বিপ্লব। ১৮৪০-এর দিকেই তিনি আবার হেগেলের প্রজাতন্ত্রী ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে বামপন্থী হেগেলীয়দের নেতা হয়ে উঠেন। হেগেলের বিষয়ীগত মরমের ধারণা থেকে তিনি তাঁর অসীম আত্মচৈতন্যের তত্ত্বের ধারণা দাঁড় করান। এই তত্ত্বে ঐতিহাসিক প্রগতি এবং যৌক্তিক আত্মসার্বভৌমত্বই হচ্ছে মূল প্রতিপাদ্য। খ্রিষ্টানধর্মের পুথিপত্রের তত্ত্ব-তালাশ করে তিনি ধর্মকে বিচ্ছিন্নতার একটি রূপ হিসেবে প্রদর্শন করেন। তাঁর মতে, দুনিয়াবী জীবনের দুঃখ-দুর্দশার অভাব সত্তার ওপরে অযৌক্তিক অতীন্দ্রিয় সব ক্ষমতা আরোপ করে, তারই সাথে ছোট ছোট টুকরোতে বিভক্ত হয়ে যাওয়া মানুষের দল এবং তাদের ভিন্ন ভিন্ন জাগতিক স্বার্থে বিচ্ছিন্নভাবে উপস্থাপিত হতে থাকে। জর্মন অঞ্চলের রাষ্ট্র এর সামাজিক এবং আইনগত ভিত্তি এবং গোঁড়া ধর্মীয় ভাবাদর্শ বাউয়েরের কাছ থেকে তীব্র সমালোচনার শিকার হয়। তিনি উদারতাবাদ পরিত্যাগ করেন, কারণ তা বহাল ব্যবস্থার সঙ্গে আপোস করে আর মুক্তি এবং সম্পত্তির মাঝখানের হিসেবটা মেলাতে গড়মিল করে ফেলে। তিনি সমাজতন্ত্রকেও খারিজ করেন, কারণ তাঁর মতে, এতে ব্যক্তির আত্মসার্বভৌমত্ব যথেষ্ট মর্যাদা পায় না। ১৮৪৮-এর বিপ্লব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে পর বাউয়ের হেগেলকে নিয়ে নতুন করে ভাবেন। ক্লান্ত দর্শন এবং উদারনৈতিক ও বিপ্লবী রাজনীতির ব্যর্থতার ফলে তিনি ইউরোপীয় সভ্যতার এক মহাসংকটের ভবিষ্যৎবাণী প্রদান করেন, তবে এও বলেন, এই মহাসংকট থেকেই মুক্তির পথ বের হয়ে আসবে। তাঁর শেষ দিককার রচনায় বিশ্বশক্তি হিসেবে রাশিয়ার অভ্যুদয় বিশ্বজোড়া সাম্রাজ্যবাদ এবং যুদ্ধ সম্পর্কে তিনি আলোচনা করেন। এসব রচনাবলী থেকে নিটশে সাংস্কৃতিক নবায়নের কথা ভাবতে উদ্বুদ্ধ হন।

    ১৮৪২ সালে তাঁর মতামতের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পদটি কেড়ে নেয়া হয়। ১৮৪২ থেকে ১৮৪৯ পর্যন্ত তিনি রাজনৈতিক সাংবাদিকতা এবং ঐতিহাসিক গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তিনি ১৮৪২-৪৩ সালের দিকে প্রুশিয়ার ইহুদিদের রাজনৈতিক মুক্তির বিপক্ষে মত রাখেন। যুক্তি ছিল তাহলে নির্দিষ্ট ধর্মীয় স্বার্থকে রাজনৈতিক বৈধতা দেয়া হবে। মার্কস-এঙ্গেলস তাঁদের ‘পবিত্র পরিবার’ (১৮৪৪) এবং জর্মন ভাবাদর্শ (১৮৪৫-৪৬) গ্রন্থে ব্রুনো বাউয়েরের মতামতকে আক্রমণ করেন। ভাই এডগার বাউয়েরকে নিয়ে ১৮৪৮ সালে তিনি শার্লটেনবুর্গ গণতান্ত্রিক সমিতি গঠন করে প্রুশিয়ার ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ব্যর্থ হন। এরপর থেকে বাইবেল সমালোচনা এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষণের ওপর তার প্রচুর লেখালেখি পাওয়া যায়। ১৮৫০-এর মাঝামাঝি সরকারপন্থী ‘দাই জেইত’ পত্রিকায় তার লেখালেখি উদারনৈতিকতার বিরোধিতা হতে রক্ষণশীল দিকে বাঁক নেয়।

    ১৮৩০ জুড়ে বাউয়ের চিন্তা এবং সত্ত্বাকে যৌক্তিক বিশ্বাসের সুতো দিয়ে বাঁধার চেষ্টা করেন। তিনি খ্রিষ্টীয় তত্ত্বগুলোকে এই সময় লজিক্যাল ক্যাটেগরি হিসেবে ব্যাখ্যা দেন। বাইবেলের পুরাতন নিয়মের ধর্ম বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ১৮৩৮ সালে ধর্মীয় অভিজ্ঞতাকে আত্মচৈতন্যের এক উৎপাদন বলে অভিমত প্রকাশ করেন। ১৮৪0-81 এর দিকে বাউয়ের মুক্ত দার্শনিক আত্মচৈতন্যকে সমস্ত ধর্মীয় রূপের বিরোধী বলে মত জাহির করেন। তার রাজনৈতিক র‍্যাডিকাল চিন্তা এবং প্রজাতন্ত্রবাদ এই সময় জমাট বাঁধে। তিনি তখন ক্যাথলিকবাদের বিপরীতে রেস্টোরেশান শাসন এবং একতরফা ধর্মীয় চৈতন্যের মাঝে ব্যক্তিস্বার্থের গঠনগত অভিন্নতা দেখতে পান। বাইবেলের ওপর তার গবেষণাগুলোতে র‍্যাডিকাল ভাবনার রাজনৈতিক এবং তাত্ত্বিক ছাপ সুস্পষ্ট। বাইবেলের সিনোপটিক পর্যালোচনা করতে গিয়ে তিনি একতরফা খ্রিষ্টান মতাদর্শের বিরোধিতা করে বাইবেলের সুসমাচারগুলো তৎকালীন ধর্মীয় চেতনার প্রকাশ বলে অভিহিত করেন। এখানে তিনি খ্রিষ্টান ধর্ম এবং সামন্তবাদকে অভিন্ন বলে ঘোষণা করে আত্মচৈতন্যের স্বাধীনতা এবং সাম্যের সপক্ষে দাঁড়ান।

    ধর্ম এবং সর্ববিলোপবাদী রাষ্ট্র, তাঁর মতে, একে অপরকে ঠেকা দিয়ে টিকিয়ে রাখে আর বিচ্ছিন্নতা এবং নির্যাতনকে সমান মাপে উৎসাহিত করে। খ্রিষ্টান ধর্ম ধর্মীয় চেতনাকে

    শুদ্ধ অমূর্ততায় উপস্থাপন করে আর তার সাথে সমস্ত নৈতিক বন্ধনকে একসাথে মিলিয়ে ফেলে। তিনি বলেন, ইহুদি ধর্মে প্রকৃতি ধর্মীয় স্বার্থের অধীনস্ত হয়ে যায় কিন্তু তারপরেও জ্ঞাতিবোধ এবং নির্দিষ্ট গোত্র টিকিয়ে রাখে। কেবল খ্রিষ্টান ধর্মেই এই ব্যাপারটি শুদ্ধ অমূর্ত সত্ত্বার স্বার্থে দূর করা হয়। ফলে বিচ্ছিন্নতা এখানে নিখুঁত রূপ পায় এবং তার বস্তুগত সমাধান প্রয়োজন হয়ে পড়ে। বাউয়ের পঞ্চম ফ্রেডরিখ উইলিয়ামের খ্রিষ্টীয় রাষ্ট্র এবং উদার সাংবিধানিকতাবাদ দুটোই খারিজ করেন। কারণ উভয় ক্ষেত্রেই স্বাধীনতা উল্লিখিত হয় ধর্মীয় বা অর্থনীতির মতো ব্যক্তি স্বার্থে। হেগেলের মুক্তি সম্পর্কিত ধারণা এসব উদারনৈতিক মতামত হতে অনেক অগ্রসর। মুক্ত রাষ্ট্রের জন্য নৈতিক আত্মচৈতন্য দ্বারা খণ্ডিত অহংবাদের বিনাশ হচ্ছে পূর্বশর্ত।

