Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ এক পাতা গল্প133 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ০৪. বেকার মানুষদের সবচে অস্বস্তিকর দিন

    বেকার মানুষদের জন্যে সপ্তাহের সবচে অস্বস্তিকর দিন হলো ছুটির দিন। যারা কাজেকর্মে থাকে এই দিনে তাদের মধ্যে ঢিলে ভাব চলে আসে যেন পায়জামার গিঁঠ বেশ খানিকটা আলগা করে দেয়া হলো। পা নাচানোর অভ্যাস যাদের নেই তাদেরকেও দেখা যায় খবরের কাগজ মুখের সামনে ধরে পা নাচাচ্ছে। বেকাররা পড়ে যায় অস্বস্তিতে। ছুটির দিনগুলির সঙ্গে নিজেদের মিলাতে পারে না। তাদের মধ্যে বোকা বোকা ভাব চলে আসে।

    মুহিবকে এখন বেকার বলার কোনো কারণ নেই। চাকরিতে জয়েন সে করে নি, কিন্তু এক তারিখেই করবে। ছুটির দিনে তার অস্বস্তি বোধ করার কোনো কারণ নেই। সে অবশ্যই একটা খবরের কাগজ কিনে এনে পা দোলাতে দোলাতে পড়তে পারে। খবরের কাগজ কিনতে হবে কারণ এ বাড়িতে যে দুটা কাগজ রাখা হয় তার কোনোটাই দুপুরের আগে রিলিজ হয় না। একটা ইংরেজি কাগজ তৌফিকুর রহমান সাহেব রাখেন। এই কাগজটা তিনি পড়েন দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর বিছানায় শুয়ে শুয়ে। দুপুরের খবরের কাগজ না পড়লে তার ঘুম হয় না। যে-সব বিশেষ বিশেষ দিনে কাগজ বের হয় না সে-সব দিনগুলিতে তাঁর খুবই সমস্যা হয়। সন্ধ্যা পর্যন্ত বিছানায় গড়াগড়ি করেন। ঘুম আসে না। দ্বিতীয় কাগজটা বাড়ির সবার জন্যে। এই কাগজ হাতে পাওয়া খুব সমস্যা। কাগজটা কে আগে পড়বে এই নিয়ে ঠাণ্ডা স্নায়ুযুদ্ধও হয়। মনোয়ারা বাড়ির কত্রী হিসেবে কাগজটা প্রথম পড়বেন এরকম আশা করেন। তিনি কাগজ কখনোই আগে হাতে পান না।

    মুহিব ঠিক করে রেখেছে যেদিন চাকরিতে জয়েন করবে সেদিন থেকে হকারকে বলে দেবে চারটা বাংলা কাগজ দিয়ে যেতে। নাশতার টেবিলে চারটা কাগজ পড়ে থাকবে, যার যেটা ইচ্ছা উঠিয়ে নাও। তখন যদি কেউ প্রশ্ন করে, ব্যাপার কী? তখন না হয় বলা যাবে। মুহিব এখনো কাউকে কিছু বলতে পারছে না কারণ সে নিজেও চাকরির ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারছে না। তার মনে প্রবল সন্দেহ— এক তারিখে সে যখন জয়েন করতে যাবে তখন তাকে বলা হবে, সামান্য ভুল হয়েছে। পরে যোগাযোগ করুন।

    এমন উদাহরণ আছে। সফিকের বেলায় এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। নান্দাইল গার্লস কলেজে ইতিহাসের লেকচারার পোস্টে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পেয়ে সে বিছানা বালিশ নিয়ে জয়েন করতে গেল। কলেজের প্রিন্সিপ্যাল সাহেব তাকে চা-টা খাইয়ে আদর-আপ্যায়ন করে বললেন— ক্ষুদ্র একটা সমস্যা হয়েছে। মন্ত্রীর সুপারিশে এডহক ভিত্তিতে একজনকে নিয়ে নেয়া হয়েছে। আপনি বরং গভর্নিং কমিটির সেক্রেটারি সাহেবের সঙ্গে কথা বলেন।

    সফিক বলল, উনার সঙ্গে কথা বলে কী হবে?

    প্রিন্সিপ্যাল সাহেব বললেন, কিছুই হবে না। মনের শান্তি।

    মনের শান্তি দিয়ে আমি করব কী? প্রি

    ন্সিপ্যাল সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, সেটাও একটা কথা।

    চাকরি নিয়ে মুহিবের ভালোরকম দুশ্চিন্তা আছে বলেই সে প্রতিরাতেই চাকরি নিয়ে দুঃস্বপ্নের মতো দেখছে। গত রাতের দুঃস্বপ্ন হলো— সে জয়েন করতে গিয়েছে। ম্যানেজার সাহেব একটা কাগজ বের করে বললেন, এখানে সই করুন। মুহিব বলল, আপনার কলমটা একটু দিন। ম্যানেজার সাহেব চোখ সরু করে বললেন, কলম ছাড়া চাকরি করতে এসেছেন! এরকম ঘটনা আমার জীবনে ঘটে নি। আপনি শুধু যে কলম ছাড়া চাকরি করতে এসেছেন তা না, লুঙ্গি পরে চলে এসেছেন। খালি পায়ে এসেছেন, না-কি পায়ে স্যান্ডেল আছে?

    মুহিব তাকিয়ে দেখল সত্যি সত্যি তার পরনে লুঙ্গি। পা খালি। এক পা কাদায় মাখামাখি।

    টেনশনে সে ঘেমে গেল। তার বুক ধড়ফড় করতে লাগল। বুক ধড়ফড়ানি নিয়েই তার ঘুম ভাঙল। যতই দিন যাচ্ছে ততই মুহিব নিশ্চিত হচ্ছে চাকরি হবে না।

    দরজায় টুকটুক শব্দ হচ্ছে। মুহিব সাড়া দিল না। সকালবেলাতেই টুকটুকানি ভালো লাগে না।

    মুহিব, দরজা খোল।

    মায়ের গলা। মুহিব বিছানা থেকে নামল। ছুটির দিনের সকালবেলায় মাতৃমুখ দর্শন তার জন্যে কোনো সুখকর ব্যাপার না। তাকে কোথাও যেতে হবে। সম্ভাবনা শতকরা ৯০ ভাগ যে মনোয়ারা তাকে তার বড় মেয়ের কাছে গোপন চিঠি দিয়ে পাঠাবেন।

    মনোয়ারা তার বড় মেয়ের সঙ্গে গোপন চিঠি চালাচালি করেন। মুহিব পোস্টম্যান। আজও মনে হয় রানারের ভূমিকা পালন করতে হবে।

    মুহিব দরজা খুলল। মনোয়ারা চায়ের কাপ হাতে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। এটা একটা বিস্ময়কর ঘটনা।

    নে চা খা।

    হঠাৎ চা! ব্যাপার কী মা?

    বড় বৌমা তোফাজ্জলের জন্যে চা বানিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। আমি বললাম, মুহিবের জন্যেও এক কাপ বানাও।

    শুধু চা দিতে এসেছ? না-কি আরো কিছু বলবে। বড় আপার কাছে যেতে হবে?

    মনোয়ারা ছেলের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, তুই কি ঘটনা কিছু শুনেছিস?

    কী ঘটনা?

    গতকাল রাতে তুই বাসায় ছিলি না?

    না।

    কোথায় ছিলি?

    আমার এক বন্ধুর মামার বাসায় ছিলাম।

    এই জন্যেই তুই কিছু জানিস না। গতকাল রাতে তোফাজ্জলের টাকা চুরি গেছে। পঞ্চাশ হাজার টাকার একটা বান্ডিল। ড্রেসিং টেবিলের উপরে টাকাটা ছিল।

    এত টাকা বাসায় ছিল?

    ওরা কালার টিভি কিনবে। আলাদা টিভি দেখবে। বৌমার বুদ্ধি। এই মেয়ে ছেলেটার মাথা খারাপ করে দিচ্ছে। আলাদা টিভি দেখার কী আছে তুই বল। এইসব আমার এখন আর ভালো লাগে না। আমি ঠিক করেছি এদের সঙ্গে থাকব না।

    থাকবে কোথায়?

    মনোয়ারা চুপ করে রইলেন।

    চিন্তা করে বের কর কোথায় থাকতে চাও। আমি দিয়ে আসব।

    মনোয়ারা সরু গলায় বললেন, মাকে কোথাও ফেলে দিয়ে আসার জন্যে তুই এত ব্যস্ত?

    মুহিব বলল, তুমি যেতে চাচ্ছ বলেই তোমাকে রেখে আসতে চাচ্ছি। মাতৃ আদেশ পালন করছি। চা-টা ভালো হয়েছে। আরেক কাপ চা খাওয়াতে পারবে?

    মনোয়ারা জবাব দিলেন না। চিন্তিত মুখ করে বসে রইলেন।

    মুহিব বলল, মা, তোমার কথা শেষ হয়েছে না আরো কিছু বলবে?

    মনোয়ারা বললেন, তোর এখানে বসে থাকলে কি কোনো সমস্যা আছে?

