Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    উত্তাল সময়ের ইতিকথা – প্রফুল্ল রায়

    প্রফুল্ল রায় এক পাতা গল্প688 Mins Read0

    ২.০৫ জমি বিলি হওয়ার কথা

    পরদিন ঘুম ভাঙতে বেশ দেরিই হয়ে গেল বিনয়ের। ধড়মড় করে উঠে মশারির বাইরে এসে দেখল বিশ্বজিৎ নেই। জমি বিলি হওয়ার কথা খুব সকাল থেকে। বিনয় গভীর ঘুমে ডুবে আছে, তাই আর তাকে ডাকেননি। নিশ্চয়ই উদ্বাস্তু এবং পুনর্বাসনের কর্মীদের নিয়ে জঙ্গলে চলে গেছেন।

    একটা তোয়ালে নিয়ে সমুদ্রের ধারে চলে এল বিনয়। তাড়াতাড়ি মুখ ধুয়ে চা এবং সকালের খাবার খেয়ে কালকের লেখাটা নিয়ে বসতে হবে।

    সূর্য পুবদিকের পাহাড়ের মাথায় উঠে এসেছে। তিনদিকের ঘন জঙ্গলে এবং সমুদ্রে রোদ ঝলকে যাচ্ছে। রোদটা এত তেজি যে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকা যায় না।

    বিচটা একেবারে ফাঁকা। কেননা জেফ্রি পয়েন্টের বাসিন্দারা এখন সবাই উত্তর দিকের জঙ্গলে।

    মুখটুখ ধুয়ে তোয়ালেতে মুছতে মুছতে বিচের ওপর দিয়ে সে যখন ফিরতে শুরু করেছে, হঠাৎ ভট ভট শব্দ কানে এল। ঘুরে দাঁড়াতেই চোখে পড়ল একটা মোটর বোট সমুদ্রের পাড় ঘেঁষে খুব আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে। বোটটার গায়ে নাম লেখা: সি-গাল। সি-গালের মানে তো সিন্ধুশকুন, নাকি সাগর পাখি।

    বোটটায় জনা চারেক লোক রয়েছে। তাদের মধ্যে একজন বর্মি, সেটা তার মঙ্গোলিয়ান চেহারা দেখে লহমায় ধরে ফেলা যায়। বাকি তিনজন বেশ কালো। সবার চুল চামড়া ঘেঁষে ছোট ছোট করে ঘঁটা। কেউ মাঝারি হাইটের, কেউ বেড ঢ্যাঙা। বমিটার বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি, পরনে ঢোলা ফুলপ্যান্ট আর হাতকাটা জামা। অন্য সবাই পরেছে খাটো হাফ প্যান্ট, প্যান্টগুলো আঁট হয়ে গায়ে লেপটে আছে। শার্টটার্ট নেই। দুজনের গলায় কালো কারে ক্রস ঝুলছে। বোঝাই যাচ্ছে খ্রিস্টান। বাকি লোকটির গলায় কিছু নেই।

    ওরা বিনয়কে দেখতে পেয়েছিল। বোটটা থামিয়ে বর্মিটি হিন্দি এবং উর্দু মেশানো হিন্দুস্থানিতে জিগ্যেস করল, সাহাব, এই জেফ্রি পয়েন্টে রিফিউজি সেটলমেন্ট বসার কথা শুনেছিলাম। পাকিস্তানের রিফিউজিরা কি এসে গেছে? বাঙালি, বিহারি, মারাঠি শিখ বর্মি কারেন–সবাই এখানে হিন্দুস্থানিতে কথা বলে। সেই মিউটিনির সময় যে সিপাহিদের কালাপানি সার করে এই দ্বীপে পাঠানো হয়েছিল তখন থেকেই হিন্দুস্থানি বুলি অর্থাৎ ভাষাটা চালু হয়েছে। প্রায় একশো বছর ধরে সেটা চলছে।

    বিনয়ের চেহারাটা উদ্বাস্তুদের মতো ক্ষয়াটে, ভাঙা-চোরা, নুয়ে-পড়া ধরনের নয়। তাকে দেখলে মনেই হয় না, দারিদ্র, কষ্ট বা চরম দুর্দশার মধ্যে আছে সে। বরং চোখেমুখে সম্ভ্রান্ত, মার্জিত একটা ছাপ রয়েছে। তাই বর্মিটা তাকে সাহাব বলেছে। তার কথাবার্তায় রীতিমতো সম্ভ্রম মেশানো।

    বিনয় বলল, হ্যাঁ, অনেক উদ্বাস্তু ফ্যামিলি এসে গেছে। আরও আসবে।

    নিজেদের মধ্যে কী যেন বলাবলি করল লোকগুলো। তারপর বর্মিটা বলল, হামলোগ আতে হেঁ। এদিকে যখন এসেই পড়েছি নয়া সেটলমেন্টের কামকাজ কেমন হচ্ছে, একবার দেখেই যাই।

    মোটর বোর্টটা যদিও ছোট কিন্তু কিনারে ঘেঁষতে পারছে না, কেননা সেখানে জলের গভীরতা দেড় দুফিটের বেশি হবে না। বোটের তলার দিকটা জলতলের বালিতে আটকে যাবে। খানিক দূরে জল যেখানে কোমর সমান গভীর সেখানে নোঙর ফেলে বর্মিরা চারজন সমুদ্রে নেমে পড়ল। তারপর জল ঠেলে ঠেলে পাড়ে এসে উঠল। তাদের প্যান্টট্যান্ট ভিজে গেছে, কিন্তু তা নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। ভাবখানা এইরকম ভিজে যখন গেছে তখন শুকিয়েও যাবে।

    বর্মি আর সঙ্গীরা বিনয়ের কাছে চলে এসেছিল। বর্মিটা জিগ্যেস করল, আপলোগ সেটলমেন্টকা অফসর হ্যায়?

    অফসর অর্থাৎ অফিসার। কলকাতা আসার পর কাজ চালাবার মতো হিন্দি এবং একটুআধটু উর্দু শিখে নিয়েছে বিনয়। বুঝতে পারে, মোটামুটি বলতেও পারে। সে বলল, না না, আমি কলকাতার একটা নিউজ পেপারে কাজ করি। আন্দামানের সেটলমেন্ট দেখতে এসেছি।

    আপনি আখবরে কাম করেন? পত্রকার? বর্মির ভক্তি যেন কয়েক গুণ বেড়ে গেল।

    আখবর কথাটার মানে জানত না বিনয়। আন্দাজে বুঝে নিল–খবরের কাগজ। পত্রকারটা আগেই শুনেছে–সেটা হল সাংবাদিক।

    বিনয় বলল, হ্যাঁ। কিন্তু আপনাদের পরিচয়টা কিন্তু জানতে পারিনি।

    বমিটি বিপুল উৎসাহে জানায়, সে শেল কালেক্টর। নাম লা পোয়ে। আন্দামানের দরিয়া ইজারা নিয়ে জলের তলা থেকে নানারকম শঙ্খ কড়ি টার্বো ট্রোকাস ইত্যাদি তুলে ঘষেমেজে সাফ করে কলকাতা বোম্বাই এমনি বিরাট বিরাট শহরে পাঠায়। আন্দামানের শেলের সারা দুনিয়া জুড়ে কদর। কলকাতা বোম্বাইয়ের বড় বড় শেঠেরা সেসব পৃথিবীর নানা জায়গায় চালান দেয়। শেল নিয়ে লাখো লাখো টাকার কারবার চলছে।

    শেলের ব্যাবসা নিয়ে কিছুই ভাবছিল না বিনয়। সে কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। বিদ্যুৎ চমকের মতো ঝিনুকের মুখ তার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। সে কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই লা পোয়ে জানায়, সি-গাল বোটটার মালিক সে নিজে। সরকারের কাছ থেকে সে নিজেই শেল তোলার লাইসেন্স নেয়, ফি বছর লাইসেন্স রিনিউ করতে হয়। বছরের পর বছর এইভাবেই চালিয়ে যাচ্ছে।

    লা পেয়ে তার সঙ্গীদের সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দেয়। তারা হল যোশেফ, জন এবং রামন। তিনজনই কেরালার লোক। দুজন। খ্রিস্টান, একজন হিন্দু। ওরা ডাইভার। অর্থাৎ জলের তলায় ডুব দিয়ে দিয়ে হাঙর এবং অন্য সব হিংস্র সামুদ্রিক জন্তুর সঙ্গে লড়াই করে ট্রোকাস টার্বো ইত্যাদি দামি দামি শেল তুলে আনে।

    ঝিনুকের চিন্তায় বিনয়ের মাথার ভেতরটা তোলপাড় করে দিচ্ছিল। সে আগেই শুনেছে, শেল কালেক্টররা আন্দামানের নানা দ্বীপের চারদিকে ঘুরে ঘুরে শেল তোলে। ঝিনুক রয়েছে মিডল আন্দামানে। এখান থেকে কম করে ষাট-সত্তর মাইল দূরে। লা পোয়েরা কি সেখানে যায়?

    রস আইল্যান্ডে চকিতের জন্য ঝিনুককে দেখার পর থেকে তীব্র ব্যাকুলতায় বুকের ভেতরটা ভরে আছে বিনয়ের। ঝিনুকের সঙ্গে তার সম্পর্কটা ঠিক কী, বিশ্বজিৎকে জানাতে পারেনি। সংকোচ হয়েছে। একটু ঘুরিয়ে শুধু বলেছে, সে মিডল আন্দামানের নতুন নতুন সেটলমেন্টগুলো দেখতে চায়। সেইসব অঞ্চলের রিপোর্টও সে নতুন ভারত-এ পাঠাবে। এগুলো তার অ্যাসাইনমেন্টের মধ্যে পড়ে। কিন্তু আসল উদ্দেশ্যটা হল, একবার মিডল আন্দামানে পৌঁছাত পারলে সেটেলমেন্টের পর সেলটমেন্ট ঘুরে সে ঝিনুককে যেভাবেই হোক খুঁজে বার করবে।

    কিন্তু বিশ্বজিৎ বিশেষ গরজ দেখাননি। বলেছেন, তাড়াহুড়োর কিছু নেই। সাউথ আন্দামানে সেটেলমেন্টের পত্তন কীভাবে হচ্ছে, প্রথম সেটা দেখুক বিনয়, পরে তাকে মিডল আন্দামানে পাঠবার ব্যবস্থা করা হবে। তিনি কেমন করে জানবেন একটি চিরদুঃখী তরুণীর জন্য কতটা অস্থির হয়ে আছে বিনয়!

    লা পোয়ের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর আশায় উত্তেজনায় উথালপাতাল হয়ে যাচ্ছিল বিনয়। কৌশলে জেনে নিতে হবে ওরা মিডল আন্দামানে শেল তুলতে যায় কিনা। যদি যায় যেভাবেই হোক ওদের সঙ্গে সেখানে চলে যাবে।

    লা পোয়ে জিগ্যেস করল, বড়ে সাহাবকে আপনি চেনেন?

    বিনয় একটু অবাক হল।কোন বড়ে সাহেব?

    রাহা সাহাব। যাঁর হাত দিয়ে এই সব সেটলমেন্ট বসছে।

    রাহা সাহাবকে চিনব না? তিনিই তো আমাকে এই জেফ্রি পয়েন্টে নিয়ে এসেছেন।

    সাহেব কি এখন এখানে আছেন?

    আছেন। জঙ্গলে রিফিউজিদের জমি দেওয়া হচ্ছে। তিনি তার দেখাশোনা করছেন।

    খুশিতে চোখমুখ চক চক করতে থাকে লা পোয়ের। আজ আমার নসিবটা বহুত আচ্ছা। বড়ে সাহাবের সঙ্গে দেখা হবে। ওঁকে সালাম দিয়ে যাই। উনি কোন দিকের জঙ্গলে আছেন?

    উত্তর দিকের।

    লা পায়ে আর সঙ্গীদের নিয়ে দুরের জঙ্গলের দিকে হাঁটতে শুরু করল।

    এই শেল কালেক্টরটাকে কোনও ভাবেই ছাড়া যায় না। বিনয়ের খেয়াল রইল না, এখনও তার চাটা খাওয়া হয় নি। খেয়াল রইল না, কাল রাত্রিরে যে লেখাটা শুরু করেছিল, সেটা শেষ করা জরুরি। সেও লা পেয়ে পাশাপাশি হাঁটতে লাগল।

    .

    উত্তরের জঙ্গলে এখন তুমুল ব্যস্ততা। একদিকে বন দপ্তরের কর্মীরা লম্বা লম্বা করাত চালিয়ে বিশাল বিশাল ঝাড়লো মহাবৃক্ষকে কাটছে। লা ডিন তার দল বল নিয়ে চেন দিয়ে জমি মাপছে, আর একটা দল বাঁশের খুঁটি পুঁতে জমির সীমানা ঠিক করে দিচ্ছে। তাদের কাজকর্ম তদারক ধনপত, নিরঞ্জন এবং বিভাস। উদ্বাস্তুরাও রয়েছে প্রচুর। তারা তাদের জমি বুঝে নিচ্ছে।

    একটু দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব লক্ষ করছেন বিশ্বজিৎ। ঝোঁপ ঝাড় লতাপাতা ঠেলে আসার শব্দে পেছন ফিরে তাকিয়ে লা পোয়েদের সঙ্গে বিনয়কে দেখে তিনি রীতিমতো অবাক।

    লা পেয়ে এবং তার তিন কেরেলি ডাইভার কপালে হাত ঠেকিয়ে কোমর ঝুঁকিয়ে বলল, সেলাম বড়ে সাহাব। আপনার তবিয়ত আচ্ছা হ্যায় তে?

    লঘু সুরে বিশ্বজিৎ বললেন, আমার তবিয়ৎ কখনও খারাপ হয় না। সব সময় আচ্ছা থাকে। তা তেমারা এখানে আমার খবর পেলে কী করে? বলে একটু কী ভেবে বিনয়কে দেখিয়ে বলল, নিশ্চয়ই এই সাহেবের কাজ?

    হা- লা পোয়ে জানায় মোটর বোট নিয়ে তারা জেফ্রি পয়েন্টে এসেছিল। বিনয়কে সমুদ্রের বিচে দেখে নেমে আসে। তারা আগেই খবর পেয়েছিল এখানে রিফিউজি সেটলমেন্ট বসছে। বিনয়ের কাছেই শুনেছে বিশ্বজিৎ এখানে আছেন। তাই

    বিশ্বজিৎ বললেন, তোমাদের কাজকর্ম ঠিকমতো চলছে?

    জি বড়ে সাহেব। সবই আপনার মেহেরবানিতে। এহী সাল আগের সালের চেয়ে তিন গুনা (গুণ) সিপি (শেল অর্থাৎ শঙ্খ কড়ি টড়ি) উঠছে।

    বিশ্বজিৎ হাসলেন। তাহলে লাভ ভালোই হবে বলছ?

    হাঁ বড়ে সাহাব। আপনি যদি আমাদের না দেখতেন, বালবাচ্চা নিয়ে ভুখা মরতে হত। আপনার জন্য আমরা বেঁচে গেছি। এই জিন্দগিতে আপনার মেহেরবানি কভি ।

    বাস, বাস– একটা হাত তুলে লা পোয়েকে থামিয়ে দিলেন। বললেন, এত গুণকীর্তন করে তাকে অকাশে চড়াতে হবে না।

    লা পেয়ে থেমে গেল। বিনয় চুপচাপ একধারে দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনছিল। সে জানে বিশ্বজিৎ রাহা আন্দামানের ফার্স্ট ক্লাস ম্যাজিস্ট্রেট এবং রিফিউজি রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্টের একজন বড় কর্তা। বর্মি শেল কালেক্টরকে তিনি কীভাবে মেহরেবানি করলেন, বোধগম্য হলনা। বিশ্বজিতের যে ধরনের দায়িত্ব তাতে তার আওতায় সমুদ্র থেকে শেল তোলার ব্যাপারটা আসে না।

    বিশ্বজিৎ লা পোয়েকে বললেন, তোমরা এদিকে কতদিন শেল তুলবে?

    দশ পন্দ্র রোজ তো জরুর।

    হঠাৎ কিছু মনে পড়তে বিশ্বজিৎ বিনয়ের দিকে তাকালেন। জানেন এই লা পোয়ে নাইনটিন টোয়েন্টি ফাইভে বর্মায় মৌলমিন থেকে কালাপানির সাজা খাটতে আন্দামানে এসেছিল। লা পোয়েকে জিগ্যেস করলেন, কী ঠিক বলছি তো?

    হাঁ, বড়ে সাহাব শাস্তি ভোগ করতে আসার কথায় নিজেকে গুটিয়ে নিল লা পোয়ে। মিনিমিনে গলায় বলল, ও সব পুরানা বাত ।

    বোঝা যাচ্ছে অতীতে যা ঘটে গেছে তা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি হোক, সেটা একেবারেই চায় না লা পোয়ে। মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে সে।

    বিশ্বজিতের হয়তো একটু মজা করার ইচ্ছা হল। বললেন, কটা যেন মার্ডার করে এখানে এসেছিলে–তিনটে না চারটে?

    জবাব না দিয়ে নীরবে ঘাড় চুলকাতে লাগল। এতকাল বাদে পুরানো দুষ্কর্মের ইতিহাস খুঁচিয়ে বার করার কি কোনও মানে হয়? বড়ে সাহাব তাকে কী ফ্যাসাদেই যে ফেলে দিয়েছেন!

    বিশ্বজিৎ বলতে লাগলেন, নাইনটিন থার্টি ফাইভে বর্মা ইন্ডিয়া থেকে আলাদা হয়ে গেল। তারপর ইন্ডিয়া, বর্মা দুই কান্ট্রিই স্বাধীন হল। সাজার মেয়াদও ফুরিয়ে গিয়েছিল। ইচ্ছা করলে লা পোয়ে নিজের দেশে মৌলমিনে ফিরে যেতে পারত। যায়নি। এখানেই বিয়েটিয়ে করে শেল-এর কারবার করছে। লা পেয়ে এখন পাকা জেন্টলম্যান। কী হে তা-ই তো? শেষ কথাটা লা পোয়েকে।

    বর্মি শেল কালেক্টরের ঘাড় চুলকানি আরও বেড়ে গেল। বিশ্বজিৎ এমনিতে গম্ভীর প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। কাজের সময় কারও পান থেকে চুন খসার উপায় নেই। কিন্তু অন্য সময় ভারী মজাদার মানুষ। অন্যের পেছনে লেগে রঙ্গ করতে ভালোবাসেন। নিছক নির্দোষ কৌতুক।

    বিনয়ের মাথায় ঝিনুকের চিন্তাটা ঘুরছিলই। তার ইচ্ছে লা পোয়েরা যদি শেল তুলতে মিডল আন্দমানে যায় সে তাদের মোটর বোটে উঠে পড়বে। কিন্তু ওঠাটা সহজ নয়। বিশ্বজিৎ বললে লা পোয়েরা নিশ্চয়ই তাকে সঙ্গে নেবে। তবে আপাতত বিশ্বজিৎকে জানাবে না, সে মধ্য আন্দামানে যেতে চায় এবং এই যাওয়ার পেছনে রয়েছে ঝিনুক। বলা যাবে না সেখানে সমুদ্রের ধারে গহন বনভূমির ভেতর নতুন যেসব সেটেলমেন্টের পত্তন হচ্ছে সেই উপনিবেশগুলিতে হানা দিয়ে ঝিনুককে খুঁজে বার করবে। ঝিনুকের কথা লা পোয়েদেরও বলবে না। এ জন্য মনে। মনে একটা কৌশল মনে মনে ঠিক করে ফেলেছে।স।

    বিশ্বজিৎ বললেন, আমি এখন খুব ব্যস্ত। আর কথা বলতে পারব না। তোমরা তোমাদের কাজ কর গিয়ে। দরকার হলে আমার সঙ্গে পোর্ট ব্লেয়ারে গিয়ে দেখা করো।

    জি বড়ে সাহাব

    লা পোয়েরা সমুদ্রের দিকে পা বাড়াতে যাবে, ব্যগ্রভাবে বিনয় বিশ্বজিৎকে বলে, আমার একটা কথা আছে।

    বিশ্বজিৎ জিগ্যেস করলেন কী কথা?

    বিনয় বলল, লা পোয়ের কাছে শুনেছি ওরা সমুদ্র থেকে হাঙর বা অন্য ধরনের ফেরোশাস সি অ্যানিম্যালদের সঙ্গে লড়াই করে শেল তুলে আনে। এই নিয়ে আমাদের কাগজে দু একটা লেখা পাঠানো যায়।

    বিশ্বজিৎকে বেশ উৎসাহিত দেখা গেল। বললেন, হ্যাঁ, ব্যাপারটা খুব ইন্টারেস্টিং। সেই সঙ্গে ভীষণ রিস্কিও। যে ডাইভাররা শেল তোলে তারা যদি একটু অসাবধান হয় হাঙরেরা তাদের ছিঁড়ে খাবে। এরকম দু চারটে ঘটনা যে ঘটে না তা নয়। একটু থেমে ফের শুরু করেন, আন্দামানের ডাইভারদের পক্ষে ভীষণ বিপজ্জনক প্রফেশন। পেটের জন্যে মানুষকে কত কিছুই না করতে হয়।

    বিনয়ের কৌতূহল হচ্ছিল। সে বলে, হাঙরটাঙরদের সঙ্গে ওরা কীভাবে লড়াই করে?

    সেটা ঠিক বলা যাবে না। লড়াইয়ের নির্দিষ্ট কোনও পদ্ধতি নেই। পরিস্থিতি বুঝে ওরা স্ট্রাটেজি ঠিক করে নেয়।

    বিনয় বলল, আমার একটা বিশেষ অনুরোধ আছে।

    হাঁ হাঁ, বলুন না—

    আমি এই শেল কালেক্টিং সম্পর্কে নতুন ভারত-এ লেখা পাঠাতে চাই। কিন্তু নিজের চোখে না দেখলে তো, মানে অভিজ্ঞতা না হলে শুনে শুনে এসব লেখা যায় না। আপনি যদি লা পোয়েদের বলে দেন, ওরা আমাকে ওদের বোটে ঘুরিয়ে সব দেখাবে।

    অবশ্যই। বিশ্বজিৎ বিনয়কে দেখিয়ে লা পোয়েদের বললেন, উনি আমার বন্ধু। কলকাতার পত্রকার।

    লা পেয়ে বলল, জানি বড়ে সাহেব। ওঁর মুখেই শুনেছি।

    উনি তোমাদের কাজকর্ম দেখতে চান। তোমরা তো এখন এখানেই আছ। ওঁর যখন সময় হবে তোমাদের বোটে তুলে সব দেখিয়ে দেবে। যা জানতে চান, ভালো করে জানাবে। তোমাদের কথা উনি আখবরে লিখবেন। ইন্ডিয়ার হাজারো মানুষ তোমাদের নাম জেনে যাবে।

    লা পোয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে জানায় বড়ে সাহেবের হুকুম নিশ্চয়ই তামিল করা হবে। কলকাতার পত্রকারজি যেদিন চাইবেন সেদিনই তাঁকে জাজিরার (দ্বীপের) চার পাশ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাদের কার্যকলাপ দেখানোর বন্দোবস্ত করবে তারা।

    বিনয়ের কৌশলের প্রথম ধাপটা মাপে মাপে খেটে গেল। বিশ্বজিৎ তাঁর কথায় রাজি হয়েছেন। পরের ধাপটা ঠিক করে নিতে হবে লা পোয়ের সঙ্গে। সেটা কোনওভাবেই বিশ্বজিৎকে জানানো হবে। না পরে তিনি নিশ্চয়ই জানতে পারবেন। তখন। ঝিনুকের ব্যাপারটা না বলে পারা যাবে না। সব শুনলে তিনি বিরক্ত তো হবেনই না, বরং সহানুভূতিই জানানে, এমন বিশ্বাস তার আছে।

    লা পোয়েরা লম্বা সেলাম ঠুকে বিশ্বজিতের কাছ থেকে বিদায় নিল। অব যাতা হুঁ বড়ে সাহাব।

    লা পেয়োদের এখন কোনওভাবেই ছাড়া যাবে না। তাদের সঙ্গে বোঝাঁপড়াটা ঠিক করে নিতে হবে। বিনয় বলল, আমিও যাই। কালকের সেই লেখাটা ইনৰ্মপ্লিট রয়েছে। ওটা শেষ করে ফেলি গিয়ে।

    হ্যাঁ হ্যাঁ যান। আমি দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর একটু রেস্ট নিয়ে পোর্ট ব্লেয়ার ফিরে যাব। তার ভেতর যা যা দেবার সব রেডি করে রাখবেন।

    বিনয় লা পোয়েদের সঙ্গে রিহ্যাবিলিটেশনের ক্যাম্প অফিসের দিকে হাঁটতে লাগল। চলতে চলতে সমানে বকরবকর করছে লা। পোয়ে। তার মুখে অনবরত একই কথা–বিশ্বজিৎ। দুনিয়ায় বিশ্বজিতের মতো মানুষ হয় না। তার কাছে বিশ্বজিৎ ঠিক স্বয়ং ফায়ার (বুদ্ধেদেবের) পরেই। অঢেল এই গুণগানের কারণটাও জানা গেল। ইংরেজ আমলের শেষ দিকে যখন লা পোয়ের সাজা শেষ হয়ে গেছে সেই সময় মধ্য আর দক্ষিণ আন্দামানের কোষ্ট লাইন ইজারা নিয়ে সে সিপিবা শেল তুলে আসছিল। স্বাধীনতার পরও নির্বিঘ্নেই চলছিল তার কাজকর্ম। কিন্তু মাদ্রাজ থেকে একজন শেলের কারবারী এসে দরিয়া ইজারা নেবার জন্য অনেক বেশি দর দিয়ে বসল। সে-ই শেল তোলার কাজটা পেয়ে যেত। এই কারবারের সঙ্গে লা পোয়ের পুরো ফ্যামিলি তো বটেই আর তিন ডাইভার এবং তাদের ঘরবাসী বাচ্চাকাচ্চাদের বাঁচা-মরা নির্ভর করে। কাজটা হাতছাড়া হয়ে গেলে তাদের মহা সংকট। তারা গিয়ে রাহা সাহেবের পা জড়িয়ে ধরেছিল। তার জন্যই শেষ পর্যন্ত লিজটা পেয়ে যায় লা পোয়েরা। রাহা সাহেবের ওপর ও তাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। ইত্যাদি ইত্যাদি।

    এসব আগেও কিছু কিছু বলেছে লা পোয়ে। বিনয় অন্যমনস্কর মতো শুনে যাচ্ছিল। তার ভাবনায় এখন একমাত্র ঝিনুক। বর্মিটাকে না থামালে বিশ্বজিৎ রাহার গুণকীর্তন শেষ হবে না। বিশ্বজিংকে শ্রদ্ধা করে বিনয়, ভালোবাসে। তিনি মার্কামারা রসকষহীন সরকারি আমলা এবং ম্যাজিস্ট্রেট নন, আগাগোড়া হৃদয়বান মানুষ। খুবই সহানুভূতিপ্রবণ। কিন্তু তাঁর সম্বন্ধে যদি লা পোয়ে সমানে বলে যায়, আর বলতে বলতে সমুদ্রে গিয়ে মোটর বোটে উঠে পড়ে, তার কথাটাই জানানো যাবে না।

    বিনয় লা পোয়ের বকবকানির মধ্যেই এক সময় বলে ওঠে, আমার একটা কথা ছিল–

    এবার যেন বিনয় সম্বন্ধে সচেতন হয়ে ওঠে লা পোয়ে। সে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। হা-হা, বোলিয়ে।

    আপনারা তো এই এলাকায় দশ পনেরো দিন থাকছেন?

    হাঁ। সমুদরে চক্কর দিতে দিতে সিপি তুলতে হবে।

    তারপর কোথায় যাবেন?

    মিডল আন্দামানে।

    আশায় উত্তেজনায় দুচোখ চকচক করে ওঠে বিনয়ের। সে জিগ্যেস করে, ওখানে কতদিন থাকবেন?

    লা পেয়ে জানায়, গভগ দো হপ্তা। ওখানে গিয়ে সিপি তুলব।

    গলা নামিয় বিনয় জিজ্ঞেস করে, আপনি কি জানেন মিডল আন্দামানে কোথায় কোথায় রিফিউজিদের সেটেলমেন্ট বসছে?

    লা সোয়ের অহমিকায় বুঝি বা একটু বাঁধল। সে বলে, লগভগ তিশ সাল ইস জাজিরামে (দ্বীপপুঞ্জে) গুজর গেল। এখানকার না জানি কী? আমার আঁখকে ফাঁকি দিয়ে আন্দামানে কুছু হতে পারে না।

    কতগুলো সেটেলমেন্ট বসছে?

    একটু ভেবে লা পেয়ে জানায়, সবে মধ্য আন্দামানে উদ্বাস্তুদের উপনিবেশ পত্তনের কাজ শুরু হয়েছে। খুব সম্ভব তিনটে কি চারটে কলোনির জন্য জঙ্গল সাফ করা হয়েছে। পাকিস্তানের। দু-তিন শো ফ্যামিলিকে ওখানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। লা পোয়ে খবর পেয়েছে, জাহাজ বোঝাই করে আরও অনেক উদ্বাস্তু আসবে। তাদের জন্য আরও জঙ্গল নির্মূল করা হবে, ইত্যাদি।

    যেসব তথ্য লা পোয়ের কাছে পাওয়া গেল সেগুলো নতুন কিছু নয়, এই মুহূর্তে যেমন জরুরিও নয়। আগেই বিভাস নিরঞ্জন এবং বিশ্বজিৎ রাহার কাছে সে শুনেছে। একটু চুপ করে থেকে বলল, রাহাসাহেব বলে দিয়েছেন সময় পেলে আপনাদের বোটে করে ঘুরব।

    হা-হা এই তো বললেন, দশ মিনিটও হয়নি। আমার ইয়াদ আছে। যেদিন বলবেন আপনাকে বোটে তুলে আমাদের কামকাজ দেখাব।

    সে তো দেখবই। আমার একটা কথা রাখতে হবে কিন্তু।

    হা-হা জরুর। আপনি বড়ে সাহাবের দোস্ত, আমাদের জাজিরার মেহমান। যা বলবেন তা-ই করব।

    আপনারা দুসপ্তাহ পর যখন মিডল আন্দামানে যাবেন আমাকে সেখানে নিয়ে যেতে হবে।

    কোই বাত নেহি। আলবত নিয়ে যাব।

    আপনাদের কাজ তো দেখবই। মিডল আন্দামানে যেখানে যেখানে রিফউজি কলোনি বসছে সেই সব জায়গাতেও কিন্তু নিয়ে যেতে হবে।

    ওখানকার সেটেলমেন্ট নিয়ে আপনাদের আখবরে লিখবেন বুঝি?

    মূল উদ্দেশ্য দুটো। পুনর্বাসন নিয়ে লেখালেখি তো আছে ই, ঝিনুককে খুঁজে বার করাটা কম জরুরি নয়। বরং এই মুহূর্তে অনেক বেশি প্রয়োজন। যে মেয়েটা সেই কোন ছেলেবেলা থেকে তার জীবনে শ্বাসবায়ুর মতো জড়িয়ে আছে তাকে রস আইল্যান্ডে দেখার পর থেকে বুকের ভেতরটা কতখানি উতলা হয়ে রয়েছে সেটা শুধু সে-ই জানে।

    লা পোয়েকে কাগজে লেখার কথাই শুধু বলল বিনয়। ঝিনুকের ব্যাপারটা পুরোপুরি গোপন রাখল। বিশ্বজিৎ বলেছিলেন, তাকে অবশ্যই মিডল আন্দামানে পাঠাবার ব্যবস্থা করবেন। করতেনও। সেজন্য কতদিন অপেক্ষা করতে হবে, কে জানে। কিন্তু অযাচিতভাবে এই সেল কালেক্টরগুলো এসে পড়েছে। এতবড় একটা সুযোগ কোনওক্রমেই হাতছাড়া করা যাবে না।

    বিনয় জিজ্ঞেস করল, মিডল আন্দামানে তো এক সপ্তাহ থাকবেন। তারপর?

    লা পোয়ে বলল, ফির সাউথ আন্দামানে এসে সিপি তুলব। সে বুঝিয়ে দেয়, এইভাবে কয়েকদিন দক্ষিণ আন্দামান, কয়েকদিন মধ্য আন্দামানে ঘুরে ঘুরে তারা পুরো সিজন ধরে সমুদ্রের তলা থেকে শঙ্খ কড়ি টার্বো ট্রোকাসনটিনাস ইত্যাদি তুলে আনে। বিনয় বলল, ওখানে কলোনি বানানো হচ্ছে। নিশ্চয়ই সেসব কাজ দেখাশোনার জন্য সরকারি ক্যাম্প অফিস বসেছে।

    জি, হাঁ। আমি ওখানকার সি এ-কে (কলোনাইজেশন অ্যাসিস্ট্যান্ট) চিনি। নাম বিজয় জেয়ারদার। বহুৎ আচ্ছা আমি।

    বিনয় উৎসাহিত হয়ে ওঠে, শুধু মধ্য আন্দামানে গেলেই তো হয় না। গেলাম, গিয়েই সঙ্গে সঙ্গে ঝিনুকের সন্ধান পেয়ে যাব তা তো আর হয় না। খোঁজাখুঁজি করতে দু-চার দিন কি তারও বেশি সময় লেগে যেতে পারে। সেখানে থাকবে কোথায়? জেফ্রি পয়েন্টের ক্যাম্প অফিসের মতো ওখানকার ক্যাম্প অফিসই একমাত্র ভরসা। লা পোয়ে জানিয়েছে বিজয় জোয়ারদার মানুষটি ভালো। কিন্তু তার মতো অচেনা উটকো লোককে সে কি ক্যাম্প অফিসে থাকতে দেবে?

    বিনয় বলল, আমাকে কিন্তু বিজয় জোয়ারদারের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে হবে।

    লা পোয়ে মাথা হেলিয়ে দেয়।জরুর।

    একটু ভেবে বিনয় বলল, আমি ওখানে কয়েকদিন থাকতে চাই। ওরা থাকতে দেবে কি?

    এর চেয়ে বিস্ময়কর কথা আগে আর বুঝি কখনও শোনেনি লা পোয়ে। দুচার লহমা হা করে তাকিয়ে থাকে সে। তারপর যা বলে তা এইরকম। বিনয় রাহা সাহেবের দোস্ত, আখবরে কাজ করে, এসব শোনার পর তাকে মাথায় করে রাখবে বিজয় জোয়ারদার। চিন্তার কারণ নেই।

    বিনয়ের দুর্ভাবনা কেটে যায়। সে বলে, আপনারা সিপি তুলবেন, আমি আমার কাজ সারব। তারপর আমাকে আবার এই জেফ্রি পয়েন্টে পৌঁছে দিয়ে যেতে হবে।

    আলবত।

    কথায় কথায় ওরা বিচে চলে এসেছিল। লা পেয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে সেলাম ঠুকে বলল, আজ আমরা যাই। দশ-পন্দ্র রোজ বাদ এসে আপনাকে নিয়ে যাব।

    বিনয় মাথা কাত করে একটু হাসে। বিশ্বজিৎ রাহার বন্ধু হওয়ার কারণে আন্দামানের লোকজন তাকে যথেষ্ট খাতির করছে।

    লা পোয়েরা সমুদ্রের জলে নেমে তাদের মোটর বোটে নিয়ে ওঠে। আর বিনয় ফিরে আসতে থাকে।

    ক্যাম্প অফিসের কাছাকাছি যখন পৌঁছে গেছে; কোত্থেকে পরিতোষ দৌড়াতে দৌড়াতে এসে হাজির। বলল, আপনে সকালের খাওয়া খান নাই। আপনেগো ঘরে পাঠাইয়া দিমু?

    ঘুমভাঙার পর সমুদ্রে মুখ ধুতে গিয়েছিল বিনয়, তারপর লা পোয়েদের সঙ্গে দেখা, তাদের নিয়ে বিশ্বজিতের সঙ্গে দেখা করানো, নানারকম কথাবার্তা, এসবের মধ্যে বেলা অনেকটা চড়ে গিয়েছিল। খাওয়ার কথা একেবারেই খেয়াল ছিল না।

    যে কদিন জেফ্রি পয়েন্টে বিনয় থাকবে তার সুবিধা-অসুবিধার দিকে পরিতোষকে নজর রাখতে বলেছিলেন বিশ্বজিৎ। যতটা সম্ভব বিনয়ের স্বাচ্ছন্দ্যের যেন ব্যবস্থা করা হয়। পরিতোষ সেটা ভোলেনি, অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছে। সকালে সবার খাওয়া হয়ে গেছে, শুধু বিনয়ই খেতে আসেনি। সেটা লক্ষ রেখেছিল পরিতোষ।

    বিনয় বিব্রতভাবে বলল, নানা, পাঠাতে হবে না, আমি নিজে গিয়ে খেয়ে আসছি।

    ক্যাম্প অফিসের সামনে যেখান থেকে উদ্বাস্তু এবং পুনর্বাসন বিভাগের কর্মীদের চারবেলা খাবার দেওয়া হয়, সেখানে চলে এল বিনয়। জায়গাটা প্রায় শুনশান। দুচারজন মুখ চেনা কৰ্মী ছাড়া অন্য কেউ নেই। পরিতোষ ব্যস্তভাবে তাদের বলল, বিনয়বাবুর খাওন হয় নাই। তেনারে খাইতে দাও।

    সকালের খাবার হল হাতে-গড়া রুটি-তরকারি আর চা। কোনও কোনওদিন চিড়ে-গুড়-টুড়। আজ রুটি হয়েছিল। শালপাতার থালায় খাবার সাজিয়ে বিনয়কে দেওয়া হল।

    তাড়াহুড়ো করে খাওয়া সেরে বিশ্বজিতের ঘরে এসে কালকের সেই লেখাটা নিয়ে বসে পড়ল সে। প্রতিবেদনটা শেষ করতে করতে ঘণ্টাদেড়েক লেগে গেল। সেটা একটা খামে পুরে মুখ আঠা দিয়ে আটকে দিল। খামের ওপর প্রসাদের নাম-ঠিকানা লিখে দিল।

    আগেও দুটো প্রতিবেদন এবং সুধা আর আনন্দকে চিঠি লিখে খামে ভরে রেখেছিল। তিনটে প্রতিবেদন এবং দুখানা চিঠি–সব মিলিয়ে পাঁচটা খাম।

    লেখালেখি শেষ হতে সূর্য মাথার ওপর সরাসরি উঠে এল। আর তখনই নানা মানুষের গলা কানে আসতে লাগল। জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বিনয় দেখতে পায়, উদ্বাস্তু এবং পুনর্বাসনের কর্মীরা জঙ্গল থেকে ফিরে আসছে। সবাই একসঙ্গে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। ফলে যে শব্দপুঞ্জের সৃষ্টি হচ্ছে সেটা লক্ষ কোটি মাছির ভনভনানির মতো শোনাচ্ছে। বিনয় বুঝতে পারে এ বেলার মতো জমি বিলি শেষ। চান-খাওয়া এবং খানিকক্ষণ জিরিয়ে নেবার পর ওবেলা ফের সবাই জঙ্গলে গিয়ে দ্বিতীয় দফার কাজ শুরু করবে।

    বিশাল জনতার সামনের দিকে রয়েছেন বিশ্বজিৎ। তিনি সোজা ঘরে চলে এলেন। জিজ্ঞেস করলেন, কি লেখা শেষ?

    বিনয় জানায়, এইমাত্র শেষ করলাম। চিঠি এবং রিপোর্টের থামগুলো আলাদা আলাদা করে রেখে দিয়েছি।

    ফাইন। আমাকে দিন। সুটকেসে ভরে ফেলি।

    .

    চান-খাওয়া চুকিয়ে ঘণ্টা দেড়েক জিরিয়ে নিলেন বিশ্বজিৎ। এর মধ্যে একটা লম্বা ফর্দ দিয়ে গিয়েছিল পরিতোষ। এখানকার ভঁড়ার প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। বুড়োধুড়ো বাচ্চাকাচ্চা, যুবকযুবতী ইত্যাদি নানা বয়সের কয়েকশো ছিন্নমূল মানুষ ছাড়াও রয়েছে। পুনর্বাসন এবং বনবিভাগের কর্মীরা। এতগুলো লোকের জন্য রোজ চারবেলা চুলো ধরাতে হবে। হিসেব করে পনেরো দিনের মতো চালডাল সবজি তেল মশলা চা চিনি গুঁড়ো দুধ, এমনি কতটা করে দরকার লিখে দিয়েছে পরিতোষ। রসদ ফুরবার দু-চার দিন আগে আবার পোর্ট ব্লেয়ারে নতুন তালিকা পাঠিয়ে দেবে সে। বেলা পড়ে এলে বিশ্বজিৎ তাঁর জিপে উঠে পড়লেন। সঙ্গে গেল বিভাস আর নিরঞ্জন। বিনয়, পরিতোষ এবং দু-তিনজন কর্মী। ওদের সঙ্গে সঙ্গে জিপটা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেই পর্যন্ত গেল। বাকি সবাই জঙ্গলে আগেই চলে গিয়েছিল। জমি বিলির কাজ একবেলার জন্যও বন্ধ রাখা যাবে না। বিশ্বজিতের কড়া নির্দেশ দশ দিনের ভেতর মাপজোক করে সীমানা বরাবর বাঁশের খুঁটি পুঁতে প্রতিটি উদ্বাস্তু পরিবারকে বরাদ্দ জমি বুঝিয়ে দিতে হবে। কোনওরকম ঢিলেমি বরদাস্ত করা হবে না। দশ মানে দশ দিনই। তার বেশি একদিনও যদি দেরি হয় তার ফলাফল হবে মারাত্মক। পুনর্বাসন দপ্তরের কর্মীরা হাড়ে হাড়ে জানে রাহাসাহেব কী ধরনের জবরদস্ত অফিসার। এক সময় ড্রাইভার স্টার্ট দিল। বিশ্বজিৎদের গাড়িটা পাহাড়ের গা বেয়ে পেঁচানো রাস্তায় পাক খেতে খেতে একটা বাকের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleগহনগোপন – প্রফুল্ল রায়
    Next Article শতধারায় বয়ে যায় – প্রফুল্ল রায়

    Related Articles

    প্রফুল্ল রায়

    আলোর ময়ুর – উপন্যাস – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    কেয়াপাতার নৌকো – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    শতধারায় বয়ে যায় – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    গহনগোপন – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    নিজেই নায়ক – প্রফুল্ল রায়ভ

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    ছোটগল্প – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Our Picks

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.