Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    উত্তাল সময়ের ইতিকথা – প্রফুল্ল রায়

    প্রফুল্ল রায় এক পাতা গল্প688 Mins Read0

    ২.০৭ ক্যাম্প অফিসের সামনে

    ক্যাম্প অফিসের সামনের ফাঁকা মাঠটায় বিনয়রা যখন ফিরে এল, সন্ধে নামতে শুরু করেছে। অন্যদিনের মতোই উদ্বাস্তুরাও চলে এসেছিল। শ্রান্ত শরীর ছেড়ে দিয়ে তারা বসে পড়েছে। নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল। এলোমেলো, অসংলগ্ন। চারদিক থেকে ভনভনানির মতো গুঞ্জন উঠছে। এর মধ্যে পুনর্বাসনের কর্মীরা বড় বড় লণ্ঠন আর হ্যাঁজাক জ্বালিয়ে দিয়েছে। আলোর ভরে গেছে চারদিক।

    জমি সাফাইয়ের কাজ করে এসে এই সময়টা খানিকক্ষণ জিরিয়ে নেয় উদ্বাস্তুরা। তারপর সমুদ্র থেকে হাতমুখ ধুয়ে আসে। আজও তা-ই করল তারা।

    দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে এতক্ষণ একটানা খাটাখাটনির পর খিদেও পায় জবর। পেটে আগুন জ্বলতে থাকে। খাবারের ব্যবস্থাও অবশ্য রয়েছে-চিড়ে, গুড় আর চা। পুনর্বাসনের একদল কর্মী সেসব নিয়ে তৈরিই ছিল।

    বিশ্বজিৎ পোর্ট ব্লেয়ারে চলে পেছেন। যে দুটো দিন ছিলেন, এখানকার কলোনাইজেশন অ্যাসিস্টান্ট একটা খাপের ভেতর যেন গুটিয়ে ছিল। এখন সে এই সেটেলমেন্টের হর্তাকর্তা। তার চেহারাটাই পালটে গেছে। হাঁকডাক করে উদ্বাস্তুদের চিঁড়েটিড়ে দেবার ব্যবস্থা করতে লাগল।

    রাতে খাওয়ার সময় আরও ঘণ্টা দুই পর। তখন দেওয়া হয় রুটি, তরকারি আর দুধ।

    উদ্বাস্তুরা খেতে খেতে গল্প করছিল। বিনয় আর শেখরনাথ এক গেলাস করে চা নিয়ে এসে অল্প অল্প চুমুক দিতে দিতে কথা বলছিলেন। তবে শেখরনাথের নজর ছিল পরিতোষের দিকে। খাবারটাবার বিলি হলে তিনি হাত নেড়ে তাকে ডাকলেন।

    শেখরনাথ শুধু বিশ্বজিৎ রাহার কাকাই নন। কতটুকু সময়ই বা তাঁকে দেখেছে বিনয়। তবে তাঁর সম্বন্ধে অনেক কিছুই শুনেছে। ব্রিটিশ আমলের দুর্ধর্ষ বিপ্লবী আন্দামান দ্বীপমালার একজন লিজেন্ড। রূপকথার নায়কই বলা যায়। তাঁকে এখানকার মানুষজন শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে।

    পরিতোষ একরকম দৌড়েই চলে এল।–আমারে কিছু কইবেন কাকা। বিশ্বজিতের কাকা, সেই সম্পর্কের সুতো ধরে সে তাঁকে কাকাই বলে। খুব সম্ভব এখানকার সকলেই তা-ই। বিনয়ও ঠিক করে ফেলল সেও শেখরনাথকে কাকা বলবে। তাতে মানুষটিকে অনেক নিবিড়, অনেক আপন করে পাওয়া যাবে।

    শেখরনাথ পরিতোষকে বললেন, তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে। এক এক করে বলি।

    দুচোখে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে রইল পরিতোষ। সেই সঙ্গে একটু শঙ্কাও। শঙ্কার হেতুটা এইরকম। সে জানে, শেখরনাথ এই দ্বীপপুঞ্জের ক্ষমতাবান কোনও আমলা নন, নন হর্তাকর্তাবিধাতা। কিন্তু তার চেয়েও অনেক বড়। এখানকার আদিম জনজাতি ওঙ্গে, জারোয়া, সেন্টিনালিস বা গ্রেট আন্দামানিসদের এতটুকু ক্ষতি বা উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনে সামান্য গাফিলতি হোক, তিনি তা রেয়াত করবেন না। প্রাক্তন বিপ্লবী এই দ্বীপপুঞ্জের চিফ কমিশনার, ডেপুটি কমিশনারদের গ্রাহ্য করেন না। তেমন কোনও ঘটনা ঘটলে তুলকালাম কাণ্ড বাধিয়ে ছাড়বেন।

    শেখরনাথ বললেন, রিফিউজিদের এখন তো চিড়ে, গুড় আর চা দিলে। সকালে দুপুরে আর রাত্তিরে কী দাও?

    পরিতোষ জানায়, সকালের খাবার হল রুটি-তরকারি বা খিচুড়ি, দুপুরে ভাত ডাল তরকারি। রাত্তিরে আবার রুটি তরকারি এবং ইউরোপ আমেরিকা থেকে আসা পাউডার মিল্ক গুলে এক গেলাস করে দুধ।

    শেখরনাথ বললেন, রিফিউজিগুলোর চেহারা দেখেছ? হাড্ডিসার, সারাক্ষণ ঝুঁকছে। কলকাতার রিলিফ ক্যাম্প আর শিয়ালদা স্টেশনের চত্বর থেকে আধমরা হয়ে এসেছে। এখানে। এসে জঙ্গল সাফ করার অত খাটুনি, তার ওপর এই রাজভোগ খাওয়াচ্ছ। জমি বার করে ধান ফলাতে ফলাতে এদের ভবসাগর পাড়ি দেওয়াবার চমৎকার ব্যবস্থা করেছ দেখছি।

    পরিতোষ ভ্যাবাচাকা খেয়ে যায়। শেখরনাথ যা বললেন, মোটামুটি তা বুঝতে পারছে। ঢোক গিলে জড়ানো, আবছা গলায় কিছু একটা বলতে চাইল। তার একটি বর্ণও বোঝা গেল না।

    শেখরনাথ কণ্ঠস্বর উঁচুতে তুলে বললেন, নিউট্রিশন নিউট্রিশন বোঝো? এদের পুষ্টিকর ভালো খাবারদাবার দরকার। নইলে একদিন দেখবে সেটেলমেন্টটা আছে, মানুষগুলো নেই।

    ভয়ে ভয়ে পরিতোষ বলে, রিফিউজিগো খাওয়ানের লেইগা যে টাকা স্যাংসন হইছে হেয়াতে (তাতে) এইর বেশি কিছু দেওন (দেওয়া সম্ভব না।

    বিদ্রুপের সুরে শেখরনাথ বলেন, যারা স্যাংশন করেছেন তাঁদের ঘাড় ধরে এখানে এনে দশ দিন এই নবাবি খানা খাওয়াও। বুঝুক রিফিউজিদের জন্যে কী ব্যবস্থা করেছে। ক্রুয়েলটির সীমা থাকা দরকার। কেন, সমুদ্রে মাছ নেই? দশবার জাল ফেললে এক মন মাছ উঠে আসবে। সেটা তো আর পয়সা দিয়ে কিনতে হচ্ছে না। সেই মাছ ওদের খাওয়াও। ম্যাল-নিউট্রিশনে আর ভুগবে না।

    কিন্তুক

    কপাল কুঁচকে গেল শেখরনাথের কীসের কিন্তুক?

    মাছ রন্ধনের কেও নাই। এহানে যারা রান্ধে হেরা (তারা) বিহার, ইউ পির লোক, দুই চাইরজন বার্মিজও আছে।

    বাঙালি রাঁধুনি রিক্রুট কর।

    আমি ছুটোখাটো এমপ্লয়ি! হেই খ্যামতা আমার নাই।

    ঠিকই বলেছে পরিতোষ। তার মতো একজন সামান্য কলোনাইজেশন অ্যাসিস্টান্ট কারও চাকরিবাকরি দিতে পারে না। একটু চুপ করে থেকে শেখরনাথ বললেন, এই ব্যাপারে বিশুর সঙ্গে আমি কথা বলব। এবার আমার দুনম্বর কথাটা শোন। জমিগুলো ডিস্ট্রিবিউট করা হয়েছে, সেসব জায়গায় ঘুরে ঘুরে কী চোখে পড়ল জানো?

    পরিতোষ তাকিয়ে থাকে, কোনও প্রশ্ন করে না।

    শেখরনাথ বলতে লাগলেন, প্রেগনান্ট বউ, বৃদ্ধের দল, ছোট ছোট বাচ্চা পর্যন্ত জঙ্গল সাফ করছে। এই পরিশ্রমের কাজ কি ওদের পক্ষে সম্ভব? জোয়ান ছেলেমেয়েরা করুক– ঠিক আছে। কিন্তু গর্ভবতী মেয়ে বা বুড়ো আর বাচ্চাদের দিয়ে এ কাজ করানো চলবে না। রিফিউজিদের মধ্যে যারা শক্তসমর্থ আছে তাদের সঙ্গে তোমাদের রিহ্যাবিলিটেশনের লোকজন দাও। তারাও হাত লাগাক।

    হেইটা (সেটা) তো দিতে পারুম না কাকা।

    কেন? শেখরনাথের স্বর রুক্ষ হয়ে ওঠে।

    উপুর (ওপর) থিকা ঠিক কইরা দেওয়া আছে বড় বড় মোটা গাছগুলান হুদা (শুধু আমরা কাইটা দিমু। বাকি হগল (সকল) সাফসুতরা করব রিফুজিরা। হেয়া (তা) ছাড়া এহানে ওয়ার্কার এত কম যে অন্য কাম সাইরা জমিনে পাঠান যাইব না।

    হু, তোমার সমস্যাটা বুঝতে পারছি। দেখা যাক, কী করা যায়। এবার আরেকটা কথা শোন– এখানে প্রেগনান্ট মেয়ে আমি একজনকেই দেখেছি। নিশ্চয়ই আরও কেউ কেউ আছে। শুনলাম এখানে কোনও ডাক্তার নেই।

    আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে পরিতোষ। –না

    শেখরনাথ জিজ্ঞেস করেন, এদের যখন ডেলিভারি হবে, কে দেখবে! তাছাড়া যে রিফিউজিরা এসেছে, এবং আরও আসছে, তারা কেউ অজর অমর নয়, লোহার শরীর নিয়েও কেউ আসেনি, আসবে না। তাদের অসুখ-বিসুখ হলে বিনা চিকিৎসায় পোকার মতো মরবে? তোমাদের রাহাসাহেব কি তার কর্তারা সেটেলমেন্টে ওষুধপত্র, ডাক্তার পাঠানোর কথা ভাবেনি? মুখ নিচু করে পরিতোষ বলল, আমি ঠিক জানি না। ওদের ভাবা উচিত ছিল। এতগুলো মানুষের জীবন-মরণের ব্যাপার। আমি কয়েকদিন পর পোর্ট ব্লেয়ারে যাচ্ছি। বিশুদের ছাড়ব না। রিফিউজি বলে ওদের জীবনের কোনও দাম নেই? এটা শিয়ার ক্যালাসনেস। সিরিয়াস কিছু ঘটে গেলে কী হবে?

    পরিতোষ চুপ করে থাকে।

    শেখরনাথ বললেন, আরেকটা ইমপর্টান্ট কথা আছে। তোমরা উত্তর দিকে কতদূর পর্যন্ত জঙ্গল কাটার প্ল্যান করেছ?

    শেখরনাথ সেটেলমেন্টের নানা বিষয়ে যেভাবে অসন্তোষ প্রকাশ করছেন তাতে মনে হয়, জঙ্গল কাটার ব্যাপারে তার আপত্তি বা ক্ষোভ থাকতে পারে। ভয়ে ভয়ে পরিতোষ জানায়, আপাতত বুশ পুলিশের উঁচু টংগুলো পর্যন্ত বনভূমি সাফ করা হবে। তবে আরও উদ্বাস্তু মেনল্যান্ড থেকে এসে পড়লে টংগুলোর ওধারে আরও মাইলখানেক জঙ্গল কাটার পরিকল্পনা আছে।

    পরিতোষ বলল, উই ব্যাপারটা আমিন আর চেনম্যানরা ভালো জানে।

    আমিন লা ডিন, হেড চেনম্যান ধনপত এবং পুনর্বাসন দপ্তরের বেশ কয়েকজন কর্মী বেশ খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিল। শেখরনাথ হাত নেড়ে তাদের ডাকলেন।

    শশব্যস্ত লা ডিনরা দৌড়ে এল। শেখরনাথ বললেন, এসব কী শুনছি–আঁ?

    তিনি কী শুনেছেন, লা ডিনরা কেমন করে জানবে? হতভম্বের মতো তারা তাকিয়ে থাকে।

    পরিতোষ যা বলেছে, সব জানিয়ে শেখরনাথ জিগ্যেস করলেন, তার মানে তোমরা জারোয়াদের এলাকা দখল করতে চাও? তার চোখেমুখে অসীম বিরক্তি ফুটে বেরয়।

    শেখরনাথের যে এ নিয়ে তীব্র আপত্তি রয়েছে সেটা আঁচ করতে পারছিল লা ডিন এবং তার সঙ্গীরা। লা ডিন ঢোক গিলে বলল, আমাদের ওপর অ্যায়সাই হুকুম হ্যায়। হামলোগ হুকুম কা নৌকর চাচাজি। শেখরনাথ খুব সম্ভব এই দ্বীপপুঞ্জের বাসিন্দাদের সার্বজনীন চাচাজি অথবা কাকা। লা ডিনরা যে নিরুপায় তা বুঝতে পারছিলেন শেখরনাথ। স্বাধীনভাবে নিজেদের বুদ্ধি বিবেচনা অনুযায়ী কিছু করার উপায় নেই। সেদিক থেকে হাত-পা বাঁধা। মাথার ওপর যে অফিসাররা রয়েছেন তাঁরা যা বলবেন সেটাই তামিল করতে হবে।

    শেখরনাথ বললেন, তা হলে পেরিমিটার রোড আর বুশ পুলিশের ক্যাম্পগুলোর কী হবে?

    ঘোর জঙ্গলের ভেতর পেরিমিটার রোড হল একটা কাল্পনিক বিভাজন রেখা। তার ওধারে থাকবে এখানকার আদিম জনজাতি, এধারে অন্য মানুষজন।

    ভয়ে ভয়ে লা ডিন বলল, জঙ্গল কাটা হলে পেরিমিটার রোড আর বুশ পুলিশের ক্যাম্পগুলো পিছিয়ে দেওয়া হবে।

    একটা কথা ভেবে দেখেছ?

    জি?

    এমনিতেই এদিকে বাইরের লোকজন আসায় জারোয়ারা খেপে রয়েছে। নইলে সেদিন সেটেলমেন্টে হামলা করত না। তার ওপর যদি এখানকার পেরিমিটার রোডের ওধারের জঙ্গল কাটা পড়ে ওদের এলাকা আরও কমে যাবে। এটা ঠিক নয়। এতে ওরা আরও খেপে যাবে।

    লেকেন চাচাজি

    কী?

    আমরা ছোটামোটা সরকারি নৌকর। আমরা কী করতে পারি?

    একটু চুপচাপ।

    তারপর শেখরনাথ বললেন, আচ্ছা, পুব আর পশ্চিম দিকে তো এখনও অনেক জঙ্গল রয়েছে।

    জি

    ওই দুধারের জঙ্গল কেটে কিছু জমি বার করে তো রিফিউজিদের বিলি করা হয়েছে। প্রচুর জমি বেরুবে ওই দুটো দিক থেকে। পুব-পশ্চিমের জঙ্গল সাফা কর। উত্তরটা বাদ দাও।

    লেকিন চাচাজি, রাহাসাহেব উত্তর দিকের কাম খতম করে ফির পুব-পশ্চিম হাত লাগাতে বলেছেন। উনি আমার উপরবালা–বলতে বলতে থেমে গেল লা ডিন।

    ধনপতও সায় দিল, জি চাচাজি। লা ডিন ঠিকই বলছে।

    আমি তোমাদের রাহাসাহেবের সঙ্গে কথা বলব। সে যদি রাজি না হয় তখন দেখা যাবে। ততদিন তোমরা পুব-পশ্চিমের জঙ্গল থেকে জমি বার কর।

    লা ডিন মুখ চুন করে বলল, লেকিন

    তার মনোভাবটা আঁচ করে নিয়ে শেখরনাথ বললেন, তোমাদের রাহাসাহেব রেগে যাবে, তা-ই তো?

    লা ডিন চুপ করে রইল।

    শেখরনাথ বললেন, ওর ব্যাপারটা আমি সামলাব। ভয় পেও না।

    অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাজি হতে হল লা ডিন এবং তার সঙ্গীদের।

    জি

    বিশ্বজিতের ঘরে তিন দিন একা কাটিয়েছে। শেখরনাথকে এই ঘরেই থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হল। যে খাটে বিশ্বজিৎ শুতেন, তিনিও সেখানেই শোবেন। সঙ্গেকরে শেখরনাথ বিশেষ কিছুই আনেননি, একটা ঝোলায় পুরে খান তিনেক মোটা সুতোর ধুতি আর সাদামাঠা টুইলের ফুলশার্ট এবং দাড়ি কামানোর ক্ষুর, সাবান, ছোট আয়না আর সস্তা চিরুনি।

    রাত্তিরে রিফিউজিদের সঙ্গে খাওয়াদাওয়া সেরে শেখরনাথ বিশ্বজিতের ঘরে চলে এলেন। সঙ্গে বিনয়।

    পুনর্বাসন দপ্তরের কর্মীরা সন্ধে নামতে না নামতেই দুটো লণ্ঠন জ্বালিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। মশা এবং পোকা-মারা ধূপও জ্বলছে ঘরের কোনায় কোনায়। উগ্র ঝাঝালো গন্ধে ভরে গেছে ঘরের বাতাস।

    শেখরনাথ তাঁর পোশাক পালটে লুঙ্গি আর হাফহাতা ফতুয়া ধরনের একটা জামা পরে নিলেন। বিশ্বজিতের খাটটায় বসে বললেন, বিশুর কাছে শুনেছি, রাত্তিরে তুমি তোমাদের পেপারের জন্যে রিপোর্ট লেখা শুরু করে দাও। আমি কথা বলে ডিসটার্ব করব না।

    বিনয় উত্তর দিতে যাচ্ছিল, সেই সময় বাইরে থেকে গান ভেসে এল। তার সঙ্গে সারিন্দা আর দোতারার সুর। অন্য দিনের মতোই ব্যারাক দুটোর সামনের ফাঁকা মাঠে যে বাঁশের মঞ্চ বাঁধা হয়েছিল সেখানে গানবাজনার আসর বসেছে। হ্যাঁজাকের তেজি আলোয় ভরে গেছে ওদিকটা। উদ্বাস্তুরা তাদের ঘিরে বসেছে।

    হরিপদই শুধু নয়, ছিন্নমূল যে মানুষগুলো বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপে চলে এসেছে তাদের মধ্যে আরও কয়েকজন চমৎকার গাইতে পারে। আজ গাইছে মাঝবয়সি হারাধন বিশ্বাস। রোজ শুনতে শুনতে কণ্ঠস্বরগুলো চেনা হয়ে গেছে বিনয়ের।

    হারাধন গাইছিল–

    জল ভরে সুন্দরী গো কইন্যা জলে দিয়া ঢেউ
    হাসি মুখে কও না কথা হায় রে,
    সঙ্গে নাই মোর কেউ রে
    পরান আমার যায় যায় রে-
    কঠিন তোমার মাতাপিতা কঠিন তোমার হিয়া
    এমন যৈবনকালে হায় রে
    না করাইছে বিয়া রে
    পরান আমার যায় যায় রে
    লজ্জা নাই রে নিলাজ ঠাকুর
    লজ্জা নাই রে তর
    গলায় কলস বাইন্ধা হায় রে
    জলে ডুইবা মর রে
    পরান আমার যায় যায় রে
    কইবা পাইবাম কলস গো কইন্যা
    কইবা পাইবাম দড়ি
    তুমি হও গহিন গাঙ হায় রে–
    আমি ডুইবা মরি
    পরান আমার যায় যায় রে—

    জানালার বাইরে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন শেখরনাথ। বললেন, কত কাল পর পূর্ববাংলার গান শুনছি। প্রাণমন ভরে যাচ্ছে। কী দরদ দিয়ে যে গাইছে লোকটা! আহা–

    রাজদিয়ায় থাকতে এই ধরনের গান যুগলই প্রথম শুনিয়েছিল বিনয়কে। তারপর আরও কতজনের মুখেই না শুনেছে সে। মাঝি-মাল্লা বৈরাগী যাত্রাদলের গায়ক–এমনি অনেক। কলকাতায় আসার পর জীবনের ওপর দিয়ে কত ঝড়ঝাঁপটা গেছে। ঝিনুক যখন নিরুদ্দেশ ইল, মনে হয়েছিল আকাশ যেন খানখান হয়ে ভেঙে পড়েছে। হৃদয় জুড়ে তখন শুধুই ক্ষত। চূর্ণবিচূর্ণ বিনয় উদভ্রান্তের মতো ঝিনুককে খুঁজে বেড়াচ্ছে কলকাতার অলিগলিতে, জনারণ্যে, চারদিকের রিফিউজি কলোনিগুলোতে। জীবন থেকে পূর্ববাংলার সেইসব মায়াবী স্বপ্নের গান বিলীন হয়ে গিয়েছিল।

    বহুকাল পর এই সেদিন, বিশ্বজিৎ তখন এখানে, জেফ্রি পয়েন্টের এই উদ্বাস্তু কলোনিতে আসার পর হরিপদর গান শুনে মনে হয়েছিল পূর্বজন্মের স্মৃতি আবার ফিরে এসেছে। তারপর থেকে রোজ গানবাজনার আসর বসে। হরিপদ হারাধন মোহনর্বাশি–এরা সবাই পাহাড় অরণ্য সমুদ্রে ঘেরা এই দ্বীপে। কিছুক্ষণের জন্য হলেওজাদুকরের মতো পূর্ববাংলার সজল কোমল মায়াময় ভূখণ্ডটিকে নামিয়ে আনে।

    শেখরনাথ আপ্লুত। বললেন, লোকগুলোর কী এনার্জি, কী প্রাণশক্তি, দেখেছ। সারাদিন জঙ্গল কেটেছে, তারপর কোথায় খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়বে, তা নয়। গানের আসর বসিয়ে দিয়েছে।

    এসব তো আগেই দেখেছে বিনয়। কিছু বলল না। শুধু একটু হাসল।

    শেখরনাথ বলতে লাগলেন, দূর থেকে শুনে জুত হচ্ছে না। যাই, আসরে গিয়ে ওদের পাশে বসি। তিনি চলে গেলেন।

    বিনয় অবাক বিস্ময়ে কিছুক্ষণ বসে থাকে। শেখরনাথ উদ্বাস্তুদের এনার্জির কথা বলেছেন। কিন্তু তাঁর নিজের? সেই পোর্ট ব্লেয়ার থেকে পাহাড়ের পর পাহাড় পেরিয়ে, দুর্গম বনজঙ্গল ভেদ করে সেটেলমেন্টে এসেছেন। এসেই ছুটেছেন জমি বিলি দেখতে। ঠায় এক জায়গায় কি দাঁড়িয়ে থেকেছেন? হেঁটে হেঁটে একরের পর একর জমি ঘুরে ঘুরে দেখেছেন। উদ্বাস্তুদের ডেকে ডেকে আলাপ করেছেন, তাদের সুবিধা অসুবিধার খোঁজখবর নিয়েছেন। তারপর এই রাত্রিবেলা ছুটলেন কাছাকাছি বসে গান শুনতে। এই বয়সেও প্রাক্তন এই স্বাধীনতা-সংগ্রামীর কী অফুরান প্রাণশক্তি! একসময় টেবলের দেরাজ খুলে কাগজ কলম বার করে লিখতে শুরু করল বিনয়।

    বঙ্গোপসাগরের এই সৃষ্টিছাড়া দ্বীপে অবিরল হারাধনের সুরের ইন্দ্রজাল ছড়িয়ে পড়ছে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleগহনগোপন – প্রফুল্ল রায়
    Next Article শতধারায় বয়ে যায় – প্রফুল্ল রায়

    Related Articles

    প্রফুল্ল রায়

    আলোর ময়ুর – উপন্যাস – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    কেয়াপাতার নৌকো – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    শতধারায় বয়ে যায় – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    গহনগোপন – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    নিজেই নায়ক – প্রফুল্ল রায়ভ

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    ছোটগল্প – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Our Picks

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.