    ১৮৪২ এবং ১৮৪৩-এ লেখা তার ‘ইহুদি প্রশ্ন’ এবং ‘বর্তমানকালের ইহুদি এবং খ্রিষ্টানদের মুক্ত হবার সামর্থ্য’ নামে দুটি রচনায় ধর্মীয় চৈতন্য এবং রাজনৈতিক সংস্কারের পর্যালোচনা বিস্তৃতভাবে পাওয়া যায়। এগুলো প্রকাশ হবার পর বাউয়ের বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বের পদটি হারান। কারণ তিনি এর একটি কেন্দ্রীয় দাবিকেই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন। প্রশ্নটি ছিল, প্রুশিয়ার খ্রিষ্টান রাষ্ট্র নাগরিক সব প্রতিষ্ঠানে ইহুদিদের অংশগ্রহণের উপরে নিষেধাজ্ঞা দূর করতে পারবে কিনা। উদারনৈতিক এবং প্রজাতন্ত্রীরা ইহুদি মুক্তির ওকালতি করতেন, বিপরীতে সংরক্ষণবাদীরা এ বিষয়ে রাষ্ট্রের বিশেষ ক্ষমতাকে সমর্থন করতেন।

    বাউয়ের রাষ্ট্রকে তার বিশেষ ধর্মীয় সুবিধা দেয়ার জন্য আক্রমণ করেন, বলেন, রাষ্ট্র অধীনস্ততার সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার স্বার্থে ধর্মকে মুখোশ হিসেবে ব্যবহার করছে। অপরদিকে তিনি ইহুদিবাদের সমালোচনা করেন বিশেষ পরিচয়ের দাবিতে মুক্তি চাওয়ার জন্য। রাজনৈতিক এবং সামাজিক মুক্তির জন্য দরকার অতীতের সাথে সমস্ত খণ্ডিত সম্পর্কের বিনাশ। ফলে সমানতার জন্য ইহুদিদেরকে অবশ্যই তাদের সমস্ত ধর্মীয় দেমাগ পরিত্যাগ করতে হবে, খ্রিষ্টানদেরও। খ্রিষ্টান ধর্ম ঐতিহাসিকভাবেই চৈতন্যের এক ধাপ উঁচু স্তর ধারণ করে। কারণ এখানে দেবতার বাহ্যিকতা অস্বীকৃত হয়েছে। খ্রিষ্টান ধর্ম তার র‍্যাডিকাল এই অস্বীকৃতির জন্যই এক ধাপ এগিয়ে। এর সম্যক প্রয়োজন হচ্ছে নতুন এবং উচ্চতর এক নৈতিক জীবন। আত্মনির্ধারণ এবং আত্ম-অবমাননার দ্বন্দ্বের চর্চার মধ্য দিয়ে খ্রিষ্টান ধর্মে মুক্তির যুগান্তকারী ক্ষণ এসে উপস্থিত। বহু সমালোচনার পরও বাউয়ের তার এই মতামতের ব্যাপারে অনড় থাকেন।

    ফরাসি বিপ্লব নিয়ে লিখতে গিয়ে তিনি জনসমাজের অভ্যুদয় লক্ষ্য করেন। বিপ্লবের দ্বারা সামন্ত জমিদারীগুলো উচ্ছেদ হয়ে গিয়ে নিখুঁত টুকরো টুকরো বৈশিষ্ট্যের সমাজ গড়ে উঠছে, যার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ব্যক্তির সম্পত্তির অধিকারের জন্য দাবি-দাওয়া। এই ব্যক্তিক অর্থনীতিক স্বার্থ বহাল শাসনব্যবস্থার পুরোপুরিভাবে উচ্ছেদ সম্ভব হতে দিচ্ছে না। এর ফলেই চূড়ান্ত বিচারে বিপ্লব ব্যর্থ হলো। তাঁর মতে, প্রলেতারিয়েত এবং বুর্জোয়া মিলিয়ে জনগণের বহাল ব্যবস্থার বিরোধিতা গভীরে যেতে পারেনি। উদারবাদী সাংবিধানিকতাবাদ, সামন্ত জামানার সঙ্গে আপোসমূলক মনোভাব পোষণ করে। সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনও তার মতে শ্রমিকদের রূপান্তর না ঘটিয়ে শুধু প্রত্যক্ষ, বিশেষ অস্তিত্বেই তাদের সংঘটিত করতে চায়। প্রলেতারিয়েতকে তিনি দেখতেন একটা শুদ্ধ বিশেষতা হিসেবে, বলতেন সেও যদি নিজের অংশগত স্বার্থ প্রথমে পরিত্যাগ না করে তাহলে নিজেকে খাঁটি সার্বিক হিসেবে রূপান্তর করতে পারবে না। একদিকে তিনি অযৌক্তিক প্রতিযোগিতামূলক রূপের জন্য পুঁজিতন্ত্রকে সমালোচনা করতেন আবার প্রগতির শর্ত ব্যক্তির স্বাধীনতা এবং মুক্ত আত্মনির্ধারণের খাতিরে প্রতিযোগিতাকে সমর্থন করতেন।

    ১৮৪৮-এ বিপ্লব প্রচেষ্টার ব্যর্থতা তাঁর মতে, য়ুরোপীয় দার্শনিক ঐতিহ্যের দেউলিয়াপনাই প্রকাশ করে। জীবনের বাকিটা কাল তিনি প্রজাতন্ত্রবাদের বিজয়ের বদলে বিশ্বজোড়া সাম্রাজ্যবাদের আগমনের ছায়া দেখেই কাটিয়ে গিয়েছেন।

    বাউয়ের বলেন, য়ুরোপীয় সভ্যতার পতন হয়তো ঐতিহ্যগত সব আঙ্গিক, মূল্যবোধ হতে মুক্তির মাধ্যমে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করবে। একই সাথে পরিত্যক্ত হবে এই সভ্যতার সব অধিবিদ্যা এবং ধর্মীয় স্বীকার-স্বীকৃতিগুলো পরিত্যাক্ত হবে। বাউয়েরের উদারতাবাদের বিরোধিতা এই সময় থেকে রক্ষণশীল মতামতের পেছনে সমর্থন যোগাতে থাকে। নিটশের মতো তিনিও সব ঐতিহ্য এবং ধর্মকে খারিজ করতে থাকেন। ১৮৪৮-এর বিপ্লব প্রচেষ্টা বাউয়েরের কাছে মনে হয়েছিল এনলাইটেনমেন্ট, কান্ট ও হেগেলের প্রস্তাবনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। এর ব্যর্থতা মানে পাশ্চাত্য দর্শনের সুদীর্ঘকালের প্রকল্পগুলোর মৃত্যুঘণ্টা, যার পরে আর যৌক্তিক ব্যক্তি আত্মসার্বভৌমত্ব সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না।

    ১৮৪৮-এর ধাক্কার পর অনেক বুদ্ধিজীবীর মতোই বাউয়েরও অধিবিদ্যাকে পরিত্যাগ করলেন। এরপর পর্যালোচনার পদ্ধতিকে তিনি পরীক্ষণমূলক অনুসন্ধানের ধারণা দিয়ে নতুন করে সাজানোর চেষ্টা করেন। ইতিহাস যে ক্রমাগত অনাবৃত হতে থাকা আত্মচৈতন্যের দ্বন্দ্ব এই বিশ্বাস তিনি হারিয়ে ফেলেন। বলেন, বৈজ্ঞানিক গবেষণা অবশ্যই সমস্ত সামাজিক বা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা বা আবেগ থেকে মুক্ত থাকতে হবে। এই নতুন পর্যালোচনার উপসংহার হলো, ভবিষ্যৎ প্রজাতন্ত্রীদেরও নয় বিচ্ছিন্ন জনগণেরও নয়, বরং বহুজাতিক সাম্রাজ্যবাদের। এই সাম্রাজ্যবাদ গড়ে উঠবে দুটো পরস্পরবিরোধী শিবিরের দ্বন্দ্বের মাঝ দিয়ে। একদিকে পশ্চিম ইউরোপীয় আঙ্গিক, অপরদিকে নবজাগ্রত রুশ আঙ্গিক। এই দ্বন্দ্ব য়ুরোপ ছাপিয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়বে। বিশ্বযুদ্ধ অনিবার্য। এই প্রক্রিয়ার শেষ হলো নিখাদ জনসমাজ, যা গড়ে উঠবে এই যুদ্ধের আগুনে পোড়া সমস্ত জাতীয়তাবাদ, ব্যক্তি বা খণ্ডিত স্বার্থ হতে।