    কোনো সমস্যা নেই। সারাদিন বসে থাক।

    ফাজিলের মতো কথা বলছিস কী মনে করে? বাংলাদেশের কোনো ছেলেকে দেখেছিস মায়ের সঙ্গে এইভাবে কথা বলে? সব রসুনের এক পাছা। তোরা তিন ভাই-ই এক রকম। তোদের মধ্যে তোফাজ্জল হচ্ছে হাড়ে গোশতে বদ। বউ-এর চোখের ইশারায় চলে। এখন হুকুম জারি করেছে প্রত্যেকের ট্রাঙ্কস্যুটকেস খুলে চেক করা হবে। টাকার জন্যে চাকর-বাকরদের পুটলা-পুটলি চেক করা এক কথা, আর প্রত্যেকের ট্রাঙ্ক-সুটকেস চেক করা ভিন্ন কথা। এখন মনে কর, তোর বড়চাচার স্যুটকেস খোলা হলো–ব্যাপারটা তোর বড়চাচার কেমন লাগবে?

    মুহিব হাই তুলতে তুলতে বলল, যদি বড়চাচার স্যুটকেস খুলে পঞ্চাশ হাজার টাকার বান্ডিলটা পাওয়া যায় তাহলে খুব খারাপ লাগবে। মা শোন, আমি ঠিক করেছি আবার ঘুমিয়ে পড়ব। ঘুমের দ্বিতীয় অধিবেশন। কাজেই এখন চলে যাও।

    ঘর থেকে বের করে দিচ্ছিস! তোর এত বড় সাহস? নিজের মাকে বলতে পারলি ঘর থেকে এক্ষুণি বের হয়ে যাও।

    এরকম কঠিন করে তো মা বলি নি। সফটলি বলেছি।

    মনোয়ারা উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে তিনি এক্ষুণি কেঁদে ফেলবেন। মুহিব বিছানায় শুয়ে পড়তে পড়তে বলল, মা, আমার একটা উপদেশ শোন। ভাইজানের কাছ থেকে তুমি যদি টাকাটা সরিয়ে থাক তাহলে আমার কাছে পাচার করে দাও। তোমার স্যুটকেস থেকে টাকা বের হলে তুমি বিরাট লজ্জার মধ্যে পড়বে।

    তুই কী বললি? কী বললি তুই?

    কী বলেছি তুমি তো শুনেছ।

    মনোয়ারা কেঁদে ফেললেন। শাড়ির আঁচলে চোখ ঢেকে ফুপিয়ে উঠলেন। ভাঙা গলায় বললেন নিজের মাকে নিয়ে এমন একটা কুৎসিত কথা তুই কীভাবে ভাবলি?

    মুহিব উঠে বসতে বসতে বলল– মা শোন, আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন তুমি বাবার মানিব্যাগ থেকে তিন হাজার টাকা সরিয়েছিলে। তারপর নিজেই টাকা চুরির জন্যে দোষী সাব্যস্ত করলে আমাদের বাসার কাজের ছেলেটাকে। তার নাম ছিল রুকু। তুমি তাকে এমন মার মারলে যে তার বাঁ হাত ভেঙে গেল। বাবা তাকে হাসপাতালে নিয়ে সেই হাত প্লাস্টার করিয়ে আনলেন।

    মনোয়ারা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললেন, তোর মতো ছেলে আমি কী করে পেটে ধরলাম? এই ছেলে নিজের মাকে বলছে চোর?

    মুহিব শান্ত গলায় বলল, মা শোন, ফোঁসফোসানি বন্ধ কর। তোমার ভাবভঙ্গি থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে টাকাটা তুমি নিয়েছ। বড়ভাবি অবশ্যই তোমাকে সন্দেহ করছেন। সন্দেহ করছেন বলেই বলা হচ্ছে সবার ট্রাঙ্কস্যুটকেস চেক করা হবে। তোমার কাছে টাকাটা পাওয়া গেলে খুবই কেলেঙ্কারী ব্যাপার হবে। তুমি এক কাজ কর টাকাটা এক্ষুণি এনে আমার ড্রয়ারে রাখ। পুরোটাই আছে, না কিছু খরচ করে ফেলেছ? মা, ঠিকঠাক জবাব দাও। আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাই। পুরো টাকাটা আছে?

    পাঁচশ খরচ করেছি।

    আমার জন্যে এক কাপ চা নিয়ে এসো, আর বাকি টাকাটা এনে আমার ড্রয়ারে রেখে দাও।

    মনোয়ারা চোখ মুছে ছেলের ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।

    ছুটির দিনের সকাল অনেক দেরিতে শুরু হয়। মুহিব সেই হিসেব করে সাড়ে দশটার দিকে ঘর থেকে বের হলো। তার কাছে পরিস্থিতি খুবই স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। যে টেনশনে মনোয়ারা মুখ শুকনো করে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন কোথাও তার ছোঁয়া দেখা গেল না। মুহিবের বড় ভাই তোফাজ্জল খবরের কাগজ হাতে নাস্তার টেবিলে। ছুটির দিন হিসেবে স্পেশাল নাশতা বানানো হয়েছে— খাসির মাংসের তেহারি। তোফাজ্জলের সামনে প্লেট ভর্তি তেহারি। সে খুবই আগ্রহের সঙ্গে তেহারি খাচ্ছে এবং পত্রিকা পড়ছে। পঞ্চাশ হাজার টাকার একটা বান্ডিল চুরি হয়েছে, তার ছাপ তোফাজ্জলের মুখে নেই। বরং তাকে আনন্দিত দেখাচ্ছে।

    মুহিব কিছু বলল না।

    তোফাজ্জল বলল, চাকরি-বাকরি নেই, তোর চেহারা তো চিমসে মেরে যাওয়ার কথা। অথচ যত দিন যাচ্ছে তোর চেহারা খোলতাই হচ্ছে। রহস্যটা কী?

    এই প্রশ্নের জবাব হলো লজ্জিত ভঙ্গির হাসি। সেই হাসি কেন যেন আসছে al

    তুই এক কাজ কর মতিঝিল এলাকায় ঘোরাঘুরি না করে এফডিসি এলাকায় ঘোরাঘুরি কর। কোনো পরিচালকের নজরে পড়লে তোক ফিল্মে নিয়ে নিবে। আমি কিন্তু ঠাট্টা করছি না। আমি সিরিয়াস।

    মুহিব ভাইয়ের পাশে বসেছে। সকালবেলায় তৈলাক্ত তেহারি দেখে গা গুলাচ্ছে। বেগুন ভাজা দিয়ে রুটি খেতে ইচ্ছা করছে। ঘরে বেগুন অবশ্যই আছে। দুটা রুটি সেঁকে দিতে বেশি যন্ত্রণা হবার কথা না। সেই নির্দেশ মুহিব দিতে পারছে না।

    তোফাজ্জল মুখের উপর থেকে পত্রিকা নামিয়ে বলল, সফিক নামে তোর কোনো বন্ধু আছে?

    মুহিব বলল, আছে।

    কমনসেন্স বলে একটা জিনিস যে বাজারে প্রচলিত আছে তার ব্যাপারে সেটা মনে হলো না। I am so annoyed.

    কী করেছে?

    ভোর ছটার সময় টেলিফোন করে তোকে চাচ্ছে। আমি বললাম, জরুরি কিছু? সে বলল— না, জরুরি কিছু না।

    আমি বললাম, জরুরি কিছু না হলে পরে টেলিফোন করো। ছুটির দিনে ভোর ছটায় জরুরি কোনো কারণ ছাড়া টেলিফোন করা অপরাধের মধ্যে পড়ে। সে টেলিফোন রেখে দিয়ে ঠিক বিশ মিনিটের মাথায় আবার টেলিফোন করেছে। আমি স্টুপিড বলে গালি দিতে চাচ্ছিলাম। শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলিয়েছি। তুই তোর বন্ধুকে বলে দিস সে যেন কখনো ছুটির দিনে দশটার আগে টেলিফোন না করে।

    জি আচ্ছা, বলে দেব।

    তুই আবার আমার কথায় রাগ করছিস না তো? বেকার যুবকরা অতিরিক্ত সেন্টিমেন্টাল হয়। তারা ধরেই নেয় পৃথিবীর সবাই তাদেরকে অপমান করার জন্যে ব্যস্ত হয়ে আছে। তুই বরং এক কাজ কর, নাস্তা খেয়ে তোর বন্ধুর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বল। ঘটনা কী জান। নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা আছে, নয়তো ভোর ছটায় কেউ টেলিফোন করে না।

    মুহিব টি-পট থেকে কাপে চা ঢালল। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে নিজের ঘরে চলে যাওয়া, বিছানায় পা ছড়িয়ে ছুটির দিনের মতো চা খাওয়া। চা খেতে খেতে এক ফাঁকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা পড়া যেতে পারে। বৃষ্টির পানিতে কাগজটা প্রায় গলন্ত অবস্থায় চলে গিয়েছিল। সেটা শুকানো হয়েছে। শক্ত কাগজে পেস্ট করা হয়েছে। একবার লেমনেট করার চিন্তাও এসেছিল। জীবনের প্রথম চাকরির অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা যত্ন করে রেখে দেয়া হলো।

    তোফাজ্জল বলল, কিরে তুই উঠে যাচ্ছিস কেন?

    ঘরে বসে চা খাব।

    ঘরে বসে চা খাবার দরকার পড়ল কেন? সিগারেট ধরেছিস?

    না।

    মিথ্যা বলার দরকার নেই। ধরলে ধরেছিস। সামান্য সিগারেট নিয়ে মিথ্যা বলা ঠিক না। ছোট মিথ্যা থেকে শুরু হয় বড় মিথ্যা। ইংরেজিতে একটা প্রবচন আছে— You start by cutting grass, you end up by killing man. আচ্ছা যা, ঘরে গিয়ে সিগারেট খেতে খেতে আরাম করে চায়ে চুমুক দে। সিগারেট দিয়ে সকালের চার কোনো তুলনা নেই। পাঁচ বছর আগে সিগারেট ছেড়েছি, এখনো স্মৃতি আছে। কিছুই বলা যায় না কোনো একদিন সিগারেট ধরে ফেলতে পারি। May be today is the day.

    মুহিব ভেবেই পাচ্ছে না বড় ভাইজান আজ এত কথা বলছেন কেন? টাকা হারানোর শোকে? টেনশনে একেকজন মানুষ একেক রকম আচরণ করে। মুহিবের মেজো ভাই মোফাজ্জল ঝিম মেরে বিছানায় পড়ে যায়। তার তখন ড্রপ বিট হয়। এবং সে বিড়বিড় করে বলে— Oh God, save me please. তার ধারণা, তার বেহেশত হবে টেনশন ফ্রি একটা জায়গায়। বেহেশতে তার হুরপরী, সরাবন তহুরা কিছুই লাগবে না। শুধু শুয়ে থাকার জন্যে নরম বিছানা লাগবে। শব্দ হয় না এরকম এসি লাগবে। আর লাগবে টেনশন ফ্রি মন।

    মোফাজ্জল বারান্দায় তার যমজ দুই মেয়েকে শাস্তি দিতে নিয়ে এসেছে। ক খ দুজনকে মুখোমুখি বসানো হয়েছে। দুজনের গালে কষে থাপ্পড় লাগানো হয়েছে। এরা কেউ কাদছে না। দুজন দুজনের দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে আছে। এদের এই এক অদ্ভুত ব্যাপার! যে শাস্তি দেয় এরা তার উপর রাগ করে না। এক বোন অন্য বোনের উপর রাগ করে। ফোস ফোস করতে থাকে। মুহিব এসে বারান্দায় দাঁড়াল। মোফাজ্জল ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে হুঙ্কার দিয়ে বলল, মুহিব, এক কাজ করতো, এই দুই শয়তানীর গালে কষে দুই থাপ্পড় দে।

    মুহিব বলল, কেন?

    প্রশ্ন করবি না। থাপ্পড় দিতে বলছি থাপ্পড় দে।

    বলে নিজেই এসে থাপ্পড় দিল। ক উল্টে পড়ে গেল। আবার নিজে নিজেই উঠে বসে খ-এর দিকে তাকিয়ে ফোস ফোস করতে লাগল। মুহিব নিজের ঘরে ঢুকে গেল। সব বাবা-মারই সন্তান পালনের নিজস্ব টেকনিক আছে। এই টেকনিকে বাধা দেয়ার দরকার নেই। সংসার তার নিজস্ব গতিতে চলুক। কেউ বাচ্চাদের থাপ্পড় দিয়ে বড় করবে। আবার কেউ আদর দিয়ে বড় করবে। ফাইনাল প্রোডাক্ট কী হবে তা কেউই জানে না।

    মুহিব বিছানায় পা এলিয়ে বসেছে। সারাদিনে সে কী করবে না করবে। একটু ভেবে নেয়ার ব্যাপার আছে। সফিক ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। সিরিয়াস কিছু নিশ্চয়ই হয়েছে। সিরিয়াস কিছু না হলে তিনি ভোরবেলায় টেলিফোন করার মানুষই না। দলের কেউ কি মারা গেছে? সফিক ভাইয়ের মামার বাড়িতে কি কোনো সমস্যা হয়েছে? পুলিশ এসেছে। পুলিশ তাদের খুঁজছে? পুলিশ বড় ধরনের কোনো সমস্যা করতে পারবে না। মহসিনের মেজো চাচা পুলিশের ডিআইজি। পুরোপুরি দুই নম্বরি মানুষ। পুলিশের লাইনে দুনম্বরি মানুষের ক্ষমতা থাকে বেশি। মহসিন যদি সত্যি সত্যি কাউকে খুন করে তার ডিআইজি চাচাকে বলে, চাচা, খুন করে ফেলেছি। উনি বলবেন— কিছু দিনের জন্যে গা ঢাকা দে, ইন্ডিয়া চলে যা। দেখি কী করা যায়।

    মহসিনের এই ডিআইজি চাচা অতি ধার্মিক মানুষ। একবার হজ করেছেন, দুবার উমরা হজ করেছেন। নামাজের কারণে কপালে দাগ পড়ে গেছে। তিনি যখন ডিউটিতে যান আর্দালির সঙ্গে জায়নামাজ থাকে। তার খাকি শার্টের পকেটে থাকে আকিক পাথরের তসবি। ডিউটিতে ফাঁক পেলে তসবি টানেন। মুহিব একবার মহসিনের সঙ্গে তার মেজো চাচার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। তিনি খুব আদর-যত্ন করেছেন। তসবি টানতে টানতে পুলিশি ক্ষমতার অনেক গল্প করেছেন— বুঝলে বাবারা, সব কিছু পুলিশের হাতে। মনে কর B খুন করেছে C-কে। পুলিশ ইচ্ছা করলে A-কে খুনের মামলায় ফাঁসিয়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিতে পারে। পুলিশ এমন প্যাচ খেলবে যে শেষের দিকে A মনে করবে খুন সে-ই করেছে। হা হা হা। তাহলে একটা ঘটনা বলি শোন, আমি তখন টাঙ্গাইলের এস.পি…

    মাগরেবের ওয়াক্ত পর্যন্ত তিনি তাদের একের পর এক গল্প বলে গেলেন। তাদের দুজনকে উনার ইমামতিতে মাগরেবের নামাজ পড়তে হলো। নামাজের শেষে তিনি এত আবেগের সঙ্গে দোয়া পড়লেন যে মুহিবের চোখ ছলছল করতে লাগল।

    মুহিব!

    জি ভাবি।

    মুহিবের বড়ভাবি দরজার পাশ থেকে তার অতি বিরক্ত মুখ বের করে বললেন— তোমার টেলিফোন এসেছে, ধর। যাকে তাকে নাম্বার দিও না তো। সময়ে অসময়ে টেলিফোন করে, অতি বিরক্ত লাগে।

    মুহিব বিছানা থেকে নামতে নামতে বলল, ইলিশ মাছটা পাঠিয়েছিলাম, কেমন ছিল ভাবি?

    ভালো। টাকাটা পুরোটাই খরচ করেছ? বাচে নি কিছু? এক হাজার টাকা দিয়েছিলাম, পুরোটা তো লাগার কথা না।

    একশ টাকার মতো বেচেছে।

    যা বাচে ফেরত দিও। সব সময় চেয়ে টাকা নিতে হবে কেন? তোমার ভাইয়ের পঞ্চাশ হাজার টাকা যে চুরি গেছে শুনেছ?

    জি।

    তোমার ভাই বলছে–সবার বাক্স-প্যাটরা চেক করা হবে। আমি না করেছি, সে শুনছে না। শেষে কার না কার ব্যাগ থেকে টাকা বের হবে, নিজের আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে…

    ভাবি, তোমরা কি নিশ্চিত যে আমাদের মধ্যে কেউ নিয়েছে?

    অবশ্যই।

    কে নিয়েছে বলে তোমার অনুমান?

    আগে টেলিফোন সেরে আস। তোমার বন্ধু কতক্ষণ টেলিফোন ধরে বসে থাকবে?

    মুহিব টেলিফোন ধরতে গেল। টেলিফোন করেছে সফিক। তার গলা উত্তেজনায় কাঁপছে। অতি দ্রুত কথা বলছে বলে কথাও জড়িয়ে যাচ্ছে।

    সকাল থেকে চেষ্টা করছি তোকে ধরার জন্য। এক্ষুণি চলে আয়। টেলিফোন রেখে দৌড় দিয়ে ঘর থেকে বের হবি। লাফ দিয়ে কোনো একটা চলন্ত বেবিটেক্সিতে উঠে পড়বি। স্ট্রেইট আমার বাসায়।

    কী হয়েছে?

    পত্রিকা পড়িস নাই? প্রথম আলোর লাস্ট পেজটা দেখেছিস?

    না।

    তোদের বাসায় কী পত্রিকা রাখা হয়?

    জানি না।

    প্রথম আলোর লাস্ট পেজ-এ হারুনের ছবি ছাপা হয়েছে।

    কেন?

    সে প্রেসক্লাবের সামনে গতরাত বারোটা থেকে বসে আছে। ঘোষণা দিয়েছে তার জন্মদিনে অর্থাৎ জুলাইয়ের দুই তারিখে বেকার গায়ে কেরোসিন ঢেলে জীবন বিসর্জন দেবে।

    কেন?

    বেকার সমস্যার দিকে জনগণের দৃষ্টি ফেরাবার জন্যে। হারুনের পেটে যে এই জিনিস ছিল কোনোদিন বলেছে? আশ্চর্য ছেলে! সকালে পত্রিকা দেখে আমার তো ব্রেইন আউলা হয়ে গেল। কোনো রকম আলোচনা নাই, কিছু নাই, হুট করে এত বড় ডিসিশান! যাই হোক, এখন পুরো দায়িত্ব আমাদের নিতে হবে। কবি-সাহিত্যিক, অভিনেতা, গায়ক, বুদ্ধিজীবী সবার কাছে ছোটাছুটি করতে হবে। সিরিয়াস জনমত তৈরি করতে হবে। আমাদের দলের সবাইকে এক হাজার টাকা করে চাঁদা দিতে হবে। অনেক খরচাপাতির ব্যাপার আছে। একটা পোস্টার ছাপাতে হবে। নীরব ঘাতক সাবেরের মামার প্রেস আছে। সাবেরকে সঙ্গে নিয়ে উনার পায়ে পড়ব। বলব, মামা আপনার পায়ে ধরলাম। রাজি না হওয়া পর্যন্ত পা ছাড়ব না। আমরা কাগজ কিনে দিচ্ছি, আপনি চার কালারের একটা পোস্টার ছেপে দিন। হারুনের সুন্দর একটা ছবিও তুলতে হবে। হতাশ চেহারা বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে টাইপ। তোর চেনাজানা কোনো ফটোগ্রাফার আছে?

    না।

    ফট করে না বলিস না। চিন্তা করে বল। ভালোমতো চিন্তা করলে দেখবি কেউ না কেউ বের হয়ে পড়েছে। এক হাজার টাকা ম্যানেজ করে চলে আয়। এক হাজার টাকা হলো মিনিমাম। যত বেশি হয় তত ভালো। কথা বলে সময় নষ্ট করিস না। দৌড় দিয়ে ঘর থেকে বের হ।

    টাকার জন্যে মুহিব গেল মনোয়ারার কাছে। তিনি অবাক হয়ে বললেন, তোর কত টাকা লাগবে বললি?

    পাঁচ হাজার।

    এত টাকা দিয়ে তুই কী করবি?

    আমার এক বন্ধুর চিকিৎসার জন্যে দরকার। সে মারা যাচ্ছে।

    তোর কি মাথাটাথা খারাপ হয়ে গেছে? বন্ধুর চিকিৎসার জন্যে পাঁচ হাজার টাকা? টাকা সস্তা হয়ে গেছে!

    মা প্লিজ ব্যবস্থা কর। এখন ধার হিসাবে নিচ্ছি। পাই পয়সা হিসাব করে টাকা ফেরত দেব।

    আমি টাকা পাব কোথায়?

    ভাইয়ার বান্ডিলটা থেকে দাও। তুমি তো মাত্র পাঁচশ খরচ করেছ। বাকিটা তো আছে। এবং এই টাকাটা ভাইজানকে ফেরত দিতে হবে। কোনোই কাজে লাগবে না। মাঝখান থেকে আমার বন্ধুর জীবন রক্ষা হয়।

    মনোয়ারা ক্ষিপ্ত গলায় বললেন, তোর এত বড় সাহস! তুই তো মানুষ না। তুই জানোয়ার। নিজের মাকে চোর বলছিস। তোর স্থান দোজখেও হবে না।

    চুরি করেছ বলেই তো বলেছি। তুমি স্বীকারও করেছ। না স্বীকার করলে বেনিফিট অব ডাউট দেয়া যেত।

    চুপ হারামজাদা।

    মা একটা কিছু ব্যবস্থা কর। পাঁচ হাজার না পার, চার হাজার, চার না পার তিন…

    তুই আমার সামনে থেকে যা। জীবনে আমার সামনে পড়বি না। আমি বাকি জীবন তোর মুখ দেখতে চাই না।

    মা শোন, বড় ভাবির সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। উনার ভাবভঙ্গি সুবিধার। মনে হয় স্যুটকেস-ট্রাঙ্ক সত্যি সত্যি খোলা হবে। তুমি অবশ্যই আমার ড্রয়ারে রেখে দিও। আগে মান-সম্মানটা বাঁচুক।

    আমার সামনে থেকে যা। কোনোদিন আমার সামনে পড়বি না। কোনোদিন না। আমি বাকি জীবনে তোর মুখ দেখতে চাই না।

     

    হারুন বসেছে প্রেসক্লাবের গেট থেকে একটু দূরে। শতরঞ্জি বিছিয়ে বসেছে। তার ডান পাশে ধবধবে সাদা রঙের বিশাল বালিশ। সামনে পিরিচে গুড়মুড়ি এবং ছোট এলাচ দানা রাখা। তার পেছনে বাঁশ পুতে বাঁশের মাথায় ছাতি দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়েছে। ছাতার ছায়া হারুনের মাথায় পড়ে নি। ঘাড়ের উপর পড়েছে। হারুনের পেছনে নীল রঙের প্লাস্টিকের চেয়ার। সফিক চেয়ারগুলি দুদিনের জন্যে ডেকোরেটরের দোকান থেকে ভাড়া করে এনেছে। চেয়ারগুলি গোল করে বসানো। সেখানে সফিকের বন্ধুরা গম্ভীর ভঙ্গিতে বসা আছে। একটা বাচ্চা চাওয়ালাকে খবর দিয়ে আনা হয়েছে। তার সঙ্গে কনট্রাক্ট— সারাদিন সে সফিকের দলকে চা খাওয়াবে। বাইরে চা বিক্রি করতে পারবে না। বিনিময়ে চায়ের দাম তো পাবেই, এক্সট্রা পঞ্চাশ টাকা পাবে। চাওয়ালার নাম জতু। জতু অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে প্রস্তাবে রাজি হয়েছে। সে নিজেকে দলের অংশ হিসেবে ভাবছে। যেন সে এখন এক বিরাট জাতীয় কর্মকাণ্ডের অংশ। গুরুত্বপূর্ণ সদস্য।

    সফিক তার দল নিয়ে চেয়ারে গোল হয়ে বসেছে। তাদের সবার হাতে চায়ের কাপ। তারা মাথা নিচু করে অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত নেবার ব্যাপারে একমত হবার চেষ্টা করছে। কোনো ইস্যুতেই কেউ একমত হতে পারছে না। সবারই মেজাজ খারাপ হচ্ছে। হারুনের সামনে একটা পোস্টার লাগানো হবে— এই বিষয়ে সবাই একমত। পোস্টারের লেখা তৈয়ব লিখেছে। লেখাটার বিষয়েও সবাই একমত। তৈয়ব ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র। তার তিনটা ছোটগল্প পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। সে খারাপ লিখবে না। লেখাটা ভালো হয়েছে। সমস্যা হলো পোস্টারটা হাতে লেখা হবে না কম্পিউটারে কম্পোজ করে সেঁটে দেয়া হবে সেটা নিয়ে। একদল বলছে, হাতে লেখা উচিত। হাতে লেখার মধ্যে একটা পার্সোনাল টাচ থাকে। ব্যাপারটা রিয়েলিস্টিকও হবে। বেকার মানুষ কম্পিউটার কম্পোজের টাকা পাবে কোথায়? আরেক দলের ধারণা কম্পিউটার কম্পোজ হওয়া উচিত। পোস্টার একটা থাকবে না, কয়েকটা থাকবে। হাতের লেখা পোস্টারের চেয়ে কম্পিউটার কম্পোজ ভালো। হার্ড ফ্যাক্ট গোটা গোটা হরফে লেখা থাকবে। কোনো কেলিওগ্রাফি না। বাস্তব সত্য। লেখাটা হলো—

    আমার নাম হারুন-অর-রশিদ। না, আমি বাগদাদের খলিফা হারুন-অর-রশিদ না। আমি বেকার হারুন। গত পাঁচ বছর অনেক চেষ্টা করেও কোনো ব্যবস্থা করতে পারছি না। জীবনের প্রতি তীব্র ঘৃণা জন্মে গেছে। আমি প্রতিবাদ হিসেবে গায়ে আগুন জ্বেলে আত্মাহুতি দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমার মৃত্যুতে কারোরই কিছু যাবে আসবে না। তাহলে কাজটা কেন করছি? প্রতিবাদ জানানোর জন্যে করছি। এ দেশের মানুষদের বেকার সমস্যার ভয়াবহতার দিকে দৃষ্টি ফেরাবার জন্যে করছি। হয়তো একটি প্রাণের বিনিময়ে হলেও সবাইকে একটা খবর পৌঁছাতে পারব। আমার মতো হাজার হাজার যুবকের অবস্থার দিকে একটু নজর দিন। একটু ভাবুন। আত্মাহুতির তারিখ ২ জুলাই, রাত বারোটা এক মিনিট। আপনার যদি কাজ না থাকে, চলে আসুন।

    প্রেসক্লাবের সামনে। আত্মাহুতির সময়টা নিয়েও মতভেদ তৈরি হয়েছে। একদল বলছে, রাত বারোটা এক মিনিট ভালো সময়। মধ্যরাত। একটি দিনের শেষ, আরেকটা দিনের শুরু। আরেকদল বলছে— রাত বারোটা এক মিনিটে ঘটনা ঘটলে পত্রিকায় নিউজ ধরানো যাবে না। পত্রিকায় নিউজ ধরাতে হলে সন্ধ্যা ছটার মধ্যে কার্য সমাধা করতে হবে।

    এক পর্যায়ে সফিক মহাক্ষিপ্ত হয়ে বলল, আমার ধারণা তোদের সবার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। হারুনকে তো আমরা সত্যি সত্যি আগুনে পুড়তে দেব না। কাজেই রাত বারোটা এক মিনিটও যা, রাত তিনটাও তা। তোরা এমনভাবে কথা বলছিস যেন সে সত্যি সত্যি গায়ে আগুন দেবে। আমরা কাজটা করছি মিডিয়া অ্যাটেনশনের জন্যে। কাজেই রাত বারোটা এক মিনিট ফাইনাল। এই বিষয়ে আর কথা হবে না। এখন মূল বিষয়ে চলে আয়, আমরা হারুনের পাশে কেরোসিনের টিন, দেয়াশলাই এইসব রাখব কিনা।

    তৈয়ব বলল, না। এতে ব্যাপারটা হাস্যকর হয়ে যাবে। মনে হবে আমরা ড্রামা তৈরির চেষ্টা করছি।

    সফিক বলল, ড্রামা তো করতেই হবে। পাবলিসিটির জন্য ড্রামা দরকার। যারা হারুনকে দেখতে আসবে তারা ধাক্কার মতো খাবে। যে আগুন দিয়ে নিজেকে পুড়াতে চাচ্ছে সে শুধু মুখের কথা বলছে না, একটিন কেরোসিন পর্যন্ত কিনে এনেছে …

    আলোচনা হৈচৈ তর্ক বিতর্ক। কোনো কিছুতেই হারুনের মন নেই। সে মোটামুটি মূর্তির মতোই বসে আছে। তাকে সিগারেট দেয়া হয়েছিল। সে বলেছে না।

    মহসিন বলেছে, সিগারেট খেতে সমস্যা কোথায়? তুই তো অনশন করছিস না। আগুন দিয়ে নিজেকে পুড়িয়ে কয়লা বানিয়ে ফেলবি। সেই ঘটনা যখন ঘটার কথা তখন ঘটবে। ঘটনা ঘটার আগে তুই তোর ইচ্ছামতো খাওয়া দাওয়া করবি। চা দিয়ে একটা সিগারেট খা।

    না।

    তুই আমাদের সঙ্গে রেগে রেগে কথা বলছিস কেন? আমরা কী করলাম?

    হারুন চুপ করে আছে। মহসিন বলল, তোর কি জ্বর না-কি? চোখ লাল।

    তারও কোনো জবাব নেই।

    হারুনের ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছে না। এমন কী ঘটনা ঘটল যে গায়ে আগুন জ্বালিয়ে দিতে হবে? কোনো মেয়ের সঙ্গে প্রেম-ফ্রেম থাকলে চিত্ত তরল থাকে। হঠাৎ হঠাৎ উদ্ভট কিছু করতে ইচ্ছে করে। হারুনের এরকম কিছুও নেই। বিয়েও করে নি যে বেকার স্বামীকে নিয়ে স্ত্রী ঘ্যানঘ্যান প্যানপ্যান করছে। তার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে শ্বশুরবাড়ির জ্ঞানী লোকজন। বেকারদের দলে হারুনের অবস্থা ভালো। সে তার নিজের বাড়িতে থাকে। তার আলাদা ঘর আছে। হারুনের বাবা রিটায়ার্ড এসপি। মাই ডিয়ার টাইপ মানুষ। হারুনের কোনো বন্ধু-বান্ধব বাড়িতে উপস্থিত হলে তিনি চোখ সরু করে তাকান না। বরং হাসি মুখে বলেন— এসো এসো। বলো দেখি কী খবর। ইয়াং ম্যানদের দেখলেই শরীরে কেমন যেন ইয়াং ভাব চলে আসে। বৃদ্ধদের এই কারণেই সবচে বেশি সময় কাটানো উচিত তরুণদের সঙ্গে। সেটা কখনো হয়ে উঠে না। তরুণরা বৃদ্ধ পছন্দ করে না।

    বেকার তরুণদের মধ্যে হারুন হয়তোবা অতি অল্প কিছু ভাগ্যবানদের একজন যার জন্মদিন পালন করা হয়। আত্মীয়স্বজনরা বাড়িতে গিজগিজ করতে থাকে। বাইরের বাবুর্চি এসে মোরগ-পোলাও রান্না করে। হারুনের বাবা অত্যন্ত আনন্দিত ভঙ্গিতে ইস্ত্রি করা পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে ঘোরাঘুরি করেন। সুযোগ পেলেই ছোটবেলায় হারুন কেমন ছিল, কী করত খুবই আগ্রহের সঙ্গে সেই গল্প করেন— হারুনকে নিয়ে আমি একটা ছড়া বানিয়েছিলাম। ছড়াটা বললেই ক্ষেপে যেত। কান্নাকাটি। ভাত খাওয়া বন্ধ টাইপ ক্ষেপা। অথচ খুবই নির্দোষ ছড়া—

    হারুন।
    ঘাড় ধরে মারুন।
    চড় থাপ্পর কিল ও ঘুসি
    মার খেলেই হারুন খুশি।

    প্রতি জন্মদিনে এই ছড়াটা আমি একবার করে বলি এবং তার রি-অ্যাকশন লক্ষ করি। আট বছর পর্যন্ত সে কাঁদত। আট বছর থেকে বারো বছর পর্যন্ত রেগে যেত। আমাকে মারতে আসত। বারোর পর থেকে বিরক্ত হওয়া শুরু করেছে।

    এ ধরনের পারিবারিক অবস্থার একটি ছেলে হঠাৎ একদিন বলবে গায়ে আগুন জ্বালিয়ে দিব–তা হয় না। কোথাও কোনো একটা সমস্যা হয়েছে। সমস্যাটা বোঝা যাচ্ছে না।

     

    মুহিবের উপর দায়িত্ব পড়েছে— শো-বিজনেসের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করা। তারা যেন একবার এসে এক মিনিটের জন্যে হলেও হারুনকে দেখে যান। বিবৃতি দেন আমরা পাশে আছি। হারুনের জন্যে আমাদের সহানুভূতি আছে। মুহিবের হাতে বিশাল এক তালিকা ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। সেখানে ফিল্মের লোক আছে, নাটকের লোক আছে, গানের শিল্পীরা আছে। এদের মধ্যে মুহিব চেনে মাত্র চারজনকে। নোরাকে চেনে। সে গায়িকা এবং তার যথেষ্টই নামডাক আছে। নোরাকে বুঝিয়ে বললে সে শুধু যে আসবে তা না, হারুনের পাশে সারাদিন বসে থাকতে বললে সারাদিন বসে থাকবে।

    নোরা যেহেতু গান করে সে নিশ্চয়ই অন্য গানের শিল্পীদেরও চেনে। তার মাধ্যমে অন্যদের কাছে যাওয়া। পাখি দিয়ে পাখি শিকার।

    নাটকের লোকজনদের মধ্যে জাহিদ হাসানের এক ফুপাতো ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় আছে। তাকে নিয়ে বাসায় যাওয়া যাবে। ভাগ্য ভালো হলে জাহিদ হাসানের স্ত্রী মৌ বাসায় থাকবেন। দুজনকেই বলা যাবে। মেয়েদের মন নরম টাইপ হয়, মৌ ভাবি হয়তো বা রাজি হয়ে যাবেন কিছুক্ষণের জন্যে আসতে। নাটকের আরেকজন শিল্পীর বাসায় মুহিব একবার গেছে। শীলা আহমেদ। তাকে বললে সে অবশ্যই রাজি হবে। তবে মেয়েটা এখন নাটক ছেড়ে দিয়েছে। নাটক ছেড়ে দিলেও লোকজন তাকে চিনে। এখন নিশ্চয়ই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়ে যাবার জন্যে লোকজন তার পেছনে লেগে থাকে না। সেখানে হঠাৎ একজন কেউ উপস্থিত হলে খুশিতেই রাজি হয়ে যাবার কথা।

    একটা গাড়ির ব্যবস্থা রাখতে হবে। কেউ রাজি হলো, সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি গিয়ে তাকে নিয়ে এলো। নোরাদের তিনটা গাড়ি। দুজন ড্রাইভার। একটা গাড়ি কখনো ব্যবহারই করা হয় না। গাড়ি চাইলে নোরা কি দেবে? দেয়ার তো কথা।

    মুহিব নোরার বাড়ির দিকে রওনা হলো। এগারোটা বাজে। নোরাকে বাড়িতে পাওয়ার সম্ভাবনা একশ দশ ভাগ। নোরা রাত তিনটা সাড়ে তিনটার দিকে ঘুমুতে যায়। এগারোটার আগে সে ঘুম থেকেই উঠে না। ইউনিভার্সিটি খোলা থাকলেও না। সকালের সব ক্লাস তার মিস যায়। এখন ইউনিভার্সিটি বন্ধ। এগারোটার আগে ঘুম থেকে উঠার তার প্রশ্নই আসে না। নোরার বাবা কি বাসায় আছেন? ভদ্রলোকের পায়জামা-পাঞ্জাবিটা নিয়ে এলে হতো। ধোপাখানায় দিয়ে ইস্ত্রি করে রাখা উচিত ছিল।

    নোরা বাড়িতে আছে। ঘুম থেকে উঠেছে অনেক আগে। সাজসজ্জা দেখে মনে হচ্ছে এক্ষুণি বের হবে। মুহিব কিছু বলার আগেই নোরা বলল, তুমি হাতে সময় নিয়ে এসেছ তো?

    মুহিব বলল, হ্যাঁ।

    মিনিমাম দুঘণ্টার জন্যে তুমি কিন্তু আটকা পড়ে গেলে। তুমি খুবই ভুল সময়ে এসেছ।

    মুহিব কথার পিঠে সুন্দর কোনো কথা বলার চেষ্টা করল। কোনো কিছুই মনে আসছে না। এদিকে সফিকের কোনো তুলনা নেই। কথার পিঠে কথা সফিকের মতো সুন্দর করে কেউ বলতে পারে না।

    চা খাবে না কফি খাবে?

    চা।

    নোরা বলল, চা না কফি খাও। কারণ আমার কফি খেতে ইচ্ছা করছে।

    আচ্ছা কফি দাও।

    আমার ঘরে চলে এসো। ঘর খুবই এলোমেলো। তাতে নিশ্চয়ই তোমার সমস্যা হবে না। আমি মাঝে মাঝে ঘর খুব গুছিয়ে রাখি। মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে ঘর এলোমেলো করে রাখি। তুমি এসেছ এলোমলো সময়ে।

     

    মুহিব মনে মনে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। তুমি এসেছ এলোমেলো সময়ে। কী সুন্দর কথা! এই কথার পিঠে যদি এরচেও সুন্দর কোনো কথা বলা যেত! যখন মুহিব মোটামুটি ইন্টারেস্টিং একটা সেনটেন্স মনে মনে গুছিয়ে এনেছে তখনই নোরা বলল, তুমি কি কোনো কাজে এসেছ না সৌজন্য সাক্ষাৎ?

    কাজে এসেছি। তুমি কি বাংলাদেশের গায়ক-গায়িকাদের চেন?

    চিনব না কেন! অবশ্যই চিনি।

    তাদের সঙ্গে কি তোমার খাতির আছে? তুমি কোনো কথা বললে কি তারা রাখবে?

    রাখবে না। কারণ আমি তাদের কাউকেই সহ্য করতে পারি না। ওরাও আমাকে সহ্য করতে পারে না। ওদের ধারণা আমি গান গাইতে পারি না। আমার গলায় সুর নেই। অকারণেই আমাকে নিয়ে মাতামাতি হয়। আর আমার ধারণা, ওরা কেউ ঠিকমতো গাইতে পারে না। ওদের গলায় সবই আছে, মমতা নেই। তোমার কি গায়ক-গায়িকা দরকার? কোনো ফাংশনে গান গাইতে হবে?

    তা না।

    অল্প কথায় গুছিয়ে বলতে পারলে বলো। আমি তোমাকে আমার ঘরে বসিয়ে রেখে গোসলে ঢুকব। আমার গোসল সারতে এক ঘণ্টা লাগে। এক ঘণ্টা পরে তোমাকে নিয়ে একটা এক্সপেরিমেন্ট করব। দুঘণ্টা শেষ। তুমি তোমার কাজে চলে যেতে পারবে।

    মুহিব হারুনের ব্যাপারটা বলল। একটু বাড়িয়েই বলল— যেমন হারুন নিজেই এক টিন কেরোসিন কিনে এনেছে। আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এখন মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছে।

    নোরা বলল, তোমার ঐ বন্ধু তো মানসিকভাবে অসুস্থ। গায়ক-গায়িকা জোগাড় না করে তাকে বরং কোনো মানসিক ডাক্তার দেখাও। সবচে ভালো কী জান কোনো হিপনোটিস্ট দিয়ে তাকে হিপনোটাইজ করে সাজেশান দেয়া। হিপনোটাইজ করাটা যদি আমি ভালোমতো শিখতে পারতাম তাহলে আমি নিজেই করতাম। আমি অনেককে নিয়ে চেষ্টা করেছি। আমার সাকসেস রেন্ট

    অনলি টুয়েন্টি পারসেন্ট। তুমি কি কাউকে হিপনোটাইজড হতে দেখেছ?

    না।

    খুবই ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। তমাকে নিয়ে একটা এক্সপেরিমেন্ট করব বলছিলাম না? হিপনোসিস নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট। তোমার আপত্তি নেই তো?

    না।

     

    রিলাক্সড হয়ে বসো। কোনোরকম টেনশন করবে না। টেনশন করার কিছু নেই।

    মুহিব রিলাক্সড হয়েই বসে আছে। সে যে ঘরে বসে আছে সেটা নোরার শোবার ঘর। নোরার খুবই ব্যক্তিগত একটা জায়গা। সে বসেছে হালকা সবুজ রঙের নিচু একটা সোফায়। সোফাটা নোরার বিছানার সঙ্গে লাগানো। বিছানার চাদর এবং সোফা মনে হয় একই কাপড় দিয়ে বানানো। ঘরের পর্দাগুলির রঙও সবুজ। ধবধবে শাদা মার্বেলের মেঝে। মাঝখানে গাঢ় লাল রঙের কার্পেট। ঘরটায় রঙ ঝলমল করছে অথচ কোনো রঙ চোখে লাগছে না।

    নোরা বাথরুমে ঢুকে গেছে। শোবার ঘরের সঙ্গে লাগানো বাথরুম। মুহিব যেখানে বসেছে সেখান থেকে বাথরুমের দরজা দেখা যায়। দরজার দিকে তাকিয়ে থাকতে মুহিবের লজ্জা লাগছে বলে সে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। শাওয়ার দিয়ে পানি ঝরার শব্দ কানে আসছে। সেই শব্দের সঙ্গে গলা মিলিয়ে মাঝে মাঝেই নোরা ঝিনিনি ঝিনিনি নি…র মতো সুর করছে। শুনতে এত অদ্ভুত লাগে! বাথরুমের ভেতর থেকে সে মাঝে মাঝে মুহিবের সঙ্গে কথা বলছে। কথাগুলি শোনাচ্ছে অদ্ভুত। মনে হচ্ছে অনেক দূর থেকে অন্য কেউ কথা বলছে…

    একা একা বোর হচ্ছ?

    না।

    আমার ঘরে অনেক ম্যাগাজিন আছে। যে-কোনো একটা ম্যাগাজিন নিয়ে পাতা উল্টাও, সময় কেটে যাবে।

    দরকার নেই।

    সময় কাটাবার খুব ভালো বুদ্ধি কী জানো?

    না।

    সময় কাটাবার সবচে ভালো বুদ্ধি মানুষকে যে প্রাণীটা দিয়েছে তার নাম গরু, The cow. জানো ব্যাপারটা?

    না।

    গরু কী করে? জাবর কাটে। সময় কাটাবার জন্যে মানুষ এই কাজটা করতে পারে। কাজটা একটু অন্যভাবে করতে হবে। স্মৃতির জাবর কাটতে হবে। কোনো একটা ইন্টারেস্টিং স্মৃতি নিয়ে জাবর কাটা। আমি এই কাজটা প্রায়ই করি। এখন আমি কী করছি অনুমান করতে পার?

    না।

    বাথটাব ভর্তি পানি। আমি গলা ড়ুবিয়ে পানিতে শুয়ে আছি। আমার হাতে একটা জ্বলন্ত সিগারেট।

    তুমি কি এখন নিয়মিত সিগারেট খাচ্ছ?

    তা খাচ্ছি। দিনে এক প্যাকেটের বেশি শেষ হচ্ছে। তবে খুব শিগগিরই ছেড়ে দিব। আমি কোনো কিছুই বেশিদিন ধরে রাখি না। বেশির ভাগ মানুষের স্বভাব পুরনো জিনিস ধরে রাখা। মানুষ কিছুই ফেলতে পারে না। এই জন্যে মানুষকে বলা হয় The collector. আমি অনেকক্ষণ কথা বললাম। এখন কথা বন্ধ। আমি মেডিটেশনে যাচ্ছি। গোসল করতে আমার দেরি হয় এই কারণে। আমি আধঘণ্টার মতো মেডিটেশন করি। পানিতে শবাসন হয়ে শুয়ে থাকি। মাথা থেকে সব চিন্তা-ভাবনা দূর করে দেই।

    মুহিব ঝিম ধরে চেয়ারে বসে আছে। বাথরুম থেকে কোনো শব্দ আসছে। মুহিবের ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে। সোফাটাকে খুবই আরামদায়ক মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, এই সোফা তৈরি হয়েছে ঘুমুবার জন্যে। সে চেষ্টা করছে। জেগে থাকার জন্যে। কিন্তু জেগে থাকতে পারছে না। চোখের পাতা ভারী।

    তার ঘুম ভাঙল। চায়ের কাপে চামচের শব্দ শুনে। চোখ মেলে দেখে নোরা কার্পেটে বসে আছে। তার হাতে কফির কাপ। কফির পোড়া পোড়া গন্ধে ঘর ম ম করছে।

    নোরা বলল, তুমি কতক্ষণ ঘুমিয়েছ জানো?

    মুহিব বলল, না।

    আমি বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখি তুমি ঘুমাচ্ছ। কাজেই তোমাকে আর জাগাই নি। তুমি তেতাল্লিশ মিনিট ধরে ঘুমাচ্ছ। গভীর ঘুম।

    সরি।

    সরি কেন? সরি বলার মতো কোনো কাণ্ড তুমি কর নি। তবে আমার পরিকল্পনা নষ্ট করে দিয়েছ। তোমার উপর আজ কোনো হিপনোসিস প্রক্রিয়া চালানো যাবে না। যে মানুষ গভীর ঘুম থেকে জেগে উঠেছে তাকে হিপনোটাইজ করা যায় না। আরেক দিন হাতে সময় নিয়ে চলে এসো।

    কবে আসব?

    যে-কোনোদিন। সন্ধ্যার পরে এসো।

    আজ সন্ধ্যায় আসব?

    আজ না। আজ আমি বাড়িতে থাকব না।

    মুহিব মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। এইমাত্র গোসল করার কারণেই হোক বা যে-কোনো কারণেই হোক কী সুন্দর যে মেয়েটাকে লাগছে! হালকা গোলাপি রঙের একটা টাওয়েল দিয়ে নোরা মাথার চুল ঢেকে রেখেছে। টাওয়েলটাকে

    নোরা কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল, তোমার ভাব-ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে তুমি আবারও ঘুমিয়ে পড়ছ। তোমার চোখ ছোট হয়ে আসছে। দয়া করে এখন বিদেয় হও। গাড়ি নিয়ে যাও। তুমি যেখানে যেতে চাও গাড়ি তোমাকে নিয়ে যাবে।

    সত্যি সত্যি মুহিবের ঘুম পাচ্ছে। তার কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে না। সোফাতে হেলান দিয়ে এই ঘরেই ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছা করছে। মুহিব অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়াল। নোরা বলল, তোমার যে বন্ধু Death Wish করছে আমি আজ দিনের মধ্যে কোনো এক সময় তাকে গিয়ে দেখে আসব।

    মুহিব বলল, আমি কি তোমার গাড়িটা আজ সারাদিন আমার সঙ্গে রাখতে পারি?

    পার। আমি ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি।

    মুহিব মুগ্ধ চোখে নোরার দিকে তাকিয়ে আছে। যে লাল কার্পেটের উপর নোরা বসে আছে সেই কার্পেটটাকেও মুহিবের এখন নোরার শরীরের অংশ বলে মনে হচ্ছে। এরকম হচ্ছে কেন?

     

    হারুন কুণ্ডুলি পাকিয়ে শুয়ে আছে। বাঁশের আগা থেকে ছাতা নামিয়ে তার মুখের উপর ধরা হয়েছে রোদ আটকাবার জন্যে। চাওয়ালা জতু মিয়া হারুনের মাথার চুলে বিলি করে দিচ্ছে। হারুনের পায়ের কাছে কেরোসিনের টিন এবং টিনের পাশে পিরিচে চারটা দেয়াশলাই। কেরোসিনের টিন এবং দেয়াশলাইয়ের মাহাত্ম কেউ বুঝতে পারছে না, কারণ পোস্টার এখনো লাগানো হয় নি। তারপরেও পথচারীদের কেউ কেউ কৌতূহলী হয়ে তাকে দেখছে। হারুনের কাছ থেকে দশ-বার গজ দূরে গাছের ছায়ায় সফিক একা বসে সিগারেট টানছে। তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে মেজাজ খুব খারাপ।

    মুহিব সফিকের দিকে এগিয়ে গেল। সফিক বলল, ওদের কাণ্ডজ্ঞান দেখেছিস আড়াইটা বাজে কারো কোনো খোঁজ নেই! খাওয়া-দাওয়া তো করতে হবে।

    মুহিব বলল, এখনো খান নি?

    সফিক রাগী গলায় বলল, খাব কীভাবে? ফাইভস্টার থেকে খাওয়া আসবে। পকেটে শেষ সম্বল সাইট টাকা ছিল— এক প্যাকেট বেনসন কিনে ফেলেছি। তুই খেয়েছিস?

    মুহিব বলল, না।

    সফিকের রাগ সঙ্গে সঙ্গে পড়ে গেল।

    মুহিব বলল, আমি আপনাদের জন্যে খাবার নিয়ে আসি।

    কোত্থেকে আনবি?

    আমার চেনা একটা রেস্টুরেন্ট আছে।

    বাকি দেয়?

    হ্যাঁ, দেয়।

    তাহলে এক কাজ কর, আট-দশ জনের মতো খাবার নিয়ে আয়। পরে দেখা যাবে সবাই এক এক করে উদয় হচ্ছে কেউ খেয়ে আসে নি। হারুনের জন্যে এক বাটি স্যুপ আনতে পারবি? ওর তো জ্বর এসেছে। ভালো জ্বর। একটা থার্মোমিটারও নিয়ে আসিস। সঙ্গে ভাংতি টাকা-পয়সা আছে?

    আছে।

    দুটাকার বাদাম কিনে দিয়ে যা। বাদাম খেয়ে আগে ক্ষিধাটা নষ্ট করি। নাড়িভুড়ি হজম হয়ে গেছে। এখন পেটের চামড়া হজম হওয়া শুরু হয়েছে।

    মুহিব গরম সিঙাড়া এবং ডালপুরি কিনে আনল। সঙ্গে তেঁতুলের চাটনি। পেঁয়াজ কাটা কাঁচামরিচ। সিঙাড়া এত গরম যে জিভ পুড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। সফিক আনন্দিত গলায় বলল, এত কিছু আনার তো দরকার ছিল না। চট করে কিছু মুখে দিয়ে কাজে বের হয়ে যা। এক সেকেন্ডও সময় নষ্ট করা যাবে না। বিভিন্ন জায়গায় যে যাবি রিকশা ভাড়া আছে?

    আমার সঙ্গে গাড়ি আছে।

    গাড়ি আছে মানে? কার গাড়ি?

    গান করেন যে নোরা উনার গাড়ি।

    বলিস কী! গাড়ি ম্যানেজ করলি কীভাবে?

    হারুনের ব্যাপারটা বললাম। বিভিন্ন জায়গায় যেতে হবে। এইসব শুনে…

    সফিক আনন্দিত গলায় বলল, ভালো ম্যানেজ করেছিস তো। উনি আসবেন না?

    বলেছেন আসবেন।

    কবে আসবেন?

    আজই আসার কথা।

    বলিস কী! পাবলিক অপিনিয়ন তো দেখি এখনই তৈরি হওয়া শুরু হয়েছে। নোরার মতো গায়িকার দেখতে আসা সহজ ব্যাপার না। একজন স্টিল ফটোগ্রাফার সার্বক্ষণিকভাবে থাকা দরকার, সেলিব্রিটি কেউ আসল, ঝপাঝপ ছবি। তোর বাসায় ক্যামেরা আছে?

    বড় ভাইজানের আছে। দিবে না।

    চেষ্টা করতে তো ক্ষতি নেই। চেষ্টা না করেই যদি বলে ফেলিস দিবে না তাহলে হবে কীভাবে? সব কাজ বাদ দিয়ে বাসায় যা, তোর ভাইকে ভজিয়ে ভাজিয়ে ক্যামেরা নিয়ে চলে আয়। নোরা ম্যাডাম যদি সত্যি আসেন তাহলে অবশ্যই ছবি তুলতে হবে। উনার সঙ্গে তার পরিচয় কেমন?

    সামান্য পরিচয়।

    সামান্য পরিচয়ই খাবলা-খাবলি করে বড় করতে হবে। কখন কী কাজে লাগে কিছুই বলা যায় না। ও ভালো কথা! তোকে বলতে ভুলে গেছি আমার মামার বাড়ির ত্রিসীমানায় যাবি না। ঐ এলাকা আমাদের গ্রুপ মেম্বার সবার জন্যেই আউট অব বাউন্ড। তোর জন্যে বিশেষ করে আউট অব বাউন্ড।

    মুহিব অবাক হয়ে বলল, কেন?

    সফিক বিরক্ত হয়ে বলল, সবাই মিলে নির্দোষ একটা মানুষকে সিঁড়ি দিয়ে নেংটো করে দৌড় দেয়াবি আর তার কনসিকোয়েন্স চিন্তা করবি না?

    ঘটনা কী হয়েছে বলেন। থানায় কেইস করেছে?

    কেইস করলে তো কোনো ব্যাপার ছিল না। কেইস টেইস কিছু না। আরজু সাহেবের ব্রেইন ঐ ঘটনার পর থেকে শর্ট সার্কিট হয়ে গেছে। কাউকে চিনতে টিনতে পারেন না। ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকেন। আরজু সাহেবের এক মেয়ে আছে। যতদূর জানি যুথী নাম। ঐ মেয়ে তোকে পাগলের মতো খুঁজছে।

    আমাকে খুঁজছে কেন?

    তোকেই তো খুঁজবে। তুই আরজু সাহেবকে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে এলি। নিজের নামও বলে এসেছিস। এই সব ক্ষেত্রে সবসময় ফলস্ নাম দিতে হয়। যাই হোক, এত দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। সামান্য কাপড় খুলতেই যে পাগল হয়ে গেছে তার মধ্যে পাগলামি আগে থেকেই ছিল। দুদিন পর আপনাআপনি পাগল হতো। এখন দোষ পড়েছে আমাদের ঘাড়ে। দাঁড়িয়ে থেকে সময় নষ্ট করিস না। ক্যামেরা আনার ব্যবস্থা কর।

     

    বাড়ির ভেতরের দিকের উঠোনে ক এবং খ পা ঝুলিয়ে বসে আছে। দুজনের মুখই অসম্ভব গম্ভীর। মুহিবকে ঢুকতে দেখে দুজনই একসঙ্গে মুখ তুলে তাকাল এবং মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে হাসতে লাগল। লক্ষণ মোটেই ভালো না। এই দুবোন যখন একসঙ্গে কারো দিকে তাকিয়ে হাসে তখন বুঝতে হবে তার কোনো খারাপ খবর আছে। মুহিব বলল, তোদের খবর কী রে?

    দুজন একসঙ্গে বলল, ভা-আ-আ-আ-লো।

    বিকেলের মার খেয়েছিস?

    দুজন একসঙ্গে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। তাদের মুখের হাসি মুছে গেল না।

    বাড়ির পরিস্থিতি অস্বাভাবিক এটা মুহিব বুঝতে পারছে। মুহিবের মন বলছে পঞ্চাশ হাজার টাকার ঘটনা কোনো একটা ক্লাইমেক্সে পৌঁছেছে। মুহিব বলল, মা কই জানিস?

    ক বলল, চলে গেছে।

    খ মাথা দুলিয়ে হেসেই যাচ্ছে। উঠানের শেষ প্রান্তে নতুন কাজের মেয়েটা আনারস কাটছে। আসরের নামাজের পর বড়চাচা সিজনাল ফুটস খান। আমের সময় আম। আনারসের সময় আনারস। কাজের মেয়েটা আনারস কাটা বন্ধ করে এক দৃষ্টিতে মুহিবের দিকে তাকিয়ে আছে। মুহিবের চোখে চোখ পড়তেই সে অতি দ্রুত চোখ নামিয়ে নিল। আনারস কাটায় অতিরিক্ত মনোযোগী হয়ে গেল। ক খ এর হাসি এবং কাজের মেয়েটির কর্মকাণ্ড পরিষ্কার বুঝিয়ে দিচ্ছে বাড়িতে পঞ্চাশ হাজার টাকার ঘটনা চূড়ান্ত পরিণতির দিকে চলে গেছে। শুধু মার বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছে না। বাড়িতে ইন্টারেস্টিং কোনো ঘটনা ঘটবে আর তিনি থাকবেন না। তা হয় না। মুহিব কাজের মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, এই মেয়ে তুমি আমাকে কড়া করে এক কাপ চা খাওয়াতে পারবে? কাজের মেয়েটা ভোতা মুখ করে বলল, আমার হাত বন্ধ।

    মুহিব নিজের ঘরে ঢুকে গেল। তার সারা শরীর কুটকুট করছে। শরীর থেকে বাসের কন্ডাকটরদের গায়ের গন্ধের মতো গন্ধ বের হচ্ছে। সারাদিন ঘোরাঘুরির উপর দিয়ে গিয়েছে। গায়ে ঘামের আস্তর পড়ে গেছে। সাবান ডলে। ডলে ঘামের আস্তর একের পর এক সরাতে হবে। এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় যাবার আগে গরম এক কাপ চা খেয়ে নিলে হতো। সেটা সম্ভব হচ্ছে না। মুহিব গায়ের ঘামে ভেজা শার্ট খুলতে গিয়েও খুলল না। বাথরুমে সাবান নেই এটা মনে ছিল না। সাবান কিনে আনতে হবে। সাবান কিনে ফেরার সময় খায়রুলের দোকান থেকে ইসপিশাল নতুন পাত্তির চা খেয়ে আসা যায়।

    মুহিব কখন ফিরেছ?

    মুহিবের বড়ভাবি দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলেন। মুহিব বলল, তিন মিনিট এখনো পার হয় নি।

    আজ দুপুরবেলা তোমার খোঁজে একটা মেয়ে এসেছিল। হাউমাউ করে কান্না।

    মেয়েটা কে?

    আমরা তো কেউ চিনি না। নাম বলল যূথী।

    একদিন দেখা হয়েছিল।

    ঘটনাটা কী? একদিন যার সঙ্গে দেখা সে এ রকম কাঁদবে কেন?

    তোমরা জিজ্ঞেস কর নি কেন কাদছে?

    আমি অনেকবারই জিজ্ঞেস করেছি। কিছুই বলে না, শুধু কাদে। একটা টেলিফোন নাম্বার দিয়ে গেছে। শুধু বলে গেছে তুমি যখনই আস, যত রাতেই আস এই টেলিফোন নাম্বারে টেলিফোন করার জন্যে। দেব টেলিফোন নাম্বার?

    দাও।

    তোমাকে ভূতের মতো লাগছে কেন? কোথায় ছিলে?

    ঘোরাঘুরির মধ্যে ছিলাম। ভাবি এক কাপ চা খাওয়াতে পারবে?

    কেন পারব না। চা পাঠিয়ে দিচ্ছি।

    তোমার কাছে ফ্রেশ গায়েমাখা সাবান আছে?

    থাকার তো কথা। আমি চা এবং সাবান পাঠিয়ে দিচ্ছি।

    ভাবি থ্যাংক য়্যু। আমি আমার জীবনের দীর্ঘতম গোসলটা আজ সারব। The longest bath.

    গোসল সেরে বড়চাচার সঙ্গে দেখা করো। উনি তোমাকে খুঁজছিলেন।

    কোনো বিশেষ ঘটনা?

    জানি না তো!

     

    মুহিব বড়চাচার সামনে বসে আছে। তিনি খবরের কাগজ পড়ছিলেন। হাতের ইশারায় মুহিবকে বসে থাকতে বলেছেন। সে বসেই আছে। আজকালকার খবরের কাগজে এত মন দিয়ে পড়ার কিছু থাকে না। তোফিকুর রহমান সাহেবের অনেক বিরক্তিকর অভ্যাসের মধ্যে এটি একটি কথা বলার জন্যে ডেকে পাঠিয়ে সামনে বসিয়ে রাখবেন, অন্য কোনো অর্থহীন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন। সেই কাজ দীর্ঘ হতেই থাকবে। কিছুতেই আর শেষ হবে না।

    মুহিব।

    জি।

    তোমার বিষয়ে একটা অপ্রিয় সিদ্ধান্ত আমরা নিয়েছি। বাধ্য হয়ে নিতে হয়েছে। শেকসপিয়রের কথায় বলি—Thave to be cruel only to be kind.

    কী সিদ্ধান্ত?

    তুমি এই বাড়িতে আর বাস করবে না। অন্য কোথাও থাকবে। হোটেলে, কিংবা কোনো বন্ধুর বাড়িতে কিংবা রেলস্টেশনে।

    জি আচ্ছা।

    জানতে চাচ্ছ না কেন?

    বুঝতে পারছি। মনে হচ্ছে চুরি সংক্রান্ত কিছু। বড় ভাইজানের টাকাটা বোধহয় আমার ঘরে পাওয়া গেছে।

    তৌফিকুর রহমান ইজিচেয়ারে সজা হয়ে বসতে বসতে বিস্মিত গলায় বললেন, আমি অবাক হচ্ছি, তুমি খুবই স্বাভাবিক আচরণ করছ। তোমার মধ্যে অপরাধবোধ গ্লানিবোধ কিছুই দেখছি না।

    মুহিব বলল, একটু আগে গোসল করেছি তো চাচা! আমাকে ফ্রেশ লাগছে। চেহারায় এই জন্যেই গ্লানিবোধ অপরাধবোেধ এইসব জিনিসের ছাপ পড়ছে না।

    তোমার সঙ্গে আমার কথা শেষ, তুমি এখন যাও। যদি সম্ভব হয় তুমি তোমার মায়ের সঙ্গে দেখা করবে। সেই বেচারি মনে খুব কষ্ট পেয়েছে। কান্নাকাটি করছিল। তোমার মুখ দেখতে হবে এই ভয়ে সে বাড়ি ছেড়েই চলে গেছে।

    মুহিব উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, আপনি যে ছাগলের লাদির মতো বড়িগুলো খাওয়াচ্ছিলেন সেগুলি কি খেয়েই যাব না খাওয়া বন্ধ করে দেব?

    তৌফিকুর রহমান কোনো জবাব দিলেন না। মুখের সামনে খবরের কাগজ ধরলেন।

    রাত দশটার দিকে মুহিব একটা স্যুটকেস এবং একটা হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে খায়রুল মিয়ার ফ্ল্যাট বাড়িতে উঠে এলো। খায়রুল মিয়ার আনন্দের সীমা রইল না। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে সে কী করবে ভেবে উঠতে পারছে না।

    সে তার হাঁসের মতো ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, ভাইজান এখন থেকে এই বাড়ি আপনার বাড়ি। বুঝেছেন, কী বলেছি? আপনার বাড়ি। যদি মনে করেন আমাকে লাথি দিয়ে বের করে দিবেন— কোনো অসুবিধা নাই। আমার পাছায় লাত্থি দিবেন।

    মুহিব বলল, ঠিক আছে প্রয়োজনে দেব। রাতে খানা কী খাবেন, বলেন।

    রাতে কিছু খাব না। শরীর ভালো লাগছে না। কাল সকালে আমি চাকরিতে জয়েন করব। আমার টাই দরকার। টাই জোগাড় করে দেবেন। পারবেন?

    আমি পারব না, কী বলেন আপনি? আপনি বলেন কী! আপনার টাই কয়টা দরকার? কী কালার?

    মুহিব জবাব দিল না। খায়রুল আগ্রহের সঙ্গে বলল, ভাইজান আপনি চাকরি পেয়েছেন? মুহিব জবাব দিল না।

    খায়রুলের সকল প্রশ্নের জবাব দিতে তার ভালো লাগে না। কোনো এক বিচিত্র কারণে ক্লান্তিতে তার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। তাকে প্রেসক্লাবের সামনে অবশ্যই যেতে হবে। হারুনের অবস্থাটা কী দেখে আসা দরকার।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleএই বসন্তে – হুমায়ূন আহমেদ
    Next Article ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    Related Articles

    হুমায়ূন আহমেদ

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই বসন্তে – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই মেঘ, রৌদ্রছায়া – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এইসব দিনরাত্রি – হুমায়ূন আহমেদ

    December 23, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    একটি সাইকেল এবং কয়েকটি ডাহুক পাখি – হুমায়ূন আহমেদ

    December 23, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Our Picks

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }