উনিশে ডিসেম্বর মরশুমের শীতলতম রাত – ৪
৪
সুবলবাবুর মৃত্যুর পর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। বাড়ির পরিস্থিতি এখন আবার স্বাভাবিক। সময় বড় আশ্চর্য এক জিনিস। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব ঠিক হয়ে যায়। দাপুটে সুবলবাবুর অকস্মাৎ মৃত্যুর বিভীষিকা সময়ের সঙ্গে অনেকটা ফিকে হয়ে আসে। গোটা বাড়িতে এমনকি পরিবার পরিজন আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবার কাছেই সুবল চক্রবর্তী মানুষটার এমন জোরালো অস্তিত্ব ছিল, প্রথম প্রথম তাঁকে ছাড়া মনে হয়েছিল সব থমকে দাঁড়িয়ে যাবে। পরিবারের বাকিদের জীবনের চাকা অচল হয়ে পড়বে। কিন্তু আস্তে আস্তে সবকিছুই স্বাভাবিক হতে লাগল। শুধু স্বাভাবিক হল না বলাই। সে আর আগের মতো আঁকতে পারে না। বাপ-মা, ক্লাসটিচার সবাই তাকে আঁকার কথা বলে, সাদা কাগজ সামনে নিয়ে বসে থাকে কিন্তু আঁকতে আর পারে না। যে ছেলে জন্মাবধি এমন সব দুর্ধর্ষ দুর্ধর্ষ ছবি এঁকে গেছে, তার এই অবস্থা দেখে সুরজিৎ হতাশ হয়ে পড়ে। তার অনেক আশা ছিল ছেলে বড় হয়ে অনেক বড় শিল্পী হবে, বংশের মুখ উজ্জ্বল করবে। কিন্তু ছেলেবেলার সেই আঁকাগুলোও তার পক্ষে যেমন অস্বাভাবিক ছিল, এখন একদমই না আঁকতে পারাটাও যেন তেমনই এক অস্বাভাবিক অলৌকিক ব্যাপার। বন্দনার অবশ্য এ নিয়ে বিশেষ আক্ষেপ নেই। তার ছেলে ছবি আঁকতে পারল, কী পারল না, তা নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। ছেলের মধ্যে অলৌকিক প্রতিভা তার চাই না। তার ইচ্ছা তার ছেলে আর পাঁচটা স্বাভাবিক মানুষের মতোই বেড়ে উঠুক। সবাই যেমন ধারা সব কিছু শেখে, জানে, তেমনই জানুক, শিখুক। অতিরিক্ত কিছুর প্রয়োজন নেই।
সুবলবাবুর ঘরটা অর্ধেক দিন বন্ধ হয়েই পড়ে থাকে। সুরজিৎই একদিন বলেছিল— বাবার ঘরটা সবসময় তালা দিয়ে রেখো বন্দি। অত দামি দামি বই, পুরোনো সব কাগজপত্র ওসব জিনিস যেন এলোমেলো না হয়। নিজের প্রাণের থেকেও ওগুলোকে বেশি ভালোবাসতেন উনি।
বন্দনা জানে তার শ্বশুর খুব সহজ সাধাসিধে মানুষ মোটেই ছিলেন না। যদিও বাইরে থেকে কিছুই বুঝতে দিতেন না। কিন্তু মনে মনে তিনি ছিলেন ইস্পাতের মতো কঠিন আর চিন্তাধারা ছিল কাচের থেকেও স্বচ্ছ।
এখনও ও-ঘরের সব তাকগুলো বইপত্তর, পুরোনো চিঠি, ফাইল প্রবন্ধ সব কিছুতে ঠাসা।
সুরজিৎ অন্য ধাচের মানুষ। অত শত বইপত্তর নিয়ে বসে থাকা তার কম্ম নয়। বন্দনা মাঝে মাঝে ঘর ঝাড় পোচ করায়, আর পুরোনো বইপত্তর সব উলটে পালটে দেখে। বোঝে না কিছুই, তাও দেখে। দেখতে ভালো লাগে।
সেদিনটা ছিল বর্ষণ মুখর। সারা দিন টিপিটপ করে বৃষ্টির পর সন্ধ্যে থেকে ঝোড়ো হাওয়া, আর তার সঙ্গে মুষল ধারে বৃষ্টি শুরু হল। গোটা শহর অক্লান্ত বর্ষণে ভিজে চলেছে। একটানা ধারাপাতের শব্দ কানে সয়ে এসেছে অনেকটা। রাস্তায় লোকজন বিশেষ কেউ নেই। এখনও রাত দশটা বাজেনি, এখনই রাস্তা ঘাট দেখে মনে হচ্ছে মধ্যেরতের নির্জনতা।
রাতের খাওয়া হয়ে গেছে তাড়াতাড়ি। বন্দনা আয়নার সামনের টুলটাতে বসে চুল আচড়াচ্ছে, সুরজিৎ খাটের উপর আধ শোয়া অবস্থায় সিগারেট টানছে আর শেয়ার বাজারের খবর সংক্রান্ত একটা ম্যাগাজিন পড়ছে মন দিয়ে। পাশের ঘর থেকে গুম গুম শব্দটা জানান দিচ্ছে বলাই এখনও জেগে আছে, কম্পিউটারে গেম খেলছে। ঝোড়ো হাওয়া জানলার খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে ঢুকছে, সেই শব্দ আচমকা শুনলে মনে হচ্ছে চার দেওয়ালের মাঝে কারা যেন হঠাৎ ফিশফিশ করে কথা বলে উঠছে। আবার পরক্ষণেই সব চুপচাপ।
আচমকা সুরজিতের মোবাইল ফোনটা কর্কশ স্বরে বেজে উঠল। বিরক্ত চোখে ফোনের স্ক্রিনটার দিকে তাকিয়ে সুরজিৎ বলল— হতভাগা ফোন করার আর টাইম পায় না। দুদিনের জন্য বাড়িতে এসেও রাত বিরেতে শান্তি নেই। আর এই যন্ত্রটাও হয়েছে সেরকম— দুদণ্ড শান্তি দেবে না।
বন্দনা পিছনে ঘুরে আড়চোখে বরকে দেখে নিয়ে আবার চুল বাধঁতে লাগল। তার ঠোঁটের কোণায় লজ্জা মাখা হাসি।
ফোনটা কেটে দিয়েও শান্তি নেই। কিছুক্ষণ দম নিয়ে ওটা আবার বাজতে শুরু করল।
— ফোনটা ধরেই নাও না বাপু, নিশ্চয় কিছু জরুরি দরকার। নয়তো এত রাতে বার বার কেন করছে। বলল বন্দনা।
সিগারেটের শেষাংশটুকু অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিয়ে সুরজিৎ উঠে এসে, তার বউ এর পিছনে এসে দাঁড়াল। আলতোভাবে পিছন থেকে জড়িয়ে বন্দনার ঘাড়ের কাছে নাক নিয়ে, বার কয়েক নিশ্বাস নিয়ে বলল— এই ওয়েদারে, আজকের এই সময়ে তোমার থেকে জরুরি আর কী হতে পারে বন্দী?
বন্দনা, সুরজিতের বাহুবন্ধন থেকে পাশ কাটানোর ছদ্ম চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না।
এমন সময় আবার ফোনটা বেজে উঠল। একরাশ বিরক্তি নিয়ে সুরজিৎ বাধ্য হল ফোনটা ধরতে। ফোনটা করেছে বিক্রমজিৎ, ওর সিনিয়র কলিগ।
— বলো বিক্রম দা! কী ব্যাপার? এত রাতে?
— জানি ভাই, বিরক্ত করলাম, ছুটির রাতে এভাবে ফোন করে…
বিক্রমজিৎ একটু বেয়াড়া গোছের অসভ্য। সময় সুযোগ পেলেই ভুলভাল বকা শুরু করবে। আর পেটে মদ পড়লে তো আর কথাই নেই। তাই তার মুখ থেকে আরও কয়েকটা ভুলভাল কথা শোনার আগেই সুরজিৎ বলে উঠল— বাজে কথা রাখো। কী ব্যাপার তাই বলো?
— ব্যাপার গুরুতর। মেইল চেক করছিস?
— না তো? কেন?
— খুলে দেখ। তোর, আমার, বাবলু, ইন্দ্র আরও প্রায় দশ জনের নতুন প্রজেক্টে ট্রান্সফার হয়েছে।
খাটের একপাশে ল্যাপটপটা পড়ে ছিল, কাঁধ আর মাথার চাপে মোবাইল ফোনটা ধরে, ল্যাপটপটা তড়িঘড়ি অন করতে থাকে সুরজিৎ।
— আমার কোথায় পড়েছে বিক্রমদা?
গলায় বাঁকা হাসির ছোঁয়া এনে বিক্রমজিৎ বলে— ধ্যাদ্দেরে গোবিন্দপুর। অবিশ্যি সবারই তাই। তবে তোর জায়গাটার নাম কেউ শুনিনি।
কথা বলতে বলতে মেইল খুলে ফেলেছে সুরজিৎ। লিস্টে বারো নাম্বারে তার নাম সুরজিৎ চক্রবর্তী, পাশে লেখা— পলাশপুর (ঝাড়খণ্ড)।
ফোনটা রেখে কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইল সে। অনেকদিন থেকেই একটা বদলির কথা উঠছে। অনেক দায়িত্ববান অফিসারকে এক্সটেনশন প্রজেক্টের দায়িত্ব নিয়ে যেতে হবে দেশের নানা জায়গায়। সিনিয়র দায়িত্ববান অফিসারদেরকেই এই দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। প্রায় দেড় বছর ধরে ব্যাপারটা কোনো রকমে ঠেকিয়ে রেখেছিল সুরজিৎ। শেষ কদিনে বুঝতেই পেরেছিল আর নিস্তার নেই। এবার যেতেই হবে । শুরু করতেই হবে নতুন করে।
কিন্তু তাই বলে পলাশপুর না কী যেন জায়গায় যেতে হবে? যার নামও কেউ কোনোকালে শোনেনি। কেমন জায়গা কে জানে? লোকজন কেমন? শহর নাকি গ্রাম তাও বোঝা যাচ্ছে না। মাথাটা হুট করে গরম হয়ে গেল সুরজিতের। কিছুতেই ওখানে যাবে না সে। কালই হেড কোয়ার্টারে মেইল করবে। চাই না বেশি মাইনে, চাই না প্রমোশন। এত দিন এদিক সেদিক ঘুরে কাজের ফাঁকে তাও টুকটাক বাড়ি ফেরা যেত, এবার তো তাও বন্ধ হয়ে যাবে।
বন্দনা তার বরের হাবভাব দেখেই আন্দাজ করে ফেলে কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। উঠে এসে তার পাশটাতে দাঁড়ায়।
— কী হয়েছে?
সুরজিৎ একবার মাথা তুলে ঘাড় গুঁজে বসে পড়ে আবার।
বন্দনা অধৈর্য হয়ে আবার জানতে চায়— আরে হয়েছেটা কী, আমায় বলবে তো নাকি?
— পলাশপুর। অস্পষ্ট স্বরে শব্দটা উচ্চারণ করল সুরজিৎ।
— কী?
— পলাশপুর। পলাশপুরে ট্রান্সফার হয়েছে আমার। সেই কোন যমের দক্ষিণ দুয়ারে। আসা যাওয়ার উপায় আছে নাকি জানি না। কোথায় থাকতে হবে জানি না, কবে আবার ফিরতে পারব তাও জানি না।
বন্দনা কথাগুলো শুনে খাটের একপাশে বসে পড়ল। কিছুই বলল না।
সুরজিৎ একা একা গজরে গেল কিছুক্ষণ। সরকারের নির্দেশের উপর কোনো কথা চলে না। তাই রাগ, দুঃখ যাই হোক না কেন, গজরাতে হবে ঘরে বসে বসেই।
বাইরে বৃষ্টির দাপট এখন একটু কমেছে। কিন্তু ঝোড়ো হাওয়াটা বন্ধ হয়নি। জানলার সেকেলে খড়খড়িগুলো দিয়ে ফিশফিশানির শব্দ হয়ে চলেছে অহরহ।
বন্দনাও যেন নিজের মনে কী একটা বিড়বিড় করে চলেছে।
সুরজিৎ জিজ্ঞাসা করে— কী ব্যাপার?
বন্দনা আরও কিছুক্ষণ একমনে বিড়বিড় করে বলে, পলাশপুর নামটা যেন কোথায় শুনেছি… না না শুনিনি, কোথাও একটা পড়েছি।
— পড়েছ? কোথায়? অবাক হয়ে জানতে চায় সুরজিৎ।
— জানি না। মনে করতে পারছি না, খুব বেশিদিন আগে পড়েছি এমনটাও নয়। কিন্তু তাও মনে করতে পারছি না।
সুরজিতের কপালে ভীষণরকমভাবে ভাঁজ পড়ে। — তোমার তো পড়ার বাতিক নেই বন্দী, তুমি আবার কোথায় পড়বে? আর ওই অজ পাড়াগেয়ে জায়গাটার নাম আমিই কোনোকালে শুনিনি তুমি আর কোথায় শুনবে? ও তোমার মনের ভুল।
— জায়গাটা কোথায়? এখান থেকে কত দূর?
— কিছুই জানি না এখনও। দুদিকে মাথা নাড়তে থাকে সুরজিৎ। কাল অফিসে যাই তারপর দেখছি।
বন্দনা তার স্বামীকে চেনে। লোকটা আদ্যপান্ত শহুরে। সারাক্ষণ কর্মহীনভাবে বিলাস ব্যসনে ডুবে থাকে, ব্যাপারটা এরকমও নয় যদিও, কিন্তু তবুও গ্রামে গঞ্জে থাকা তার পোষাবে না। দুদিনেই হাঁফিয়ে উঠবে। এতদিন সে, যে-যে জায়গায় ঘুরে-ঘুরে কাজ করেছে, সবগুলোই ছিল ছোট-বড় কোনো না কোনো শহুরে অঞ্চল। তাই সামলে নিয়েছে কোনোরকমে। কিন্তু এবার সামলানো মুশকিল। তাই মনে মনে এখনই অস্থির হয়ে পড়েছে।
বন্দনা সরে এসে সুরজিতের পাশে এসে বসে। — তোমার কোনো চিন্তা নেই। এত ভেবো না তো! সব ঠিক হয়ে যাবে।
— ভাবনা তো আমার তোমাকে নিয়ে।
— আমাকে নিয়ে? তাই বুঝি?
বন্দনার চোখে চপল হাসির ঝিলিক।
সুরজিৎ বলে— হ্যাঁ তোমাকে নিয়ে, বলাইকে নিয়ে। আমি থাকব না এত বড় বাড়িতে তোমরা একা থাকবে সারাটা ক্ষণ। আগে তাও বাবা ছিলেন। বাবার প্রেজেন্সটাই ছিল অনেক বড় ব্যাপার। আর এখন তো… সুরজিৎ হয়তো আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই বন্দনা তার মুখে হাত চাপা দিয়ে কথা বলা বন্ধ করিয়ে দেয়।
— আমার জন্য তোমায় ভাবতে হবে না। আমি আর এখন ছোটটি নেই। আর তাছাড়া একা কোথায়, বলাই বড় হয়েছে, রামুদা আছে, বাকি ঠাকুর চাকরেরা আছে, ও আমি ঠিক সামলে নেব, তুমি খালি খালি এসব নিয়ে চিন্তা করে মাথা গরম কোরো না তো, ভালো করে নিজের কাজ কোরো।
এরপর আর সুরজিতের কিছুই বলার থাকে না। বউকে জড়িয়ে বুকে টেনে নেয়। অনেক বছর আগের মতো শিরশিরানি নেমে আসে বন্দনার শিরদাঁড়া দিয়ে। সেই আগের মতো নিজেকে সমর্পণ করে দেয় সুরজিতের বাহু বন্ধনীর মাঝে।
চরম সুখকর মুহূর্তের মাঝেও গলার কাটার মতো খোঁচা দিতে থাকে ‘পলাশপুর’ নামটা। কোথায় যেন নামটা দেখেছে সে। কিছুতেই মনে করতে পারছে না।