    এই বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ খ্রিষ্ট-জর্মন ব্যবস্থার পতন ঘটাবে যার স্বপ্ন বাউয়ের প্রথম থেকেই দেখে আসছেন। কেবল তখনই সম্ভব হবে নতুন সংস্কৃতির উন্মেষ, থাকবে না ধর্মীয় বা আধিবিদ্যক মায়া।

    শেষ বয়সে বাউয়ের প্রায়শ তরুণ ফ্রেডরিখ নিটশের দেখা পেতেন। বাউয়ের নিটশের ডেভিড স্ট্রসকে আক্রমণের ধারা দেখে খুব আমোদ পেতেন, নিটশে তাকে বলতেন, “আমার সব পড়ুয়া মানুষ”। এই ছিল বাউয়েরের সর্বশেষ বড় কাজ!

    মন বা চৈতন্য (Mind or Consciousness )

    মন চৈতন্যের সমার্থক, তবে প্রায়ই তাকে আলাদা ভাবে সব মরমের সারকথা বা মানবউত্তীর্ণ অস্তিত্ববোধক হিসেবে ব্যবহারের রেওয়াজ আছে। হেগেল ‘অধিকারের দর্শনে’ বলছেন, ‘মনের ইতিহাস তার নিজেরই কাজ। মন যা করে সে কেবল তাই, আর তার কাজ হলো নিজেকে নিজেরই চৈতন্যের বিষয় বানানো। ইতিহাসে এর কাজ হলো মন হিসেবে নিজেকেই জেনে ওঠা, যাতে সে নিজের কাছে নিজেকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নিজেকে অনুধাবন করতে পারে। (অনুচ্ছেদ ৩৪৩ )

    চৈতন্য হলো ব্যক্তির নিজ, পরিবেশ এবং চিন্তা সম্পর্কে সচেতনতা। ফলে একে সব দর্শনের মূল ভিত্তি বললে অত্যুক্তি হয় না। চৈতন্যের বাইরে যা আছে তা কোনো না কোনোভাবে চৈতন্যে প্রতিফলিত হয়।

    তাই দর্শনের সবচেয়ে মৌলিক প্রশ্ন হলো বাইরের দুনিয়া আর চৈতন্য সম্পর্ক নিয়ে। পশ্চিমা জগতে চৈতন্যের সাথে বস্তুর সম্পর্ক বিবেচনায় (দেকার্ত) প্রশ্ন উঠেছিল—কেমন করে চৈতন্যের পক্ষে বস্তুজগৎ প্রতিফলিত করা সম্ভব? তারপর ৪০০ বছর এই ছিল পশ্চিমা দর্শনের প্রাণের প্রশ্ন।

    চৈতন্যের স্বভাব বুঝতে হেগেল চৈতন্যকে বিষয় বলে বর্ণনা করে বলেন যে, মানুষ তার সামাজিক সম্পর্কে অংশগ্রহণের মাধ্যমে চৈতন্য অর্জন করে। হেগেলের পদ্ধতিতে চৈতন্য বিষয়ীগত মরমের বিকাশের মধ্যে থাকে – আত্মা (অচেতন মানসিক ক্রিয়া) → চৈতন্য → মরম (আত্মা ও চৈতন্যের ঐক্য)। চৈতন্যের ধাপ হলো সাধারণ চৈতন্য, আত্মচৈতন্য ও বুদ্ধি।

    ১৮৪০ সালের দিকে হেগেলের এই মত বহুমুখী তোপের মুখে পড়ে। মূলধারা পাশ্চাত্য দর্শন হেগেলের বিষয়গত ভাববাদ খারিজ করে চৈতন্যের মনোবৈজ্ঞানিক ব্যক্তিবাদী, বিষয়ীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নেয়। মার্কস কিন্তু হেগেলের সমাজ-ঐতিহাসিক চৈতন্য সম্পর্কিত ধারণা সমর্থন করে গেছেন, কিন্তু চৈতন্যের আঙ্গিককে কোনো ঈশ্বরের কাজ না বলে বলেছেন, মানুষের নিজস্ব সমাজচর্চা ও পরিবেশের সৃষ্টি।

    মার্কস সিদ্ধান্ত টানেন — মানুষের চৈতন্য তার অস্তিত্ব নির্ধারণ করে না, তাদের সামাজিক অস্তিত্ব তাদের চৈতন্য নির্ধারণ করে। (দেখুন – A Contribution to the Critique of Political Economy’র মুখবন্ধ। মার্কস-এঙ্গেলস: জর্মন ভাবাদর্শ, প্রথম অংশ।)

    মরম (Spirit)

    জর্মন ভাষায় Geist, যার অনুবাদ মরম, মন, জগত মানস, পরম ভাব এমনকি ঈশ্বর পর্যন্ত হতে পারে। এই ধারণাটি নিখাদ হেগেলীয়। এখানে এই শব্দ বৈচিত্রও তাঁর দার্শনিক বীক্ষা অনুযায়ী করা হয়েছে। মরম বলতে হেগেল বোঝাতেন কোনো এক প্রকারের নীতিগত প্রক্রিয়া অনুযায়ী জিনিসের পরম্পরার এবং ঘটনাগুলোর একের পর আরেকটি ঘটনার যৌক্তিকতার ভাব। এই যৌক্তিকতার ভাবটিই হেগেল-এর মতে মরম’। তিনি মরমকে মানুষের শ্রমের সৃষ্টি না বলে মানুষের সমস্ত সৃষ্টি, তার ইতিহাসকে মরমের প্রকাশ বলতেন।

    এই মরম এমন কোনো একতরফা ঘটনার সমাহার নয় যাতে সবাই একই রকম ভাবে এগোয়। এতে বরং বোঝায় কোনো নির্দিষ্ট সমাজে নির্দিষ্ট ভাষা, সংস্কৃতি বা ধারণার আওতায় প্রতিটি বাদ-বিসম্বাদ, প্রতিটি ঝামেলা একে অপরের সাথে লড়াই করেই ফয়সলায় আসা। মরমের মাঝের এই সত্য, প্রতিটি ঝামেলার মাঝে লুকিয়ে থাকা এই অকথিত চুক্তি এসবের বিষয়ী ‘মানুষের’ পেছন হতে, তাদের অজান্তেই কাজ করে। হেগেল এমনই বলতেন।

    মানব এবং নাগরিকদের অধিকার ঘোষণা (Declaration of the Rights of Man and of the Citizen)

    ফরাসি La Declaration desdroits de I’Homme et du। এটি ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম একটি মৌলিক দলিল, এখানে জনগণের একগুচ্ছ স্বতন্ত্র এবং সমন্বিতের অধিকার বর্ণনা করা আছে। গৃহীত হয় ১৭৮৯-এর ২৬ আগস্ট, জাতীয় সংসদের অ্যাসেম্বলিতে সংবিধান রচনার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে। এতে গৃহীত অধিকারগুলো শুধু ফরাসি নাগরিকদের জন্য নয় বরং সমস্ত মানুষের জন্যই ঘোষণা হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে।

    ঘোষণার খসড়া তৈরি করেন মার্কুই লাফায়েত। এটি ছিল প্রম রাজতন্ত্র সাংবিধানিক রাজতন্ত্রে উত্তরণের দিকে যাওয়ার সময়। এতে উল্লিখিত অধিকাংশ অধিকারই বিপ্লবপূর্ব ফ্রান্সের শাসনতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিরোধী। পরে ফ্রান্স প্রজাতন্ত্র রূপ পাওয়ার পরেও দলিলটি মৌলিকরূপেই স্বীকৃত হয়। ঘোষণার মূলনীতিগুলো এনলাইটেনমেন্টের কালের দার্শনিক এবং রাজনৈতিক নীতি, জ্যা জ্যাক রুশোর সামাজিক চুক্তি এবং ব্যরন দ্য মতেস্কুর ক্ষমতার বিচ্ছিন্নকরণের তত্ত্ব হতে নেয়া। পাঠ করলে দেখা যাবে, এই দলিলটি মূলত ১৭৭৬-এর ৪ জুলাই গৃহীত যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণার মানব অধিকার ঘোষণারই প্রতিলিপি, তার সঙ্গে মিল পাওয়া যাবে ১৭৭৬-এর জুনের জর্জ ম্যাসনের তৈরি করা ভার্জিনিয়ার অধিকার ঘোষণার, যা আবার গড়ে উঠেছিল ১৬৮৯ সালের ইংল্যান্ডের বিল অব রাইটসের ওপর ভিত্তি করে।

