উনিশে ডিসেম্বর মরশুমের শীতলতম রাত – ১১
১১
মুক্তারাম স্ট্রিটের চক্রবর্তী পরিবারে আজ অনেক লোক জড় হয়েছে। ঈশ্বর সুবল চক্রবর্তী মশাইয়ের বাৎসরিক কাজ। সকাল থেকে পুজোআর্চা, খাওয়া-দাওয়া চলেছে। সুবল বাবুর আকস্মিক মৃত্যুর আঘাত গোটা পরিবারের বুকে এমনভাবে নেমে এসেছিল, যে গোটা পরিবার একেবারে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। এখন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রাথমিক আঘাতটা সামলে গিয়েছে অনেকটা। সব কিছুই আবার জীবনের চেনা ছন্দে ফিরে আসতে শুরু করেছে।
আত্মীয়স্বজনরা অনেককেই আজ এসেছে। বাড়ি আজ সরগরম। এখন সন্ধ্যা সাতটা। সুরজিৎ বৈঠকখানায় বসে গল্প করছে তার কিছু বিশেষ বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে। বন্দনাও আছে। আর আছে পুলিশ ইন্সপেক্টর অভিজিৎ ঘোষাল। সুবলবাবুর মৃত্যু রহস্য যার মনে প্রথম থেকেই দাগ কেটেছিল। কিন্তু কোনো কুলকিনারা করে উঠতে পারেনি। কী করেই বা পারবে? এই হিসেব মেলানো কী চাট্টিখানি কথা। কীভাবে যে সব হিসেব মিলল, তা সুরজিৎ নিজেও জানে না। পলাশপুরে বদলি হওয়া, হারাধনবাবু, রামবিলাস, রায় বর্মন বাড়ি, হিমু বড়ুয়ার কঙ্কাল সবকিছুই যেন আজ স্বপ্নের মতো মনে হয় তার। কীভাবে যে এত কিছু হল সে নিজেই বুঝতে পারে না।
— আচ্ছা ইন্সপেক্টর ঘোষাল, আপনি কী একটা প্রেস কনফারেন্স কল করতে পারেন?
আচমকা সুরজিতের এই প্রশ্নে ঘোষালবাবু একটু হকচকিয়ে গেল। — প্রেস কনফারেন্স? কেন বলুন তো?
সিগারেটে একটা বড় টান দিয়ে, বেশ খানিকটা ধোঁয়া ছেড়ে সুরজিৎ বলল — আসলে হারাধন বাবুর… থুড়ি হিমু বড়ুয়ার শেষ ইচ্ছাটা রাখতে চাই।
ঘরে উপস্থিত কয়েকজোড়া চোখ তখন অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সুরজিতের দিকে।
অবস্থা বুঝে সুরজিৎ বলল— “আমি চাই হিমু বড়ুয়ার ব্যাপারটা সকলে জানুক। এরকম জঘন্য চক্রান্ত বিচার পাক।”
ইন্সপেক্টর ঘোষাল বললেন— “প্রেস কনফারেন্স করে এসব কথা বলতে বসলে লোকে আমাদের পাগল ভাববে দাদা। আর তাছাড়া এতগুলো বছর আগের এই সব কন্সপিরেসি আর পলিটিক্যাল মার্ডারের এগেইনস্টে কীই বা আপনি প্রমাণ দাখিল করবেন?”
সুরজিৎ মাথা নীচু করে। সে জানে প্রমাণ করার কিছুই নেই। এক রাতের রহস্যময় অলৌকিক কিছু ঘটনার কীই বা প্রমাণ আছে? বাস্তব ভিত্তিই বা কী এমন আছে?
সাক্ষীইবা কে দেবে? সেই হারাধনবাবুই তো আর নেই। সেই রাতে তার পরের ঘটনা কিছুই আর সুরজিতের মনে নেই। ওর মনে পড়ে, দালানের উপর রাখা হিমু বড়ুয়ার কঙ্কালটার কথা। মনে পড়ে রামবিলাস কেমন করে ওকে জোর করে টানতে টানতে রায় বর্মন ভিলার মূল গেটের বাইরে বের করে নিয়ে এসেছিল। মনে পড়ে দালানের বাগানে পড়ে থাকা হিমু বড়ুয়ার কঙ্কালের মুখে শোনা হারাধনবাবুর গলার স্বরে শেষ কয়েকটা কথা।
— “বিচার চাই না সরকারিবাবু। মুক্তি চাই। সরকারিবাবু… সেদিন ছিল উনিশে ডিসেম্বর।”
ব্যস, এর পরের আর কোনো কথাই সুরজিতের মনে পড়ে না। তারপর সব অন্ধকার। জ্ঞান ফিরতে দেখে তার মাথার কাছে পাড়ার বেশ কিছু লোক জটলা করে বসে আছে। গায়ে ধুম জ্বর। রামবিলাস স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে একজন স্থানীয় ডাক্তারকে তুলে নিয়ে এসেছে চিকিৎসার জন্য।
কয়েকদিন পর এসব অবস্থা যখন স্বাভাবিক হয়ে এল, নদীর পাড় দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সুরজিৎ চিন্তা করত হারাধনবাবুর বলা বাংলা নকশাল আন্দোলনের গল্পগুলোর কথা। চিন্তা করত আর তার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠত। নকশাল নেতা হিমু বড়ুয়া তাঁর দুই সঙ্গীর জঘন্য চক্রান্তের শিকার হয়ে অকালে মৃত্যুবরণ করে। একজনের নাম হীরক ঘোষ। আর-একজনের নাম অবশ্য হারাধনবাবু বলে যাননি। কিন্তু সুরজিতের কাছে আজ তাঁর নাম জলের মতো পরিষ্কার। আপনারাও এতক্ষণে বুঝে গেছেন আশা রাখি। বন্দনা টের পেয়েছিল সেই দিন, যেদিন সুবলবাবুর পুরোনো বই ঘাটতে ঘাটতে হিমুর লেখা সেই চিঠিটা চোখে পড়েছিল, যাতে পলাশপুরে যাওয়ার কথা উল্লেখ ছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয়, টেলিফোনে যোগাযোগ করতে না পারায়, সে কথা সে সুরজিৎকে জানাতে পারেনি। জানিয়েছে যখন তখন সব কিছু ঘটে গেছে, যা ঘটার।
নদীর ধার দিয়ে একমনে হাঁটতে হাঁটতে সুরজিৎ শিব মন্দিরের পিছনের ধানের গোলাটা দেখতে পায়। হারাধনবাবু বলতেন এই ধানের গোলার পেছনেই একটা ছোট্ট ঘরে নাকি থাকেন তিনি। এরকম কোনো ঘর সুরজিতের চোখে পড়ে না। চোখে পড়ার কথাও নয়। লোকটারই যখন কোনো বাস্তব অস্তিত্ব নেই, তার আবার ঘর।
গোলা ছাড়িয়ে দূরে শিমুল গাছের ফাঁক দিয়ে সূর্য অস্ত যায়। পলাশপুরের রাত গভীর হয়ে আসে।
এর পরে মাসখানেক সুরজিৎ পলাশপুরে ছিল। আসল ঘটনার অনেকটাই গোপন করে, বেশ কিছুটা উপরমহলে জানিয়ে ট্রান্সফার অর্ডার বার করে আনতে তার বিশেষ অসুবিধা হয়নি। পলাশপুর ছেড়ে আসার সময় রামবিলাসের জন্য মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল সুরজিতের।
রামবিলাস কথা বলতে জানে না। ভদ্রলোকের সঙ্গে কীভাবে গুছিয়ে কথা বলতে হয় তা সে শেখেনি। তার হাবভাব যতই পাগলাটে হোক, একসময়ে তার অদ্ভুতুরে হাবভাব দেখে সুরজিতের মনে যতই সন্দেহ দানা বাধুক, আজ সে ভালো করেই জানে, এই রামবিলাসকে সন্দেহ করা তার কত বড় ভুল ছিল। সে সারাদিন গাঁজা খেয়ে পড়ে থাকত, অদ্ভুত আচরণ করত, কিন্তু সে তার কর্তব্যে এতটুকু ফাঁক রাখেনি কোথাও। ওই ভূতুড়ে বাড়িতে দিনরাত কাটালেও, সে নিজে ভূত ছিল না। সে সুরজিতের কোনো ক্ষতি তো চায়নি বটেই, বরং তাকে হারাধনবাবুর সান্নিধ্য থেকে আড়াল করার চেষ্টা করেছিল। সে আগেই আন্দাজ করেছিল এর মধ্যে একটা বিশাল কোনো গণ্ডগোল লুকিয়ে আছে। তারপর সেই রাতে যখন হারাধনবাবুকে আর দেখতে পাওয়া যায় না, সুরজিৎ পাগলের মতো তার নাম ধরে বাড়ির আনাচে-কানাচে খুঁজতে শুরু করে, তখন এই রামবিলাসই তাকে জোর করে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে না এলে, কী যে বিপদ ঘটত বলা যায় না। তখন সুরজিতের জ্ঞান নেই। গায়ে ধুম জ্বর। সেই অবস্থায় স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে তড়িঘড়ি ডাক্তার ডেকে এনে, সেবাযত্ন করে সুরজিৎকে সে-ই সুস্থ করে তুলেছিল।
— “আগেই আন্দাজ করেছিলাম সুবলবাবুর মৃত্যুর মধ্যে কোনো না কোনো এক জটিল রহস্য লুকিয়ে আছে। কিন্তু তার তল খুঁজে পেতে যে পলাশপুরে যেতে হবে তা আর কী করে বুঝব বলুন?” কথাগুলো বললেন ইন্সপেক্টর ঘোষাল।
— “কিন্তু আমি যে চাই হিমু বড়ুয়ার এই ঘটনাটা লোকজন জানুক। সেটা কীভাবে সম্ভব হবে, তাই ভাবছি…” সুরজিৎ বলল।
— সেটা আর যাই হোক। প্রেস কনফারেন্স ডেকে সম্ভব নয়।
— তাহলে?
— মাথায় একটা প্রস্তাব এসেছে, একবার বাজিয়ে দেখতে পারেন।— ইন্সপেক্টর ঘোষাল বললেন।
— কী প্রস্তাব?
— আমার থানায় ফেসিয়াল কম্পোসাইট বানাতে এক ছোকরা মাঝে মাঝে আসে। ভালো নামটা মনে নেই তবে ডাক নাম বাবলু। ছোকরার তুখোড় আঁকার হাত। লেখালেখিরও স্বভাব আছে বলে শুনেছি। দু-একটা গল্প-উপন্যাস এদিক-সেদিক বেরিয়েছে। আপনি চাইলে ওকে একবার কাহিনিটা বলে শোনাতে পারেন। ও যদি ব্যাপারটা গল্পের আকারে প্রকাশ করে, আপনার আপত্তি আছে?
ইন্সপেক্টর ঘোষালের বুদ্ধির তারিফ করে, তার এই প্রস্তাবকে সর্বান্তকরণে সমর্থন করে সুরজিৎ। বলে— “গ্র্যান্ড আইডিয়া ঘোষালবাবু। এর চেয়ে ভালো আর কিছু হতে পারে না। এই কাহিনি বই হয়ে লোকের হাতে হাতে ঘুরলে, হিমু বড়ুয়ার অতৃপ্ত আত্মা নিশ্চয়ই শান্তি পাবে। লোকে জানতে পারবে, সেকালের প্রশাসনিক আর রাজনৈতিক চক্রান্ত ছাড়াও, কীরকম মারাত্মক সব জঘন্য অপরাধ মানুষের রক্তে রক্তে ঢুকে গিয়েছিল। আপনি ওই ছেলেটিকে ডেকে পাঠান ঘোষালবাবু। আমি পুরো কাহিনি আদ্যোপান্ত ওকে শোনাই।”
বন্দনা দেবী এতক্ষণ চুপ করেই বসে ছিলেন। এবার তিনি মুখ খুললেন— “আমার একটা কথা বলার আছে।” সকলেই ঘুরে তাকাল তার দিকে।
— এই শহরে আমাদের বাড়ির একটা সুনাম আছে। আমার শ্বশুর মশাইকেও এখনও সবাই মানে। যতই হোক এই কাহিনিতে আমাদের পরিবার একটা বিশেষ অংশে জড়িয়ে রয়েছে।
বন্দনা দেবী হয়তো আরও কিছু বলত। তার পুরো কথাটা শেষ করতে না দিয়েই ইন্সপেক্টর অভিজিৎ ঘোষাল বলে ওঠেন— “আমি বুঝতে পারছি মিসেস চক্রবর্তী আপনি ঠিক কী বলতে চাইছেন। আপনি চাইছেন এই লেখা গল্পের আকারে বাইরে বেরোলেও আপনাদের পরিবারের সম্মানটুকু যেন অক্ষুণ্ণ থাকে। তাই তো?”
বন্দনা মাথা নেড়ে সায় দেয়।
ইন্সপেক্টর ঘোষাল বলেন— “এর একটা সহজ সমাধান আমার কাছে আছে। সুরজিৎবাবু, আপনি যখন বাবলুকে গল্পটা শোনাবেন, তখন ওকে বলে দেবেন, কাহিনির মূল বিষয়বস্তুকে ঠিক রেখে, ও যেন চরিত্রগুলোর নামধাম সব বদলে ফেলে। জায়গার নাম পালটাতে আপত্তি নেই। ব্যস তাহলেই আর কোনো সমস্যা রইল না। আপনাদের পরিবারের মান সন্মান যেমন ছিল তেমনি রইল। আর এইটুকুতে আমার মনে হয় আপনাদের হিমু বড়ুয়ার আত্মা ক্ষুণ্ণ হবেন না।”
এতে আর আপত্তি করার মতো কিছু নেই। সুরজিৎ মনে মনে অনেক হালকা বোধ করে। অনেক ধন্যবাদ জানায় ইন্সপেক্টর ঘোষালকে। এরকম দুর্দিনে তাদের পরিবারের পাশে থাকার জন্য। সবকিছুর এত সুন্দর সমাধানের রাস্তা খুঁজে দেওয়ার জন্য।
একমনে ঘুরন্ত সিলিং ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে সুরজিৎ ভাবতে থাকে— লোকলজ্জার ভয়ে না হোক নামধাম সব পালটে ফেলা হল, তাই বলে পরিবারের পুরোনো পাপের কলঙ্কের ইতিহাস কি মুছে ফেলা যাবে? পাপের ঋণ কখনও শোধ হয় না। একদিন না একদিন হিসেব চুকাতেই হয়। অনেক বছর আগের, এক উনিশে ডিসেম্বরের শীতের রাতের হিসেব চুকাতে হয়েছে— গত বছর উনিশে ডিসেম্বরে। সেও ছিল মরশুমের শীতলতম দিন।
হিমু বড়ুয়ার মৃত্যুর জন্য দায়ী তার দুই বন্ধু, একজনের নাম হীরক ঘোষ, আর আর-একজনের নাম, হারাধনবাবু বলে না গেলেও সুরজিৎ তা আজ ভালোমতোই বুঝতে পারে। বোঝে বন্দনা, বোঝেন ইন্সপেক্টর ঘোষালও। তবে এই নিয়ে কেউ বিশেষ আলোচনাও করে না। সবার মনের ভাবটা এইরকম— কী লাভ এত বছরের পুরোনো কাসুন্দি ঘেঁটে?
সুকল্প ওরফে বলাই ফিরেছে আঁকার ইস্কুল থেকে। এখন সে আঁকা শিখতে যায়। মাস্টারমশাই বলেছেন সুকল্পের আঁকার হাত খারাপ না, চেষ্টা করলে হবে। বন্দনা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে। তার ছেলের আঁকা পুরোনো সব ছবিগুলো আলমারির ভিতর তুলে রেখেছে সে। কাউকে দেখাবে না। কোনোদিনও না।
ছেলের আচরণও এখন আগের থেকে অনেক স্বাভাবিক। এখন আর নিজের থেকে কল্পনা করে সে ছবি আঁকতে পারে না। আর্ট স্কুলের মাস্টার যা শেখান তাই আঁকে। ছেলের অঙ্কন প্রতিভা নষ্ট হয়ে গেছে, এই নিয়ে আজ আর সুরজিৎ বন্দনার মনে কোনো আক্ষেপ নেই। বরং যা হয়েছে ভালোই হয়েছে।
*******
অতিথিরা সবাই চলে গেছে। মুক্তারামবাবু স্ট্রিটের চক্রবর্তী বাড়ির বৈঠকখানা আবার ফাঁকা। ইন্সপেক্টর ঘোষাল বেরোবেন বলে দরজার পথে পা বাড়িয়েছেন।
সুরজিৎ এসেছে তাকে দরজা দিয়ে এগিয়ে দেওয়ার জন্য। গায়ের চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে সুরজিৎ বলল— “বাবলুকে আপনি তাড়াতাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করুন ইনস্পেক্টর ঘোষাল। আমি ওকে গল্পটা শোনাই। সবাই জানুক হিমু বড়ুয়ার মতো একজন মানুষের জীবনের নিদারুণ পরিণতির কথা, যা এতগুলো বছর চাপা পড়েছিল পরিত্যক্ত রায়-বর্মণ বাড়ির গর্ভে।”
সুরজিৎ আরও বলে— গল্পের নাম যদিও আমি ঠিক করে ফেলেছি।
ইন্সপেক্টর ঘোষাল যেতে যেতে থমকে দাঁড়ান। পিছনে তাকিয়ে জিজ্ঞাসু স্বরে বলেন— কী নাম?
— নামের আইডিয়া সেই রাতে আমাকে হিমু বড়ুয়ার কঙ্কালই বলে গেছিল।
ইন্সপেক্টর অভিজিৎ ঘোষালের কপালে ভ্রূকুটি। সুরজিৎ হেসে বলল— এখন বরং সারপ্রাইজ থাক।