Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    উত্তাল সময়ের ইতিকথা – প্রফুল্ল রায়

    প্রফুল্ল রায় এক পাতা গল্প688 Mins Read0

    ২.১২ আনন্দটা ক্ষণস্থায়ী

    আনন্দটা কিন্তু ক্ষণস্থায়ী। দুদিন কাটতে না কাটতেই জারোয়ারা মারাত্মক কাণ্ড ঘটিয়ে দিল।

    আজ সকালে অন্য দিনের মতোই জমিতে গিয়েছিল উদ্বাস্তুরা। উত্তর-পূর্ব দিকে মোহনবাঁশি কর্মকার তার বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে তার জমির জলডেঙ্গুয়ার ঝাড় সাফ করছিল। আচমকা ওধারের জঙ্গল ফুড়ে, বুশ পুলিশের নজর এড়িয়ে এক দঙ্গল কালো কালো জারোয়া তির-ধনুক নিয়ে হানা দিল। বেশ কয়েকদিন আগে, বিশ্বজিৎ তখন জেফ্রি পয়েন্টে ছিলেন, জারোয়ারা মাঝরাতে হামলা চালিয়েছিল। আজ একেবারে প্রকাশ্য দিবালোকে।

    অদ্ভুত আওয়াজ করে, দুর্বোধ্য ভাষায় গজরাতে গজরাতে তারা এলোপাতাড়ি তির ছুঁড়তে থাকে। চোখেমুখে তাদের প্রচণ্ড আক্রোশ।

    তিরগুলো এধারে ওধারে উড়ে যাচ্ছিল। তবে একটা এসে লাগল মোহনবাঁশির বুকের ডান পাশে। চারপাশের জমিতে যারা কাজ করছিল তারা তুমুল হুলস্থুল বাধিয়ে দিল। সবাই আতঙ্কগ্রস্ত। কেউ কেউ উদভ্রান্তের মতো ক্যাম্পের দিকে দৌড়াতে থাকে। ওদিকে বুশ পুলিশও পেরিমিটার রোডের উঁচু উঁচু টঙ থেকে জারোয়াদের দেখতে পেয়েছিল। তারা টিন বাজাতে বাজাতে তুমুল হইচই বাধিয়ে দেয়। সেই সঙ্গে আকাশের দিকে বন্দুক তুলে ফায়ার করতে থাকে।

    লহমায় জারোয়ারা গভীর জঙ্গলে উধাও হয়ে যায়। বিনয় আর শেখরনাথ উত্তর দিকের একটা জমিতে ছিলেন। বহু মানুষের চিৎকার শুনে দৌড়ে মোহনবাঁশিদের কাছে চলে আসেন। ওদিকে জমি মাপামাপি বন্ধ করে লা ডিনরা দৌড়ে এসেছে।

    মোহনবাঁশির বুকে তিরটা অনেকখানি ঢুকে গেছে। সে বেহুঁশ মাটিতে পড়ে আছে। তিরের ফলার পাশ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত বেরিয়ে আসছে। তাকে ঘিরে তার বউ ছেলেমেয়েরা উন্মাদের মতো কাঁদছে। আর জড়ানো জড়ানো গলায় তার বউ বলে যাচ্ছে, ক্যান যে আন্ধারমান দ্বীপি আইছিলাম। মানুষটার পরানডা গেল! এই আছিল আমাগো কপালে!

    ছেলেমেয়ে দুজনেই রুদ্ধশ্বাসে একটানা বলে যাচ্ছিল, বাবা, চৌখ মেইলা তাকাও। চৌখ মেল–

    শেখরনাথ পলকহীন মোহনবাঁশিকে লক্ষ করছিলেন। বুঝতে পারছেন, তিটা টানাটানি করে খুলতে গেলে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে আসবে। জেফ্রি পয়েন্টের তো প্রশ্নই নেই, আশপাশে কোথাও ডাক্তার নেই। দ্রুত মোহনবাঁশির নাকের তলায় হাত রাখলেন তিনি। তির তির করে নিঃশ্বাস পড়ছে। তার মানে লোকটা বেঁচে আছে।

    ওদিকে হইচই শুনে ক্যাম্পের দিক থেকে পরিতোষ এবং পুনর্বাসনের কর্মীরা দৌড়ে এসেছিল।

    শেখরনাথ সংক্ষেপে ঘটনাটা জানিয়ে দিয়ে ব্যস্তভাবে বললেন, মোহনবাঁশিকে বাঁচাতে হলে এক্ষুনি পোর্ট ব্লেয়ারের হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। মালপত্র নিয়ে যে লরিটা এসেছিল সেটা কি ফিরে গেছে?

    পরিতোষ বলল, হে তো আপনেরা যেইদিন উইধারের সেটেলমেন্টে গ্যাছিলেন হেইদিনই বিকালে চইলা গ্যাছে।

    সর্বনাশ। এখন উপায়? বলতে বলতে হঠাৎ কিছু খেয়াল হল শেখরনাথের।

    -আরে, ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের ট্রাক দুটো তো রয়েছে। তার একটায় তুলে মোহনবাঁশিকে নিয়ে যাব।

    কিন্তুক

    শেখরনাথ বিরক্ত হলেন।-কীসের কিন্তু?

    পরিতোষ ভয়ে ভয়ে জানায়, একটা লরি গাছের গুঁড়ি দিয়ে বোঝাই করা হয়েছে। আরেকটায় হাতি দিয়ে ভোলা হচ্ছে। সেটা ভর্তি হতে হতে বিকেল হয়ে যাবে। তারপর ট্রাক দুটো রওনা হবে ব্যাম্বু ফ্ল্যাটের দিকে। মাল খালাস করে ফিরে আসতে আসতে পরশু।

    শেখরনাথ ধমকে উঠলেন, পরশু অবধি মোহনবাঁশি তির বেঁধা অবস্থায় পড়ে থাকবে? ওকে বাঁচানো যাবে? এক্ষুনি গিয়ে আমার নাম করে বল, যেটা এখনও ভর্তি হয়নি সেটায় গুঁড়ি তোলা বন্ধ রাখুক। যা তোলা হয়েছে নামিয়ে ফেলুক। ওই ট্রাকটায় আমরা মোহনবাঁশিকে নিয়ে যাব।

    পরিতোষ ঊৰ্ধশ্বাসে ছুটে গেল।

    .

    ঘণ্টা দেড়েক বাদে একটা লম্বা পুরু চট দুভাজ করে তার ওপর মোহনবাঁশিকে খুব সাবধানে শুইয়ে ট্রাক দৌড় শুরু করল। শেখরনাথ তো গেলেনই, তার সঙ্গে বিনয়ও গেল। মোহনবাঁশির ছেলেমেয়ে বউ ট্রাকে উঠে পড়েছে। তারা মোহনবাঁশিকে ঘিরে বসেছে; তাকে অন্যের হাতে ছেড়ে দিতে ওদের খুব সম্ভব ভরসা নেই। কেঁদে কেঁদে সবার গলা ভেঙে গেছে। মোহনবাঁশিকে ট্রাক থেকে ওঠানোনামানোর জন্য পুনর্বাসনের কর্মীকেও সঙ্গে নেওয়া হয়েছে।

    ড্রাইভারের পাশে ফ্রন্ট সিটে বসেছেন শেখরনাথ। জানালার ধারে বিনয়।

    শেখরনাথ ড্রাইভারকে তাড়া দিচ্ছিলেন।জোরে চালিয়ে যত তাড়াতাড়ি পার আমাদের ব্যাম্বু ফ্ল্যাটে পৌঁছে দাও। পেছন ফিরে পুনর্বাসনের কর্মীদের বারবার সতর্ক করে দিচ্ছিলেন, তারা যেন শক্ত করে মোহনবাঁশিকে দুদিক থেকে ধরে রাখে। গাড়ির ঝাঁকুনিতে তির যদি তার বুকের আরও গভীরে ঢুকে যায়, মোহনবাঁশিকে হয়তো বাঁচানো যাবে না।

    বেলা যখন অনেকখানি হেলে পড়েছে সেই সময় ট্রাক ব্যাম্বু ফ্ল্যাটে এসে গেল। জেটিতে একটা লঞ্চ দাঁড়িয়ে ঘন ঘন ভো দিচ্ছিল। খুব শিগগিরই ছেড়ে দেবে।

    লঞ্চটা বিনয়ের খুবই চেনা-সিগাল। এই জলযানেই কয়েকদিন আগে পোর্ট ব্লেয়ার থেকে দেড়শো উদ্বাস্তু ফ্যামিলি এবং বিশ্বজিতের সঙ্গে সে জেফ্রি পয়েন্টে গিয়েছিল।

    শেখরনাথরা নেমে পড়লেন। পুনর্বাসনের কর্মীরা শক্ত করে চটের চার কোনা ধরে মোহনর্বাশিকে নামিয়ে আনল। তাদের পেছন পেছন নামল মোহনর্বাশির বউ ছেলেমেয়েরা।

    শেখরনাথ ট্রাকের ড্রাইভারকে জেফ্রি পয়েন্টে ফিরে যেতে বলে একরকম দৌড়ে গিয়েই টিকেট কেটে ফেললেন। তারপর সবাই লঞ্চে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে সিগাল লম্বা ভো দিয়ে চলতে শুরু করল।

    লঞ্চে বেশ ভিড় ছিল। বিশ্বজিতের সঙ্গে উদ্বাস্তুদের নতুন সেটেলমেন্টে যাবার সময় যেমন বর্মি কারেন শিখ এমনি ইন্ডিয়ার নানা প্রভিন্সের প্যাসেঞ্জার দেখা গিয়েছিল, এখনও ঠিক তেমনটাই চোখে পড়ল। বিনয় আন্দাজ করে নিল এদের বেশিরভাগই ব্রিটিশ আমলের কয়েদি। কালাপানির সাজা খাটতে আন্দামানে এসেছিল। মুক্তি পাওয়ার পর স্বাধীন ভারতের নাগরিক। শেখরনাথকে দেখে তারা অনেকে এগিয়ে এসে সসম্ভ্রমে মাথা ঝুঁকিয়ে বলে, আদাব চাচাজি, কেউ বলে, নমস্তে–মোহনবাঁশিকে ডেকে শুইয়ে রাখা হয়েছিল। তার দিকে তাকিয়ে প্রাক্তন কয়েদিরা খুব একটা অবাক হল না।

    একজন মোহনবাঁশিকে দেখিয়ে শেখরনাথকে জিগ্যেস করল, জরুর পাকিস্তানকা রিফিউজি-হ্যায় না চাচাজি? উদ্বাস্তুদের চেহারায় মার্কামারা একটা ছাপ থাকে, এতদিনে এখানকার পেনাল সেটেলমেন্টের পুরানো বাসিন্দারা তা চিনে ফেলেছে।

    শেখরনাথ আস্তে মাথা নাড়লেন, হ্যাঁ।

    গভীর জঙ্গলের খাঁজে কোথায় কোথায় উদ্বাস্তুদের উপনিবেশ গড়ে উঠছে, কোথায় জারোয়ারা তাদের পড়োশি, এবং এই আদিম জনজাতিটি কতটা হিংস্র, সব তাদের জানা। লোকটি বলল, জরুর জারোয়ারা তির মেরেছে!

    এবারও শেখরনাথ আস্তে মাথা নাড়েন।-হ্যাঁ।

    ওহি জংলি লোগ বহুৎ খতরনাক। রিফিউজিদের হেঁশিয়ারি থাকা দরকার। বলে লোকটা জানতে চাইল, তার এবং তার সঙ্গীদের কোনওরকম সাহায্যের প্রয়োজন আছে কি না?

    শেখরনাথ জানালেন, প্রয়োজন নেই। তার সঙ্গে লোক আছে। বেশিক্ষণ লাগল না; মিনিট পনেরোর ভেতর সিগাল উপসাগর পেরিয়ে ও পারে পোর্ট ব্লেয়ারের চ্যাথাম জেটিতে গিয়ে ভিড়ল।

    তড়বড় করে অন্য প্যাসেঞ্জাররা নেমে যাবার পর শেখরনাথদের সঙ্গে পুনর্বাসনের যে কর্মীরা এসেছিল, ধরাধরি করে তারা মোহনবাঁশিকে নামিয়ে জেটিতে শুইয়ে দিল। জানতে চাইল, এবার কী করতে হবে।

    শেখরনাথ বললেন, এখান থেকে হাসপাতালে যেতে হলে একটা গাড়ির ব্যবস্থা করতে হবে। তোমরা একটু বসো। দেখি কোথায় পাওয়া যায়–

    জেটির বাইরের রাস্তায় ছোট ছোট প্রাইভেট শিপিং কোম্পানির দু-তিনটে অফিস। শেখরনাথ বিনয়কে সঙ্গে করে সেখানে চলে এলেন।

    শেখরনাথকে এইসব কোম্পানির লোকেরা ভালোই চেনে। শ্রদ্ধাও করে। একটা অফিস থেকে জানানো হল, তাদের একটা জিপ এবং একটা ভ্যান কিছুক্ষণ আগে বেরিয়ে গেছে। বিব্রতভাবে ম্যানেজার বলল, কাকা, এখন কিছুই দিতে পারছি না। দু ঘণ্টা পর গাড়ি দুটো ফিরলে নিশ্চয়ই দেব।

    শেখরনাথ জানালেন, যে মারাত্মকভাবে জখম লোকটিকে জেফ্রি পয়েন্ট থেকে নিয়ে আসা হয়েছে তাকে অতটা সময় ফেলে রাখা যাবে না।

    দ্বিতীয় শিপিং অফিস থেকে একটা লম্বা ভ্যান পাওয়া গেল। তবে ঘণ্টা দেড়েকের ভেতর সেটা ফিরিয়ে দিতে হবে।

    শেখরনাথ বললেন, অতটা সময় লাগবে না। তার আগেই ফিরিয়ে দেব।

    ভ্যানটা লম্বা তো বটেই, ভেতরে অনেকটা জায়গা রয়েছে। মোহনবাঁশিকে তুলে পেছন দিকের পাটাতনে শুইয়ে তার। চারপাশে একটু ঘেঁষাঘেঁষি করে বাকি সবাই বসল। বিনয়কে নিয়ে ড্রাইভারের পাশে বসেছেন শেখরনাথ। শিপিং কোম্পানিটা থেকে ড্রাইভারও দেওয়া হয়েছিল।

    গাড়ি ছুটল উঁচুনিচু সড়ক ধরে। এই এলাকাগুলো বিনয়ের চেনা। এই রাস্তা দিয়েই কিছুদিন আগে বিশ্বজিতের সঙ্গে চ্যাথামে এসেছিল সে। তবে হাসপাতাল কোথায় সে জানে না। পোর্টের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে হ্যাঁডো, ডিলানিপুর, ফুদ্দি চাউঙ, মিডল পয়েন্ট, এবারডিন মার্কেট পেছনে ফেলে বাঁ দিকের মোড় ঘুরে অন্য একটা রাস্তায় এসে পড়ল ভ্যানটা। রাস্তাটা খাড়াই বেয়ে উঁচু টিলার দিকে চলেছে। আর টিলার মাথায় বিশাল দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে আছে সেলুলার জেল।

    বিনয় বুঝতে পারছে না, ভ্যানটা কেন জেলখানার দিকে চলেছে। শেখরনাথকে তা জিগ্যেস করে ফেলল।

    চড়াই ভাঙছে, তাই ভ্যানের গতি অনেক কমে গেছে। শেখরনাথ বুঝিয়ে দিলেন। সেলুলার জেলের মাঝখানে রয়েছে একটা বিরাট উঁচু টাওয়ার। একসময় সাতটা মস্ত মস্ত তেতলা বিল্ডিং সেটার সাতদিকে চলে গেছে। এই সাতটা বিল্ডিংয়ে ছিল সবসুদ্ধ হাজারখানেক সেল বা কয়েদিদের আটকে রাখার কুঠুরি। দুটো টাওয়ার ভূমিকম্পে ভেঙে যায়, একটা জাপানি বোমায় ধংস হয়েছে। বাকি চারটে এখনও অটুট। এই ব্লকের একটায় এখন লোকাল জেল, একটায় হাসপাতাল। অন্য দুটোয় মিউজিয়াম। ব্রিটিশ আমলে বিপ্লবীরা কে কোন কুঠুরিতে ছিলেন, কীভাবে তাদের এবং সাধারণ অন্য সব কয়েদির ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হত তার কিছু কিছু স্মারক ওই ব্লক দুটোয় সংরক্ষণ করা আছে। ভ্যান সেলুলার জেলের সামনে চলে এসেছিল। ঢোকার মুখ প্রথমেই গম্ভীর, থমথমে, ভয়ংকর গোলাকার চেহারার একজোড়া টাওয়ার। দুটোর দূরত্ব তিরিশ চল্লিশ ফিটের মতো। জোড়া টাওয়ারের মাঝামাঝি জায়গায় খানিকটা উঁচুতে দোতলা সমান হাইটে লম্বা করিডর। সেটা টাওয়ার দুটো জুড়ে রেখেছে। তার তলায় লোহার মজবুত ফটক। এটা দিয়েই যাতায়াত করতে হয়।

    ফটকের দুটো পাল্লা খোলা রয়েছে। বিনয় কার একটা লেখায় পড়েছে ব্রিটিশ আমলে চব্বিশ ঘণ্টা রাইফেল হাতে খাস ইংরেজ পুলিশের একটা বাহিনী চব্বিশ ঘণ্টা ফটকের সামনে টহল দিতে দিতে নজরদারি চালাত। তাদের চোখে ধুলো ছিটিয়ে একটা মাছিও গলতে পারত না।

    স্বাধীনতার পর দিনকাল বদলে গেছে। ফটক এখন হাট করে খোলাই থাকে। বন্দুকওয়ালা পুলিশবাহিনী তো দূরের কথা, একজন গার্ডও চোখে পড়ল না।

    এখান থেকে অনেকটা নিচে ঘোড়ার খুরের আকারে সিসোস্ট্রেস বে-টাকে দেখা যাচ্ছে। তার ওধারে রস আইল্যান্ড। কিছুদিন আগে উদ্বাস্তুদের সঙ্গে এস এস মহারাজা জাহাজে নেমেছিল বিনয়। সেখান থেকে ছোট মোটর বোটে এসেছিল পোর্ট ব্লেয়ারে।

    ফটক দিয়ে ভ্যানটা ঢুকতে যাবে, কেউ ডেকে উঠল, আদাব চাচাজি—

    লোকটাকে দেখতে পেয়েছিলেন শেখরনাথ। একটু অবাক হলেন। ব্যস্তভাবে ড্রাইভারকে ভ্যান থামাতে বলে লোকটার দিকে তাকালেন।-নসিমুল, তুমি এখানে?

    মায়াবন্দর থেকে তোমাদের কোম্পানির জাহাজ নিয়ে এসেছ নাকি?

    জি। একটু কাত হয়ে তেরছাভাবে ডান হাতের তর্জনীটা বাড়িয়ে দিল।

    সেলুলার জেল যে টিলাটার মাথায় ঠিক তার পেছন দিয়ে সিসোস্ট্রেস বে বা উপসাগর ঘোড়ার খুরের আকারে পশ্চিম থেকে পুবে চলে গেছে। সেটার পাড়ে পোর্ট ব্লেয়ারের গা ঘেঁষে একটা জেটি। সেখানে একটা ছোট জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে। এস এস সাগর। নসিমুলের আঙুল সেটার দিকে। তার ঠিক উলটো দিকে উপসাগরের ওপারে রস আইল্যান্ড। বিনয়ের খুবই পরিচিত এলাকা। এই তো সেদিন মহারাজা জাহাজে চেপে কয়েক শো রিফিউজি ফ্যামিলির সঙ্গে এসে নেমেছিল।

    নসিমুলের বয়স পঞ্চাশবাহান্ন। তামাটে রং। মাঝারি হাইটের মজবুত চেহারা। লম্বাটে মুখে বসন্তের দাগ, মাথায় কাঁচাপাকা চুল। পরনে ঢোলা নীলচে ফুলপ্যান্ট আর সাদা শার্ট। লোকটা এবার জানাল, কয়েকদিন আগে তারা এখানে এসেছে। আজই মায়াবন্দর ফিরে যাবে। তবে রাহাসাহেব অর্থাৎ বিশ্বজিৎ তাঁদের অনুরোধ করেছেন সপ্তাহখানেক আগে মধ্য আন্দামানের একজন বৃদ্ধ রিফিউজি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পোর্ট ব্লেয়ারের হাসপাতালে এসে ভর্তি হয়েছিল। তার সঙ্গে পরিবারের দুজন এসেছে। বৃদ্ধ এখন রোগমুক্ত। তাকে আজ রিলিজ করে দেওয়া হবে। নসিমুলরা উত্তর আন্দামানের মায়াবন্দর যাবার পথে যেন এই উদ্বাস্তু পরিবারটিকে মিডল আন্দামানে নামিয়ে দিয়ে যায়। সেজন্য এস এস সাগর-এর বয়লারে যে কয়লা দেয় সেই স্টোকার রহমানকে হাসপাতালে পাঠিয়ে এখানে অপেক্ষা করছে নসিমুল। রহমানরা চলে এলে সে বৃদ্ধদের নিয়ে গিয়ে সে জাহাজ ছেড়ে দেবে।

    ঠিক আছে, আবার দেখা হবে। আমার সঙ্গে একজন জখম লোক রয়েছে। তাকে এক্ষুনি হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। আচ্ছা চলি

    আদাব

    শেখরনাথ হাত তুলে প্রতিনমস্কার জানালেন। ভ্যানওলাকে বললেন, চল– কথা বলতে বলতে তিনি লক্ষ করেছিলেন বিনয় পলকহীন নসিমুলের দিকে তাকিয়ে আছে। নিশ্চয়ই নসিমুল সম্পর্কে তার খুবই কৌতূহল হচ্ছে। তাকে বললেন, পোর্টব্লেয়ার থেকে একশো মাইল দূরে উত্তর আন্দামানের মায়াবন্দরে দত্তদের স-মিল এবং সামুদ্রিক শেল অর্থাৎ শঙ্খ, কড়ি, টার্বো, ট্রোকার্সের ফলাও কারবার। বাঙালি কোম্পানি সারা পৃথিবীতে তারা শেল চালান দেয়। তাদের দু দুটো জাহাজও রয়েছে। এস এস সাগর তো এই মুহূর্তে জেটিতে বাঁধা রয়েছে। অন্যটার নাম এস এস বরুণ।

    ভ্যান ফটক পেরিয়ে বিরাট এক চত্বরে এসে পড়েছিল। কোনাকুনি খানিকটা গিয়ে একটা লম্বা ব্লকের সামনে এসে থেমে গেল। সেখানে দোতলার হাইটে মস্ত বোর্ডে লেখা: আন্দামান অ্যান্ড নিকোবর হসপিটাল।

    শেখরনাথের শেষ কথাগুলো শুনতে পাচ্ছিল না বিনয়। সেলুলার জেলের চৌহদ্দিতে ঢোকার পর থেকে সারা শরীর ছমছম করছে। ছেলেবেলায় রাজাজিয়ায় থাকার সময় ভারতের বাস্তিল এই জেলখানা সম্পর্কে কত বিভীষিকা, কত আতঙ্কের কাহিনিই না শুনেছে সে। শত শত বিপ্লবী থেকে সাধারণ কয়েদিকে অকথ্য অত্যাচারে পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছে। অনেকে নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে উন্মাদ হয়ে গেছে। ব্রিটিশ পুলিশ কতজনকে যে এই কয়েদখানায় ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে দিয়েছে তার লেখাজোখা নেই। আচ্ছন্নের মতো তিনদিকের উঁচু উঁচু দালানে অগুনতি সেলগুলো দেখতে থাকে বিনয়।

    এদিকে ভ্যানটা থামতেই শেখরনাথ নেমে পড়েছিলেন। ব্যস্তভাবে বিনয়কে তাড়া দিলেন, চলচল আমার সঙ্গে। অন্যদের গাড়িতেই অপেক্ষা করতে বললেন।

    হাসপাতালের তেতলা বিল্ডিংটার মাঝামাঝি জায়গা থেকে ওপরে ওঠার সিঁড়ি। এপাশে ওপাশে সারি সারি যে কুঠুরিগুলোতে ইংরেজ আমলে কয়েদিদের আটকে রাখা হত, এখন সেগুলোতে রোগীদের জন্য বেড় পাতা। এখন ভিজিটিং আওয়ার্স চলছে। পেশেন্টদের ঘিরে বসে আছে তাদের বাড়ির লোকজন।

    বিনয়কে সঙ্গে করে সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় চলে এলেন শেখরনাথ। নিচের তলার মতো এখানেও কুঠুরিতে কুঠুরিতে রোগীদের পাশে তাদের আত্মীয়স্বজন।

    সেলগুলোর সামনে দিয়ে পনেরো ফিটের মতো চওড়া করিডর বহুদূরে শেষ প্রান্ত অব্দি চলে গেছে। দু চারজন নার্স, অ্যাপ্রন-পরা। জুনিয়র ডাক্তার এবং হাসপাতালের কর্মীদের দেখা যাচ্ছে।

    সিঁড়ির ডানপাশে একটু এগুতেই দেখা গেল দেওয়ালের গায়ে পেতলের ঝকঝকে প্লেটে লেখা আছে: ডাঃ পি. চট্টরাজ। চিফ মেডিক্যাল অফিসার।–

    দরজার সামনে দামি পরদা ঝুলছে। বাইরে থেকে শেখরনাথ গলার স্বর সামান্য উঁচুতে তুলে ডাকলেন, প্রণবেশ-প্রণবেশ আমি শেখরকাকা-ভেতরে আসতে পারি?

    ডাঃ চট্টরাজ নিজেই উসে এঠে পরদা সরিয়ে বললেন, আপনি! আসুন, আসুন, ভেতরে

    তাঁকে থামিয়ে দিয়ে শেখরনাথ বললেন, এখন বসার সময় নেই৷ কী কারণে হাসপাতালে আসা, সংক্ষেপে তা জানিয়ে দিলেন। সেই জেফ্রি পয়েন্ট থেকে নিয়ে আসতে হয়েছে। লোকটা খুব সম্ভব বেঁচে আছে। শিগগির ভর্তির ব্যবস্থা কর।

    তক্ষুনি তৎপরতা শুরু হয়ে যায়। ডাঃ চট্টরাজ একে ওকে ডেকে স্ট্রেচার, একজন জুনিয়র ডাক্তার এবং একজন নার্সকে নিচে পাঠিয়ে দেন। পাঁচ মিনিটের ভেতর মোহনবাঁশিকে দোতলাতেই এমার্জেন্সি ডিপার্টমেন্টে ভর্তি করে নেওয়া হয়। বাইরের করিডরে অপেক্ষা করতে থাকেন শেখরনাথ এবং বিনয়। তাদের সঙ্গে উৎকণ্ঠিত মোহনবাঁশির ছেলেমেয়ে বউ আর পুনর্বাসনের কর্মীরা।

    ডাঃ চট্টরাজ এমার্জেন্সিতে মোহনর্বাশিকে দেখতে গিয়েছিলেন। মিনিট দশেক পর বেরিয়ে এসে বললেন, কেসটা ক্রিটিক্যাল। প্রথমে তিরটা বার করতে হবে। তারপর বড় একটা অপারেশন। অন্তত পনেরোকুড়ি দিন হাসপাতালে থাকতে হবে। আশা করি, বাঁচাতে পারব।

    ডাঃ চট্টরাজের দুই হাত ধরে গভীর স্বরে শেখরনাথ বললেন, যেভাবে তোক বাঁচাতে চেষ্টা কর।

    আমাদের চেষ্টার কোনও ত্রুটি হবে না কাকা। আন্দামানের আরও অজস্ৰজনের মতো ডাঃ চট্টরাজও শেখরনাথকে কাকা বলেন।

    শেখরনাথ তাঁর সঙ্গীদের দেখিয়ে বললেন, এঁরা মোহনবাঁশির বউ ছেলেমেয়ে আর রিহ্যাবিলিটেশনের এমপ্লয়ি। তারপর বিনয়কে কাছে টেনে এনে জিজ্ঞেস করলেন, এঁকে কি তুমি চেন?

    ডাঃ চট্টরাজ কয়েক পলক বিনয়কে লক্ষ করলেন। তারপর বললেন, মুখটা চেনা চেনা লাগছে। ঠিক

    ও কলকাতার একজন সাংবাদিক। বিনয়। রিফিউজিদের সঙ্গে এখানকার সেটেলমেন্ট দেখতে এসেছে।

    এইবার মনে পড়ে গেল। ডাঃ চট্টরাজ বিনয়ের কাঁধে একটা হাত রেখে বললেন, রস আইল্যান্ডে রাহা সাহেব আপনার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন। অ্যাম আই রাইট?

    বিনয় হেসে হেসে বলল, ওয়ান হানড্রেড পারসেন্ট।

    উত্তর দিতে যাচ্ছিলেন ডাঃ চট্টরাজ। তার আগেই শেখরনাথ বলে উঠলেন, সেই সকালে আমরা বেরিয়েছি। আর্টটা নাগাদ চা আর রুটি ছাড়া এখন অব্দি কারও পেটে একফোঁটা জল পড়েনি। সবার জন্য কিছু খাবার নিয়ে আসি। তাছাড়া একটা শিপিং কোম্পানি থেকে গাড়ি নিয়ে চ্যাথাম থেকে মোহনবাঁশিকে এখানে এনেছি। গাড়িটা এক্ষুনি তাদের ফেরত দিতে হবে। বিশুকেও মোহনবাঁশির খবরটা দেওয়া দরকার। আমি মিনিট চল্লিশেকের ভেতর চলে আসছি।

    বিনয় জিগ্যেস করল, কাকা, আমি কি আপনার সঙ্গে যাব?

    একটু ভেবে শেখরনাথ বললেন, না, তুমি এখানেই থাক। সেলুলার জেলটা যতটা প্রার, দেখ। পরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সমস্ত দেখাব।

    মোহনবাঁশির বউ ছেলেমেয়েদের ভরসা দিয়ে বললেন, কোনও ভয় নেই। কেউ কান্নাকাটি কোরো না।

    ডাঃ চট্টরাজ তার চেম্বারে চলে গেলেন। বিনয় শেখরনাথের সঙ্গে নিচের চত্বরে নেমে এল। বাকি সকলে এমার্জেন্সি বিভাগের সামনের করিডরে কয়েকটা বেঞ্চে বসে রইল।

    নিচে এসে শেখরনাথ সেই ভ্যানটায় উঠে পড়লেন। সঙ্গে সঙ্গে গাড়িটা স্টার্ট দিয়ে ফটকের দিকে ছুটল।

    হাসপাতালের ব্লকটার ঠিক উলটো দিকে একই মাপের একই চেহারার বিশাল একটা ব্লক। একতলা থেকে তেতলা অব্দি লাইন দিয়ে কত যে সেল। সেসব দেখতে দেখতে পুরানো ভাবনাটা আবার ফিরে আসে। শত আলোকবর্ষ পেরিয়ে ইতিহাসের সেই উথালপাতাল দিনগুলোতে ফিরে গেল বিনয়। সারা দেশ জুড়ে, বিশেষ করে বাংলায় সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামীরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে ইংরেজদের ওপর। বাতাসে তখন বারুদের গন্ধ। চলছে গুলি, বোমা, ট্রেন,ডাকাতি। মরণজয়ী বিপ্লবীরা পণ করেছে ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটিশ শাসন উৎখাত করবেই।

    ওদিকে যাদের রাজত্বে কোনওদিন সূর্যাস্ত হয় না, সেই ব্রিটিশ প্রশাসন হাত গুটিয়ে বসে রইল না। তাদের বন্দুকের নল থেকে পালটা গুলি ছুটে গেল ঝুঁকে ঝাকে। চলল ধরপাকড়। চলল চরম দমননীতি। শত শত বিপ্লবীতে ভরে গেল কয়েদখানাগুলো। তাদের অনেককে ফাঁসিতে ঝোলানো হল। অনেককে নির্বাসন দেওয়া হল আন্দামানে।

    ব্লকের ভেতরে ঢোকেনি বিনয়। সামনের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে চেষ্টা করছিল কোন সেলে ছিলেন উল্লাসকর দত্ত, কোনটায় সাভারকার ভাইরা, কোনটায় গণেশ ঘোষ, কোনটায় উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।

    চলতে চলতে কখন যে ফটকের কাছাকাছি চলে এসেছে। খেয়াল নেই। পুরানো দিনের ইতিহাসে মগ্ন হয়ে ছিল বিনয়।

    হঠাৎ একটি মেয়ে-গলা কানে এল। আস্তে আস্তে। বুড়োমানুষ, জোরে জোরে কি পা ফেলতে পারে?

    চেনা কণ্ঠস্বর। লহমায় আচ্ছন্নতা কেটে যায় বিনয়ের। ব্যগ্রভাবে একটু কাত হয়ে তাকাতেই পা থেকে মাথা অব্দি সমস্ত শরীরে তড়িৎপ্রবাহ খেলে যায় ঝিনুক। একটি বৃদ্ধের একখানা হাত ঝিনুকের কাঁধে। ঝিনুক তার পিঠটা নিজের হাতে বেড় দিয়ে আছে। বৃদ্ধের অন্য হাতটা ধরে আছে নসিমুল। পেছন থেকে ধরে রয়েছে একটি যুবক। নিশ্চয়ই এস এস সাগর-এর স্টোকার। আরও একজন বৃদ্ধাও রয়েছে। তিনি খুব সম্ভব বৃদ্ধটির স্ত্রী। নসিমুল এদের জন্যই তাহলে গেটের কাছে অপেক্ষা করছিল।

    বিহ্বলের মতো দাঁড়িয়ে থাকে বিনয়। কী করবে সে যেন ভেবে পায় না।

    ওদিকে বৃদ্ধকে নিয়ে ঝিনুকরা ফটক থেকে খানিক দূরের ঢাল বেয়ে নিচে নেমে এসেছে। আরও মিনিট কয়েক হাঁটলেই সিসোস্ট্রেস বের কিনারে জেটিটায় পৌঁছে যাবে।

    হঠাৎ স্নায়ুমণ্ডলীতে তীব্র একটা ঝাঁকুনি লাগল বিনয়ের। উদ্ভ্রান্তের মতো সেও ঢাল বেয়ে নামতে নামতে ডাকতে থাকে, ঝিনুক-ঝিনুক

    নসিমুলরা দাঁড়িয়ে পড়েছিল। ততক্ষণে বিনয় তাদের কাছে চলে এসেছে। নসিমুল তাকে চিনতে পেরেছে। জিগ্যেস করল, ভাইসাব, আপ চাচাজিকা সাথ ভ্যানমে থে

    তার কথাগুলো শুনতেই পেল না বিনয়। উতরোল আবেগে বুকের ভেতরটা তোলপাড় হয়ে যাচ্ছিল তার। যেন লক্ষ কোটি, বছর পর ঝিনুককে সামনাসামনি দেখল সে। কী যে কষ্ট, কত যে সুখানুভূতি! কাঁপা গলায় বলতে লাগল, ঝিনুক ঝিনুক-তুমি বাকিটা আর শেষ করা গেল না। গলা বুজে এল।

    ফটকের সামনে খুব সম্ভব বিনয়কে লক্ষ করেনি ঝিনুক। সে প্রথমটা হকচকিয়ে যায়। তারপর ঠোঁট টিপে দাঁড়িয়ে থাকে। ভাবলেশহীন। বিনয়কে সে আগে কোনও দিন বুঝিবা দেখেনি। সম্পূর্ণ অপরিচিত।

    কণ্ঠস্বর আবার ফিরে পেল বিনয়। তুমি ভবানীপুরের বাড়ি থেকে চলে আসার পর কলকাতা আর চারপাশে কত যে তোমাকে খুঁজেছি! দিনের পর দিন। সারা রাত ঘুমোতে পারিনি, মনে হত যন্ত্রণায় মৃত্যু হবে। কিন্তু মরতেও পারিনি।

    সেই একদিন বুকের ভেতর আগলে আগলে বিনয় পূর্ব পাকিস্তান থেকে যে মেয়েটিকে কলকাতায় নিয়ে এসেছিল দুঃখে গ্লানিতে আতঙ্কে সে একেবারে শীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। সেই ঝিনুক আর নেই। ঝলমলে স্বাস্থ্যে, লাবণ্যে সে এখন পরিপূর্ণ যুবতী।

    ঝিনুক উত্তর দিল না। বিনয় যেন কথাগুলো তাকে নয়, অন্য কারওকে বলছে। উদাসীন মুখে ঝিনুক সমুদ্র, সি-গাল পাখি, আকাশ দেখতে থাকে।

    উদ্বেল স্বরে বিনয় জিগ্যেস করে, খিদিরপুর ডকে আবছাভাবে তোমাকে যখন দেখি, মনে হয়েছিল হয়তো তুমি নও। তারপর রস আইল্যান্ডেও দেখলাম। অত মানুষের ভিড়ে তেমন ভালো করে নয়। কিন্তু চলুঙ্গা জাহাজে স্পষ্ট দেখতে পেলাম। একই জাহাজে এতদূরে এসেছি, তুমি কি আমাকে দেখতে পাওনি ঝিনুক?

    বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধা বিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে ছিল।

    বৃদ্ধটি এবার বলল, বাবা, আপনে কারে ঝিনুক কইতে আছেন?

    ঝিনুকের দিকে আঙুল বাড়িয়ে দিল বিনয়। একে—

    আপনের ভুল অইছে বাবা। ও ঝিনুক না– সীতা।

    বিনয় বুঝতে পেরেছে, নিরুদ্দেশ হবার পর ঝিনুক নাম পালটে ফেলেছে। সে জোর দিয়ে বলল, সীতা না, ও ঝিনুকই।

    এতক্ষণে মুখ খুলল ঝিনুক, না, আমি সীতাই।

    তুমি ঠিক বলছ না।

    বিনয়ের চোখে চোখ রেখে ঝিনুক বলল, যদি আমি ঝিনুকই হই, কী এসে যায়? এই পৃথিবীর কোনও ক্ষতি বৃদ্ধি হবে না। বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধার দিকে ফিরল সে। মাসিমা মেসোমশাই চলুন, সন্ধে হয়ে আসছে, বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হয়ে যাবে।

    দলটা নেমে যেতে লাগল। চলতে চলতেই নসিমুল, রহমান, বৃদ্ধা ও বৃদ্ধ বার বার পেছন ফিরে বিনয়কে দেখতে লাগল। ঝিনুক ফিরেও তাকাল না।

    বিনয় দাঁড়িয়েই আছে, দাঁড়িয়েই আছে। হতবুদ্ধি। বিহ্বল। এতকাল খোঁজাখুঁজির পর এ কোন ঝিনুককে দেখল বিনয়? যে মেয়েটা ছিল সারাক্ষণ ত্রস্ত, সারাক্ষণ আতঙ্কগ্রস্ত, এক পলক তাকে না দেখলে কী যে ব্যাকুল হয়ে পড়ত তার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে অন্য এক নারী। দৃঢ়, অবিচল, কঠিন।

    বিহ্বলতা কাটলে বিনয় অদ্ভুত এক ঘোরের মধ্যে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগল, আজ তুমি আমার সঙ্গে ভালো করে কথা বললে না। না চেনার ভান করলে। কিন্তু তোমার ঠিকানা মোটামুটি জেনে গেছি। খুব শিগগির আমি মিডল আন্দামানে যাব। দেখব সেদিন আমাকে চিনতে পার কি না।

    ঝিনুক এবারও তার দিকে তাকাল না।

    দাঁড়িয়ে থাকতে বিনয়ের মনে হল, অসহ্য কষ্টে, তীব্র যাতনায় মাথার শিরা-স্নায়ু ছিঁড়ে ছিঁড়ে পড়ছে, বুকের ভেতরের কোথায় যেন অবিরল রক্তক্ষরণ হচ্ছে।

    দিনের আলো কমে গিয়েছিল। ঝাপসা আঁধারে একসময় দেখা গেল ঝিনুকরা এস এস সাগর-এ উঠে পড়েছে। একটু পর ভোঁ বাজিয়ে উপসাগরকেচকিত করে জাহাজ চলতে শুরু করল।

    দ্বিতীয় পর্ব সমাপ্ত

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleগহনগোপন – প্রফুল্ল রায়
    Next Article শতধারায় বয়ে যায় – প্রফুল্ল রায়

    Related Articles

    প্রফুল্ল রায়

    আলোর ময়ুর – উপন্যাস – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    কেয়াপাতার নৌকো – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    শতধারায় বয়ে যায় – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    গহনগোপন – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    নিজেই নায়ক – প্রফুল্ল রায়ভ

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    ছোটগল্প – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Our Picks

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.