    মুক্তি/স্বাধীনতা (Freedom)

    মুক্তি/স্বাধীনতা হলো জনগণের নিজেদের কাজ-কারবার নির্ধারণের অধিকার ও সামর্থ্য। এটি ঘটে এমন সম্প্রদায়ে যা মানব সম্ভাবনার সম্পূর্ণ বিকাশের শর্তাদি যোগান দিতে পারে। মুক্তি/স্বাধীনতা ব্যক্তি উপভোগ করতে পারে কেবল সম্প্রদায়ের মাঝে, সম্প্রদায়ের মাধ্যমে।

    “কেবল সম্প্রদায়ের মাঝে প্রত্যেক স্বতন্ত্রের তার যোগ্যতা সব দিকে চর্চার উপায় আছে; আর তাই কেবল সম্প্রদায়ের মাঝেই ব্যক্তি স্বাধীনতা সম্ভব। অতীতের সম্প্রদায় বিকল্পসমূহে, রাষ্ট্র, ইত্যাদিতে ব্যক্তি মুক্তি ছিল কেবল শাসকশ্রেণীর সম্পর্কের মাঝে বেড়ে ওঠা স্বতন্ত্রদের জন্য, আর তার ব্যাপ্তি ছিল ঐ শ্রেণীর স্বতন্ত্র পর্যন্ত। (মার্কস- এঙ্গেলস, জর্মন ভাবাদর্শ, অধ্যায় ১,

    বুর্জোয়া সমাজে স্বাধীনতা অর্থ দিয়ে পরিমাপযোগ্য, হরেক রকমের স্বাধীনতা/মুক্তি একটা আরেকটা থেকে কম বা বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত। যেমন ব্যবসার স্বাধীনতা মানে শুধুই ব্যবসার স্বাধীনতা, তার সাথে অন্যসব স্বাধীনতার কোনো যোগসাজশ নেই। প্রতিটি স্বাধীনতার বিশেষ বলয় ঐ বলয়েরই স্বাধীনতা, যেমন করে জীবনের প্রতিটি বিশেষ ধরন বিশেষ প্রকৃতির জীবনের ধরন।

    যেসুইট

    ল্যাটিন Societes Jesu ( Socity of Jesus ), যীশু সঙ্ঘ-রোমান ক্যাথলিক চার্চের একটি খৃষ্টিয় ধর্ম সম্প্রদায়। এই সঙ্ঘের সদস্যদের যেসুইট বলা হয়।

    ১৫৩৪ খৃষ্টাব্দে স্পেনের বাক্ জাতভুক্ত লয়োলা’র ইগনেশিয়াসের উদ্যোগে দারিদ্র্য আর চারিত্রিক শুদ্ধতায় ব্রত নিয়ে পোপের নিরঙ্কুশ বশ্যতা মেনে এই যিশু সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথম থেকে তারা তিনটি কাজে মনোযোগ দেয়—য়ুরোপ জুড়ে স্কুল স্থাপন, অখ্রিষ্টানদের দীক্ষিত করা আর প্রোটেস্টান্ট প্রসার থামানো।

    ইগনেশিয়াসের মূল নীতি ছিল Ad Miorem Dei Gloriam-ঈশ্বরের অধিকতর মহিমা। মানে, অশুভ নয় এমন যে কোনো কাজ, উদ্দেশ্য নির্ভর হলে আধ্যাত্ম্য জীবন উন্নয়নে কাজে লাগে।

    রোমান চার্চের প্রশ্নহীন বশ্যতা মেনে নিয়ে তারা চার্চের দুর্নীতি, সম্পদ জমা করার প্রবণতার বিরুদ্ধে সংস্কার চাইতেন। তারা বিশ্বাস করতেন যে, চার্চের সংস্কার শুরু হবে ব্যক্তির মন পরিবর্তনের মাঝ দিয়ে। বর্তমানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা, ভিন্ন ধর্মসমূহের মত বিনিময় প্রসারে যেসুইটরা উদ্যোমী।

    রাজনীতি (Politics)

    রাজনীতি হলো সম্প্রদায়ের চৈতন্য পরিবর্তনকেন্দ্রিক কাজ-কারবার যা সম্প্রদায়ের নিছক প্রতিদিনকার ক্রিয়ার সরলতার নির্যাসস্বরূপ। রাজনীতির বিজ্ঞান নিয়ে বহু আগে আলোচনা করে গেছেন কনফুশিয়াস, এ বিষয়ে প্রথম কেতাবি য়ুরোপীয় রচনা পাওয়া গেছে প্লেটোর লেখা ‘রিপাবলিক’। তাঁর ছাত্র এরিস্তোতল বিভিন্ন রকমের সংবিধান ও রাষ্ট্রকে শ্রেণী ভাগ করেন, রাজনীতিবিদদের পরামর্শ দেন সুখ পরিপোষণে নৈতিক তত্ত্ব প্রয়োগ করতে।

    সামন্ত সমাজে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কাছে রাজনীতি ও শ্রমের কোনো বাস্তব তফাৎ ছিল না। সমস্ত সমাজ ছিল রাজনৈতিক জগতের আবেষ্টনের ভেতর, সমাজের কে কোথায়, কোন অবস্থানে শ্রম দেবে তা নির্ভর করতো রাজনৈতিক ধারাক্রমে তার অবস্থান অনুযায়ী। রাজনীতি সেখানে উচ্চশ্রেণীর কাজ, বাকিরা তাদের জন্য নির্ধারিত ভূমিকা পালন করবে। শাসন চালানোর কাজই সেখানে রাজনীতি। এই পর্যায়ের রাজনীতি বিজ্ঞানের বিকাশ নিয়ে লেখা বই হলো নিকোলো মেকিয়াভেলির ‘দি প্রিন্স’। তাঁর এবং কনফুশিয়াসের মূল প্রতিপাদ্য হলো- যে কোনো মূল্যে স্থিতিশীলতা।

    বুর্জোয়া সমাজের উত্থানের সাথে রাষ্ট্র ও পরিবারের বাইরে ছড়িয়ে পড়া কাজ- কারবারের জন্য নৈতিক ও রাজনৈতিক জমিন সৃষ্টি প্রয়োজন হলো। টমাস হবস বুর্জোয়া সমাজের মাঝে প্রত্যেকের বিরুদ্ধে প্রত্যেকের লড়াই রুখতে বা এড়াতে রাষ্ট্রকে মনে করতেন অনিবার্য; জন লক ইংরাজ দেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের ধারণা বিকাশ করলেন; রুশো স্বৈরতন্ত্রের উদ্ভব ঠেকাতে “সামাজিক চুক্তি” ধারণা বিকশিত করলেন। অপরদিকে হেগেল জন্ম দিলেন ‘অধিকারের দর্শন’, যেখানে মার্কসের মতে, “এক পারস্পরিক বোঝাপড়ার সমাজ” চালিত হয় সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের হাতে; টমাস পেইন তদবির করলেন ‘মানব অধিকারের’ সপক্ষে।

    আধুনিককালে রাজনৈতিক সংগ্রামের প্রধান হাতিয়ার হলো রাজনৈতিক দল, যেখানে সামাজিক স্বার্থ সংগঠিত হয়ে রাজনৈতিক আঙ্গিক পায়। কথিত পোস্ট-মডার্ন যুগে কেউ কেউ বিশ্বায়নের মুখোমুখি কার্যকর শক্তির ভরকেন্দ্র বা আধার হিসেবে রাষ্ট্র বা সরকারকে মানতে নারাজ। রাজনৈতিক দল, সামাজিক আন্দোলনের বিপরীতে তারা সম্প্রদায় ধারণা খেলাফ করে আত্ম-তন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে

    রাজনৈতিক বিপ্লব (Political Revolution)

    রাজনৈতিক বিপ্লব হলো বহাল শাসক রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে ব্যাপক জনআন্দোলন দিয়ে শক্তির সাহায্যে ছুঁড়ে ফেলা। এর উদ্দেশ্য অন্তর্গত উৎপাদন সম্পর্ক পাল্টানো বা রাষ্ট্র বিলুপ্ত করা নয়।

    রোবোসপিয়ের, ম্যাক্সমিলিয়েন ফ্রাসোয়া মারি ইসিদোরো দ্য

    ৬ মে ১৭৫৮-২৮ জুলাই ১৭৯৪। ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম নেতা। বিপ্লবের প্রতি আমৃত্যু বিশ্বস্ত। জননিরাপত্তা কমিটির খুবই প্রভাবশালী নেতা। এই কমিটি বিপ্লবীদের শক্তি সুসংহত করবার কালে মূল ক্ষমতায় ছিল, এই সময়কে সাধারণভাবে ‘ত্রাসের রাজত্ব’ বলা হয়। বিপ্লবী পঞ্জিকার দ্বিতীয় বছরে তিনি নিহত হন।

    রাজনৈতিকভাবে ছিলেন এনলাইটেনমেন্টের অন্যান্য দার্শনিকদের মাঝে বিশেষ করে জ্যা জ্যাক রুশোর শিষ্য। বামপন্থী বুর্জোয়া মতের যোগ্য প্রচারক। বিদ্রোহ সংগঠনে তার প্রতিভা ছিল অসাধারণ। যতটা ভালো তাত্ত্বিক তত ভালো প্রশাসক তিনি ছিলেন না। সহিংসতাকে তিনি জননিরাপত্তা অর্জনের জন্য অপরিহার্য মনে করতেন।

    সদৃশ (Semblence )

    সদৃশ হলো মায়ার সমার্থক, জর্মনে বলা হয় Schein বা প্রদর্শন। মায়া হলো হেগেলীয় দর্শনের এক ক্যাটেগরি, এতে বোঝায় কোনো বিষয় প্রথম ধারণায় যে সন্দেহ জাগায় – সেই ক্ষণ।

    সমালোচনা, পর্যালোচনা (Criticism )

    কোনো আলোচনার ভেতরে থাকা মূল বিষয়টিকে বের করে আনবার চর্চাকে পর্যালোচনা বলে।

    কোনো বিষয় বা আলোচনাকে ভিন্ন জায়গা হতে বিশ্লেষণ বা তা ভুল প্রমাণের চেষ্টা হতে পর্যালোচনার তফাৎ আছে। আদতে এখানে ধরে নেয়া হয়, যে বিষয়টি নিয়ে পর্যালোচনা হচ্ছে তার মাঝে সঠিকতা আছে, তবে সেই বিশেষ সামাজিক স্বার্থটি সম্পূর্ণ ওজন নিয়ে ঘোষিত হচ্ছে না।

    পশ্চিমে এর শুরু হয় কান্টের শুদ্ধবুদ্ধির পর্যালোচনা দিয়ে। কান্টের মতে, সমালোচনা হচ্ছে অন্ধ মত আর সন্দেহবাদের মাঝের পথ। কোনো বিবৃতি সত্য না মিথ্যা–কান্ট সোজাসাপ্টা তার সিদ্ধান্ত নেয়ার বদলে এর ক্যাটেগরিগুলো, যে ধারণা দিয়ে প্রশ্নটি উপস্থাপিত হয় সেগুলোই বিশ্লেষণ করতেন।

    হেগেল প্রথম সমালোচনা/পর্যালোচনা গঠনগতভাবে গড়ে তোলেন। তিনি কোনো বিষয়ের ভেতরকার দ্বন্দ্বগুলো কিভাবে নিজের লজিক অনুযায়ী নিজেরই বিপরীত অবস্থানে যেতে পারে তা শেখান। তরুণ হেগেলীয়রা নিজেদের সমালোচক বলতো। এ প্রসঙ্গে মার্কস-এঙ্গেলসের ‘পবিত্র পরিবার’ দেখুন। তরুণ হেগেলীয়দের লুডভিগ ফয়েরবাখ হেগেলের বিরুদ্ধেই এক সমালোচনার ধারা বিকাশ ঘটান। তিনি হেগেলের বাক্য হতে উদ্ধৃতি নিয়ে তার উদ্দেশ্য আর বিধেয় পরস্পর বদলে দেখান যে এভাবে হেগেলের বলা কথা আরো বহু অর্থ প্রকাশ করে। যেমন, খ্রিষ্টানরা বলে জাগতিক পরিবার আসলে দৈবী পরিবারের ছায়ামাত্র, সেখানে ফয়েরবাখ দেখান ঐ দৈবী পরিবার আসলে জাগতিক পরিবারের কাল্পনিক প্ৰতিচ্ছবি।

    হেগেলের অধিকার দর্শনের পর্যালোচনায় মার্কস ফয়েরবাখের এই পদ্ধতি কাজে লাগান। পরে মার্কস এই পদ্ধতির ঘাটতি নিয়ে বলেন:

    “তাই ফয়েরবাখ দেখতে পান না যে, ‘ধর্মীয় অনুভূতি নিজেই হলো একটা সামাজিক সৃষ্টি এবং যে বিমূর্ত ব্যক্তিটির বিশ্লেষণ তিনি করেন সেও প্রকৃতপক্ষে কোনো একটা নির্দিষ্ট রূপের সমাজের অন্তর্ভুক্ত।” (মার্কস, ফয়েরবাখ সম্বন্ধে ৮ম থিসিস)

    এমনি করে মার্কস হেগেলের পর্যালোচনা হতে মূল্যবান এক ব্যাপার বের করলেন। তাঁর মতে, ধারণা ও তত্ত্ব ‘বিশেষ রূপের সমাজে’র মাঝে তাদের স্বার্থ প্রকাশ করে। ভাবাদর্শের ভেতরে, সমাজ সম্পর্ক লুকিয়ে থাকে, যা ধরলে ভাবাদর্শকে বোঝা যায়, তবে একই কালে ভাবাদর্শই সমাজ সম্পর্ক বোঝায় সবচেয়ে ভালো খোলা পথ!

    মার্কস তাঁর ‘পুঁজি’ গ্রন্থটিকে পর্যালোচনাই বলেছেন। মার্কসের পর্যালোচনা জ্যাক দেরিদার পর্যালোচনা হতে ভিন্ন। তাঁর পদ্ধতি ‘অবিনির্মাণ’ (Deconstruction) নামে পরিচিত। পদ্ধতিটি হলো কোনো তর্কের ভেতর হতে লুকোনো বাইনারিটি প্রকাশ করে তার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা। দেখানো যায় যে প্রতিটি আর্গুমেন্টেই এমন অকথিত বাইনারি আছে, ফলে কোনো টেক্সটের বাইরে না গিয়েই সেখানে অবিনির্মাণের প্রক্রিয়া চালানো যায়। মার্কসের মতে, টেক্সটে বলা, প্রকাশিত আর্গুমেন্ট ও তার সামাজিক শর্ত অবিচ্ছেদ্য।

    সম্প্রদায় (Community)

    সম্প্রদায় হলো শ্রমের নির্দিষ্ট সামাজিক বিভাগের মাধ্যমে সাধারণ বৈধ-অবৈধতার ধারণা মেনে একসাথে বেঁচে থাকা মানুষের দল। একে এক নৈতিক মূল্যবোধ বলা যায়।

    নিজেকে নিজে শাসন করতে পারা সম্প্রদায় ধারণার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এসব বিচারে মানবতার জন্য সম্প্রদায় ধারণাটি ফেলনা নয়। পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বুর্জোয়া শ্রেণী সামাজিক উৎপাদন মাধ্যমের শ্রেণীগত দখলদারি কায়েম করে, সম্প্রদায়ে একত্রিত উৎপাদন করবার শক্তিকে ব্যবহার করে তাদের সম্পত্তির মতো করে। এর ফলে সম্প্রদায়গত আস্থা ভেঙে পড়ে, অসংখ্য রেশারেশির জন্ম নেয় মানুষের বিভিন্ন দলের মাঝে। পুঁজিবাদী উৎপাদনের তিনটি বৈশিষ্ট্য বর্তমানে সম্প্রদায় ধারণাটি শাসন করছে:

    ১. “উপাদনী উপায়ের মুষ্টিমেয় হাতে জমা হয়ে যাওয়া, যার ফলে তাদের আর সরাসরি শ্রমদাতার সম্পত্তি বলে মনে হয় না এবং তা সামাজিক উৎপাদনী ক্ষমতায় বদলে যায়। যদিও শুরুতে তা পুঁজিপতিদের ব্যক্তিসম্পত্তি, কিন্তু আসলে তা বুর্জোয়া সমাজের আমানতদারি, কিন্তু এই আমানত সব ফল তারাই পকেটস্থ করে।”

    ২. “শ্রমের সংগঠন নিজে সামাজিক শ্রম হয়ে যায় পারস্পরিক সহযোগিতা, শ্রম বিভাগ এবং প্রকৃতি বিজ্ঞানের সাথে শ্রমকে একত্রিত করবার মাধ্যমে।”

    “এই দুই দৃষ্টিতে, পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদনের ধরন ব্যক্তিসম্পত্তি এবং ব্যক্তি শ্রম, পরস্পরবিরোধী আঙ্গিকে হলেও, উচ্ছেদ করে।

    ৩. “বিশ্ববাজারের সৃষ্টি।”

    (মার্কস: পুঁজি, ৩য় খণ্ড)

    সার্বিক (Universal )

    জগতের সমস্ত জিনিসে সাধারণ কোনো গুণ আর নীতি উপস্থিত যা সর্বদা আর সবসময় সত্য—জ্ঞান তত্ত্বে এমনি করেই সার্বিককে চেনানো হয়।

    সার্বিক কেবল স্বতন্ত্রের মাঝ দিয়েই থাকতে পারে। মানে এমন বিষয়ের অস্তিত্ব যার মাঝে সার্বিক গুণ উপস্থিত। যেমন, জাম (স্বতন্ত্র) কাল (সার্বিক)। মানব সত্তার হাতে কলমের কাজ এবং তার ওপর ভিত্তি করা জ্ঞানগত ক্রিয়া ছাড়া সার্বিকের কোনো অস্তিত্ব থাকতে পারে না। সার্বিকের আসলেও কোনো বিষয়গত ভিত্তি আছে কিনা তা দেখানো সম্ভব কেবল চর্চার মাধ্যমে।

    সামন্ত সমাজ (Feudal Society )

    সামন্ত সমাজ হলো এমন এক ধরনের সভ্যতা যা সাধারণত ব্যাপকভাবে ক্ষুদ্র মাপের কৃষি উৎপাদনের সাথে সমন্বিত, যার ভিত্তি প্রথাগত গঠনের ভূমি মালিকানা, যেখানে সমাজের প্রতিটি সদস্যের অধিকার এবং কর্তব্য ঐতিহ্যগত উত্তরাধিকার এবং জ্ঞাতিসম্পর্ক দ্বারা নির্ধারিত।

    সামন্ত সমাজ একটি শ্রেণী সমাজ। এখানে বিভিন্ন পরিবার অসম অধিকার এবং কর্তব্য পালন করে, ভূমি, সম্পদ এবং সামাজিক মর্যাদা পূর্বতন প্রজন্মের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া হয়। এ সমাজে খুব নিম্নমাত্রায় হলেও প্রতিটি শ্রেণীরই কিছু অধিকার থাকে। এই সমাজে দাসত্ব থাকলেও তা উৎপাদনের প্রধান ধরন হয় না।

    জমিতে সংযুক্ত সাধারণ জনগণই এখানে প্রধান উৎপাদক, তার কিছু সুচিহ্নিত রাজনৈতিক এবং ভূমিগত অধিকার থাকে। দাস সমাজের মতো রাজা এখানে নিজেই আইন নন, তাকে এবং তাঁর অভিজাতদেরকে সুনির্দিষ্ট কিছু দায়িত্ব-কর্তব্য অনুযায়ী চলতে হয়। বুর্জোয়া সমাজের সঙ্গে এর পার্থক্য হলো – বুর্জোয়া সমাজ ঐতিহ্যগত অধিকার এবং নীতিবোধের আরোপিত বাধার বাইরে গিয়ে শুধুই মুনাফা অর্থাৎ ‘বাজার’ দ্বারা শাসিত হয়।

    সামন্ত সমাজে রাষ্ট্র সমাজের ওপরে অবস্থিত কোনো শক্তি হিসেবে নিজেকে জাহির করে না, বরং নিজেকে সমাজের সঙ্গে অভিন্ন হিসেবেই প্রকাশ করে। বুর্জোয়া সমাজের তুলনায় সামন্ত সমাজের ধর্মীয় ধারণাতেও তফাৎ থাকে। দাস সমাজের শাসক হতেন নিজেই আধা-ঈশ্বর আর সামন্ত সমাজে রাজা মোটামুটিভাবে পৃথিবীতে ঈশ্বরের প্রতিনিধি। এখানে সমস্ত সিদ্ধান্তই আধিপত্যমূলক। ব্যক্তি স্বতন্ত্রতা অকল্পনীয়, তবে প্রতিটি ব্যক্তি ঐ আধিপত্যশীল সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ার ধারা অনুযায়ী নির্দিষ্ট অধিকার ধারণ করে।

    সাধারণভাবে বলতে গেলে সামন্ত সমাজ হলো ক্ষুদ্র মাপের কৃষিভিত্তিক উৎপাদনী শক্তির জন্য লাগসই উৎপাদনের ধরন। ক্ষুদ্র মাপের কৃষি হতে সর্বোচ্চ সুবিধা নেয়ার স্বার্থে এখানে শ্রমদাতাকে জমির ওপরে অধিকার দেয়া হয়। কৃষক এখানে জানে সামন্ত সমাজের উপরিকাঠামো টিকিয়ে রাখতে কি অনুপাতে তার শ্রম ব্যয় হয়, কারণ তার শ্রমের বা উৎপাদনের একটা নির্দিষ্ট অংশই সরাসরি তার কাছ থেকে গ্রহণ করা হয়। অপর দিকে পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে মজুরি শ্রমিক এই পরিমাণটি না জেনেই শোষিত হয় কারণ তার মনে হয় প্রতিটি শ্রম-ঘণ্টার জন্যই সে মজুরি পাচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের বেড়ে উঠার ফলে এবং সামন্ত সমাজের এখতিয়ারের বাইরে বেড়ে উঠা পুঁজির দাপটে ধ্রুপদী পশ্চিমা সামন্ত সমাজের অবসান ঘটে।

    প্রাসঙ্গিক পাঠ: ১. কমিউনিস্ট ইস্তেহার, ২য় অধ্যায়; ২. মার্কস: ক্যাপিটাল, ১ম খণ্ড, ২৬ অধ্যায়; ৩. এঙ্গেলস: পরিবার, ব্যক্তিসম্পত্তি ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি, ৮ম অধ্যায়; ৪. মার্কস-এঙ্গেলস: জার্মান ভাবাদর্শের ১ম অধ্যায়।

    সিভিল সমাজ

    সিভিল সমাজ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে কয়েকটি বিষয় লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। প্রথমত, বিষয়টি যেভাবে আমাদের সমাজ-রাজনৈতিক চর্চায় প্রচিলত তার বৈশিষ্ট্য ও উৎস এবং দ্বিতীয়ত, সিভিল সমাজ ধারণার ঐতিহাসিক বিকাশ, প্রচলিত ধারণার সাথে তার উৎসগত যোগাযোগ এবং মার্ক্সীয় আলোচনায় ধারণাটির রাষ্ট্র, রাজনীতি ও সমাজ রূপান্তরের গুরুত্বপূর্ণ সংশ্লেষ।

    ‘সুশীল সমাজ’ তার্কিকরা একমত যে জ্ঞান আঞ্চলিক, ভিন্নতা ও ব্যবধানই আধুনিক সমাজ জীবনের প্রধান বিষয়, মানব সম্পর্ক গড়ে ওঠে নিছক ভাষা ও ডিসকোর্সের মাধ্যমে আর লড়াইয়ের ময়দান অর্থনীতি-রাজনীতি নয় বরং সংস্কৃতি। রাষ্ট্র বা রাজনীতির সমগ্রতার বিপরীতে প্রস্তাবিত প্রতিপক্ষ হচ্ছে বহুধা বিভক্ত, আত্ম-পরিচয় নির্ধারিত একক। কিন্তু বিশ্বজোড়া সুশৃঙ্খল, সচেতন শাসক শ্রেণীর রাজনৈতিক ক্ষমতার ব্যবহারের কাছে এই সব প্রস্তাবনা অসহায় হয়ে পড়ে। জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে বাজারের অনুপ্রবেশ আর পুঁজির পুঞ্জিভবনের সর্বাত্মক লজিক প্রমাণ করে যে, রাষ্ট্র হতে সিভিল সমাজের আলাদা হওয়া মানুষকে সর্বগ্রাসী, অন্ধ বাজারের গ্রাসে ছুঁড়ে দেয়।

    হাল আমলের সমাজ ও রাজনৈতিক চিন্তা জগতের সিভিল সমাজ সংক্রান্ত ধারণার দুটো ধরন পাওয়া যায়। উভয়েরই মূল উদার গণতন্ত্রী তত্ত্বে। এ ব্যাপারে প্রথম ধ্রুপদি বুর্জোয়া বোঝাপড়া দাঁড় করান এডাম স্মিথ। তাঁর কাছে এটা ছিল প্রয়োজনের বাজার সংগঠিত বলয় যা চালিত হয় ব্যক্তি মালিকদের আত্ম-স্বার্থের গতিতে। জন লকের কাছে সিভিল সমাজ ছিল সম্পত্তি, শ্রম, বিনিময় ও ভোগের সমন্বয়। লকের এই ধারণার কাছে স্মিথ ঋণী। এরপর বাজারের বিকাশ ঘটলো দ্রুত গতিতে। বুর্জোয়া অর্থশাস্ত্রীরা সিভিল সমাজকে তত্ত্বায়িত করলেন এমন এক স্বশাসিত স্বনিয়ন্ত্রিত, বলয় হিসেবে যা বিশেষ সুবিধার জন্য ব্যক্তির প্রচেষ্টাকে জনস্বার্থে রূপান্তরিত করতে পারে। হেগেল তাঁর রাষ্ট্র ও সিভিল সমাজের তত্ত্ব এই বোঝাপড়ার ওপরে ভর করেই দাঁড় করান।

    অপর দিকে তকভিলের মতে সিভিল সমাজ হল স্বেচ্ছা সম্মিলনের এক অন্তর্বর্তী বলয় যা টিকে থাকে নিজেই সংগঠিত আর সহযোগিতার এক ইনফর্মাল সংস্কৃতির মাঝ দিয়ে।

    এই দুই ধারণার সাথে স্থল আরেকটা ধারা প্রচলিত আছে যারা বলে বেড়ায় যে আমাদের প্রত্যেকের মাঝে সুসম্পর্ক থাকা উচিত, রাজনীতিবিদদের সৎ, দুর্নীতিমুক্ত হওয়া উচিত, প্রচার মাধ্যম শুধু নেতিবাচক না হয়ে বাস্তব যেমনই হোক ইতিবাচকভাবে তুলে ধরা উচিত… এই সব। এই ঘরানা রাজনীতিবিদ হতে জনগণ পর্যন্ত সবাইকে ন্যায়-নীতি, আচার ব্যবহার শিক্ষা দেয়।

    এবার হেগেলের কাছে ফিরে যাওয়া যাক। তাঁর কাছে সিভিল সমাজ হলো প্রয়োজন দিয়ে গঠিত, রাষ্ট্র ও পরিবারের মধ্যস্থতায় বাজার সম্পর্কের নেটওয়ার্ক। কিন্তু নৈতিকতার বিচারে তাকে সর্বদাই আপোষ করতে হয়। কারণ এর গোড়ায় থাকা প্রতিযোগিতামূলক ব্যক্তি দখলের প্রবণতা-এক সার্বিক বিশৃঙ্খলতায় পর্যবসিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এই পরিস্থিতিতে ভাণ্ডার যত বড়ই হোক অভাব সব সময় তাড়া করে, প্রত্যেকে নিজেকেই সব’চে গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে থাকে। এমন ঝামেলার সুরাহা করতে না পেরে সিভিল সমাজে প্রয়োজন হয় রাষ্ট্রের নৈতিকতার।

    মার্ক্স জানতে চাইলেন-হেগেল রাষ্ট্রকে যে দায়িত্ব দিলেন সে তা পালন করতে সক্ষম কিনা! রাষ্ট্র তাঁর কাছে এক মিথ্যা সার্বিকতা। তিনি আরো বললেন যে, ব্যক্তিসম্পত্তি কেন্দ্রিক বস্তুগত স্বার্থের নেটওয়ার্কই এর গলদের মূল। ফরাসি বিপ্লব ধর্ম, সম্পত্তি, নৈতিকতা এ সবের ফর্মাল রাজনৈতিক মানে বদলে ব্যক্তি বিশেষের বৈশিষ্ট্যে বদলে দিল। কিন্তু এই বদল একই সঙ্গে প্রমাণ করলো যে রাষ্ট্রকে, ফর্মালভাবে সমাজ হতে মুক্ত করলে তার সাথে সমাজও রাষ্ট্র হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। যদি আমজনতার বিষয় ধর্ম বা সম্পত্তি দিয়ে ব্যাপকভাবে নির্ধারিত না হয় তবে ধর্ম বা সম্পত্তি রাজনৈতিক বাধা-নিষেধ ছাড়া বল্গাহী- ভাবে বেড়ে যেতে পারে। রাজনীতি হতে এগুলো মুক্ত হলে মানুষের ওপর তাদের প্রভাব কমে না বরং ফর্মাল রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা হতে মুক্তি তাদের ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। সিভিল সমাজের এই আপাত স্বাধীনতার মানে, “মানুষকে বাধা-নিষেধ হতে মুক্ত না করেই রাষ্ট্র নিজেকে তা হতে মুক্ত করতে পারে। মানে মানুষকে মুক্ত না করেই রাষ্ট্র মুক্ত হতে পারে (মার্ক্স, ইহুদি প্রশ্নে)”। আরো লক্ষণীয় যে, রাজনৈতিক মুক্তির দৌড়ও সীমাবদ্ধ, “মানুষ ধর্ম হতে মুক্ত হল না, পেল ধর্মীয় স্বাধীনতা। সম্পত্তি হতে মুক্তি না পেয়ে পেল সম্পত্তির স্বাধীনতা। ব্যবসার অহং হতে মুক্ত না হয়ে পেল ব্যবসা করবার স্বাধীনতা (ঐ)

    মুক্তির জন্য ধর্ম বা রাজনীতিতে পরিবর্তনের চাইতে বেশি কিছু দরকার। “রাজনৈতিক মুক্তি সন্দেহ নেই যে এক বিরাট অগ্রবর্তী পদক্ষেপ, সাধারণভাবে তা মানব ‘মুক্তির চূড়ান্ত রূপ নয়, তবে একে বিদ্যমান জগত ব্যবস্থার ভেতরে মানব মুক্তির চূড়ান্ত রূপ বলা যায়। বলা বাহুল্য আমরা এখানে বাস্তব, প্রায়োগিক মুক্তির কথা বলছি (ঐ) বুর্জোয়া রাজনৈতিক গণতন্ত্র বাজারের সামাজিক ভিত্তিকে ধরা ছোঁয়ার বাইরে রেখে দেয়। সমস্যার মূল হল ব্যক্তিসম্পত্তি। মার্ক্স-এঙ্গেলস এবার মনোযোগ দিলেন এমন সামাজিক শক্তির দিকে যা এই সমস্যাকে সমাধান করে বিদ্যমান বিশ্ব ব্যবস্থাকে পাল্টাতে পারে।

    আগের সব সমাজ পর্যালোচকদের ঝোঁক ছিল খেটে খাওয়া মানুষদের মাঝে সবচে দূর্গত, নয়তো সব’চে বেশি পরিশ্রমি অথবা সব’চে শোষিতদের দিকে। মার্ক্স- এঙ্গেলস এই প্রবণতা চির তরে পাল্টে দিলেন আধুনিক জীবনের একেবারে কেন্দ্রে বাস করা সম্পত্তিহীন সর্বহারাদের দিকে মনোযোগ দিয়ে। এই সর্বহারা হল সিভিল সমাজের জলজ্যান্ত নেতিকরণ। মার্ক্স সমস্যার আরো স্পষ্ট করেন ফয়েরবাখের ওপর দশম থিসিসে, “পুরাতন বস্তুবাদের দৃষ্টিকোণ হল “সিভিল’ সমাজ; নতুন বস্তুবাদের দৃষ্টিকোণ মানব সমাজ বা সমাজিকৃত মানব জাতি।”

