Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    উত্তাল সময়ের ইতিকথা – প্রফুল্ল রায়

    প্রফুল্ল রায় এক পাতা গল্প688 Mins Read0

    ৩.০৬ শেখরনাথ ঘুরে দাঁড়ালেন

    শেখরনাথ ঘুরে দাঁড়ালেন। বিনয়ও। একটা লম্বা-চওড়া লোক–শেখরনাথের চেয়ে ছোটই হবে, ষাটের নিচে বয়স, কাঁচাপাকা চুল চামড়া ঘেঁষে ছোট ছোট করে ছাঁটা, তামাটে রং, এই বয়সেও বেশ তাগড়াই, পরনে ঢোলা ফুলপ্যান্ট আর হাফহাতা শার্ট, পায়ে পুরু সোলের চপ্পল, হাতে কালো কারে বাঁধা গুচ্ছের তাবিজ আর মাদুলি–বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে আসছে।

    শেখরনাথ তাকে দেখে খুশিই হলেন। গলার স্বর উঁচুতে তুলে বললেন, আরে বৈজু, তুই? এখানে?

    লোকটা অর্থাৎ বৈজু ততক্ষণে কাছে চলে এসেছে। এবার তাকে আরও স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। গোলাকার সরল মুখ, পুরু ঠোঁট, ওপরের মাড়িটা একটু উঁচু তাই কয়েকটা দাঁত সবসময় বেরিয়ে থাকে। বলল, হ্যাঁ ভাইসাব৷ বলে ঝুঁকে ভক্তিভরে শেখরনাথের পা ছুঁয়ে হাতটা মাথায় ঠেকাল।

    তুই আমার খবর পেলি কী করে?

    বৈজু জানায়, কিছুক্ষণ আগে রাহা সাব অর্থাৎ বিশ্বজিৎ রাহার সঙ্গে আদালতের কাছে তার দেখা হয়েছিল। তিনি জানিয়েছেন, জেফ্রি পয়েন্টের নতুন রিফিউজি সেটলমেন্টে জারোয়ারা একজন উদ্বাস্তুকে তির মেরেছে; বেহুশ অবস্থায় তাকে নিয়ে শেখরনাথ পোর্ট ব্লেয়ারে এসেছেন। লোকটাকে হাসপাতালে ভরতি করা হয়েছে। হাসপাতালে এলে শেখরনাথের সঙ্গে দেখা হবে। তাই দৌড়তে দৌড়তে সে চলে এসেছে। অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজি করেও দেখা না পেয়ে কী ভেবে এধারে আসতেই শেখরনাথের দেখা পায়।

    বৈজু বলল, বহোৎ রোজ বাদ আপনার সাথ দেখা হল। তবিয়ৎ ঠিক হ্যায় তো ভাইসাব?

    শেখরনাথ আস্তে মাথা নাড়লেন। তার শরীর স্বাস্থ্য ঠিকই আছে।

    বৈজু বলতে লাগল, দেখা হবে কী করে? আপনি করোজ আর পোর্ট ব্লেয়ারে থাকেন? জাজিরায় জাজিরায় (দ্বীপে দ্বীপে) ঘুরে বেড়ান। এখন রিফিউজিদের নিয়ে পড়েছেন। পচাশ ষাট মিল দূরে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে নয়া নয়া সেটলমেন্ট দেখছেন। আপনার সব খবর কানে আসে।

    শেখরনাথের মুখে হালকা হাসি লেগেই ছিল। বললেন, জেল থেকে বেকার হয়ে পড়েছি। কিছু একটা নিয়ে থাকতে হবে তো। সময় কাটবে কী করে?

    পোর্ট ব্লেয়ারে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে বিনয় একটা ব্যাপার লক্ষ করেছে। সবাই এখানে হিন্দি-উর্দু মেশানো ভাষায় কথা বলে। বাঙালি ছাড়া অন্যদের সঙ্গে শেখরনাথ এবং বিশ্বজিৎ ওই ভাষাটাই বলে থাকেন। বিনয় শুনেছে, আঠারোশো সাতান্নয় মিউটিনির পর যে বিদ্রোহী সিপাহিদের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল তাদের শতকরা নব্বই ভাগই উত্তরপ্রদেশের লোক। ওদের ভাষাটাই পরে এখানে চালু হয়ে যায়। বর্মী হোক, কারেন হোক, শিখ, পাঠান বা মারাঠি যারাই মিউটিনির পরবর্তীকালে কালাপানির সাজা খাটতে এসেছিল তাদের মুখের বুলি ওটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে।

    বৈজু বলল, সময় কাটানোর জন্যে নয়, মানুষকে আপনি প্যার করেন, তাই তাদের কোনও তখলিফ হলে পাশে গিয়ে দাঁড়ান। সময় কেটে যায়।

    শেখরনাথ উত্তর দিলেন না।

    একটু চুপচাপ।

    তারপর বৈজু বলল, আপনার দেখা যখন পেয়েছি তখন আর ছাড়ছি না। পুরো দো সাল আমাদের কোঠিতে যাননি। কবে আসবেন বলুন–

    শেখরনাথ বললেন, তুই তো জেনেই গেছিস, একজন রিফিউজিকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছি। বিপদ অনেকটা কেটে এসেছে। তবু আরও কয়েকটা দিন তাকে হাসপাতালে থাকতে হবে। যতদিন না সে পুরো সুস্থ হয়ে উঠছে, কোথাও যেতে পারব না।

    ঠিক যায়, ঠিক হ্যায়। ভালো হয়ে উঠলেই যাবেন। সোমবারী আপনার কথা দো-এক রোজ পরপরই বলে। বলে, আপনি আমাদের বিলকুল ভুলে গেছেন।

    একটু ভেবে শেখরনাথ বললেন, জেফ্রি পয়েন্টে ফেরার আগে তোদের ওখানে একবার নিশ্চয়ই যাব। সোমবারীকে বলে দিস। সে ভালো আছে তো?

    হ্যাঁ। ভগোয়ান রামজি কিষুণজির কিরপায় (কৃপায়) আচ্ছাই হ্যায়। বৈজু বলল, আমি তা হলে এখন চলি ভাইসাব। এবারডিন মার্কিটে কিছু কেনাকাটা করতে হবে। ঘরে চাল ডাল ফুরিয়ে এসেছে।

    আচ্ছা, যা

    এতক্ষণ শেখরনাথের সঙ্গেই কথা বলে গেছে বৈজু। তার পাশে যে বিনয় দাঁড়িয়ে আছে, সেভাবে খেয়ালই করেনি। পা বাড়াতে গিয়ে তার চোখ এসে পড়ল বিনয়ের ওপর। বলল, এই বাবুসাবকে তো পহচানতে পারলাম না। নয়া মালুম হচ্ছে। আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের লোকজন প্রায় সবাই সবাইকে চেনে। বিনয়কে সে আগে কখনও দেখেনি, তাই এই কৌতূহল।

    শেখরনাথ বললেন, ও আমার ভাতিজা (ভাইপো) বলতে পারিস। কলকাতায় থাকে। ওখানে আখবরে কাজ করে। পত্রকার। আন্দামানের নয়া সেটলমেন্ট আর পুরনো পেনাল কলোনি দেখতে এসেছে। এসব নিয়ে ওদের কাগজে লিখবে।

    শেখরনাথ তাকে ভাইপো বলে পরিচয় দিয়েছেন, তার মানে খুব কাছে টেনে নিয়েছেন। এটা বিনয়ের পক্ষে বিরাট এক মর্যাদা। বুকের ভেতরটা আবেগে যেন উথালপাতাল হতে লাগল।

    একে পত্রকার অর্থাৎ সাংবাদিক, তার ওপর শেখরনাথের ভাইপো। সসম্ভ্রমে বৈজু কপালে হাত ঠেকিয়ে বলল, নমস্তে বাবুসাব। আপনি কত রোজ আন্দামানে থাকবেন?

    বিনয় প্রতি-নমস্কার করে জানায়, বেশ কিছুদিন তাকে থাকতে হবে। জঙ্গল নির্মূল করে উদ্বাস্তুদের যেসব নয়া বসত গড়ে উঠছে, সেগুলো তো আছেই, যে কয়েদিরা একদিন কালাপানির মেয়াদ খাটতে এসেছিল সারা ভারতবর্ষ এবং বার্মা থেকে দীর্ঘ বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে, এখানকার বড় বড় দ্বীপগুলোতে ঘুরে তাদের কলোনিগুলো দেখতে তো সময় লাগবেই।

    বৈজুর চোখ আবার শেখরনাথের দিকে ঘুরে গিয়েছিল। সে তাঁকে বলল, ভাইসাব যেদিন আমাদের কোঠিতে যাবেন, ভাতিজাকেও নিয়ে যাবেন। আমরা বহোৎ খুশ হব।

    আস্তে মাথা নাড়লেন শেখরনাথ। বিনয়কে অবশ্যই নিয়ে যাবেন।

    বৈজু আর দাঁড়াল না; যেমন লম্বা লম্বা পা ফেলে এসেছিল হুবহু সেইভাবেই চলে গেল।

    লোকটাকে বেশ ভালো লেগে গিয়েছিল বিনয়ের। ভারী বিনয়ী। নম্র ব্যবহার, কথাবার্তা চমৎকার। শেখরনাথকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করে। সেটা অবশ্য এই দ্বীপপুঞ্জের সবাই করে থাকে। নিজের চোখে তা দেখেছে বিনয়।

    শেখরনাথ বিনয়কে জিগ্যেস করলেন, বৈজুকে কেমন মনে হল তোমার?

    যা মনে হয়েছে, অকপটে জানিয়ে দিল বিনয়। শেখরনাথ একটু হাসলেন।–অথচ জানো, বৈজু একসময় ড্রেডেড ক্রিমিনাল ছিল। আমি যে বছর সেলুলার জেলে আসি সেই বছর তিন তিনটে মার্ডার করে একই দিনে সেও এসেছিল। এমনকী খিদিরপুর থেকে একই জাহাজে। এস এস মহারাজা। তাকে রাখা হয়েছিল আমার ঠিক পাশের সেলে।

    বিনয় অবাক। বৈজুর মতো সরল ভালোমানুষ তিন তিনটে মার্ডার করতে পারে, এ যেন ভাবাই যায় না। সে জিগ্যেস করে, খুন করেছিল কেন?

    তা জানি না। আন্দামানে যেসব এক্স-কনভিক্ট দেখতে পাবে, তাদের সবার গায়ে দু-চারটে মার্ডারের হিস্ট্রি জুড়ে আছে। কে কী কারণে খুন করেছে তা জানা একটা পুরো জীবনেও সম্ভব হবে না।

    বৈজু সম্বন্ধে ভীষণ আগ্রহ বোধ করছিল বিনয়। কয়েকদিন আগে জেফ্রি পয়েন্টে একজন রিফিউজি সৃষ্টিধরের দশ মাসের পোয়াতি বউ যখন যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে, যে কোনও সময় তার। পেট থেকে বাচ্চা বেরিয়ে আসতে পারে দাইয়ের খোঁজে তিনটে পাহাড় পেরিয়ে অন্য একটা রিফিউজি সেটলমেন্টে শেখরনাথের সঙ্গে বিনয়ও গিয়েছিল। পথে পড়েছিল ব্রিটিশ আমলের একটা পেনাল কলোনি। সেখানে রঘুবীর আর তার স্ত্রী। মা ফুনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন শেখরনাথ। একদিন রঘুবীররাও দ্বীপান্তরী সাজা মাথায় নিয়ে আন্দামানে এসেছে। কিন্তু শরীরে যে অপরাধের রক্তধারা বইত তা কবেই শোধন হয়ে গেছে। এখন তারা পরিপূর্ণ সংসারী মানুষ। সুখী গৃহস্থ। এই দ্বীপে বছরের পর বছর কাটিয়ে জীবন থেকে ভয়ংকর, গ্লানিকর অতীতকে ওরা মুছে দিয়েছে। বিনয় ঠিক করেছিল পেনাল কলোনি সম্পর্কে জানতে ওদের কাছে চলে যাবে। কিন্তু কবে পোর্ট ব্লেয়ার থেকে ফিরে সেখানে যাওয়া সম্ভব হবে, জানা নেই। হাতের কাছে যখন বৈজুকে পাওয়া গেছে, সুযোগটা কোনও ভাবেই ছাড়বে না সে। শেখরনাথের সঙ্গে তাদের কোঠিতে চলে যাবে। তার খুব কৌতূহল হচ্ছিল রঘুবীর কীভাবে মা ফুনকে বা বৈজু কীভাবে সোমবারীকে বিয়ে করেছিল, তা জানতেই হবে। মেনল্যান্ড থেকে আট নশো মাইল দূরে বহু বছর আগে তাদের যৌবনে বৈজু কোন পদ্ধতিতে তাদের স্ত্রীদের জোগাড় করেছিল সেটা বিনয়ের কাছে মস্ত ধাঁধা।

    শেখরনাথ বললেন, চল, ডানপাশের ব্লকটায় ঢোকা যাক। এখানেই আমার জীবনের অনেকগুলো বছর কেটে গেছে।

    আগাছা আর বুনো ঘাসে ভরা মস্ত চত্বরটা। পাঁচটা পাথরের সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠলেন শেখরনাথরা। হাসপাতালের ব্লকটার মতো এটাও অবিকল একই রকমের। একতলার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত অবধি সারি সারি কুঠুরি বা সেল। প্রতিটি সেলের সামনে লোহার মোটা মোটা শিক বসানো নিচু দরজা। দরজাগুলোতে মস্ত মস্ত মজবুত তালা ঝুলছে। প্রতিটি সেল সাত ফিটের মতো লম্বা, চওড়া ছফিটের বেশি হবে না। সামনে দরজা, পেছনে ঘুলঘুলির চেয়ে সামান্য বড় জানলা; সেগুলোতেও মোটা শিক গেঁথে দেওয়া। সেলগুলোর সামনে দিয়ে চওড়া, টানা বারান্দা চলে গেছে। বারান্দার একপাশে সেল, অন্যপাশে রেলিং। পঁচিশ-তিরিশ ফিট পর পর ওপরে ওঠা বা নিচের চত্বরে নামার জন্য সিঁড়ি।

    সুবিশাল তিনতলা ব্লকটা একেবারে নিঝুম। কেউ কোথাও নেই। যে ব্লকটায় হাসপাতাল সেখানে একটা বের্ডও খালি নেই। সব বেডেই পেশেন্ট। তাছাড়া ডাক্তার, নার্স, ক্লাস-ফোর স্টাফের কর্মী এবং রোগীদের ভিজিটরে সর্বক্ষণ এলাকাটা গমগম করে। কিন্তু এই পরিত্যক্ত ব্লকটা এত নির্জন, এত স্তব্ধ যে গা ছম ছম করে।

    দীর্ঘ বারান্দা দিয়ে বিনয়কে পাশে নিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে দূরে আট-দশ তলা হাইটের উঁচু ওয়াচ টাওয়ার দিকে আঙুল বাড়িয়ে দিলেন শেখরনাথ। বললেন, ওটা একবার লক্ষ কর।

    ওয়াচ টাওয়ার আগেও চোখে পড়েছে বিনয়ের। তবু সেদিকে তাকাল সে৷ টাওয়ারটা মাঝখানে রেখে একসময় সেটার গা থেকে জেলখানার সাতটা তিনতলা উইং সাতদিকে সামান্য কোনাকুনি বেরিয়ে গেছে। সাতটার সবগুলোই টিকে নেই। জাপানি বোমায় একটা ভেঙে গিয়েছিল; একটা ভূমিকম্পে শেষ।

    শেখরনাথ বললেন, ওই উঁচু ওয়াচ টাওয়ারটার একটা স্পেশাল ব্যাপার আছে।

    কী ব্যাপার? বিনয় উৎসুক হল।

    ওটার টপ ফ্লোর থেকে জেলখানার প্রায় প্রত্যেকটা সেল দেখা যায়। ইংরেজরা আর্কিটেকচারটা কেমন আটঘাট বেঁধে তৈরি করেছিল ভেবে দেখ। ব্রিটিশ পুলিশ অফিসাররা পালা করে। টাওয়ারটা থেকে দিনরাত কয়েদিদের ওপর নজরদারি করত। কেউ কোনও মতলব আঁটছে কি না সেটা বুঝতে চেষ্টা করত। তাছাড়া প্রতিটি ব্লকের সামনের খোলা চত্বরে অন্য সেন্ট্রিরা তো ছিলই। তাদের কেউ কেউ ব্রিটিশ, তবে বেশিরভাগই ইন্ডিয়ান।

    বারান্দায় শেখরনাথ আর বিনয়ের পায়ের আওয়াজ ছাড়া কোথাও বিশেষ শব্দ নেই। তবে সামনের খোলা চত্বরের ঘাসবন। আর আগাছার জঙ্গল থেকে ঝিঁঝিদের একটানা কনসার্ট উঠে আসছে; মাঝে মাঝে কোনও গাছের ডালে কাঠঠোকরারা ধারালো ঠোঁটে সমানে তুরপুন চালাচ্ছে। ঠক ঠক ঠক ঠক।

    বিনয় বলল, মাঝখানে উঁচু টাওয়ারটা থেকে পাহারাদারির কথাটা আমি দু-একটা বইয়ে পড়েছি।

    শেখরনাথ বললেন, তাছাড়া, একতলা থেকে তেতলা অব্দি প্রতিটি ফ্লোরের বারান্দায় টহল দিত টিল্ডাল আর পেটি অফিসাররা। তাদেরও একটা বড় কাজ ছিল কয়েদিদের ওপর নজর রাখা। ব্রিটিশ কি ইন্ডিয়ান সেন্ট্রিদের তুলনায় এরা ছিল আরও মারাত্মক। পরে তাদের মহিমা হাড়ে হাড়ে বুঝেছি।

    বিনয় জিগ্যেস করল, টিন্ডাল আর পেটি অফিসার কাদের বলা হত? নজরদারি ছাড়া তাদের কী কাজ ছিল?

    শেখরনাথ জানালেন, পুরনো সাংঘাতিক কয়েদিদের ভেতর এদের বাছাই করে নেওয়া হত। যে যত ভয়াবহ বাছাইয়ের ব্যাপারে তাদের প্রেফারেন্স ছিল বেশি। এদের শতকরা নব্বই জন পাঠান কি জাঠ। এদের মতো নিষ্ঠুর অত্যাচারী ভূ-ভারতে খুব। কমই জন্মেছে। নতুন কয়েদিদের মধ্যে কেউ জেলের নিয়ম একচুল ভাঙলে ওদের দিয়ে প্রচণ্ড নির্যাতন চালানো হত। পেটি অফিসারদের মাইনে ছিল এক টাকা থেকে দেড় টাকা, টিন্ডালদের বারো থেকে চোদ্দো আনা। এর জন্যে তারা না পারত এমন অপকর্ম নেই। এইসব সাক্ষাৎ শয়তানের অবতারদের একমাত্র কাজ ছিল পদে পদে কয়েদিদের খুঁত ধরা। এতটুকু এদিক ওদিক চোখে পড়লে টিকটিকিতে চড়িয়ে বেতের বাড়ি। অবশ্য ব্রিটিশ ডেপুটি জেলারকে কার কতটা অপরাধ হয়েছে তার ফিরিস্তি দিতে হত। অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী কাকে কত ঘা বেতের বাড়ি বরাদ্দ করা হবে সেটা ঠিক করে দিত ওই ডেপুটি জেলার। তাছাড়া আরও নানারকম শাস্তির ব্যবস্থাও ছিল।

    তালাবন্ধ সেলগুলোর পাশ দিয়ে যেতে যেতে বিনয় বলল, কাকা, জেফ্রি পয়েন্টে আপনি একদিন বলেছিলেন নাইনটিন টোয়েন্টি এইট আপনি সেলুলার জেলে এসেছিলেন।

    হ্যাঁ, বলেছিলাম তো। তোমার কি এ নিয়ে কোনও প্রশ্ন আছে? চলার গতি থামাননি শেখরনাথ। বিনয়ের দিকে ঘাড় ফিরিয়ে জিগ্যেস করলেন শেখরনাথ।

    বিনয় বলল, প্রশ্ন ঠিক না, কৌতূহল।

    বল, কী জানতে চাও

    কত বছর এখানে কাটিয়েছেন?

    উনিশ বছর। নাইনটিন টোয়েন্টি এইট থেকে ফর্টি সেভেন। দেশ স্বাধীন হবার পর মুক্তি পেয়েছিলাম।

    যতদিন এখানে ছিলেন কীভাবে দিনগুলো কেটেছে, জেলখানার তখনকার পরিস্থিতি কেমন ছিল, কয়েদিরা বা জেলের কর্তারা আপনাদের মতো রাজবন্দি রেভোলিউশনারিদের কীরকম ব্যবহার করত, জানতে ইচ্ছা করে।

    একটু চুপ করে রইলেন শেখরনাথ। তারপর একটু হেসে বললেন, শোনার যখন এত আগ্রহ, বলছি। তুমি তো স্টিমলিপ মহারাজায় রিফিউজিদের সঙ্গে আন্দামানে এসেছ।

    হ্যাঁ

    ওই জাহাজটা এই রুটে বহু বছর ধরে চলাচল করছে। আমিও ওই মহারাজাতেই আরও দুজন বিপ্লবীর– ইংরেজ–২ গভর্নমেন্টের ভাটায় টেরোরিস্ট–সঙ্গে কালাপানির সাজা নিয়ে এসেছিলাম। ওই জাহাজে একশো পঞ্চাশ জন খুনি ডাকাতকেও দ্বীপান্তরী পানিশমেন্ট খাটতে পাঠানো হয়েছিল। ইংরেজদের চোখে টেরোরিস্টরা অন্য সব ক্রিমিনালদের চেয়েও অনেক বেশি ভয়ংকর। অনেক বেশি বিপজ্জনক। আমাদের তিনজনকে রাখা হয়েছিল দোতলার ডেকে তিনটে পাশাপাশি কেবিনে। দরজার সামনে রাইফেল হাতে ইংরেজ সার্জেন্ট। রাতদিন পালা করে তিন শিফটে আমাদের পাহারা দিত। আমাদের পায়ে কিন্তু ডান্ডাবেড়ি ছ, লাগানো থাকত। ভাবো তো, হুগলি নদী পেরিয়ে, স্যান্ডহেড পেছনে ফেলে বে অফ বেঙ্গল-এ জাহাজ আসার পর কেবিনের দরজা জানলা হাট করে খুলে দিয়ে পাহারা তুলে নিলেও পালাব কোথায়? মুক্তির একমাত্র উপায় তো পায়ে বেড়ি নিয়ে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়া। কিন্তু সেখানে ঝাঁকে ঝাকে হাঙর ঘুরে বেড়াচ্ছে। না, হাঙরেরা আমাদের নিয়ে ভোজসভা বসাক, এটা কি মেনে নেওয়া যায়? পৈতৃক প্রাণটা এভাবে খোয়াতে কেউ রাজি ছিলাম না। সে যাক গে আমাদের কেবিনের ধারেকাছে অন্য কয়েদিদের ঘেঁষতে দেওয়া হত না। তাদের রাখা হয়েছিল লোয়ার ডেকের তলায় জাহাজের খোলের ভেতর। সেখান থেকে ওদের উঠে আসতে দেওয়া হত না। আমাদের কাছাকাছি এলে যদি ওই কয়েদিদের রক্তে বিপ্লবের বিষ ঢুকে যায়– এমনটাই ছিল ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের ভয়। বোঝো, পায়ে লোহার বেড়ি নিয়ে তিন নিরস্ত যুবক ইংরেজদের কাছে কতটা ভয়ংকর ছিলাম। শুনলে হাসি পায় না?

    সেটা ছিল খুব সম্ভব অক্টোবর মাস। মনসুনের দাপট আর নেই। পুজো শেষ হয়েছে তার কয়েকদিন আগে। সমুদ্র শান্ত থাকার কথা। কিন্তু বে অফ বেঙ্গল আর বে অফ বিস্কে সৃষ্টিছাড়া সমুদ্র। মনসুনই হোক বা বছরের অন্য যে কোনও সময়ই তোক, কখন যে খেপে উঠবে, আগে তার আঁচ পাওয়া যায় না। খিদিরপুর থেকে জাহাজ ছাড়ার পরের দিন বিকেলের দিকে উত্তর-পশ্চিম কোণ থেকে হঠাৎ কালো কালো পাহাড়ের মতো মেঘ ধেয়ে এসে সারা আকাশ ছেয়ে ফেলল। বঙ্গোপসাগর চোখের পলকে উন্মাদ হয়ে উঠেছে। তার ঘাড়ে যেন লক্ষ কোটি অশরীরী জিন কয়েদিদের ভর করেছে। পারাপারহীন, খোলা সমুদ্রের ওপর দিয়ে প্রায় একশো মাইল বেগে ঝোড়ো হাওয়া। বইতে লাগল। আট দশ মাইল জুড়ে ঢেউয়ের পর ঢেউ দেড়শো দুশ ফিট উঁচু হয়ে মোচার খোলার মতো মহারাজা। জাহাজটাকে একবার মহাশূন্যে তুলে পরক্ষণে পাতালে আছড়ে ফেলছে। ঝড়ের সঙ্গে শুরু হয়েছে তুমুল বৃষ্টি। বৃষ্টির ঝাঁপটা তো আছেই, সেই সঙ্গে ঢেউগুলো প্রবল আক্রোশে একতলা দোতলা তেতলার ডেকের ওপর দিয়ে সাঁই সাঁই আওয়াজ করে বয়ে যাচ্ছে। শরৎচন্দ্রের লেখায় সাইক্লোনের কথা পড়েছি। সেটা যে কতখানি ভয়ংকর, সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম।

    মনে হয়েছিল, আমাদের অদৃষ্টে আর সেলুলার জেলে বাকি জীবন কাটাবার সৌভাগ্য হবে না। তার আগেই অতবড় দশ বারো টনের বিশাল জাহাজটা কয়েদি এবং জাহাজের ক্যাপ্টেন, ছোট বড় নানা অফিসার এবং কয়েক ডজন লস্করসুদ্ধ জলের তলায় ডুবে যাবে। যদি তাই হত, একরকম বেঁচে যেতাম। কিন্তু কপালে উনিশ বছর সেলুলার জেলের নরকযন্ত্রণা লেখা আছে, সেটা খণ্ডাবে কে?

    অফুরান আগ্রহে শুনে যাচ্ছিল বিনয়। বলল, আমি যখন আসি তখনও সমুদ্রে সাইক্লোন হয়েছিল। সেটা কিন্তু মনসুনের সময় নয়।

    শেখরনাথ বললেন, এটাই বে অফ বেঙ্গলের ক্যারেক্টার তার মতিগতি বোঝা ভার। কখন যে কী করে বসবে তার ঠিক ঠিকানা নেই। তারপর শোন। আগে দুচারবার লঞ্চে যে চড়িনি তা নয়। কিন্তু সেগুলো চলত নদীর ওপর দিয়ে। মাত্র দু-এক ঘণ্টার ব্যাপার। জাহাজে সমুদ্রযাত্রা আমার সেই প্রথম। সাইক্লোনের মধ্যে পড়াও প্রথম। কেবিনের পুরু কাচের জানলা জাহাজের গায়ে শক্ত করে ঠেসে আটকানো ছিল। সেটা দিয়ে বাইরে তাকিয়েই ছিলাম। কিন্তু বিশ্বব্রহ্মাণ্ড অন্ধকার। যেন কালো পিচে ঢাকা। এদিকে রোলিং আর পিচিংও শুরু হয়েছে। জাহাজের ক্যাপ্টেন, অফিসার আর লস্কররা ছিল এক্সপার্ট। এবং দুঃসাহসীও। সাইক্লোনের মুখে কী করতে হয় তারা জানে। বিশাল বিশাল ঢেউ কাটিয়ে কাটিয়ে কখনও ওপরে উঠে, কখনও নিচে নেমে জাহাজ এগিয়েই চলছিল। কোন দিকে যাচ্ছে কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। ভেবেছিলাম যে কোনও মুহূর্তে সলিল সমাধি ঘটে যাবে। মৃত্যু একেবারে অবধারিত। কিন্তু টের পাচ্ছিলাম বেঁচে আছি, বেঁচে আছি।

    আন্দাজ ছসাত ঘণ্টা পর সাইক্লোনের তাণ্ডব কমে এল। সমুদ্র শান্ত হয়ে আসছে। উথালপাতাল ঢেউয়ে জাহাজের তুমুল দোলানিতে হাড়গোড় বোধহয় আস্ত ছিল না। কখন নির্জীব হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না। ঘুম ভেঙে ছিল পরদিন সকালে। বঙ্গোপসাগর তখন ভারী শান্ত। আগের দিনের বিকেল থেকে কয়েকটা ঘণ্টা সেটা যে অলৌকিক এক মহাদানব হয়ে উঠেছিল, বোঝাই যায় না। গ্রামের কোনও নিরীহ জলাশয়ের মতো দিগন্ত জুড়ে সেটা পড়ে আছে। দিনের প্রথম নরম সোনালি রোদ ছোট ছোট ঢেউগুলোর ওপর ঝিলমিল করছে।

    শুনতে শুনতে বিনয় অবাক। কলকাতা থেকে আসার সময় এমন অভিজ্ঞতাই হয়েছিল তারও। সাইক্লোনের সময় সমুদ্র বুঝি বা এইভাবেই জাহাজের যাত্রীদের সঙ্গে একইরকম মশকরা করে থাকে। সে জিগ্যেস করল, তারপর কী হল কাকা?

    শেখরনাথ বলতে লাগলেন, ফোর্থ ডে বিকেলে আমরা পোর্ট ব্লেয়ার পৌঁছলাম। চ্যাথাম জেটিতে তখন কলকাতা কি মাদ্রাজের জাহাজ এসে ভিড়ত। কখনও কখনও রস আইল্যান্ডের জেটিতে। কিন্তু সেইসময় কী একটা অসুবিধা হওয়ায় মহারাজা জাহাজ রস বা চ্যাথামে ভেড়েনি। রস-এর উলটো দিকে সিসোস্ট্রেস বের এধারে যে জেটিটা রয়েছে সেখানে এসে নোঙর ফেলেছিল। তখন এই জেটিটা ছিল অনেক বড়।

    বিনয়ের মনে পড়ল সে যখন রিফিউজিদের সঙ্গে আন্দামান। আসে জাহাজ রস আইল্যান্ডে ভেড়ে। সেখান থেকে ছোট ছোট লঞ্চে তাদের তুলে কয়েকবারে সেসষ্ট্রেস বের এধারের জেটিতে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল।

    শেখরনাথ বলেছিলেন, সেই আটাশ সালে আমাদের তো জাহাজ থেকে নামানো হল। সঙ্গে অন্য কয়েদিদেরও। পায়ের বেড়ি অবশ্য খুলে দেওয়া হয়েছিল। আমাদের অভ্যর্থনার জন্য অনেক আগে থেকেই প্রচুর আর্মড পুলিশ মোতায়েন ছিল। পুলিশে পুলিশে জেটির চারপাশ ছয়লাপ। তারা দুটো দলে ভাগ হয়ে একটা দল সাধারণ কয়েদিদের ঘিরে ফেলল। আমাদের তিনজন রেভোলিউসনারির জন্যে রাজকীয় বন্দোবস্ত। শদেড়েক সাধারণ কয়েদির জন্যে চল্লিশ জন পুলিশ এবং একজন ব্রিটিশ অফিসার। আমাদের তিনটি প্রাণীর জন্য বারোজন পুলিশ এবং তিনজন ইংরেজ অফিসার। কতখানি মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল ভেবে দেখ। অন্য কয়েদিদের দুপাশে এবং পেছনে পুলিশ, সামনে অফিসার। আমাদেরও তাই। তবে একসঙ্গে অন্য কয়েদিদের সঙ্গে আমাদের আনা হয়নি। শোভাযাত্রা করে টিলার পর টিলা পেরিয়ে ওরা খানিকটা এগিয়ে যাবার পর, আমাদের যাত্রা শুরু হল।

    আধঘণ্টার মতো হাঁটার পর আমরা সেলুলার জেলের গেটের সামনে চলে এলাম। বাংলাদেশে আরও দু-চারটে জেলে কিছুদিন থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। কিন্তু ভয়ংকর চেহারার মজবুত লোহার ফটক আগে কখনও দেখিনি। তিরিশ-চল্লিশ জনের একটা পুলিশ বাহিনী সেখানে রাইফেল হাতে অ্যাটেনশনের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। কঠোর, নিষ্ঠুর মুখ। মনে হয় পাথরে তৈরি। দু-চারজন ইংরেজ অফিসারও চোখে পড়ল। বিপ্লবীদের সঙ্গে জীবনমৃত্যুর মাঝখানের তফাতটা এক চুলও নয়, তবু এদের তদারকিতে বাকি জীবন কাটাতে হবে ভাবতেই বুকের ভেতরটা আমূল কেঁপে গেল। নির্মম দৃষ্টিতে তারা আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল। মুখে একটা কথাও নেই। যে বাহিনীটা জেটি থেকে আমাদের নিয়ে এসেছিল, গেটের একজন অফিসার তাকে ভেতরে যাবার জন্যে হাত নেড়ে ইশারা করল।

    গেট পেরিয়ে সেলুলার জেলে পা রাখলাম। ভেতরে চত্বরে তখন অনেক পুরনো কয়েদি লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সবার গলায় কালো মোটা সুতোয় লোহার চৌকো ফলক ঝুলছে। দু ইঞ্চির মতো লম্বা, দেড় ইঞ্চির মতো চওড়া, একই মাপের। প্রতিটি ফলক। সেগুলোতে নম্বর খোদাই করা রয়েছে। এক, দুই, তিন, চার…। দাড়ি পাগড়ি দেখে কে শিখ, কে মুসলমান আন্দাজ করা যাচ্ছিল। মোঙ্গোলিয়ান মুখ দেখে বর্মি আর কারেনদের চিনতে পারছিলাম। অন্য সবাই কারা কোন প্রভিন্স থেকে এসেছে বোঝা যায়নি। তবে এদের সঙ্গে বাকি জীবন যখন কাটাতে হবে তখন নিশ্চয়ই চিনতে পারব। রাইফেল হাতে এক দঙ্গল পুলিশ কাছাকাছি দাঁড়িয়ে তাদের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখছিল। তিন-চারজন ইংরেজ অফিসারও রয়েছে। একজন কয়েদি, তার গলায় ফলকে লেখা পেটি অফিসার স্কুলে যেমন রোল কল করা হয় সেইভাবে হেঁকে যাচ্ছিল, সাত-আট নে- দশ সঙ্গে সঙ্গে ওই সব নম্বরধারী কয়েদিরা হাজির বলেই লাইন থেকে বেরিয়ে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াচ্ছিল। এই বিচিত্র রোল কলের কারণটা সেদিন বোধগম্য হয়নি, পরে বুঝতে পেরেছিলাম।

    আমাদের দেখে পুরনো কয়েদিদের মধ্যে তুমুল চাঞ্চল্য দেখা দিল। তারা হই হই করে উঠল, নয়া মেহমান আ গিয়া রে, নয়া মেহমান আ গিয়া

    কঁহাসে আয়া তুলোগ? বঙ্গালি, বিহারি, পাঠান, মারাঠি? কিতনা আদমিকো খতম কিয়া রে?

    অর্থাৎ আমরা যারা সেলুলার জেলে প্রথম পা ফেললাম তারা ইন্ডিয়ার মেনল্যান্ডে কে কটা খুন করে এসেছি সেটাই তারা জানতে চাইছে। পরে জেনেছিলাম, যে যত বেশি হত্যা করেছে, কালাপানির এই জেলখানার বাসিন্দাদের চোখে তার কদর, তার কৌলীন্য অন্যদের তুলনায় শতগুণ বেশি।

    এদিকে ইংরেজ অফিসাররা কোমরের খাপ থেকে পিস্তল বের করে কয়েদিদের দিকে তাক করে গর্জে উঠেছে, শাট আপ শালেলোগ পেটি অফিসার গলার স্বর আরও সাত পর্দা চড়িয়ে দিল। কুত্তাকা বাচ্চা, বিলকুল খামোস। মুহসে আওয়াজ নিকালে তো গলার নলিয়া ছিঁড়ে ফেলব। তারপর পুরনো কয়েদিদের বাপ-মা চোদ্দোপুরুষ উদ্ধার করে একটানা কিছুক্ষণ বাছা বাছা খিস্তি চলল।

    আমরা যারা নতুন আন্দামানে এলাম, জাহাজে এবং জাহাজ থেকে নামার পর যেমনটা করা হয়েছিল, জেলখানাতেও তার তফাত কিছু ঘটল না। অন্য কয়েদিদের পাহারা দিয়ে ডানপাশের। অন্য একটা ব্লকের দিকে নিয়ে যাওয়া হল। আর আমাদের তিন বিপ্লবীকে পুলিশরা চারপাশ থেকে ঘিরে বাঁ-ধারের অন্য একটা ব্লকে আনাল। ইংরেজ গভর্নমেন্টের চোখে সশস্ত্র বিপ্লবীরা যে কতটা ভয়ংকর, কতখানি বিপজ্জনক, মহারাজা জাহাজে ওঠার সময় থেকেই টের পেয়েছিলাম। কলকাতা থেকে আটশো মাইল দূরে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন আন্দামান দ্বীপে এসে দেখা গেল, হাল একই। যতই পৃথিবী নামে গ্রহটির সবচেয়ে শক্তিধর জাতি হিসেবে ওরা দম্ভে ফেটে পড়ুক, ভারতীয় বিপ্লবীদের ওরা মনে মনে যমের মতো ভয় পায়।

    আমাদের যে ব্লকটার সামনে নিয়ে আসা হল সেখানেও খোলা চত্বরে পুরনো কয়েদিদের লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে রোল কল করা হচ্ছিল। চেনা দৃশ্য। একটু আগেই এমনটা দেখে এসেছি। এই কয়েদিরা কিন্তু কোনও আগ্রহ দেখাল না। আমাদের দিকে নিস্পৃহ চোখে একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল। ..

    এধারের ব্লকটার পাশে একটা বড় দোতলা বিল্ডিং। সেটার চারপাশে রাইফেল হাতে পঁচিশ-তিরিশ জন সেন্ট্রি। এদের কেউ ভারতীয় নয়, সব ব্রিটিশ। পঁচিশ-তিরিশ হাত দূরে দূরে পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

    যারা পাহারা দিয়ে নিয়ে এসেছিল তাদের অপেক্ষা করতে বলে তিন ইংরেজ পুলিশ অফিসার আমাদের বলল, কাম অন

    দোতলা বিল্ডিংটার গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলে ফুলে বাগান। মাঝখান দিয়ে সুরকির পথ সোজা বাড়িটায় গির থেমেছে। অফিসারদের সঙ্গে পথটা পেরিয়ে তিনটে স্টেপ ওপ উঠতেই দেখা গেল চওড়া বারান্দা। সেটার একধার দি দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। অফিসাররা আমাদের দোতলায় এক ঘরের দরজার সামনে এনে দাঁড় করাল। দরজার পাশে দেওয়ালে পেতলের চকচকে মস্ত ফলকে লেখা: জেল সেলুলার জেল। পোর্ট ব্লেয়ার।

    দরজায় দামি পর্দা ঝুলছিল। বাইরে থেকে একজন অফিসা সসম্ভ্রমে বলল, মে উই কাম ইন স্যার

    ভারী গমগমে স্বর ভেসে এল। কাম ইন–

    পরদা ঠেলে তিন অফিসার আমাদের নিয়ে ভেতরে বুটে ঠুকে স্যালুট করল।

    কামরাটা বিশাল। ভারী ভারী ক্যাবিনেট দিয়ে সাজানো। সিনি থেকে চার ব্লেডওয়ালা ফ্যান ঝুলছে। তাছাড়া হাতে টানা ম পাখাও আছে। পুরো মেঝে জুড়ে দামি পার্সিয়ান কাপে মাঝখানে মস্ত সেক্রেটারিয়েট গ্লাসটপ টেবিলের ওধা গদিমোড়া হাতলওলা চেয়ারে যিনি বসে আছেন তাঁর দিে তাকালে রক্ত হিম হয়ে যায়। বিপুল শরীরের ওপর বুলন্ডগে মতো প্রকাণ্ড একটা মুণ্ডু ঠেসে বসিয়ে দিলে যেমন দেখায়, হুব সেই রকম। চোখের তারা দুটো বাদামি। ছড়ানো চৌকো চোয়াল। বাঘের থাবার মতো দুটো হাত। পুরু ঠোঁট।

    টেবিলের এধারে কয়েকটা আরামদায়ক চেয়ার। সেগুতে আপাতত ফাঁকা। স্যালুটের জবাবে কোনওরকম প্রতিক্রিয়া দে গেল না। তিন অফিসারের দিকে ফিরেও তাকালেন না জেলর। তাঁর চোখ দুটো আমাদের মুখের ওপর স্থির হয়ে আছে। এমন চাউনি আগে কখনও দেখিনি। মনে হচ্ছিল হাড়মাংস ভেদ করে আমাদের বুকের ভেতর অবধি দেখে নিচ্ছে।

    চোখের পাতা পড়ছিল না লোকটার। আমাদের শিরদাঁড়ার ভেতর দিয়ে অদ্ভুত এক কনকনে শিহরণ খেলে যাচ্ছিল। অনেকক্ষণ পর জেলর বললেন, ওয়েলকাম টু সেলুলার জেল। মনে রেখো, ইন্ডিয়ায় এর চেয়ে বড় নরক আর কোথাও নেই। এটা অ্যাবসোলিউটলি আমার রাজ্য। এখানে কোনওরকম বজ্জাতি আমি বরদাস্ত করি না।

    আমরা কোনও উত্তর দিলাম না।

    জেলর বলতে লাগলেন, তোমাদের মতো টেররিস্টরা স্বাধীনতার খোয়াব ইন্ডিয়ার মেনল্যান্ডে ফেলে এখানে আসে।

    আমাদের মধ্যে চরম দুঃসাহসী ছিল রাজনাথ চক্রবর্তী। ফরিদপুরের ছেলে। একুশ-বাইশের বেশি বয়স হবে না। সে হঠাৎ বলে উঠল, আমরা টেররিস্ট নয়, ফ্রিডম ফাইটার।

    আমার সমস্ত অস্তিত্ব আমূল কেঁপে গিয়েছিল। আমরা কেউ ভীরু, কাপুরুষ নই। কিন্তু ওই হিংস্র বুলগের মুখের ওপর কেউ ওভাবে বলতে পারে কল্পনা করতে পারিনি। চোখের কোণ দিয়ে লক্ষ করলাম, জেলরের লাল মুখটা গনগনে হয়ে উঠেছে। বারুদের স্কুপে যেন আগুন লাগিয়ে দিয়েছে রাজনাথ। সেই মুহূর্তে যেন বিস্ফোরণ ঘটে যাবে। আমার বুকের ধুকধুকুনি থেমে গিয়েছিল। কিন্তু না, তেমন কিছুই হল না। জেলর যেন বেশ আমোদই বোধ করলেন। চোখ ছোট করে ব্যঙ্গের সুরে বললেন, ফ্রিডম ফাইটার! তোমাকে কেউ বলেনি ইংরেজ রাজত্বে কোনও নেটিভের মুখ থেকে ফ্রিডম শব্দটা বেরুনো ক্রাইম!

    রাজনাথ চুপ করে থেকেছে, জবাব দেয়নি।

    জেলর বলেই যাচ্ছিলেন, তোমার বয়স কম, এখনও তেজ একটু-আধটু থেকে গেছে। কালাপানি কী বস্তু তুমি জানো না। শান্তশিষ্ট হয়ে থাকলে কোনও সমস্যাই নেই৷ আনন্দে বাকি জীবনটা জেলখানার সেলে কাটিয়ে দাও।

    রাজনাথ পলকহীন জেলরের তাকানো, কথা বলার ভঙ্গি, রি। থুতনি এবং ঠোঁটের নড়াচড়া লক্ষ করছিল। বলল, বাকি জীবন কাটানোর মতো ধৈর্য আমার নেই জেলর সাব। তারআগেই ইন্ডিয়া স্বাধীন হয়ে যাবে।

    জেলরের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। পৃথিবীজোড়া মহান ব্রিটিশ এম্পায়ারে কোনও কলোনি কোনওদিন স্বাধীন হয়নি; হবেও না। তুমি কেন, তোমার পর হানড্রেড জেনারেশন পার হয়ে গেলেও ইন্ডিয়া ইংল্যান্ডের বুটের তলায় থেকে যাবে। আগেও বলেছি, এখনও বলছি, গোলমাল পাকাবার চেষ্টা কোরো না। আমাদের। ডানপাশে যে ব্রিটিশ পুলিশ অফিসারটি দাঁড়িয়ে আছে তাকে বললেন, এই নোংরা পোকাগুলোকে নিয়ে যাও। দু-একদিনের মধ্যে সেলুলার জেলে যে তিনটি ফাঁসিঘর আছে ওদের দেখিয়ে দিও। ফের তার চোখজোড়া রাজনাথের দিকে ফিরে এল। — বুঝলে ছোকরা, এই জেলখানা তৈরি হবার পর তোমার মতো কয়েকশো বেয়াদপ কয়েদিকে এখানে ফাঁসিতে চড়ানো হয়েছে। বি কেয়ারফুল। নাউ স্টিফেন গো– বলে আঙুল তুলে দরজা দেখিয়ে দিল।

    .

    প্রায় এক নিঃশ্বাসে পুরনো দিনের কথা বলতে বলতে একটু হাঁপিয়ে পড়েছিলেন শেখরনাথ। অফুরান কৌতূহল নিয়ে শুনে যাচ্ছিল বিনয়। উনিশশো আটাশ সালের সেলুলার জেলের টুকরো টুকরো ছবি অদৃশ্য সিনেমার পর্দায় যেন ফুটে উঠছিল। মোহনবাঁশির স্ত্রী ছেলেমেয়েদের এক নম্বর ব্লকে হাসপাতালের বারান্দায় বসিয়ে তারা নির্জন তিন নম্বর ব্লকে চলে এসেছিল। একতলার টানা বারান্দা ধরে দোতলার দিকে যেতে যেতে কখন যে দাঁড়িয়ে পড়েছিল, খেয়াল নেই।

    বিনয় বলল, তারপর?

    ফের শুরু করতে গিয়ে হঠাৎ আকাশের দিকে চোখ চলে গেল শেখরনাথের। সূর্য মাথার উপর উঠে এসেছে। আঁ আঁ করছে রোদ। তিন নম্বর এবং চার নম্বর ব্লকের ফাঁক দিয়ে সিসোস্ট্রেস উপসাগরের লম্বা একটা ফালি চোখে পড়ে। রোদে ঝলকাচ্ছে সমুদ্রের উঁচু উঁচু ঢেউগুলো। সেখান থেকে তীব্র ঝাঁঝ।

    হঠাৎ শেখরনাথের মনে পড়ল, মোহনবাঁশির বউ ছেলেমেয়েদের দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তার নিজেরও খিদে পেয়েছে। নিশ্চয় বিনয়েরও। ব্যস্তভাবে বললেন, আজ আর না; খাবার কিনতে এবারডিন মার্কেটে যেতে হবে। কাল আবার এখানে আসব। তখন পুরনো দিনের আরও ইতিহাস শোনাব।

    বিনয় আর কিছু বলল না। সিঁড়ি দিয়ে নিচের চত্বরে নেমে হাসপাতালের দিকে এগিয়ে চলল।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleগহনগোপন – প্রফুল্ল রায়
    Next Article শতধারায় বয়ে যায় – প্রফুল্ল রায়

    Related Articles

    প্রফুল্ল রায়

    আলোর ময়ুর – উপন্যাস – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    কেয়াপাতার নৌকো – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    শতধারায় বয়ে যায় – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    গহনগোপন – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    নিজেই নায়ক – প্রফুল্ল রায়ভ

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    ছোটগল্প – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Our Picks

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.