উনিশে ডিসেম্বর মরশুমের শীতলতম রাত – ১০
১০
রাত তখন দশটা। পলাশপুর ঘুমিয়ে পড়েছে অনেক আগেই। শুধু এই আদ্যিকালের রায় বর্মন বাড়ির সামনের দিকের একটা ঘরে চিন্তিত মানুষ পায়চারি করে চলেছে প্রতিনিয়ত। গত দুদিন ধরে তার খাওয়া ঘুম উড়ে গেছে, মাথায় একরাশ চিন্তার ভিড় এসে জট পাকাচ্ছে। বুকের ভেতর হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে অবিরত।
আজ রাতে গোটা পলাশপুর যেন প্রকৃতই নিঝুম হয়ে উঠেছে। বাদুড়ের ডানা ঝটপট, মাঝে মাঝে পেঁচার ডাক, পিছনের জঙ্গল থেকে শেয়ালের চিৎকার— আজ যেন কিছুই নেই। গোটা প্রকৃতি যেন মৌনব্রত নিয়ে অপেক্ষা করছে এক নিদারুণ কিছুর। উত্তর দিক থেকে বয়ে আসা হাওয়ার শব্দ, আর পাশের ঘরে রামবিলাসের খুটখাট, এছাড়া বাকি সব নিশ্চুপ।
সুরজিতের মনে হতে লাগল কলকাতার কথা, বাড়ির কথা। কী এমন রাত হয়েছে কলকাতায় এখন, সবে তো সন্ধ্যা বলতে গেলে। এই সময় লোকজন সেজেগুজে বেরোচ্ছে পার্টি করবে বলে। রাস্তাঘাট জনবহুল, হু হু করে গাড়ি যাচ্ছে পথ দিয়ে। ট্রেনে বাসে মেট্রোয় ভিড় কমেনি এখনও। চারিদিকে ব্যস্ততা। এই পলাশপুরের সঙ্গে যেন ভিন্ন মেরুর বৈপরীত্য।
ভাবতে ভাবতেই দরজায় একটা আওয়াজ শোনা গেল, আর তার সাথেই দেখা গেল এক জোরালো টর্চের আলো। সুরজিৎ বুঝল হারাধনবাবু এসে পড়েছেন। গায়ে গলাবন্ধ কালো কোট আর ফিনফিনে সাদা ধুতি। কাঁধে সেই চেনা ঝোলা ব্যাগ, বাঁহাতে একটা মোটা লাঠি আর ডানহাতে টর্চ। চোখে মুখে যেন একটা উচ্ছল ভাব।
সুরজিৎ বুঝল, ভদ্রলোক আজ বেশ খুশি খুশি। আর হবে নাই বা কেন? এত বছর ধরে অপেক্ষা করে আছেন, এই রায় বর্মন বাড়িতে ঢুকবেন বলে। কত বছর ধরে কত পড়াশোনা করেছেন। কত জেনেছেন, বুঝেছেন। আজ সব কিছুর পরিণতির দিন।
সুরজিৎ অবশ্য প্রথমটায় বলেছিল, দিনের বেলা দেখলে ভালো হয় না? রাতের অন্ধকারে সবদিক ভালো করে খোঁজা যাবে কি?
হারাধনবাবু এ-প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন— সরকারিবাবু যে কাজ করতে চলেছি তা দিনের আলোয় হয় না। চাই রাত্রের নিস্তব্ধতা। আর তাছাড়া ভয় নেই, আমি তো থাকব। আজ বয়স হয়ে গেলেও এককালে শরীরচর্চার বদভ্যাস ছিল আমার।
সেটা না বললেও চলত। হারাধনবাবুকে দেখলেই মনে হয় তিনি এখনও সুরজিতের থেকে বেশি ফিট। মেরুদণ্ড সোজা রেখে যখন গটগট করে হাঁটেন, তখন কে বলবে তার বয়স আশির কাছাকাছি। হাবে ভাবে, কথায় বার্তায়, স্মৃতিতে কোনো মরচে ধরেনি একটুও।
সুরজিৎ এও বলেছিল, এভাবে হুট করে ভেতরে না ঢুকে পড়ে, একবার পুলিশে খবর দিলে হতো না? আমি এখানকার সরকারের উঁচু পদের অফিসার। আমার কথা ওই আউটপোস্টের দারোগাবাবু ফেলতে পারত না। এই প্রস্তাবও সঙ্গে সঙ্গে নাকচ হয়ে গিয়েছিল বলাই বাহুল্য।
— আরে মশাই আপনি ভিড় বাড়িয়ে সবকিছু বানচাল করে দিতে চান নাকি? আপনার ভয়টা কীসের? এই মারাত্মক ঠান্ডায় সাপখোপ বাইরে বেরোবে না। যদিওবা বেরোয় তার ওষুধ আমার জানা আছে। দুজনের হাতে থাকবে বারো সেলের জোরালো টর্চ, একটা করে লোহার শাবল।
— “শাবল কী দরকার?” জানতে চেয়েছিল সুরজিৎ ।
হারাধনবাবু বলেছিলেন— “প্রয়োজনে মাটি খুঁড়তে হতে পারে। আপনি রামবিলাসকেও বলে রাখবেন। ওকেও দরকার লাগতে পারে।”
— আবার ওকে কেন মশাই? ও তো নিজেই…
সুরজিতের কথাটা শেষ করতে না দিয়েই রহস্যময় এক হাসি হেসে হারাধনবাবু বলেছিলেন— “ওকেও লাগবে সরকারিবাবু। ওকে বাদ দিয়েও বাড়ির আনাচে-কানাচে ঘুরতে পারবেন ভেবেছেন?”
অতএব নৈশ অভিযানের সবকিছুই প্রায় প্রস্তুত। টর্চ, শাবল, কোদাল, লাঠি, জলের বোতল, কফির ফ্লাক্স, ওডোমস, কার্বলিক অ্যাসিড সব ঘরের কোণে মজুত রাখা।
গরম কফির কাপে চুমুক দিয়ে, হারাধনবাবু উঠে দাঁড়ালেন— “চাঁদ প্রায় মাঝ আকাশে। চলুন সরকারিবাবু এবার যাওয়া যাক।”
আগে আগে হারাধনবাবু, পিছনে সুরজিৎ, ওদের অনেকটা পিছনে রামবিলাস গুটিগুটি পায়ে বাড়ির পিছনের অংশে প্রবেশ করল। অন্ধকারে রামবিলাসের চোখ আগুনের মতো জ্বলছে। একনাগাড়ে বিড়বিড় করে সে বলে চলেছে— “মাত কিজিয়ে বাবু মাত কিজিয়ে!”
আর মাত কিজিয়ে! সুরজিতের মাথায় তখন রোখ চেপে গেছে। আর সত্যি কথা বলতে কী, সবটা শুনে সুরজিতেরও কেমন যেন মনে হচ্ছে, কোনো এক নিদারুণ চাপা রহস্যের আর্তনাদ, সত্যিই এ-বাড়ির ভিতরে কোথাও বন্দি হয়ে পড়ে আছে এতগুলো বছর। কেন এ-কথা মনে হচ্ছে তা সে নিজেও জানে না। হয়তো কয়েকটা দিনে বাড়ির সামনের ঘরটাতে থাকার ফল। হয়তো হারাধনবাবুর থেকেই নকশাল নেতা হিমু বড়ুয়াদের গল্প শোনার ফল।
বিকাল থাকতে থাকতে বাড়ির ভিতরের বেশ খানিকটা জায়গা সাফ করে রাখা হয়েছে, আর কার্বলিক অ্যাসিড ছড়িয়ে রাখা হয়েছে। হারাধনবাবু এগিয়ে চলেছেন ধীর পায়ে। তার জোরালো টর্চের আলো একবার সামনে আর-একবার হাতে ধরা ছবিগুলোতে পড়ছে। সুরজিৎ পিছনে পিছনে যাচ্ছে। ওই তিনটে ছবি সকাল থেকে এতবার দেখেছে, যে এই অন্ধকারেও বাড়ির ভিতরের কোনো কোনো জায়গায় দাঁড়িয়ে সে বলে উঠছে— “এই তো এই সেই জায়গা হারাধনবাবু। এই দেখুন এই ভাঙা খিলান, এই দেখুন অন্দর মহলে যাওয়ার রাস্তা। এই দেখুন দালান, এই যে এই দিকে সিঁড়ি। এই সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় যাওয়া যেত। আর ওখানেই ছিল এই ঘরটা।” ছেলের আঁকা ছবিগুলো মোবাইল স্ক্রিনে বার বার দেখছে আর বলে চলেছে সুরজিৎ।
— “হ্যাঁ সেই ঘর, যেখানে হিমু বড়ুয়া আর তার দলের কজন সঙ্গী থাকত।” বললেন হারাধনবাবু।
রামবিলাস নিশ্চুপ। তার কালো চেহারা অন্ধকারের সাথে মিশে গেছে একেবারে, চোখে জ্বলন্ত দৃষ্টি। আর নাক দিয়ে জোরে জোরে গরম নিশ্বাস ছাড়ছে সে। রামবিলাস অনেক বছর এ-বাড়িতে রয়েছে, এ-বাড়ির খোল নলচে তার নখদর্পণে। অন্ধকারে টর্চের আলো ছাড়াই দিব্যি হেঁটে হেঁটে এগিয়ে আসছে সে। আর থেকে থেকেই বলে উঠছে ওই একই কথা— “মাত যাইয়ে বাবু। আউর মাত যাইয়ে।”
এত বড় বাড়ি এখনকার দিনে কল্পনা করা যায় না। বিশাল বাগান, দালান কোঠা, ফোয়ারা, ঠাকুর বাড়ি, সব পেরিয়ে বাড়ির মূল অংশ। এখন অবশ্য সব ভগ্ন প্রায় আর আগাছার জঙ্গলে ভর্তি। জায়গাগুলোর এই অবস্থা হলেও চিনতে খুব একটা অসুবিধা হয় না সুরজিতের। কারণ ওই তিনটে ছবি। ছবিগুলো মনে থাকলেই বাড়ির কোথায় কী ছিল তা চোখের সামনে ভেসে উঠবে। এই যেমন এখন সুরজিৎ যেখানটা দাঁড়িয়ে আছে সেখানে ছিল এক বিরাট ইঁদারা। ইঁদারার পাঁচিলের কিছু অংশ এখনও মাথা উঁচিয়ে তার মরণোত্তর অস্তিত্ব জানান দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু ওই ছবিগুলো না দেখা থাকলে কেউ বুঝতে পারত না, যে এখানে একসময় বিশাল ইঁদারা ছিল।
কত সময় কেটে গেছে বোঝার উপায় নেই। ঠান্ডা হাওয়ায় শিরদাড়ায় বরফ কুচির স্রোত যেমন বইছে, উত্তেজনার পারদও তেমনই উপরের দিকে উঠছে। বাড়িটার দুদিকে কোনো সীমানা পাঁচিলের অস্তিত্ব নেই। একদিকে দেখা যাচ্ছে দূরে পাহাড়ের সারি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। কালো আকাশের সাথে ঘন কালো পাহাড়ের দেহ মিশে থাকলেও, আলাদা করে তার অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে। আকাশের বুকে কালো ওড়নার মাঝে অগণিত তারার চকমকি।
নদীর ছলাৎ ছলাৎ শব্দও শোনা যাচ্ছে স্পষ্টভাবে। মূক প্রকৃতি নিদ্রিত। মাঝে মাঝে গাছের উপর থেকে পাখির দল ডানা ঝাপটে বিরক্তি জাহির করছে। রাত জাগা পাখি কর্কশ স্বরে ডেকে ডেকে নিজের অস্তিত্ব জাহির করে চলেছে। পায়ের ফাঁকফোঁকর দিয়ে কোনো অজানা সরীসৃপ সুরুৎ করে চলে যাচ্ছে এদিক থেকে ওদিক।
কিছুদূর যাওয়ার পর একটা ভাঙা সিঁড়ি চোখে পড়ল। সিঁড়ির ধাপগুলো অর্ধেক ভেঙে গেছে। রেলিংয়ের ধারে পলেস্তারা খসে হাড় বেরিয়ে গেছে। জায়গায় জায়গায় পুরোনো অয়েল পেইন্টিং আর আয়নার ভাঙা অংশ দেওয়ালে লটকে রয়েছে। যেদিকেই টর্চের আলো পড়ছে দেখা যাচ্ছে ধুলোর আস্তরণ আর ঘন মাকড়সার জাল। দুর্ভেদ্য মাকড়সার জলের বন্ধন ছিন্ন করে ওরা পায়ে পায়ে দোতলায় উঠে যেতে লাগল। সুরজিতের পা দুটো যেন আপনা থেকেই সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। তার নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছার বশবর্তী হয়ে না। দোতলায় উঠেই কেমন একটা আশটে গন্ধ নাকে এসে লাগল। হারাধনবাবু বললেন— “এতদিন নোংরার স্তূপ আর মড়া পাখি, বাদুড়ের দেহ পচার গন্ধ। সুরজিতের গা গুলিয়ে উঠল। পকেট থেকে রুমাল বের করে নাক চাপা দিল সে।
দোতলায় উঠে বোঝা গেল, একটা বড় বারান্দার সামনে তারা দাঁড়িয়ে রয়েছে। অনুমানে বুঝে নিতে হয় যদিও। বারান্দার ছাদ আর কয়েকটা গোল স্তম্ভ ছাড়া এখন আর প্রায় কিছুই অবশিষ্ট নেই। বারান্দা দিয়ে কিছুটা সামনের দিকে পা বাড়ালেই ডানদিকে একটা ভাঙা দরজা চোখে পড়ে। তার পিছনে একটা বিশাল ঘর। ঘরের ভিতরে পা রেখেই সুরজিৎ বুঝল, এ-ঘর ওর চেনা। আগে দেখেছে ও। দেখেছে, বলাইয়ের আঁকা ছবিতে, দেখেছে হারাধনবাবুর ডায়েরির ভিতরে থাকা পুরোনো সাদা-কালো ছবিতে। এটা সেই ঘর কোনো সন্দেহ নেই। সেই মেঝে, সেই ছাদ, কড়ি বরগার সিলিং, পুরোনো সেকেলে ভাঙা ঝাড় লণ্ঠন। মেঝেতে যেন ধুলোর গালিচা পাতা। পুরু ধুলোর আস্তরনে ওদের তিন জনের পায়ের ছাপ পড়ছে স্পষ্টভাবে। কত বছর যে এই ঘরে কোনো মানুষের পায়ের ছাপ পড়েনি, তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
ঘরের কোণে একটা তক্তাপোশ, যার একটা পায়া ভাঙা, একদিকে কাত হয়ে পড়ে আছে একটা জলের কলসি। দেওয়ালে একটা পুরোনো ছবি, আর দুটো ক্যালেন্ডার। সেটা অনেক কষ্টে বোঝা গেল উনিশশ একাত্তরের। অর্থাৎ তারপর থেকে এখানে আর কোনো মানুষের পা পড়েছে কিনা সন্দেহ।
— এই ঘরেই কী নকশাল নেতা হিমু বড়ুয়া আর তাঁর সঙ্গীরা থাকত?
মাথা নেড়ে সায় দেয় হারাধনবাবু— “হ্যাঁ। সঙ্গীরা বলতে, দুজন মাত্র। ওঁর খুব কাছের দুজন।”
হারাধনবাবু বলছেন আর সারা ঘরময় টর্চের আলো বোলাচ্ছেন। রাতের আঁধারে এই ঘুমন্ত বাড়ির ভগ্নপ্রায় দেওয়ালগুলো, জোরালো আলোর ধাক্কায় যেন চমকে চমকে উঠছে।
হঠাৎই একটা ঠান্ডা দমকা বাতাসে উত্তরের জানলার ভাঙা পাল্লাটা খুলে গেল সশব্দে। এরকম ফাঁকা জায়গায় গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে ঝোড়ো হাওয়া চললে যে এরকম শো শো শব্দ হয়, তা সুরজিতের এর আগে জানা ছিল না।
এই ঝোড়ো হাওয়াটা চলে যাওয়ার ঠিক পরেই, চাঁদের আলোর জোর খানিকটা বেড়ে গেল, আর তাতে চারপাশ যেন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল। বোঝা গেল চাঁদের ঠিক উপরে একখানা মেঘের খণ্ড এতক্ষণ, আলোটাকে আড়াল করে রেখেছিল। আড়াল সরে যেতে, এবারে ফুটফুটে জ্যোৎস্না একেবারে ঠিকরে বেরোচ্ছে। দোতলায় আর বিশেষ কিছুই দেখার নেই। বারান্দার সামনের অংশ ভেঙে নীচে পড়ে আছে, সে পথে আর যাওয়ার উপায় নেই।
— বুঝলেন সরকারিবাবু। আমাদের এইখানটায় যেতে হবে।
হারাধনবাবুর গলার স্বরে সুরজিৎ তাকিয়ে দেখল, ভদ্রলোক হাতে ধরা ছবির উপর টর্চের আলো ফেলে, তার মধ্যে আঙ্গুল দিয়ে একটা বিশেষ জায়গা দেখাচ্ছেন।
সুরজিৎ ঝুঁকে পড়ে দেখল, সেটা একতলায় দালানের পিছনে দিকে ওই ইঁদারাটার ছবি।
— কেন? এখানে কী আছে?
মেঝের উপর ছবি তিনটে মেলে ধরলেন হারাধনবাবু। তার উপর টর্চের আলো ফেলে বললেন— “খুব ভালো করে ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখুন তো সরকারিবাবু। কিছু বুঝতে পারছেন কি?”
কিছুক্ষণ ছবিগুলোর দিকে তাকিয়েই সুরজিৎ বুঝতে পারল, হারাধনবাবু ঠিক কী বলতে চাইছেন। তিনটি ছবিতেই ইঁদারাটা হল যাকে বলে কমন ফ্যাক্টর। প্রথম ছবিতে সদর দরজা পেরিয়ে বাগানের মূল অংশের কিছুটা দেখা যাচ্ছে, সেখানে ইঁদারা চোখে পড়ছে। দ্বিতীয় ছবিতে উপরের ঘরের জানলা দিয়ে ইঁদারার কিছুটা আংশিক দেখা যাচ্ছে। আর তৃতীয় ছবিটা পিছনের বাগানের, সেখানে ইঁদারা তো স্পষ্টত দৃশ্যমান।
সুরজিৎ মনে করল, বলাইয়ের আঁকা ছবিগুলোর কথা। ফোন থেকে একবার দেখেও নিল। ঠিক, এই তিনটে ছবিতেও ইঁদারাই কমন ফ্যাক্টর।
— “কিছু বুঝলেন?” জিজ্ঞাসা করলেন হারাধনবাবু।
সুরজিতের মাথায় সব জট পাকিয়ে আছে, সে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে হারাধনবাবুর দিকে। যার অর্থ— কিছুই বুঝলাম না।
— আপনিই বলুন কী বুঝলেন?
হারাধনবাবু বললেন— “ওই ইঁদারাটাই হল আসল জায়গা। আসুন ওখানে গিয়ে যা খোঁজার খুঁজি।”
সুরজিতের তখন নিজের বিচার বুদ্ধি প্রয়োগ করবার মতো মানসিক অবস্থা নেই। সে শুধু ভেবে নিল, হারাধনবাবু যখন বলছেন, ওখানে যেতে, নিশ্চয় ওখানে যাওয়া কর্তব্য। বাকি কিছু সে জানে না। সেখানে কী খুঁজবে, কোথায় খুঁজবে, কীভাবে খুঁজবে? এসব প্রশ্নের উত্তর আপাতত তার কাছে নেই।
হারাধনবাবু তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে বাগানের পিছনে ওই পরিত্যক্ত ভাঙা ইঁদারার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। যার উপরে জঙ্গল আর জঞ্জালের স্তূপ হয়ে গেছে। মাটি পড়ে পড়ে উঁচু ঢিপির মতো উঠে আছে।
ঝুপ ঝুপ শব্দে পিছনে ফিরে সুরজিৎ দেখল, রামবিলাস হঠাৎ কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে প্রবল বিক্রমে ওই ইঁদারার উপরের অংশ শাবল দিয়ে খুঁড়তে শুরু করেছে।
হারাধনবাবু সুরজিতের কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বললেন— “ছোকরা ভূত হলেও বুদ্ধি আছে। আমি কিছু বলার আগেই ও বুঝে গেছে ওখানটা খোঁড়া দরকার।”
সুরজিতের আর বেশি চিন্তাভাবনা করার মতো অবস্থা নেই। রামবিলাসের মধ্যে কিছু যে একটা গোলমাল আছে, এ-কথা সে অনেক আগেই টের পেয়েছিল। এখন প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেল।
— কী মশাই? হাত গুটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন নাকি?
হারাধনবাবু হাতে শাবল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। দু-পা সরে গিয়ে বললেন, এই আশি বছরের বুড়োটাকে দিয়ে মাটি খোঁড়াবেন, ভেবেছেন নাকি? নিন শাবল নিন। হিমু বড়ুয়ার অতৃপ্ত আত্মাকে এবার মুক্তি দিন। আমার রিসার্চ সার্থক হোক।
সুরজিৎ বিনা প্রতিবাদে ইঁদারার চারপাশের মাটি আর পাথুরে অংশে শাবলের আঘাত করতে লাগল। নিস্তব্ধ প্রকৃতি খান খান হয়ে গেল নিমেষে। চারপাশের গাছের নিদ্রিত পাখির দল ডাকতে লাগল বিরক্তির সঙ্গে। মাটি খোঁড়ার শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল রায় বর্মন বাড়ির আনাচে কানাচে।
দোতলার উপর থেকে কেউ হেঁসে উঠল কি? কেউ নিশ্বাস ফেলল জোরে? নাকি সবটাই সুরজিতের মনের ভুল?
খুব বেশি না। আধঘণ্টাখানেক খোঁড়ার পরেই পাওয়া গেল, একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের বাঁ পায়ের ফিমার বোনের কিছুটা অংশ। সুরজিৎ মাটি খুঁড়ে চলেছে সম্মোহিতের মতো। একেবারে একেকটা দেহাংশের কঙ্কাল আবিষ্কৃত হচ্ছে আর রামবিলাস এনে রাখছে দালানে। রামবিলাসের নাক মুখ দিয়ে গরম নিঃশ্বাস পড়ছে, তাঁর চোখ দুটো যেন আগুনের হল্কার মতো জ্বলছে। আস্ত কঙ্কালটিকে উদ্ধার করতে সময় লাগল ঘণ্টাখানেক।
রাত তখন মৃত প্রায়। পুবের আকাশ ফর্সা হতে আর বিশেষ দেরি নেই। এত ঠান্ডাতেও সুরজিতের সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে জাব হয়ে আছে। নাক দিয়ে গরম নিশ্বাস পড়ছে। বুকের পাঁজরের হাড়, হাপরের মতো একবার উঠছে আর নামছে।
রামবিলাসের ক্লান্তি নেই। কিন্তু সুরজিতের দেহে আর জোর নেই। মনের জোরও প্রায় শেষের পথে। হাতের শাবলটাকে পাশে ফেলে, মাটির উপর হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছে সে।
দালানের উপর রাখা নকশাল নেতা হিমু বড়ুয়ার কঙ্কাল। জঘন্যতম ষড়যন্ত্রের স্বীকার হয়ে অকালে মৃত্যু বরণ করতে হয়েছিল যাঁকে। সুরজিৎ দালানের উপর বসে বসে হাঁফাচ্ছে। তার সর্বাঙ্গ ঘামে ভেজা। পাশে বসে রামবিলাস সেই স্থির অবিচল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
সুরজিৎ উঠে দাঁড়াল। একদল পাখি ডাকতে ডাকতে উড়ে গেল বাগানের উপর দিয়ে। দমকা হাওয়ায় গাছগুলো বারবার চমকে চমকে উঠছে। সুরজিৎ তাকিয়ে আছে কঙ্কালটার দিকে। ওর মনে হল— হিমু বড়ুয়ার অতৃপ্ত আত্মা, তাঁর হত্যাকারীর বিচার চায় না, চায় এই মিথ্যে আর অজানার আড়ালে লুকিয়ে থাকা আসল সত্যটি শুধু সামনে আসুক।
সুরজিতের আরও মনে হল— হিমু বড়ুয়া নিজের হত্যাকারীর প্রতি প্রতিশোধ নিতে চায় না। সশস্ত্র কমরেডরা কখনও মরতে ভয় পায়নি। মৃত্যু, ষড়যন্ত্র তাঁদের ছায়া সঙ্গী ছিল। তাই মৃত্যুর প্রতিশোধ চায় না সে। চায় এতগুলো বছর পর সে মুক্তি পাক। লোকে জানুক তাঁর অন্তিম পরিণতিটুকুর কথা। ব্যস। এইটুকুই, আর কিছুই চায় না সে। আর কিছুই না। তবেই সে মুক্তি পাবে।
— ঠিক বলেছ ভায়া। হারাধনবাবুর গম্ভীর গলার স্বরে পিছন ফিরে তাকাল সুরজিৎ। দালানের যে সিঁড়িতে এতক্ষণ তিনি বসেছিলেন, সেটা খালি পড়ে আছে।
— “হারাধনবাবু! হারাধনবাবু?” ডাকতে ডাকতে সারা বাড়ি খোঁজে সুরজিৎ। হারাধনবাবুর দেখা পায় না।
— “আশ্চর্য! লোকটা গেল কোথায়? একটু আগেও তো দেখলাম। হারাধনবাবু? ও হারাধনবাবু?” আবার চিৎকার করে ডাকে সুরজিৎ। না এবারেও কোনো সাড়া নেই। তবে কী? আবার সিঁড়ি দিয়ে উপরে গেলেন?
এই ভেবে সুরজিৎ পিছন দিকে সবে পা বাড়াবে, এমন সময় রামবিলাস তার ঠান্ডা হাতটা দিয়ে সুরজিতের হাত ধরে ফেলে। সুরজিৎ যতই সামনের দিকে এগোনোর চেষ্টা করে, রামবিলাস তাকে পিছনের দিকে টানতে থাকে।
— আউর মাত যাইয়ে বাবু! আইয়ে বাহার আইয়ে।
রামবিলাসের শক্ত হাতের বাঁধন ছেড়ে সুরজিৎ আর এগুতে পারে না। তাকে টানতে টানতে রামবিলাস বাগানের বাইরে নিয়ে আসে।
সুরজিৎ পিছনে ফিরে দেখে হিমু বড়ুয়ার কঙ্কাল সেখানেই পড়ে আছে। আর অবিকল হারাধন বাবুর গলা করে বলছে— বিচার চাই না সরকারিবাবু। মুক্তি চাই। সরকারিবাবু? সেদিন ছিল উনিশে ডিসেম্বর।