    তবে রাজনৈতিক বিপ্লবের সমালোচনা মানে সমস্ত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিত্যাগ নয়। ‘কমিউনিস্ট ইশতেহারে’র অন্যতম প্রতিপাদ্য হল সর্বহারা বিপ্লবে রাজনীতির ভূমিকা স্পষ্ট করা, আর এই বিপ্লবের প্রতিপাদ্য হল সমাজ রূপান্তর। বুর্জোয়াদের যদি প্রথমে রাজনৈতিকভাবে পরাজিত করা যায় তাহলেই তাদের অর্থনৈতিকভাবে পরাজিত করা যাবে—এই অবস্থান থেকে মার্ক্স এঙ্গেলস জানান যে, “কমিউনিস্টদের তাৎক্ষণিক লক্ষ্য অন্যসব সর্বহারা পার্টির মতই, আর তা হল সর্বহারাদের শ্রেণী হিসেবে গঠন করা, বুর্জোয়া শ্রেষ্ঠত্বকে ছুঁড়ে ফেলা, প্রলেতারিয়দের রাজনৈতিক ক্ষমতা জিতে নেয়া (ইশতেহার)।”

    রাজনৈতিক মুক্তির সীমাবদ্ধতা জানা সত্ত্বেও মার্ক্স সমাজ রূপান্তরে রাজনীতির এমন অগ্রবর্তী ভূমিকা রাখার কারণ আছে। তাঁর মতে, প্রলেতায়িত বিপ্লব পূর্ববর্তী বিপ্লবগুলো থেকে ভিন্ন হবে। সামন্ত সমাজের ভেতরে পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কম বেশি আকার ধরে বেড়ে ওঠার পরই বুর্জোয়া বিপ্লব শুরু হয়। সামন্ত রাষ্ট্রকে খোলাখুলি বিপ্লবী ধাক্কা দেবার আগেই বুর্জোয়া সম্পত্তি ও উৎপাদন সামন্ত সম্পত্তি ও উৎপাদনকে ব্যাপকভাবে প্রতিস্থাপিত করেছিলো। বুর্জোয়া বিপ্লবের প্রধান কাজ ছিল অভিজাততন্ত্রের শ্রেষ্ঠত্ব শেষ করে দেয়া। বুর্জোয়াদের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা যাওয়ার আগেই বুর্জোয়া সমাজ সম্পর্কের মূল কাঠামো প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। বুর্জোয়া বিপ্লব শুধু এক ক্ষয়ে যাওয়া উপরিকাঠামোকে ইতিমধ্যে রূপান্তরিত ভিত্তি দিয়ে প্রতিস্থাপিত করেছিলো। এ কারণেই ইশতেহার উৎপাদনি মাধ্যমে ব্যক্তিসম্পত্তির কোন রূপকে তার চাইতে উন্নত কোন রূপ দিয়ে প্রতিস্থাপিত হওয়ার রাজনৈতিক রূপান্তরের ধারাক্রমে বুর্জোয়া বিপ্লবকে সর্বশেষ বলেছে। পূর্বতন সমস্ত সমাজ বিপ্লবে ব্যক্তি মালিকানায় রূপান্তরের মূল সূত্র ছিল অভিন্ন। এ কারণেই ধ্রুপদি সমাজ বিকাশে সামন্ততন্ত্র বেড়ে ওঠে দাসতন্ত্র হতে, পুঁজিতন্ত্র সামন্ত ব্যবস্থার বস্তু আর সমাজ শর্ত হতে কিন্তু সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব তার সামাজিক ও বস্তুগত শর্ত সম্পন্ন হওয়ার আগেই শুরু হয়।

    সর্বহারা বিপ্লবের চূড়ান্ত ফলাফল সমাজ বদল, তার তাৎক্ষণিক লক্ষ্য রাজনৈতিক। মার্ক্সের প্রকল্পে এই প্রলেতারিয়েত রাষ্ট্র অবিকল্প গুরুত্বপূর্ণ। তবে এই রাষ্ট্র ক্ষমতার সমগ্র লক্ষ্য হচ্ছে তার নিজেকে বিনাশ করবার পরিস্থিতি তৈরি করা। এই দ্বন্দ্ব বাস্তব রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনে বহু পুরাতন।

    আজকালের সিভিল সমাজ নিয়ে যে হুজুগ তার সূত্রপাত ১৯৮০’র গোড়ার দিকে পূর্ব য়ুরোপে। সেখানকার কিছু বুদ্ধিজীবী সোভিয়েত স্টাইলের বহাল সমাজতান্ত্রিক সমস্যাগুলোকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সিভিল সমাজের বিদ্রোহ বলে বর্ণনা করেন। তাঁরা সিভিল সমাজকে বিভিন্ন আঙ্গিকে সংগঠিত কমিউনিস্ট বিরোধিতা বলেই মনে করতেন। এই জমিনের ধারণা শীতল যুদ্ধের কালে পশ্চিম য়ুরোপে ও মার্কিন মুলুকে ছড়িয়ে পড়ে বর্তমানে মূলস্রোতের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় প্রায় শাস্ত্রের মর্যাদা পেয়ে গেছে।

    সারসত্ত্বা (Essence )

    কোনো কিছুর বৈশিষ্ট্য বা মানে। মধ্যযুগের পশ্চিমা দার্শনিকরা মনে করতেন সারসত্ত্বা কোনো জিনিসের গুপ্ত এক গুণ, যাকে কেবল বুদ্ধি বা বিশ্বাসের ক্ষমতা দিয়েই কবজা করা যায়। কান্ট একে সব সংবেদনক্ষম উপাদান বর্জিত, নিজেই সর্বেসর্বা — এমন এক ধারণাতে গুটিয়ে আনেন।

    হেগেল একে মনে করতেন ‘বিকাশের পরস্পরবিরোধী’ প্রক্রিয়া। তাঁর মতে, সারসত্ত্বার বিকাশ তিন ধাপে সম্পন্ন হয়। প্রথমে “প্রতিফলন” যাতে ভিন্নতাগুলো পরস্পরের বিরোধী হয়ে দেখা দেয় এবং ক্রমে এদের মাঝে দ্বন্দ্ব আবির্ভূত হয়; এরপর প্রতীয়মানতা, যা আঙ্গিক ও আধেয়র সংগ্রাম, যেখানে প্রতিটি নতুন আঙ্গিক গভীরতর আধেয় নিয়ে আসে; আর সব শেষে বাস্তবতা, মানে কারণ ও কার্যের পারস্পরিক কাজ। এই ধারণা মার্কসের চিন্তাতেও গুরুত্বপূর্ণ, এখানে কোনো জিনিসের সত্যটুকু যে প্রত্যক্ষভাবে সংবেদনে নাজেল হয় – এই ধারণা অস্বীকৃত।

    স্বতন্ত্র (Individual)

    দর্শনে স্বতন্ত্র বলতে বোঝায় প্রত্যক্ষভাবে দেয়া বিষয়, যা নিজের মাঝে সমস্ত টুকরো অংশের সমগ্রতা ধারণ করে, প্রকাশও করে, কিন্তু নিজে থাকে এই সব হতে আলাদা। ধর্ম বা গোত্র সমাজ সার্বিকতায় জোর দেয়; পুঁজিতান্ত্রিক সমাজ সাচ্চা বলে স্বতন্ত্রকে, যেমন মার্গারেট থ্যাচার বলেছিলেন: “সমাজের কোনো অস্তিত্ব নেই।”

    মার্কস সামাজিক সমস্যা চর্চা ও তা বুঝতে কোনো জিনিসকে তার স্বতন্ত্রতা, বিশিষ্টতা এবং সার্বিকতা দিয়ে কবজা করবার পক্ষপাতি ছিলেন।

    1 2 3 4
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleলাভ ক্যান্ডি – জাফর বিপি
    Next Article নয় এ মধুর খেলা – জাহানারা ইমাম
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }