Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    উত্তাল সময়ের ইতিকথা – প্রফুল্ল রায়

    প্রফুল্ল রায় এক পাতা গল্প688 Mins Read0

    ৩.০৩ উপসাগরের মুখোমুখি

    এখন অনেক রাত।

    ভুবনরা ঘণ্টা দুয়েক আগে মোহনবাঁশির স্ত্রী-ছেলে-মেয়েকে খাইয়ে দিয়েছিল। তারা এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। বিনয়, শেখরনাথ এবং বিশ্বজিতেরও স্নান-খাওয়া হয়ে গেছে।

    এই বাংলোয় উপসাগরের মুখোমুখি পরপর তিনটে বেডরুম৷ একেবারে পশ্চিম দিকের ঘরটায় সেদিন রাত কাটিয়ে গিয়েছিল বিনয়। আজও সেখানেই তার জন্য বিছানা করে দেওয়া হয়েছে। ওটা এই বাংলোর গেস্ট রুম। ঠিক হয়েছে বিনয় যখনই পোর্ট ব্লেয়ারে আসবে এখানেই থাকবে। তার পাশের ঘরটা শেখরনাথের আর পুব দিকের শেষ ঘরটা বিশ্বজিতের।

    বিনয় তার ঘরে চলে এসেছিল। দুই দেওয়ালে জোরালো আলো জ্বলছে। তেজি আলোয় ভরে আছে ঘরটা।

    গোপালের কাজে খুঁত নেই। খাটের পাশে জগ ভর্তি জল এবং কাচের ঝকঝকে গেলাস রেখেছে। তাছাড়া এলাচ-লবঙ্গ ভর্তি একটা ছোট কৌটোও। এখন মশারি খাটিয়ে বিছানার চারপাশে পরিপাটি করে গুঁজে দিচ্ছে।

    শিয়রের দিকে খোলা জোড়া জানলা। তার পাশে পড়াশোনার জন্য ছোট টেবিল এবং চেয়ার। বিনয় চেয়ারে বসে তড়িৎ গতিতে গোপালের হাত চালানো দেখছিল। সেই সকালের দিকে জেফ্রি পয়েন্ট থেকে মোহনবাঁশিকে ট্রাকে চাপিয়ে তারা চলে এসেছে। সারাদিন শরীরের ওপর প্রচণ্ড ধকল গেছে। স্নানের পর পেটে ভাত পড়তেই অসীম ক্লান্তিতে দুচোখ জুড়ে আসছিল। গোপাল তার কাজ শেষ করা মাত্র সে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়বে।

    বিশ্বজিৎ ঘরে এসে ঢুকলেন। তার হাতে পুরু ব্রাউন কাগজের একটা প্যাকেট। একটু অবাক হয়েই উঠে দাঁড়াল বিনয়। খানিক আগেই খাওয়াদাওয়া চুকিয়ে তিনি শুতে চলে গিয়েছিলেন। হঠাৎ কী এমন হল যে এ সময় তাকে আসতে হয়েছে!

    বিশ্বজিৎ বললেন, নানা কথায় একেবারে ভুলে গিয়েছিলাম। কলকাতা থেকে কাল আপনার কয়েকটা চিঠি এসেছে। এর ভেতর সব রেখে দিয়েছি। ভেবেছিলাম জেফ্রি পয়েন্টে পাঠিয়ে দেব। ভালোই হল আপনি পোর্টব্লেয়ারে চলে এসেছেন। এই নিন। প্যাকেটটা বিনয়ের হাতে দিলেন।

    গোপালের মশারি গোঁজা হয়ে গিয়েছিল। সে চলে গেল। বিশ্বজিৎ কিন্তু গেলেন না। ঘরে বাড়তি একটা চেয়ার রয়েছে সেটা টেনে এনে বসতে বসতে বললেন, কী হল, দাঁড়িয়ে কেন? বসুন। আপনার সঙ্গে জরুরি একটা কথা আছে। আর্জিও বলতে পারেন।

    বিনয়ের বিস্ময় বাড়ছিলই। এতক্ষণ ড্রইংরুমে বসে কত আলোচনা হয়েছে। একসঙ্গে ডাইনিং টেবিলে বসে তারা খেয়েছে। তখনও কিছু কথাবার্তা যে হয়নি তা নয়। তারপরও বিশ্বজিতের কী এমন কথা থাকতে পারে, সে ভেবে পেল না। তাছাড়া আর্জি শব্দ কেমন ধন্দের মতো মনে হচ্ছে। ধীরে ধীরে বসে পড়ল বিনয়। কোনও প্রশ্ন করল না।

    বিশ্বজিৎ বললেন, মোহনবাঁশি কর্মকারের ব্যাপারটা খুবই আনফরচুনেট ঘটনা। আপনি নিজে তার প্রত্যক্ষদর্শী। আমার বিশেষ অনুরোধ এই নিয়ে কোনও রিপোর্ট কলকাতায় পাঠাবেন না। বিনয় চমকে উঠল। –এ কী বলছেন! আমি একজন সাংবাদিক। এখানে যা ঘটছে, নিজের চোখে যা যা দেখছি তা লেখার জন্যেই তো আমাকে আন্দামানে পাঠানো হয়েছে। সঠিক তথ্য পাঠকের কাছে তুলে না ধরাটা তো অন্যায়। ডিসঅনেষ্টি।

    বিশ্বজিৎ প্রায় অনুনয়ের সুরে বললেন, আপনি যা বললেন তা হান্ড্রেড পারসেন্ট ট্র। কিন্তু বেঙ্গল, বিশেষ করে উদ্বাস্তুদের স্বার্থে দয়া করে এই ইনসিডেন্টটার কথা লিখবেন না। তিনি বোঝাতে লাগলেন, কলকাতায় উদ্বাস্তুদের নিয়ে মারমুখি আন্দোলন চলছে, এই রিপোর্টটা বেরুলে পার্টিগুলো মারাত্মক একটা অস্ত্র হাতে পেয়ে যাবে। রিফিউজিরাও ভীষণ ভয় পাবে। আন্দামানের জাহাজে তাদের তোলা অসম্ভব হয়ে পড়বে। এদিকে জঙ্গলের ফাঁকা জমিগুলোতে মোপলাদের বসানোর ভাবনাচিন্তা চলছে। সেটা বিপজ্জনক ব্যাপার।

    কত ছিন্নমূল মানুষের পুনর্বাসন এই দ্বীপপুঞ্জের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। পুরোদমে বিশাল কর্মকাণ্ড চলছে। উদ্বাস্তুরা না তাদের নতুন করে বাঁচার সুবর্ণ সুযোগ নষ্ট করে ফেলে। একটা ঘটনা যদিও সেটা খুবই মর্মান্তিক গোপন করলে যদি হাজার হাজার মানুষের কল্যাণ হয় সেটা বিরাট ব্যাপার। আন্দামান নামে এই জিয়নকাঠিটি কখনওই ছাড়া ঠিক হবে না।

    বিশ্বজিৎ আরও বললেন, জেফ্রি পয়েন্টে জারোয়ারা আর যাতে হামলা চালাতে না পারে সে জন্য সিকিউরিটি বন্দোবস্ত আরও জোরদার করা হবে। তাছাড়া আরও কিছু কিছু ব্যবস্থার কথাও ভাবা হবে।

    শুনতে শুনতে অভিভূত হয়ে পড়েছিল বিনয়। বিশ্বজিৎকে যত দেখছে তার শ্রদ্ধা যেন ততই বেড়ে যাচ্ছে। এই মানুষটির লেশ মাত্র স্বার্থ নেই। তিনি অজস্র টাকা মাইনে পান, প্রচুর পার্কস, সেই সঙ্গে বিপুল ক্ষমতা। রিফিউজিরা যদি না আসে, ফাঁকা জমিতে যদি মোপলাদের বসিয়ে দেওয়া হয় তাতে তার এতটুকু ক্ষতি হবে না। বরং যেভাবে পুনর্বাসনের কাজে জঙ্গলে জঙ্গলে ছোটাছুটি করেন, যেভাবে দিন রাত পরিশ্রম করেন তার কিছুই করতে হবে না। গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ফুরফুরে হালকা মেজাজে তিনি বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে পারবেন। অথচ উদ্বাস্তুদের জন্য তার কী অফুরান মমতা, তার জন্য তিনি কত ভাবেন। নিঃস্বার্থ এই মানুষটি বহুজন হিতে নিজের সমস্ত অস্তিত্ব সঁপে দিয়েছেন।

    বিনয় কয়েক লহমা তার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর গাঢ় গলায় বলল, ঠিক আছে, মোহনবাঁশির কথা লিখব না।

    বিশ্বজিৎ উঠে পড়লেন। কৃতজ্ঞ সুরে বললেন, অনেক ধন্যবাদ। আমি চলি। আপনি শুয়ে পড়ুন।

    তিনি চলে যাবার পরও বসে রইল বিনয়। এখন চারিদিক নিঝুম। শুধু সিসোস্ট্রেস বের ঢেউগুলো অবিরল ঝাঁপিয়ে পড়ছে পাড়ের পাথরের চাইগুলোর ওপর। দূর সমুদ্র থেকে ঝেড়ো হাওয়া উঠে এসে পোর্টব্লেয়ারের সবগুলো বিশাল বিশাল গাছের ঝুঁটি ধরে ঝাঁকিয়ে চলেছে। ঢেউ আর বাতাসের আওয়াজ ছাড়া কোথাও অন্য কোনও শব্দ নেই।

    এক সময় উঠে পড়তে যাচ্ছিল বিনয়। তখনই খেয়াল হল হাতের ভেতর চিঠির প্যাকেটটা ধরা রয়েছে। না, এখন আর শোওয়া হবে না। প্যাকেটটা টেবিলে রেখে চিঠিগুলো বার করল সে৷ গুনে দেখল মোট চারটে সবই খামের চিঠি।

    প্ৰথম খামটা খুলতেই নতুন ভারত-এর চিফ রিপোর্টার প্রসাদ লাহিড়ির চিঠি বেরিয়ে পড়ল। তাঁর চিঠিতে ফেনানো ব্যাপার থাকে না। কাজের কথাগুলো গুছিয়ে সংক্ষেপে লিখে পাঠান।

    প্রসাদদা আগের চিঠির মতোই এবারও লিখেছেন বিনয়ের রিপোর্টগুলো পাঠকদের মধ্যে তুমুল সাড়া জাগিয়েছে। তবে লেখার সঙ্গে আন্দামানের রিফিউজি সেটলমেন্ট, সেখানকার মানুষজন, এবং অন্যান্য বাসিন্দা, বিশেষ করে পেনাল কলোনির লোকজন, সেলুলার জেল, রস আইল্যান্ড ইত্যাদি এলাকায় যারা থাকে তাদের ফোটো থাকাটা ভীষণ জরুরি। তাছাড়া আন্দামানের আদিম জনজাতি জারোয়া, ওঙ্গে এবং গ্রেট আন্দামানিজদের ছবি যেভবে হোক জোগাড় করে পাঠাতে হবে। মনে রাখা দরকার খবরের কাগজে চার কলম একটা প্রতিবেদনের চাইতে প্রাসঙ্গিক একটা ভালো ফোটো পাঠকের কাছে বিরাট ছাপ রাখে। রিপোর্টের বিশ্বাসযোগ্যতা এবং গুরুত্ব অনেক বাড়িয়ে দেয়। আপাতত আন্দামান থেকেই একটা ক্যামেরা জোগাড় করে কাজ চালিয়ে নিক। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অফিস থেকে ক্যামেরা পাঠানো হচ্ছে।

    প্রসাদদা লিখেছেন, আগের চিঠিতে তিনি যা জানিয়েছিলেন, কলকাতার অবস্থা এখন তার চেয়ে অনেক বেশি অগ্নিগর্ভ। হাজরা.পার্ক, শ্ৰদ্ধানন্দ পার্ক, দেশবন্ধু বা দেশপ্রিয় পার্ক– সর্বত্র রোজ উদ্বাস্তুদের নিয়ে মিটিং চলছে। তার ওপর রয়েছে মিছিল। মহানগরের উত্তর বা দক্ষিণ কিংবা পুব, যেদিকেই যাওয়া যাক বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মিছিল শুরু হয়ে যায়। মিছিলে মিছিলে যান চলাচল ঘণ্টার পর ঘণ্টা থমকে যায়। শহরের নাভিশ্বাস উঠতে থাকে।

    এদিকে জবরদখল কলোনিগুলো থেকে উদ্বাস্তুদের তুলে দেবার জন্য জমি মালিকদের চাপে পশ্চিমবঙ্গ সরকার উচ্ছেদ বিল আনতে চলেছে। বিরোধী দলগুলো কিছুতেই বিল পাশ করতে দেবে না। ফলে বিরাট সংঘাত অনিবার্য।

    সীমান্তের ওপার থেকে উদ্বাস্তুরা যেমন আসছিল তেমনই আসছে। যে সব ছিন্নমূল মানুষ পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসামে গিয়েছিল উৎখাত হয়ে তারাও আসছে। তাদের আসাটা দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে।

    শুধু উদ্বাস্তুদের নিয়ে আন্দোলনই নয়, ট্রেড ইউনিয়ন মুভমেন্টও দ্রুত বিরাট আকার নিচ্ছে। কলকাতার চারপাশে যত কলকারখানা, বিশেষ করে জুট মিল আর ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিটগুলোর কোনও না কোনওটায় রোজই প্রায় ডাকা হচ্ছে স্ট্রাইক, মালিকপক্ষ ঝুলিয়ে দিচ্ছে লক-আউটের নোটিস। উদ্বাস্তুদের মতো কারখানার শ্রমিকদেরও নিয়ে বেরুচ্ছে মিছিল। জওহরলাল নেহরু বলেছেন, কলকাতা এখন মিছিল নগরী– সিটি অব প্রশেসনস।

    কলকাতার পরিস্থিতি জানানো হল। বিনয় যেন যত শিগগির পারে চার পাঁচটা প্রতিবেদন একসঙ্গে পাঠিয়ে দেয়।

    প্রসাদদার আগের চিঠির বয়ান প্রায় একইরকম ছিল। তবে উদ্বাস্তুদের আন্দোলনটা আরও ঘোরালো হয়েছে। সেই সঙ্গে নতুন যোগ হয়েছে ট্রেড ইউনিয়ন মুভমেন্ট।

    অন্যমনস্কর মতো চিঠিটা ভাঁজ করে খামে পুরতে পুরতে বিনয় আন্দাজ করতে চেষ্টা করল কলকাতা যেন একটা আগ্নেয়গিরির মাথায় বসে আছে।

    এবার দুনম্বর চিঠি। সেটা সুনীতির। মাত্র কয়েকটা লাইন। তার মধ্যে নিজের যাবতীয় ক্ষোভ এবং অভিমান ঢেলে দিয়েছে। কারণও আছে। আন্দামানে আসার পর অনেককেই চিঠি লিখেছে, বিনয়। আনন্দকে লিখেছে বলে সুনীতিকে লেখার কথা ভাবেনি।

    সুনীতি লিখেছে অতি অবশ্য বিনয় যেন তার চিঠির জবাব দেয়। বিনয়ের জন্যে সারাক্ষণ সে চিন্তায় থাকে। অথচ তার কথা ভাইয়ের মনে পড়ে না। এরপর লিখেছে— হেমনলিনী, আনন্দ, তার দেওর এবং জা দীপক আর মাধুরী সবাই ভালো আছে। পারিবারিক নানা ব্যস্ততার কারণে সুধাদের বাড়ি এর মধ্যে যাওয়া হয়নি। তবে সামনের রবিবারের পরের রবিবার সে আর আনন্দ অবশ্যই যাবে। সারাটা দিন তাদের সঙ্গে কাটিয়ে আসবে। ইত্যাদি ইত্যাদি।

    অনেকের কথাই লিখেছে সুনীতি কিন্তু ঝুমা সম্পর্কে একেবারেই নীরব। ঝুমা নামে কোনও তরুণীকে সে চেনে বলেই মনে হয় না।

    চিঠিটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে বিনয়। আটশো মাইল দূরে বসে ঝুমা সম্পর্কে তার নতুন মনোভাবটা কি আঁচ করে ফেলেছে সুনীতিরা? বোঝা গেল না।

    এক সময় তিন নম্বর খামটা খুলল বিনয়। সুধার চিঠি। খুদি খুদি অক্ষরে পাক্কা তিনটি পাতা বোঝাই। এর কমে সে চিঠি লিখতে পারে না।

    বিনয় যে তার আগের চিঠির জবাব দিয়েছিল সেটা পেয়ে সুধা ভীষণ খুশি। তার আবদার, বিনয়ের যত কাজই থাক, সে যেন অবশ্যই, অবশ্যই সময় করে নিয়মিত তাকে চিঠি লেখে। সে তাদের একমাত্র ভাই। কলকাতায় তাদের নতুন বাড়িতে না থাকায় কত দুঃখ যে পেয়েছিল সুধা। এই কষ্ট তার ইহ জীবনে ঘুচবে না।

    বিনয় উঠল গিয়ে কিনা একটা নোংরা বারোয়ারি মেসে। সেখানে রাজ্যের মানুষ, সারাক্ষণ হইচই, হট্টগোল৷ এই সব জায়গায় খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা কোনওভাবেই মনের মতো হতে পারে না। আধো-অন্ধকার চাটাইয়ের ময়লা আসনে বসে কী যে খায় বিনয়! তবু একটু সান্ত্বনা, ইচ্ছা করলে যখন তখন শান্তিনিবাস মেসে গিয়ে তাকে দেখে আসা যায়। বিনয়ও আসতে পারে তাদের কাছে। ট্রামে বা বাসে বড়জোর মিনিট কুড়ি পঁচিশেকের ব্যাপার। কিন্তু কালাপানি পাড়ি দিয়ে আন্দামানের কোন ভয়ংকর বিজন অরণ্যে গিয়ে বসে আছে বিনয়। আতঙ্কে সারাক্ষণ সুধার বুক কাপে।

    সুধার আরও একটা দুর্ভাবনার কারণ হেমনাথ। তিনিও রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে-বহুদূরে। অন্য কোনও গ্রহে। নিত্য দাস-এর মধ্যে তাদের বাড়ি আসেনি, দাদুর খবরও পাওয়া যাচ্ছে না। কাগজে রোজই খবর থাকে পূর্ব পাকিস্তানের হাল ক্রমশ আরও খারাপ হচ্ছে। হেমনাথের জন্য ভীষণ অস্থির হয়ে আছে। সুধা।

    সে আরও জানিয়েছে, এর মধ্যে তার দাদাশ্বশুর দ্বারিক দত্তকে নিয়ে কম ভোগান্তি যায়নি। হঠাৎই শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিলেন। এই বয়সে টাইফয়েড। স্পেশালিস্ট ডাক্তার ডাকতে হয়েছিল। রাত জেগে হিরণ, সুধা আর উমাকে শুশ্রূষা করতে হয়েছে। প্রাণের আশা প্রায় ছিলই না। নেহাত আয়ুর জোরে দ্বারিক দত্ত এ যাত্রা সামলে উঠেছেন। একটা মারাত্মক ফঁড়া কেটে যাওয়ায় আপাতত স্বস্তি। সুধার জেঠিশাশুড়ি সরস্বতী যিনি বারো মাস কোনও না কোনও রোগে ভোগেন– ঈশ্বরের করুণায় ভালো আছেন।

    এবার যুগলের কথা। সে এখন মুকুন্দপুর কলোনিরই নয়, ওই অঞ্চলের বেশ কয়েকটা জবরদখল কলোনিরও ছোটখাট নেতা। বিরোধী পার্টিগুলোর ডাকে উদ্বাস্তুদের নিয়ে এসে সে কলকাতায় মিছিল করে। ক্রমশ সে রাজনীতির মধ্যে ঢুকে পড়ছে। কলকাতায় এলে সে সুধাদের বাড়ি আসবেই। যুগল জানায় একবার তারা উদ্বাস্তু হয়ে এ দেশে এসেছে। সরকার যদি জোর করে উচ্ছেদ আইন পাশ করায়ও, জান গেলেও তারা কলোনির দখল ছাড়বে না। কোনওভাবেই দ্বিতীয়বার তারা বাস্তুহারা হবে না।

    এসবের মধ্যে একটা সুখবরও দিয়েছে সুধা। অফিসে হিরণের একটা ভালো প্রোমোশনও হয়েছে। মাইনে বেড়ে গেছে। অনেকটাই।

    সবশেষে একটা কথা জানতে চেয়েছে সুধা। বিনয় তার প্রথম চিঠিতে লিখেছিল আন্দামানে আসার পর তার জীবনে একটা বিস্ময়কর ঘটনা ঘটেছে। সেটা এমনই যা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। ঘটনাটা কী, তা জানায়নি। শুধু লিখেছিল কলকাতায় ফিরে সে সবাইকে হতবাক করে দেবে।

    সুধা লিখেছে, কবে বিনয় ফিরবে সে জন্য ধৈর্য ধরে বসে থাকতে পারবে না। হেঁয়ালি না করে বিনয় যেন সব খুলে বিশদভাবে জানায়। তাদের বাড়ির সবাই সে জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে।

    পড়া শেষ করল বিনয়। তার চিঠিতে ঝিনুক সম্পর্কে ইঙ্গিত দিয়েছিল সে। কিন্তু না, ঝিনুকের কথা এখন কিছুতেই সুধাকে জানানো যাবে না।

    বিনয় ভেবেছিল, ঝিনুককে কলকাতায় নিয়ে গেলে একটা চমক লাগানো যাবে। কিন্তু আজ সেলুলার জেলের সামনের ঢালু রাস্তায় ঝিনুক তার সঙ্গে যেভাবে কথা বলেছে, যে ধরনের আচরণ করেছে, চিনেও না-চেনার ভান করেছে তাতে দমে গিয়েছিল সে। তার বিশ্বাস ছিল, একবার তারা মুখোমুখি দাঁড়ালে ঝিনুকের সব অভিমান, সব দুঃখ ঘুচে যাবে। সেই কোন কিশোর বয়স থেকে এই মেয়েটির সঙ্গে পাশাপাশি বড় হতে হতে তার ওপর বিপুল অধিকার জন্মে গিয়েছিল। অন্তত তেমনটাই তার ধারণা। কিন্তু এতকালের সম্পর্কটা আজ একরকম অস্বীকারই করেছে ঝিনুক

    মনে মনে একটা ধাক্কা খেলেও বিনয় কিন্তু আশা ছাড়েনি। তার সংকল্প আরও দৃঢ় হয়েছে৷ রস আইল্যান্ডে ঝিনুককে দেখার পর থেকেই সে স্থির করে রেখেছে মধ্য আন্দামানে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করবে। জেফ্রি পয়েন্টে বর্মী–শেল কালেক্টর লা পোয়ের সঙ্গে তার কথাও হয়ে গেছে। বিনয় তাদের মোটরবোট সি-গাল-এ চেপে মিডল আন্দামানে চলে যাবে। লা পোয়ে সেখানকার সবকটা রিফিউজি সেটলমেন্ট চেনে। একবার। পৌঁছুতে পারলে লা পোয়ে ঠিক খুঁজে খুঁজে ঝিনুককে বার করে ফেলবে। বিনয় বলবে প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের বাড়ি থেকে। নিরুদ্দেশ হওয়ার আগে একবারও তার কথা মনে পড়ল না ঝিনুকের? আত্মীয়-পরিজন, বিশেষ করে অবনীমোহন তার সঙ্গে যে নিষ্ঠুর ব্যবহার করেছেন, তার জন্য বিনয় কি দায়ী? সে যে কত কষ্ট পেয়েছে তা কি একবারও ভাবল না ঝিনুক?

    ঝিনুককে বোঝাবে ঠিকই কিন্তু ঝিনুক কি শেষ পর্যন্ত কলকাতায় যেতে আদৌ রাজি হবে? যে বিশ্বাসের জোরে বিনয় তাকে নিয়ে যাবার কথা ভেবেছে তার ভিতটা যেন অনেকখানি ধসে পড়েছে। অদ্ভুত এক সংশয়ে তার বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে যেতে থাকে।

    এর মধ্যেই চার নম্বর অর্থাৎ শেষ খামটা হাতে তুলে নিতেই বিনয়ের সারা শরীরে শিহরন খেলে গেল৷ শিহরন না বলে বিদ্যুৎপ্রবাহ বলা যেতে পারে। খামের ওপর গোটা গোটা অক্ষরে তার নাম লেখা। হাতের লেখাটা তার চেনা– ঝুমা।

    এর আগেও ঝুমা চিঠি লিখেছে। কিন্তু রস আইল্যান্ডে ঝিনুককে দেখার পর সে চিঠির উত্তর দেয়নি বিনয়।

    আশ্চর্য, আজও ঝিনুকের সঙ্গে সেলুলার জেলের সামনে দেখা হয়েছে। আর আজই কিনা ঝুমারও চিঠি এল। এই দুই নারী অদৃশ্য কোনও সুতোয় তার জীবনে বাঁধা রয়েছে। অন্ততকাল ধরে। সেই গিট যেন ছেঁড়া যায় না। কখনও ঝিনুক সামনে এসে দাঁড়ায়, কখনও ঝুমা। আচ্ছন্নের মতো, খানিকটা নিজের অজান্তেই যেন খাম খুলে চিঠিটা বার করল বিনয়। খুব ছোট্ট চিঠি। সামান্য কয়েকটি লাইন।

    একটা মেয়ে প্রাণভরে তোমাকে ভালোবেসেছে। সে সারাদিন তোমার চিঠির আশায় অপেক্ষা করে থাকে। এই মহানগরে কত মানুষ তোমার চিঠি পায়। শুধু সেই মেয়েটা বাদ। তার অপরাধ কী?

    লাইনগুলোর মাথায় কোনও সম্বোধন নেই, নিচে কারুর নামও না।

    ঝুমার অভিমান, ঝুমার মানসিক যাতনা এর মধ্যেই তীব্র ব্যাকুলতা নিয়ে ফুটে উঠেছে। কদিন আগেই এই মেয়েটাকে নিজের জীবন থেকে খারিজ করে দেবার কথা ভেবেছিল বিনয়। কিন্তু ঝিনুকের মতো সেও যেন শতপাকে তাকে জড়িয়ে রেখেছে। সরিয়ে দিতে গেলেও বুঝি বা তাকে সরানো যায় না। ঝিনুক আর ঝুমা, এই দুই নারী যেন তার অনিবার্য নিয়তি।

    চিঠিটা ফের খামের ভেতর পুরে উঠে পড়ল বিনয়। সোজা গিয়ে দাঁড়াল খোলা জানলার পাশে।

    সেই সন্ধে থেকে কুয়াশা পড়তে শুরু করেছিল। এখন তা অনেক গাঢ় হয়েছে। কুয়াশার স্তর ভেদ করে ক্ষীণ চাঁদের যে আলোটুকু চুঁইয়ে চুঁইয়ে নেমে আসছে তাতে চরাচরের কোনও কিছুই স্পষ্ট নয়। দূরের দ্বীপগুলো একেবারে ঝাপসা। মাউন্ট হ্যারিয়েটের যে সাদা ক্রসটা আকাশের দিকে মাথা তুলে থাকে। সেটাও দেখা যাচ্ছে না। শুধু আগের মতোই ঢেউ ভেঙে পড়ার শব্দ আর তুমুল ঝোড়ো হাওয়া। বিনয় টের পেল তার বুকের ভেতর তেমনই কিছু চলছে। অবিরল।

    অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল সে। বিমূঢ়। বুদ্ধিভ্রষ্ট। তারপর কখন এসে শুয়ে পড়ল নিজেরই খেয়াল নেই।

    .

    পরদিন কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল বিনয়ের। এক টানা নয়, থেমে থেমে আর্ত, করুণ সুরে কেউ কেঁদে চলেছে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleগহনগোপন – প্রফুল্ল রায়
    Next Article শতধারায় বয়ে যায় – প্রফুল্ল রায়

    Related Articles

    প্রফুল্ল রায়

    আলোর ময়ুর – উপন্যাস – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    কেয়াপাতার নৌকো – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    শতধারায় বয়ে যায় – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    গহনগোপন – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    নিজেই নায়ক – প্রফুল্ল রায়ভ

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    ছোটগল্প – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Our Picks

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.