Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    উত্তাল সময়ের ইতিকথা – প্রফুল্ল রায়

    প্রফুল্ল রায় এক পাতা গল্প688 Mins Read0

    ২.০৬ বিশ্বজিৎ চলে যাবার পর

    বিশ্বজিৎ চলে যাবার পর দিন তিনেক কেটে গেছে। এর মধ্যে বিশাল বিশাল মহাবৃক্ষ তো বটেই, ছোট মাঝারি গাছগুলোর নামও ধনপতের কাছ থেকে জেনে নিয়েছে বিনয়। শুধু তা-ই না, ঝোঁপঝাড় লতাগুল্ম সবই চিনিয়ে দিয়েছে ধনপত। সেই কতকাল আগে কালাপানির সাজা খাটতে এখানে এসেছিল সে। বনবিভাগে চেনম্যানের কাজ নিয়ে দ্বীপে দ্বীপে ঘুরতে ঘুরতে আন্দামানের আদিম অরণ্যের নাড়িনক্ষত্র জেনে গেছে সে।

    সেই সকাল থেকে বনদপ্তরের একদল কর্মী প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড করাত দিয়ে বিশাল বিশাল মহাবৃক্ষ যেমন দিদু চুগলুম প্যাডক বা ঝাড়ালো রেনট্রি গুলো কেটেই চলেছে, কেটেই চলেছে। সমস্ত বনভূমি জুড়ে আওয়াজ উঠছে– ঘসর ঘস, ঘসর ঘস।

    অন্যদিকে জমি মেপে উদ্বাস্তুদের মধ্যে বিলির কাজও চলছে পুরোদমে। যারা যারা জমি পেয়েছে তারা কোদাল দা করাত ইত্যাদি হাতিয়ার দিয়ে ঝোঁপঝাড় ছোট গাছ টাছ নির্মূল করার কাজ শুরু করে দিয়েছে। যার নামে জমি দেওয়া হল সে-ই শুধু নয়, তার ফ্যামিলির সবাই ছেলেমেয়ে বউ তার সঙ্গে হাত লাগিয়েছে। সব চেয়ে বেগ দিচ্ছে উদ্দাম জলডেঙ্গুয়া। অর্থাৎ বনতুলসীর ঝাড়গুলো। সেগুলোর শিকড় মাটির গভীরে বহুদূর অবধি ছড়িয়ে আছে। উপড়ে ফেলা কি মুখের কথা!

    সেদিন যে চারটে হাতি নিয়ে তিরুর থেকে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের আজীব সিংরা এসেছিল তারাও হাত-পা গুটিয়ে বসে নেই। এখানে পৌঁছুবার পরদিন থেকেই হাতিগুলোকে সে এবং তার সঙ্গীরা কাজে লাগিয়ে দিয়েছে।

    যে মস্ত মস্ত ট্রাকে চাপিয়ে হাতিগুলো আনা হয়েছিল সে দুটো ব্যারাকগুলোর ডান পাশে, খানিকটা দূরে নামিয়ে আনা হয়েছে। তারপর ট্রাকের পেছন দিকটা খুলে একটা কংক্রিটের ঢালু পাটাতন মাটিতে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে।

    যেসব বড় গাছ আগেই কাটা হয়েছিল সেগুলোর খণ্ড খণ্ড গুঁড়ি, মোটা মোটা ডাল চারিদিকে উঁই করে রাখা আছে।

    দুই মাহুত জিভ দিয়ে অদ্ভুত টকাস টকাস শব্দ করতেই তাদের দুই হাতি থামের মতো ভারী ভারী পা দিয়ে ধাক্কা মারতে মারতে ট্রাকের পাটাতন অবধি নিয়ে আসছে; তারপর গুঁড়ে পেঁচিয়ে পাটাতনের মসৃণ গড়ানে গায়ের ওপর দিয়ে ঠেলে ঠেলে ট্রাকে তুলে দিচ্ছে। ট্রেনিং পাওয়া শিক্ষিত হাতি। মাহুতের জিভের আওয়াজে কী সংকেত থাকে, সেটা নিমেষে তারা বুঝে ফেলে। বিনয় লক্ষ করেছে ট্রাক দুটো বোঝাই হলেই ড্রাইভার আর বনদপ্তরের চারজন কর্মী সে দুটো নিয়ে চলে যাচ্ছে। সে শুনেছে। সরকারি করাতকলে গাছের গুঁড়িটুড়ি পৌঁছে দিয়ে তারা ফিরে আসছে। এভাবে দুখেপ তারা গেল এবং এল। যতদিন গাছ কাটা হবে লরিগুলোকে যাতায়াত করতেই হবে।

    দুটো হাতি গাছের গুঁড়ি ট্রাকে তোলে। বাকি দুটোর কাজ অন্যরকম। যেসব বড় গাছ কাটার পর শিকড়বাকড় সমেত খানিকটা অংশ মাটির ওপরে এবং নিচে থেকে গেছে সেগুলোও তাদের দিয়ে পুরোপুরি উপড়ে ফেলা হচ্ছে। পদ্ধতিটা এইরকম। কেটে ফেলার পর মাটির ওপরে তিন-চার হাত অংশটা থাকছে তাতে মোটা বঁড়শির মতো লোহার মস্ত হুক ঢুকিয়ে তার সঙ্গে স্টিলের শিকল আটকে হাতির গলায় সেই শিকলের একটা দিক বেঁধে দেওয়া হচ্ছে। তারপর সহিস জিভ চকচক করে সুরেলা আওয়াজ করে চলেছে। এই শব্দটাও সংকেত। হাতি দুটো প্রবল শক্তিতে টানাটানি করে শিকড়টিকড় নিয়ে গাছের শেষ অংশটা তুলে ফেলছে। সেগুলো ট্রাকে তুলে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

    জেফ্রি পয়েন্টের পাহাড় সমুদ্র এবং দুর্গম অরণ্যে ঘেরা এই এলাকাটা জুড়ে সকাল থেকে সন্ধের আগে পর্যন্ত তুমুল কর্মকাণ্ড চলছে। দক্ষিণ আন্দামানের এমন একটা এলাকায় নতুন সেটেলমেন্ট গড়ে তোলা কি সহজ কাজ!!

    বিনয় রোজ সকালে রিহ্যাবিলিটেশনের কর্মী এবং উদ্বাস্তুদের সঙ্গে জঙ্গলে চলে যায়। জমি মাপামাপি দেখে। দুপুরে সবার সঙ্গে ফিরে চান-খাওয়া এবং বিশ্রাম। তারপর আবার জঙ্গলে গিয়ে ঢাকা। দিনের আলো যতক্ষণ থাকে সেখানেই কাটিয়ে আসে। রাত্তিরে খাওয়া দাওয়ার পর বিশ্বজিতের ঘরে এসে সারাদিনে যা-যা দেখল তার প্রতিবেদন লিখতে বসে।

    বিশ্বজিৎ পোর্ট ব্লেয়ার চলে গেছেন। পুরো ঘরখানা এখন একা বিনয়ের দখলে।

    ওধারে ব্যারাক দুটোর সামনের দিকে মস্ত ফাঁকা চত্বরটায় কাঠের মোটা মোটা অগুনতি খুঁটি পুঁতে তার ওপর চেরা বাঁশের পাটাতন বসিয়ে বিরাট মঞ্চ বানিয়েছে মোহনবাঁশিরা। শখানেক মানুষ সেখানে ঘেঁষাঘেঁষি করে বসতে পারে।

    রাত্তিরে খাওয়াদাওয়া চুকলে মোহনবাঁশি সহদেবরা একতারা দোতারা সারিন্দা, এমনি সব বাদ্যযন্ত্র নিয়ে আজকাল রোজই গানবাজনার আসর বসাচ্ছে।

    বিশ্বজিতের ঘরে বসে রিপোর্ট লিখতে লিখতে গান শোনে। বিনয়। এই নির্জন দ্বীপ মায়াবী সুরের দোলায় যেন অলীক কোনও স্বপ্নের দেশ হয়ে ওঠে। কী ভালো যে লাগে বিনয়ের।

    .

    বিশ্বজিৎ চলে যাবার তিন দিন বাদে দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর সবার সঙ্গে রোজকার মতো জঙ্গলে গেছে বিনয়। পুরোদমে কাজ চলেছে চারদিকে। হঠাৎ গাড়ির আওয়াজে ডান দিকে তাকায় সে। ওধারে উপত্যকার তলায় উদ্বাস্তুদের জন্য লম্বা লম্বা ব্যারাক আর সেটেলমেন্টের ক্যাম্প অফিস। সে সবের পেছন দিকে পাহাড়।

    বিনয় দেখতে পেল, একটা জিপ পাহাড়টার গা বেয়ে নেমে আসছে। বিশ্বজিৎ বা পুনর্বাসন দপ্তরের অন্য কোনও অফিসারের তো আজ আসার কথা নয়। তারা এলে কলোনাইজেশন অ্যাসিস্টান্ট পরিতোষ বণিককে আগেভাগেই জানিয়ে দেওয়া হয়। পরিতোষের সঙ্গে প্রায় সারাক্ষণই তো কাটে বিনয়ের। কেউ আসবেন, এমন খবর পেলে সে নিশ্চয়ই জানিয়ে দিত। কে আসতে পারে তাহলে?

    বিনয় লক্ষ করল, জিপটা ক্যাম্প অফিসের সামনে এসে থামল। সঙ্গে সঙ্গে গাড়িটা থেকে যিনি নামলেন তাঁর বয়স তিপ্পান্ন-চুয়ান্নর মতো। মাঝারি হাইট। মাথায় কাঁচাপাকা এলোমেলো চুল, চোখে চশমা। পরনে পাজামা এবং খাটো ঝুলের শার্ট। দূর থেকে এর বেশি আর কিছু বোঝা গেল না।

    ক্যাম্প অফিসের কাছাকাছি দু-তিনজন কর্মী কী করছিল, তারা দৌড়ে বয়স্ক লোকটির কাছে চলে এল। তাদের সঙ্গে দু-এক মিনিট কী কথা বললেন, তারপর জঙ্গলের দিকে লম্বা লম্বা পায়ে হাঁটতে শুরু করলেন। কর্মী দুটি তার পিছুপিছু আসছিল। তিনি হাত তুলে তাদের থামিয়ে দিলেন। বোঝা গেল, তিনি একাই। জঙ্গলে আসতে চান, পথ দেখাবার জন্য কারওকে দরকার নেই।

    কর্মী দুজন আর এগুল না। মাঝবয়সি লোকটি সোজা জঙ্গলে চলে এলেন।

    তাঁকে দেখে আমিন লাডিন, চেনম্যান ধনপত এবং পুনর্বাসনের অন্য কর্মীরা কাজকর্ম ফেলে দৌড়ে এল। সসম্ভ্রমে মাথা ঝুঁকিয়ে কেউ বলল, সালাম, কেউ বলল, নমস্তে- কেউ বলল, আপকা তবিয়ত ঠিক হ্যায় তো?

    মধ্যবয়সি মানুষটি যে সামান্য লোক নন, লা ডিনদের সসম্ভ্রমে কথা বলতে দেখে সেটা আন্দাজ করতে পারছিল বিনয়।

    কাছাকাছি আসায় মানুষটিকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। রোগা, ক্ষয়াটে চেহারা, গাল ভাঙা, হাতের শিরাগুলো প্রকট। কণ্ঠার হাড় চামড়া কুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে। আরও একটা ব্যাপার চোখে পড়ল। তাঁর দুই হাতের কবজিতে মোটা কালচে দাগ। অনেকদিন হাতে গোলাকার ধাতুর জিনিস পরিয়ে রাখলে যেমন হয়, ঠিক সেইরকম আর কী।

    মধ্যবয়সী, দেখা গেল, সবাইকে চেনেন। প্রত্যেককে আলাদা আলাদা করে জিগ্যেস করলেন, তুমি কেমন আছ লা ডিন? তুমি কেমন আছ ধনপত? ইত্যাদি।

    সবাই জানায়, মাঝবয়সির মেহেরবানিতে তারা ভালোই আছে।

    বয়স্ক মানুষটি বললেন, কাজ বন্ধ করে গল্প নয়। তোমরা যাও। পরে কথা হবে।

    লা ডিনদের সঙ্গে তিনি কথাবার্তা বলছিলেন ঠিকই কিন্তু তাঁর চোখ বারবার বিনয়ের দিকে চলে যাচ্ছিল। ভিড়টা হালকা হয়ে। গেলে তিনি এগিয়ে এলেন। একটু হেসে বললেন, আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে, তুমি নিশ্চয়ই বিনয়। কলকাতার কাগজের রিপোর্টার?

    বিনয় অবাক। বলল, আপনি আমাকে চিনলেন কী করে?

    আগে আমাদের কখনও দেখা হয়েছে বলে তো মনে হয় না।

    না, হয়নি। তবু তোমার কথা আমি জানি। আমার নাম শেখরনাথ রাহা; হয়তো নামটা শুনেছ। আমি বিশ্বজিতের কাকা। বিশুর কাছে তোমার কথা শুনেছি।

    বোঝাই যায় বিশ্বজিতের ডাকনাম বিশু। এই মানুষটি ইংরেজ রাজত্বের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলন করতে গিয়ে ধরা পড়েছিলেন। তারপর দ্বীপান্তরী সাজা দিয়ে তাঁকে আন্দামানে পাঠানো হয় উনিশশো পঁচিশে। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে এবং পরে কত বিপ্লবী ভারতের মেনল্যান্ডে ফিরে গেছেন কিন্তু শেখরনাথ ফেরেননি। বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপপুঞ্জেই থেকে গেছেন।

    সাভারকার, উল্লাসকর দত্ত থেকে শেখরনাথ পর্যন্ত কত বিপ্লবীর নামই তো শুনেছে বিনয়। এঁরা সবাই পরমাশ্চর্য রূপকথার সব নায়ক। অসমসাহসী, আদর্শবাদী, আদ্যোপান্ত দেশপ্রেমিক। ভারতকে স্বাধীন করাই ছিল তাদের একমাত্র লক্ষ্য। যে ইংরেজদের রাজত্বে কোনওদিন সূর্যাস্ত হত না সেই বিপুল অপরাজেয় শক্তির বিরুদ্ধে দুর্জয় মনোবলে এঁরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। মৃত্যু এঁদের কাছে ছিল নেহাতই ছেলেখেলার জিনিস। মহা কৌতুকে তিন তুড়িতে মৃত্যুর চিন্তাকে তারা উড়িয়ে দিতেন। বিচারক যাবজ্জীবন কারাবাস মৃত্যুদণ্ডের সাজা দিলে এঁরা হেসে হেসে গড়িয়ে পড়তেন। যেন এরচেয়ে মজার কথা ভূভারতে কেউ কোনওদিন শোনেনি।

    এইসব মরণজয়ী বিপ্লবীদের একজন শেখরনাথ। মেনল্যান্ডে সত্যাগ্রহ করে জেল খেটেছে, এমন কয়েকজনকে আগে দেখেছে বিনয় কিন্তু কালাপানি পার হয়ে সেলুলার জেলে বন্দি ছিল, এমন কারও সঙ্গে কথাও হয়নি। অবাক বিস্ময়ে শেখরনাথের দিকে তাকিয়ে থাকে বিনয়। বুকের ভেতর অদ্ভুত এক শিহরন; গায়ে যেন কাটা দিচ্ছিল তার।

    বিহ্বল ভাবটা কাটিয়ে উঠতে একটু সময় লাগল। তারপর ঝুঁকে শেখরনাথের পা ছুঁতে যাচ্ছিল। শেখরনাথ তার দুধ ধরে তুলে। ধরে হেসে হেসে বললেন, থাক থাক। পায়ে ধুলো-ময়লা লেগে আছে। হাত দিলে নোংরা লেগে যাবে।

    বিনয় বলল, বিশ্বজিৎবাবুর মুখে শুনেছিলাম, খুব শিগগিরই আপনি এখানে আসবেন। আপনার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। রোজই ভাবি, এই বুঝি এলেন।

    বিশু বলেনি, আমি লিটল আন্দামানে গিয়েছিলাম।

    হ্যাঁ-হ্যাঁ, বলেছেন। সেই দ্বীপটা কত দূরে? পোর্ট ব্লেয়ার থেকে ষাট-পঁয়ষট্টি মাইল হবে। ওটাই হল আন্দামানের সাদার্নমোস্ট আইল্যান্ড। ঔখানে কারা থাকে জানো?

    না। আমি তো এই প্রথম আন্দামানে এসেছি। পোর্ট-ব্লেয়ারে নামার পরই তো জেফ্রি পয়েন্টে চলে এলাম। আর কোথাও যাবার সময়ই পাইনি।

    তা ঠিক। লিটল আন্দামানে থাকে ওঙ্গেরা। আন্দামানের আদিম ট্রাইবদের একটা। এরা কালো কালো পিগমি। সাড়ে চার ফিটের মতো হাইট। সংখ্যায় কত জানো? মাত্র চারশো একান্ন। ক্রমশ এরা কমে আসছে। ভয় ছিল, হয়তো একদিন ট্রাইবটা আর থাকবে না। একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কিন্তু হঠাৎ খবর পেলাম, ওদের দুটো বাচ্চা হয়েছে। শুনে ভীষণ আনন্দ হল, জেলেদের ট্রলারে চেপে চলে গেলাম। তাছাড়া যাবার আরও একটা কারণও ছিল।

    বিনয় উৎসুক চোখে তাকিয়েই থাকে।

    শেখরনাথ বলতে লাগলেন, হাজার হাজার ছোট কচ্ছপ সমুদ্র। সাঁতরে এই সময়টা লিটল আন্দামানে আর নিকোবরে বালির চড়ায় ডিম পাড়তে আসে। সে একটা আশ্চর্য দৃশ্য। একসঙ্গে এত কচ্ছপ, কল্পনাও করতে পারবে না। চোখ ফেরানো যায় না।

    কচ্ছপের ঝাঁক দেখলেন?

    দেখলাম তো।

    এমন এক বিপ্লবী, যিনি বন্দুক পিস্তল হাতে ইংরেজ পুলিশের সঙ্গে মরণপণ লড়াই করেছেন, তিনিই কিনা ওঙ্গেদের বাচ্চা আর কচ্ছপদের ডিম পাড়া দেখার জন্য জেলেদের ট্রলারে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে সেই কতদূরে চলে গিয়েছিলেন! বিস্ময়ের সীমা-পরিসীমা থাকে না বিনয়ের। হঠাৎ কিছু মনে পড়ায় সে চকিত হয়ে ওঠে, আপনি যে ওঙ্গেদের ওখানে চলে গেলেন বিপদ হতে পারত তো?

    একটু অবাক হয়েই শেখরনাথ জিজ্ঞেস করেন, কীসের বিপদ?

    এখানকার ট্রাইবরা তো ভীষণ হিংস্র। তারা বিনয়কে হাত তুলে থামিয়ে দিলেন শেখরনাথ। জানালেন ওঙ্গেরা খুবই নিরীহ। শান্ত। মাত্র কিছুদিন হল আগুন ব্যবহার করতে শিখেছে। তির দিয়ে সমুদ্র থেকে মাছ শিকার করে আগুনে ঝলসে খায়। শেখরনাথ অনেকবার লিটল আন্দামানে গেছেন। তাকে দেখলে ওরা খুশি হয়।

    হঠাৎ কয়েকদিন আগের সেই রাতের ভয়ংকর দৃশ্যটা চোখের সামনে ভেসে আসে। বিনয় বলে, কিন্তু

    কী?

    এখানকার জঙ্গলে যে ট্রাইবটা আছে তারা কিন্তু ভীষণ হিংস্র।

    তুমি জারোয়াদের কথা বলছ?

    হ্যাঁ।

    সেদিন রাতে আচমকা এই সেটেলমেন্টে হানা দিয়ে জারোয়ারা আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছিল সেটা সংক্ষেপে জানিয়ে বিনয় বলল, রিফিউজিরা তো ওই ঘটনার পর জেফ্রি পয়েন্টে এক মুহূর্তও থাকতে চাইছিল না। পারলে সেই রাত্তিরেই সবাই কলকাতায়। ফিরে যায়। বিশ্বজিৎবাবু বিভাসবাবু নিরঞ্জনবাবুরা অনেক বুঝিয়েসুঝিয়ে তাদের ঠান্ডা করেন।

    একটু চুপ করে থাকেন শেখরনাথ। তারপর বলেন, জারোয়ারা ওঙ্গেদের মতো শান্তশিষ্ট নয়। ওরা খুবই উগ্র ধরনের। তার কারণও আছে।

    বিনয় উৎসুক হল। কী কারণ?

    শেখরনাথ বললেন, তুমি তো উদ্বাস্তুদের সঙ্গে এই খেপে কলকাতা থেকে এসেছ। প্রথমে রস আইল্যান্ডে নেমেছিলে। তারপর এসেছিল পোর্টব্লেয়ারের এবারডিন মার্কেটের সামনে। তাই তো? জারোয়াদের প্রসঙ্গে এসব কথা আসছে কেন! বুঝতে পারল না বিনয়। শুধু বলল, হ্যাঁ।

    সেলুলার জেল তৈরি হবার আগে ইংরেজ পুলিশ প্রায় চল্লিশজন জারোয়াকে ধরে এনে গুলি করে মারে। সেই থেকে প্রচণ্ড হিংস্র হয়ে উঠেছে ওরা। তারা চায় না, বাইরের থেকে সো কলড সভ্য জগতের কেউ এসে তাদের জঙ্গল পাহাড় দখল করে বসুক। অনেকদিনের সেই ঘটনা। কিন্তু জেনারেশনের পর। জেনারেশন তারা ক্রোধটা পুষে রেখেছে।

    ইংরেজ পুলিশ জারোয়াদের খুন করেছিল কেন?

    সেসব পরে শুনো। চল, সেটেলমেন্টের কাজ দেখি। সেই সঙ্গে তোমার কথাও শুনব। বিশু তোমার সম্পর্কে কিছু কিছু বলেছে, তবে আমি ডিটেলে সব শুনব।

    কিন্তু তার আগে আপনার কথা শোনাতে হবে। সেই যে। বাইশ-তেইশ বছর আগে সেলুলার জেলে আপনাকে পাঠানো হল তখন থেকে

    বিনয়কে থামিয়ে দিলেন শেখরনাথ।–তোমাকে নিয়ে সময় পেলেই একদিন সেলুলার জেলে যাব। তখন সব শুনো

    সেলুলার জেল দেখতে যাবার কথা বিশ্বজিতের সঙ্গে আগেই হয়েছিল। চিফ রিপোর্টার প্রসাদদা, নিউজ এডিটর তারাপদ ভৌমিক তো বটেই নতুন ভারত-এর মালিক এবং সম্পাদক জগদীশ গুহঠাকুরতা বার বার বিনয়কে বলে দিয়েছিলেন, সেলুলার জেলের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ভারতবর্ষের বাস্তিল এই কুখ্যাত কারাগারের ইতিহাস, কী নির্মমভাবে কয়েদিদের, বিশেষ করে সশস্ত্র বিপ্লবীদের ওপর নির্মম অত্যাচার চালানো হত তা নিয়ে বিশদভাবে পাঁচ-সাতটা প্রতিবেদন যেন অবশ্যই পাঠায়।

    সেলুলার জেলের ইতিহাস নিশ্চয়ই জানাতে পারবেন বিশ্বজিৎ, কিন্তু সেখানে নির্জন সেলে কাটানো এবং অকথ্য নিগ্রহ আর নারকীয় যন্ত্রণা ভোগ করার অভিজ্ঞতা তো তার নেই। সেই কষ্টকর, দুর্বিষহ জীবনের অনুপুঙ্খ বিবরণ দিতে পারবেন শেখরনাথ। তার সময়ে আর কোন কোন বিপ্লবী সেখানে ছিলেন, ছিল কী ধরনের দুর্ধর্ষ খুনি ডাকাতের দল, সব জানা যাবে।

    কুখ্যাত এই জেলখানা অপার রহস্যে ঘেরা। মেনল্যান্ডের মানুষজনের মনে এই কারাগার সম্পর্কে শুধুই ত্রাস আর আতঙ্ক। কত করম ভীতিকর জনশ্রুতি যে ভেসে বেড়াত। একজন বিপ্লবী যিনি জীবনের মহা মূল্যবান সময় অশেষ নির্যাতন সইতে সইতে এখানে ক্ষয় করে দিয়েছেন, তিনি তাঁকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন, ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব দেখাবেন, ভাবতেই স্নায়ুমণ্ডলীতে শিহরন খেলে যেতে থাকে বিনয়ের।

    শেখরনাথ সামনের দিকে পা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। দূরের জঙ্গলে গাছ কাটা চলছে। ডানপাশে চলছে জমি মাপামাপি এবং বরাদ্দ জমির সীমানা বরাবর বাঁশের খুঁটি পোঁতার কাজ। আর যেধারে এর মধ্যেই জমি দেওয়া হয়ে গেছে সেই সব জায়গাতেও কাজ চলছে পুর্ণোদ্যমে। প্রতিটি উদ্বাস্তু পরিবারের লোকজন, দুধের শিশুরা বাদে, বুড়ো ধুড়ো মেয়েপুরুষ সবাই দা কোদাল। কুড়াল ইত্যাদি দিয়ে ঝোঁপঝাড়, ছোট-মাঝারি গাছ, জলডেঙ্গুয়ার। উদ্দাম জপল কেটে, উপড়ে সাফ করে ফেলছে।

    প্রতিটি জমিতে গিয়ে ছিন্নমূল মানুষগুলোর সঙ্গে আলাপ করছেন শেখরনাথ। নিজের নাম জানিয়ে বলছেন, আমি তোমাদের কলোনির কর্তা বিশ্বজিতের কাকা। তোমার নাম কী?

    যাকে জিগ্যেস করা হল, অচেনা প্রৌঢ়টি বিশ্বজিতের কাকা শুনে সসম্ভ্রমে বলে, আইজ্ঞা, বিন্দাবন সাহা

    দেশ ছিল কোথায়?

    বরিশাল। গেরামের নাম হরিশ্চন্দপুর।

    দেশে কী করতে?

    দোকানদারি। চাউল ডাইল মশল্লাপাতি বেচতাম। আন্ধারমানে জমি চষতে অইবে। ব্যাবসাদার থিকা চাষি বইনা গ্যালাম।

    জমির পর জমি পেরিয়ে যান শেখরনাথ। তার পাশাপাশি হেঁটে চলেছে বিনয়।

    শেখরনাথের প্রশ্নের উত্তরে উদ্বাস্তুরা কেউ জানায় তার নাম গণেশ পাল, বাড়ি ফরিদপুর, দেশে মাটির হাঁড়ি পাতিল বানাত, পুজোর মরশুমে গড়ত দুর্গা কালী সরস্বতীর মূর্তি। তারও খানিকটা আক্ষেপ, চোদ্দোপুরুষের কুলকর্ম ছেড়ে তাকেও কৃষক হতে হচ্ছে। দমদমের রিলিফ ক্যাম্পে পচে গলে মরার চেয়ে এ একরকম ভালোই।

    কেউ বলল তার নাম রাধেশ্যাম কুণ্ডু, দেশ ছিল ঢাকা, গ্রাম মেদিনীমণ্ডল, পাইকারদের কাছ থেকে ধান চাল কিনে নিয়ে গঞ্জে বেচত। খুবই নগণ্য কারবারি কেউ ক্ষৌরকার বা নাপিত, সাবেক দেশ নোয়াখালি। কেউ ধোপা তার দেশ ছিল বগুড়া। খুলনা যশোরের দুজন রয়েছে, তারা দেশে বরজে পানের চাষ করে সংসার চালাত। এমনি নানা পেশার মানুষের সঙ্গে আলাপ হচ্ছে। তবে বেশিরভাগই কৃষিকর্ম করে এসেছে পুরুষানুক্রমে। ফলাত ধান, পাট, নানা ধরনের রবিশস্য।

    উদ্বাস্তুদের সঙ্গে আলাপ করার ফাঁকে ফাঁকে বিনয়ের সঙ্গেও কথা বলছেন শেখরনাথ। স্বাধীনতার চেহরাটা কেমন দেখছ বিনয়? বলে ভুরুদুটো ওপর দিকে তুললেন।

    তিনি কী ইঙ্গিত দিয়েছেন মোটামুটি তা আন্দাজ করতে পারছিল বিনয়। তবে উত্তর দিল না।

    শেখরনাথ বলতে লাগলেন, এই যে মানুষগুলো চোদ্দো পুরুষের ভিটেমাটি খুইয়ে সমুদ্র পেরিয়ে এই সৃষ্টিছাড়া দ্বীপে টিকে থাকার চেষ্টা করছে, এমনটা কি ওরা কোনওদিন ভাবতে পেরেছিল? এ কেমন স্বাধীনতা যার জন্যে নিজের দেশ থেকে উৎখাত হতে হবে? হঠাৎ কী খেয়াল হতে একটু চুপ করে থেকে এবার বললেন, আরে কাকে কী বলছি! বিশুর কাছে শুনেছি, তুমিও তো মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তান থেকে চলে এসেছ। যন্ত্রণাটা কতখানি তা তুমি জানো।

    আস্তে মাথা নাড়ে বিনয়।

    শেখরনাথ থামেননি, আন্দামানে যে কয়েকশো ফ্যামিলি এসেছে, আরও হাজারখানেক ফ্যামিলি আসবে–এরা হয়তো চাষ। আবাদ করে বেঁচে যাবে। কিন্তু কলকাতায় আর পশ্চিমবাংলার নানা জায়গায় রিলিফ ক্যাম্পে, রাস্তায়, স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে যে লাখ লাখ মানুষ পোকামাকড়ের মতো পড়ে রয়েছে তাদের কী হবে? পশ্চিমবাংলা কতটুকু স্টেট? তেত্রিশ হাজার স্কোয়ার মাইলের মতো এরিয়া। সেখানে এত লোকের জায়গা হবে কোথায়? কী হবে এদের ভবিষ্যৎ?

    তিনি আরও যা বললেন তা এই রকম। ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ, বিহার, পূর্ব পাকিস্তানের ছিন্নমূল মানুষদের জন্য কিছু জমি দিতে চেয়েছে। কিন্ত কতটা জমি? কতজনের সেখানে পুনর্বাসন হবে? আসামে তো বহু উদ্বাস্তু চলে এসেছে। তাদের অনেককে খেদিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই সব বিতাড়িত অসহায় মানুষ এসে ভিড় জমাচ্ছে কলকাতায়, নর্থবেঙ্গলে। বিহার ওড়িশায় যারা যাবে তাদেরও যদি কোনওদিন তাড়ানো হয়?

    শেখরনাথ বললেন, লক্ষ লক্ষ বাঙালিকে উৎখাত করে এই স্বাধীনতা এসেছে। পাঞ্জাবের সমস্যাটার সমাধান হয়ে যাবে। ওখানে টোটাল এক্সচেঞ্জ অফ পপুলেশন হয়ে গেছে। এখানকার মুসলমানদের ফেলে যাওয়া জমিতে এসে বসেছে ওপারের শিখ। আর জাঠেরা। ওপারের ফেলে আসা জমিতে গিয়ে বসেছে। এপারের পাঞ্জাবি মুসলমানরা। জমির জন্যে, পুনর্বাসনের জন্য ওয়েস্টার্ন ইন্ডিয়ায় কোনও সমস্যা নেই। তাছাড়া তাদের জন্য দরাজ হাতে টাকা ঢেলে দেওয়া হচ্ছে। আর বাঙালিদের জন্যে সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের হাত বড়ই কৃপণ। মুঠি খুলতেই চায় না। বলতে বলতে কণ্ঠস্বর তিক্ত হয়ে ওঠে, স্বাধীনতার স্বাদটা কেমন, বুঝতে পারছ? এই স্বাধীনতার জন্যেই কি হাজার হাজার সোনার ছেলে জেলের ঘানি ঘুরিয়েছে, ফাঁসির দড়িতে প্রাণ দিয়েছে?

    একটু চুপচাপ।

    তারপর শেখরনাথ বলেন, চুক্তিতে সই করে, দেশটাকে কেটেকুটে স্বাধীনতা এলে তার চেহারাটা কেমন হয় তা তো দেখতেই পাচ্ছ। মুক্তি সংগ্রামীদের এত আত্মত্যাগ সব বৃথাই গেল। ক্ষোভে, বেদনায় তার গলা বুঝে এল।

    বিনয় অবাক হয়ে যাচ্ছিল। মেনল্যান্ড থেকে প্রায় হাজার মাইল দুরের এই দ্বীপপুঞ্জে থেকেও দেশের কত খবর রাখেন এই মানুষটি।

    কথায় কথায় ওরা পশ্চিম দিকের শেষ জমিটায় এসে পড়ল। এরপর গভীর জঙ্গল। সেই জঙ্গল সাফ হলে আবার কিছু উদ্বাস্তুকে ভাগ করে দেওয়া হবে।

    শেষ জমিটায় আসতেই চোখে পড়ল একটি যুবক, তিরিশের বেশি বয়স হবে না, ঢ্যাঙা, রোগাটে চেহারা, লম্বা ধরনের মুখ ধারালো বার্মিজ দা দিয়ে ঝোঁপঝাড় কাটছিল। একটা যুবতী, কপালে সিঁথিতে সিঁদুর, মাথায় ঘোমটা নেই–সেও দা দিয়ে বুনো লতা কেটে একধারে জড়ো করছে। এছাড়া আর কেউ নেই। তাদের দুজনকে নিয়েই খুব সম্ভব একটা ডি. পি (ডিসপ্লেসড) ফ্যামিলি।

    বিনয়দের দেখে যুবকটি কাছে এগিয়ে আসে। বিনয়কে সে চেনে কিন্তু শেখরনাথ তার অপরিচিত। সে হাত জোড় করে বিনয়কে নমস্কার করে, শেখরনাথের দিকে তাকায়।–আপনারে তো চিনতি ফারলাম না।

    বিনয় পরিচয় করিয়ে দিতে সে ঝুঁকে শেখরনাথের পা ছুঁয়ে উঠে দাঁড়ায়। বলে, আপনে বড় সারের কাকা। আপনেরে দেখে। বড় আনন্দ হতিচে। আমাগের নয়া কুলোনি দেখতি আসিছেন?

    মাথা নাড়িয়ে শেখরনাথ বললেন, হ্যাঁ। তারপর জিগ্যেস করলেন, তোমার নাম কী?

    ছিষ্টিধর বারুই।

    দেশ ছিল কোথায়?

    আইজ্ঞে, খুইলনে জিলা। গেরাম নেহেরপুর।

    পাকিস্তান থেকে কতদিন আগে ইন্ডিয়ায় এসেছ?

    তা হবে নে, বছর দেড়-দুই।

    ছিলে কোথায়?

    কলকেতায় এইসে ছয়-আট মাস শিয়ালদার ইষ্টিশানে। তার পরি (তারপর) কেম্পে। কেম্প থিকে বাবুরা আমাগেরে আন্ধারমান দ্বীপি আনিছে।

    শেখরনাথ কী বলতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ তার নজরে পড়ল লতাটতা কাটা বন্ধ করে বউটি বসে বসে হাঁফাচ্ছে। সে গর্ভবতী। বাচ্চার জন্ম হতে বেশি দেরি নেই। সারা মুখে দানা দানা ঘাম। ঘামে ভিজে গেছে জামা। ক্লান্তিতে তার শরীর ভেঙে পড়ছে।

    বিনয়ের মতো ওদের দুজনের সম্পর্কটা আন্দাজ করে নিয়েছিলেন শেখরনাথও। ধমকের সুরে বললেন, বউয়ের এই অবস্থা। তাকে জমিতে খাটাতে নিয়ে এসেছ? মরে যাবে যে।

    অপরাধী অপরাধী মুখ করে ছিষ্টিধর অর্থাৎ সৃষ্টিধর বলে, কী করবা নে সার? সরকারি বাবুরা বড় বড় গাছ কাটি দেছেন। ছোট ছোট জঙ্গল সাফ না করতি পারলে জমিন বারোবে (বেরুবে) ক্যামনে? ক্যাশ ডোল তো একদিন বন্ধ হয়ি যাবে। চাষবাস করতি না পারলে না খেয়ি মরতি হবে নে।

    শেখরনাথ ভীষণ রেগে গেলেন। গলার স্বর কয়েক পর্দা চড়িয়ে বললেন, আর কক্ষনো বউকে জমির কাজে লাগাবেনা। ওর এখন বিশ্রাম দরকার।

    ঢোক গিলে সৃষ্টিধর বলে, কিন্তুক সার, আমার ফেমিলিতে তো আর কেউ নাই। ক্যামন করি এত বড় জঙ্গল সাফা করব?

    পরিতোষকে বলব একটা লোক দিতে। সে-ই তোমার সঙ্গে সাফসুফ করবে। যদি বাড়তি লোক পরিতোষের হাতে না থাকে, আমিই কাজে লেগে যাব।

    লম্বা জিভ কেটে সৃষ্টিধর বলল, অমন কথা কতি নাই। আমার পাপ হবা। যা পারি আমি একাই করতি চ্যাষ্টা করব।

    এ নিয়ে আর কিছু বললেন না শেখরনাথ। জিগ্যেস করলেন, বউকে ডাক্তারবদ্যি দেখিয়েছ?

    এই জঙ্গুলি ডাক্তারবদ্যি কোয়ানে (কোথায়) পাবানে (পাব)?

    একটু ভেবে শেখরনাথ বললেন, আজ আর কাজ করতে হবে না। বউকে নিয়ে চলে যাও কোথায় থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। তোমাদের?

    দুরের ব্যারাকগুলো দেখিয়ে দিল সৃষ্টিধর। এক পলক দেখে শেখরনাথ বললেন, দেখি ডাক্তারের কী বন্দোবস্ত করা যায়।

    এতগুলো জমিতে ঘোরাঘুরি করতে করতে বেলা হেলে গেল। তিনদিকের পাহাড়ের ছায়া দীর্ঘ হচ্ছে। সূর্যটা পশ্চিম পাহাড়ের আড়ালে নেমে গেছে। সেটাকে তখন আর দেখা যাচ্ছে না।

    নীরবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন শেখরনাথ। তারপর! স্বগতোক্তির মতো বললেন, রিফিউজি সেটেলমেন্টের জনা # জেফ্রি পয়েন্টটা বাছা হল তখন একবারই এখানে এসেছিলাম। সেইসময় সবে ক্যাম্প অফিস বসেছে, ব্যারাকগুলো তৈরি হচ্ছে। পরিতোষ, লা ডিন, ধনপত পুনর্বাসন আর ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের এমন কিছু লোকজনকে পাঠানো হয়েছে। চারিদিকে চাপ চাপ জঙ্গল। এখন এসে দেখছি সেই জঙ্গলের অনেকটাই সাফ করে ফেলা হয়েছে। রিফিউজিরা এসে তাদের জমিজমা বুঝে নিচ্ছে। বলে চুপ করে গেলেন।

    জঙ্গল ধ্বংস হওয়াতে তিনি কি খুশি হননি, ঠিক এমনি বুঝতে পারল না বিনয়। কিন্তু বনভূমি নিমূল না হলে উদ্বাস্তুদের জমি দেওয়া হবে কী করে? তাদের পুনর্বাসনের পরিকল্পনাই। তো বন্ধ করে দিতে হবে।

    এখানে উত্তর দিকের জঙ্গলটাই সবচেয়ে ঘন, সবচেয়ে নিবিড়। সেটা অন্য দুধারের জঙ্গলের চেয়ে বেশি ঝাপসা হয়ে দল গেছে। তবু আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে ও দিকের বনভূমির মাথা ছাপিয়ে দুশ হাত দুরে দুরে বাঁশের তৈরি টও খাড়া হয়ে আছে। টঙগুলোকে ছুঁয়ে চলে গেছে কাল্পনিক পেরিমিটার রোড।

    ওইসব উঁচু, উঁচু মাচা বা টঙ যে বুশ পুলিশের ঘাঁটি বা ওয়াচ টাওয়ার, শেখরনাথ তা জানেন। ওখানে বসেই বুশ পুলিশের দল জারোয়াদের গতিবিধির ওপর নজর রাখে। পেরিমিটার রোডের অস্তিত্ব তার অজানা নয়। সেদিকে আঙুল বাড়িয়ে একসময় জিজ্ঞেস করলেন, যেভাবে উত্তর দিকের জঙ্গল কাটা হচ্ছে তাতে আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছে।

    বিনয় উত্তর দিতে যাচ্ছিল, তার আগেই শেখরনাথ জিজ্ঞেস করেন, তুমি কি জানো রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্টের পরিকল্পনাটা কী? বিশু তোমাকে কিছু বলেছে?

    বিনয় বলে, কীসের পরিকল্পনা?

    ওরা কি বুশ পুলিশের ঘাঁটি আর পেরিমিটার রোডের ও ধারের জঙ্গলও রিফিউজি সেটেলমেন্টের জন্যে সাফ করে ফেলবে?

    আমি জানি না। রাহা সাহেব এ নিয়ে আমাকে কিছু বলেননি।

    চিন্তাগ্রস্তের মতো শেখরনাথ বললেন, ও পাশের জঙ্গলে হাত। দেওয়া ঠিক হবে না। ওটা যেমন আছে তেমনই থাক। কেন। জানো?

    কেন? বিনয় উৎসুক হল।

    শেখরনাথ জানালেন, দক্ষিণ আন্দামানের উত্তর দিকের ওই জঙ্গলটা জারোয়াদের নিজস্ব এলাকা। পূর্ব পাকিস্তানের ছিন্নমূল মানুষজনের পুনর্বাসনের জন্য আন্দামানের আদিম বাসিন্দা জারোয়াদের উৎখাত করা খুবই অন্যায়। জঙ্গল গেলে ওদের রিহ্যাবিলিটেশন হবে কোথায়?

    শেখরনাথ বললেন, সৃষ্টিধরের জমি পর্যন্ত জঙ্গল কাটা হয়ে গেছে। এই পর্যন্তই থাক। বিশুকে বলব এধারের ফরেস্টে যেন আর হাত না পড়ে। পরক্ষণে কী যেন খেয়াল হয় তার।–কিন্তু বিশুকে বলে কিছু হবে বলে মনে হয় না। যদি ওর ওপরের অথরিটি ঠিক করে থাকে উত্তরের বনবাদাড় শেষ করে ফেলবে, আমি কিন্তু ছাড়ব না। চিফ কমিশনার আন্দামান-নিকোবরের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ হেড। আমি তার সঙ্গে দেখা করব। তাতেও যদি কাজ না হয়, ওঁর অফিসের সামনে ধর্নায় বসে যাব।

    বিনয় লক্ষ করল, শেখরনাথের মুখটা কঠিন হয়ে উঠেছে। তার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে অদম্য, জেদি সেই পুরনো বিপ্লবীটি। সে একটু ধন্দে পড়ে যায়। শেখরনাথ যা বললেন তাতে এই দ্বীপে পুনর্বাসনের পরিকল্পনা ধাক্কা খাবে। কুণ্ঠার সুরে সে। বলে, কিন্তু

    কী? উত্তর পাহাড়ের দিক থেকে চোখ সরিয়ে এনে শেখরনাথ। জিজ্ঞেস করেন।

    বহু রিফিউজি এসে গেছে। তাদের সবাইকে এখনও জমি দেওয়া হয়নি। একমাসের ভেতর আরও অনেক রিফিউজি ফ্যামিলি এসে পড়বে। তাদেরও জমি দিতে হবে। জঙ্গল সাফ না করলে এত ল্যান্ড কোত্থেকে পাওয়া যাবে?

    চোখ কুঁচকে একটু ভাবলেন শেখরনাথ। হ্যাঁ, সেটা একটা বড় সমস্যা। তবে তারও সলিউশন আছে। উত্তর দিকটা বাদ দিয়ে পুব আর পশ্চিমের জঙ্গল সাফ করা যেতে পারে। এই দুটো দিকে প্রচুর জমি বেরুবে। জারোয়ারাও নেই।

    শেখরনাথের মনোভাবটা এখন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। উদ্বাস্তুদের সম্পর্কে তার অপার সহানুভূতি, ওদিকে জারোয়াদের ওপরেও অফুরান মমতা। এখানকার জনজাতি তাদের নিজেদের বাসস্থানে চিরকাল যেভাবে থেকে এসেছে তেমনি থাক। তাদের উচ্ছেদ করলে তার ফলাফল হবে মারাত্মক। জঙ্গলে হাত পড়ায় এমনিতেই জারোয়ারা খুশি নয়, যদি উৎখাত হতে হয় তাহলে আরও হিংস্র হয়ে উঠবে।

    একদিকে উদ্বাস্তুরা থাক, অন্যদিকে জাবোয়ারা। কোনওরকম বিশৃঙ্খলা, অশান্তি যেন না ঘটে। সহাবস্থানই তার কাম্য।

    আলো ফুরিয়ে আসছে দ্রুত। কিছুক্ষণের মধ্যে ঝপ করে সন্ধে নেমে যাবে।

    শেখরনাথ বললেন, চল, ফেরা যাক।

    দুজনে দক্ষিণে ক্যাম্প অফিসের দিকে হাঁটতে লাগলেন।

    এদিকে হাতিরা এ বেলার মতো গাছের গুঁড়ি ঠেলার পর ফিরে যাচ্ছে। সঙ্গে তাদের চালকেরা। উদ্বাস্তুরাও ঝোঁপ-জঙ্গল কেটে সার বেঁধে চলেছে। এদের মধ্যে অনেক বুড়োটুড়োও রয়েছে। বয়সের ভারে নুয়ে-পড়া, গায়ের কুঁচকানো চামড়া আলগা হয়ে ঝলঝল করছে, বেজায় দুর্বল। ধুকে ধুকে তারা হাঁটছে।

    এই বয়স্ক, অশক্ত মানুষগুলোকে জমিতে কাজ করতে দেখেছেন শেখরনাথ। তখন সেভাবে লক্ষ করেননি। এখন তাদের ক্লান্ত বিধস্ত চেহারা দেখে বড় মায়া হল।

    সৃষ্টিধরকেও দেখা যাচ্ছে। সে তার গর্ভবতী বউকে ধরে ধরে নিয়ে চলেছে মেয়েটির হাঁটতে খুব কষ্ট হচ্ছে। এলোমেলো পা ফেলছে। যদি কিছুতে টক্কর লেগে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়, মহা সর্বনাশ হয়ে যাবে।   শেখরনাথ বললেন, এক জায়গা থেকে তুলে এনে এই মানুষগুলোকে বহুদুরের অচেনা দুর্গম একটা এলাকায় এনে ফেলা হল, কিছু জমিজমা দেওয়া হল। ব্যস, দায়িত্ব শেষ। বৃদ্ধেরা, প্রেগনান্ট মেয়েরা জঙ্গল সাফ করার মতো পরিশ্রমের কাজ কবে–এ কেমন কথা? এদের জন্যে কিছু একটা করতেই হবে। পুনর্বাসন বললেই পুনর্বাসন হয় না। দেশে যেভাবে তারা ছিল সেই পরিবেশ, সেই স্বাচ্ছন্দ্যটি তাদের তৈরি করে দিতে হবে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleগহনগোপন – প্রফুল্ল রায়
    Next Article শতধারায় বয়ে যায় – প্রফুল্ল রায়

    Related Articles

    প্রফুল্ল রায়

    আলোর ময়ুর – উপন্যাস – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    কেয়াপাতার নৌকো – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    শতধারায় বয়ে যায় – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    গহনগোপন – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    নিজেই নায়ক – প্রফুল্ল রায়ভ

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    ছোটগল্প – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Our Picks

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.