Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ঈগল ইন দ্য স্কাই – উইলবার স্মিথ

    উইলবার স্মিথ এক পাতা গল্প456 Mins Read0

    ৭. প্রাকৃতিক ছাদ

    কোবজের কাছে জাবুলানি ঘরের উপরে প্রাকৃতিক ছাদ মতন একটা জায়গা আছে। যেখান থেকে দেখা যায় পুরো এস্টেট। জায়গাটা বেশ খানিকটা দূরে আর একেবারে শান্ত। সন্তানকে সেখানে সমাহিত করল তারা। কোবজের পাথর দিয়ে নিজের হাতে কবর তৈরি করল ডেভিড।

    ভালোই হল যে ডেবরা বাচ্চাকে কখনো হাত দিয়ে ছুঁতে পারেনি বা দুধ খাওয়ানি। ওর কান্না শোনেনি বা শরীরের ঘ্রাণ নেয়নি।

    যাই হোক, ভেতরের বেদনা মুখ ফুটে প্রকাশ করলো না কেউই। নিয়মিত সমাধি স্থানে যায় ডেভিড আর ডেবরা। এরপর এক রবিবারে পাথরের বেঞ্চিতে বসে প্রথম বারের মতো দ্বিতীয় বাচ্চার কথা উচ্চারণ করল ডেবরা।

    ‘প্রথমবার তুমি অনেক সময় নিয়েছে মরগ্যান। অভিযোগ করে বলল ডেবরা।

    ‘আমার মনে হয় এখন শিখে গেছ কৌশলটা, তাই না?

    আবারো পাহাড় বেয়ে নেমে এলো দুজনে। ল্যান্ড রোভারে বঁড়শি আর পিকনিক বাস্কেট নামিয়ে রেখে নেমে গেল পুলের পানিতে।

    দুপুর হবার ঠিক এক ঘণ্টা আগে বঁড়শিতে খাবার গিলল মোজাম্বিক ব্রিম। কষ্ট হল ডেভিডের ধরা মোটাসোটা মাছটাকে তুলতে। পাঁচটা তুলল ডেবরা, প্রতিটার ওজন তিন পাউন্ডের কাছাকাছি। এরপর ও আরো ডজনখানেক নীল মাছ ধরল ডেভিড। অন্ধকার নামার আগপর্যন্ত এভাবেই চলল। তারপর ঠাণ্ডা লাঞ্চবক্স খুলল দু’জনে।

    ফিভার গাছের নিচে পড়ে থাকা পাতার উপর বিছানো কার্পেটে শুয়ে পড়ল দু’জনে। আইস বক্সে থাকা সাদা ওয়াইন নিল।

    কখন যেন কেটে গেল আফ্রিকার বসন্ত এসে গেল গ্রীষ্মকাল। ঝোঁপঝাড়ে বেড়ে গেল নিঃশব্দ পদচারণা। পাখিরা ব্যস্ত হয়ে পড়ল নিজেদের ঘর বানানো নিয়ে। উজ্জ্বল হলুদ রঙের পাখা ছড়িয়ে কালো মাথা নেড়ে যখন ঘর বানায় দেখার মতো দৃশ্য হয় সেটি। পুলের ওপারে ছোট্ট একটি মাছরাঙা পাখি বসে আছে শান্ত পানির উপর ভাসতে থাকা মড়া ডালের উপর। হঠাৎ করেই উড়ে গিয়ে ছো মারল নীল পানিতে। ঠোঁটে উঠে এলো সিলভার সিলভার। যেখানে তারা শুয়ে আছে তার পাশেই লাইন করে উড়ে বেড়াতে লাগল হলুদ, ব্রোঞ্জ আর সাদা প্রজাপতির দল। মৌমাছিরও গুঞ্জন তুলে চূড়ার উপরে বাসার দিকে যাচ্ছে।

    পানির কারণেই চারপাশে জীবনের স্পন্দন ছড়িয়ে পড়েছে। তাই পুলই হল জাবুলানির প্রধান সম্পদ। দুপুরের একটু পরে, ডেবরার হাত ধরল ডেভিড। নায়লারা এসেছে’–ফিসফিসিয়ে উঠল সে।

    পুলের ধার ঘেঁষে এলো অ্যান্টিলোপের দল। সহজ ভঙ্গিতে এগিয়ে এলো দলটা। বড় বড় চোখ মেলে তাকিয়ে রইল ডেভিড আর ডেবরার দিকে। কান ছড়িয়ে বিপদ আঁচ করতে চাইছে।

    ‘হরিণীগুলোর পেটে শাবক।’ জানাল ডেভিড। সামনের কয়েক সপ্তাহের মাঝেই প্রসব করবে। সবকিছুই ঠিক ভাবে চলছে। অর্ধ-পাশ ফিরে ডেবরার দিকে তাকাল ডেভিড। বুঝতে পেরে কাছে গেল ডেবরা। পানি পান করে চলে গেছে নায়লার দল, সাদা মাথাওয়ালা মাছ ধরা ঈগল অনেক উপরে চক্কর মারছে মাথার উপর চেস্টনাট রঙের পাখা ছড়িয়ে, গুঞ্জন করছে অদ্ভুত সুরে আর এরই মাঝে শান্ত পুলের পাশে ছায়ার মাঝে ভালোবাসা-বাসি করল দু’জনে।

    ডেবরার মুখের দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে দেখল ডেভিড। চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে মেয়েটা। কার্পেটের উপর উজ্জ্বল কালো কাপড়ের মতো ছড়িয়ে আছে চুল। কপালের উপর রং হালকা হয়ে হয়ে হলুদ আর নীল হয়ে আছে। হাসপাতাল থেকে আসার পর কেটে গেছে দুই মাস। হালকা কাটার দাগের পাশে বড় বেশি উজ্জ্বল দেখাচ্ছে ডেভিডের গ্রেনেড দিয়ে ক্ষত-বিক্ষত হওয়া মুখমণ্ডল। সাদা হয়ে উঠল ডেবরার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। উপরের ঠোঁট খুলে গেল, আরামদায়ক সুরেলা ধ্বনি বের হয়ে এলো মুখ থেকে।

    তাকিয়ে তাকিয়ে খুব কাছ থেকে দেখল ডেভিড। বুকের মাঝে ভালোবাসায় ভরে গেল মেয়েটার জন্য। উপর থেকে পাতার চাদোয়া ভেদ করে নেমে এলো সূর্যের আলোর সরু একটি রেখা। পড়ল এসে ডেবরার মুখের উপর। উষ্ণ সোনালি একটি আভা ছড়িয়ে পড়ল যেন, মনে হল মধ্যযুগীয় কোন গির্জার জানালায় দেখা ম্যাজনার মুখ। আর সহ্য করতে পারল না ডেভিড। শুরু হল প্রস্রবণ। চিৎকার করে উঠল ডেবরা। চোখ খুলে বড় বড় হয়ে গেল। সোনালি মধুরঙা চোখের গভীর পর্যন্ত দেখতে পেল ডেভিড। পিউপিলগুলো মনে হলো বড় একটা কালো পুল। কিন্তু সূর্যের আলো পড়া মাত্র ছোট ছোট কালো কালো ফুটকি দেখা গেল।

    এমনকি এই সময়েও বিস্মিত হয়ে গেল চোখ দেখে। এর অনেক পরেও চুপচাপ শুয়ে রইল যখন দু’জনে ডেবরা জানতে চাইল, কী হয়েছে ডেভিড? বলল আমাকে।

    না, কিছু হয়নি ডার্লিং, কী হবে?

    ‘আমি জানি ডেভি। কিছু একটা হয়েছে পৃথিবীর ও মাথায় থাকলেও আমি ঠিক টের পাবো।’

    হাসল ডেভিড। অপধারীর ভঙ্গিতে সরে এলো ডেবরার কাছ থেকে। সম্ভবত এটা তার কল্পনা, ছোট্ট একটু আলোর শিখা। চেষ্টা করল জোর করে মাথা থেকে সরিয়ে দিতে এই চিন্তা।

    সন্ধ্যার ঠাণ্ডা নেমে এলে বঁড়শিগুলো গুছিয়ে নিলি ডেভিড। তারপর কার্পেট ভাজ করে পার্ক করা গাড়ির পাশে গিয়ে চড়ে বসল। বাড়ির উদ্দেশে গাড়ি ছোটাল। পথে যাবার সময় দক্ষিণ দিকের বেড়া চেক করে দেখল ডেভিড। এরপর নিঃশব্দে মিনিট বিশেক ড্রাইভ করার পর ডেভিডের হাত স্পর্শ করল ডেবরা।

    যখন তুমি তৈরি হবে আমাকে জানাতে যে কী হয়েছে-আমি শুনবো। এরপর অনবরত বকবক করে চেষ্টা করল ডেভিডকে একই সাথে নিজের মনকেও অন্য দিকে ফিরিয়ে নিতে।

    রাতের বেলা ঘুম থেকে উঠে বাথরুমে গেল ডেভিড। ফিরে আসার পর অনেকক্ষণ বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইল ডেবরার ঘুমন্ত মুখের দিকে। ঠিক যখন সরে যেতে চাইল সে তখনই পুলের কাছে থেকে চিৎকার করে ডেকে উঠল একটা সিংহ। দুই মাইলের ব্যবধান সত্ত্বেও পরিষ্কার শোনা গেল স্পষ্ট সেই ডাক।

    এই অজুহাতটুকুই দরকার ছিল ডেভিডের। নিজের বেডসাইড টেবিল থেকে পাঁচ ব্যাটারির ফ্ল্যাশ লাইট তুলে নিল হাতে। আলো ফেলল ডেবরার মুখের উপর। এত সুন্দর নিষ্পাপ মুখশ্রী ইচ্ছে হল ঝাঁপিয়ে পড়ে আদর করতে। এর বদলে ডাক দিল ডেবরাকে।

    ‘ডেবরা! চোখ খোল ডার্লিং। নড়েচড়ে চোখ খুললো ডেবরা। ফ্ল্যাশ লাইটের পুরো আলো ফেলল ওর চোখে ডেভিড। দেখা গেল আর কোন সন্দেহ নেই। সত্যিই নড়াচড়া করতে লাগল কালো রঙের পিউপিল।

    কী হয়েছে ডেভিড? ঘুম জড়ানো স্বরে জানাতে চাইল ডেবরা। উত্তর দিতে গিয়ে খসখসে শোনাল ডেভিডের স্বর।

    ‘একটা সিংহ পুলের কাছে কনসার্ট করছে। ভেবেছে হয়তো তুমি পছন্দ করবে, ঘুমের মাঝে গান শুনতে চাইবে। মাথা ঘুরিয়ে নিল ডেবরা। মনে হল ফ্ল্যাশ লাইটের আলোয় অস্বস্তি লাগছে চোখে। কিন্তু সন্তুষ্টির স্বরে বলে উঠল, “ওহ, হ্যাঁ ভালোই লাগছে এ গর্জন। তোমার কী মনে হয় কোথা থেকে এসেছে এটা?

    ফ্ল্যাশ লাইট বন্ধ করে বিছানায় তার পাশে ফিরে গেল ডেভিড।

    হতে পারে দক্ষিণ দিক থেকে এসেছে। আমি নিশ্চিত বেড়ার নিচ দিয়ে এত বড় একটা গর্ত করেছে যে তুমি ট্রাক ঢুকিয়ে দিতে পারবে।

    ডেবরা কাছে এগিয়ে আসায় নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে চাইল ডেভিড। শুনতে লাগল সিংহের গর্জন। এরপর আস্তে আস্তে দূরে চলে গেল ডাকটা। কিন্তু এরপর আর ঘুমালো না ডেভিড। হাতের উপর ডেবরার মাথা নিয়ে জেগে রইল ভোর পর্যন্ত।

    এরপর আরো এক সপ্তাহ কেটে যাবার পর সাহস করে চিঠি লিখতে বসল ডেভিডঃ

    ডিয়ার ডা. ইদেলমান,

    আমরা একমত হয়েছিলাম যে ডেবরার চোখ বা ওর স্বাস্থ্যের কোন পরিবর্তন হলেই আপনাক জানাবো।

    সাম্প্রতিক সময়ে কিছু দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটে যাওয়ায় মাথায় বারংবার ভারী জিনিসের আঘাত সহ্য করতে হয়েছে ওকে। এর ফলে প্রায় আড়াই দিন অচেতন অবস্থায় ও ছিল।

    হাসপাতালে নিতে হয়েছিল খুলি ফেটে যাওয়ার ভয়ে। কিন্তু দশ দিন পর বাসায় নিয়ে আসতে পেরেছি। প্রায় দুই মাস আগে হয়েছে এ ঘটনা।

    যাই হোক, এরপর থেকে আমি দেখছি যে আলোর প্রতি সংবেদনশীল হয়ে উঠেছে ওর চোখ। যেমনটা আপনি জানেন, আগে এমন হত না। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি ওর মাঝে। মাঝে মাঝেই প্রচণ্ড মাথা ব্যথার অভিযোগও করে সে।

    আমি একের পর এক সূর্যের আলো আর টর্চের আলো দিয়ে পরীক্ষা করে দেখেছি। এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে শক্তিশালী আলো ফেললে ওর চোখের পিউপিল সাড়া দেয়। যেমনটা হয় যে কোন স্বাভাবিক চোখে।

    এখন মনে হচ্ছে যে আপনার প্রাথমিক পরীক্ষা আরো একবার করতে হবে। কিন্তু এর উপড়েই বেশি জোর দিব আমি–এই কাজে সাবধানে এগোতে হবে আমাদেরকে। আমি কোন মিথ্যে বা ভিত্তিহীন আশা জাগাতে চাই না।

    এই ব্যাপারে যে কোন পরামর্শ পেলে আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকবো। আর অপেক্ষা করছি আপনার কাছ থেকে শোনার আশায়। ইতি

    —ডেভিড মরগ্যান

    .

    ঠিকানা লিখে খামে ঢোকাল ডেভিড। কিন্তু পরের সপ্তাহে ও নেলস্প্রুটে থেকে বাজার করে ফেরার পর দেখা গেল এখনো তার চামড়ার জ্যাকেটের উপরের পকেটে রয়ে গেছে চিঠিটা।

    নিরুত্তাপ শান্তভাবে কাটতে লাগল দিন। নতুন উপন্যাসের প্রথম খসড়া শেষ করলা ডেবরা। ববি ডুগান অনুরোধ করল যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় পাঁচটা শহরে বক্তৃতা দিতে যাবার জন্য। নিউইয়র্ক টাইমস-এর বেস্টেসেলার লিস্টে বত্রিশ সপ্তাহ পার করেছে আ প্লেস অব আওয়ার ওন। এজেন্ট জানিয়েছে ডেবরাকে পিস্তলের চেয়েও হট লাগছে বেশি।

    এ ব্যাপারে ডেভিডের মন্তব্য হল যতটা তার মনে হয় যে এর চেয়ে বেশি হট ডেবরা। ডেভিডকে লম্পট বলে গাল দিল ডেবরা। আরো জানল কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না যে ওর মতো সাধাসিধা একটা মেয়ে কেমন করে জড়িয়ে গেল ডেভিডের সাথে। এরপর এজেন্টের কাছে চিঠি লিখে বক্তৃতার ট্যুর বাতিল করে দিল।

    ‘মানুষকে কী দরকার?’ একমত হল ডেভিড। জানে যে তার জন্যেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে ডেবরা। আবার এটাও জানে যে ডেবরার মতো সুন্দরী অন্ধ, বেস্ট সেলিং লেখক কোথাও গেলে সাড়া পড়ে যাবে। আর একটা টুর হয়তো তাকে খ্যাতির চূড়ায় পৌঁছে দেবে।

    এর মাধ্যমে আবার টালমাটাল হয়ে গেল ওর দুনিয়া। নিজেকেই বোঝাতে চাইল যে আলোর প্রতি সংবেদনশীল মানেই এই নয় যে ডেবরা তার দৃষ্টিশক্তি আবার ফিরে পাবে। ও এখন এখানেই খুশি আছে। নিজের মতো করে পৃথিবী তৈরি করে নিয়েছে। মিথ্যে আশা বা নিষ্ঠুর একটা সার্জারি হয়ত হিতে বিপরীত হয়ে যাবে।

    নিজের সমস্ত চিন্তায় চেষ্টা করল ডেবরার প্রয়োজনকেই বেশি গুরুত্ব দিতে। কিন্তু আবার এও জানে যে নিজের সাথে ছলনা করছে সে। এই আকুতি জানাচ্ছে ডেভিড মরগ্যান। ডেভিড মরগ্যানেরই জন্য যদি ডেবরা তার দৃষ্টিশক্তি খুঁজে পায়—-নিজের খুশি হয়তো ধ্বংস করে ফেলবে সে।

    এক সকালে জাবুলানির শেষ মাথা পর্যন্ত গাড়ি চালিয়ে গেল ডেভিড। এরপর কাটা গাছ ভর্তি একটা জায়গায় পার্ক করল গাড়ি। ইঞ্জিনের সুইচ অফ করে ড্রাইভিং সিটে বসে আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল নিজের মুখমণ্ডল। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে পরীক্ষা করল নিজের চেহারা। মানুষ হিসেবে ভাবাই যায় না শুধু চোখ দুটো ছাড়া–এত কুৎসিত দেখতে ক্ষতবিক্ষত মুখটার প্রতি সে জানে কোন নারীই আকর্ষণ বোধ করবে না। কাছাকাছি আসতে চাইবে না, স্পর্শ করতে চাইবে না, ভালোবাসতে চাইবে না। আস্তে আস্তে গাড়ি চালিয়ে বাসায় ফিরে এল ডেভিড। উচছুসিত ভঙ্গিতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল ডেবরা। তার পরনে রং-চটা ডেনিম আর উজ্জ্বল গোলাপি ব্লাউজ। ডেভিডের কাছে এসে মুখ তুলে ধরল কিস্ করার জন্য।

    এই সন্ধ্যায় বারবিকিউ করার আয়োজন করল ডেবরা। গাছের নিচে আগুনের পাশ বসল দুজনে। শুনতে লাগল নিশাচর পাখিদের গান। রাতটা বেশ ঠাণ্ডা। কাঁধের উপড়ে হালকা ভাবে সোয়েটার ফেলে রেখেছে ডেবরা। নিজের ফ্লাইং জ্যাকেট ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে ডেভিড।

    বুকের কাছে রয়ে গেছে এখনো চিঠিটা। মনে হল মাংসের মাঝে গেঁথে যাবে। চামড়ায় জ্যাকেটের পকেট খুলে চিঠিটা হাতে নিল ডেভিড। পাশে বসে কলকল করে চলেছে আনন্দিত ডেবরা। হাত বাড়িয়ে রেখেছে আগুনের শিখার দিকে। হাতের মাঝে চিঠিটা আস্তে আস্তে ঘুরতে লাগল ডেভিড।

    হঠাৎ করে মনে হল জীবন্ত একটি বিছা বা এ জাতীয় কিছু, এমন ভাবে আগুনের মাঝে হাতের চিঠিটা ছুঁড়ে মারল ডেভিড। তাকিয়ে দেখতে লাগল আগুনে পুড়ে এটা ছাই হয়ে যাবার দৃশ্য।

    এত সহজে শেষ হয়ে যায়নি ব্যাপারটা। সে রাতে ঘুমাতে যাবার পর মাথার মধ্যে কেবল ঘুরতেই লাগল চিঠির কথাগুলো। এতটুকু স্বস্তি পেল না ডেভিড। চোখ ঢুলুঢুলু হয়ে এলেও ঘুমাতে পারল না।

    এরপর থেকে দিনের বেলা অধিকাংশ সময় চুপচাপ বসে থাকতে শুরু করল ডেভিড। বুঝতে পারল ডেবরা যে কিছু একটা হয়েছে, যদিও অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও কিছুই জানতে পারল না ভয় পেয়ে গেল সে। ভাবল ডেভিড তার সাথে রাগ করেছে। আরো বেশি করে করে ডেভিডকে ভালোবাসা দিয়ে চেষ্টা করল ব্যাপারটা ভুলিয়ে দিতে।

    কিন্তু ফল হল উল্টো। নিজের কাছে আরো বেশি করে অপরাধী হয়ে গেল ডেভিড।

    হতাশায় মুষড়ে উঠে এক সন্ধ্যায় যখন মুক্তোর ছড়ার কাছে একসাথে গেল দুজনে, ল্যান্ড রোভার ছেড়ে দিয়ে হাতে হাত ধরে পানির কিনারে গেল। পড়ে থাকা গাছের গুঁড়ি পেয়ে পাশাপাশি বসল চুপচাপ। এই প্রথমবারের মতো মনে হলো একে অপরকে বলার মতো কোন কথা নেই।

    গাছের পাতায় ডুবে গেল বিশাল লাল সূর্য। বনের ভিতর নেমে এলো সন্ধ্যা। হালকা পায়ে এগিয়ে এলো নায়লার দল। মনে হল ছায়ার মাঝে নড়াচড়া শুরু করল।

    ফিসফিস করে কথা বলা শুরু করল ডেভিড। কাছে এগিয়ে এসে মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগল ডেবরা।

    ‘আজ কেন যেন বেশ সচকিত হয়ে আছে নায়লার দল। মনে হচ্ছে বৃদ্ধ। পুরুষটার নার্ভাস ব্রেক ডাউন হয়েছে। এত মনোযোগ দিয়ে কিছু শুনছে যে স্বাভাবিকের চাইতে দ্বিগুণ লম্বা হয়ে গেছে কান। মনে হয় আশেপাশে নিশ্চয় চিতাবাঘের অস্তিত্ব টের পাচ্ছে কোথাও তারপরই থেমে গিয়ে আস্তে করে চিৎকার করে উঠল।

    ‘ওহ এই তো এসে গেছে!

    উত্তেজনায় নড়েচড়ে বসল ডেবরা। ডেভিডের হাত ধরে ঝাঁকুনি দিতে লাগল, কী হয়েছে ডেভিড?

    ‘একটা নতুন শাবক! গলার স্বরে ফুটে উঠল উত্তেজনা। একটা হরিণী শাবক প্রসব করেছে। ওহ্ গড ডেবরা! এখনো পা নাড়াতে পারছে না ঠিকমত’ শাবকের বর্ণনা দিতে শুরু করল ডেভিড। মা হরিণের সাথে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। পুরো মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগল ডেবরা। বোঝা গেল নিজের ভেতরের মাতৃত্বকে টের পেল। সম্ভবত ভাবতে লাগল নিজের মৃত সন্তানের কথা। ডেভিডের হাতে থাকা হাত শক্ত হয়ে গেল। সন্ধ্যার আলোতে দেখা গেল উজ্জ্বল দেখাচ্ছে মধুরঙা চোখ জোড়া। হঠাৎ কথা বলে উঠল সে। নিচু স্বরে কিন্তু পরিষ্কারভাবে ব্যথিত গলায় বলে উঠল, “আমার ইচ্ছে করছে দেখতে। ওহ গড! গড! আমাকে দেখার শক্তি দাও। প্লিজ আমি আবার দেখতে চাই। হঠাৎ করেই কাঁদতে লাগল ডেবরা। পুরো শরীর কাঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

    পুলের কাছে ভয়ে পেয়ে গেল নায়লার দল। দ্রুত পালিয়ে গেল গাছের আড়ালে। ডেবরাকে ধরে শক্ত করে বুকের কাছে চেপে ধরল ডেভিড। মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। চোখের পানিতে ভিজে গেল তার শার্ট আর বুকের অনেক গভীরে অনেক অনেক গভীরে ছড়িয়ে পড়ল হতাশার ঠাণ্ডা ভাব।

    সেই রাতেই গ্যাসবাতির আলোয় বসে আবারো চিঠি লিখতে বসল ডেভিড। রুমের ওপাশে বসে শীতকালে ডেভিডকে দেবার জন্য জার্সি সেলাই করতে বসল ডেবরা। ভাবল ডেভিড নিশ্চয়ই এস্টেটের অ্যাকাউন্টস নিয়ে ব্যস্ত 1 ডেভিড দেখল প্রথম চিঠিটার শব্দগুলো হুবহু মনে করতে পারল সে। তাই মাত্র কয়েক মিনিটের মাঝে চিঠি লিখে খাম বন্ধ করার কাজও শেষ হয়ে গেল।

    ‘কাল সকালে বইয়ের কাজ করবে তুমি? হালকাস্বরে জানাল যে সে করবে। আবারো বলে চলল ডেভিড, ‘আমি এক বা দুই ঘণ্টার জন্য নেলটে যাবো।’

    এত উঁচু দিয়ে উড়ে গেল ডেভিড যেন মাটিতে আর ফিরে আসতে চায় না।

    নিজেও বিশ্বাস করতে পারল না যে সে সত্যিই এটা করতে চলেছে। এতটা আত্মত্যাগ করতে পারে তা তার ধারণাতেও ছিল না। অবাক হয়ে ভাবল, কেউ কী কাউকে এতটা ভালোবাসতে পারে যে সেই মানুষটার ভালোর জন্য ভালোবাসাটুকুও ভুলে যেতে পারবে? দক্ষিণে উড়ে যেতে যেতে বুঝতে পারল যে সে পারবে এর মুখোমুখি হতে।

    আর সকলের মতো ডেবরারও অধিকার আছে পৃথিবী দেখার আর এই কারণে নিজের প্রতিভার পুরো ব্যবহার করতে পারছে না সে। যতক্ষণ পর্যন্ত না দেখবে কিছু একটা বর্ণনা করতে পারবে না সে। একজন লেখক হবার ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে সে, কিন্তু এর অর্ধেক ক্ষমতাই কেড়ে নেয়া হয়েছে তার কাছ থেকে। ডেবরার কান্না বুঝতে পারল ডেভিড। ওহ গড! গড! আমি দেখতে চাই। প্লিজ আমাকে দেখতে দাও। ডেভিড নিজেও একই আকুতি জানাল মনে মনে ঈশ্বরের কাছে। প্রার্থনা করল : “প্লিজ গড, তাকে আবার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দাও।

    এয়ারস্ট্রিপে নাভাজো নিয়ে ল্যান্ড করল ডেভিড। ট্রাক্সি নিয়ে সোজা চলল পোস্ট অফিসে। অপেক্ষা করে নিজের বক্স থেকে চিঠিও তুলে নিল।

    ‘এখন কোথায় যাবেন? জানতে চাইল ট্যাক্সি ড্রাইভার। আরেকটু হলে বলেই ফেলছিল এয়ারফিল্ডের কথা। তারপর মাথা নেড়ে বলে উঠল, আমাকে দোকানে নিয়ে চলুন। এক কেস ভেভ ক্লিকট শ্যাম্পেন কিনল ডেভিড।

    বাসায় ফেরার পথে বেশ হালকা লাগল নিজেকে। চাকা গড়িয়ে গেছে, বলে লাথি মারা শেষ। এখন আর কিছুই করার নেই তার। আর কোন দ্বিধা নেই। অপরাধবোধ নেই। ফলাফল যাই আসুক না কেন, মেনে নেবে সে।

    প্রায় তৎক্ষণাৎ বুঝে ফেলল ডেবরা যে কিছু একটা হয়েছে। স্বস্তির সাথে উচ্চস্বরে হেসে উঠল। গলা ধরে ঝুলে পড়ল ডেভিডের বুকে।

    কী হয়েছে জানতে চাইল সে।

    ‘সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে তুমি চুপচাপ ছিলে। চিন্তা করতে করতে আমি অসুস্থ হয়ে গেছি–আর মাত্র এক-দুই ঘন্টার জন্য বাইরে গিয়েই প্রাণশক্তি ফিলে পেলে তুমি। কী ঘটেছে মরগ্যান?

    ‘আমি মাত্রই বুঝতে পেরেছি যে আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি, ডেবরাকে জড়িয়ে ধরে জানাল ডেভিড।

    ‘অনেক?’ আবারো জানতে চাইল ডেবরা।

    ‘অনেক! অনেক!’ একমত হল ডেভিড।

    ‘এই তো আমার বাছা!’ হাততালি দিল ডেবরা।

    খোলা হল ভেভ ক্লিকট। নিজের সাথে নিয়ে আসা চিঠিতে ববি ডুগানের চিঠি পেল ডেভিড, ডেবরার পাঠানো নতুন উপন্যাসের প্রথম চ্যাপ্টার পড়েই দারুশ আশাবাদী হয়ে উঠেছে ববি আর প্রকাশক। অগ্রিম ডেবরাকে এক লক্ষ ইউ এস ডলারের চেকও পাঠিয়ে দিয়েছে।

    ‘তুমি তো ধনী হয়ে গেছ!’ হাসল ডেভিড।

    এর একমাত্র কারণ তুমি আমাকে বিয়ে করেছ। ভাগ্য শিকারি!’ উত্তেজনায় হাসতে লাগল ডেবরা। বুক ভরে গেল ডেভিডের।

    ‘ওরা এটা পছন্দ করেছে, ডেভিড।’ সিরিয়াস হয়ে উঠল ডেবরা। ওরা সত্যিই পছন্দ করেছে। আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। এত বড় অংকের চেক পেয়ে নিজেরে কাজের স্বীকৃতিও পেল ডেবরা।

    ‘এটা পছন্দ না করলে পাগল বলতে হতো তাদেরকে’, মন্তব্য করল ডেভিড।

    এর পরের সপ্তাহগুলো কাটতে লাগল প্রচণ্ড আনন্দে। তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল ডেভিডের-সন্দেহ। দিগন্তে ঝড়ের ছায়া দেখেও মনে হল সামনে বছর খরা হবে। এরপর আরো পাঁচ সপ্তাহ কেটে যাবার পর নেলপ্রটে যাবার প্রস্তুতি নিল সে। কেননা ডেবরা অস্থির হয়ে ছিল প্রকাশকের কাছ থেকে কোন নতুন খবর এসেছে কিনা জানার জন্য। এছাড়া টাইপিং করা শেষ হলে খসড়াও দেখার প্রয়োজন আছে।

    ‘আমি আমার চুল কাটতে চাই, আর যদিও আমি জানি যে এটা তেমন প্রয়োজন নেই। তারপরেও ডেভিড, মাই ডার্লিং আমাদের মানুষের সাথে মেশা দরকার–মাসে অন্তত একবার তাই না?

    ‘এতটা দেরি হয়ে গেছে? কিছুই জানে না এমন সরল ভঙ্গীতে জানাতে চাইল ডেভিড। যদিও প্রতিটি দিন পুরোপুরি উপভোগ করতে চাইছে সে। যেন ভবিষ্যতের জন্যে স্মৃতি সঞ্চিত হয়।

    বিউটি স্যালনে ডেবরাকে রেখে পোস্ট অফিসে গেল ডেভিড।

    চিঠিতে ভরে আছে বক্স। তাড়াতাড়ি করে বাছাই করল ডেভিড। তিনটি এসেছে ডেবরার আমেরিকান এজেন্টের কাছ থেকে আর দু’টিতে ইস্রায়েলীয় ষ্ট্যাম্প। এ দুটি একটার খামের উপর আবার ডা. এর প্রেশক্রিপশনের ছাপ দেয়া। অবাক হয়ে গেল ডেভিড যে ঠিকঠিক ডা. এর হাতে পৌঁছেছিল চিঠিটা। দ্বিতীয় খামের উপর হাতের লেখা দেখে ভুল হবার কোন কারণ নেই। প্রতিটি শব্দ ঠিকঠিক নিয়ম মেনে লেখা। আর এমন ভঙ্গিতে যে বোঝাই গেল গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত কোন ব্যক্তির হাতের লেখা।

    ডেভিড বেগুনি জাকারান্ডা গাছের নিচে বসল একটা বেঞ্চিতে, পোস্ট অফিসের পাশের পার্কে। প্রথমেই খুললো ডা, এর লেখা চিঠি। হিব্রুতে লেখা।

    ‘ডিয়ার ডেভিড,

    তোমার চিঠি পেয়ে খুব অবাক হয়েছি আমি। এরপর এক্স-রে প্লেটগুলো আরো একবার পরীক্ষা করে দেখেছি আমি। প্রথমবারের মতোই একই কথা আবার বলতে চাইবে আমি।’

    নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও কেন যে স্বস্তি পেল ডেভিড।

    যাই হোক যদি আমি গত পঁচিশ বছর এই পেশা থেকে কিছু শিখে থাকি, তা হল নম্রতা। আমি মেনে নিচ্ছি যে তোমার পর্যবেক্ষণ ঠিক হয়েছে। তাহলে আমাকে এও মানতে হবে যে চোখের অপটিক নার্ভের একটা অংশ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তার মানে নার্ভগুলো আগেই পুরোপুরি শুকিয়ে যায়নি। আর এখন সম্ভবত ডেবরা মাথায় যে আঘাত পেয়েছে–কিছু কাজ করা শুরু করেছে অংশগুলো।

    কঠিন প্রশ্ন হচ্ছে? কতটা, আর এ ব্যাপারে আমি সাবধান করতে চাই যে হয়তো বর্তমানে যা দেখছে ততটুকুই অর্থাৎ আলোর প্রতি সংবেদনশীল মানেই দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়া নয়। তাই এটুকু হয়তো বলা যায় যে চিকিৎসার মাধ্যমের আংশিক দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবার সম্ভবনা আছে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এ অংশ খুবই সামান্য। হয়তো আলো বা আকৃতির প্রতি সামান্য সাড়া পাওয়া যাবে। কিন্তু নাজুক এ অংশে যে কোন সার্জারির ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে হবে খুবই ভেবেচিন্তে।

    আমি নিজের হাতে ডেবরাকে পরীক্ষা করতে চাই। কিন্তু তোমার পক্ষে এতটা আসা হয়তো সম্ভব হবে না। তাই আমি কেপটাউনে আমার একজন সহকর্মীর কাছে চিঠি লিখে দিচ্ছি। তিনি নিজেও একজন পৃথিবীখ্যাত অপটিক্যাল ট্রমা বিশেষজ্ঞ। নাম ডা, রুবেন ফ্রাইডমান। আমি আমার একটা কাগজও পাঠিয়ে দিচ্ছি। ডেবরা’র এক্স-প্লেট আর চিকিৎসার পূর্ব ইতিহাসও পাঠিয়ে দিচ্ছি।

    আমি সুপারিশ করব যে, তুমি ডেবরাকে ডা. ফ্রাইডম্যানের কাছে নিয়ে যাও। তাহলে তার উপর তোমার নির্ভরযোগ্যতা বেড়ে যাবে। এক্ষেত্রে নিশ্চিত থাকতে পারো যে গ্রুট শূর হাসপাতাল পৃথিবী বিখ্যাত এবং যে কোন চিকিৎসা দেবার সম্পূর্ণ ব্যবস্থা আছে। তারা এমনকি হার্ট ট্রান্সপ্লাটও করে থাকে।

    আমি তোমার চিঠি নিয়ে জেনারেল মোরদেসাই এর সাথে কথা বলব–

    .

    সাবধানে চিঠি ভাঁজ কলে রাখল ডেভিড। ব্রিগ’কে এর ভেতরে টানার কী দরকার ছিল? মনে মনে ভাবল ডেভিড। এরপর খুললো ব্রিগের চিঠি।

    ডিয়ার ডেভিড,

    ডা. ইদেলমানের সাথে কথা হয়েছে আমার। আমি কেপটাউনে ফ্রাইডম্যানের সাথে কথা বলেছি। তিনি ডেবরাকে দেখতে রাজি হয়েছেন।

    কয়েক বছর ধরে দক্ষিণ আফ্রিকাতে এস.এ জিয়েনিস্ট কাউন্সিল আমাকে বক্তৃতা দেবার জন্যে ডাকছে। কিন্তু আমি যাচ্ছি না। কিন্তু আজকে তাদেরকেও চিঠি লিখে সব ব্যবস্থা করতে বলেছি। এর মাধ্যমে ডেবরাকে অজুহাত দেখিয়ে কেপ টাউনে নিয়ে আসা যাবে। তাকে বলল তোমার খামারবাড়িতে গিয়ে ওর সাথে দেখা করার মতো সময় হবে না আমার। কিন্তু তাকে দেখতে চাইছি আমি।

    আমি তোমাকে পরে আমার তারিখ জানিয়ে দেব। আশা করি তখন দেখা হবে।

    চিরাচরিত আদেশমূলক মনোভাব ব্রিগের মাঝে। পুরো ব্যাপারটা ডেভিডের হাতের বাইরে চলে গেছে এখন। ফিরে আসার আর কোন পথ খোলা নেই। কিন্তু সম্ভাবনা আছে যে হয়তো কোন কাজ হবে না। এই আশাই করতে চাইল সে নিজের এ স্বার্থপরতার মনোভাব দেখে হতচকিত হয়ে গেল সে। চিঠিটা উল্টে ওপর পৃষ্ঠায় ডেবরাকে পড়ে শোনানোর জন্য চিঠির খসড়া করল। খানিকটা মজা পেল এভাবে ব্রিগের ভঙ্গি নকল করতে গিয়ে।

    খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল ডেবরার মুখ। বাবার চিঠির কথা শুনে নিজের ভনিতার উপর খানিকটা আস্থা পেল ডেভিড।

    ‘বাবাকে দেখতে পাবো, অনেক মজা হবে। ইস, মাও যদি আসতো বাবার সাথে।

    ‘যদিও জানায়নি কিন্তু সন্দেহ হচ্ছে আমার। এরপর একে একে আমেরিকা থেকে আসা চিঠিগুলো পড়ল ডেভিড। তারিখ মিলিয়ে প্রথম দুটো বার্নিং ব্রাইটের উপর সম্পাদকীয়- কিন্তু তৃতীয়টি আরেকটা শক্ত খবর বয়ে আনল।

    ইউনাইটেড আর্টিস্ট, আ প্লেস অব আওয়ার ওন নিয়ে সিনেমা বানাতে চায়। সম্পত্তি ক্রয় করতে চায় বারো মাসের জন্য আর লাভের সামান্য একটা অংশ। যদি ডেবরা ক্যালিফোর্নিয়া গিয়ে স্কিনপ্লে লিখে দেয়, তাহলে চিত্রনাট্যসহ পুরো ব্যাপারটার জন্য ববি ডুগান নিশ্চিত কোয়ার্টার মিলিয়ন ডলারের প্যাকেজ তৈরি হয়ে যাবে। তাই জোরে দিয়ে জানাল যেন ডেবরা পুরো ব্যাপরটা ভেবে দেখে। কেননা অনেক সময় দেখা যায় প্রতিষ্ঠিত উপন্যাস রচয়িতাগণও চিত্রনাট্য লেখার সুযোগ পায় না। তাই হালকা ভাবে না নিয়ে এ প্রস্তাব গ্রহণ করার অনুরোধ জানালো ডেবরাকে।

    ‘মানুষদের কী দরকার?’ তাড়াতাড়ি হেসে ফেলল ডেবরা। তারপর খুব দ্রুত মুখ ঘুরিয়ে নিল–এত দ্রুত যে ডেভিড বুঝতে পারল তার আগ্রহের কথা। তোমার কাছে আর শ্যাম্পেন আছে মরগ্যান? আমার মনে হয় আমরা সেলিব্রেশনের আরো একটা বাহানা পেয়ে গেলাম, তাই না?

    ‘তুমি যেভাবে এগোচ্ছ, এই জিনিসের দোকান দিতে হবে আমাকে। উত্তর দিল ডেভিড। এরপর এগিয়ে গেল রেফ্রিজারেটরের দিকে। ওয়াইন ঢালার সাথে সাথে গ্লাস পূর্ণ হয়ে গেল ফেনায়। পড়ে যাবার আগেই নিয়ে গেল ডেবরার কাছে। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সে।

    চলো, ব্যাপারটা নিয়ে সিরিয়াসলি চিন্তা করা যাক। ধরে নাও যে তুমি হলিউডে যাচ্ছো।’ ডেবরার হাতে গ্লাস ধরিয়ে দিল ডেভিড।

    ‘ভাবার কী আছে? জানতে চাইল ডেবরা। আমরা এখানেই ঠিক আছি।’

    না, উত্তর দেবার আগে আরো একটু ভেবে দেখ।

    কী বলতে চাও তুমি? ওয়াইনে চুমুক না দিয়েই গ্লাস নামিয়ে রাখল ডেবরা।

    ‘আমরা অপেক্ষা করব, যতক্ষণ পর্যন্ত না–এর বদলে বলা যায়, ব্রিগ আগে আসুক কেপ টাউনে।

    ‘কেন?’ বিস্মিত হয়ে গেছে ডেবরা।

    কী? ঘটবে তখন?

    ‘কিছু না। এটা সত্যিই একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। সময়টাও গুরুত্বপূর্ণ। উত্তর দিল ডেভিড।

    “ঠিক আছে!’ রাজি হয়ে গেল ডেবরা। এরপর গ্লাস তুলে টোস্ট করল।

    ‘আই লাভ ইউ।’ জানাল ডেভিডকে।

    ‘আই লাভ ইউ।’ প্রতি উত্তরে বলে উঠল ডেভিড। খেতে খেতে খুশিই হল যে মেয়েটার হাতে কয়েকটা পথ খোলা থাকবে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য।

    আরো তিন সপ্তাহ সময় পেল ডেভিড। কেপটাউনে ব্রিগের আগমনের আগে নিজের গড়া ইডেনে ডেবরাকে নিয়ে সময় কাটানোর।

    দিনগুলো কাটতে লাগল অসম্ভব আনন্দে আর মনে হলো প্রকৃতিও নিজের সব সম্পদ সৌন্দর্য ঢেলে দিল তাদের জন্য। সুন্দরভাবে বৃষ্টি হলো, শুরু হতো সন্ধায়, শেষ হত সকাল বেলা। মেঘের ভেলায় ভেসে বিদ্যুৎ চমক আর বাতাসে ভরে থাকত সারাদিন। সূর্যাস্তের সময় মেঘের ফাঁক গলে দেখা যেত নানা রঙের খেলা। রাগী সূর্যমামা তখন হয়ে যেত ব্রোঞ্জ আর কুমারীর লজ্জারাঙা মুখের মতো। রাত নেমে এলে গুরু গুরু মেঘ ডাকত। জানালা দিয়ে ঘরে এসে পড়ত চৌকোনা সাদা আলো। পাশে ডেভিড থাকায় নিশ্চিন্তে ঘুমোত ডেবরা।

    সকালবেলা ঠাণ্ডা চারপাশে দেখা যেত উজ্জ্বল আলো। গাছগুলো বৃষ্টিতে ধুয়ে আরো সবুজ হয়ে উঠত যেন।

    বন্যপ্রাণীদের জীবনে প্রাণসঞ্চার করল এই বৃষ্টি। প্রতিদিনই তাই নতুন কিছু না কিছু দেখা যেত।

    মোবাহোবা গাছে তৈরি বাসা থেকে মা ঈগল নিয়ে গেল নিজের ছানাদের। এরপর ছেড়ে দিল পুলের উপরে পড়ে থাকা গাছের শাখার উপর। দিনের পর দিন বসে থেকে সাহসী হয়ে উঠল ছানা দু’টো। ঈগল দম্পত্তি শেখাতে লাগলা কীভাবে উড়তে হয়।

    এরপর এক সকালে ডেভিড আর ডেবরা যখন সকালের নাস্তা করছে, পাখিদের উল্লাসিত চিৎকারে ভরে গেল চারপাশ। তাড়াতাড়ি ডেবরার হাত ধরে সিঁড়ি দিয়ে খোলা জায়গায় নিয়ে গেল ডেভিড। চোখ তুলে তাকাতেই দেখতে পেল চারটা বড় বড় পাখা মেলে পাখি দুটো উড়ে বেড়াতে লাগল পরিষ্কার নীল আকাশে। উত্তরে দুই হাজার মাইল দূরে জাম্বোজি নদীতে না যাওয়া পর্যন্ত মাথার উপর কিছুক্ষণ চক্রাকারে উঠে উড়াউড়ি করল পাখির দল।

    কিন্তু শেষ দিনগুলোতে এমন একটা ঘটনা ঘটল যাতে দুজনেরই মন খারাপ হয়ে গেল। একদিন সকালবেলা উত্তর দিকে চার মাইল হেঁটে এল দু’জনে। বড় বড় লিডউড গাছ উঠে গেছে এ পথ ধরে।

    বিশাল মার্শাল ঈগলের একটা জোড়া একটা লিডউড গাছকে চিহ্নিত করেছে নিজেদের মিলিত স্থান হিসেবে। স্ত্রী পাখিটা বেশ সুন্দর আর তরুণী। কিন্তু পুরুষ পাখিটা তত সুন্দর নয়। অনেক উঁচু ডালের উপর নিজেদের বাসা বানাতে লাগল এ জোড়া। কিন্তু আরো একটা পুরুষ ঈগল এসে ভেস্তে দিল কাজ। বিশাল বড়সড় অন্য একটা পুরুষ পাখি। কিন্তু নিজের সীমানাতে রইল পাখিটা প্রথম দিকে। পাহাড়ের উপর নিজস্ব জায়গা তৈরি করে নিয়েছিল। যতদূর সম্ভব নিজের অংশেই থাকার চেষ্টা করত সে। নিচে ছিল সমতল ভূমি।

    ডেভিড একদিন ঠিক করল সমতল ভূমিতে যাবে। পাখির বাসার ছবি তোলার জন্য যুতসই একটা জায়গা খোঁজার জন্য। আর একই সাথে পুরুষ দু’জনের মাঝে আদিম এই বিরোধটুকুও দেখার ইচ্ছে আছে তার। ঠিক সেইদিনই ঘটল ঘটনাটা।

    পাহাড়ের উপর উঠে এলো ডেভিড আর ডেবরা। পাথরের উপর বসে নিচে তাকিয়ে রইল। নিচে পড়ে রইল যুদ্ধক্ষেত্র।

    পুরুষ পুরাতন পাখিটা তখন নিজের ঘরে। সাদা বুক আর মাথা নিচে নামানো। শক্তিশালী কাধ দেখা যাচ্ছে। চোখে বাইনোকুলার দিয়ে অপর পুরষ পাখিটাকে খুঁজলো ডেভিড। কিন্তু পেল না। বুকের কাছে বাইনোকুলার নামিয়ে রেখে ডেবরার সাথে খানিক গল্প করে কাটাল ডেভিড।

    এরপর হঠাৎ করে পুরোনো ঈগলের দিকে চোখ পড়ল তার। হঠাৎ করেই আকাশে উঠে এল এটি। বেশ তাড়াহুড়া করে সে উড়ে চলেছে বোঝাই গেল।

    প্রায় তাদের মাথায় উপর চলে এল পাখি। ডেভিড স্পষ্ট দেখতে পেল বাঁকানো ঠোঁট। আর রাজকীয় সাদা বুকে কালো রঙের ছিটে।

    হলুদ ঠোঁট ফাঁক করতেই কর্কশ স্বরে ডাক বের হয়ে এলো। তাড়াতাড়ি আকাশের চারপাশে চোখ বুলালো ডেভিড। অপেক্ষাকৃত কম বয়সী পাখিটাকে দেখা গেল। বেশ চতুরের মতো পরিকল্পনা করেছে সে। সূর্যের কাছে গিয়ে উঁচু ভবনের মতো দাঁড়িয়ে আছে পাখা ছড়িয়ে। বৃদ্ধ পাখিটার জন্যে সমবেদনা অনুভব করল ডেভিড।

    তাড়াতাড়ি উধ্বশ্বাসে ডেবরাকে পুরো ঘটনা জানাল ডেভিড। ডেরা নিজেও সহানুভূতি প্রকাশ করল বৃদ্ধ পুরুষ ঈগলের প্রতি।

    আমাকে বলো কী হচ্ছে? জিজ্ঞেস করল ডেবরা।

    শান্ত হয়ে অপেক্ষা করছে কম বয়সী পাখিটা। মাথা ঝুঁকিয়ে শত্রুর পদক্ষেপ দেখছে।

    ‘এই তো এসে গেছে! আড়ষ্ট হয়ে গেল ডেভিডের গলা। নেমে আসছে। কম বয়সী শিকারি পাখিটা।

    ‘আমি শুনতে পাচ্ছি ওকে।’ ফিসফিস করে উঠল ডেবরা, পাখার বাতাস কাটার হিসহিস শব্দ পরিষ্কার ভাবে শুনতে পেল তারা। কম বয়সী পাখিটা বৃদ্ধ পাখির গায়ের উপর ডাইভ দেয়ার সাথে সাথে মনে হল শুকনো ঘাসে আগুন লেগে যাবার শব্দ হল।

    বাম পাশে! গো! গো!

    ডেভিড এমন ভাবে বৃদ্ধ ঈগলের উদ্দেশে চিৎকার করে উঠল, যেন সে তার উইংম্যান। আর ডেবরার হাতে চাপ দিতে লাগল। মনে হল ওর কথা শুনতে পেল পাখিটা। পাখা খানিকটা ভাজ করে চলে এল সে পথ ছেড়ে। তার পাশ দিয়ে উড়ে গেল কম বয়সী পাখিটা।

    ধরো ওটাকে! চিৎকার করে উঠল ডেভিড ‘আবার মোড় নেবার সময় ওকে ধারো! এখনি!

    গাছের মাথার দিকে উড়ে গেল কম বয়সী পাখিটা। পাখা ঝাঁপটে চেষ্টা করল না পড়ে যেতে। তাড়াতাড়ি মোড় ঘুরে চেষ্টা করল শত্রুকে এড়াতে। এই ফাঁকে হঠাৎ করে এগিয়ে এলো বৃদ্ধ পাখিটা। আর আঘাত করল।

    পাহাড়ে বসে থাকা দর্শনার্থীরা পরিষ্কার ভাবে দেখতে পেল মুহূর্তটা। মনে হল বিস্ফোরণ ঘটেছে। এমন ভাবে উড়তে লাগল সাদা পাখার স্তূপ। পাখনা থেকে কালো পালক আর বুক থেকে সাদা।

    নখ দিয়ে আঁকড়ে ধরল বৃদ্ধ পাখিটা, কম বয়সী পাখিটাকে একে অন্যের পাখা নিয়ে যুদ্ধ করতে লাগল। বাতাসে ভাসতে লাগল পালক।

    এভাবেই পাখি দু’টি পড়ে গেল লিডউড গাছের মাথায়। এরপর অবশেষে মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়ল।

    ডেবরাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি কী ঘটেছে দেখতে গেল ডেভিড।

    ‘দেখতে পাচ্ছো?” উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চাইল ডেবরা। নিজের বাইনোকুলার ফোকাস করল ডেভিড।

    ‘দু’জনেই ফাঁদে পড়ে গেছে। ডেভিড জানলো ডেবরাকে। বৃদ্ধ পাখিটা নখ দিয়ে ওপরটার পিঠ খামচে ধরেছে। আর ছোটাতে পারেনি। একে অন্যের সাথে জড়াজড়ি করতে করতে গাছের নিচে নেমে এসেছে।

    পাহাড়ের মাঝে ভেসে বেড়াতে লাগল তীক্ষ্ণ চিৎকার। লিডউডের উপরে উদ্বিগ্ন ভাবে উড়ে বেড়াচ্ছে স্ত্রী পাখিটা। যুদ্ধের শব্দের সাথে যুক্ত হল তার কিচির-মিচির। কম বয়সী পাখিটা মারা যাচ্ছে। লেন্সের মাঝে দিয়ে পরীক্ষা করে বলল ডেভিড। দেখতে পেল হলুদ ঠোঁট বেয়ে সাদা বুকের উপর রুবি পাথরের মতো পড়ছে বিন্দু বিন্দু রক্তের ফোঁটা।

    ‘আর বৃদ্ধ পাখিটা—’ মুখ উপরে তুলে শব্দ শুনতে লাগল ডেবরা। চিন্তায় কালো ছায়া জমেছে চোখে। নখগুলো আলগা করতে পারছে না। আপনাতেই আটকে গেছে নখগুলো। সে ও মারা যাবে। তুমি কিছু করতে পারো না? ডেভিডের হাত ধরে ঝাঁকুনি দিল ডেবরা। ওকে সাহায্য করো।

    আস্তে আস্তে ডেবরাকে বোঝাতে চাইল ডেভিড যে পাখিগুলো একে অন্যের সাথে মাটি থেকে সত্তর ফিট ওপরে যুদ্ধ করছে। লিউডের মাথা বেশ মৃসণ আর প্রথম পঞ্চাশ ফিটের মাঝে কোন ডালপালা নেই। সারাদিন লেগে যাবে পাখিগুলোর কাছে পৌঁছাতে আর তাতেও লাভ হবে বলে মনে হয় না।

    আর যদি কেউ ওদের কাছে পৌঁছাতেও পারে ডার্লিং, এগুলো বেশ হিংস্র। এই তীক্ষ্ণ ঠোঁট দিয়ে চোখ তুলে নিবে বা হাড় থেকে মাংস। প্রকৃতি তার মাঝে অনাধিকার প্রবেশ পছন্দ করে না।

    ‘কিছুই করার নেই আমাদের? আকুতি জানালো ডেবরা।

    হ্যাঁ। আস্তে করে উত্তর দিল ডেভিড।

    ‘আমরা সকালবেলা ফিরে এসে দেখব এটা নিজেকে উদ্ধার করতে পেরেছে কিনা। নয়তো আমাদের সাথে আনা বন্দুক কাজে লাগাতে হবে।’

    সকালবেলা আবারো একসাথে লিডউডের কাছে এল দু’জনে। কমবয়সী পাখিটা মারা গেছে। কিন্তু বৃদ্ধ পাখিটা এখনো বেঁচে আছে। নখ এখনো অপর পাখিটার মৃতদেহে আটকে আছে। কিন্তু চোখ জ্বলছে হলুদ শিখার মতো। ডেভিডের কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে মাথা নেড়ে ঠোঁট ফাঁক করে চিৎকার করে উঠল।

    নিজের শটগান লোড করল ডেভিড। ব্যারেলে চোখ দিয়ে তাকাল বৃদ্ধ পাখিটার দিকে।

    তুমি একা নও, বন্ধু, চিন্তা করল সে। কাঁধে বন্দুক তুলে পরপর দুবার গুলি ছুড়ল। রক্ত ঝরে পড়তে লাগল ফোঁটায় ফোঁটায়। ওভাবে পাখিটাকে রেখে চলে এল তারা। ডেভিডের মনে হল এই বিস্ফোরণে তার নিজের একটা অংশ উড়ে গেল। আর এর ছায়া পড়ল পরবর্তী উজ্জ্বল দিনগুলোতে।

    কয়েকটা দিন খুব দ্রুত কেটে গেল। যখন একেবারে যাওয়ার সময় কাছে চলে এসেছে ডেবরাকে সাথে নিয়ে জাবুলানিতে ঘুরে বেড়াল ডেভিড। সব বিশেষ জায়গাগুলোতে ভ্রমণ করল। খুঁজে খুঁজে বের করল প্রতিটি দলকে বা বিভিন্ন বন্য জন্তুকে। মনে হল যেন বিদায় নিল বন্ধুদের কাছ থেকে। সন্ধ্যায় এলো পুলের পাশে। অদ্ভুত বেগুনি আর মেটে গোলাপি রং নিয়ে পৃথিবী থেকে সূর্যের বিদায় না হওয়া পর্যন্ত বসে রইল দু’জনে। এরপর মাথার উপরে গুনগুন শুরু করল মশার ঝাঁক। হাতে হাত রেখে অন্ধকারে ঘরে ফিরে এলো তারা।

    রাতের বেলা ব্যাগ গুছিয়ে সিঁড়ির কাছে রেখে দিল। যেন যাবার সময় তাড়াহুড়া না হয়। এরপর বারবিকিউর আগুনের পাশে বসে শ্যাম্পেন পান করল। ওয়াইনের প্রভাবে হালকা হয়ে গেল মূড। আফ্রিকার রাতের মাঝে নিজেদের ছোট্ট দ্বীপে বসে হাসতে লাগল দু’জনে। কিন্তু ডেভিডের কাছে মনে হল বিদায় ঘণ্টা বাজছে কোথাও।

    খুব সকাল বেলা ল্যান্ডিং স্ট্রিপ থেকে টেক অফ করল এয়ারক্রাফট। এস্টেটের উপর দিয়ে দু’বার ঘুরে এলো ডেভিড। এরপর আস্তে আস্তে উঠে গেল উপরে। সবুজের বিভিন্ন রঙের মিশেল নিয়ে ভরে উঠেছে বন। উত্তরের অঞ্চল থেকে একেবারে আলাদা। বাসার উঠানে দাঁড়িয়ে আছে ভৃত্যের দল। চোখে হাতচাপা দিয়ে হাত নাড়ল তাদের উদ্দেশে। মাটিতে দীর্ঘ ছায়া পড়ল মানুষগুলোর। কোর্স ঠিক করল ডেভিড।

    ‘কেপটাউন, আসছি আমরা’, বলে উঠল। সে হেসে তার উরুর উপর হাত রাখল ডেভিড।

    মাউন্ট নেলশন হোটেলে সুইট ভাড়া করা হল তাদের জন্য। প্রাচীন একটা অভিজাত্য আছে এ স্থানটার। সাথে আছে চওড়া বাগান আর আধুনিক কাঁচ ঘেরা জায়গা সি পয়েন্টের উপরে। দুই দিন স্যুইটে রইল তারা। অপেক্ষা করল ব্রিগের আগমনের জন্য। মানুষের ভীড়ে না আসাটাই অভ্যেস হয়ে গেছে ডেভিডের জন্য। তাই চোরাচাহনি আর দ্রুত মুখ ঘুরিয়ে বিড়বিড় করে বলা মন্তব্য হজম করতে কষ্টই হলো তার।

    দ্বিতীয় দিনে পৌঁছালো ব্রিগ। স্যুইটের দরজায় টোকা দিল। এরপর নিজের স্বভাবসুলভ গটগট ভঙ্গিতে ভেতরে ঢুকে এলো। আগের তুলনায় কৃশকায়, শক্ত আর বাদামী হয়ে গেছে ভদ্রলোক। যেমন স্মরণ করতে পারল ডেভিড। পিতা-কন্যা অলিঙ্গন করল পরস্পরকে। এরপর ব্রিগ তাকাল ডেভিডের দিকে। শুকনো চামড়ার মতো হাত দিয়ে করমর্দন করল–কিন্তু মনে হল নতুন এক ধরনের হিসেব কষা চাহনি দিয়ে পরিমাপ করল ডেভিডকে।

    ডেবরা গোসল সেরে সন্ধ্যার জন্যে তৈরি হয়ে নিল। ডেভিডকে নিজের স্যুইটে জেকে নিল ব্রিগ। কিছু না জিজ্ঞাসা করেই ড্রিংকস হিসেবে হুইস্কি নিল ডেভিডের জন্য। ডেভিডের হাতে গ্লাস দিয়েই নিজের ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলা শুরু করে দিল।

    রিসেপশনে থাকবে ফ্রাইডম্যান। আমি ডেবরার সাথে তার পরিচয় করিয়ে দেব। কিছুক্ষণ কথা বলার সুযোগ দেব। এরপর ডিনার টেবিলে ডেবরার পাশেই বসবে সে। এর ফলে পরবর্তীতে চেকআপে রাজি হবে ডেবরা।

    আমরা এর বেশি এগোনের আগে স্যার, বাধা দিয়ে উঠল ডেভিড, “আমি আপনার নিশ্চয়তা চাই যে কখনোই ডেবরাকে এ আশ্বাস দেয়া হবে না যে ও দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবে।’

    “ঠিক আছে।

    ‘আমি বলতে চাইছি কখনোই না। এমনকি ফ্রাইডম্যান যদি নিশ্চিত হয় ও যে সার্জারি দরকার, এর অন্য কোন কারণ থাকবে, দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়া নয়।’

    ‘আমার মনে হয় না এটা সম্ভব। রাগান্বিত স্বরে বলে উঠল ব্রিগ। যদি ঘটনাটা এতদূর এগোয় তাহলে ডেবরাকে জানাতেই হবে। এটা ঠিক হবে না।

    এবার রেগে ওঠার পালা ডেভিডের। যদিও তার সুখের বরফের মতো জমে থাকা মাংসপেশী এতটুকু পরিবর্তন হল না। ঠোঁটবিহীন মুখ ফ্যাকাশে হয়ে চোখে নীল আলো জ্বলে উঠল।

    ‘আমাকে ভাবতে দিন যে কোনটা ঠিক। আমি তাকে যতটা জানি ততটা আপনি জানেন না। আমি জানি ও কী ভাবে, কীভাবে চিন্তা করে। কী অনুভব করে। যদি আপনি তাকে দৃষ্টিশক্তির সুযোগ দেন তাহলে প্রথমে আমি যে উভয় সংকটে পড়ে গিয়েছিলাম ওর মাঝেও তা তৈরি হবে। আমি তা চাই না।’

    ‘আমি বুঝতে পারছি না। শক্ত ভাবে জানাল ব্রিগ। দু’জনের মাঝে বৈরিতা এমন হল যে মনে হল রুমের মাঝে ব্ৰজপাতসহ বৃষ্টি শুরু হবে।

    তাহলে শুনুন। চোখ বন্ধ করল ডেভিড। চায় না এই বৃদ্ধ সৈনিকের ভ্রুকুটি সহ্য করতে। আপনার মেয়ে আর আমি এক অসাধারণ আনন্দের খোঁজ পেয়েছি।

    মাথা নেড়ে স্বীকার করল ব্রিগ। হ্যাঁ, এ ব্যাপারে তোমার সাথে একমত আমি। কিন্তু এটা কৃত্রিম। এটা হচ্ছে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা। সত্যিকারের পৃথিবীর সাথে এর কোন যোগাযোগ নেই। এটা স্বপ্নিল ভুবন।’

    রাগের চোটে মনে হল বোধ-বুদ্ধি গুলিয়ে ফেলবে ডেভিড। সে চায় না। কেউ ডেবরা আর তার জীবন নিয়ে প্রভাবে কথা বলুক কিন্তু একই সাথে যুক্তি দিয়েও ব্যাপারটা বুঝল সে। আপনি এভাবে বলতেই পারেন স্যার। কিন্তু ডেবরা আর আমার জন্য সত্যি স্যার। এর অসম্ভব মূল্য আছে আমাদের কাছে।’

    চুপ করে রইল ব্রিগ।

    ‘আমি আপনাকে সত্যি বলছি অনেক আগেই আমি টের পেয়েও আমার নিজের কথা ভেবে

    ‘এখনো সভ্যভাবে কথা বলছে না তুমি। ডেবরার দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়া তোমাকে কীভাবে প্রভাবিত করবে?

    ‘তাকান আমার দিকে। নরম ভাবে বলে উঠল ডেভিড। হিংস্রভাবে তাকাল ব্রিগ। আশা করল অনেক কিছু। কিন্তু দেখল কিছুই ফুটে উঠল না ডেভিডের মুখে। এরপর চোখ ফিরিয়ে নিল সে। প্রথম বারের মতো সত্যিকার অর্থে দেখতে পেল ক্ষত-বিক্ষত বিভৎস মুখ। মানবিক কোন আকুতি নেই। হঠাৎ করেই বুঝতে পারল ডেভিডের কথা। অথচ প্রথম থেকে শুধুমাত্র মেয়ের কথাই ভেবে এসেছেন।

    চোখ নামিয়ে হুইস্কির গ্লাস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ব্রিগ।

    যদি আমি তার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিতে পারি, আমি তা করব। যদিও এটা আমার জন্য বেশ মূল্যবান হয়ে যাবে। ওকে এটা নিতে হবে।

    ডেভিড বুঝতে পারল তার গলা কাঁপছে। কিন্তু আমার বিশ্বাস আছে যে ও আমাকে এতটাই ভালোবাসে যে এটা ফিরিয়ে দেবে। যদি তাকে অপশন দেয়া হয়। কিন্তু এই সুযোগে আমি তাকে বিমর্ষ হতে দিতে চাই না।’

    গ্লাস তুলে গভীরভাবে চুমুক দিল ব্রিগ। লম্বা চুমুকে একেবারেই গলায় ঢাললো অনেকটুকু।

    ‘যেমন তোমার ইচ্ছে। অবশেষে রাজি হল ব্রিগ। হতে পারে হুইস্কির প্রভাব। কিন্তু এমন এক গলায় কথা বলে উঠল বিগ যা আগে কখনো শোনেনি ডেভিড।

    ধন্যবাদ, স্যার। নিজের গ্লাস নামিয়ে রাখল ডেভিড। এখনো একটুও ছোঁয়ানি। যদি আপনি কিছু না মনে করেন আমি বেশ বদল করে আসি।’ দরজার দিকে এগিয়ে গেল সে। ডেভিড!’ ডেকে উঠল ব্রিগ! ফিরে তাকাল সে।

    গোঁফের ফাঁকে ঝিক করে উঠল স্বর্ণের দাঁত। অদ্ভুত অস্বস্তি মেশানো হাসি হাসতে লাগল ব্রিগ।

    ‘তুমি পারবে। জানাল সে।

    .

    হিরেনগ্রাচ হোটেলের ব্যানকোয়েট রুমে হল রিসেপশন। এলিভেটরে একসাথে চড়ে বসল ডেভিড আর ডেবরা। অনুভব করল কিছু একটা নিয়ে চিন্তিত ডেভিড। ওর হাতে চাপ দিল ডেবরা।

    ‘আজ রাতে আমার কাছাকাছি থেক। ফিসফিস করে জানাল সে। আমার তোমাকে দরকার। ডেভিড বুঝতে পারল ওর মনোসংযোগ অন্য দিকে হটাতে এ কথা বলল ডেবরা। মেয়েটার প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করল সে। ঝুঁকে পড়ে নিজের গাল দিয়ে ডেবরার গালে স্পর্শ করল সে।

    ডেবরার এলোমেলো চুল নরম আর ঘন, চকচক হয়ে আছে–সূর্যের আলো পড়ে সোনালি দেখাচ্ছে মুখমণ্ডল। সবুজ রঙের সাধারণ একটা পোশাক পরেছে। মেঝে ছুঁয়েছে পাড়। হাত আর কাধ খোলা। শক্তিশালী কিছু মসৃণ। বিশেষ একধরনের চিক্কন ভাব সবসময় দেখা যায় মেয়েটার গাত্রবর্ণে।

    খুবই কম মেকআপ করেছে ও, ঠোঁটে শুধুমাত্র একটুখানি ছোঁয়া। চোখের শান্ত আর স্নিগ্ধ ভাবটাই আলো ছড়িয়েছে সাদা দেহে। আর এই সাহস সঞ্চারিত হল ডেভিডের মাঝেও। রুম ভর্তি মানুষের মাঝে পা দিল তারা।

    বেশ ভালোই লোক সমাগম হয়েছে চারপাশে। দামী-দামী সিল্ক আর গহনা পরে এসেছে নারীরা, গাঢ় রঙের স্যুট পরে পুরুষেরা, শরীরে এমন একটা ভারী ভাব যে ঘোষণা করছে তাদের অর্থ-বিত্তের পরিমাণ। সবার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে ব্রিগ। সিভিলিয়ান স্যুট পরা থাকলেও মনে হচ্ছে সুন্দর সব পাখির ভীড়ে একটা চিল।

    রুবেন ফ্রাইডম্যানকে সাথে করে নিয়ে এসে ডেভিড আর ডেবরার সাথে স্বাভাবিক ভঙ্গীতে পরিচয় করিয়ে দিল ব্রিগ। ছোটখাটো হলেও ভারী শরীর ডা, ফ্রাইডম্যানের। শরীরের তুলনায় মাথাটা আরো বড়। চুল ছোট করে কাটা, লেপ্টে আছে গোলকার খুলিতে। কিন্তু এক নজরেই লোকটাকে ভাল লেগে গেল ডেভিডের। ডাক্তারের চোখ দুটো পাখির মতো শ্যেন আর হাসি দেখে বোঝা গেল যে কোন কিছুর জন্য সদা প্রস্তুত সে। বাড়ানো হাতে উষ্ণতা আছে, কিন্তু শক্ত আর দৃঢ়, ডেবরাও বোঝা গেল পছন্দ করেছে তাকে। কেননা কণ্ঠের দৃঢ়তা আর ব্যক্তিত্বের উষ্ণতা অনুভব করে হাসল।

    ডিনারে যাবার পথে ডেভিডের কাছে জানতে চাইল ডেবরা যে ডা. দেখতে কেমন। হেসে ফেলল যখন বর্ণনা দিল ডেভিড।

    ‘ঠিক একটা কোলা ভালুকের মতো। মাছের পদগুলো আসার আগপর্যন্ত হাসিমুখে কথা বলতে লাগল দু’জনে। ফ্রাইডম্যানের স্ত্রী কৃশকায় মহিলার চোখে চশমা। সুন্দরীও না আবার একেবারে সাদামাটা নয়। কিন্তু স্বামীর মতোই বন্ধুত্বপূর্ণ ভাবে আগে বেড়ে ডেভিডকে আর ডেবরাকে বলল আগামীকাল আমাদের বাসায় লাঞ্চে এসো। অবশ্য যদি এক দঙ্গল দুষ্ট ছেলেমেয়েকে সহ্য করতে পারো।

    ‘আমরা আসলে উত্তর দিল ডেবরা। কিন্তু হঠাৎ করে ডেভিডের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল।

    ‘আমরা কী যাবো?’ ডেভিড একমত হতেই পুরোনো বন্ধুর মতো হাসতে লাগল দু’জনে। চুপচাপ ডেভিড ভাবতে লাগল চারপাশের তুলনায় কেমন একা বোধ করছে সে। জানে যে এসবই ভনিতা। হঠাৎ করে আরো খারাপ লাগল চারপাশে মানুষের চিৎকার আর বাসন-কোসনের শব্দ। ইচ্ছে হল নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে রাতের নিস্তব্ধতা অনুভব করতে।

    এরপর অনুষ্ঠানের সঞ্চালক উঠে গিয়ে স্পিকারে নাম ঘোষণা করল। স্বস্তি পেল ডেভিড।

    সূচনা বক্তব্য হল সাধারণ আর পেশাদার কথাবার্তায় পূর্ণ। একটা কৌতুক শুনে আবার হাসির রোল উঠল চারপাশে। কিন্তু এখানে সারবস্তু কিছু ছিল না। পাঁচ মিনিট পরে আর কিছুই মনে থাকবে না যে কী বলা হয়েছিল।

    এরপর উঠে এলো ব্রিগ। চারপাশে তাকিয়ে ডেভিড বুঝতে পারল সে ব্রিগের দৃষ্টি দেখে শান্ত হয়ে এলো ধনীদের দল। সবাই আসলে উপভোগ করতে শুরু করল। অদ্ভুত এক ধরনের আনন্দ পেল সকলে। কেননা তাদের বিশ্বাস আর অস্তিত্বের ভিত্তি নিয়ে কথা বলা শুরু করল ব্রিগ। যা একধরনের গভীর আত্মবিশ্বাস সঞ্চারিত করল সকলের সামনে। তাদের একজন হয়েও ভিন্ন, ব্রিগ। মনে হল যেন পুরো জাতির অহমিকা আর শক্তি ধারণ করছে ব্রিগ নিজের মাঝে।

    এমনকি বৃদ্ধ সৈনিকের মুখ নিঃসৃত বাণী শুনে ডেভিড নিজেও বেশ অবাক হয়ে গেল। পুরো কক্ষ জুড়ে অনুভূত হলো তার উপস্থিতি। মনে হল কখনো পরাজিত হবে না সে, মৃত্যু হবে না তার। নিজের অনুভূতি চাঙ্গা হয়ে উঠছে বুঝতে পারল ডেভিড, তার নিজের হৃৎপিণ্ডের গতি বেড়ে গেল। মনে হল কোন এক বন্যায় ভেসে চলেছে সে।

    কিন্তু সবকিছুর জন্যই মূল্য দিতে হবে। এক ধরনের মূল্য হল সব সময় সজাগ থাকা, প্রস্তুত থাকা, আমাদের সবাইকে সদা প্রস্তুত থাকতে হবে যা আমাদের তাকে রক্ষা করার জন্য। আর আমাদের সবাইকে প্রস্তুত থাকতে হবে যা প্রয়োজন সে আত্মত্যাগ করার জন্য। এটা হতে পারে জীবন, হতে পারে আমার প্রিয় কিছু।

    হঠাৎ করেই ডেভিড বুঝতে পারল যে ব্রিগ আসলে তাকে লক্ষ্য করেই বলেছে কথাগুলো। একে অন্যের দিকে তাকাল দু’জনে। ব্রিগ চাইছে তাকে সাহসী করে তুলতে, উৎসাহ দিতে–কিন্তু উপস্থিত অন্যরা নিশ্চয়ই এর ভিন্ন অর্থ করবে।

    সবাই তাকিয়ে দেখল ডেভিড আর ব্রিগের চাহনি। তাদের অনেকেই জানে যে ডেবরার অন্ধত্ব আর ডেভিডের কুৎসিত মুখমণ্ডল যুদ্ধের ফসল। আত্মত্যাগ বলতে ব্রিগ কী বুঝিয়েছে তা বুঝতে পারল না কেউ, একজন তো আবার হাততালিই দিতে শুরু করল।

    তৎক্ষণাৎ অন্যরাও শুরু করল। প্রথমে আস্তে তারপর হঠাৎ করে সবাই ভীষণ গর্জনের মতো করে উঠল। হাততালি দিতে দিতে ডেভিড আর ডেবরার দিকে তাকাল সকলে। মাথা ঘুরিয়ে অন্যরাও তাকাতে লাগল। চেয়ার সরিয়ে নারী-পুরুষ আসতে লাগল তাদের দিকে। হাসিমুখে হাততালি দিচ্ছে সকলে। সবাই উঠে দাঁড়াল।

    পুরো ব্যাপরটা কী ঘটছে বুঝতেই পারল না ডেবরা। হঠাৎ করে ওর হাত ধরে টানতে লাগল ডেভিড। বলে উঠল, “চলো এখান থেকে, তাড়াতাড়ি। সবাই দেখছে। সবাই আমাদেরকেই দেখছে’।

    ডেভিডের হাত কাঁপছে অনুভব করল ডেবরা, এহেন আচরণে কৌতূহলী হয়ে উঠল অন্যরা।

    ‘চলো, চলে যাই।’ ভেতরে ভেতরে কেঁদে উঠল ডেবরা, ডেভিডের জন্য। অনুসরণ করল ডেভিডকে। বুঝতে পারল ডেভিডের ক্ষত-বিক্ষত মুখের উপর সেঁটে আছে চোখগুলো। কিছুই করার নেই ডেভিডের।

    এমনকি নিজের স্যুইটে ফেরার পরেও জ্বরতপ্ত রোগীর মতো কাঁপতে লাগল ডেভিড।

    ‘বাঞ্চোত কোথাকার। ফিসফিস করে উঠল ডেভিড। গ্লাসে ঢেলে নিল হুইস্কি। ক্রিস্টাল গ্লাসের কিনারায় লেগে ঠাশ ঠাশ শব্দ করতে লাগল বোতল।

    ‘শয়তান বাঞ্চোত, কেন এরকম করেছে আমাদের সাথে?

    ‘ডেভিড’, এগিয়ে এসে ডেভিডের হাত ধরল ডেবরা। সে আঘাত করার জন্য এটা বলেনি। আমি জানি যে ভালোটাই বোঝাতে চেয়েছে। আমার মনে হয় সে বোঝাতে চেয়েছে যে সে তোমাকে নিয়ে গর্বিত।

    ডেভিডের মনে হল উড়ে চলে যেতে জাবুলানিতে নিজের গৃহে। বহু কষ্টে নিজেকে থামিয়ে গেল। কেননা ইচ্ছে হল ডেবরাকে বলতে ‘চলো আমরা চলে যাই। সে জানে শোনার সাথে সাথে তাই করবে ডেবরা। নিজের সাথে যুদ্ধ শুরু করল ডেভিড। যেন কোন শত্রুর মুখোমুখি হয়েছে সে।

    হুইস্কির স্বাদ মনে হল ধোয়াটে। পালিয়ে যেতে একটুও সাহায্য করল না। তাই প্রাইভেট বারের উপর ঠক করে রেখে দিল গ্লাস। এরপর ফিরে তাকাল ডেবরার দিকে।

    ‘হ্যাঁ। ডেভিডের মুখের কাছে এসে ফিসফিস করল ডেবরা। হ্যাঁ, মাই ডার্লিং, এটাই সত্যি।’ বোঝা গেল নারী হিসেবে তার স্বার্থকতা অনুভব করল সে। ডেভিডকে শান্ত করতে পেরে তৃপ্তি পেল। যেমনটা সে সবসময় করে থাকে। ঝড়ের সময় উড়ে যায় ডেভিডকে নিয়ে। নিজের বন্যভালোবাসা দিয়ে ভুলিয়ে দেয় সবকিছু। অবশেষে শান্তির নীড়ে ফিরে আসে দুজনে।

    ডেবরাকে ঘুমন্ত রেখে বিছানায় জেগে উঠে বসল ডেভিড। ফ্রেঞ্জ উইন্ডো দিয়ে ঘরে এসে পড়েছে রুপালি চাঁদ। মেয়েটার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে রইল ডেভিড। কিন্তু এর পরেও মন ভরলো না তার। আস্তে করে বিছানার পাশের আলো জ্বালালো।

    ঘুমের মাঝেও নড়ে উঠল ডেবরা। হালকা শব্দ করে উঠল। চোখের উপর থেকে চুল সরিয়ে দিল ঘুম জড়ানো হাতে। নিজের ক্ষতির পরিমাণ অনুভব করল ডেভিড। সে জানে আলো জ্বালাতে গিয়ে একটুও শব্দ করেনি সে বা বিছানা থেকে নড়েওনি। তার মানে কোন সন্দেহই নেই যে আলো নিজেই মেয়েটাকে বিরক্ত করেছে—আর এবার এমনকি ভালোবাসাতেও মন বসল না তার।

    .

    রুবেন ফ্রাইডম্যানের আবাসও তার মতোই বিখ্যাত। সমুদ্রের কাছেই তৈরি বাড়ির লন নেমে গেছে বীচের দিকে। সুইমিং পুলের চারপাশে বড়সড় সবুজ মিল্কহুত গাছ। আরো আছে প্রশস্ত কাবানা ও বারবিকিউ জায়গা। ম্যারিয়ন ফ্রাইডম্যানের ছেলেমেয়ের দল ঘরে নেই। কেবল ছোট দু’জন আছে। কয়েক মিনিট ভয়ার্ত চোখ নিয়ে তাকিয়ে রইল ডেভিডের দিকে। কিন্তু সাথে সাথে মায়ের বকুনি খেয়ে উড়ে গেল সুইমিং পুলের কাছে। ব্যস্ত হয়ে গেল নিজেদের খেলায়।

    আরো একটা বক্তৃতার অনুষ্ঠানে গেছে ব্রিগ। তাই তারা চারজন বস্তুত একা। খানিকক্ষণ পরেই সহজ হয়ে গেল চারপাশ। রুবেন একজন ডাক্তার। কোন না কোন ভাবে এ বোধ হালকা হতে সাহায্য করল ডেভিড আর ডেবরাকে। নিজের এ মন্তব্য প্রকাশ করল ডেবরা। যখন তাদের আঘাত নিয়ে কথা বলা শুরু করল রুবেন। স্বরে জানতে চাইল।

    ‘এটা নিয়ে কথা বলতে খারাপ লাগবে তোমার?

    না। আপনার সাথে না। একজন ডাক্তারের সামনে নিজেকে মেলে ধরা সহজ।’

    ‘এরকম করো না মাই ডিয়ার। ম্যারিয়ন সাবধান করে দিল। রুবির দিকে না–তাকাও আমার দিকে, ছয়জন ছেলেমেয়ে ইতিমধ্যে।’ হেসে ফেলল সবাই।

    আজ সকলেই বাইরে গিয়ে স্বচ্ছ পানি থেকে নিয়ে এসেছে অর্ধডজন ক্রে ফিশ। পাথরের খাঁজে থাকা এ অংশকে নিজের ব্যক্তিগত ফিশিং গ্রাউন্ড বলতে ভালবাসে রুবেন।

    তারপর কেল্কা পাতা দিয়ে মুড়ে কয়লার উপর স্ট্রিম করা হয়েছে যতক্ষণ পর্যন্ত না বেগুনি রঙের হয়ে উঠেছে মাছগুলো। মাংস হয়ে উঠেছে সাদা আর তুলোর মতো নরম, সুস্বাদু।

    ‘এখন, এটা যদিও না হয় তোমার দেখা সবচেয়ে মজার চিকেন রেসিপি শেলফিশ হাতে নিল রুবেন। খেয়ে সকলেরই মনে হবে যে এর দুই-পা আর পালক আছে।

    ডেভিড স্বীকার করতে বাধ্য হল যে এতটা মজার ডিশ কখনো খায়নি সে আগে। এরপর ড্রাই কেপ রিজলিং দিয়ে খেতে খেতে আরেকটার জন্য হাত বাড়ালো সে। ডেবরা আর সে দুজনেই আনন্দ পেল ব্যাপারটাতে। এরপর নিজের আসল উদ্দেশ্য ব্যক্ত করল রুবেন।

    ডেবরার দিকে ঝুঁকে ওয়াইন গ্লাস পূর্ণ করে দিল। এরপর জানতে চাইল।

    কতদিন আগে তোমার চোখ শেষ চেকআপ করেছে, ডিয়ার?’ আস্তে হাত রাখল ডেবরার চিবুকে। এরপর তাকাল মেয়েটার চোখের দিকে। নড়ে উঠল ডেভিড। তাড়াতাড়ি চেয়ার ঘুরিয়ে মনোযোগ দিয়ে তাকাল ডেবরার দিকে।

    ইস্রায়েল ছাড়ার পরে আর নয়। যদিও হাসপাতালে থাকাকালীন কয়েকবার এক্স-রে করা হয়েছে।

    ‘কোন মাথা ব্যথা? জানতে চাইল রুবেন। মাথা নাড়ল ডেবারা, চিবুক থেকে হাত নামিয়ে নিল রুবেন।

    ‘আমার মনে হয় তোমার চোখজোড়া আমার সব কাজ নষ্ট করে দেবে। যাই হোক মাঝে মাঝেই পরীক্ষা করা উচিৎ। দুই বছর অনেক বড় সময়। এছাড়া তোমার মাথা ভর্তি হয়ে গেছে বিদেশী জিনিসে।

    ‘আমি এর সম্পর্কে কখনো ভাবিনি। আস্তে করে নিজের কপালের ক্ষতের দাগে হাত বোলালো ডেবরা। নিজের উপর অস্বস্তি হলো ডেভিডের। কেননা এ ষড়যন্ত্রে তারও অংশ আছে।

    ‘এতে কোন ক্ষতি হবে না ডার্লিং। এখানে যখন এসেই পড়েছি, রুবি একবার পরীক্ষা করে দেখুক না হয়। ঈশ্বর জানে পরে আবার কখন সুযোগ পাবো।

    ‘ওহ ডেভিড, উড়িয়ে দিতে চাইল ডেবরা ব্যাপারটাকে। আমি জানি তুমি ঘরে ফেরার জন্য পাগল হয়ে আছ। আমিও।

    ‘আরেকটা দিন বা দুই দিন এমন কোন সমস্য হবে না। এখন আমরা যেহেত চিন্তা করছি। পরে আরো বেড়ে যাবে চিন্তা।

    রুবির দিকে তাকাল ডেবরা। কতক্ষণ লাগবে?

    ‘একদিন। সকালে একটা পরীক্ষা করব। তারপর সন্ধ্যায় কয়েকটা এক্স-রে।

    কত তাড়াতাড়ি দেখতে পারবেন তাকে?’ জানতে চাইল ডেভিড। এমন ভাবে বলল যেন কিছু জানে না সে। অথচ ঠিকই জানে যে পাঁচ সপ্তাহ আগেই ঠিক করা হয়েছে অ্যাপয়েন্টমেন্ট।

    “ওহ, আমি ভাবছি কালই। যদিও একটু তাড়াহুড়া হয়ে যায়, কিন্তু তোমাদের কথা ভিন্ন।

    হাত বাড়িয়ে ডেবরার হাত ধরল ডেভিড। ঠিক আছে ডার্লিং?

    “ঠিক আছে। একমত হল ডেবরা।

    .

    1 2 3 4 5 6 7 8
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleদ্য টাইগার’স প্রে – উইলবার স্মিথ / টম হারপার
    Next Article পাওয়ার অফ দ্য সোর্ড – উইলবার স্মিথ

    Related Articles

    উইলবার স্মিথ

    ডেজার্ট গড – উইলবার স্মিথ

    July 12, 2025
    উইলবার স্মিথ

    ফারাও – উইলবার স্মিথ

    July 12, 2025
    উইলবার স্মিথ

    রিভার গড – উইলবার স্মিথ

    July 12, 2025
    উইলবার স্মিথ

    দ্য সেভেনথ স্ক্রৌল – উইলবার স্মিথ

    July 12, 2025
    উইলবার স্মিথ

    ওয়ারলক – উইলবার স্মিথ

    July 12, 2025
    উইলবার স্মিথ

    দ্য কোয়েস্ট – উইলবার স্মিথ

    July 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.